আমার বাংলাদেশ

ভূমিকা

 

বাংলাদেশ কোটি কোটি লোকের। তবু আমি বলছি ‘আমার বাংলাদেশ’। ছোট আধো আধো উচ্চারণে বলে, ‘আমাল আব্বু’ ‘আমাল আম্মু’। তাঁর বড় ভাই বোনেরা ওকে এ বলে ক্ষেপায় ‘না আমার আব্বু’। সে রাগ করে কেঁদে আরো জোরে বলে ‘আমা-ল আব্বু’। কে এই শিশুকে শেখালো ‘আমাল আব্বু’ বলতে ? ভালোবাসা এক আজব অনুভূতি যা মানুষের মুখের ভাষায় ফুটে ওঠে।

 

নামাযের রুকু ও সিজদায় সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম ও সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা বলা স্বয়ং আল্লাহর রাসুল ( সাঃ ) শিক্ষা দিয়েছেন। রাব্বীয়া মানে আমার রব। আল্লাহ কি শুধু কি আমার একার রব ? তবু কেন বলি আমার রব ? এটাও ঐ ভালোবাসারই কারবার।

 

তাই কোটি কোটি মানুষের বাংলাদেশকে আমি বলি ‘আমার বাংলাদেশ’ বলতে বাধ্য হলাম। এ আমার জন্মভূমি। এর আলো বাতাস ও রোদ- বৃষ্টি, চন্দ্র-সূর্য ও তাঁরার মেলা, নীল আসমান ও সবুজ জমিন, গাছ-পালা ও নদী- নালা, ফল- মূল ও শস্যফসল, মাঠ- ঘাট ও বাজার-হাট, ধুলা- বালি ও ঘাস-বিচালী, পশু- পাখি ও কীট- পতঙ্গ, গ্রীষ্ম-বর্ষা ও শীত- বসন্ত, ইত্যাদির সাথে আমার আজন্ম ঘনিস্ট পরিচয়। ৭ বছর একটানা বাধ্যতামূলক প্রবাস জীবনে ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার মতো দেশে গেলাম কোথাও প্রকৃতিকে এমন আপন মনে হয়নি। সব দেশেই ঘনিষ্ঠ মানুষ পেয়েছি। কিন্তু পরিচিত আবহাওয়া পেলাম না। পানির মাছ শুকনায় যেমন অবস্থায় পরে আমার দশাও তেমনি মনে হতো।

 

আমার মতো আরো যাদের নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছিলো তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন। বন্ধু বান্ধবদের পরামর্শ সত্ত্বেও আমি তা করতে মনকে রাযী করাতে পারলাম না। আমার জন্মভূমিতে আর ফিরে যেতে পারবোনা এমন নৈরাশ্য সৃষ্টি হলে হয়তো তাই করতাম। আমার লন্ডন থাকাকালে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ভুট্টো আমার পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে অশালীন আচরন করার কথা জানতে পেরে সৌদি আরবের সব চাইতে প্রভাবশালী আলেম শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল আযীয বিন বায অত্যন্ত স্নেহের সাথে প্রস্তাব দিলেন, ‘তোমাকে সৌদি নাগরিক বানিয়ে দেই’। বাংলাদেশের মায়া ত্যাগ করতে পারলাম না বলে এ প্রস্তাবও কবুল করা গেলো না।

 

আমার ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে বিদেশে থাকা কালে শুধু আমার দেশ সম্পর্কেই চিন্তা-ভাবনা করেছি। ৭১ সালের ২২শে নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠকে যোগদান করার জন্য লাহোর গেলাম। ৩রা ডিসেম্বর করাচী থেকে বিমানে ঢাকা রওয়ানা দিলাম। সেদিনই ভারতের সাথে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় আমার বিমান বাংলাদেশের কাছে এসেও ফিরে যেতে বাধ্য হলো। এভাবে আমি বিদেশে রয়ে গেলাম। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে আটকা পরে রইলাম। ১৬ই ডিসেম্বরের পর দেশের সাথে যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। লন্ডন হয়ে চিঠি পত্র আদান প্রদান হওয়া ছাড়া যোগাযোগের আর কোন পথই পেলাম না। লন্ডন যেতে চাইছিলাম। মিঃ ভুট্টো যেতে দিলেন না। ৭২ এর নভেম্বরে হজ্জ উপলক্ষে কোনরকমে বের হলাম এবং হজ্জের পর ৭৩ সালের এপ্রিলে লন্ডন পৌঁছলাম।

 

হজ্জের সময় বাংলাদেশ থেকে আগত হাজীদের কাছে দেশের হাল অবস্থা জেনে খুবই পেরেশানী বোধ করলাম। তাঁদের মধ্যে যারা পরিচিত তাঁদের সাথে কিছু মত বিনিময়ও হল। আমি না চিনলেও আমাকে সবাই নামে চেনার কারনে অনেকেই অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করলেন, “হুযুর দেশের উপায় কি হবে ? আর মুসলমানদের ঈমান-আকীদাহ কিভাবে রক্ষা করা যাবে ? ভারতের খপ্পর থেকে কেমন করে বাঁচা যাবে ? ”

 

বাঙ্গালী মুসলমানদের এই সময়ে কি পরামর্শ দেয়া যায় সে বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা- ভাবনা করতে বাধ্য হলাম। দোয়া কবুল হওয়ার খাস জায়গাগুলোতে মহান মনীবের দুয়ারে ধরনা দিতে থাকলাম। মদীনা শরীফের মসজিদে নববীতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাযার শরীফ ও মসজিদের মিম্বরের মাঝখানের জায়গাটি দোয়া কবুলের বিশেষ স্থান, যার নাম রাওয়াতুল জান্নাহ। এ জায়গাটিকে রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) বেহেস্তের বাগানগুলোর একটি বাগান বলে ঘোষণা করেছেন। সেখানে তিনদিন একটানা ৫ ওয়াক্ত নামায আদায় করে দোয়া করতে থাকলাম যেন আল্লাহ পাক বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য সময়োপযোগী বক্তব্য পেশ করার তৌফিক দান করেন।

 

হজ্জের পরে লন্ডন ফেরত গিয়ে “বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে ?” শিরোনামে একটি পুস্তিকা রচনা করলাম। সেখানে বাংলা ছাপাখানা না থাকায় বাংলা টাইপ করে এর ফটোকপি দ্বারা পুস্তিকাটি প্রকাশ করা হলো। ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে পুস্তিকাটি ছাপা হওয়ার পর লন্ডনে প্রবাসী বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে বিতরন করা হল। পরবর্তী হজ্জের সময় সৌদি আরবে আগত বাঙ্গালী হাজীদের মধ্যে বইটি বিলি করা হয় এবং তাঁদের মাধ্যমে বাংলাদেশে তা পৌঁছে।

 

৭৩ এর এপ্রিলে লন্ডন পৌছার পর বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করা সহজ হয়ে গেলো। কিন্তু তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ আলোচনা করার উপায় হিসেবে হজ্জের উপলক্ষটিকেই বাছাই করতে হলো। ৭৭ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর হজ্জের সময় আমি বাংলাদেশী নেতৃবৃন্দের সাথে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে লন্ডন থেকে সৌদি আরবে হাযীর হতাম। তাঁদের কাছ থেকে দেশের বিস্তারিত অবস্থা, ইসলামী আন্দোলনের গতি- প্রকৃতি ও অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত হয়ে যথাসাধ্য পরামর্শ দিতাম। এর ফলে সশরীরে বিদেশে থাকলেও মন-মগজ ও চিন্তা- চেতনায় আমার জন্মভূমিই স্থায়ী আসন দখল করে রইলো।

 

৭৫ এর আগস্টে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ৭৬ এর জানুয়ারীতে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করলেন যে যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল তারা তা বহাল করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি দু’বার লেখা সত্ত্বেও সরকার তা নামঞ্জুর করলেন। অবশেষে ৭৮ এর জুলাই মাসে ভিসা নিয়েই আসতে বাধ্য হলাম। কয়েক মাস পর সরকার আমাকে দেশ থেকে বের হয়ে যাবার আদেশ দেন। আমি সে আদেশ অমান্য করেই দেশে রয়ে গেলাম। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে দেশ থেকে বের করবার কোন আইনগত পথ না থাকায় সরকার চুপ করে থাকতে বাধ্য হলেন।

 

৭৮ এ দেশে আসার পর পরই সর্বপ্রথম ‘বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন’ নামে বইটি লিখি। পরবর্তী সংস্করণে বইটি ‘ইসলামী ঐক্য ইসলামী আন্দোলন’ নামে প্রকাশিত হবার পর এ নামেই বহু সংস্করন বের হয়েছে। দেশের ইসলামী শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে একটি ব্যাপক ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলন গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য ছিল। এ বইটিতে প্রমান করা হয়েছে যে, মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, ওয়াজ এবং তাবলীগের মাধ্যমে ইসলামের দ্বীনের যথেষ্ট খেদমত হচ্ছে। কিন্তু শুধু খেদমতে দ্বীনের দ্বারাই ইসলামের বিজয় হতে পারেনা। তাই ইকামতে দ্বীনের জন্য এর উপযোগী কর্মসূচী এবং পরিকল্পনা প্রয়োজন ও জামায়াতে ইসলামী সে মহান লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে।

 

১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে দৈনিক সংগ্রামে উপ-সম্পাদকীয় কলামে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে আমার বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ১৫ টি প্রবন্ধ নিয়ে ‘আমার দেশ বাংলাদেশ’ নামে এবং রাজনৈতিক বিষয়ে ১১ টি প্রবন্ধের সংকলন হিসেবে ‘বাংলাদেশের রাজনীতি’ নামে বেশ কয়েকটি সংস্করন প্রকাশিত হয়েছে।

 

১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রথম রোকন সম্মেলনে “বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামী” শিরোনামে আমার বক্তৃতায় বাংলাদেশ সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভংগি কী এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জামায়াত কেমন সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী সে বিষয়ে জামায়াতের সুস্পষ্ট নীতি ঘোষণা করা হয়।

 

১৯৮৮ সালে “বাংলাদেশে আদর্শের লড়াই” নামে বিশেষ করে শ্রমিক সমাজের চিন্তাধারাকে ইসলামী দৃষ্টিতে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে একটি বই লেখা হয়। শ্রমিকরাজ কায়েমের দোহাই দিয়ে কমিউনিস্ট এবং সমাজতন্ত্রীরা মেহনতী মানুষকে তাঁদের খপ্পরে নেয়ার জন্য যে ধাপ্পাবাজী সুলভ প্রচারাভিযান পরিচালনা করে তাঁর মুখোশ খুলে দিয়ে শ্রমিকদেরকে সুস্থ বা বাস্তব চিন্তা করার যোগ্য বানানোই এ বইটির উদ্দেশ্য।

 

১৯৮৮ সালের এপ্রিলে “পলাশী থেকে বাংলাদেশ” নামে প্রকাশিত আমার পুস্তিকাটিতে ১৯৭১ সালে জামায়াতের রাজনৈতিক ভুমিকার বিশ্লেষণ পেশ করা হয়। আলোচ্য বিষয়ের প্রসংগক্রমে পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমি, পাকিস্তান আমলের কুশাসন, পূর্ব পাকিস্তানের আসল সমস্যা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

 

“জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভূমিকা” নামক পুস্তকে ১৯৪১ সালে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র বহাল হওয়া পর্যন্ত জামায়াতের রাজনৈতিক ভূমিকা আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনৈতিক ভূমিকা এ দেশের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।

 

বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কিত সকল লেখা থেকে বিষয়ভিত্তিক বাছাই করে বিভিন্ন প্রবন্ধ সংকলিত আকারে একটি গ্রন্থে সন্নিবেশিত করার প্রয়োজন অনেক দিন থেকেই বোধ করছিলাম। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে আমার গোটা চিন্তা-ভাবনা একত্র সংকলিত অবস্থায় পেশ করার উদ্দেশ্যেই “আমার বাংলাদেশ” শিরোনামে এ গ্রন্থটি সাজানো হলো।

 

এ সংকলনে পরিবেশিত প্রতিটি প্রবন্ধের শেষে যে বইতে ইতিপূর্বে এটা প্রকাশিত হয়েছে তা উল্লেখ করা হলো। কোন কোন প্রবন্ধ পাকিস্তান আমলে দৈনিক ইত্তেহাদে প্রকাশিত হয়। কোন কোনটি উপরোক্ত কোন বইতেই ছাপা হয় নি। মোটকথা বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কিত আমার প্রায় যাবতীয় রচনাই এ গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

 

বিভিন্ন বিষয়ে পুনরাবৃত্তি থাকলেও আশা করি পাঠক পাঠিকাদের বিরক্তির কারন ঘটবে না। কারন বিষয় এক হলেও ভাষা ও পরিবেশনা সম্পূর্ণ এক নয়। তবুও পুনরাবৃত্তি না থাকলেই ভালো হতো বলে স্বীকার করি। কিন্তু এর প্রতিকার করা এখন অসাধ্য। এটা করতে গেলে নতুন করা লিখতে হয় যা আমার পক্ষে অসম্ভব। এর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

 

মোট ৯১ টি প্রবন্ধকে ১৯ টি শিরোনামে বিভিন্ন পরিচ্ছদে ( চ্যাপ্টারে ) বিভক্ত করে প্রতি পরিচ্ছদের অধীনে প্রবন্ধগুলোকে সাজানো হয়েছে। বিষয় সূচিতে সেভাবেই এক একটি পরিচ্ছদের নামে প্রবন্ধগুলোর তালিকা পেশ করা হয়েছে যাতে পাঠক পাঠিকাগণ সহজেই তাঁদের ইচ্ছা মতো বিষয় তালাশ করে নিতে পারেন।

 

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবকাশ যাপনের সুযোগ না পেলে হয়তো এ সংকলন পরিবেশন করার সময় বের করা সম্ভব হতো না। আশা করি রাজনীতি সচেতন পাঠক পাঠিকা এ বইটিতে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা প্রতিফলন অনুভব করবেন। যে উদ্দেশ্যে সংকলনটি প্রনয়ন করা হল তা আল্লাহ পাক সফল করুন। আমীন।

 

গোলাম আযম

 

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

জানুয়ারী, ১৯৯৩।

 

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

 

আমার বাংলাদেশ

অধ্যাপক গোলাম আযম

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড