ইসলাম ও জাহেলিয়াত

ইসলাম ও জাহেলিয়াত

 

[১৯৪১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পেশোয়ার ইসলামিয়া কলেজের মজলিশে ইসলামিয়াতের সভায় ভাষণ দেয়ার জন্যে মাওলানাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এটি সে সভায় প্রদত্ত ভাষণ, যা পরবর্তীকালে ‘ইসলাম ও জাহেলিয়াত’ শিরোনামে পুস্তিকারে প্রকাশিত হয়।]

 

জীবনের কর্মক্ষেত্রে মানুষকে যতো বস্তুরই সংস্পর্শে আসতে হয় তার প্রত্যেকটির প্রকৃতির গুণাগুণ ও অবস্থা এবং এর সাথে তার সম্পর্ক সম্বন্ধে সর্বপ্রথমেই একটি সুস্পষ্ট মত নির্দিষ্ট করে নেয়া একান্তই আবশ্যক। পূর্বেই এমত নির্দিষ্ট না করে কোনো একটি জিনিসকেও কোনো কাজে প্রয়োগ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। সে মত মূলত ভুল কি নির্ভুল সে প্রশ্ন গৌণ, কিন্তু মত যে একটি নির্দিষ্ট করে নিতে হয়, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর এ নির্ধারণের পূর্বে কোন্‌ বস্তুর সাথে কিরূপ ব্যবহার ও আচরণ করতে হবে, কার সাথে কিরূপ কর্মনীতি গ্রহণ করতে হবে চূড়ান্তভাবে তার ফায়সালা করাও কিছুতেই সম্ভব নয়। একথা বুঝাবার জন্য বিশেষ কোনো যুক্তির অবতারণা করার কোনই আবশ্যকতা নেই। কারণ ইহা প্রত্যেকেই রাত-দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা হতেই বুঝে নিতে পারে। কারো সাথে প্রথম সাক্ষাত হলে তার সম্পর্কে জেনে নিতে হয় যে, কে এই ব্যক্তি, কি এর সম্মানও মর্যাদা? কোন্‌ ধরনের গুণ ও যোগ্যতা এর মধ্যে রয়েছে এবং আমার সাথে তার কোন্‌ ধরনের সম্পর্ক বিদ্যমান? এ প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর না জেনে তার সাথে কোন্‌ ধরনের ব্যবহার বা আচরণ অবলম্বন করতে হবে, তা নির্ধারণ করা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্ভুল জ্ঞান লাভ করা যদি একান্ত অসম্ভবই হয়ে পড়ে, তবুও বাহ্যিক নিদর্শনসমূহ হতে যথাসম্ভব এসব প্রশ্নের অন্তত একটি আনুমানিক উত্তর অবশ্যই ঠিক করে নিতে হয়। অতপর তার সাথে যে ধরনেরই আচরণ করা হোকনা কেন, তা পূর্ব নির্ধারিত এই মতের ভিত্তিতেই করতে হয়। মানুষ খাদ্য হিসেবে যেসব দ্রব্য গ্রহণ করে, তা মানুষের খাদ্য প্রয়োজন পূরণ করে- এই জ্ঞান বা ধারণার ফলেই তা সম্ভব হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে মানুষ যা পরিত্যাগ করে বা দূরে নিক্ষেপ করে, যা মানুষ নিজের কোনো না কোনো কাজে ব্যবহার করে, যার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মানুষ যত্ন নেয়, যেসব জিনিসের প্রতি সম্মান বা উপেক্ষা প্রদর্শন করে, যাকে মানুষ ভয় করে বা ভালবাসে, সেসব সম্পর্কেই তাদের সত্তা ও গুণাগুণ এবং তাদের সাথে মানুষের সম্পর্ক সম্বন্ধে পূর্ব নির্ধারিত ধারণার ভিত্তিতেই উক্তরূপ আচরণ ও ব্যবহার হয়ে থাকে।

 

পরন্তু বিভিন্ন বস্তু সম্পর্কে স্থিরিকৃত এ ধারণা নির্ভুল হলে এর সাথে অবলম্বিত আচরণও নির্ভুল হবে এবং এ ধারণা ভ্রান্ত, ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ হলে এর প্রতি মানুষের ব্যবহার তদনুরূপ হবে। এই ব্যবহারে তারা পরস্পরের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু স্বয়ং সেই ধারণাটির শুদ্ধাশুদ্ধি কিসের উপর নির্ভর করে? তা নির্ভর করে বস্তুটি সম্পর্কে মত নির্ধারণের পন্থার উপর। সেমত হয় নির্ভুল বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে গ্রহণ করা হয়, নতুবা শুধু আন্দায-অনুমান, অমূলক ধারণা কিংবা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পর্যবেক্ষণ উপায়ের উপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একটি শিশু আগুন দেখতে পায় এবং নিছক বাহ্যলব্ধ জ্ঞানের উপর নির্ভর করে তাকে ‘চমৎকার খেলনা’ বলে মনে করে। আগুন সম্পর্কে এমত ঠিক করার ফলেই শিশু উহা ধরবার ও উঠিয়ে নেয়ার জন্য হস্ত প্রসারিত করে দেয়। অন্য এক ব্যক্তি সেই আগুন দেখে নিছক ধারণা-অনুমানের উপর নির্ভর করে সে সম্পর্কে এমত পোষণ করতে শুরু করে যে, এর মধ্যে ঐশ্বরিক সত্তা রয়েছে অথবা এটা ঐশ্বরিক বাহ্যরূপ। এ মতের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত করে যে, তার সাথে তার প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া এবং তার সম্মুখে মাথা নত করাই কর্তব্য। তৃতীয় এক ব্যক্তি আগুন দেখে তার প্রকৃত রূপ, তার অন্তর্নিহিত গুণাগুণ, শক্তি ও ক্ষমতার অনুসন্ধান করতে শুরু করে এবং চিন্তা ও গবেষণার পর এমত নির্ধারণ করে যে, এটা উত্তাপ দানকারী পদার্থ, অতএব এটাকে একান্ত চাকরের ন্যায় ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। এ মতের উপর ভিত্তি করে আগুনকে সে খেলনা মনে করে না। উপাস্য দেবতা হিসেবেও একে গ্রহণ করে না বরং প্রয়োজন মতো একে কখনো খাদ্য প্রস্তুত কার্যে, কখনো কিছু ভস্ম করার কাজে ব্যবহার করে। একই আগুনের সাথে এরূপ বিভিন্ন প্রকার আচরণের মধ্যে শিশু ও অগ্নিপূজকের আচরণ নিতান্ত অজ্ঞতা ও অন্ধতামূলক, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ আগুনকে খেলনা মনে করা সম্পর্কে শিশুর ধারণা বাস্তব অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়। অগ্নি উপাসকের মতো আগুনের খোদা হওয়া বা তাতে খোদার আত্মপ্রকাশ করার বিশ্বাসও কোনো বৈজ্ঞানিক অকাট্য প্রমাণ ভিত্তিক নয়। বরং এরূপ ধারণা নিছক খোশখেয়াল, কল্পনা ও অমূলক আন্দায-অনুমানের উপর নির্ভর করে গ্রহণ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে আগুনকে সেবা পরিচর্যার কাজে নিযুক্ত করা, এর সাহায্যে মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর কাজ সম্পন্ন করা নির্ভুল বৈজ্ঞানিক কর্মপন্থা সন্দেহ নেই। কারণ আগুন সম্পর্কে এই যে মত নির্ধারণ করা হয়েছে, ইহা জ্ঞান ও নির্ভুল বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে।

 

ইসলাম ও জাহেলিয়াত

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড