আমাদের জাতি সত্ত্বার বিকাশ ধারা

মুখবন্ধ

বাংলাদেশের ইতিহাসকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় অষ্টম শতক থেকে। এর পূর্বের ইতিহাস আছে, কিন্তু তা সুস্পষ্ট নয়। তখন সুস্পষ্টভাবে এবং বিশেষ ধারাক্রম অনুসারে এ অঞ্চলের কর্মকাণ্ড প্রবাহিত হয়নি। সুতরাং সে সময়কার কথা আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করার কোন প্রয়োজন হয় না। অষ্টম শতক থেকে পাল রাজত্বের আরম্ভ। তারা এ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজ্য শাসন করতেন। তাদের আমলে সুস্পষ্ট এবং শৃঙ্খলিত কোন নগর-জীবন গড়ে ওঠেনি। এর ফলে সে সময়কার সংস্কৃতি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। নৃত্য, গীত এবং লোকরঞ্জনের বহুবিধ উপকরণ সকল মানুষের আচরণবিধি এবং জীবন যাপনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। পালরা যেহেতু বৌদ্ধ ছিল, সুতরাং তারা মানুষে মানুষে বিভাজন মানত না। তখন এমন অবস্থা ছিল যে, কর্মের দায়ভাগে এবং অধিকারে একজন শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারত, আবার ব্রাহ্মণও ইচ্ছা করলে শূদ্র হতে পারত। শূদ্র হওয়াটা তখন ঘৃণার বা অপরাধের ছিল না। বাংলা ভাষার প্রথম কবি সরহপা ব্রাহ্মণের পুত্র ছিলেন, বড় হতে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হন এবং নালন্দা বিদ্যাপীঠের একজন আচার্যের সম্মান লাভ করেন। তিনি তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে একজন অন্ত্যজ শ্রেণরি রমণীকে গ্রহণ করে নিম্ন পর্যায়ের মানুষের মধ্যে বসবাস করতে থাকেন। এভাবে তিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, মানুসের পরিচয় হচ্ছে তার বুদ্ধিতে, বিবেকে, অনুভূতিতে এবং মননে, তার পরিচয় জাতিগত বিচারে নয়।

দ্বাদশ শতকে কর্ণাটক থেকে বহিরাগত সেনরা এসে যখন এদেশকে অধিকার করল, তখন তারা একটি নিষ্ঠুর শোষন-কার্যের মধ্য দিয়ে এদেশবাসীকে নির্যাতন করতে লাগল। তারা সংস্কৃতিকে নিয়ে এল রাজসভার মধ্যে এবং মন্দিরের অভ্যন্তরে। পাল আমলে বাংলা ভাষা ক্রমশ রূপলাভ করছিল। সরহপা পুরবী অপভ্রংশে তাঁর দোঁহাকোষ রচনা করেছিলেন। সেনরা এসে সংস্কৃতিকে প্রশাসনিক ভাষা হিসাবে গ্রহন করেন এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতর ভাষা হিসেও সংস্কৃতকে গ্রহণ করেন। তার ফলে এদেশের মানুষের নিজস্ব উচ্চারণের ভাসা সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। আমরা লক্ষ্য করি যে, সেনদের আমলে দেশীয় ভাষায় চর্চা সম্পূণরূপে বন্ধ ছিল। সেনরা যে সংস্কৃতি নিয়ে এল, স সংস্কৃতি ছিল হিন্দুদের এবং তাও সকল শ্রেণীর হিন্দুদের নয়, তা ছিল কৌলিন্যবাদী ব্রাহ্মণদের এবং অংশত ক্ষত্রিয়দের। সর্বশেষ সেন রাজা লক্ষণ সেনের রাজদরবারে যে সমস্তু কবি-সাহিত্যিক ছিলেন, তাঁরা সংস্কৃত ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে জয়দেব রাধা-কৃষ্ণ উপাখ্যানকে কাব্যে রূপান্তরিত করে একটি বিশেষ কাব্যধারার জন্ম দিলেন। এর ফলে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি পরিপূর্ণভাবে বর্ণহিন্দুদের অধিকারে চলে গেল।

১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজীর আগমনে এদেশের সাধারণ মানুষ নতুন করে চেতনা পেল। সুকুমার সেন তাঁর একটি রচনায় স্বীকার করেছেন যে, অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা বখতিয়ারের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিল, এমনকি কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণও বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেনকে বিভ্রান্ত করে দেশত্যাগ করতে সহায়তা করেছিল। মানুষে মানুষে বিভাজন মুসলমান আমলে আর রইল না, পাল আমলেও এটা ছিল না। মুসলমানরা একটি নতুন বিশ্বাসকে আনলেন, এদেশের সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করলেন এবং একটি বিস্ময়কর মানবিক চৈতন্যের উদ্বোধন ঘটালেন।

আমাদের জাতিসত্তার উন্মেষ এবং বিকাশকে আলোচনা করতে গেলে পাল আমলের বিস্তৃত পরীক্সা করা প্রয়োজন এং সেনরা যে অসৌজন্যের জন্ম দিয়েছিল, তারও সুস্পষ্ট পরিচিতি উপস্থিত করা প্রয়োজন। অবশেষে মুসলমান আমলে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি যে নতুন মানবিক রূপ পরিগ্রহ করল তারও বিস্তৃত সমীক্ষার প্রয়োজন। এ নিয়ে অল্পস্বল্প লিখিত হলেও বিস্তৃতভাবে এ নিয়ে কেউ গবেষণা করেননি। সম্প্রতি মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এ নিয়ে গবেষণা করছেন এবং তাঁহার ‘মুক্তি সংগ্রামের মূলধারা’ গ্রন্হটি এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। তাঁর বর্তমান গ্রন্হটি যার নাম ‘আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা’ আমাদের সংস্কৃতির পরিচয়কে নতুন করে উদঘাটন করেছে। আমরা বিশেষ একটি ভূখণ্ডের অধিবাসী এবং সেই ভূখণ্ডের অতীত এবং বিশ্বাস আমাদের সংস্কৃতি নির্মাণে যে বিপুলভাবে সহায়ক, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান তা তাঁর গ্রন্হের মধ্যে সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন। এ অঞ্চলের মানুষের যে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা আছে এবং তা পাল আমল থেকে ক্রমশ গড়ে উঠেছে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এবং সতর্ক বিবেচনা মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের গ্রন্হে পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে অধিকাংশ সাম্প্রদায়িক হিন্দু ঐতিহাসিকের কারণে বহিরাগত সেনদের সং স্কৃতিকে বিরাট এবং মহার্ঘ করে দেখানো হয়েছে এবং আমাদের দেশের আত্মবোধবিমুখ কিছু সংখ্যক লোক হিন্দুদের বিবেচনাটি মেনে নিয়েছে। এহেন অবস্থা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। মোহাম্মদ আবদুল মান্নান যে এ পথে এগিয়ে এসেছেন সেজন্য তাঁকে আমি সাধূবাদ দেই।

তার এই গ্রন্হটি সর্বজনগ্রাহ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস। আম গ্রন্হটির বহুল প্রচার কামনা করি।

আমাদের জাতি সত্ত্বার বিকাশ ধারা

মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড