হাদীস সংকলনের ইতিহাস

পূর্ব –কথা

ইসলামী জীবন বিধান তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে দুইটি মৌল বুনিয়াদের উপর স্থাপিতঃ একটি পবিত্র কুরআন, অপরটি রাসূলের হাদীস। পবিত্র কুরআন ইসলামের একটি মৌল কাঠামো উপস্থাপন করিয়েছে আর রাসূলের হাদীস সেই কাঠামোর উপর একটি পূর্ণাঙ্গ ইমারত গড়েয়া তুলিয়াছে। তাই ইসলামী জীবন বিধানে পবিত্র কুরআনের পরই রাসূলের হাদীসকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে। হাদীসেই ইসলামী জীবন-বিধানের বিস্তৃত রূপরেখার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এই কারণে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও মর্ম উপলদ্ধি এবং তদনুসারে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ গঠনের জন্য হাদীসের বিকল্প আর কিছুই হইতে পারে না।

পবিত্র কুরআনের শিক্ষানুসারে রাসুলে আকরাম (স)- এর জীবন ও কর্মধারা মুসলমানদের জন্য ‘উসয়ায়ে হাসানাহ’ বা সর্বোত্তম আদর্শ। মুসলমানদের জীবন. সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির সকল অঙ্গনেই এই আদর্শের পরিধি বিস্তৃত। এই আদর্শের সঠিক ও নির্ভূল বিবরণ সংরক্ষিত রহিয়াছে হাদীসের বিশাল ভাণ্ডারে। কাজেই প্রকৃত মুসলিম রূপে জীবন যাপন ও সর্বতোভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য হাদীসের ব্যাপকতর অধ্যয়ন এবং ইহার বিশুদ্ধতা ও প্রমাণিকতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানার্জন করা একান্তই আবশ্যক। হাদীস সম্পর্কে জ্ঞানার্জন না করা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকারই নামান্তর।

দুঃখের বিষয় যে, মুসলমানদের জীবনকে রাসূলে আকরাম (স)-এর জীবন ও কর্মধারা হইতে বিচ্ছিন্ন করা এবং ইসলামকে একটি নিস্প্রাণ ও স্থবির ধর্মে পরিণত করার লক্ষ্যে হাদীসের প্রামাণিকতা ও বিশুদ্ধতা এবং ইহার সঙ্কলন ও সংরক্ষণ সম্পর্কে একটা সন্দেহের ধূম্রজাল সৃষ্টির অপচেষ্টা চলিয়া আসিতেছে সুদীর্ঘকাল হইতে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সোনালী যুগের অবসানের পর ম’তাজেলা সম্প্রদায়ের উত্থানের মধ্য দিয়েই এই অপচেষ্টা শুরু হইয়াছে এবং পরবর্তীকালে ‘কুরআনপন্হী’র মুখোশ পরিয়া হাদীস-অবিশ্বাসীদের একটি গোষ্ঠি বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের মধ্যে সুকৌশলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির এই হীন প্রয়াস চালাইয়াছে।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই উপমহাদেশেও অনুরূপ একটি চক্রান্তকারী মহল হাদীস বিরোধী এক প্রচণ্ড অভিযান শুরু করিয়াছিল। তাহারা হাদীসের সংকলন, লিপিবদ্ধকরণ ও সংরক্ষণ সম্পর্কে নানা অবান্তর প্রশ্ন তুলিয়া ইহার প্রামাণিকতা ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মুসলিম জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াইতে চাহিয়াছিল। দুঃখের বিষয় যে, তৎকালীন পাকিস্তানের দায়িত্বশীল ও প্রশাসনিক পর্যায়ের কিছু সংখ্যক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিও সরকারী ক্ষমতার পক্ষপুটে থাকিয়া এই ষড়যন্ত্রকে ইন্ধন যোগাইয়াছিল।

এই সর্বনাশা চক্রান্তের মুকাবিলার লক্ষ্যেই এই ভূখণ্ডের বিশিষ্ট হাদীস-বিশেষজ্ঞ শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা মুহাম্মদ আবদুর রহীম ষাটের দশকের প্রথমভাগে ‘হাদীস সংকলনের ইতিহাস ‘ শীর্ষক এই বিশাল গ্রন্হখানি প্রণয়ন করিয়াছেন।

প্রায় অর্ধ যুগের ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষনার ফসল এই মূল্যবান গ্রন্হে হাদীসের সংকলন, লিপিবদ্ধকরণ ও সংরক্ষণ এবং হাদীস শাস্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে হাদীস-বিরোধীদের সকল কূট প্রশ্নেরই তিনি বিস্তৃত ও পুংখানুপুংখ জওয়াব দিয়াছেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সহিত এতৎসম্পর্কিত যাবতীয় শোবাহ-সন্দেহের অপনোদন করিয়াছেন। আল্লাহর অশেষ শোকর যে, গ্রন্হটি ইতিমধ্যেই বাংলা ভাষায় হাদীস চর্চার ক্ষেত্রে অপরিহার্য পাঠ্যপুস্তকের মর্যাদা লাভ করিয়াছে।

বিগত ২৬ বৎসরে এই অনন্য গ্রন্হটির পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে। ইহার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছিল জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী হইতে-১৯৭০ সনে। বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর ১৯৮০ হইতে ১৯৯২ সন পর্যন্ত ইহার তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর সৌজন্যে। প্রকাশনার এই ধারাবাহিকতা হইতে নিঃসন্দেহে গ্রন্হটির অসাধারণ জনপ্রিয়তাই প্রতিভাত হইয়াছে। এক্ষণে মওলানা আবদুর রহীম রচনাবলী প্রকাশনার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘খায়রুন প্রকাশনী’ গ্রন্হটির সুষ্ঠ প্রকাশনা ও বাজারজাতকরণের সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত ইহার পূর্বোকার সংস্করণের মুদ্রণ-প্রমাদগুলি সংশোধনের জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, গ্রন্হের এই সংস্করণটি বিদগ্ধ পাঠক সমাজে অধিকতর সমাদর লাভ করিবে।

মহান আল্লাহ এই অনন্য দ্বীনী খেদমতের জন্যে গ্রন্হকারকে জান্নাতুল ফিরদৌস নসীব করুন, ইহাই আমাদের সানুনয় প্রার্থনা।

মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান

চেয়ারম্যান

মওলানা আবদুর রহীম ফাউন্ডেশন

ঢাকাঃ আগস্ট, ১৯৯৭

ভূমিকা

মানব প্রকৃতির স্বভাবতই দুইটি পরস্পর-বিরোধী ভাবাধারা বিদ্যমান। একটি অপরের আনুগত্য স্বীকার করা আর দ্বিতীয়টি অন্য লোককে নিজের অনুগত বানাইয়া লওয়া। [Instincts of submission and gregariousness] অন্য কথায়, আনুগত্য স্বীকার ও আধিপত্য বিস্তার এই দুইটি গুণই মানুষের স্বভাবগত এবং এই গুণ দুইটি মানুষের মধ্যে সাধারণত প্রায় সমান মাত্রায় বিদ্যমান। মানুষের প্রকৃতি এক দিকে যেমন তাহাকে অপর লোকের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য উদ্যোগী করিয়া তোলে, অপর দিকে ঠিক অনুরূপভাবেই তাহাকে অপর শক্তির নিকট আনুগত্যের মস্তক অবনমিত করিতে বাধ্য করে। যে লোক দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া আছে, তাহাকেই দেখা যাইবে অপর কোন উচ্চতর বৃহত্তর শক্তির সম্মুখে অবনমিত মস্তকে। প্রভাব বিস্তার ও আনুগত্য স্বীকার এই উভয়বিধ ভাবধারাই মানুষের প্রকৃতি নিহিত বলিয়া মানুষ সমাজ জীবন যাপন করিতে ও বহু মানুষের সহিত মিলিত হইয়া সামাজিক দায়িত্ব পালন করিতে সক্ষম। এই ভাবধারা না থাকিল না সমাজ গড়িয়া উঠিতে পারিত, না সমাজের উপর মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে পারিত কোন রাষ্ট্রের প্রাসাদ।

মানব-প্রকৃতি ও মনস্তত্ত্বের গভীরতর অনুশীলনের ফলেই এই তত্ত্বের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব। মানব-প্রকৃতি নিহিত এই দুই বিপরীতমূখী ভাবধারা যেমন অপ্রয়োজনীয় নয়, তেমনি নয় কোন দূষনীয়। সকল প্রকার স্বাভাবিক ভাবধারা, প্রবণতা ও আবেগ-উচ্ছাসের একটি স্বভাবসম্মত সীমা নির্দিষ্ট রহিয়াছে এবং সেই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকিলেই তাহা মানূষের জন্য কল্যাণকর হইতে পারে।

আনুগত্য ও প্রভাব বিস্তারের এই ভাবধারা কালভিত্তিক ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে বহুর সঙ্গে এক-এর সম্পর্কে-সম্বন্ধ ও যোগাযোগ সৃষ্টি করে। এই ভাবধারার প্রবাহ শুষ্ক ও স্তব্ধ হইয়া গেলে সভ্যতার অগ্রগতি ব্যাহত হইতে এবং জীবন-যন্ত্র বিকল হইয়া পড়িতে বাধ্য। দুনিয়ার কোন মতাদর্শ ও চিন্তাধারাই এই কারণে সম্পূর্ণ অভিনব ও অপূর্ব হইতে পারে না, বাহ্য দৃষ্টিতে তাহা যতই ‘আনকোরা’ ও ‘নতুন’ বলিয়া মনে হউক না কেন। বরং একটৃ সন্ধনী দৃষ্টিতে বিচার করিলেই উহার প্রত্যেকটির মূল শিকড় অতীতের গভীর তলদেশে খুজিঁয়া পাওয়া যাইবে। গবেষণা ও অনুসন্ধানের প্রতিভা সূক্ষ্ম ও ব্যাপক হইলে অতীতের অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্তে প্রবাহমান এক চিরন্তন জীবন ঝর্ণার ফল্গুধারা লক্ষ্য করা কিছুমাত্র কঠিন নহে। বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারই এমন নহে, যাহার বীজ পূর্ববর্তী কোন আবিষ্কার-উদ্ভাবনীর ক্ষেত্রে হইতে সঞ্চারিত নয়। সভ্যতা সংষ্কৃতি এই উত্তুংগ প্রাসাদ আদিম প্রাচীনত্বের ধ্বংসস্তূপের উপরই দণ্ডায়ামন, তাহাতে সন্দেহ নাই।

এই কারণে দুনিয়ার কোন সংস্কৃতিবান জাতিই স্বীয় অতীতের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া দীর্ঘকাল বাচিঁয়া থাকিতে পারে না। অতীতকাল জাতিকে একটি দৃঢ় ভিত্তিই দেয় না, ভবিষ্যতের চলার পথে দান করে বহুবিধ বাস্তব অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত জ্ঞান-পাথেয়। অতীতের ভূল-ভ্রান্তি, পদস্থলন ও ঘাত –প্রতিঘান তাহাকে অধিকতর সতর্ক করিয়া তোলে। কিন্তু সেই জন্য জাতির মধ্যে নিরপেক্ষ ও উদার মননশীলতা এবং উপদেশ গ্রহণের অনুকূল মানবিক অবস্থা বর্তমান থাকা একান্তই আবশ্যক। ইতিহাস অধ্যয়নের গুরুত্ব এই দৃষ্টিতেই অনুধাবনীয়। ইহার সাহায্যে অতীতকে বর্তমানের পাশাপাশি স্হাপন করিয়া পারস্পরিক যাচাই ও তুলনা করা এবং উহা হইতে অর্জিত জ্ঞান-আলোকে অজ্ঞাত ভবিষ্যতের তিমিরাচ্ছন্ন দিগন্তকে উদ্ভাসিত করিয়া তোলা প্রত্যেক জাতির পক্ষেই সহজ।

উপরন্তু একটি জাতির ইতিহাস কেবল সেই জাতির জন্য। নয়, দুনিয়ার সকল মানব জাতির জন্যই তাহা অমূল্য সম্পদ। এই কারণে কুরআন মজীদ সংক্ষিপ্তভাবে হইলেও বহু প্রাচীন জাতির ইতিহাস উল্লেখ করে এবং সেইসব জাতির উত্থান-পতন ও কল্যাণ-অকল্যাণের মর্মস্পশী কাহিনী হইতে এক নির্ভুল ইতিহাস-দর্শন গড়িয়া তোলে। ফলে কুরআন সকল যুগের মানুষের জন্য কল্যাণ পথের দিশারী। কিন্তু ইহার কার্যকারিতা নির্ভর করে ঘটনার যথার্থতা, সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার উপর। এই গুণাবলী সঠিকভাবে অর্জিত হইলে আজিকার মানুষও  তাহা হইতে যেমন সঠিক পথের নির্দেশ লাভ করিতে পারে, তেমনি পারে ভবিষ্যতের দুর্গম পথে চলিবার বিপুল উদ্যম ও প্রেরণা লাভ করিতে।

মানুষের কল্যাণকামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন শ্রেণী রহিয়াছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বাধিক উন্নতমানের কল্যাণকামী লোক হইতেছেন আল্লাহর প্রেরিত আম্বিয়ায়ে কিরাম। তাঁহারাই বিশ্বমানবতার উজ্জ্বলম আদর্শ। তাহারা সকল প্রকার পাপ-ক্রটি ও গুনাহ-নাফরমানীর কলুষতা হইতে চিরমুক্ত। তাঁহাদের চিন্তাধারা, দৃষ্টিকোণ, কথা ও কাজ-সবকিছুই সরাসরিভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। অতএব তাঁহারা সাধারণ মানুষের নিকট কেবল ভক্তি-শ্রদ্ধা পাওয়ারই যোগ্য পাত্র নহেন, আকীদা ও বিশ্বাস হইতে শুরু করিয়া জীবনের সকল পর্যায়ের সকল প্রকার কাজে ও কর্মে বাস্তবভাবে অনুসৃত হইবার যোগ্য।

সকল নবীই একই নূরানী কাফেলার অগ্রপথিক, একই মূলনীতি ও আদর্শভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থার উদগাতা এবং প্রচারক; একই দ্বীনের প্রবর্তন। মানব-প্রকৃতিও চিরন্তনভাবে অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয়। এই কারণে মানুষের প্রয়োজনীয় পথ-নির্দেশ এবং উহার মৌলিক ভাবধারা ও চূড়ান্ত আদর্শও অভিন্ন, চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয়। এই মৌলিক শাশ্বত আদর্শের নাম ‘দ্বীন’। আর দ্বীন-ইসলাম এই কারণেই বিম্ভমানবের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রবর্তিত এক অখণ্ড জীবন বিধান। হযরত আদম (আ) হইতে শেষ নবী মুহাম্মদ (স) পর্যন্ত সকল নবীই দ্বীন ইসলামের বাহক প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাকামী। নবী আগমনের ধারাবাহিকতায় হযরত মুহাম্মদ (স) সর্বশেষ পর্যায়। আল্লাহ তাঁহাকে যেমন সকলের শেষে প্রেরণ করিয়াছেন, তেমনি তাহাকে ধারণাতীতভাবে সামগ্রিক পূর্ণত্বও দান করিয়াছেন। মানবীয় গুণের দিক দিয়া যেমন, নবুওয়্যাতের যোগ্যতায়ও তিনি ছিলেন তেমনই এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ তাহাকে উত্তরকালে সকল স্তরের ও সকল দিক ও ক্ষেত্রের জন্য উজ্জ্বলতর নিদর্শনরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। তাঁহার প্রতি অবতীর্ণ শরীয়াত চিরকালের, সমগ্র মানুষের এবং ইহকাল-পরকাল উভয় ক্ষেত্রের সার্বিক কল্যাণ লাভের একমাত্র নিয়ামক। সময় ও স্থানের পরিধি বা আবর্তন-বিবর্তন উহাকে স্পর্শ করিতে অক্ষম। এই কারণে নবুয়্যাত তাহাতেই চূড়ান্তভাবে পরিণতি লাভ করিয়াছে। আর এই কারণেই তিনি ‘খাতামুন-নাবিয়্যীন, ‘রাহমাতুললিল আলামীন’।

পূর্বেই বলিয়াছি রাসূলে করীম (স) মানব জাতির জন্য এক পরিপূর্ণ আদর্শ। মানব জীবনের কোন একটি দিক বা একটি কাজ এমন নাই- হইতে পারে না- যে সম্পর্কে রাসূলে করীমের নিকট হইতে পথ-নির্দেশ লাভ করা যায় না। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন, পারস্পররিক লেন-দেন, সম্পর্ক সম্বন্ধ স্থাপন, আত্মীয়তা-শক্রতা, শিক্ষাদীক্ষা, দেশ শাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক- যুদ্ধ ও সন্ধি- সবকিছু সম্পর্কেই সুস্পষ্ট আদর্শ বিদ্যমান রহিয়াছে রাসূলে করীম (স)-এর জীবনে।

রাসূলে করীম (স) ইসলামী আদর্শ প্রচার ও উহার প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। এইজন্য তাহাকে পরিচালনা করিতে হইয়াছে এক সর্বাত্মক সাধনা, এক ক্ষমাহীন অভিযান। ইহা কোন সহজসাধ্য কাজ নহে। ইহা যদি কেবল চিন্তার সূক্ষ্ম জাল রচনা কিংবা বাণীর যাদুমন্ত্র সৃষ্টির দ্বারাই স্মভব হইত, তাহা হইলে চিন্তা ও কল্পনার নির্লিপ্ত প্রশান্তির আসনে অধরূঢ় দার্শনিকদের দ্বারাই মন ও জীবনে অনুরূপ বিপ্লব সৃষ্টি সম্ভব হইত, সম্ভব হইত মৃত জাতির পুনর্গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার দুরূহ কাজ। এই কাজ প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ ও পথ-নির্দেশের মাধ্যমেই অতিবাহিত হয় একজন নবীর জীবন। আর ‘নবুওয়্যাত’ কোন উপার্জনযোগ্য বস্তু নহে, উত্তরাধিকারসূত্রে লভ্য কোন সম্পদও ইহা নয়। ইহা একান্তভাবে আল্লাহর দান। ইহাকে যাহারা সম্পূর্ণত কিংবা আংশিক উপার্জনযোগ্য বলিয়া মনে করে, তাহারা কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণার বিপরীত ধারণা পোষণ করে। আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেনঃ

اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ আল্লাহ মানুষ ও ফেরেশতাদের মধ্য হইতে নিজেই রাসূল বাছাই ও মনোনীত করেন। (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াতঃ ৭৫)

اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ

আল্লাহ তাহার নবুওয়্যাত ও রিসালাত কোথায় কাহার প্রতি সংস্থাপন করিবেন, তাহা ততিন সকলের অপেক্ষা অধিক জানেন। (সূরা আন’আম, আয়াতঃ ১২৩)

এই কারণে নবী- আর আমাদের জন্য সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-ই চিরন্তন ও পরিপূর্ণ আদর্শ। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই অনুসরণীয়। তাহার মাধ্যমে যে মহান পবিত্র কিতাব-কুরআন মজীদ- আমরা লাভ করিয়াছি, তাহাও যেমন আমাদের জন্য এক অক্ষয় আদর্শ, তেমনি তাহার কথা, কাজ ও সমর্থনের সমন্বয়ে গঠিত সুন্নাতও এক চির উজ্জ্বল দীপ-শিখা। আর ইহাই হইতেছে হাদীসের দার্শনিক ভিত্তি। ইহার উপর রচিত হয় ইসলামী জীবন বিধানের সর্বকালীন প্রাসাদ।

আজ হইতে চৌদ্ধশথ বৎসর পূর্বে আরবের সরজমীনে যে সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল, উহাতে সার্বভৌমত্যের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন আল্লাহ তা’য়ালা এবং উহার নেতৃত্বের আসনে সমাসীন ছিলেন সর্বষশষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)। কিন্তু এই সভ্যতা যেহেতু কেবল একচি দেশ ও একটি যুগের জন্যই ছিল না, উুহা ছিল বিশ্বের সকল দেশ, সকল সমাজ ও জাতি এবং সকল যুগের নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্য স্থায়ী ও কল্যাণকর, এই কারণে সভ্যতার মূল ভিত্তিদ্বয়-আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও রাসূলের নেতৃত্বকে চিরন্তন সব্যরূপে শাশ্বত ও চিরন্তন করিয়া রাখার উদ্দেশ্যে বিশ্ব মানবতার নিকট দুইটি বিকল্প ব্যবস্থা সংরক্ষিত করা হয়। এই দুইটি ব্যবস্থঅ হইতেছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতীক কুরআন মজীদ এবং রাসূলের একচ্ছত্র নেতৃত্বের বাস্তব রূপ ‘সুন্নাত’। এই দু্ইটির মাধ্যমে আল্লাহর বিধান রাসূলের আদর্শ তথা ইসলাম মানব সমাজে চিরন্তন সত্য ও চিরন্তন ব্যবস্থা হইয়া থাকিতে পারে, পারে দেশের সকল কালের জাতির মানুষ এই দুইটি স্থায়ী বুনিয়াদের ভিত্তিতে নতুন নতুন সমাজ ও সভ্যতা গড়িয়ে তুলিতে। এই কারণেই কুরআন মজীদ যেমন আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে অক্ষুণ্ন ও অপরিবর্তিতভাবে সংরক্ষিত হইয়াছে এবং বর্তমানেও মজুদ রহিয়াছে, ঠিক অনুরূপভাবে ধ্বংস ও বিলুপ্তির করাল গ্রাস হইতে রক্ষা করিয়া রাখা হইয়াছে রাসূলে করীমের আদর্শকে-সুন্নত বা হাদীসকে।

বস্তুত দেড় সহস্র বৎসরকালীন মুসলিম জাতি ইসলামের ভিত্তি হিসাবে কুরআন মজীদের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসকেও স্বীকার করিয়া লইয়াছে এবং এই ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে অতীতকাল হইতে কোনরূপ মতভেদ সৃষ্টি হওয়া তো দূরের কথা, কোন কালের কোন মুসলমান একবিন্দু সন্দেহ কখনো পোষণ করন নাই। উপরন্তু কোন লোক যদি এই দুইটি ভিত্তিকে এক সঙ্গে স্বীকার করিতে ও মানিয়া লইতে অসম্মতি প্রদান

করিয়াছেন, মুসলিম সমাজে তাহাকে একবিন্দু স্বীকৃতি দিতেও কান মুসলমান প্রস্তুত হন নাই।

কিন্তু বর্তমানকালে মুসলমানদের মধ্যে এমন এক শ্রেণীর মুষ্টিমেয় লোক যত্রতত্র পরিদৃষ্ট হইতেছে, যাহারা কুরআন মজীদের সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের সুন্নাতকে ইসলামের উৎস হিসাবে মানিয়া লইতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিতেছে। আবার এমন কিছু লোকেরও অস্তিত্ব দেখা যাইতেছে, যাহারা হাদীস যথাসময়ে ও যথাযথভাবে সংরক্ষিত হইয়াছে কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিতেছে আর এই বিষয়ে পশ্চিমা পণ্ডিতদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় প্রভাবান্বিত হইয়া পড়িতেছে। ইহার ফলে মুসলিম সমাজে ইসলামী আদর্শের নিভুলতা, বিশ্বস্ততা, চিরন্তনতা সম্পর্কে কাহারো-কাহারো মনে সন্দেহের উদ্রেক না হওয়াই ছিল অস্বাভাবিক ব্যাপার। অথচ মুসলিম সমাজের ই পুনরুক্থান ও পনর্জাগরণ পর্যায়ে ইসলামী আদর্শের ভিত্তি সম্পকের্ক এইরূপ সন্দেহ বা অবিশ্বাস গোটা জাতির পক্ষেই মারাত্মক হইয়া দেখা দিতে পারে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘হাদীস সংকলনের ইতিহাস’ সম্পর্কে ঐতিহসিক বিচার বিশ্লেষণ এবং ইহার স্বপক্ষে প্রামাণিক যুক্তি ও দলিলাদির ভিত্তিতে নিরপেক্ষ গবেষণা পরিচালনা একান্তই অপরিহার্য ছিল।

আরবী এবং উর্দু সাহিত্যে এই পর্যায়ে যথেষ্ট গবেষণা করা হইয়াছে বলা চলে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ইহার অভাব ইসলামী সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাংলাভাষীদের বিশেষ দৈন্যের প্রমাণ। এই অভাব মোচন ও দীনতা বিদূলণ করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি ও উন্নয় ন এবং হাদীস সম্পর্কে যাবতীয় সন্দেহ অপনোদনের উদ্দেশ্যে আমি বিগত চার বৎসরকাল ধরিয়া এই বিষয়ে ব্যাপক অধ্যাপনা ও গভীর গবেষণা চালাইয়া যে ফসল লাভ করিয়াছি, তাহাই অত্র গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়া বিদগ্ধ পঠকদের সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়াছি। ইহা আমার কোন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ কিনা তাহা চিন্তাশীল পাঠকদেরই বিচার্য। বাংলা একাডেমীর আনুকূল্য এই বিরাট গ্রন্হ প্রথমবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইতেছে দেখিয়াআল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করিতেছি।

মুহাম্মদ আবদুর রহীম

১৭৩, নাখালপাড়া

মুস্তফা মনজিল

..............১৯৬৫

نضر الله امرء سمع منا شىا

আল্লাহ ধন্য করিবেন সেই ব্যক্তিকে, যে আমার নিকট হইতে কোন কিছু শুনিল এবং উহা যেভাবে শুনিল সেই ভাবেই অপরের নিকট পৌঁছাইয়াদিল। কেননা শ্রোতার অপেক্ষা উহা যাহার নিকট পৌছায় সে-ই উহার অধিক সংরক্ষণকারী হইয়া থাকে। (তিরমিযী)

قَالَ  رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عليه وَسَلَّم نَضَر اللهُ عَبْدًا سَمِعَ مقَالتىْ فَحَفَظَهَا اوْوَ عَاهَا وَاَدَّها وَرَدَّهَا فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهِ اَلَى مَنْ هُوَ اَفْقَهٌ مِنْهُ-    (ابو داؤد)

নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ তা’য়ালা সেই লোকের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল উদ্ভাসিত করিবেন, চিরসবুজ, চিরতাজা করিয়ারাখিবেন, যে আমার কথা শুনিয়া মুখস্থ করিয়া রাখিবে কিংবা স্মৃতিপটে সংরক্ষিত রাখিবে এবং অপর লোকের নিকট তাহা পৌঁছাইবে। জ্ঞানের বহু ধারকই প্রকৃত জ্ঞানী নহে। তবে জ্ঞানের বহু ধারক উহা এমন ব্যক্তির নিকট পৌঁছায়, যে তাহার অপেক্ষা অধিক সমঝদার।                                 (আবূ দাউদ)

হাদীস সংকলনের ইতিহাস

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

হাদীসের সংজ্ঞা ও পরিচয়

কুরআন ও হাদীস ইসলামী জীবন-বিধানের মূল ভিত্তি। কুরআন যেখানে জীবন-ব্যবস্থার মৌলিক নীতি পেশ করে, সেখানে হাদীস হইতে লাভ করা যায় খুটিঁনাটি বিধানের বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও কুরআনী মূলনীতি বাস্তবায়নের কার্যকর পন্হা। কুরআন ইসলামের প্রদীপ স্তম্ভ, হাদীস উহার বিচ্ছুরিত আলোর বন্যা। আলোহীন প্রদীপ যেমন অবাস্তব, হাদীসকে অগ্রাহ্য করিলে কুরআনও তেমনি অর্থহীন হইয়া যায়। কুরআনকে বলা যায় ইসলামের বিরাট বৃক্ষের মূল ও কাণ্ড; হাদীস উহার শাখা ও প্রশাখা। শাখা-প্রশাখাহীন কাণ্ড ও মূল নিষ্ফল আবর্জনা মাত্র। কুরআন যেন ইসলামের জীবন প্রসাদ রচনার পরিকল্পনাসহ ইঞ্জিনিয়ার (রাসূল) প্রেরণের নিয়ম আল্লাহর বিধান নাযিল হওয়ার প্রথম দিন হইতেই কার্যকর। কালের যে-কোন স্তরে, পরিবর্তিত অবস্থার যে-কোন পর্যায়ে মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাসাদ রচনায় ইঞ্জিনিয়ারের (রাসূলের) ব্যাখ্যা-বিশ্লষণ, বাস্তব কর্মের নির্দেশ, পরামর্শ ও উপদেশকে কখনই উপেক্ষা করা যাইতে পারে না।

ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে কুরআন যেন হৃৎপিণ্ড, আর হাদীস এই হৃৎপিণ্ডের সহিত সংযুক্ত ধমনী। ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল ক্ষেত্রে এ ধমনী প্রতিনিয়ত তাজা তপ্ত শোণিত ধারা প্রবাহিত করিয়া উহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অব্যাহতভাবে সতেজ ও সক্রিয় করিয়া রাখে। হাদীস একদিকে যেমন কুরআনের নির্ভুল ব্যাখ্যা দান করে, অনুরূপভাবে উহা পেশ করে কুরআরে বাহক বিশ্বনবীর পবিত্র জীবন-চরিত, কর্মনীতি ও আদর্শ এবং তাঁহার কথা ও কাজ, হেদায়েত ও উপদেশের বিস্তারিত বিবরণ। এই কারণে ইসলামী জীবিন-বিধানে কুরআন মজীদের পরে পরেই এবং কুরআনের সঙ্গে সঙ্গেই হাদীসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আল্লাহর দাসত্ব ও আনগত্য করা যেমন রাসূলের আনগত্য ও বাস্তব অনুসরণ ব্যতীত সম্ভব নয়, অনুরূপভাবে হাদীসকে বাদ দিয়া কুরআন অনুযায়ী আমল করা অসম্ভব। বস্তুর হাদীস ও হাদীস-জ্ঞান ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা ও ইসলামী জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে এক অমূল্য ও অপরিহার্য সম্পদ। এই পর্যায়ের প্রাথমিক আলোচনা হিসাবে এখানে আমরা হাদীসের সংজ্ঞা, পরিচয় এবং উহার প্রকার ও ক্ষেত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করিব।

 

হাদীস শব্দের অর্থ

কুরআনে হাদীস শব্দের ব্যবহার এবং

হাদীসের কুরআনী ভিত্তি

‘হাদীস’ শব্দের বিশ্লেষণ করিয়া ইমাম রাগব ইসফাহানী লিখিয়াছেনঃ

اًلحَدِيثُ: وَاَلْحدِيْثُ كَوْنُ اَلشَّئِ بَعَدَ اَنْ لَّمْ تَكُنْ عِرضَاً كَاَنَ تَوْ اَوْجَدْ هَرَّا وكٌلُّ كَلاَمٍ يَبْلُعُ الْانْسَانَ مِنْ جَهَةِ الْسَّمْعِ اَوِ الْوَحِىْ فِىْ يَقْظَتِهِ اَوْ مَنَامِهِ حَدِيْثٌ-

‘হাদীস’ আর ‘হুদুস’ বলিতে বুঝায় কোন একটি অস্তিত্বহীন জিনিসের অস্তিত্ব লাভ করা, তাহা কোন মৌলিক জিনিস হোক কি অমৌলিক। আর মানুষের নিকট শ্রবণেন্দ্রিয় বা ওহীর সূত্রে নিদ্রায় কিংবা জাগরণে যে কোন কথা পৌঁছায়, তাহাকেই হাদীস বলা হয়।

অন্যত্র লিখিয়াছেনঃ

شَىَّ ىُلْقَى فِىْ رَوْعٍ اَحَدٍ مِنْ جِهَةِ الْملأَ

উচ্চতর জগত হইতে একজনের অন্তর্লোকে যাহা কিছু উদ্রিক্ত হয় তাহাই হাদীস।[مفردات راغب اصفهانى صفحه]

স্বপ্নকালীন কথাবার্তাকে কুরআন মজীদে ‘হাদীস’ বলা হইয়াছে। কুরআনে হযরত ইউসুফের জবানীতে বলা হইয়াছেঃ

وَعَلَّمْتَنِي مِن تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ –

স্বপ্নের কথার ব্যাখ্যা তুমি আমাকে শিক্ষা দিয়াছ। (সুরা, ইউসূফ, আয়াত-১০১)

ইমাম রাগেব এই আয়াতের অর্থ প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

اَىْ مَا يحَدِّثُ بِهِ الأِنسَانَ فِىْ نَوْمِهِ-

অর্থাৎ লোককে স্বপ্নযোগে যে সব কথা বলা হয়।[مفردات راغب صفع]

আল্লাহ্ তা’য়ালা কুরআন মজীদকে ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করিয়াছেন। কুরআনে বলা হইয়াছেঃ

فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلَىٰ آثَارِهِمْ إِن لَّمْ يُؤْمِنُوا بِهَٰذَا الْحَدِيثِ أَسَفً ا [الكهف:٦]

তাহারা এই ‘কথা’র (কিতাব) প্রতি বিশ্বাস না করিলে, হে নবী, তুমি হয়ত নিজেকে চিন্তাক্লিষ্ট করিয়া তুলিবে।

অন্যত্র বলা হইয়াছেঃ

فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ مِّثْلِهِ إِن كَانُوا صَادِقِينَ [الطُّور:٣٤]

(তাহারা কুরআনকে আল্লাহর কিতাব না মানিলে) এইরূপ একখানি কিতাব আনিয়া পেশ করা তাহাদের কর্তব্য, যদি তাহারা সত্যবাদী হইয়া থাকে।

সূরা আয্-যুমার-এ বলা হইয়াছেঃ

اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُّتَشَابِهًا

আল্লাহ তা’য়ালা পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ কিতাবরূপে অতীব উত্তম কালাম নাযিল করিয়াছেন।

এখানে হাদীসকে কিতাব বা কালাম অর্থে ব্যবহার করা হইয়াছে।

‘হাদীস’ শব্দের অর্থ কথা বা বাণী। কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতসমূহ ইহা কথা বা বাণী অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছেঃ

*********************************

অতঃপর তাহারা কোন কথাকে বিশ্বাস করিবে?

*************************************

এবং যখন নবী তাঁহার এক স্ত্রীর নিকট গোটন একটি কথা বলিলেন।

****************************

এই কথায় তোমরা কি আশ্চর্যান্বিত হইতেছ?

এই কয়টি আয়াতেই ‘হাদীস’حديث  শব্দটি ‘কথা’ বা ‘বাণী’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। কুরআন মজীদে নতুন সংবাদ, খবর ও নূতন কথা প্রভৃতি অর্থেও এই শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যথাঃ

******************************************************

ইবরাহীমের (নিকট আগত) সম্মানিত অতিথিদের খবর তোমার নিকট পৌঁছাইয়াছে কি?

******************************************************

মূসার খবর জানিতে পারিয়াছ কি?

******************************************************

সেই সৈনিকদের কথা জানিতে পারিয়াছ কি?

******************************************************

সব কিছু আচ্ছন্নকারী কিয়ামাতের সংবাদ তোমার নিকট আসিয়াছে কি?

******************************************************

এখন এই কথার প্রতি তোমরা উপেক্ষা প্রদর্শন করিতেছ?

এই ‘হাদীস’ শব্দ হইতে নির্গত হইয়াছে ‘তাহদীস’تحديث  আর কুরআনে ইহা ব্যবহৃত হইয়াছে বর্ণনা করা, প্রকাশ করা ও কথা বলার অর্থে। যথা--

******************************************************

তুমি আল্লাহর নিয়ামতের কথা বর্ণনা করঃ

আল্লামা আবুল বাকা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘হাদীস’ নাম হইল কথা বলার, সংবাদ দানের। [৪**************************************************]

মোটকথা আরবী অভিধান ও কুরআনের ব্যবহারের দৃষ্টিতে ‘হাদীস’ শব্দের অর্থ কথা, বাণী, সংবাদ, খবর ও ব্যাপার, বিষয়। নবী করীম (স) আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাইবার উদ্দেশ্যে লোকাদের সাথে কথা বলিতেন, নিজের কথার সাহায্যে ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কথা, তথ্য ও তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিতেন, নিগূঢ় তত্থ্ব বুঝাইয়া দিতেন, বক্তৃতা ও ভাষণের মাধ্যমে আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিতেন, এইজন্য তাহা ‘হাদীস’ নামে অভিহিত হইয়াছে।

নবী করীম (স) নিজে ইসলামের যাবতীয় হুকুম আহকাম পাণ করিয়াছেন, আল্লাহর বিধান মোতাবেক কাজ করিয়েছেন এবং নিজের আমলের সাহায্যে আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়িত করিয়াছেন। এই কারণে তাঁহার বিভিন্ন আমলের বিবরণকেও ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করা হইয়াছে।

নবী করীম (স) বিশেষ যত্ন ও চেষ্টার সাহায্যে সাহাবায়ে কিরাম (রা)- কে ইসলামের উন্নত আদর্শের ভিত্তিতে তৈয়ার করিয়াছেন, তাঁহাদের চরিত্র, চিন্তা, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের উন্নত মানে গঠন করিয়াছেন। এই কারণে সাহাবায়ে কিরামের যেসব কথা ও কাজাকে নবী করীম (স) অনুমোদন করিয়াছেন, সমর্থন করিয়াছেন, অন্তত তিনি যে সবের প্রতিবাদ করেন নাই, তাহারও নাম দেওয়া হইয়াছে ‘হাদীস’।

এক কথায় রাসূলের কথা, কাজের বিবরণ ও সমর্থন-অনুমোদনকেই হাদীস বলা হয়। একটি হাদীস হইতে প্রমাণিত হয়, নবী করীম (স) নিজেই ইহাকে ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করিয়াছেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) তাঁহার নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কে, যে লোক কিয়ামতের দিন রাসূলের শাফা’আত লাভে ধন্য হইবে? ‘তখন নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি মনে করি, এই হাদীস সম্পর্কে তোমার পূর্বে আর কেহই আমাকে জিজ্ঞাসা করে নাই। বিশেষত এই কারণে যে, হাদীস শোনার জন্য তোমাকে সর্বাধিক চেষ্টিত ও আগ্রহান্বিত দেখিতে পাইতেছি। [৫****************************************************** ]

কুরআন মজীদ দ্বীন-ইসলামের সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্হ। ইহা সর্বশেষ নবীর প্রতি নাযিল হইয়াছে। রাসূলে করীম (স)-কে আল্লাহ তা’য়ালা ইসলামের নবী, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রচারক ও প্রতষ্ঠাতা এবং মানবতার পথ-প্রদর্শক ও শিক্ষকরূপে প্রেরণ করিয়াছেন। রাসূল এই মহান পবিত্র গ্রন্হ ‘কুরআন মজীদ’ আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া লোকদেরকে শুনাইয়াছেন, বহু সংখ্যক সাহাবী তাহা সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ করিয়াছেন। সর্বোপরি রাসূল নিজের জীবনধারা, চিন্তা-বিশ্বাস, ও কর্ম আচরণ ও বাস্তব অনুসরণের মাধ্যমে ইসলামের মূল বিধান শিক্ষা, উপদেশ ও আদেশ-নিষেধকে বাস্তবায়িক করিয়া দেখাইয়া দিয়াছেন; অর্থাৎ একটি জাতিকে তিনি এই আদর্শের ভিত্তিতে পুরোপুরি গঠন করিয়াছেন। বস্তুত নবী করীমের মহান যিন্দেগী ছিল কুরআন মজীদের তথা ইসলামের বাস্তব রূপ, কুরআনী আদর্শের কর্মরূপ। অতএব, দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে রাসূলে করীমের যাবতীয় কথা, কাজ অনুমোদন ও সমর্থনকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘হাদীস’।

‘হাদীস’ একটি আভিধানিক শব্দমাত্র নয়। মূলত ইহা ইসলামের একটি বিশেষ পরিভাষা। সে অনুযায়ী রাসূলে করীমের যে কথা, যে কাজের বিবরণ কিংবা কথা ও কাজের সমর্থন ও অনুমোদন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত, ইসলামী পরিভাষায় তাহাই ‘হাদীস’ নামে অভিহিত হয়।

‘হাদীস’কে আরবী ভাষায় ‘খবর’ ও বলা হয়। কিন্তু পার্থক্য এই যে, ‘খবর’ শব্দটি হাদীস অপেক্ষা ব্যাপক অর্থবোধক। ‘খবর’ যুগপৎভাবে হাদীস ও ইতিহাস উভয়কেই বুঝায়।[৬****************************]

নবী করীমের কথা, কাজ, সমর্থন-অনুমোদন এবং তাঁহার অবস্থার বিবরণকে ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করা কোন মনগড়া ব্যাপার নয়। কুরআন মজীদে ইহার অকাট্য প্রমাণ বিদ্যমাণ। আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন যে নিখিল মানুষের জন্য এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত, তাহাতে সন্দেহ নাই। কুরআন মজী এই ‘দ্বীন’কে আল্লাহর নিয়ামতরূপে ঘোষণা করা হইয়াছে এবং নিয়ামতের প্রচার ও প্রকাশ করাকে ‘তাহদীস’ (বর্ণনা করা, প্রচার ও প্রকাশ করা) বলা হইয়াছে।

আল্লাহর নিয়ামতসমূহ সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমাদের প্রতি আল্লাহর দেয়া নিয়ামত স্মরণ কর এবং তোমাদিগকে নসীহত করার উদ্দেশ্যে যে কিতাব ও যে বুদ্ধি-বিচক্ষণতা অবতীর্ণ করা হইয়াছে, তাহাও স্মরণ কর।

দ্বীন-ইসলামকে পূর্ণ ও পরিণত করার প্রসঙ্গেও আল্লাহ তা’আলা উহাকে একটি নিয়ামত বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। ইরশাদ করা হইয়াছেঃ

****************************************************** (সূরা-আল মায়েদা-৩)

আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ পরিণত করিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমর (দেয়া) নিয়ামত সম্পূর্ণ ও সমাপ্ত করিয়া দিলাম।

পূর্বোক্ত আয়াতদ্বয়ে দ্বীন-ইসলাম তথা কুরআন মজীদকে সুস্পষ্ট ভাষায় ‘আল্লাহর নিয়ামত’ বলিয়া ঘোষলা করা হইয়াছে। এই নিয়ামতের বর্ণনা ও প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতেঃ

****************************************************** (সূরা- আল ফাজর-১১)

তোমরা আল্লাহর নিয়ামতের বিবরণ দাও- প্রচার ও বর্ণনা কর। [আল্লামা বায়জীদ এই আয়াতের তাফসীরে লিখিয়াছেনঃ ******************************************************

‘এখানে নিয়মিত বলিতে নবুয়্যাতে বুঝানো হইয়াছে এবং তাহদীস করা অর্থ উহার প্রচার করা।

আল্লামা আ-লুসী লিখিয়াছেনঃ

‘নিয়ামত অর্থ কুরআন’ এ কথা অনেকেই বর্ণনা করিয়াছেন।]

এই দৃষ্টিতেই হযরত মুহাম্মদ (স) নবী ও রাসূল হিসাবে যে সকল কথা বলিয়াছেন ও যে সব কাজ করিয়াছেন, তাহার ভাষাগত বিবরণকে ইসলামী পরিবাষায় বলা হইয়াছে ‘হাদীস’। শুধু তাহাই নয়, তাঁহার সম্মুখে কোন সাহাবী কোন কথা বলিলে বা কোন কাজ করিলে তাহা যদি তিনি সমর্থন অনুমোদন করিয়া থাকেন অথবা উহার কোন প্রতিবাদ না করিয়া থাকেন, তাবে উহার বিবরণও ‘হাদীস’ নামেই অভিহিত হইবে। কেনন্ নবী করীম (স) সত্য ও ন্যায়ের প্রচার, প্রতিষ্ঠা এবং সকল অন্যায় ও মিথ্যার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার দায়িত্ব লইয়াই দুনিয়ায় আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার সম্মুখে কোন মিথ্যা ইসলাম বিরোধী-ইসলামী ভাবধারার বিপরীত-উক্তি বা কাজ করা হইবে আর তিনি উহার প্রতিবাদ করিবেন না- তাহা হইতে সাহাবীদের বিরত রাখিবেন না; বরং নির্বাক ও নিস্তব্ধ হইয়া থাকিবেন, এ কথা ধারণা পর্যন্ত করা যায় না। আর বস্তুতই তাহা সম্ভবও নয়।

দ্বিতীয়ত অন্যায় ও পাপ অনুষ্ঠিত হইতে দেখিয়া চুপ ও নিষ্ত্রিুয় হইয়া থাকিলে রাসূলের মূল কর্তব্যই অসম্পাদিত থাকিয়া যায়। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

 (সূরা আল-মায়েদা: আয়াতঃ ৬৭)               يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ ۖ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ

হে রাসূল, তোমার আল্লাহর নিকট হইতে তোমর প্রতি যাহা নযিল হইয়াছে, তাহা যথাযথরূপে পৌঁছাইয়া দাও, যদি তাহা না কর তবে তুমি আল্লাহর রিসালত পৌঁছাবার দায়িত্বই পালন করিলে না।

ইবনে জরীর তাবারী এই পর্যায়ে ইবনে জায়েদের একটি গুরত্বপূর্ণ কথা উদ্ধৃত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এই কথা বলা হইত যে, নবী করীম (স) যদি ওহীর মাধ্যমে নাযিল হওয়া কোন জিনিস গোপন করিতে চাহিতেন, তবে তিনি তাঁহার নিজের ‘ক্রটি’ সম্পর্কে অবতীর্ণ সূরা ‘আবাসা ওয়া-তাওয়াল্লা’কে অবশ্যই গোপন করিতেন। [৮****************************************************** ]

বস্তুত নবী করীমের সুরক্ষীত জীবন কাহিনী অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, তিনি জীবনের সংকটপূর্ণ মুহূর্তেও নবুয়্যতের দায়িত্ব পালন করিতে এবং অহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ আল্লাহর কালামকে যথাযথরূপে লোক-সমক্ষে প্রচার করিতে বিন্দুমাত্রও ক্রটি করেন নাই। এই ব্যাপারে তিনি কখনো উপেক্ষা বা দুর্বলতাও প্রদর্শন করেন নাই। ইসলামী দাওয়াতের সূচনায় ইসলাম প্রচারের অভিযান পরিত্যাগ করিলে সেরা সুন্দরী নারী, বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ ও আরবের নিরংকুশ রাজত্ব লাভের প্রলোভনকেও তিনি অম্লান বদনে ও তীব্র ঘৃণা সহকারে প্রত্যাখ্যান করেন। [৯******************************************************] অতএব তিনি কোন মুহূর্তেই যে দ্বীন প্রচার বন্ধ করিতে পারেন নাই, অন্যায়ের প্রতিবাদ হইতে বিরত থাকেন নাই এবং কোন ভূল ও ক্রটি কাহারো মধ্যে দেখিতে পাইলে উহার সংশোধন না করিয়া নিরস্ত হন নাই, তাহাতে একবিন্দু সন্দেহ থাকিতে পারে না। এই কারণে তাঁহার নিজের কথা, কাজ এবং তিনি যে কথা বা কাঝ সমর্থন করিয়াছেন- প্রতিবাদ করেন নাই, তাহার বিবরণ ‘হাদীস’ নাম অভিহিত হইয়াছে।

রাসূলের সম্মুখে সাহাবী কোন কাজ করিলে বা কোন কথা বলিলে তিনি যদি উহার প্রতিবাদ না করিয়া থাকেন, তবে উহার শরীয়াত সম্মত হওয়া সম্পর্কে সাহাবীগণ সম্পূর্ণ একমত ছিলেন এবং হযরতের এই সমর্তন অনুমোদন ও মৌনতাবলম্বনও কোন বিষয়ে শরীয়াতের নির্দেষ জানিবার জন্য অন্যতম সূত্ররূপে গণ্য হইত। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারে। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) আল্লাহর নামে ‘হলফ’ করিয়া কোন কথা বলিলে মুহাম্মদ ইবনুল মুনকাদের আপত্তি জানাইলেন। বলিলেনঃ

******************************************************

আপনি আল্লাহর নাম করিয়া হলফ করিতেছেন?

উত্তরে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

আমি হযরত উমরকে নবী করীম (স)- এর সম্মখে আল্লাহর নামে হলফ করিতে শুনিয়াছি, কিন্তু নবী করীম (স) তাহা অপছন্দ করেন নাই, উহার প্রতিবাদ করেন নাই।[১০********************************************]

হাদীসের সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে প্রামাণ্য গ্রন্হাবলী হইতে কতকগুলি উক্তি এখানে উদ্ধৃত করা যাইতেছে। ইহা হইতে বিষয়টি অধিকতর স্পষ্ট হইবে।

ইমাম সাখাভী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

অভিধানে ‘হাদীস’ (নূতন) ‘কাদীম’ (পুরাতন)-এর বিপরীত অর্থবোধক। আর মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় (হাদীস বলিতে বুঝায়) রাসূলের কথা, কাজ, সমর্থন-অনুমোদন এবং তাঁহার গুণ; এমন কি জাগরণ ও নিদ্রাবস্থায় তাহার গতিবিধিও ইহার অন্তর্ভুক্ত।[১১****************************************************** ]

বুখারী শরীফের ভূমিকায় বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

হাদীস এমন জ্ঞান, যাহার সাহায্যে নবী করীম (স)-এর কথা, কাজ এবং তাঁহার অবস্থা জানা যায়।[১২**********]

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী ও নওয়াব সিদ্দীক হাসান লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইলমে হাদীস এমন বিশেষ জ্ঞান, যাহার সাহায্যে নবী করীম (স)- এর কথা কাজ ও অবস্থা জানিতে পারা যায়। [১৩************* রাসূলের কথা বলিতে বুঝায় ************ তাঁহার আরবী ভাষায় উচ্চারিত কথা। ইহা বিভিন্ন প্রকারের হইতে পারে। তাঁহার কাজ বলিতে বুঝায়ঃ**************************************]

মিশাকাতুল মাসাবীহ গ্রন্হের ভূমিকায় শাহ আবদূল আজীজ (র) লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

পূর্বকালের মনীষিগণ সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের মুখের কথা ও কাজের বিবরণ এবং তাঁহাদের ফতোয়াসমূহের উপর ‘হাদীস নাম ব্যবহার করিতেন। আর দুইটি স্বতন্ত্র সূত্রে বর্ণিত একটি বিবরণকে তাঁহারা দুইটি হাদীস গণনা করিতেন। [১৪****************************************************** ]

নওয়াব সিদ্দীক হাসান (র)- ও এই কথাই বলিয়াছেন। তিনি হাদীসের সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অনুরূপভাবে সাহাবীর কথা, কাজ ও সমর্থন এবং তাবেয়ীর কথা, কাজ ও সমর্থনকেও হাদীস নামে অভিহিত করা হয়।[১৫****************************************************** ]

তবে পার্থক্য এই যে, তিনি ইহাতে তাবে-তাবেয়ীগণের কথা ও কাজের বিবরণকে ‘হাদীস’ বলেন নাই। কিন্তু সাহাবা ও তাবেয়ীগণের ন্যায় তাবে-তাবেয়ীনের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণও যে কুরআন হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং বাস্তব রূপায়ণের দৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় জিনিস, তাহাতে সন্দেহ নাই। হাদীস ও তাফসীরের কিতাবসমূহে এই ধরনের প্রামাণ্য যে সব কথা সাহাবী, তাবেয়ী এ তাবে-তাবেয়ীন হইতে বর্ণিত হইয়িাছে, তাহাকেও এক সঙ্গে হাদীসের পর্যায়ে গণ্য করা হইয়াছে। যদিও ঐসবের পারিভাষিক নাম বিভিন্ন। প্রসিদ্ধ হাদীসবিদ হাফেয সাখাভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘অনুরূপভাবে সাহাবা তাবেয়ীন ও অন্যান্য (তাবে-তাবেয়ী) –র আ-স-র ও ফতোয়াসমূহের প্রত্যেকটিকে পূর্ববর্তী মনীষিগণ ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করিতেন’। [১৬******]

অন্যকথায়, নবী করীম (স) সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ী এ তাবে-তাবেয়ীনের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণ যদিও মোটামুটিভাবে ‘হাদীস’ নামে অভিহিত হইয়া থাকে- কেননা এই সকলের কথা-কাজ সমর্থন একই মূল বিষয়কে কেন্দ্র করিয়াই চলিত; কিন্তু তবুও শরীয়াতী মর্যাদার দৃষ্টিতে এই সবের মধ্যে পার্থক্য থাকায় প্রত্যেকটির জন্য স্বতন্ত্র পরিভাষা নির্ধারণ করা হইয়াছে। যথা নবী করীমের কথা, কাজ ও সমর্থনকে বলা হয় ‘হাদীস’। সাহাবীদের কথা, কাজ ও সমর্থনকে বলা হয় আ-সা-র ((اثارএবং তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণকে বলা হয় ‘ফতোয়া’। কারণ কুরআন ও হাদীসের মূলকে ভিত্তি করিয়াই তাঁহাদের এই সব কাজ সম্পন্ন হইত। [এই তিন প্রকারের হাদীসের আরও তিনটি স্বতন্ত্র পারিভাষিক নাম রহিয়াছে; যথাঃ রাসূলের কথা, কাঝ ও সমর্থনের বিবরণকে বলা হয় মারফূ; সাহাবীদের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণকে বলা হয় মওকুফ এবং তাবেয়ীদের কথা, কাজ ও সমর্থনকে বলা হয় মকতু।

مقد مة صحيح بخارى ص -13]

 

হাদীস ও সুন্নাত

হাদীসের অপর নাম হইতেছে ‘সুন্নাত’। ‘সুন্নাত শব্দের অর্থ হইল চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি। ইহা ফিকাহশাস্ত্রে প্রচলিত ও উহাতে ব্যবহৃত ‘সুন্নাত’ নহে।

ইমাম রাগেব লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘সুন্নাতুন্নবী’ বলিতে সে পথ ও রীতি-পদ্ধতি বুঝায়, যাহা নবী করীম (স) বাছাই করিয়া লইতেন ও অবলম্বন করিয়া চলিতেন। [১৮****] ইহা কখনো ‘হাদীস’ কখনো শব্দের সমার্থকরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ‘তা-জুল মাছাদির’ গ্রন্হে লিখিত হইয়াছেঃ

******************************************************

‘সুন্নাত’ অর্থ পথ নির্ধারণ। ‘মুয়ায তোমাদের জন্য পথ নির্ধারণ করিয়াছেন’।

এই হাদীসে ‘সুন্নত’ শব্দ এই অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে। [*********১৯]

অন্য কথায় নবী করীম (স)-এর প্রচারিত যে উচ্চতম আইন বিধান (Supreme Law) আল্লাহ তা’য়ালার মত ও মর্জি প্রমাণ করে, প্রকাশ করে, তাহাই সুন্নত। আর কুরআনের ভাষায় ****** ‘মহান আদর্শ’ বলিতে এই জিনিসকেই বুঝানো হইয়াছে।রাসূলে করীমের যে ‘মহানতম আদর্শ’ অনুসরণ করিতে আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিয়াছেন, তাহা এই হাদীস হইতেই জানিতে পারা যায়। এই কারণে মুহাদ্দিসগণ- বিশেষ করিয়া শেষ পর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ- ‘হাদীস’ ও ‘সুন্নাত’ কে একই অর্থে ব্যবহার করিয়াছেন। [২০*********]  বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

‘সুন্নাত’ শব্দটি রাসূলের কথা, কাজ ও চুপ থাকা এবং সাহাবীদের কথা ও কাজ বুঝায়। [২১*********]

আল্লামা আল-জাজায়েরী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘সুন্নাত’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাসূলের নামে কথিত কথা, কাজ ও সমর্থন বুঝায়। ইহা বিশেষজ্ঞদের মতে হাদীসের সমার্থবোধক।[২২***********]

আল্লামা আবদুল আজীজ আল-হানাফী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘সুন্নাত’ শব্দটি দ্বারা রাসূলের কথা ও কাজ বুঝায় এবং ইহা রাসূল ও সাহাবীদের অনুসৃত বাস্তব কর্মনীতি অর্থেও ব্যবহৃত হয়। [২৩***********]

সফীউদ্দীন আল-হা’লী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘সুন্নাত’ বলিতে বুঝায় কুরআন ছাড়া রাসূলের সব কথা, কাজ ও সমর্থন অনুোদন। [২৪************]

এই পর্যায়ে মোট কথা হইল, ‘সুন্নাত’ শব্দটি সম্পর্ণরূপে ও সর্বতোভাবে ‘হাদীস’ শব্দের সমান নয়। কেননা ‘সুন্নাত’ হইল রাসূলের বাস্তব কর্মনীতি, আর ‘হাদীস’ বলিতে রাসূলের কাজ ছাড়াও কথা ও সমর্থন বুঝায়। [এই কারণে ইলমে হাদীসেও বলা হয়ঃ সুফিয়ান সওরী হাদীসের ইমাম, আওজায়ী সুন্নাতের ইমাম, হাদীসের ইমাম নহেন। আর মালিক ইবনে আনাস উভয়ের ইমাম। *****************]

 

হাদীসের বিষয়বস্তু

হাদীসের বিষয়বস্তু কি? কি বিষয় লইয়া উহাতে প্রধানত আলোচনা হইয়াছে? এ বিষয়ে ইলমে হাদীসের বিশেষজ্ঞ সকল মনীষীই একমত হইয়া লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইলমে হাদীসের বিষয়ব্সুত বাআলোচ্য বিষয় হইল রাসূলে করীম (স)- এর মহান সত্তা এ হিসাবে যে, তিনি আল্লাহ তা’য়ালার রাসূল।[২৬ ********************]

অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহ তা’য়ালার মনোনীত ও প্রেরীত ব্যক্তি-রাসূল হিসাবেও এই পদমর্যাদায় অীভষিক্ত থাকিয়া যাহা কিছু বলিয়াছেন, যাহা কিছু করিয়াছেন, যাহা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়াছেন, সমর্থন জানাইয়াছেন তাহা এবং এ সবের মাধ্যমে রাসূলে-করীমের যে মহান সত্তা বিকশিত ও উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে তাহাই ইলমে হাদীসের বিষয়বস্তু। হাদীসে এই সব বিষয়ই আলোচিত হইয়াছে এবং হাদীস পাঠ করিলে তাহা হইতে এব বিষয়ই জানিতে পারা যায়। রাসূলে করীমের জীবনব্যাপী বলা কথা, কাজ , সমর্থন এবং সাধনা সংগ্রামের বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য বিবরণও জানিবার একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য উপায় হইতেছে হাদীস।

বস্তুত হাদীস কোন সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ, একদেশদর্শী ও ক্ষুদ্র পরিসর সম্পদ নহে। ইহা মূলতই অত্যন্ত ব্যাপক ও বিপুল ভাবধারা সমন্বিত, বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (স) এর মহান নেতৃত্বে আরবভূমিতে যে বিরাট বিপ্লবী আন্দোলন উত্থিত হইয়াছিল তাহার সম্যক ও বিস্তারিত রূপ হাদীস হইতেই সুপরিস্ফুট হইয়া উঠে। রাসূল জীবনের পূর্ণাঙ্গ কাহিনী, তাঁহার ও সাহাবায়ে কিরামের বিপ্লবাত্মক কর্মতৎপরতা, তাদনীন্তন সমাজ সভ্যতা ও আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁহার ব্যাপক ও মৌলিক সংশোধনীর এবং সাধিত সংস্কারের বিবরণও হাদীসের মধ্যেই সামিল।

হাদীসের এ ব্যাপকতা অনস্বীকার্য, ইহার যথার্থতা হৃদয়ঙ্গম করাও কিছুমাত্র কঠিন নহে। পূর্বকালের মনীষিগণও হাদীসের এ ব্যাপক রূপ বুঝিতে পারিয়াছেন। ইমাম বুখারী সংকলিত হাদীসি গ্রন্হ বুখারী শরীফ নামে খ্যাত হইলেও উহার আসল ও পূর্ণাঙ্গ নাম হইলঃ

******************************************************

রাসূলে করীমের কার্যাবলী ও তাঁহার সমসাময়িক যুগের সমস্ত অবস্থা ও ব্যাপারসমূহের বিশুদ্ধ সনদযুক্ত বিবরণের ব্যাপক সংকলন। [২৭****************]

হাদীসের অধ্যয়নের উদ্দেশ্য ও সার্থকতা

হাদীস অধ্যয়নের উদ্দেশ্য কি? কি লক্ষ্য লইয়া হাদীস অধ্যয়ন করা কর্তব্য এবং উহার অধ্যয়নের সার্থকতাই বা কি, ইহাও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী প্রমুখ মনীষী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

উভয় কালের চরম কল্যাণ লাভই হইতেছে হাদীস অধ্যয়নের সার্থকতা।[২৮**********]

নওয়াব সিদ্দীক হাসান লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইহকাল ও পরকালের পরম কল্যাণ লাভই হইতেছে হাদীস অধ্যয়নের লক্ষ্য।[২৯**************]

আল্লামা কিরমানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

‘কুরআনের পরে সকল প্রকার জ্ঞানের মধ্যে সর্বাধিক উন্নত, উত্তম এবং তথ্য ও তত্ত্বসমৃদ্ধ শ্রেষ্ঠ সম্পদ হইতেছে ইলমে হাদীস। ইহা এই কারণে যে উহার দ্বারাই আল্লাহর কালামের লক্ষ্য ও তাৎপর্য জানিতে পারা যায় এবং আল্লাহর যাবতীয় হুকুম-আহকামের উদ্দেশ্যও উহা হইতেই বুঝিতে পারা যায়। যেহেতু কুরআনের অধিকাংশই-এবং সবই-মোটামুটি ও নীতিকথা মাত্র. আর তাহা হইতে কেবল এজমালী কথাই জানিতে পারা যায়। [৩০]

মোটকথা হাদীষ হইল একটি সভ্যতার পতন এবং এক নবতর সভ্যতার অভ্যুদয়, উত্থান ও প্রতিষ্ঠালাভের ইতিহাস। এ দৃষ্টিতেই হাদীস অধ্যয়ন আবশ্যক।

হাদীসের সংজ্ঞাভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ

হাদীসের উল্লিখিত সংজ্ঞা হইতে উহার তিনটি প্রাথমিক বিভাগ সুপরিস্ফুট হইয়া উঠে। তাহা হইতেছেঃ রাসূলের মুখ নিঃসৃত কথা, তাঁহার নিজের কাজ ও আচরণ এবং তাঁহার সম্মখে অনুমোদনপ্রাপ্ত কথা ও কাজের বিবরণ। সমস্ত হাদীসই এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত। কিন্তু উহার বাস্তব গুরুত্ব, প্রয়োগ ও ব্যবহারিক মূল্যের দৃষ্টিতে এই তিন পর্যায়ের হাদীসের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। সর্বপ্রথম স্থান হইল রাসূলের কথার-কোন বিষয়ে রাসূল যাহা নিজে বলিয়াছেন ইসলামী জীবন ব্যবস্থঅর ইহাই প্রথম উৎস। ইহাকে বলা হজয় রাসূলের ‘কাওলী হাদীস’–(*************) ‘কথামূলক হাদীস’, যাহাতে রাসূলের নিজের কোন কথা উদ্ধৃত হইয়াছে।

দ্বিতীয় ভাগে হযরতের নিজস্ব কাজ-কর্ম ও আচার-আচরণের বিবরণ। রাসূল (স) যে দ্বীন ইসলাম লইয়া আসিয়াছিলেন, বাস্তবিক পক্ষে তিনি তাহা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করিয়াছেন, সে অনুযায়ী প্রত্যেকটি কাজ আঞ্জাম দিয়াছেন। তাঁহার কাজ ও চরিত্রের ভিতর দিয়াই ইসলামের যাবতীয় বিধিবিধান ও রীতিনীতি সুপরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহার একটি কাজও ইসলামী শরীয়াতের বিপরীত হইতে পারে নাই। এই কারণে তাঁহার প্রতিটি কাজই ইসলামী শরীয়াতের ভিত্তিরূপে গণ্য হইবার যোগ্য। আর যো হাদীসে রাসূলের রাসূল হিসাবে করা কোন কাজের বিবরণ উল্লিখিত হইয়াছে তাহাকে বলা হয় ‘ফে’লী হাদসী’ (*******)।

আর তৃতীয় হইল রাসূলে করীম (স) এর নিকট অনুমোদন ও সমর্থনপ্রাপ্ত (সাহাবাদের০ কথা ও কাজ। কেননা পূর্বেই বলা হইয়াছে, হযরতের সম্মুখে ইসলামী শরীয়াতের বিপরীত কোন কথা বলা হইলে বা কোন কাজ করা হইলে রাসূল (স) উহার প্রতিবাদ বা নিষেধ না করিয়া পারেন নাই। এই ধরনের কোন কথা বা কাজের বিবরণ হইতেও শরীয়াতেরে দৃষ্টিভঙ্গী নিঃসন্দেহে জানিতে পারা যায়। অতএব ইসলামী শরীয়াতের ইহাও একটি উৎস। যে হাদীসে এই ধরনের কোন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, তাহা হইতেছে ‘তাকরীরী হাদীস] (**********)।

এখানে বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য করিয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে এই তিন পর্যায়ের তিনটি হাদীস উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ

******************************************************

হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন; হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ ফাসিক ব্যক্তির প্রশংসা ও স্তুতি করা হইলে আল্লাহ তা’য়ালা অসন্তুষ্ট ও ক্রুব্ধ হন এবং এই কারণে আল্লাহর আরধ কাঁপিয়া উঠে। (বায়হাকী)

ইহাতে রাসূলের একটি বিশেষ কথার উল্লেখ হওয়ার কারণে ইহাকে বলা হয় ‘কাওলী হাদীস’।

******************************************************

হযরত আবূ মূসা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি রাসূলে করীম (স)- কে মোরগের গোশত খাইতে দেখিয়াছে। (বুখারী ও মুসলিম)

এই হাদীসে রাসূলের একটি কাজের বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। এজন্য ইহা ‘ফে’লী হাদীস’।

******************************************************

হযরত ইবনে আবূ আওফা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমরা রাসূলে করীম (স)- এর সঙ্গে মিলিয়া সাতটি লড়াই করিয়াছি। আমরা তাঁহার সঙ্গে থাকিয়া জারাদ (ফড়িং জাতীয় চড়ই) খাইতাম। (বুখারী ও মুসলিম)

ইহা ‘তাকরীরী হাদীস’।

 

বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে হাদীসের প্রকারভেদ

বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে হাদীস কয়েক প্রকারের রহিয়াছে। ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ হাদীস তিন প্রকারের। কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত যেসব বিষয়ে নবী করীম (স) নিজ ভাষায় ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ দান করিয়াছেন তাহা প্রথম প্র্রকারের হাদীস। কুরআন মজীদে মোটামুটি ও অবিস্তৃতভাবে অনেক আইন ও বিধানের উল্লেখ রহিয়াছে, রাসূলে করীম (স) তাহার বিস্তৃত রূপ পেশ করিয়াছেন ও উহার ব্যাখ্যা দিয়াছেন। অনেক সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট বিষয়কে তিনি মুসলিমদের সম্মুখে নিজ ভাষায় বিস্তারিত ও সুস্পষ্টরূপে তুলিয়া ধরিয়াছেন।ইহা দ্বিতীয় প্রকারের হাদীস। আর তৃতীয় প্রকারের হইতেছে সেসব হাদীস, যাহাতে রাসূলে করীম (স) কুরআনে অনুল্লিখিত অনেক বিষয়ের উল্লেখ করিয়াছেন। এই তিন প্রকারের হাদীস যেহেতু আল্লাহর নিকট হইতে রাসূলে করীমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লব্ধ জ্ঞানের আকর, সে কারণে ইহা সবই কুরআনের মতই নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাস্য। [কিতাবুর রিসালা-ইমাম শাফেয়ী (র)]

এই পর্যায়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর আলোচনার সারাংশ নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ

নবী করীম (স) হইতে বর্ণিত ও হাদীস-গ্রন্হসমূহে সংকলিত হাদীসসমূহ শরীয়াতী হুকুম গ্রহণের দৃষ্টিতে দুই প্রকারের। রিসালাতের বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য রাসূলে করীম (স) যত কথাই বলিয়াছেন, তাহা প্রথম প্রকারের। ‘রাসূল যাহা দেন তাহা গ্রহণ কর এবং যাহা হইতে নিষেধ করেন, তাহা হইতে বিরত থাক’- আয়াতটিতে এ প্রকারের হাদীস সম্পর্কেই আল্লাহর নির্দেশ ঘোষিত হইয়াছে। পরকাল ও মালাকুতী জগতের আশ্চর্যজনক বিষয়াদি ও ঘটনাবলী সম্পর্কে রাসূল (স) যাহা বলিয়াছেন, তাহাও এই প্রকারের হাদীস। এই হাদীসসমূহ ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান হইতে নিঃসৃত। শরীয়াতের বিধি-বিধান, ইবাদতের নিয়ম-প্রণালী এবং সমাজ ও জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থাপনার ব্যাখ্যা ও উহার পালনের জন্য উৎসাহ দান সম্পর্কিত হাদীসসমূহও এই পর্যায়ের। তবে উহা কিছু অংশ সরাসরি ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত এবং কিছু অংশ স্বয়ং নবী করীমের ইজতিহাদ।অবশ্য নবী করীম (স)-এর রায় কখনো ভুলের উপর স্থায়ী হইয়া থাকিতে পারিত না। তাঁহার ইজতিহাদ আল্লাহর হুকুমের উপরই ভিত্তিশীল হইবে, ইহার কোন প্রয়োজন নাই। কেননা প্রায়ই এমন হইত যে, আল্লাহ তা’য়ালা তাঁহার নবীকে শরীয়াতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ জানাইয়া দিতেন; শরীয়াত প্রণয়ন, উহার সহজতা বিধান ও আদেশ-নিষেধ নির্ধারণের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিতেন; নবী ওহীসূত্রে জানা এই আইন ও নিয়ম অনুযায়ী ওহীর সূত্রে লব্ধ উদ্দেশ্যাবলীর ব্যাখ্যা দান করিতেন। যেসব যুক্তিপূর্ণ ও কল্যাণময় বিষয় বিনা শর্তে পেশ করিয়াছেন, যাহার কোন সময় বা সীমা নির্দিষ্ট করা হয় নাই –যেমন উন্নত ও খারাপ চরিত্র-ইহাও রিসালাতের দায়িত্ব পালন পর্যায়ের  এবং ইহার অধিকাংশই ওহীর উৎস হইতে গৃহীত। তাহা এই অর্থে যে, আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলকে সমাজ ও জনকল্যাণের নিয়ম-কানুন জানাইয়াদিয়াছেন, নবী সে নিয়ম-কানুন হইতে যুক্তি বা দলিল গ্রহণ করিয়াছেন এবং উহাকে মূলনীতি হিসাবে পেশ করিয়াছেন। আমলসমূহের ফযীলত, আমলকারীদের গুণ ও প্রশংসামূলক হাদীসও এই পর্যায়ে গণ্য। আমার মতে ইহার আধিকাংশই ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত, আর কিছু অংশ তাঁহার ইজতিহাদের ফসল। দ্বিতীয় প্রকারের হাদীস রিসালাতের দায়িত্ব পালন পর্যায়ের নহে। রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি একজন মানুষ মাত্র, অতএব তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে আমি যখন কোন জিনিসের আদেশ করি, তখন তাহা তোমরা গ্রহণ করিও- পালন করিও। আর যদি আমার নিজের মতে কোন কাজের আদেশ করি তবে মনে রাখিও, আমি একজন মানুষ মাত্র।

এ বাণীতে রাসূলে করীম (স) দ্বিতীয় প্রকারের হাদীসের কথাই বুঝাইয়াছেন। মদীনার মুসলমানদিগকে অত্যাধিক ফসল লাভের আশায় পুরুষ খোরমা গাছের ডাল স্ত্রী খোরমা গাছের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিতে দেখিয়া নবী করীম (স) ‘উহা না করিলে কোন ক্ষতি হইবে না’ বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

তোমরা ইহা না করিলে সম্ভবত ভালই হইত।

কিন্তু ইহা না করার দরুন পরবর্তী বছর অত্যন্ত কম পরিমাণে ফসল উৎপন্ন হয়। তখন নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘আমি একটা ধারণা পোষণ করিতাম, এবং তাহাই তোমাদিগকে বলিয়াছিলাম (ধারণার ভূল হইলে) তোমরা সেজন্য দোষ ধরিও না। কিন্তু আমি যখন আল্লাহর তরফ হইতে কোন কিছু বর্ণনা করি, তখন তোমরা তাহা অবশ্যই গ্রহণ করিবে। কেননা আমি আল্লাহর সম্পর্কে কোন মিথ্যা কথা বলি না’। [এই কয়টি হাদীসই মুসলিম শরীফের ২য় খণ্ডের ২৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হইয়াছে।

****************************************************** ]

চিকিৎসা ও দ্রব্যগুণ ইত্যাদি সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহাও এই পর্যায়ের। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হালকা সাদা কপোল বিশিষ্ট গাঢ় কৃষ্ণ ঘোড়া তোমরা অবশ্যই রাখিবে।

ইহা রাসূলের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আলোকে বলা কথা।

রাসূল (স) অভ্যাসবশত যাহা করিতেন- ইবাদত হিসাবে নয় কিংবা যাহা ঘটনাবশত করিয়াছেন- ইচ্ছামূলকভাবে নয়, তাহার কোন শরীয়াতী ভিত্তি নাই। হযরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা)-এর নিকট একদল লোক হাদীস শ্রবণের ইচ্ছ প্রকাশ করিলৈ তিনি বলিয়াছেনঃ ‘আমি রাসূলের প্রতিবেশী ছিলাম। তাঁহার প্রতি যখন ওহী নাযিল হইত তখন আমাকে তিনি ডাকিয়া পাঠাইতেন, আমি গিয়া তাহা লিখিয়া লইতাম। তাঁহার অভ্যাস ছিল, আমরা যখন দুনিয়ার বিষয় আলোচনা করিতাম, তখন তিনিও আমাদের সাথে দুনিয়ার কথা বলিতেন। আর যখন পরকালের কথা বলিতাম, তিনিও আমাদের সাথে পরকালের কথা বলিতেন। আমরা যখন খানাপিনার কথা বলিতাম তিনিও আমাদের সাথে তাহাই বলিতেন। এখন আমি কি তোমদিগকে রাসূলের এইসব হাদীস বলিব? এ কথাটি এ প্রসঙ্গেই উল্লেখযোগ্য।

এতদ্ব্যতীত রাসূলের সময়কালীন আংশিক কল্যাণের জন্য অনেক ব্যবস্থা প্রদান করা হইয়াছিল। সমস্ত মানুষের জন্য তাহা কোন চিরন্তীন বিধান ছিল না। ইহার দৃষ্টান্ত এইঃ যেমন কোন বাদশাহ এক সৈন্যবাহিনী সজ্জিত করিয়া উহার কোন নিদর্শন ঠিক করিয়া দেয়। এই দৃষ্টিতে হযরত উমর ফারূক (রা) বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

রমল করার আমাদের কি প্রয়োজন? ইহা আমরা এমন এক শ্রেণীর লোকদিগকে দেখাইবার জন্য পূর্বে করিতাম, যাহাদিগকে আল্লাহ তা’য়ালা ধ্বংস করিয়াছেন।

কিন্তু পরে তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন যে, ‘রমল’ করার অন্য কারণও থাকিত পারে এবং ইহা কিছুতেই পরিত্যাজ্য নহে।

যুদ্ধের বিশেষ পদ্ধতি এবং বিচার ফয়সালার বিশেষ রীতিনীতি ও ধরণ-ধাারণ সম্পর্কিত হাদীসসমূহও এই পর্যায়ের গণ্য।[হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা, ১ম খণ্ড, ১০২ পৃষ্ঠা হইতে উদ্ধৃত।]

যথাযথভাবে সত্য প্রমাণিত হইবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই। খেজুর গাছ সম্পর্কিত আরব দেশের প্রচলিত নিয়ম সম্পর্কে রাসূলের নিষেধবাণীও এই পর্যায়েরই কথা ছিল। ইমাম নববী এই প্রসঙ্গে আলোচনা করিতে গিয়া লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

বিশেষজ্ঞদের মতে নবীর এই কথা কোন বিষয়ে সংবাদ দানের পর্যায়ভুক্ত ছিল না; বরং ইহা তাঁহার একটি ধারণামাত্র ছিল।যেমন এই প্রসঙ্গের হাদীসসমূহে উল্লেখিত হইয়াছে। তাঁহারা ইহাও বলিয়াছেন যে, বৈষয়িক ব্যাপারে নবী করীমের মত ও ধারণা আন্যান্য মানুষের মত ও ধারণার মতই। কাজেই এইরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়া- অবাস্তব প্রমাণিত হওয়া- কোন অসম্ভব ব্যাপার নহে এবং ইহাতে কোন ক্রটি বা দোষের কারণ নাই।[নববী, শরহে মুসলিম ২য় খণ্ড, ২৬৪ পৃষ্ঠ]

রাসূলের ইজতিহাদ সম্পর্কে এই কথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, যেসব বিষয়ে ওহী নাযিল হয় নাই, সে বিষয়ে রাসূলে করীম (স) ইজতিহাদ করিয়াছেন। এই ইজতিহাদ যদি নির্ভূল হইয়া থাকে, তবে আল্লাহ উহাকে প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর হইতে দিয়াছেন; আর যদি তাহাতে মানবীয় কোন ভূল হইয়া থাকে, তবে আল্লাহ সে বিষয়ে রাসূলকে জানাইয়া দিয়াছেন ও সতর্ক করিয়া দিয়াছেন। কাজেই রাসূলের ইজতিহাদও সুন্নাতের পর্যায়ে গণ্য। হাদীসে এ সব ইজতিহাদের বিবরণ রহিয়াছে। অতএব হাদীস ও রাসূলের ইজতিহাদে কোন মৌলিক পার্থক্য বা বিরোধ নাই।[**************]

কিন্তু দ্বীন ও শরীঅত সম্পর্কিত ব্যাপারে- আকীদা, ইবাদত, নৈতিক চরিত্র, পরকাল, সামাজিক ও তমদ্দুনিক বিষয়ে- রাসূলে করীম (স) যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহা সবই ওহীর উৎস হইতে গৃহীত, তাহা চিরন্তন মূল্য ও স্থায়ী গুরুত্ব স’লিত এবং তাহা কোন সময়ই বর্জনীয় নহে।[হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা, ১ম খণ্ড**********]

 

হাদীসে কুদসী

হাদীসের আর এক প্রকার রহিয়াছে, যাহাকে ‘হাদীসে কুদসী’حديث قدسى    বলা হয়। ‘কুদসী’قدسى‘কুদস’قدسহইতে গঠিত ইহার অর্থ الظهر  পরিত্রতা, মাহনত্ব। আল্লাহর আর এক নাম ‘কুদ্দুস’قدوس  : মহান; পবিত্র। [*******]

এই ধরনের হাদীসকে ‘হাদীসে কুদসী’ বল হয় এইজন্য যে, উহার মূল কথা সরাসরিভাবে আল্লাহর নিকট হইতে প্রাপ্ত। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁহার নবীকে ‘ইলহাম’ কিংবা স্বপ্নযোগে যাহা জানাইয়া দিয়াছেন, নবী নিজ ভাষায় সে কথাটি বর্ণনা করিয়াছেন। উহা কুরআন হইতে পৃথক জিনিস। কেননা কুরআনের কথা ও ভাষা উভয়ই আল্লাহর নিকট হইতে ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ। প্রখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাতা আল্লাম মুল্লা আলী আল-কারী ‘হাদীসে কুদসী’র সংজ্ঞা দান প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

হাদীসে কুদসী সেসব হাদীস, যাহা শ্রেষ্ঠ বর্ণনাকারী পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল পরম নির্ভরযোগ্য হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর নিকট হইতে বর্ণনা করেন, কখনো জিব্রাঈল (আ) এর মাধ্যমে জানিয়া, কখনো সরাসরি ওহী কিংবা ইলহাম বা স্বপ্নযোগে লাভ করিয়া। যে, কোন প্রকারের ভাষার সাহায্যে ইহা প্রকাশ করার দায়িত্ব রাসূলের উপর অর্পিত হইয়া থাকে। [৩৮************]

আল্লামা আবুল বাকা তাঁহার ‘কুল্লিয়াত’ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

কুরআনের শব্দ, ভাষা, অর্থ, ভাব ও কথা সবই আল্লাহর নিকট হইতে সুস্পষ্ট ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ; আর ‘হাদীসে কুদসী’র শব্দ ও ভাষা রাসূলের; কিন্তু উহার অর্থ, ভাব ও কথা আল্লাহর নিকট হইতে ইলহাম কিংবা স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত।[৩৯**********]

আল্লামা তাইয়্যেবী-ও এই কথা সমর্থন করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

কুরআনের শব্দ ও ভাষা লইয়া জিব্রাঈল (আ) রাসূলে করীমের নিকট নাযিল হইয়াছেন। আর ‘হাদীসে কুদসী’র মূল কথা ইলহাম বা স্বপ্নযোগে আল্লাহ তাহা জানাইয়া দিয়াছেন। (এইজন্য হাদীসে কুদসী আল্লাহর কথারূপে পরিচিত হইয়াছে) কিন্তু এতদ্ব্যতীত অন্যান্য হাদীসকে আল্লাহর কথা বলিয়া প্রচার করেন নাই এবং তাঁহার নামেও সে সবের বর্ণনা করেন নাই।[৪০********]

কুরআন ও হাদীসে কুদসীর পার্থক্য

কুরআন ও হাদীসে কুদসীর মধ্যে যে পার্থক্য রহিয়াছে, তাহা নিম্নরূপঃ

ক) কুরআন মজীদ জিব্রাঈলের মাধ্যম ছাড়া নাযিল হয় নাই, উহার শব্দ ও ভাষা নিশ্চিতরূপে ‘লওহে মাহফুয; হইতে অবতীর্ণ। উহার বর্ণনা পরস্পরা মুতাওয়াতির, -অবিচ্ছিন্ন, নিশ্চিত ও নিঃসন্দেহ; প্রত্যেক পর্যায়ে ও প্রত্যেক যুগে।

খ) নামাযে কেবল কুরআন মজীদই পাঠ করা হয়, কুরআন ছাড়া নামায সহীহ্ হয় না, আর কুরআনের পরিবর্তে হাদীসে কুদসী পড়িলেও নামায হয় না।

গ) ‘হাদীসে কুদসী’ অপবিত্র ব্যক্তি হায়েয নিফাস সম্পন্ন নারীও স্পর্শ করিতে পারে, কিন্তু কুরআন স্পর্শ করা ইহাদের জন্য হারাম।

ঘ) হাদীসে কুদসী কুরআনের ন্যায় ‘মুজিযা’ নহে।

ঙ) হাদীসে কুদসী অমান্য করিলে লোক কাফির হইয়া যায় না- যেমন কাফির হইয়া যায় কুরআন অমান্য করিলে।[৪১***********]

শায়খ মুহাম্মদ আলী ফারুকী হাদীসকে দুই ভাগে ভাগ করিয়াছেন। এক, হাদীসে নববী- রাসূলে করীমের হাদীস; এবং দুই হাদীসে ইলাহী- আল্লাহর হাদীস। আর ইহাকেই বলা হয়, ‘হাদীসে কুদসী’। তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘হাদীসে কুদসী’ তাহা, যাহা নবী করীম (স) তাঁহার আল্লাহ তা’য়ালার তরফ হইতে বর্ণনা করেন, আর যাহা সেরূপ করেন না, তাহা হাদীসে নববী। [৪২************]

‘হাদীসে কুদসী’ কুরআন নয়; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ইহাতে আল্লাহর কুদসী জগতের মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণ মিশ্রিত রহিয়াছে। উহাও গায়েবী জগত হইতে আসা এক ‘নূর’। মাহন প্রতাপসম্পন্ন আল্লাহর দাপটপূর্ণ ভাবধারা উহাতেও পাওয়া যায়। ইহাই ‘হাদীসে কুদসী’। ইহাকে ‘ইলাহী’ বা ‘রব্বানী’ ও বলা হয়। [৪৩************]

প্রাচীনকালের হাদীস গ্রন্হাবলীতৈ হাদীসে কুদসীর বর্ণনা হয় এই ভাষায়ঃ

******************************************************

নবী করীম (স) আল্লাহর তরফ হইতে বর্ণনা করিতে গিয়া বলিয়াছেন...........

আর পরবর্তীকালের মুহাদ্দিগণ ইহা উদ্ধৃত করিয়াছেন এই্ ভাষায়ঃ

******************************************************

আল্লাহ বলিয়াছেন- যাহা নবী করীম (স) তাঁহার নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেন........।

বলা বাহুল্য, এই উভয় ধরনের কথার মূল বর্ণনাকারী একই এবং তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)।[৪৪***********]

সনদ ও মতন

হাদীসের মূল কথাটুকু যে সূত্রে ও যে বর্ণনা পরস্পরা ধারায় গ্রন্হ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌছিঁয়াছে, উহাকে ইলমে হাদীসের পরিভাষায় বলা হয় ‘সনদ’। উহাতে হাদীসের বর্ণনাকারীদের নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে। এইজন্য বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

মূল হাদীস পৌছিঁবার পরস্পরা সূত্রই হইতেছে সনদ।[মুকাদ্দামা আল-হাদীস আল-মুহাদ্দিসূন, ২,৩,৪ পৃষ্ঠা।]

বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

হাদীসের সূত্র- উহার বর্ণনাকারী ব্যক্তিগণের পরস্পরাকে সনদ বলে।

******************************************************

হাদীসের মূল কথা ও উহার শব্দসমূহ হইতেছে ‘মতন’।

শায়খ আবদুল হক লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সনদ সূত্র যে পর্যন্ত পৌছিঁয়াছে উহার পরবর্তী অংশকেই ‘মতন’ বলা হয়।

সনদ বা বর্ণনাকারীদের গুণগত পার্থক্যের দিক দিয়া হাদীসকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম ভাগে সেই সব হাদীস, যাহা ‘হাফেযে মুতকিন’ (নির্ভূলভাবে স্মরণ রাখিতে সক্ষম হাদীসের এমন হাফেয) লোকদের মাধ্যমে বর্ণিত হইয়াছে। দ্বিতীয় সেই সব হাদীস, যাহার বর্ণনাকারী অপ্রসিদ্ধ এবং স্মরণ ও সতর্কতার মধ্যম মানের লোক। আর তৃতীয় হইতেছে সে সব হাদীস, যাহা বর্ণনা করিয়াছে দুর্বল ও গ্রহণ অযোগ্য এবং অগ্রাহ্য লোকেরা। [৪৬*****************]

হাদীসসমূহের সনদভিত্তিক বিভাগ

হাদীসের সনদ- বর্ণনা পরম্পরা ধারা যে স্তর পর্যন্ত পৌছিয়াছে ও তাহা যেভাবে পৌছিঁয়াছে, এই দৃষ্টিতে হাদীসকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করা হইয়াছে এব উহার প্রত্যেকটি ভাগেরে এক একটি পারিভাষিক নাম দেওয়া হইয়াছে। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাইতেছেঃ

১। মারফূঃ যেসব হাদীসের বর্ণনা পরম্পরা রাসূল (স) পর্যন্ত পৌছিঁয়াছে, যে সূত্রৈ মাধ্যমে স্বয়ং রাসূলের কোন কথা, কোন কাজ করার বিবরণ কিংবা কোন বিষয়ের অনুমোদন বর্ণিত হইয়াছে, যে সনদের ধারাবাহিকতা রাসূলে করীম (স) হইতে হাদীস গ্রন্হ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত হইয়াছে এবং মাঝখান হইতে একজন বর্ণনাকারীও উহ্য হইয়া যায় নাই তাহা ‘হাদীসে মারফূ’حديث نرفوع  নামে পরিচিত।

ইমাম নববী উহার সংজ্ঞা দিয়াছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

******************************************************

‘মারফূ’ সেই হাদীস, যাহা বিশেষভাবে রাসূলের কথা-তিনি ছাড়া অপর কাহারো কথা নয়-বলিয়া বর্ণিত’।[৪৭********]

ইবনে সালাহ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

যে কথা রাসূলের, অপর কাহারো নয়-কোন সাহাবীরও নয়, তাহাই ‘হাদীসে মারফূ’ নামে পরিচিত।[৪৮********]

দৃষ্টান্ত দ্বারা ইহা স্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইবে। যেমন কোন সাহাবী বলিলেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-কে এইরূপ বলিতে শুনিয়াছি-

এইরূপ বর্ণনাসূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ ‘হাদীস মারফূ কাওলী’ নামে পরিচিত।

কিংবা কোন সাহাবী বলিলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-কে এইরূপ করিতে দেখিয়াছি।

ইহা ‘হাদীসে ‘মারফূ ফে’লী’ নামে পরিচিত। কেননা ইহা সাহাবীর বর্ণনাতে নবী করীমের কোন কাজের বিবরণ পেশ করে।

বা কোন সাহাবী বলিলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-এর উপস্থিতিতে এইরূপ কাজ করিয়াছি কিন্তু তিনি ইহার প্রতিবাদ করেন নাই।

ইহা ‘হাদীসে মারফূ ‘তাকরীরী’ নামে পরিচিত। নবী করীমের সামনে কোন কাজ করার এবং তাঁহার নিষেধ না করার কথা বলা হইয়াছে এই হাদীসে।

২।   যে সব হাদীসের বর্ণনাসূত্র (সনদ) ঊর্ধ্বদিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌছিয়েঁছে-কোন সাহাবীর কথা কিংবা কাজ বা অনুমোদন যেসব সনদসূত্রে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা ‘হাদীসে মওকুফ’ নামে অভিহিত। ইমাম নববী ইহার সংজ্ঞা দিয়াছেন এই ভাষায়ঃ

******************************************************

যাহাতে কোন সাহাবীর কথা বা কাজ কিংবা অনুরূপ কিছু বর্ণিত হয়- তাহা পরপর মিলিত বর্ণনাকারীদের দ্বারা বর্ণিত হউক কিংবা মাঝখানে কোন বর্ণনাকারীর অনুপস্থিতি ঘটুক- তাহা ‘মওকুফ হাদীস’।

৩।   যে সনদসূত্রে কোন তাবেয়ী’র কথা, কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়, তাহা ‘হাদীসে মকতু’ নামে পরিচিত। ইমাম নববী বলিয়াছেন **************** তাবেয়ী পর্যন্ত যাহার সূত্র পৌছিঁয়াছে, তাহাই ‘হাদীসে মকতু’।[৪৯**********]

৪।   যেসব হাদীসের সনদে উপর হইতে নিচ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা পূর্ণরূপে রক্ষিত হইয়াছে, কোন স্তরেই কোন বর্ণনাকারী উহ্য হয় নাই, উহাকে ‘হাদীসে মুত্তাসিল’ ********** বলা হয়।

৫।   যেসব হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় নাই, মাঝখানের কোন বর্ণনাকারী যদি উহ্য বা লুপ্ত হইয়া থাকে, তাহাকে ‘হাদীসে মুনকাতা’حديث منقطع   বলা হয়। [৫০************]

হাদীস বর্ণনাকারীদের নিজস্ব গুণ-পার্থক্যের দৃষ্টিতেও হাদীসের কতকগুলো বিভাগ হইয়া থাকে এবং উহাদের প্রত্যেকটিরই এক-একটি পারিভাষিক নাম দেওয়া হয়। যথাঃ

১।   যে হাদীসের বর্ণনাসূত্র ধারাবাহিক রহিয়াছে, সনদের প্রত্যেক স্তারের বর্ণনাকারীর নাম সঠিকরুপে উল্লিখিত হইয়াছে, বর্ণনাকারিগণ সর্বতোভাবে বিশ্বস্ত- সিকাহ, যাহাদের স্মরণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর এবং যাঁহাদের সংখ্যা কোন স্তরেই মাত্র একজন হয় নাই, এইরূপ হাদীসকে পরিভাষায় ‘হাদীসে সহীহ’ ********* বলা হয়।

ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

যে হাদীসের সনদ নির্ভরযোগ্য ও সঠিকরূপে সংরক্ষণকারী বর্ণনাকরীদের সংযোজনে পরম্পরাপূর্ণ ও যাহাতে বিরল ও ক্রটিযুক্ত বর্ণনাকারী একজনও নাই, তাহাই ‘হাদীসে সহীহ’।[৫১********]

২।   উপরিউক্ত সকল গুণ বর্তমান থাকার পর বর্ণনাকারীদের স্মরণ-শক্তি যদি কিছুটা দুর্বল প্রমাণিত হয়, তবে সেই হাদীসের পারিভাষিক নাম ‘হাদীসে হাসান’ (********)।

ইহার সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

যে হাদীসের উৎস সর্বজনজ্ঞাত ও যাহার বর্ণনাকারীগণ প্রখ্যাত, তাহাই হাদীসে হাসান।[৫২**********]

৩।   উপরিউক্ত সবরকমের গুণই যদি বণনাকারিদের মধ্যে কম মাত্রায় পাওয়া যায়, তবে তাহাদের বর্ণিত হাদীসকে ‘হাদীসে যয়ীফ’ *********** বলা হয়।

ইমাম নববী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যাহাতে সহীহ্ ও হাসান হাদীসের শর্তসমূহ পাওয়া যায় না তাহাই ‘যয়ীফ হাদসী’।[৫৪*******]

বর্ণনাকারীদের সংখ্যাভিত্তিক হাদীস বিভাগ

হাদীসের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা সকল ক্ষেত্রে একই রূপ হয় নাই। বিভিন্ন হাদীসে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা বিভিন্ন হইয়াছে। এই দিক দিয়া হাদীসের কয়েকটি বিভাগ এবং প্রত্যেকটি বিভাগের এক একটি পারিভাষিক নাম রহিয়াছে। এইখানে এই বিভাগগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ উল্লেখ করা যাইতেছে।

১।   মুতাওয়াতির (*****) যে হাদীসের সনদের সকল স্তরেই বর্ণনাকারীদের সংখ্যা এত বেশী যে, তাঁহাদের সকলের একত্রিত হইয়া মিথ্যা কথা রচনা বা বলা স্বভাবতই অসম্ভব বলিয়া মনে হয়, এইরূপ হাদীসকে ‘হাদীসে মুতাওয়াতির’ বলা হয়। যেমন হাদীস ******************** সকল আমলের মূল্যায়ন নিয়ত অনুযায়ীই হয়। এই হাদীসটি সাত শতেরও অধিক সনদসূত্রে বর্ণিত হইয়াছে।[ ৩-شرح النخبة ص  মুহাদ্দিসগণ সাধারণত ‘মুতাওয়াতির’ হাদীসকে এই পারিভাষিক নামে অভিহিত করেন না। কেননা কোন হাদীসের ‘মুতাওয়াতির’ হওয়াটা সনদের আলোচনা পর্যায়ে গণ্য হয় না। তাহার কারণ এই যে, সনদশাস্ত্রে সাধারণত হাদীসের ‘সহীহ’ বা ‘যয়ীফ’ হওয়ার ব্যাপারটিই আলোচ্য- যেন হয় তদনুযায়ী আমল করা যায়, না হয় যেন উহা ত্যাগ করা যায়। উপরন্তু মুতাওয়াতির হাদীসের বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয় না। তদনুযায়ী আমল করা আলোচনা ব্যতিরেকেই ওয়াজিব। علوم الحديث ومصطله وشرح النخبة ج-3 ص- 150   ]

২। খবরে ওয়াহিদ (***********) যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা ও সনদ ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস অপেক্ষা কিছুটা কম, তাহা ‘খবরে ওয়াহিদ’। এই ধরনের হাদীস তিন প্রকারের হইয়া থাকেঃ

ক.   সাহাবীদের পরবর্তী স্তরসমূহের কোন স্তরে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা যদি তিনজন হইতে কম না হয়, তবে তাহা ‘হাদীসে মশহুর’ (*************)।

খ.   কোন স্তরেই যদি বর্ণনাকারীদের সংখ্যা দুইজনের কম না হয়, তবে তাহা ‘হাদীসে আযীয’ (**********)।

গ.   কোন স্তরে যদি বর্ণনাকারীদের সংখ্যা মাত্র একজন হয়, তবে সেই হাদীস ‘ হাদীসে গরীব’ (*************) নামে পরিচিত।

 

জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল সূত্র

জ্ঞান এবং বিদ্যার অর্থই হইতেছে অজানাকে জানা। যাহা অজ্ঞাত, যাহা মানুষের জ্ঞান-সীমার বহির্ভূত, তাহা জানিয়া লওয়া এবং উহার সকল দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়াকেই বলা হয় জ্ঞান। বস্তুর জ্ঞান ও বিদ্যা হইতেছে আলো। আলোর স্ফুরণেই অন্ধকারের অবসান। জ্ঞান ও বিদ্যা মানব-মনের অজ্ঞতার পুঞ্জীভূত অন্ধকার বিদূরিত করিয়া দেয়, অন্তঃকরণকে করে আলোকোজ্জ্বল, জ্ঞানের মহিমায় সুষমামণ্ডিত।

কিন্তু কতগুলি তত্ত্ব ও তথ্যের সমারোহই জ্ঞান নয়। নির্ভরযোগ্য ও সংশয়াতীত সূত্রে লব্ধ সত্য তত্ত্ব ও তথ্যই হইতেছে প্রকৃত জ্ঞান। যে তত্ত্ব ও তথ্য সত্যভিত্তিক নয় এবং যাহা নির্ভযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত নয়, তাহা সংশয়াপন্ মানসলোককে মেঘমুক্ত করিতে পারে না, তাহা যেমন মানুষের কোন কল্যাণ সাধন করিতে পারে না, তেমনি ‘জ্ঞান’ নামে অভিহিত হওয়ারও সম্পূর্ণ অযোগ্য। এইরূপ জ্ঞানের উপর নির্ভর করিয়াজীবন-পথে পদবিক্ষেপ করা এবং অকুন্ঠিত চিত্তে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় না। এই জন্য এমন জ্ঞান ও বিদ্যা মানুষের জন্য প্রয়োজন, যাহা সর্বতোভাবে সত্য ও নির্ভরযোগ্য, অকাট্য ও নিশ্চিত সূত্রে প্রাপ্ত। এইরূপ জ্ঞানই মানুষের মন ও মগজকে নিঃসংশয়, দৃঢ়-নিশ্চিত ও আলোকোদ্ভাসিত করিয়া তোলে। জীবন-পথের প্রতিটি বাঁক- প্রত্যেকটি চরাই-উতরাই পর্যন্ত দৃষ্টিপথে সমুদ্ভাসিত করিয়া দেয়। এইরূপ জ্ঞান ব্যতীত আমাদের না জৈব জীবন সঠিকরূপে চলিতে পারে, না মানুষ হিসাবে দুনিয়ায় বসবাস করা সম্ভব হয়।

কিন্তু এইরূপ জ্ঞান মানুষ কোথায় পাইবে? কোন সূত্রে এইরূপ জ্ঞান লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব? ইহা এক কঠিন প্রশ্ন। এই সম্পর্কে একটু গভীরভাবেই আমাদিগকে বিচার-বিবেচনা ও আলোচনা-পর্যালোচনা করিয়া দেখিতে হইবে।

নির্ভূল, অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য জ্ঞান-অর্জনের জন্য মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই যেসব উপায় ও সূত্র দান করা হইয়াছে, তন্মধ্যে বাহ্যিক ও প্রাথমিক সূত্র হইতেছে মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয়। কিন্তু এই পঞ্চেন্দ্রিয় একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই মানুষের জন্য পরিধির সমাপ্তি। উহার বহির্ভূত কোন জ্ঞানই মানুষকে দেওয়া সাধ্যাতীত। উপরন্তু পঞ্চেন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞান যে সর্বতোভাবে নির্ভূল ও সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত, তাহা নিশ্চঢ করিয়া বলা সম্ভব নয়। ইহা মানুষকে অনেক সময় নিতান্ত ভূল তথ্য পরিবেশন করে, মানুষকে প্রতারিতও করে কখনো কখনো। মানুষ রোগাক্রান্ত হইলে তাহার রুচিবিকৃতি ঘটে, মুখ বিস্বাদ হইয়া যায়, মিষ্টি হইয়া যায় তিক্ত। দ্রুতগতিশীল রেলগাড়ীর আরোহীর দৃষ্টি প্রতারিত হয়, দুই পার্শ্বের স্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান দৃশ্যাবলী বিপরীত দিকে দুরন্ত বেগে ধাবমান বলিয়া মনে হয়। চলমান জাহাজ মনে হয় স্থির, দণ্ডায়মান। এক বিন্দু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সরল ঋজু-পথে তীব্র গতিতে ছুটিয়া চলিলে উহা একটি একটানা জ্বলন্ত অগ্নিরেখা বলিয়া মনে হইবে, আর বৃত্তাকারে চলিলে মনে হইবে একটি অগ্নিবৃত্ত। দূর ঊর্ধ্বলোকরে বৃহদায়তন নক্ষত্ররাশিকে ক্ষুদ্রাকায় ও মিটমিট করা ক্ষীণ দ্বীপশিখা বলিয়া মনে হওয়া একটি সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু তাহা প্রকৃত পক্ষেও কি সেইরূপ?

মানুষের জ্ঞানার্জনের দ্বিতীয় সূত্র হইতেছে অন্তর্নিহিত বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, চিন্তা-গবেষণা, যুক্তির ভিত্তিতে বিচার-বিবেচনা। ইহা মূলত প্রথম পর্যায়ের জ্ঞান-সূত্র লব্ধ তথ্যের ভিত্তিতেই জ্ঞা পরিবেশন করে। সংগৃহীত তথ্যের উপর অজনা জ্ঞানের প্রাসাদ নির্মাণ করে। আয়ত্তাধীন তথ্যবস্তু জগত হইতে সংগৃহীত হইলে উহার ভিত্তিতে লব্ধ জ্ঞান অনেকটা সন্দেহ বিমুক্ত হইতে পারে। আর বস্তু বিজ্ঞানের (Physical Science) মূল ক্ষেত্রে ইহাই। কিন্তু বস্তু-অতীত তথ্যভিত্তিক জ্ঞান নিছক ধারণা অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। যাবতীয় মানব-রচিত মতাদর্শ ও দর্শন ইহারই উৎপাদন। ইহা যেমন সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত নয়, তেমনি ইহাতে মতবৈষম্য সৃষ্টিরও যথেষ্ট অবকাশ বিদ্যমান। আধুনিক দার্শনিক চিন্তাধারা ও মতাদর্শ এই কারণেই চরমভাবে দুর্দশাগ্রস্ত।

বসউতু জগতের সহিত সম্পর্কহীন যে জ্ঞান, তাহার স্থান ইহার পর। ইহা যদিও বস্তু-অতীত জ্ঞান, তথাপি ইহা বস্তুনিষ্ঠ মন ও মগজের সূক্ষ্ম দর্পণের উপরই প্রতিফলিত ও প্রতিবিম্বিত হয়। প্রথম পর্যায়ের জ্ঞান যেমন প্রত্যক্ষ্যভাবে বস্তু নির্ভর, এই দ্বিতীয় পর্যায়ের জ্ঞানও তেমনি মানুষের মন ও আধ্যাত্মিক শক্তির সহিত সংশ্লিষ্ট।

এই শেষোক্ত জ্ঞানসূত্রের কয়েকটি স্তর রহিয়াছে- ফিরাসত, (Insight observation) হদস্, (Conjecture) কাশফ, ইলহাম ও ওহী। ফিরসাত অর্থ দূরদৃষ্টি অন্তদৃষ্টি- ইহা একটি স্বভাবজাত প্রতিভা। ইহার সাহায্যে যে সব কথাবার্তা বলা হয়, সাধারণ মানুষের মনে তাহা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ইহার পর ‘হদস’। ইহা একান্তুভাবে মানস চর্চা ও মননশীলতার ফল, যাকে আরা বলি প্রজ্ঞা। কাশফ অর্থ উদঘাটন, কোন অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে অন্তর্লোকে জ্ঞানের স্ফূরণ হওয়াই হইল ‘কাশফ’। ইহার উত্তম দৃষ্টান্ত স্বপ্ন। তবে পার্থক্য এই যে, স্বপ্ন নিদ্রার মধ্যে সম্ভব; কিন্তু ‘কাশফ’ হয় জাগ্রত ও সচেতন অবস্থায়। ‘ইলহাম’ অর্থ, মনে কোন জ্ঞানে সঞ্চার হওয়া। কোন চেষ্ট যত্ন ব্যতীতই মানসপটে জ্ঞানের আলো জ্বলিয়া উঠা। ‘ওহী’ এই পর্যায়ের সর্বোচ্চ জ্ঞানসূত্র। লোকচক্ষুর অন্তরালে অদৃশ্য উপায়ে ব্যক্তিকে বিশেষ কোন লোকাতীত ও সন্দেহমুক্ত জ্ঞান দানই হইতেছে ‘ওহী’। জ্ঞানলাভ ও তত্ত্ব পরিবেশনের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক উপায় এবং জ্ঞান সূত্রের নির্ভরযোগ্য সর্বশেষ সীমা ইহাই।

 

ওহী

‘ওহী’ সম্পর্কে ব্যাপক ও প্রমাণ্য আলোচনা আবশ্যক। প্রামাণ্য গ্রন্হাবলী হইতে ‘ওহী’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এখানে পেশ করা যাইতেছে।

‘ওহী’ শব্দের আভিধানিক অর্থ নিম্নরূপঃ

******************************************************

‘ওহী’ অর্থ ইশারা করা, কিছু লিখিয়া পাঠানো, কোন কথাসহ লোক প্রেরণ, গোপনে অপরের সহিত কথা বলা, অপরের অজ্ঞাতসারে কাহাকেও কিছু জানাইয়া দেওয়া।[৫৬****************]

আবূ ইসহাক লুগভী বলেনঃ

******************************************************

সকল অভিধানেই ‘ওহী’ অর্থ গোপনে কিছু জানাইয়া দেওয়া’।

ইমাম রাগেব ইসফাহানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘ওহী’ অর্থ দ্রুত গতিশীল ইশারা, ইঙ্গিত; ইহা ইশার-ইঙ্গিতে কথা বলা দ্বারাও সম্পন্ন হইতে পারে। ইহা এমন শব্দেও হইতে পারে যাহার কোন সঠিক রূপ নাই। আবার ইহা অঙ্গের ইশারা বা লিখনীর সাহায্যেও হইতে পারে।[৫৭**************]

কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ

***********************************************

তখন আল্লাহ তাহাদিগকে ইংগিত বলিলেন যে, সকাল ও সন্ধ্যায় তসবীহ কর।[সূরা মরিয়ম, ১১ আয়াত]

আল্লাহর যে বাণী নবীগণের মানসপটে নিক্ষেপ করা হয় তাহাকেও ‘ওহী’ বলা হয়।

শায়খ আবদুল্লাহ সারকাভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘ওহী’ অর্থ ‘জানাইয়া দেওয়া’। আর শরীয়াতের পরিভাষায় ওহী হইল- আল্লাহ তাঁহার নবীগনকে কোন বিষয়ে কথা বলিয়া বা ফেরেশতা পাঠাইয়া কিংবা স্বপ্নযোগে অথবা ইলহামের সাহায্যে জানাইয়া দেওয়া। এই শব্দটি ‘আদেশ দান’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়।[৫৯**********]

বস্তুত ওহীর নিগূঢ় তত্ত্ব ও প্রকৃত রহস্য কি, তাহা আল্লাহ ছাড়া আর কেহই সঠিকরূপে জানেন না। আভিধানিক, ধর্ম বিজ্ঞান বিশারদ ও দার্শনিকগণ ইহার সংজ্ঞা দিতে ও ইহার তাৎপর্য ও পরিচয় বর্ণনা করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। তাহা হইতে ‘ওহী’ সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ও মোটামুটি ধারণা সহজেই জন্মে। শায়খ বু’আলী সীনা এই প্রসংগে যাহা বলিয়াছেন, তাহা আল্লামা আবুল বাকা’র ভাষায় নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ

******************************************************

আমরা ইন্দ্রিয় শক্তির সাহায্যে দ্রব্যাদি দেখিয়া থাকি, নবী অভ্যন্তরীণ ও অন্তর্নিহিত শক্তির সাহায্যে দেখেন। আমরা প্রথমে দেখি, তাহার পর সে সম্পর্কে জানিতে পারি। আর নবী প্রথনেই জানিতে পারেন, তাহার পর দেখেন। [৬০**********]

নবী করীমের প্রতি নিম্নলিখিত উপায়ে ওহী নাযিল হইতঃ

১।   সত্য স্বপ্নঃ নবুয়্যাত লাভের প্রথম পর্যায়ে নবী করীম (স) স্বপ্ন দেখিতে পাইতেন এবং তাঁহার এই স্বপ্ন অত্যন্ত ভাল হইত। প্রত্যেকটি স্বপ্নই নির্ভূল, সত্য ও বাস্তব প্রমাণিত হইত। হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ

******************************************************

রাসূলের প্রতি ওহী নাযিল হওয়া শুরু হয় সর্বপ্রথম নিদ্রাোযোগে ভাল ভাল স্বপ্নের মাধ্যমে। এই সময় তিনি যে স্বপ্নই দেখিতেন, তাহাই প্রভাত-আলোর মত বাস্তবে প্রতিফলিত হইত। [৬১**********]

মুসলিম শরীফের বর্ণনায় ********** ‘ভাল স্বপ্ন’-এর পরিবর্তে *********** ‘সত্য স্বপ্ন’ উল্লিখিত হইয়াছে।[৬২***********]

২।   দিলের পটে উদ্রেক হওয়াঃ একটি হাদীসে নবী করীম (স)-এর এই কথাটি উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

******************************************************

জিব্রাঈল ফেরেশতা আমার মনের পটে এই কথা ফুকিয়া দিলেন যে, নির্দিষ্ট রিযিক পূর্ণরূপে গ্রহণ করা ও নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল পূর্ণ হওয়ার আগে কোন প্রাণীই মরিতে পারে না।[৬৩************]

এই হাদীসে ‘আমার মনের পটে ফুকিয়া দিলেন’ কথাটি ওহী নাযিল করার এক বিশেষ পন্হার নির্দেশ করে। আল্লামা ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

এই আয়াত হইতে ওহী নাযিল হওয়ার বিভিন্ন পন্হার অস্তিত্ব জানা যায়। ‘আল্লাহ তা’য়ালা কখনো কখনো নবী করীমের অন্তর্লোকে কোন কথা জাগ্রত করিয়াদিতেন যাহা আল্লাহর নিকট হইতে আসা সম্পর্কে কোন সন্দেহ করা যাইতে পারে না।[৬৪*************]

৩।   ঘন্টার ধ্বনির মত শব্দে ওহী নাযিল হওয়াঃ হযরত আয়েশা (রা) হযরত হারিস ইবনে হিশাম (রা) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি নবী করীম (স)-কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

আপনার নিকট ওহী কিভাবে নাযিল হয়?

ইহার জওয়াবে নবী করীম (স) ইরশাদ করেনঃ

******************************************************

কখনো ওহী আমার নিকট প্রচণ্ড ঘন্টার ধ্বনির মত আসে। ইহা আমার উপর বড় কঠিন ও দুঃসহ হইয়া থাকে। পরে ওহীর তীব্রতা ও প্রচণ্ডতা আমার উপর হইতে কাটিয়া যায়। এই অবসের যাহা বলা হইল তাহা সবই আমি আয়ত্ত ও মুখস্থ করিয়ালই।[৬৫*************]

এই কথা হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, সর্বপ্রকারের ওহীই অত্যন্ত দুঃসহ ব্যাপার হইলেও তন্মধ্যে এই প্রকারের ওহী রাসূলের উপর সর্বাধিক মাত্রায় দুঃসহ হইয়া পড়িত। এই প্রকারের ওহী সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি লৌহ ঘন্টার ধ্বনি শুনিতে পাই, তখন আমি চুপচাপ বসিয়া থাকি। এইরূপ ওহী যখনই নাযিল হয়, তখনই আমার মনে হয় যেন আমার জান কবজ হইয়া যাইবে।

এইরূপ অবস্থায় রাসূলৈর দেহ হইতে অজস্র ধারায় ঘর্মস্রোত প্রবাহিত হইত। কঠিন শীত ও প্রচণ্ড ঠাণ্ডার সময়ও ইহার ব্যতিক্রম হইত না। তখন কোন শক্তিশালী উষ্ট্রের পৃষ্ঠে আরোহী থাকিলেও উহা প্রচণ্ড চাপ অনুভব করিয়া বসিয়া পড়িত।

আল্লামা কিরমানী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইহা হইতে জানা গেল যে, রাসূলের প্রতি যখন ওহী নাযিল হইত, তখন তিনি খুব বেশী কষ্ট ও তীব্র চাপ অনুভব করিতেন এবং তাঁহার প্রতি যাহা নাযিল হইত, উহার দুর্বহ ভাবে এক দুঃসহ যন্ত্রণা তাঁহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিত। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁহার নিম্নোক্ত বানীতে ইহাই বলিয়াছেনঃ শীঘ্রই আমি তোমার উপর এক ভারি কথা নাযিল করিব। [৬৬************]

৪।  ফেরেশতা কোন এক ব্যক্তির বেশে রাসূলের নিকট উপস্থিত হইতেন এবং আল্লাহর নিকট হইতে প্রেরিত বাণী পৌঁছাইয়া কিংবা নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করিয়া চলিয়াযাইতেন। নবী করীম (স) নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কখনো ফেরেশতা কোন ব্যক্তির রূপ ধারণ করিয়া আমার নিকট আসেন, তিনি আমার সহিত কথা বলেন এবং যাহ বলেন তাহা আমি ঠিকভাবে আয়ত্ত করিয়া লই। [বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড, ১ম পৃষ্ঠা]

প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে, ফেরেশতা বিশেষভাবে হযরত দাহিয়া কালবী নামক সাহাবীর রূপ ধারণ করিয়া আগমন করিতেন। ইহার কারণ সম্পর্কে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অন্যান্য সাহাবীদের পরিবর্তে বিশেষভাবে দাহিয়া কালবীর রূপ ধারণ করিয়া ফেরেশতা আগমন করার কারণ এই যে, তিনিই সে সময়ের লোকদের মধ্যে সর্বাধক সুশ্রী সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট ছিলেন।[৬৮***********]

নিতান্ত অপরিচিত ব্যক্তির বেশে ফেরেশতার আগমন এবং জরুরী কথা পৌঁছাইয়া দেওয়ার বিবরণও হাদীসে উল্লিখিত হইয়াছে। হযরত আবূ হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিক এক দীর্ঘ বিবরণের শেষে রাসূল (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এই ব্যক্তি জিব্রাঈল, জনগণকে তাহাদের দ্বীন শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে আসিয়াছেন।[মুসলিম শরীফ, ১ম খণ্ড, ২৯ পৃষ্ঠা ববীসহ।]

৫। জিব্রাঈল (আ)-এর নিজের ছবি-সুরত ও আকার-আকৃতি সহকারে রাসূলে করীম (স)-এর সম্মুখে উপস্থিত হওয়া ও ওহী পৌঁছাইয়া দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হইয়াছে। বুখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত প্রথম ওহী নাযিল হওয়া সম্পর্কিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

অতঃপর তাঁহার নিকট ফেরেশতা আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং বলিলেনঃ পড়।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, ১ম পৃষ্ঠা।]

দ্বিতীয়বারে ফেরেশতা দর্শনের বিবরণ রাসূলে করীম (স)- এর নিজস্ব ভাষায় নিম্নরূপঃ

******************************************************

আমি পথ চলিতেছিলাম, হাঠাৎ ঊর্ধ্বদিক হইতে একটি আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। আকাশের দিকে চোখ তুলিয়া তাকাইতেই দেখিতে পাইলাম সেই ফেরেশতা, যিনি ইতিপূর্বে হেরা গুহায় আমর নিকট আসিয়াছিলেন, তিনি আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে একটি আসনে উপবিষ্ট। অতঃপর আল্লাহ তা’য়ালা সূরা মুদ্দাসসির নাযিল করেন।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, ৭৩৩ পৃষ্ঠা]

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, কুরআন মজীদ সম্পূর্ণ এই প্রকারের ওহীর মাধ্যমে নাযিল হইয়াছে। কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

এই কুরআন নিঃসন্দেহে রাব্বুল আলামীন আল্লাহরই নাযিল করা, ইহা লইয়া জিব্রাঈল আমীন নাযিল হইয়াছে এবং ইহা (হে নবী) তোমার হৃদয়ের উপর অবতীর্ণ হইয়াছে, যেন তুমি লোকদের ভয় প্রদর্শন কারী হও। [এই আয়াতে ‘রুহুল আমীন’ বলিতে যে হযরত জিব্রাঈলকে বুঝানো হইয়াছে, তাহাতে দ্বিমত নাই। **********]

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী এই প্রসংগে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও নিরবিচ্ছিন্ন বর্ণনা ধারা উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করিতেছে যে, আমাদের নবী করীমের প্রতি কুরআন লইয়া যিনি আসিতেন, তিনি হইলেন হযরত জিব্রাঈল (আ) যে সবসময়ই শুধু কুরআন লইয়া আসিতেন, তিনি হইলেন হযরত জিব্রাঈল (আ)। এই ব্যাপারে কোন অস্বীকৃতি বা প্রতবাদ কেহই জানায় নাই, কেহ একবিন্দু দ্বিমতও পোষণ করে নাই।[৭৩***********]

বস্তুত জিব্রাঈল (আ) ফেরেশেতার মাধ্যমেই কুরআন মজীদ নাযিল হইয়াছে, ইহা সর্ববাদীসম্মত ও অকাট্য। কিন্তু জিব্রাঈল (আ) যে সবসময়ই শুধু কুরআন লইয়া আসিতেন, কুরআন ছাড়া দ্বীন-ইসলামের অপর কোন কথা লইয়া আসিতেন না, তাহাও কিছুমাত্র ঠিক নহে। কেননা হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনায় স্পষ্ট  দেখা যায়, তিনি স্বরূপে আল্লাহর নিকট হইতে রাসূলে করীমের নিকট উপস্থিত হইয়াছেন; কিন্তু কুরআনের কোন আয়াত বা সূরা লইয়া আসেন নাই, আসিয়াছেন দ্বীন-ইসলাম সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়াদি পেশ করার উদ্দেশ্যে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে একটি হাদীস উল্লেখ করা যাইতেছে।

হযরর উমর ফারূক (রা) বলেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) যখন ‘আকীকা’ নামক উপত্যকায় অবস্থান করিতেছিলেন, তখন তাঁহাকে এই কথা বলিতে শুনিয়াছি, তিনি বলিতেছিলেনঃ আমার নিকট বিগত রাত্রে আল্লাহর নিকট হইতে একন আগমনকারী আসিয়াছেলেন এবং আমাকে বলিয়াছেনঃ এই বরকতপূর্ণ উপত্যকায় নামায পড় এবং বল যে, ইহা ‘হজ্জ’ কালীন ‘উমরা’।[৭৪*************]

এই হাদীসে ‘আগমনকারী’ বলিয়া নবী করীম (স) যে হযরত জিব্রাঈলকেই বুঝাইয়াছেন, তাহা সুস্পষ্ট। কিন্তু তিনি কুরআনের কোন আয়াত লইয়াআসেন নাই এবং নবী করীম (স)- কে কুরআনের কোন আয়াতও শোনাইয়া যান নাই। বরং তিনি আসিয়া ‘কেরান’ ধরনের ‘হজ্জ’ জায়েয হওয়া সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ জানাইয়া গিয়াছেন। কিন্তু এই কথা কুরআনে সন্নিবেশিত হয় নাই। কুরআনে ‘হজ্জে কেরা’- এর কোন উল্লেখও নাই। তাহা হইলে কুরআন নাযিল করা ছাড়াও যে হযরত জিব্রাঈল (আ) কোন দ্বীনী কথা লইয়া রাসূলের নিকট আগমন করিতেন, তাহা প্রমাণিত হইত।

পাচঁখানি প্রধান সহীহ হাদীসের কিতাবের নিম্নোক্ত হাদীসটি উল্লেখ করা হইয়াছে, এই পর্যায়ে তাহাও উল্লেখ্য। হাদীসটি এইঃ

******************************************************

রাসূলৈ করীম (স) বলিয়াছেনঃ আমার নিকট জিব্রাঈল আসিলেন এবং আমার সাহাবিগণকৈ উচ্চস্বরে তাকরীর ও তাহলীল বলিতে আদেশ করার জন্য আমাকে নির্দেশ দিলেন।[৭৫***************]

ইমাম আহমদ ইবনে হা’ল (রা) তাঁহার মুসনাদে এই হাদীসটিকে উল্লেখ করিয়াছেন এই বলিয়াঃ

******************************************************

নবী করীমের নিকট জিব্রাঈল আসিলেন এবং বলিলেন।[৭৬**************]

৬।  পর্দার অন্তারাল হইতে রাসূলে করীমের সাথে স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালার কথা বলা এবং ওহী নাযিল করা। ইহাতে ফেরেশতার মধ্যস্থতার কোন অবকাশ থাকে না। আল্লাহ তা’য়ালা সরাসরিভাবে রাসূলে করীমের অন্তর্লোকে ওহী নাযিল করিয়া দেন। এই পর্যায়ে কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

আল্লাহ কোন লোকের সহিত কথা বলেন না, তবে তিনি ওহী নাযিল করেন কিংবা পর্দার অন্তরাল হইতে কথা বলেন।[ সূরা আশশুরা, ৫১ আয়াত।]

এই আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

 পর্দার অন্তরাল হইতে কথা কথা বলার দৃষ্টান্ত, যেমন মূসা (আ) আল্লাহর সহিত কথাবার্তা বলার পর তিনি তাঁহাকে দেখিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু আল্লাহ দর্শন না দিয়া  পর্দা ফেলিয়া দিলেন।[৭৮*************]

মি’রাজের রাত্রে আল্লাহ তা’আলা রাসূলে করীমের সহিত এইরূপ অন্তরালে থাকিয়াই কথা বলিয়াছিলেন। ইহা রাসূলের সম্পূর্ণ জাগ্রত ও সচেতন অবস্থায় সম্পন্ন হইয়াছিল। রাসূলে করীম (স) নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমাকে যখন মি’রাজে ঊর্ধ্বলোকে লইয়া যাওয়া হইল, তখন আল্লাহ তা’য়ালা আমাকে তাঁহার অতি নিকটবর্তী করিয়া লইলেন। এমন কি শেষ পর্যন্ত তাঁহার ও আমার মাঝে ধনুক ও তীরের মধ্যবর্তী দূরত্বটুকু অবশিষ্ট থাকে কিংবা তাহা হইতেও কম। তখন তিনি বলিলেনঃ ‘হে মুহাম্মদ‍‍!’ আমি বলিলামঃ ‘হে পরোয়ারদিগার, আমি আপনার অতি নিকটেই অবস্থিত’। [৭৯*****************]

নিদ্রিতাবস্থায়ও এইরূপ ‘ওহী’ নাযিল হওয়ার ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে। নবী করীমের নিজের একটি বাণী হইতেই ইহা প্রমাণিত। তিনি ইরশাদ করেনঃ

******************************************************

আল্লাহ আমার নিকট এক উত্তম অনুপমরূপে আগমন করিলেন এবং বলিলেনঃ উচ্চতর জগত (ফেরেশতাকুল) কি বিষয় লইয়া বিতর্ক করিতেছে? [৮০****************]

মোটকথা, অদৃশ্য জগত হইতে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য জ্ঞান লাভের যে সূত্র, কুরআনের পরিভাষায় তাহাকেই বলা হইয়াছে ‘ওহী’। এই সূত্রে নবী রাসূলগণ যে জ্ঞান, তথ্য ও তত্ত্ব লাভ করেন, তাহার প্রতি তাঁহারা নিশ্চিত বিশ্বাসী হইয়া থাকেন। উহার সত্যতা সম্পর্কে তাঁহাদের মনে একবিন্দু উদ্রেক হয় না। এই বিশ্বাস ও সন্দেহহীনতা বস্তুজগত হইতে অর্জিন জ্ঞান অপেক্ষা শত-সহস্র গুণ অধিকতর নিশ্চিত ও দৃঢ় বিশ্বাসযোগ্য। এ উৎসলব্ধ জ্ঞান সম্পর্কেই কুরআন মজীদে উদাত্ত কন্ঠে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

নবী নিেজর ইচ্ছা ও খাহেশমত কোন কথা বলে না, যাহা বলে তাহা অবতীর্ণ ওহী ভিন্ন আর কিছু নহে। [সূরা আন- নাজম, আয়াত ৩-৪।]

কুরআন মজীদ এই ওহী সূত্রে প্রাপ্ত আল্লাহর কালাম। কিন্তু কেবল কুরআন মজীদই এই সূত্রে পাওয়া একমাত্র জ্ঞান সম্পদ নহে; এতদ্ব্যতীত আরো বহু জ্ঞান ও তথ্য সরাসরি কিংবা ফেরেশতার মাধ্যমে নবী লাভ করেন। অবশ্য এ দুই শ্রেণীর জ্ঞানের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রহিয়াছে। কুরআন মজীদ পুরাপুরি আল্লাহর কালাম, অন্যান্য জ্ঞান ও তথ্য আল্লাহর নিকট হইতে ওহীর মাধ্যমে পাওায়া গেলেও তাহা আল্লাহর কালাম নহে। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের জ্ঞান ও তথ্যের উদ্দেশ্য হইতেছে আল্লাহর নিজস্ব কালামা-কুরআন মজীদের নির্ভুল ও সঠিক ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ দান। এ কারণে এই উভয় প্রকারের সবকিছুই; আল্লাহর নিকট হইতেই প্রাপ্ত। এজন্য উহার প্রতিটি অক্ষর, শব্দ ও ভাষা সর্বতোভাবে সুরক্ষিত। উহাতে কোন প্রকার রদবদল বা পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কোন অবকাশ থাকিতে পারে না।

পক্ষান্তরে হাদীসের শব্দ ও ভাষা নহে, কেবলমাত্র ভাব এবং মূল কথাটাই আল্লাহর নিকট হইতে প্রাপ্ত। এ কারণে কুরআন মজীদের সর্বাঙ্গীন সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ তা’য়ালা নিজেই গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাযিল করিয়াছি এবং আমিই উহার সংরক্ষণকারী।[সূরা আল-হিজর, আয়াত ৯।]

কিন্তু কুরআন ব্যতীত ওহী সূত্রে প্রাপ্ত অন্যান্য জ্ঞানের ভাষা ও শব্দ আল্লাহ কর্তৃক সুরক্ষিত নহে, উহার শব্দ ও ভাষা রাসূলের নিজস্ব, উহাকে কুরআনের ন্যায় সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ নিজে গ্রহণ করেন নাই। তাহার উপর বেশি গুরুত্বও আরোপ করা হয় নাই। উহাকে কখানো ‘আল্লাহর বাণী’ ও বলা হয় নাই।

 

হাদীসের উৎস

পূর্বের আলোচনা হইতে একথা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা’আলা বিশ্বনবীল প্রতি যে ওহী নাযিল করিয়াছেন, তাহাই হইতেছে হাদীসের মূল উৎস। আল্লাহর প্রেরিত ওহী প্রধানত দুই প্রকারেরঃ প্রথম প্রকারের ওহীকে বলা হয় ‘ওহী’য়ে মতলু’- সাধারণ পঠিতব্য ওহী’ ইহাকে ওহীয়ে জ্বলীও বলা হয়। আর দ্বিতীয় প্রকারের ওহী ‘ওহীয়ে গায়র মতলূ; নামে পরিচিত। ইহা সাধারণত তিলাওয়াত করা হয় না। ইহার অপর এক নাম ‘ওহীয়ে খফী’–প্রচ্ছন্ন ওহী। ইহা হইতে জ্ঞান লাভ করার সূত্রে এবং এই সূত্রলব্ধ জ্ঞান উভয়ই বোঝানো হয়।

শরীয়াতের মূল ভিত্তি হিসাবে কুরআনের পরেই হাদীসের স্থান। আল্লাহর হেদায়েত ও নির্ভূল নির্ভরযোগ্য সত্য জ্ঞানের যে উৎস হইতে কুরআন মজীদ অবতীর্ণ, হাদীসেও ঠিক সেই উৎস হইতেই নিঃসৃত। কুরআন মজীদের ঘোষণা হইতেই এই কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

হে নবী! আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমাত নাযিল করিয়াছেন এবং তুমি যাহা জানিতেন না, তাহা তোমাকে শিক্ষা দিয়াছেন। [সূরা আন-নিসা, ১১৩ আয়াত।]

এই আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

 আয়াতে উল্লিখিত আল-কিতাব অর্থ কুরআন মজীদ এবং হিকমত অর্থ সুন্নত বা হাদীসে রাসূল (এবং এই উভয় জিনিসই আল্লাহর নিকট হইতে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ।) [তাফসীরে ইবনে কাসীর।]

নবী করীম (স)- এর নিম্নোক্ত বাণীও প্রমাণ করে যে, কুরআন এবং হাদীস উভয়ই একই স্থান ও একই সূত্র হইতে প্রাপ্ত। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমাকে কুরআন দেওয়া হইয়াছে এবং সেই সঙ্গে উহারই মত আর একটি জিনিস।[কাঞ্জুল উম্মাল, -শায়ক আলাউদ্দীন; আবূ দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ।]

‘উহার মত আর একটি জিনিস’ কথাটির অর্থ হাদীস ছাড়া আরি কিছু হইতে পারে না। কেননা দুনিয়ার মানুষ রাসূলে করীম (স)-এর হইতে এই দুইটি জিনিসই লাভ করিয়াছেন।

হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

জিব্রাঈল (আ) হযরতের নিকট সুন্নাত বা হাদীস লইয়া নাযিল হইতেন, যেমন নাযিল হইতেন কুরআন লইয়া এবং তাঁহাকে সুন্নাতও শিক্ষা দিতেন, যেমন শিক্ষা দিতেন কুরআন।[৮৬**********]

হাসন ইবনে আতীয়াতা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স) –এর প্রতি ‘ওহী’ নাযিল হইত এবং হযরত জিব্রাঈল তাঁহা নিকট সুন্নাত লইয়া হাযির হইতেন, যাহা প্রথম প্রকার ওহী কুরআনের-ব্যাখ্যা দান করে। [৮৭***********]

কুরআনের আয়াত ছাড়া শুধু হাদীস লইয়াও হযরত জিব্রাঈল নবী করীমের নিকট উপস্থিত হইতেন, একথা মুসলিম শরীফের একটি হাদীস হইতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। কিতাবুল জিহাদ- এ উল্লেখিত—

******************************************************

হাদীসে আত্মোনিবেদিত নিষ্ঠাবান মুজাহিদের গুনাহ মাফ হওয়া সম্পর্কে এক লম্বা কথা বর্ণনা করার পর রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ

জিব্রাঈল (আ) নিজেই আমাকে এই কথা বলিয়া গেলেন।

এই কথাটি এই পর্যায়ে খুবই স্পষ্ট ও অকাট্য।

বস্তুত নবী করীম (স) দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপারে আল্লাহর নিকট হইতে নির্ভূল জ্ঞান লাভ করার পরই কথা বলিতেন। দ্বীন সম্পর্কিত কোন কথাই িতনি নিজস্ব আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে বলিতেন না। ইহা র বাস্তব প্রমাণ এই যে, তাঁহার নিকট দ্বীন-ইসলাম সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হইলে এবং সে বিষয়ে তাঁহার পূর্ব জ্ঞান না থাকিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই উহার কোন জওয়াব দিতেন না। বরং জিব্রাঈলের মারফতে আল্লাহর নিকট হইতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভের অপেক্ষায় থাকিতেন। তিনি এই উপায়ে যখন জানিতে পারিতেন, তখনই সেই জিজ্ঞাসার জওয়াব দান করিতেন। উহার দুইটি দৃষ্টান্ত পেশ করা যাইতেছেঃ

১। এক ইয়াহুদী পণ্ডিত নবী করীমের নিকট জিজ্ঞাসা করিলঃ পৃথিবীতে উত্তম স্থান কোনটি? ইহার সঠিক জওয়াব উপস্থিতভাবে নবী করীমের জানা ছিল না, সেই কারণে তিনি এই প্রশ্নের জওযাব সঙ্গে সঙ্গেই দিলেন না। পরে জিব্রাঈলেরে আগমন হইলে তিনি তাঁহার নিকট এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। জিব্রাঈল প্রথশত বলিলেনঃ ‘এই বিষয়ে প্রশ্নকারী ও যাহার নিকট প্রশ্ন করা হইয়াছে উভয়ই অজ্ঞ। এই বিষয়ে আল্লাহর নিকট হইতে জানিয়া জওয়াব দেওয়া যাইবে’। দ্বিতীয়বারে জিব্রাঈল আসিয়াবলিলেনঃ হে নবী, আমি এইবার আল্লাহর এতিই নিকটবর্তী হইয়াছি, যতটা আর কখনো হই নাই। আল্লাহ তা’আলা জিজ্ঞাসিত বিষয় সম্পর্কে ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

সর্বোপক্ষো নিকৃষ্ট হইতেছে হাট-বাজারের স্থান এবং সর্বাপেক্ষা উত্তম ও কল্যাণময় স্থান হইতেছে মসজিদসমূহ। [৮৯**************]

হযরত আবূ ইয়ালা একটন সাহাবী ‘ওহী’ কিভাবে নাযিল হয় এবং ‘ওহী’ নাযিল হওয়ার সময় রাসূলে করীমের অবস্থাটা কিরূপ হয় তাহা প্রত্যক্ষভাবে দেখিবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিদায় হজ্জের সফরে তাহা প্রত্যক্ষ করা অপূর্ব সুযোগ ঘটে। নবী করীম (স) এই সময় ‘জেয়ের রেনা’ নামক স্থানে অবস্থান করিতেছিলেন। তখন একজন সাহাবী রাসূলে করীমের নিকট জিজ্ঞাসা করেনঃ ‘সুগন্ধি মাখিয়া উমরা পালনের জন্য ইহরাম বাঁধা জায়েয কিনা? [আল্লামা শারকাভী লিখিয়াছেনঃ প্রশ্নকারীর ছিলেন- আতা ইবনে মুনিয়া, হযরত ইয়ালার ভাই।]নবী করীম (স) সঙ্গে সঙ্গেই ইহার জওয়াব প্রদান করেন নি। তিনি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকেন। অতঃপর রাসূল (স)-এর প্রতি ওহী নাযিল হয়। বুখারী শরীফে এই প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

তখন নবী করীম (স) নবী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। পরে তাঁহার প্রতি নাযিল হইল.................।

এই সময় নবী করীম (স)- এর উপর কাপড় দ্বারা ছায়া করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। তখনই ইয়ালা উহার মধ্যে মাথা প্রবেশ করাইয়া দেখিলঃ

******************************************************

রাসূলের সমস্ত মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করিয়াছে এবং তিনি বিকট শব্দে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করিতেছেন। [বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড, কিতাবুল মানাসিক, ২০৮ পৃষ্ঠা এবং ঐ ২য় খন্ড, কিতাব ফাযায়েলুল কুরআন, ৭৪৫ পৃষ্ঠা।]

মুহাদ্দিসীনের মতে ওহী অবতরণের দুর্বহ ভারে এই সময় নবী করীমের ভীষণ শ্বাসকষ্ট হইতেছিল। আল্লামা শারাকাভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীসে উল্লিখিত ‘গাতীত’ এমন এক প্রকারের বিকট শব্দ, যাহা ওহী নাযিল হওয়ার সময়ে উহার দুর্বহ ভারে অতি কষ্টে শ্বাস লওয়ার কারণে ধ্বনিত হইত। [ফতহুল মুবদী, ২য় খন্ড, ৮৯ পৃষ্ঠা।]

রাসূলে করীমের প্রতি ওহী নাযিল হওয়ার সময় এইরূপ কষ্ট অনুভূত হইত এবং সেইজন্য তাঁহার ভীষণ শ্বাস-কষ্ট হইত। পক্ষান্তরে এইরূপ শব্দ হইতে শুনিলে সকল সাহাবীই বুঝিতে পারিতেন যে, এখন রাসূলের প্রতি ওহী নাযিল হইতেছে।

বস্তুত কুরআন মজীদ জিব্রাঈলের মাধ্যমে ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ সত্য বিধান। কিন্তু এই ওহীর মাধ্যমে যত সত্য ও নির্ভুল তত্ত্বই লাভ হইয়াছে, তাহা সবই কুরআন মজীদে সন্নিবেশিত নহে। দ্বীন-ইসলামে এই ধরণের সত্য জ্ঞানের গুরুত্ব কুরআনের অব্যাবহতি পরেই, এই কারণে উহা কুরআনে সন্নিবেশিত না হইয়া ‘হাদীসে রাসূল’ হিসাবে সংরক্ষিত হইয়াছে। নবী-জীবনের ইতিহাসে এমন অসংখ্য ওহী নাযিল হওয়ার সন্ধান পাওয়া যায়, যাহা ত্রিশপারা কুরআন মজীদের কোথাও পরিদৃষ্ট হয় না। তবে উহা কি বিনষ্ট ও বিস্মৃতির অতল তলে নিমজ্জিত হইয়া গিয়াছে? উহা কি অপ্রয়োজনীয় ছিল? তাহা হইতে পারে না। বাস্তবিকই উহা বিনষ্ট হয় নাই। মানব জীবনের জন্য উহা একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল বলিয়াচিরদিনের জন্য স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত হইয়াছে। মুসলিম জাতির জন্য ইহা এক চিরন্তন সম্পদ।

পরন্তু নবী করীম (স) গঠিত সমাজের লোকদের আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদের প্রতি যেমন ঈমান ও গুরুত্ব বোধ ছিল, ওহীর কুরআন-বহির্ভূত অংশ-হাদীসের প্রতিও ছিল অনুরূপ আগ্রহ ও লক্ষ্য। বরং রাসূলে ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে করিামের নিকট কুরআন মজীদ সম্পূর্ণ লিপিবদ্ধ ও সংকলিত অব্স্থায় বর্তমান ছিল বলিয়া উহার কোন অনুসন্ধান-তৎপরতা অবল’নের প্রয়োজন দেখা দেয় নাই। কিন্তু রাসূলের হাদীসের ব্যাপারে এই প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল। আর এইজন্য তাঁহাদের চেষ্টা ও সাধনার কোন অন্ত ছিল না। তাঁহারা রাসূলের অধিক নিকটবর্তী লোকদের নিকট এই পর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদও করিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ দুইটি ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারেঃ

******************************************************

কুরআনে সংকলিত ওহী ছাড়া ওহীর অপর কোন অংশ আপনার নিকট রক্ষিত আছে কি?[বুখারী শরীফ, প্রথম খন্ড, কিতাবুল জিহাদ, ৪২৮ পৃষ্ঠা।]

ইহার জাওয়াবে হযরত আলী কয়েকটি হাদীস পেশ করেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয়ঃ (ক) কুরআন ছাড়াও ওহী সুত্রে পাওয়া জ্ঞানের আরো অস্তিত্ব আছে। (খ) সব ওহীই কুরআন মজীদে সংকলিত বা উহার মধ্যে সামিল নয়। ওহীর আরো এমন অংশ রহিয়াছে, যাহা কুরআনের বাহিরে রহিয়াছে। তাহা আল্লাহর ‘কালাম’ না হইলেও আল্লাহর নিকট হইতেই জানিয়া লওযা জ্ঞান। (গ) কুরআন-বহির্ভূত ওহী রাসূলে করীমের মৌখিক কথা বাস্তবে করা কাজের বিবরণ হইতে জানা যায় এবং তাহাও ‘ওহী’– ওহীলব্ধ জ্ঞান, ইহা নিঃসন্দেহ। হযরত আবূ হুযায়ফা উহাকেও ‘ওহী’র মধ্যে গণ্য করিলেন, কিন্তু হযরত আলী (র) তাহাতে কোন রূপ আপত্তি করে নাই। তিনি বলেন নাই যে, সব ওহী- ওহীর মাধ্যমে পাওয়া সব জ্ঞানই- কুরআন মজীদে সংকলিত; উহার বাহিরে ওহীর কোন অংশ নাই।

কুরআন ও হাদীস বাহ্যত দুই জিনিস হইলেও মুলত উভয়ই ওহীর উৎস হইতে উৎসারিত। এই কারণে মৌলিকতা, যুক্তিভত্তিকতা, প্রামাণিকতা এবং অবশ্য অনুসরণীয় হওয়ার দিক দিয়া উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। কাজেই হাদীসের প্রতি কোন প্রকার উপেক্ষা প্রদর্শন করা এবং উহা রাসূলের কথা- আল্লাহর কথা নহে, অতএবং তাহা না মানিলেও চলিবে’ বলিয়া উহার গুরুত্ব হ্রাস করা কোন মুসলমানেরই নীতি হইতে পারেন না।

এই পর্যায়ে একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখিতে হইবে। তাহা এই যে, নবী করীম (স) তাঁহার প্রতি অবতীর্ণ কুরআনের ভিত্তিতে অনেক সময় ইজতিহাদও করিয়াছেন। কুরআনের মৌলিক ও ইজমালী নীতির দৃষ্টিাতে দ্বীনে বিস্তারিত রূপ সম্পকেৃ স্বীয় চিন্তা ও বিবেচনার ভিত্তিকে জনগণকে দিয়াছেন অনেক আদেশ- উপদেশ। শরীয়াতের দৃষ্টিতে তাহাও হাদীস- ‘রাসূলের সুন্নাত পর্যায়ে গণ্য। এই সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ******************************************************

রাসূলে করীম (স) যাহা কিছু হুকুম দিয়াছেন তাহা সবই তাহাই, যাহা তিনি কুরআন হইতে বুঝিতে পারিয়াছেন। পরে কুরআন হইতে উহার সমর্থন বাহির করিয়াছেন।

মুল্লা আলী আলকারী লিখিয়াছেন, হাদীসকে নবী করীমের কথারূপে পরিচয় দেওয়া হয় এইজন্য যে,তিনিই উহা কুরআন হইতে বুঝিয়া লইয়াছেন।

******************************************************

এইজন্য যে, তিনি তাহা কুরআন হইতেই বুঝিয়া পাইয়াছেন এবং কুরআনের ভাবধারা হইতেই উহা বাহির করিয়াছেন।

 

কুরআন ও হাদীসের পার্থক্য

কুরআন ও হাদীস উভয়ই ওহীর উৎস হইতে উৎসারিত হইলেও এতদুভয়ের মধ্যে নানা দিক দিয়া পার্থক্য বিদ্যমান। পূর্ববর্তী আলোচনায় এই সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হইয়াছে; কিন্তু বর্তমান পর্যায়ে উহার বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা আবশ্যক।

কুরআন মজীদ এক অপূর্ব মু’জিযা। ইহা কেবল শব্দ, ভাষা ও সাহিত্যের দিক দিয়াই মু’জিযা নহে; ইহার বিষয়বস্তু, আলোচন্য বিষয়ের ব্যাপকতা, প্রসারতা, গভীরতা ও সূক্ষ্মতা এবং উহার উপস্থাপিত মানব কল্যাণকর পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থাও এক অপূর্ব ও চরম বিস্ময়কর মু’জিযা।

প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোত্তম কালাম হইতেছে কুরআন মজীদ, উহার অলৌকিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উহা কালজয়ী, সর্বপ্রকার পরিবর্তণ, পরিবর্ধন ও সংশোধন-সংযোজন হইতে চিরসুরক্ষিত, বিনা অযুত উহা স্পর্শ ও পাঠ করা হারাম। নামাযে উহা সুনির্দিষ্টভাবে পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য।

কিন্তু হাদীসসমূহ কুরআনের ন্যায় কোন মু’জিযা নহে। হাদীসৈর মূল কথাটিই শুধ ওহীর মাধ্যমে হযরতের স্বচ্ছ ও পবিত্র হৃদয়পটে প্রতিফলিত হইয়াছে, তিনি নিজ ভাষায় তাহা জনসমক্ষে পেশ করিয়াছেন। এজন্য উহার ভাষা’ মতলু’ নহে; উহার ভাষা ও শব্দের তিলাওয়ারত করা বাধ্যতামূল নহে, উহার মূল বক্তব্য ও ভাবধারা অনুসরণ করার জন্যই শরীয়াতে নির্দেশ দান করা্ হইয়াছে। এই কারণেই উহাকে ‘ওহীয়ে গায়ের মতলু’ নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু কুরআন মজীদের ভাব-শব্দ সব কিছুই আল্লাহর, আল্লাহর নিকট হইতে অবতীর্ণ।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ওহীয়ে ‘মতলূ’ হইতেছে কুরআন মজীদ। অপর প্রকার ওহী রাসূলে করীম (স) হইতে (বর্ণনাকারীদের সূত্রে) বর্ণিত। [৯৬**************]

আল্লামা মুহাম্মদুরল মাদানী লিখিয়াছেনঃ কুরআন হাদীসের পারস্পরিক কার্থক্য ছয়টি দিক দিয়া বিবেচ্য। প্রথম, কুরআন অলৌকি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মু’জিযা’ হাদীস তাহা নহে। দ্বিতীয়, কুরআন পাঠ না হইলে নামায বিশুদ্ধ হয় না, হাদীস সেরূপ নহে। তৃতীয়, কুরআন ও উহার সামান্য অংশও কেহ অস্বীকার করিলে সে নিশ্চিত কায়ির হইয়া যায়, কিন্তু বিশেষ কারণের ভিত্তিতে বিশেষ কোন হাদীস মানিয়া লইতে অস্বিকৃত হইলে কাফির হইতে  হয় না। চুতর্থ, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আল্লাহ ও রাসূলের মাঝখানে জিব্রাঈরের মধ্যস্থতা, অপরিহার্য।; হাদীসের জন্য ইহা জরুরী নয়। পঞ্চম, কুরআনের প্রতিটি শব্দ ও কথা আল্লাহর নিজস্ব, হাদীসের শব্দ ও ভায়া রাসূলের নিজের এবং ষষ্ঠ, কুরআন  অযু ও পবিত্রতার সহিত স্পর্শ করা কর্তব্য, বিনা অযুতে স্পর্শ করা যায় না। হাদীস সম্পর্কে এরূপ কোন নির্দেশ নাই।[৯৭************]

অন্য কথায় চিঠি ও মৌখিক পয়গামের মধ্যে যে পার্থক্য, কুরআন ও হাদীসের মধ্যেও অনুরূপ পার্থক্য  বলা যায়। লোক মারফত মৌখিক পয়গম প্রেরণের ক্ষেত্রে মূল কথাটিই মুখ্য, ভাষা বা শব্দের তারতম্যে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু চিঠির ব্যাপারটি এরূপ নহে। প্রথমত উহা চিঠি প্রেরকের নিজস্ব মর্জি অনুযায়ী রচিত হয় এবং দ্বিতীয়ত উহাতে নিজ মত ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী পূর্ণ ভাব প্রকাশক ভাষা ও শব্দ প্রয়োগ হইয়া থাকে। কিন্তু মৌখিক কথা প্রেরণ শব্দ ও ভাষার সেই বাধ্যবাধকতা থাকে না।

কুরআন ও হাদীরেস স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে যদিও এইরূপ পার্থক্য রহিয়াছে- কুরআনকে মনে করা যায় আল্লাহর নিজ লিখিত চিঠি আর হাদীস হইতেছে আল্লাহর মৌখিক পয়গাম; কিন্তু সেই সেঙ্গ এই কথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহরর এই ‘চিঠি’ ও ‘মৌখিক পয়গাম’ উভয়েরই মুখপাত্র হইতেছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স)। এই কারণে তাঁহার নিকট হইতে আল্লাহর লিখিত চিঠি (কুরআন) গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার মৌখিক পয়গাম (হাদীস)- ও জানিয়া লওয়া একান্ত আবশ্যক। আল্লাহর প্রেরিত এই দুইটি জিনিসই পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়া অপরটি গ্রহণ করিলে মূল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হইতে বাধ্য।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি যখন কোন হাদীস বর্ণনা করি, তখন তোমাদের নিকট উহার কুরআন সমর্থিত হওয়ারই সংবাদ প্রকাশ করি।[৯৮***********]

ইবনে যুবায়র বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার নিকট যে হাদীসই পৌছিঁয়াছে আমি আল্লাহর কিতাবে উহার সমর্থন ও উহার সত্যতার প্রমাণ পাইয়াছি। [৯৯**********]

শরীয়াতের ইমামগণের সর্বসম্মত মত হইলঃ

******************************************************

সমগ্র সুন্নাত ও হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যা।

 

ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব

হাদীস ইসলামী মিল্লাতের এক অমুল্য সম্পদ, ইসলামী শরীয়াতের অন্যতম অপরিহার্য উৎস। ইহাকে বাদ দিয়াইসলামী জীবন-ধারা ধারণাতীত। হাদীসের গুরুত্ব নির্ধারণের পূর্বে স্বয়ং রাসূলে করীম (স)- এর গুরুত্ব এবং মর্যাদা (Position) নির্ধারণ একান্ত প্রয়োজন।

ইসলামের দৃষ্টিতে রাসূলের আদেশ –নিষেধ, তাঁহার যাবতীয় কাজ-কর্ম, কথাবার্তা- এক কথায় তাঁহার মূখ- নিঃসৃত বাণী ও গোটা কর্মময় জীবনই ইসলামী মিল্লাতের জ ন্য একান্ত অনুসরণীয় এক মহান আদর্শ। রাসূল প্রেরণের মূলে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই এই ছিল যে, উম্মত তাঁহাকে পূর্ণ মাত্রায় অনুসলণ করিয়াচলিবে, তাঁহার হুকুম আহকাম পুরাপুরি পালন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বাস্তব জীবন ধারাকেও অনুসরণ করিয়া চলিবে। কুরআন মজীদ স্পষ্ট ভাষায় রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য ঘোষণা করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি রাসূল পাঠাইয়াঠি একমাত্র ইএ উদ্দেশ্যে যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁহাকে অনুসরণ করা হইবে- তাঁহাকে মানিয়া চলা হইবে। [সূরা আন-নিসা, ৬৪ আয়াত।]

অপর এক আয়াতে রাসূলকে আনুগত্য ও অনুসরণ করিয়াচলার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়াছেন, বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে ঈমানদার লোকগণ, আল্লহ এবং তাঁহার রাসূলের আনুগত্য কর, তাঁহাদের আদেশ শ্রবণের পর তাহা অমান্য করিয়া পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করিও না। তাহাদের মত হইও না, যাহারা বলে- আমরা শুনিয়াছি, কিন্তু কার্যত তাহারা শোনে না। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত ২০ ও ২১।]

এখানে ঈমানদার লোকদের প্রতি প্রথমে আল্লাহর আনুগত্য করার আদেশ দান করা হইয়াছে, সেই সঙ্গে রাসূলেরও অনুসরণ বা আনুগত্য করিতে আদেশ করা হইয়াছে। আল্লাহর এবং রাসূলের আনুগত্য করিতে বলা হইয়াছে একই ******** ‘আনুগত্য কর’আদেশমূলক শব্দ দ্বারা। আল্লাহ এবং রাসূল উভয়কেই মানিয়া চলা মুসলমানের কতৃব্য ঘোষিত হইয়াছে এবং এই কর্তব্যের ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নাই। তবে বাহ্যত শুধু এতটুকুই পার্থক্য করা যাইতে পারে যে, আল্লাহর নাম প্রথমে উল্লিখিত হইয়াছে- অতএব তাহার আনুগত্য করিতে হইবে মূলত এবং প্রথমত, আর তাঁহার পরই আনুগত্য করিতে হইবে রাসূলের।

দ্বিতীয়ত আল্লাহর আনুগত্য করা যায় আল্লাহর কিতাব-কুরআন মজীদের আদেশ-নিষেধ মান্য করিয়া। আর রাসূলের আনুগত্য করিতে হয় রাসূলের আদেশ-নিষেধ ও অনুসৃত রীতি-নীতি পালন করিয়া। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ত্রিশ পারা কুরআন মজীদে বর্তমান; কিন্তু রাসূলের আদেশ-নিষেধ কোথায় পাওয়া যাইবে? তাহা পাওয়া যাইবে রাসূলের কথা, কাজ, সমর্থন সম্বলিত মহান সম্পদ-হাদীসের মাধ্যমে।

আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

বল হে নবী, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমাকে অনুসরণ করিয়াচল। তাহা হইলে আল্লাহও তোমাদের ভালবাসিবেন; তোমাদের গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গুনাহ মার্জনাকারী, দয়াশীল।[সূরা আল-ইমরান, ৩১ আয়াত।]

অর্থাৎ আল্লাহকে ভালবাসার অনিবার্য দাবি ও বাস্তব শর্ত হইতেছে রাসূলকে কার্যত অনুসরণ করিয়া চলা; আল্লাহর ভালবাসা ও তাঁহার নিকট হইতে গুনাহের মাজনা লাভের একমাত্র পথ ও উপায় হইতেছে রাসূল (স)- কে অনুসরণ করা। রাসূলকে অনুসরণ না করিলে আল্লাহর ভালবাসা ও তাহার নিকট গুনাহ মার্জনা লাভ স্ভব নহে। কেবল ইহাই নয়, রাসূলকে অনুসরণ করিয়া না চলিলে মানুষ ঈমানদারই হইতে পারে না, মুসলিম থাকিতে পারে না, বরং কাফির হইয়া যায়।

আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

বল হে নবী, আল্লাহ ও রাসূলকৈ মানিয়া চল; যদি তাহা না করা তবে জানিয়া রাখ, আল্লাহ কাফিরদের ভালবাসেন না।[সূরা আল-ইমরান, ৩২ আয়াত।]

এই আয়াতেও আনুগত্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর পরে ও সঙ্গে সঙ্গেই রাসূলকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেওা হইয়াছে। ফলে কেবল আল্লাহর আনুগত্য করিলেই চলিবে না, রাসূলেরও আনুগত্য করিতে  হইবে। আল্লাহর আনুগত্য না করিলে মানুষ যেমন কাফির হইয়া যায়, রাসূলের আনুগত্য না করিলেও মানুষ অনুরূপভাবেই কাফির হইয়া যাইবে। আয়াতের শেষাংশ এই কথা স্পষ্ট ভাষায়ই ব্যক্ত করিয়াছেন। সেই সঙ্গে এই কথাও বলা হইয়াছে যে, এই কাফিরদিগকে আল্লাহ কিছুমাত্র ভালবাসেন না- পছন্দ করেন না।

মুসলিম হওয়ার জন্য আল্লাহর সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের আনুগত্য করা এইরূপ তাকীদ হওয়ার বিশেষ কারণ রহিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র আল্লাহর কালাম পৌঁছাইয়া দেওয়াই রাসূলের একমাত্র কাজ নহে। আল্লাহর কালাম ব্যাপক প্রচার করা, লোকদিগকে উহা বিশদভাবে বুঝাইয়া দেওয়া, উহার ভিত্তিতে লোকদের মন-মগজ চরিত্র ও জীবন গঠন করা এবং তদনুযায়ী এক আদর্শ সমাজ গঠন করাও রাসূলের কাজ, সন্দেহ নাই।

কুরআন মজীদে এই সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

সেই মাহন আল্লাহ-ই উম্মী লোকদের প্রতি তাহাদের মধ্যে হইতেই একজন রাসূল পাঠাইয়াছেন। রাসূল আল্লাহর আয়াতসমূহ তাহাদের সম্মুখে তিলাওয়াত করে, তাহাদিগকে পবিত্র-পরিশুদ্ধ ও সুসংগঠিত করে, তাহাদিগকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়- যদিও তাহারা ইহার পূর্বে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল। [সূরা জুময়া, আয়াত ২।]

আয়াতে নবী করীমের তিনটি সুস্পষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ঘোষণা করা হইয়াছেঃ

প্রথম, কুরআনের আয়াতসমূহ পাঠ করা, পাঠ করিয়া লোকদিগকে শোনানো। দ্বিতীয়, জন-মনকে পবিত্র-পরিচ্চন্ন ও বিশুদ্ধকরণ, বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট আদর্শের মানদণ্ডে তাহাদের লালন-পালন ও গঠন করা। শিরক ও চরিত্রহীনতার পংকিলতা হইতে তাহাদিগকে পরিশুদ্ধকরণ।

তৃতীয়, আল্লাহর কিতাব ও জরুরী জ্ঞান শিক্ষা দান, ইসলামী জ ীবনাদর্শ বাস্তাবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বুদ্ধি ও প্রতিভার বিকাশ সাধন, ‘সুন্নাত’ শিক্ষা দান।

আলোচন্য আয়াতে প্রথম ও তৃতীয় পর্যায়ে যে কাজের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে-আয়াত তিলাওয়াত করা ও কিতাবের তালীম দেওয়া- এই্ দুইটি কি একই ধরনের কাজ? একই ধরনের কাজ হইলে ইহা নিঃসন্দেহে পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট। আর তাহা হইলে উভয় ক্ষেত্রে একই ধরনের শব্দ প্রয়োগ হওয়া উচিত ছিল। অথচ উভয় ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শব্দের ব্যবহার হইয়াছে। ফলে অর্থের তারতম্যের কারণে ইহা দুইটি স্বাতন্ত্র কাজরূপেই প্রতিফলিত হইয়াছে। বস্তুত ‘আয়াত তিলাওয়াত’ ও ‘কিতাবের তালীম’ দুইটি আলাদা আলাদা কাজ, স্বতন্ত্র দায়িত্ব বিশেষ।

অতএব কুরআন তিলাওয়াত করা সঙ্গে সঙ্গে উহার কঠিন ও অভিনব পারিভাষিক শব্দসমূহের ব্যাখ্যা, নির্দেশিত বিষয়সমূহের বিশ্লেষণ, সংক্ষিপ্ত বিষয়গুলির বিস্তৃ রূপদান এবং স্বীয় কথা ও কাজের মাধ্যমে উহার বাস্তব রূপায়ণ ও প্রতিষ্ঠা- এ সবই রাসূলৈ করীমের দায়িত্ব ও কর্তব্যরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছে।

আয়াতের শেষাংশে ‘কিতাব’ ও ‘হিকমাত’ শিক্ষাদানের কথা বলা হইয়াছে। ‘আল কিতাব’ অর্থঃ কুরআন মজীদ, কিন্তু ‘হিকমাত’ অর্থ কি?

কুরআন মজীদের বহুস্থানে ‘হিকমাত’ শব্দটি ‘আল-কিতাবের’ সঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে এবং সকল রাসূলকে যেমন কিতাব দেওয়া হইয়াছে, তেমনি হিকমাতও দান করা হইয়াছি বলিয়া স্পষ্ঠ ভাষায় ঘোষণঅ করা হইয়াছে। সূরা আল-আমরানে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

স্মরণ কর, আল্লাহ নবীদের নিকট হএত প্রতিশ্রুতি লইয়াছেন যে, (আজ) তোমাদিগকে কিতাব ও হিকমাত দান করিয়াছি। [সূরা আল-ইমরান, ৮১ আয়াত।]

আয়াতে উল্লিখিত ‘কিতাব’ অর্থ যে আল্লাহর কালাম সম্বলিত আসমানী গ্রন্হ, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ‘হিকমাত’ শব্দের তাৎপর্য কি? ইহা দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা কি বুঝাইতে চাহেন? কিতাবের সাথে আল্লাহ রাসূলগণের প্রতি এমন আর কি জিনিস নাযিল করিয়াছেন, যাহাকে তিনি ‘হিকমাত’ নামে অভিহিত করিয়াছেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা ও অনুসন্ধান আবশ্যক।

অভিধানের দৃষ্টিতে ‘হিকমত’ শব্দের মূল হইতেছে *******, ইহার অর্থ ****************** ‘সংশোধন উদ্দেশ্যে কোন জিনিস বা কাজ হইতে নিষেধকরণ’। লাগামকে এই দৃষ্টিতেই ‘হাকামাতুন’ ****** বলা হয়; কেননা, উহা দ্বারা ঘোড়াকে বিদ্রোহ ও যথেচ্ছা গমন হইতে বিরত রাখা হয়। এই অর্থগত সামঞ্জস্যের কারণেই ‘হিকমাতে’র অর্থ করা হয়- *************** জিনিসগুলিকে যথোপযুক্ত স্থানে স্থাপন করা-রাখা এবং অনুপযুক্ত স্থানে রাখা, বন্দ করা।

‘তাজুল-উরুস’ অভিধানে ইহার অধিকতর বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

বিচার-মীমাংসার ক্ষেত্রে সুবিচার-ইনসাফ ও ন্যায়পরতাকে বলা হয় ‘হিকমাত’।

‘জিনিসসমূহের প্রকৃত নিগূঢ় তত্ত্ব ও হাকীকত (Reality) জানিয়া লওয়া এবং এই বিশুদ্ধ ও নির্ভুল জ্ঞানের দৃষ্টিতে আমল করা। এই কারণে ‘হিকমাত’ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ জ্ঞানগত, আর অপর ভাগ বাস্তবমূলক বা কাজ সম্পর্কিত। [তাজুল ‘উরুস’‘হিকমাত’ শব্দের আলোচনা।]

ইমাম রাগেব ইসফাহানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হিকমাত হইতেছে জ্ঞান ও বুদ্ধির সাহায্যে প্রকৃত সত্য লাভ, সত্য লাভের যোগ্যতা ও প্রতিভা। অতএব আল্লাহর ‘হিকমাত’ হইতেছে সমস্ত জিনিস ভাল করিয়া জানা-চেনা এবং চূড়ান্ত বিধানের ভিত্তিতে নূতন জিনিস সৃষ্টি ও উদ্ভাবন। আর মানুষের ‘হিকমাত’ হইতেছে বস্তুজগতের বিষয়াদি সম্পর্কে পরিচিতি ও জ্ঞানলাভ এবং ভাল ভাল কাজ সম্পাদন।[১০৭]

লিসানুল আরব গ্রন্হে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

কার্যত সর্বোত্তম ও উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ সম্পর্কে সূক্ষ্ম গভীর জ্ঞান লাভই হইতেছে হিকমাত।[১০৮]

ইমাম ইবনে জরীর তাবারী বিভিন্ন লোকের কথা উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হিকমাত সম্পর্কে আমার দৃষ্টিতে সঠিক কথা এই যে, হিকমাত হইতেছে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সম্পর্কেত ইলম, যাহা রাসূলের বর্ণনা ছাড়া কিছুতেই লাভ করা সম্ভব নয় এবং উহার সম্পর্কে গভীর সূক্ষ্ম পরিচিতি লাভ করাও হিকমাত। উহার সহিত সামঞ্জস্যশীল আর যেসব জিনিস দ্বারা উহা লাভ করা যায়, তাহাও উহার অন্তুর্ভক্ত। আমার মতে ‘হিকমাত’ শব্দটি ‘হাকাম’ হইতে নির্গত হইয়াছে। উহার অর্থ হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকরণ। [১০৯**************]

ইমাম শাফেয়ী (র) লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

কুরআন সম্পর্কিত জ্ঞানে সর্বাধিক পারদর্শী আস্থাভাজন বিশিষ্ট লোকদের নিকট আমি শুনিয়াছি, তাঁহারা বলিয়াছেনঃ হিকমাত হইতেছে রাসূলে করীম (স)-এর সুন্নাত।[কিতাবুর রিসালা; ২৮ পৃষ্ঠা।]

অতঃপর তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের সুন্নাত হইতেছে সেই হিকমাত, যহা হযরতের দিল মুবারকে আল্লাহর নিকট হইতে উদ্রেক করা হইয়াছে।[কিতাবুর রিসালা; ২৮ পৃষ্ঠা।]

কুরআন মজীদের যেসব স্থানে ‘আল-কিতাবের’ সঙ্গে ‘আল-হিকমাতে’র উল্লেখ হইয়াছে, সেসব স্থানেই কিতাব অর্থ আল্লাহর নিজস্ব কালাম, যাহা রাসূলের প্রতি নাযিল হইয়াছে এবং যাহাতে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও উপদেশ নসীহত বর্ণিত হইয়াছে। আর ‘আল-হিকমাত’ অর্থ সে সবের নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে বিশুদ্ধ ও সঠিক জ্ঞান এবং সে নির্ভূল জ্ঞান অনুযায়ী সঠিক কাজ। বস্তুত এই নির্ভূল জ্ঞান ও তদনুযায়ী সঠিক কাজ করার যথেষ্ট বুদ্ধি প্রত্যেক রাসূলকেই দেওয়া হইয়াছে। নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রে ইহা আল্লাহর স্থায়ী ও নির্বিশেষ নিয়ম।

এই নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) কেও আল-কিতাব কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে ‘আল হিকমাত’ ও দেওয়া হইয়াছে। কুরআন মজীদের বহু সংখ্যক আয়াতে ইহা স্পষ্টভাষায় উল্লেখ করা হইয়াছে। এখানে একটি আয়াত উল্লেখ করা যাইতেছে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

হে নবী, আল্লাহ তোমার প্রতি ‘আল-কিতাব’ ও ‘আল-হিকমাত’ নাযিল করিয়াছেন এবং তুমি যেসব কথা জানিতে না, তাহার শিক্ষা তোমাকে দান করিয়াছেন। আর ইহা তোমার প্রতি আল্লাহর এক বিরাট অনুগ্রহ।[সূরা আন-নিসা, ১১৩ আয়াত।]

কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর দেওয়া এই ‘আল-হিকমাত’ নিশ্চিতরূপে কুরআন হইতে এক স্বতন্ত্র জিনিস। ইহার সুন্নাত এবং ইহার বিস্তৃত বিবরণ হাদীস সম্পদেই পুঞ্জীভূত রহিয়াছে।[হাদীসকে হিকমাত বলার তাৎপর্য কি, তাহা অনুধাবনীয়। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ ********************** সুন্নাত বা হাদীসকে হিকামত বলার তাৎপর্য এই যে, উহা দ্বারাই হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করা হইয়াছে ***************** এবং কুরআনের মোটামুটি কথার উহার দ্বারা ব্যাখ্যা করা হইয়াছে।]

‘আল-হিকমাত বা সুন্নাতও যে আল্লাহর নিকট হইতেই অবতীর্ণ, তাহা পূর্বোক্ত আয়াত স্পষ্ট ভাষায় প্রমাণ করে। বস্তুত আল্লাহ তা’আলা বিশ্বমানবতার পথ-নির্দেশের জন্য এবং হিদায়আয়াতের পথে পরিচালনার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র আল-কিতাব নাযিল করাই যথেষ্ট মনে করেন নাই; সেই সঙ্গে রাসূল ও রাসূলের সুন্নাতকেও আল্লাহর তরফ হইতে প্রেরণের প্রয়োজন মনে করিয়াছেন। অন্যথায় শুধুমাত্র ‘আল-কিতাব’ মানুষের প্রকৃত কোন কল্যাণ সাধন করিতে পারিত না।

কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করাও রাসূলেরই অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। নিম্নোক্ত আয়াত এই দৃষ্টিতে সুন্নাত বা হাদীসের গুরুত্ব ঘোষণা করে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

হে নবী, তোমার প্রতি এই কিতাব এই উদ্দেশ্যে নাযিল করিয়াছি যে, তুমি লোকদের জন্য অবতীর্ণ এই কিতাব তাহাদের সম্মুখে বয়ান ও ব্যাখ্যা করিবে এবং এই উদ্দেশ্যে যে, তাহারা ইহা চিন্তা ও গবেষণা করিবে’।[সূরা আন-নাহাল, আয়াত ৪৪; বয়ান’ করার তাৎপর্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হাফেজ ইবনে আবুল বার বলিয়াছেনঃ নবী করীমের কুরআন ‘বয়ান’ করা দুই প্রকারের হইয়াছেঃ প্রথম, কুরআনের মোটামুটি কথার ব্যাখ্যা, যেমন পাঁচবারের নামায ও সময়, উহার সিজদা, রুকু ও অন্যান্য হুকুম আহকাম হইবে তাহা বলা এবং হজ্জের নিয়ম প্রণালী বর্ণনা করা। নবী করীম (স) যখন হজ্জ করিয়াছিলেন, তখন বলিয়াছিলেনঃ ************ ‘আমার নিকট হইতে তোমরা হজ্জের নিয়ম-কানুন গ্রহণ কর’। ইহার প্রয়োজন এই যে, কুরআনে তোম কেবল নামায, যাকাত ও হজ্জের মোটামুটি আদেশ দেওয়া হইয়াছে, এ সবের কোন ব্যাখ্যা করা হয় নাই-কোন বিস্তৃত রূপ দেওয়া হয় নাই। হাদীসই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পেশ করে।(******************)]

আলোচ্য আয়াতের মূল প্রতিপাদ্য কথা এই যে, জনগণের সম্মযখে কুরআনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করাই রাসূলের প্রতি কুরআন নাযিল করা আসল উদ্দেশ্য। বস্তুত কোন বিষয়কে সঠিক রূপ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝাইয়া দেওয়ার জন্য তিনটি কাজ একান্তই অপরিহার্যঃ

প্রথম, মুখের কথা দ্বারা উহার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা, আলোচনার মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়ের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক রূপ উদঘাটিত করা।

দ্বিতীয়, নিজ জীবনের কাজ-কর্ম ও বাস্তব জীবনধারার সাহায্যে উহার ব্যবহারিক মূল্য ও গুরুত্ব উজ্জ্বল করিয়াতোলা।

তৃতীয়, লোকদের দ্বারা উহাকে কার্যকর ও বাস্তবায়িত করার জন্য চেষ্টা করা, সঠিকরূপে তাহারা উহার মর্মার্থ অনুধাবন ও অনুসরণ করিতেছে কিনা, সেদিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা; যাচাই ও পরীক্ষা কার্যে আত্মনিয়োাগ করা এবং সিঠকরূপে কার্যকর হইতে দেখিলে তাহাকে সমর্থন ও অনুমোদন দান, আর কোনরূপ ভূল-ক্রন্তি বা ক্রটি বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হইলে তাহার সংশোধন করা।

নবী করীম (স)- এর প্রতি কুরআন নাযিল হওয়ার এই উদ্দেশ্যে ঘোষিত হইয়াছে যে, তিনি কুরআনকে এই তিন-তিনটি দিক দিয়া সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল করিয়া জনসমক্ষে তুলিয়া ধরিবেন। রাসূলে করীম (স) তাঁহার তেইশ বছরের নবুয়তী জীবনে এই দায়িত্ব পূর্ণ মাত্রায় ও যথাযথরূপরে পালন করিয়াছেন। এই দায়িত্ব পালন করিতে গিয়া তিনি যাহা কিছু বলিয়াছেন বা করিয়াছেন, তাহার নির্ভরযেগ্য রেকর্ডই হইতেছে হাদীস। অতএব হাদীস যে কুরআন সমর্থিত এবং কুরআন সমর্তন করে না এমন কোন জিনিস যে হাদীসে পাওয়া যায় না, তাহাতে তো সন্দেহ থাকিতে পারে না। ইমাম শাতেবী এ এ জন্যই লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাতে বা হাদীসে এমন জিনিসই পাওয়া যাইবে, কুরআন যাহার পূর্ণ সমর্থন করে। কুরআন সমর্থন করে না এমন কোন জিনিসই হাদীসে পাইবে না। [১১৫*********]

রাসূলে করীম (স) যে কুরআন মজীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আয়াতের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিয়াছেন, তাহার বাস্তব প্রমাণ হইতেছে হাদীস গ্রন্হসমূহের তাফসীর অধ্যায়সমূহ। যেসব আয়াতের সঠিক অর্থ সাহাবায়ে কিরাম (রা) বুঝিতে পারেন নাই এবং তাহার কারণে তাহারা কাতর হইয়া পড়িয়াছেন, রাসূলে করীম (স) সে সবের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিয়া সাহাবাদের উদ্বেগ দূরীভূত করিয়াছেন। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটির উল্লেখ করা যাইতে পারে। আল্লাহ তা’য়ালার ইরশাদঃ

******************************************************

যাহারা ঈমান আনিয়াছে এবং তাহাদের ঈমানকে কোন প্রকার জুলুমের সহিত মিশ্রিত করে নাই.............

যখন নাযিল হয়, তখন ইহা সাহাবাদের পক্ষে বড়ই উদ্বেগের কারণ হইয়া পড়ে। তায়হারা ইহার সঠিক তাৎপর্য জানিবার জন্য রাসূলের নিকট জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে তাহার ঈমানকে জুলুমের সহিত মিশ্রিত করে নাই?

এই প্রশ্ন শুনিয়া নবী করীম (স) বুঝিতে পারিলেন যে, সাহাবায়ে কিরামের নিকট এই আয়াতটি অত্যন্ত দুর্বোধ্য অনুভূত হইয়াছে। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ

******************************************************

 তোমরা যেরূপ ধারণা করিয়াছে, আয়াতের অর্থ তাহা নহে। এখানে জুলুম অর্থ শিরক ছাড়া আর কিছু নয়। তোমারা কি শোন নাই, লোকমান তাহার পুত্রকে বলিয়াছেনঃ ‘হে প্রিয় পুত্র, আল্লাহর সাথে শিরক করিও না, নিশ্চয়ই শিরক এক বিরাট জুলুম সন্দেহ নাই। [সহীহ বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, কিতাবুত তাফসীর, ৭০৮ পৃষ্ঠা।]

রাসূলের নিকট উক্ত আয়াতের প্রকৃত ব্যাখ্যা জানিতে পারিয়াই সাহাবায়ে কিরাম সান্তনা লাভ করেন। এই কারণে কুরআন মজীরে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা জানিবার জন্যও বিশ্ব মুসলিম রাসূলের হাদীসের মুখাপেক্ষী। রাসূলের ব্যাখ্যা ব্যাতীত কুরআনের সঠিক তাৎপর্য জানিবার জন্য নির্ভরযোগ্য অপর কোন উপায়ই থাকিতে পারে না।

অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে নবী, তোমার প্রতি এই কিতাব সত্যতা সহকারে নাযিল করিয়াছে এই উদ্দেশ্যে যে, আল্লাহর প্রদর্শিত নিয়ম পদ্ধতি অনুযায়ী তুমি লোকদের মধ্যে বিচার ফয়সালা করিবে।[সূরা আন-নিসা, ১০৫ আয়াত।]

আল্লাহ তা’আলা কিতাব নাযিল করিয়াছেন এই উদ্দেশ্যে যে, রাসূলে করীম (স) লোকদের মধ্যে বিচার ফয়সালা করিবেন, কিন্তু কোন পদ্ধতিতে তাহা করিবেন? ইহার উত্তরে বলা হইয়াছে-************ ‘যে পদ্ধতি আল্লাহ তোমাকে দেখাইয়াছেন’। তাহা হইলে মূল কিতাবও যেমন আল্লাহ নাযিল করিয়াছেন, তদনুযায়ী বিচার-ইনসাফ কায়েম করার নিয়ম পদ্ধতিও ওহীর মাধ্যমেই প্রাপ্ত। [তাফসীরে রুহুল মাআনী, ৫ম খণ্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা। তাফসীরে বায়যাবী, ১ম খণ্ড, ২০৫ পৃষ্ঠা। উভয়ই ************* -এর তাফসীর করিয়াছেন ********* রূ ‘যাহা তোমাকে বুঝাইয়া দিয়াছেন এবং যে বিষয়ে তেমার নিকট ওহী পাঠাইয়াছেন’ বলিয়া।] এব ইহার বিবরণ হাদীসের মারফতেই লাভ করা যাইতে পারে।কুরআন মজীদি সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার আল্লাহ তা’আলা নিজেই গ্রহণ করিয়াছেন। এই সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

নিশ্চয়ই আমার উপর ন্যস্ত রহিয়াছে উহার সংগ্রহ এবং উহার পাঠ অধ্যয়ন। অতএব আমি যখন াঠ করি, তখন তুমি উহার পাঠ অনুসরণ কর। এতদ্ব্যতীত উহার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দানও আমারই কাজ।[সূরা আল-কিয়ামাহ, ১৭, ১৮, ১৯ আয়াত।]

এই আয়াত অনুযায়ী তিনটি কাজের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই গ্রহণ করিয়াছেনঃ কাজ তিনটি নিম্নরূপঃ

ক) কুরআন মজীন সঞ্চয়ন, সংগ্রহ ও সন্নিবদ্ধকরণ।

খ) কুরআন মজীদের পাঠ শিক্ষা দান।

গ) কুরআনের অর্থ, ভাব ও তাৎপর্য বুঝাইয়া দেওয়া।

কিন্তু এই তিনটি কাজ আল্লাহ তা’আলা কিভাবে সম্পন্ন করিলেন, তাহা বিচার্য। এই কথা সর্বজনবিদিত যে, আল্লাহ তা’আলা জিব্রাঈলের মারফতে কুরআন মজীদ রাসূলকে পড়াইয়া দিয়াছেন, জিব্রাঈলের পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলকেও সেই পাঠের অনুসরণ করিতে বলিয়া রাসূলকে উহার অধ্যয়ন শিক্ষা দিয়াছেন এবং এইভাবে রাসূলের হৃদয়পটে পূর্ণাঙ্গ কুরআনকে সঞ্চিত ও সুসংবদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। আল্লাহর তিনটি কাজের মধ্যে প্রথম দুইটি কাজ এইভাবেই সুসম্পন্ন হইয়াছে। কিন্তু তৃতীয় কাজটি কিভাবে সম্পন্ন করা হইল? আল্লাহ নিশ্চয়ই রাসূলকে কুরআনের অর্থ, ভাব, তাৎপর্য ও কঠিন অংশের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়াছেন এবং তাহা কুরআন হইতে স্বতন্ত্রভাবে করা হইয়াছে। বস্তুত এ প্রসঙ্গে আল্লাহর শিক্ষা দেওয়া যাবতীয় বিষয় হাদীসের মধ্যে সঞ্চিত হইয়া আছে।

ইসলামী জীবনাদর্শের প্রতি বিশ্বাসীদের জন্য হালাল-হারাম নির্ধারণের দায়িত্ব রাসূলের উপর অর্পিত হইয়াছে।রাসূল এই কাজ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবেই আনজাম দিয়াছেন। কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

রাসূল ভাল কাজের আদেশ করেন; খারাপ কাজ হইতে লোকদিগকে বিরত রাখেন; লোকদের জন্য ভাল ও উৎকৃষ্ট জিনিস হালাল করিয়া দেন এবং খারাপ ও নিকৃষ্ট জিনিস হারাম ঘোষণা করেন।[সূরা আল-আরাফ, ১৫৭।]

অতএব রাসূলের যাতবীয় আদেশ-নিষেধ উপদেশ এবং তাঁহার ঘোষিথ হালাল ও হারাম বিশ্বাস করা ও মানিয়া চলা মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য। তাঁহার এই সমস্ত কাজের বিস্তারিত ‘রেকর্ড’ হাদীসের মধ্যে সঞ্চিত হইয়া আছে।রাসূলকে আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের চূড়ান্ত মীমাংসাকারী করিয়া পাঠাইয়াছেন। এই সম্পর্কে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় ঘোষণা দেওয়া হইয়াছে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতেঃ

******************************************************

তোমার আল্লাহর শপথ, লোকেরা কিছুতেই ঈমানদার হইতে পারিবে না, যদি না তাহারা –হে নবী- তোমাকে তাহাদের পারস্পরিক যাবতীয় ব্যাপারে বিচারক ও সিদ্ধান্তকারীরূপরে মানিয়া লয়, তোমার ফয়সালা সম্পর্কে মনে কুন্ঠাহীনতা বোধ করে এবং তাহা সর্বান্তকরণে মানিয়া লয়।[সূরা আন-নিসা, ৬৫ আয়াত।]

জীবনে সমগ্র ক্ষেত্রে রাসূলের আনুগত্য করাও প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। এই সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের মধ্য হইতে দায়িত্বশীল লোকদেরও,,,,,,,,,,,,,,। কোন বিষয়ে তোমরা পরস্পর মতবিরোধ করিলে উহাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরাও।[সূরা আন-নিসা ৫৯ আয়াত।]

এই আয়াতে তিনটি বিভিন্ন সত্তার আনুগত্য করার স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ করা হইয়াছে। প্রথমে আল্লাহর আনুগত্য, দ্বিতীয় রাসূলের আনুগত্য এবং তৃতীয় মুসলিম দায়িত্বশীল লোকদের আনুগত্য। আল্লাহ ও রাসূলের প্রসঙ্গ স্পষ্ট ভাষায় দুই-দুইবার ******* ‘আনুগত্য’ বলার কারণে উভয় আনগত্যই মৌলিক ও স্বতন্ত্র মর্যাদা সম্পন্নরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই নির্দেশ অনুসারে কুরআন মজীদ মানিয়া চলিলেই আল্লাহর আনুগত্য কার্যকর হইতে পারে। কিন্তু ‘রাসূলের আনগত্য কর’ এই আদেশ কার্যকর করার কি পথ?............... এই জন্য হাদীসকে মানিয়ালওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় হইতে পারে না। পক্ষান্তরে পারস্পরিক বিরোধী বিষয়ের চুড়ান্ত মীমাংসার জন্য আল্লাহর ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করিতে বলা হইয়াছে। আল্লাহ দিকে প্রত্যাবর্তন করা যায় আল্লাহর কিতাবের সাহায্য গ্রহণ করিলে, কিন্তু রাসূলের অবর্তমানে রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করার কি উপায় হইতে পারে? তাহার উপায় হইতেছে রাসূলের সুন্নাত বা হাদীসকে গ্রহণ করা। তাহা করা হইলেই আল্লাহর এই আদেশ পালন করা সম্ভব হইতে পারে। ইহা ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই। এই জন্যই উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মায়মুন ইবনে মাহরান বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহর প্রতি ফিরানোর অর্থ আল্লাহর কিতাবের প্রতি ফিরানো এবং রাসূলের প্রতি ফিরানোর অর্থ রাসূলে করীমের জীবদ্দশায় তাঁহার নিজের নিকট পেশ করা। আর আল্লাহ যখন তায়হার জান কবজ করিয়া লইলেন তখন ইহার বাস্তব অর্থ তাঁহার সুন্নাতের দিকে ফিরানো। [১২৩*********]

আল্লামা ইবনে হাজার আল-আসকালানী এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

যদিও প্রকৃতপক্ষে আনুগত্য পাইবার যোগ্য অধিকারী হইতেছেন একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। কিন্তু তাহা সত্বেত্বও রাসূলেরও আনুগত্য করার আদেশ নূতন করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু পরবর্তী ‘উলীল আমর’ ******** এর পূর্বে ‘আনুগত্য কর’ নূতন করিয়াবলা হয় নাই। ইহার কারণ এই যে, মানুষ মানিয়া চলিতে বাধ্য শুধু দুইটি জিনিস, তাহা হইল ‘কুরআন ও সুন্নাহ’। কাজেই এখানে অর্থ হইবে এই, যেসব বিষয়ে কুরআনে স্পষ্ট ফয়সালা করিয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহাতে আল্লাহর আনুগত্য কর, আর যাহা কুরআন হইতে জানিতে পারিয়া তোমাদিগকে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং যাহা সুন্নাতের দলিল দিয়া তোমাদের সামনে প্রমাণ করা হইয়াছে, তাহাতে রাসূলের আনুগত্য কর। ফলে আয়াতের মোট অর্থ দাঁড়াইল এইরূপঃ তিলাওয়াত করা হয় যে ওহী, তাহা হইতে তোমাদিগকে যে হুকুম দেওয়া হইবে, তাহা পালন করিয়া আল্লাহর আনুগত্য কর। আর যে ওহী কুরআন নয়, তাহা হইতে তোমাদিগকে যে হুকুম করা হইবে তাহা পালন করিয়া তোমরা রাসূলের আনুগত্য কর।[*****************************]

আল্লামা তাইয়্যেবী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহর হুকুম ‘রাসূলের আনুগত্য কর’ কথায় আনুগত্যের আদেশের পুনরাবৃত্তি করার কারণে বুঝা গেল যে, রাসূলে করীম (স) স্বতন্ত্র স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী। আর ‘উলীল আমর’- এর ক্ষেত্রে এই শব্দটির পুনরুল্লেখ না হওয়ায় বুঝা গেল যে, ‘উলীল আ্মর’ এমনও হইতে পারে যাহার আনুগত্য করা ওয়াজিব নহে। [১২৫**************]

রাসূলে করীম (স) কে অমান্য করা হইরে তাহাতে কতখানি অপরাধ হইতে পারে? এই সম্পর্কে নিম্নোদ্ধৃত আয়াত হইতে অনেক তত্ত্বই জানিতে পারি। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা যখন পরস্পর পরামর্শে মিলিত হও তখন গুনাহের কাজ, সীমালংঘনমূলক কাজ ও রাসূলের নাফরমানী করার বিষয়ে পরামর্শ করিও না। বরং পরামর্শ কর নেক কাজ ও আল্লাহ ভীতিমূলক কাজ সম্পর্কে। আর আল্লাহকে ভয় করিয়া চল, যাঁহার নিকট তোমাদের সকলকেই একত্রিত করা হইবে।[সূরা মুযাদালাহ, আয়াত নং ৯]

এই আয়াতে রাসূলকে অমান্য করিতে স্বতন্ত্রভাবে নিষেধ করা হইয়াছে। একদিকে পাপ, সীমালংঘন ও রাসূলের অনানুগত্য বা নাফরমানীর কথা উল্লেখ করা হইয়াছে, অপরদিকে উল্লেখ করা হইয়াছে নেকী ও আল্লাহ ভীতিমূলক কাজের। ইহার অর্থ এই যে, রাসূলের অবাধ্যতা ও অনানুগত্য করিলে যেমন গোনাহ ও সীমালংঘন করা হয়, অনুরূপভাবে সকল কল্যাণ নেকী ও আল্লাহভীতি হইতেও বঞ্চিত ইতে হয়। আয়াতের শেষাংশে পরকালের কথা উল্লেখ করিয়াবলা হইয়াছে যে, রাসূলকে অমান্য ও অনানুগত্য করিলে কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।

রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ মুসলিম জীবনের এক চিরন্তন কর্তব্য। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

অতএব তোমরা আল্লাহ এবং তাঁহার ‘উম্মী’ নবীর প্রতি ঈমান আন; যে নবী নিজে আল্লাহ এবং তাঁহার বাণীর প্রতি ঈমানদার এবং তোমরা তাহার অনুসরণ করিয়া চল। [সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৫৯]

অপর এক আয়াতে ইরশাদ হইয়াছেঃ

******************************************************

রাসূল তোমাদিগকে যাহা কিছু দান করে তাহা পূর্ণরূপে তোমরা গ্রহণ ও ধারণ কর; আর যাহা হইতে নিষেধ করে, তোমরা তাহা হইতে বিরত থাক। (রাসূলের আদেশ-নিষেধ মানিয়া চলার ব্যাপারে) আল্লাহকে ভয় কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।[সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭]

রাসূলের আদেশ-নিষেধ অমান্য বা তাঁহার বিরোধিতা করিলে আল্লাত তা’আলা কঠোর শাস্তি দান করিবেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের আদেশের যাহারা বিরোধিতা করে, তাহাদের ভয় করা উচিত যে, তাহাদের উপর কোন বিপদ মুসীবত আসিতে পারে অথবা কোন পীড়াদায়ক আযাবে তাহারা নিক্ষিপ্ত হইতে পারে।[সূরা আন-নূর, আয়াত-৬৩]

রাসূলের ‘ইতায়াত’ বা আনুগত্য স্বীকার করা এবং বাস্তব জীবন তাঁহাকে অনুসরণের ভিত্তিতে যাপন করার উপরই মানুষের হিদায়াত ও কল্যাণ লাভ একান্তভাবে নির্ভরশীল।

আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ করিলেই হিদায়াত প্রাপ্ত হইবে।[সূরা আন-নূর, আয়াত- ৫৪]

আবার আল্লাহর আনুগত্যও নির্ভর করে রাসূলের আনুগত্যের উপর। অন্য কথায়, রাসূলের আনুগত্য না করিলে আল্লাহর আনুগত্য করা সম্ভব হইতে পারে না। এই কথাই স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছে নিম্নোক্ত আয়াতেঃ

******************************************************

যে লোক রাসূলের আনুগত্য করিবে, সে-ই ঠিক আল্লাহর আনুগত্য করিল।[সূরা আন-নিসা, আয়াত-৮০]

‘ইত্তিবা’ ও ‘ইতয়াতে’ রাসূল

উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলেরও আনুগত্য ও অনুসরণ করার জন্য স্পষ্ট ভাষায় আদেশ করা হইয়াছে। আল্লাহর এই আদেশকে সঠিকরূপে অনুধাবন করার জন্য কুরআনে ব্যবহৃত ‘ইত্তিবা’ ও ‘ইতায়াত’ শব্দদ্বয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আবশ্যক। এখানে আমরা এই শব্দ দুইিট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করিব।

আরবী ভাষায় ‘ইত্তিবা’ (*******) বলা হয় কোন ব্যক্তির পিছনে পিছনে চলাকে। ইবনে মনজুর তাঁহার বিখ্যাত অভিধান গ্রন্হ ‘লিসানুল আরব’-এ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

অভিধান ও ব্যাকরণ শাস্ত্রের ইমাম ফরা বলেনঃ ইত্তিবা বলিতে বুঝায়ঃ কোন ব্যক্তি অগ্রে অগ্রে চলে এবং তুমি তাহার পিছনে পিছনে চল। এখন তুমি যদি বল, আমি তাহার ‘ইত্তিবা’ করি, তবে বুঝাইবে যে, তুমি তাহার পদাংক অনুসরণ করিয়া পিছনে পিছনে চলিতেছ।[*****************]

‘তাজুল উরুস’ গ্রন্হে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

‘তুব্বু’ বা ‘তুব্বু’ যেমন সুক্কারু, অর্থ ছায়া। উহাকে ছায়া বলা হয় এই জন্য যে, উহা সব সময়ই সূর্যের অনুসরণ করিয়া চলে। এই সম্পর্কের দৃষ্টিতে মধুমক্ষিকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ও সর্বোক্তম (পুরুষ) মক্ষিকাকেও ‘তুব্বা’ বলা হয়। কেননা সমস্ত সাধারণ মক্ষিকা উহাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করিয়া চলে।[*******************]

ইমাম আবুল আল-আ-মদী উহার পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসংগে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘মুতাবিয়াত-অনুসরণ- কখনো কথার ব্যাপারে হয়, কখনো কোন কাজ করা বা না করার ব্যাপারে হয়। কথার ব্যাপারে ‘ইত্তিবা’ হইতেছে কথার দাবি ও প্রকৃতি অনুযায়ী কাজ করা। আর কাজের ক্ষেত্রে ‘ইত্তিবা’ হইতেছে কাহারো কাজ দেখিয়া তাহা এমনভাবে করা ঠিক যেভাবে সে করিতেছে। এবং সে করিতেছে বলিয়াই সেই কাজ করা হইবে।[***************]

এই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যাইতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলার নির্দেম অনুযায়ী রাসূলের ‘ইত্তিবা’ করার জন্য রাসূলের প্রত্যেকটি কথা এমনভাবে পালন করিতে হইবে, যেমনভাবে পালন করা তাঁহার কথার লক্ষ্য ও দাবি এবং রাসূলের কাজগুলিকে যেভাবে তিনি সম্পন্ন করিয়াছেন ঠিক সেইভাবেই সম্পন্ন করিতে হইবে। অন্যথায় রাসূলকে ‘ইত্তিবা’ করার আল্লাহর আদেশ পালন হইতে পারে না।

‘ইতায়াত’ (**********) শব্দটিও অনুরূপভাবে ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। আরবী ভাষায় ‘ইতায়াত’ বলা হয় কাহারো সম্মখে আনুগত্যের মস্তক অবনমিত করাকে, কাহারো হুকুম আহকামযথাযথরূপে পালন করাকে।

‘লিসানুল আরব’ গ্রন্হে উল্লেখ করা হইয়াছেঃ

******************************************************

‘তাহযীব’ নামক প্রামাণ্য অভিধান গ্রন্হে বলা হইয়াছে ************* কথাটির অর্থ কাহারো সম্মুখে আনুগত্যের মস্তক নত করিয়া দেওয়া। কেহ যদি অপর কাহারো আদেশ পালন করে, তখন বলা হয় ********** সে তাহার আনুগত্য করিল।[*****************]

ইমাম আবুল হাসান আল-আ-মদী ‘ইতায়াত’ শব্দর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কাহাকেও বড় জানিয়া বা বড় করার উদ্দেশ্যে যদি কেহ তাহার মত কাজ করে, তবে সে তাহার ‘অনুগত হইল’ বলা হয়।[******************]

‘ইত্তিবা’ ও ‘ইতায়াত’ শব্দদ্বয়ের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের এই আলোচনা হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইল যে, রাসূলের কথাও কাজকে পুরাপুরি মানিয়া লওয়া এবং যথাযথরূপে পালন করা এক কথায় তাহার পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য ও অনুসরণ করা মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য। আর রাসূলের যাবতীয় কথা ও কাজের বিবরণ যেহেতু হাদীসের মাধ্যমেই জানা যাইতে পারে, এজন্যই দ্বীন-ইসলামে হাদীসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

এই প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের আর একটি আয়াতের উল্লেখ করা আবশ্যক বোধ হইতেছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

কোন বিষয়ে আল্লাহ ও রাসূলের ফযসালা এবং ফরমান আসার পর তাহা মানা-না- মানার ব্যাপারে মু’মিন পুরুষ ও স্ত্রীলোকের কোন ইখতিয়ারই থাকিতে পারে না। সে লোক  আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের নাফরমানী করে, সে পথভ্রষ্ট হইয়া ইসলাম হইতে বহুদূরে চলিয়া যায়।[সূরা আল-আহযাব, ৩৬ আয়াত।]

এই আয়াত হইতে একসঙ্গে তিনটি কথা জানা যায়। প্রথশ এই যে, কোন বিষয়ে আল্লাহর যেমন স্বাধীনভাবে কোন ফয়সালা করার বা ফরমান দেওয়ার অধিকার আছে, আল্লাহর রাসূলেরও ঠিক সেইরূপ অধিকার আছে। দ্বিতীয় এই যে, মু’মিন স্ত্রী-পুরুষ যেমন আল্লাহর ফরমান ও ফয়সালা মানিয়া লইতে বাধ্য, রাসূলের ফয়সালা ও ফরমানও অনুরুপভাবে মানিয়া লইতে বাধ্য। তৃতীয় এই যে, আল্লাহর ফরমান ও ফয়সালা না মানিলে যেমন মানুষ গোমরাহ ও কাফির হয়, রাসূলের ফয়সালা ও ফরমান না মানিলেও সেইভাবেই গোমরাহ ও কাফির হইতে হয়।

অতএব কুরআন মজীদের মত রাসূলের ফরমান ও ফয়সালা নির্ভরযোগ্য রেকর্ড-হাদীস- মানিয়া লওয়াও প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানদার হওয়া এবং ঈমানদার হইয়া জীবন যাপন করার জন্য একান্তই অপরিহার্য।

 

হাদীসের অপরিহার্যতা

হাদীস কুরআন মজীদের ব্যাখ্যাদাতা ও বিশ্লেষণকারী। হাদীসের সাহায্য গ্রহণ ব্যতীত কুরআন মজীদের যথাযথ ব্যাখ্যা ও অর্থ করা, উহার সঠিক উদ্দেশ্য ও ভাবধারা নিরূপণ করা সুকঠিন। নবী করীম (স) এই জন্যই নিজ ইচ্চামত কুরআন ব্যাখ্যা সস্পর্কে কঠোর সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছামত কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা করে সে যেন জাহান্নামে নিজের আসন তালাশ করিয়া লয়।[তিরমিযী, আরওয়াবুত্তাফাসীর, ইবনে আক্কাস বর্ণিত।]

হাদীসে বর্ণিত আছেঃ

******************************************************

যে লোক নিজের ইচ্ছামত কুরআন মজীদের অর্থ করে, তাহার ব্যাখ্যা নির্ভূল হইলেও সে ভূল করে।[তিরমিযী, আবওয়াবুত্তাফাসীর, জুনদুব হইতে বর্ণিত।]

বস্তুত মানুষের বুদ্ধি যতই প্রখর, তীক্ষ্ণ ও সুদূরপ্রসারী হউক না কেন, তাহা অবশ্যই সীমাবদ্ধ। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পৌছিঁয়া উহা ব্যর্থ হইতে ও স্বীয় অক্ষমতা প্রকাল এবং প্রমাণ করিতে বাধ্য কিন্তু বুদ্ধবাদ বা বুদ্ধির পূজা কোন সীমা মানিয়ালইতে প্রস্তুত নয়। বুদ্ধি ও বিবেক-শক্তি যদি রাসূলের সুন্নাত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাবে তাহা বুদ্ধিবাদ ও বিবেক-পূজার নামান্তর। এই বুদ্ধিবাদ ও বিবেক-পূজা মানুষকে আল্লাহর আনগত্যের সীমা লংঘন করিতে বাধ্য করে। উপরন্তু তাহাতে একদিকে যেমন কুরআনের অপব্যাখ্যা, ভূল ও বিপরীত ব্যাখ্যা হয় বলিয়া উহার উপর জুলুম করা হয় এবং মানুষ এই কারণেই কুরআন মানিয়া চলার সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত হইয়া যায়; অপরদিকে তেমনি কুরআন বিশ্বাসীদের মধ্যে কঠিন মতবৈষম্য সৃষ্টি ও বিভিন্ সাংঘর্ষিক মতাদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হওয়ার ফলে মুসলিম সমাজ বহুধা বিভক্ত হইয়া পড়ে। অনেক লোক আবার এই সুযোগে কুরআন লইয়া স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করে, কুরআনের ছত্রে ছত্রে নিজেদের মনগড়া ব া পরকীয় চিন্তার পাঠ গ্রহণ করিতে শুরু করে। রাসূলের হাদীস এই পথে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ইহাই মানুষের সম্মুখে কুরআনী হিদায়াতের প্রশস্ত পথ উপস্থাপিত করে; গোমরাহী বিভ্রান্তি হইতে মানুষকে রক্ষা করে ও সঠিক সরল ঋজুপথে পরিচালিত করে।

নবী করীম (স) কুরআনের বাহক, কুরআন তাঁহারই উপর অবতীর্ণ হইয়াছে; কিন্তু তিনি কেবল কুরআনই মানুষের সম্মুখে পেশ করেন নাই, কুরআনকে ভিত্তি ও কেন্দ্র করিয়া তিনি ইসলামের এক পূর্ণাঙ্গ বিধান উপস্থাপিত করিয়াছেন। এই কারণে তিনি নিজে কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে সুন্নাত ও হাদীসের গুরুত্বের কথা নানাভাবে ঘোষণা করিয়াছেন। এখানে আমরা এই প্রৃসংগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস উল্লেখ করা জরুরূ মনে করিতেছি।

হযরত মিকদাম ইবনে মা’দি কারাব (রা) বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

সাবধান, আমাকে কুরআন দেওয়া হইয়াছে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে উহারই মত আর একটি জিনিস। সাবধান, সম্ভবত কোন সুখী ব্যক্তি তাহার বড় মানুষির আসনে উপবিষ্ট হইয়া বলিতে শুরু করিবে যে, তোমরা কেবল এই কুরআনকেই গ্রহণ কর, ইহাতে যাহা হালাল দেখিবে তাহাকেই হালাল এবং যাহাকে হারাম দেখিবে তাহাকেই হারাম মনে করিবে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, রাসূল যাহা হারাম করিয়াছেন, তাহা আল্লাহর ঘোষিত হারামের মতই মাননীয়।[ইবনে মাজা, পৃষ্ঠা ৩, আবূ দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহঃ *********************]

এই হাদীসটিই ‘সুনানে দারেমী’ গ্রন্হ নিম্নলিখিত ভাষায় উল্লেখ করা হইয়াছেঃ

******************************************************

সম্ভবত এক ব্যক্তি তাহার আসনে হেলান দিয়া বসিয়া আমার বলা কথার উল্লেখ করিবে এবং বলিবেঃ তোমাদের ও আমাদের মাঝে একমাত্র আল্লাহর কিতাব রহিয়াছে। উহাতে যাহাই হালাল পাইব, তাহাকেই হালাল মনে করিব, আর যাহা হারাম পাইব, তাহাকেই হারামরূপে গ্রহণ করিব। (অতঃপর রাসূল বলেন) সাবধান, আল্লাহর রাসূল যাহা হারাম করিয়াছেন, তাহা আল্লাহর নির্দিষ্ট করা হারামের মতই।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭০।]

রাসূলের এই কথাটি অধিক সুস্পষ্ট হইয়া ফুটিঁয়া উঠিয়াছে নিম্নোক্ত হাদীসে। হযরত ইবরাজ ইবনে সারীয়া বলেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের একজন তাহার আসনে বসিয়া কি এই ধারণ করে যে, কুরআনে যাহার উল্লেখ আছে তাহা ব্যতীত আল্লাহ তা’আলা আর কিছুই হারাম করেন নাই? সাবধান, আল্লাহর কসম, আমিও কিন্তু অনেক আদেশ করিয়াছে, উপদেশ দিয়াছি এবং অনেক বিষয়ে নিষেধ করিয়াছি; আর তাহাও কুরআনের মতই মাননীয় কিংবা তাহারও অধিক কিছু।[আবূ দাউদ কিতাবুসসুন্নাহ ইহার সনদে আশয়াস ইবনে শু’বা একজন বর্ণনাকারী; কিন্তু তাঁহার বর্ণিত হাদীস গ্রহণ সম্পর্কে আপত্তি করা হইয়াছে।]

কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসও গ্রহণ করিতে হইবে এবং কোন বিশুদ্ধ হাদীসই যে কুরআনের খেলাফ হইতে পারে না, তাহা নিম্নোক্ত হাদীস হইতে প্রমাণিত হয়। হযরত সায়ীদ ইবনে যুবায়র (রা) একদা নবী করীম (স)- এর একটি হাদীস বর্ণনা করিলেন। উপস্থিত এক ব্যক্তি বলিলঃ

******************************************************

এই সম্পর্কে কুরআনে এমন কথা আছে যাহা এই হাদীসের বিপরীত।

তখন হযরর সায়ীদ বলিলেনঃ

******************************************************

আমি তোমার নিকট রাসূলের হাদীস বর্ণনা করিতেছি, আর তুমি আল্লাহর কিতাবের সহিত উহার বিরোধিতার কথা বল। অথচ রাসূলে করীম আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে তোমার অপেক্ষা অধিক ওয়াকিফহাল ছিলেন।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৭।]

হিদায়াতের পথে চলা ও গোমরাহী হইতে বাঁচিয়া থাকা কুরআন ও হাদীস উভয়ই মানিয়া ও পালন করিয়া চলার উপর নির্ভর করে। এই প্রসঙ্গে এখানে রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণিত দইটি হাদীসের উল্লেখ করা যাইতেছে। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন।

******************************************************

আমি তোমাদের মাঝে দুইটি জিনিস রাখিয়া যাইতেছে। এই দুইটি অনুসরণ করিতে থাকিলে অতঃপর তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হইবে না। তাহা হইতেছে আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাত (হাদীস) এবং কিয়ামতের দিন ‘হাওযে কাওসার’- এ উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত এই দুইটি জিনিস কখনই পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইবে না।[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩।]

বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

দুইটি জিনিস, যাহা আমি তোমাদের মাঝে রাখিয়া যাইতেছি, তোমরা যতক্ষণ এই দুইটি জিনিস দৃঢ়ভাবে ধারণ করিয়া থাকিবে তোমরা কখনো গোমরাহ হইবে না। তাহা হইল, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত।[ঐ, মালেক ইবনে আনাস বর্ণিত।]

ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় এই ভাষণের ভাষা এইরূপঃ

******************************************************

আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রাখিয়া গেলাম যাহা তোমরা শক্তভাবে ধারণ করিয়া থাকিলে কস্মিনকালেও পথভ্রষ্ট হইবে না। তাহা হইল আল্লাহর কিতাব এবং তাঁহার নবী (স) –এর সুন্নাত।[তাফসীরে রুহুল মায়ানী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৮।]

সীরাতে ইবনে হিশাম-এ বিদায় হজ্জের ভাষণের এই অংশ নিম্নোক্তরূপ ভাষায় বর্ণিত হইয়াছেঃ

******************************************************

হে মানব সমাজ, আমি তোমাদের নিকট এমন এক সম্পদ রাখিয়া গেলাম, তোমরা যদি তাহা খুব দৃঢ়তা সহকারে ধারণ কর, তবে কখনই গোমরাহ হইবে না। তাহা হইল, আল্লাহর কিতাব এবং তাঁহার নবীর সুন্নাত।

হযরত ইমরান ইবনে হুসায়ন (রা)-এর মজলিসে একজন লোক বলিলঃ

******************************************************

আপনি আমাদের নিকট কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু বর্ণনা করিবেন না।

তখন হযরত ইমরান সে ব্যক্তিকে ডাকিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

তুমি কি চিন্তা করিয়াদেখিয়াছ, তোমাকে ও তোমার সঙ্গী-সাথীদেরকে যদি কেবলমাত্র কুরআনের উপরই নির্ভরশীল করিয়াদেওয়া হয়, তাহা হইলে কি তুমি কুরআনে যেহরের চার রাকআত, আছরের চার রাকআত ও মাগরিবের তিন রাকআত নামাযের উল্লেখ পাইবে?

হজ্জের প্রসঙ্গ তুলিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

 কেবল কুরআন মজীদেই কি তুমি সাতবার বায়তুল্লাহার তওয়াফ, সাফা-মারওয়ার তওয়াফ, আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং পাথর টুকরা নিক্ষেপ করার বিধান দেখিতে পাও?

তিনি আরো বলিলেনঃ কুরআনে চোরের হাত কাটার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু-

******************************************************

চোরের হাত কোন স্থান হইতে কাটিতে হইবে?............... এইখান হইতে না এইখান হইতে, তাহা কি কুরআনে লেখা আছে?[****************]

সুন্নাত ও হাদীসের গুরুত্ব এবং অপরিহার্যতা এইসব যুক্তি হইতে স্পষ্টভাবে ফুটিয়া উঠে। প্রাথমিক যুগের মনীষিগণ ইহার গুরুত্ব পূর্ণ মাত্রায় স্বীকার করিতেন। সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীন সকলেই কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসকেও অবশ্য পালনীয় বিষয় হিসাবে গ্রহণ করিতেন। এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে পেশ করা হইবে। এখানে প্রসংগত আমরা পূর্ববর্তী মনীষীদের এমন কিছু উক্তির উল্লেখ করিব, যাহা হইতে হাদীস ও সুন্নাত মানিয়া লওয়ার গুরুত্ব সুস্পষ্ট হইয়া উঠিবে।

এই পর্যায়ে প্রথমত সাহাবী যুগের একটি ঘটনা উল্লেখ করা আবশ্যক। এক ব্যক্তি হযরত ইমরান ইবনে হুসায়ন (রা) কে বলিলেনঃ

******************************************************

আপনারা আমাদের নিকট এমন সব হাদীস বর্ণনা করেন, যাহার কোন মূল ভিত্তি আমরা কুরআনে খুজিঁয়া পাই না।

 ইহাতে হযরত ইমরান অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং প্রশ্নকারী ব্যক্তিকে সম্বোধন করিয়াবলিলেনঃ

******************************************************

প্রত্যেক চল্লিশ দিরহামে এক দিরহাম যাকাত দিতে হইবে, এত এত (প্রত্যেক চল্লিশটি) বকরীতে একটি বকরী দিতে হইবে ও এত এত (প্রত্যেক পচিঁশটি) উষ্ট্রে একটি উষ্ট্র দিতে হইবে- যাকাতের নিসাব কি তোমরা কুরআন মজীদে দেখিতে পাও?

অর্থাৎ যাকাত দানের স্পষ্ট আদেশ তো কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছে; কিন্তু উহার বিস্তারিত বিধান ও ব্যবস্থা কি কুরআনে উল্লিখিত হইয়াছে?

সেই ব্যক্তি বলিলেনঃ ‘না, তাহা কুরআনে পাওয়া যায় না’। তখন হযরত ইমরান বলিলেনঃ

******************************************************

তাহা হইলে যাকাতের এই বিস্তারিত বিধি-বিধান তোমরা কাহার নিকট হইতে জানিতে পারিলে? ইহা সবই তোমরা আমাদের (সাহাবীদের) নিকট হইতে পা্ইয়াছ, আর আমরা ইহা আল্লাহর নবীর নিকট হইতে (হাদীসের মাধ্যমে) লাভ করিয়াছি।[***************]

এই হাদীসের ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে যে মূলনীতি ও ফর্মূলা প্রমাণ করিয়াছেন, তাহা এইঃ

******************************************************

সমগ্র বিষয়েরই মূল বিধান কুরআনে উল্লিখিত; কিন্তু উহাদের শাখা-প্রশাখা খুটিঁনাটি (ও ব্যবহারিক নিয়মনীতি) সবই রাসূলের বর্ণনা হইতে জানা গিয়াছে।[******************]

মকহুল দেমাশকী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কুরআন হাদীস বা সুন্নাতের প্রতি অধিকতর মুখাপেক্ষী, সুন্নাত কুরআনের প্রতি ততটা নয়।[**********************]

ইমাম আওযায়ীও এই কথা বলিয়াছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

******************************************************

আল্লাহর কিতাব ব্যাখ্যার জন্য সুন্নাত অধিক দরকারী কিন্তু সুন্নাত ব্যাখ্যার জন্য কুরআনের প্রয়োজন ততটা নয়।[***********]

ইয়াহইয়া ইবনে আবী কাসীর বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীস কুরআনের তুলনায় অধিক ফয়সালাকারী, কুরআন সুন্নাতের বিপরীত ফয়সালা দিতে পারে না।[**************]

ইমাম আহমদ ইবনে হা’ল এই দুইটি কথার ব্যাখ্যাদান করিতে গিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীস কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকারী এবং সুন্নাত উহার অর্থ প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করে।[********]

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী হাদীসের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা নিম্নোক্ত ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

ইলমে হাদীস সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনায় অধিক উন্নত, উত্তম এবং দ্বীন-ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ভিত্তি। হাদীসের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং তাহার সাহাবীদের হইতে নিঃসৃত কথা, কাজ ও সমর্থন বর্ণিত হইয়াছে। বস্তুত ইহা অন্ধকারের মধ্যে আলোকস্তম্ভ, ইহা যেন এক সর্বদিক উজ্জ্বলকারী পূর্ণ চন্দ্র। যে ইহার অনুসারী হইবে ও ইহকে আয়ত্ত করিয়া লইবে, সে সৎপথ প্রাপ্ত হইবে। সে লাভ করিবে বিপুল কল্যাণ। আর যে উহাকে অগ্রাহ্য করিবে, উহা হইতে বিমুখ হইবে সে পথভ্রষ্ট হইবে, লালসার অনুসারী হইবে, পরিণামে সে অধিক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। কেননা নবী করীম (স) অনেক কাজ করিতে নিষেধ করিয়াছেন, অনেক কাজের আদেশ করিয়াছেন। পাপের পরিণাম সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করিয়াছেন, নেক কাজের সুফল পাওয়ার সুসংবাদ দিয়াছেন। তিনি অনেক দৃষ্টান্ত দিয়া লোকদের নসীহত দান করিয়াছেন। অতএব তাহা নিশ্চয়ই কুরআনের মত কিংবা ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ।[হুজ্জতুল্লাহিল বালিগা, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১।]

শাহ দেহলভী আরো বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যাদাতা এবং তাহা উহার কিছুমাত্র বিরোধিতা করে না।[***********************]

ইমাম আবূ হানীফার নিম্নোক্ত বাক্যটিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়ঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীসের অস্তিত্ব না হইলে আমাদের মধ্যে কেহই কুরআন বুঝিতে পারিত না।[**************]

এই প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত কথাটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ

******************************************************

রাবিয়া (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ  ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা (হে নবী) তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করিয়াছেন অতিশয় বিস্তারিতভাবে; কিন্তু উহাতে হাদীস ও সুন্নাতের জন্য একটি অবকাশ রাখিয়া দিয়াছেন। নবী করীম (স) সেই সুন্নাত ও হাদীস স্থাপন করিয়াছেন, যদিও তাহাতে ইজতিহাদ করা বা নিজের মত প্রয়োগের সুযোগও রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে।[তাফসীরে দুররে মনসুর, তারিখুত্তাফসীর, পৃষ্ঠা ৪।]

ইমাম উবায়াদ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহ ও রাসূলের হালাল-হারাম সম্পর্কিত হুকুমের মধ্যে পার্থক্য নাই। রাসূল এমন কোন হুকুম দিতেন না, যাহার বিপরীত কথা কুরআন হইতে প্রমাণিত হইত। বরং সুন্নাত (হাদীস) হইতেছে আল্লাহর নাযিল করা কিতাবের ব্যাখ্যাদাতা এবং কুরআনের আইন-বিধান ও শরীয়াতের বিশ্লেষণকারী।[কিতাবুল আমওয়াল-আবূ উবায়দ, পৃষ্ঠা ৫৪৪।]

হাদীস অমান্যকারী কাফির

ইসলামী ফিকাহর ইমামগণ সম্পূর্ণ একমত হইয়া ঘোষণা করিয়াছেন যে, হাদীস অমান্যকারী গুমরাহ, ইসলাম হইতে বাহির হইয়া যাওয়া লোক। ইসহাক ইবনে রাহওয়াই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যে লোকের নিকট রাসূল করীম (স) হইতে কোন হাদীস পৌছিঁল, সে উহার সত্যতা যথার্ততা স্বীকার করে তাহা সত্ত্বেও সে যদি কোনরূপ কারণ ব্যতীত উহা প্রত্যাখান করে। তাহা হইলে তাহাকে কাফির মনে করিতে হইবে।

ইমাম ইবনে হাজম তাঁহার  ‘আল-আহাকাম’ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

কোন ব্যক্তি যদি বলে যে, আমরা শুধু তাহাই গ্রহণ করিব যাহা কুরআনে পাওয়া যায়-উহা ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করিব না, তাহা হইলে সে গোটা মুসলিম উম্মতের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাফির।

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

খুব শীঘ্র এমন সব লোক আসিবে যাহারা কুরআনের প্রতি সন্দেহ লইয়া তোমাদের সহিত বিবাদ করিবে, তোমরা তাহাদিগকে সুন্নাত বা হাদীসের সাহায্যে পাকড়াও কর। কেননা সুন্নাতের ধারক বা হাদীস বিশারদ মহান আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে অধিক জ্ঞানের অধিকারী।*********************************

 

হাদীস ও রাসূলের ইজতিহাদ

নবী করীম (স) হইতে বিশ্বমানব দুইটি জিনিস লাভ করিয়াছে। একটি হইতেছে কুরআন মজীদ আর দ্বিতীয়টি সুন্নাত। কুরআন সরাসরি আল্লাহর কালাম, আল্লাহর নিকট হইতেই ওহীর মারফতে নাযিল হইয়াছে। আর সুন্নাতেরও মূল উৎস হইতেছে ওহী। রাসূলে করীম  (স) অনেক ক্ষেত্রে নিজেই ইজতিহাদ করিয়াছেন একথা সত্য; কিন্তু তাহাও ওহীবিহীন নহে। হয় উহার সহিত ওহীর সরাসরি সম্পর্ক রহিয়াছে, নয় উহা ওহী কর্তৃক সমর্থিত এবং অনুমতিপ্রাপ্ত। কাজেই রাসূলের ইজতিহাদকেও ইসলামের উৎস হিসাবে স্বীকার করিতে হইবে।

এই পর্যায়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর আলোচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি এই বিষয়টির প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দান প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

হাদীসের কিতাবসমূহে রাসূল (স) হইতে যেসব হাদীস বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা দুই প্রকারের। প্রথম প্রকারের হাদীস হইতেছে তাহা. যাহা রিসালাতের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে বলা হইয়াছে। কুরআনের আয়াতঃ

******************************************************

‘রাসূল তোমাদিগকে যাহা কিছু দিয়াছেন তাহা গ্রহণ কর, আর যাহা হইতে নিষেধ করিয়াছেন তাহা হইতে বিরত থাক’- এই বিশাল পর্যায়ে এই ধরনের হাদীস গণ্য। এই ধরনের হাদীসের এক ভাগ তাহা, যাহাতে পরকালের অবস্থা ও মালাকুতী জগতের বিস্ময়কর বিষয় সম্পর্কে বলা হইয়াছে। এইসব বিষয়ের ভিত্তি হইতেছে ওহী। হাদীসসমূহে যে ভাবে শরীয়াতের হুকুম-আহকাম বর্ণিত হইয়াছে, ইবাদাতের আরকান ও নিয়মাবলীর বিশ্লেষণ রহিয়াছে, জীবন প্রণালীর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা ও উপদেশ রহিয়াছে, তাহা এই প্রথম পর্যায়ের প্রথম ভাগের হাদীস। প্রথম পর্যায়ের এই হাদীসসমূহের এব দ্বিতীয় ভাগের কিছু হাদীস ওহীবদ্ধ; আর কিছু রাসূলে করীমের নিজের ইজতিহাদ-ভিত্তিক। কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে যে, রাসূলে করীমের ইজতিহাদও ওহীর সমপর্যায়ভুক্ত। কেননা আল্লাহ তা’আলা তাঁহাকে ভূল ইজতিহাদ করিতে দেন নাই। তাঁহার ইজতিহাদ কখনো ভূল হইয়া গেলে সেই ভূলের উপর তাঁহাকে কায়েম থাকিতে দেন নাই। কোন প্রকার ভূল হইলে অনতিবিলম্বে আল্লাহর তরফ হইতে উহার সংশোধন ও বিশুদ্ধ হইয়া যাওয়া অপরিহার্য।[****************]

শাহ ওয়ালীউল্লাহ এই শেষ কথা কয়টি এই ভাষায় লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

এই প্রকারের হাদীসের কিছু অংশ ওহীমূলক, আর কিছু ইজতিহাদমূলক। তবে রাসূলে করীম (স)-এর ইজতিহাদও ওহীরই সমতুল্য। কেননা রাসূলের রায়কে ভূলের উপর স্থায়ী হইয়া থাকা হইতে আল্লাত তা’আল্অ তাঁহাকে রক্ষা করিয়াছেন।

 

হাদীসের উৎপত্তি

পূর্বোক্ত বিস্তারিত আলোচনা হইতে ইসলামী জীবনে হাদীসের স্থান এবং হাদীসের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। বর্তমান পর্যায়ে আলোচনা করিব কিভাবে হাদীস লাভ করিলেন, তাহাই হইবে এখনকার মূল আলোচ্য বিষয়।

নবী করীম (স) এর নিকট হইতে হাদীসের সর্বপ্রথম শ্রোতা হইতেছেন সাহাবায়ে কিরাম। দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তারিত জ্ঞান লাভের জন্য তাঁহারা রাসূলেল দরবারে উদগ্রীব হইয়া বসিয়া থাকিতেন। তাঁহারা নবী করীম (স) কে চব্বিশ ঘন্টা পরিবেষ্টিত করিয়া রাখিতেন। তিনি কোথায়ও চলিয়া গেলে তাঁহারা ছায়ার মত তাঁহার অনুসরণ করিতেন।

রাসূলে করীম (স) জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ছিলেন ইসলামী বিধানের ব্যাখ্যাদাতা। কেবল মুখের কথায়ই নয়, নিজের কাজকর্ম ও সাহাবাদের কথা ও কাজের সমর্থন দিয়াও তিনি উহার বাস্তব ব্যাখ্যা দান করিতেন। সাহাবাগণ ইহার মাধ্যমেই হাদীসের মাহন সম্পদ সংগ্রহ এবং সঞ্চয় করিতেন। দ্বীন-ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যখনই কোন জটিলতা কিংবা অজ্ঞতা দেখা দিত। কোন প্রশ্নের উদ্রেক হইত, তখনই রাসূলের নিকট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিয়াজওয়াব হাসিল করিতেন এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা) একটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে ইহার সংরক্ষণ করিতেন।

এতদ্ব্যতীত হাদীস উৎপত্তির আরো উপায় ইলমে হাদীসের ইতিহাসে সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হয়। হযরত জিবরাঈল (আ) কখনো কখনো ছদ্মবেশে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হইতেন এবং রাসূলের নিকট নানা বিষয়ে প্রশ্ন করিয়া ও উহার জওয়াব হাসিল করিয়া উপস্থিত সাহাবাদিগকে পরোক্ষভাবে শিক্ষাদান করিতেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত ‘হাদীসে জিবরাঈল’ নামের প্রখ্যাত হাদীসটি ইহার অকাট্য প্রমাণ। ইহাতে বলা হইয়াছে যে, একজন অপরিচিত ও সুবেশী লোক রাসূলের দরবারে উপস্থিত হইয়া ইসলাম, ঈমান, ইহসান ও কিয়ামাত প্রভৃতি বুনিয়াদী বিষয়ে প্রশ্ন করেন। রাসূলে করীম (স) প্রত্যেকটি প্রশ্নের যথাযথ জওয়াব দান করেন। অতঃপর তিনি দরবার হইতে চলিয়া যান। রাসূলে করীম (স) উপস্থিত সাহাবাদের মধ্যে হযরত উমর ফারূক (রা) কে জিজ্ঞাসা করেনঃ

******************************************************

হে উমর, তুমি জান, এই প্রশ্নকারী লোকটি কে?

হযরত উমর (রা) স্বীয় অজ্ঞতা প্রকাশ করিলে রাসূলে করীম (স) নিজেই বলিলেনঃ

******************************************************

এই প্রশ্নকারী ছিলেন জিবরাঈল, তিনি তোমাদের নিকট তোমাদিগকে দ্বীন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে আসিয়াছিলেন।[*******************]

অতঃপর আমরা প্রামাণ্য গ্রন্হাবলী হইতে এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ করিব, যাহা হইতে রাসূলের নিকট সাহাবাদের নানা বিষয়ে প্রশ্ন করা ও উহার জওয়াব হাসিল করার কথা প্রমাণিত হয়।

বস্তুত নবী করীম (স) এর নিকট সাহাবীদের সওয়াল করা অস্বাভাবিক ব্যাপর ছিল না। তিনি নিজেই তাহাদিগকে সওয়াল করিতেন, তাঁহার নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইতে ও তদনুযায়ী কাজ করিতে বলিয়াছিলেন এবং এইজন্য সময় সময় তাকীদও করিতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ নবী করীম (স)-এর যামানায় এক ব্যক্তি আহত হইলে তাহাকে গোসল করিতে বলা হইল। পরে সে মারা যায়। এই ঘটনার কথা নবী করীম (স) শুনিতে পাইয়া ক্রুদ্ধস্বরে বলিলেনঃ

******************************************************

আল্লাহ‍‍! ঐ লোকগুলিকে খতম করুন। আমার নিকট জিজ্ঞাসা করিলে না কেন? জিজ্ঞাসা করাই কি সব অজ্ঞতার প্রতিবিধান নয়?[********************]

হযরত নাওয়াস ইবনে সালমান (রা) বলেনঃ আমি রাসূলের নিকট একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার জন্য দীর্ঘ একটি বৎসর পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করিয়াছি।

******************************************************

শেষ পর্যন্ত আমি তাঁহার নিকট ‘বিরর’ ও ‘ইসম’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলোম। তিনি জওয়াবে বলিলেনঃ ‘বিরর’ হইতেছে নেক চরিত্র আর ‘ইসম’ তাহাই যাহা তোমার খটকা জাগায়-সংকোচের সৃষ্টি করে এবং তাহা লোকেরা জানুক ইহা তুমি পছন্দ কর না।[*****************]

কেবল মদীনায় উপস্থিত লোকেরাই যে রাসূলের নিকট প্রশ্ন করিতেন তাহা নহে; সুদূরবর্তী শহর ও পল্লী অঞ্চল হইতেও নও-মুসলিম লোকেরা দরবারে উপস্থিত হইয়া প্রশ্ন করিতেন। একদিন নবী করীম (স) সাহাবাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া মসজিদে নববীতে বসিয়াছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি উটের উপর সওয়ার হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। রাসূলের নিকট প্রশ্ন করার অনুমতি চাহিয়া বলিলঃ

******************************************************

আমি আপনার নিকট প্রশ্ন করিব; প্রশ্ন করার ব্যাপারে আমি অত্যন্ত কঠোরতাও প্রদর্শন করিব, আপনি কিন্তু আমার সম্পর্কে মনে কোন কষ্ট নিতে পারিবেন না।

অতঃপর নবী করীম (স) তাহাকে প্রশ্ন করার অনুমতি দান করিলে সে আল্লাহ সম্পর্কে, সমগ্র মানুষের প্রতি রাসূলের রাসূল হিসাবে প্রেরিত হওয়া সম্পর্কে, পাঁচ ওয়াকত নামায, একমাসের রোযা এবং ধনীদের নিকট হইতে যাকাত আদায় করিয়া গরীবদের মধ্যে বন্টন করা ফরয হওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিল। রাসূলে করীম (স) উত্তরে বলিলেনঃ

******************************************************

হ্যাঁ, আল্লাহ তা’আলা এই সবই ফরয করিয়া দিয়াছেন।

শেষ কালে সেই লোকটি রাসূলের জওয়াবে উদ্ধুদ্ধ হইয়া বলিলঃ

******************************************************

আপনি যে দ্বীন লইয়া আসিয়াছেন, তাহার প্রতি আমি ঈমান আনিলাম। আমার নাম যিমাম ইবনে সা’লাবা; আমি আমার জাতির লোকদের প্রতিনিধি হইয়াই আপনার নিকট আসিয়াছি।

হযরত আনাম বলেনঃ  গ্রামদেশীয় এক ব্যক্তি আসিয়া রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করিলঃ

******************************************************

আপনার প্রেরিত ব্যক্তি আমাদের নিকট গিয়া এই সংবাদ দিয়া আসিয়াছে যে, আপনাকে আল্লাহ তা’আলা রাসূল বানাইয়া পাঠাইয়াছেন বলিয়া আপনি মনে করেন, ইহা কি সত্য?

নবী করীম (স) উত্তরে ইহার সত্যতা স্বীকার করিয়া লন। অতঃপর সেই ব্যক্তি দ্বীন-ইসলামের কতগুলি মৌলিক বিষয়ে পূর্বে যাহা কিছু শুনিতে পাইয়াছিল তাহার সত্যতা সম্পর্কে রাসূলকে প্রশ্ন করে। রাসূল (স) তাহার সত্যতা বুঝাইয়া দিলে পর সে উদাত্ত কন্ঠে বলিয়া উঠেঃ

******************************************************

আপনাকে সত্য বিধানসহ যে আল্লাহ পাঠাইয়াছেন তাহার নাম শপথ করিয়া বলিতেছিঃ আপনার বিবৃত বিষয়সমূহে আমি কিছুই বেশি-কম করিব না।[****************]

আবদুল কায়স গোত্রের প্রতিনিধিদল নবী করীম (স)-এর খেদমতে উপস্থিত হইয়া নিজেদের অসুবিধা সম্পর্কে বিবরণ দিতে গিয়া বলিলঃ ‘হে রাসূল, আমাদের ও আপনার মাঝে মুশরিক গোত্রের অবস্থিতি রহিয়াছে, এই কারণে যে চার মাস যুদ্ধ করা হারাম তাহা ব্যতীত অপর সময়ে আমরা আপনার নিকট উপস্থিত হইতে পারি না’। অতএবঃ

******************************************************

দ্বীন-ইসলামে মূল বিষয় সম্পর্কে আমাদিগকে এমন কিছু বলিয়া দিন, যাহা অনুসরণ ও সে অনুযায়ী আমল করিলে আমরা বেহেশতে দাখিল হইতে পারিব এবং আমাদের পিছনে অবস্থিত লোকদিগকে তদনুযায়ী আমল করার জন্য আমরা দাওয়াত জানাইব।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, ৬২৭ পৃষ্ঠা-************]

বনূ তামীম গোত্র ও ইয়েমেনবাসীদের পক্ষ হইতে একদল লোক রাসূলের দরবারে উপস্থিত হইয়া আরয করিলেনঃ

******************************************************

 আমরা আপনার নিকট দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে আগমন করিয়াছি। এই সৃষ্টির মূলে ও প্রথম পর্যায়ে কি ছিল, সে সম্পর্কেও আমরা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, ১৫ পৃষ্ঠা।]

বসরার বনূ-লাইস ইবনে বকর ইবনে আবদ মানাফ ইবনে কিনানা হইতে কিছু সংখ্যক যুবক ও সমবয়সী লোক মদীনায় রাসূলের দরবারে আসিয়া প্রায় বিশ দিন পর্যন্ত অবস্থান করেন। তাঁহারা যখন নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তন করিবার জন্য উদ্বগ্ন হইয়া পড়িলেন, তখন নবী করীম (স) তাঁহাদিগকে বলিলেনঃ

******************************************************

 তোমরা ফিরিয়া যাও, তোমাদের পরিবার-পরিজনদের সহিত জীবন যাপন কর। তাহাদিগকে দ্বীন-ইসলামের শিক্ষা দান কর। তোমরা নামায পড়।(বুখারী)

মুসলিমের অপর বর্ণনায় ইহার পর রহিয়াছেঃ

******************************************************

 (যেমন ভাবে তোমরা আমাকে নামায পড়িতে দেখ) আর যখন নামায উপস্থিত হইবে, তখন তোমাদের একজন সকলের জন্য আযান দিবে এবং তোমাদের অধিক বয়স্ক ব্যক্তি ইমামতি করিবে।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, *****************]

 নবী করীম (স) এই যুবক দলকে বিশ দিন পর্যন্ত দ্বীন-ইসলামের অনেক কথাই হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়াছিলেন। শরীয়াতের হুকুম আহকাম ও ইবাদতের যাবতীয় নিয়ম-নীতিও শিক্ষা দিয়াছিলেন। ফলে একদিকে যেমন বহু হাদীসের উৎপত্তি হইয়াছে, অপরদিকে ঠিক তেমনি রাসূলের এই হাদীসসমূহ মদীনা হইতে সুদূর বসরা পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য সাহাবীদের মারফতে পৌছিঁতে ও প্রচারিত হইতে পারিয়াছে।

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ আমরা রাসূলের দরবারে বসিয়াছিলাম। তিনি লোকদের সাথে কথা বলিতে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় জনৈক আরব বেদুঈন আসিয়ারাসূলের নিকট জিজ্ঞাসা করিলঃ *************** ‘কিয়ামত কবে হইবে’? নবী করীম (স) তাঁহার কথা শেষ করিয়া বেদুঈনকে ডাকিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

আমানত যখন বিনষ্ট করা শুরু হইবে তখন কিয়ামরে অপেক্ষা করিবে।

লোকটি জিজ্ঞাসা করিলঃ *************** আমানত কিভাবে নষ্ট করা হইবে?

নবী করীম (স) বলিলেনঃ

******************************************************

দায়িত্বপূর্ণ কাজ যখন অনুপযুক্ত ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করা হইবে, তখন কিয়ামতের প্রতীক্ষার সময় উপস্থিত মনে করিবে।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, ১৪ পৃঃ।]

এইসব ঘটনা হইতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআনের বাহক হযরত মুহাম্মদ (স)- এর নিকট হইতে ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক ও খুটিঁনাটি বিষয়ে জানিয়া লওয়ার তীব্র আকাঙ্খা এবং সেই জন্য চেষ্টা ও কষ্ট স্বীকার করিবার প্রবণতা সকল সহাবীর মধ্যেই বর্তমান ছিল। আর রাসূলে করীম (স) এইসব জিজ্ঞাসার জওয়াবে যত কথাই বলিয়াছেন, যত কজই করিয়াছেন এবং যত কথা ও কাজের সমর্থন করিয়াছেন, তাহার বিবরণ ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার বিস্তৃত ব্যাখ্যার পর্যায়ভুক্ত এবং তাহাই হাদীস। এই সম্পর্কে আল্লাম বদরুদ্দীন আয়নী যাহা লিখিয়াছেন, তাহা এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

******************************************************

সাহাবায়ে কিরাম রাসূলের নিকট অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করিতেন। নবী করীম (স) তাহাদিগকে একত্র করিতেন, তাহাদিগকে দ্বীনের শিক্ষাদান করিতেন। সাহাবাদের কিছু লোক রাসূলের নিকট প্রশ্ন করিয়াজওয়াব লাভ করিতেন, অপর কিছু লোক উহা স্মরণ করিয়া রাখিতেন, কিছু লোক তাহা অপরের নিকট পৌছাইয়া দিতেন, অপরকে জানাইতেন, এইভাবে আল্লাহ তা’আলা তাঁহার দ্বীনকে পূর্ণতারয় পরিণত করিয়া লন।[***********]

হাদীস শাস্ত্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ইহা এক প্রামাণ্য ভাষণ, সন্দেহ নাই। এই প্রসঙ্গে ইমাম এবনে কাইয়্যেমের একটি উদ্ধৃতিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বনুল মুনফাতিক নামক এক কবীলার আগমন সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তাহাদের এক প্রশ্নের উল্লেখ  করিয়াছেন এবং তাহার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

ইহা হইতে প্রমাণ পাওয়া গেল যে, সাহাবাগণ রাসূলের সম্মুখে তাঁহাদের নানাবিধ প্রশ্ন ও শোবাহ-সন্দেহ পেশ করিতেন এবং তিনি তাঁহাদিগকে উহার জওয়াব দিতেন। ফলে তাহাদের মন সান্ত্বনা লাভ করিত। তাঁহার নিকট শক্ররাও প্রশ্ন করিত, যেমন করিত তাঁহার সাহাবিগণ। পার্থক্য এই যে, শক্ররা প্রশ্ন করিত ঝগড়া করা ও নিজেদের বাহদুরী প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে, আর সাহাবিগণ প্রশ্ন করিতেন দ্বীনের তত্ত্ব বুঝিবার জন্য, উহার প্রকালের জন্য এবং বেশী বেশী ঈমান লাভের উদ্দেশ্যে। আর রাসূল (স) তাহাদের সকলেরই জওয়াব দান করিতন। অবশ্য যেসব বিষয়ের কোন জওয়াব তাঁহার জানা ছিল না- যেমন কিয়ামত হওয়ার সময়- কেবল সে- সব বিষয়েরই তিনি জওয়ার দিতেন না।[****************]

নবী করীম (স) কেবল যে লোকদের সওয়ালেরই জওয়াব দিতেন এবং তাহাতেই হাদীসের উৎপত্তি হইত, তাহাই নয়। তিনি নিজে প্রয়োজন অনুসারে সাহাবিগণকে দ্বীন সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা দান করিতেন। হাদীসে এই পর্যায়ে বহু গটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। আমরা এখানে এই পর্যায়ের দুই একটি বিবরণের উল্লেখ করিতেছি।

১.  হযরত আবূ যায়দ আনসারী (রা) বলেনঃ “একদিন নবী করীম (স) আমাদের লইয়া ফজরের নামায পড়িলেন। পরে তিনি মিম্বরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন ও আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দান করিলেন। জোহরের নামাযের সময় পর্যন্ত এই ভাষণ চলিল। তখন তিনি নামিয়া জোহরের নামায পড়িলেন। নাময পড়া হইয়া গেলে তিনি আবা মিম্বরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন ও ভাষণ দিতে থাকিলেন। আসরেরর নামায পর্যন্ত তাহা চলিল। আসরের নামাযের সময় উপস্থিত হইলে তিনি নামিয়া আসরের নামায পর্যন্ত তাহা পড়িলেন। নামায পড়া হইয়া গেলে তিনি আবার মিম্বরে দাঁড়াইয়া ভাষণ দিতে লাগিলেন। এই ভাষণ সূর্যাস্তকাল পর্যন্ত চলিল। এই একদিন ব্যাপী দীর্ঘ ভাষণে তিনি আমাদের নিকট অতীত ও ভবিষ্যতের অনেক কথাই বলিলেন। শুধু বলিলেনই না, আমাদিগকে জানাইয়াদিলেন ও মুখস্থ করাইয়া দিলেন।[মুসনাদে আহমদ ইবন হা’ল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৩।]

২.   হযরত হানযালা (রা) বলেনঠঃ আমরা একদিন রাসূল (স)- এর সঙ্গে ছিলাম। এই সময় তিনি আমদিগকে জান্নাত ও জাহান্নামের কথা সবিস্তারে বলিলেন। উহার ফলে এই দুইটি জিনিস আমাদের সামনে উজ্জ্বল উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, যেন আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখিতে পাইতেছি...................।[মুসনাদে আহমদ ইবন হা’ল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৩।]

মাত্র দুইটি বর্ণনা এখানে উদ্ধৃত করা গেল, যদিও হাদীসের কিতাবে এই পর্যায়ের বহু কথারই উল্লেখ রহিয়াছে। এই দুইটি বিবরণ হইতেই এই কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইতেছে যে, নবী করীম (স) প্রয়োজনে বুঝিয়ানিজ হইতেই অনেক সময় দ্বীন সম্পর্কে অনেক কথাই বলিতেন এবং সব কথাই সাহাবিগণ স্মরণ রাখিতেন ও অন্যান্য লোকদের নিকট এই হাদীস- কথাসমূহ তাঁহারা বর্ণনা করিতেন।

হাদীসের উৎপত্তি পর্যায়ে এই কথাও উল্লেখ্য।

 

হাদীস সংরক্ষণ

ইসলাম বিশ্বমানবের জন্য এক চিরন্তন জীবন- ব্যবস্থা। এইজন্য উহার প্রধান ও প্রাথমিক বুনিয়াদ কুরআন মজীদের হিফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি ঘোষণা করিয়াছেনঃ

******************************************************

নিশ্চয়ই আমিই কুরআন নাযিল করিয়াছি এবং আমিই উহার সংরক্ষণকারী।[সূরা আল-হিজর, আয়াত- ৯।]

বস্তুত আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদ নাযিল করার সঙ্গে সঙ্গে উহার পূর্ণ সংরক্ষণের সার্বিক ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করিয়াছেন। জিবরাঈলের মারফতে রাসূলে করীমের নিকট কুরআন নাযিল হইয়াছে, তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তাহা লোকদিগকে পাঠ করিয়া শোনাইয়াছেন। অতঃপর ইহাকে চিরতরে সংরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে দুইটি উপায় অবলম্বিত হইয়াছে। একদিকে সাহাবায়ে কিরাম কুরআন শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তাহা মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন। স্মরণ শক্তির মণিকোঠায় ইহার প্রতিটি শব্দ ও অক্ষর চিরদিনের তরে সুরক্ষিত করিয়া লইয়াছেন। [সূরা আল-আনকাবূত, ৪৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় শাহ আবদুল কাদির লিখিত আলোচনা, **************** পৃষ্ঠা ১২৪।]

ফলে উহার একটি বিন্দুও বিলুপ্ত বা বিকৃত হইতে পারে নাই। এই উপায়ে সংরক্ষণে লাভের দিক দিয়াও কুরআন মজীদ আসামানী গ্রন্হাবলীর ইতিহাসে অতুলনীয় জিনিস, দুনিয়ার অপর কোন গ্রন্হই মুখস্থ করিয়া রাখাকে এক বিরাট সওয়াবের কাজ বলিয়া বিশ্বাস করেন। এই কারণে কুরআন মজীদ মুখস্থ করার রীতি আবহমানকাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে। এমন কি, গ্রন্হাকারে লিপিবদ্ধ কুরআন যদি আজ বিলুপ্তও হইয়া যায়, তবুও হাফেজদের স্মৃতিপটে রক্ষিত কুরআন মজীদ তাহার স্থান দখল করিতে পারিবে। পুনরায় কুরআনকে লিখিতরূপ দান করা কিছুমাত্র অসুবিধার ব্যাপার হইবে না। ইহা যে কুরআন মজীদের এক মু’জিযা তাহাতে সন্দেহ নাই।

অপরদিকে কুরআন নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবী করীম (স) সর্বক্ষণ নিযুক্ত ওহী-লেখকদের দ্বারা তাহা লিখাইয়া লইয়াছেন। হযরত বরা ইবনে আজিব (রা) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটি ইহার জ্বলন্ত প্রমাণঃ

******************************************************

নিষ্ক্রিয় মু’মিন লোক ও আল্লাহর পথে জিহাদকারী লোক কখনো সমান হইতে পার না- এই আয়াত যখন নাযিল হইল, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ যায়দকে ডাকিয়া দাও এবং তাহাকে দোয়াত, তখতি ইত্যাদি লইয়া আসিতে বলিও। তিনি (যায়দ) যখন আসিলেন, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ এই আয়াতটি লিখ...............।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৪৬।]

এইভাবে সমস্ত কুরআন মজীদ নবী করীম (স) এর জীবদ্দশায়ই নির্দিষ্ট লেখকের দ্বারা লিখিত হয়। প্রায় চল্লিশ জন সাহাবী কুরআন মজীদ লিখিবার জন্য নিযুক্ত ছিলেন। [***********] প্রায় ছাব্বিশ জন সাহাবী ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে প্রখ্যাত। হযরত আবূ বকর, হযরত উমর, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত যায়দ ইবনে সাবিত, হযরত আবদুল্লাহ ইবন সায়াদ, হযরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম, হযরত খালিদ ইবন সায়ীদ, হযরত আমর ইবনুল আ’স, হযরত মুয়াবিয়া ইবন আবূ সুফিয়ান, হযরত উবাই ইবন কায়াব (রা) প্রমুখ তাহাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। [তাবাকাতে ইবন সায়াদ, তারীখ-ই তাবারী, ***************************************]

এই উভয়বিধ উপায় অবলম্বিত হওয়ার ফলে কুরআন মজীদ সর্বপ্রকার বিকৃতিও বিলুপ্তির হাত হইতে চিরকালের তরে রক্ষা পাইয়াছে।

কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে কেবল কুরআন মজীদকে রক্ষা করাই দ্বীন ইসলাম রক্ষা ও স্থায়িত্বের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এই কারণে আমরা দেখিতেছি, কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তা’আলা হাদীস সংরক্ষণেরও যথাযথ ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাসে আমাদের সামনে স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, কুরআন সংরক্ষণের জন্য প্রধানত দুইটি বাহ্যিক উপায় অবলম্বিত হইয়াছে, রাসূলের সুন্নাত তথা হাদীসও প্রধানত ঠিক সেই দুইটি উপায়ের সাহায্যেই সুরক্ষিত হইয়াছে। আর তাহা হইতেছে আল্লাহ তা’আলার কায়েম করা স্বাভাবিক ব্যবস্থা এবং মানুষের মানবিক প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থাপনা। এই পর্যায়ে বিস্তারিত ও ঐতিহাসিক তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক আলোচনা পেশ করার জন্য আমরা এখানে চেষ্টা করিব।

স্বাভাবিক ব্যবস্থা

হাদীস সংরক্ষণের স্বাভাবিক ব্যবস্থা যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া দেখিলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করিয়াছে বলিয়া মনে হয়। প্রথম, তদানিীন্তন আরবদের স্বাভাবিক স্মরণশক্তির তীক্ষ্ণতা ও প্রাখর্য। দ্বিতীয়, সাহাবায়ে কিরামের জ্ঞান-পিপাসা, জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানানুশীলনের অপূর্ব তিতিক্ষা এবং তৃতীয়, ইসলামী আদর্শ ও জ্ঞান বিস্তারের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দায়িত্ববোধ। এই তিনটি বিষয়েরই বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা যাইতেছে।

আরব জাতির স্মরণশক্তি

তদানীন্তন আরব জাতির স্মরণশক্তি বস্তুতই এক ঐতিহাসিক বিস্ময়। কুরআন এবং হাদীসের সংরক্ষণে ইহার যথেষ্ট অবদান রহিয়াছে। কুরআন মজীদ ইহাকে একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

বরং এই কুরআন সুস্পষ্ট আয়াত সমষ্টি, ইহা জ্ঞানপ্রাপ্ত লোকদের মানসপটে সুরক্ষিত।[সূরা আল-আনকাবুত, ৪৯ আয়াত।]

এই আয়াতে সেকালের মুসলিম জ্ঞানী লোকদের স্মরণশক্তির দিকে সুস্পষ্ট ইংগিত রহিয়াছে এবং কুরআন মজিদ যে তাহাদের মানসপটে স্মৃতিশক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত ছিল, তাহাও ব্যক্ত করা হইয়াছে। আল্লামা বায়াযাবী এই আয়াতের তাফসীরে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অর্থাৎ তাঁহারা কুরআনক এমনভাবে হিফয করিয়া রাখিতেন ও উহার সংরক্ষণ করিতেন যে, কেহই উহাকে বিকৃত বা রদবদল করিতে পারিত না।[তাফসীরে বায়যাবী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৯।]

ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে যে, তদানীন্তন আরব সমাজের লোকদের স্মরণশক্তি অসাধারণরূপে প্রখর ছিল, কোন কিছু স্মরণ করিয়া রাখার জন্য একবার শ্রবণই তাহাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই সম্পর্কে ইবন আবদুল বির লিখিত এই ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখযোগ্যঃ

******************************************************

আরব জাতি স্বভাবতই স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিল এবং উহা ছিল তাহাদের বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য।

******************************************************

তাহারা স্বাভাবিকভাবেই স্মরণশক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিত।[****************]

******************************************************

এই কথা প্রসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত যে, আরব জাতি মুখস্থ করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি ও প্রতিভার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিল। তাহাদের এক একজন লোক যে কাহারো দীর্ঘ কবিতা একবার শুনিয়াই মুখস্থ করিয়া ফেলিতে ও স্মরণ রাখিতে সক্ষম হইত।[***************]

হযরত ইবন আব্বাস (রা) উমর ইবন আবূ রাবিয়ানামক প্রসিদ্ধ আরব কবির এক দীর্ঘ কবিতা একবার মাত্র শ্রসণ করিয়া সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছিলেন। [***************] রাসূলের সাহাবিগণও খালেস আরব জাতির লোক ছিলেন। তাঁহারা প্রথমে না কিছু লিখিতে পারিতেন, না পারিতেন কোন লিখিত জিনিস পাছ করিতে। ফলে তাঁহাদের সকলকেই কেবল স্মরণশক্তির উপর নির্ভরশীল হইয়া থাকিতে হইত। জাহিলিয়াতের যুগে তাঁহারা তাঁহাদের দীর্ঘ বংশতালিকা, পূর্বপুরুষদের অপূর্ব প্রশংসা ও গুণ-গরিমার কথা সবিস্তারে মুখস্থ করিয়া রাখিতেন। তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে যখন বংশ-গৌরবের প্রতিযোগিতা হইত, তখন তাঁহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অতীত বংশ গৌরব ও স্তুতি গাঁথা একটানা মুখস্থ বলিয়া যাইতেন। তাঁহাদের প্রায় প্রত্যেকেই স্মরণশক্তির তীক্ষ্ণতার কারণে নিজ নিজ বংশের ভাষ্যকার বা মুখপাত্র ছিলেন।

আল্লাহ তা’আলা স্বাভাবিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন এই আরব জাতিকেই হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়্যাত ও প্রচরিত বাণীর সংরক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। প্রখর স্মরণশক্তিসম্পন্ন এইসব হৃদয়কে কুরআনের আয়াত ও রাসূলের হাদীস মুখস্থ রাখার জন্য পূর্ণ মাত্রায় প্রস্তুত করিয়াছিলেন। [***************************]

ঠিক এই কারণেই আমরা দেখিতে পাই যে, কুরআন মজীদ নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবিগণ নবী করীম (স)- এর মুখে তাহা শুনিয়াই মুখস্থ করিয়া লইতে পারিতেন। এইভাবে পূর্ণ কুরআন মজীদ মুখস্থ করিয়ালওয়া এবং রাখা তাহাদের পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন ব্যাপার ছিল না।

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী কাতাদাহ ইবন দায়ামহ দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহ এই  জাতিকে স্মরণশক্তির এমন প্রতভা দান করিয়াছেন, যাহা কোন জাতিকেই দান করা হয় নাই। ইহা এক বিশেষত্ব, যাহা কেবল তাহাদিগকেই দেওয়া হইয়াছে এবং ইহা এমন এক সম্মান ও মর্যাদা যাহা দ্বারা শুধু তাহাদিগকেই সম্মানিত করিয়াছেন।[যুরকানী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৫।]ৱ

হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি বিপুল সংখ্যাক হাদীসের হাফেজ ছিলেন। কিন্তু উমাইয়া বংশের শাসক খলীফা মারওয়ান ইবন হিকামের মনে এই সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হয়। তিনি হযরত আবূ হুরায়রার পরীক্ষা লওয়ার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেন। একদিন হযরত আবূ হুরায়রাকে কিছু সংখ্যক হাদীস শোনাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। আবূ হুরায়রা (রা) তখন কিছু সংখ্যক হাদীস শোনাইয়া দেন। মারওয়ানের নির্দেশ মুতাবিক পর্দার অন্তরালে বসিয়া হাদীসসমূহ লিখিয়া লওয়া হয়। বৎসরাধিক কাল পরে একদিন ঠিক এই হাদীসসমূহই শোনাইবার জন্য হযরত আবূ হুরায়রাকে অনুরোধ করা হইলে তিনি সেই হাদীসসূহই এমনভাবে মুখস্থ শোনাইয়াদেন যে, পূর্বের শোনানো হাদীসের সহিত ইহার কোনই পার্থক্য হয় না। ইহা হইতে হযরত আবূ হুরায়রার স্মরণশক্তির প্রখরতা অনস্বীকার্যভাবে প্রমাণিত হয়।[কিতাবুল কুনী, ইমাম বুখারীকৃত, পৃষ্ঠা ৩৩।]

প্রসিদ্ধ হাদীস-সংকলক ইমাম ইবন শিহাব জুহরীও ছিলেন অসাধারণ স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনিও একবার এক পরীক্ষার সম্মখীন হইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তদানীন্তন বাদশাহ হিশাম তাঁহার পুত্রকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু সংখ্যক হাদীস লিখিয়া দিতে তাঁহাকে অনুরোধ করেন। জুহরী তখনি চারশত হাদীস লিখাইয়া দেন। দীর্ঘদিন পর সেই হাদীসসমূহ পুনরায় লিখাইয়া দেওয়ার জন্য অনুরুদ্ধ হইয়া তিনি আবার তাহা লিখিইয়া দেন। বাদশাহ এই উভয়বারে লিখিত হাদীসসমূহের তুলনামূলক পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পান যেঃ

******************************************************

এই দ্বিতীয়বারে সেই হাদীসসমূহের একটি অক্ষরও বাদ পড়িয়া যায় নাই।[তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০১।]

ইহা যেম ইমাম জুহরীর অপরিসীম স্মৃতিশক্তির বাস্তব প্রমাণ, তাহাতে সন্দেহ নাই।

ইবনে শিহাব জুহরী বলিতেনঃ

******************************************************

আমি যখনি ‘বকী’ বাজারের নিকট যাতায়াত করিতাম, তখন আমার কর্ণদ্বয় এই ভয়ে বন্ধ করিয়া লইতাম যে, উহাতে কোন প্রকার অশ্লীল কথা যেন প্রবেশ করিতে না পারে। কেননা, আল্লাহর শপথ, আমার কর্ণে কোন কথা প্রবেশ করিলে আমি তাহা কখনো ভুলিয়া যাই না।[******************]

তিনি আরো বলেনঃ

******************************************************

আমি আমার খাতা বইতে হাদীস বা অন্য যাহা কিছু লিখিয়াছি, তাহই মুখস্থ করিয়াছি।[**************]

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ও বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী ইমাম শা’বী স্বীয় স্মরণশক্তি প্রখরতার পরিচয় ও বিবরণ দান প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি কখনো কোন খাতা হইতে কোন হাদীস লিখি নাই এবং কখনো কাহারো নিকট হইতে কোন হাদীস একাধিকবার শ্রবণ করার প্রয়োজন বোধ করি নাই।[***************]

ইমাম অকী’ও অনুরূপ একজন আসামন্য স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল তাঁহার সম্পর্কে বলেনঃ

******************************************************

তাঁহার মত হাদীস হিফযকারী লোক আমি আর দেখি নাই।[তারীখে খতবী, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭৪।]

অপর এক মুহাদ্দিস তাঁহার সম্পর্কে বলেনঃ

******************************************************

‘অকী’র স্মরণশক্তি ছিল প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য।[তারীখে খতবী, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭৪।]

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুহাদ্দিস কাতাদাহর স্মরণশক্তিও ছিল অতুলনীয়। তাঁহার এই ঐতিহাসিক স্মরণ শক্তির প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাসকার হাফিজ যাহবীর নিম্নোক্ত বর্ণনা হইতে। তিনি বলেনঃ

******************************************************

কাতাদাহ ছিলেন বসরাবাসীদের মধ্যে সর্বাধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি যে কথাই শুনিতেন, তাহাই স্রমণ করিয়ালইতেন। হযরত জাবিরের সংকলিত হাদীস গ্রন্হ তাঁহার সম্মুখে একবার পাঠ করা হইলে তিনি তাহা মুখস্থ করিয়া ফেলেন।[তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬।]

ইয়াহইয়া ইবনে কাতান বলেনঃ আমি সুফিয়ান সওরী অপেক্ষা অধিক স্মরণশক্তিসন্পন্ন লোক দেখি নাই। তাঁহার ত্রিশ হাজার হাদীস মুখস্থ ছিল। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

‘আমি যাহা কিছু একবার মুখস্থ করিয়াছে তাহা কখনই ভুলিয়া যাই নাই’।[তাযকিয়াতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা।]

সুফিয়ান ইবন উয়াইনার সাত সহস্র হাদীস কন্ঠস্থ ছিল এবং এজন্য তিনি কোন কিতাব রাখিতেন না।

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল বলেনঃ রাজধানী বাগদাদে মুহাদ্দিস আবূ জুরয়া অপেক্ষা অধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোক দেখা যায় নাই। কেবলমাত্র কুরআন সম্পর্কেই দশ হাজার হাদীস তাঁহার মুখস্থ ছিল। বস্তুত স্মরণশক্তির দিক দিয়া তিনি ছিলেন অতুলনীয়।

কাযী আবূ বকর ইসফাহানী মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সেই সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করেন।

ইমাম বুখারীর উস্তাদ মুহাদ্দিস ইসহাক ইবন রাহওয়া-এর স্মরণশক্তি অতিশয় তীক্ষ্ণ ছিল। অসংখ্য হাদীস তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। তাঁহার শিক্ষার্থীদিগকে তিনি মুখস্থ কয়েক সহস্র হাদীস লিখিয়াই দিয়াছিলেন, ইহাতে তিনি একবারও কিতাব দেখার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। তিনি নিজেই বলিতেনঃ ‘সত্তর সহস্র হাদীস আমার চোখের সম্মুখে সব সময় ভাসমান থাকে’।

মুহাদ্দিস আবু জুরয়া তাঁহার সম্পকের্ক বলিতেনঃ

তাঁহার (ইবন রাহওয়ার) মত স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোক একজন দেখি নাই।[****************]

তদানীন্তন শাসনকর্তা আমীর আবদুল্লাহ তাঁহার স্মরণশক্তির বিস্ময়কর পরিচয় পাইয়া বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

আপনি অনেক বিষয় মুখস্থ করিয়া রাখিতে পারেন তাহা জানি, কিন্তু আপনার এই স্মরণশক্তির পরিচয় পাইয়া আমি আশ্চর্যান্বিত হইতেছি।[কিতাবুল-কুনী, ইমাম বুখারী কৃত, পৃষ্ঠা ৩৩]

পরবর্তী যুগের হাদীসবিদ ইমাম বুখারীর স্মরণশক্তিও কোন অংশে কম উল্লেখযোগ্য নয়। নওয়াব সিদ্দীক হাসান আবূ বকর ইবন আবূ ইতাব হইতে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম বুখারী বাল্যাবস্থায়ই সত্তর হাজার হাদীস সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছিলেন।[************]

তাঁহার সম্পর্কে আরো উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

বর্ণিত আছে, তিনি একবার মাত্র কিতাব দেখিয়া তাহা সবই মুখস্থ করিয়া লইতেন।[*************]

মুহাম্মদ ইবন আবূ হাতেম বলিয়াছেনঃ দুইজন লোক আমার নিকট বলিয়াছেন যে, আমরা একত্রে হাদীস শ্রবণ করিতাম, ইমাম বুখারী তখন আমাদের মধ্যে বালক বয়সের ছিলেন। আমরা যাহা শুনিতাম তাহা সঙ্গে সঙ্গে লিখিয়া লইতাম; কিন্তু ইমাম বুখারী কিছুই লিখিতেন না। একদিন তাঁহাকে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেনঃ তোমরা আমার প্রতি বড় অবিচার করিলে। আচ্ছা, তোমরা কি লিখিয়াছ তাহাই আমাকে শোনাও। অতঃপর আমাদের লিখিত পনেরো হাজারেরও অধিক হাদীস তাঁহাকে দেখাইলাম।

******************************************************

অতপর তিনি তাঁহার স্মরণশক্তিতে রক্ষিত এই সব হাদীসই মুখস্থ পড়িয়া শোনাইলেন। এমনকি তাঁহার মুখস্থ পাঠ শুনিয়া আমাদের লিখিত কিতাবগুলিকে সংশোধন করিয়া লইলাম।[*****************]

ইমাম বুখারী সম্পর্কে আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি বাগদাদ আগমন করিলে মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন ও আলাদা আলাদাভাবে মোট একশতটি হাদীস তাঁহার সম্মুখে এমনভাবে পেশ করিলেন যে, উহার প্রত্যেকটির সনদ উল্টাপাল্টা করিয়া দেওয়া হইয়াছে, একটির সনদ অপরটির সহিত জুড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। এইসব হাদীস সম্পর্কে ইমাম বুখারীর মতামত জানিতে চাহিলে তিনি এই হাদীসসমূহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন। অতঃপর প্রত্যেকটি হাদীসকে সঠিকভাবে উল্লেখ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, তাঁহারা উহাকে যেভাবে উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহাতে এই ভূল ছিল এবং কোন হাদীসের সনদ কোনটি-কোনটি নয়, তাহাও তিনি অকাট্যভাবে প্রকাশ করিয়া দিলেন। তাঁহার এই অপরিসীম স্মরণশক্তি দর্শনে সকলেই গভীর বিস্ময় প্রকাশ করেন।

******************************************************

তাঁহার এই অপরিসীম স্মরণশক্তির কথা তাঁহারা স্বীকার করিলেন এবং এই ব্যাপারে তাঁহার বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সকলেই বিশ্বাস করিলেন।[*************]

এই সব ঘটনা হইতে এই কথা প্রমাণিত হয় যে, এই যুগের মুসলিম মনীষীদের স্মরণশক্তি স্বাভাবত অত্যন্ত তীক্ষ্ন ও প্রখর ছিল। সাহাবাদের যুগ হইতে তাবে-তাবেয়ীন ও মুহাদ্দিসীনের যুগ পর্যন্ত ইহার কোন ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় না। সেকালের আরবদের মধ্যেও যেমন এই বিস্ময়কর স্মরণশক্তি বর্তমান ছিল, অনারব মুসলিমদের মধ্যেও তাহার প্রকাশ দেখা গিয়াছে। বস্তুত মুসলিম উম্মতের প্রতি ইহা ছিল আল্লাত তা’আলার এক অপরিসীম ও মহামূল্য অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহ ছিল বলিয়াই কুরআন এবং হাদীস ইসলামের এই ভিত্তিদ্বয় যথাযথভাবে সংরক্ষিত হইতে ও সুরক্ষিত থাকিতে পারিয়াছে।

এই যুগের এই বৈশিষ্ট্যের একটি জীবতাত্ত্বিক তাৎপর্যও রহিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা মানবদেহে যতগুলি শক্তি ও সামর্থ্য দান করিয়াছেন, তন্মধ্যে কোন একটির ব্যবহার না হইলে কিংবা কোন একটি অঙ্গ অকেজো হইয়া পড়িলে অপরচির শক্তি বৃদ্ধি পায়। যাহার একটিমাত্র হাত, তাহার সে হাতে দুই হাতের শক্তি সঞ্চিত হয়। অন্ধ ও দৃষ্টিহীন ব্যক্তির আন্দাজ অনুমান ও অনুভূতির শক্তি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। ইসলামের প্রথম যুগের মুসলামানদের ব্যাপারে ইহার সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। একালে সাধারণভাবে লেখাপড়ার বেশী প্রচলন ছিল না। মানুষ লেখনীশক্তির প্রয়োগ অপেক্ষা স্মরণশক্তির ব্যবহার বেশী করিত। ফলে এ্ই যুগে স্মরণশক্তির প্রয়োগ অপেক্ষা স্মরণশক্তির ব্যবহার বেশি করিত। ফলে এই যুগে স্মরণশক্তির বিস্ময়কর বিকাল পরিলক্ষিত হয়।কুরআন ও হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রাথমিক উপায় হিসাবে ইহা খুবই গুরত্বপূর্ণ স্থান দখল করিয়াছে।

 

হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য রাসূলের নির্দেশ

হযরত রাসূলে করীম (স)-এর জীবনব্যাপী কথা ও কাজের মাধ্যমেই ইসলামী জীবন ব্যবস্থার রূপায়িত হইয়া উঠিয়াছে। এই কারণে তাঁহার যাবতীয় কথা ও কাজ মুসলিম সমাজের নিকট মহামূল্য সম্পদ। সাহাবায়ে কিরাম রাসূলে করীম (স)-এর প্রত্যেকটি কথা মনোনিবেশ সহকারে শ্রবণ করিতেন এবং তাঁহার প্রত্যেকটি কাজ ও গতিবিধি সূক্ষ্ণ ও সন্ধানী দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিতেন। ফলে রাসূলে করীমের কথা ও কাজ সাহাবাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সঞ্চিত ও সঞ্জীবিত হয়।

কিন্তু এই ব্যাপারে কেবল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক সংরক্ষণের উপরই সম্পূণূ নির্ভর করা হয় নাই। নবী করীম (স) নিজেও এই জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন।

নবী করীম (স) সাহাবায়ে কিরামকে ইসলাম সম্পর্কিত যাবতীয় কথা, আদেশ-নিষেধ ও উপদেশাবলী মনোনিবেশ সহকারে শ্রবণ করিতে যেমন বলিয়াছেন, উহাকে স্মরণ রাখিতে ও অন্য লোকদের পর্যন্ত উহাকে যথাযথভাবে পৌঁছাইয়া দিতেও তেমনি আদেশ করিয়াছেন। তিনি সাহাবাদের সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে চিরসবুজ চিরতাজা করিয়া রাখিবেন, যে আমার নিকট হইতে কোন কিছু শুনিতে পাইল ও তাহা অন্য লোকের নিকট যথাযথভাবে পৌঁছাইয়া দিল। কেননা পরে যাহার নিকট উহা পৌঁছিয়াছে সে প্রয়াশই প্রথম শ্রোতার তুলনায় উহাকে অধিক হিফাযত করিয়া রাখিতে সক্ষম হইয়াছে।[তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯০ (১৯৪০ সনের দিল্লী সংস্করণ) ইবন মাজা, ***************** দারেমী, আবুদ্দারদা হইতে বর্ণিত মুস্তাদরাক, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৭।]

হযরত আবুদল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এ হাদীসটি অন্যভাবে বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার বর্ণিত হাদীসটির ভাষা এইরূপঃ

******************************************************

আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে আলোকোদ্ভাসিত করিয়া দিবেন, যে আমার কথা শুনিয়া তাহা স্মরণ করিয়া লইল, উহাকে পূর্ণ হিফাযত করিল এবং অপরের নিকট উহা পৌঁছাইয়া দিল। অনেক জ্ঞান বহনকারী লোকই এমন ব্যক্তির নিকট উহা পৌঁছাইয়া দেয়, যে তাহার অপেক্ষা অধিক জ্ঞানী ও বিজ্ঞ।[শাফেয়ী ও বায়হাকী।]

এই সঙ্গে হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটির ভাষাও লক্ষণীয়। তিনি বলেনঃ নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহ তাহার জীবন উজ্জ্বল করিবেন, যে আমার কথা শুনিয়া উহাকে মুখস্থ করিল ও উহাকে সঠিকরূপে স্মরণ রাখিল এবং উহা এমন ব্যক্তির নিকট পৌঁছাইল যে তাহা শুনিতে পায় নাই।...............। [******************* তিরমিযী।]

আবদুল কায়স গোত্রের এক প্রতিনিধি দল রাসূল করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইলে তিনি তাহাদিগকে ইসলামের মূল বিষয়াদি সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষাদান করেন এবং তাহাদিগকে বলেনঃ

******************************************************

এই কথাগুলি তোমরা পুরাপুরি স্মরণ করিয়া রাখ, উহাকে পূর্ণরূপে সংরক্ষণ কর এবং তোমাদের পশ্চাতে যাহারা রহিয়াছে তাহাদিগকে এই বিষয়ে অবহিত কর।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, কিতাবুল ইলম, ১৯ পৃষ্ঠা।]

সাহাবায়ে কিরামের ভবিষ্যতের দায়িত্ব ও সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আজ তোমরা (আমার নিকট দ্বীনের কথা) শুনিতেছ, তোমাদের নিকট হইতেও তাহা শোনা হইবে (অন্য লোকেরা শুনিবে), আর তোমাদের নিকট হইতে যাহারা শুনিবে তাহাদের নিকট হইতেও (এই কথা) শোনা হইবে।[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৫, হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত।]

অপর একটি হাদীসে নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

 ‘মুসলিম উম্মতের দ্বীন’ সম্পর্কে চল্লিশটি হাদীস যে ব্যক্তি মুখস্থ করিবে, সংরক্ষণ করিবে, আল্লাহ তা’আলা তাহাকে একজন ফিকাহবিদ বানাইয়া দিবেন এবং আমি কিয়ামতেন দিন তাহার জন্য শাফাআতাকরী ও সাক্ষী হইব।[মিশকাতুল মাসাবীহ, পৃষ্ঠা ৩৬, হযরত আবুদ্দারদা বর্ণিত।]

নবী করীম (স)-এর হাদীস সংরক্ষণ সম্পর্কিত এই নির্দেশাবলী ও উপদেশ বাণীর ফলে তদানীন্তন মুসলিম সমাজের প্রায় এক লক্ষ ব্যক্তিই রাসূলের মুখের বাণী ও কাজের বিবরণ সংরক্ষণ করিয়াছেন, মুখস্থ রাখিয়াছেন ও স্মৃতিপটে এমনভাবে জাগরূপ করিয়া রাখিয়াছেন যে, সাধারণত তাঁহারা কখন তাহা ভুলিয়া যান নাই। এই ব্যাপারে তাঁহাদের স্বভাবজাত স্মরণশক্তি তাঁহাদের যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছেন। তদুপরি রাসূলের এই আদেশাবলী উহাকে অধিকতর জোরদার করিয়া তুলিয়াছে। রাসূল (স) যখনই একটি কথা বলিতেন, উপস্থিত সাহাবিগণ তাহা কণ্ঠস্থ করিতে শুরু করিতেন, যেন ভুলিয়া না যান। হযরত সামুরা ইবেন জুবদুব (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের যামানায় আমি বালক ছিলাম এবং তখনই আমি রাসূলের কথা মুখস্থ করিতাম।[মুসলিম শরীফ, ১ম খণ্ড, মুকাদ্দমা, পৃষ্ঠা ১০ নববীসহ।]

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমরা রাসূলের হাদীস মুখস্থ করিতাম, রাসূলের নিকট হইতে এইভাবে হাদীস মুখস্থ করা হইত।[মুসলিম শরীফ, প্রথম খণ্ড, মুকাদ্দমা, পৃষ্ঠা ১০ নববীসহ।]

মক্কা বিজয়ের পরের দিন নবী করীম (স) মুজাহিদীনের সামনে যে ভাষণ প্রদান করেন, তাহার শেষভাগে তিনি বলেনঃ

******************************************************

উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিত লোকদের নিকট এই কথাগুলি পৌঁছাইয়া দেয়। বিদায় হজ্জ্বের ঐতিহাসিক ভাষণের শেষভাগে রাসূলে করীম (স) উদাত্ত কণ্ঠে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

 এখানে উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিত লোকদের পর্যন্ত আমার এই কথাগুলি পৌঁছাইয়া দেয়। কেননা যাহাদের নিকট ইহা পৌঁছানো হইবে, তাহাদের অনেকেই আজিকার শ্রোতাদের অপেক্ষা অধিক হাদীস হিফাযতকারী হইতে পার।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১।]

বুখারী শরীফে কথাটি এই ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

******************************************************

উপস্থিত লোকেরা অনুপস্থিত লোকদের পর্যন্ত এ কথাগুলি পৌঁছাইয়া দেয়। কেননা উপস্থিত লোক হয়ত ইহা এমন এক ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিবে, যে উহা তাহার অপেক্ষা বেশী হিফাজাত করিয়া রাখিতে সক্ষম হইবে।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬।]

ইবন আউনের সূত্রে বর্ণিত হাদীসটির শেষাংশ নিম্নরূপঃ

******************************************************

এমন হইতে পারে যে,আমার কথা স্মরণ করিয়া রাখার ব্যাপারে অনুপস্থিত ব্যক্তি উপস্থিত ব্যক্তি উপস্থিত ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক সক্ষম হইবে।[**************]

নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার নিকট হইতে একটি আয়াত হইলেও তাহা অবশ্য বর্ণনা কর।[বুখারী শরীফ, মিশকাত, কিতাবুল ইলম......।]

মাযহারী ও মুল্লা আলী আল-কারী ইহার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার হাদীসসমূহ খুব অল্প পরিমাণ হইলেও প্রচার কর।[***********************]

নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

 আমার পরে লোকেরা তোমাদের নিকট হাদীস শুনিতে চাহিবে। যখন তাহারা তোমাদের নিকট এই উদ্দেশ্যে আসিবে, তখন তোমরা যেন তাহাদের প্রতি অনুগ্রহশীল হও এবং তাহাদের নিকট আমার হাদীস বর্ণনা কর।[মুসনাদে আহমাদ, মালিক ইবনে আনাস বর্ণিত। *****************]

তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা ইলম শিক্ষা কর ও উহা লোকদিগকে শিক্ষা দাও। তোমরা ফারায়েয বা মিরাসী আইন শিক্ষা কর ও অন্যান্য লোকদিগকেও তাহা শিক্ষা দাও। তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং উহা লোকদিগকে শিক্ষা দাও। কেননা আমাকে একদিন চলিয়া যাইতে হইবে।[দারেমী শরীফ, পৃষ্ঠা ৪০]

একবার নবী করীম (স) দোয়া করিয়া বলিতেছিলেনঃ

******************************************************

হে আল্লাহ আমার খলীফাগণকে রহমত কর।

সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করিলেন।

******************************************************

হে রাসূল, আপনার খলীফা কাহারা?

উত্তরে নবী করীম (স) বলিলেনঃ

******************************************************

যাহারা আমার হাদীসসমূহ বর্ণনা করে ও তাহা লোকদিগকে শিক্ষা দেয় )তাহারাই আমার খলীফা)।[মুকাদ্দামায়ে দারেমী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫।]

নবী করীম (স) আরে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

দ্বীন সম্পর্কিত কোন বিষয়ে কাহাকেও যদি কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় এবং সে তাহা গোপন রাখে-প্রকাশ না করে, তবে কিয়ামতের দিন তাহাকে জাহান্নমের আগুনের লাগাম পরাইয়া দেওয়া হইবে।[মুসনাদে আহমদ, আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবন মাজা-************]

এইসব নীতিগত কথা ছাড়াও নবী করীম (স) তাঁহার বিশেষ বিশেষ কাজ সম্পর্কে অপরাপর লোকগিদকে ওয়াকিফহাল করিবার জন্য উপস্থিত সাহাবিগণকে জোরালোভাবে তাগিদ করিতেন।

নিম্নোক্ত হাদীস হইতে এই কথার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। ইয়াসার বলেনঃ একদিন হযরত আবদুল্লহ ইবনে উমর (রা) আমাকে ফজর ‘উদয়’ হইয়া যাওয়ার পর নামায পড়িতে দেখিতে পান। তখন ইবনে উমর আমাকে বলিলেনঃ

******************************************************

আমরা এইভাবে একদিন নামায পড়িতেছিলাম। এমন সময় নবী করীম (স) আমাদের নিকট আসিলেন। তখন বলিলেনঃ তোমাদের যাহারা এইখানে উপস্থিত আছ তাহারা যেন অনুপস্থিত লোকদের নিকট আমার এই কথা পৌঁছাইয়া দেয় যে, ফজর হওয়ার পর দুই সিজদা ব্যতীত অন্য কোন নামায পড়া জায়েয নয়।[মুসনাদে আহমদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৪।]

মালিক ইবনুল হুয়ায়রিস (রা) বলেনঃ আমরা কিছু সংখ্যক যুবক ও সমবয়স্ক লোক রাসূলে করীম (স)-এর দরবারে বিশ দিন ও রাত্র অবস্থান করার পর বাড়ি প্রত্যাবর্তন করার ইচ্ছা প্রকাল করিলাম। তখন তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

তোমরা তোমদের ঘরের লোকদের নিকট ফিরিয়া যাও, তাহাদের সহিতই বসবাস করিত থাক, তাহাদিগকে (দ্বীন ইসলাম) শিক্ষা দাও এবং তাহা যথাযথ পালন করার জন্য আদেশ কর। [এই সময় রাসূল (স) কতকগুলি কাজের উল্লেখ করেন, যাহা আমি স্মরণ করিয়া লইলাম] এবংআমাকে তোমরা যেইভবে নামায পড়িতে দেখিয়াছ, ঠিক সেইভাবেই নামায পড়িও।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৭৬]

এই হাদীস হইতে জানা যায় যে, দূর-দূরান্তর হইতে নও-মুসলিমগণ রাসূল (স)- এর দরবারে ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে আগমন করিতেন। রাসূল (স) তাঁহাদিগকে ইসলামী আদর্শ ও শরীয়াত শিক্ষা দিতেন। তাহারা যাহা কিছু শুনিতে ও জানিতে পাইত তাহা স্মরণ রাখার জন্য এবং ফিরিয়া গিয়া নিজ নিজ এলাকার লোকদিগকে তাহা শিক্ষাদান ও প্রচার করার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ করিতেন।

এভাবে রাসূল (স)- এর স্পষ্ট ও নীতিগত আদেশ-নির্দেশের ফলে দূর দূর অঞ্চলে অবস্থিত মুসলিমদের নিকট রাসূল (স)-এর হাদীস তীব্র গতিতে পৌঁছিয়া যায় এবং তৎকালীন প্রায় সকল মুসলমানই নির্ভরযোগ্য সূত্রে রাসূল (স)-এর হাদীস জানিতে পারে। হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচার লাভের ইহাই ছিল প্রাথমিক ও স্বাভাবিক পন্হা।

 

পারস্পরিক হাদীস পর্যালোচনা ও শিক্ষাদান

সাহাবায়ে কিরাম নবী করীম (স)-এর নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়া অবসর সময় সুযোগ ও প্রয়োজনমত একত্র হইয়া বসিতেন এবং পারস্পরিক চর্চা ও আলোচনায় লিপ্ত হইতেন। কোন কোন সময় হাদীস আলোচনার জন্য সাহাবাগণ নিজেদের মধ্যে বিশেষ বৈঠকের ব্যবস্থা করিতেন। এই ধরনের বৈঠক সাধারণত মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত হইলেও কখনো কখনো সাহাবীদের বাড়িতেও অনুরূপ বৈঠক বসিত। েই বৈঠকসমূহে রাসূলে করীমের কথা, কাজ ও উপদেশাবলী সম্পর্কে প্রকাশ্য আলোচনা হইত। প্রধান প্রধান সাহাবিগণই এইসব বৈঠকে যোগদান করিতেন। পূর্বৈ কাহারো কোন বিষয়ে অজ্ঞতা থাকিলে এইসব বৈঠকের আলোচনা হইতে নির্ভরযোগ্যভাবে ও বিশ্বস্তসূত্রে তাঁহারা সেই বিষয়ে পূর্ণ ওয়াকিফহাল হইতে পারিতেন। কাহারো কোন বিষয়ে সন্দেহ থাকিলে তাহাও এই আলোচনার ফলে তিরোহিত হইয়া যাইত। এই ধরণের আলোচনা সভা-অনুষ্ঠান সম্পর্কে এখানে আমারা কয়েকটি প্রামাণ্য বিবরণ পেশ করিতেছিঃ

১.   হযরত আনাম (রা) বলেনঃ

আমরা রাসূল (স)- এর নিকট হাদীস শ্রবণ করিতাম. তিনি যখন মজলিস হইতে উঠিয়াচলিয়া যাইতেন, তখন আমরা বসিয়া শ্রুত হাদীসসমূহ পরস্পর পুনরাবৃত্তি করিতাম, চর্চা করিতাম, পর্যালোচনা করিতাম। আমাদের এক একজন করিয়াসবকয়টি হাদীস মুখস্থ শোনাইয়া দিত। এই ধরনের প্রায় বৈঠক হইতে আমরা যখন উঠিয়া যাইতাম, তখন আমাদের প্রত্যেকের সবকিছু মুখস্থ হইয়া যাইত।[**********]

২.    আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেনঃ

একদিন নবী করীম (স) তাঁহার কোন এক হুজরা হইতে বাহির হইয়া আসিলেন এবং মসজিদে দুইটি জনসমাবেশ দেখিতে পাইলেন। একটিতে সমবেত লোকেরা কুরআন পাঠ করিতেছিল ও আল্লাহর নিকট দোয়া প্রার্থনা করিতে মগ্ন ছিল। আর অপরটির লোকেরা (হাদীস) শিক্ষা করিতেছিল ও শিক্ষা দান করিতেছিল। নবী করীম (স) বলিলেনঃ এই উভয় সমাবেশের লোকই কল্যাণের  কাজ করিতেছে। ইহারা (একদল লোক) কুরআন পাঠ করিতেছে ও আল্লাহকে ডাকিতেছেঃ আল্লাহ চাহিলে তিনি তাহাদিগকে প্রার্থিত জিনিস দান করিবেন, আর না চাহিলে দিবেন না। আর অপর দলের লোক জ্ঞান ও হাদীস শিক্ষা করিতেছে ও শিক্ষা দিতেছে। ********************* এবং আমি শিক্ষক হিসাবেই প্রেরিত হইয়াছি। আবদুল্লাহ ইবন আমর বলেনঃ ‘অতঃপর তিনি তাহাদের সহিতই বসিয়া গেলেন।[**********************]

ইলম চর্চায় নিযুক্ত লোকগণ যে রাসূলের হাদীস, কাজ-কর্ম ও উহার পরিপ্রেক্ষিতে দ্বীন-ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করিতে ও উপস্থিত লোকদিগকে তাহা শিক্ষা দিতেছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশায়ই এই ধরনের বৈঠক বসিত ও রাসূল (স) নিজে তাহাতে যোগদান করিতেন, লোকদিগকে ইলম হাদীস শিক্ষার জন্য বিশেষ উৎসাহ দান করিতেন, তাহা উপরিউক্ত দীর্ঘ বর্ণনা হইতে অকাট্যরূপে প্রমাণিত হইতেছে।

৩.   হযরত মু’আবিয়া বর্ণিত নিম্নোক্ত ঘটনা হইতে উপরের কথার আরো প্রমাণ মেলে। তিনি বলিয়াছেন৬

******************************************************

আমি একদিন নবী করীম (স)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি মসজিদে প্রবেশ করিয়া একদল লোককে উপবিষ্ট দেখিতে পাইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমরা কিসের জন্য বসিয়া আছ? তাহারা বলিলঃ আমরা ফরয নামায পড়িয়াছি, তাহার পর বসিয়া আল্লাহর কিতাব ও তাঁহার নবীর সুন্নাত সম্পর্কে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করিতেছি।[মুস্তাদরাক-হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৪।]

হাদীস মুখস্থ করার পর উহা যাহাতে ভুলিয়া না যান, সাহাবায়ে কিরাম সেইদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন। এইজন্য অনেক সাহাবী নিজস্বভাবেই হাদীস চর্চা ও আবৃত্তি করিতে থাকিতেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর নিম্নোক্ত উক্তি হইতে তাহা প্রমাণিত হয়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি রাত্রক তিন ভাগে ভাগ করিয়া লই। এক ভাগ রাত্র আামি ঘুমাই, এক ভাগ ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত করি, এক ভাগে আমি রাসূলের হাদীস স্মরণ ও মুখস্থ করিতে থাকি।[মুসনাদে দারেমী, *****************]

এই প্রসঙ্গে ‘আসহাবে সুফফা’র কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। বিশেষত হাদীসের প্রথম উৎপত্তিক্ষেত ও ধারক হিসাবে হাদীসের ইতিহাসে আসহাবে সুফফার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

সাধারণভাবে সকল সাহাবীই রাসূলের সাহচর্যে অধিক সময় অতিবাহিত করিতে চেষ্টা করিতেন। কিন্তু ‘সুফফার অধিবাসিগণ দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টাই রাসূলের দরবারে পড়িয়া থাকিতেন। মসজিদে নববীর সম্মুখস্থ চত্তরই ছিল তাঁহাদের আবাসস্থল। ইহাদের কোন ঘর-সংসার ছিল না, আয়-উপার্জনের তেমন কোন প্রয়োজনও ছিল না। তাই অন্যান্য সাহাবাদের তুলনায় তাঁহারা যে রাসূলের সাহচর্যে সর্বাধিক সময় ব্যয় করিতে পারিতেন, তাহাতে সন্দেহ থাকিতে পারে না।

ফলে মসজিদে নববী কার্যত একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হইয়াছিল। স্বয়ং নবী করীম (স) ছিলেন ইহার প্রধান অধ্যক্ষ আর প্রায় সকল সাহাবীই ছিলেন এখানকার শিক্ষার্থী। রাসূলের নির্দেশক্রমে বড় বড় সাহাবিগণ বিশেষ বিশেষ বিষয়ে শিক্ষাদানের কাজও করিতেন।

সুফফার বসবাসকারী সাহাবীদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে সে সংখ্যা যে কিছুমাত্র নগণ্য ছিল না, তাহাতে সন্দেহ নাই। ইবন আবদুল বার কর্তৃক এক কবীলা সম্পর্কে প্রদত্ত বর্ণনা হইতে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপকতা সমন্ধে ধারণা করা যায়। তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তামীম প্রতিনিধি দলে সত্তর কি আশি জন লোক ছিল। তাহারা ইসলাম কবুল করিয়া দীর্ঘদিন পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করেন। এই সময়ে তাহারা কুরআন ও দ্বীন-ইসলাম শিক্ষা করিতেছিল।[**************]

মোটকথা আসহাবে সুফফার সাহাবিগণ দিন ও রাত্র রাসূলের সন্নিকটে থাকিয়াতাঁহার মুখ-নিঃসৃত বাণীসমূহ, তাঁহার কার্যাবলী, কর্মতৎপরতা, গতিবিধি ও চিন্তা-প্রবণতা এবং তাঁহার নিকট অনুমোদনপ্রাপ্ত কথা ও কাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ও বিশেষ সতর্কতা সহকারে শ্রবণ, পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবণ করিতেন। কোন একটি কথা- একটি সামান্য বিষয়ও – যাহাতে তাঁহাদের অজ্ঞতা থাকিয়া না যায়, সেজন্য সর্ব প্রযত্নে চেষ্টা করিতেন।[****************]

বস্তুত রাসূলের করীম (স)-এর দরবারে নিরবিচ্ছিন্নভাবে উপস্থিত থাকিতে পারা ছিল সাহাবিগণের নিকট সর্বাধিক কার্ম। এই পর্যায়ে হযরত সলীত (রা)- এর ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। রাসূলে করীম (স) তাহাকে একখণ্ড জমি চাষাবাদের জন্য দিয়াছিলেন। তিনি উহার চাষাবাদের কাজে বাহিরে চলিয়া যাইতেন এবং আবার ফিরিয়া আসিতেন। তখন তিনি তখন তিনি অন্যান্য সাহাবীর নিকট শুনিতে পাইতেন যে, তাঁহার অনুপস্থিতিতে কুরআনের অমুক অমুক আয়াত নাযিল হইয়াছে এবং রাসূলে করীম (স) এই এই কথা বলিয়াছেন। তখন তাহার মনে বিশেষ দুঃখ ও বঞ্চনার জ্বালা অনুভূত হইত। তিনি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট গিয়া বলিলেনঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি আমাকে যে ভুমিখণ্ড দান করিয়াছেন, উহা ফিরাইয়া নিন। কেননা উহার কারণেই আমাকে দরবারে উপস্থিত থাকার পরম সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত থাকিতে হয়। ইহা আমি চাই না, ইহার কোন প্রয়োজনই আমার নাই।

******************************************************

 কোন সাহাবী যদি বিশেষ কারণে কোন দিন দরবারে উপস্থি হইতে না পারিতেন, তাহা হইলে তিনি অপর যে লোক সেই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন, তাহার নিকট হইতে সব কথা জানিয়া লইতেন। হযরত উমর (রা) তাঁহার আনসারী ভাই ও প্রতিবেশী হযরত উতবান মালিকের সহিত এই প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হইয়াছিলেন যে, তাঁহাদের কেহ কোন দিন রাসূল (স)- এর দরবারে উপস্থি হইতে না পারিলে অপরজন তাঁহাকে সেই দিনের যাবতীয় বিষয়ে অবহিত করিবেন। হযরত উমরের ভাষায়ঃ

******************************************************

আমি যখন রাসূল (স)- এর দরবারে যাইতাম, তখন সেই দিনের ওহী ও অন্যান্য বিষয়ক খবর তাহাকে পৌছাইয়া দিতাম আর তিনি যখন যাইতেন তখন তিনিও এইরূপ করিতেন।[**************]

হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) হাদীস শিক্ষা লাভের জন্য বিশেষ আগ্রহশীল ছিলেন। তিনি দরবারে নববী হইতে কোন দিন বা কোন সময় অনুপস্থিত থাকিলে সেই সময়ে রাসূলে করীম (স) যেসব কথা বলিয়াছেন, যেসব কাজ করিয়াছেন এবং যেসব কথা ও কাজের অনুমোদন দান করিয়াছেন তাহা জানিবার জন্য সেই সময়ে যেসব সাহাবী উপস্থিত ছিলেন তাঁহাদের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইতেন।[**************] কোন হাদীস বা অপর কোন বিষয়ে তাঁহার অজানা থাকিলে তিনি স্বয়ং নবী করীম (স)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া সকল অজ্ঞতা ও শোবাহ-সন্দেহ দূর করিয়া লইতেন।[***************]

একবার লায়স বংশীয় এক ব্যক্তি হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) সূত্রে বলিল, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

 তোমরা স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ কেবল সমান পরিামণে ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় করিও না।[বুখারী শরীফ, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ২৯১।]

এই কথাটি হযরত ইবন উমরের অজানা ছিল। তিনি তখনই আবূ সাঈদ খুদরীর নিকট উপস্থি হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

আপনি রাসূল (স)- এর নিকট হইতে এই কি হাদীস বর্ণনা করিতেছেন?

সাহাবায়ে কিরাম (রা) নিজেরাও কুরআন হাদীস শিক্ষাদানের জন্য নিজ নিজ এলাকায় অনুরূপ শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করিয়াছিলেন। নবী করীম (স)- এর জীবদ্দশায়ই মদীনা শহরে নয়টি মসজিদ তৈরী হইয়াছিল। তাহাতে যেমন পাঁচ ওয়াক্ত জামা’আতের সহিত নামায পড়া হইত তেমনি প্রত্যেকটিতে দ্বীন-ইসলাম শিক্ষাদনেরও ব্যবস্থা ছিল।[******************] আবদুল কায়স গোত্রের আগত প্রতিনিধি দল এই স্বীকৃতিসহ নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেনঃ

******************************************************

আনসারগণ আমাদিগকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত শিক্ষা দিতেছিলেন।[***********]

ফরহাম ইবন মালিক (রা) ইয়ামেন হইতে ইসলামের শিক্ষা লাভের জন্য মদীনায় আগমন করেন। তাঁহার সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবন সায়াদ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি ইয়ামেন হইতে আগমন করেন এবং কুরআন, ইসলামের ফরযসময়হ ও শরীয়াতের বিধান শিক্ষা করেন। [*********]

এই প্রসঙ্গে হযরত আবূ হুরায়ারা কর্তৃক উক্ত নিম্নোক্ত কথাটিও উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি যে নিয়মিনভাবে রাসূল (স)-এর দরবারে উপস্থিত থাকিতাম তাহা সাহাবাদের ভাল করিয়াই জানা ছিল। এই জন্য তাঁহারা রাসূলে করীম (স)- এর হাদীস সম্পর্কে আমার নিকট জিজ্ঞাসা করিতেন ও জানিয়া লইতেন। তাঁহাদের মধ্যে হযরত উমর, উসমান, আলী, তালহা ও যুবায়র প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।[***************]

মদীনার বিভিন্ন অঞ্চলে সাহাবাগণ কর্তৃক স্থাপিত দ্বীন-শিক্ষার কেন্দ্রসমূহ সাধারণত দিনের বেলায়ই শিক্ষাদান করা হইত। সেই কারণে অনেক শ্রমজীবী ও বিভিন্ন পেশা-পালনকারী লোক ইহাতে শরীক হইতে ও ইলম হাসিল করার সুযোগ পাইতেন না। এইজন্য তাঁহারা নৈশ বিদ্যালয় ধরনের শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করিতে বাধ্য হন। এইসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাত্রির অন্ধকার যখন তাঁহাদিগকে ঢাকিয়া ফেলিত, তখন তাঁহারা মদীনায় অবস্থিত তাঁহাদের শিক্ষকদের নিকট চলিয়া যাইতেন। এবং সেখানে তাঁহারা সকালবেলা পর্যন্ত পড়াশোনার কাজে মশগুল হইয়া থাকিতেন।[************]

বলা বাহুল্য, এইসব কেন্দ্রে কুরআনে সঙ্গে সঙ্গে হাদীসেরও শিক্ষাদান করা হইত। ঠিক এই কারণেই অনেক সাহাবী রাসূলের নিকট হইতে বর্ণনা না করিয়া অপর কোন সাহাবীর সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত আনাম ইবন মালিক (রা)- এর নিম্নলিখিত উক্তি হইতে ইহার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমরা তোমাদের নিকট যেসব হাদীস বর্ণনা করি, তাহার সবই আমরা সরাসরি রাসূলের নিকট হইতে শুনি নাই। বরং আমাদের (সাহাবীদের ) লোকেরা পরস্পরের নিকট হাদীস বর্ণনা করিতেন।[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৫।]

হযরত বরা ইবন আজিব (রা) তাঁহার বর্ণিত হাদীসসমূহের মর্যাদা সম্পর্কে বলিতে গিয়া যে কথাটি বলিয়াছেন, তাহা হইতেও ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

 সব হাদীসই আমরা রাসূলের নিকট হইতে শুনি নাই বরং আমাদের সঙ্গী-সাথিগণও আমাদিগকে রাসূলের হাদীস শোনাইতেন। কেননা উট পালনের কাজ ও ব্যস্ততা আমাদিগকে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হইতে দিত না।[তাবকাতে ইবন সাদ ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৩; মুসতাদরাক, ১ম খণ্ড, পৃষ্টা ৯৫।]

‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্হে এই কথাটির ভাষা নিম্নরূপঃ******************************************************

আমরা সব হাদীসই রাসূলের নিকট হইতে শুনি নাই, বরং আমাদরে সঙ্গিগণ আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করিতন। আর আমরা উট চড়াইবার কাজে ব্যস্ত থাকিতাম।[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৬]

এই দীর্ঘ প্রমাণমূলক আলোচনা হইতে একথাই প্রমাণিত হয় যে, যেসব সাহাবী নবী করীম (স)- এর নিকট হইতে হাদীস শুনিতে পাইতেন, তাঁহারা অপরাপর সাহাবীদের নিকট তাহা পৌঁছাইতেন এবং যাঁহারা সরাসরি রাসূরে নিকট হইতে হাদীস শ্রবণের সুযোগ পাইনত না, তাঁহারা অপর যেসব সাহাবী তাহা শুনিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট হইতে শুনিয়া লইতেন। এইভাবে রাসূলে করীম (স)-এর প্রতেকটি হাদীস তাঁহার জীবদ্দশায়ই প্রায় সমস্ত সাহাবী পর্যন্ত গিয়াছিল।

 

হাদীসেন বাস্তব অনুসরণ

সাহাবায়ে কিরাম (রা) নবী করীম (স)-এর নিকট হইতে প্রাপ্ত হাদীস কেবল মুখস্থ রাখিয়া ও বৈঠকসমূহে উহার মৌখিক প্রচার ও পর্যালোচনা করিয়াই ক্ষান্ত থাকিতেন না। সেই সঙ্গে তাঁহারা উহাকে বাস্তবে রূপায়িত করিতেও যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেন। নবী করীম (স) যখন কোন আকীদা ও নিছক তত্ত্বমূলক কথা বলিয়াছেন,তখন সাহাবায়ে কিরাম তাহা মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন, মনে-মগজে উহাকে দৃঢ়ভাবে আসীন করিয়া লইয়াছেন এবং সেই অনুযায়ী নিজ নিজ আকীদা ও বিশ্বাস গড়িয়া তুলিয়াছেন। আর যখন কোন আদেশ-নিষেধমূলক উক্তি করিয়াছেন, কোন কাজ করার আদেশ বা কোন কাজ করিতেন নিষেধ করিয়াছেন, কোন শাসনতান্ত্রিক ফরমান জারী করিয়াছেন, তখন সাহাবায়ি কিরাম (রা) সঙ্গে সঙ্গে উহাকে কাজে পরিণত করিয়াছেন। উহাকে যতক্ষণ নিজেদের নৈমত্তিক অভ্যাসে পরিণত করা না গিয়াছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁহারা উহার চর্চা  ও অভ্যাস করিতে চেষ্টার একবিন্দু ক্রিট করেন নাই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমাদের কেহ যখন দশটি আয়াত শিক্ষালাভ করিত, তখন উহার অর্থ ভালরূপে হৃদয়ঙ্গম করা ও তদনুযায়ী আমল করার পূর্বে সে আর কিছু শিখিবার জন্য অগ্রসর হইত না।[*************]

ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সাহাবায়ে কিরাম নবী করীম (স)- এর নিকট হইতে যাহা কিছু শিক্ষালাভ করিতেন, তাহা তাঁহারা প্রথমে আমলে আনিবার জন্যই সর্বপ্রযত্নে চেষ্টা করিতেন। ফলে রাসূলের প্রত্যেকটি কথা, আদেশ ও ফরমান সাহাবায়ে কিরাম কর্তৃক অনতিবিলম্বে কার্যকর ও বাস্তবায়িত হইত।

নবী করীম (স)- এর নিম্নলিখিত ধরনের অসংখ্য আদেশবাণী হইতেও এই কথারই প্রমাল মেলে যে, ইসলামের মৌলিক আইন-কানুন সাহাবাদের বাস্তব জীবনে রূপায়িত করিয়া তোলার দিকে নবী করীম (স) নিজে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন। মুসলিমগণ ব্যক্তিগত জীবনে তাঁহার নির্দেশ মানিয়া চলে কিনা সেদিকে তিনি কড়া নজর রাখিতেন। ইসলামরে ব্যবহারিক আচার-আচরণ ও অনুসরণের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইত। ইসলামী আকীদা ও আইন মুসলমানদের অভ্যাসে ও স্বভাবে পরিণত করার জন্য বিশেষ যত্ন লওয়া হইত। দৃষ্টান্তস্বরূপ রাসূলের অসংখ্য আদেশমূলক বাণীর মধ্য হইতে এখানে দুইটি বাণীর উল্লেখ করা যাইতেছে। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়িতে দেখ, ঠিক সেইভাবেই নামায পড়।[সহীহ বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৭৬।]

হজ্জ উদযাপন সম্পর্কে নবী করীম (স) বিদায় হজ্জের ভাষণে ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা আমার নিকট হইতে হজ্জ উদযাপনের নিয়ম-কানুন গ্রহণ কর। [[(ক). ******************* মুসলিম শরীফে কথাটি এইভাবে উল্লিখিত হইয়াছেঃ

******************************************************

তোমরা যেন তোমাদের হ্জ্জ উদযাপনের নিয়মাবলী গ্রহণ কর-জানিয়া লও।

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

রাসূলের উক্ত কথার ভাবার্থ এই যে, আমার হজ্জ উদযাপনে আমি যেসব কথা, কাজ ও আল্লাহ সম্পর্কিত বিষয়াদি প্রয়োগ করিয়াছি, তাহা্ হজ্জের অনুষ্ঠান ও পরিচয়। তোমাদের জন্যও সেই নিয়ম ও অনুষ্ঠানাদি নির্দিষ্ঠ। অতএব তোমরা উহা আমার নিকট হইতে গ্রহণ কর, কবুল কর। উহা জানিয়া মুখস্থ করিয়া উহা সংরক্ষণ কর, তদনুযায়ী আমল কর, উহা অন্যন্য লোককেও শিক্ষা দাও। ইমাম নববী বলেনঃ হজ্জের অনুষ্ঠানাদি ও নিয়ম প্রণালীর ব্যাপারে ইহা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি ও উৎস। ইহা ঠিক ‘আমাকে যেমন নামায পড়িতে দেখ, তোমরা্ও সেইরূপ পড়’- এই রকমই একটি হুকুম।]]

এই ফরমানদ্বয় হইতে প্রথম প্রমাণিত হয়  যে, কুরআন মজীদে নাময, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগীর সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকিলেও এইসবের বিস্তারিত নিয়ম- কানুন তাহাতে উল্লেখ করা হয় নাই। অতএব তাহা কুরআন-বাহক বিশ্বনবীর নিকট হইতেই গ্রহণ করিতে হইবে।

দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি কাজের নিয়ম পদ্ধতি শিক্ষাদানের জন্য রাসূল (স) নিজে সেই কাজ করিয়া লোকদের সম্মুখে বাস্তব দৃষ্টান্ত পেশ করিতেন; কিভাবে কাজ করিতে হইবে, তাহা তিনি নিজে কাজ করিয়া দেখাইয়া দিতেন।

শুধু ইহাই নহে, ইবাদনের কাজে কাহারো কোন ভূল-ক্রটি পরিলক্ষিত হইলে রাসূলে করীম (স) তাহা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনও করিয়া দিতেন, ভূল ধরিয়া দিয়া তাহা শোধরাইবার জন্যও তাকীদ দিতেন। একদিন তিনি মসজিদে নববীতে একজন সাহাবীর নামায পড়া লক্ষ্য করিতেছিলেন। তিনি দেখিলেন, তাঁহার নামায ঠিক নিয়মে হইতেছে না। নামায সমাপ্ত করিয়া তিনি যখন রাসূলের নিকট আসিলেন, তখন তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

তুমি ফিরিয়া যাও, আবার নামায পড়, কেননা তুমি নামায পড় নাই।

অর্থাৎ তোমার নামায পড়া হয় নাই, যেভাবে নামায পড়িতে হয় সেভাবে পড় নাই। অতএব পুনরায় নামায পড়। এইভাবে তিন অথবা চারবার নামায পড়িলেও যখন তাঁহার নামায ঠিক নিয়মে সম্পন্ন হইল না, তখন নবী করীম (স) নিজে বাস্তবভাবে নামায পড়ার নিয়ম-কানুন সবিস্তারে শিক্ষা দিলেন।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০।]

এইভাবে সাহাবায়ে কিরাম (রা) রাসূলের সম্মুখে ও সংস্পর্শে থাকিয়া ইসলামের আদর্শিক, নীতিগত ও বাস্তব শিক্ষা এবং ট্রেনিং লাভ করিতেন। কুরআনের আয়াত নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের নিকট হইতে উহা তাঁহারাই সর্বপ্রথম শুনিতে পাইতেন। কুরআনের কোন আয়াতের ব্যাখ্যা ও বাস্তব রূপ সম্পর্কে রাসূল (স) কিছু ইরশাদ করিলে তাহা সর্বপ্রথম তাঁহাদেরই কর্ণগোচর হইত।

অপরদিকে সাহাবয়ে কিরাম (রা) নিজেরাও রাসূলের যাবতীয় কাজ-কর্ম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করিতে থাকিতেন, মন ও মগজ দ্বারা তাহা অনুধাবন করিতে চেষ্টা করিতেন। নিম্নোক্ত হাদীস কয়টি ইহার প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারেঃ

(ক) কিছু সংখ্যক লোক হযরত খাব্বার ইবনুল ইরত (রা)-কে জিজ্ঞাসা করিলঃ রাসূলে করীম (স) জুহরের নামাযে কুরআন পাঠ করিতেন কি? হযরত খাব্বাব বলিলেন, ‘হ্যা’। তখন তাহারা বলিলঃ

******************************************************

নামাযে রাসূলের কুরআন পাঠ করাকে আপনারা পিছনে থাকিয়া কিভাবে জানিতে পারিতেন?

উত্তরে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

তাহার শ্মশ্রুর নড়াচড়া দেখিয়াই আমরা ইহা জানিতে ও বুঝিতে পারিতাম।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৫; আবু দাউদঃ কিতাবুস সালাত, ১ম খণ্ড, মুস্তাদরাক হাকে, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৯।]

(খ) হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেনঃ নবী করীম (স) জুহর ও আসরের নামাযে কতক্ষন দাঁড়াইয়া থাকিতেন, তাহা আমরা অনুমান করিয়া দেখিতাম। দেখিতাম, তিনি প্রথম দুই রাকা’আতে তিন আয়াত কুরআন পারে সমান সময় এবং শেষ দুই রাকা’আতে উহার অর্ধেক পরিমাণ সময় দণ্ডায়মান থাকিতেন।[মুসলিম শরীফঃ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৫; আবূ দাউদ, কিতাবুস সালাত, ১ম খণ্ড।]

সাহাবায়ে কিরাম যে রাসূলের আমল দেখিয়াতদনুযায়ী কাজ করিতেন, তাহা নিম্নোক্ত হাদীস হইতে প্রমাণিত হয়ঃ

এক ব্যক্তি হযরত উমর (রা)- কে বলিলেনঃ ‘আমরা কুরআন মজীদে কেবল ভয়কালীন নামাযে (********) ও নিজ বাড়িতে অবস্থানকালীন নামাযের উল্লেখ দেখিতে পাই; কিন্তু সফরকালীন নামাযের কোন উল্লেখ কুরআন মজীদে পাই না। ইহার কারণ কি? উত্তরে তিনি বলিলেনঃ

আমরা দ্বীন সম্পর্কে কিছুই জানিতান না। এইরূপ অবস্থায় আল্লাহ তা’আলা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে রাসূল করিয়া পাঠাইলেন; কাজেই এখন আমরা তাঁহাকে যেভাবে দ্বীনের কাজ করিতে দেখি, ঠিক সেইভাবেই উহা পালন করি।[মুসনাদে আহমদঃ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৫।]

পূর্বোল্লিখিত হাদীসত্রয় হইতে নিম্নলিখিত কথাগুলি সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়ঃ

(ক) দ্বীন সম্পর্কে কাজকমূ রাসূল নিজে যেভাবে করিতেন, সাহাবায়ে কিরামও তাহা ঠিক সেইভাবেই করিতেন; সাহাবায়ে কিরাম রাসূলের ক্থা ও কাজ উভয়েরই হুবহু অনুকরণ করিতেন এবং এইরূপ করিলেই দ্বীন পালিত হইল বলিয়া মনে করিতেন।

(গ) রাসূলে করীম (স) দ্বীনের কোন কাজ কিভাবে করিতেন তাহা লক্ষ্য করা ও অনুসরণ করার জন্য রাসূলে করীম (স) নিজেও সাহাবিগণকে তাকীদ করিতেন এবং সাহাবায়ে কিরামও নিজেদের দ্বীন পালনের গরযে তাহা পূরণ করিতেন। কেননা দ্বীন সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় ছিল রাসূলের কথা গ্রহণ ও অনুধাবন এবং তাঁহার কাজকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা ও হাতে কলমে তাঁহার নিকট শিক্ষা গ্রহণ করা।

বস্তুত ইসলামের বিস্তারিত ও খুটিঁনাটি নিয়ম-কানুন জানার জন্য ইসলামের প্রথম সমাজ সাহাবায়ে কিরাম অপরিসীম চেষ্টা  ও অনুসন্ধিৎসা চালাইতেন। কুরআনী মূলনীতিসমূহের বুনিয়াদে ইসলামের বিস্তারিত ব্যবস্থা এইভাবে রচিত হইয়াছে।

সাহাবায়ে কিরাম (রা) এমন সব কাজেও রাসূলের হুবহু অনুসরণ করিয়া চলিতেন, যাহাতে রাসূলকে অনুস্মরণ করিয়া চলা শরীয়াত অনুযায়ী অপরিহার্যভাবে প্রয়োজন নহে। নবী করীম (স) একবার কেবলমাত্র একখানি চাদর পরিধান করিয়া নামায পড়িয়াছিলেন। প্রসিদ্দ সাহাবী হযরত জাবির একদিন তাহাই করিলেন। তাঁহার ছাত্রগণ তাহা দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ‘আপনার নিকট অতিরিক্ত চাদর থাকা সত্ত্বেও আপনি নামাযের সময় উহা ব্যবহার করিলেন না কেন? উত্তরে তিনি বলিলেন, ‘নবী করীম (স) কর্তৃক এইরূপ রুখসত দেওয়া হইয়াছে বলিয়াই আমি এইরূপ করিলাম, যেন তোমরা এই সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হইতে পার’।[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৮।]

হযরত বরা ইবনে আযিব (রা) নামাযের প্রত্যেকটি কাজে রাসূলের সহিত সাদৃশ্য স্থাপনের জন্যে প্রণপণে চেষ্টা করিতেন। একদিন তিনি পরিবারবর্গের লোকদিগকে একত্র করিয়া বলিলেনঃ ‘নবী করীম (স) যেভাবে ওযু করিতেন ও নামায পড়িতেন, তাহা আজ আমি তোমাদিগকে দেখাইব। অতঃপর তিনি ওযু করিয়া জুহর, আসর, মাগরিব ও ইশার নামায জামা’আতের সহিত আদায় করিলেন ও প্রত্যেক কাজই নবীর অনুকরণে সম্পন্ন করিলেন। রাসূল (স) কিভাবে রুকূ সিজদা করিতেন, তাহাও তিনি করিয়া দেখাইলেন’।[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৮ ও৩০৩।]

হযরত আনাস (রা) দশ বৎসর পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে রাসূলে করীম (স)-এর খিদমত করিয়াছেন। রাসূল (স)- কে যখন যেভাবে যে কাজ করিতে দেখিয়াছেন, তিনি সমগ্র জীবন সেই কাজ ঠিক সেইভাবেই সম্পন্ন করিয়াছেন। তাঁহার নামায পড়ার ধরন ও পদ্ধতি দেখিয়া হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিতেনঃ ‘ইবনে উম্মে সলীম (আনাস) অপেক্ষা রাসূলের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সাদৃশ্যশীল নামায পড়িতে আর কাহাকেও দেখি নাই’। আইনুত্তামার নামক স্থানের বাহিরের ময়দানে তিনি একদা উষ্ট্রের পৃষ্ঠে আরোহী অবস্থায় নামায পড়িতেছিলেন। উষ্ট্র কেবলামুখী দাঁড়ানো ছিল না। ইহা দেখিয়া সাথিগণ আশ্চর্যান্বিত হইয়া ইহার তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি বলিলেন, ‘নবী করীম (স)-কে এইরূপ নামায পড়িতে না দেখিলে আমি কখনই এইরূপ পড়িতাম না’। আর একদিন তিনি একখানা কাপড়ের এক দিক পরিধান করিয়া ও অপর দিক গায়ে জড়াইয়া নামায পড়িলেন। নিকটেই একখানা চাদর পড়িয়াছিল। নামায পড়া শেষ হইলে ইবরাহীম ইবন রাবীয়া (তাবেয়ী) ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে হযরত আানস (রা) বলিলেনঃ ‘আমি নবী করীম (স)-কে ঠিক এইরূপেই নামায পড়িতে দেখিয়াছি’।ফরয কাজ ছাড়া ওয়াজিব ও সুন্নাতের ব্যাপারেও তিনি নবী করীমের হুবহু অনুকরণ ও অনুসরণ করিতেন। নবী করীম (স)- এর মহান পবিত্র জীবন, জীবনের প্রত্যেকটি কাজ ও পদক্ষেপ ছিল তাঁহার এবং তাঁহার ন্যায় সহস্র লক্ষ সাহাবীর নিকট হিদায়াতের উজ্জ্বলতম আলোকস্তম্ভ।

বস্তুত সাহাবীদের এইরূপ অনুসরণের মাধ্যমেই রাসূলের প্রত্যেকটি কথা ও কাজ এবং কাজের বিবরণ চিরদিনের জন্য সুরক্ষিত রহিয়াছে, রাসূলের তৈরী করা সমাজ তাহা কোন দিনই ভুলিয়া যাইতে পারে নাই। রাসূলের হাদীস সংরক্ষণের ইহা এক অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

 

ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন

সাহাবায়ে কিরাম (রা) ইসলাম সম্পর্কে রাসূলের নিকট হইতে যাহা কিছু শিক্ষালাভ করিতেন, কুরআন ও হাদীসের যে জ্ঞান সম্পদই তাঁহারা আহরণ করিতেন, তাহা তাঁহারা কেবল নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ও কুক্ষিগত করিয়ারাখিতেন না; বরং একটি মৌলিক ও নৈতিক দায়িত্ব হিসাবেই তাহা জনগণের মধ্যে রাসূলের দরবার ও তাঁহার নিত্য সাহচর্য হইতে দূরে অবস্থিত মুসলিমদের মধ্যে প্রচার করিতে নিরন্তর ব্যস্থ হইয়া থাকিতেন। ইহা তাঁহাদের একটি প্রধান ধর্মীয় কর্তব্য ছিল। আর প্রকৃতপক্ষে ই দায়িত্ব পালনের জন্যই আল্লাহ তা’আলা নবী করীম (স)-এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মতকে গঠন করিয়াছিলেন। মুসলিম জাতির ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বর্ণনা করিয়াকুরআন মজীদ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেনঃ

******************************************************

এইভাবেই আমি তোমাদিগকে মধ্যম পন্হানুসারী উম্মত বানাইয়াছি, যেন তোমরা জনগনের পথপ্রদর্শক হও এবং রাসূল হইবে তোমাদের পথ প্রদর্শনকারী।[সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৪৩।]

কুরআনের এই ঘোষণা অনুযায়ী সাহাবায়ে কিরাম (রা) সত্যের বাস্তব প্রতীকরূপে নিজেদের জীবন ও চরিত্র গড়িয়া তোলার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণকেও সত্য পথ প্রদর্শন এবং সত্যের দিকে আহবান জানাইবার দায়িত্ব ও কর্তব্য মর্মে অনুভব করিতেন। এই ব্যাপারে তাঁহারা কোন প্রকার বাধ্য বা কষ্ট ও ক্লান্তিকে বিন্দুমাত্র পরোয়া করিতেন না।কোন আঘাতই তাঁহাদিগকে এই পথ হইতে বিরত রাখিতে পারিত না। উপরন্তু দ্বীনের কোন কথা জানিতে পারিলে তাহা গোপন রাখিয়া অপর লোকদের নিকট তাহা প্রকাশ না করিয়া দুনিয়া হইতে চলিয়া যাওয়াকে তাঁহারা মারাত্মক অপরাধ বলিয়া মনে করিতেন। কেননা তাঁহারা কুরআনের নিম্নোক্ত ঘোষনার কারণে এই দিক দিয়া অন্যন্ত ভীত, শংকিত ও সন্ত্রস্ত হইয়া থাকিতেন। আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি যে সুস্পষ্ট বিধান নাযিল করিয়াছি, জনগনের জন্য হিদায়াতের যে বাণী প্রেরণ করিয়াছে এবং আমি যাহার ব্যাখ্যাও কিতাবের মধ্যে করিয়া দিয়াছি, তাহার পর উহা যাহারা গোপন করিয়া রাখিবে, তাঁহাদের উপর আল্লাহ এবং সমস্ত অভিশাপ বর্ষণকারীরা অভিশাপ বর্ষণ করেন।[সূরা-আল- বাকারা, আয়াত ১৫৯]

এই কঠোর সতর্কবাণী শ্রবণের পর কোন সাহাবীই দ্বীন সম্পর্কিত একটি ছোট্র কথাও গোপন করিয়া রাখার মত দুঃসাহস করিতে পারেন না। কোন সাহাবীকে ইসলামের কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহার জ্ঞানমত তাহার জওয়াব দেওয়া কর্তব্য মনে করিতেন। কেননা নবী করীমের নিম্নোক্ত বাণী তাঁহাদের স্মরণ ছিলঃ

******************************************************

কেহ কোন জ্ঞানে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হইলেও তাহা সে গোপন করিলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাহাকে আগুনের লাগাম পরাইয়া দিবেন।[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০১।]

সেই কারণে একথা জোর করিয়াই বলা যাইতে পারে যে, নবী করীম (স) যে ইসলামী সমাজ গঠন করিয়াছিলেন, তাহা সামগ্রিকভাবে কুরআন হাদীস প্রচারের একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মত কাজ করিতেছিল। হৃৎপিণ্ড হইতে রক্ত উৎসারিত হইয়া সমগ্র দেহে-দেহের প্রতিটি ক্ষুদ্র-বৃহৎঅঙ্গে যেমন স্থায়ী ও স্বয়ংক্রিয় ধমনীর মাধ্যমে সঞ্চালিত ও প্রবাহিত হয়, ইসলামে হাদীস সম্পদও নবী করীমের নিকট হইতে উৎসারিত হইয়া প্রতিটি মুসলিমের অক্লান্ত চেষ্টা ও তৎপরতার ফলে মানব সমাজের দূরবর্তী কেন্দ্রসমূহে পৌঁছিয়াছে।

ইসলাম প্রচারের এই ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন ছাড়াও নবী করীম (স)- এর জীবদ্দশায় সরকারী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও হাদীস প্রচারিত হইয়াছে। কেননা নবী করীম (স) বিভিন্ন স্থানে ও দেশে ইসলাম প্রচারকার্যে ব্যক্তি ও দল প্রেরণ করিয়াছেন। এ পর্যায়ে আমরা কয়েকটি প্রসিদ্ধ ঘটনার উল্লেখ করিতেছি।

হযরত আবূ ইমাম বাহেলী (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স) আমাকে আমার নিজ কবীলা ও এলাকার লোকদের প্রতি তাহাদিগকে আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দান ও তাহাদের সম্মুখে ইসলামী শরীয়াতের বিধান পেশ করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করিয়াছেন।[মুস্তাদরাক হাকেম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪১।]

নবী করীম (স)-এর খিদমতে একদল আনসার অবস্থান করিতেন। তাঁহারা দিনের বেলা পানি বহন করিতেন, কাষ্ঠ সংগ্রহ করিতেন এবং তাহা বিক্রয় করিয়া সুফফার অধিবাসীদের জন্য খাদ্য ক্রয় করিতেন। আর রাত্রিবেলা কুরআন ও হাদীস অধ্যয়ন করিতেন। একবার কয়েজন মুনাফিক একত্র হইয়া রাসূলের নিকট বলিলঃ

******************************************************

আমাদিগকে কুরআন ও হাদীস শিক্ষাদান করিবে এমন কিছু লোক আমাদের সহিত পাঠাইয়া দিন।

নবী করীম (স) এই উদ্দেশ্যে উপরিউক্ত লোকদের মধ্য হইতে সত্তর জন লোককে তাহাদের সহিত প্রেরণ করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পথের মাঝখানেই মুনাফিকরা তাঁহাদের উপর আকস্মিক আক্রমন চালায় ও তাঁহাদিগকে শহীদ করিয়া দেয়।[সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৯। ********************]

হিজরতের প্রাক্কালে হযরত আবূ যর গিফারী (রা) নবী করীম (স)- এর নিকট মক্কা শরীফে ইসলাম কবুল করেন। নবী করীম (স) তাঁহাকে বলিলেনঃ

******************************************************

আমাকে খেজুরের দেশে চলিয়া যাইবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। আমি মনে করি উহা ‘ইয়াসরিব’ বা মদীনা ছাড়া অন্য কোন দেশ হইবে না। এখন তুমি কি আমার পক্ষ হইতে তোমার নিজ গোত্র ও এলাকার লোকদিগকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার কাজ করিতে পারিবে?

আবূ যর গিফারী (রা) সানন্দে এই দায়িত্ব কবুল করিলেন ও নিজ দেশে পৌঁছিয়া লোকদিগকে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। তিনি রাসূলে করীম (স)- এর নিকট হইতে ইসলামের যেসব কথা জানিয়া লইয়াছিলেন, তাহা তাঁহার কবীলা ও দেশের লোকদের নিকট প্রকাশ করিয়া বলিলেন। ফলে বহু লোক ইসলাম কবুল করেন।[সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৭৬।******************]

অনুরূপভাবে কায়স ইবনে নাশিয়া আসলামী (রা) ইসলাম কবুল করার পর নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি নিজ গোত্র ও এলাকার লোকদিগকে বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

হে বনু সুলাইমের লোকেরা  ! আমি রোমান ও পারসিক জাতির সাহিত্য আরব কবিদের কবিতা, কুহানদের কাহিনী এবং হেমইয়ারের কাব্য শুনিয়াছি। কিন্তু মুহাম্মদের কালামের সহিত উহার কোনই তুলনা হইতে পারে না- উহা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবধারার জিনিস। অতএব, তোমরা মুহাম্মদের প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারে আমার অনুসরণ কর।[***************]

হযরত আমর ইবনে হাজম (রা) কে নবী করীম (স) নাজরান গোত্রের প্রতি প্রেরণ করিয়াছিলেন এই উদ্দেশ্যে যে-

******************************************************

তিনি তাহাদিগকে দ্বীন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানদান করিবেন ও কুরআন শিক্ষা দিবেন।[*************]

হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রা) কে নবী করীম (স) ইয়ামেনে পাঠাইয়াছিলেনঃ

******************************************************

ইয়ামেন ও হাজরা মাউতের অধিবাসীদের শিক্ষক হিসাবে।[******************]

‘কারবা’ ও ‘আদল’ নামরে দুইটি গোত্র হিজরতের তৃতীয় বৎসরে ইসলাম কবুল করিলে নবী করীম (স) তাহাদের জন্য ছয়জন শিক্ষক প্রেরণ করিলেনঃ

******************************************************

‘নবী করীম (স) আদল ও কাররা’ নামক গোত্রদ্বয়ের প্রতি দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান দান, কুরআন ও ইসলামী শরীয়াতের বিধান শিক্ষাদানের জন্য ছয়জন শিক্ষক প্রেরণ করেন। তাঁহারা হইলেনঃ মারসাদ ইবন আবী মারসাদ, আসেম ইবন সাবেত, হাবীব ইবন আদী, খালেদ ইবনুল বুকায়ার, যায়দ ইবন দাসনা এবং আবদুল্লাহ ইবন তারেক (রা)।[*******************]

মক্কা বিজয়ের পর সমগ্র আরব জাহান ইসলাম কবুল করার জন্য প্রস্তুত হইয়া উঠে। তখন লোকেরা নিজ নিজ কবীলা সর্দারদেরকে নবী করীম (স)-এর নিকট পাঠাইতে শুরু করে। তাহারা ইসলাম কবুল করিয়া নিজ নিজ কবীলা ও এলাকার লোকদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে এবং তাহাদিগকে ইসলামের দাওয়াত দেয় ও ইসলামী জ্ঞান-কুরআন হাদীস প্রচার করে।[**************

এতদ্ব্যতীত বহু সংখ্যক সাহাবীকে নবী করীম (স) ব্যক্তিগত বা দলগতভাবে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন।[**********************] তখন ইহাদের মাধ্যমে যেমন কুরআন মজীদ ও উহার ভাষ্য হিসাবে রাসূলের হাদীসও বিপুলভাবে প্রচার লাভ করিয়াছে।

নবী করীম (স) যেসব সাহাবীকে ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশে গভর্নর নিযুক্ত করিয়া পাঠাইয়াছেন, তাঁহারা শাসনকার্য সম্পাদনের জন্য কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসকেও অন্যতম ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন। এই প্রসংগে হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রা)- এর সাথে তাঁহাকে ইয়ামেনের গভর্নর নিযুক্ত করিয়া পাঠাইবার সময়ে রাসূলে করীম (স)-এর যে কথোপকথন হইয়াছিল, তাহা বিশেষভাবে স্মরণীয়। নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কিসের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করিবে? মু’আয বলিলেন, কুরআনের ভিত্তিতে। জিজ্ঞাসা করিলেনঃ সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সম্পর্কে কুরআনে যদি কিছু না পাওয়া যায়, তখন? মু’আয বলিলেনঃ

******************************************************

রাসূলের সুন্নাতের ভিত্তিতে কার্য সম্পাদন করিব।

এই আলোচনার শেষভাগে রাসূলে করীম (স) অতিশয় সন্তোষ সহকারে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করিলেন এবং হযরত মু’আযের বক্ষস্থলে হাত রাখিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

যে আল্লাহ তাঁহার রাসূলের প্রেরিত ব্যক্তিকে আল্লাহর রাসূলের সন্তোষমূলক কাজ ও নীতি নির্ধারণ করার তওফীক দিয়াছেন, তাঁহারই প্রশংসা।[************************]

এই প্রসঙ্গে শেষ কথা এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রায় সর্বত্রই রাসূলের প্রেরিত লোকদের চেষ্টা ও যত্নে রাসূলের জীবদ্দশায়ই হাদীস পৌছিয়াছে। সর্বত্র উহার চর্চা শুরু হইয়া গিয়াছে।ইহার ফলে দূর-দূরান্তরে অবস্থিত মুসলিমগণ কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের হাদীসের সহিত সম্যক পরিচয় লাভ করিতে সমর্থ হয়।

 

সাহাবীদের হাদীস প্রচার ও শিক্ষাদান

ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পাল ব্যাপারে দেশে দেশে সাহাবিগণের মাধ্যমে কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীস ও প্রচারিত হইয়াছে। এই পর্যায়ে আমরা সাহাবিগণের বিশেষভাবে হাদীস প্রচার সংক্রান্ত সাধনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করিব।

কিন্তু সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে ‘সাহাবী’ কাহাকে বলে; কে সাহাবী, কে নয়; এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ও মৌলিক আলোচনা এইখানে পেশ করা আবশ্যক।

ইমাম বুখারী ও আহমদ ইবন হাম্বল প্রমুখ প্রখ্যাত মুহাদ্দিসের মত এই যেঃ

******************************************************

যিনি রাসূল (স)-কে দেখিতে পাইয়াছেন, তাঁহার মধ্যে পার্থক্যবোধ বর্তমান ছিল, তাঁহার প্রতি ঈমানদার এবং ইসলামের উপরই তাঁহার জীবনাবসান ঘটিয়াছে, তিনিই সাহাবী। রাসূলের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ-বৈঠক দীর্ঘ হউক কি সংক্ষিপ্ত হইয়া থাকুক, তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করুন আর নাই করুন, তাঁহার সহিত মিলিয়া যুদ্ধ করুন আর না-ই করুন তিনিই সাহাবীরূপে গণ্য হইবেন।[*********************]

ইমাম বুখারী তাঁহার সহীহ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

যে মুসলমান রাসূলের সংস্পশ লাভ করিয়াছে কিংবা যে মুসলমান তাঁহাকে দেখিয়াছে, সে-ই রাসূলের সাহাবী।[************]

আবুল মুযাফফর আস সাময়ানী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস বিজ্ঞানিগণ এমন সকল লোককেই সাহাবী বলেন, যাঁহারা রাসূলের নিকট হইতে একটি হাদীস বা একটি কথাও বর্ণনা করিয়াছেন।[**************]

আল্লাহ নিজেই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে সাহাবীদের প্রশংসা ও পরিচয় দান করিয়াছেন। এক জায়গায় অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত ও অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁহার সঙ্গের লোক (সাহাবী)-গণ কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; তাঁহারা পরস্পরের প্রতি অনুগ্রহ ও ভালবাসাসম্পন্ন। তুমি তাহাদিগকে সব সময় রুকূ ও সিজদা দানকারী-বিনীত ও আল্লাহর সম্মুখে অবনত দেখিতে পাইবে। তাহারা সব সময়ই আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তোয় লাভের অভিলাষী। তাঁহাদের কপালদেশে সিজদার চিহ্ন অংকিত রহিয়াছে।[সূরা আল-ফাতহ, ২৯ আয়াত।]

অন্যত্র বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

আল্লাহ এই মু’মিন (সাহাবী-দের প্রতি বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছেন- যখন তাহারা বৃক্ষের নীচে বসিয়া (হে নবী) তোমার হাতে বায়’আত করিতেছিল। অতঃপর তাহাদের দিলের কথা আল্লাহ তা’আলা জানিতে পারিলেন।[ঐ, ১৮ আয়াত।]

সহীহ হাদীসেও সাহাবীদের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা উদ্ধৃত হইয়াছে।

একটি হাদীসে রাসূল (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা আমার সাহাবীকে গালাগাল করিও না। কেননা যাঁহার হস্তে আমার প্রাণ- সেই আল্লাহর শপথ, তোমাদের কেহ যদি ওহুদ পর্বত সমান স্বর্ণও দান করে, তবুও সে একজন সাহাবীর সমান বা তাহার অর্ধেক মর্যাদাও পাইতে পারিবে না।[মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১০, বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১৮।]

বস্তুত এই সাহাবিগণের আপ্রাণ চেষ্টা-সাধনা ও অসীম-অতুলনীয় আত্মত্যাগের ফলে একদিকে যেমন ইসলাম প্রচার হইয়াছে অপরদিকে ঠিক তেমনি রাসূলে করীম (স)-এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র পূর্ণ মাত্রায় সুরক্ষিতও রহিয়াছে। সাহাবিগণই কুরআন-হাদীসের জ্ঞান রাসূলের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছেন, সেই সঙ্গে দুনিয়ার দিকে দিকে উহার অমিয়ধারা প্রবাহিত করিয়া বিশ্ববাসীকে চিরধন্য করার ব্যবস্থাও করিয়াছেন।

কাজেই হাদীসের প্রথম গ্রাহক, বাহক ও প্রচারক হওয়ার কারণে সাহাবিগণ বিশ্ব মুসলিমের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন, তাহাতে একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ নাই।

বস্তুত হাদীস শিক্ষাকরা, সংরক্ষণ ও মুখস্থ করা এবং উহার প্রচার ও শিক্ষাদান সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)- এর নির্দেশ পাইয়া সাহাবিগণ নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিয়া থাকিতে পারেন নাই। বরং তাঁহারা নিজেরা যেমন হাদীসের প্রতি যথোপযুক্ত গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন, নিজেরা উহার শিক্ষালাভও করিয়াছেন, মুখস্থ করিয়াছেন, অনরূপভাবে হাদীস অনভিজ্ঞ লোকদের পর্যন্ত তাহা পৌঁছাইবার, তাহাদিগকেও হাদীস শিক্ষায় পূর্ণ শিক্ষিত করিয়া তুলিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছেন। নবী করীম (স)- এর জীবদ্দশায় তো বটেই, তাঁহার ইন্তেকালের পরও তাঁহারা কুরআন মজীদের সঙ্গে সঙ্গে হাদীস প্রচারে  ও হাদীসের শিক্ষাদনে বিন্দুমাত্র গাফিলতি করেন নাই। হযরতের ইন্তেকালের পর সমগ্র ইসলামী রাষ্ট্রের দিকে দিকে এবং দূরবর্তী বহু অমুসলিম দেশে তাঁহারা ছড়াইয়া পড়েন এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে ও পরিমণ্ডলে হাদীস ও ইসলামী জ্ঞান-বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। এইখানে কয়েকজন বিশিষ্টি সাহাবীর হাদীস প্রচার এবং শিক্ষাদানের ঐতিহাসিক ও প্রামাণ্য বিবরণ পেশ করিতেছিঃ

১ হযরত আবূ ইদরীস খাওলানী (রা) বলেনঃ আমি হিমস শহরের মসজিদে অনুষ্ঠিত এক মজলিসে শরীক হইলাম। ইহাতে ৩২ জন সাহাবী উপস্থিত ছিলেন। এখানে সমষ্টিগতভাবে হাদীসের চর্চা ও শিক্ষাদান করা হইতেছিল। একজন সাহাবী হাদীস বর্ণনা সমাপ্ত করিলে ইহার পর দ্বিতীয়জন হাদীস বর্ণনা শুরু করিতেন।[মুসনাদে আহমাদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৮।]

২. নসর ইবন আসেমুল লাইসী বলেনঃ আমি কুফা শহরের জামে মসজিদে একটি জনসমাবেশ দেখিতে পাইলাম। সকল লোক নির্বাক ও নিশ্চল হইয়া এক ব্যক্তির দিকে গভীর অভিনিবেশ ও অধীর আগ্রহ সহকারে উম্মুখ ও নিস্পলক দৃষ্টিকে তাকাইয়া আছে। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, ইনি প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত হুযায়ফা ইবন ইয়ামান (রা) এবং তিনি হাদীসের শিক্ষা দান করিতেছেন।[মুসনাদে আহমদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৬।]

৩. উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা) মদীনায় হাদীস শিক্ষা দানের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁহার নিকট এক সংগে শিক্ষার্থী লোকের সংখ্যা দুইশতেরও অধিক ছিল। তন্মধ্যে ৩৮ জন ছিলেন মহিলা। হযরত আবু মুসা আশ’আরী, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, আমর ইবনুল আস প্রমুখ শদ্ধাভাজন সাহাবী তাঁহার দরসে হাদীসের মজলিসে নিমিত শরীক হইতেন।[তাযকিরাতুল হুফফায যাহবী, হযরত আবূ দারদা প্রসংগ।]

৪. কফা নগরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নিয়মিতভাবে হাদীসের দরস দিতেন। তাঁহার দরসে অন্যূন্য চারি সহস্র ছাত্রশ্রোতা সমবেত হইত।[আসরারুল আনওয়ার প্রন্হ দ্রঃ।]

৫. হযরত আবুদ্দরদা (রা) [এই সাহাবীর নাম হইল উয়াইমির ইবন যায়দ, পৃষ্ঠা ৩২।] দামেশকে বসবাস করিতেন। তিনি যখন মসজিদে হাদীসের দরস দিতে উপস্থিত হইতেন, তখন তাঁহার সম্মুখে এত বিপুল সংখ্যক শ্রোতার সমাবেশ হইত যে, তাহাদের মাঝে তাঁহাকে মনে হইত যেন শাহানশাহ্ বসিয়া আছেন।[তাযকিরাতুল হুফফায, আবু দারদার প্রসঙ্গ।]

‘তাযকিরাতুল হুফফায কিতাবে উল্লেখ করা হইয়াছে, হযরত আবুদ্দারদার দরসের মজলিসে অন্তত ষোলশত ছাত্র রীতিমত যোগদান করিত।

৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) ইলমে হাদীসের মহাসমুদ্র আয়ত্ত করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহা তিনি কেবলম্রাত নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন নাই, উহা দ্বারা তিনি সহস্র লক্ষ মুসলিমের জ্ঞান পিপাসা নিবৃত্ত করিতেন। ফলে তাঁহার দ্বারা হাদীসের ব্যাপক প্রচার সাধিত হয়। তিনি নবী করীম (স)- এর ইন্তেকালের পর ষাট বৎসরেরও অধিককাল জীবিত ছিলেন (মৃঃ৭৪ হিঃ)। এই দীর্ঘ জীবনে হাদীসের শিক্ষাদান ও প্রচার সাধনই ছিল তাঁহার প্রধান কাজ। [*****************] এই কারণে তিনি কোন চাকরি পর্যন্ত গ্রহণ করেন নাই। কেননা তাহাতে এই মহান কাজ ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হইত।

তিনি মদীনা শরীফে স্থায়ীভাবে দরসে হাদীসের মজলিস অনুষ্ঠান করিতেন। বিশেষত হজ্জের সময় যখন বিপুল সংখ্যক মসলমান মদীনায় সমবেত হইতেন, তখন তিনি তাঁহাদের নিকট হাদীস পেশ করিতেন। ইহার ফলে মুসলিম জাহানের দুরতম কেন্দ্র পর্যন্ত রাসূলের হাদীস অতি সহজেই পৌঁছিয়া যাইত।[উসদুল গাবাহ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৮।]এতদ্ব্যতীত লোকদের ঘরে ঘরে পৌঁছিয়াও তিনি হাদীসের প্রচার করিতেন। ইয়াযীদ ইবন মুয়াবিয়ার শাসনামলে তিনি আবদুল্লাহ ইবন মুতীর ঘরে উপস্থিত হইলেন। তাঁহার জন্য বিছানা ও শয্যা ঠিক করিতে বলা হইলে হযরত আবদুল্লাহ ইব উমর (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

আমি তোমার ঘরে বসিবার জন্য আসি নাই, শুধু একটি হাদীস শুনাইবার উদ্দেশ্যে আসিয়াছি। হাদীসটি আমি নবী করীম (স)-এর নিকট হইতে শুনিয়াছিলাম।

অতঃপর তিনি বলিলেন, আমি নবী করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছিঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি আমীরর তথা ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য হইতে বিরত থাকে, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে এমন অবস্থায় উপস্থিত হইবে যে, তাহার সে কৈফয়ত দেওয়ার কিছুই থাকিবে না। আর যে লোক আমীরের নিকট বায়আত না করিয়া মরিবে, তাহার জাহিলিয়াতের মৃত্যু ঘটিবে।[মুসলিম শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২৮। মুসনাদে আহমদ ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৫৪।]

৭.  হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) কথায় কথায় হাদীস প্রচার করিতেন ও লোকদিগকে হাদীসের শিক্ষাদান করিতেন। আলী ইবন আবদুর রহমান বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) আমাকে নামাযের মধ্যে পাথরকুচি লইয়া খেলা করিতে দেখিলেন। আমি নামায শেষ করিলে তিনি আমাকে এইরূপ করিতে নিষেধ করিলেন এবং বলিলেনঃ

******************************************************

রাসূল (স) যেইরূপ সুন্দরভাবে নামায পড়িতেন, তুমিও সেইভাবেই নামায পড়।

রাসূল (স) কিভাবে নামায পড়িতেন জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

রাসূল (স) যখন নামাযে বসিতেন, তখন ডান হাত ডান রানের উপর রাখিতেন, এবং সবগুলি অংগুলি বন্ধ করিয়া লইতেন, এবং বৃদ্ধাঙ্গুলির পাশের অংগুলি দ্বারা ইশারা করিতেন। আর বাম হাত বাম রানের উপর স্থাপন করিতেন।[মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ, পৃঃ ৫৩ (তরজমা সহ)]

বহু দিন পর্যন্ত একটি বিশেষ হাদীস বর্ণনা না করায় সাহাবীদের মনে ভয় জাগ্রত হইত যে, ইহা বর্ণনা না করিলে ও উহাকে গোপন করিয়া রাখিলে গুনাহ করা হইবে। অতএব উহা আর গোপন রাখা যায় না। তখনই তিনি তাহা লোকদের নিকট বর্ণনা করিতেন। হযরত উসমান (রা) সম্পর্কে নিম্নোক্ত বর্ণনা হইতে ইহার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়ঃ

******************************************************

হযরত উসমান (রা) যখন অযূ করিলেন, তখন বলিলেনঃ আমি তোমাদের নিকট নিশ্চয়ই একটি হাদীস বর্ণনা করিব। অবশ্য যদি একটি আয়াত না থাকিত, তাহা হইলে আমি তাহা তোমাদিগকে কিছুতেই বলিতাম না। আমি শুনিয়াছি, নবী করীম (স) বলিতেছিলেনঃ কোন ব্যক্তি যদি অযূ করে, তাহার অযূ সর্বাঙ্গ সুন্দর করিয়া সম্পন্ন করে এবং নামায আদায় করে, তবে তাহার ও নামাযের মধ্যে যত গুনাহ হইবে, তাহা সব মাফ করিয়া দেওয়া হইবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে নামায সম্পন্ন করিতে থাকিবে। হাদীসের বর্ণনাকারী উত্তরে বলেনঃ সে আয়াতটি হইল এইঃ ‘নিশ্চয়ই যাহারা আমার নাযিল করা কথাকে গোপন করে.................’।[সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮।

উদ্বৃত আয়াতটিকে হযরত উসমান (রা)- এর হাদীস গোপন করায় গুনাহ হওয়া সম্পর্কে প্রমাণ হিসাবে পেশ করা হএত এইকথা প্রমাণিত হয় যে, তিনি ওইসব সাহাবায়ে কিরাম হাদীসকে ‘আল্লাহর নিকট হইতে অবতীর্ণ কথা মনে করিতেন। অন্যথায় এই আয়াত যুক্তি হিসাবে পেশ করা এবং আয়াতে উল্লিখিত গুনাহ ও শাস্তির ভায়ে বহু দিনের বর্ণনা না করা হাদীসকে বর্ণনা করা এবং এই কথা বলা যে, এই আয়াত না থাকিলে আমি কিছুতেই এই হাদীস বর্ণনা করিতাম না-ইহার কোনই তাৎপর্য থাকিতে পারে না।]

মৃত্যুশয্যায় শায়িত থাকা অবস্থায়ও সাহাবায়ে কিরাম (রা) প্রয়োজনবশত রাসূল (স)-এর হাদীস বর্ণনা করিতেন। হাসান বসরী বলেন৬ হযরত মাম্বকাল মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন, তখন সেখানে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ উপস্থিত হইলেন। এই সময় হযরত মাম্বকাল বলিলেনঃ

******************************************************

আমি তোমাকে রাসূল (স)-এর নিকট হইতে শ্রুত একটি হাদীস শুনাইব। তিনি বলিয়াছেনঃ আল্লাহ যে বান্দকে জনগণের শাসন পরিচালনার দায়িত্ব দিবেন, সে যদি তাহাদিগকে সদুপদেশ দিয়া ও তাহাদের কল্যাণবোধ করিয়া তাহাদের হিফাজত না করে, তবে সে বেহেশতের সুগন্ধিটুকুও পাইবে না।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৫৮।]

হযরত আবূ আয়্যূব আনসারী (রা) মৃত্যূশয্যায় শায়িত থাকা অবস্থায় হাদীস প্রচারের দায়িত্বানুভূতিতে কম্পিত হইয়াছিলেন। মৃত্যুর প্রাক্কালে তিনি এমন দুইটি হাদীস বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, যাহা তিনি পূর্বে কখনও বর্ণনা করেন নাই। তাঁহার ইন্তেকালের পর সাধারণ ঘোষনার মাধ্যমে হাদীস দুইটিকে মুসলিম জনগণের নিকট পৌঁছানো হয়।[মুসনাদে আহমদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৪।]

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) সম্পর্কেও এই ধরনের একটি ঘটনা ইবনে আবী শায়বাহ কর্তৃক উদ্ধৃত হইয়াছে। তিনি রোগশয্যায় শায়িত ছিলেন; তখন তিনি উপস্থিত লোকদের বলিলেনঃ

******************************************************

তোমরা আমাকে উঠাইয়া বসাইয়া দাও, কেননা রাসূল করীম (স)-এর রক্ষিত এক আমানত আমার নিকট সংরক্ষিত রহিয়াছে, আমি তাহা তোমাদের নিকট পৌঁছাইতে চাই।

অতঃপর তাঁহাকে বসাইয়া দেওয়া হইলে তিনি বর্ণনা করিলেনঃ

******************************************************

তোমাদের কেহ যেন তাহার নামাযেন মধ্যে এদিক-ওদিক না তাকায়। যদি কেহ তাকায়-ই তবে যেন ফরয নামায ছাড়া অন্য নামাযে করা হয়।[তাফসীরে রুহুল-মাআনী, ১৮ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩।]

আবুল আলীয়া তাবেয়ী বলেনঃ

******************************************************

আমরা বসরা শহরে রাসূল (স)-এর সাহাবীদের বর্ণিত হাদীসের বর্ণনা লোকদের নিকট শুনিতে পাইতাম; কিন্তু আমরা তাহাতে কিছুম্রাত সন্তুষ্ট বা পরিতৃপ্ত হইতে পারিতাম না, যতক্ষণ মদীনায় গমন করিয়া উহা তাঁহাদের নিজেদের মুখ হইতে শুনিয়া না লইতাম।[মুসনাদে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৪।]

বস্তুত মুসলিম জাহানের বিভিন্ন কেন্দ্র হইতে ইসলামী ইলম, হাদীস ও কুরআন শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে অসংখ্য মুসলমান সাহাবায়ে কিরামরে খিদমতে উপস্থিত হইত। তাঁহারা তাহাদিগকে সমাদরে ও সোৎসাহে গ্রহণ করিতেন এবং তাহাদের নিকট হাদসী পেশ কিরতনে। বিশেষত হযরত আবু হুরায়রা (রা) ও হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত হইয়াছে যে, তাঁহাদের দরবার হাদীস শিক্ষাথীদের বিপুল ভীড় জমিয়া যাইত। কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা হইলে তাহার জওয়াব পাইতে যথেষ্ট বিলম্ব হইত।[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯২; তিরমিযী আওয়াবুল ইলম।]

হযরত ইবন আব্বাস (রা) তাঁহার পুত্র আলী এবং দাস ইকরামাকে হযরত আবূ সাঈদ খুদরীর নিকট হাদীস শ্রবণের জন্য পাঠাইলেন। তাঁহারা যখন পৌঁছিল, তখন তিনি বাগানে ছিলেন। তাহাদিগকে দেখিয়া তিনি তাহাদের নিকট আসিয়া বসিলেন এবং হাদীস (বর্ণনা করিয়া) শুনাইলেন।[ঐ]

৮. হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) ইলমে হাদীসের প্রচারে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। সমগ্র জীবনই তিনি হাদীস শিক্ষাদানের পরিমণ্ডলে অতিবাহিত করেন। রাসূলে করীম (স)-এর অপরাপর সাহাবিগণ যখন নানা যুদ্ধে ব্যস্ত হইয়াছিলেন, সেই সময় তিনি বসরার জামে মসজিদে রাসূল (স)-এর হাদীস প্রচার ও শিক্ষাদানের কাজে গভীরভাবে নিমগ্ন হইয়াছিলেন। তাঁহার হাদীস বয়ানের মজলিসে মক্কা, মদীনা, বসরা, কুফা ও সিরিয়া হইতে বিপুল সংখ্যক লোক উপস্থিত থাকিত। তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের অন্যতম। তাঁহার বর্ণিত ৮০ টি হাদীস সহীহ বুখারী শরীফে, ৭০ টি হাদীস সহীহ মুসলিম শরীফে এবং ‌১২৮ টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হে স্থান পাইয়াছে।

৯. হযরত উবায় ইবন কাম্বব (রা) হাদীসে বিশেষ ব্যুৎপত্তি রাখিতেন, যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স)-এর নিকট হইতে যাহারা অধিক সংখ্যক হাদীস শুনিয়াছেন, হযরত উবায় তাঁহাদের একজন।[তাযকিয়াতুল হুফফাজ-উবায় প্রসঙ্গ।] হাদীস প্রচারক বহু সাহাবীকেই প্রথমে তাঁহার নিকট শাগরেদী করিতে হইয়াছেন।

১০.  মদীনার শাসনকর্তা আমর ইবন সাঈদ মক্কায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়রের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করিতেছিলেন, তকন হযরত আবু শুরায়হ (রা) তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

হে আমীর ! আমাকে অনুমকি দিন, আমি আপনাকে রাসূল (স)-এর একটি হাদীস শুনাইব, যাহা তিনি মক্কা বিজয়ের পরের দিন দাঁড়াইয়া বলিয়াছিলেন-আমার দুই কর্ণ তাহা শ্রবণ করিয়াছে, আমার অন্তঃকরণ তাহা হিফাজত  ও মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছে এবং তিনি যখন কথা বলিয়াছিলেন, তখন তাঁহাকে আমার এই দুই চক্ষু দেখিতেছিল। অতঃপর মক্কার হেরেম হওয়ার ও অন্যান্য কথা সম্বলিত একটি হাদীস শুনাইয়া দেন।[বুখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা২১।]

হযরত আবূ শুরায়হার কথা হইতে প্রথমত এই জানা যায় যে, তিনি হাদীস পূর্ণমাত্রায় মুখস্থ ও হিফাজত করিয়া রখিয়াছিলন এবং দ্বিতীয়ত তিনি হাদীস বর্ণনার দায়িত্ব পালনে সবসময়ই প্রস্তুত থাকিতেন।

হযরত জাবির ইবনে আদুল্লাহ (রা)- ও মসজিদে নববীতে বসিয়া রীতিমত হাদীসের দরস দিতেন। আল্লামা সুয়ুতি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মসজিদে নববীতেই হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহর একটি শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। সেখানে লোকেরা একত্র হইয়া তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করিত।[*************]

সাহাবায়ে কিরাম (রা) লোকদিগকে হাদীসের কেবল মৌখিক শিক্ষাদান করিয়াই ক্ষান্ত হইতেন না, বরং হাদীস যাহাতে লোকেরা মুখস্থ করে এবং উহাকে তাহারা নিজেদের স্মৃতিপটে চিরদিনের তরে মুদ্রিত ও সুরক্ষিত রাখিতে পারে, সেইজন্য ও তাহারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করিতেন ও বিশেষ যত্ন লইতেন। হাদীস মুখস্থ করা সম্পর্কে সাহাবীদের নিজস্ব প্রচেষ্টার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। এখানে আমরা দেখাইতে চেষ্টা করিব যে, সাহাবিগণের নিকট যাহারা হাদীস শিক্ষার্থে আসিতেন- তাঁহাদিগকে হাদীস মুখস্থ করাইবার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করিতেন।

ইসলামের এই প্রথম যুগে মুসলমানগণ তাহাদের ছোট ছেলেমেয়েকে যেমন কুরআন মুখস্থ করার উদ্দেশ্যে বিশেষ বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করিতেন, অনুরূপভাবে হাদীস শিক্ষাকেন্দ্রে নিজেদের সন্তান-সন্ততিদিগকে প্রেরণ করিতেন। এতদ্ব্যতীত লোকদিগকে তাঁহারা হাদীস মুখস্থ করিবার জন্য বিশেষ তাকীদ করিতেন- সেইজন্য নানাভাবে উপদেশ দিতেন।

আবু নজরা নামক তাবেয়ী হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা)-কে বলিলেনঃ

******************************************************

আমরা আপনার নিকট হইতে যাহা শ্রবণ করি তাহা কি আমরা লিখিয়া লইব না?

ইহার জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

তোমাদের নবী করীম (স) আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করিতেন, আমরা তাহা মুখস্থ করিয়া স্মরণ রাখিতাম, অতএব তোমরাও আমাদের ন্যায় হাদীস মুখস্থ কর।[********************]

হাদীসের হর-হামেশা চর্চা করার এবং সেইজন্য উৎসাহ দানের ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম বিন্দুমাত্র ক্রটি করিতন না। তাবেয়ী যুগের ইলমে হাদীসের ইমাম ইকরামার উস্তাদে হাদীস হযরত ইবন আব্বাস (রা) তাহাকে কিভাবে হাদীস শিক্ষা দিয়াছেন, তাহার বিবরণ দান প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ

******************************************************

ইবন আব্বাস আমাকে কুরআন ও হাদীস শিক্ষাদানের জন্য আমার পায়ে বেড়ি পরইয়া দিতেন।[তাযকিরাতুল হুফফায, যাহবী, পৃষ্ঠা ৯০।]

হযরত আলী (রা) বলিতেনঃ

******************************************************

তোমরা খুব বেশী করিয়া হাদীস চর্চা করিতে থাক, তাহা না করিলে তোমাদের এই ইলম (হাদীস-জ্ঞান) বিলিন হইয়া যাইবে।[**************]

সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) বলিতেনঃ তোমরা পারস্পরিক হাদীস পর্যালোচনা ও চর্চা কর, কেননা কেবল চর্চা ও পর্যালোচনার মাধ্যমেই উহার সংরক্ষণ করা সম্ভব।[****************]

সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলিতেনঃ

******************************************************

তোমরা সব সময় হাদীস চর্চা ও স্মরণ করিতে থাক।

তাবেয়ী আবদুর রহমান ইবন আবী লায়লাও তাঁহার হাদীসের ছাত্রদিগকে প্রায়ই বলিতেনঃ

******************************************************

অর্জিত হাদীস-জ্ঞান বারবার চর্চা, স্মরণ ও আবৃত্তির মাধ্যমেই জীবন্ত ও সংরক্ষিত থাকিতে পারে। অতএব তোমরা সকলে হাদীসের চর্চা, স্মরণ ও আবৃত্তি করিতে থাক।[**************]

অপর একটি বর্ণনায় এই কথাটি নিম্নরূপ বলা হইয়াছেঃ

হাদীস পারস্পরিক স্মরণ ও চর্চা কর, কেননা এইরূপ স্মরণ ও চর্চার মাধ্যমেই হাদীস জীবন্ত থাকিবে।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৮।]

এই সম্পর্কে হযরত ইবন আব্বাস (রা)-এর নিম্নলিখিত কথা অধিকতর স্পষ্ট। তিনি তাঁহার ছাত্রদের লক্ষ্য করিয়া বলিতেনঃ

******************************************************

তোমরা এই হাদীস পরস্পর মিলিত হইয়া চর্চা কর। তাহা হইলে ইহা তোমাদের নিকট হইতে বিলুপ্ত হইবে না। কেননা এই হাদীস কুরআন মজীদের ন্যায় সুসংবদ্ধ, সংকলিত ও সংরক্ষিত নয়। এই কারণে তোমরা ইহার ব্যাপক চর্চা না করিলে ইহা তোমাদের নিকট হইতে বিলীন হইয়া যাইবে।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৭।]

হযরত ইবন আব্বাসের নিম্নোক্ত বানীও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিতেনঃ

******************************************************

তোমরা যখন আমাদের নিকট হইতে কোন হাদীস শুনিতে পাও তখন তোরা পারস্পরিক উহার চর্চা কর।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৮।]

হযরত ইবন উমর (রা) তাঁহার ছাত্রদিগকে তাকীদ করিয়া বলিতেনঃ

******************************************************

তোমাদের কেহ যখন অপর লোকের নিকট হাদীস বর্ণনার ইচ্ছা করে, তখন যেন সে অবশ্যই উহা তিন তিনবার আবৃত্তি করিয়া লয়।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৮।]

উপরিউক্ত বিস্তারিত আলোচনা হইতে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা) যেমন নিজেরা হাদীস মুখস্থ রাখিতে ও উহার ব্যাপক প্রচার করিতে চেষ্টা করিতেন অনুরূপভাবে তাবেয়ী যুগের যে সব লোক তাঁহাদের নিকট হাদীস শিক্ষা করিতেন তাহাদিগকে উহা মুখস্থ করিয়া রাখিতে, উহার চর্চা করিতে ও পরবর্তী লোকদিগকে উহার শিক্ষাদান করিতে বিশেষভাবে তাকীদ করিতেন।

 

হাদীস বর্ণনায় সতর্কতা

নবী করীম (স) তাঁহার হাদীস প্রচার ও অপর লোকদের নিকট উহা বর্ণনা করার সুস্পষ্ট নির্দেম দিয়াছেন। কিন্তু এই প্রচার ও বর্ণনাকে তিনি অবাধ, স্বাধীন ও নিরংকুশ করিয়া দেন নাই। বরং তিনি হাদীস বর্ণনা ও প্রচারের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতাবলম্বনের জন্য অত্যন্ত কড়া ভাষায় তাকীদ করিয়াছেন এবং তাঁহার নামে কোন মিথ্যা মনগড়া ও অসম্পূর্ণ কথা বর্ণনা ও প্রচার করিতে তীব্র ভাষায় নিষেধ করিয়াছেন। এখানে এই প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (স)-এর কয়েকটি বাণী উল্লেখ করা যাইতেছে।

হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) বলেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

যে ব্যক্তি ইচ্ছা করিয়া আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন তাহার আশ্রয় জাহান্নামে খুজিঁয়া লয়।

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলিবে, সে যেন জাহান্নাম তাহার আশ্রয় বানাইয়া লয়।

হযরত মুগীরা ইবন শু’বা বলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূল (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, আমার সম্পর্কে কোন প্রকার মিথ্যা কথা বলা অন্য কাহারো সম্পর্কে মিথ্যা বলার সমান নয়। কাজেই আমার সম্পর্কে যে মিথ্যা কথা ইচ্ছা করিয়া বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় খুঁজিয়া লয়।[এই সব কয়টি হাদীস সহীহ মুসলিম ****************************১ম খণ্ড, ৭ম পৃষ্ঠা হইতে গৃহীত।]

বিভিন্ন সাহাবীর সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে উল্লিখিত তিনটি হাদীসেরই মূল প্রতিপাদ্য কথা একই এবং তাহা এই যে, রাসূল (স) সম্পর্কে বা তাঁহার নামে কোনরূপ মিথ্যা কথা বলা কিংবা নিজের মনগড়া কথা রাসূলের নামে ও তাঁহার কথা বলিয়া চালাইয়া দেওয়া অত্যন্ত গুনাহের কাজ। নবী করীম (স) এইরূপ কাজ সম্পর্কে কঠোর নিষেধবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। হযরত মুগীরা (রা) বর্ণিত হাদীস হইতে জানা যায় যে, রাসূল (স) সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলা অপর কাহারো সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলার সমান নয়। কেননা রাসূল ও রাসূলের কথা আল্লাহ ও আল্লাহর কালামরে পরে পরেই ইসলামী শরীয়াতের সনদ ও জ্ঞান-উৎস। কাজেই এইখানে কোনরূপ মিথ্যার অনুপ্রবেশ হইলে গোটা শরীয়াতের ভিত্তিই দুর্বল ও অবিশ্বাস্য হইয়া পড়ে। আর ইসলামী শরীয়াতের ভিত্তি দুর্বল হইলে অতঃপর মানুষের মুক্তির কোন পথই আর উন্মুক্ত থাকে না। ইরশাদুস সারী শরহে বুখারী গ্রন্হে এই হাদীসটি সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

এই হাদীসটি বিশুদ্ধতা ও সনদ শক্তির অকাট্যতার দিক দিয়া চূড়ান্ত ও অনস্বীকার্য। মুহাদ্দিসীনের এক বিরাট জামা’আত এই হাদীসটিকে ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।[*****************]

ইমামুল হারামাইন আবুল মায়ালীর পিতা শায়খ আবূ মুহাম্মদ আল-জুয়াইনী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) সম্পর্কে যে লোক ইচ্ছা করিয়া মিথ্যা বলিবে, সে কাফির হইয়া যাইবে।[ঐ]

বস্তুত হাদীস বর্ণনা সম্পর্কে রাসূলে করীমের এইসব কঠোর সাবধান বাণীর কারণে সাহাবায়ে কিরাম (রা) রাসূল সম্পর্কে কোন কথা বলিতে অত্যন্ত ভয় পাইতেন, বলিতে গেলে অতিমাত্রায় সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করিতেন এবং প্রত্যেকেই নিজের জানা ও বহুবার শোনা কথাকে অপর সাহাবীর নিকট পুনরায় শুনিয়া উহার সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করিয়া লইতেন। ভূল হইলে তাহা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করিয়া লইতেও একবিন্দু ক্রটি করিতেন না। এমনটি রাসূল সম্পর্কে কোন মিথ্যা বলা হইয়া যাওয়ার আশংকায় অনেক সংখ্যক সাহাবীই হাদীস বণনা করিতে সাহস পাইতেন না। আর যখন বর্ণনা করিতেন, তখন তাঁহারা ভয়ে থর থর করিয়া কাপিতেঁন। অত্যন্ত দায়িত্ব ও চেতনাবোধ সহকারে প্রত্যেকটি হাদীস ও হাদীসের প্রত্যেকটি কথা উচ্চারণ করিতেন।

এই কারনে সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়িগণ নির্ভরযোগ্য অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও বর্ণনা পরম্পরা শৃঙ্খলের ধারাবাহিকতা অটুট ও অবিচ্ছিন্ন না হইলে কখনই কোন হাদীস কবুল করিতেন না। পরবর্তীকালের হাদীস সংগ্রহকারীদের নিকট নিম্নোক্ত নীতি সর্ববাদ সম্মতরূপে গৃহীতি হইয়াছেঃ

******************************************************

রাসূল সম্পর্কে একটি হাদীসও কাহারো ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলা প্রমাণ হইয়া গেলে সে ফাসিক সাব্যস্ত হইবে, তাহার বর্ণিত সমস্ত হাদীসই প্রত্যাহৃত হইবে এবং উহার কোনটিকেই শরীয়াতের দলীল হিসাবে গ্রহণ করা যাইবে না।[************ ১ম খণ্ড,  পৃষ্ঠা ৮।]

হাদীস বর্ণনায় সতর্কতাবল’ন সম্পর্কে এই নীতিমূলক আলোচনার পর সাহাবায়ে কিরামের জীবনের কতিপয় বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করিয়া এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করা আবশ্যক। আমরা এখানে কয়েকজন সাহাবীর কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করিতেছি।

১। হযরত যুবায়র (রা) আদৌ কোন হাদীস বর্ণনা করিতেন না। একদিন হযরত আবদুল্লাহ (রা) তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ আপনি অন্যান্য সাহাবীদের মত হাদীস বর্ণনা করেন না কেন? তিনি বলিলেনঃ রাসূলের সাথে আমার যদিও বিশেষ সম্পর্ক ছিল, তবুও যেহেতু আমি রাসূলের নিকট শুনিয়াছি, তিনি বলিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার ঠিকানা বানাইয়া লয়। (এই ভয়ে হাদীস বর্ণনা করি না।)[আবূ দাউদ, কিতাবুল ইলম **********************]

২।  বহু সংখ্যক সাহাবী একাদিক্রমে অনেক বৎসর পর্যন্ত ***************- ‘রাসূল (স) বলিয়াছেন’ এইরূপ উক্তি করিতেন না। ইমাম শা’বী বলেনঃ আমি এক বৎসর পর্যন্ত হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমরের নিকট অবস্থান করিয়াছি। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তিনি কোন হাদীস বর্ণনা করেন নাই। হযরত সায়ের  ইবন ইয়াযীদ (রা) বলেনঃ আমি হযরত তালহা ইবন আবদুল্লাহ হযরত সায়াদ, হযরত মিকদাদ ও আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা)- এর সংস্পর্শে বহুদিন অবস্থান করিয়াছি; কিন্তু কাহাকেও কোন হাদীস বর্ণনা করিতে দেখি নাই। তাবে হযরত তালহা কেবলমাত্র উহুদ যুদ্ধের দিন সম্পর্কে হাদীস বর্ণনা করিতেন।[সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, কিতাবুল জিহাদ, পৃষ্ঠা ৩৯৬।]

৩। হযরত সায়ের ইবন ইয়াযীদ (রা) বলেনঃ আমি মদীনা হইতে মক্কা পর্যন্ত হযরত সায়াদ ইবনে মালিক (রা)- এর সহিত একত্রে সফর করিয়াছি; কিন্তু এই দীর্ঘ পথের মধ্যে তাঁহার মুখ হইতে একটি হাদীসও শুনিতে পই নাই।[সুনানে ইবনে মাজাহ***************************]

৪। অনেক লোক সাহাবায়ে কিরামরে নিকট হাদীস শ্রবণের ইচ্ছা প্রকাল করিতেন, কিন্তু অনেক সময় তাঁহারা হাদীসি বর্ণনা করিতে অস্বীকার করিয়া বসিতেন। একবার কিছু লোক হযরত যায়দ ইবন আরকাম (রা) কে বলিলেনঃ আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করুন- হাদীস বর্ণনা করিয়া আমাদিগকে শোনান। ইহার উত্তরে তিনি বলিলেনঃ আমরা বৃদ্ধ হইয়াছি, ভুলিয়া গিয়াছি; হাদীস বর্ণনা করা বড়ই কঠিন কাজ।

৫। হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) কে একবার হাদীস বর্ণনা করিতে বলা হইলে তিনি জওয়াবে শুধু বলিলেন ‘ইনশা আল্লাহ’।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৪৬।]

অর্থাৎ তিনি হাদীস বর্ণনার দায়িত্ব এড়াইয়া যাইতে চাহিয়াছিলেন। (আর অনেক সাহাবীরই এইরূপ রীত ছিল।)। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের এই বানী-‘আমার সম্পর্কে যে মিথ্যা বলিতে ইচ্ছা করিবে সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় বানাইয়া লয়’–আমাকে তোমাদের নিকট অধিক হাদীস বর্ণনা করিতে নিষেধ করে।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১।]

ইহার অর্থ এই নয় যে, তিনি আদ্য কখনো হাদীস বর্ণনা করিতেন না। হাদীস বর্ণনা করিতেন; কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি যারপরনাই সতর্কতা অবলম্বন করিতেন।[****************] তাঁহার সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

হযরত আনাস (রা) হাদীস বয়ান কারা সময় অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িতেন- তাঁহার অন্তর কাঁপিয়া উঠিত। এই কারণে তিনি হাদীস বর্ণনা করার পর বলিতেনঃ রাসূলে করীম (স) এইরূপ বলিয়াছেন কিংবা ঠিক যেরূপ তিনি বলিয়াছেন।[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৫ম খণ্ড পৃষ্ঠা ১৪০।]

যে সব হাদীসের মর্মোদ্ধারে ভূল হওয়ার আশংকা থাকিত, তাহা হযরত আনাস (রা) আদৌ বর্ণনা করিতেন না। এতদ্ব্যতীত রাসূলের নিকট হইতে সরাসরি শ্রুত হাদীসের মধ্যেও পার্থক্য করিতেন।[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪০।]

৬। হযরত উবাই ইবন কায়াব (রা) হাদীস বয়ান করিতেন, কিন্তু এই কাজে তিনি অপরিসীম সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। তিনি যদিও রাসূলের খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং জীবনের বেশীর ভাগ সময় তিনি রাসূলের সংস্পর্শেই অতিবাহিত করিতেন; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি রাসূলের খুব বেশী হাদীস বর্ণনা করেন নাই। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মাত্র ৬৪ টি। [****************]

৭। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) ইলমে হাদীসে বিরাট দক্ষতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও হাদীস বয়ান করিয়াছেনঃ সাহাবীদের সমাজে হাদীস বয়ান করার ব্যাপারে হযরত ইবন উমর (রা) অপেক্ষা অধিক সতর্ক আর কেহ ছিলেন না। তিনি হাদীস কম বেশি করিয়া বর্ণনা করাকেও ভয় করিতেন।[তাযকিরাতুল হুফফায, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪।]

আবু জাফর তাবেয়ীও এই কথারই প্রতিধ্বনি করিয়াছেন।[মুস্তাদরাক হাকেম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬১।]

সায়ীদ তাঁহার পিতার জবানীতে বলিয়াছেনঃ হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ইবন উমর অপেক্ষা অধিক সতর্ক আমি আর কাহাকেও দেখি নাই।[*********************]

বস্তুত এই সতর্কতাবলম্বনের কারণেই তিনি সাধারণত হাদীস বর্ণনা করিতে রাযী হইতেন না।[***************]

৮। হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা)-ও খুব কম এবং কদাচিৎ হাদীস বর্ণনা করিতেন। তিনি রাসূল (স) সম্পর্কে মিথ্যা বলা সম্পর্কিত হাদীস সম্মুখে রাখিয়াই এই নীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিছু সংখ্যক লোক একবার তাঁহাকে বলেনঃ আপনাকে খুব কম হাদীস বর্ণনা করিতে দেখিতেছি, অথচ অমুক অমুক সাহাবী এবং হযরত ইবন মাসউদ (রা) যথেষ্ট সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেন। অন্য কথায় রাসূলের সংস্পর্শে আপনার বিশিষ্ট স্থান থাকা সত্ত্বেও হাদীস বর্ণনায় আপনি এতদূর পশ্চাদপদ কেন? ইহার জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

শোন, ইসলাম কবুল করার পর আমি কখনো রাসূল (স)- এর নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া অবস্থান করি নাই। কিন্তু আমি রাসূল (স) কে বলিতে শুনিয়াছিঃ আমার সম্পর্কে যে মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় করিয়া লয়।[মুসনাদে ইমাম আবু হানীফা (উর্দূঅনবাদ), পৃষ্ঠা ৭৩, বুখারীশরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১। বুখারীর বর্ণনায় আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদের নামের উল্লেখ নাই; কিন্তু ইবন মাজা’হর রেওয়ায়েতে তাঁহার উল্লেখ আছে।(****************) এবং ইসমাঈলীর  বর্ণনা ********** ‘যখন হইতে আমি ইসলাম কবুল করিয়াছি’ কথাটির উল্লেখ আছে, বুখারীতে তাহা নাই।]

বস্তুত এই ভয়ই ছিল তাঁহার কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনার একমাত্র কারণ।

 

হাদীস লিখন

হাদীস সংরক্ষণের যে স্বাভাবিক ব্যবস্থার বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে পেশ করা হইয়াছে, হাদীস সংরক্ষণের মূলে তাহাই একমাত্র উপায় ছিল না। বরং ইহা হইতেও অধিকতর দৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে হাদীস সংরক্ষিত হইয়াছে। হাদীস সংরক্ষণের এই ব্যবস্থা হইতেছে হাদীস লিখন।

হাদীস সম্পর্কে সাধারণ একটি ভূল ধারণা অনেক লোকের মনেই বদ্ধমূল দেখা যায়। হাদীসরে শক্রগণ উহাকে হাদীসের অমৌলিকত্ব ও অপ্রামাণিকতা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে একটি যুক্তি হিসাবে পেশ করিয়া থাকে। তাহা এই যে, হাদীস নবী করীম (স)- এর জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ হয় নাই, হইয়াছে তাঁহার ইন্তেকালের শতাব্দীকাল পরে। অতএব তাঁহাদের মতে হাদীস বিশ্বাসযোগ্য নহে।

কিন্তু হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাস সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করিলে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, এই ধারণা আদৌ সত্য নহে, বরং ইহা শক্রদের অপপ্রচার ও মিথ্যা রটনা মাত্র। ইতিহাস ইহার তীব্র প্রতিবাদ করে।বস্তুত হাদীস সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি এতখানি ভিত্তিহীনি ও অপ্রমাণিত থাকিতে পারে না। ইহার সংরক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সম্ভাব্য ব্যবস্থাই যথাসময়ে গ্রহণ করা হইয়াছে। ইহাকে যেমন মুখস্থ করা ও স্মরণ রাখা হইয়াছে, নানাভাবে ইহার চর্চা করা হইয়াছে; অনুরূপভাবে ইহার জন্য যথাসময়ে ও যথেষ্ট পরিমাণে লেখনী শক্তিরও ব্যবহার এবং প্রয়োগ হইয়াছে- আর সর্বোপরি এই সব ব্যবস্থার মধ্যে কোন একটিরই উপর একান্তভাবে নির্ভর করা হয় নাই, একটির উপর নির্ভর করিয়া অন্য সব উপায়ের প্রতি কিছুমাত্র উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয় নাই। বরং একই সঙ্গে ও প্রায় একই সময় এই সব ব্যবস্থাই একটি শ্রেণী পরস্পরা নিমানুযায়ী কার্যকর করা হইয়াছে। হাদীস লিখন সম্পর্কে আমাদের বর্তমান পর্যায়ের আলোচনা হইতেই তাহা পাঠকদের সম্মুখে উজ্জ্বল হইয়া উঠিবে।

প্রথমেই উল্লেখ করিয়াছি, নবুয়্যাতের প্রথমকালে যখন কুরআন মজীদ নাযিল হইতেছিল, তখনই রাসূলে করীম (স) তাহা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য বহু ‘ওহী লেখক’ নিযুক্ত করিয়াছিলেন।[************ এক বিবরণ অনুযায়ী ওহী লেখকদের সংখ্যা ছিল অন্ততপক্ষে চল্লিশজন।**********] হযরতের প্রতি কোন আয়াত বা সূরা নাযিল হইলেই তাহা একদিকে যেমন তিনি সমবেত ইসলামী জনতাকে একটি ভাষণের ন্যায় মুখস্থ পড়িয়া শোনাইতেন, অপরদিকে সেই সঙ্গে উক্ত ওহী লেখকদের দ্বারা তাহা সঠিকরূপে লিখাইয়ও রাখিতেন। ইহা ছিল রাসূলে করীমের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘সরকারী’ ব্যবস্থা। ইহার ফলেই রাসূলের জীবনের শেষভাগ পর্যন্ত কুরআন মজীদ পূর্ণ লিখিত ও সংরক্ষিত রূপ লাভ করিতে সমর্থ হয়।

কিন্তু এই সময় কেবল যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘ওহী লেখক’-ই ওহী বা কুরআন লিখিয়া রাকিতেন, আর অপর কোন সাহাবী তাহা লিখিতেন না, তাহা নহে। বরং রাসূলে করীম কর্তৃক নিযুক্ত লেখক ছাড়া আরো বহু সাহাবী রাসূলের দরবারে উপস্থিত থাকিয়া নিজস্বভাবে কুরআনের আয়াত লিখিয়া রাখিতেন।

রাসূলে করীমের হাদীস লিখনের ব্যাপারেও আমরা তাহাই দেখিতে পাই। সেখানে কিছু সংখ্যক সাহাবী রাসূলের অনুমতিক্রমে এবং বহ লোক নিজস্বভাবে স্বকীয় উদ্যোগে হাদীস লিখিয়া রাখিতে শুরু করেন। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে ইহাতে একটি অসুবিধা দেখা দেয়। তাহা এই যে, বহুসংখ্যক সাহাবী রাসূলের  নিকট হইতে যাহা কিছুই শুনিতে পাইতেন, তাহা আল্লাহর বাণী হউক কি রাসূলের নিজস্ব কথা- সবই একসঙ্গে ও একই পাত্রে লিখিতে শুরু করেন। ইহার ফলে কুরআন ও হাদীস সংমিশ্রিত হইয়া যাওয়ার এবং উহাদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা কঠিন হইয়া পড়ার তীব্র আশংকা দেখা দেয়। আর ইহার পরিণাম যে কত ভয়াবহ, তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়। নবী করীম (স) ইহাকে কিছুতেই সমর্থন করিতে পারেন না। এইরূপ লেখকদের লিখিত জিনিস দেখিয়া তিনি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এই প্রসঙ্গে হযরত আবূ সাঈদ (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ একদা কিছু সংখ্যক সাহাবী বসিয়া লিখিতেছ? তাঁহারা বলিলেনঃ *********** ‘আপনার নিকট হইতে যাহা শুনিতে পাই, তাহাই আমরা লিখিয়া লইতেছি। তখন তিনি বলিলেনঃ *********** আল্লাহর কিতাবের সংগে মিশাইয়া আর একখানা কিতাব লিখিত হইতেছে কি?

ইহার অথ এই যে, কুরআন ও হাদীস একত্র মিলাইয়া মিশাইয়া লিপিবদ্ধ করা ও উহাদের মধ্যে পার্থক্য করার কোন ব্যবস্থা না করা কুরআনের চিরস্থায়ী ও অক্ষুণ্নতার পক্ষে যেমন মারাত্মক, তেমনি মারাত্মক দ্বীন-ইসলামেন ভিত্তির দৃঢ়তা ও নির্ভরযোগ্যতার পক্ষেও। এই কারণে রাসূলে করীম (স) তাঁহাদিগকে আদেশ দিলেনঃ

******************************************************

এইরূপ লেকার নিয়ম তোমরা ত্যাগ কর। কেবলমাত্র আল্লাহর কিতাব খালিসভাবে লিপিবদ্ধ কর। উহার সহিত অন্য কিছুই মিলইও না।

ফলে এইসব সাহাবী কর্তৃক কুরআন ও হাদীস মিলাইয়া যাহা কিছু লিখিত হইয়াছিল, তাহা সব বিনষ্ট করিয়া দেওয়া হয়, অতঃপর কুরআনকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে লিপিবদ্ধ করা হইতে থাকে।[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭১, মজমায়ুজ জাওয়ায়িদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫২।]

রাসূলে করীমের এই কাজ ও কথার যৌক্তিকতা একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায়। কুরআনকে যদি কোন একজন সাহাবীও হাদীসের সঙ্গে একত্র করিয়া লিখিয়া রাখিতেন, তাহা হইলে উত্তরকালে উহা কুরআন মজীদের নির্ভরযোগ্যতার বিরুদ্ধে এক চ্যালেঞ্জ হইয়া দাঁড়াইত। কুরআন মজীদকে বর্তমানের ন্যায় খালিসভাবে অবিকৃত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক মহান গ্রন্হ হিসাবে দুনিয়ার মানুষ কিছুতেই লাভ করিতে পারিত না; আল্লাহর কালাম এবং রাসূলের কথা ও কাজের বিবরণকে আলাদা আলাদাভাবে জানিতে ও চিহ্নিত করিতে সমর্থ হইত না। এই কারণে প্রতশ পর্যায়ে নবী করীম (স) কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিপিবদ্ধ করিতে সাহাবাগণকে স্পষ্ট ও তীব্র ভাষায় নিষেধ করিয়াছিলেন; কিন্তু উহার মৌখিক প্রচার ও বর্ণনা করিতে রাসূলে করীম (স) আদৌ নিষেধ করেন নাই। নবী করীম (স)-এর বাণী নিম্নরূপঃ

******************************************************

আমার কোন কথাই লিখিও না। কুরআন ব্যতীত আমার নিকট হইতে অন্য কিছু কেহ লিখিয়া থাকিলে তাহা মুছিয়া ফেল। তবে আমার কথা বা আমার সম্পর্কে কথা মৌখিক বর্ণনা কর, তাহাতে দোষ নাই। কিন্তু মৌখিক বর্ণনায়ও যেন কোন প্রকার মিথ্যার প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। বস্তুত যে আমার সম্পর্কে কোন মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় গ্রহণ করে।[সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৪, আবু সাঈদ খুদরী বর্ণিতঃ *****************************]

হযরত আবূ সাঈদ বর্ণিত আর একটি হাদীস নিম্নরূপঃ

******************************************************

আমরা রাসূল (স)-এর নিকট (কুরআন ছাড়া অন্য কথা-হাদীস) লিপিবদ্ধ করিয়া রাখার অনুমতি চাহিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি আমাদিগকে অনুমতি দেন নাই।[*****************]

হযরত যায়দ ইবন সাবিত (রা) হইতেও এই অর্থেরই একটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তাহা এইঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে (কুরআন ব্যতীত) কোন কিছুই না লিখিতে আদেশ করিয়াছেন।[ঐ]

কুরআন ব্যতীত কোন কিছু লিখিতে নিষেধ করার ও সেই ‘অন্য কিছু’ লিখিবার অনুমতি না দেওয়ার গভীর তাৎপর্য রহিয়াছে। রাসূলে করীম (স)- এর এইরূপ করার মুলীভুত কারণ কি, তাহা অবশ্যই প্রণধানযোগ্য।

ইহার প্রথশ কারণ কুরআনের সাথে অন্য জিনিস মিলাইয়া মিশাইয়া লিখায় ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আশংকা। এই সময় পর্যন্ত মুসলমানগণ সাধারভাবে কুরআনের বিশেষ ভাষা, ভাব ও বাণী এবং উহার গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাবধারার সহিত পুরামাত্রায় পরিচিত হইতে পারেন নাই। কুরআন ও অ-কুরআনের মাঝে পার্থক্য করার মত তীক্ষ্ম দৃষ্টি ও বিবেক-বুদ্ধিও তাহাদের মধ্যে তখনও জাগ্রত হয় নাই। ইহার দ্বিতীয় কারণ এই যে, রাসূলে করীম (স)- এর এই নিষেধ ছিল সেই সব সাহাবীদের প্রতি, যাহাদের স্মরণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর, যাঁহারা কানে শুনিয়া খুব সহজেই স্মৃতিপটে মুদ্রিত করিয়া লইতে পারিতেন, কিছু মাত্র ভুলয়া যাইতেন না। কেননা এই শ্রেণীর সাহাবিদণও যদি লেখনীর উপর নির্ভরশীল হওয়ার অভ্যাস করিতে শুরু করেন, তাহা হএল স্মৃতিশক্তির প্রাখর্য হ্রাস পাওয়ার নিশ্চিত আশংকা রহিয়াছে। এবং এইভাবে আল্লাহর এ মহান নিয়ামতের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন কিছুতেই উচিত হইতে পারে না।[***********************]

ইমাম নববী ও সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

হাদীস লিখিতে প্রথমত নিষেধ করা হইয়াছিল। কুরআন পরিচিত হওয়ার পূর্বে এই নিষেধ ছিল প্রত্যেকেরই জন্য। তখন কুরআন ব্যতীত অপর কোন কিছুই লিখিয়া রাখিতে নিষেধ করা হইয়াছিল কুরআনের সঙ্গে উহার মিশ্রিত হওয়ার ও তদ্দরুন সন্দেহ ও সংশয়  সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে। পরে যখন কুরআন সর্বজনপরিচিত হ্য় এবং এই ভয়ের কারণ হইতে নিরাপত্তা লাভ হয় তখন উহা লিখিবার অনুমতি দেওয়া হয়।

আর দ্বিতীয়ত যাঁহাদের স্মরণশক্তি নির্ভরযোগ্য ছিল, তাঁহারা কেবল লেখনীর উপর নির্ভর করিয়া বসিতে পারে- এই ভয়ে তাঁহাদিগকে লিখিতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু সে নিষেধের ফলে লেখা মূলতই হারাম ছিল না। যাঁহাদের স্মরণশক্তি নির্ভরযোগ্য ছিল না, তাঁহাদিগকে হাদীস লিখিয়া লওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।[*******************]

ইমাম খাত্তাবী এই প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

মনে হয় হাদীস লিখিতে নিষেধ করা প্রথশ যুগের ব্যাপার ছিল। পরবর্তীকালে ইহা জায়েয করা হইয়াছে। আর নিষেধ করা হইয়াছিল কুরআনের সহিত মিশাইয়া একই কাগজে হাদীসি লিখিতে। কেননা তাহার ফলে কুরআন ও হাদীস সংমিশ্রিত হইয়া যাইত এবং তাহা পাঠকদের পক্ষে বড় সন্দেহের ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইত।[**********]

ইমাম নববী ও ইমাম খাত্তাবীর এই বিশ্লেষণ হইতে প্রমাণিত হয় যে, প্রথম পর্যায়ে সকলকেই কুরআন ব্যতীত অপর কিছু লিখিতে নিষেধ করা হইলেও তাহাতে ব্যতিক্রম ছিল। নবী করীম (স) সাহাবীদের স্মরণশক্তিকে পূর্ণ মাত্রায় প্রয়োজনীয় কাজে প্রয়োগ করিতে চাহিয়াছিনে। এই কারণে প্রচণ্ড স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোকদিগকে হাদীস মুখস্থ করা পরিত্যাগ করিয়া কেবল লেখনী শক্তির উপর নির্ভরশীল হইতে নিষধ করিয়াছিলেন। কিন্তু যাঁহারা স্মরণশক্তি ও লেখনী উভয় শক্তির ব্যবহার করিতে চাহিয়াছেন, তাঁহাদিগকে তিনি হাদীস লিখিতে নিষেধ করেন নাই। বরং তাঁহাদিগকে অনুমতিই দিয়াছেন। নিম্নের হাদীস হইতেও এই কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ঃ

******************************************************

আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি রাসূলের নিকট আসিয়া বলিলেনঃ হে রাসূল ! আমি হাদীস বর্ণনা করিতে চাহি। এইজন্য আমি স্মরণশক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে লেখনীর ও সাহায্য গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিয়াছি, অবশ্য আপনি যদি তাহা পছন্দ করেন। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ আমার হাদীস লিখিতে চাহিলে উহা স্মরণ রাখার সঙ্গে সঙ্গে লিখিয়অ রাখার কাজও করিতে পার।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৭।]

শুধু তাহাই নয়, নবী করীম (স)- এর দরবারে বহু সংখ্যক লেখনীধারক লোকই সব সময় উপস্থিত থাকিতেন এবং রাসূলের মুখে যে কথাই তাঁহারা শুনিতে পাইতেন, তাহাই লিখিয়া লইতেন- তাহাও এক ঐতিহাসিক সত্য। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমরের নিম্নোক্ত কথা হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়ঃ

******************************************************

আমরা বহু কয়জন লোক রাসূলের চতুর্থাংশে লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় রাসূলে করীম (স)-কে প্রশ্ন করা হইলঃ কনস্টান্টিনোপাল নগর প্রথম বিজিত হইবে, না রোম? উত্তরে তিনি বলিলেনঃ না হেরাক্লিয়াসের শহুর কনস্টান্টিনোপালই প্রথম বিজিত হইবে।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৮।]

এই বর্ণনায় প্রথম বাক্যটি প্রণিধানযোগ্য। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলে করীম (স) যখনই দরবারে বসিতেন, তখনই তাঁহার চারিপার্শ্বে লেখকগণও বসিয়া যাইতেন। আর এই সব দলীল-প্রমাণ হইতে এই কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, প্রথম পর্যায়ে প্রধানত কেবলমাত্র কুরআন মজীদই লিপিবদ্ধ হইতে থাকে। আর হাদীসি লেখার জন্য সরকারী পর্যায়ে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয় নাই। তখন হাদীস সাধারণভাবে মুখস্থ করা, মৌখিক চর্চা, বর্ণনা ও আলোচনার মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়। এইভাবে কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর সাহাবিগণকে হাদীসলেখার সাধারণ অনুমতি দেওয়া হয়। তখন হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে কুরআনের মতই সাহাবীদের স্মরণশক্তি, পারস্পরিক চর্চা ও বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে লেখনীশক্তিরও পূর্ণ ব্যবহার হইতে থাকে।[**************]

ইবনে কুতাইবা লিখিয়াছেনঃ

প্রথমে হাদীসি লিখিতে নিষেধ করেন এবং পরে লিখিয়া হিফাজত করার প্রযোজনীয়তা বুঝিতে পারেন।[************]

আল্লামা ইবন জাওযী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

প্রথমাবস্থায় লিখিতে নিষেধ করিয়াছেন। পরে লিখিবার অনুমতি দান করেন।[*************************]

এই পর্যায়ে তিনি সাহাবীদের লক্ষ্য করিয়া স্পষ্ট ভাষায় বলেনঃ

******************************************************

ইলমে হাদীসকে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখ।[***************]

ইলমে হাদীসকে লিখন সম্পর্কিত মূল মাসালাটি সম্পর্কে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনা অবতারণা করা আবশ্যক। হাদীস লিখিয়া রাখা আদৌ জায়েয ছিল কিনা, সে বিষয়েও মতভেদ রহিয়াছে। আমাদের মতে হাদীস লিখিয়া রাখা শুধু জায়েযই নহে, ইহা ছিল দ্বীনের এক অতি জরুরী কাজ। স্বয়ং কুরআন মজীদ সবরকমের জরুরবী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেখনী ব্যবহারের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়াছেন। আল্লাহ তা’আল্লা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

লেন-দেন ছোট হউক কি বড় ব্যাপার হউক, নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্তের জন্য তোমরা লিখিয়া রাখিতে একবিন্দু অবহেলা করিও না। লিখিয়া লওয়া আল্লাহর দৃষ্টিতে খুবই ইনসাফপূর্ণ, প্রমাণ রক্ষার জন্য সুষ্ঠু ও সন্দেহ হইতে বাচিঁবার জন্য অতি উত্তম ব্যবস্থা।[সূরা আল-বাকারা, ২৮২ আয়াত। মনে রাখা আবশ্যক যে, এই সূরাটি হিজরতের পর মদীনীয় জীবনের প্রথম অধ্যায়েই নাযিল হইয়াছিল এবং এই সময়ই সব লিখিয়া লইবার তাকীদ করায় হাদীস লিখিয়া রাখার কাজও সাহাবীগণ অবশ্যই করিয়া থাকিবেন। ফলে ইহাকে রাসূলে করীম (স) নিশ্চয়ই নিষেধ করেন নাই।]

ইমাম আবু হানিফা (র) এই আয়াতের ভিত্তিতে যুক্তি পেশ করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহ তা’আলা যখন সাধারণ লেনদেনের ব্যাপারও সন্দেহ সৃষ্টির আশংকা লিখিয়া লইতে আদেশ করিয়াছেন, আর ইলম –ইলমে হাদীস- মুখস্ত করিয়া রাখা যখন লেনদেনের কথা স্মরণ রাখা অপেক্ষা অনেক কঠিন, তখন এই সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টির ভয়ে তাহা লিখিয়া লওয়া বৈধ হওয়া অধিক প্রয়োজন ও সবচাইতে বেশী উপযুক্ত ব্যাপার।[*********************]

আল্লামা আবূ মলীহ অপর এক আয়াতের ভিত্তিতে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

লোকেরা মুহাদ্দিসগণকে হাদীস লিখিয়া রাখার জন্য দোষ দেয়। অথচ আল্লাহ তা’আলা নিজেই বলিয়াছেনঃ পূর্বের জাতিসমূহের অবস্থা আল্লাহর নিকট লিখিতভাবে সংরক্ষিত রহিয়াছে।[***************]

অথচ আল্লাহ তা’আলা না বিস্মৃত হন, না বিভ্রান্ত হন। এমতাবস্থায়, মানুষ ভূল-ভ্রান্তির প্রতিমূর্তি হইয়াও লিখার প্রয়োজন হইতে কিরূপে মুক্ত হইতে পারে?

অতএব, হাদীস লিখিয়া রাখা কোন কালেই সম্পূর্ণ হারাম ছিল না। শুরুতে উহাকে সাধারণভাবে মুলতবী রাখা হয়- যদিও এই সময় বিশেষ ব্যক্তিতে ইহার অনুমতিও দেওয়া হইয়াছিল।

এই পর্যায়ে যে মতভেদের উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহার বিশেষ কোন মূল্য নাই। একেবারে প্রাথমিককাল ছাড়া সবসময়ই হাদীস লিখিয়া রাখা সম্পূর্ণ জায়েয ছিল।

ইবনুস সালাহ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

পরে এই মতভেদ দূর হইয়া যায় এবং হাদীস লিখিয়া রাখা মুবাহ হওয়া সম্পর্কে সমস্ত মুসলমানই একমত হন। কেননা উহা যদি তখন লিখিত না হইত, তাহা হইলে শেষকালে উহা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হইয়া যাইত।[***************]

 

নবী (স) কর্তৃক লিখিত সম্পদ

ইসলামী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে- মক্কী অধ্যায়ে – নবী করীম (স) কুরআন মজীদ ব্যতীত অন্যকিছু লিখিয়া রাখিবার অনুমতি দেন নাই। তাই হিজরতের পূর্বে মক্কী জীবনে কোন হাদীস লিখিত হইয়াছে বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তো হিজরতের পর মদীনীয় জিন্দেগী শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুরআন ছাড়াও হাদীসের বিরাট সম্পদ লিপিবদ্ধ হইতে থাকে। নিম্নলিখিত প্রমাণাদির ভিত্তিতে এই কথা জোর করিয়া বলা যাইতে পারে যে, মদীনীয় পর্যায়ে- নবুয়্যাতের এয়োদশ চতুর্দশ বৎসরে- কুরআন ও হাদীসের পারস্পরিক পার্থক্য বোধ সুস্পষ্ট হইয়া উঠার পর একদিকে যেমন হাদীস লিখিয়া লইবার সাধারণ অনুমতি প্রদান করা হয়, অন্যদিকে স্বয়ং নবী করীম (স) কর্তৃক লিপিবদ্ধ করানো বিপুল সংখ্যক সম্পদ মুসলমানদের হস্তে সঞ্চিত হয়। প্রসঙ্গত বলা যাইতে পারে যে, বদরের যুদ্ধ-বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে মদীনায় মুসলিম বালকদিগকে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা হওয়ার পর[********************] হাদীস লেখা অধিকতর সহজ হয় এবং উহার মাত্রাও অধিক ব্যাপক হইয়া পড়ে। হযরত আবদুল্লাহ ইবন সাঈদ ইবনুল আ’স মদীনার মসজিদে নববীতে রীতিমত লিখা শিক্ষা দেওয়ার স্কুল খুলিয়া দিয়াছিলেন।[*********************] এতদ্বত্যতীত মদীনার নয়টি মসজিদে বালকদিগকে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হইয়াছিল।[*****************] ফলে উত্তরকালে লিখা জানা বা লিখিতে সক্ষম লোকদের কোন অভাবই ছিল না।

ফলে জরুরী লিখার কাজ সম্পন্ন কারর জন্য নবী করীম (স) নিজের নিকট বহু ব্যক্তিকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন এবং বহুসংখ্যক লেখক (লিখিতে সক্ষম) নানা বিষয়ের লিখন কার্য সম্পাদনের জন্য রাসূলের দরবারে সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত থাকিতেন। আধুনিক ভাষায় বলিলে বলা যায়, তখন মদীনায় একটি পূর্ণাঙ্গ সচিবালয় গড়িয়া উঠিয়াছিল ও কাজ করিতেছিল। বিশেষ বিশেষ লিখার কাজ সম্পাদনের জন্য বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি নিযুক্ত ছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে হযরত আলী (রা), হযরত উসমান (রা), হযরত যায়দ ইবন সাবিত (রা) [***************] ও হযরত উবাই ইবন কাব (রা) প্রমুখ সাহাবী কুরআন মজীদ লিপিবদ্ষ করণের কাজে দায়িত্বশীল ছিলেন। হযরত যুবায়র ইবনূল আওয়াম (রা) ও জহম ইবনুসসালত (রা) ছিলেন যাকাত-সাদাকাত-এর মাল-সম্পদের হিসাবরক্ষক। হযরত আবদুল্লাহ ইবনুল আরকাম (রা) ও আল-উলা ইবন উকবা (রা) জনগনের পারস্পরিক লেন-দেন ও চুক্তি প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত দলীল-দস্তাবিজ লিখিতেন। হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা) খেজুর ফসলের পরিমাণ ও তাহার উপর ধার্য যাকাতের পরিমাণ অনুমানপূর্বক লিখিয়া রাখিতেন। মুয়াইকীব ইবন আবূ ফাতিমাদসী (রা) রাসূলে করীমের প্রাপ্ত মালের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিতেন।[******************] রাসূলে করীম (স)- এর সময়ে যেসব সাহাবী জিহাদে যোগদান করিতেন তাঁহাদের নাম-ধাম পরিচিতি লিখিয়া রাখারও ব্যবস্থা করা হইয়াছিল।[***************] লেখক হিনযিলা (রা) দরবারে প্রত্যেক অনুপস্থিত লেখকের স্থানে কাজ করিতেন। রাসূলে করীম (স)-এর সিলমোহরও তিনিই ধারণ ও ব্যবহার করিতেন।[***************************]

বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকদের জন্য তাহাদের ভাষায় পত্রাদি লিখার কাজ করার জন্য রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তদানীন্তন সভ্য দুনিয়ায় প্রচলিত ভাষাসমূহ শিখিয়া লইয়াছেন বহু কয়জন সাহাবী। হযরত যায়দ ইবন সাবিত (রা) সুরীয়ানী ভাষা শিখিবার জন্য আদিষ্ট হইয়া উহা শিখিয়াছিলেন। এই ভাষায় লিখিত কোন পত্র রাসূলের নিকট আসিলে উহা পাঠ করিয়া লিখিত বিষয় সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)- কে অবহিত করিতেন। রাসূলের দরবারে নিয়োজিনত লেখকদের সম্পর্কে বহু গ্রন্হও রচিত হইয়াছে। [***********************]

১। নবী করীম (স) মদীনায় হিজরত করিয়া স্থঅনীয়ভাবে বসবাস শুরু করার পর সর্বপ্রথম যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেন, মদীনার ইয়াহুদী ও আশেপাশের খৃষ্টান এবং মদীনার আনসার ও মুহাজির মুসলমানদের পাস্পরিক অনাক্রমণ ও অন্যান্য শর্ত স’লিত এক দীর্ঘ চুক্তিনামা রচনা করা তাহার অন্যতম। উহার ভাষা ছিল এইঃ

******************************************************

মুহাম্মদ (স) আল্লাহর নবী ও রাসূল কর্তৃক কুরায়শ বংশের মু’মিন মুসলমান ও মদীনাবাসী যাহারা তাহাদের সঙ্গে মিলিত হইবে ও একত্রে জিহাদ করিবে, তাহাদের মধ্যে লিখিত চুক্তিনামা ইহা। সিদ্ধান্ত এই যে, তাহারা অন্যান্য লোকদের হইতে পৃথক এক স্বতন্ত্র উম্মত তথা জাতি হইবে।[***************]

এই চুক্তিনামা ইসলামের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক অমূল্য সম্পদ। ইহাতে মোট ৫২টি দফা সন্নিবেশিত হয়। ইহাতে মদীনা শরীফকে মুসলমানদের জন্য ‘হেরম’ ঘোষণা করা হয়।[কিতাবুল আমওয়াল, আবূ দউদ, পৃষ্ঠা ৩১১।] নিম্নোকত্ উদ্ধৃতি হইতে প্রমাণিত হয় যে, চুক্তিনামা যথারীতি লিখিত হইয়াছিল এবং ইসলামে ইহই সর্বপ্রথম লিখিত সম্পদঃ

******************************************************

হযরত ‘রাফে’ ইবন খাদীজা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে- তিনি বলেন, মদীনা একটি হেরেম। রাসূলে করীম (স) উহাকে হেরেম ঘোষণা করিয়াছেন। আমাদের নিকট এই চুক্তিনামা খাওলানী চর্মে লিখিত রহিয়াছে। [********]

হযরত আলী (রা) –এর নিকট এই লিখিত চুক্তিনামাখানি পরবর্তীকাল পর্যন্ত সুরক্ষিত ছিল। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার নিকট আল্লাহর কিতাব এবং নবী করীম (স) হইতে প্রাপ্ত এই সহীফাখানি ছাড়া লিখিত সম্পদ আর কিছু নাই। সহিফাখানিতে লিখিত রহিয়াছেঃ মদীনা হেরেম। উহার সীমানা ‘আয়ের’ পাহাড় হইতে ঐ স্থান পর্যন্ত। এই হেরেমে যে কেহ কোন বিদ’আত উদ্ভাবন ও প্রচলন করিবে কিংবা কোন বিদ’আতকারীকে আশ্রয় দান করিবে, তাহারই উপর আল্লাহর ফেরেশতাদের এবং সমস্ত মানুষের লা’নত হইবে। তাহার নিকট হইতে কোনরূপ ব্যয় বা বিনিময় কবূল করা হইবে না। মুসলমানের প্রদত্ত নিরাপত্তা সর্বতোভাবে সমান মর্যাদায় গণ্য হইবে। কেহ যদি মুসলমানের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভংগ করে, তবে তাহার উপরও আল্লাহ, ফেরেশতা এবং সমস্ত মানুষের লা’নত। তাহার নিকট হইতে কোনরূপ ব্যয় বা বিনিময় গ্রহণ করা হইবে না।[**********************]

বস্তুত সভ্যতার ইতিহাসে এই চুক্তিনামাই একখানি প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্রের মর্যাদর অধিকারী এবং অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দলীল।

১। রাসূলে করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পর মুসলিম নাগরিকদের আদশুমারী গ্রহণ করেন। তিনি এ্ই উদ্দেশ্যে নিম্নোক্তদ্ধৃত ভাষায় এক ফরমান জারী করেনঃ

******************************************************

যে সব লোক ইসলাম কবুল করার কথা বলিয়াছে, তাহাদের নাম-ধাম আমার জন্য লিখিয়া দাও।

হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত হুযায়ফা (রা) বলেনঃ

******************************************************

অতঃপর আমরা রাসূলকে এক হাজার পাঁচশত ব্যক্তির নাম-ধাম ও পরিচয় লিখিয়া দিলাম।[*****************]

ইহাও রাসূলে করীম (স)- এর জীবন কালেরই এক লিখিত সম্পদ।

৩। তৃতীয় হিজরী সনের সফর মাসে বনী জামরা গোত্রের সাথে নবী করীম (স) এক সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিনামাও লিখিত অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে।[*****************]

অবশ্য নিম্নলিখিত দুইটি বিবরণ হইতে এই কথার ইংগিত পাওয়া যায় যে, হিজরতের অব্যবহিত পূর্বেও নবী করীম (স) অন্তত দুইটি ক্ষেত্রে লিখিত ফরমান দিয়াছিলেনঃ

(ক) তমীমদারীকে নবী করীম (স) এক লিখিত পরোয়ানা প্রেরণ করেন। [*****************]

(খ) হিজরত করিয়া মদীন যাওয়ার পথে নবী করীম (স) সুরাকার ইবন মালিক মুদলেজীকে এক নিরাপত্তালিপি লিখিয়া দিয়াছিলেন।[***************]

আল্লামা ইবন কাসীর উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

সুরাকা বলিলঃ আমার জন্য একটি দলীল লিখাইয়া দিন, যাহা আমার ও রাসূলের মধ্যবর্তী এই মুক্তির সিদ্ধান্তের প্রমাণ হইবে। অতঃপর নবী করীম (স) আমার জন্য হাড় বা পাতা বা ছেঁড়া কাপড়ে একটি লেখা তৈরী করাইয়া দিলেন।[****************]

৪। হযরত আবূ হুরায়ারা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, মক্কা বিজলেয়র বৎসর (৮ম হিজরী) খাজায়অ গোত্রের লোকগণ লাইস গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এই সংবাদ রাসূলে করীমের নিকট পৌঁছিলে তিনি তাঁহার জন্তু যানের পৃষ্ঠে সওয়ার থাকা অবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন। তাহাতে তিনি হেরেম শরীফের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য এবৃং নরহত্যার দণ্ড্ ও ‘দিয়ত’ সংক্রান্ত যাবতীয় হুকুম আহকাম বিস্তারিতভাবে বর্ণণা করেন। ভাষণ সমাপ্ত হইলে হযরত আবূ শাহ নামক জনৈক সাহাবী রাসূলে করীম (স)-কে বলিলেনঃ ****************************************************** হে রাসূল ! আমার জন্য ভাষণটি লিখাইয়া দিন। [আবূ শাহ যে রাসূল প্রদত্ত ভাষণটিই লিখিয়া দিতে বলিয়াছিলেন তাহার প্রমাণ এই যে, এই হাদীসের বর্ণনাকারী আলী ইবন মুসলিম ইমাম আওযায়ীকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ  ************************* ‘হে রাসূল ! আমার জন্য ইহা লিখাইয়া দিন’ বলিয়া লিখাইয়া দিতে আবূ শাহ রাসূলে করীমকে বলিয়াছেন? ইমাম আওযায়ী বলিলেনঃ ********************** ‘রাসূলের দেওয়া যে ভাষণটি তিনি শুনিতে পাইয়াছিলেন ইহা তাহাই’। ******************************************************] তখন নবী করীম (স) তাঁহার আবেধন মঞ্জুর  করিয়া জনৈক সাহাবীকে বলিলেনঃ- ***************** এই ভাষণটি আবূ শাহকে লিখিয়া দাও।[**************]

৫। ঐতিহাসিক হাফিয ইবন আবদুল বার লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স)আমর ইবন হাজম ও অন্যান্যকে সাদকা, দিয়ত, ফরয ও সুন্নাত সম্পর্কে এক দস্তাবেজ লিখাইয়া দিয়াছিলেন।[***************]

আল্লামা শাওকানী বিভিন্ন স্থানে এই কিতাবখানিরই উল্লেখ করিয়াছেন। [***************] ইমাম মালিক (রা) এই কিতাবখানির উল্লেখ করিয়া বর্ণনা করিয়াছেনঃ

******************************************************

আবদুল্লাহ ইবন আবূ বকর ইবন হাজম হইতে কথাটি বর্ণিত হইয়াছে যে, নবী করীম (স) আমর ইবন হাজমের জন্য যে কিতাবখানি লিখাইয়া দিয়াছিলেন, তাহাতে লিখিত রহিয়াছে, কুরআন মজীদকে কেবল পবিত্র ব্যক্তিই স্পর্শ করিবে।[***************]

ইমাম বায়হাকী তাঁহার *************** গ্রন্হে এই কিতাবখানি সম্পর্কে নিম্নোক্ত বর্ণনার উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ বকর ইবন মুহাম্মদ ইবন হাজম হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তিনি বলেনঃ ইহা নবী করীম (স) লিখিত সেই কিতাব, যাহা তিনি আমর ইবন হাজমকে ইয়েমেনে পাঠাইবার সময় লিখাইয়া দিয়াছিলেন। তাঁহাকে পাঠাইয়াছিলেন সেখানকার অধিবাসীদিগকে দ্বীন-ইসলামের গভীর জ্ঞান দান ও সুন্নাতের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে এবং তাহাদের নিকট হইতে যাকাত আদায় করার জন্য। ইহাতে তাঁহার জন্য নিয়োগপত্র ও প্রতিশ্রুতি এবং সেখানকার লোকদের মধ্যে তাঁহার দায়িত্ব পালনের বিষয়ও লিখিত ছিল।[******************]

হিজরী দশম সনে নবী করীম (স) হযরত আমর ইবন হাজম (রা)- কে নাজরান অধিবাসীদের শাসনকর্তা নিযুকত্ করেন। তিনি যখন নজরান এলাকার দিকে রওয়ানা  হইতেছিলেন, তাখন তাঁহাকে উক্ত দস্তাবেজখানা শাসনতান্ত্রিক আইন ও বিধান হিসাবে ব্যবহার করার জন্য প্রদান করা হয়।[***************]

ইমাম আবূ দাউদ উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) নাজরানবাসীদের সহিত সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং তাহাদের জন্য একখানি কিতাব লিখাইয়া দিলেন। [**************]

৬। এতদ্ব্যতীত নবী করীম (স) ইয়েমেনের অধিবাসীদের জন্য আর একখানি ‘দস্তাবেজ’ লিখাইয়া পাঠাইয়াছিলেন। উহার নাম ছিল ‘কিতাবুল জিরাহ’ (********)। ইহার সূচনায় লিখিয়ত হইয়াছিলঃ

******************************************************

ইহা আল্লাহ তা’আলা এবং তাঁহার রাসূলের তরফ হইতে প্রদত্ত ফরমানঃ হে ঈমানদার লোকেরা ! তোমরা তোমাদের ওয়াদা্ এ প্রতিশ্রুতিসমূহ পূরণ কর।[*****************]

এই ঘোষণাপত্র উষ্ট্রচর্মের লিখিত ছিল। হাফিয ইবন কাসীর লিখিয়াছেনঃ

এই গ্রন্হখানি ইসলামের প্রাথমিক ও পরবর্তীকালের সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কর্তৃক সমাদৃত, নিয়মিত পঠিত ও সকল গুরুত্বপর্ণ ব্যাপারে জ্ঞান উৎসরূপে পরিগণিত হইয়া আসিয়াছে। এমন কি-

******************************************************

রাসূলের সাহাবিগণ এই দস্তাবেজের দিকে সবসময়ই তাকাইতেন এবং উহার মুকাবিলায় নিজেদের রায় ও মতামত পরিহার করিতেন।[************]

৭ । বনু সকীফের প্রতিও তিনি এক সন্ধিনামা লিপিবদ্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। উহার শুরুতে লিখিত ছিলঃ

******************************************************

ইহা সকীফ গোত্রের জন্য আল্লাহর রাসূলের লিখিত সন্ধিনামা।[********************]

৮। নবী করীম (স) সদকা ও যাকাত সম্পকের্ক একখানি পূর্ণাঙ্গ দস্তাবেজ লিখাইয়া লইয়াছিলেন। উহাকে ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারী দায়িত্বশীল কর্মচারীদের নিকট প্রেরণ করাই ছিল তাঁহার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাহা পাঠাইবার পূর্বেই তিনি ইন্তেকাল করেন। পরে ইহা খিলাফতে রাশেদার কার্যপরিচালনার ব্যাপারে পুরাপুরি দিকদর্শন হিসাবে ব্যবহৃত হয়।[**************]

আল্লামা শওকানী এই দস্তাবেজখানি সম্পর্কে নিম্নোক্ত বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) সদকা সম্পর্কে একখানি কিতাব রচনা করাইয়াছিলেন। কিন্তু উহা তাঁহার কর্মচারীদের নিকট প্রেরণ করার পূর্বেই তিনি ইন্তেকাল করিয়া যান। তাঁহার পর হযরত আবূ বকর উহা বাহির করিয়া তদনুযায়ী আমল করেন। তাঁহার ইন্তেকালের পর হযরত উমর উহাকে বাহির করিয়া তদনুযায়ী কাজ করেন। হযরত উমরের ইন্তেকালের পর উহা তাঁহার এক অসিয়তের সহিত নথি করা অবস্থায় পাওয়া যায়। [******************]

ইমাম জুহরী এই দস্তাবেজখানি দেখিতে পাইয়াছেন এবং বলিয়াছেন, ইহা নবী করীমের সদকা সম্পর্কে লিখিত কিতাব। জুহরী সালেম ইবন আবদুল্লাহর নিকট উহার পাঠ গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তিনি উহা নিজের মধ্যে আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিলেন। উত্তরকালে উমর ইবন আবদুল আযীয খিলাফতের দায়িত্ব করিয়া হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমরের বংশধরদের নিকট হইতে উহা গ্রহণ করেন এবং উহার প্রতিলিপি তৈয়ার করাইয়া লন।[ ঐ, পৃষ্ঠা ১৯০ মুসনাদে ইমাম আহমদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪।]

৯। হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রা)- কেও সাদকা সম্পর্কে একখানি দস্তাবেজ লিখাইয়া দিয়াছিলেন। মুসা ইবন তালহা বলেনঃ

******************************************************

আমাদের নিকট নবী করীম (স)-এর নিকট হইতে প্রাপ্ত মু’আয ইবন জাবালের একখানি কিতাব রহিয়াছে।[মিশকাত, পৃষ্ঠা ১৫৯।]

এতদ্ব্যতীত নবী করীম (স)- এর লিখিত আরো বহুসংখ্যক সন্ধিচুক্তি ও অন্যান্য দলীল-দস্তাবেজ পাওয়া গিয়াছে। হাদীস বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সে সবের মূল্য অপরিসীম। এই ধরনের দস্তাবেজ সমূহের সংখ্যা হিসাবে করিলে তিন শতাধিক হইবে। ‘মিফতাহুল আকবা’ গ্রন্হে নবী করীম (স)- এর প্রেরিত ৩৬ খানা চিঠির প্রতিলিপির উল্লেখ করা হইয়াছে। টংক রাজ্যের তদানীন্তন অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী সাহেবজাদা আবদুর রহীম খান ২৫০ খানা লিখিত দস্তাবেজের উল্লেখ করিয়াছেন।[**********]

১। হুদায়বিয়ার সন্ধিনামা।[কিতাবুল আমওয়ালঃ আবূ উবাইদ, পৃষ্ঠা ১৫৭-১৫৮; আল-বিদায়া আন-নিহায়া, ইবনে কাসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৮; সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭১; ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬১০।]

২। বিভিন্ন কবীলা ও গোত্রের প্রতি বিভিন্ন সময়ের লিখিত ফরমান।[তাবাকাতে ইবনে সায়াদ, কিতাবুল আমওয়ালঃ আবূ উবাইদ, পৃষ্ঠা ২১।]

৩। বিভিন্ন দেশের বাদশাহ ও রাষ্ট্রনেতাদের নিকট লিখিত ইসলামী দাওয়াতের পত্রাবলী।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৩১ কিতাবুল আমওয়ালঃ আবূ উবাইদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০-২৩।]

৪। আবদুল্লাহ ইবন হাকীম সাহাবীর নিকট রাসূলের প্রেরিত চিঠি। এই চিঠিতে মৃত জন্তু ইত্যাদি সম্পর্কে আইন লিখিত হইয়াছিল।[মুজিমুস সগীর তাবরানী।]

৫। ওয়ায়েল ইবন হাজার সাহাবীর জন্য নামায, মদ্যপান ও সুদ ইত্যাদি সম্পর্কে নবী করীম (স) বিধান লিখাইয়া দিয়াছিলেন।[ঐ।]

৬। জহাক ইবনে সুফিয়ান সাহাবীর নিকট রাসূলে করীম (স)-এর লিখিতও প্রেরিত একখানি হিদায়াতনামা বর্তমান ছিল, তাহাতে স্বামীর পক্ষ হইতে স্ত্রী কর্তৃক রক্তপাতের বদলা (*********) আদায় করার বিধান লিখিত ছিল।[আবু দাউদ।]

৭। ইয়েমেনবাসীদের প্রতি বিভিন্ন ফসলের যাকাত সম্পর্কে নবী করীম (স) কর্তৃক লিখিত ও প্রেরিত এক দস্তাবেজ।[********************]

৮। ইয়েমেনবাসীদের প্রতি রাসূলে করীম (স)- এর লিখিত অপর একখানি পত্র, যাহাতে লিখিত ছিলঃ

******************************************************

ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের মধ্যে যাহারা ইসলাম কবুল করিবে, তাহারা মু’মিন লোকদের মধ্যে গণ্য হইবে, তাহাদের অধিকার ও কর্তব্য মু’মিনদের সমান হইবে। আর যাহারা ইয়াহুদী বা খৃষ্টান থাকিয়া যাইবে, তাহাদিগকে তাহাদের ধর্মপালন হইতে  বিরত রাখার চেষ্টা করা হইবে না, তবে তাহারা ‘জিযিয়া’ আদায় করিতে বাধ্য থাকিবে।[কিতাবুল আমওয়ালঃ আবূ উবাইদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১।]

৯। হুযায়ফা ইবন আয়ামান (রা)-কে এক ফরমান লিখাইয়া দিয়াছিলেন। তাহাতে যাকাতের ফরযগুলি সম্পর্কে বিবরণ লিখিত ছিল।[তাবাকাতে ইবন সায়াদ।]

১০। আল-ইবনুল হাজারীকে রাসু করীম (স) যাকাতের মসলা লিখাইয়া দিয়াছিলেন।

১১। নবম হিজরী সনে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)- কে আমীরে হজ্জ নিযুক্ত করিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিলেন এবং তাঁহাকে নবী করীম (স) হজ্জ্বের নিয়ম-পদ্ধতি লিখাইয়া দিয়াছিলেন।[তাফসীরে রুহুল মায়ানী, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৪ ******************** সীরাতে ইবন হিশাম, পৃষ্ঠা ৫৫৬।]

১২। সূরা তওবা নাযিল হওয়ার পর নবম হিজরী সনে মদীনা হইতে হযরত আলী (রা)- কে মক্কার বিশেষ পয়গাম সহকারে প্রেরণ করেন। তাঁহাক হজ্জ্বের সময় লোকদিগকে জানাইয়া দেওয়ার জন্য নিম্নোক্ত ঘোষণা লিখাইয়া দেনঃ

******************************************************

এই বৎসরের পর কোন মুশরিকই কা’বা ঘরের নিকটে যাইতে পারিবে না; উলঙ্গ হইয়া কেহ উহার তওয়াফ করিতে পারিবে না, বেহেশতে মু’মিন ব্যতীত কেহ দাখিল হইতে পারিব না এবং প্রত্যেকে প্রতিশ্রুতি পূরণ করিতে বাধ্য থাকিবে।[তাফসীরে আবুস সয়ুদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫২, সীরাতে ইবন হিশাম (উর্দূ), পৃষ্ঠা ৫৫৩।]

১৩। উমর ইবন আকসা সুলামীকে এক লিখিত ফরমান পাঠানো হয়, তাহাতে সদকা ও জন্তুর যাকাত সম্পর্কিত আইন-কানুন লিখিত ছিল।

১৪। গালিব ইবন আবদুল্লাহকে এক ফরমান পাঠানো হয়, তাহাতে গনীমতের মাল সম্পর্কে বিস্তারিত মাসলা-মাসায়েল লিখিত হইয়াছিল।

১৫। সুমামা প্রতিনিধিদলকে রাসূলে করীম (স) ফরযসমূহ এবং সদকার মাসলা লিখাইয়া দিয়াছিলেন।

১৬। আবূ রাশেদুল আজদীকে নামাযের নিয়ম-কানুন ও আইন লিখাইয়া দেন।

১৭। নজরানাবাসীদের এক পাদ্রীর প্রতি রাসূলে করীম (স)- এর এক লিখিত ফরমান প্রেরণ করা হয়। উহাতে ইসলাম, ইসলামের দাওয়াত ও জিযিয়ার আদেশ লিখিত হয়।

১৮। ‘হাজরামাউত’-এর শাসনকর্তার নামে নামায, যাকাত ও গনীমনের মালের বিবরণ লিখিয়া পাঠানো হয়।

১৯। ‘দাওমাতুল জান্দাল’ অধিবাসীদের নামে জিযিয়া ও যাকাতের বিধান লিখিয়া পাঠানো হয়।[কিতাবুল আমওয়াল আবূ উবায়দ, পৃষ্ঠা ১৯৫।]

২০। দাওমাতুল জান্দাল ও কতনের অধিবাসীদের নাম ওশর সম্পর্কীয় মাসলা লিখিয়া পাঠানো হয়।

২১। হররা ও আজরাহ কবীলাসমূহের নামে জিযিয়ার বিধান লিখিয়া পাঠান হয়।

২২। বনু নাহাদ কবীলার নামে যাকাতের পশু সম্পর্কে নির্দেশ পাঠানো হয়।

২৩। বনূ হানীফা কবীলাকে জিযিয়ার মাসলা লিখিয়া পাঠানো হয়।

২৪। ‘হাজার’-বাসীদের প্রতি এক ফরমান পাঠানো হয়। উহাতে ইসলামের উপর মজবুত হইয়া দাঁড়াইতে ও শাসনকর্তার আনুগত্য করিতে বলা হয়।[ঐ, পৃষ্ঠা ২০০।]

২৫। ‘আয়লা’ ও ‘ইউহানা’ বাসীদিগকে আমন-নামা লিখিয়া দেওয়া হয়। ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূল তাহাদের জন্য একটি দস্তাবেজ লিখিয়া দেন। উহা তাহাদের নিকট রক্ষিত ছিল। উহার শুরুতে লিখিত হয়ঃ

******************************************************

দয়মায় মেহেরবান আল্লাহর নামে- ইহা আল্লাহ ও তাঁহার নবী মুহাম্মদের তরফ থেকে ‘ইউহানা’ ও ‘আয়লা’- বাসীদের জন্য দেওয়া এক আমানত।[কিতবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা ২০০, নূরুল ইয়াকীন পৃষ্ঠা ২৪৮।]

২৬। তমীমদারী কবীলাকে উপঢৌকন কবুল করা ও স্বর্ণ নির্মিত জিনিসপত্র ব্যবহার করা সম্পর্কে ইসলামী বিধান লিখিয়া দেওয়া হয়।

২৮। আম্মানের শাসনকর্তা জা’ফর ও আবদের নামে ইসলামের দাওয়াত, ‘ওশর’‘যাকাত’ ইত্যাদির মাসলা লিখিয়া পাঠানো হয়।

২৯। খালিদ ইবন জামাদকে ইসলামের ‘আরকান’ লিখিয়া দেওয়া হয়।

৩০। জুরয়া-ইবন সায়ফকে জিযিয়া ও যাকাতের বিধান লিখিয়া দেওয়া হয়।[কিতাবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা ২০১, ********]

৩১। রবীয়া ইবন যী-মারহাব হাজরীকে শুল্ক ইত্যাদির মাসলা লিখিয়া দেওয়া হয়।

৩২। শারহবীল, হারেস, নয়ীম, বনু আবদু-কালানকে গনীমতের মাল, ওশর ও যাকাতের মাসলা লিখিয়া দেওয়া হয়।

৩৩। মুসলিম জনগণের জন্য এক ফরমানে নবী করীম (স) ফল পরিপক্ক হওয়ার পূর্বে উহার বিক্রয় ও বায়তুল মালের এক-পঞ্চমাংশ আদায় করা পূর্বে গণীমতের মাল হইতে নিজেদের অংশ গ্রহণ ইত্যাদি সম্পর্কে ইসলামরে বিধি-বিধান লিখাইয়া দিয়াছিলেন।

৩৪। বিক্রয় করার পূর্বে পণ্যদ্রব্যের দোষ প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আদা ইবনে খালিদকে এক বয়ান লিখাইয়া দেওয়া হয়।

৩৫। হযরত উমর (রা)- কে সদকার মাসলাসমূহ লিখিয়া দেওয়া হয়।

৩৬। হযরত আবূ বকর (রা)- কে যাকাতের যাবতীয় হুকুম-আহকাম লিখিয়া দেন।

৩৭। তমীমদারী ইসলাম কবুল করিলে তাঁহার গ্রামরে একখণ্ড জমি লিখিয়া দেওয়া হয়। হযরত উমর (রা) খলীফা নিযুক্ত হওয়ার পর সেই লিখিত দস্তাবেজ তাঁহার নিকট পেশ করা হয় এবং তিনি উক্ত ভূমিখণ্ড তাঁহার জন্যই বরাদ্দ করেন।[কিতাবুল আমওয়াল-আবু উবাইদ, পৃ: ২৭৪]

৩৮। মজ্জায়া ইয়ামনীকে একখণ্ড জমি লিখিয়া দেওয়া হয় এবং ইহার জন্য দস্তাবেজ তৈয়ার করিয়া দেওয়া হয়। আবূ সা’লাবাত খুশানীকেও অনুরূপ দস্তাবেজ তৈয়ার করিয়া একখণ্ড জমি দেওয়া হয়।

৩৯। মতরফ ইবন কাহেন বাহেলীকে যাকাহের মাসলা-মাসায়েল লিখিয়া দেন।

৪০। মুনযির ইবন সাবীকে জিযিয়ার মাসলা লিখাইয়া দেওয়া হয়। অগ্নিপূজকদের প্রতি ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কেও এক বয়ান লিখাইয়া দেওয়া হয়।[ঐ, পৃ: ২৮০ ও ২৮১ ***************]

৪১। ‘আকীদর’ বংশের লোকদিগকে এক ফরমান লিখাইয়া দেওয়া হয়। তখন পর্যন্ত রাসূল (স)-এর নবুয়্যাতী (সরকারী) স্ট্যাস্প তৈয়ার না হওয়ার কারণে উহার উপর হযরতের টিপসহি লাগানো হয়।[আল ইসাবাহ, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৩১।]

৪২। মুসাইলমাতুল কাযযাবের নামে রাসূলে করীম (স) এক ফরমান লিখাইয়া পাঠাইয়াছিলেন (এই ফরমানের আলোকচিত্র ১৮৯৬ সনে লণ্ডনের Picture Mahazine পত্রিকায় প্রকাশিত হয়)।

৪৩। খায়বারের ইয়াহুদীদের এলাকায় হযরত আবদুল্লাহ ইবন সাহল (রা)-কে মুতাবস্থায় পাওয়া যায়। তখন নবী করীম (স) ইয়াহুদীদিগকে উহার দিয়ত দেওয়া সম্পর্কে এক পত্র লিখিয়া পাঠান।[সীরাতে ইবনে হিশাম (উর্দু), পৃষ্ঠা ৪৭৩।]

৪৪। ইয়েমেনাবাসীদিগকে লিখিয়া পাঠানো হয় যে, মধুরও যাকাত দেওয়া কর্তব্য।

বায়হাকী উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) ইয়েমেনবাসীদিগকে লিখিলেন যে, মধু চাষকারীদের নিকট হইতে যাকাত লওয়া হইবে।[***********]

৪৫। হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রা)-কে নবী করীম (স) নগদ টাকা ও স্বর্ণের যাকাত সম্পর্কে এক বিধান লিখিয়া পাঠানঃ

******************************************************

নবী করীম (স) মু’আয ইবনে জাবাল (রা)-কে লিখিয়া পাঠান যে, প্রতি দুইশত দিরহাম হইতে পাঁচ দিরহাম ও প্রতি কুড়ি মিসকাল স্বর্ণ হইতে অর্ধ মিসকাল যাকাত গ্রহণ করিবে।[******************* প্রথম খণ্ড, কিতাবুযযাকাত পৃষ্ঠা, ১৭৫, দারে কুতনী।]

৪৬। ইয়েমেনবাসীদের প্রতি প্রেরিত অপর এক ফরমান সম্পর্কে ইমাম দারেমী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) ইয়েমেনের অধিবাসীদিগকে লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, কুরআন মজীদকে কেবল পাক ব্যক্তিই স্পর্শ করিবে, বিবাহের মালিকানার বা স্বামীত্ব লাভের পূর্বে তালাক হইতে পারে না এবং খরিদ করিয়া লওয়ার পূর্বে গোলাম আযাদ করা যায় না।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ২৯৩।]

৪৭। আরবের সকল কবীলার নামেই নবী করীম (স) এক সময় দিয়তের মাসলা লিখাইয়া পাঠাইয়াছিলেন।[বুখারী, নাসায়ী, দারে কুতনী, নায়লুল আওতার, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪২।]

৪৮। খায়বারের দখলকৃত জমি ইয়াহুদিদের মধ্যে বন্টনের চুক্তিনামা লিখিত হয়।[ফতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ৩৬-৪২।]

৪৯। নবী করীম (স) ‘হামাদান’ গোত্রের প্রতি এক পত্র হযরত আলী (রা)- এর মাধ্যমে পাঠাইয়াছিলেন। এই পত্র তাহাদিগকে পাঠ করিয়া শোনাইলে তাহারা সকলেই ইসলাম কবুল করে। আল্লামা ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আলী তাহাদিগকে রাসূলে করীম (স)-এর পত্র পাছ করিয়া শোনাইলেন। তাহারা যখন সব শুনিলেন, তখন ‘হামদান’ গোত্রের সব লোক একত্রে ইসলাম কবুল কর।[****************]

৫০। জুরবা ও আযরাহবাসীদের নামেও রাসূলে করীম (স)-কে আমান-নামা লিখিয়া দেন।

আল্লামা ইবন কাসীর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স) জুরবা ও আযরাহবাসীদের জন্য আমান-নামা লিখিলেন। উহার শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখার পর লিখিত হয়ঃ ইহা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের তরফ হইতে জুরবা ও আযরাহবাসীদের জন্য লিখিত দলীল, তাহারা আল্লাহর ও মুহাম্মদের নিকট হইতে প্রদত্ত আমান ও পূর্ণ নিরাপত্তার মধ্যে থাকিবে।[************** ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬-১৭।]

৫১। হেমইয়ারের বাদশাহদের প্রতি রাসূলের লিখিত পত্র।

আল্লামা ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স) তাঁহাদের প্রতি পত্র লিখিলেন।[***************]

৫২। নবী করীম (স) নাজরানের বিশপ পাদ্রীর নামে এক পত্র প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাহাতে লিখিত ছিলঃ

******************************************************

আল্লাহর রাসূল ও নবী মুহাম্মদের তরফ হইতে নাজরানের বিশপের প্রতিঃ তুমি ইসলাম কবুল কর, আমি তোমার নিকট ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের আল্লাহর হামদ করিতেছি। অতঃপর আমি তোমাদিগকে বান্দার দাসত্ব হইতে মুক্ত হইয়া আল্লাহর দাসত্ব কবুল করার ও মানুষের বন্ধুত্ব পৃষ্ঠপোষকতা হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া আল্লাহর বন্ধুত্ব-পৃষ্ঠপোষকতার আশ্রয় গ্রহণের আহবান জানাইতেছি। ইহা কবুল না করিলে তোমরা জিযিয়া দিতে বাধ্য থাকিবে। আর তাহাও অস্বীকার করিলে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিব।[****************]

 

সাহাবীদের লিখিত হাদীস সম্পদ

সাহাবীদের মধ্যে কিছু লোক জাহিলিয়াতের যুগেই লিখিতে ও পড়িতে জানিতেন এবং পূর্বে যেমন বলিয়াছি-বদর যুদ্ধে ধৃত মক্কার লেখাপড়া জানা লোকদের নিকট অনেক যুবক সাহাবীই শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। ফলে তাহাদের অনেকেই নবী করীম (স)-এর নিকট শ্রুত হাদীস ব্যক্তিগতভাবে লিখিয়া রাখিতে সমর্থ ছিলেন। নবী করীম (স) সাধারণভাবে সকলকেই হাদীস লিখিতে প্রথম পর্যায়ে নিষেধ করিলেও উত্তরকালে ইহার জন্য তিনি সাধারণ অনুমতিই দান করেন। এমনকি, হাদীস লিখার পথে কোনরূপ অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতরা সৃষ্টি হইলে তাহা তিনি দূর করিয়া দিতেন।

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স (রা) বলেনঃ

আমি নবী করীম (স)-এর নিকট শ্রুত প্রত্যেকটি কথাই হিফাযতের উদ্দেশ্যে লিখিয়া লইতাম। ইহা দেখিয়া কুরায়শ বংশের সাহাবিগণ আমাকে এই কাজ করিতে নিষেধ করেন। আমাকে তাঁহারা বলেনঃ

******************************************************

তুমি রাসূলে মুখে যাহাই শুনিতে পাও, তাহা সবই লিখিয়া রাখো? অথচ রাসূল (স) একজন মানুষ তো, তিনি কখনো সন্তোষ আর কখনো ক্রোধের মধ্যে থাকিয়া কথা বলেন?

আবদুল্লাহ বলেনঃ অতঃপর আমি হাদীসি লেখা বন্ধ করিয়া দেই এবং একদিন রাসূলের নিকট ব্যাপারটি উল্লেখ করি এবং বলিঃ

******************************************************

হে আল্লাহর রাসূল! কুরায়শরা বলে, তুমি রাসূলের সব কথাই লিখিতেছ? অথচ তিনি একজন মানুষ। সাধারণ মানুষের মতই তিনি কখনো কখনো ক্রদ্ধ হইয়া থাকেন।

রাসূলে করীম (স) আমার একথা শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দুই ওষ্ঠের দিকে ইশারা করিয়া বলিয়া উঠিলেনঃ

******************************************************

তুমি লিখিতে থাক। যে আল্লাহর মুষ্টিবদ্ধ আমার প্রাণ, তাঁহার শপথ, আমার এই (মুখ) হইতে প্রকৃত সত্য কথা ছাড়া কিছুই বাহির হয় না।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৭। আবূ দাউদ; মুসনাদে আহমাদ মুস্তাদরাক-হাকেমের বর্ণনায় এই কথার পর উল্লেখ করা হইয়াছে। রাসূল বলিলেন-************ ‘অতএব লিখ; ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ১০৪; ইমাম আহমাদের উদ্ধৃতিতে বলা হইয়াছেঃ ************************** লিখ, যাহার হস্তে আমার প্রাণ তাঁহার শপথ, আমার হইতে ‘হক ছাড়া কিছুই প্রকাশিত হয় না। *****************************]

এই আদেশ শ্রবণের পর হযরত আবদুল্লাহ রাসূল (স)-কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

হে রাসূল ! আপনার নিকট হইতে যাহা কিছুই শুনিতে পাই তাহা সবই কি লিখিয়া রাখিব?

রাসূল বলিলেনঃ ****** হ্যাঁ; আবদুল্লাহ পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

**************************- ক্রদ্ধ ও সন্তোষ উভয় অবস্থায় বলা সব কথাই কি লিখিব?

তখন রাসূল (স) চুড়ান্তভাবে বলিলেনঃ

******************************************************

হ্যাঁ, এই সকল অবস্থায়ই আমি প্রকুত সত্য  ছাড়া আর কিছুই বলি না।[******************************************************]

এই বর্ণনা হইতে এক সঙ্গে দুইটি কথা সুস্পষ্টভাবে জানা যায়। প্রথম এই যে, নবীর কণ্ঠ হইতে কখনো সত্যোর বিপরীত কথা প্রকাশিত ও উচ্চারিত হয় নাই। কখনে সেরূপ কথা বলিয়া ফেলিলে বা বলিতে উদ্যত হইলেও আল্লাহর সামগ্রিক হেফাজতের সাহায্যে নবী সেই ভূল হইতে রক্ষা পাইয়া গিয়াছেন। উপরের উদ্ধৃতি হইতে সত্য কথা বলার ব্যাপারে নবীর অপ্রতুল দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠ মানসিকতা প্রমাণিত হয়।

দ্বিতীয়ত, হাদীস লিখিয়া রাখা কেবল সঙ্গতই নয়, সেজন্য রাসূলের কেবল অনুমতিই ছিল না, সেই সঙ্গে হাদীস লিখিয়া রাখার সুস্পষ্ট ও অবাধ আদেশও তিনি করিয়াছিলেন। রাসূলের এই আদেশ বিশেষ কোন সময় বা অবস্থার মধ্যে সীমিত ছিল না। সকল সময় ও অবস্থায় বলা সব কথাই লিখিবার জন্য তিনি বলিষ্ঠ স্বরে অনুমতি দিয়াছিলেন।

কেননা, রাসূলে করীম (স) সর্বসাধারণ মুসলিমের জন্য সকল সময়ে ও সকল অবস্থায়ই অনুসরনীয় ছিলেন। তাঁহার প্রত্যেকটি অবস্থা ও প্রত্যেক সময়ের সকল কথা এবং সকল প্রকার কাজই ইসলামী শরীয়াতের অন্যতম উৎসরূপে গণ্য।

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) রাসূলের সকল কথা লিপিবদ্ধ করিয়া যে হাদীস সংগ্রহ তৈয়ার করিয়াছিলেন নবী করীম (স) নিজেই উহার নামকরণ করিয়াছিলেন ‘সহীফায়ে সাদেকা’ (*************)। ইহা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’সের অন্যন্ত প্রিয় গ্রন্হ ছিল।তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

জীবনের প্রতি মাত্র দুইটি জিনিসই আমাকে আকৃষ্ট করিয়াছে, তন্মধ্যে একটি হইতেছে ‘সাদেকা’ আর দ্বিতীয়টি হইতেছ আমার নিম্ন জনি। তবে ‘সাদেকা’ এমন একখানি গ্রন্হ, যাহা আমি নবী করীম (স)- এর নিকট হইতে (শুনিয়া) লিখিয়া লইয়াছি।[সুনানে দারেমী; পৃষ্ঠা ৬৭. - ************* জামে’ বয়ানুল ইলম-ইবনে আবদুল বার ************] ইহাতে এক হাজারটি হাদীস সংগৃহীত হইয়াছিল।[*********************]

হযরত আবদুল্লাহর ইন্তেকালের পর এই ‘সাদেকা’ গ্রন্হখানি তাঁহার পৌত্র শুয়াইব ইবন মুহাম্মদের হস্তগত হয়। তাঁহার নিকট হইতে পুত্র আমর সাদেকা’র হাদীসসমূহ লোকদের নিকট বর্ণনা করেন।

******************************************************

হাদীস গ্রন্হসমূহে আমর ইবনে শুয়াইব, তাহার পিতা হইতে.............. তাঁহার দাদা হইতে সূত্রে যত হাদীসই বর্ণিত হইয়াছে, তাহা সবই এই ‘সাদেকা সহীফা’ হইতে গৃহীত ও বর্ণিত।[তিরমিযী শরীফ, *********************- কিতাবুল  ইলম, দারেমী।]

মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল গ্রন্হে এই সহীফাখানি সম্পর্ণ শামিল হইয়াছে। ফিকাহর চারজন ইমামই এই গ্রন্হের হাদীস দলীল হিসাবে পেশ করিতেন।[যাদুল মায়াদ-ইবনুল কাইয়্যেম, ৩য় পৃষ্ঠা ৪৫৮।]

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ একজন আনসার সাহাবী রসালে করীম (স)-এর খিদমতে বসিয়া থাকিয়া তাঁহার বাণী শুনিতেন; তাহা তাঁহার খুবই ভাল লাগিত, পছন্দ হইত। কিন্তু তিনি কোন কথাই ভালভাবে স্মরণ রাখিতে পারিতেন না। সব কথা স্মরণ রাখার ব্যাপারে তিনি ছিলেন কতকটা ব্যতিক্রম। তাই একদিন তিনি তাঁহার এই অসুবিধার কথা রাসূলের নিকট প্রকাশ করিলে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ ******************** ‘তোমার দক্ষিণ হস্তের সাহায্য গ্রহণ কর’। এই বলিয়া তিনি হাত দ্বারা লিখিবার কথা বুঝাইয়াছিলেন।[**************]

নবী করীম (স) সকল প্রকার ইলম –বিশেষভাবে ইলমে হাদীস লিখনের মাধ্যমে অক্ষয় ও চিরন্তন করিয়া রাখার জন্য আদেশ করেন।

তিনি বলেনঃ- ******************* ‘ইলম লিপিবদ্ধ করিয়া রাখ’। অপর এক বর্ণনায় উল্লেখ করা হইয়াছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বলেনঃ নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইলমে হাদীস বন্দী করিয়া সংরক্ষিত কর?

আমরা জিজ্ঞাসা করিলামঃ

******************************************************

উহাকে কেমন করিয়া বন্দী করিব।

রাসূল বলিলেনঃ

******************************************************

উহাকে লিখিয়া লও।[মুস্তাদরাক, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৬।]

আবু তুফাইল আমের ইবনে ওয়াসিল বলেনঃ আমি একদিন হযরত আলীর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি হযরত আলী (রা)-কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

রাসূল আপনাকে বিশেষভাবে কোন জিনিস দান করিয়াছেন কি?

জওয়াবে হযরত আলী (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

রাসূল বিশেষভাবে আমাকে এমন কোন জিনিস দিয়া যান নাই, যাহা সকল লোককে সাধারণভাবে দেন নাই। তবে  আমার এ্ই তরবারির খাপের মধ্যে যাহা লিখিথ অবস্থায় আছে, তাহা আমাকে তিনি বিশেষভাবে দান করিয়া গিয়াছেন।[জামে বায়ানুল ইলম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭২; মুস্তাদরাক-হাকেম, মুসলিম, শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬১।]

অপর এক বর্ণনায় কথাগুলি নিম্নরূপ ভাষায় বলা হইয়াছে। হযরত আলী (রা)-কে জিজ্ঞাসাকরার হইলঃ

******************************************************

রাসূল আপনার নকট গোপন করিয়া কি কিছু বলিয়া গিয়াছেন?

জওয়াবে হযরত আলী (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

রাসূল আমাকে অন্য লোকদের হইতে লুকাইয়া একটি জিনিস ব্যতীত গোপনভাবে আর কিছুই দিয়া যান নাই। সেই জিনিসটি হইল এই যে, তিনি চারিট কথা আমাকে বলিয়া গিয়াছেন।[জামে বয়ানুল ইলম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭২ ; মুস্তাদরাক-হাকেম, মুসলিম শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬১।]

হযরত আবু হুযায়ফা (রা) হইতেও অনুরূপ ঘটনা বর্ণিত হইয়াছে। তিনি বলেন, একদিন তিনি হযরত আলী (রা)-কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

আপনার নিকট কোন লিখিত জিনিস আছে কি? উত্তরে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

না। আল্লাহর কিতাব, মুসলিম ব্যক্তিকে প্রদত্ত বোধশক্তি এবং এই সহীফায় লিখিত জিনিস ব্যতীত আমার নিকট আর কিছুই নাই।

হুযায়ফা (রা) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

এই সহীফার মধ্যে কি কি লিখিত আছে?

হযতর আলী (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

ইহাতে রক্তপাতের বদলা, বন্দী মুক্তিদান ও কাফির হত্যার শাস্তিস্বরূপ মুসলিম নিহত হইবে না- এই সব কথা লিখিত আছে।[বুখারী শরীফ, কিতাবুল ইলম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১।]

আবু তুফাইল বর্ণিত হাদীসের শেষভাগে বলা হইয়াছে, অতঃপর হযরত আলী (রা) তাঁহার কোষের মধ্য হইতে একখানি সহীফা বাহির করেন। তাহাতে নিম্নোক্ত কথাগুলি লিখিত ছিলঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অপর কাহারো উদ্দেশ্যে জন্তু বা প্রাণী যবেহ  করে, তাহার উপর আল্লাহর অভিশাপ; যে ব্যক্তি জমির বিভিন্ন অংশের চিহ্ন চুরি করে বা (অপর বর্ণনামতে ) পরিবর্তন করে, তাহার প্রতি আল্লাহর লা’নত; এবং যে ব্যক্তি কোন ইসলাম বিকৃতকারী বা বিদ’আত ব্যক্তিকে আশ্রয় দান করে, তাহার উপর আল্লাহর লা’নত।[মুসলিম শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৬২।]

এই সম্পর্কে বুখারী শরীফে বর্ণিত একটি হাদীসও এখানে উল্লেখযোগ্য। ইয়াযীদ ইবনে শরীফ বলেনঃ

******************************************************

হযরত আলী (রা) একদিন ‘আজুর’ নামক স্থানে মিম্বরের উপর দাঁড়াইয়া আমাদের সম্মুখে ভাষণ দিতেছিলেন। তাঁহার স্কন্ধে একখানি তরবারি ঝুলানো ছিল। উহার সহিত একটি ‘সহীফা’ ও লটকানো ছিল। তিনি বলিলেনঃ আল্লাহর শপথ, আমর নিকট পাঠযোগ্য কোন কিতাব- আল্লাহর কিতাব ও এই সহীফার লিখিত জিনিস ব্যতীত- নাই। এই বলিয়া তিনি সহীফাখানি খুলিয়া ধরিলেন। তাহাতে উষ্ট্রের দাঁত রক্ষিত দেখিলাম এবং লিখিত দেখিলামঃ মদীনা ‘আইর’ নামক স্থান হইতে অমুক পাহাড় পর্যন্ত হেরেম। এই স্থানে যদি কেহ কোন বিদ’আত- ইসলাম-বহির্ভূতকাজ করে, তবে তাহার উপর আল্লাহ ফেরেশতা ও সমগ্র মানুষের অভিশাপ। আল্লাহ তাহার কোন অর্থব্যয় বা বিনিময় কবুল করিবেন ন। উহাতে আরো লিখিত ছিলঃ সকল মুসলিমের ‘যিম্মা’ এক, উহার জন্য তাহাদরে সকলেই চেষ্টা করিবে। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের সহিত কৃত ওয়াদা ভংগ করিবে, তাহার উপর আল্লাহর ফেরেশতা ও সমগ্র মানুষের অভিশাপ। আল্লাহ তাহার কোন অর্থব্যয় বা বদলা গ্রহণ করিবেন না।

উহাতে ইহাও লিখিত ছিল৬ ‘যে ব্যক্তি স্বীয় পৈতৃক সম্পর্ক ব্যতীত অপর কাহারো সহিত পৈতৃক সম্পর্ক স্থাপন করিবে, তাহার উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সমগ্র মানুষের অভিশাপ। তাহার নিকট হইতে কোন অর্থব্যয় বা বদলা গ্রহণ করা হইবে না’।[বুখারী, শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৮৪।]

হযরত হুযায়ফা (রা) বর্ণিত অপর একটি হাদীসও এই প্রসঙ্গেই উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেনঃ

******************************************************

আমি হযরত আলী (রা)-কে জিজ্ঞাসা করিলামঃআপনার নিকট আল্লাহর কিতাব লিখিত ওহী ব্যতীত ওহী’র আর কোন জিনিস আছে কি?

হযরত আলী ইহার জওয়াবে বলিলেনঃ

******************************************************

না, যে আল্লাহ বীজ দীর্ণ করেন ও মানুষকে সৃষ্টি করে, তাঁহার শপথ, আমি কুরআন ব্যতীত অহীর অপর কোন জিনিস জানি না। তবে জানি দুইিট জিনিস- একটি হইল বোধশক্তি, যাহা আল্লাহ তা’আলা এই কুরআন হইতে এক ব্যক্তিকে দান করেন; আর দ্বিতীয় জিনিস, যাহা এই সহীফায় লিখিত আছে।

হযরত হুযায়ফা (রা) জিজ্ঞাসা করিলেন৬ এই সহীফায় কি আছে? তখন হযরত আলী (রা) বলিলেনঃ ‘উহাতে দিয়ত’ বন্দীমুক্তির নিয়ম এবং কাফিরের বিনিময়ে কোন মুসলমানকে হত্যা করা হইবে না’ লিখিত আছে।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, কিতাবুল জিহাদ পৃষ্ঠা ৪২৮। এই হাদীস হইতে জানা যায় যে, সহীফাখানিতে কতকগুলি হাদীস লিখিত ছিল এবং তাহাও ওহীরই অংশ। দ্বিতীয়ত কেবল কুরআনই ওহীলব্ধ জিনিস নহে, হাদীসও ওহীলব্ধ জিনিস।]

হযরত আলী (রা)- এর এই ভাষণ সম্পর্কই আর একটি বর্ণনারও উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বলেনঃ

******************************************************

আমরা নবী করীম (স)- এর নিকট হইতে কুরআন মজীদ ও এই সহীফায় লিপিবদ্ধ হাদীস ব্যতীত আর কিছুই লিখি নাই।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫১।]

উপরে উল্লিখিত সমস্ত বর্ণনা ও আলোচনার সারকথা এই যে, হযরত আলী (রা) নবী করীম (স)-এর নিকট হইতে কুরআন মজীদ এবং হাদীস শরীফ লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। উপরন্তু তিনি হাদীসের একটি সংকলনও তৈয়ার করিয়া লইয়াছিলেন। উহাতে কি ধরনের হাদীস লিখিত ছিল, তাহা উপরোল্লিখিত বিভিন্ন বর্ণনা হইতে জানা গিয়াছে। কিন্তু উহার সংখ্যা কত ছিল, তাহা কোথাও উল্লেখ করা হয় নাই।

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ

******************************************************

রাসূল (স)-এর সাহাবীদের মধ্যে আমর অপেক্ষা অধিক কেহ রাসূলের হাদীস বর্ণনা করেন নাই । তবে আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আ’স অধিক বর্ণনা করিয়াছেন। ইহার কারণ এই যে, তিনি হাদীস লিখিয়া রাখিতেনঃ কিন্তু আমি লিখিতাম না।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২। সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৭।]

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আ’স (রা) যে রাসূলের হাদীসমূহ লিখিয়া রাখিতেন, তাহা ইতিপূর্বে প্রমাণিত হইয়াছে। তবে হযরত আবূ হুরয়ারার নিজ সম্পর্কিত উক্তি তাঁহার প্রথম জীবনের জন্য প্রযোজ্য, জীবনের শেষভাগের জন্য নয়। কেননা তিনি প্রথম পর্যায়ে রাসূলের হাদীস লিখিয়া রাখিতেন না, তখন উহা লিখিয়া রাখার প্রয়োজন বোধ করিতেন না। তিনি যাহা শুনিতে পাইতেন, তাহা মুখস্থ করিয়া রাখাকেই যথেষ্ট মনে করিতেন। আর তিনি অপরের তুলনায় অধিক স্মরণশক্তিসম্পন্নও ছিলেন। তাঁহার শক্তি সম্পর্কে হাদীসে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

অপরে যাহা স্মরণ রাখিতে পারিতেন না, তাহা তিনি স্মরণ রাখিতে পারিতেন।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২।]

হযরত আবূ হুরায়রার স্মরণশক্তি অধিক হওয়া সম্পর্কে তাঁহার নিজের জবানীতেই একটি ঘটনার উল্লেখ করা হইয়াছে। মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছে-একদিন নবী করীম (স) মজলিসে উপস্থিত লোকদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাহার কাপড় বিছাইয়া দিয়া আমার এই হাদীস শ্রবণ করিবে, তাহার পর উহাকে নিজের বুকের সাথে মিলাইবে, সে যাহা শুনিবে, তাহার কোন কথাই সে কখনো ভুলিয়া যাইবে না।

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ

******************************************************

এই কথা শুনিয়া আমি আমার স্কন্ধে রক্ষিত চাদরখানা বিছাইয়া দিলাম। রাসূল যখন তাহার কথা সম্পূর্ণ করিলেন, তখন চাদরখানাকে আমার বুকের সহিত লাগাইলাম। অতঃপর রাসূলের নিকট শোনা কোন হাদীসই আমি ভুলিয়া যাই নাই।[মুসলিম শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০২,*************]

স্মরণশক্তির এই প্রখরতা সত্ত্বেও তিনি শেষ পর্যন্ত হাদীস লিখিয়া রাখিতে শুরু করেন এবং তিনি বিপুল সংখ্যা হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া লন। তাঁহার লিখিত হাদীসের সংখ্যা ছিল পাঁছ সহস্রাধিক।[মুস্তাদরাক হাকেম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১১, ফতহুল বারী- ************* জামে’ বায়ানুল ইলম – ইবনে আবদুল বার, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৪।]

হযরত আবূ হুরায়রার নিকট হাদীস শিক্ষাপ্রাপ্ত হাসান ইবনে আমর ইবনে উমাইয়া জমরী একদিন তাঁহাকে (আবূ হুরায়ারাকে) একটি হাদীস মুখস্থ শোনান এবং বলেন, ‘ইহা আপনার নিকট হইতে শুনিয়াছে’। তখন আবূ হুরায়রা (রা) বলিলেনঃ আমার নিকচ হইতে শুনিয়া থাকিলে উহা নিশ্চয়ই আমার নিকট লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। অতঃপর তিনি হাসানের হাত ধরিয়া নিজের ঘরে লইয়া গেলেন এবং তাঁহা লিখিত হাদীসসমূহের এক বিরাট স্তুপ দেখাইয়া বলিলেনঃ তোমার বর্ণিত হাদীসটি ইহাতে লিখিত রহিয়াছে।

হাসান বলেনঃ

******************************************************

তিনি (আবূ হুরায়রা) আমাকে বিপুল সংখ্যক কিতাব দেখাইলেন, উহাতে রাসূলের হাদীস লিখিত ছিল।[ফতহুল বারী গ্রন্হের ১ম খণ্ডের ১৮৪ পৃষ্ঠায় লিখিত রহিয়াছেঃ হযরত আবূ হুরায়রা কর্তৃক সংগ্রহীত হাদীস বিপুল পৃষ্ঠায় ছড়াইয়াছিল, ইবনে ওহাব ইহা দেখিয়াছিলেন।]

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে প্রায় আটশত কিংবা ততোধিক সাহাবী ও তাবেয়ী হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। [****************] ‘মুসনাদে আবী হুরায়রা’ নামক গ্রন্হখানি সাহাবীদের যুগেই সংকলিত হয়।[*********************]

হযরত আনাস (রা)- ও হাদীস লিখিয়া রাখিতেন। তিনি দশ বৎসর বয়সকালেই লিখিতে ও পড়িতে সক্ষম হইয়াছিলেন। তাঁহার পিতা তাঁহাকে রাসূলের খেদমতের জন্য পেশ করিয়া বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

হে রাসূল! এই আমার পুত্র, লিখিতে-জানা বালক।[****************]

তিনি রাসূলের খেদমতে ক্রমাগত দশ বৎসর কাল অতিবাহিত করেন। রাসূলের নিকট তিনি যাহা কিছু শুনিতেন, তাহা যে তিনি লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিবেন, তাহা আর বিচিত্র কি! সায়ীদ ইবন হেলাল বলেনঃ

******************************************************

আমরা আনাস ইবনে মালিক (রা)-কে হাদীস বর্ণনা করার জন্য শক্ত করিয়া ধরিলে তিনি একটি চোঙ বাহির করিয়া আনিতেন এবং বলিতেনঃ ইহা সেইসব হাদীস, যাহা আমি নবী করীম (স)- এর নিকট শুনিয়াছি এবং লিখিয়া লওয়ার পর ইহা তাঁহাকেই পড়িয়া শোনইয়াছি।[মুস্তাদরাক-হাকেম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৩।]

ইহা হইতে জানা গেল যে, হযরত আনাস (রা) রীতিমত হাদীস লিখিয়া রাখিতেন। শুধু নিজে নিজে লিখিয়াই স্তুপ করিতেন না বরং উহা রাসূলকে পড়িয়া শোনাইতেন এবং ভূল-ক্রটি সংশোধন করিয়া লইতেন।[***********]

তিনি তাঁহার পুত্রদেরও হাদীস লিখিয়া রাখিতে আদেশ করিতেন। বলিতেনঃ

******************************************************

হে পুত্রগণ! এই ইলমে হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া রাখ।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৮।]

তিনি যখন বাহরাইনের শাসনকর্তা নিযুক্ত হইয়া তথায় গিয়াছিলেন, তখন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) তাঁহার নিকট একখানি হাদীস সংকলন প্রেরণ করিয়াছিলেন। উহার শুরুতে লিখিত ছিলঃ

******************************************************

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম- ইহা সাদকার বিধান, রাসূল (স) মুসলমানদের প্রতি ইহা নির্ধারিত করিয়াছেন এবং আল্লাহ তাঁহার রাসূলকে ইহারই আদেশ দান করিয়াছেন।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৫। আবূ দাউদ-১৫৬৭ ন’র হাদীস।]

হযরত আনাসরে বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে এই সংকলনেরও যে বহু হাদীস রহিয়াছে, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই।

হযরত জাবির (রা)- ও হাদীসের একটি সংকলন সংগ্রহ করিয়াছিলেন।[*************]

হাসান বসরী  ও কাতাদাহ প্রমুখ তাবেয়ী যুগের মুহাদ্দিসগণ এই সংকলন হইতেই হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনা করিতেন। এতদ্ব্যতীত সুলায়মান ইবনূল কায়স আবূ যুবায়র, আবূ সুফিয়ান ও শা’বী প্রমুখ তাবেয়ী্ও হযরত জাবিরের এই সংকলন হইতেই হাদীস বয়ান করিতেন। আবূ সুফিয়ান হযরত জাবির হইতে যত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা সবই এই সহীফা হইতে গৃহীত।[**************]

হযরত জাবিরের এই হাদীস সংকলনের কথা প্রায় সকল মুহাদ্দিসই উল্লেখ করিয়াছেন। হাফেয যাহবী কাতাদাহ ইবিনে দুয়ামাতা সম্পর্কে ইমাম আহমদ হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ

******************************************************

কাতাদাহ বসরাবাসীদের মধ্যে অধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যাহাই শুনিতেন, তাহাই মুখস্থ করিয়া ফেলিতেন। একবার তাঁহার সম্মুখে হযরত জাবিরের হাদীস-সংকলন পাঠ করা হয় এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তাহা সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লন।[**************]

কাতাদাহ নিজেই বলিতেনঃ

******************************************************

আমি সূরা বাকারা অপেক্ষা জাবিরের সহীফা অধিক মুখস্থ করিয়াছিলাম।[***************]

ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, হযরত জাবির (রা) হাদীসের এক সংকলন তৈয়ার করিয়াছিলেন এবং তাহাতে তাঁহার পরবর্তীকাল পর্যন্ত হাদীস শিক্ষার্থীগণ কর্তৃক রীতিমত পঠিত এবং তাহা হইতেই হাদীস বর্ণিত হইত।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-ও হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতেন। ফলে তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীসের এক সংকলন তৈয়ার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তাঁহার ইন্তেকালের পর এই সংকলন তাঁহার পুত্রদের নিকট সংরক্ষিত ছিল। তাঁহার পুত্র আবদুর রহমান একখানি হস্তলিখিত হাদীস সংকলন দেখাইয়া বলিতেনঃ ‘আল্লাহর শপথ, ইহা আব্বাজানের হস্তলিখিত হাদীস সংকলন।[*************]

হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা)-ও হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। তাঁহার ইন্তেকালের পর এই হাদীস সংগ্রহখানি মীরাসী সূত্রে লাভ করেন তাঁহার পুত্র সালমান ইবনে সামুরা। ঐতিহাসিক ইবনে সিরীন বলেনঃ ‘সামুরার সংকলিত হাদীস গ্রন্হে বহুমূল্য ইলম সন্নিবেশিত রহিয়াছে।[****************]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) যে সব হাদীস শুনিতে পাইয়াছিলেন, তাহা সবই গ্রন্হকারে সংকলিত করিয়াছিলেন। তায়েফের কিছু লোক তাঁহার নিকট শুনিয়া শুনিয়া এই পূর্ণ গ্রন্হখানি নকল করিয়া লইয়া গিয়াছিল।[****************] তিনি চিঠিপত্র লিখিয়াও হাদীস প্রচার করিতেন।[আবু দাউদ, কিতাবুল আকযীয়া] তাঁহার ইন্তেকালের পর তাঁহার পুত্র আলী ইবনে আদুল্লাহ বহু সংখ্যক হাদীস সংকলন উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন।[***************] বর্ণিত হইয়াছেঃ

******************************************************

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এক উট বোঝাই হাদীসগ্রন্হ রাখিয়া গিয়াছিলেন।[*************]

হযরত ইবনে আব্বাসের হাদীস লেখা সম্পর্কে নিম্নোক্ত বর্ণনা উল্লেখযোগ্য। আলকাতানী ‘তবাকাতে ইবনে সায়াদে’র সূত্রে আবূ রাফে’র স্ত্রী সালমা’র এই কথাটির উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি ইবনে আব্বাসকে কিছু লেখার তখতি লইয়া তাহার উপর আবূ রাফে হইতে রাসূলের কাজকর্ম সম্পর্কে কোন কথা লিখিতে দেখিয়াছি।[*********************]

আল-কাতানী ইহাও লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবনে আব্বাস আবূ রাফে’র নিকট আসিতেন। বলিতেনঃ রাসূলে করীম (স) অমুক দিন কি করিয়াছেন? ............. ইবনে আব্বাস সঙ্গে এমন একজন লোক লইয়া আসিতেন, আবূ রাফে যাহা বলিতেন সে লিখিয়া লইত।[****************]

হযরত ইবনে আব্বাসের লিখিত হাদীস সম্পদ যে কত বিরাট ছিল, তাহা নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি হইতে অনুমান করা যায়। ইমাম মূসা ইবনে আকাবা বলেনঃ

******************************************************

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের গোলাম কারীব আমাদের সম্মখে তাঁহার (ইবনে আব্বাসের ) লিখিত হাদীস গ্রন্হসমূহের এক উষ্ট্রবোঝাই সম্পদ পেশ করে।[***************]

হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রা) হযরত মুয়াবিয়র (রা)-কে তাঁহার অনুরোধক্রমে বহুসংখ্যক হাদীস লিখাইয়া দিয়াছিলেন।[সহীহ বুখারী শরীফ,*********] ইমাম বুখারী (র) এই সম্পর্কে নিম্নোক্ত বর্ণনার উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

মুগীরা ইবনে শু’বার লেখক অররাদ বলেনঃ মুগীরা ইবন শু’বা মুয়াবিয়া (রা)-র প্রতি লিখিত  এক কিতাবে (পত্রে) আমার দ্বারা (অনেক হাদীস) লিখিয়াছিলেন।[সহীহ বুখারী শরীফ, ***********]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স (রা) নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর অপর একখানি হাদীস সমষ্টি তৈয়ার করেন। ঐতিহাসিকদের এক বর্ণনায় জানা যায়, স্বয়ং নবী করীম (স)-ই তাহা করার জন্য তাঁহাকে নির্দেশ দিয়াছিলেন।[******************] উহার নাম ছিল ‘সহীফায়ে ইয়ারমুক।[******************]

হযরত সায়াদ ইবনে উবাদা আনসারীও হাদীসের একখানি সহীফা সংকলন করিয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র এই ‘সহীফা’ হইতেই হাদীস বর্ণনা করিতেন।[***************] ইমাম বুখারী বলেনঃ

******************************************************

এই সহীফাখনি আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফার সহীফারই এক খণ্ড ছিল।[********************] তিনি নিজের হাতেই হাদীস লিখিতেন।

মোট কথা নবী করীম (স)-এর অনুমোদন, অনুমতি ও উৎসাহদানের ফলে সাহাবায়ে কিরাম ইসলামরে এই মহামূল্য সম্পদ-ইলমে হাদীস-সংরক্ষণ, লিখন ও সংকলনের জন্য সর্বাত্মকভাবে তৎপর হইয়াছিলেন। তদানীন্তন সমাজে ইলমে হাদীসের চর্চা একমাত্র পরকালীন সওয়ার লাভের উপায় হিসাবে করা হইত না, সামাজিক মর্যদা লাভ, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, অন্তর্নিহিত প্রতিভার বিকাশ সাধনের উদ্দেশ্যেও তখন ইহা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়রূপে গণ্য ছিল। এই কারণে নবী করীম (স)-এর অসংখ্য অপরিমেয় বাণী তাঁহার তৈরী করা সর্বাদিক বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য সত্যবাদী ও আল্লাহ ভীরু সাহাবাদের দ্বারা চিরদিনের জন্য সংরক্ষিত হয়।

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আ’স বলেন, আমি অল্প বয়সে সাহবাদের জিজ্ঞাসা করিয়াছিলামঃ

******************************************************

আপানারা রাসূলের হাদীস কেমন করিয়া বর্ণনা করেন? আপনারাতো শুনিয়াছেন, যাহা তিনি বলিয়াছেন। অথচ আপনারা রাসূলের হাদীসেই নিমগ্ন ছিলেন?

এই কথা শুনিয়া তাঁহারা হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেনঃ ‘হে আমাদের ভাই-পুত্র, আমার তাঁহার নিকট হইতে যাহাই শুনিতাম, তাহা আমাদের নিকট কিতাবে লিখিত রহিয়াছে।[তিবরানী, কবীর-এবং *********************]

এই ঘটনা হইতে প্রমাণিত হয় যে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর যখন অল্প বয়সের ছিলেন, তখনো সাহাবায়ে কিরাম হাদীস লিখিতেন। ইহা ইসলামী মদীনার প্রাথমিক যুগের কথা।

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) মাহমুদ ইবনে রবী’র নিকট হযরত উৎবান ইবনে মালিক বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীস শ্রবণ করেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ

******************************************************

হাদীসটি আমার খুবই মনঃপুত হয়।

তখন তিনি তাঁহার পুত্রকে বলিলেনঃ **********- ‘ইহা লিখিয়া লও’। তখন ইহা লিখিত হয়।[***************]

 

হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের শ্রেণীবিভাগ

[সংখ্যাভিত্তিক]

নবী করীম (স)- এর নিকট হইতে যাঁহারা সরাসরিভাবে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন এবং তাঁহার তরফ হইতে কিছু না কিছু হাদীসও বর্ণনা করিয়াছেন, তাঁহাদের সংখ্যা কিছুমাত্র কম নহে। এ সম্পর্কে হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবন চরিত-বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিস ইমাম আলী ইবনে আবু জুরয়া এক প্রশ্নের জওয়াবে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পূর্বে যাঁহারা তাঁহাকে নিজেদের চক্ষে দেখিতে পাইয়াছেন এবং তাঁহার বানী নিজেদের কর্ণে শ্রবণ করিয়াছেন, তাঁহাদের সংখ্যা স্ত্রী-পুরুষ মিলাইয়া লক্ষাধিক হইবে। তাঁহারা প্রত্যেকেই সরাসরি হযরতের নিকট হাদীস শুনিয়া কিংবা অপরের নিকট বর্ণনা পাইয়া হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাদীস বিজ্ঞানবিদ মিসরস্থ জামে আযহারের শিক্ষক মুহাম্মদ আবূ জাহু লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) প্রায় এক লক্ষ্য চৌদ্দ হাজার সাহাবী রাখিয়া দুনিয়া ত্যাগ করে। তাঁহারা নবী করীম (স)-এর নিকট হাদীস শুনিয়া পাইয়া তাহা বর্ণনা করিয়াছেন। বলা হয়, তাঁহারা কোথায় থাকিতেন এবং কোথায় কেমন করিয়া তাঁহারা হাদীস শুনিতে পাইলেন? উহার জওয়াব এই যে তাঁহারা ছিলেন মক্কা ও মদীনার অধিবাসী, এই শহরদ্বয়ের মধ্যবর্তী এলকার লোক, সাধারণ আরব জনগণ আর যাঁহারা তাঁহার সহিত বিদায় হজ্জে উপস্থিত হইয়াছিলেন তাঁহারা। তাঁহারা সকলেই রাসূলে করীম (স)-কে নিজেদের চক্ষে দেখিতে পাইয়াছেন এবং তাঁহার জীবদ্দশায়ই তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শুনিতে পাইয়াছেন।[*************]

মুহাদ্দিস আবূ জুরয়া প্রদত্ত এক বিবরণ অনুযায়ী সাহাবীদের [এবং নবী করীম (স)- হইতে কিছু না কিছু বর্ণনা করিয়াছেন, এমন লোকদের] সংখ্যা যদিও লক্ষাধিক ছিল কিন্তু যেসব সাহাব রীতিমত ও গণনাযোগ্য সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, আল্লামা যাহবীর মতে তাঁহাদের সংখ্যা ছিল মাত্র এক শত পাঁচজন।[************] অবশ্য অনুসন্ধান করিলে এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাইতে পারে। মুসনাদে আবূ দাউদ তায়ালিসী দ্বিতীয় হিজরী শতকের শেষ ভাগে সংকলিত একখানি হাদিস গ্রন্হ, ইহাতেই প্রায় আড়াই শত সাহাবী হইতে বর্ণিত হইয়াছে।[****************] ‘উসুদল গাবাহ’ গ্রন্হে হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের সংখ্যা ৭৫৫৪ উল্লেখ করা হইয়াছে। তাঁহারা সকলেই রাসূলের নিকট হইতে সরাসরি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন বলিয়া এই গ্রন্হে দাবি করা হইয়াছে। কিন্তু আল্লামা ইবনে হাজার ইহাতে আপত্তি জানাইয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, সাহাবী নয়-এমন লোকেই ইহাকে গণ্য করা হইয়াছে।[****************]

আল্লামা যাহবীর মতে এই একশত পাঁচজন সাহাবীর মধ্যে আটাশজন সাহাবী হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতে এই আটাশজন সাহাবীই হইতেছেন সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী। সত্য কথা বলিতে কি, বিরাট হাদীস সম্পদের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ এই আটাশজন সাহাবী হইতে বর্ণিত হইয়াছে। মুহাদ্দিসদের সিদ্ধান্ত এই যে, যাঁহারা চল্লিশটির কম হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তাঁহারা হইতেছেন, ‘কম হাদীস বর্ণনাকারী’। এই ভিত্তিতে অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী ও কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে সাহাবাদের চারটি ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ

ক) প্রথম ভাগের সাহাবীঃ যাঁহারা এক হাজার কিংবা ততোধিক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

খ) দ্বিতীয় ভাগের সাহাবীঃ যাঁহাদের নিকট হইতে পাঁচশত কিংবা তদুর্ধ্ব সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইয়াছে।

গ) তৃতীয় ভাগের সাহাবীঃ যাঁহাদের হাদীসের সংখ্যা চল্লিশ কিংবা চল্লিশের অধিক।

ঘ) চতুর্থ ভাগের সাহাবীঃ যাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা চল্লিশের ক।[***************]

কিন্তু ঊর্ধ্ব পাঁচশত হইতে নিম্ন সংখ্যা চল্লিশ পর্যন্ত হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের সংখ্যা সমধিক। সেই কারণে তাহাদিগকে আমরা আবার দুই পর্যায়ে বিভক্ত করিতে পারি। একশত হইতে পাঁচশত পর্যন্ত হাদীস বর্ণনাকারী প্রথম পর্যায়ের এবং চল্লিশ হইতে একশত হাদীস পর্যন্ত বর্ণনাকারীরা দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

এই ল্ডসীর অনুযায়ী হাদীস বর্ণনাকারী সমস্ত সাহাবীকে মোট পাঁচটি শ্রেণতে বিভক্ত করা চলেঃ

১। যাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা হাজার কিংবা হাজারের অধিক।

২। যাঁহাদের বর্ণিত হাদীস পাঁচশত কিংবা পাঁচশতের অধিক, কিন্তু হাজার হইতে কম।

৩। যাঁহাদের বর্ণিত হাদীস একশত কিংবা একশতের অধিক, কিন্তু পাঁচশতের কম।

৪। যাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা চল্লিশ কিংবা চল্লিশ কিংবা চল্লিশের বেশী কিন্তু একশতের কম।

৫। যাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা চল্লিশ কিংবা চল্লিশের কম।

প্রথম ভাগ

অধিক সংখ্যক হাদীস বিজ্ঞানীর মতে প্রথম শ্রেণতে মাত্র ছয়জন সাহাবী গণ্য হইতে পারেন। তাঁহারা হইতেছেনঃ (১) হযরত আবূ হুরায়রা (রা) (২) হযরত আয়েশা (রা), (৩) হযরত আবদুল্লহ ইবন আব্বাস (রা), (৪) হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা), (৫) হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) এবং (৬) হযরত আনাস ইবন মালিক (রা)। তাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সহস্রাধিক। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (র) এই পর্যায়ে মোট আটজন সাহাবীকে গণ্য করিয়াছেন। তিনি ইহাদের সঙ্গে শামিল করিয়াছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আ’স (রা) ও হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা)-কে।[**************]

শাহ দেহলভীর এই মত হাদীস বিজ্ঞানের প্রথম শ্রেণীর মনীষীদের মতের বিপরীত। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রা)- ও প্রথমোক্ত ছয়জন সাহাবীকেই সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী বলিয়া উল্লেক করিয়াছেন।[************]

বস্তুত মুহাদ্দিসরা সাধারণত হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা)-কে এই পর্যায়ে গণ্য করেন নাই’ যদিও তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সহস্রাধিক।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি এক হাজার একশত সত্তরটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম- উভয় কিতাবে ৪৬ টি এবং স্বতন্ত্রভাবে বুখারী শরীফে ১৬ টি ও মুসলিমে অপর ৫২ টি হাদীস উল্লিখিত হইয়াছে।[**********]

শাহ ওয়ালীউল্লাহ (র) হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আ’স (রা)-কে কেন এই পর্যায়ভুক্ত করিতে চাহেন, তাহা বুঝা গেল না। কেননা নির্ভরযোগ্য হিসাব মুতাবিক তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মাত্র সাতশত।[**********] এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যাইতে পারে যে, সহস্র কিংবা সহস্রাধিক হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা মাত্র সাতজন এবং তাঁহাদের বর্ণিত মোট হাদীসের সংখ্যা চৌদ্দ হাজার আটশত সত্তরটি।[***********]

এই ছয়-জন সাহাবী সম্পকের্ক এখানে খানিকটা বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা আবশ্যক বোধ হইতেছে। কেননা হাদীস সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস ও স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টির জন্য এই আলোচনা অপরিহার্য।

হযরত আবূ হুরায়রা (রা)

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) সপ্তম হিজরী সনের মুহররম মাসে খায়বার যুদ্ধের সময় ইসলাম কবুল করেন এবং স্থানীয়ভাবে নবী করীম (স)-এর সঙ্গে ধারণা করেন। সেই সময় হইতেই নবী করীম (স)- এর ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি কখনো রাসূলের দরবার ও সঙ্গ ত্যাগ করিয়া যান নাই।[***********] ইহার মূলে তাঁহার উদ্দেশ্যে ছিল ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তারিত জ্ঞানার্জন।

ইবনে আবদুল বার লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ হুরায়রা খায়বরের যুদ্ধের বছর ইসলাম কবুল করেন। তিনি রাসূলে করীম (স)- এর সঙ্গেই এই যুদ্ধে শরীক হন। অতঃপর তিনি রাসূলের সঙ্গ ধারণ করেন। সব সময়ই তাঁহার সঙ্গে থাকিতেন। তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল ইলম হাসিল করা। ইহাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকিতেন ও তাঁহার ক্ষুধা নিবৃত্ত হইত। তাহার হাতে রাসূলের হাত বাঁধা থাকিত। তিনি যেখানে যাইতেন, আবূ হুরায়রা (রা)-ও সেখানে যাইতেন।[***************]

রাসূলে করীম (স) সাধারণত যেসব কথাবার্তা বলিতেন, অপর লোকের সওয়ালের জওয়াবে তিনি যাহা কিছু ইরশাদ করিতেন, ইসলাম ও কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ে যাহা কিছু শিক্ষাদান করিতেন, কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিতেন, বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ ও বক্তৃতা দিতেন, রাসূলের দরবারে সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকিয়া তাহা সবই তিনি গভীরভাবে শ্রবণ করিতেন ও মুখস্থ করিয়া রাখিতেন। সেই সঙ্গে তিনি নিজেও রাখিতেন। অন্য সাহাবিগণের অনেকেই পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাষাবাদের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকিতেন বলিয়া তাঁহারা খুব বেশী সময় রাসূলের দরবারে অতিবাহিত করিত পারিতেন না। কিন্তু হযরত আবূ হুরায়রার এই ধরনের কোন ব্যস্ততাই ছিল না। এই কারণে অন্যান্যদের তুলনায় তিনি অধিক হাদীস শ্রবণের সুযোগ লাভ করিয়াছেলেন। বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করা তাঁহার পক্ষে বিচিত্র কিছুই নয়। এমতাবস্থায় হযরত আবূ হুরায়রা (রা) নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার মুহাজির ভাইগণ অধিকাংশ সময়ে বাজারে ব্যবসায়ের কাজে ব্যস্ত থাকিতেন, আর আমি রাসূলের সঙ্গে লাগিয়া থাকিতাম। বাহিরে আমার কোন ব্যস্ততাই ছিল না। ফলে তাঁহারা যখন রাসূলের দরবারে অনুপস্থিত থাকিতেন আমি তখন সেখানে হাযিল থাকিতাম। তাঁহারা ভুলিয়া গেলে আমি তাহা স্মরণ রাখিতাম।

অপরদিকে আমার আনসার ভাইগণ তাঁহাদের ধন-সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা লইয়া ব্যস্ত থাকিতেন। কিন্তু আমি ছিলাম সুফফার একজন মিসকীন ও গরীব ব্যক্তি। ফলে তাঁহারা কোন বিষয় ভূলিয়া গেলেও আমি তাহা স্মরণ করিয়া রাখিতাম।[***************]

হযরত আবূ হুরায়রা (রা)- এর বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা ৫৩৪৭ টি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হে উল্লেখ করা হইয়াছে ৩২৫টি হাদীস, আর স্ববন্ত্রভাবে ৭৯ টি হাদীস কেবল বুখারী শরীফে এবং ৯৩টি হাদীস কেবল মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হইয়াছে।[*****************]

ইমাম বুখারী ও বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আটশতেরও অধিক সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[************]

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) অন্য সাহাবীদের অপেক্ষা এত অধিক হাদীস কেমন করিয়া বর্ণনা করিতে পারিলেন, উপরিউক্ত তাঁহার নিজস্ব বিশ্লেষণ হইতে তাহা বিশদভাবেই জানিতে পারা যায়। এতদ্ব্যতীত তাঁহার নিম্নোক্ত বানী হইতেও এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা জন্মে। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এই আয়াত দুইটি যদি আল্লাহ তা’আলা তাঁহার কিতাবে নাযিল না করিতেন, তাহা হইলে আমি কখনই কোন হাদীস বর্ণনা করিতাম না। উহাতে আল্লাহ বলিয়াছেনঃ আমি যেসব সুস্পষ্ট যুক্তিপূর্ণ ও হিদায়অতের কথা  নাযিল করিয়াছে, তাহাকে যাহারা গোপন করিয়া রাখে- তাহাদের উপর আল্লাহর ও অন্যান্য অভিসম্পাতকারীদের অভিশাপ।[মুসলিম শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০২; বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, ২২ পৃষ্ঠা।]

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কমবেশী প্রায় তিন বৎসরকাল ক্রমাগতভাবে রাসূলের সঙ্গে থাকিয়া হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন এবং তাহা স্মরণ করিয়া রাখিয়াছেন। তাহার ফলেই তাঁহার পক্ষে অন্য সাহাবীদের তুলনায় এত অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করা সম্ভব হইয়াছে। বিশেষত তাঁহাকে আল্লাহ তা’আলা এত প্রখর স্মরণশক্তি দান করিয়াছিলেন যে, তিনি যাহা কিছু শুনিতেন, তাহা কখনই ভুলিয়া যাইতেন না। যদিও তাঁহার এই অতুলনীয় স্মৃতিশক্তি রাসূলে করীমের দো’আ ও এক বিশেষ তদবীরের ফলেই অর্জিত হইয়াছিল। [************] তাঁহার সর্বাধিক হাদীস অর্জন ও অতুলনীয় স্মৃতিশক্তির কথা তদানীন্দন সমাজে সর্বজনবিদিত ও স্বকৃত ছিল। নিম্বোদ্ধৃত উক্তিসমূহ হইতে তাহা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়।

হযরত উবায় ইবন কা’ব (রা) বলেনঃ

******************************************************

আবূ হুরায়রা রাসূলের নিকট প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা করার ব্যাপারে বড় সাহসী ছিলেন। তিনি এমন সব বিষয়ে তাঁহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেন, যে বিষয়ে অপর কোন সাহাবী জিজ্ঞাসা করিতেন না।[***********]

আবূ আমের বলেনঃ আমি হযরত তালহার নিকট উপস্থি ছিলাম। এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহাকে বলিলঃ ‘হে  আবূ মুহাম্মদ!’ আবূ হুরায়রা রাসূলের হাদীসের বড় হাফেয, না তোমরা, তাহা আজ পর্যন্ত আমরা বুঝিতে পারিলাম না’। তখন হযরত তালহা (রা) বলিলেনঃ ‘তিনি [আবূ হুরায়রা (রা)] এমন অনেক কথাই জানেন, যাহা আমাদের জ্ঞান বহির্ভূত। ইহার কারণ এই যে, আমরা বিত্ত-সম্পত্তিশালী লোক ছিলাম, আমাদের ঘর-বাড়ি ও স্ত্রী-পরিজন ছিল, আমরা তাহাতেই অধিক সময় মশগুল থাকিতাম। কেবল সকাল ও সন্ধ্যার সময় রাসূল (স)-এর খিদমতে হাযির থাকিয়া নিজের নিজের কাজে চলিয়া যাইতাম। আর আবূ হুরায়রা (রা) মিসকীন ছিলেন, তাঁহার কোন জায়গা-জমি ও পরিবার –পরিজন ছিল না। এই কারণে তিনি রাসূলের হাতে হাত দয়িা তাঁহার সঙ্গে লাগিয়া থাকিতেন। আমাদের সকলেরই বিশ্বাস, তিনি আমাদের সকলের অপেক্ষা অধিক সংখ্যক হাদীস শুনিতে পাইয়াছেন। তিনি রাসূলের নিকট না শুনিয়াই কোন হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, আমাদের কেহই তাঁহার উপর এই দোষারোপ করে নাই।[**************]

হযরত আয়েশা (রা) একবার তাঁহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “কি রকমের হাদীস বর্ণনা করিতেছ? অথচ আমি রাসূল (স)- এর যেসব কাজ দেখিয়াছি ও যেসব কথা শুনিয়াছি, তুমিও তাহাই শুনিয়াছ? ‘ইহার জওয়াবে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিলেনঃ “আম্মা! আপনি তো রাসূল (স)-এর জন্য সজ-সজ্জার কাজেই ব্যস্ত থাকিতেন আর আল্লাহর শপথ, রাসূলের দিক হইতে কোন জিনিসই আমার দৃষ্টিকে অন্যদিকে ফিরাইতে পারিত না”।[******************]

উমাইয়া শাসক মারওয়ানের নিকট হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কোন ব্যাপার অসহ্য হওয়ায় তিনি রাগান্বিত হইয়া একবার বলিয়াছিলেনঃ ‘লোকেরা বলে, আবূ হুরায়রা (রা) বহু হাদীস বর্ণনা করেন; অথচ নবী করীম (স)- এর ইন্তেকালের কায়েকদিন মাত্র পূর্বেই তিনি মদীনায় আসেন।

জওয়াবে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিলেনঃ ‘আমি যখন মদীনায় আসি তখন আমার বয়স ছিল ত্রিশ বৎসরের কিছু বেশী। অতঃপর রাসূল (স)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত আমি তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে রহিয়াছি। তাঁহার সাথে বেগমদের মহল পর্যন্ত যাইতাম তাঁহার খিদমত করিতাম, তাঁহার সঙ্গে লড়াই-জিহাদে শরীক হইতাম, তাঁহার সঙ্গে হজ্জে গমন করিতাম। এই কারণে আমি অপরের তুলনায় অধিক হাদীস জানিতে পারিয়াছি। আল্লাহর শপথ, আমার পূর্বে যেসব লোক রাসূল (স)-এর সাহচর্যে আসিয়াছিলেন, তাঁহারাও রাসূল (স)-এর দরবারে আামার সব সময় উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করিতেন এবং আমার নিকট তাঁহারা হাদীস জিজ্ঞাসা করিতেন। হযরত উমর (রা) হযরত উসমান (রা), হযরত তালহা (রা) ও হযরত যুবায়র (রা) তাঁহাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[************] তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ বলেনঃ

******************************************************

আবূ হুরায়রা  রাসূল (স)-এর নিকট হইতে এতসব হাদীস শুনিয়াছেন তাহা আমরা শুনিতে পরি নাই; ইহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।[*************]

হযরত ইবন উমর (রা) হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-কে লক্ষ্য করিয়া একদিন বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

তুমি আমাদের অপেক্ষা রাসূল (স)-এর সাহচর্যে বেশ লাগিয়া থাকিতে এবং এই কারণে তাঁহার হাদীস তুমি আমাদের অপেক্ষা অধিক জানিতে ও মুখস্থ করিতে পারিয়াছ।[***********]

ইমাম যাহবী লিখিয়াছেন, হযরত উমর ফারুক (রা)- ও হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-কে একদিন এই কথাই বলিয়াছিলেন।[***********]

তাবয়িদের মধ্যে বহুসংখ্যক মনীষী হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর তীক্ষ্ম স্মরণশক্তি সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়াছেন। এখানে কয়েকজনের উক্তি উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ

আবূ সালেহ বলেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স)-এর সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) সর্বাধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ও হাদীসের অতি বড় হাফেয ছিলেন।[*************]

সায়ীদ ইবনে আবুল হাসান বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) অপেক্ষা অধিক হাদীস বর্ণনাকারী আর একজনও ছিলেন না।[*******]

ইমাম বুখারী (রা) হযরত আবূ হুরায়রা (রা) সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার নিকট হইতে প্রায় আটশত মনীষী হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার যুগের হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন হাদীসের সবচেয়ে বড় হাফেয।[****************]

বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আবু হুরায়রা (রা) সাহাবীদের মধ্যে সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী-ইহাতে সকল হাদীসবিজ্ঞানীই একমত।[***************]

ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ হুরায়রা (রা) তাঁহার যুগের সমস্ত হাদীস বর্ণনাকারীর মধ্যে সর্বাধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ও হাদীসের বড় হাফেয।[*************]

মুহাদ্দিস হাকেম বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) রাসূল (স)- এর সাহাবীদের মধ্যে অধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ও হাদীসের অতি বড় হাফেয ছিলেন। তিনি রাসূল (স)-এর সঙ্গে অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশী সময় অবস্থান করিয়াছেন। কেননা তিনি প্রয়োজনের দিক দিয়া পরিতৃপ্ত ছিলেন। তাঁহার হাত রাসূল (স)-এর হাতের মধ্যে থাকিত, রাসূল (স) যখন যেখানে যাইতেন তিনিও তখন সেখানে যাইতেন। রাসূলের ইন্তেকাল পর্যন্তই এই অবস্থা থাকে। আর এই কারণেই অন্যান্যের তুলনায় হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশী হইয়াছে।[***************]

ইমাম আল-হাফিয বাকী ইবন মাখলাদ আন্দালুসী তাঁহার মুসনাদ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ হুরায়রার বর্ণিত পাঁচ হাজার তিন শত চুয়াত্তরটি হাদীস রহিয়াছে। সাহাবাদের মধ্যে অন্য কেহই এই পরিমাণ কিংবা ইহার কাছাকাছি পরিমাণ হাদীসও বর্ণনা করেন নাই।[********************]

মোটকথা তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অধিক হওয়ার চারটি প্রধান কারণ রহিয়াছে। কারণ চারটি এইঃ

১। ইসলাম কবুল করার পর সব সময়ের জন্য রাসূল (স)-এর সঙ্গ ধারণ।

২। হাদীস শিক্ষা ও উহা মুখস্থ করিয়া রাখার জন্য আকুল আগ্রহ এবং শ্রুত কোন কথাই ভুলিয়া না যাওয়া।

৩। বড় বড় সাহাবীর সাহচর্য ও তাঁহাদের নিকট হাদীস শিক্ষার সুযোগ লাভ ইহাতে তাঁহার হাদীস জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করে ও পূর্বাপর সর্বকালের হাদীসই তিনি সংগ্রহ করিতে সমর্থ হন।

৪। নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর দীর্ঘ দিন পর্যন্ত বাঁচিয়া  থাকা, প্রায় ৭৪ বৎসর পর্যন্ত হাদীস প্রচারের সুযোগ লাভ এবং কোন প্রকার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদের ব্যস্ততা কবুল না করা।

এই সব কারণে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হাদীসের বড় হাফেয ও সাহাবীদের মধ্য অধিক হাদীসজ্ঞ এবং অধিক হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন। সাহাবিগণ বিচ্ছিন্নভাবে যাহা বর্ণনা করিতেন, সেই সব হাদীস হযরত আবূ হুরায়রার নিকট একত্রে পাওয়া যাইত। ফলে সকলেই তাঁহার নিকট জিজ্ঞাসা করিতেন ও তাহার উপর নির্ভর করিতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ হুরায়রা (রা) মুসলমানদের জন্য রাসূল (স)-এর হাদীস হিফয করিয়া রাখিতেন।[***************]

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) যে হাদীসের অতি বড় আলিম ছিলেন, তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা যে অন্যান্যের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই বেশী হইবে এবং তাঁহার বর্ণিত হাদীস যে সর্বতোভাবে বিশ্বাষ্য ও নির্ভরযোগ্য, তাহা পূর্বোক্ত দীর্ঘ আলোচনা হইতে অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হইতেছে। এতদসত্ত্বেও যাহারা হযরত আবূ হুরায়রার অধিক হাদীস বর্ণনার প্রতি কটাক্ষ করিয়াছেন, তাহাদের ধৃষ্টতা দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইতে হয়।

হযরত আয়েশা (রা)

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) বিশ্বনবনী জীবন সংঙ্গিনী হিসাবে একাধারে দীর্ঘ নয়টি বৎসর অতিবাহিত করেন। আর রাসূল জীবনের এই বৎসর কয়টিই সর্বাধিক কর্মবহুল ও ইসলামী জীবন ব্যস্থার পূর্ণ প্রতিষ্ঠার সময়। হযরত আয়েশার আঠারো বৎসর বয়সকালে নবী করীম (স)-এর ইন্তেকাল হয়। অতঃপর প্রায় ঊনচল্লিশ বৎসর তিনি জীবিত থাকেন। এই কারণে একদিকে তিনি যেমন নবী করীম (স)-এর নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিলেন, অপরদিকে ঠিক তেমনি পারিয়াছিলেন উহার সুষ্ঠু প্রচার করিতে। নবী করীম (স)-এর বহু সংখ্যক সাহাবী এবং তৎপরবর্তী কালের বহু সংখ্যক তাবেয়ী তাহার নিকট হাদীস শ্রবণ করিতে পারিয়াছেন, পারিয়াছেন তাহার মুসনাদসূত্রে উহার বর্ণনা করিতে।[********]

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আয়েশা (রা) একজন বড় ফিকাহবিদ সাহাবী ছিলেন এবং রাসূল (স)-এর নিকট হইতে যে ছয়জন সাহাবী সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি তাঁহাদের একজন। তাঁহার সনদে দুই হাজার দুইশত দশটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হদ্বয়ে সমানভাবে একশত চুয়াত্তরটি হাদীস উল্লেখ করা হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত আলাদাভাবে চুয়ান্নটি হাদীস বুখালী শরীফে এবং অপর আটান্নটি মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে।[**********]

হযরত আনাস (রা)

পূর্বেই বলা হইয়াছে, হযরত আনাস (রা) দীর্ঘ দশ বৎসর কাল পর্যন্ত নবী করীম (স)-এর খিদমতে নিযুক্ত ছিলেন।[ঐ] রাসূলে করীম (স)-এর সান্নিধ্যে থাকিয়া তাঁহার অনেক কথা শুনিবার এবং অনেক কাজ লক্ষ্য করিয়া দেখিবার তিনি সুযোগ পাইয়াছিলেন। হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে যে কয়জন সাহাবী বিশেষ নীতি অবলম্বন করিতেন, তিনি তাহাদের অন্যতম। তিনি ইলমে হাদীসের বিশেষ খিদমত আঞ্জাম দিয়াছেন। বলিতে গেলে সমগ্র জীবনই তিনি হাদীস প্রচারের কাজে নিয়োজিত রহিয়াছেন । রাসূল (স)-এর ইন্তেকালের পর অন্যান্য সাহাবা যখন যুদ্ধ ও সংঘাতে নিমজ্জিত ঠিক সেই সময়ও তিনি হাদীস প্রচারে অক্লান্তভাবে মশগুল ছিলেন। শেষ জীবনে বসরার জামে মসজিদই ছিল তাঁহার হাদীস প্রচারের কেন্দ্র।

তাঁহারদ হাদীস প্রচারের মজলিসে মক্কা, মদীনা, বসরা, কুফা ও সিরিয়ার হাদীস শিক্ষাভিলাষী ছাত্রগণ আকুল আগ্রহ লইয়া শরীক হইতেন।

তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা কয়েক সহস্র। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীর কথায়ঃ

******************************************************

তিনি নবী করীম (স) হইতে দুই হাজার দুইশত ছিয়াশিটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]

তন্ম্যে বুখারী শরীফে ৮৩টি মুসলিম শরীফে অপর ৯১টি হাদীস উল্লেখ করা হইয়াছে। আর ১৬৮ টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হেই উদ্ধৃত হইয়াছে। বসরা নগরে ইন্তেকালকারী সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষ। তিনি প্রায় এক শতাব্দীকাল বাঁচিয়াছিলেন।[*****************]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) রাসূল (স)-এর দরবারে খুবই ছোট বয়সেই সাহাবী ছিলেন। এই অল্প বয়স্কতার কারণে তিনি বদর যুদ্ধে যোগদান করিবার সুযোগ ইইতে বঞ্চিত হইয়াছিলেন।[*************] কিন্তু উহার পরবর্তী সকল ব্যাপারেই তিনি প্রত্যক্ষভাবে শরীক হইয়াছেন। ফলে তিনি নবী করীম (স)-এর সঙ্গে থাকার এবং তাঁহার হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের মধ্যে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদার অধিকারী। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা ১৬৩০। তন্মধ্যে ‌১৭৩টি বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হেই উদ্ধৃত। এতদ্ব্যতীত বুখারী শরীফে ৮১টি ও মুসলিম শরীফে ৩‌১ হাদীস উল্লেখ করা হইয়াছে।[****************] আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ হুরায়রার পরে সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী।[*****************]

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা)

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসের খালা ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত মায়মুনা (রা)। হযরত আবদুল্লাহ সাধারণত খালা আম্মার ঘরেই অবস্থান করিতেন। করিতেন এই কারণে যে, তিনি নবী করীম (স)-এর রাত্রিকালীন ইবাদত-বান্দেগী নিজ চক্ষে দেখিবার জন্য বিশেষ আগ্রহান্বিত ছিলেন।[**********] নবী করীম (স) তাঁহার জন্য দোয়া করিয়াছিলেন এই বলিয়াঃ

******************************************************

হে আল্লাম তুমি ইবন আব্বাসকে দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ সমঝদার বানাও এবং তাহাকে সে ব্যাপারের নিগূঢ় তত্ত্ব জানাইয়া দাও।[************]

ইহার ফলে তিনি যে বিপূল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইবেন, তাহা আর বিচিত্র কি! আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবন আব্বাস (রা) নবী করীম (স) হইতে এক হাজার ছয়শত ষাটটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে ৯৫ টি বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হে্ উল্লিখিত হইয়াছে। আর কেবলমাত্র বুখারীতে একশত কুড়িটি এবং কেবল মুসলিমে ৪৯ টি হাদীস রহিয়াছে।[*******] সাহাবী তাবেয়ীনের মধ্যে। বিপুল সংখ্যক লোক তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। সকলে তাঁহাকে হাদীসের বিশেষ পারদর্শী বলিয়া জানিতেন।[**************]

হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা)

হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) ইলমে হাদীসে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। হাদীসের জন্য তিনি আজীবন সাধনা করিয়াছেন। হাদীস শিক্ষা, চর্চা ও প্রচারই ছিল তাঁহার জীবনের লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি বহু দূরবর্তী অঞ্চলের দুর্গমতম পথে বহু বৎসর পর্যন্ত সফর করিয়াছেন। তাঁহার সম্পর্কে মিশকাত-গ্রন্হ সংকলনক বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি প্রখ্যাত সাহাবীদের অন্যতম। যে কয়জন সাহাবী বেশী সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি তাঁহাদের একজন।[****************]

তিনি সরাসরি নবী করীম (স) হইতে যেমন হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তেমনি করিয়াছেন সাহাবাদের মধ্যমে। ওহুদের যুদ্ধে হযরত আবদুল্লাহ শহীদ হইলে হযরত জাবির রাসূল (স)-এর স্থায়ী সঙ্গ অবলম্বন করেন। তিনি দীর্ঘদিন জীবিত থাকেন। মুসলিম জাহানের বড় বড় শহর নগর সফর ব্যাপদেশে তিনি হাদীস বর্ণনাকারী বহু সাহাবীর সহিত সাক্ষাত লাভের সুযোগ পান । মসজিদে নববীতে তিনি দীর্ঘদিন হাদীস শিক্ষাদানের জন্য একটি ‘হলকা’ (চক্র) গঠন করেন। রাসূল (স)-এর পর তিনি ৬৪ বৎসর বাঁচিয়া থাকেন। এই দীর্ঘ জীবন তিনি হাদীস প্রচারেই অতিবাহিত করেন। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে ‌১৫৪০। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম ষাটটি হাদীস মিলিতভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। বুখারী আলাদাভাবে ২৬ টি এবং মুসলিম স্বতন্ত্রভাবে অপর ২৬ টি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন।[*******************]

দ্বিতীয় ভাগ

দ্বিতীয় ভাগে গণ্য পাঁচশত কিংবা পাঁচশতের অধিক হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে যে সাহাবীদের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে, তাঁহারা হইতেছে মাত্র চার জন্য। তাঁহাদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া গেল

১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা):তিনি মক্কা শরীফে ইসলামী দাওয়তের প্রথম সময়েই ইসলাম কবুল করেন এবং রাসূল (স)-এর সঙ্গে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই যোগদান করেন। তিনি রাসূল (স)-এর জুতারক্ষক ছিলেন। রাসূল (স) কে তিনি কাপড় পরাইয়া দিতেন।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূল (স) হইতে তিনি ৮৪৮টি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিমের উভয় কিতাবে ৬৪ টি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত অপর ২১ টি বুখারী শরীফৈ এবং আরো ৩৫টি মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে।[******************]

২. হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (রা):আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি অত্যন্ত বড় আলিম ও ইবাদতের কাজে বড় পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি হযরত আবূ হুরায়রা (রা) অপেক্ষা অধিক হাদীসের ধারক ছিলেন। কেননা তিনি হাদীস লিখিয়া লইতেন আর হযরত আবূ হুরায়রা (রা) (প্রথমে) লিখিতেন না। এতদসত্ত্বেও তাহার সনদে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা হযরত আবূ হুরায়রার সনদে বর্ণিত হাদীস অপেক্ষা অনেক কম।[****************]

তিনি হাদীস লিখিয়া রাখিতেন। মুজাহিদ বলেনঃ আবদুল্লাহর নিকট একখানি হাদীস সংকলন দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিরাম ইহা কি? তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

ইহার নাম সাদেকা। রাসূল (স)-এর নিকট হইতে আমার শ্রুত হাদীসসমূহ ইহাতে লিখিত আছে। এই হাদীস শ্রবণে আমার ও রাসূল (স)-এর মাঝখানে অন্য কোন ব্যক্তি নাই।[***************]

৩. হযরত আলী (রা):খুলাফায়ে রাশেদীনের চতুর্থ খলীফা। পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ও স সময়ে রাসূলের সহচর হিসাবে অবস্থানকারী। রাসূলে করীম (স)-এর চাচাতো ভাই এবং জামাতা। বনি হাশিম বংশের প্রথম খলীফা ও তিনি।[*****************]

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার সনদে রাসূল (স) হইতে মোট ৫৮৬টি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে বুখারী-মুসলিম উভয়ই নিজ নিজ গ্রন্হে বিশটি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত বুখারী ৯টি এবং মুসলিম অপর পনেরোটি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন।[************]

৪. হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা):  খুলাফায়ে রাশেদীনের দ্বিতীয় খলীফা। নবুয়্যাতের ষষ্ঠ বৎসরেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাহার ইসলাম গ্রহণের ফলে মক্কা শরীফে ইসলাম প্রবল শক্তি লাভ করে। ইসলামের জন্য তিনি সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেন।[*************] এক হিসাব মুতাবিক তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে ৫৩৯।[************]

তৃতীয় ভাগ

তৃতীয় পর্যায়ে মোট ২৬  জন সাহাবী গণ্য হইয়া থাকেন। তাঁহাদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে প্রদত্ত হইতেছেঃ

১. উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা (রা):তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৫৭টি । তন্মধ্যে দুইটি বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হেই উল্লিখত আছে। মিশকাত গ্রন্হকার তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাহার নিকট হইতে হযরত ইবন আব্বাস (রা), আয়েশা (রা) এবং তাঁহার নিজের কন্যা যয়নব, তাহার পুত্র উমর ও ইবনুল মুসাইয়্যিব হাদীস রিওয়ায়েত করিয়াছেন।

এতদ্ব্যতীত বহু সংখ্যক সাহাবী এবং তাবেয়ীও তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[******************]

২। হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা): আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার বর্ণিত হাদীস তিনশ ষাটটি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হেই পঞ্চশটি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। এতেদ্ব্যতীত বুখারী শরীফে স্বতন্ত্রভাবে চারটি হাদীস ও মুসলিম শরীফে অপর পনরটি হাদীস উল্লেখ করা হইয়াছে। তাঁহার নিকট হইতে আনাস ইবন মালিক (র) ও তারেক ইবন শিহাব এবং আরো বহু সংখ্যক তাবেয়ী হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি সাহাবাদরে মধ্যে একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরূপে গণ্য হইতেন।[**********]

৩। হযরত বরা ইবন আজেব (রা): বদরদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের নিকট হইতে তাঁহার সনদে তিনশত ও আরো পাঁচটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তান্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম- উভয় কিতাবে ২২টি হাদীস, কেবল বুখারী শরীফে পনেরোটিএবং কেবল মুসলিম শরীফে ছয়টি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।[*****************]

৪। হযরত আবূ যর গিফারী (রা): তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

প্রথম চারজন ইসলাম গ্রহণকারীর মধ্যে আমি চতুর্থ।[ঐ]

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার সনদে রাসূলের নিকট হইতে ২৮১ টি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে বারোটি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হে এবং এককভাবে বুখারী শরীফে ২টি ও মুসলিম  শরীফে ১৭টি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। বহু সংখ্যক সাহাবীও তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[***********] তাবেয়ী ও তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[**********]

হযরত সায়াদ বিন ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা):দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবীর মধ্যে তিনি একজন। ১৪ কি ১৭ বৎসর বয়সে তিনি ইসলাম কবুল করেন। তিনিই সর্বপ্রথম আল্লাহর দ্বীনের জন্য জিহাদে তীর নিক্ষেপ করেন। তাঁহার সম্পর্কে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের নিকট হইতে তাঁহার বর্ণিত মোট হাদীস হইতেছে দু্ইশত সত্তরটি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম উভয়ই পনেরোটি হাদীস উ্ল্লেখ করিয়াছেন। আর আলাদাভাবে বুখারীতে পাঁচটি ও মুসলিম-এ আঠারোটি হাদীস উল্লেখিত হইয়াছে।[***********]

৬। হযরত সহল ইবনে সায়াদ আনসারী (রা): তাঁহার পনেরো বৎসর বয়সের সময় রাসূলে করীম (স) ইন্তেকাল করেন এবং সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সকলের শেষে মদীনায় ইন্তেকাল করেন।[**********] সকল সাহাবীর ইন্তেকালের পর একমাত্র তিনিই জীবিত ছিলেন বলিয়া ইলমে হাদীসের জন্য সকলে তাঁহার দিকেই প্রত্যাবর্তন করিত। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে ১৮৮ টি। তন্মধ্যে ২৮ টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম-উভয় গ্রন্হেই উল্লিখিত হইয়াছে।[*************]

৭। হযরত উবাদা ইবনে সাবিত (রা):মক্কা হইতে ইসলামের আওয়াজ মদীনারর যেসব লোকের কর্ণে প্রবেশ করে ও পরপর তিন বারের হজ্জের সময় অনুষ্ঠিত আকাবার বায়’আতে শরীক হন, তিনি তাঁহাদের একজন।[************]

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের নিকট হইতে তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৮১। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম-উভয় গ্রন্হে ছয়টি হাদীস উল্লেক করা হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত বুখারী অপর দুইটি হাদীস এবং মুসলিম অপর দুইটি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন।[*************]

৮। হযরত আবূদ্দরদা (রা):তিনি একজন বড় সম্মানিত সাহাবী। তাঁহার জ্ঞান, বুদ্ধি, মনীষা ও ইলমে হাদীসের উপর পূর্ণ পারদর্শিতা সুপ্রসিদ্ধ। হযরত আবূযর গিফারী (রা) তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া একদিন বলিলেনঃ

******************************************************

জমিনের উপর ও আসমানের নীচে তোমার অপেক্ষা বড় আলিম এখন আর কেহ নাই হে আবূদ্দরদা।[************]

৯। হযরত আবূ কাতাদাহ আনসারী (রা):তিনি হাদীসবর্ণনার ব্যাপারে অত্যাধিক মাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। রাসূলের প্রতি মিথ্যা কথা আরোপ করা সম্পর্কিত তীব্র বাণী শ্রবণের পরই তিনি এই নীতি অবলম্বন করিতে শুরু করেন।[ঐ, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯২।] এতদসত্ত্বেও তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১০০।

১০। হযরত উবাই ইবন কায়াব (রা):তাঁহার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ইলমে হাদীসের খিদমতে অতিবাহিত হইয়াছে। খতীবুল উমরী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি নবী করীম (স)-এর জন্য ওহী লেখক ছিলেন। রাসূলের যুগে যাঁহারা সম্পূর্ণ কুরআন মজীদ মুখস্থ করেন তিনি তাঁহাদের একজন্য। তাঁহার সূত্রে বহু সংখ্যক লোক হাদীস বর্ণনাকরিয়াছেন।[************]

১১। হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা):দ্বিতীয়বারে অনুষ্ঠিত আকাবার বায়’আতে উপস্থিত সাতজনের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। বদর ও অন্যান্য সকল যুদ্ধেই তিনি শরীক ছিলেন। নবী করীম (স) তাঁহাকে বিচারপতি ও ইসলামের শিক্ষাদাতা হিসাবে ইয়েমেন প্রদেশে প্রেরণ করিয়াছিলেন।[************]

হযরত ইবন মাসউদ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মুয়ায সব কল্যাণের শিক্ষাগুরু এবং আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত ছিলেন।[ঐ ৩৪১ পৃষ্ঠা।]

তাঁহার সম্পর্কে স্বয়ং নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হালাল হারাম সম্পর্কে মুয়ায সকলের অপেক্ষা বেশী জানে।[**************]

তিনি আরো বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কিয়ামতের দিন মুয়ায আলিম সমাজের ইমাম হিসাবে উপস্থিত হইবেন।[***************]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর, ইবনে আব্বাস, ইবনে আবূ আওফা, আনাস ইবনে মালিক, আবূ ইমামাতা, আবূ কাতাদাহ, আবূ সালাবাতা, আবদুর রহমান ইবনে সামুরাতা, জাবির ইবনে সামুরাতা প্রমুখ সাহাবী তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[*********************]

১২। হযরত নুমান ইবনে বশীর (রা): তিনি হিজরতের পরে আনসার বংশের প্রথম সন্তান। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার সনদে একশত চৌদ্দটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে।[************]

১৩। হযরত আবূ বাকরাতা (রা):তিনি তায়েফ বিজয়ের পর রাসূলের সহিত আসিয়া যোগদান করেন। তাঁহার সম্পর্কে বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি সাহাবাদের মধ্যে ইলমের দিক দিয়া অধিক পারদর্শী ছিলেন। ছিলেন সর্বাধিক নেক লোকদের অন্যতম। তিনি সব সময় ইবাদতের কাজে প্রাণপণ চেষ্টা করিতে থাকিতেন।[*************]

আইনী ইহাও লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার সনদে নবী করীম (স) হইতে মোট ১৩৩ টি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে ৮টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম- উভয় গ্রন্হে এবং অপর পাঁচটি বুখারী শরীফে ও অপর একটি মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে।[*******]

১৪। হযরত জরীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা):তিনি রাসূলে করীম (স)-এর ইন্তেকালের বৎসরই ইসলাম কবুল করেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলের ইন্তেকালের চল্লিশ দিন পূর্বে ইসলাম কবুল করিয়াছি।[*********]

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার বর্ণিত হাদীস একশতটি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম উভয়ই আটটি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন এবং বুখারী ও মুসলিম ছয়টি আলাদা হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন। মুসলিম শরীফের শরাহ নববী কিতাবে উল্লেখ করা হইয়াছে, তাঁহার বর্ণিত হাদীস দুইশত। তন্মধ্যে বুখারী এককভাবে উল্লেখ করিয়াছেন মাত্র একটি। কেহ বলিয়াছেন, ছয়টি।[************]

১৫। হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (রা):তিনি একজন অতি সম্মানিত সাহাবী। দ্বিতীয়বারের আকাবার বায়’আতে এবং বদর যুদ্ধে তিনি শরীক হইয়াছিলেন। মদীনায় উপস্থিত হইয়া রাসূলে করীম (স) প্রথমে তাঁহারই ঘরে  অবস্থান করিয়াছিলেন। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা একশত পঞ্চাশটি। তন্মধ্যে সাতটি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হেই উল্লিখিত হইয়াছে। বুখারীতে ইহা ব্যতীত অন্য একটি হাদীসও রহিয়াছে।[**********]

১৬। হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা):তিনি খুলাফায়ে রাশেদীনের তৃতীয় খলীফা, আমীরুল মু’মিনীন। রাসূলের দুই কন্যারই পরপর তাঁহার সঙ্গে বিবাহ হইয়াছিল। বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি রাসূলের নিকট হইতে ১৪৬টি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। বুখারী তন্মধ্যে এগারটি নিজ কিতাবে উল্লেখ করিয়াছেন।[***********]

১৭। হযরত মুগীরা ইবনে শুবা (রা):সাহাবীদের মধ্যে ইলম-এর দিক দিয়া বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। হাদীসের কিতাবসমূহে তাঁহার বর্ণিত ১৩৩টি হাদীসের উল্লেখ রহিয়াছে। এতদ্ব্যতীত আরো একটি হাদীস বুখারী শরীফে  এবং অপর দুইিট মুসলিম শরীফে উল্লেখ করা হইয়াছে।[***********]

১৮। হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা):খতীবুল উমরী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি সাহাবীদের মধ্যে বিশিষ্ট মনীষী এবং ফিকাহবিদদের অন্যতম।[***********]

১৯। হযরত উসামা ইবনে যায়দ (রা):তিনি নবী করীম(স)- এর পালিত পুত্র। ইসলামী জ্ঞানে তিনি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। রাসূলের ইন্তেকালের সময় তাঁহার বয়স ছিল আঠার কিংবা বিশ বৎসর মাত্র। তবুও রাসূলে করীম (স)-এর বিপুল সংখ্যক বানী তাঁহার স্মৃতিশক্তিতে সুরক্ষিত ছিল। তাঁহার আমল ও চরিত্রও ছিল সকলের জন্য আদর্শ এবং অনুসরণীয়।[*************]

তাঁহার দ্বারা বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণিত ও প্রচারিত হইয়াছে। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে ১২৮টি । তন্মধ্যে ১৫টি বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত অপর দুইট হাদীস বুখারী শরীফে এবং অপর দুইটি মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে।[*************]

২০। হযরত সওবান (রা):তিনি রাসূলে করীম (স)-এর ক্রীদাস ও তাঁহার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি সব সময়ই রাসুলে করীম (স)-এর সঙ্গে থাকিতেন। তিনি একদিকে যেমন হাদীস মুখস্থ করিতেন, স্মরণ রাখিতেন, তেমনি হাদীস প্রচারের দায়িত্বও তিনি পূর্ণ মাত্রায় পালন করিতেন।[************]

২১। হযরত বুরায়দা ইবনে হাসীব (রা):সাহাবীদের মধ্যে তিনি বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। রাসূলের বিপূল সংখ্যক হাদীস তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা ১৬৪। তন্মধ্যে একটি মাত্র হাদীস বুখারী ও মুসলিম-উভয় গ্রন্হে উল্লিখিত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত আরো ২টি হাদীস কেবলমাত্র বুখারী শরীফে ও ১১ টি কেবলমাত্র মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হইয়াছে।[**********] তাঁহার বর্ণিত সব কয়টি হাদীসই সরাসরি রাসূলের নিকট হইতে শ্রুত।[***********]

২২। হযরত আবূ মাসউদ আকাবা ইবনে উমর (রা):আকাবার দ্বিতীয় বায়’আতের সময় তিনি ইসলাম কবুল করেন।দ্বীন-ইসলামের একজন উদ্যমশীল প্রচারক ছিলেন তিনি। সব কয়টি যুদ্ধেই তিনি শরীক ইয়াছিলেন। হাদীস প্রচারেও তিনি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। হাদীসের কিতাবসমূহে তাঁহার বর্ণিত ১০২টি হাদীসের উল্লেখ পাওয়া যায়।[***********]

২৩। হযরত জরীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা):তিনি রাসূলের ইন্তেকালের প্রায় চল্লিশ দিন পূর্বে ইসলাম কবুল করেন। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা একশত। তন্মধ্যে আটটি হাদীস বুখারী ও মুসলিম-উভয়  গ্রন্হেই উল্লিখিত হইয়াচে। এতদ্ব্যতীত বুখারী শরীফে একটি হাদীস স্বতন্ত্রভাবে উল্লিখিত হইয়াছে, আর মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে ছয়টি হাদীস। অবশ্য নববীর শরহে মুসলিম গ্রন্হে বলা হইয়াছে যে, হযরত জরীর হইতে দুইশত হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে বুখারী শরীফে একটি এবং মসলিম শরীফে নয়টি হাদীস উল্লিখিত হইয়াছে।[************]

২৪। হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব ফরাজী (রা):তাঁহার সম্পর্কে মিশকাত সংকলক বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি হাফেজে হাদীস ছিলেন এবং রাসূলে নিকট হইতে অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারীদের মদ্যে তিনি অন্যতম। তাঁহার নিকট হইতেও বহু সংখ্যক লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[************]

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার নিকট হইতে মোট একশত তেইশটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তাহার মধ্য হইতে মাত্র চারিটি হাদীস বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হইয়াছে।[**************]

২৫। হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রা):তিনি হযরত সায়াদ ইবনে আবূ অক্কাসের ভাগ্নেয়। কুফা নগরে তিনি অবস্থান করিতেন এবং সেখানেই ৭৪ হিজরীতে তাঁহার ইন্তেকাল হয়। তাঁহার নিকট হইতেও বিপুল সংখ্যক লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[*****************]

২৬। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা):তিনি খুলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম খলীফা। নবী করীম (স)-এর আজীবনের বন্ধু ও সহচর। জাহিলিয়াতের যুগ হইতে ইসলামী সমাজ কায়েম হওয়া পর্যন্ত কোথাও কোন অবস্থায়ই তিন বেশিী সময়ের জন্য রাসূলে করীম (স) হইতে বিচ্ছিন্ন হন নাই। তাঁহার সম্পর্কে  তাঁহার সম্পর্কে মিশকাত সংকলক লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

বহু সংখ্যক সাহাবী ও তাবেয়ীন তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তবে রাসূলের ইন্তেকালের পর অল্পকাল মাত্র জীবিত থাকার কারণে তাঁহার নিকট হইতে খুব কম সংখ্যক হাদীসই বর্ণিত হইয়াছে।[**************

হযরত আবূ বকরের হাদীস বর্ণনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য এই গ্রন্হের ‘খুলাফায়ে রাশেদীন ও হাদীস গ্রন্হ সংকলন’ আালোচনা দ্রষ্টব্য।]

উপরিউল্লিখিত সাহাবীদের প্রত্যেকের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা একশত কিংবা ততোধিক এবং ইহাদের সকলের বর্ণিত সর্বমোট হাদীস হইতেছে ৪৫৫৬টি।

চতুর্থ ভাগ

চতুর্থ ভাগের হাদীস বর্ণকারী সাহাবী হইতেছে ৩৩ জন। তাঁহাদের প্রত্যেকেরই নিকট হইতে চল্লিশ হইতে একশতটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তাঁহাদের নামের পূর্ণ তালিকা এখানে পেশ করা হইতেছেঃ

(১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা (২) হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (৩) হযরত যায়দ ইবনে আরকাম (৪) হযরতকায়াব ইবনে আসলামী (৫) হযরতযায়দ ইবনে খালেদুল জুহানী (৬) হযরতহযরত আবূ তালহা যায়দ ইবনে সহল (৭) হযরতহযতর রাফে’ ইবনে খাদীজ (৮) হযরতসালমা ইবনে আকাওয়া (৯) হযরতআবূ রাফে কিবতী (১০) হযরত আওফ ইবনে মালিকুল আশজায়ী (১১) হযরতআদী ইবনে হাতিম (১২) হযরতআবদুর রহমান ইবনে আওফ (১৩) উম্মল মুমিনীন হযরত উম্মে হাবীবা (১৪) হযরতআম্মার ইবনে ইয়াসার (১৫) হযরত সালমান ফারসী (১৬)  উম্মুল মুমিনীন হযরত হাবসা (১৭) হযরতহযরত বুরাইরা ইবনে মুতরিম কুবশী (১৮) হযরতআসমা বিনতে আবু বকর (১৯) হযরতওয়াসিলা ইবনে আসকা কানানী (২০) হযরত আকবা ইবনে আমের জুহানি (২১) হযরত ফুযালা ইবনে উবায়দা আনসারী (২২) হযরত উমর ইবনে উতবা (২৩) হযরত কায়াব ইবনে আমর আনসারী (২৪) হযরত ফুযালা ইবনে উবাইদ আসলামী (২৫) উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা (২৬) হযরত উম্মে হানী (২৭) হযরত আবূ হুযায়ফা ইবনে মুগাফফাল (২৮) হযরত বিলাল ইবনে রিয়াহ তামীমী (২৯) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (৩০)হযরত মিকদান ইবনে  আসাদ কুফী (৩১) হযরত উম্মে আতীয়া আনসারীয়া (৩২) হযরত হাকীম ইবনে হাজার আসাদী এবং (৩৩) হযরত সালমা ইবনে হানীফ আনসারী (রা)।

পঞ্চম ভাগ

পঞ্চম ভাগের সাহাবীদের সংখ্যা পঞ্চান্ন। তাঁহাদের প্রত্যেকের নিকট হইতে চল্লিশ কিংবা চল্লিশ হইতেও কম সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। এখানে এই পর্যায়ের অপেক্ষাকৃত বেশী হাদীস বর্ণনাকারী ৪০ জনের নাম উল্লেখ করা যাইতেছে। তাঁহারা হইতেছেনঃ

(১) হযরত জুবাইর ইবনে আওয়াম (২) হযর ফাতিমা বিনতে কায়স (৩) হযতর খাব্বাব ইবনুল ইবত (৪) হযরত আয়াজ ইবনে হাম্মাদ তামীমী (৫) হযরত মালিক ইবনে রবীয়া সয়েদ (৬) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (৭) হযরত উম্মে কায়স বিনতে মহয (৮) হযরত ফজল ইবনে আব্বাস (৯) হযরত আমের ইবনে রবীয়া (১০) হযরত রবী বিনতে ময়ূদ (১১) হযরত উসাইদ ইবনে হুযাইর আশহালী (১২) হযরত খালিদ ইবনে অলীদ (১৩) হযরত উমর ইবন হারীস (১৪) হযরত খাওলা বিনতে হাকীম (১৫) হযরত সাবিত ইবনে জহাক (১৬) হযরত ওরওয়াহ ইবনে আবী জায়দুল আসাদী (১৭) হযরত মুয়াবিয়া ইবনে হাকীম সালামী (১৮) হযরত ইয়ামরা বিনতে সফওয়ান (১৯) হযরত ওরওয়াহ ইবনে মজরাস (২০) হযরত মজমা ইবনে ইয়াজীদ (২১) হযরত সালম  ইবনে কায়স (২২) হযরত কাতাদা ইবনে লুকমান (২৩) হযরত কুবাইসা ইবনে মুখরিক আমেরী (২৪) হযরত আসেম ইবনে আদী (২৫)  হযরত সালমা ইবনে নয়ীম আশজায়ী (২৬) হযরম মালিক ইবনে স’সায়া (২৭) হযতর মহজন ইবনে আদরা (২৮) হযরত সায়েব ইবনে ফালাহ (২৯) হযরত খাফাফ গিফারী (৩০)হযতর যু’ফজর হাবশী (৩১) হযরত মালিক ইবনে হুবাইর (৩২) হযরত যায়দ ইবনে হারিস (৩৩) হযরত সাবিত ইবনে আদীয়া (৩৪) হযরত কায়াব ইবনে আয়াজ আশ’আরী (৩৫) হযরত কুলসুম ইবনে হুসাইন গিফারী (৩৬) হযরত দাহইয়া কলবী (৩৭) হযরত জুদানা বিনতে ওহাব (৩৮) হযরত মালিক ইবনে ইয়াসার (৩৯) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জামরা এবং (৪০) হযরত কুলসুম ইবনে আলকামাহ (রা)।

অবশিষ্ট ১৫ জন অল্পবয়স্ক সাহাবী। তাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুবই অল্প ও অনুল্লেখযোগ্য।

উপরে বিভিন্ন পর্যায়ে যে সাহাবীদের নাম উল্লেখ করা হইল, তাঁহাদের মোট সংখ্যা একশত পাঁচ। মুসলিম মিল্লাতের নিকট হাদীসের যে বিরাট মহান সম্পদ অক্ষয় ও অনির্বাণ আলোক-স্তম্ভ রহিয়াছে, ইহা তাঁহাদের বর্ণিত- তাঁহারদেরই অপরিসীম নিষ্ঠাপূর্ণ ও নিরবিচ্ছিন্ন চেষ্টা, সাধনা, অক্লান্ত শ্রম, অবিচল আল্লাহ-বিশ্বাষী ও চিরন্তন মানব কল্যাণ কামানার ফল, তাহাতে সন্দেহ নাই।[*******************]

 

হাদীস বর্ণনায় সংখ্যা পার্থক্যের কারণ

পূর্বের আলোচনায় দেখা গিয়াছে যে, হাদীস বর্ণনায় সাহাবীদের মধ্যে সংখ্যার দিক দিয়া বিরাট পার্থক্য রহিয়াছে। একই নবীর সাহাবী সত্ত্বেও কেহ বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, আবার কেহ করিয়াছেন অতি নগণ্য সংখ্যক হাদীস। হাদীস বর্ণনায় এই বিরাট পার্থক্য সৃষ্টির কারণ কি, তাহা আমাদের বিশেষভাবে জানিয়া লওযা আবশ্যক।

নবী করীম (স) যতদিন পর্যন্ত সাহাবীদের মধ্যে জীবিত ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত তিনি সাধারণভাবে তাঁহাদের সকলকেই দ্বীন-ইসলাম, আল্লাহর কিতাব হিকমতের শিক্ষা দানে ব্যাপৃত ছিলেন। তখন যেমন রাসূলের নামে কোন মিথ্যা কথা প্রচার করার অবকাশ ছিল না, তেমনি ছিল না রাসূলের কোন কথাকে ‘রাসূলের কথা নয়’ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়ার বা প্রত্যাখ্যান করার এক বিন্দু সুযোগ। তখন মুনাফিকগণও রাসূলের কোন কথার অপব্যাখ্যা করিয়া ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার তেমন কোন সুযোগ পাইত না। কেননা তেমন কিছু ঘটিলেই সাহাবীয়ে কিরাম রাসূলের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া সমস্ত ব্যাপারে পরিস্কার ও সুস্পষ্ট করিয়া লইতে পারিতেন। ইতিহাসে বিশেষত হাদীস শরীফে ইহার অসংখ্য নিদর্শন বিদ্যমান রহিয়াছে। হযতর উমর ফারূক (রা) একবার হযরত হিশাম ইবনে হাকীমকে সূরা আল-ফুরকান নূতন পদ্ধতিতে পড়িতে দেখিয়া অত্যন্ত আশ্চর্যোবোধ করেন এবং তাঁহাকে পাকড়াও করিয়া রাসূলের দরবারে লইয়া আসেন। অতঃপর নবী করীম (স) হযরত হিশামের পাঠ শ্রবণ করিয়া বলিয়াছেন যে, এইভাবেও উহা পাঠ করা বিধিসম্মত। ফলৈ হযরত উমরের মনের সন্দেহ দূরীভূত হয়। এ কারণে এই কথা বলা যায় যে, রাসূলে করীম (স) তাঁহার জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কিরামের পারস্পরিত সমস্ত মতবিষম্যের মীমাংসা দানকারী ছিলেন। কোন বিষয়ে একবিন্দু সন্দেহ বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হইলেই রাসূলের দ্বারা সাক্ষাতভাবে উহার অপনোদন করিয়া লওয়া হইত।

কিন্তু নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর এই অবস্থায় বিরাট পরিবর্তন ঘটে। একদিকে যেমন ওহীর জ্ঞান লাভের সূত্র ছিন্ন হইয়া যায়, তেমনি অপরদিকে অসংখ্য নও-মুসলিম মুর্তাদ হইয়া দ্বীন-ইসলাম পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হয়। এইরূপ অবস্থায় ঘোলা পানিতে স্বার্থ শিকারের উদ্দেশ্যে কিছু সংখ্যা মুনাফিকও মাথাচাড়া দিয়া উঠে। তখন তাহারা যদি রাসূলের নামে কোন মিথ্যা রটাইতে চেষ্টা করিয়া থাকে, তবে তাহা কিছুমাত্র বৈচিত্র বা বিস্ময়ের কিছু নয়।

কিন্তু প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা) ইহার সম্মুখে প্রবল প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেন। তিনি একদিকে যেমন পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করিয়া মুর্তাদ ও যাকাত অস্বীকারকারীদের মস্তক চূর্ণ করিয়া দেন, অপরদিকে ঠিক তেমনি প্রবলভাবে মিথ্যাবাদীদের মিথ্যা কথা প্রচারের মুখে দুর্জয় বাধার প্রাচীর রচনা করিয়া দেন। তাঁহার পর হযরত উমর ফারুক (রা)-ও ইহার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিন হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে অত্যন্ত কড়াকড়ি অবলম্বন করেন। হাদীসের বিরাট সম্পদ বক্ষে ধারণ করিয়া বিপুল সংখ্যক সাহাবী অতন্দ্র প্রহরীর মত সজাগ হইয়া বসিয়া থাকেন। কোন হাদীস বর্ণনা করিলে তাহা মুনাফিকদের হাতে ক্রীড়ানক হইয়া পড়িতে পারে ও বিকৃত রূপ ধারণ করিতে পারে- এই আশংকায় তাঁহারা সাধারণভাবে হাদীস বর্ণনা করা প্রায় বন্ধ করিয়া দেন। কাহারো মনে এই ভয় এতদূর প্রবল হইয়া দেখা দেয় যে, বেশী করিয়া হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ভূল হইয়া যাইতে পারে কিংবা সাধারণ মুসলমান হাদীস চর্চায় একান্তভাবে মশগুল হইয়া পড়িলে তাহারা আল্লাহর নিজস্ব কালাম কুরআন মজীদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিতে পারে। এইসব কারণেও সাধারণভাবে সাহাবায়ে কিরাম হাদীস প্রচার ও বর্ণনা সাময়িকভাবে প্রায় বন্ধ করিয়া রাখেন। শরীয়াতের মাসলা-মাসায়েলের মীমাংসা কিংবা রাষ্ট্র শাসন ও বিচার-আচার প্রভৃতি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে যখন হাদীসের আশ্রয় গ্রহণ অপরিহার্য হইয়া পড়িত কেবলমাত্র তখন তাঁহারা পরস্পরের নিকট হাদীস বর্ণনা করিতেন।

এই পর্যায়ে আমরা বিশেষভাবে কয়েকজন সাহাবীর কথা উল্লেখ করিতে পারি এবং বিপুল সংখ্যক হাদীস জানা থাকা সত্ত্বেও তাঁহাদের অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিবার কারণও তাহা হইতে অনুধাবন করিতে পারি।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) নবী করম (স)-এর আজীবনের সঙ্গী, হযরত আবূ উবায়দা, হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব, হযতর ইমরান ইবনে হুসাইন প্রমুখ মহাসম্মানিত সাহাবী বিপুল সংখ্যক হাদীস জানা থাকা সত্ত্বেও তাঁহাদের নিকট হইতে খুবই কম সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। হযরত সায়ীদ ইবনে যায়দ বেহেশতবাসী হওয়ার সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবীর মধ্যে অন্যতম; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি মাত্র দুইটি কিংবা তিনটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত উবাই ইবনে উম্মারাতা কেবলমাত্র একটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

কোন কোন সাহাবী রাসূলের ইন্তেকালের পর খিলাফতের দায়িত্ব পালনে এতই মশগুল হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, তাঁহার পক্ষে হাদীস বর্ণনার মত সুযোগ বা অবসর লাভ করা সম্ভব হয় নাই । খুলাফায়ে রাশেদীনের চারজন সম্মানিত সাহাবী এবং হযরত তালহা ও হযরত জুবাইর (রা) এই কারণের বাস্তব দৃষ্টান্ত।

বহু সংখ্যক সাহাবীর অবস্থা ছিল ইহার ঠিক বিপরীত। তাঁহাদের ছিল বিপুল অবসর। হাদীস বর্ণনার প্রতিবন্ধক হইতে পারে এমন কোন ব্যস্ততাই তাঁহাদের ছিল না। ফলে তাঁহারা বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিতে সমর্থ হন। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা (রা), হযরত আয়েশা (রা) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)।

কোন কোন সাহাবী নবী করীম (স)- এর সংস্পর্শে ও সঙ্গে থাকার অপেক্ষাকৃত বেশী সুযোগ পাইয়াছিলেন। দেশে-বিদেশে, ঘরে ও সফরে সর্বত্র তাঁহার সঙ্গে থাকার কারণে একদিকে যেমন অধিক সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করা তাঁহাদের পক্ষে সহজ হইয়াছিল, তেমনি তাঁহার ইন্তেকালের পর উহাকে অপরের নিকট পূর্ণ মাত্রায় বর্ণনা করার সুযোগও তাঁহাদের ঘটিয়াছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা), হযরত আবূ হুরায়রা (রা), হযতর যাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা), হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) প্রমুখ সাহাবীর নাম এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। কিছু সংখ্যক সাহাবী রাসূলে করীম (স)-এর জীবদ্দশায়ই কিংবা তাঁহার ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই ইন্তেকাল করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহাদের জীবনে অপরের নিকট হাদীস বর্ণনা করার কোন সুযোগই ঘটে নাই। রাসূলের সঙ্গলাভ কিংবা তাঁহার সঙ্গে লাগিয়া থাকার সুযোগ যাঁহাদের বেশী ঘটে নাই, তাঁহাদের নিকট হইতেও খুব কম সংখ্যক হাদীসই বর্ণিত হইয়াছে।

রাসূলে করীম (সা)-এর অন্তর্ধানের পর ইসলামী সমাজে নিত্য নূতন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তখন মুসলিম জনসাধারণের পক্ষে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূলের কথা জানা আবশ্যকীয় হইয়া পড়ে। ফলে এই সময়ে জীবিত সাহাবীগণ বেশী সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিতে বাধ্য হইয়াছেন। পরবর্তীকালে মুসলিমদের মধ্যে ইলম হাদীস অর্জন করার  প্রবল আগ্রহ জন্মে। তাঁহারা সাহাবীদের নিকট নানাভাবে রাসূলের হাদীস শ্রবণের আবদার পেশ করিতেন। এই কারণেও সাহাবিগণ তাঁহাদের নিকট সুরক্ষিত ইলমে হাদীস তাঁহাদের সামনে প্রকাশ করিতে ও তাঁহাদিগকে উহার শিক্ষাদান করিতে প্রস্তুত হন। এই কারণও অনেক সাহাবীর নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইতে পারিয়াছে।

খিলাফতে রাশেদার শেষ পর্যায়ে মুসলিম সমাজে নানাবিধ ফিতনার সৃষ্টি হয়। শিয়া এবং খাওয়ারিজ দুইটি বাতিল ফিরকা স্থায়ীভাবে মাথাচড়া দিয়া উঠে। এই সময় তাহারা কিছু কিছু কথা রাসূলের হাদীস হিসাবে চালাইয়া দিতেও চেষ্টা করে। এই কারণে রাসূলের কোন কোন সাহাবী প্রকৃত হাদীস কম বর্ণনা করিতেও হাদীস বর্ণনায় অধিক কড়াকড়ি করিতে বাধ্য হন। ঠিক এই কারণেই চতুর্থ খলীফা হযতর আলী (রা)-এর নিকট হইতে খুবই কম সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইতে পারিয়াছে।

স্মরণশক্তির পার্থক্য  ও হাদীস লিখিয়া রাখা বা না রাখাও হাদীস বর্ণনায় এই সংখ্যা পার্থক্য সৃষ্টির অন্যতম কারণ। যাঁহারা হাদীস বেশী মুখস্থ করিয়া কিংবা লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতে পারিয়াছিলেন- যেমন হযরত আবূ হুরায়রা (রা) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা)- তাঁহারা অপর সাহাবীদের অপেক্ষা অধিক হাদীস বর্ণনা করিতেত সমর্থ হইয়াছিলেন। একই রাসূলের অসংখ্য সাহাবীদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা পার্থক্য সৃষ্টির মূলে এইসব বিবিধ কারণ নিহিত রহিয়াছে। কাজেই ব্যাপারটি যতই বিস্ময়কর হউক না কেন, অস্বাভাবিক কিছুই নয়, তাহা নিঃসন্দেহে বলা যায়।[মুহাম্মদ আবু জহু লিখিত ***************গ্রন্হের ৬৬,৬৭, এবং ১৪৭ ও ১৪৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]

 

তাবেয়ীদের হাদীস সাধনা

নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর সাহাবীদের যুগ সূচিত হয়। সাহাবায়ে কিরাম যেভাবে নবী করীমের নিকট হইতে কুরআন-হাদীস তথা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষালাভ করিয়া বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন, সাহাবায়ে কিরামও ঠিক সেইভাবে তাঁহাদেরই পরবর্তী পর্যায়ের লোক তাবেয়ীদিগকে কুরআন-হাদীস এবং ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা দিয়াছেন। নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশায় ইসলামী জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ং নবীর যে মর্যাদা ছিল, নবী করীমের অন্তর্ধানের পর সাহাবায়ে কিরাম (রা) অনুরূপ দায়িত্বপূর্ণ মর্যাদায় অভিষিক্ত হন। তাঁহারাও ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত চেষ্টার মারফতে তাবেয়ী যুগের মুসলিম জনগণকে ইসলামী জ্ঞানধারায় পরিষিক্ত করার জন্য কুরআন ও হাদীস জ্ঞানের অধিকতর পারদর্শী করিয়া তুলিবার কাজে ব্রতী হন। নবী করীম (স) যেভাবে মদীনায় প্রাথমিক পর্যায়ে এক বিরাট জ্ঞান-কেন্দ্র স্থাপন করিয়াছিলেন, উত্তরকালে সাহাবীদের অধিকাংশই ব্যক্তিগতভাগে ও নিজস্ব পরিমণ্ডলে এক-একটি জ্ঞান-চক্র রচনা করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের নিকট হইতে তাবেয়ী যুগের মুসলিমগণ কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু তাবেয়ী কে? এ সম্পর্কে মৌলিক আলোচনা এখানেই হওয়া আবশ্যক। ঐতিহাসিক খতীব বাগদাদী এই সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাবেয়ী তিনি,যিনি সাহাবীরে সংস্পর্শে রহিয়াছেন।

এই সংজ্ঞা অনুযায়ী সাহাবীর সহিত নিছক সাক্ষাৎ লাভই তাবেয়ী হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং সাহাবীর একত্রে কিছুকাল অতিবাহিত করাও জরুরী। কিন্তু বহুসংখ্যক মুহাদ্দিসের মত অন্যরূপ। তাঁহাদের মতেঃ

******************************************************

‘তাবেয়ী’ তিনি , যিনি কোন সাহাবীর সাক্ষাৎ পাইয়াছেন, যদিও তাঁহার সংস্পর্শে থাকেন নাই।

ইবনে হাব্বান এই ব্যাপারে সাহাবীর সহিত সাক্ষাতকালে তাবেয়ী’র মধ্যে বুদ্ধি ও ভালমন্দ জ্ঞানের উন্মেষ হওয়ার শর্ত আরোপ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সাক্ষাতের সময় যদি সে অল্প বয়স্ক হইয়া থাকে এবং যাহা কিছু শুনিয়াছে তাহার পূর্ণ হেফাযত ও সংরক্ষণে সমর্থ হইয়া না থাকে, তাহা হইলে সাহাবীর সহিত তাহার নিছক সাক্ষাৎলাভের কোন মূল নাই।[**************]

সাহাবীদের পর তাবেয়ীদের উচ্চমর্যাদা কুরআন মজীদেও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

এবং মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যাহারা ইসলাম কবুল করার ব্যাপারে অগ্রবর্তিতা লাভ করিয়াছে এবং যাহারা ঐকান্তিক আত্মোৎসর্গ ও সন্তোষ সহকারে তাহাদের অনুসরণ করিয়াছেন, আল্লাহ তাহাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তাহারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এবং আল্লাহ তাহাদের জন্য বাগান তৈরী করিয়া রাখিয়াছেন, যাহার নিম্নদেশ হইতে ঝরনাধারা প্রবাহিত রহিয়াছে।[সূরা আত-তাওরা, ২য় রুকূ, ১০০ নং আয়াত।]

কুরআনের এই আয়াতে মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের পরেই তাবেয়ীদের কথা বরা হইয়াছে। ইহারা ঈমান ও আমলের ব্যাপারে যেমন সাহাবায়ে কিরামরে অধীন, অনুরূপভাবে কালের দিক দিয়াও তাঁহারা সাহাবদের উত্তরসূরী। এই কারণেই প্রচলিত পরিভাষায় তাঁহাদিগকে ‘তাবেয়ীন’ (পরবর্তী বা অনুসারী) বলা হইয়াছে।

তাবেয়ীদের কথা হাদীসেও বিশেষ মর্যাদা সহকারে বলা হইয়াছে। রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার সমকালীন লোকগণ (সাহাবী) আমার উম্মতের মধ্যে উত্তম। তাহাদের পর তাহারা, যাহারা তাহাদের সহিত মিলিতকালে অবস্থিত (তাবেয়ী’ন) তাহাদের পর তাহাদের সহিত মিলিতকালের লোকগণ (তাবে-তাবেয়ীন)।[মুসলিম শরীফ, কিতাবুল ফাজায়েল পৃষ্ঠা ৩০৯।]

বস্তুত সাহাবাদের পরবর্তী সময়ের মুসলিম জামা’আত- তাবেয়ীন মোটামুটিভাবে সাহাবীদেরই প্রতিবিম্ব ছিলেন। তাঁহারা একদিকে যেমন রাসূলের সাহাবীদের নিকট হইতে কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কিত যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করেন, অপরদিকে তাঁহারা তদানীন্তন বিরাট মুসলিম সমাজের দিকে দিকে কোণে কোণে উহার ব্যাপক প্রচারাকার্য় সম্পাদন করেন। ইসলামী ইলমে সাহাবীদের নিকট হইতে গ্রহণ ও পরবর্তীকালের অনাগত মুসলিমদের নিকট উহা পৌঁছাইবার জন্য কার্যত তাঁহারাই মাধ্যম হইয়াছিলেন।[তাবেয়ীন-শাহ মুয়ীনউদ্দীন প্রণীত, ভূমিকা, পৃষ্ঠা ২-৩।]

এই তাবেয়িগণ সংখ্যায় ছিলেন অনেক- তাঁহাদের সংখ্যা নির্ভূলভাবে নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়। কেননা নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কিরাম দুনিয়ার বিভিন্ন দিকে ছড়াইয়া পড়েন এবং-

******************************************************

সাহাবীদের মধ্য হইতে একজনের সঙ্গেও যাঁহার সাক্ষাৎ ঘটিয়াছে, তিনিই একজন তাবেয়ী।[****************]

এই কারণে সারা মুসলিম জাহানে বিশেষভাবে এবং সারা দুনিয়ায় সাধারণভাবে কত সংখ্যক তাবেয়ী হইয়াছিলেন, তাহা নিরূপণ করা বাস্তবিকই অসম্ভব। কিন্তু হাদীস সংকলনের ইতিহাসে কেবল সেইসব তাবেয়ীই উল্লেখযোগ্য, যাঁহারা নবী করীম (স)-এর পরবর্তী যুগে হাদীস শিক্ষা, হাদীস কণ্ঠস্থকরণ ও লিখনের সহিত কোন না কোন দিক দিয়া জড়িত ছিলেন। তাবেয়ীদের হাদীস সাধনা পর্যায়ে আমরা কেবল এই শ্রেণীর প্রখ্যাত তাবেয়ীদের সম্পর্কেই আলোচনা করিব।

তাবেয়ীদের যুগে হাদীস শিক্ষার যে ক্রমিক পদ্ধতি ছিল, তাহা নিম্নোক্ত বাক্যাংশ হইতে প্রমাণিত হয়ঃ

******************************************************

ইলমে হাদীস শিক্ষার পদ্ধতি এইরূপ ছিল যে, প্রথমে শ্রবণ করা হইত, পরে উহাতে মনোযোগ স্থাপন করা হইত, তাহার পর উহা মুখস্থ করা হইত, অতঃপর তদনুযায়ী আমল শুরু করা হইত এবং উহার পর তাহা প্রচার করার জন্য বাস্তব কার্যক্রম গ্রহণ করা হইত।[**************]

বস্তুত ঠিক এই পদ্ধতি ও ক্রমিক অনুযায়ীই সাহাবায়ে কিরাম (রা) তাঁহাদের শিষ্য- শাগরিদদিগকে হাদীসের শিক্ষা দান করিতেন এবং নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী সমাজকেন্দ্রে জ্ঞান বিস্তারের আলোক-স্তম্ভ রচনা করিয়াছিলেন। ফলে এই যুগে বিপুল সংখ্যক লোক হাদীস শিক্ষা লাভ করার ও তদনুযায়ী নিজেদের জীবন গড়িয়া তুলিবার সুযোগ লাভ করেন। হাদীস মুখস্থ করা, হাদীস লিখিয়া রাখা এবং হাদীস গ্রন্হ সংকলন করা প্রভৃতি সকল কাজেই তাঁহারা পূর্ণমাত্রায় উদ্যোগী ও উৎসাহী হইয়াছিলেন। সেই সঙ্গে এই সকল বিষয়ে তাঁহারা পূর্ণ ব্যুৎপত্তি, কৃতিত্ব, যশ ও খ্যাতি লাভ করেন।

তাবেয়ী যুগে হাদীস চর্চার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে এখানে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা যাইতেছে।

হাদীস মুখস্থকরণ

সাহাবায়ে কিরামের ন্যায় তাবেয়িগণও হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ ও মুখস্থকরণের ব্যাপারে পূর্ণ উদ্যম, উৎসাহ, অপরিসীম আগ্রহ এবং নিষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। তাঁহাদের নিকট কুরআন মজীদের পরে পরেই দ্বিতীয় জ্ঞন-উৎস ছিল এই হাদীস। কুরআনে তাঁহারা যেখানে ইসলামের মূল নীতি ও বিধানের পাঠ গ্রহণ করিতেন, হাদীসের মাধ্যমে তাঁহারা লাভ করিতেন ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান ও তথ্য।

তাবেয়ী যুগের মুসলমানগণ প্রথম পর্যায়ে হাদীস মুখস্থ করার প্রতিই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। যে হাদীসেই শুনিতে পাইতেন, তাহাই তাঁহারা মুখস্থ করিয়া ফেলিতেন। এই সময় পর্যন্ত আরব জাতির স্বাভাবিক স্মৃতিশক্তির উপর পূর্ণমাত্রায় নির্ভরতা ছিল, কোন কিছু আয়ত্ত করিতে হইলে প্রথমত উহাকে মুখস্থ করাই ছিল তাঁহাদের চিরন্তন অভ্যাসগন রীতি। বিশেষত তখন পর্যন্ত লিখন-শিল্প তাহাদের মধ্যে বিশেষ বিস্তার, প্রসার ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ  করিতে পারে নাই।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও হাদীস যে একেবারেই লিখিত হইত না, কেবল মুখস্থ করার উপরই সকলে নির্ভর করিতেন এমন কথাও নহে। বরং প্রকৃত অবস্থা এই ছিল যে, অধিকাংশ লোকই তখন মুখস্থ করিতেই অভ্যস্ত ছিলেন।যদি কেহ লিখিতেনও, তবুও তাহা লিখিতেন মুখস্থ করারই উদ্দেশ্যে, মুখস্থ না করিয়া কেবল লিখিয়া রাখার কোন রীতিই সেখানে ছিল না একথা বলা চলে। ইমাম মালিকের নিম্নোদ্ধৃত উক্তি হইতে এই সংক্রান্ত কাজের প্রকৃত অবস্থা জানা যায়। তিনি বলেনঃ

******************************************************

তখনকার লোক সাধারণত লিখিতে অভ্যস্ত ছিলেন না, তাঁহারা সাধারণত মুখস্থ করিতেই অভ্যস্থ ছিলেন। তাঁহাদের কেহ কোন জিনিস লিখিয়া লইলেও কেবল মুখস্থ করার উদ্দেশ্যেই লিখিতেন, আর মুখস্থ হইয়া গেলে পর উহাকে মুছিয়া ফেলিতেন।[***************]

মুহাম্মদ ইবনে সিরীন তাবেয়ী সম্পর্কে বলা হইয়াছে যে, প্রথমে হাদীস লিখিয়া লইয়া উহা মুখস্থ করা এবং মুখস্থ হওয়ার পর লিখিত জিনিস বিনষ্ট করাই ছিল তাঁহাদের হাদীস শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি।[********************]

ঐতিহাসিক ইবনে আসাকির মুহাদ্দিস ইসমাঈল ইবনে উবায়দার একটি উক্তি উদ্ধৃত করিয়া এই যুগের হাদীস মুখস্থ করার গুরুত্ব সুস্পষ্ট করিয়া তুলিয়াছেন। মুহাদ্দিস ইসমাঈল বলিতেনঃ

******************************************************

আমারা যেভাবে কুরআন মুখস্থ করি, হাদসকেও ঠিক সেইভাবে মুখস্থ করা আমাদের কর্তব্য।[****************]

ঐতিহাসিক যাহবী প্রখ্যাত হাফেজে হাদীস ইবনে খুজায়মা সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

একজন কুরআন পাঠক যেমন করিয়া কুরআনের সূরাসমূহ মুখস্থ করেন, ইবনে খুজায়মাও ঠিক তেমনিভাবে ফিকাহ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ মুখস্থ করিতেন।[****************]

খালিদ-আল-হাযযা তাবেয়ী বলিয়াছেনঃ আমি প্রথমে বড় বড় হাদীস লিখিয়া লইতাম এবং **********************************  যখন উহা মুখস্থ করিয়া লইতাম, তখন উহা মুছিয়া ফেলিতাম।[************]

তাবেয়ী ইসমাঈল ইবনে ইউনুসের জীবনী বর্ণনা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক যাহবী লিখিয়াছেন যে, তিনি বলিতেনঃ

******************************************************

আমি কুরআনের সূরা যেভাবে মুখস্থ করিতাম ঠিক সেইভাবেই আবূ ইসহাক বর্ণিত হাদীসসমূহ মুখস্থ করিতাম।[**********************]

তাবেয়ী শহর ইবনে হাউসাবের জীবনী আলাচনা প্রসঙ্গে লিখিত হইয়াছে যে, আহমাদ আবদুল হামীদ ইবনে রহমানের নিকট তাঁহার (শহর) বর্ণিত সমস্ত হাদীস সংগৃহীত ছিল এবং

******************************************************

তিনি হাদীস এমনভাবে মুখস্থ করিতেন যে, মনে হইত তিনি কুরআনের কোন সুরা পাঠ করিতেছেন।[**************]

প্রখ্যাত মুসনাদ গ্রন্হ সংকলনকারী মুহাদ্দিস আবূ দায়ূদ তায়ালিসি দাবি করিয়া বলিতেনঃ

******************************************************

আমি ত্রিশ সহস্র হাদীস ‘ফর ফর’ করিয়া মুখস্থ পড়িতে পারি; অবশ্য ইহা আমার অহংকারের কথা নয়।[***********]

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী কাতাদাহ মুহাদ্দিস সায়ীদ ইবনে আরারাহকে সূরা বাকারার প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ পড়িয়া শোনাইলেন, তাহাতে একটিও ভূল হইল না। অতঃপর তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

হযরত জাবির সংকলিত হাদীস গ্রন্হ (সংকলন) সুরা বাকারা অপেক্ষাও অধিক মাত্রায় আমার মুখস্থ রহিয়াছে।[*****]

এই যুগে হাদীস শিক্ষাদান কার্য কিভাবে সম্পাদিত হইত, তাহা নিম্নলিখিত বিবরণ হইতে বুঝিতে পারা যায়।

উরাওয়া ইবনে জুবাইর হযরত আয়েশা (রা)-এর বোনপো এবং ছাত্র ছিলেন। তাঁহার পুত্র হিশাম ইবনে উরওয়া বলেন যে, আমার পিতা আমাকে ও আমর অন্যান্য ভাইদের হাদীস শিক্ষা দিতেন। আবার আমাদের কাছে তাহা শুনিতে চাহিতেন এবং বলিতেনঃ

******************************************************

তোমরা যাহা পড়িয়াছ, তাহা আমাকে বারবার পড়িয়া শোনাও।

ইহার পর তিনি বলেনঃ

******************************************************

আমার পিতা আমার মুখস্থ করার শক্তির পরিচয় পাইয়া অত্যন্ত বিস্মিত এবং খুশী হইতেন।[*****************]

ইবরাহীম নাখারী তাবেয়ী তাঁহার হাদীসের ছাত্রদিগকে উপদেশ স্বরূপ বলিতেনঃ

******************************************************

তুমি যখন কোন হাদীস শ্রবণ করিবে, তখন উহা অপরের নিকট বর্ণনা করিবে।[***************]

তাবেয়ী যুগের প্রসিদ্ধ হাদীস সংগ্রহক ইমাম ইবনে শিহাব জুহরী সম্পর্কে বর্ণিত হইয়াছে, তিন এশার নামাযের পর অযু করিয়া হাদীস মুখস্থকরণ ও হাদীস আলোচনায় বসিয়া যাইতেন এবং ফযরের নামায পর্যন্ত একই বৈঠকে আসীন থাকিয়া হাদীস চর্চা করিতেন।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৯।]]

এই ইমাম জুহীর বলিয়াছেনঃ

******************************************************

উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহকে যখন আমি কোন হাদীস জিজ্ঞাসা করিতাম, তখন তিনি এমনভাবে হাদীস বর্ণনা শুরু করিতেন যে, তখন মনে হইত যেন একটি সমুদ্র ফুটিয়া বাহির হইয়াছে।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৮০।]

বস্তুত প্রথম হিজরী শতকের প্রায় শেষ পর্যন্তই আবর জাহানের মুসলিম আলিমগণ সাধারণত কোন কিছু লিখিয়া রাখার প্রতি মনোযোগী ছিলেন না, লিখিয়া রাখার পরিবর্তে মুখস্থ করিয়া রাখাই ছিল তাঁহারদের নিকট সহজতর কাজ।

এইরূপ পরিবেশ একালের সকল হাদীসবিদ তাবেয়ী কর্তৃক যে ব্যাপকভা হাদীস লিখিত হইবে, তাহা ধারণা করা যায় না। এই কারণে প্রথম হিজরী শতকে হাদীস লেখকদের তুলনায় হাদীস মুখস্থকারীদের সংখ্যা অনেক বেশী। এই যুগের এমন অসংখ্য মনীষীর নাম জীবনী গ্রন্হসমূহে উল্লিখিত হইয়াছে, যাহারা বিপুল সংখ্যক হাদীস- হাদীসের বিরাট বিরাট সংকলন- সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছিলেন এবং তাঁহারা তাহা এমনভাবেই মুখস্থ পড়িয়া শোনাইতে পারিতেন যে, কোথাও একটি ভূলও পরিলক্ষিত হইত না।

হাদীস লিখন

সাহাবায়ে কিরাম যেমন হাদীস সংরক্ষণের জন্য উহা কেবর মুখস্থ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, অনেক সাহাবী উহা লিখিয়া রাখার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করিয়াছেন। অনুরূপভাবে তাবেয়িগণও হাদীস কেবল মুখস্ত করাকেই হাদীস সংরক্ষণের দায়িত্ব পালনের জন্য যথেষ্ট মনে করেন নাই, সেই সঙ্গে তাঁহাদের মধ্যে এমন লোকও ছিলেন, যাঁহারা উহাকে লিখিয়া রাখার গুরুত্ব পূর্ণমাত্রায় অনুভব করিয়াছিলেন। এক কথায় বলা যায়, সাহাবা ও তাবেয়ী- এই উভয় যুগে হাদীস কেবলমাত্র মুখস্থ করাই যদি যথেষ্ট মনে করা হইত এবং কেহই উহা লিপিবদ্ধ করার দিকে মনোযোগ না দিতেন, তাহা হইল রাসূলের হাদীসের বিরাট অংশের বিলুপ্ত হইয়া যাওয়ার আশংকা ছিল। এইজন্য মুখস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে হাদীস লিখিয়া লওয়ার দিকেও যে এই উভয় যুগের বিশেষ বিশেষ লোকের দৃষ্টি নিবদ্ধ হইয়াছিল, ইহাকে মুসলিম জাতির প্রতি আল্লাহর এক অপরিসীম অনুগ্রহই বলিতে হইবে।

বস্তুত তাবেয়ীদের মধ্যে বহু লোক সাহাবীদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও শিক্ষা লাভ করিয়া তাহা যথাযথ সতর্কতা, লক্ষ্য ও মনোযোগ সহকারে লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করিয়াছেন। নিম্নোক্ত বর্ণনা হইতে তাহার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যাইবে।

১। বশীর ইবনে নুহাইক তাবেয়ী হযরত আবূ হুরায়রার হাদীসের ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেনঃ আমি হযরত আবূ হুরায়রার নিকট যত হাদীস শুনিতাম, তাহা সবই লিপিবদ্ধ করিয়া লইতাম। শেষকালে তাঁহার নিকট হইতে বিদায় লওয়ার সময় তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া লিখিত হাদীস-সমষ্টি তাঁহার নিকট পেশ করিলাম এবং তাহা সবই আদ্যোপান্ত পড়িয়া তাঁহাকে শোনাইলাম। বলিলামঃ- ********************* ‘ইহা সেই সমস্ত হাদীসের সমষ্টি, যাহা আমি আপনার নিকট হইতে শুনিয়াছি’। জওয়াবে হযরত আবূ হুরায়রা (রা বলিলেনঃ হ্যাঁ, ‘ঠিক আছে’। [সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৮।]

২। হযরত আবূ হুরায়রার অপর একজন ছাত্র হইতেছেন হাম্মাম ইবনে মুনাববাহ ইয়ামানী। তিনিও শ্রুত হাদীসসমূহ লিখিত আকারে সুসংবদ্ধ করেন। এই সংকলন ‘সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাব্বাহ’ নামে খ্যাত। ইহাতে প্রায় একশত চল্লিশটি হাদীস সন্নিবেশিত রহিয়াছে। এই গ্রন্হের পাণ্ডুলিপি আজিও দামেশক ও বালিনের লাইব্রেরীতে সুরক্ষিত রহিয়াছে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত গবেষক ও অনুসন্ধান-বিশারদ ডক্টর হামীদুল্লাহ ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে প্রথম ইহার সন্ধান লাভ করেন। উহার ঠিক বিশ বৎসর পর ১৯৫৩ সনে দামেশকের আবরী পত্রিকা **************** তে উহাকে চার কিস্তিতে প্রকাশ করেন। ডক্টর হামীদুল্লাহর ঘোষণা হইতে ইহাও জানা গিয়াছে যে, তুরস্কের আনকারা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে হাম্মাম ইবনে মুনাববাহর ছাত্র মা’মর ইবনে রাশেদ সংকলিত অপর একখানি হাদীস গ্রন্হের পাণ্ডুলিপিও বর্তমান রহিয়াছে।

মা’মর ইবনে রাশেদের ছাত্র এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের উস্তাদ আবদুর রাজ্জাক ইবনে হাম্মাম আস-সানয়ানী আল-ইয়ামনী (১২৫-২১১ হিঃ} সংকলিত এক হাদীস গ্রন্হও পাওয়া গিয়াছে। ইহা ‘মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক’ নামে খ্যাত।

এই হাদীস সংকলনসমূহ একদিকে যেমন নবী করীম (স)-এর জীবনকাল ও খিলাফতে রাশেদার আমলের হাদীস সংকলিত হওয়ার জীবন্ত নিদর্শন এবং প্রাচীনতম গ্রন্হসমূহের মূল উৎস।[এই সমস্ত বিবরণ ডঃ হামীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাব্বাহ’র ভূমিকা হইতে গৃহীত।]

৩। সায়ীদ ইবনে জুবাইর তাবেয়ী বলেনঃ

******************************************************

আমি ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাসের নিকট রাত্রিবেলা হাদীস শুনিতাম ও সওয়ারীর উপর বসিয়া তাহা লিখিয়া রাখিতাম।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৮।]

তাঁহার অপর এক উক্তি হইতে জানা যায়, তিনি হযরত ইবনে আব্বাসের সাথে কোন এক রাত্রিবেলা মক্কার পথে চলিতেছিলেন। এই সময় ইবনে আব্বাস (রা) হাদীস বর্ণনা করিতনে এবং তিনি উহা লিখিয়া রাখিতেন। এইভাবে সকাল বেলা পর্যন্ত চলিতে থাকিত।[ঐ]

৪। তাবেয়ী সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা সম্পর্কে মুবারক ইবনে সায়ীদ বলেনঃ

******************************************************

সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাত্রিবেলা হাদীস শ্রবণ করিয়া প্রাচীরগাত্রে লিখিয়া রাখিতেন, সকাল বেলা উহার অনুলিপি তৈয়ার করিয়া উহা মুছিয়া ফেলিতেন।[সুনানে দারেমী।]

৫। হুজর ইবনে আদী’র সম্মুখে একদিন পানি দ্বারা ইস্তেঞ্জা করা সম্পর্কে একটি প্রশ্ন পেশ করা হয়। তিনি বলিলনঃ আমার সহীফাখানা লইয়া আস।

******************************************************

উহা আনা হইলে তিনি বিসমিল্লাহ বলিয়া পড়িতে লাগিলেন এবং বলিলেনঃ ইহা আমি হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব হইতে শুনিয়াছি, তিনি বলিতেছিলেন যে, ‘পবিত্রতা হইতেছে অর্ধেক ঈমান’।[তাবাকাতে ইবনে সায়াদ ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫৪।]

ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, হযরত আলীর নিকট হইতে হাদীসসমূহের কোন লিখিত সংকলন হুজর ইবনে আদীর নিকট বর্তমান ছিল এবং কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা হইলেই তিনি উহা খুলিয়া হাদীস পাঠ করিয়া তাহা হইতে জওয়াব শোনাইতেন।

৬। আবদুল আ’লা ইবনে আমরের নিকটও একখানি লিখিত হাদীস সংকলন রক্ষিত ছিল। তাঁহার সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

আবদুল আ’লা যত হাদীস ইবনুল হানাফীয়া হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, আসলে তাহা সবই লিখিত পুস্তক আকারে পাওয়া একটি সমষ্টি ছিল। তিনি উহা তাঁহার নিকট হইতে পাইয়াছিলেন; কিন্তু হাদীসসমূহ তাঁহার জবানীতে শ্রবণ করেন নাই।[তাবাকাতে ইবনে সায়াদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৪।]

৭। ইমাম বাকের –এর নিকটও হাদীসের এক সংকলন গ্রন্হ বর্তমান ছিল। হযরত জা’ফর সাদেক বলেনঃ আমি আমার পিতার নামে যত হাদীস বর্ণনা করিঃ ************** তাহা সবই তাঁহার সংকলিত গ্রন্হে লিপিবদ্ধ পাইয়াছি ও তাহা হইতেই গ্রহণ করিয়াছি’।[তাহযীবুত তাহযীব, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৪।]

৮। হযরত মুয়াবিয়ার শাসন আমলে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীসসমূহের কয়েকটি সংকলন তৈয়ার করা হয। মারওয়ান ইবনে হাকাম হযরত যায়দ ইবনে সাবিত বর্ণিত হাদীস সমূহের সংকলন করেন।[সুনানে দারেমী।]

বস্তুত তাবেয়িগণ সাহাবীদের নিকট হইতে নানাভাবে হাদীস সংগ্রহ করিতেন। দূরবর্তী কোন সাহাবীর নিকট হইতে হাদীস জানিবার উদ্দেশ্যে তাঁহারা পত্রালাপও করিতেন এবং পত্রের মারফতে তাঁহারা রাসূলের হাদীস জানিয়া লইতেন। হযরত সায়াদ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসে উহার সুস্পষ্ট প্রমাণ রহিয়াছে। আমের জুহরী আল-করশী (মৃত্যুঃ ১০৪ হিঃ) বলেনঃ

******************************************************

আমি হযরত জাবির (রা)- এর নিকট আমার গোলাম নাফে’র হস্তে এক পত্র প্রেরণ করিয়াছিলাম। তাহাতে লিখিয়াছিলাম যে, আপনি রাসূলের নিকট হইতে শুনিয়াছেন এমন কোন জিনিস আমাকে লিখিয়া পাঠান। উত্তরে তিনি (জাবির) আমাকে লিখিলেন যে আসলামীকে যে শুক্রবার ‘সংগেসার’ করা হয় সেই দিনের বৈকালে আমি রাসূলে করীমকে বলিতে শুনিয়াছিঃ দ্বীন-ইসলাম কিয়ামত পর্যন্ত কায়েম থাকিবে; কিংবা বলিয়াছেনঃ যতদিন তোমাদের উপর কুরায়শ বংশের বারোজন খলীফা নিযুক্ত না হইবে (ততদিন পর্যন্ত দ্বীন ইসলাম কায়েম থাকিবে)।[ সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, কিতাবূল ইমারাত, পৃষ্ঠা ১১৯।]

১০। রাজা ইবনে হায়াত বলেন যে, খলীফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিক আমার নিকট একটি হাদীস জিজ্ঞাসা করিয়া তাঁহাকে লিখিয়া পাঠাইবার জন্য তাঁহার এক কর্মচারীকে নির্দেশ দেন। কিন্তু-

******************************************************

উক্ত হাদীস আমার নিকট লিখিত না থাকিলে আমি উহা ভুলিয়া যাইতাম।[সুনানে দরেমী, পৃষ্ঠা ৬৯।]

১১। তাবেয়ী হাদীসবিদগণ পারস্পরিক পত্রালাপের মারফতে একজন অপরজনকে হাদীসের কথা জানাইতেন। ইয়াযিদ ইবনে আবূ হাবীব বলেনঃ

******************************************************

তাবেয়ী আতা আমাকে লিখিয়াছিলেন যে, তিনি হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা)- কে বলিতে শুনিয়াছেন যে, রাসূলে করীম (স)-কে মক্কা বিজয়ের দিন (মক্কায় থাকিয়া) বলিতে শুনিয়াছি যে, নিশ্চয় আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূল মদ্য, মৃত জন্তু, শূকর ও মূর্তি ক্রয়-বিক্রয় হারাম করিয়া দিয়াছেন।[*******************]

এই হাদীস লিখনে তাবেয়িগণও যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করিতেন, যাহার তাহার নিকট হইতে তাঁহারাও হাদীস লিখিয়া লইতেন না। ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন তাবেয়ী বলেনঃ

******************************************************

আমাকে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুর রাজ্জাক বলিলেনঃ আমার নিকট হইতে কোন কিতাব ছাড়া অন্ততঃ একটি হাদীস হইলেও তাহা লিখিয়া লও।

তিনি হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন বটে। কিন্তু এই সময় (শেষ জীবনে) তিনি অন্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। এইজন্য আমি তাঁহার নিকট হইতে কোন হাদীস লিখিয়া লইতে রাযী হইলাম না, কেননা তাঁহার হাদীস ভূলিয়া যাওয়ার আশংকা ছিল ও কি বলিতে কি বলেন তাহারও ভয় ছিল। এইজন্য আমি তাঁহাকে স্পষ্ট ভাষায় বলিলামঃ *************** ‘না, একটি অক্ষরও আপনার নিকট হইতে শুনিয়া লিখিয়া লইব না’।[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৪।]

আহলি বায়াত-এর হাদীস সংকলন

ইমাম হুসাইন (রা)-এর দৌহিত্র ও আলী ইবনুল হুসাইনের পুত্র ইমাম যায়দ ৮০ হিজরী সনের কোন এক সময় মদীনা-তাইয়্যেবায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আহলি বায়াত- এর লোকদের নিকট হইতে সুন্নাত ও হাদীসের যাবতীয় ইলম সংকলন করেন। তাঁহার সংকলিত হাদীস গ্রন্হের নাম ************** ইহাতে বিপুল সংখ্যক হাদীস সংকলিত হইয়াছিল। এই হাদীসমূহের অধিকাংশই হযরত আলী (রা)-এর সূত্রে নবী করীম (স)-এর নিটক হইতে বর্ণিত। কিছু সংখ্যক হাদীসের সূত্র হযরত আলী (রা) পর্যন্ত পৌছিয়া *********** হইয়া গিয়াছে। ইমাম হুসাইন ও হযরত আলী (রা)  ছাড়াও অন্যান্য বহু সূত্রে বিপুল সংখ্যক হাদীস তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তাঁহার পিতা আলী ইবনুল হুসাইন বহু সংখ্যক  তাবেয়ী হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। সেই বর্ণনাসমূহ ইমাম যায়দ তাঁহার বড় ভাই ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকের এর নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলেন। কেননা তাঁহার পিতা আলী ইবনুল হুসাইন ৯৪ সনে ইন্তেকাল করেন। তখন তিনি মাত্র চৌদ্দ বৎসর বয়সের বালক ছিলেন। ইমাম আবূ হানীফা (র) ও অন্যান্য ফিকহী ইমামগণ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনা করিয়াছেন।[**********************]

 

কয়েকজন প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাদ্দিস

পূর্বোক্ত সাধারণ আলোচনার পর আমরা এখানে তাবেয়ী যুগের কয়েকজন বিশিষ্ট হাদীস বিশেষজ্ঞ সম্পর্কে বিশেষ ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিব। তাবেয়ী যুগের হাদীস সাধনা কি বিরাট ও মহৎ সাধনা ছিল এবং তাহার ফলে কি ধরনের যোগ্যতা ও প্রতিভাসম্পন্ন লোক তৈয়ার হইয়াছিলেন, তাহা এই আলোচনা হইতে অধিক স্পষ্টভাবে জানিতে পারা যাইবে।

প্রথম হিজরী শতক হইতে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমাধ্য পর্যন্ত সময়ে মুসলিম জাহানের বিভিন্ন শহর ও অঞ্চলে বিভিন্ন বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। স্থানের উল্লেখসহ তাঁহার নাম ও মৃত্যুর সন নিম্নে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

মদীনাঃ (১) সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব- মৃত্যু ৯৩ হিঃ (২) উরওয়া ইবনুযযুরায়র- মৃত্যু ৯৪ হিঃ (৩) আবূ বকর ইবনে আবদুর রহমান ইবনুল হারিস- মৃত্যু ৯৪ হিঃ (৪) উবায়দুল্লাহ ইবনে উতবা- মৃত্যু ৯৯ হিঃ (৫) সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর- মৃত্যু ১০৬ হিঃ (৬) সুলায়মান ইবনে ইয়াসার- মৃত্যু ৯৩ হিঃ (৭) কাসেম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর- মৃত্যু ১১২ হিঃ (৮) নাফে ‘মাওলা ইবনে উমর- মৃত্যু ১১৭ হিঃ (৯) ইবনে শিহাব জুহরী- মৃত্যু ১২৪ হিঃ (১০) আবুজ্জানাদ- মৃত্যু ১৩০ হিঃ।

মক্কাঃ (১) ইকরামা মাওলা ইবনে আব্বাস- মৃত্যু ১০৫ হিঃ (২) আতা ইবনে আবূ রিবাহ- মৃত্যু ১১৫ হিঃ (৩) আবু যুবায়র মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিম – মৃত্যু ১২৮ হিঃ।

কূফাঃ (১) আশশা’বী আমের ইবনে শারাহবীল- মৃত্যু ১০৪ হিঃ (২) ইবরাহীম আন- নাখয়ী- মৃত্যু ৯৬ হিঃ (৩) আলকামা ইবনে কায়স ইবনে আবুল হাসান বসরী- মৃত্যু ১১০ হিঃ।

বসরাঃ (১) আল হাসান ইবনে আবূল হাসান আল-বসরী – মৃত্যু ১১০ হিঃ (২) মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন- মৃত্যু ১১০ হিঃ (৩)  কাতাবাদ ইবনে দায়ামাতা আদ- দওসী- মৃত্যু ১১৭ হিঃ।

সিরিয়াঃ (১) উমর ইবনে আবদুল আযীয – মৃত্যু ১০১ হিঃ (২) মফহুল – মৃত্যু ১১৮ হিঃ (৩) কুবাইচা ইবনে যুয়াইয়িব –মৃত্যু ৮৬ হিঃ। (৪) কায়াবুল আহবার- মৃত্যু ৩২ হিঃ।

মিসরঃ (১) আবুল খায়ের মারসাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইজনী- মৃত্যু ৯০ হিঃ এবং (২) ইয়াযিদ ইবনে আবূ হাবীব- মৃত্যু ১২৮ হিঃ।

ইয়ামনঃ (১) তায়ূস ইবনে কাইসান-আল ইয়ামানী আলহিময়ারী- মৃত্যু ১০৬ হিঃ (২) অহব ইবনে মুনাববাহ- মৃত্যু ১১০ হিঃ। [তাবেয়ীদের এই পূর্ণ তালিকা জামে’ আজহার – এর অধ্যাপক মুহাম্মদ আবূ জাহু প্রণীত *********************** গ্রন্হের ১৭৩ পৃষ্ঠা হইতে গৃহীত।]

‘আসমাইর রিজাল’ সম্পর্কীয় গ্রন্হসমূহে ইহাদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা উদ্ধৃত রহিয়াছে। এখানে মাত্র কয়েকজন সম্পর্কে খানিকটা বিস্তারিত আলোচনা দেওয়া যাইতেছে।

ইবনে শিহাব জুহরী

(আসল নাম মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম)

ইমাম জুহরী ইলমে হাদীসের সুবিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি হযরত আনাস ইবনে মালিক, সহল ইবনে সায়াদ, সায়েব ইবনে ইয়াযিদ, শুবাইব আবূ জামীলা, আবদুর রহমান ইবনে সায়াদ, রবীয়াতা ইবনে আতাদ, মাহমুদ ইবনে রবী ও আবুত্তোফাইল প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। অপরদিকে বিপুল সংখ্যক তাবেয়ী তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

 ইলমে হাদীসে তিনি ছিলেন সর্ববাদীসম্মত ইমাম। তাঁহার বর্ণিত হাদীস ছিল তাঁহার অপূর্ব স্মৃতিশক্তির বাস্তব প্রমাণ।

আমর ইবনে দীনার তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম জুহুরী অপেক্ষা হাদীসের অধিক প্রামাণ্য ও অকাট্য দলীল রূপে আমি আর কাহাকেও দেখিতে পাই নাই।

বস্তুত আল্লাহ তাঁহাকে অপরিসীম স্মরণশক্তি দান করিয়াছিলেন। ইমাম বুখারীর বর্ণনা মতেঃ

******************************************************

তিনি মাত্র আশিটি রাত্রে কুরআন মজীদ সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়াছেন।

তিনি নিজে স্বীয় স্মরণশক্তির পরিচয় দিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কোন কিছু মুখস্থ করিয়া লওয়ার পর উহা আমি কখনও ভুলিয়া যাই নাই।[*******************]

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয- এর আদেশক্রমে সর্বপ্রথম তিনিই রাসূল (স)-এর হাদীস সংগ্রহ ও গ্রন্হাবদ্ধ করেন। তাঁহার হাদীস সংগ্রহের বিরাট কাজ লক্ষ্য করিয়া ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম জুহরী না হইলে মদীনায় হাদীস সমূহ নিঃসন্দেহে বিলিন হইয়া যাইত।[*******************]

তিনি ১২৪ হিজরী সনে সিরিয়ার ‘শাগবাদ’ নামক গ্রামে ইন্তেকাল করেন ও সেখানেই তাঁহাকে সমাধিস্থ করা হয়। [*************************] তিনি সমগ্র হিজাজ অঞ্চলে প্রাপ্তব্য সুন্নাতে রাসূল (হাদীস) সংগ্রহ করিয়াছিলেন।

ইকারামা মওলা ইবনে আব্বাস

তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রা)- এর মুক্তিপ্রদত্ত ক্রীতদাস ছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাসই তাঁহাকে কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা দান করেন। ইকরামা নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবনে আব্বাস তাঁহার পায়ে বেড়ী পরাইয়া আটকাইয়া রাখিয়া তাঁহাকে কুরআন ও হাদীস শিক্ষা দান করিতেন।[********************]

ইকরামা হযরত ইবনে আব্বাস ছাড়াও হাসান ইবনে আলী, আবূ কাতাদাহ, ইবনে উমর, আবূ হুরায়রা, আবূ সায়ীদুল খুদরী, মু’আবিয়া, ইবনে আমর ইবনুল আস প্রমুখ সাহাবীর নিকট হইতেও হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। আবার বিপুল সংখ্যক তাবেয়ীও তাঁহার নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যিব তাবেয়ী’কে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিলঃ *********************** ‘হাদীসে আপনার অপেক্ষা অধিক বিদ্বান আর কেহ আছেন কি? উত্তরে তিনি বলিলেনঃ হ্যাঁ, আছেন এবং তিনি ইকরামা।[*******************]

সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব

তিনি হযরত উমর ফারুকের ফিলাফতের দ্বিতীয় কি চতুর্থ বৎসরে জন্মগ্রহণ করেন। [********************] এই সময় রাসূলে করীমের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হইয়া গিয়াছিল; কিন্তু তবুও ইসলামের বসন্তকাল সর্বত্র বিরাজিত ছিল। দুই-চারজন ব্যতীত প্রধান সাহাবীদের প্রায় সকলেই তখন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। আর তাঁহারাই ছিলেন ‘ইলমে রিসালাতে’র প্রকৃত উত্তরাধিকারী। ইবনে মুসাইয়্যিবের ছিল অসীম জ্ঞান পিপাসা। তিনি সাহাবীদের নিকট হইতে কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান- অমৃত আহরণ করেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) ছিলেন তাঁহার শশুর। এই সম্পর্কের কারণে হযরত আবূ হুরায়রার নিকট হইতে হাদীস জ্ঞান অধিক মাত্রায় অর্জন করা তাঁহার পক্ষে সহজ হইয়াছিল। এই কারণে তাঁহার বর্ণিত অধিকাংশ হাদীসই মূলত হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত। [***********************] অপরদিকে তাঁহার স্বাভাবিক স্মরণশক্তি ছিল এতই তীক্ষ্ণ ও প্রবল যে, একবার যাহা শুনিতেন তাহা চিরদিনের তরেই তাঁহার স্মৃতিপটে মুদ্রিত ও রক্ষিত হইয়া  যাইত।[**************************] এইসব কারণে তাঁহার হাদীস- জ্ঞান অত্যন্ত গভীর ও প্রশস্ত হইয়াছিল।

উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ

তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের ভ্রাতা উতবার পৌত্র। ইসলামী জ্ঞানের কেন্দ্র ছিল তাঁহার ঘর ও পরিবার। এই পরিবেশে লালিত- পালিত হইয়া তিনি অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী হইয়াছিলেন। ইবনে সায়াদ তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি বহু হাদীসের বর্ণনাকারী ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন।[*********************]

ইমাম জুহরী বলিয়াছেন, আমি সমসাময়িক প্রায় সকল হাদীসবিদের নিকট হইতেই প্রায় সবটুকু ইলম আহরণ করিয়াছি। কিন্তু উবায়দুল্লাহর ইলম ছিল অসীম ও অতলস্পর্শ সমুদ্র, তাঁহার নিকট যখন আসিতাম, তখনই সম্পূর্ণ নূতন ইলম লাভ করার সুযোগ হইত।[*******************] ইহা হইতে তাঁহার ইলমের গভীরতা, ব্যাপকতা ও প্রসারতা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়।

উরওয়া ইবনুয যুবায়র

উরওয়া হাদীস ও ফিকাহ উভয় ধরনের ইলমেই গভীর ব্যুৎপত্তি ও পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন। আল্লামা ইবনে সায়াদ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি বহু হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন, ফিকাহর ইলমে ছিলেন বিশেষ পারদর্শী ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। সকল বিপর্যয় হইতে তিনি সুরক্ষিত ও অত্যন্ত দৃঢ় ও বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন।[***************]

তাঁহার পিতা, ভাই, মা, খালা প্রভৃতি সকল নিকট-আত্মীয়ই হাদীস  জ্ঞান বিশেষ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ছিলেন। উরওয়া তাঁহাদের সকলের নিকট হইতেই হাদীস আহরণ করেন।[*************************] কিন্তু হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসসমূহ তিনি প্রায় সম্যক পরিমাণে সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি তাঁহার নিকট বারবার যাতায়াত করিতেন, আর আয়েশা (রা) ছিলেন সকলের অপেক্ষা অধিক বড় আলিমে হাদীস।[ঐ] উরওয়া নিজেই বলিয়াছেন, হযরত আয়েশার ইন্তেকালের পূর্বে-পূর্বে আমি তাঁহার সমূদয় ইলমে হাদীস আহরণ করিয়া পূর্ণরূপে সংরক্ষণ করিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিলাম।[ঐ] উরওয়া হযরত আয়েশা (রা) ছাড়াও অন্যান্য বড় বড় সাহাবীর নিকট হইতে বিপুল পরিমাণ হাদীস আহরণ করিয়া লইয়াছিলেন।[ঐ]

সালেম ইবনে আবদুল্লাহ

সালেম মদীনার শীর্ষস্থানীয় তাবেয়দের অন্যতম। তিনি ছিলেন ইলম ও আমল উভয়ের সমন্বয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের নিকট হইতেই তিনি বেশীর ভাগ হাদীস আহরণ করিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত হযরত আবূ হুরায়রা, আবূ আইয়ূব আনসারী ও হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা)- এর নিকট হইতেও তিনি হাদীসের জ্ঞান লাভ করিয়াছিলেন।[*********************] আল্লামা ইবনে সায়াদ তাঁহাকে ‘বহু হাদীস বর্ণনাকারী ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি; বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।[*****************]

সুলায়মান ইবনে ইয়াসার

তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত মায়মুনার ক্রীতদাস ছিলেন। এই কারণে তিনি হযরত আয়েশা (রা) ও অন্যান্য সাহাবীদের নিকট যাতায়াত করা ও ইলমে হাদীস আহরণ করার বিরাট সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। ফলে তিনি মদীনার প্রধান আলিমদের মধ্যে গণ্য হইত পারিয়াছিলেন।[********************] ইমাম নববী লিখিয়াছেন, তাঁহার মর্যাদা ও ইলমী প্রাধান্য সর্ববাদী সমর্থিত ছিল।[ঐ পৃষ্ঠা ২৩৫।]

আতা ইবনে আবূ বিরাহ

তিনি ছিলেন হাবশী গোলাম। কিন্তু ইলম ও আমল, তাকওয়া ও পরহেযগারীর দিক দিয়া তিনি সৈয়দ বংশের তাবেয়ীদের মধ্যে গণ্য হইতেন। [********************] কুরআন, হাদীস, ফিকাহ প্রভৃতি জরুরী দ্বীনী ইলমে তিনি বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। ইবনে সায়াদের ভাষায়ঃ

******************************************************

তিনি ফিাকহ জ্ঞানসম্পন্ন ও অধিক হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন। তিনি লোকদিগকে কুরআন শিক্ষা দিতেন।[********************]

তিনি ছিলেন হাদীসের প্রখ্যাত হাফেজ। ঐতিহাসিক যাহবী তাঁহাকে প্রথম শ্রেণীর হাফেযে হাদীসের মধ্যে গণ্য করিয়াছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আবদুল্লাহ ইবনে আমর, ইবনে যুাবায়র, মু’আবিয়া, উসামা ইবনে যায়দ, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ, যায়দ ইবনে আরকাম, আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব, রাফে ইবনে খাদীজ, আবূ দারদা, আবূ সায়ীদ খদরী, আবূ হুরায়রা ও হযরত আয়েশা (রা) প্রমুখ প্রখ্যাত সাহাবী হইতে তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস আহরণ করেন।[********************]

তিনি হাদীসের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করিতেন। হাদীস বর্ণনার মাঝখানে অন্য কোন কথা বলা তিনি আদৌ পছন্দ বা বরদাশত করিতেন না।[********************]

ইমাম বাকের (রা) লোকদিগকে এই বলিয়া উৎসাহদান করিতেন যে, তোমরা যত পার আতা’র নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ কর।[********************]

ইবরাহীম নাখরী

তিনি ছিলেন কূফা নগরের শ্রেষ্ঠ তাবেয়ীদের অন্যতম। তিনি ইলম ও আমলের পবিত্র পরিবেশে লালিত-পালিত হইয়াছিলেন। তাঁহার চাচা আলকামা ও মামা আসওয়াদ উভয়ই কুফার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন।[********************] এই সুযোগে তিনি হযরত আয়েশা (রা)-এর খিধমতেও যাতায়াত করিতেন ও তাঁহার মজলিসমূহের যোগদান করিতেন।

এই কারণে ইবরাহীম ইলমে হাদীসে বিরাট যোগ্যতা অর্জন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ইমাম নববীর মতে তাঁহার প্রামাণ্যতা, মর্যাদা ও ফিকাহ-জ্ঞান সম্পর্কে

সকলে একমত। হাদীসের হাফেয ছিলেন তিনি। ঐতিহাসিক যাহবী তাঁহাকে দ্বিতীয় স্তরের হাফেযে- হাদীসগণের মধ্যে গণ্য করিয়াছেন।[********************]

হাসান আল-বসরী

হাসান বসরী যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন বিপুল সংখ্যক সাহাবী ভূ-পৃষ্ঠে বাঁচিয়াছিলেন। তখনকার পরিবেশে সর্বত্র ইলমে রিসালাতের আওয়াজে মুখরিত ছিল।

ইবনে সায়াদ তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাসান বসরী বহু পূর্ণত্ব যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। অতি বড় আলিম ছিলেন, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন, ফিকাহবিদ ছিলেন, ফিতনা হইতে সুরক্ষিত ছিলেন, বড় আবেদ ও পরহেযগার ছিলেন, জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, শুদ্ধভাষী, মিষ্টভাষী সুন্দর ও অমায়িক ছিলেন। [********************] বিশেষভাবে ইলমে হাদীসে তাঁহার গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল।

হাফেয যাহবীর ভাষায় তিনি ছিলেন বড় বিজ্ঞ, ইলমের সমুদ্র।[********************] তিনি হযরত উসমান, আলী, আবূ মুসা আশ’আরী, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আনাস ইবনে মালিক প্রমুখ বড় বড় সাহাবীর নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]

ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ

তিনি বিশিষ্ট তাবেয়ীদের অন্যতম। হাফেয যাহবী তাঁহাকে ইমাম ও ‘শায়খুল ইসলাম’ প্রভৃতি নামে উল্লেখ করিয়াছেন।[********************]

তিনি যদিও সাহাবী যুগের প্রায় শেষ পর্যায়ের লোক, কিন্তু তবুও তখনকার দিনের অবশিষ্ট সকল সাহাবী হইতেই পূর্ণরূপে ইলম হাসিল করিয়াছেন; হযরত আনাস ইবনে মালিক, কাসিম ইবনে মুহাম্মদ, আমর ইবনে সালমা ইবনে আবদুর রহমা, উরওয়া ইবনে যুবায়র ও সুলায়মান ইবনে ইয়াসার প্রমুখ সাহাবী ও বিশিষ্ট তাবেয়ীদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন।[********************]

ফলে তিনি হাদীসের বড় হাফেয হইয়াছিলেন। আল্লামা ইবনে সায়াদ তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি বড়ই নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাস্য, বেশী সংখ্যক হাদীসের বর্ণনাকারী, অকাট্য প্রমাণ্য ও প্রতিষ্ঠালব্ধ ছিলেন।

ইবনে মুবারক তাঁহাকে হাদীসের শ্রেষ্ঠ হাফেযদের মধ্যে গন্য করিয়াছেন। আবূ হাতিম তাঁহাকে ইমাম জুহরীর সমপর্যায়ের হাদীসবিদ বলিয়া জানিতেন। বস্তুত ইমাম জুহরী ব্যতীত আর যাঁহারা অক্লান্ত চেষ্টায় মদীনার বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ সংগৃহীত ও সুরক্ষিত হইয়াছিল, তিনি ছিলেন এই ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ। ইয়াযিদ ইবনে হারুন বলেন যে, ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ তাঁহার বর্ণিত তিন সহস্র হাদীস মুখস্থ করিয়াছেন।[]

 

হাদীস লিখনে উৎসাহ দান

তাবেয়ী হাদীসবিদগণ তাঁহাদের নিকট হাদীস শিক্ষার্থীদিগকে হাদীস লিখিয়া লইতে বিশেষ উপদেশ দান করিতেন। সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিবের হাদীসের ছাত্র আবদুর রহমান ইবনে হারমালাতা তাঁহার নিকট তাঁহার স্মরণশক্তির দুর্বলতার অভিযোগ করিলে তিনি তাঁহাকে সব হাদীস লিখিয়া লইবার উপদেশ দিয়াছিলেন।[********************] শা’বী তো তাঁহার ছাত্রদের নিকট রাসূলে করীমের কথিত এবং সাহাবা  ও তাবেয়ী’দের দ্বারা বহু বর্ণিত হাদীসটি বারবার আবৃত্তি করিতেন। সেই হাদীসটি হইলঃ

******************************************************

লেখার কাজ হইল হাদীসের ইলমকে ধরিয়া রাখা।[********************]

হাদীস লিখিয়া রাখার যে ফায়দা রহিয়াছে তাহা তিনি বিশেষভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিয়া বুঝাইয়া দিতেন। তিনি বলিতেনঃ

******************************************************

তোমরা আমার নিকট হইতে যেসব হাদীস শুনিতে পাও তাহা শোনার সঙ্গে সঙ্গে লিখিয়া লইবে- তাহা প্রাচীরগাত্রে লিখিতে হইলেও বিরত হইবে না।[********************]

তাঁহার সম্পর্কে জানা গিয়াছে যে, তিনি নিজেও বিশেষ বিশেষ হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতেন। সেই কারণেই তাঁহার ইন্তেকালের পর ফারায়েজ ইত্যাদি সম্পর্কিত হাদীসমূহ সংকলিত এক গ্রন্হ পাওয়া যায়।[********************]

মুজাহিদ ইবনে যুবায়র (মৃঃ ১০৩ হিঃ) লোকদের সঙ্গে লইয়া তাঁহার কক্ষে প্রবেশ করিতেন ও তাঁহাদের সামনে স্বীয় হাদীস সংকলনসমূহ পেশ করিতেন। তাহারা তাহা হইতে হাদীস নকল করিয়া লইত।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ১২৮। ************]

আতা ইবনে আবূ রিবাহ (মৃঃ ১১৪ হিঃ) নিজেও হাদীস লিখিয়া রাখিতেন এবং অন্যদের তাহা করিতে উপদেশ দিতেন।[********************]

কাতাদাহ ইবেন দায়ামাতা হাদীস লিখন সম্পর্কে যে-কোন প্রশ্নকারীকে অসংকোচে ও জোরালো ভাষায় বলিতেনঃ

******************************************************

তোমাকে লিখিয়া রাখিতে কে নিষেধ করিতেছে? মহান আল্লাহ নিজেই সব কিছু লিখিয়া রাখার কথা ঘোষণা করিয়াছেন এই বলিয়াঃ কিয়ামত সম্পর্কিত ইলম আমার আল্লাহর নিকট লিখিত রহিয়াছে, অথচ তিনি না ভ্রষ্ট হন, না ভুলিয়া যান।[******************** আয়াতটি সূরা তা-হা’র ৫২ নং আয়াত।]

উমর ইবনে আবদুল আযীয

(জন্ম-৬১ হিঃ মৃত্যু-১০১ হিঃ)

উমর ইবনে আবদুল আযীয তাবেয়ী ইলমে হাদীসে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি প্রথমত মদীনায় মুহাদ্দিস সালেহ ইবেন কাইসানের নিকট হাদীস ও দ্বীনী-ইল শিক্ষা সম্পর্ক স্থাপন, পারস্পরিক চর্চা ও আলোচনার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন এবং হাদীসের অনন্যসাধারণ জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ ‘আমি যখন মদীনা হইতে চলিয়া গেলাম, তখন আমার অপেক্ষা (হাদীসে) বড় আলিম আর কেহ ছিল না।[********************]

হাফেয যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীযী ইমাম, ফিকাহবিদ, মুজতাহিদ, সুন্নাত ও হাদীসে বিশেষ পারদর্শী, বিরাট মর্যাদাসম্পন্ন, লব্ধপ্রতিষ্ঠ হাদীস-অভিজ্ঞা, গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী, হাদীসের হাফেয, আল্লাহর হুকুম পালনকারী, বিনয়ী ও আল্লাহ পরস্ত লোক ছিলেন।[********************]

উমর ইবনে আবদুল আযীয বিপুল সংখ্যক হাদীসের বর্ণনা করিাছেন। তিনি নিম্নোক্ত সাহাবী ও তাবেয়ী মুহাদ্দিসগণ হইতে হাদীস শিক্ষা ও বর্ণনা করিয়াছেনঃ

(১) উকবা ইবনে আমের (২) ইউসুফ ইবনে আবদুল্লাহ (৩) হযরত তমীমুদদারী (রা) (৪) হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) (৫) সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (৬) হযরত মু’আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা) (৭) হযরত আয়েশা (রা) (৮) আসমা বিনতে উমাইয়া (৯) খাওলা (১০) সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (১১) আবদুল্লাহ ইবনে  কারুয (১২) আবান ইবনে উসমান (১৩)  আবূ বকর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে হারিস ইবনে হিশাম (১৪) উরওয়া ইবনে যুবায়র (১৫) মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রওফল (১৬) আবূ বুরাদাহ (১৭) আবূ সালমাহ (‌১৮) সায়ীদ ইবনে খালিদ (১৯) আমের ইবনে সায়াদ (২০) ইয়াহইয়া ইবনুল কাসিম (২১) কায়স ইবনে হারিস (২২) আবদুল আযীযী (উমরের পিতা) (২৩) আবদুল্লাহ ইবনে মওহাব (২৪) উবাদা ইবনে আবদুল্লাহ (২৫) ইবনে শিহাব জুহরী (২৬) রবী’ ইবনে সাবুরা (২৭) মুহাম্মদ ইবনে সাবিত ইবনে শুরাহবীল এবং আরো অনেক মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[এ, এইচ, হালে সম্পাদিত ‘মুসনাদে উমর ইবনে আবদুল আযীয’–এর ভূমিকা।]

যত বিপুল সংখ্যক মরফু হাদীস তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল, তত আর কোন তাবেয়ীরই ছিল না। আইয়ূব সখতীয়ানী বলিতেনঃ

‘আমি যত লোকের সঙ্গেই সাক্ষাত করিয়াছি, উমর ইবনে আবদুল আযীয অপেক্ষা রাসূলে করীম হইতে অধিক হাদীস বর্ণনাকারী আর কাহাকেও দেখি নাই।[********************]

ইমাম মকহুল

ইমাম মকহুল প্রথম জীবন শুরু করেন ক্রীতদাস হিসাবে। এই অবস্থার মধ্যেও তিনি ইলম শিক্ষালাভে মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। গোলামী মুক্তিলাভের পরই তিনি সমগ্র মুসলিম জাহানে পর্যটনে বাহির হইয়া পড়েন। ইসলামী রাজ্যের প্রত্যেকটি কেন্দ্রেই তিনি গমন করেন এবং সেখান হইতে সম্ভাব্য সমস্ত হাদীসজ্ঞান আয়ত্ত করিয়া লন। প্রথমে তিনি মিসরের জ্ঞান-সম্পদ অর্জন করেন।[********************] এবং তাহা নিঃশেষে আয়ত্ত করার পূর্বে তিনি মিসর হইত বাহিরে পদার্পণ করেন নাই।[********************]

অতঃপর তিনি মদীনা গমন করেন এবং সেখানে হইতে ইরাক চলিয়া যান। এই উভয় স্থান হইতে তিনি সমস্ত হাদীস-সম্পদ আহরণ করিয়া সিরিয়া রওয়ানা হইয়া যান। সিরিয়ার তদানীন্তন প্রত্যেক হাদীসবিদের নিকট হইতেই তিনি হাদীস শিক্ষালাভ করেন। মোটকথা, হাদীস শিক্ষালাভ ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি মুসলিম জাহানের প্রতিটি কেন্দ্রের অলি-গলি ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ ‘ইলমে হাদীসের সন্ধানে আমি সারা জাহান পরিক্রম করিয়াছি।[********************]

তিনি কয়েকজন সাহাবীর নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছেন। তাঁহারা হইতেছেনঃ (১) হযরত আনাস (রা), (২) হযরত আবূ হিন্দদারী (রা) (৩) হযরত ওয়াসিলা ইবনে আসকা (রা) (৪) হযরত আবূ ইমাম (রা), (৫) হযরত আবদুর রহমান ইবনে গানাম (রা) (৬) হযরত আবূ জানদাল ইবনে সুহাইল (রা)।[********************]

এতদ্ব্যতীত সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, মুসরুক, যুবাইর ইবনে নুফাইর, কারীব আবূ মুসলিম, উরওয়া ইবনে যুবাইর, মগরী ইবনে কাসীর প্রমুখ বিশিষ্ট তাবেয়ীর নিকট হইতেও হাদীস শিক্ষা করেন।[********************]

ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদের বর্ণনা মতে তিনি ১১২, ১১৩ কিংবা ১১৮ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। তাঁহার জন্ম তারিখ সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। হাদীস ও ফিকাহ সম্পর্কে তিনি দুইখানি গ্রন্হ রচনা করেন। অথচ এই সময় পর্যন্ত গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ সূচিতই হয় নাই।[********************]

ইমাম শা’বী

ইমাম শা’বী তাঁহার সময়কার অনন্য শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ তাবেয়ী। তিনি যখন পূর্ণ বয়স্ক হন তখন কূফা নগরে বিপুল সংখ্যক সাহাবী জীবিত ও বর্তমান ছিলেন। তাঁহাদের নিকট তাঁহার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। জীবনে তিনি প্রায় পাঁচশত সাহাবীর সহিত সাক্ষাত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে ৪৮ জন সাহাবীর নিকট হইতে তিনি রীতিমত হাদীস শিক্ষালাভ করিয়াছেন।[********************] হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের খিধমতে একাদিক্রমে দশ মাস পর্যন্ত থাকিয়া তিনি হাদীসের গভীর ও ব্যাপক শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন।[********************]

এই হাদীস শিক্ষালাভ ও সংগ্রহ করার জন্য তাঁহাকে প্রাণান্তকর পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করিতে হইয়াছে। তিনি কেমন করিয়া হাদীসের এই জ্ঞান-সমুদ্র আয়ত্ত করিয়াছিলেন, তাহা জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিয়াছিলেনঃ সমস্ত চিন্তা –ভাবনা পরিত্যাগ করিয়া, দেশ-দেশান্তর পর্যটন করিয়া, গর্দভের ন্যায় শক্তি ব্যয় ও কাকের মত প্রত্যুষ জাগরণ সহ্য করিয়া।[********************] হাদীসে তাঁহার জ্ঞান যে কত ব্যাপক ও গভীর ছিল, তাহা তাঁহার নিজেরই একটি কথা হইতে প্রমাণিত হয়। তিনি বলিয়াছেনঃ

বিশ বৎসর পর্যন্ত আমি কাহারো নিকট হইতে এমন কোন হাদীস শুনিতে পাই নাই, সে সম্পর্কে আমি হাদীসের সেই বর্ণনাকারী অপেক্ষা অধিক ওয়াকিফহাল ছিলাম না।[********************]

তিনি ইমাম আবূ হানীফার কেবল উস্তাদই ছিলেন না, হাফেয যাহবীর মতে ******************** তিনি আবূ হানীফার প্রধান উস্তাদ ছিলেন।[ঐ]

 

হাদীস সংগ্রহের অভিযান

হাদীস শিক্ষালাভ এবং হাদীস সংগ্রহ-সংকলনের জন্য নিজেদের ঘরবাড়ি ও সাংসারিক উন্নতি-অগ্রগতির সমস্ত চিন্তা-ভাবনা পরিহার করিয়া দেশে বিদেশে দূর-দূরান্তরের দুর্গম ও পর্বতসংকুল পথ অতিক্রম করা মুসলিম মনীষীদের অনেকেরই এক পবিত্র ব্রত ছিল। কুরআন ও হাদীসে এই কাজের জন্য বিশেষ উৎসাহ দান করা হইয়াছে। এই কাজের অপরিসীম সওয়াবের কথাও সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষিত হইয়াছে। দ্বীন সম্পর্কীয় জ্ঞান আহরণের জন্য বিদেশ যাত্রা এবং তথা হইতে জ্ঞান সম্পদ অর্জন করিয়া নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করা ও নিজ দেশের জনগণকে ইসলামী জীবনাদর্শ গ্রহণের দাওয়াত দেওয়া বস্তুতই মুসলিম জাতির এক মহান পবিত্র দায়িত্ব। এই পর্যায়ে সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন ওতৎপরবর্তীকালের জ্ঞান আহরণকারীদের অবিশ্রানত্ সাধনার বিস্ময়কর কাহিনী পাঠ করিলে মনে হয়, এক পবিত্র অপরিহার্য ব্রত ও দায়িত্ব মনে করিয়াই তাঁহারা এই কাজে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিলেন। কুরআন মজীদ একদিকে হযরত মূসা নবীর জ্ঞান আহরণ উদ্দেশ্যে  ‘মাজমাউল বাহরাইন’ (দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থল) পর্যন্ত সফর করার ইতিবৃত্ত প্রচার করিয়াছে, অপরদিকে দ্বীনী জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি লাভের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরের জন্য নিম্নলিখিত রূপ তাকীদ পেশ করিয়াছেনঃ

******************************************************

সকল মু’মিনকেই একসঙ্গে ঘর হইতে বহির হইয়া পড়িতে হইবে না বটে; কিন্তু তাহা হইলেও তাহাদের প্রত্যেক দল ও সমাজ হইতে কিছু কিছু লোক দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভের জন্য কেন ঘর হইতে বহির্গত হইবে না- এই উদ্দেশ্যে যে, তাহারা নিজেদের জাতির লোকদের নিকট ফিরিয়া আসিয়া তাহাদিগকে আল্লাহ সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করিবে? তাহা হইলেই এই আশা করা যায় যে, তাহারা সতর্ক হইবে ও ভয় করিয়া চলিতে শুরু করিবে।[সূরা তওবা, ১৫ রুকু, ১২২ আয়াত।]

কুরআনের এই সুস্পষ্ট নির্দেশের সমর্থন বেশ কিছু সংখ্যক হাদীসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই পর্যায়ে সর্বপ্রথম হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত নিম্নোদ্ধৃত হাদীস উল্লেখযোগ্য।

 রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি জ্ঞান-অন্বেষণের উদ্দেশ্যে কিছু পথও অতিক্রম করিবে আল্লাহ ইহার বিনিময়ে জান্নাতে যাওয়ার পথ তাহার জন্য সুগম করিয়া দিবেন।[বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬।]

হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে ঘর হইতে বাহির হইবে, তাহার ঘরে ফিরিয়া আসা পর্যন্ত তাহার এই সফর আল্লাহর পথের সফর হইবে।[তিরমিযী, ******************** সুনানে দারেমী।]

বলা বাহুল্য, এই পর্যায়ের যাবতীয় হাদীসে যে ইসলাম শিক্ষার উদ্দেশ্যে বাহির হইবার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হইয়াছে, তাহা কুরআন- হাদীস সম্পর্কিত ইলম। বিশেষভাবে হাদীসের ইলমও হইতে পারে।

(ক)

সাহাবীদের যুগ

নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশাইতেই আরব দেশের বিভিন্ন গোত্র দূর-দূরান্ত হইতে তাঁহার দরবারে আসিয়া জমায়েত হইত ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান-তথ্য সংগ্রহ করিয়া নিজ নিজ দেশে চলিয়া যাইত। ব্যক্তিগতভাবে নিকট দূরের সাহাবীদের সম্পর্কেও এই কথাই সত্য।

হযরত আকাবা ইবনুল হারেস (রা) তাঁহার নিজের বিাবহ সম্পর্কীয় একটি মাসলার রায় জানিবার উদ্দেশ্যে দূরবর্তী কোন স্থান হইতে মদীনায় আগমন করেন। আসিয়া হযরতের নিকট হইতে শরীয়াতের ফয়সালা জানিয়া লইয়া নিজের বাড়ির দিকে চলিয়া যান এবং সেই ফয়সালা অনুযায়ী স্ত্রীরূপে গৃহীত স্বীয় দুধমাকে পরিত্যাগ করেন।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯।] ইসলামের প্রথম যুগের ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনার কোন সীমা সংখ্যা নাই। কেননা তখন ইসলামকে জানিবার জন্য দূরবর্তী মুসলিমদের পক্ষে আর কোন উপায়ই ছিল না।

অবশ্য সুফফার অধিবাসিগণ স্থায়ীভাবে প্রায় চব্বিশ ঘন্টা সময়ই রাসূলের সন্নিকটে অবস্থান করিতেন এবং রাসূল (স)-এর নিকট হইতে জ্ঞানলাভ করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ও উন্মুখ হইয়া থকিতেন। নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর তাঁহার সাহাবিগণের অনেকেই মুসলিম জাহানের বিভিন্ন কেন্দ্রে বিছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়েন। এই কারণে হাদীস-সম্পদ সংগ্রহের জন্য বিদেশ সফর ও দেশ-দেশান্তরে আঁতিপাতি করিয়া খুঁজিয়া বেড়াইবার প্রয়োজন দেখা দেয়। সাহাবীদের যুগ হইতে পরবর্তীকালের মুসলিমগণকে এক-একটি হাদীসের জন্য বিদেশ সফরের অপরিসীম কষ্ট ভোগ করিতে হইয়াছে। এই স্থান হাদীস শিক্ষার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।[********************]

বুখারী শরীফে উল্লেখ করা হইয়াছে, হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইসের নিকট হইতে একটি হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে একামাস দূরত্বের পথ অতিক্রম করিয়া গিয়াছিলেন। তিনি সংবাদ জানিতে পারিয়াছিলেন যে, সুদূর সিরিয়ায় অবস্থানকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস (রা) রাসূলে করীমের একটি হাদীস জানেন, যাহা অপর কাহারো নিকট রক্ষিত নাই। সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি উষ্ট্র ক্রয় করিয়া সিরিয়ার পথে রওয়ানা হইয়া যান। একমাস কালের পথ অতিক্রম করিয়া সিরিয়ার গ্রামাঞ্চলের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছিয়া তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইসের সাক্ষাত লাভ করেন। তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

তোমার নিকট হইতে আমার কাছে একটি হাদীস পৌঁছিয়াছে, যাহা তুমি রাসূলের নিকট হইতে শুনিয়াছ। আমার ভয় হইল যে, তোমার নিজের নিকট হইতে উহা নিজ কর্ণে শ্রবণ করার পূর্বেই হয়ত আমি মরিয়া যাইব (এই ভয়ে আমি অনতিবিলম্বে তোমার নিকট হাযির হইয়াছি)।[********************]

অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস (রা) জিজ্ঞাসিত হাদীসটি মুখস্থ পাঠ করিয়া শোনাইলেন। হাদীসটি নিম্নরূপঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, আল্লাহ তা’আলা বান্দাদিগকে হাশরের ময়দানে একত্রিত করিবেন এবং তাহাদিগকে এমন এক আওয়াচে সম্বোধন করিবেন, যাহা নিকট  ও দূরে অবস্থিত লোকেরা সমানভাবে শুনিতে পাইবে। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করিবেনঃ আমিই মালিক, আমিই বাদশাহ, আমিই অনুগ্রহকারী।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড- *************************** পৃষ্ঠা ১১১৪। তাযকিরাতুল হুফফায গ্রন্হে এই পর্যায়ে কিসাস সম্পর্কিত একটি হাদীসের উল্লেখ করা হইয়াছে, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৩।]

হযরত মুসলিমা ইবনে মাখলাধ (রা) যখন মিসরে অবস্থান করিতেছিলেন, তখন ‘কিসাস’ সম্পর্কিত একটি হাদীস জানিবার জন্য হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বহু কষ্ট স্বীকারপূর্বক তাঁহার নিকট উপস্থিত হন এবং বলেনঃ ‘এই একটি হাদীস শিখিবার ঐকান্তিক আগ্রহ লইয়াই আমি আপনার নিকট আসিয়াছি এবং আমাদের একজনের মৃত্যুর পূর্বে আমি হাদীসটি জানিয়া লইতে চাহি।[********************]

হযরত ফুজলা ইবনে উবাইদ (রা)-এর নিকট মিসরে একজন সাহাবী দূরবর্তী স্থান হইতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। ফুজালা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাইলেন। তিনি বলিলেনঃ আমি আপনার নিকট কেবল সাক্ষাত লাভের উদ্দেশ্যে আসি নাই। আসিয়াছি বিশেষ একটি উদ্দেশ্য লইয়া। আমি ও আপনি একত্রে রাসূলে করীমের নিকট হইতে একটি হাদীস শ্রবণ করিয়াছিলাম, সম্ভবত আপনার তাহা খুব ভালরূপে স্মরণ থাকিবে, আপনার নিকট হইতে তাহা নূতন করিয়া শুনিবার জন্যেই আমি এখানে উপস্থিত হইয়াছি।

অতঃপর ফুজালা প্রার্থিত হাদীসটি পেশ করেন এবং হাদীসটি জানিয়া লইয়া উক্ত সাহাবী নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।[দারেমী, আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২।]

হযরত মুয়াবিয়ার শাসন আমলে হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী (রা) শুধুমাত্র একটি হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে মদীনা হইতে মিসরের নিভৃত পল্লীতে অবস্থানকারী হযরত আকাবা ইবনে আমের জুহানী (রা)-র নিকট উপস্থিত হন। আকাবা সংবাদ পাইয়া বাহিরে আসিলেন ও হযরত আইয়ূব (রা)-কে বক্ষে জড়াইয়া ধরিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

আবূ আইয়ূব! আপনি কি কারণে এত দূরে (আমার নিকট) আসিয়াছেন? তখন হযরত আবূ আইয়ূব (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

মু’মিন ব্যক্তির ‘সতর’ (বিশেষ জিনিস গোপন রাখা) সম্পর্কে একটি হাদীস আম রাসূলের নিকট শুনিয়াছিলাম, কিন্তু এখন তোমার ও আমার ছাড়া উহার শ্রবণকারী আর কেহ দুনিয়ায় বাঁচিয়া নাই। (তাহাই তোমার নিকট হইতে নূতন করিয়া শ্রবণের বাসনা লইয়া আমি এত দূর আসিয়াছি)।

তখন হযরত আকাবা নিম্নলিখিত ভাষায় হাদীসটি বলিলেনঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি  এই দুনিয়ায় কোন মু’মিন লোকের কোন লজ্জাকর, অপমানকর কাজ গোপন রাখিবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাহার গুনাহকে গোপন (মাফ) করিয়া দিবেন।

হযরত আবূ আইয়ূব বাঞ্চিত হাদীসটি শ্রবণ করিয়া বলিলেনঃ ******************** তুমি ‘ঠিকই বলিয়াছ, সত্যই বলিয়াছ’। অতঃপর তিনি উষ্ট্রযানে সওয়ার  হইয়া মদীনার দিকে এমন দ্রুততা সহকারে রওয়ানা হইয়া গেলেন যে, মিসরের তদানীন্তন শাসনকর্তা মুসলিমা ইবনে মাখলাদ তাঁহাকে প্রচুর পরিমাণে উপঢৌকন দেওয়ার আয়োজন করিয়াও তাহা তাঁহাকে দিতে পারিলেন না, সেজন্য তিনি একটু সময়ও বিলম্ব করিতে প্রস্তুত হইলেন না।[বায়হাকী, ইবনে মাজাহ, জামে বায়ানুল ইলম, মুসনাদে আহমদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ******************** আল- হাদীস আল মুহাদ্দীসুন, পৃষ্ঠা ১১০।]

একদা নবী করীম (স) একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তখন দরবারে উপস্থিত হযরত সায়েব ইবনে খাল্লাদ এবং হযরত আকাবা ইবনে আমেরও উহা শ্রবণ করেন। উত্তরকালে হাদীসটি সম্পর্কে হযরত সায়েবের মনে কিছুটা বিস্মৃতি ঘটে, উহার ভাষা সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু হাদীস সম্পর্কে একবিন্দু সন্দেহ মনের মধ্যে পোষণ করা কিছুতেই উচিত নয় মনে করিয়া তিনি মিসরে অবস্থানকারী হযরত আকাবার নিকট উপস্থিত হইয়া হাদীসটি শ্রবণ ও স্বীয় ভ্রম ও সন্দেহের অপনোদন করার জন্য উদ্যোগী হইলেন। প্রথমে তিনি মিসরের শাসনকর্তা মুসলিম ইবনে মাখলাদের নিকট উপস্থিত হইলেন। ইবনে মাখলাদ তাঁহাকে অতিথি হিসাবে পাইয়া বিশেষে সন্তুষ্টি সহকারে অভ্যর্থনা জানাইলেন। কিন্তু হযরত সায়েচ বলিলেনঃ আমি কোথাও বিলম্ব ‘করিতে প্রস্তত নহি, অনতিবিলম্বে আকাবার সহিত সাক্ষাত করা আবশ্যক। পরে তিনি আকাবার নিকট উপস্থিত হন এবং রক্ষিত হাদীসের সাহিত উহার তুলনা করিয়া লইলেন। অতঃপর উহার সঠিক সত্যতা ও ও যথার্থতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হইয়া সান্ত্বনা লাভ করিলেন।[********************]

কুরআন মজীদের কোন আয়াতের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য সম্পর্কে সাহাবীদের মধ্যে মতভেদ হইলে বিশেষজ্ঞের নিকট হইতে উহার মীমাংসা লাভ করিবার উদ্দেশ্যেও দূরদেশে সফর করিতেন। হযরত সায়ীদ ইবনে যুবাইর (রা) বলেনঃ

******************************************************

কুরআনের আয়াতঃ ‘যে লোক কোন মু’মিনকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করিবে, জাহান্নামই তাহার পরিণতি হইবে’- সম্পর্কে কূফাবাসীদের মতভেদ হয়। তাই আমি ইবনে আব্বাসের নিকট চলিয়া গেলাম ও তাঁহাকে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেনঃ ইহা সর্বশেষ নাযিল হওয়া আয়াত । কোন জিনিসই ইহাকে রদ বা বাতিল করিতে পারে নাই।[********************]

হযরত আবুদ-দরদ (রা) বলেনঃ

******************************************************

কুরআনের কোন আয়াত আমার নিকট দুর্বোধ্য হইলে ইহার ব্যাখ্যার জন্য যদি মক্কা হইতে পাঁচ রাত্রি পথ দূরে অবস্থিত এক ব্যক্তির নিকট যাইতে হইতে তবুও আমি তথায় যাইতাম।[********************]

সাহাবায়ে কিরামের একজন দূরবর্তী স্থানে অবস্থানকারী অপর এক সাহাবীর নিকট হইতে পত্রালাপের মাধ্যমেও রাসূলের হাদীস জানিতে ও সংগ্রহ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন।

হযরত মুয়াবিয়া দামেশক হইতে হযরত মুগীরার নিকট কূফা নগরে এক পত্র প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাহাতে লিখিয়াছিলেনঃ

******************************************************

আপনি রাসূলের নিকট যাহা কিছু শুনিতে পাইয়াছেন, তাহা আমাকে লিখিয়া পাঠান।

তখন হযরত মুগীরা লিখিয়া পাঠাইলেনঃ নবী করীম (স) নিম্নোক্ত দোয়া প্রত্যেক নামাযান্তে পড়িতেনঃ

******************************************************

আল্লাহ ছাড়া কেহ মা’বুদ নাই, তিনি এক ও একক। মালিকানা ও বাদশাহী কেবল তাঁহারই, তাঁহারই জন্য সমগ্র প্রশংসা, তিনি সর্বশক্তিমান। হে আল্লাহ ! তুমি যাহা দাও, তাহা কেহ দিতে পারে না। নিছক চেষ্টা করিয়া ইহার বিপরীত কিছু করা সম্ভব নয়। এই সঙ্গে তিনি ইহাও লিখিয়া পাঠাইলেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) অপ্রয়োজনীয় ও অর্থনীন তর্কবিতর্ক করিতে বারবার ও বেশী বেশী প্রশ্ন করিতে ও ধন-সম্পদ বিনষ্ট করিতে নিষেধ করিতেন। তিনি মায়ের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ বা খারাপ ব্যবহার করা এবং কন্যা সন্তানদের গোপনে হত্যা করা হইতেও নিষেধ করিতেন।[এই সমস্ত বিবরণ বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, ১০৮৩ ও ৭ম খণ্ড, ৯৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হইয়াছে।]

খুলাফায়ে রাশেদুন নিজ নিজ খিলাফত আমলে খিলাফতের দায়িত্ব পালন হিসাবে বিভিন্ন স্থানের দায়িত্বশীল লোকদের নিকট প্রয়োজনীয় হাদীস লিখিয়া পাঠাইতেন।

আবূ উসমান বলেনঃ

******************************************************

আমরা উৎবা ইবনে ফারকাদ সেনাপতির সাথে (আজারবাইজান) অবস্থান করিতেছিলাম। তখন হযরত উমর ফারুকের চিঠি আমাদের নিকট (উৎবার নামে) আসিয়া পৌঁছিল। তাহাতে লিখিত ছিলঃ নবী করীম (স) বলিয়াছেন যে, রেশমী কাপড় সেই পুরুষই পড়িতে পারে, যাহার ভাগে পরকালে কিছু নাই।[বুখারী শরীফ, ২ূ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৬৭। ********************]

সাহাবায়ে কিরাম প্রয়োজনের সময় একজন অপরজনকে নিজ হইতেই রাসূল (স)-এর হাদীস লিখিয়া পাঠাইয়া দিতেন। উমর ইবনে উবায়দুল্লাহ যখন হারুরীয়া গমন করেন, তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা (রা) তাঁহাকে লিখিয়া পাঠানঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স) তাঁহার জীবনে কোন একদিন শক্রদলের সহিত মুকাবিলা হওয়ার অপেক্ষায় উদগ্রীব হইয়া বসিয়াছিলেন। শেষ পর্যন্ত সূর্য যখন ঢলিয়া পড়িল, তখন তিনি সংগের লোকদের সম্মুখে দণ্ডয়মান হইলেন। বলিলেনঃ হে লোকগণ ! তোমরা শক্রর সাথে মুকাবিলা ও সাক্ষাতের কামনা করিও না, বরং আল্লাহর নিকট শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া কর। তাহার পরও শক্রর সহিত সাক্ষাত ঘটিলে অপরিসীম ধৈর্য সহকারে সংগ্রাম চালাইয়া যাও। জানিয়া রাখিও, ‘বেহেশত তলোয়ারের ছায়ার তলে অবস্থিত। অতঃপর নবী করীম (স) দাঁড়াইয়া নিম্নোক্ত দোয়া করিলেনঃ

হে আল্লাহ ! কিতাব নাযিলকারী, মেঘ পরিচালনাকারী, শক্র বাহিনীকে পরাজয়দানকারী! তুমি তাহাদিগকে পরাজিত ও পর্যুদস্ত কর এবং আমাদিগকে তাহাদের উপর জয়ী করিয়া দাও।[মুসলিম শরীফ, ২য় খণ্ড, ******************** পৃষ্ঠা ৮৪।]

সাহাবায়ে কিরাম (রা) একজন অপরজনের নিকট হইতে হাদীস জিজ্ঞাসা করিয়া উহার সত্যতা যাচাই করিয়া লইতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) একবার হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় আগমন করেন। তখন তাঁহার নিকট হইতে আয়েশা (রা)-র নিকট পৌঁছায়। পরের বারে হযরত আবদুল্লাহ আবার যখন হজ্জ করিতে আসেন, তখন হযরত আয়েশা (রা) তাঁহার বোন-পুত্র উরওয়াকে বলিলেনঃ

******************************************************

হে বোন-পুত্র! তুমি আবদুল্লাহর নিকট চলিয়া যাও এবং আমার নিকট তুমি তাঁহার নিকট হইতে যে বর্ণনা করিয়াছিলে, আমার জন্য উহা সত্যতা যাচাই করিয়া আস।

উরওয়া বলেন, আমি হযরত আবদুল্লাহর নিকট উপস্থিত হইয়া সেই হাদীসটি পুনরায় শুনিবার ইচ্ছা প্রকাশ করি। তিনি উক্ত হাদীসটি বিগত বৎসর যেইভাবে বর্ণনা করিয়াছিলেন, এইবারও ঠিক সেইরূপেই বর্ণনা করিলেন। আমি হযরত আয়েশার নিকট আসিয়া উহা প্রকাশ করিলে তিনি খুবই আশ্চর্যান্বিত হইয়া যান এবং বলেনঃ

******************************************************

আল্লাহর কসম আবদুল্লাহ ইবনে আমর সঠিকরূপে স্মরণ করিয়া রাখিয়াছেন।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৮৬।]

সাহাবায়ে কিরাম যে হাদীসের জন্য বিদেশ সফর করিতনে এবং উহা শিক্ষালাভ করার জন্য বহু কষ্ট স্বীকার ও তিতিক্ষা অবলম্বন করিতেন, তাহা হযরত ইবনে আব্বাসের নিম্নোক্ত উত্তি হইতেও সুস্পষ্টরূপে জানা যায়। তিনি বলেনঃ

******************************************************

আমাদের নিকট যখন অপর কোন ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস পৌঁছিত, তখন যদি তাহার নিকট লোক পাঠাইয়া তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইতে চাহিতাম যে সে আসিয়া আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করিবে, তবে তাহা আমি অনায়াসেই করিতে পারিতাম। কিন্তু তাহা না করিয়া আমি নিজেই তাঁহার নিকট যাইতাম ও তাঁহার ঘরের সম্মুখে শুইয়া পড়িতাম। সে যখন ঘর হইতে বাহির হইত, তখন সে আমার নিকট উক্ত হাদীস বর্ণনা করিত।[********************]

ইহা হইতে জানা যায় যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা) অপর কোন সাহাবীর বর্ণিত হাদীস লোকমুখে শুনিয়াই সন্তুষ্ট হইতেন না ও সঙ্গে সঙ্গেই উহা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করিয়া লইতেন না। বরং উহা সরাসরি মূল হাদীস বর্ণনাকারীর নিকট হইতেই শ্রবণ করিবার জন্য চেষ্টা করিতেন। এইজন্য তাঁহারা বর্ণনাকারীর ঘরের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইতেন। কিন্তু তাঁহাকে ঘর হইতে ডাকিয়া বাহিরে আনা পছন্দ করিতেন না, বরং তিনি কখন নিজে ঘর হইতে বাহির হইবেন, সেইজন্য অপেক্ষা করিতেন। এই প্রতীক্ষা কত দীর্ঘ হইত তাহার অনুমান ইহা হইতে করা যায় যে, অপেক্ষমান লোকেরা প্রতীক্ষায় থাকিয়া থাকিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িতেন ও ঘরের সম্মুখে ক্লান্ত-শ্রান্ত হইয়া শুইয়া পড়িতেন। হাদীস সঠিকরূপে লাভ করার উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কিরামরে এই তিতিক্ষা সত্যই বিস্ময়কর।

(খ)

তাবেয়ীদের যুগ

সাহাবীদের যুগে হাদীস সংগ্রহ অভিযানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপরে পেশ করা ইহল। এই যুগে হাদীস সংগ্রহ পর্যায়ের যত কাজই সম্পাদিত হয়, উপরিউক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা হইতে সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা অতি সহজেই করা যাইতে পারে। এক কথায় বলা যায় সাহাবীদের যুগে হাদীস সংগ্রহ অভিযান কেবল আরম্ভ করা হইয়াছে, তাবেয়ীদের যুগে এই কাজ অধিকতর উন্নত ও ব্যাপক ভিত্তিতে সাধিত হয়। বিশেষত, তাবেয়ী যুগের হাদীস বর্ণনাকারিগণ কেবল একজনের নিকট কিংবা নিজ শহরে অবস্থানকারী সাহাবীদের নিকট হাদীস শুনিয়াই ক্ষান্ত হইতেন না। এইজন্য তাঁহারা নিকট ও দূরে অবস্থিত বহু শহর-নগর-গ্রম সফর করিতে বাধ্য হইয়াছেণ। ইহাতে তাঁহারা একই হাদীস বহু সংখ্যক মূল বর্ণনাকারীর নিকট হইতে শুনিবার এবং বহু বর্ণনাকারীর নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস শুনিবার ও সংগ্রহ করিবার সুযোগ পাইয়াছেন। ইহার ফলে তাঁহাদের মনে হাদীসের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিত।[********************]

নিম্নে প্রদত্ত বিবরণ হইতে এই যুগের কাজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইংগিত পাওয়া যাইতে পারে।

সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যিব বলেনঃ

******************************************************

কেবল একটি হাদীস লাভ করার উদ্দেশ্যে আমি একাদিক্রমে কয়েকদিন ও কয়েক রাত্রের পথ সফর করিতাম।[********************]

কূফা নগরে অবস্থানরত শ’বী তাবেয়ী একবার সন্তান ও দাস-দাসীকে ইলম শিক্ষাদান ও চরিত্রবান করিয়া তোলার সওয়াব সম্পর্কে এক দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন। হাদীসটির বর্ণনা শেষ করিয়া তাঁহার ছাত্রদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

এই হাদীসটি ভালভাবে গ্রহণ কর, ইহার বিনিময়ে তোমাদের কিছুই দিতে হইবে না, (কোন কষ্ট স্বীকার করিতে হইল না)। যদিও এমন এক সময় ছিল, যখন এক এক ব্যক্তিকে এতদপেক্ষাও অল্প কথার জন্য (ফা হইতে) মদীনা পর্যন্ত সফর করিতে হইত।[******************** মূল হাদীসটি বুখারীর ১ম খণ্ড কিতাবুল ইলম-এ উদ্ধৃত হইয়াছে।]

বুসর ইবনে আবদুল্লাহ হযরামী বলেনঃ

******************************************************

একটি হাদীসের জন্য বিভিন্ন শহর ঘুরিয়া বেড়াইবার প্রয়োজন হইলেও আমরা তাহাই করিতাম।[********************]

এখানে কয়েকজন প্রসিদ্ধ তাবেয়ীর হাদীস সংগ্রহ সাধনার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা যাইতেছেঃ

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী উবায়দুল্লাহ ইবনে আদী জানিতে পারিলেন যে, হযরত আলী (রা)-এর নিকট এমন একটি হাদীস রহিয়াছে, যাহা তিনি নিজে আজ পর্যন্ত খোঁজ করিয়া কোথাও কাহারো নিকট হইতে জানিতে পারেন নাই। তখন তিনি চিন্তা করিলেন যে, অনতিবিলম্বে তাহা জানিয়া না লইলে ও সাধারণ্যে প্রচার না করিলে ইহা হইতে গোটা উম্মতের বঞ্চিত হইয়া যাওয়ার আশংকা রহিয়াছে। এইজন্য তিনি অতি সত্ত্বর হযতর আলী (রা)-এর সহিত সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে ইরাক যাত্রা করিলেন।[********************]

কাসীর ইবনে কায়াস তাবেয়ী বলেনঃ আমরা হযরত আবূদদারদা (রা)-এর সহিত দামেশকের জামে মসজিদে বসিয়াছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁহার সম্মখে উপস্থিত হইয়া বলিলেনঃ হে আবূদদারদা! আমি শুনিয়াছি, আপনি রাসূলের সূত্রে বিশেষ একটি হাদীস বর্ণনা করিয়া থাকেন। আম মদীনা শরীফ হইতে কেবল সেই হাদীটি শ্রবণের উদ্দেশ্যে এই দূর পথ সফর করিয়া আসিয়াছি। হযরত আবূদদারদা (রা) তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ আপনি অন্য কোন উদ্দেশ্যে, কোন ব্যবসায়-বাণিজ্যের কাজের জন্য এখানে আসেন নাই তো? বহিরাগত লোকটি বলিলেন, না অন্য কোন উদ্দেশ্যেই আমার এই আগমন হয় নাই। তখন হযরত আবূদদারদা (রা) নিম্নলিখিত হাদীসটি তাঁহার নিকট বর্ণনা করেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, যে ব্যক্তি ইলমের সন্ধানে কোন পথ চলিবে, আল্লাহ তাহার জন্য বেহেশতের অসংখ্য পথের কোন একটি পথ সুগম ও সহজতর করিয়া দিবেন। বস্তুত ফেরেশতাগণ জ্ঞানানুসন্ধানীর সন্তুষ্টির জন্য তাঁহাদের পক্ষ বিছাইয়া দেন এবং জ্ঞান-সন্ধানীর জন্য আসমান যমীনের সবকিছু-  এমন কি পানির তলার মাছও আল্লাহর নিকট গুনাহ মাফের দোয়া করিয়া থাকে। পরন্তু আবিদ অপেক্ষা আলিমের মর্যাদা এত বেশী, যেমন চন্দ্রের প্রাধান্য সমগ্র নক্ষত্রের উপর। আলিমদের মধ্যে হইতেই নবীদের উত্তরাধিকারী হইয়া থাকেন। নবীগণ কখনো টাকা-পয়সা মিরাসী সম্পদ হিসাবে রাখিয়া যান না। তাঁহারা কেবল ইলম ও জ্ঞানই রাখিয়া যান। অতএব যে তাহা গ্রহণ করিবেন। সে তাহার অংশ লাভ করিবে কিংবা (বলিয়াছেন) সে পূর্ণ ও বিপূল অংশ পাইবে।[হাদীসটি মুসনাদে আহমদ, আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ প্রভৃতি সহীহ গ্রন্হে উল্লিখিত হইয়াছে। যদিও উহাদের শব্দ ও ভাষায় পারস্পরিক পার্থক্য রহিয়াছে। এখানে সুনানে দারেমীর বর্ণিত ভাষা উদ্ধৃত করা হইয়াছে।]

বসর ইবনে উবায়দুল্লাহর একটি কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেনঃ ‘আমি কেবল একটি হাদীসের জন্য অসংখ্য শহর ও নগর আতিঁপাতি করিয়া খুঁজিয়া বেড়াইয়াছি।[দারেমী পৃষ্ঠা ৭৪।]

আবূল আলীয়া তবেয়ী বলেনঃ

******************************************************

আমরা (বসরায় থাকিয়া) মদীনায় অবস্থিত সাহাবীদের বর্ণিত হাদীস (লোক মারফত) শুনিতে পাইতাম; কিন্তু মদীনায় অব্স্থানকারী হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর নিজ মুখে উহা শুনিয়া লওয়ার পূর্বে আমরা কিছুতেই সান্তনা পাইতাম না (এবং অপরের নিকট তাহা বর্ণনা ও করিতাম না)।[দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৪।]

আবূ কালাবা (আবদুল্লাহ ইবনে যায়দ আল জুরামী আল বসরী) বলেনঃ

******************************************************

আমি মদীনায় তিন (দিন বা মাস বা বৎসর) অবস্থান করিয়াছি কেবল এই অপেক্ষায় যে, একজন লোকের নিকট একটি হাদীস রহিয়াছে। সে আসিবে ও তাহার নিকট হইতে আমি তাহা শুনিব।[********************]

তাবেয়ী মুহাদ্দিস মকহুল (আবূ আবদুল্লাহ ইবনে আবূ মুসলিম) একটি হাদীসের জন্য মিসর হইতে হিজাজ, হিজাজ হইতে ইরাক, ইরাক হইতে সিরিয়া সফর করেন এব সেখানেই তিনি প্রার্থীত হাদীসটি শুনিতে পান।[********************]

মোটকথা, তাবেয়ী যুগের হাদীস-সন্ধানীদের সাধনা, পারস্পরিক সাক্ষাত ও হাদীস সংগ্রহের জন্য অবিশ্রান্ত দেশ ভ্রমণের ফলে বিপুল সংখ্যক হাদীসের প্রচার ও প্রসার লাভ সম্ভব হয়। সাহাবাগণ মুসলিম জাহানের বিভিন্ন শহরে ও বিভিন্ন স্থানের বিক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন, তাঁহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে থাকিয়া হাদীসের প্রচার ও শিক্ষাদান করিতেন। তাঁহাদেরই ছাত্র তাবেয়িগন হাদীস সংগ্রহর উদ্দেশ্যে শঞর হইতে শহরান্তরে, দেশ হইতে দেশান্তরে যাতায়াত করিতেন এবং বিভিন্ন সাহাবীর নিকট হইতে বিভিন্ন হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিতেন; কিংবা একই হাদীস বিভিন্ন সাহাবীর নিকট হইতে শ্রবণ করিতেন। ফলে হাদীস সম্পদ সামগ্রিকভাবে বিরাট ও বিপুল আকার ধারণ করে।

দৃষ্টান্তরূপে বলা যায়, হযরত আমর ইবনুল আস (রা) মিসরে অবস্থান করিতেন এবং সেখানকার লোকদের নিকটই তিনি রাসূলের কথা, কাজও সমর্থনের বিবরণ পেশ করিতেন। রাসূলে করীম  ও খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলের আদালতী বিচার ফয়সালা সমূহের বর্ণনা করিতেন। ফলে ইসলামী জ্ঞানের এই সব অমূল্য সম্পদ কেবল স্থানীয় লোকগণই লাভ করিতে পারিতেন। কিন্তু তাবেয়ী যুগে যখন মিসরের এই লোকগণই দামেখক, কূফা, বসরা, মদীনা ও অন্যান্য হাদীসকেন্দ্র ও সাহাবীদের আবাসস্থালে পৌঁছিয়া হাদীস সংগ্রহ করিতে শুরু করিলেন, তখন তাঁহাদের হাদীস-জ্ঞান অত্যন্ত ব্যাপক ও প্রশস্ত হইয়া পড়ে। যেসব তাবেয়ী পূর্বে একটি হাদীস কেবল একই সাহাবীর সূত্রে বর্ণনা করিতেন, এক্ষণে তাহাই তাঁহারা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করিতে সক্ষম হন। ইলমে হাদীসের দৃষ্টিতে তাবেয়ীদের এই দেশ-বিদেশ ভ্রমণের পর্যালোচনা করিলে ইহার গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। বস্তুত তাবেয়ীদের যুগে এই হাদীস-সংগ্রহ অভিযান সম্পাদিত না হইলে বহু হাদীসই যে বিস্মৃতির অতল গভীরে বিলুপ্ত হইয়া যাইত এবং সাধারণের জ্ঞান পরিধির বাহিরেই পড়িয়া থাকিত তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই।

প্রসংগত উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, তাবেয়ীদের এই হাদীস সংগ্রহ অভিযানের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হইয়াছে পরবর্তীকালের হাদীসগ্রন্হ সংকলনের উপর। কেননা, যেসব হাদীস গ্রন্হ সংকলক কেবল নিজ শহরে প্রচারিত হাদীসেরই সংকলন করিয়াছেন, অন্যান্য হাদীসকেন্দ্রে গমন করিয়া- দেশ-দেশান্তর ভ্রমণ করিয়া হাদীস সংগ্রহ করেন নাই, তাঁহাদের সংকলনের কোনই মূল্য জনসমাজে স্বীকৃত হয় নাই। উপরন্তু তাঁহাদিগকে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

সে প্রকৃত হিদায়াতের পথ-ভ্রান্ত এবং হিদায়ত ও সত্যতার পথের যৌক্তিকতা প্রমাণে সে ব্যর্থ-অসমর্থ।[********************]

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইয়াইয়া ইবনে মুয়ীন বলিয়াছেনঃ

******************************************************

চারজন লোকের নিকট হইতে প্রকৃত হিদায়াতের আশা করা যায় না। তাহারা হইলঃ সূক্ষ্ণ শিল্প দক্ষতার পাহারাদার, বিচারকের ঘোষণাকারী, বিদয়াতীর পুত্র এবং যে ব্যক্তি হাদীসের সন্ধানে বিদেশ সফর করেন না, কেবল নিজ শহরে পাওয়া হাদীসই সংকলন করে।[********************]

অথচ ঐ যুগের যানবাহন ও যাতায়াত পথ ছিল অত্যন্ত দুষ্কর, দূরধিগম্য এবং বিপদসংকুল। অশ্ব কিংবা উষ্ট্রের পৃষ্ঠা আরোহণ করিয়া তাঁহাদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি পর্বতসংকুল ও দূরধিগম্য অরণ্য পথ অতিক্রম করিতে হইত এবং তাঁহাদের এই ভ্রমন চলিত রাতের পর রাত, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর ধরিয়া। এই পরিশ্রম যে কতদূর কষ্টসাধ্য ছিল, তাহা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এই কষ্ট ও দুঃখ তাঁহাদের নিকট চিল একান্তই নগণ্য। এতদূর অমানুষিক কষ্ট স্বীকার করার পর তাঁহারা যে হাদীস সম্পদ লাভ করিতেন, তাহাই তাঁহাদের হৃদয়ে নির্মল আনন্দের বন্যা প্রবাহিত করিয়া দিত, আর তাঁহাদের জীবন ইহাতেই সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হইত। প্রকৃতপক্ষে ইহা ছিল বিশ্ব মুসলিমের প্রতি তাঁহাদের এক অপূর্ব কল্যাণময় অবদান। বিশ্বের মুসলমান তাঁহাদের এই অবদান কোনদিনই বিস্মৃত হইতে পারে না।

(গ)

তাবে-তাবেয়ীদের যুগ

তাবেয়ী যুগে হাদীস সংগ্রহের যে অভিযান আরম্ভ হয়, তাহা পরবর্তী দুই-তিন শতাব্দী পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে চলিতে থাকে। তাবে-তাবেয়ীনের যুগে ইহার প্রয়োজন যেমন কিছুমাত্র হ্রাস পায় নাই, তেমনি এই অভিযান কিছু মাত্র ক্ষীণ ও ব্যাহতও হয় নাই। বরং আমরা দেখিতে পাই, তাবে-তাবেয়ীনের পর্যায়ে এই অভিযান পূর্বপেক্ষাও ব্যাপকতর রূপ লাভ করে। তাবেয়ীনের পর তাঁহাদেরই লালিত ও তৈরী করা তাবে-তাবেয়ীদের জামাআত এই মহন ব্রত পূর্ণ মাত্রায় নিজেদের স্কন্ধে গ্রহণ করেন এবং নিজেদের সময়ের অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া এই কঠিন দয়িত্ব পালনে ব্রতী হন। এই পথে পূর্ববর্তীদের ন্যায় তাঁহাদেরও অপরিসীম দুঃখ ও কষ্ট স্বীকার করিতে হইয়াছে।

তাবে-তাবেয়ীনের যুগে সন-তারিখের দৃষ্টিতে নির্ধারণ করা কঠিন, যেমন কঠিন তাবেয়ীনের যুগ নির্ধারণ। ঠিক কখন, কত সনে তাঁহাদের যুগের সূচনা এবং কবে তাহার সমাপ্তি, তাহা সুস্পষ্ট করিয়া বলা বাস্তবিকই সম্ভব নয়। কোন কোন ঘটনা ও নিদর্শনের আলোকে বলা যায় যে, নবী করীম (স)-এর যুগেই তাবেয়ীনের যুগ সূচিত হইয়াছিল। কেননা এই যুগে এমন কিছু মহান লোকের সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁহারা নিজেদের চক্ষে রাসূলে করীমের চেহারা মুবারক দর্শন করিতে না পারিলেও ইসলামের দাওয়াত যখনই তাঁহাদের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছে, তখনই তাঁহারা অকৃত্রিম আন্তরিকতা সহকারে তাহা কবুল করিয়াছেন। ওয়ায়েস করনী ও আবিসিনিয়ার বাদশাহ আসহামার নাম এই পর্যায়ে উল্লেখ করা যায়। ফলে একথা বলা যায় যে, প্রায় এক শতাব্দী কাল পর্যন্ত সাহাবাদের যুগ ও তাবেয়ীদের যুগ একই সঙ্গে পাশাপাশি অতিবাহিত হইয়াছে। কিন্তু প্রথম হিজরী শতকের সমাপ্তিতে এই যুগেরও সমাপ্তি হইয়া যায়। তখন তখনই তাবেয়ীদের লালিত, দীক্ষিত ও তৈরী করা লোকদের অর্থাৎ তাবে-তাবেয়ীনের যুগ আরম্ভ হইয়া যায়। কিন্তু তাবেয়ীনের যুগ তখনও শেষ হইয়া যায় নাই। বরং তাবে-তাবেয়ীনের যুগের সঙ্গে সঙ্গে তাহাও চলিতে থাকে এবং প্রায় তিন-চতুর্থাংশ শতাব্দীকাল পর্যন্ত একই সঙ্গে অতিবাহিত হইতে থাকে।

অনুরূপভাবে তাবে-তাবেয়ীনের যুগ ঠিক কখন শুরু হইল এবং কখন শেষ হইয়া গেল, সন-তারিখের ভিত্তিতে তাহা বলা কঠিন। কিন্তু কোন কোন তাবে-তাবেয়ীর জন্ম তারিখ ও কোন কোন তাবেয়ীর মৃত্যু সনের ভিত্তিতে বলা যায় যে, প্রথম হিজরী শতকের শেষভাগ হইতেই এই যুগের সূচনা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ইমাম শো’বা’র জন্ম হয় ৮০ হিজরী সনে, ইমাম আবূ হানীফাও এই সনেই জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু সকল জীবনী রচয়িতাই ইমাম শো’বাকে তাবে-তাবেয়ীন ও ইমাম আবূ হানীফাকে তাবেয়ীনের মধ্যে গণ্য করিয়া থাকেন। এতদসত্ত্বেও প্রকৃত কথা এই যে, তাবে-তাবেয়ীনের আসল যুগ দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম চতুর্থাংশে সূচিত হইয়া তৃতীয় শতকের প্রথম চতুর্থাংশ পর্যন্ত শেষ হইয়া যায়। কেননা অনেক তাবেয়ী’ই ১৬৪ হিজরী হইতে ১৭৪ সনে ইন্তেকাল করেন। অন্য কথায় বলা যায়, উমাইয়া বংশের খলীফা দ্বিতীয় ওলীদের সময় হইতে আব্বাসী বংশের দশম খলীফা মুতাওয়াক্কিলের সময় পর্যন্ত তাবে-তাবেয়ীনের যুগ বর্তমান ছিল।

পূর্বেই বলিয়াছি, এই যুগের হাদীসের চর্চা, প্রচার ও সংগ্রহ পূর্বাপেক্ষাও অধিক ব্যাপক ও গভীরভাবে চলে। এই যুগে যাঁহারা ইলমে হাদীসে সর্বাধিক বুৎপত্তি  এবং খ্যাতি অর্জন করেন, তাঁহাদের মধ্যে নিম্নোক্ত লোকগণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ

(১) ইমাম আবূ হানীফা (২) ইমাম মালিক (৩) ইমাম আবূ ইউসুফ (৪) ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী (৫) ইমাম আওযায়ী (৬) ইমাম ইবনে জুরাইজ (৭) ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় (৮) ইমাম সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (৯) আবদুল্লাহ ইবেন মুবারক (১০) ইমাম শু’বা (১১) মুসয়ের ইবনে কুদাম (১২) আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব (১৩) ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (১৪) আলী ইবনে মাদানী (১৫) ইমাম লাইস ইবনে সায়াদ (১৬) হযরত ফুযাইল ইবনে আয়াজ এবং (১৭) ইয়াহইয়া ইবনে আদাম (র)।

আমরা এখানে তাঁহাদের মধ্যে প্রধান কয়েকজনের হাদীস সাধনা ও সংগ্রহ অভিযান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিব।

ইমাম আবূ হানীফা (র)

ইমাম আবূ হানীফা (র) তাবেয়ী ছিলেন, কি তাবে-তাবেয়ী তাহা লইয়া যথেষ্ট মতভেদের সৃষ্টি হইয়াছে। ইমাম আবূ হানীফা যেহেতু কোন সাহাবী হইতেই হাদীস বর্ণনা করেন নাই- বর্ণনা করিয়াছেন বলিয়া যে সব হাদীসের কথা কোন কোন মহল হইতে প্রচার করা হইয়াছে তাহা যেহেতু অপ্রমাণিত এবং ইলমে হাদীসের কষ্টিপাথরে তাহা অনুত্তীর্ণ- এই কারণে কোন কোন ঐতিহাসিক তাঁহাকে ‘তাবেয়ী’ মানিয়া লইতেও অস্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে একথা জোর করিয়া বলা যায় যে, ইমাম আবূ হানীফা (র) সাহাবাদের দর্শন লাভ করিয়াছেন। কেননা ইমাম আবূ হানিফা ৮০ হিজরী সনে কূফা নগরে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। [********************] এই সময় তথায় রাসূলের সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা (রা) জীবিত ছিলেন। তিনি ৮১ হিজরী কিংবা উহার পরে ইন্তেকাল করেন। ইবনে আবদুল বার-এর বর্ণনাতে তিনি ইন্তেকাল করিয়াছেন ৮৭ হিজরী সনে। [********************] ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদ লিখিয়াছেনঃ ইমাম আবূ হানীফা (র) হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা)-কে দেখিয়াছেন। কেননা তিনি বসরা নগরে ৯১ হিজরী সনে, আর ইবনে আবদুল বার-এর মতে ৯৯ হিজরী সনে ইন্তেকাল করিয়াছেন।[********************]

এতদ্ব্যতীত হযরত সহল ইবনে সায়াদ সায়েদী মদীনায় এবং হযরত আবুত্তোফাইল, আমের ইবনে ওয়াসিল মক্কানগরে বসবার করিতেছিলেন। সুতরাং ইমাম আবূ হানীফার পক্ষে কোন সাহাবীর দর্শন লাভ করা অসম্ভব বলা যায় না।[********************]

মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা লেখক আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী প্রদত্ত ফতোয়ার ভিত্তিতে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র) সাহাবাদের এক জামাআতকে দেখিতে পাইয়াছেন, যাঁহারা কূফা নগরে থাকিতেন, যখন তিনি ৮০ হিজরী সনে তথায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাহার সহযোগী সিরিয়ার আওযায়ী, বসরার হাম্মাদ ইবনে সালমা ও হাম্মাদ ইবনে যায়দ, কূফার সুফিয়ান সওরী, মদীনার মালিক এবং মিসরের লাইস ইবনে সায়াদ প্রমুখ ইমাম এই মর্যাদা লাভ করেন নাই। (তাঁহাদের কেহই তাবেয়ী নহেন)।[********************]

ইবনে হাজার মক্কী মিশকাতের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আ’জম আবূ হানীফা আটজন সাহাবীর সাক্ষাত পাইয়াছেন। তন্মধ্যে হযরত আনাস ইবনে মালিক, আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা, সহল ইবনে সায়াদ এবং আবূত্তোফাইল (রা) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[********************]

আল্লামা আলাউদ্দীন ‘দূররুল মুখতার’ গ্রন্হের ভূমিকায় লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

বয়সের হিসাবে তিনি প্রায় বিশজন সাহাবীকে পাইয়াছেন।[********************]

‘মুনিয়াতুল মুফতী’ গ্রন্হর উদ্ধৃতি দিয়া তিনি আরো লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা সাতজন সাহাবীর নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন ইহা প্রমাণিত সত্য।[********************]

এই সব উদ্ধৃতির ভিত্তিতে বলা যায়, ইমাম আবূ হানীফা (র) তাবেয়ী ছিলেন।

আল্লামা ইবনে আবেদীন লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সবদিকেরই বিচারে ইমাম আবূ হানীফা তাবেয়ী ছিলেন। মুহাদ্দিস যাহবী ও মুহাদ্দিস আসকালানী ইহা দৃঢ়তা সহকারেই ঘোষণা করিয়াছিলেন।[********************]

অবশ্য একালের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা শাহ আনওয়ার কাশ্মীরী (র) ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি সাক্ষাত লাভের দিক দিয়া তাবেয়ী ছিলেন এবং তাবে-তাবেয়ীন ছিলেন হাদীস বর্ণনার দিক দিয়া।[********************]

ইমাম আবূ হানীফা যখন হাদীস শিক্ষার জন্য উদ্যোগী হন, তখন সমগ্র মুসলিম জাহান হাদীস চর্চায় মুখরিত ছিল। প্রত্যেক শহর ও জনপদে হাদীস বর্ণনার বড় বড় দরবার কায়েম হইয়াছিল। প্রায় দশ হাজার সাহাবী সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন এবং তাঁহাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কয়েক লক্ষ পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল। যেসব শহরে সাহাবী কিংবা তাবেয়ী অবস্থান করিতেন, উহাকে ‘দারুল-উলুম’ (বিদ্যালয়) বলিয়া অভিহিত করা হইত।[********************]

এই সময় ইমাম আবূ হানীফা (র) প্রথমে কূফা নগরে বড় তাবেয়ী হাদীসবিদদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করেন। ইমাম শাফেয়ী লিখিয়াছেনঃ ‘ইমাম আবূ হানীফা কূফা নগরের ৯৩ জন মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিখিয়াছেন। আর ইমাম যাহরীর বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, কুফা নগরে ইমাম আবূ হানীফার হাদীসের ওস্তাদ ছিলেন ২৯ জন। তাঁহাদের অধিকাংশই ছিলেন বড় বড় তাবেয়ী। তাঁহাদের মধ্যে ইমাম শা’বী, সালমা ইবনে কুহাইল, মুহারিব ইবনে দিসার, আবূ ইসহাক সাবয়ী, আওন ইবনে আবদুল্লাহ, সামাক ইবনে হারব, আমর ইবনে মুবরা, মনসুর ইবনে মা’মর, আ’মশ ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মদ, আদী ইবনে মারসাদ প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহাদের নিকট হইতে ইমাম আবূ হানীফা (র) বিপুল সংখ্যক হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন।

অতঃপর তিনি আরো হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বসরা গমন করেন। এই সময় ইমাম হাসান বসরী, শু’বা, কাতাদাহ প্রমুখ বড় বড় তাবেয়ী মুহাদ্দিসের প্রচারিত হাদীসের জ্ঞানে বসরা নগরী কানায় কানায় ভরপুর ছিল।

ইহার পর তিনি মক্কা ও মদীনা গমন করেন। এখানে তখন হাদীসের শিক্ষা ব্যাপকভাবে চলিতেছিল। সাহাবীদের সংস্পর্শে ও লক্ষ্য-যত্নে লালিত ও শিক্ষাপ্রাপ্ত কয়েকজন বড় বড় তাবেয়ী স্বতন্ত্রভাবে বহু সংখ্যক হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করিয়াছিলেন। আতা ইবনে আবূ রিবাহ ও ইকারামা প্রমুখ তাহাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মনীষী। এই পর্যায়ে মুহাদ্দিস যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা মক্কা শরীফে আতা ইবনে আবূ রিবাহ’র নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও শিক্ষা করেন।[********************]

মদীনায় ইমাম বাকের তখন অবস্থান করিতেছিলেন। ইমাম আবূ হানীফা (র) তাঁহার দারবারেও কেবল হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যেই উপস্থিত হইয়াছিলেন।

মোটকথা ইমাম আবূ হানীফা (র) তদানীন্তন বিশাল মুসলিম জাহানের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত হাদীস-কেন্দ্রসমূহের সর্বমোট প্রায় চার সহস্র মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছেন, আবূ হাফস কবীর এই কথা দাবি করিয়াছেন। ইলমে হাদীসের কষ্টিপাথরে তাঁহার এই দাবি উত্তীর্ণ ও সম্পূর্ণ নির্ভূল প্রমাণিত না হইলেও একথা জোর করিয়াই বলা যায় যে, তাঁহার হাদীস শিক্ষার ওস্তাদের সংখ্যা ছিল বিপুল। ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ গ্রন্হে ইমাম যাহবী ইমাম আবূ হানীফার ওস্তাদের নাম উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ত্রতদ্ব্যতীত আরো বিপুল সংখ্যক মুহাদ্দীসই তাঁহার ওস্তাদ ছিলেন।

হাফেয মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ সালেহী শাফেয়ী বলেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা হাদীসের বড় বড় হাফেয ও গুরুদের মদ্যে গণ্য। তিনি যদি হাদীসের প্রতি খুব বেশী মনোযোগী না হইতেন ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন না হইতেন, তাহা হইলে ফিকাহর মাসালা মাসায়েল বাহির করা তাঁহার পক্ষে কখনই সম্ভব হইত না।[********************]

শায়খুল ইসলাম ইয়াজীদ ইবনে হারুন বলেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা অত্যন্ত মুত্তাকী, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন গুণসম্পন্ন সাধক, আলিম, সত্যবাদী ও সমসাময়িককালের সকলের অপেক্ষা হাদীসের বড় হাফেয ছিলেন।[********************এই গ্রন্হের পাণ্ডুলিপি করাচী ‘মজলিসে ইলমী’ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।]

ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাতান বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহর শপথ, আবূ হানীফা বর্তমান মুসলিম উম্মতের মধ্যে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীস ও সুন্নত সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বেশী বিজ্ঞ ও জ্ঞানী।[********************]

মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীনকে যখনই ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইত, তখনই তিনি বলিতেনঃ

******************************************************

তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, ভূল-ভ্রান্তিমূক্ত। হাদীসের ব্যপারে কেহ তাঁহাকে ‘দুর্বল’ বা অগ্রহণযোগ্য বলিয়াছেন বলিয়া আমি শুনি নাই।[********************]

তিনি আরো বলিতেনঃ

******************************************************

আবূ হানীফা দ্বীনদার, বিশ্বস্ত , সত্যবাদী ও নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ছিলেন। কেহ তাঁহাকে মিথ্যা বর্ণনা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন নাই। তিনি আল্লাহর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং হাদীস বর্ণনায় পূর্ণ সত্যবাদী ছিলেন।[********************]

বলখের ইমাম ইবনে আইয়ূব সত্যই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

প্রকৃত ইলম আল্লাহর নিকট হইতে মুহাম্মদ (স)-এর নিকট পৌঁছিয়াছে। তাঁহার পর তাঁহার সাহাবিগণ উহা লাভ করিয়াছেন। সাহাবীদের নিকট হইতে পাইয়াছেন তাবেয়িগণ। আর তাবেয়িগণের নিকট হইতে উহা কেন্দ্রীভূত ও পরিণত হইয়াছে ইমাম আবূ হানীফাতে।[********************]

হাফেয আবূ নয়ীম ইসফাহানী ইয়াহইয়া ইবনে নসর ইবনে হাজেব- এর সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি আবূ হানীফার নিকট একটা ঘরে উপস্থিত হইলাম, যাহা কিতাবে ভর্তি হইয়াছিল। জিজ্ঞাসা করিলামঃ এই কিতাবগুলি কিসের? বলিলেনঃ এই সবই হাদীসের কিতাব। ইহার সামান্য অংশই আমি বর্ণনা করিয়াছি মাত্র, যাহা হইতে লোকেরা যথেষ্ট উপকৃত হইতেছে।[********************]

ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীনের আর একটি কথাও উল্লেখযোগ্য। বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ হানিফা খুবই নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি নিজের মুখস্থ ও সুরক্ষিত হাদীসই বর্ণনা করিতেন। যাহা তাঁহার মুখস্থ নাই, তাহা তিনি কখনো বর্ণনা করিতেন না।[********************]

দ্বিতীয় এই যে, হাদীসের বিরাট সম্পদ বক্ষে ধারণ করার পর উহার শাব্দিক বর্ণনা তিনি কম করিয়াছেন, কেবল হাদীস শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে মজলিস অনুষ্ঠান তিনি বড় একটা করেন নাই, বরং তিনি হাদীসের নিগূঢ় অর্থ উদঘাটন ও উহা হএত মুসলমানদের ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রয়েজনীয় মাসলা-মাসায়েল বাহির করার কাজেই সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন।[********************]

কিন্তু তাই বলিয়া তিনি হাদীস সন্ধান ও সংগ্রহের কাজ বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন তাহাও নয়। বরং নিত্য নূতন হাদীসের সন্ধান লাভ করিয়া অধিকতর সমৃদ্ধ হইবার জন্য তিনি সবসময়ই চেষ্টিত ও যত্ববান হইয়াছিলেন। ইমাম নযর ইবনে মুহাম্মদ মারওয়াজী ইমাম আবূ হানীফার একজন বিশিষ্ট ও প্রখ্যাত ছাত্র। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি ইমাম আবূ হানীফার অধিক কাহাকেও হাদীস সন্ধানে উৎসাহী ও মনোযোগী দেখিতে পাই নাই। একবার ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল আনসারী, হিশাম ইবনে উরওয়া ও সায়ীদ ইবনে আবূ আরুবা আগমন করিলেন। তখন ইমাম আবূ হানীফা আমাদিগকে বলিলেনঃ যাইয়া দেখ, এই লোকদের নিকট হাদীসের এমন কোন সম্পদ আছে কিনা, যাহা আমি তাঁহাদের নিকট হইতে শুনিয়া লইতে পারি।[********************]

ইমাম আজমের অপর এক শাগরিদ হইতেছেন মুহাদ্দিস আবদুল আযীয ইবনে আবূ রাজামা। তিনিও প্রায় এই রূপ কথাই বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

একজন মুহাদ্দিস কূফায় আগমন করিলে ইমাম আবূ হানীফা তাঁহার ছাত্র-সঙ্গীদের বলিলেনঃ তোমরা তাঁহার নিকট যাইয়া দেখ, আমাদের নিকট নাই এমন কোন হাদীস তাঁহার নিকট আছে নাকি?

আবদুল আজীজ বলেনঃ আরো একবার একজন মুহাদ্দিস আসিলে ইমাম আবূ হানীফা তাঁহার ছাত্রদিগকে এইরূপ বলিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।[********************]

উপরিউক্ত বর্ণনা দুইটি হইতে ইমাম আবূ হানীফার হাদীস সন্ধানপ্রিয়তা স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। তাই হাদীসের ব্যাপারে তিনি অমনোযোগী ছিলেন, এরূপ কথা অর্বাচীনই বলিতে পারে।

তিনি হাদীস পরিত্যাগ করিয়া কেবল কিয়াস ও বুদ্ধি প্রয়োগের সাহায্যেই মাসালার রায় দিতেন বলিয়া যে অভিযোগ করা হইয়াছে, তাহা সর্বৈব মিথ্যা। মাসালার রায় দেওয়ার ব্যাপারে তাঁহার নীতি কি ছিল,  তাহা তাঁহার নিম্নোক্ত উক্তি হইতেই সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। তিনি নিজেই নিজের সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি প্রথমে আল্লাহর কিতাবকেই ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করি, যখন তাহাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফয়সালা পাই, তখন সেই অনুযায়ীই রায় দেই। তাহাতে যদি না পাই, তবে অতঃপর রাসূলের সুন্নাত ও বিশুদ্ধ কার্যবিবরণী- যাহা নির্ভরযোগ্য লোকদের মারফতে প্রচারিত হইয়াছে- গ্রহণ করি। কিন্তু আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতেও যদি তাহা না পাই, তবে তখন কাহারো কথা ছাড়িয়া দেই।[********************]

কিয়াস ও সাধারণ বুদ্ধির বিপরীত হইলেও তিনি যে হাদীসকেই গ্রহণ করিতেন এবং প্রমাণিত হাদীস অনুযায়ী আমলন করিতেন, তাহার প্রমাণ এই যে, কুরয়া দ্বারা কর্তব্য নির্ধারণ করাকে তিনি জায়েয মনে করিতেন, যদিও বাহ্যদৃষ্টিতে উহা জুয়ার সমান।

তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কিয়াস অনুযায়ী কুরয়া জায়েয হওয়া উচিত নয়, কিন্তু উহার জায়েয হওয়া সম্পর্কে যে হাদীস ও সুন্নাত প্রমাণিত হইয়াছে, কিয়াস ত্যাগ করিয়া আমি তাহাই মানিয়া লইতেছি।[********************]

তিনি হাদীস গ্রহণে যে কঠোর শর্ত ও কড়াকড়ি আরোপ করিয়াছেন ইহা আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বস্তুতই অপরিহার্য ছিল। কেননা ইমাম আবূ হানীফার যুগে বিভিন্ন প্রকারের ভ্রান্ত আকীদা ও এক শ্রেণীর মানুষের মনগড়াভাবে রচিত মিথ্যা হাদীস ব্যাপকভাবে প্রচারিত হইয়াছিল। এই সময় তিনি যদি বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন না করিতেন, যদি হাদসি নামে কথিত ভূল-শুদ্ধ নির্বিচারে সব কথাই মানিয়া লইতেন, তাহা হইলে আল্লাহর দ্বীন নির্ভূলভাবে রক্ষিত হইতে পারিত না। প্রকৃতপক্ষে ইহা তাঁহার অপরিসীস তাকওয়া ও দ্বীনের প্রতি ঐকান্তিক অকৃত্রিম বিশ্বাস ও ভালবাসারই ফল, ইহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।[********************]

হাদীস গ্রহণে ইমাম আবূ হানীফার শর্ত

ইমাম আবূ হানীফা (র) হাদীস গ্রহণে যেসব শর্ত আরোপ করিয়াছেন, তাহার অধিকাংশই সাধারণ মুহাদ্দিস র্তৃক আরোপিত শর্ত। কিন্তু কতকগুলি শর্ত তিনি নিজে বিশেষভাবে ও বিশেষ বিশেষ কারণে অতিরিক্ত আরোপ করিয়াছেন। এখানে তন্মধ্যে কয়েকটি শর্তের উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১.  কোন হাদীস বর্ণনা করার পর বর্ণনাকারী যদি তাহা ভুলিয়া যায়, তবে সাধারণ মুহাদ্দিসদের নিকট তাহা গ্রহণীয় হইলেও ইমাম আবূ হানীফা এবং তাঁহার শাগরিদগণ তাহা গ্রহণ করিতে রাযী নহেন।[********************]

২. কেবল সেই হাদীসই গ্রহণযোগ্য, যাহ বর্ণনাকারী স্বীয় স্মরণ ও স্মৃতিশক্তি অনুসারে বর্ণনা করিবেন।[ঐ]

৩. যেসব প্রখ্যাত মুহাদ্দিসের মজলিসে বিপুল সংখ্যক শ্রবণকারীর সমাবেশ হওয়ার কারণে উচ্চ শব্দকারী লোক নিয়োগ করা হয় এবং তাহাদের নিকট শ্রুত হাদীসকে আসল মুহাদ্দিসের নিকট শ্রুত হাদীস বলিয়া বর্ণনা করা হয়, ইমাম আবূ হানীফার নিকট সেই হাদীস গ্রহণযোগ্য নহে। হাফেয আবূ নয়ীম, ফযল ইবনে আকীন, ইবনে কুদামাহ প্রমুখ প্রখ্যাত মুহাদ্দিসও এই মত পোষণ করেন। হাফেয ইবনে হাজার মক্কীর মতে ইহা বিবেকসম্মত কথা হইলেও সাধারণ মুহাদ্দিসের মতই সহজসাধ্য।[********************]

৪. যে বর্ণনাকারী নিজের খাতায় লিখিত পাইয়া কোন হাদীস বর্ণনা করেন, কিন্তু তাহা তাহার কোন উস্তাদ মুহাদ্দিসের নিকট হইতে শুনিয়াছেন বলিয়া স্মরণে পড়ে না, ইমাম আবূ হানীফা এই ধরনের হাদীস সমর্থন করেন না। অপরাপর মুহাদ্দিসের মতে ইহাতে কোন দোষ নাই।[********************]

কূফাবাসী মুহাদ্দিসগণ হাদীসের মূল বক্তব্যকে নিজ ভাষায় বর্ণনা (********************) করা জায়েয মনে করিতেন। আর ইহাই ছিল তখন সাধারণভাবে প্রচলিত রীতি। হাদীসের মূল শব্দ বর্ণনাকারীদের সংখ্যা বেশী ছিল না। ফলে হাদীসের বর্ণনায় পার্থক্য ও রদ-বদল হইয়া যাওয়ার আশংকা পূর্ণমাত্রায় বর্তমান ছিল। ইমাম আবূ হানীফা ইহার ফলে হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে কঠোর কড়াকড়ি নীতি অবলম্বন করিতে বাধ্য হন। এতসব সতর্কতার পর তিনি যে হাদীসের গ্রন্হ সংকলন করিয়াছিলেন, তাহা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ আল খাওয়ারিজমী ইমাম আবূ হানীফার পনেরখানা মুসনাদ (সংকলিত হাদীস গ্রন্হ ) সংগ্রহ করিয়াছিলেন।[********************]

ইমাম মালিক ইবনে আনাস (র)

ইমাম মালিক মদীনাতুর-রাসূলের সর্বাপেক্ষা বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি ৯৩ হিজরী সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। [******************** কিন্তু ঐতিহাসিক ইয়াফিয়ী ‘তোবকাতুল ফুকাহা’ গ্রন্হে জন্ম সন ৯৪ হিজরী বলা হইয়াছে।] এই সময় মদীনার সমগ্র শহরটি হাদীস চর্চা ও হাদীস শিক্ষার সুমিষ্ট আওয়াজে মুখরিত ছিল। নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কিরাম যদিও দূর দূরান্তরে অবস্থিত স্থানে ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন; কিন্তু স্বর্ণের খনি হইতে স্বর্ণ উত্তোলনের পরও তাহা স্বর্ণের খনিই থাকিয়া যায় এবং তখনো সেখানে যাহা অবশিষ্ট থাকিয়া যায়, তাহার পরিমাণ কিছুমাত্র নগণ্য হইতে পারে না। সমস্ত বড় বড় সাহাবী এই শহরেই বসবাস করিতেন। নবী করীমের জীবদ্দশায় এবং তাহার পরে ২৪/২৫ বৎসর পর্যন্ত এই শহরেই ছিল ইসলামী হুকুমতের কেন্দ্র। এইখানেই ইসলামের যাবতীয় আইন-কানুন চর্চা, প্রচার ও কার্যকর হইত এবং তাহার পরই তাহা মুসলিম জাহানের অপরাপর কেন্দ্রে প্রচারিত হইত। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক, উমর ফারূক,  হযরত আয়েশা, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর, হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত আবূ হুরায়রা, হযতর যায়দ ইবনে সাবিত প্রমুখ মহান সাহাবীর হাদীদ শিক্ষাদানের কেন্দ্র এই শহরেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ফলে এই শহরের শত সহস্র ব্যক্তি ওহী ও সুন্নাতের ইলমে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করিতে সমর্থ হন এবং উত্তরকালে তাঁহারাই উহার প্রকৃত উত্তরাধিকারী হন।

ইমাম মালিক যখন হাদীস শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হন, তখন ইলমে হাদীসের বড় বড় ‘বাদশাহ’ মদীনায় অবস্থান করিতেছিলেন। হযরত আয়েশার বড় বড় ছাত্রগণ, তাঁহার ভ্রাতস্পুত্র কাসেম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর, তাঁহার বোনপুত্র উরওয়া ইবনে যুবায়র, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমারের ছাত্র নাফে ও আবদুল্লাহ ইবিনে দীনার, তাঁহার দুই গোলাম ও সালেম ইবনে আবদুল্লাহ প্রমুখ তাবেয়ী তখনো সেখানে বর্তমান ছিলেন। হযরত যায়দ ইবনে সাবিত মদীনার বাহিরে চলিয়া গেলেও তাঁহার পুত্র খারেজাহ ইবনে যায়দ তাহার ইলমে হাদীসের ওয়ারিশ হইয়াছিলেন এবং তিনি মদীনাতেই বসবাস করিতেন। হযরত আবূ হুরায়ারার বিরাট হাদীস জ্ঞানের মহাসমুদ্র আকণ্ঠ পান করিয়াছিলেন তাঁহার জামাতা সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব। তিনিও এই মদীনাতেই বাস করিতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস যদিও তাহার হাদীস জ্ঞান প্রধানত মদীনার বাহিরে মক্কা কূফা ও বসরায় প্রচার করিয়াছিলেন, কিন্তু মদীনায় অবস্থানকারী তাবেয়ী সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব তাঁহার নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিলেন।

এতদ্ব্যতীত আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকজন তাবেয়ী এই সময় মদীনায় অবস্থান করিতেন। তাঁহারা হইতেছেন হিশাম ইবনে উরউয়া, মুহাম্মদ ইবনুল মুনকাদির, উবায়দুল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ, মুহাম্মদ ইবনে শিহাব যুহহরী, আমের ইবনে আবদুল্লাহ জাফর সাদিক, রবীয়া রায়ী, আবূ সুহাইল ও সুলায়মান ইবনে ইয়াসার। তাঁহারা এমন তাবেয়ী ছিলেন, যাঁহাদের ক্রোড়ে হাদীস ও তাফসীরের জ্ঞান লালিত-পালিত ও ক্রমবিকশিত হইয়াছিল।

ইমাম মালিকের পিতামহ, চাচা পিতা সকলেই বড় বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। ইহা হইতে বলা যায়, ইমাম নিজস্ব ঘর ও পরিবারে গোটা পরিবেশই ইলমে হাদীসের গুঞ্জনে মুখরিত ছিল। এই কারণে তিনি বাল্য জীবনেই হাদীস শিক্ষা লাভ করিতে শুরু করেন। তিনি সম্ভবত সর্বপ্রথম তাঁহার চাচা আবূ সুহাইলের নিকট হাদীস শিক্ষা করিতে শুরু করেন। পরে নাফে’র নিকট হাদীস শিক্ষা করিতে যান। নাফে যতদিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন ইমাম মালিক তাঁহার নিকটই হাদীস শিক্ষার জন্য যাইতেন। অতঃপর তিনি মদীনার উপরোল্লিখিত প্রায় সকল হাদীসবিদ তাবেয়ীর নিকট হইতেই হাদীস শিক্ষা করিয়াছেন। তাঁহার উস্তাদের মোট সংখ্যা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর মতে ৭৫ জন। অপর এক বর্ণনায় ৯৪ জন উল্লেখ করা হইয়াছে।[********************]

কিন্তু আল্লামা জালালুদ্দীন সয়ূতী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম মালিক নয়শত মুহাদ্দিসের নিকটি হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন। তন্মধ্যে তিনশত হইতেছে তাবেয়ী ও ছয়শ হইতেছেন তাবে-তাবেয়ী।[********************]

এই সকল উস্তাদকেই তিনি মদীনা শরীফে পাইয়াছিলেন। এই কারণে হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মদীনার বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নাই।

ইমাম মালিক সকল প্রকারের হাদীস বর্ণনাকারীর নিকট হইতেই হাদীস গ্রহণ করিতেন না। তিনি হাদীসের উস্তাদ হিসাবে কাহাকে গ্রহন করিবেন, তাহা তিনি গভীর সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চিন্তা করিয়া ছাঁটাই-বাছাই করিয়া লইতেন। এই সম্পর্কে তাহার প্রিয় ছাত্র হাবীবের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি নিজেই বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

হে হাবীব ! এই মসজিদেই (মসজিদে নববী) আমি সত্তর জন এমন মুহাদ্দিস পাইয়াছি, যাঁহারা রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবীরে সাক্ষাত ও সংস্পর্শ লাভ করিয়াছিলেন এবং তাবেয়ীদের হইতেও হাদীস বর্ণনা করিতেন। (আমি তাঁহাদের নিকট হইতেই হাদীস শিক্ষা ও গ্রগণ করিয়াছি।) এবং হাদীসকে উহার উপযুক্ত লোকদের নিকট হইতেই গ্রহণ করিয়াছি, অনুপযুক্ত ব্যক্তির নিকট হইতে কখনো গ্রহণ করি নাই।[********************]

তাঁহার উস্তাদ কোন ধরনের লোক ছিলেন এবং কাহাদের নিকট হইতে তিনি হাদীস গ্রহণ করেন নাই, তাহা নিম্নোক্ত বর্ণনা হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

তাঁহার হাদীস শিক্ষার উস্তাদ যাঁহারা ছিলেন, তাঁহাদের সকলকেই ইমাম মালিক ছাঁটাই-বাছাই করিয়া লইয়াছিলেন, তাঁহাদের দ্বীনদারী, বুঝশক্তি ও ফিকাহ-জ্ঞান এবং হাদীস বর্ণনার হক ও শর্ত আদায় করার দিক দিয়া তাঁহাদিগকে তিনি পছন্দ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সম্পর্কে তাঁহার অন্তরে ঐকান্তিক বিশ্বাস ও নিশ্চিন্ততা বিরাজমান ছিল। এতদ্ব্যতীত তিনি বহু দ্বীনদার ও কল্যাণময় ব্যক্তির নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করেন নাই। কেননা তাঁহারা হাদীস বর্ণনার সুষ্ঠু নিয়ম সঠিক ভাবে জানিতেন না।[********************]

ইমাম মালিক (র) যে কত বড় মুহাদ্দিস ছিলেন, তাহা তাঁহার সম্পর্কে কথিত অপরাপর শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদের নিম্নোল্লিখিত উক্তিসমূহ হইতে স্পষ্টরূপে বুঝিতে পারা যায়।

ইমাম শাফিয়ী (র) তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম মালিক তাবেয়ীদের পরবর্তী যুগের লোকদের জন্য আল্লাহর এক অকাট্য দলীল বিশেষ।[********************]

মুহাদ্দিস নাসায়ী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার দৃষ্টিতে তাবেয়ীনের পরবর্তী যুগে মালিক অপেক্ষা বড় বিজ্ঞ ব্যক্তি আর কেহ নাই।[********************]

ইমাম আবূ ইউসূফ (র)

ইমাম আবূ ইউসূফ (র) যদিও ইলমে ফিকাহর একজন প্রসিদ্ধ বিশেষজ্ঞ ও ইমাম হিসাবেই প্রখ্যাত; কিন্তু হাদীস-জ্ঞানের দিক দিয়াও তিনি অপর কাহারো অপেক্ষা কিছুমাত্র পশ্চাদপদ ছিলেন না। আল্লাহ তাঁহাকে অনন্যসাধারণ স্মরণশক্তি দান করিয়াছিলেন। তিনি যখনই হাদীসের উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিতে থাকিতেন, তখনই তাঁহার হাদীস মুখস্থ হইয়া যাইত। এমন কি, একই বৈঠকে পঞ্চাশ-ষাটটি হাদীস পূর্ণ সনদসহ শ্রবণ করিয়া একবারেই তিনি মুখস্থ বলিতে পারিতেন। ইমাম যাহবী তাঁহাকে হাদীসের বড় বড় হাফেযদের মধ্যে গণ্য করিয়াছেন। হাফেয ইবনে হাজার আল-আসকালানী উল্লেখ করিয়াছেন যে, একবার তিনি অসুস্থ ও রোগাক্রান্ত হইয়া পড়েন। এই অবস্থায় শ্রেষ্ঠ হাফেযে হাদীস সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা তাঁহাকে চল্লিশটি হাদীস শোনান। এই হাদীসসমূহ সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার মুখস্থ হইয়া যায় এবং সুফিয়ানের চলিয়া যাওয়ার পর তিনি তাহা সবই তাঁহার নিকট উপস্থিত অন্যান্য লোকদিগকে মুখস্থ পড়িয়া শোনাইয়া দেন। ইহাতে উপস্থিত সকল লোকই স্তম্ভিত ও বিস্মিত হয়।

হাদীষ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি জন্মস্থান কূফা নগরের মুহাদ্দিসীনের নিকট শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া মদীনা যাত্রা করেন এবং তথায় ইমাম মালিকের ছাত্র আসাদ ইবনে ফুরাত সাকালবীর নিকট হইতে ইমাম মালিক সংকলিত ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ আদ্যোপান্ত শ্রবণ করেন।

ইমাম আবূ ইউসূফ হাদীস শিক্ষার জন্য উস্তাদের নিকট শ্রুত হাদীস কখনো লিখিয়া লইতেন না; বরং একবার শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তাহা সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইতেন। কিন্তু তাঁহার সহপাঠিগণ বারবার শ্রুত হাদীসসমূহ লিখিয়া লইতেন। শুধু তাহাই নয়, লিখিত হাদীসকে অনেক সময়ই তাঁহাদিগকে ইমাম আবূ ইউসূফের জবানীতে শুনিয়া শুদ্ধ ও সংশোধন করিয়া লইতে হইত।

হাদীস ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য জ্ঞানে তিনি ছিলেন একজন ইমাম।

হাদীস শিক্ষার জন্য তাঁহার আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্যম এতই তীব্র ছিল যে, একদিকে তিনি ইমাম আবূ হানীফার দরবারে উপস্থিত থাকিয়া ফিকাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করিতেন; আর সেখান হইতে উঠিয়াই তিনি মুহাদ্দিসের নিকট হাদীস শিক্ষা করার উদ্দেশ্যে চলিয়া যাইতেন। এইভাবে অপরিসীম সাধনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেই তিনি ইলমে হাদীসে বিরাট বিশেষজ্ঞ হইতে পারিয়াছিলেন।[এই আলোচনা মাওলানা মুজীবুল্লাহ নদভী লিখিত ******************** গ্রন্হ হইতে সংগৃহীত।]

ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী (র)

ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী ইমাম আবূ হানীফার দ্বিতীয় প্রধান ছাত্র। ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আবূ ইউসূফের সংস্পর্শে আসার ফলে তাঁহার মনে হাদীস শিক্ষার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইরাক অন্তর্গত ‘ওয়াসিত’ (জন্মস্থান) হইতে কয়েকশত মাইল দূরে অবস্থিত মদীনায় উপস্থিত হইলেন এবং তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ ইমাম মালিকের নিকট হাযির হইলেন। তিনি একাদিক্রমে তিন বৎসরকাল পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করেন ও নিয়মিতভাবে ইমাম মালিকের হাদীস শিক্ষারদানের মজলিসে উপস্থিত হইত থাকেন। তিনি এই মজলিসৈ অন্ততঃ সাতশত হাদীস শ্রবণ করেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি ইমাম মালিকের দরবারে তিন বৎসর কি ততোধিক সময় অবস্থান করিয়াছি এবং তাঁহার নিকট হইতে সাতশত হাদীস শিক্ষালাভ করিয়াছি।[********************]

ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম আবূ ইউসূফ ও ইমাম মালিকের ন্যায় জগদ্বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদের নিকট হাদীস শিক্ষা করার পর অপর কোন হাদীসবিদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করার কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ইমাম মুহাম্মদের মনে হাদীস শিক্ষার জন্য যে উদগ্র পিপাসা জাগ্রহ হইয়াছিল, তাহা নিবৃত্ত করার জন্য তিনি সেকালের অন্যান্য বড় বড় হাদীসবিদের মজলিসে উপস্থিত না হইয়া ও তাঁহাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা না করিয়া কিছুতেই ক্ষান্ত ও শান্ত হইতে পারিলেন না।

আল্লামা জাহেদুল কাওসারী ইমাম মুহাম্মদের হাদীস শিক্ষার উস্তাদ সত্তর জন বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।[********************] এই উস্তাদগণ কূফা, মদীনা, মক্কা, বসরা, ওয়াসিত, সিরিয়া, খোরাসান ও ইয়ামামা প্রভৃতি দেশে ছড়াইয়াছিলেন।

তাঁহার স্মরণশক্তি এত তীক্ষ্ম ছিল যে, ইমাম আবূ হানীফার আদেশে তিনি কুরআন মজীদ হেফজ করিতে শুরু করেন এবং মাত্র এক সপ্তাহ কালের মধ্যেই সম্পূর্ণ কুরআন হেফয করিয়া ফেলেন। [ঐ] তিনি ইলমে হাদীসের কত বড় মনীষী ছিলেন, তাহা হইতে সহজেই অনুমান করা যায়। কেননা এইরূপ তীক্ষ্ম স্মরণশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি যখন হাদীস শিখিতে যান, তখন তিনি উস্তাদের নিকট হইতে যে হাদীসই শ্রবণ করিবেন, তাহা তাঁহার মানসপটে চিরতরে মুদ্রিত হইয়া যাইবে, ইহাই স্বাভাবিক।

ইমাম আওযায়ী (র)

ইমাম আওযায়ী তাবে-তাবেয়ীদের যুগের একজন বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি প্রথমে ইয়ামামায় অবস্থানকারী মুহাদ্দিস ইহায়ইয়া ইবনে কাসীরের নিকট হাদীস শিক্ষা করেন। অতঃপর সুদূর বসরা নগরের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে সীরিন ও হাসান বসরীর নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে তথায় গমন করেন। কিন্তু এই দীর্ঘ ও দূরধিগম্য পথ অতিক্রম করিয়া তিনি যখন বসরায় পৌঁছিলেন তখন জানিতে পারিলেন যে, ইমাম হাসান বসরীর ইন্তেকাল হইয়াছে ও ইমাম ইবনে সিরীন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। ইহাতে তাঁহার মনে যে ব্যর্থতার আঘাত লাগিয়াছিল, তাহা সহজেই অনুমেয়।

ইমাম আওযায়ী বিপুল সংখ্যক তাবেয়ীর নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছে।

ঐতিহাসিক হাফেয ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি বহু সংখ্যক তাবেয়ী লোকেরই সাক্ষাত সাহচর্য লাভ করিয়াছিলেন।[********************]

জীবনী লেখকগণ উল্লেখ করিয়াছেন যে, ইমাম আওযায়ী নিম্নোক্ত তাবেয়ী ও তাবেয়ীদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছেনঃ

(১) আতা ইবনে আবূ রিবাহ (২) কাতাদাহ (৩) নাফে মাওলা ইবনে উমর (৪) ইমাম যুহরী (৫) মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম (৬) শাদ্দাস ইবনে আবূ উমারাহ (৭) কাসিম ইবনে মুখাইমিরাহ ও (৮) রবীয়া ইবনে ইয়াযীদ প্রমুখ।

আওযায়ী নিজেই বলিয়াছেনঃ ইমাম যুহরী ও ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর উভয়ের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ সমাপ্ত হইলে তাঁহাদের নিজস্ব সংকলিত হাদীস সংকলন আমাকে দান করেন এবং বলেনঃ

********************

এই হাদীসসমূহ তুমি আমার নিকট হইতে ও আমার সূত্রে অন্যদের নিকট বর্ণনা কর।[********************]

ইমাম ইবনে জুরাইজ (র)

ইবনে জুরাইজ যখন জন্মগ্রহণ করেন (৮০ হিজরী), তখন বহু সংখ্যক সাহাবী জীবতি ছিলেন। প্রথম হইতেই তাঁহাদের সংস্পর্শে আসিতে পারিলে তিনি তাবেয়ীদের মধ্যে গণ্য হইতেন। কিন্তু তাঁহাদের নিকট হইতে তিনি ‘ইলম’ হাসিল করিতে পারেন নাই। এই কারণে তিনি তাবে-তাবেয়ীদের মধ্যে গণ্য হন।

এই সময় মক্কা নগরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)-এর বিশিষ্ট ছাত্র আতা ইবনে আবূ রিবাহ হাদীস শিক্ষাদানে নিযুক্ত ছিলেন। প্রাথমিক প্রয়োজনীয় শিক্ষা অর্জনের পর একাদিক্রমে সতেরো বৎসর পর্যন্ত তাঁহার সংস্পর্শে থাকিয়া হাদীস শিক্ষা করেন।

অতঃপর মুসলিম জাহানের প্রায় সকল প্রখ্যাত ইমামে হাদীস-এর নিকট হইতে তিনি হাদীস শিক্ষা করেন। আতা ইবনে আবূ রিবাহর ন্যায় আমর ইবনে দীনারের খিদমতেও তিনি দীর্ঘদিন থাকিয়া হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। এই সব কারণে ইমাম ইবনে জুরাইজ হাদীস জ্ঞানে এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হন। তাঁহার বর্ণিত হাদীস হাদীসের বড় বড় মনীষীর নিকট গ্রহণযোগ্য হইয়াছে। তাঁহার সংগ্রহীত হাদীসসম্পদ লিখিত আকারে তাহার নিকট বর্তমান ছিল।

সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (র)

সুফিয়ান ইলমে হাদীসের একজন যুগশ্রেষ্ঠ মনীষী ছিলেন। শৈশব কাল হইতেই তাঁহার তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটিয়াছিল। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি কখনও কিছু লিখি নাই, কিন্তু যখনই যাহাই লিখিয়া লইয়াছি, তাহাই আমার মুখস্থ হইয়া গিয়াছে।[********************]

তিনি বহু শত তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীর নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। তাঁহার হাদীস শিক্ষার উস্তাদদের মধ্যে আশি জনেরও অধিক ছিলেন তাবেয়ী। তাঁহাদের মধ্যে ইমাম যুহরী, ইমাম শু’বা , মুসায়েব ইবন কুদাম, আমর ইবনে দীসার, আবূ ইসহাক সাবীয়ী, মুহাম্মদ ইবনে আকাবা, হুমাইদ, জিয়াদ ইবনে আলাকা, সালেহ ইবনে কাইসান প্রমুখ মণীষী উল্লেখযোগ্য।[********************] হাদীস শিক্ষার জন্য তিনি কূফা, মক্কা, মদীনা ও অন্যন্য জ্ঞানকেন্দ্রসমূহ সফর করেন।

প্রসিদ্ধ হাদীসবিদ আলী ইবনে মদীনী তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম যুহরীর ছাত্রদের মধ্যে ইবনে উয়াইনা অপেক্ষা অধিক নির্ভরযোগ্য আর কহ নাই।[********************]

আমাশ, সওরী, ইবনে জুরাইজ, শু’বা, আকী, ইবনে মুবারক, সায়ীদুল কাতান, শাফেয়ী ও আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ মুহাদ্দিস তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি হিজরী ১০৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন ও ১৯৮ সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

আবদুল্লাহ ইবেন মুবারক (র)

ইবনে মুবারক প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পর হাদীস শিক্ষার জন্য বিদেশ সফরে বহির্গত হন। এই উদ্দেশ্যে তিনি সিরিয়া, হিজাজ, ইয়ামেন, মিসর, কূফা ও বসরার বিভিন্ন শহর ও নগর পরিভ্রমণ করেন এবং যেখানেই ও যাহার নিকটই তিনি হাদীস শিক্ষার সুযোগ পাইয়া্ছেন, যেখানেই এবং তাঁহার নিকট হইতেই হাদীস শিক্ষা করিয়াছেন। হাদীস সন্ধান করার উদ্দেশ্যে তিনি যে একজন বড় পর্যটক ছিলেন, তাহা  সকলেই স্বীকার করিয়াছেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল-এর মতে সেকালে হাদীসের জন্য এত দূর-দূরান্তরে সফরকারী আর একজনও ছিল না।[********************]

আবূ উসামা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবনে মুবারক অপেক্ষা দেশ-দেশান্তরের হাদীস অন্বেষণকারী অন্য কোন ব্যক্তিকে আমি দেখি নাই।[********************]

মনে রাখা আবশ্যক যে, সেকালে বিদেশে সফর যুগের ন্যায় কিছুমাত্র সহজসাধ্য ছিল না। পায়ে হাঁটিয়া কিংবা উষ্ট্র বা গাধার পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া মাসের পর মাস চলিয়াই এক স্থান হইতে অন্য এক স্থানে পৌঁছিতে হইত। তখনকার সময়ে পথ চলা কতদূর কষ্টসাধ্য ছিল, তাহা এখন ধারণা করাও সম্ভব নয়।

ইবনে মুবারক কতজন উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছেন তাহা তাঁহার নিম্নোক্ত উক্তি হইতেই বুঝিতে পারা যায়। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি চার হাজার উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছি এবং তন্মধ্যে এক হাজার উস্তাদের বর্ণিত হাদীস আমি অন্যদের নিকট বর্ণনা করিয়াছি।[********************]

এক কঠিন পরিশ্রমলব্ধ বিরাট হাদীসসম্পদ তিনি নিজেই বিপুল সংখ্যক লোককে শিক্ষা দিয়াছেন। ইমাম যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইসলামী জাহানের এত লোক তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছে যে, তাহাদের সংখ্যা নির্ধারণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়।[********************]

ইলমে হাদীসে তিনি একজন বড় ইমামের মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। হাদীস চর্চা ছিল তাঁহার চব্বিশ ঘন্টার ব্রত। তাঁহাহ মতে যখন হাদীস আলোচনা করা হয়, তখন যেন ঠিক রাসূল করীম (স)-এর সংস্পর্শে ও সাহচর্য লাভ হয়। ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন প্রমুখ বড় বড় মনীষী বলিয়াছেনঃ ইবনে মুবারকের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা বিশ-একুশ হাজার হইবে।[********************]

ইমাম শু’বা (র)

ইমাম শু’বা হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) ও হযরত আমর ইবনে মুসলিম (রা) এই দুইজন সাহাবীকে দেখিতে পাইয়াছেন। এই কারণে তিনি তাবেয়ী পর্যায়ের হইলেও জীবনী লেখকগণ তাঁহাকে তাবে-তাবেয়ী মধ্যে গণ্য করিয়াছেন। তিনি ‘ওয়াসিত’ নামক কূফা ও বসরার মধ্যবর্তী এক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষালাভ করার পরই তিনি ইলমে হাদীস শিখিবার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। উত্তরকালে তিনি হইতে চরম মাত্রায় বুৎপত্তি লাভ করেন। তৎকালীন প্রায় সকল বড় বড় হাদীসবিদের নিকট হইতেই তিনি হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছেন। সাধারণ জীবনী লেখকগণ লিখিয়াছেন যে, তাঁহার হাদীসের উস্তাদের মধ্যে প্রায় চারিশত তাবেয়ী রহিয়াছেন। হাফেয ইবেন হাজার আল আসকালানী লিখিয়াছেন যে, কূফা নগরের তিনশত হাদীসবিদের নিকট হইতে তিনি হাদীস শ্রবণ ও বর্ণনা করিয়াছেন।

এই উস্তাদগণ দুই একটি শহরেই অবস্থান করিতেন না; বরং তাঁহারা মুসলিম জাহানের লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল বিস্তীর্ণ এলাকায় বিক্ষিপ্ত ছিলেন। তদুপরি রহিয়াছে এই কালের চলার পথের দুর্গমতা ও দূরতিক্রম্য অবস্থা। অনেক সময় কেবল একটি হাদীসের জন্য সহস্র মাইল পথ পায়ে হাঁটিয়া কিংবা উষ্ট্র বা ঘোড়ায় চড়িয়া অতিক্রম করতে হইত। এই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য হইতেছে তাঁহার অনন্যসাধারণ তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির। তিনি হাদীস শ্রবণ করিয়া তাহা বড় একটা লিখিয়া লইতেন না; বরং লম্বা লম্বা হাদীস সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ করিয়া ফেলিতেন।[********************] ইহার দুরুন তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক হাদীস স্বীয় স্মৃতিপটে মুদ্রিত ও সুরক্ষিত করিয়া রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

সমসাময়িক ও তাঁহার পরবর্তীকালের বড় বড় হাদীসবিদ তাঁহার ইলমে হাদীসৈর অনন্যসাধারণ জ্ঞানের কথা অকপটে স্বীকার করিয়াছেন।[********************]

ইমাম লাইস ইবনে সায়াদ (র) (জন্ম ৯৪ হিজরী মৃত্যু ১৬৫ হিঃ)[********************]

ইমাম লাইস তাবে-তাবেয়ীন ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করিয়াই তিনি হাদীস শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করেন। তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের বিশেষভাবে লালিত ও শিক্ষাপ্রদত্ত প্রসিদ্ধ তাবেয়ী নাফের নিকট হাদীস শিক্ষার জন্য উপস্থিত হন। তাঁহার নিকট হইতে তিনি যত হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছিলেন তাহার সব একটি সংকলনে লিপিবদ্ধ করিয়া লইয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত তিনি ইমাম যুহরী, সায়ীদুল মুকবেরী, আবদুল্লাহ ইবনে আবূ মূলাইকা, ইয়াহইয়া আল-আনসারী ও আবূ যুবায়র প্রমুখ তাবেয়ীর নিকট হইতেও হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। ইমাম নববী ইমাম লাইসের কয়েকজন বিশিষ্ট উস্তাদের নাম উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহাদের ছাড়া তিনি আরো এত বিপুল সংখ্যক ইমামে হাদীসের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও শ্রবণ করিয়াছেন যাহাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।[********************]

ইমাম সুফিয়ান সওরী (র) (জন্ম ৯৭ হিজরী, মৃত্যু ১৬১ হিজরী)[********************]

সুফিয়ান সওরী ছিলেন তাবে-তাবেয়ী যুগের হাদীস-জ্ঞানের একজন শ্রেষ্ঠ মনীষী। প্রাথমিক শিক্ষা পিতার নিকট লাভ করেন। অতঃপর কূফা নগরের সকল মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করেন। এই সময় কূফা নগরে আ’মাশ ও আবূ ইসহাক প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসের রীতিমত দারস দেওয়ার একটা প্রতিষ্ঠান কায়েম করিয়াছিলেন।

ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুফিয়ান আ’মাশ বর্ণিত হাদীসসমূহ অন্যান্য সকল লোক অপেক্ষা অধিক জানেন।[********************]

এই সময় হাদীস যেহেতু সাধারণের জন্য গ্রন্হবদ্ধ হয় নাই, হাদীস সমূহের বিরাট অংশ ছিল মুহাদ্দিসদের স্মৃতিপটে মুদ্রিত এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রক্ষিত। এইজন্য হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীকে দূরদূর দেশে সফর করিতে হইত। সুফিয়ানকেও হাদীস শিক্ষার জন্য দূরদেশে পরিভ্রমণ করিতে হইয়াছে ও এইজন্য শত-সহস্র মাইল পথ অতিক্রম করিতে হইয়াছে।

কূফায় উস্তাদদের নিকট হাদীস শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া তিনি বসরা ও হিজাজ গমন করেন। এই দুই শহরে বিপুল সংখ্যক মুহাদ্দিসের নিকট হইতে তিনি হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। তাঁহার কূফা, বসরা ও হিজাজের প্রখ্যাত উস্তাদের নাম উল্লেখের পর হাফেয ইবনে হাজার লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

কূফার বহুসংখ্যক উস্তাদের নিকট হইতে তিনি হাদীস শিক্ষা করেন। এইভাবে বসরারও বহু সংখ্যক উস্তদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করেন এবং হিজাজের বিভিন্ন হাদীস শিক্ষার বৈঠক হইতেও তিনি যথেষ্ট ফায়দা গ্রহণ করেন।[********************]

আবদুর রহমান ইবনে মাহদী ইমামে হাদীস। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি সুফিয়ান সওরী অপেক্ষা অধিক হাদীস মুখস্থকারী আর এক জন লোকও দেখি নাই।[********************]

হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীসের বিক্ষিপ্ত সম্পদ যখন গ্রন্হাকারে সুসংবদ্ধ হইয়াছিল, তখন লক্ষ লক্ষ সনদসহ মুখস্থ করা খুবই সহজ ছিল, কিন্তু পূর্বে ইহা যখন বিক্ষিপ্ত ছিল, তখন দুই চার হাজার হাদীস স্বীয় বক্ষে ধারণ করা ও উহাকে সুরক্ষিত করিয়া রাখা বড়ই কঠিন ব্যাপার ছিল। এই কারণে তাবে-তাবেয়ীন যুগের কোন হাদীসের ইমামের পক্ষে দশ সহস্রের অধিক হাদীস মুখস্থ করিয়া রাখার দৃষ্টান্ত কুত্রাপি পরিদৃষ্ট হয় না। এইদিক দিয়াও সুফিয়ান সওরীর কৃতিত্ব বিশেষত্ব উল্লেখযোগ্য। তাঁহার বর্ণিত যেসব হাদীস তাঁহার স্মৃতিপটে রক্ষিত ছিল তাহার সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার।[********************] আবূ আসেম বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম সওরী ইলমে হাদীসের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা।[********************]

মোটকথা, এই যুগে ইলমে হাদীস সুসংবদ্ধ ছিল না। বরং উহা মুসলিম জাহানের প্রায় সর্বত্রই বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। ইহার কারণ- যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে- এই ছিল যে, সাহাবায়ে কিরামই ছিলেন হাদীসের প্রাথমিক ধারক ও বাহক। তাঁহারা মসজিদ বা খানকার নিভৃত কোণে জীবন অতিবাহিত করেন নাই। বরং তাঁহারা প্রকৃত মুজাহিদের ন্যায় জীবন যাপন করিয়াছেন। জিহাদ, ইসলামী দাওয়াতের জন্য ও অন্যান্য দ্বীনি দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে তাঁহারা মুসলিম অধ্যুষিত দুনিয়ার প্রায় সকল দেশে ও ক্ষেত্রেই ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহারা যেখানেই পৌঁছিতেন, সেখানকার অধিবাসিগণ তাঁহাদের নিকট হইতে ইসলামী জ্ঞান তথা ইলমে হাদীস শিক্ষা করিতেন। নবী করীম (স)-এর কথা, কাজ ও চরিত্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করিয়া তাহা তাঁহারা নিজেদের স্মৃতিপটে সুরক্ষিত করিয়া রাখিতেন। এক্ষণে কেবল ইসলামী যিন্দিগী যাপন করাই যাহাদের উদ্দেশ্যে হইত তাহাদের পক্ষে ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান লাভ এবং কোন একটন সাহাবীর বাস্তব জীনব অনুসরণ করাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সাহাবীদের পরে যেসব মহান ব্যক্তি রাসূল-জ্ঞানের বিক্ষিপ্ত মণিমুক্তা সংগ্রহ ও সংকলন করার কঠিন ব্রত অবলম্বন করিয়াছিলেন এবং  যাঁহারা ইসলামী ইলমের এই মহামূল্য সম্পদকে ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করার দায়িত্ব লইয়াছিলেন, তাঁহাদের পক্ষে দেশের পর দেশ, বিরাট বিরাট উপমহাদেশ, বিশাল সমুদ্র, সীমাহীন উত্তপ্ত মরু প্রান্তর, নিবিড় দুর্গম অরণ্য পর্বত সমাকীর্ণ পথ অতিক্রম করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। উপরন্তু এ যুগের হাদীস সংগ্রহকারী সাধকদের নিকট ইহা ছিল অত্যন্ত প্রিয় কাজ।

বলখ শহরের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস খালফ ইবন আইয়ূবকে এক ব্যক্তি একটি জরুরী বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। তিনি বলিলেনঃ ইহা আমার অজ্ঞাত, তবে কূফা নগরের বাসিন্দা হাসান ইবনে জিয়াদের নিকট হইতে ইহার সঠিক জওয়াব জানা যাইতে পারে। প্রশ্নকারী কূফা শহরের নাম শুনিয়া বলিলঃ................. কূফা! সে তো বহু দূরে ! ইহা শুনিয়া খালফ ইবনে আউয়ুব বলিলেনঃ

******************************************************

দ্বীনের চিন্তা যাহাকে পাইয়া বসিয়াছে, কূফার ন্যায় বহু দূরবর্তী শহরও তাহার নিকট অতি নিকটবর্তী বিবেচিত হইবে।[********************]

এই কারণেই সেকালের কোন লোক যদি জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘ পথ সফর করিতে অক্ষমতা প্রকাল করিত তবে সমাজক্ষেত্রে সে নিদারুণ লাঞ্ছনা ও ভৎসনার সম্মুখীন হইতে বাধ্য হইত। হাদীস বিশেষজ্ঞ ও  হাদীস শাস্ত্রের প্রখ্যাত সমালোচক ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন বলেনঃ

যে মুহাদ্দিস কেবল নিট শহরে বসিয়াই হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিবেন, সেজন্য বিদেশ সফরের কষ্ট স্বীকার করিতে প্রস্তুত হইবেন না, তোমরা তাঁহার নিকট হইতে কোন কল্যাণের আশা করিতে পার না।[********************]

হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরের যে কল্যাণ নিহিত রহিয়াছে, উহার বৈষয়িক মূল্য ও উপেক্ষা করা যায় না। ইবরাহিম ইবনে আদহামের নিম্নোক্ত উক্তি হইতে উহার গুরুত্ব অনুধাবণ করা যায়। তিন বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস শিক্ষার্থী ও সংগ্রহকারীদের এই উদ্দেশ্যে দেশ-বিদেশে সফরের বরকতে আল্লাহ এই জাতিকে অনেক বিপদ-মুসিবত হইতে রক্ষা করেন।[********************]

বস্তুত সাহাবীদের যুগ হইতে তাবে-তাবেয়ীন ও তৎপরবর্তী মুহাদ্দিসদের যুগ পর্যন্ত আমরা হাদীস সংগ্রহ অভিযানের যে ব্যাপকতা ও তীব্রতা দেখিতে পাই তাহাতে এই বিদেশ সফরের গুরুত্ব সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হইয়া পড়ে এবং যেসব মহান ব্যক্তি এই অভিযান বাস্তব ক্ষেত্রে চালাইয়াছেন, তাঁহাদের প্রতি আমাদের মনে জাগে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তাঁহারা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও দ্বীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুনিয়াদ হাদীস সংরক্ষণে এইরূপ প্রাণপণ সংকল্প লইয়া ময়দানে ঝাঁপাইয়া রা পড়িতেন তাহা হইলে আজ মুসলিম জাতি রাসূলে করীম (স)-এর সুন্নাতের বিরাট অংশ হইতে চিরদিনের তরে বঞ্চিত হইয়া যাইত, তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।

 

হাদীস গ্রন্হ সংকলন

পূর্বের আলোচনা হইতে প্রমাণিত হইয়াছে, প্রথম পর্যায়েই রাসূলে করীম (স)-এর হাদীসসমূহ গ্রন্হাকারে সংকলিত হইতে পারে নাই। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স)-এর হাদীস তাঁহার সাহাবী ও শ্রেষ্ঠ তাবেয়ীদের যুগে গ্রন্হকারে সংকলিত ও সুসংবদ্ধ ছিল না।[********************]

ইসলামের প্রথম পর্যায়েই হাদীস গ্রন্হসমূহ সংকলিত না হওয়ার মূলে কয়েকটি যুক্তিসংগত কারণ রহিয়াছে। প্রথমত, পূর্বে যেমন বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইয়াছে, সাহাবায়ে কিরাম তীব্র স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিলেন, রাসূলের নিকট হইতে যাহা কিছু শ্রবণ করিতেন, তাহাই তাঁহাদের মুখস্থ হইয়া যাইত, উহা লিখিয়া লওয়ার কোন প্রয়োজন সাধারণভাবে ও স্বভাবতই তাঁহারা মনে করিতেন না।

দ্বিতীয়ত, লিখিবার শক্তি তাঁহাদের অনেকেরই ছিল না। তখন লিখন শিল্পের প্রচলনও পরবর্তীকালের ন্যায় ব্যাপক ছিল না, উহা সাধারণ জনপ্রিয়তাও তখন লাভ করিতে পারে নাই।

তৃতীয়ত, নবী করীম (স) নিজেই প্রথম পর্যায়ে হাদীস লিখিতে নিষেধ করিয়াছেলেন বলিয়া হাদীস গ্রন্হ সংকলনের প্রতি সকল সাহাবীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হইতে পারে নাই।

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী এই সম্পর্কে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা এখানে প্রণিধানযোগ্যঃ

******************************************************

নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশায়ই হাদীসসমূহ সংগৃহীত ও সংকলিত হওয়া বাহ্য দৃষ্টিতে যদিও উত্তম ছিল, কিন্তু কুরআনের অনুরূপ হাদীসেরও সংকলিত হওয়া এবং ঠিক কুরআনের মতই হাদীসেরও সংরক্ষিত হওয়া বোধ হয় আল্লাহরই মর্জি ছিল না।[ফায়জুলবারী শরহে বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৮।]

এইসব কথাই হইল হাদীস গ্রন্হ সংকলনের উদ্দেশ্যে বিশেষ ব্যবস্থা ও যত্ন গ্রহণ সম্পর্কে। অন্যথায় হাদীসের হিফাযত ও উহাকে বিলীন হইয়া যাওয়ার হাত হইতে রক্ষা করার ব্যাপারে রাসূলে করীমরে যুগ হইতে সাহাবাও তাবেয়ীনের যুগ পর্যন্ত উহার প্রতি কখনই এবং কিছু মাত্র কম গুরুত্ব দেওয়া হয় নাই।

সেই কারণেই আমরা দেখিতে পাই যে, কুরআনের সঙ্গে হাদীস মিশিয়া যাওয়ার আশংকা দূরীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেমন সাহাবায়ে কিরাম হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া রাখার দিকে লক্ষ্য দিয়াছেন, অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কিরামের সময় হইতেই হাদীস সংকলন ও গ্রন্হাকারে উহাকে সুসংবদ্ধকরণের কাজও পূর্ণ মাত্রায়ই সম্পন্ন করা হইয়াছে।

তবে সাহাবীদের যুগে হাদীসকে গ্রন্হাকারে সংকলিত করিয়া লওয়ার ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা সাধারণভাবে অনুভূত ছিল না। কেননা তখন সাহাবিগণ নিজেরাই রাসূলের হাদীসের ধারক ছিলেন। যে কোন ব্যাপারে প্রয়োজন দেখা দিলেই জনগণ সাহাবীদের নিকট উপস্থিত হইতেন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানিয়া লইয়া সকল ব্যাপারের মীমাংসা করিয়া লইতেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে রাসূলে করীমের ফরমান কি, তাহাও নিঃসন্দেহভাবে সাহাবাদের নিকট হইতে জানিতে পারা যাইত। কিন্তু সাহাবাগণ যখন এক এক করিয়া দুনিয়া হইতে চলিয়া যাএত লাগিলেন তখন সাধারণ মুসলমানও যেমন হাদীস গ্রন্হ সংকলনের প্রয়োজন বোধ করেন, তেমনি হাদীসের অবশিষ্ট ধারক সাহাবীগণও উহাকে সংকলিত করিয়া চিরদিনের তরে সুরক্ষিত করিয়া রাখিয়া যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করিতে থাকেন।

তাবেয়ী যুগে সাহাবায়ে কিরামের বিদ্যমানতা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাহা হযতর আনাস (রা)-এর ইন্তেকালের পর মুরেক নামক জনৈক তাবেয়ীর নিম্নোক্ত উক্তি হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আজ অর্ধেক ইলম – হাদীস – দুনিয়া হইতে চলিয়া গেল।

এই কথার তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

সাহাবীদের যুগে কোন অসদুদ্দেশ্যসম্পন্ন ব্যক্তি হাদীস সম্পর্কে আমাদের বিরোধিতা কিংবা মতবিরোধ করিলে আমরা বলিতামঃ যে লোক এই হাদীস স্বয়ং রাসূলের নিকট শ্রবণ করিয়াছেন তাঁহার নিকট চল ( ও ইহার সত্যতা যাঁচাই করিয়া লও)।[********************]

এই কারণেই সাহাবাদের কাফেলার শেষ অন্তর্ধান শুরু হওয়ার পূর্বেই হাদীসি সংকলনের ও হাদীসকে গ্রন্হবন্ধ করিয়া উহাকে চির দিনের তরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা সাধারণভাবে ও তীব্রতা সহকারে অনুভূত হইতে শুরু করে। নবুয়্যাত- উত্তর যুগে এই পর্যায়ে একসঙ্গে পেশ করা আবশ্যক। এখানে প্রথমে খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলের সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হইব। অতঃপর পরবর্তীকালের বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হইবে।

 

খুলাফায়ে রাশেদুন ও হাদীস গ্রন্হ সংকলন

নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর খুলাফায়ে রাশেদীন ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ও ইসলামী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পরিচালনা ও যাবতীয় দ্বীনি কার্যাবলীর দায়িত্বগ্রহণ করেন। এই সময় ইসলামের অপরিহার্য দ্বিতীয় স্তর- ইলমে হাদীস- সম্পর্কে তাঁহাদের চেষ্টা- যত্নের কোনই ক্রটি ছিল না। এখানে স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক খলীফার হাদীস সংক্রান্ত খিদমত সম্পর্কে আলোচনা পেশ করা যাইতেছে।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)

প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) নিজে পাঁচশত হাদীসের এক সংকলন তৈয়ার করিয়াছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষভাগে তিনি নিজেই তাহা বিনষ্ট করিয়া ফেলেন। ইহার কারণস্বরূপ মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করিয়াছেন যে, হাদীসসময়হ সংকলন করার পর তিনি মোটেই স্বস্তি লাভ করিতে পারেন নাই। তাঁহার মনে কয়েক প্রকার ভয়ের সঞ্চার হয়। তিনি এজন্য বিশেষ ভাবিত হইয়া পড়েন যে, তাঁহার সংকলিত হাদীসসমূহের মধ্যে একটি কথা- একটি শব্দও যদি রাসূলে করীমের মূল বাণীর বিন্দুমাত্রও বিপরীত হইয়া পড়ে, তাহা হইলে রাসূলের কঠোর সতর্কবাণী অনুযায়ী তাঁহাকে জাহান্নামের ইন্ধন হইতে হইবে।

দ্বিতীয়ত, তাঁহার মনে এই ভয়ও জাগ্রত হইল যে, তাঁহার সংকলিত হাদীস গ্রন্হকে মুসলিম জনগণ যদি কুরআনের সমতুল্য মর্যাদা দিয়া বসে কিংবা অন্যান্য সাহাবীদের বর্ণিত ও সংকলিত হাদীস অপেক্ষা অধিক মর্যাদা দিতে শুরু করে, তাহা হইলেও মুসলমানদের পক্ষে বিশেষ ক্ষতির কারণ হইবে। তাহার ফলে হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজ ও অগ্রগতি ব্যাহত হইতে পারে। এই সব চিন্তার ফলেই তিনি তাহা নষ্ট করিয়া ফেলেন।[কিন্তু আল্লামা যাহবী হযরত আবূ বকর কর্তৃক তাঁহার নিজেরই সংকলিত হাদীস গ্রন্হ বিনষ্ট করিয়া দেওয়ার বর্ণনাকে সত্য বলিয়া স্বীকার করেন নাই।]

ব্যাপারটিকে আমরা যতই গভীর ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিচার করিয়া দেখি না কেন, ইহাতে একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক অবস্থার পরিণাম বলা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও হযরত আবূ বকর (রা) হাদীস সংকলন করিতে নিষেধ করেন নাই। বরং তিনি নিজেও কিছু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার বর্ণিত হাদীস হইতেছে ইমাম সয়ূতীর মতে ১৪২টি । এই হাদীসসমূহ হাদীসের কোন কোন গ্রন্হে উল্লিখিত হইয়াছে তাহাও তিনি উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার এত কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনার মূলেও যথেষ্ট কারণ রহিয়াছে। ইমাম সয়ূতী এ বিষয়ে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাহার কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনার কারণ এই যে, হাদীসে প্রচার ও তাবেয়ীন কর্তৃক উহা শ্রবণ করা শিক্ষা ও সংরক্ষণ করার কাজ  শুরু করার পূর্বেই তাঁহার ইন্তেকাল হইয়া যায়।[********************]

হযরত আবূ বকর (রা) হইতে কম সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ প্রসংগে ইমাম সয়ূতী উপরিউক্ত গ্রন্হের অন্যত্র লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আবূ বকর (রা) হইতে সনদ সম্পন্ন হাদীস খুব কম সংখ্যক বর্ণিত হইয়াছে। কেননা হযরতের ইন্তেকালের পর তাঁহার আয়ুষ্কাল খুবই  অল্প ছিল ও তাঁহার মৃত্যু খুব তাড়াতাড়িই সংঘটিত হইয়াছিল। অন্যথায় তিনি যদি দীর্ঘদিন বাঁচিয়া থাকিতেন তাহা হইলে তাঁহার নিকট হইতে বহু সংখ্যক হাদীসই বর্ণিত করিতেন। তিনি যতদিন বাঁচিয়াছিলেন, ততদিন সাহাবাদের কেহই তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। কেননা সমস্ত ব্যাপারে তাঁহারা সমানভাবেই শরীক ছিলেন। যাহা তাঁহাদের অজ্ঞতা ছিল কেবল তাহাই তাঁহারা নিকট হইত বর্ণনা করিতেন।[********************]

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবীও এই কথাই লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সাহাবাগণ হযরত আবূ বকরের সূত্রে খুব বেশী হাদীস বর্ণনা কার জন্য প্রয়োজনশীল ছিলেন না। কেননা অধিক সংখ্যক হাদীস তাঁহারা নিজেরাই রাসূলের মুখে শুনিয়াছিলেন।[********************]

এতদ্ব্যতীত হযতর আবূ বকর (রা) হযরতের অন্তর্ধানের পর মাত্র আড়াই বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। এই আড়াইটি বৎসর তাঁহার খিলাফাতের কঠিন দায়িত্ব পালন ও ভীষণ প্রতিকূল ঝড়-ঝাপটার মধ্যে অতিবাহিত হয়। ফলে এই সময়ে অন্যন্য দীর্ঘায়ূসম্পন্ন সাহাবায়ে কিরামের মত হাদীস বর্ণনার নিরবচ্ছিন্ন অবসর ও অনুকুল পরিবেশও তিনি পান পান নাই।

উপরন্তু মুসলমাদের সহিত পরামর্শ করিয়া যাবতীয় দায়িত্ব পালন করাই ছিল তাঁহার এই সময়কার বড় কাজ। ইসলামী খিলাফতের প্রকৃত গণতন্ত্রিক ও পরামর্শভিত্তিক হওয়ার কারণে প্রত্যেকটি সামাজিক, রাষ্ট্রিয় ও সামগ্রিক ব্যাপারে  বিশিষ্ট সাহাবীদের সহিত পরামর্শ করিয়া এবং কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মীমাংসা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াই কাজ করা হইত।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) খিলাফতের যাবতীয় কার্য সম্পাদনের ব্যাপারে কুরআন মজীদের পরে-পরেই হাদীসের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। খলীফা নির্বাচিত হইয়াই তিনি যে ভাষণ দিয়াছিলেন, তাহাতেই তিনি কুরআনের পরে পরেই হাদীসের গুরুত্ব ঘোষণা করিয়াছিলেন। বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে লোকগণ! আমাকে তোমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল বানানো হইয়াছে। অথচ আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। কিন্তু কুরআন নাযিল হইয়াছে এবং নবী করীম (স) তাঁহার সুন্নাত ও আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছেন। তিনি আমাদিগকে এই উভয় জিনিসের শিক্ষা দান করিয়াছেন, আর আমরা তাহা শিখিয়া লইয়াছি।[********************]

খিলাফতের কাজের ক্ষেত্রেও বাস্তবভাবেই তিনি কুরআনের পরেই হাদীসের উৎস হইতে নির্দেশ ও বিধান লাভ করিতেন। প্রমাণ্য গ্রন্হাবলীতে তাঁহার এই নীতির কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখিত হইয়াছে। বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

হযরত আবূ বকরের নিকট যখন মীমাংসা যোগ্য কোন ব্যাপার উপস্থিত হইত তখন তিনি প্রথমত আল্লাহর কিতাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেন। তাহাতে যদি ফায়সালা করার ভিত্তি খুঁজিয়া পাইতেন, তবে উহার ভিত্তিতে লোকদের মধ্যে ফয়সালা করিয়া দিতেন। আর কুরআনে কিছু নাই পাইলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূলের সুন্নাত যদি কিছু জানা যাইত, তবে উহার ভিত্তিতে মীমাংসা করিয়া দিতেন।[সুনানে দারেমী, ২৩ পৃঃ ********************]

হযরতের ইন্তেকালের পর যতগুলি সামগ্রিক ব্যাপারেই মতভেদ দেখা দিয়াছে হযরত আবূ বকর (রা) তাহার প্রায় প্রত্যেকটি ব্যাপারেই মীমাংসা করিয়াছেন রাসূলে করীমের হাদীস পেশ করিয়া এবং তাঁহার উপস্থাপিত হাদীস সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সকল মতভেদ খতম করিয়া দিয়াছে। হযরতের ইন্তেকালের পর সকীফায়ে বণী সায়েদায় সাহাবীদের মধ্যে প্রথম জটিল প্রশ্ন দেখা দেয়- খলীফা কে হইবে। অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছিল যে, এই বিষয়ে কোন মীমাংসা করাই তখন অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল। তখন হযরত আবূ বকর (রা) দাড়াইয়া রাসূলে করীম (স)-এর একটি হাদীস পেশ করিলেন এবং বলিলেনঃ

******************************************************

ইমাম ও খলীফা কুরায়েশদের মধ্য হইতে হইবে।

সেই সঙ্গে রাসূলের এই কুরায়শ বংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিবে।[********************]

এই হাদীস শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকল সাহাবী ইহার সত্যতা স্বীকার করিয়া লইলেন। অতঃপর খলীফা নির্বাচনের কাজ নির্বিাবাদে সম্পন্ন হয়।

নবী করীম (স)-কে কোথায় দাফন করা হইবে, তাহা লইয়া যখন মতবিরোধ দেখা দিল, তখন হযরত আবূ বকর (র) সিদ্দীক (রা) হাদীস পেশ করিলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলের নিকট একটি কথা শুনিয়াছিলাম, যাহা আমি ভুলিয়া যাই নাই। তিনি বলিয়াছিলেনঃ আল্লাহ তাঁহার নবীর জান কবজ করেন সেই স্থানে, যেখানে তাঁহাকে দাফন করা কর্তব্য হয়।

অতঃপর বলিলেনঃ******************************************************

অতএব তোমরাও রাসূলে করীম (স)- কে তাঁহার মৃত্যুশয্যার স্থানেই দাফন কর।[শামায়েলে তিরমিযী, পৃষ্ঠা ৩০ ******************** মুয়াত্তা মালিক, পৃষ্ঠা ৮০।]

হযরত আয়েশা (রা) প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকরের নিকট নবী করীমের সম্পত্তি হইতে অংশ লাভের দাবি করিলেন। তখন হযরত আবূ বকর (রা) নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, আমরা কাহাকেও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বানাই না। যাহা কিছু রাখিয়া যাই, তাহা সবই আল্লাহর পথে দান। কাজেই মুহাম্মদের বংশধর বায়তুলমাল হইতে জীবিকা গ্রহণ করিবে।

অতঃপর হযরত আবূ বকর (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

আল্লাহর শপথ, রাসূলকে আমি যে যে কাজ করিতে দেখিয়াছি আমি তাহা প্রত্যেকটিই কার্যে পরিণত করিব, একটিও ছাড়িয়া দিব না।

এই হাদীস বর্ণনার উপস্থিত ফল এত ত্বরান্বিত দেখা দেয় যে, হাদীসের বর্ণনাকারী শেষ ভাগে বলেনঃ

******************************************************

অতঃপর হযরত ফাতিমা মীরাসের দাবি পরিত্যাগ করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর এই বিষয়ে কোন কথা বলেন নাই।[বুখারী শরীফ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠ ৯৯৫-৯৬।]

পক্ষান্তরে তিনি যখন রাসূলের হাদীসের ভিত্তিতে জানিতে পরিলেন যে, দাদীর মীরাস রহিয়াছে, তখন হাদীস অনুযায়ী তাঁহার জন্য মিরাসের ফয়সালা করিয়া দিতে এতটুকুও বিলম্ব করিলেন না। প্রথমত দাদী যখন মিরাসের দাবি করেন, তখন তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমার জন্য আল্লাহর কিতাবে মীরাসের কোন অংশ নির্দিষ্ট হয় নাই।  রাসূলের আদর্শে (হাদীস)-ও তোমার জন্য কোন অংশ নির্দিষ্ট হইয়াছে বলিয়া আমার জানা নাই। অতএব, তুমি চলিয়া যাও। আমি লোকদের নিকট এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিয়া পরে তোমাকে জানাইব।

অতঃপর তিনি একদিন সাহাবীদের নিকট এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন। তখন হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা দাড়াঁইয়া বলিলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলের নিকট উপস্থিত ছিলাম, তিনি দাদীর জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। আমি নিজ চক্ষে দেখিয়াছে।

হযরত আবূ বকর (রা)-এর আমল সম্পর্কে বর্ণিত এই হাদীস সম্পন্ধে নিঃসন্দেহে হইবার জন্য ও ইহার প্রামাণ্যতাকে বলিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

তোমার সঙ্গে এই কথার সাক্ষী আর কেহ আছে?

তখন হযরত মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম (রা) দাঁড়াইয়া সাক্ষ্য দান করিলেন ও হযরত মুগীরার কথার সমর্থন করিলেন। [********************] অতঃপর হযরত আবূ বকর (রা) ইহা মানিয়া লইতে একটু দ্বিদা করিলেন না।

তবে একথা সত্য যে, হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে হযরত আবূ বকর (রা) বিশেষ কড়াকড়ি করিতেন। বিশেষভাবে ও অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে যখন রাসূলের কোন হাদীস প্রমাণিত হইত, তখন তিনি উহার সম্মুখে মাথা নত করিয়া দিতেন। দাদীর মীরাস সংক্রান্ত এইমাত্র উল্লেখিত ঘটনা হইতেই ইহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠে। পরন্তু কোন হাদীসের সত্যতা সম্পর্কে তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত নিঃসন্দেহ ও নিশ্চিত না হইতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইতেন না।[********************]

হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস গ্রহণে হযরত আবূ বকরই সর্ব প্রথম বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন।[********************]

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) হযরত আনাস (রা)-কে যখন বাহরাইনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া পাঠাইয়াছিলেন, তখন তিনি যাকাতের হুকুম-আহকাম সংক্রান্ত এক বিস্তারিত দস্তাবেজ লিখিয়া তাঁহার সঙ্গে পাঠাইয়া দেন। এই বিস্তারিত দস্তাবেজের শুরুতে লিখিত ছিলঃ

******************************************************

দয়াবান করুণাময় আল্লাহর নামে।– ইহা যাকাতের ফরয হওয়া সংক্রান্ত দস্তাবেজ। রাসূলে করীম (স) মুসলমানদের জন্য ইহা ফরয করিয়াছেন এবং আল্লাহ তাঁহার রাসূলকে এই নির্দেশ দিয়াছেন।[********************]

হযরত উমর ফারূক (রা)

দ্বিতীয় খলীফা হযতর উমর ফারূক (রা) নিজে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার দৃষ্টিতে দ্বীন-ইসলামের ভিত্তি হিসাবে কুরআন মজীদের পরই ছিল সুন্নাহ বা হাদীসের রাসূলের স্থানে। তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করিয়া ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের শাসকদের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন এবং সর্বসাধারণ্যে উহার ব্যাপক প্রচার করার নির্দেশ দিয়াছিলেন।

ইলমে হাদীসের শিক্ষা ব্যাপবতর করিয়া তোলার জন্য তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সংখ্যক মাদ্রাসা কায়েম করেন। প্রখ্যাত সাহাবিগণকে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে হাদীস শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে পাঠাইয়াছিলেন। এই পর্যায়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল,হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) ও হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার (রা)-কে বসরা প্রদেশে এবং হযরত উবাদা ইবনে সামিত ও হযরত আবুদ দারদা (রা) কে সিরিয়ায় প্রেরণ করিয়াছিলেন। [********************] আরজান ইবনে আবূ হালাকে এই উদ্দেশ্যেই মিসর পাঠাইয়াছিলেন।[********************]

হযরত আবূ মূসা আশ’আরী (রা) কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত হইয়া তখায় গমন করেন ও সেখানকার মুসলমানগণকে সম্বোধন করিয়া বলেনঃ

******************************************************

আমাকে হযরত উমর (রা) তোমাদের নিকট এই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করিয়াছেন যে, আমি তোমাদিগকে আল্লাহর কিতাব ও তোমাদের নবীর সুন্নাত-হাদীস শিক্ষা দিব।[********************]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-কেও তিনি কূফায় হাদীস ও কুরআনের শিক্ষাদাতা করিয়া পাঠাইয়াছিলেন এবং তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করার জন কূফাবাসীদিগকে আদেশ করিয়াছিলেন।[********************]

আল্লামা খাজরী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কূফায় অবস্থান করিলেন। সেখানকার লোকেরা তাঁহার নিকট রাসূল (স)-এর হাদীস শিক্ষা করিতেন। তিনি ছিলেন তাঁহাদের শিক্ষক ও বিচারপতি।[********************]

হযরত উমর (রা) হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে প্রথম খলীফার মত খুবই কঠোর নীতি অবলম্বন করিতেন। হযরত আবূ মুসা আশ’আরী (রা) বর্ণিত একটি হাদীসের সত্যতা প্রমাণের জন্য তিনি তাঁহাকে (আবূ মুসাকে) কঠোর ভাষায় নির্দেশ দিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

দলীল পেশ কর, নতুবা আমি তোমাকে কঠোর শাস্তি দিব।

পরে তাঁহার কথার  সমর্থনে অপর এক সাহাবীকে যখন সাক্ষী হিসাবে পেশ করা হইল, তখন তিনি আশ্বস্ত হইলেন।[********************]

আল্লামা যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে তিনি মুহাদ্দিসদের জন্য দৃঢ় ও মজবুত নীতি অবলম্বনের নিয়ম প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়াছেন।[********************]

হযরত আবূ মুসা তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সপক্ষে আর একজন সাহাবীকে সাক্ষী হিসাবে পেশ করিলেন। তাহার পরই হযরত উমর (রা) তাহা কবুল করিলেন। ইহিা হইতে প্রমাণিত হয়ঃ

******************************************************

কোন হাদীসস যখন অন্তত দুইজন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী বর্ণনা করেন, তখন তাহা একজনের বর্ণিত হাদীস অপেক্ষা অধিক প্রামাণ্য, শক্তিশালী ও অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য হয়। এই হাদীস বর্ণনার বহু সংখ্যক সূত্র লাভ করার জন্যও ইহা যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। ইহার ফলে হাদীস ‘সাধারণ ধারণার’ (********************) পর্যায় হইতে নিঃসন্দেহ ইলমের (নির্ভূল ও নির্ভরযোগ্য জ্ঞান) পর্যায়ে উন্নীত হইতে পারে।[********************]

হযরত উবায় ইবনে কা’ব একটি হাদীস বর্ণনা করিলে হযরত উমর (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

আপনি যে হাদীস বর্ণনা করিলেন, তাহার সত্যতা সম্পর্কে আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ পেশ করিতে হইবে।[********************]

হযরত উবায় আনসারদের মধ্য হইতে কয়েকজন সাহাবীকে সাক্ষী হিসাবে পেশ করিলে খলীফা বলিলেনঃ

******************************************************

আমি আপনার প্রতি কোন সন্দেহ করি নাই, হাদীসকে অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যেই আমি আপনার নিকট প্রমাণের দাবি করিয়াছিলাম।[********************]

হযরত উমর ফারূকের সময়ই সরকারী পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হাদীস সম্পদ সংকলন ও লিপিবদ্ধ করা হয় এবং উহাকে সুসংবদ্ধ করিয়া লওয়ার প্রশ্ন সর্বপ্রথম উত্থাপিত হয়। হযতর উমর (রা) নিজেই এই বিরাট কাজ সম্পন্ন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং এ সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবীর সহিত পরামর্শও করিয়াছিলেন। মুসলমানরা তাঁহাকে ইহার অনুকূলেই পরামর্শ দিয়াছিলেন। কিন্তু পরে তাঁহার নিজের মনেই এই সম্পর্কে দ্বিধা ও সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, ইহা করা সমীচীন হইবে কিনা? তিনি প্রায় একমাস কাল পর্যন্ত অনেক চিন্তা-ভাবনা ও ইস্তেখারা করিতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই একদিন বলিলেনঃ

******************************************************

আমি তোমাদের নিকট হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করার কথা বলিয়াছিলাম, একথা তোমরা জান। কিন্তু পরে মনে হইল, তোমাদের পূর্বের আহলে কিতাব লোকেরাও এমনিভাবে নবীর কথা সংকলিত করিয়াছিল, ফলে তাহারা তাহাই আঁকড়িয়া ধরিল এবং আল্লাহর কিতাব পরিত্যাগ করিল। আল্লাহর শপথ, আমি আল্লাহর কিতাবের সাথে কোন কিছুই মিশ্রিত করিব না। অতঃপর তিনি হাদীস সংকলিত করার সংকল্প ত্যাগ করেন।

বস্তুত সুসংবদ্ধ ও সংকলিত হাদীস-গ্রন্হ পাইয়া লোকেরা হয়ত উহাতে এতখানি মনোনিবেশ করিয়া বসিবে যে, কুরআন শরীফকেও তাহারা ভুলিয়া যাইবে, লোকদের নিকট উহার গুরুত্ব নগণ্য হইয়া পড়িবে ও কেবলমাত্র হাদীসকে ভিত্তি করিয়াই তাহারা চলিতে চাহিবে, কেবলমাত্র এই আশংকায়ই হযরত উমর ফারূক (রা) নিজে হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করার কাজ করেন নাই। অন্যথায় ইহাকে তিনি কোন নাজায়েয কাজ নিশ্চয়ই মনে করিতেন না। তাঁহার এই আশংকা কতখানি যুক্তিসংগত ছিল, তাহা পরবর্তীকালের অবস্থার দৃষ্টিতে বিচার করিলেই বুঝিতে পারা যায়।[********************] এই ধরণের সতর্কতাবম্বনের ফলেই আজ মুসলিম মিল্লাত কুরআন মজীদকে প্রথম এবং হাদীসকে উহার পরেই দ্বিতীয় গুরুত্ব দিতে শিখিয়াছে। এইরূপ সতর্কতা অবলম্বিত না হইলে মুসলমানদের নিকটই হযরত কুরআন মজীদের স্থান প্রথম ও মুখ্য না হইয়া গৌণ হইয়া পড়িত, যেমন হইয়াছে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিকট তাহাদের ধর্মগ্রন্হ।

হযরত উসমান (রা)

হযরত উসমান (রা) নিজে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন; কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক হাদীসই তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত হইয়াছে। ইহার কারণ প্রদর্শন সম্পর্কে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে রাসূলের অধিক হাদীস সংরক্ষণকারী আমি নহি, এই কারণটি আমাকে রাসূলের হাদীস বর্ণনা করা হইতে বিরত রাখে নাই। বরং হাদীস বর্ণনা হইতে বিরত থাকার কারণ এই যে, আমি নিজেই রাসূল করীম (স)-কে এই কথা বলিতে শুনিয়াছি বলিয়া সাক্ষ্য দিয়েছি যে, রাসূল যাহা বলেন নাই তাহা যদি কেহ তাঁহার উপর আরোপ করে তবে সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় খুঁজিয়া লয়।[********************]

হযরত আলী (রা)

যে কয়জন সাহাবী নিজেদের হাতে রাসূলের নিকট শ্রুত হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া লইয়াছিলেন, হযরত আলী (রা) তাঁহাদের অন্যতম।তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস রাসূলের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়া লিখিয়াছিলেন। এই হাদীস সমষ্টির তিনি নাম দিয়াছিলেন ‘সহীফা’। ইহাকে ভাঁজ করিয়া তিনি তাঁহার তলোয়ারের খাপের মধ্যে সযত্নে রাখিয়া দিয়াছিলেন। ইহাতে ব্যবহারিক ও কাজকর্ম সংক্রান্ত হুকুম আহকামের কয়েকটি হাদীস লিখিত ছিল।[সহীহ বুখারী শরীফ, কিতাবুল ইলম ও কিতাবূল ই’তেসাম, মুসনাদে আহমদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭০৯।]

পরবর্তীকালে এই সহীফাখানিকে তিনি হযরত উসমানের নিকট পাঠাইয়া দেন হাদীসের একখানি লিখিত দস্তাবেজ হিসাবে। তাঁহার পুত্র মুহাম্মদ ইবনুল হানাফীয়া বলেনঃ

******************************************************

আমাকে আমার পিতা এই বলিয়া পাঠাইয়া দিলেন যে, এই কিতাবখানি লইয়া খলীফা উসমান (রা)- এর নিকট যাও। ইহাতে সদকা ও যাকাত সম্পর্কে রাসূলে করীমের ফরমান লিখিত রহিয়াছে।[********************]

উপরিউক্ত আলোচনা হইত প্রমাণিত হয় যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে হাদীস প্রচারিত হইয়াছে, উহা শিক্ষাদানের কাজ পূর্ণ মাত্রায় চলিয়াছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিচার-আচারে উহা আইনের অন্যতম ভিত্তি হওয়ার মর্যাদা লাভ করিয়াছে। খণ্ডভাবে বিভিন্ন লোকদের দ্বারা উহা লিখিত এবং সংগৃহীতও হইয়াছে। কিন্তু হাদীস যথাযথভাবে গ্রন্হকারে সংকলিত হয় নাই। তখন পর্যন্ত তাহা বহু তাবেয়ী তাহাদের নিকট হইতে উহা শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়া বহু লোকের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচার করিয়া দিয়াছেন। কিন্তু হাদীস যথারীতি গ্রন্হকারে সংকলনের কাজ এই পর্যায়ে কেহ করিয়াছেন- ইতিহাসে ইহার কোন নজীর পাওয়া যায় না। এইভাবেই ইসলামী ইতিহাসের প্রায় একটি শতাব্দীকাল অতিক্রম হয়। হিজরী প্রথম শতকের শেষভাগে ইহার ব্যতিক্রম ঘটে এবং হাদীস সংকলনের ব্যাপারে এক বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) ও হাদীস সংকলন

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) ৯৯ হিজরী সনে খলীফা নির্বাচিত হন। তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াই হাদীসের বিরাট বিক্ষিপ্ত সম্পদ সংকলনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, ইসলামী জীবন যাপন ও খিলাফত পরিচালনার জন্য হাদীস এক অপরিহার্য সম্পদ। অনতিবিলম্বে ইহার সংকলন ও পূর্ণ সংরক্ষিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করিলে এই সম্পদ হইতে গোটা উম্মতের বঞ্চিত হওয়ার আশংকা। সাহাবায়ে কিরামের প্রায় সকলেই দুনিয়া হইতে বিদায় লইয়াছেন। তাঁহাদের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত তাবেয়ীদেরও অধিক সংখ্যক লোক তাহাদেরই অনুগামী হইয়াছেন। এখনও যাহারা জীবিত আছেন, তাঁহারা আরও দীর্ঘদিন বাঁচিয়া থাকিবেন- তাহার নিশ্চয়তা কিছু নাই। অতএব অনতিবিলম্বে এই মহান সম্পদ সংগ্রহ ও সংকলন এবং উহাকে সুবিন্যাস্তকরণ একন্তই আবশ্যক।

অতঃপর তিনি ইসলামী রাজ্যের কেন্দ্রে নিম্নোক্ত ভাষায় ফরমান লিখিয়া পাঠাইলেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীমের হাদীসের প্রতি অনতিবিলম্বে দৃষ্টি দাও এবং তাহা সংগ্রহ ও সংকলন করিতে শুরু কর।[]

মদীনার শাসনকর্তা ও বিচারপতি আবূ বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাযমকেও নিম্নোক্ত মর্মে এক ফরমান লিখিয়া পাঠানঃ

******************************************************

রাসূলের হাদীস, তাঁহার সুন্নাত কিংবা হযরত উমরের বাণী অথবা অনুরূপ যাহা কিছু পাওয়া যায়, তাহার প্রতি দৃষ্টি দাও এবং আমার জন্য লিখিয়া লও। কেননা আমি ইলমে হাদীসের ধারকদের অন্তর্ধান ও হাদীস সম্পদের বিলুপ্তির আশংকা বোধ করিতেছি।[********************]

******************************************************

আর হাদীসে- রাসূল ছাড়া আর কিছুই যেন গ্রহণ করা না হয়। লোকেনা যে এই ইলমে হাদীসকে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। হাদীস শিক্ষাদানের জন্য যেন মজলিস অনুষ্ঠিত হয়, যাহারা জানে না, তাহারা যেন শিখিয়া লইতে পারে। কেননা ইলম গোপন করা হইলেই তাহা বিনাশপ্রাপ্ত হয়।[******************** বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ২০।]

ইমাম দারেমী আবদুল্লাহ ইবনে দীনার-এর জাবানীতে এই কথাটি নিম্নোক্ত ভাষায় উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের যেসব হাদীস তোমার নিকট প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত, তাহা এবং হযরত উমরের হাদীসসমূহ আমার নিকট লিখিয়া পাঠাও। কেননা আমি ইলমে হাদীস বিনষ্ট ও হাদীসবিদদের বিলীন হইয়া যাওয়ার আশংকা বোধ করিতেছি।[********************]

ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদ উমর ইবনে আবদুল আযীযের ফরমানের আর একটি অংশেরও উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার উদ্ধৃত অংশটুকু এইরূপঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয আবূ বকর ইবেন হাযমকে উমরা বর্ণিত হাদীসসমূহও লিখিয়া তাহার নিকট পাঠাইয়া দিবার জন্য ফরমান পাঠাইয়াছিলেন।[********************]

ইবনে সায়াদের বর্ণনা হইতে ইহাও জানা যায় যে, উমর ইবনে আবদুল আযীয হযরত আয়েশা (রা)-এর বর্ণিত হাদীসসমূহও লিখিয়া পাঠাইতে বলিয়াছেন। আর উমরা বিনতে আবদুর রহমানের বর্ণিত হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করিয়া পাঠাইবার জন্য এই কারণেই তাকিদ করিয়াছিলেন। কেননা মুসলমানের আকাইদ ও ব্যবহরিক জীবনের জন্য জরুরী হুকুম-আহকাম হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসসমূহেই বিশেষভাবে উল্লেখিত হইয়াছে।[********************] আর এই উমরা হযরত আয়েশা (রা)-এর ক্রোড়েই লালিত পালিত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার নিকট হাদীসের শিক্ষা পূর্ণমাত্রায় লাভ করিয়াছিলেন। উমর ইবনে আবদুল আজীজ নিজেই তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আয়েশার বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে উমরা অপেক্ষা বড় আলিম আর কেহ অবশিষ্ট নাই।[********************]

ইমাম জুহরীও তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি তাহাকে হাদীস জ্ঞানের এক অফুরন্ত সমুদ্রের মত পাইয়াছি।[********************]

ইমাম মালিক বলিয়াছেন, উমর ইবনে আবদুল আযীয আবু বকর ইবনে হাজমকে উমরা বিনতে আবদুর রহমানের সঙ্গে সঙ্গে কাসেম ইবনে মুহাম্মদ বর্ণিত হাদীসও লিখিয়া পাঠাইতে আদেশ করিয়াছিলেন।[********************]

এই কাসেম কে ছিলেন? ইমাম বুখারী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার পিতা নিহত হইলে তিনি তাঁহার ফুফু-আম্মা হযরত আয়েশার ক্রোড়ে লালিত-পালিত হন এবং তাঁহার নিকট দ্বীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন।[********************]

ইবনে হাব্বান এই কাসেম সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

কাসিম তাবেয়ী এবং তাঁহার যামানার লোকদের মধ্যে হাদীস ও দ্বীনের জ্ঞানের দিক দিয়া সর্বোত্তম ও সর্দার ব্যক্তি ছিলেন।[********************]

আবূ বকর ইবনে হযম সম্পর্কে পূর্বে বলা হইয়াছে যে, তিনি মদীনার শাসনকর্তা ছিলেন। সেই সঙ্গে বিচারপতির দায়িত্বও তাঁহাকেই পালন করিতে হইত। তিনি তদানীন্তন মদীনার একজন প্রধান ফকীহ ছিলেন। ইসলামী আইন-কানুনে তাঁহার অতুলনীয় পারদর্শিতা ছিল। পূর্বোক্ত উমরা বিনতে আবদুর রহমানের নিকট হযরত আয়েশা বর্ণিত যাবতীয় হাদীস পূর্বেই লিপিবদ্ধ করিয়া নিজের নিকট রাখিয়া দিয়াছিলেন। উমরা তাহার আপন খালা হইতেন।[********************]

কাযী আবূ বকর খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীযের আদেশানুক্রমে বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ ও হাদীসের কয়েকখানী খণ্ড গ্রন্হ সংকলন করিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু খলীফার ইন্তেকালের পূর্বে তাহা ‘দারুল খিলাফতে’ পৌঁছানো সম্ভবপর হইয়া উঠে নাই। এ সম্পর্কে আল্লামা সুয়ূতী ইবনে আবদুল বার লিখিত ‘আত-তামহীদ’ গ্রন্হের সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবনে হাযম কয়েক খণ্ড হাদীস- গ্রন্হ সংকলন করেন; কিন্তু তাহা খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীযের নিকট পাঠাইয়া দেওয়ার পূর্বেই ইন্তেকাল করেন।[********************]

কিন্তু অতঃপর এই হাদীস- সংকলনসমূহের পরিণাম কি হইল? এই সম্পর্কে ইমাম মালিক বলিয়াছেনঃ আমি এই হাদীস গ্রন্হসমূহ সম্পর্কে কাযী আবূ বকরের পুত্র আবদুল্লাহর নিকট জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেনঃ ******************** তাহা সব বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে।[********************] কিন্তু ইহা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা খলীফা ইন্তেকাল করিয়া গিয়াছেন বলিয়াই সরকারী ব্যবস্থাপনায় তৈয়ার করা হাদীস সংকলনসমূহ বিনষ্ট হইয়া যাইবে, তাহার রক্ষণাবেক্ষণের কোন ব্যবস্থাই হইবে না- এমন কথা হইতে পারে না। নিশ্চয়ই উহা জনগণের নিকট রক্ষিত ছিল এবং পরবর্তীকালে উহার ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে হাদীসের প্রচার করা হইয়াছে।

কোন কোন বর্ণনা হইতে এ কথা জানা যায় যে, খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীয মদীনায় আবু বকর ইবনে হাযম ছাড়া সালেম ইবনে আবদুল্লাহকেও হাদীস সংগ্রহ করিয়া পাঠাইতে আদেশ করিয়াছিলেন। আল্লামা সুয়ূতী ইমাম জুহুরীর সূত্রে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয সালেম ইবনে আবদুল্লাহকে হযরত উমরের যাকাত ও সদকা সম্পর্কে রীতিনীতি লিখিয়া পাঠাইবার জন্য আদেশ করিয়াছিলেন।[********************]

ইমাম সুয়ুতী সালেম সম্পর্কে অতঃপর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সালেম যে বিষয়ে আদিষ্ট হইয়াছিলেন, তাহা তিনি পুরাপুরি লিখিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি (সালেম) তাঁহাকে ইহাও লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, হযরত উমর (রা) তাঁহার আমলেও তদানীন্তন লোকদের মধ্যে অনুরূপ কাজ করেন তবে আপনি আল্লাহর নিকট উমর ফারূক হইতেও উত্তম ব্যক্তি বলিয়া বিবেচিত ও পরিগণিত হইবেন।[********************]

এই সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আনসারী বলেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয যখন খলীফা নির্বাচিত হইলেন, তখন তিনি মদীনায় রাসূলে করীমের ও হযরত উমরের যাকাত ইত্যাদি সংক্রান্ত লিখিত দস্তাবেজ সংগ্রহের জন্য তাকীদ কারিয়া পাঠাইলেন। পরে আমর ইবনে হাযমের বংশধরদের নিকট রাসূলে করীমের লিখিত বস্তাবেজ এবং হযরত উমরের বংশধরদের নিকট রাসূলে করীমের অনুরূপ লিখিত দস্তাবেজ পাওয়া গেল।[********************]

উমর ইবনে আবদুল আযীয ইমাম জুহরীকে বিশেষভাবে হাদীস সংকলনের কাজে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।[********************]

ইমাম জুহরী সম্পর্কে উমর ইবনে আবদুল আযীয নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত ও হাদীস সম্পর্কে যুহরী অপেক্ষা বড় আলিম বিগত কালের আর একজনও বাঁচিয়া নাই।[********************]

এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী (র) নিজেই বলেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয আমাদিগকে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন করার জন্য আদেশ করিলেন। এই আদেশ পাইয়া আমরা হাদীসের বিরাট গ্রন্হ লিখিয়া তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দিলাম। অতঃপর তিনি নিজেই তাঁহার  রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রদেশে এক-একখানি গ্রন্হ পাঠাইয়া দিলেন।[********************]

সংগৃহীত হাদীস সম্পদ যে কিছুমাত্র বিনষ্ট হয় নাই, এই কথা হইতে তাহা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়।

ইমাম মালিক (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সর্বপ্রথম যিনি হাদীস সংকলন করেন, তিনি হইলেন ইবনে শিহাব যুহরী।[********************]

ইমাম  আবদুল আযীয দারাওয়ার্দী নামক অপর এক মনীষীও এই কথারই সমর্থন করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস সংকলনও উহা লিপিবদ্ধকরণের কাজ সর্বপ্রথম করিয়াছেন ইবনে শিহাব যুহরী।[********************]

ইমাম যুহরী এই গৌরবের দাবি করিয়া নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার পূর্বে ইলমে হাদীস আর কেহ সংকলিত করেন নাই।[********************]

উমর ইবনে আবদুল আযীয কেবল হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করণেরই নির্দেশ দেন নাই, বরং সর্বত্র উহার ব্যাপক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার জন্যও তিনি সুস্পষ্ট ফরমান পাঠাইয়াছিলেন।

অপর একজন শাসনকর্তার নামে নিম্নোক্ত ভাষায় এক ফরমান প্রেরিত হইয়াছিলঃ

******************************************************

হাদীসবিদ ও বিদ্বান লোকদিগকে আদেশ করুন, তাঁহারা যেন মসজিদে মসজিদে হাদীসের শিক্ষাদান ও উহার ব্যাপক প্রচার করেন। কেননা হাদীসের জ্ঞান প্রায় বিলীন হইয়া যাইবার উপক্রম হইতেছে।[********************]

উপরিউক্ত উদ্ধৃতি ও ঐতিহাসিক দলীল- প্রমাণের ভিত্তিতে এই কথায় কোনই সন্দেহ থাকে না যে, উমর ইবনে আবদুল আযীযের হাদীস-সংগ্রহ সম্পর্কিত ফরমান বিশেষ একটি মাত্র স্থানে প্রেরিত হয় নাই, বরং ইসলামী রাজ্যের সর্বত্রই এই ফরমান পাঠানো হইয়াছিল এবং উহার ফলে সর্বত্রই হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের অভিযান সুষ্ঠুভাবে শুরু হইয়া গিয়াছিল। এই অভিযানের অনিবার্য ফলস্বরূপ সর্বত্রই হাদীস সংকলিত হয়। সেই সময় জীবিত প্রায় সকল হাদীসবিদই হাদীস সংকলনের মহৎ কাজে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের সংকলিত বিরাট বিপুল সম্পদ মুসলিম সমাজের নিকট চিরকালের অমূল্য ধনরূপে গণ্য ও সংরক্ষিত হইয়া রহিয়াছে।

উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) অন্য লোকদিগকে আদেশ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, তিনি নিজেও হাদীস লিখিয়া লইবার কাজ শুরু করিয়াছিলেন, এইরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ও হযরত আনাস হইতে হাদীস বর্ণনাকারী আবূ কালাবা [********************] বলিয়াছেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয একদা জুহরের নামাযের জন্য মসজিদে আসিলে আমরা তাঁহার হাতে কিছু কাগজ দেখিতে পাইলাম। পরে আসরের নামাযের জন্য বাহির হইয়া আসিলেও তাঁহার সহিত সেই কাগজই দেখিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলামঃ হে আমীরুল মুমিনীন! এই লিখিত জিনিসটি কি? জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ আওন ইবনে আবদুল্লাহ আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, উহা আমার খুব পছন্দ হইয়াছে, আমি তাহা লিখিয়া লইয়াছি। তাহার মধ্যে এই হাদীসটিও রহিয়াছে।[********************]

ইমাম যুহরীর পরবর্তী সময়ে যাঁহারা ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন কেন্দ্রে হাদীস সংকলন ও গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে নিম্নোক্ত মনীষিগণ উল্লেখযোগ্যঃ

মক্কা শরীফে ইবনে জুরইজ (১৫০ হিঃ); মদীনায় ইবনে ইসহাক (১৫১ হিঃ) ও ইমাম মালিক (১৭৯ হিঃ); বসরায় রুবাই ইবনে সুবাইহ (১৬০ হিঃ), সায়ীদ ইবনে আবূ আরুবা (১৫৬ হিঃ) ও হাম্মাদ ইবনে সালমা (১৭৬ হিঃ); কূফায় সুফিয়ান আস-সওরী (১৬১ হিঃ); সিরিয়ায় ইমাম আওযায়ী (১৫৬ হিঃ); ওয়াসত-এ হুশাইম (১৮৮ হিঃ); ইয়েমেন মা’মার (১৫৩ হিঃ); এবং খোরাসানে জরীর ইবনে আবদুল হামীদ (১৮৮ হিঃ); আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রা) (১৮১ হিঃ)।[********************]

উপরে প্রত্যেক নামের সঙ্গে উল্লিখিত সন তারিখ হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, তাঁহারা সকলেই সমসাময়িক ও প্রায় একই যুগের লোক ছিলেন এবং একই সময়ের বিভিন্ন স্থানে থাকিয়া রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস সম্পদ সংগ্রহ ও হাদীস গ্রন্হ সংকলন করিয়াছেন। কাজেই এই ব্যাপারে তাঁহাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কে এই কাজ করিয়াছেন, তাহা নিশ্চিত করিয়া বলার উপায় নাই। কিন্তু আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী তাঁহাদের মধ্যে অগ্র-পরের একটি বিন্যাস কায়েম করিয়া দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সর্বপ্রথম হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ করেন রুবাই ইবনে সুবাইহ ও সাদ ইবনে আবূ আরূবা এবং তাঁহাদের ছাড়া আরো কেহ কেহ। তাঁহারা হাদীসের প্রত্যেকটি অধ্যায়কে স্বতন্ত্রভাবে গ্রন্হাবদ্ধ করিতেন।[********************]

এই পর্যায়ে ইমাম মকহুলের নামও উল্লেখযোগ্য। কেননা তিনি গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হওয়ার পূর্বেই ‘কিতাবুস সুনান’ নামে হাদীসের একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]

কূফা নগরে ইমাম শা’বী একই বিষয়  সম্পর্কিত হাদীসসমূহ একই স্থানে সন্নিবদ্ধ করার কাজে সর্বপ্রথম হাত দেন।[********************] প্রথমত তিনি হাদীস লিখন ও হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের পক্ষপাতী ছিলেন না, কিন্তু কেবলমাত্র খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনে আবদুল আযীযের নির্দেশ পাইয়াই হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন শুরু করেন। কেননা তিনি কূফা প্রদেশে উমর ইবনে আবদুল আযীযের নিযুক্ত বিচারপতি ছিলেন।[********************]

আল্লামা সুয়ূতী ইবনে হাজর আসকালানী হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

একই বিষয় সম্পর্কিত হাদীসসমূহ একত্র সংকলন করার কাজ সর্বপ্রথম করেন ইমাম শা’বী। কেননা তাঁহার সম্পর্কে বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি ‘ইহা তালাক সম্পর্কে এক বিরাট অধ্যায়’ বলিয়া উহাতে বহু সংখ্যক হাদীস একত্রে লিখিয়াদিয়াছেন।[********************]

ইমাম শা’বী ২২ হিজরী সনে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের খিলাফত আমলে জন্মগ্রহণ করেন, আর ইন্তেকাল করেন ১০৪ হিজরীতে। ইমাম মকহুলের ইন্তেকাল হয় ১৩৪ সনে। আর ইমাম যুহরীও এই ১২৩, ১২৪ কিংবা ১২৫ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। এই হিসাবের ভিত্তিতে বলা যায়, হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইমাম মকহুল প্রথম ব্যক্তি।

কিন্তু বিশেষভাবে বিচার করিলে এই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করিতে হয় যে, হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ সর্বপ্রথম করিয়াছেন মদীনার হাদীসবিদগণ- আবূ বকর ইবনে হাজম, সালেম ও ইমাম যুহরী প্রমুখ। আর অধ্যায় ভিত্তিতে হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ করিয়াছেন কূফার মুহাদ্দিসগণ- ইমাম শা’বী ও অন্যান্য।[********************]

উমাইয়া বংশের ‘খলীফায়ে রাশেদা’ উমর ইবনে আবদুল আযীয হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের ফরমান জারি করার পর বেশিী দিন জীবিত ছিলেন না। কিন্তু তাঁহার এই ফরমানের ফলে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের যে প্রবাহ তরংগায়িত হইয়িা উঠিয়াছিল, তাহা অতঃপর কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ইমাম যুহরীরর পরবর্তী মনীষী ও হাদীসবিদগণ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে পূর্ণমাত্রায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। অতঃপর এই কাজ পূর্ণোদ্যমে চলিতে থাকে।

 

হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস সংকলন

উমর ইবনে আবদুল আযীয ১০১ হিজরীর ২৫শে রজব ইন্তেকাল করেন। তাঁহার খিলাফতের মেয়াদ ছিল দুই বৎসর পাঁচ মাস। ইমাম শা’বী ইমাম যুহরী, ইমাম মকহুল দেমাশকী ও কাযী আবূ বকর ইবনে হাযমের সংকলিত হাদীস গ্রন্হাবলী তাঁহারই খিলাফতকালের অমর অবদান। প্রথম হিজরী শতকের মধ্যেই এই গ্রন্হাবলীর সংকলন কার্য সম্পূর্ণতা লাভ করিয়াছিল।

প্রথম হিজরী শতকে এই পর্যায়ে যতটুকু কাজ সম্পন্ন হইয়াছিল, পরিমাণে ও আকারে তাহা বিরাট কিছু না হইলেও উহার ফলে যে হাদীস গ্রন্হ-সংকলনের দ্বার উন্মুক্ত হইয়াছিল, তাহা অনস্বীকার্য। ফলে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম হইতেই এই কাজ যথোপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে সম্পন্ন হইতে শুরু করে। এই পর্যায়ে কেবলমাত্র রাসূল (স)- এর কথা ও কাজ সম্পর্কিত হাদীসই নহে, সাহাবায়ে কিরামের কথা, ফতোয়া, তাবেয়ীদের কুরআন-হাদীসভিত্তিক বিভিন্ন ফতোয়া এবং দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তাঁহাদের কথাবার্তা ও নসীহতের বাণী পর্যন্ত এই যুগের হাদীস গ্রন্হাবলীতে সন্নিবেশিত হইবার সুযোগ লাভ করে।

কিতাবুল আ’সর

তাবেয়ী যুগের মুহাদ্দিসদের সংকলিত হাদীস গ্রন্হাবলী স্বীয় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লইয়া পরবর্তীকালের হাদীসানুধ্যায়ীদের নিকট পৌঁছায় নাই। এই দিক দিয়া আমাদের নিকট বিরাজমান কেবলমাত্র একখানি গ্রন্হেরই নাম করা যাইতে পারে এবং তাহা হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার। ইমাম আবূ হানীফা (র) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর সময়ে প্রতিষ্ঠিত [********************] কূফার জামে মসজিদের প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধান শিক্ষাগুরু নিযুক্ত হইয়া একদিকে যেমন ‘ইলমে ফিকাহ’র ভিত্তি স্থাপন করেন, অপরদিকে সেই সঙ্গেই তিনি রাসূল (স)-এর আদেশ-নিষেধমূলক হাদীসসমূহের ও একটি সংকলন নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংকলিত হাদীস সমূহের সমন্বয়ে রচনা করেন। এই গ্রন্হেরই নাম হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার’। দুনিয়ার মুসলিম জাতির নিকট ইহা অপেক্ষা প্রাচীনতম হাদীস গ্রন্হ সম্ভবত আর একখানিও বর্তমান নাই। অথবা বলা যায়, মুসলিম উম্মতের নিকট মওজুদ হাদীস গ্রন্হাবলীর মধ্যে ইহাই সর্বাধিক প্রাচীন হাদীস-গ্রন্হ। ইমাম আবূ হানীফার পূর্বে হাদীস সংগ্রহকারিগণ কর্তৃক যেন-তেনভাবে হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও সংকলন করার কাজই হইয়াছিল। ঠিক গ্রন্হ প্রণয়নের ধারায় হাদীসের কোন গ্রন্হই বিরচিত হয় নাই। ইমাম শা’বী একই বিষয়ের হাদীস একস্থানে একত্র করিয়া একখানি গ্রন্হের রূপ দিয়াছিলেন বটে; কিন্তু তাহা মাত্র কয়েকটি অধ্যায় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল, ইহার বেশী কিছু করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। এই কাজ অতঃপর আর অগ্রসরও হইতে পারে নাই। এই কারণে হাদীসসমূহকে পরিচ্ছেদ (কিতাব) ও অধ্যায় (বাব) হিসাবে, গ্রন্হ প্রণয়নের ধারা ও পদ্ধতি অনুসারে সুসংকলিত করার কাজ তখন পর্যন্তও অসম্পন্নই রহিয়া গিয়াছিল। ইমাম আবূ হানীফা (র) ‘কিতাবুল আ’সার’ প্রণয়ন করিয়া এই দায়িত্ব বিশেষ যোগ্যতা ও বিজ্ঞতা সহকারেই পালন করিয়াছিলেন। হাফেজ সুয়ূতী ইমাম আবূ হানীফা (র) সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র) বিশেষ একটি কীর্তি-যাহাতে তিনি একক, তাহা এই যে, তিনিই সর্বপ্রথম ইলমে শরীয়াতকে সুসংবদ্ধ করিয়াছেন এবং উহাকে অধ্যায় হিসাবে সংকলিত করিয়াছেন। ইমাম মলিক (র) ‘মুয়াত্তা’ প্রণয়নে তাহারই অনুসরণ করিয়াছেন। কিন্তু এইরূপ গ্রন্হ প্রণয়নের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র)-কে সময়ের দিক দিয়া কেহই অতিক্রম করিয়া যাইতে পারেন নাই।[********************]

ইমাম  আবূ হানীফা (র)-এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র) বর্ণিত স্বতন্ত্র হাদীস-গ্রন্হ বর্তমান। আর তাহা হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার’; ইহা তাঁদের নিকট হইতে মুহাম্মদ ইবনে হাসান বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]

ইমাম আলাউদ্দিন ‘কাশানী’ এই কিতাবের উল্লেখ করিয়াছেন ******************** ইমাম আবূ হানীফা (র) সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বলিয়া।[********************]

‘কিতাবুল আ’সার’ নামক হাদীসগ্রন্হখানি প্রণয়নের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র) ব্যাপকভাবে হাদীস সংগ্রহ ও ছাঁটাই-বাছাই করিয়াছেন। সদরুল আয়িম্মা মুয়াফফিক ইবনে আহমদ মক্কী তাঁহার গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র) চল্লিশ সহস্র হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া ‘কিতাবুল আ’সার’-এর এই গ্রন্হখানি প্রণয়ন করেন।[******************** এখানে হাদীসের যে সংখ্যা বলা হইয়াছে, তাহা হাদীসের আলাদা আলাদা সংখ্যা নহে; বরং হাদীসের সূত্র মাও এবং এক-একটি হাদীসের বহু সংখ্যক সূত্র হইতে পারে।]

হাদীস চয়ন ও হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে তাঁহার এই অসামান্য সতর্কতার কথা সকল হাদীস-পারদর্শী ব্যক্তিই স্বীকার করিয়াছেন। ইমাম ওকী (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র) কর্তৃক যেরূপ সতর্কতা অবলম্বিত হইয়াছে, তদ্রুপ আর কাহারও দ্বারা অবলম্বিত হয় নাই।[ঐ, এখানে উল্লেখ্য, হাদীসের ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাতান হাদীস যাচাই, পরখ ও বাছাই-ছাঁটাই শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

****************************************************** আল্লাহর নামের শপথ, মুসলিম উম্মত বা জাতির নিকট আল্লাহ ও রাসূলের নিকট হইতে পাওয়া সমস্ত ইলম-এর ক্ষেত্রে অধিক বড় আলিমরূপে স্বীকৃত।]

ঠিক এই কারণেই মনে হয় মুহাদ্দিমগণ ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সমালোচনা করিতে গিয়া তাঁহাকে ******************** ‘হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত কঠোর ও কড়া লোক’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন এবং এই কারণেই তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুব বেশী হইতে পারে নাই। ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে খালদুন ইহার কারণ বর্ণনা প্রসংগে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণ এই যে, তিনি হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনার ব্যাপারে কঠোর নৈতিক শর্ত আরোপ করিতেন।[********************]

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সংগ্রহীত হাদীসের বিপুলতা ও উহা সামান্য পরিমাণ বর্ণনা করা সম্পর্কে স্বয়ং ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর হইতে একটি উক্তি এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার নিকট কয়েক সিন্দুক ভর্তি লিখিত হাদীস-সম্পদ মজুদ রহিয়াছে। কিন্তু আমি তাহা হইতে অতি অর্প সংখ্যকই প্রকাশ ও বর্ণনা করিয়াছি, যাহা লোকদের ব্যবহারিক জীবনের উপকার দিবে।[********************]

অন্যান্য হাদীস গ্রন্হের ন্যায় ‘কিতাবুল আ’সার’-এর ‘নুসখা’ (অনুলিপি) রহিয়াছে। এই কারণে তাহা এক-একজন ছাত্রের নামেই প্রখ্যাত হইয়াছে। অন্যথায় মূল গ্রন্হ ইমাম আবূ হানীফারই সংকলিত একখানি মাত্র হাদীসগ্রন্হ। এই ‘নুসখা’ প্রকাশকারীদের মধ্যে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখযোগ্যঃ

১. ইমাম যুফার ইবনুল হুযাইলঃ এই সম্পর্কে প্রামাণ্য গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

******************************************************

আহমদ ইবনে বকর যুফার ইবনুল হুযাইলের ছাত্র আবূ ওহাবের নিকট  হইতে আবূ হানীফা (র)- এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]

২. ইমাম আবূ ইউসুফ ইবনে আবূ ইউসুফঃ তাঁহার সম্পর্কে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে তাঁহার সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ তাঁহার পিতার সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন। উহা একখানি বিরাট আকারের গ্রন্হ।[কাজী আতহার মূবারকপুরী (বো’ই হইতে প্রকাশিত ‘আল বালাগ’ পত্রিাকর সম্পাদক) লিখিয়াছেনঃ ইমাম আবূ হানীফার ‘কিতাবুল আ’সার’ তাঁহার নিকট হইতে তাঁহার ছাত্ররা অন্য লোকদের নিকট বর্ণনা করিয়াছেন এবং বর্ণনা করার সময় তাঁহারা নিজেরাও ইহাতে অনেক হাদীস সংযোজিত করিয়াছেন। এই কারণে মূল গ্রন্হখানি বিভিন্ন ছাত্রের নামে জনগণের মধ্যে পরিচিত হইয়াছে। অন্যথায় মুলগ্রন্হ ইমাম আবূ হানিফা (র)-এর সংকলিত হাদীস গ্রন্হ।********************]

৩. ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীঃ তাঁহার তৈরী করা সংকলনটিই প্রসিদ্ধ এবং ইহাই বর্তমান ভূলক্রমে ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বলিয়া পরিচিত।

৪. ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদ লু’লুয়ীঃ ইবনে হাজার আসাকালানী (র) ইহার সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবেন ইবরাহীমের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ‘কিতাবুল আ’সার’ মুহাম্মদ ইবনে শুজা তাহার ওস্তাদ হাসান ইবনে যিয়াদের সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]

মুয়াত্তা ইমাম মালিক

ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’-এর পরে পরেই সংকলিত হাদীস গ্রন্হ হিসাবে আমরা দেখিতে পাই ইমাম মালিক (র)-এর সংকলিত ‘মুয়াত্তা’।

কিতাবুল আ’সার ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র)-এর মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য এই যে, প্রথমোক্ত গ্রন্হে হিজায, ইরাক, সিরিয়াও মুসলিম জাহানের অন্যান্য হাদীস-বর্ণনাকারী লোকদের বর্ণিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হইয়াছে; কিন্তু ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’-এ রহিয়াছে কেবলমাত্র মদীনায় অবস্থানকারী মুহাদ্দিসদের বর্ণিত হাদীস। কেননা ইমাম মালিক (র) সম্পর্কে পূর্ববর্তী আলোচনা হইতে আমরা দেখিয়াছি যে, তিনি হাদীস সংগ্রহের জন্য মদীনার বাহিরে কখনো সফরে গমন করেন নাই।

‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের ধারা এইভাবে সাজানো হইয়াছে যে, প্রথমে রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস- কথা বা কাজের বিবরণ উল্লেখ করা হইয়াছে। তাহার পর উহাতে সাহাবায়ে কিরামের কথা এবং তাবেয়ীদের কুরআন-হাদীস ভিত্তিক ফতোয়াসমূহ সন্নিবেশিত হইয়াছে।[********************]

ইমাম মালিক (র) হাদীসের এই গ্রন্হখানি সংকলন করেন আব্বাসী খলীফা আল- মনসুর –এর আদেশক্রমে। মুহাম্মদ আবূ যাহু নামক এ যুগের একজন মিসরীয় গ্রন্হ-প্রণেতা লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আব্বাসী খলীফা  আবূ জাফর আল-মনসূর ইমাম মালিক (র)- কে ডাকিয়া বলিলেনঃ তিনি যেন তাঁহার নিজের নিকট প্রমাণিত ও সহীহরূপে সাব্যস্ত হাদীসসমূহ সংকলন ও একখানি গ্রন্হাকারে তাহা প্রণয়ন করেন এবং উহাকে যেন তিনি লোকদের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করার জন্য নির্দিষ্ট করেন। অতঃপর তিনি তাঁহার এই গ্রন্হ প্রণয়ন করেন এবং উহার নাম নির্দিষ্ট করেন- ‘আল-মুয়াত্তা’।[********************]

ইমমা মালিক (র) এই গ্রন্হখানি প্রণয়নের অপরিসীম শ্রম-মেহনত ও অমলিন ধৈর্য ও অধ্যবসায় নিয়োগ করিয়াছিলেন। ইমাম সুয়ূতী ইবনুল হুবাব-এর সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম মালিক (র) প্রথমে একলক্ষ বর্ণনা করেন। তাহা হইতে দশ হাজার হাদীসের সমন্বয়ে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ সংকলন করেন। অতঃপর তিনি উহাকে কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যাঁচাই করিতে থাকেন। সাহাবীদের আ’সার ও অন্যান্য খবর-এর ভিত্তিতেও উহার পরীক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত উহাতে মাত্র পাঁচশত হাদীস সন্নিবেশিত করেন।[********************]

ইমাম সুয়ূতী আতীক ইবনে ইয়াকুবের সুত্রে নিম্নোক্ত বর্ণনাও উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম মালিক প্রায় দশ সহস্র হাদীসের সমন্বয়ে ‘মুয়াত্তা’ রচনা করেন। অতঃপর তিনি উহার প্রত্যেক বৎসর দৃষ্টি দিতে ও যাঁচাই করিতে এবং উহা হইতে হাদীস প্রত্যাহার করিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত বর্তমান আকারে উহা পূর্ণ পরিণীত লাভ করে।[********************]

এই গ্রন্হ প্রণয়ন চূড়ান্তভাবে সম্পূর্ণ করিতে ইমাম মালিকের পূর্ণ চল্লিশটি বৎসর সময় লাগিয়াছে। এ সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেন, ইমাম মালিক এই গ্রন্হখানি প্রণয়নে পূর্ণ চল্লিশটি বৎসর অতিবাহিত করিয়াছেন। এই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনি উহাকে যাঁচাই ও ছাঁটাই করিতেছিলেন এবং উহাকে সুসংবদ্ধরূপে সজ্জিত, নির্ভূল ও শৃংখলিত করিতে ব্যস্ত ছিলেন।[********************]

এই গ্রন্হের নামকরণ সম্পর্কে ইমাম মালিক নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার এই কিতাবখানা আমি মদীনায় বসবাসকারী সত্তর জন ফিকাহবিদ-এর সম্মুখে পেশ করিয়াছি। তাঁহারা প্রত্যেকেই উহার জন্য আমাকে উপদেশ দিয়াছেন। এই কারণে আমি উহার নাম রাখিয়াছি ‘মুয়াত্তা’।[********************]

উপরে ইবনুল হুবাবের সূত্রে উল্লেখিত ইমাম সুয়ূতীর উদ্ধতি হইতে জানা গিয়াছে যে, ইমাম মালিক দশ হাজার হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া মাত্র পাঁচশত হাদীস তাঁহার গ্রন্হে রাখিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হে মোট কতটি হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে, তাহা এই উদ্ধৃতি হইতে জানা যায় না। এই সম্পর্কে ইমাম সয়ূতীর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি হইয়াছে, তাহা এই উদ্ধৃতি হইতে জানা নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়।  তিনি আবূ বকর আল- আবরাহীর সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

মুয়াত্তা গ্রন্হে রাসূলে করীম (স), সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীন হইতে বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে এক হাজার সাতশত বিশটি।[********************]

ইহার মধ্যে সঠিকরূপে সনদযুক্ত  হাদীস হইতেছে মাত্র তিনশত, ‘মুরসাল’ হাদীস হইতেছে ২২২টি, ‘মওকুফ’ হইতেছে ৬১৬টি এবং তাবেয়ীদের উক্তি হইতেছে ২৮৫টি। [********************] ইমাম হাযম (র) বলেনঃ

******************************************************

আমি ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের হাদীসসমূহ গণনা করিয়াছি। ফলে উহাতে আমি পাইয়াছি ‘মুসনাদ’ হাদীস পাঁচশতের কিছু বেশী প্রায় তিনশত হাদীস ‘মরসাল’। এতদ্ব্যতীত উহাতে প্রায় সত্তরটি হাদীস এমনও আছে, যাহার অনুসরণ করা ইমাম মালিক (র) পরিহার করিয়াছিলেন।[********************]

‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের নোসখা অসংখ্য। তন্মধ্যে তিনশত ‘নোসখা’ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এই নোসখাসমূহে সন্নিবেশিত হাদীসের সংখ্যায় যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান- কোনটিতে অপেক্ষাকৃত বেশী, আর কোনটিতে কম হাদীস রহিয়াছে। ইমাম সুয়ুতী ইহার তিনটি নোসখার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। নোসখা তিনটি এইঃ

১. ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া লাইসী আন্দালুসীকৃত নোসখাঃ তিনি ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হইতে সরাসরিভাবে শেষ তিনটি অধ্যায় বাদে সম্পূর্ণ ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ শবণ করিয়াছিলেন।

২. আবূ মুসয়িব আহমদ ইবনে আবূ বকর আল কাসিম কৃতঃ তিনি মদীনার বিচারপতি ছিলেন এবং তাঁহার তৈরী করা নোসখাই ইমাম মালিক (র)-কে সর্বশেষে শুনানো হয়। ইহাতে অপর নোসখার তুলনায় প্রায় একশতটি হাদীস বেশী রহিয়াছে।

৩. ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান শায়বানী কৃতঃ তিনি যেমন ইমাম আবু হানীফা (র)-এর নিকট ইলমে ফিকাহ শিক্ষা করিয়াছেন, অনুরুপভাবে ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হাইতে তিনি হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করিয়াছেন।[********************] ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হইতে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ শ্রবণ করিয়া প্রায় এক হাজার ব্যক্তি উহার বর্ণনা করিয়াছেন।[********************] ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, তদানীন্তন ইসলামী সমাজে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ যথাযথ মর্যাদা লাভ করিয়াছিল। জনগণ উহাকে সাদরে গ্রহন করিয়াছিল এবং মদীনার অধিবাসী ইমাম মালিক (র)-এর নিকট সরাসরিভাবে উহা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করার উদ্দেশ্যে গোটা মুসলিম জাহানের জনতা ভীড় জমাইয়াছিল। বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস এই কারণেই মনে করেন যে, তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত নবী করীম (স)-এর নিম্নোক্ত ভবিষ্যদ্বাণী ইমাম মালিক (র) সম্পর্কেই সত্য প্রমাণিত হইয়াছে। হাদীসটি এই- নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সেই সময় খুব দূরে নয়, যখন জনগণ ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে উষ্ট্রপৃষ্ঠে সাওয়ার হইয়া দূর দূর দেশ সফর করিবে; কিন্তু তাহারা মদীনায় অবস্থানকারী ‘আলেম’ অপেক্ষা অধিক বিজ্ঞ অন্য কাহাকেও কোথাও পাইবে না।[********************]

ইবনে উয়াইনা ও আবদুর রাযযাক প্রমুখ বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে বলিয়াছেন যে, এই হাদীসে উক্ত ‘আলেম’ হইতেছেন ইমাম মালিক (র)।[তিরমিযী, হযরত আবূ হুরায়রা বর্ণিত।]

‘মুয়াত্তা’ ইমাম মালিক (র) সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী (র) অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করিতেন ও ইহাকে এক অনন্য সাধারণ গ্রন্হ মনে করিতেন। তাঁহার এই সম্পর্কিত নিম্নোদ্ধৃত উক্তি সর্বজনবিদিত। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহর কিতাবের পর ইমাম মালিক (র) সংকলিত হাদীসের কিতাব অপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধ গ্রন্হ দুনিয়ার বুকে আর একখানিও নাই।[********************]

তাঁহার এই কথাটি নিম্নোক্ত ভাষায়ও বর্ণিত হইয়াছেঃ

******************************************************

কুরআনের অধিকতর নিকটবর্তী কিতাব ইমাম মালিক (র)-এর কিতাব অপেক্ষা আর একখানিও পৃথিবীর বুকে রচিত হয় নাই।[********************]

পরবর্তীকালের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ জারয়া মুয়াত্তা মালিক (র) সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এতখানি আস্থা ও নির্ভরতা অপর কোন কিতাবের উপর স্থাপিত হয় নাই।[********************]

ইমাম মালিক সংকলিত এই হাদীস গ্রন্হ এতই জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিল যে, তদানীন্তন আব্বাসীয় বাদশাহ আল-মনসুর হ্জ্জ উপলক্ষে মদীনায় গমন করিলে তিনি ইমাম মালিক (র)-কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

আমি সংকল্প করিয়াছি যে, আপনার সংকলিত হাদীস গ্রন্হখনির অসংখ্য অনুলিপি তৈয়ার করাইয়া প্রত্যেক মুসলিম শহরেও নগরে এক-একখানি করিয়া পাঠাইয়া দিব ও সেই অনুযায়ী আমল করার জন্য সকলকে আদেশ করিব। এবং উহাকে ছাড়িয়া অপর কোন গ্রন্হের দিকে মনোযোগ না দিতে বলিব।

এই কথা শ্রবণের পর ইমাম মালিক (র)-এর মনে আনন্দ ও স্ফূর্তির বন্যা প্রবাহিত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ইমাম মালিক (র)-ইহা মোটেই পছন্দ করিতে ও মানিয়া লইতে পারিলেন না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলিলেনঃ

******************************************************

আপনি এইরূপ কাজ করিবেন না। কেননা লোকরেদ নিকট পূর্বেই শরীয়াতের বহু কথা পৌঁছিয়া গিয়াছে। তাহারা বহু হাদীস শ্রবণ করিয়াছে, বহু হাদীস তাহারা বর্ণনা ও করিয়াছে এবং লোকেরা প্রথমেই যাহা কিছু পাইয়াছে, তাহাই তাহারা গ্রহণ করিয়া লইয়াছে, তদানুযায়ী তাহারা আমল শুরু করিয়া দিয়াছে। অতএব প্রত্যেক শহর ও অঞ্চলের লোকেরা নিজেদের জন্য যাহাই গ্রহণ করিয়াছে তদানুযায়ীই তাহাদিগকে আমল করিতে দিন।[********************]

অতঃপর বাদশাহ হারুন-অর-রশীদও ‘মুয়াত্তা’ মালিক (র) সম্পর্কে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে চাহিয়াছিলেন। তিনি উহাকে কা’বা ঘরের সঙ্গে ঝুলাইয়া রাখার ও তদানুযায়ী আমল করার জন্য জনগণকে নির্দেশ দেওয়ার সংকল্প করিয়াছিলেন। কিন্তু ইমাম মালিক (র)-এর নিকট ইহার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

না, আপনি এইরূপ করিবেন না। কেননা রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে খুঁটিনাটি ব্যাপারে মত-পার্থক্য রহিয়াছে, তাঁহারা বিভিন্ন শহরে ও অঞ্চলে ছড়াইয়া পড়িয়াছেন। আর তাহারা সকলেই সঠিক পথে পরিচালিত।[********************]

ইসলামের বিরাট ও ব্যাপক জীবন-ব্যবস্থার খুঁটিনাটি ব্যাপারে মতভেদ হওয়া অতি স্বাভাবিক। ইহার পথ বন্ধ করিয়া দিয়া সকল মানুষকে বিশেষ ও নির্দিষ্ট একটি মতের অনুসারী করিতে চেষ্টা করা ও সেজন্য রাজ-ক্ষমতার ব্যবহার করা কিছুতেই সমীচীন হইতে পারে না। বরং ইসলামী বিধানভিত্তিক সকল (খুঁটিনাটি) মতকেই- তাহা বাহ্যত যতই পরস্পর-বিরোধী মনে হউক না কেন, সত্য ও সঠিক বলিয়া স্বীকার করাই হইতেছে ইসলামের নীতি। ইমাম মালিক (র)-এর উপরোক্ত উক্তি হইতেও এই কথা প্রমাণিত হয়। ইমাম মালিক (র)-এর এই নীতি যে অত্যন্ত যুক্তিসংগত ও ইনসাফপূর্ণ ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। ইমাম ইবনে আবদুল বার (র) এই নীতির প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সমঝদার লোকদের জন্য ইহা এক অতি ইনসাফপূর্ণ নীতি, সন্দেহ নাই।[********************]

ফিকাহর খুঁটিনাটি মাসলা লইয়া যাঁহারা সীমালংঘনকারী গোঁড়ামীতে লিপ্ত রহিয়াছেন ও খুঁটিনাটি ব্যাপারে নিজস্ব একটি বিশেষ মতকে জোরপূর্বক অন্যান্য মানুষের মাথায় চাপাইয়া দিবার জন্য অনমনীয়, ইমাম মালিক (র)- এর উপরোক্ত ভূমিকায় তাঁহাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা নিহিত রহিয়াছে।

জামে সুফিয়ান সওরী (র)

ঠিক এই সময়ই ইমাম সুফিয়ান সওরী (র) তাঁহার সংকলিত হাদীস গ্রন্হ ‘আল-জামে’ নামে প্রণয়ন করেন। সুফিয়ান সওরী (র) ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর অনুষ্ঠিত দারসের মজলিসে রীতিমত হাযির থাকিতেন এবং তাঁহার সূত্রে হাদীস বর্ণনা করিতেন। কিন্তু ফিকাহ তিনি গ্রহণ করিয়াছেন ইমাম আবূ হানীফার বিশিষ্ট ছাত্র আলী ইবনে মসহর-এর নিকট হইতে। আলী ইবনে মসহর ছিলেন ফিকাহ ও হাদীস উভয়েরই বিশিষ্ট সুদক্ষ আলিম। তাঁহার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি হাদীস ও ফিকাহ- উভয়েরই পরদর্শী ছিলেন।[********************]

ইমাম সাওরী তাঁহারই সাহায্য ও সহযোগীতা লইয়া তাঁহার জামে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইমাম ইয়াযীদ ইবনে হারূন বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুফিয়ান সওরী ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ফিকাহ গ্রহণ করিতেন আলী ইবনে মসহর-এর নিকট হইতে এবং তাঁহারই সাহায্য এবং তাঁহার সহিত আলাপ-আলোচনা করিয়াই তিনি তাঁহার ‘জামে’ নামক হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]

এককালে সুফিয়ান সওরীর এই ‘আল-জামে’ কিতাখানি হাদীসবিদদের নিকট বড়ই প্রিয় ও বহুল পঠিত হওয়ার মর্যাদা লাভ করিয়াছিল। ইমাম বুখারী (র) সর্বপ্রথম যেসব হাদীস-গ্রন্হ অধ্যয়ন করিয়াছেন, তন্মধ্যে এই ‘আল-জামে’ গ্রন্হ অন্যতম।

ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় (র)-এর নিকট প্রশ্ন করা হইয়াছিলঃ

******************************************************

গ্রন্হদ্বয়ের মদ্যে কোনখানি অধিকতর উত্তম, ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ না সুফিয়ান সওরীর ‘আল-জামে’?

তিনি অবশ্য জওয়াবে ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’কে উত্তম কিতাব বলিয়াছিলেন।[********************] কিন্তু ইমাম আবূ দাউদ সিজিস্তানী (সুনান প্রণেতা) ইহা হইতে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এই পর্যায়ে লোকেরা যত গ্রন্হই প্রণয়ন করিয়াছেন, সুফিয়ান সওরীর ‘আল-জামে’ তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম গ্রন্হ।[********************]

উপরে এই সময় পর্যন্ত সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহের মধ্যে কেবলমাত্র উল্লেখযোগ্য কয়েকখানির সংক্ষিপ্ত পরিচয় পেশ কর হইয়াছে, কিন্তু এই শতকের বিস্তারিত ইতিহাস প্রমাণ যে, এই সময়ে কেবলমাত্র এই কয়েকখানি গ্রন্হই সংকলিত হয় নাই। বরং এতদ্ব্যতীত আরো কয়েকখানি হাদীস-গ্রন্হ সংকলিত হইয়াছে। কিন্তু সেই গ্রন্হসমূহ উপরোল্লিখিত গ্রন্হ কয়খানি হইতে সরাসরি ও বিশেষ সাহায্য গ্রহণের মারফতেই সংকলিত হইয়াছে বলিয়া উহাদের সবিশেষ উল্লেখ করা হয় না।

এই সময় দুইজন গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ মুহাদ্দিসের আবির্ভব ঘটে। উল্লেখযোগ্য যে, তাঁহাদের দুইজনেরই নাম আবূ হাফস এবং তাঁহারা হইতেছেন পিতা ও পুত্র। পিতা-পুত্রের একই নাম হওয়ার কারণে তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য করার উদ্দেশ্যে পিতাকে আবূ হাফস কবীর (বড়) এবং পুত্রকে আবূ হাফস সগীর (ছোট) বলিয়া সম্ভোধন করা হয়। এইযুগে ইলমে হাদীসের প্রচার ও প্রসারকার্যে এই দুইজনের অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁহারা বুখারার প্রদান মুহাদ্দিসদের মধ্যে গন্য এবং তাঁহাদের প্রচেষ্টায়ই বুখারার সমস্ত এলাকায় ইলমে হাদীস ব্যাপক প্রচার লাভ করে, ঘরে ঘরে উহার চর্চা, শিক্ষা ও আলোচনা শুরু হয়। হাফেজ সাময়নী আূ হাফস কবীর সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার নিকট হইতে এত লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাহার সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব নয়।[********************]

বস্তুত বুখারার প্রতিটি গ্রামে তাঁহার ছাত্রগণ ছড়াইয়াছিল। খাইজাখীজ নামক গ্রামেও তাঁহার অসংখ্য ছাত্র ইলমে হাদীসের চর্চায় নিযুক্ত ছিল।[********************]

ইমাম আবূ হাফস ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের নিকট হইতে ইলমে হাদীস ও ফিকাহ শিক্ষা করেন। হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হাফস কবীর ইমাম মুহাম্মদের প্রধান ছাত্রদের মধ্যে গণ্য ছিলেন এবং বুখারার হানাফী আলিমদের নের্তৃত্বের তিনিই ছিলেন শেষ স্তম্ভ।[********************]

ইসলামের ইতিহাসে ইহা এমন এক পর্যায়ে, যখন তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ ও ইতিহাস-ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাপকভাবে গ্রন্হ-প্রণয়নের কাজ সম্পাদিত হয়। ঐতিহাসিক সুয়ূতী লিখিয়াছেনঃ এই সময় ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মালিকের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত ও দীক্ষিত অসংখ্য লোক ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল সম্ভার বক্ষে ধারণ করিয়া মুসলিম জাহানের বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্র স্থাপন করিয়া উহার ব্যাপাক শিক্ষাদান ও প্রচারকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম  আবূ হানীফার ছাত্রদের প্রকৃত সংখ্যা কত হাফেয আবদুল কাদের কুরায়শীর নিম্নোদ্ধৃত বর্ণনা হইতে এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম  আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে প্রায় চার সহস্র ব্যক্তি হাদীস ও ফিকাহ সম্পর্কীয় তাঁহার মত বর্ণনা  ওপ্রচার করিয়াছেন।[********************]

ইমাম হাজেজুদ্দীন ইবনুল বাযযায কুরদারী ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর বিপুল সংখ্যক ও মুসলিম  জাহানের সর্বত্র বিক্ষিপ্ত ছাত্রদের এক দীর্ঘ তালিকা পেশ করিয়াছেন। উহার শিরোনামায় নিম্নোদ্ধৃত কথা লিখিত হইয়াছেঃ

******************************************************

পূর্ব ও পশ্চিম এলাকার শহরে-শহরে বিক্ষিপ্ত ঐসব লোক, যাঁহারা ইমাম আবূ হানীফার নিকট হইতে হাদীস ও ফিকাহ বর্ণনা করিয়াছেন।

অতঃপর তিনি তদানীন্তন মুসলিম জাহানের প্রায় সব কয়টি উল্লেখযোগ্য প্রদেশ, শহর, নগর, ও গ্রামের নাম লিখিয়া তথায় ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর কোন কোন ছাত্র হাদীস ও ফিকাহ প্রচারে নিযুক্ত ছিলেন, তাহার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করিয়াছেন।[********************]

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে হাদীস ও ফিকাহর শিক্ষা লাভের পর যেসব মনীষী স্বাধীন ও নিজস্বভাবে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন, তাঁহদের সম্পর্কে ইমাম তাহাভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর যেসব ছাত্র গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ করিয়াছেন, তাঁহারা হইতেছেন, চল্লিশজন। তাঁহাদের প্রথম পর্যায়ের দশজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনঃ ইমাম আবূ ইউসুফ, ইযুফার, ইমাম দাউদ-আত্তায়ী, ইমাম আসাদ ইবনে আমর, ইমাম ইউসুফ ইবন খালিদ সিমতী, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া ইবেন আবূ যায়েদা। আর এই শেষোক্ত ব্যক্তি তো ত্রিশ বৎসর পর্যন্ত প্রথমোক্ত ব্যক্তিদের লেখক হইয়া কাজ করিয়াছেন।[********************]

তাঁহারা সকলেই খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ছিলেন। ইমাম হাসান ইবেন যিয়াদও এই পর্যায়েরই  একজন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ। তিনি ইবনে জুরাইজ-এর নিকট হইতে হাদীস সংগ্রহ করিয়াছেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি ইবনে জুরইজের নিকট হইতে বারো হাজার হাদীস লিখিয়া লইয়াছিলাম। এই হাদীসসমূহ ফিকাহবিদদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।[********************]

মোটকথা, ইমাম যুহরীর অব্যবহিত পর হইতেই হাদীস সংকলন ও হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের এক দুই কূলপ্লাবী সয়লাব প্রবাহিত হয়। মুসলিম জাহানের প্রায় প্রত্যেকটি শহরেই এই কাজ আরম্ভ হইয়া যায়। এই সময়কার অন্যান্য গ্রন্হ প্রণেতা হইতেছেনঃ

মক্কায় এবনে জুরইজ (১৫০ হিঃ); ইবনে ইসহাক (১৫২ হিঃ); মদীনায় সায়ীদ ইবনে আবূ আরুজা (১৫৬ হিঃ); রুবাই ইবনে দুবাই (১৬০ হিঃ) ও মালিক ইবনে আনাস (‌১৭৯ হিঃ) বসরায় হাম্মাদ ইবনে সালামাহ (১৭৬ হিঃ) ও ইবনে আরূবা; কুফায় সুফিয়ান সওরী (১৬১ হিঃ) সিরিয়ায় আবূ আমর আওযায়ী (১৫৬ হিঃ) ওয়াসতে হুশাইম (১৮৮ হিঃ); লাইস ও ইবনে লাহইয়া’ খুরাসানে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (১৮১ হিঃ) ইয়ামেনে মা’মর (১৫৩ হিঃ) রায় শহরে জরীর ইবনে আবদুল হামিদ (১৮৮ হিঃ) তাঁহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।[********************]

তাঁহারা সকলেই প্রায় একই যুগের লোক এবং সমমাময়িক; দ্বিতীয় হিজরী শতকের তাঁহারা শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ।[********************] আর তাঁহাদেরই অবিশ্রান্ত সাধনা ও আন্তরিক গভীর নিষ্ঠাপূর্ণ গবেষণা ও যাচাই পরীক্ষা চালনার ফলেই হানাফী মাযহাবের দৃষ্টিতে ইলমে ফিকাহদের বিরাট প্রাসাদ রচিত হয়।

অনুরূপভাবে ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রগণও মুসলিত জাহানের প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে ছড়াইয়া পড়েন। তাঁহার নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছেন ও উহার প্রচার এবং শিক্ষাদানে নিযুক্ত হইয়াছেন এমন লোকের সংখ্যা কত? খতীব বাগদাদী বর্ণনাকারীদের সংখ্যা বলিয়াছেন ৯৩; কিন্তু হাফেয কাযী ইয়ায লিখিয়াছেনঃ এক হাজার তিন শতেরও অধিক।[********************]

ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব (মৃঃ ১৯৫ হিঃ); আবদুর রহমান ইবনুল কাসেম (মৃঃ ১৯১ হিঃ) ও আশহুব (মৃঃ ২০৪ হিঃ) সুদক্ষ ওউচ্চমানের গ্রন্হ রচয়িতা ছিলেন। হাফেজ যাহবী বলিয়াছেন, ইবনে ওহাব এক লক্ষ হাদীস মুখস্থ বর্ণনা করিতেন। আর তাঁহার সংকলিত গ্রন্হাবলীতে এক লক্ষ বিশ হাজার হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।[********************] ইবনুল কাসেমও হাদীসের হাফেজ ছিলেন এবং ইমাম মালিক (র)-এর ‘ফিকহ’ যাঁহারা বর্ণনা ও প্রচার করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে তিনি প্রধান ব্যক্তিরূপে গণ্য হইতেন।[********************]

উপরের এই দীর্ঘ আলোচনা হইতে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই হাদীসের অসংখ্য সংকলন তৈয়ার হইয়া সর্বত্র প্রচারিত হইয়াছিল। সেই সঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা (র) ও ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রগণ হাদীসের বিপুল জ্ঞান-সম্ভার বক্ষে ধারণ করিয়া গোটা মুসলিম জাহানের কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। উহার প্রচার ও শিক্ষাদানের ব্রতে আত্মনিয়েঅগ করিয়াছিলেন।

 

হিজরী তৃতীয় শতকে হাদীস চর্চা

হিজরী তৃতীয় শতকে ইলমে হাদীস পূর্বাপেক্ষা অধিক উন্নতি, অগ্রগতি, প্রসারতা ও ব্যাপকতা লাভ করে। এই হাদীস একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার এক-একটি বিভাগ সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্রভাবে গঠিত হয়।

এই শতকের মুহাদ্দিস ও হাদীস বর্ণনাকারীগণ হাদীসের সন্ধানে জলে-স্থলে পরিভ্রমণ করেন; মুসলিম জাহানের প্রতিটি কেন্দ্রে খুঁজিয়া আঁতি-পাতি করিয়া ছাড়েন। এক-একটি শহর, এক-একটি গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছিয়া বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহকে এক করেন। পূর্ণ সনদ সম্পন্ন হাদীসসমূহ স্বতন্ত্রভাবে সজ্জিত ও সুবিন্যস্ত করেন। সন্দ ও বর্ণনা সূত্রের ধারাবাহিকতা এবং উহার বিশুদ্ধতার উপর পূর্ণমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেন। এই প্রয়োজনে ‘আসমা-উর-রিজাল’ এর স্বতন্ত্র জ্ঞান-বিভাগ হিসেবে সংকলিত ও বিরচিত হয়। হাদীস যাচাই-পরীক্ষা, ছাঁটাই-বাছাই ও সত্য মিথ্যা নির্ধারণের সূক্ষ্ম তত্ত্ব একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসাবে গড়িয়া উঠে। প্রখ্যাত ‘সিহাহসিত্তাহ’ (ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্হ)-ও এই শতকেই সংকলিত হয়।

এই শতকে একদিকে যেমন হাদীস সংগ্রহ, সংকলন, গ্রন্হ প্রণয়ন ও হাদীস-সম্পর্কিত জরুরী জ্ঞানের অপূর্ব উদ্ভাবন হয়, অপরদিকে মুসলিম জনগণের মধ্যে হাদীস শিক্ষা ও চর্চার অদম্য উৎসাহ এবং বিপুল আগ্রহ ও পরিলক্ষিত হয়। এক-একজন হাদীস শিক্ষাদাতার সম্মুখে দশ দশ হাজার ছাত্র হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে সমবেত হইত ও আসন গ্রহণ করিত। হাফেয যাহবী অষ্টম পর্যায়েরএকশত ত্রিশজন মুহাদ্দিসের নাম উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহাদেরই সমপর্যায়ের বড় এক জামা’আত হাফেযে হাদীস- এর কথা উল্লেখ করিলাম না।এই সময় এক-একটা দরসে হাদীসের বৈঠক দশ হাজার কিংবা ততোধিক দোয়াতএকত্র হইত। লোকেরা রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস লিপিবদ্ধ করিতেন এবং এইরূপ মর্যাদা সহকারেই তাঁহারা ইহার প্রতি পূর্ণ লক্ষ্য দিতেন। তাহাদের মধ্যে দুইশত লোক ছিলেন হাদীসের ইমাম। তাঁহারা যেমন হাদীসের ভিত্তিতে ফতোয়া দেওয়ার যোগ্য ছিলেন, তেমনি তাঁহারা প্রকাশ্যভাবে ফতোয়া দেওয়ার কাজও শুরু করিয়াছেন।[********************]

উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে যে দশ সহস্র ছাত্র উপস্থিত থাকার কথা বলা হইয়াছে, তাহা অতি সাধারণ ও প্রাথমিক পর্যায়ের হাদীস শিক্ষা কেন্দ্র সম্পর্কেই প্রযোজ্য হইতে পারে। কেননা হাদীসের বড় ও বিশিষ্ট ইমাম এবং হাফেযদের দরসের মজলিসে ইহাপেক্ষাও বহুগুণ বেশী- এক লক্ষ পর্যন্ত হাদীস শিক্ষার্থী সমবেত হইত এরূপ উল্লেখ পাওযা যায়। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ছাত্র ইমাম হাফেজ আবুল হাসান আলী ইবনে আসেম ওয়াস্তীর দরসে হাদীসের মজলিসে ত্রিশ সহস্রাধিক ছাত্র একত্র হইত।[********************]

হাসান ইবনে আসিমের হাদীস শিক্ষা লাভের পশ্চাতে এক ঘটনার উল্লেক করা হয়। তাঁহার পিতা তাঁহাকে এক লক্ষ মুদ্রা দিয়া বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

তুমি হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ যাত্রা কর; অন্তত এক লক্ষ হাদীস শিক্ষা করিয়া না আসা পর্যন্ত আমি তোমার মুখ দেখিতে চাই না।

অতঃপর তিনি বিদেশে চলিয়া যান ও হাদীস শিক্ষার এতদূর ব্যুৎপত্তি লাথ করেন যে, শেষ পর্যন্ত হাদীস-পারদর্শিতার প্রতীক হিসাবে ‘মুসনাদুল ইরাক’ ও ‘আল-ইমামুল হাফেজ’ প্রভৃতি খেতাব লাভ করিয়া পিতার নিকট প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতেও হাদীস শিক্ষা করিয়াছিলেন।[********************]

তাঁহারই পুত্র ইমাম আবূ হুসাইন আসিম ইবনে আলী ওয়াস্তী (মৃঃ ২১২ হিঃ) ইমাম বুখারীর ওস্তাদ। বুখারী শরীফে তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। তাঁহার সম্পর্কে হাফেয যাহবী লিখিয়াছেনঃ

তিনি বাগদাদে উপস্থিত হইয়া হাদীস লিখাইতে শুরু করিলেন।ফলে তাঁহার নিকট শিক্ষার্থী জনতার এক বিরাট ভীড় জমা হইয়া গেল।[********************]

আবূল হুসাইন ইবনুল মুবারক (র) বলেনঃ তাঁহার দরসের মজলিসে লক্ষাধিক লোক জমায়েত হইত। হারূন নামক এক ব্যক্তি খেজুর গাছের মাথায় উঠিয়া দূর দূর পর্যন্ত তায়হার আওয়াজ পৌঁছাইবার কাজ করিতেন। এই মজলিসে লোকের সংখ্যা অনুমান করিয়া বুঝা গেল যে, এক লক্ষ বিশ হাজারের কম হইবে না।[********************]

ইয়াযীদ ইবেন হারূন ইমাম আজম আবূ হানীফার অপর একজন ছাত্র। তিনি হাদীসের একজন বিশেষজ্ঞ ও বিপুল সংখ্যক হাদীসের হাফেয ছিলেন। তিনি বাগদাদে হাদীসের দরস দিতেন। তাঁহার দরসের মজলিসৈ সত্তর হাজার ছাত্র সমবেত হইত।[********************]

বাগদাদের প্রসিদ্ধ ‘হাফেযে হাদীস’ সূলায়মান ইবনে হারব (মৃঃ ২২৪ হিঃ)। তাঁহার দরসের বৈঠকে চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থী উপস্থিত হইত। বাদশাহ মামুনের প্রাসাদের সন্নিকটে একটি উচ্চ মিম্বর নির্মাণ করা হইয়াছিল। সুলায়মান উহার উপর আসন গ্রহণ করিয়া হাদীসের দারস দিতেন। বাদশাহ ও রাজন্যবর্গ ছাড়াও বিপুল সংখ্যক জনতা মজলিসে উপস্থিত থাকিতেন।[********************]

‘সুনান’ প্রণেতা হাফেজ আবূ মুসলিম কাজী (মৃঃ ২৯২ হিঃ) যখন বাগদাদের ‘গামান’ চকে হাদীস লিখাইবার মজলিস অনুষ্ঠান করিতেন, তখন এত বিপুল জনতা সমবেত হইত যে, সাত ব্যক্তিকে পরস্পরের সাহায্যে বহু দুরবর্তী লোকদের নিকটে আবূ মুসলিমের মুখ-নিসৃত কথা পৌঁছাইবার জন্য নিযুক্ত করিতে হইত। মজলিস শেষ হইয়া যাওয়ার পর একবার কেবলমাত্র দোয়াত-কলম সহ লিখিয়া লইবার উদ্দেশ্যে আগত লোকদের সংখ্যা গণনা করিয়া দেখা গেল যে, তাহারাই ছিল অন্যূন্য চল্লিশ হাজার। আর যাহারা শুধু শ্রবণের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হইয়াছিল, তাহাদের সংখ্যা ছিল অগণিত।[********************]

হাফেজ জাফর ফরইয়াবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ) বাগদাদের ‘মানার’ রাজপথে দরসে হাদীসের যে মজলিস করিয়াছিলেন,তাহাতে কমপক্ষে ত্রিশ সহস্র জনতা উপস্থিত হইয়াছিল।[********************]

ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী যখন কূফা নগরে হাদীসের দরস দিতেন তখন জনতার ভীড়ে নগরীর রাজপথ বন্ধ হইয়া যাইত।[********************]

ইমাম ইবন মাজাহ (র)-এর ওস্তাদ হাফেয আবূ বকর ইবনেস আবূ শায়বাহ এবং তাঁহার ভ্রাতা উসামান ইবনে আবূ শায়বাহ উভয়েই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁহাদের হাদীসের দরসেও অন্যূন্য ত্রিশ সহস্র লোক একত্র হইত।[********************]

বস্তুত তৃতীয় হিজরী শতকে হাদীস শিক্ষালাভের জন্য ইসলামী জনতার মনে যে কি বিপুল উৎসাহ এবং উদগ্র পিপাসা বিদ্যমান ছিল, তাহা পূর্বোল্লেখিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী হইতে সুস্পষ্টরূপে ধারণা করা চলে। উপরন্তু এই যুগে হাদীসে পারদর্শী ও উহার প্রচার এবং শিক্ষাদানকারী লোক যে মুসলিম জাহানে কত ছিলেন, তাহার সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নহে। ইমাম আবূ দাউদ সিজিস্তানী লিখিয়াছেনঃ ‘তৃতীয় শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হাফেজ ইবনে ইবরাহীম ফরাহীদী (মৃঃ ২২২ হিঃ) প্রায় এক হাজার মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও লিপিবদ্ধ করিয়াছেন; কিন্তু এইজন্য তাঁহার নিজ শহরের বাহিরে বিদেশ সফর করার কোন প্রয়োজন দেখা দেয় নাই।[********************]

এই কারণে এই যুগের মুহাদ্দিসগণের উস্তাদের সংখ্যা বিপুল ও অত্যাধিকই। এক একজন মুহাদ্দিসের উস্তাদের সংখ্যা সহস্রাধিক হইয়াছে। অনেকে আবার চার হাজার উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক নিজেই বলিয়াছেনঃ ‘আমি চার হাজার মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছি। তন্মধ্যে মাত্র এক হাজার মুহাদ্দিসের সনদে আমি হাদীস বর্ণনা করিয়াছি।[********************]

হাফেয শামুসুদ্দীন যাহবী তাঁহার গ্রন্হ তাযকিরাতুল হুফফাজ-এ নবম পর্যায়ের একশত ছয়জন হাদীসের হাফেয সম্পর্কে আলোচনা করার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

এই যুগে এবং ইহার কাছাকাছি সময়ে রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস পারদর্শী বহু সংখ্যক ইমাম বর্তমান ছিলেন। আমি তাঁহাদের একদশমাংশেরও এখানে উল্লেখ করিতে পারিলাম না। আমার লিখিত ইতিহাস গ্রন্হে তাঁহাদের অধিকাংশেরই উল্লেক করা হইয়াছে।[********************]

ইমাম বুখারীও এই তৃতীয় শতকেই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এক হাজার আশি জন উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়া লিখিয়াছি। তাঁহাদের প্রেত্যেকেই বড় বড় মুহাদ্দিস ছিলেন।[********************]

 

তৃতীয় শতকের হাদীস সমৃদ্ধ শহর

তৃতীয় হিজরী শতকে ইলমে হাদীসের অপূর্ব উৎকর্ষ সাধিত হয়। মুসলিম জাহানের প্রায় সব কয়টি বড় বড় শহরেই তখন- শহর হইতে দূরবর্তী গ্রামে পর্যন্ত হাদীসের ব্যাপক চর্চা ও শিক্ষাদান হইতেছিল। তন্মধ্যে কতকগুলি শহর ছিল হাদীসের সর্বাপেক্ষা বড় কেন্দ্র। তথায় স্থানয়ভাবে যেমন বিপুল সংখ্যক মুহাদ্দিস হাদীস প্রচার করিতেন, অনুরূপভাবে হাদীস অনুসন্ধানকারী ও সংগ্রহক মুহাদ্দিসগণ এই সব শহরে আগমন করিয়া হাদীস শ্রবণ করিতেন ও তাহা লিপিবদ্ধ করিয়া লইতেন। এই সময় মুহাদ্দিসগণ হাদীস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যেসব শহর ও স্থান পরিভ্রমন করিয়াছেন, সে সবের সংখ্যঅ অন্যূন পঞ্চাশ হইবে। হাফেয যাহবী এই শহর ও স্থানসমূহের নাম এবং উহাদের বিবরণ উল্লেখ করিয়া একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্হ রচনা করিয়াছেন। উহার নাম হইলঃ

********************- হাদীস- সমৃদ্ধ শহরসমূহ।

এই হাদীস-কেন্দ্রসমূহের মধ্যে কয়েকটি শহর আবার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই গুলির নাম ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখপূর্বক ইমাম ইবনে তায়মিয়া লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

এই হাদীস-কেন্দ্রসমূহের মধ্যে কয়েকটি শহর আবার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই গুলির নাম ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখপূর্বক ইমাম ইবনে তায়মিয়া লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

মক্কা-মদীনা, কূফা-বসরা ও সিরিয়া – এই পাঁচটি  শহর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীট; এইসব শহর হইতেই নবীর প্রচারিত জ্ঞান- ঈমান, কুরআন ও শরীয়াত সম্পর্কিত ইলম-এর ফল্গুধারা উৎসারিত হইয়াছে।[********************]

আমরা এখানে এই পাচঁটি শহর সম্পর্কে বিবরণ পেশ করিতে চাহি।

মদীনা

মদীনা বিশ্বনবীর কর্মজীবনের শেষ ভাগের কেন্দ্রস্থান দারুল হিজরাত; নবুয়্যাতী ইলম- এর আকর ও উৎস হইবার গৌরব কেবলমাত্র এই শহরের ভাগ্যলিপি। এ কারণে এই শহরের অপর নাম হইতেছে দারুস-সুন্নাত এবং ইহা যে খুবই উপযুক্ত নাম তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।[********************] নবী করীম (স)-এর সময় হইতে হযরত আলী (রা)-এর খিলাফতকাল পর্যন্ত ইহাই ছিল সমগ্র মসলিম জাহানের জ্ঞান ও কর্মের কেন্দ্রস্থল। উত্তরকালে ইমাম মালিক (র)-এর সময় পর্যন্ত ইহার এই মর্যাদা অক্ষুণ্ন ছিল। শেষ পর্যন্ত এই শহরের অধিবাসী ছিলেন নাফে; ইবরাহীম ইবনে সায়াদ; সুলায়মান ইবনে বিলাল ও ইসমাঈল ইবনে জাফর। [********************] তাঁহাদেরও পরে ছিলেন হাফেয আবূ মুসয়িব যুহরী, হাফেয ইবরাহীম ইবনুল মুসযির এবং হাফেয ইসহাক ইবনে মুসা আল-আনাসারী।

হাফেয আবূ মুসয়িব যুহরী সম্পর্কে হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য একজন হাদীস বর্ণনাকারী, মদীনাবাসীদের জন্য হাদীসের উস্তাদ, বিচারপতি এবং মুহাদ্দিস।[********************]

তিনি ১৫০ হিরজী সনে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং ২৪২ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। ইমাম নাসায়ী ব্যতীত সিহাহ-সিত্তার অপর পাঁচজন প্রণেতারই তিনি ওস্তাদ ছিলেন।

হাফেজ ইবরাহীম সম্পর্কে যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীসের ইমাম বড় মুহাদ্দিস এবং নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী।

তিনি ইমাম বুখারী ও ইমাম নাসায়ীর উস্তাদ ছিলেন। হিজরী ২৩৬ সনে মদীনায় ইন্তেকাল করেন।[********************] হাফেজ ইসহাক সম্পর্কে যাহবী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ফিকাহবিদ, হাদসের হাফেজ এবং নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী।

তিনি ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাযাহর হাদসের ওস্তাদ ছিলেন। ২৪৪ সনে তাঁহার ইন্তেকাল হয়।[********************]

এই তিনজনই হাদীসের বড় হাফেজ ও উস্তাদ ছিলেন। তাঁহাদের ছাড়াও বাকর ইবনে আবদুল ওহহাব মাদানী (মৃঃ ২৫০ হিঃ) হাসান ইবনে দাউদ (মৃঃ ২৪৭ হিঃ) ও মুহাম্মদ ইবনে উবায়দ মাদানী উল্লেখযোগ্য মুহাদ্দিস ছিলেন।

মক্কা

এই শহরেই রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি ওহী নাযিল হইতে শুরু হইয়াছিল। এখানেই তাঁহাকে নবী ও রাসূলরূপে নিয়োজত নিয়োজিত করা হয়। অতঃপর নবী করীম (স) দীর্ঘ তেরোটি বৎসর প্রাণন্তকর সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়া এই শহরেই অতিবাহিত করিয়াছেন। সাহাবীদের যুগে এখানে ইলমে হাদীসের চর্চা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। সাহাবীদের শেষ যুগ এবং তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের আমলে এখানে বিশিষ্ট মুহাদ্দিসের আবাসকেন্দ্র ছিল। মুজাহিদ, আতা, সায়ীদ ইবনে যুবাইর, ইবনে আবূ মূলাইকা এখানেই বসবার করিতেন ও হাদীস লিক্ষাদানের কাজ করিয়াছেন। উত্তরকালে এখানে আবদুল্লাহ ইবনে আবূ নযীহ, ইবনে কাসিম, হানযালা ইবনে উয়াইনা, আবূ সুফিয়ান, ইবনে জুরাইজ এবং মুসলিম জঞ্জী, ফুযায়ল ইবনে উয়াইন, আবূ আবদুর রহমান মূকরী, আজরাকী, হুমাইদী ও সায়ীদ ইবনে মনসুর প্রমুখ খ্যাতনামা মুহাদ্দিস বসবাস করেন।[********************]

তৃতীয় হিজরী শতকে মক্কা শহরে ইলমে হাদীসের চর্চা যদিও মদীনার মত ব্যাপক ছিল না, তথাপি হাদীস প্রদীপ তখনো তথায় প্রজ্বলিত ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই শতকে তথায় বেশ কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিস জীবিত থাকিয়া হাদীস শিক্ষাদান ও প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁহারা হইতেছেনঃ

১। হাফেজ হালওয়ানী ইমাম আবূ মুহাম্মদ হাসান ইবন আলী ইবনে মুহাম্মদুল খাল্লাল। শেষ জীবন তিনি মক্কাতেই অতিবাহিত করেন। তিনি ‘মুহাদ্দিসে মক্কা’ নামে প্রখ্যাত হইয়াছিলেন। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি হাদীসের গ্রন্হ সংকলন করিয়াছেন এবং এজন্য বহু কষ্ট ও শ্রম স্বীকার করিয়াছেন।

ইবনে আদী উল্লেখ করিয়াছেন যে, তিনি ‘কিতাবুস সুনান’ নামে হাদীসের একাখানি গ্রন্হ সংকলন করিয়াছিলেন। ২৪২ হিজরী সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]

২। হাফেজ যুবায়র ইবনে বাক্কার- আবূ আবদুল্লাহ ইবনে আবূ বকর কুরায়শী। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে আলোচনা শুরু করিয়াছেন এই বলিয়াঃ

******************************************************

হাদীসের ইমাম, হাফেজ, নসব বিশেষজ্ঞ ও মক্কার বিচারপতি।

তিনি ইমাম ইবনে মাজাহর ওস্তাদ। ২৫৬ হিজরীতে তিনি মক্কাতেই ইন্তেকাল করেন।[********************]

৩। হাফেয সালাম ইবনে শুবাইব- আবূ আবদুর  রহমান আল-হুজুরী আল-মাসময়ী। আসলে তিনি ছিলেন নিশাপুরের অধিবাসী। পরে তিনি স্থায়ীভাবে মক্কায় বসবাস শুরু করেন। আবূ নয়ীম ইসফাহানী তাঁহার সম্পর্কে বলেনঃ

******************************************************

তিনি অন্যতম নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী, বহু ইমাম ও প্রথম পর্যায়ের লোকেরা তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

হাকেম লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি মক্কাবাসীদের মুহাদ্দিস, তাঁহার সততা ও ইলমের গভীরতা সম্পর্কে সকলেই একমত।

তিনি ২৪৬ হিজরী সনে ইন্তোকল করেন।[********************]

৪। হাফেজ ইয়াকুব ইবনে হুমাইদ- প্রথমে মদীনার বাসিন্দা ছিলেন, পরে মক্কায় বসবাস করিতে থাকেন। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীসের ইমাম, পারদর্শী মুহাদ্দিস, মদীনার আলিম, মক্কায় অবস্থানকারী।

ইমাম বুখারী তাঁহার ছাত্র। ২৪১ হিজরী সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।

এই চারজন ছিলেন হাদীসের হাফেজ। এতদ্ব্যতীত হাদীসের শিক্ষক শায়খ ছিলেন অনেক।

কূফা

ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদ কূফা নগরের হাদীস-জ্ঞানমূলক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন প্রসংগে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

গাছের তলায় মৃত্যুর জন্য বায়’আত গ্রহণকারী তিনশতজন সাহাবী ও বদর যুদ্ধে যোগদানকারীদের মধ্য হইতে সত্তরজন সাহাবী এই কূফা নগরে অবস্থান করিতেন।[********************]

কিন্তু হাফেজ আবূ বাশর দুলাবী কাতাদা হইতে নির্ভরযোগ্য সূত্রে উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

কূফা নগরে নবী করীম (স)-এর  এক হাজার পঞ্চাশজন সাহাবী আগমন করেন। এতদ্ব্যতীত বদর যুদ্ধে যোগদানকারীদের মধ্য হইতে চব্বিশজন সাহাবীও আগমন করিয়াছিলেন।[********************]

এই শহরে হাদীসের ব্যাপক শিক্ষাদান ও চর্চা হইত। ইবনে শীরীন তাবেয়ী বলেনঃ

******************************************************

আমি যখন কূফা আগমন করি, তখন সেখানে চার হাজার হাদীস শিক্ষার্থী শিক্ষায় নিয়োজিত ছিল।[********************]

হাদীসের অধ্যায়ভিত্তিক সংকলন এই শহরেই সর্বপ্রথম শুরু হয়। সহীহ হাদীসের প্রথম সমষ্টি এইখানেই গ্রন্হাবদ্ধ হয়। ইমাম আবূ হানীফা (র) এই শহরেরই অধিবাসী ছিলেন বলিয়া হাদীসের ভিত্তিতে ফিকাহর জন্ম ও উৎকর্ষ সাধিত হইয়াছিল এই শহরের পরিবেশের মধ্যে। এই শহরে হাদীসের হাফেজ আবূ বকর ইবনে আবূ শায়বা বসবার করিতেন। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ বকর  হাদীসের হাফেজ, অতুলনীয়, দৃষ্টান্তহীন ও নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী এবং বিশেষ দক্ষতারসম্পন্ন ব্যক্তি।[********************]

ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাঊদ ও ইবনে মাজাহ তাঁহার বিশিষ্ট ছাত্র ও শাগরিদ। তাঁহাদের হাদীস গ্রন্হসমূহে তাঁহার নিকট হইতে গৃহীত বহুসংখ্যক হাদীস সন্নিবেশিত রহিয়াছে।[********************] ইমাম আবূ জুরয়া তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবনে আবূ শায়বা অপেক্ষা হাদীসের অধিক মুখস্থকারী আমি আর কাহাকেও দেখি নাই।[********************]

তিনি ২৩৫ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। তিনি তাঁহার সংকলিত কয়েকটি গ্রন্হ স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রাখিয়া গিয়াছেন।

শায়খূল ইসলাম আশাজ্জ আবূ সায়াদ আবদুল্লাহও এই শহেই বাস করিতেন। তাঁহারই নিকট হইতে আবূ বকর ইবনে আবূ দাঊদ এক মাসে ত্রিশ সহস্র হাদীস লিখিয়া লইয়াছিলেন। ইমাম ইবনে মাজাহও তাঁহার গ্রন্হে তাঁহার নিকট হইতে গৃহীত বহু হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। আল্লামা যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আশাজ্জ হাদীসের ইমাম, মুসলামনদের নেতা, হাদীসের হাফেজ, কুফার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, কুরআনের তাফসীর ও অন্যান্য গ্রন্হাবলীর রচয়িতা।

সিহাহ সিত্তার সব কয়জন প্রণেতাই হাদীসে তাঁহার ছাত্র। তিনি ২৪৭ হিজরী সনে নব্বই বছরেরও বেশী বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

হাদীসের হাফেজ উসমান ইবনে আবূ শায়াবাহও এই শহরেরই বাসিন্দা ছিলেন। তিনি উপরোল্লিখিত আবূ বকর ইবন আবূ শায়বার বড় ভাই। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি তাঁহার ভাই আবূ বকরের মতই একজন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ ও হাদীসের ইমাম।[********************]

‘দুররাতুল ইরাক’ (ইরাক-শিরোমণি) হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে নুমাইর কূফারই অধিবাসী ছিলেন। আলী ইবনুল হুসাইন ইবনুল যুনাইদ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘তিনি ছিলেন জ্ঞান, বুদ্ধি, সুন্নাত ও পরহেযগার সমন্বয়, কূফা নগরে তাঁহার কোন দৃষ্টান্ত দেখিতে পাই নাই।[********************]

ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম ইমাম আবূ দাঊদ ও ইবনে মাজা প্রমুখ সিহাহ প্রণেতাগণ তাঁহার ছাত্র। মুসলিম শরীফে তাঁহার সূত্রে ৫৩৬টি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। ইবনে মাজা গ্রন্হেও তাঁহার নিকট হইতে বহু হাদীস গৃহীত ও  উল্লিখিত হইয়াছে।[********************]

আবু কুরাইব, মুহাদ্দিসে-কূফা কূফা নগরের প্রখ্যাত হাদীসের হাফেজ ছিলেন। সিহাহ-সিত্তাহ প্রণয়নকারী সব কয়জন মুহাদ্দিসই তাঁহার ছাত্র ছিলেন। ইবনে উকদাহ ইলমে হাদীসে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি বলিয়াছেনঃ কূফা নগরে আবূ কুরাইব হইতে তিন লক্ষ হাদীস প্রচারিত হইয়াছে। কেবল মূসরা ইবনে ইসহাকই তাঁহার নিকট হইতে এক লক্ষ হাদীস গ্রহণ করিয়াছিলেন। বুখারী শরীফে তাঁহার সূত্রে ৭৫টি এবং মুসলিম শরীফে ৫০০ টি হাদীস গৃহীত হইয়াছে। তিনি ২৪৩ হিজরী সনে প্রায় ৮৭ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন।[********************]

শায়খুল কূফা হান্নাদও কূফারই একজন বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। হাফেজ যাহবী তাঁহা উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন এবং হাদীসের ইলম ও তাকওয়ায় তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিয়াছেন। সিহাহ সিত্তার সব কয়জন প্রণেতাই তাঁহার নিকট হাদীস শিক্ষালাভ করিয়াছেন। তিনি ২৪৩ সনে ৯‌‌১ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

হাফেজ ওলীদ ইবনে শুজা কূফার বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন। ইমাম মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ তাঁহার ছাত্র ছিলেন। ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন বলিয়াছেনঃ তাঁহার নিকট সিহাহ- নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সূত্রে বর্ণিত এক লক্ষ হাদীস সংগৃহীত ছিল। হাফেজ যাহবী তাহাকে ******************** ‘হাদীসের বড় হাফেজ ও সত্যপ্রিয় মুহাদ্দিস’ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। তিনি ২৪৩ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

হাফেজ হারূন ইবনে ইসহাক আল-হামদানী কূফার মুহাদ্দিসদের একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন ইমাম বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ প্রমুখ গ্রন্হ প্রণেতাদের ওত্তাদ। তিনি ২৫৮ সনে ইন্তোকল করেন।[********************]

এই কয়জন শ্রেষ্ট ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ছাড়াও হাদীসজ্ঞানে বহু ধারক, শিক্ষক ও প্রচারক তৃতীয় শতকে কূফা নগরে অবস্থান করিতেছিলেন। সিহাহ-সিত্তার কোন কোন কিতাবে বিশেষ করিয়া ইবনে মাজাহ শরীফে তাঁহাদের নিকট হইতে বহু হাদীস গ্রহণ করা হইয়াছে।

বসরা

হিজরী তৃতীয় শতক পর্যন্ত এই শহর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র রূপে পরিগণিত ছিল। প্রথম দিকে হযরত আবূ মুসা আশআরী হযরত ইমরান ইবনে হুসায়ন, হযরত ইবনে আব্বাস ও আরো বহু সংখ্যক সাহাবী এই শহরে বসবাস করিতেন। সর্বশেষ হযরত আনাস (রা)-ও এইখানে আসিয়া বসবাস শুরু করিয়াছিলেন। তাবেয়ীদের মধ্যে হাসানুল-বসরী, ইবনে শীরীন, আবূল আলীয়া এবং তাঁহাদের পরে কাতাদাহ, আইয়ূব, সাবেতুল বানানী, ইউনুস, ইবনে আউন আর তাঁহাদের পরে হাম্মাদ ইবনে সালমাহ, হাম্মাদ ইবনে যায়দ এবং তাঁহাদের ছাত্র মুহাদ্দিসগণ এই শহরেই জীবন অতিবাহিত করেন।[********************]

বসরা নগরে  এত বিপুল সংখ্যক মুহাদ্দিসের সমাবেশ হইয়াছিল যে, হাফেজ মুসলিম ইবনে ইবরাহীম বসরী বলেনঃ

******************************************************

আমি আটশত হাদীসের ওস্তাদের নিকট হইতে হাদীস লিখিয়াছি অথচ সেজন্য আমাকে একটি পুল ও পার হইতে হয় নাই।[********************]

তৃতীয় শতক পর্যন্ত বসরায় হাদীসের যেসব হাফেজ ও উস্তাদ বর্তমান ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে প্রধান কয়েকজনের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১। হাফেজ তহহান- হাসান ইবনে মুদরাক ইবনে বশীর আস-সদূসী। তিনি ইমাম বূখারী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহর উস্তাদ। তাঁহার সম্পর্কে ইবনে আদী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি বসরা নগরের বিশিষ্ট হাফেজে হাদীসগণের অন্যতম ছিলেন।[********************]

২। হাফেজ যায়দ ইবনে আখজাম- আবূ তালিব তায়ী আল-বসরী। ইমাম মুসলিম ব্যতীত সিহাহ- সিত্তাহ প্রণেতা অপর কয়জন মুহাদ্দিসেরই তিনি উস্তাদ ছিলেন। হাফেজ যাহবী তাঁহাকে--- ‘হাদীসের হাফেজ ও ইমাম’ বলিয়া উল্লেক করিয়াছেন।[********************]

৩। হাফেজ আব্বাস আনরবী। আল্লামা যাহভী তাঁহাকে - ******************** হাদীসের লব্ধপ্রতিষ্ঠ হাফেজ এবং ইমাম বলিয়া উল্লেখ করিাছেন। সিহাহ-সিত্তাহ প্রণেতাগণ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ ও নিজ নিজ গ্রন্হে উদ্ধৃত করিয়াছেন।[********************]

৪। হাফেজ আব্বাস বুহরানী ইবনে ইয়াযীদ ইবনে আবূ হাবীব আল বসরী। হাফেজ যাহবী তাঁহাকে ******************** বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে, তিনি হাদীসের উচ্চতম সূত্র ও হাদীস সম্পর্কে গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। অকীহ ইবনুল জাররাহ, ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাত্তান, সুফিয়া ইবনে উয়াইনা ও আবদুর রাযযাক প্রমুখ বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন। তিনি যখন বুহরান  হইতে হামদান আগমন করেন তখন তিনি নিজস্ব বহু সংখ্যক হাদীস সংকলন হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। হামাদান, বাগদাদ ও ইসফাহান প্রভৃতি স্থানসমূহে তিনি হাদীস শিক্ষা দিতেন। তিন ২৫৮ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

৫। হাফেজ বিদয়া আবদুল্লাহ ইবনে ইসহাক আবূ মুহাম্মদ আল জাওহারী। তিনি ইমাম আবূ হানীফার প্রখ্যাত ছাত্র। ইমাম আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবেন মাজাহ- তাঁহারা সকলেই তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছেন। তিনি ছিলেন হাদীসের একজন বিখ্যাত হাফেজ। ২৫৮ হিজরী সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]

৬। হাফেজ আকাবা ইবনে মুকাররম ইবনে আফলাহ হাদীসের বিখ্যাত হাফেজ ছিলেন।[********************] ইমাম মুসলিম, আবূ দাঊদ , তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ হাদীসে তাঁহার প্রসিদ্ধ ছাত্র ছিলেন। ২৪৩ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]

৭। হাফেজ উমর ইবনে শিবাহ ইবনে উবাইদাহ আল-বসরী। হাফেজ যাহবীর ভাষায় তিনি ছিলেন ******************** হাদীসের বড় হাফেজ, বড় বিজ্ঞ আলিম, বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী। ইবনে মাজাহ হাদীসে তাঁহার বিশিষ্ট ছাত্র ছিলেন। ২৬২ সনে ৮৯ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৮। হাফেজ আমার ইবনে আলী ফাল্লাস। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেন ******************** হাদীসের বড় হাফেজ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী। হাদীসে সিহাহ-সিত্তাহ প্রণেতা সব কয়জন মুহাদ্দিসই তাঁহার ছাত্র। ২৪৯ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]

৯। ইমাম আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে বাশার ইবনে উসমান আল বসরী। সিহাহ-সিত্তাহ সংকলক সবকয়জন মুহাদ্দিসই তাঁহার ছাত্র। তিনি ২৫২ সনে ইন্তেকাল করেন। বুখারী শরীফে ২০৫ ও মুসলিম শরীফে ৪০৬টি হাদীস তাঁহার নিকট হইতে গৃহীত হইয়াছে।[********************]

১০। হাফেজ মুহাম্মদ ইবনুল মুসান্না। তিনি হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন। হাফেজ যাহবী তাঁহাকে ******************** হাদীসের হাফেজ, অকাট্য প্রামাণ্য মর্যাদাসম্পন্ন ও বসরার মুহাদ্দিস বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি সিহাহ-সিত্তাহ গ্রন্হাবলীর সবকয়জন মুহাদ্দিসেরই উস্তাদ। বুখারী শরীফে তাঁহার বর্ণিত ১০৩ ও সহীহ মুসলিম-এ ৭০০টি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। ইবনে মাজাহ গ্রন্হে তাঁহার নিকট হইতে বহু হাদীস গ্রহণ করা হইয়াছে।[********************]

১১। হাফেজ মুহাম্মদ বুহরানী- আবূ আবদুল্লাহ ইবনে মা’মর আল বসরী। তিনি হাদীসের প্রখ্যাত হাফেজ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন। সিহাহ-সিত্তাহর সংকলক সকলেই তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেলেন।[********************]

১২। হাফেজ নসর ইবনে আল- আবূ আমর আল-আযদী আল বসরী। তিনি সিহাহ-সিত্তাহর সবকয়জন গ্রন্হ প্রণতারই উস্তাদ ছিলেন। খলীফা মুস্তায়ীন বিল্লাহ তাঁহাকে বিচারপতির পদে নিয়োগ করিতে চাহিলে তিনি আল্লাহর নিকট কাতর কণ্ঠে দোয়া করিলেনঃ

******************************************************

হে আল্লাহ ! তোমার নিকট আমার জন্য কোন কল্যাণ থাকিলে, আমাকে তোমার নিকট লইয়া যাও।

আল্লাহ তাঁহার দোয়া কবুল করিলেন। তিনি দোয়া করিয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন, আর জাগ্রত হইলেন না। ২৫০ হিজরী রবিউল আউয়াল মাসের এই ঘটনা।[********************]

১৩। হাফেজ ইয়াহইয়া ইবনে হাকীম আবূ সায়ীদ আল বসরী। ইবনে মাজাহ শরীফে তাঁহার বর্ণিত বহু সংখ্যক হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। আবূ দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ- এই তিনজন তাঁহার ছাত্র। তাঁহাকে    ******************** নির্ভরযোগ্য ও সতর্ক হাফেজে হাদীন বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে।[********************]

এই শতকে তাঁহাদের ছাড়া আরো বহু খ্যাতনামা মুহাদ্দিস বসরা নগরে বর্তমান ছিলেন।

বাগদাদ

আব্বাসী বাদশাহদের শাসন আমলে বাগদাদ শহর মুসলমানদের তাহযীব তমদ্দুন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান কেন্দ্র ছিল। হাফেজ নিশাপুরী এই শহর সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

এই শহর হাদীস ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র, এখানে বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস ও বিজ্ঞ সুধী ব্যক্তি বসবাস করিতেন।[********************]

বাগদাদে কোন সাহাবীর ইন্তেকাল হইয়াছে বলিয়া জানা যায় নাই। তবে তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের এক বড় জামাআত এখানে বসবাস করিয়াছেন এবং এই শহরেই তাঁহারা জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছেন।[********************] এই শহরে বেশ কয়েকজন বড় বড় হাদীসবিদ অবস্থান করিতেন, ইমাম আবূ ইউসুফ (র) তাঁহাদের অন্যতম। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) সর্বপ্রথম তাঁহার নিকট হাদীস শিক্ষা শুরু করেন।[********************]

ইমাম আসাদ ইবনে আমরও একজন বড় হাদীসবিদ এবং তিনি এই শহরে অবস্থান করিতেন। তাঁহার সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ******************************************************

‘রায় শহরের অধিবাসীদের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা (র)-র পরে ইমাম আসাদ অপেক্ষা অধিক সংখ্যক হাদীসের ধারক আর কেহ ছিল না।[********************]

বাগদাদে হাদীসের ব্যাপক শিক্ষাদান ও চর্চা হইত। এক-একজন মুহাদ্দিসের সম্মুখে হাজার হাজার ছাত্র হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে সমবেত হইত।

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র) এই শহরেরই অধিবাসী ছিলেন।[********************] ইমাম আবূ সওর (মৃঃ ২৪০ হিঃ), ইমাম দাউদ যাহেরী (মৃঃ ২৭০ হিঃ) ও ইমাম মুহাম্মদ ইবনে জরীর তাবেরী (মৃতঃ ৩১০ হিঃ) বাগদাদেরই অধিবাসী ছিলেন। ইমাম তাবারীর বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর এই শহরেই লিখিত হয়।[********************]

দামেশক

দামেশক উমাইয়া খলীফাদের রাজধানী, সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত এক সভ্যতামণ্ডিত শহর। সিরিয়ায় এক সময় দশ সহস্র সাহাবী অবস্থান করিতেন। ঐতিহাসিক ইবনে আসাকির লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সিরিয়ায় দশ সহস্র লোক এমন ছিলেন, যহাদের চক্ষু রাসূলে করীম (স)-কে দর্শনলাভে ধন্য হইয়াছিলেন।[********************]

পূর্বে এক স্থানে উল্লেক করা হইয়াছে, হযরত উমর ফারুক (রা) তাঁহার খিলাফতকালে হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল, উবাদাহ ইবনুস সামিত এবং আরো কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীকে কুরআন ও হাদীসের ব্যাপক প্রচার ও শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় প্রেরণ করিয়াছিলেন। সিরিয়ায় জনগণ প্রথমত তাহাদের নিকট হইতেই কুরআন ও হাদীস শিক্ষা লাভ করেন এবং-

******************************************************

তাহাদের নিকট ও সূত্র হইতেই সমগ্র মুসলমানের নিকট কুরআন ও হাদীসের ইলম পৌঁছায়।[********************]

উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক –এর শাসনকালে দামেশকে ইসলামী ইলমের ব্যাপক চর্চা হইত। তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের সময়ও এখানে বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদ বর্তমান ছিলেন। হাফেজ যাহবী এই কথার উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

দামেশক কুরআন-হাদীস ও ফিকাহর কেন্দ্রস্থল। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম হিজরী শতকে এখানে ইলমে হাদীসের চর্চা অনেকখানি হ্রাস পায়।[********************]

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদ ইমাম আওযায়ী এই শহরেরই অধিবাসী ছিলেন। হিশাম ও দহীম নামক দুইজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস এখানে ছিলেন, তাঁহারা ব্যাপকভাবে হাদীসের দরস দিতেন। ইমাম ইবনে মাজাহ (র) এইসব দরসে শরীক হইয়াছেন এবং এখান হইতে তিনি বহু সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করিয়াছিলেন। ইমাম বুখারী, আবূ দাউদ ও নাসায়ীও তাঁহার ছাত্র। ২৪৫ হিজরী সনে হাফেজ দহীম ইন্তেকাল করেন এবং হিশাম দামেশকে ইন্তেকাল করেন।

আফ্রিকায় হাদীস চর্চা

মিসর

মিসর হাদীস চর্চা ও শিক্ষা প্রচারের দিক দিয়া এই যুগে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। এখানে অন্যূন তিনশত সাহাবী আগমন করিয়াছেন। হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

সাহাবায়ে কিরামের একটি বিরাট জামা’আত এখানে আসিয়া ব্যাপকভাবে বসবাস শুরু করেন। তাবেয়ীদেন যুগে এখানে হাদীসের চর্চা হয়। পরে আমর ইবনুল হারিস, ইহাহইয়া ইবনে আয়ুব, হায়াত ইবন শুরাইহ, লইস ইবনে সাআদ ও ইবনে লাহইয়ার যুগে হাদীস চর্চা পূর্বাপেক্ষা অধিক ব্যাপক রূপ পরিগ্রহ করে। ইবনে ওহাব, ইমাম শাফেয়ী, ইবনুল কাসেম এবং তাঁহাদের শাগরিদদের সময় পর্যন্ত এই চর্চা চলিতে থাকে।[********************]

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয খলীফা নির্বাচিত হইয়া মিসরে হাদীসের ভিত্তিতে ফতোয়া দানের জন্য ইয়াযীদ ইবনে আবূ হুবাইবকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তিনিই সেখানকার লোকদিগকে হাদীস ও ফিকাহর সহিত পরিচিত ও উহার শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তোলেন। হাফেজ জালালুদ্দীন সুয়ূতী ইয়াযীদ ইবনে আবূ হুবাইব সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনিই মিসরে সর্বপ্রথম হাদীসের প্রকাশ ও প্রচার করেন এবং হালাল-হারামের মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা দেন। তাঁহার পূর্বে সেখানকার লোক পরকাল সম্পর্কে উৎসাহদান, যুদ্ধ ও ফিতনা সম্পর্কিত হাদীসই বর্ণনা ও আলোচনা করিত।[********************]

এই যুগে মিসরে কয়েকজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস বর্তমান ছিলেন। তন্মধ্যে কয়েকজনের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১। হারমালা (জন্মঃ ১৬২ হিঃ মৃঃ ২৪৩ হিঃ)। হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেন যে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে ওহাবের নিকট হইতে প্রায় এক লক্ষ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম ও ইবনে মাজাহ তাঁহার ছাত্র। আল্লামা তুজুদ্দীন সুবকী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বিশিষ্ট হাদীসবিদ ও ইমাম ছিলেন।

২। রবী মুরাদী। মিসরের বড় মুহাদ্দিস ছিলেন (জন্মঃ ১৭৪ হিঃ মৃঃ ২৭০ হিঃ)। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি ছিলেন হাদীসের হাফেজ, ইমাম এবং মিসর অঞ্চলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস।

ইমাম আবূ দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ তাঁহার ছাত্র ছিলেন। খলীলী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী ও সর্বসম্মত মুহাদ্দিস।[********************]

৩। হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে রিমাহ ইবনে মুহাজির। তিনি হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন। ইমাম মুসলিম ও ইবনে মাজাহ ইলমে হাদীসে তাঁহার ছাত্র। ইবনে ইউনুস তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ মুহাদ্দিস।

ইমাম বুখারী তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন। সহীহ মুসলিমে তাঁহার বর্ণিত ১৬১ টি হাদীস স্থান পাইয়াছে। সুনানে ইবনে মাজাহ কিতাবেও তাঁহার বহু সংখ্যক হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।[********************]

৪। হাফেজ ইয়াহইয়া ইবনে সারেহ আল-কুরায়শী। তিনি হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন।

এতদ্ব্যতীত মিসর এলাকা ও আফ্রিকার অন্যান্য স্থানেও ব্যাপকভাবে হাদীস শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের কাজ চলে। প্রায় সকল স্থানেই দক্ষ ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন মুহাদ্দিসহণ এই মহান ব্রতে নিযুক্ত ছিলেন।

 

তৃতীয় হিজরী শতকের কয়েকজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস

তৃতীয় শতকে সারা মুসলিম জাহানে সমাধিক খ্যাতিসম্পন্ন অগাধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ কয়েকজন মুহাদ্দিসের আবির্ভাব ঘটে। হাদীস সমৃদ্ধ ও স্থান ও শহরসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করার পর এই বিশিষ্ট হাদীসবিদদের সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা একান্তই আবশ্যক। অন্যথায় এই শতকের হাদীসের ব্যাপক প্রসারতা ও অপূর্ব উৎকর্ষতা লাভ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সম্যক ধারণা করা সম্ভব হইবে না। এই পর্যায়ে যে কয়জন মুহাদ্দিসের নাম বিশেষভাব উল্লেখযোগ্য, তাঁহারা হইতেছেনঃ (১) আলী ইবনুল মাদানী (২) ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (৩) আবূ জুরয়া-আর-রাযী (৪) আবূ হাতেম আর-রাযী (৫) মুহাম্মদ ইবনে জরীর আততাবারী (৬) ইবনে খুযাইমা (৭) মুহাম্মদ ইবনে সাআদ (৮) ইসহাজ ইবনে রাহওয়াই (৯) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)।

আলী ইবনুল মাদীনী (র)

আলী ইবনুল মাদীনী একজন বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। হাদীস শিক্ষায় যাঁহারা তাঁহার উস্তাদ ছিলেন, তাঁহাদের তালিকা দীর্ঘ। তাহা দেখিলে সহজেই ধারণা করা যায় যে, তিনি হাদীস শিক্ষায় অদম্য উৎসাহে দেশ-দেশান্তর পরিভ্রমণ করিয়াছেন।মক্কা, মদীনা, বাগদাদ, কূফা প্রভৃতি হাদীসকেন্দ্র ও হাদীস- সমৃদ্ধ শহরসমূহ ঘুরিয়া তিনি রাসূল (স)-এর হাদীস  শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছেন। ইয়েমেন শহরে তিনি এই উদ্দেশ্যেই একাধিক্রমে তিন বৎসর কাল অতিবাহিত করেন। কিন্তু ইয়েমেনে অবস্থানের সময় তিনি হাদীসের প্রাথমিক ছাত্র ছিলেন না, বরং ইহার পূর্বেই তিনি হাদীসের এক বিরাট সম্পদ স্বীয় বক্ষে ধারণা করিয়া লইয়াছিলেন।[********************] তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জাফর, হাম্মাদ ইবনে যায়দ, আবূ দাউদ তায়ালিসী ও সাঈদ ইবনে আমের প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন।

হাদীস গ্রহনের ব্যাপারে তিনি অতিশয় সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। তিনি উব্বাদ ইবনে সুহাইব নামক একজন বর্ণনাকারী সূত্রে ত্রিশ হাজার হাদীস সংগ্রহ করিয়াছিলেন; কিন্তু পরে তাঁহার সত্যবাদিতা ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হওয়ায় তিনি উহা সবই প্রত্যাখ্যান ও আগ্রাহ্য করিলেন।[********************]

তিনি একজন দক্ষগ্রন্হ প্রণেতা ছিলেন, হাদীস সম্পর্কিত ইলমের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তিনি বহু সংখ্যক গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইতিপূর্বে অপর কোন মুহাদ্দিসই এইসব বিষয়ে কোন গ্রন্হ রচনা করেন নাই।[********************]

তিনি ১৬১ হিজরী সনে বসরা নগরে জন্মলাভ করেন এবং হিজরী ২৩৪ সনে ইন্তেকাল করন।[********************]

ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (র)

ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন ইলমে হাদীসের এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পরই তিনি হাদীস শিক্ষার দিকে মনোযোগ দেন এবং সে জন্য তিনি স্বীয় জান ও মাল সবকিছু অকাতরে উৎসর্গ করেন। তাঁহার পিতার নিকট হইতে প্রাপ্ত এক লক্ষ মুদ্রা তিনি এই হাদীস শিক্ষার কাজে ব্যয় করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এতই দরিদ্র ও নিঃস্ব হইয়া পড়েন যে, পায়ের জুতা সংগ্রহ করাও তাঁহার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি নিম্নলিখিত শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছেনঃ (ক) আবদুস সালাম ইবনে হারব (খ) আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (গ) ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদুল কাত্তান (ঘ) অকী ইবনে জাররাহ (ঙ) আবদুর রহমান ইবন মাহদী (চ) সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (ছ) হিশাম ইবনে ইউসুফ এবং আরো অনেক।[********************]

ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন হাদীস শুধুমাত্র শ্রবণ করিয়াই ক্ষান্ত হইতেন না, সঙ্গে সঙ্গে উহা লিখিয়াও রাখিতেন। আলী ইবনে মাদানী বলেনঃ ইবনে মুয়ীন মত হাদীস লিখিয়া লইয়াছেন, তত আর কেহ লিখেন নাই। ইবনে মুয়ীন নিজেই বলিয়াছেনঃ

আমি নিজের হাতে লক্ষ লক্ষ হাদীস শ্রবণ করিয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছি। তিনি যে কেবল লিখিয়া লইতেন তাহাই নয়, প্রত্যেকটি হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া সে সম্পর্কে গভীর চিন্তা ও গবেষণা করিতেন, উহার যথাথর্ততা যাচাই ও পরীক্ষা করিতেন।[********************]

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন যেটিকে হাদীস মনে করন না, তানা মূলত হাদীসই নহে।

তিনি ২৩৩ হিজরী সনে মদীনা শরীফে ইন্তেকাল করেন।[********************] হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞানে তাঁহার অপূর্ব অবদান সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হইবে।

আবূ জুরয়া আর-রাযী (র)

আবূ জুররা হাদসের একজন বিখ্যাত হাফেজ ছিলেন। ইমাম আবূ দাউদ ছাড়া সিহাহ-সিত্তার অপর পাঁচজন মুহাদ্দিসই তাঁহার ছাত্র। তাঁহার সম্পর্কে হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ জুরয়া স্মরণশক্তি, প্রতিভা ও মেধাশক্তি, ইসলামী ইলম, দ্বীন পালন ও সহীহ আমলের দিক দিয়া অতুলনীয় ছিলেন।[********************]

আবূ জুরয়া ইলমে হাদীস শিক্ষা লাভের জন্য মক্কা, মদীনা, ইরাক, সিরিয়া, জযীরা, খোরাসান ও মিসর পরিভ্রমণ করিয়াছেন। তিনি একলক্ষ সনদের হাদীস লিখিয়াছিলেন। তাঁহার সম্পর্কে মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকদের সাক্ষ্য এইঃ

******************************************************

তিনি সাত লক্ষ হাদীস মুখস্ত রাখিতেন।[********************]

আবূ জুরয়া ২০০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৬৪ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

আবূ হাতেম আর-রাযী (র)

ইমাম আবূ হাতেম আর-রাযী হাদীসের বিশেষ পারদর্শী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইমাম বুখারীর সমপর্যায়ের মুহাদ্দিস। ১৯৫ হিজরী সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, ২০৯ হিজরীতেই তিনি হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরে বহির্গত হন। তিনি এই সফরে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করিয়াছিলেরন। তিনি বাহরাইন হইতে মিসর, মিসর হইতে রমলা, রমলা হইতে দামেশক, এবং সেখান হইতে তরসুম পদব্রজে সফর করিয়াছেন। অতঃপর হিমস প্রত্যাবর্তন করিয়া মক্কায় উপনীত হন। সেখান হইতে রওয়ানা হইয়া ইরাকে পৌঁছেন। এই দীর্ঘ সফর যখন তিনি সমাপ্ত করেন, তখন তাঁহার বয়স মাত্র ২০ বৎসর। তিনি তাঁহার পুত্র আবদুর রহমানকে একবার বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে প্রিয় পুত্র! আমি হাদীসের সন্ধানে পায়ে হাটিয়া হাজার ফার্লং-এর বেশী পথ অতিক্রম করিয়াছি।[********************]

ইরাকে পৌঁছিয়া বসরা শহরে তিনি আটমাস পর্যন্ত অবস্থান করেন। এখানে নিদারুন অর্থাভাবে পতিত হওয়ার কারণে তিনি স্বীয় ব্যবহার্য পোশাক-পরিচ্ছদ পর্যন্ত বিক্রয় করিতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত উপবাস থাকিতে বাধ্য হন। কিন্তু এই কঠিন দারিদ্র ও নিদারুণ নিঃস্বতায় প্রপীড়িত হইয়াও তিনি হাদীস শিক্ষার কাজ অব্যাহতভাবে করিয়া গিয়াছেন। বস্তুত এইরূপ কষ্ট স্বীকার করিয়াই তিনি ইলমে হাদীস শিক্ষা করেন এবং শেষ পর্যন্ত হাদীসের এক প্রখ্যাত হাফেজ ও বিশেষ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ইমাম হওয়ার মর্যাদা লাভ করিতে সমর্থ হন।[********************]

মুহাম্মদ ইবনে জরীর আত-তাবারী (র)

ইবনে জরীর প্রসিদ্ধ হাদীসবিদ ও কুরআন মজীদের তাফসীর লেখক। তিনি ২২৪ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমাম তিরমিযী ও নাসায়ী পর্যায়ের মুহাদ্দিস রূপে গণ্য। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের উস্তাদদের নিকট হইতে তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস শিক্ষা সংগ্রহ করেন। তাঁহার নিকট হইতেও বড় বড় মুহাদ্দিসগণ হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে আহমদ ইবনে কামেল, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ শাফেয়ী ও মাখলাদ ইবনে জাফর প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ উল্লেখযোগ্য। ইবনে জরীর তাফসীর, হাদীস ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বহু সংখ্যক মূল্যবান ও বিরাট বিরাট গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।তিনি হাদীস গ্রন্হ সংকলন করিয়াছেন বলিয়া ইবনে কাসীর উল্লেখ করিয়াছেন। হিজরী ৩১০ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইবনে খুযাইমা (র)

তাঁহার পূর্ণ নাম হইতেছে মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর ইবনে খুযাইমা নিশাপুরী। তিনি হাদীসের একজন বড় ইমাম ছিলেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি রায়, বাগদাদ, বসরা, কূফা, সিরিয়া, জযীয়া, মিসর ও ওয়াসত প্রভৃতি স্থানসমূহ সফর করেন এবং বহু সংখ্যক খ্যাতনামা হাদীসবিদদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করেন। তাঁহার ওস্তাদের মধ্যে ইসহাক ইবনে রাহওয়াই ও মুহাম্মদ ইবনে হুমাইদ আর-রাযী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

তিনি হাদীস শিক্ষার জন্য বিশেষ উৎসাহ ও সংকল্পপরায়ণ ছিলেন। ইমাম দারে কুতনী তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবনে খুযাইমা হাদীসের লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ইমাম ছিলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী। তাঁহার কোন তুলনা পাওয়া যায় না।

তিনি হাদীস ও  দ্বীনি মাসয়ালা মাসায়েল সম্পর্কে বিপুল সংখ্যক গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। হিজরী ৩১১ সনে তাঁহার ইন্তেকাল হয়।[********************]

মুহাম্মদ ইবনে সায়াদ (র)

ইবনে সায়াদ একজন বড় ঐতিহাসিক ও জীবনীকার হিসাবে প্রসিদ্ধ হইলেও তিনি তৃতীয় হিজরী শতকের একজন বড় মুহাদ্দিসি ছিলেন। তিনি বসরা শহরে ১৬৮হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। বসরার বড় মুহাদ্দিসগণের নিকট হইতে তিনি হাদীস শ্রবণ করেন। অতঃপর কূফা, ওয়াসত, বাগদাদ, মক্কা-মদীনা, সিরিয়া, ইয়েমেন, মিসর ও মুসলিম জাহানের অন্যান্য বড় বড় শহর-নগর সফর করিয়া বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ ও শিক্ষা করেন। তাঁহার নিকট হইতেও বহু খ্যাতিমান মুহাদ্দিস হাদীস শিক্ষা ও বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

তিনি বিপুল ইলমের অধিকারী ছিলেন। বহু সংখ্যক গ্রন্হের প্রণেতা ছিলেন। তাঁহার গ্রন্হাবলী ছিল হাদীস, ফিকাহ ইত্যাদি বিষয়ক।[********************]

ইবনে সায়াদ হাদীস বর্ণনাকারীদের নিকট বড়ই প্রিয় মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি তদানীন্তন সমাজের কোন ফিতনায় লিপ্ত হন নাই। ফলে তাঁহার পক্ষে ইলম বিস্তার ও প্রসারতার জন্য এবং পূর্ববর্তী ইলমকে পরবর্তীকালের মানব সমাজের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভবপর হইয়াছে।[********************]

ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (র)

ইসহাক তাবে-তাবেয়ীন যুগের একজন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। তিনি সর্বপ্রথম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারকের নিকট হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে উপস্থিত হন। কিন্তু তাঁহার অল্প বয়স এই পথের প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়ায়। অতঃপর তিনি হাদীস শিক্ষার অন্যান্য কেন্দ্রের সন্ধানে বাহির হইয়া পড়েন। এই কেন্দ্রসমূহ একটি হইতে অন্যটি শতসহস্র মাইলি দূরে অবস্থিত ছিল। ইবনে রাহওয়াই এই দূরাতিক্রম্য পথে পর্যটন শুরু করেন এবং বড় বড় হাদীসবিদ মনীষীদের নিকট হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। মুসলিম জাহানের যেসব প্রদেশে এই হাদীস কেন্দ্রসমূহ অবস্থিত ছিল, তন্মধ্যে ইরাক, হিজায, ইয়েমেন, মক্কা ও সিরিয়া উল্লেখযোগ্য। ইহার  এক-একটি শহরে শত শত হাদীস শিক্ষা কেন্দ্র বিরাজিত ছিল। ইমাম ইসহাক এই সবের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকটি কেন্দ্রেই উপস্থিত হইয়াছেন এবং হাদীস সম্পদ শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছেন।

এই চেষ্টা-সাধনাকে দ্বিগুণ কার্যকর ও কল্যাণময় করিয়া দিয়াছিল তাঁহার অনন্যসাধারণ তীক্ষ্ম স্মরণশক্তি। অসংখ্য হাদীস তাঁহার মুখস্থ ছিল। কয়েক সহস্র হাদীস তিনি ছাত্রদিগকে মুখস্থ শুনাইতে ও তাহাদিগকে লিখাইয়া দিতেন। এইজন্য তাঁহাকে কখনো কিতাব দেখিতে হইত না। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি যাহা কিছু শুনি, তাহা সই মুখস্থ করিয়া লই এবং যাহা মুখস্থ করি, তাহা আর কখনো ভুলিয়া যাই না।

তিনি ১৬১ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন ও  হিঃ ২৩৮ সনে নিশাপুরে ৭৭ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল কারেন।[********************]

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) ইলমে হাদীসে এক অনন্য সাধারণ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ও সুদক্ষ মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি ১৬৪ হিজরী সনে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি ইমাম  আবূ ইউসুফের মজলিসে শরীক হইতে শুরু করেন। পরে হিঃ ১৮৭ সনে তিনি হাদীস শিক্ষায় গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মুসিলম জাহানের সবকয়টি শহর ও অঞ্চল সফর করিয়াছেন।

প্রথমে বাগদাদের মুহাদ্দিসদের নিকট হইতেই তিনি হাদীস শিক্ষা করিতে শুর করেন। এই পর্যায়ে তাঁহার হাদীসের উস্তাদ হইতেছেন হুশাইম ইবনে বশীর ইবনে আবূ হাযেম (মৃঃ ১৮৩ হিঃ)। তাঁহার খিদমতে তিনি একদিক্রমে চার বৎসর পর্যন্ত অব্স্থান করেন- ১৬ বৎসর বয়স হইতে ২০ বৎসর পর্যন্ত, (১৭৯-১৮৩হিঃ)।[********************] এই সময়ে তিনি বাগদাদের অপর একজন মুহাদ্দিস উমাইর ইবনে আবদুল্লাহ ইবেন খালিদ হইতে যথেষ্ট সংখক হাদীস শ্রবণ করেন। আবদুর বহমান ইবনে মাহাদী ও আবূ বকর ইবনে আইয়াশ নামক অপর দুইজন মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিখিয়াছেন বলিয়া উল্লেক করা হইয়াছে।[********************]

১৮৬ হিঃ সনে তিনি হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ ভ্রমণ শুরু করেন। প্রথমে বসরা গমন করেন,তারপর হিজায উপস্থিত হন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইয়েমেন ও কূফা শহরেও গমন করেন। বসরা শহরে তিনি পরপর পাঁচবার উপস্থিত হন। কোন কোন বার তখায় তিনি ক্রমাগতভাবে তিন মাস করিয়া অবস্থান করেন। হিজাযেএ তিনি পাচঁবার গমন করিয়াছেন। বিদেশে এইসব সফরের মূলে তাঁহার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করা। বস্তুতপক্ষে এই সময়কার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের নিকট হইতেই তিনি হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছেন।[********************]

ইমাম আহমদ হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের অভিযানে প্রথম হইতেই একটি নীতি পালন করিয়া চলিতেন। তাহা হইতেছে হাদীস শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে উহাকে লিখিয়া লওয়া। তিনি তাঁহার অসাধারণ স্মৃতিশক্তির উপর একান্তভাবে নির্ভর করিতেন না। বরং যাহাই শুনিতে পাইতেন তাহাই কাগজের উপর লিখিয়া লওয়া ছিল তাঁহার স্থায়ীভাবে অনুসৃত নীতি।[********************]

তাঁহার শ্রুত হাদীসসমূহ তাঁহার সম্পূর্ণ মুখস্থই থাকিত, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি কোন হাদীস স্বীয় পাণ্ডুলিপি না দেখিয়া কখনো বর্ণনা করিতেন না। কেহ কোন হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে- তাহা স্মরণ ও মুখস্থ থাকা সত্ত্বেও স্বীয় কিতাব খুলিয়া উহার সন্ধান করিতেন ও পরে তাহা সম্মুখে পড়িয়া শুনাইতেন। তিনি যখন কাহাকেও হাদীস লিখাইতেন তখন হাদীস লিখিত হওয়ার পর তাঁহাকে বলিতেনঃ যাহা লিখিয়াছ, তাহা পড়িয়া শুনাও। ইহার মূলে তাঁহার লক্ষ্য থাকিত যে, হাদীসের ভাষা ও শব্দে যেন কোনরূপ পার্থক্য হইতে না পারে।[********************]

এই যুগের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম শাফেয়ী, আবদুর রাযযাক অকী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম শাফেয়ী হাদীসের সত্যতা নির্ণয়ের ব্যাপারে ইমাম আহমদের উপর পূর্ণমাত্রায় নির্ভর করিতেন। তাঁহাকে তিনি বলিয়াই রাখিয়াছেনঃ

******************************************************

হে আবূ আবদুল্লাহ ! আপনার দৃষ্টিতে যখনই কোন সহীহ হাদীস পৌঁছিবে আপনি তাহা আমাকে অবশ্যই জানাইবেন। আমি উহার ভিত্তিতে আমার ফিকাহর মাযহাব ঠিক করিব।[********************]

ইমাম আহমদ ২৩১ হিজরী সনে বাগদাদ নগরে ইন্তেকাল করেন।[********************]

 

মুসনাদ প্রণয়ন

তৃতীয় হিজরী শতকের প্রথম ভাগেই মুসনাদ নামে হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ‘মুসনাদ’ বলা হয় কোন ধরনের গ্রন্হকে?

******************************************************

মুহাদ্দিস এক একজন সাহাবীর প্রসঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে সমস্ত হাদীসকে এক সঙ্গে উল্লেখ করেন, তাহা সহীহ কি সহীহ নয় তাহার কোন পার্থক্য করেন না এবং হাদীসসমূহের বিষয়বস্তুও হয় সম্পূর্ণ বিভিন্ন। এই ধরনের গ্রন্হেই মুসনাদ বলা হয়।[********************]

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মুহাদ্দিস হযরত আবূ বকর (রা)-এর নাম উল্লেখ করেন। অতঃপর তাঁহার নিকট হইতে বিভিন্ন বিষয়ে যে সব হাদীস বর্ণিত হইয়াছে ও বিভিন্ন সনদের সূত্রে এই মুহাদ্দিস পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে, তাহার সমস্ত হাদীসই এক স্থানে লিপিবদ্ধ করা হয়। ইহার পর হযরত উমর (রা)-এর নাম আসিল এবং তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত যাবতীয় হাদীসকে এক স্থানে ও স্বতন্ত্রভাবে উল্লেক করা হইল। এইভাবে সকল সাহাবীর নামের পরে তাঁহার বর্ণিত ও বিভিন্ন সনদের সূত্রে গ্রন্হাকারে প্রাপ্ত সমস্ত হাদীসই একস্থানে সংকলিত করা হইল।[********************] তৃতীয় শতকের শুরুতে এই ধরনের হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই পর্যায়ে নিম্নলিখিত মুসনাদ গ্রন্হসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ (১) মুসনাদে উবাইদুল্লাহ ইবনে মুসা (মৃঃ ২১৩ হিঃ), (২)মুসনাদুল হুমাইদী (মৃঃ ২১৯ হিঃ), (৩) মুসনাদে মুসাদ্দাদ ইবনে মাসারহাদ (মৃঃ ২২৮ হিঃ), (৪) মুসনাদ ইসহাক ইবনে রাওয়াই (মৃঃ ২৩৮ হিঃ), (৫) মুসনাদ উসমান ইবনে আবূ শায়বাহ (মৃঃ ২৩৯ হিঃ), (৬) মুসনাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃঃ ২৩১ হিঃ), (৭) মুসনাদ ইবনে হুমাইদ (মৃঃ ২৪৯ হিঃ), (৮) আল-মুসনাদুল কবীর- ইয়াকুব ইবনে শায়বাহ (মৃঃ ২৬২ হিঃ), (৯) মুসনাদ মুহাম্মদ ইবনে মাহদী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ), (১০) আল-মুসনাদুল কবীর- বাকী ইবনে মাখলাদুল কুরতাবী (মৃঃ ২৭২ হিঃ), (১১) মুসনাদ আবূ দায়ূদ তায়ালিসী (মৃঃ ২০৪ হিঃ)।

কিন্তু হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের এই পদ্ধতি দোষমুক্ত নয়। ইহাতে হাদীসের সত্যতা, সনদের বিশ্বস্ততা ও উহার মর্যাদা সস্পষ্ট ধারণা করা কঠিন হইয়া পড়ে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এইরূপ হাদীস হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু মঙ্গল নিহিত আছে তাহা অস্বীকার করা যায় না। ইহার ফলে প্রথমতঃ রাসূলে করীম (স)- এর হাদীসসমূহ অন্যান্য বর্ণনা হইতে আলাদাভাবে পাঠ করার সুযোগ হয়। দ্বিতীয়ত একজন সাহাবীর নিকট হইতে কতজন লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা স্পষ্টভাবে জানা যায়। এমনও হইতে পারে যে, একটি হাদীসের বিশেষ কোন সনদ সূত্র হয়তো দুর্বল; কিন্তু উহারই অপর এক বর্ণনা সূত্র হয়তো নির্দোষ ও গ্রহণযোগ্য। পরিণামে এই দূর্বল সূত্রে বর্ণিত হাদীসটিও নির্ভরযোগ্য সূত্রে সমর্থনে সহীহরূপে বিবেচিত ও গ্রহণযোগ্য হইতে পারে।[********************]

তবে একথাও মনে করা যায় না যে, মুসনাদ-প্রণেতা মুহাদ্দিসগণ হাদীস নামে যাহাই পাইয়াছেন, নিতান্ত অন্ধের ন্যায় কিংবা ‘অন্ধকারে কাষ্ঠ সংগ্রহকারীর’ মত তাহাই সাহাবীর নামের সঙ্গে যুক্ত করিয়া দিয়াছেন। বস্তুত এইরূপ ধারণা করাই ভিত্তিহীন এবং অনুচিত। কেননা তাঁহারা প্রত্যেকটি হাদীসের যথার্থতা প্রাণপণে যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। সেইজন্য গভীর সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োগ করিয়াছেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁহারা দেশের পর দেশ সফর করিয়াছেন এবং তাঁহাদের সমগ্র জীবন উহার সংগ্রহ যাঁচাই-পরীক্ষা ও ছাটাই-বাছাই করার কঠিন ও কঠোরতম কাজের মধ্যে দিয়াই অতিবাহিত করিয়াছেন। মুসনাদ গ্রন্হের এমন অনেক প্রণেতাই আছেন, যাঁহারা মূল হাদীসের ও উহার সনদের যথাযথ যাচাই না করিয়া একটি হাদীসও গ্রহণ করেন নাই। অনেক মুসনাদ গ্রন্হে আবার ফিকাহ প্রণয়ন রীতি অনুযায়ী প্রত্যেক সাহাবীর হাদীসসমূহকে সন্নিবেশিত করা হইয়াছে। এই পর্যায়ে বাকী ইবনে মাখলাদ প্রণীত আল মুসনাদুল কবীর-এর নাম উল্লেখ্য। আবার কেহ কেহ প্রত্যেকটি হাদীসকে বিভিন্ন বর্ণনা সূত্র ও বিভিন্ন বর্ণনাকারীর উল্লেখসহ সজ্জিত করিয়াছেন।[********************]

এই পর্যায়ে বিভিন্ন গ্রন্হ প্রণয়ন সম্পর্কে আল্লামা ইবনে হাজর আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

শেষ পর্যন্ত হাদীসের কোন কোন ইমামের ইচ্ছা হইল কেবলমাত্র নবী করীম (স) সম্পর্কিত হাদীসসমূহ স্বতন্ত্র করিয়া গ্রন্হবদ্ধ করার । এই সময় উবাইদুল্লাহই বনে মুসা আবসী কূফী, মুসাদ্দাদ ইবনে মাসারহাদ বরসীফ, আসাদ ইবনে মুসা উমাভী ও মিসরে অবস্থানকারী নয়ীম ইবনে হাম্মাদ খাজায় এক-একখানি করিয়া মুসনাদ প্রণয়ন করেন। তাঁহাদের পরবর্তীকালীন হাদীসের ইমামগণও তাঁহাদেরই পদাংক অনুসরণ করিয়া চলিলেন। হাদীসের হাফেজগণের একজন ইমামও এমন পাওয়া যাইবে না যিনি তাঁহার সংগৃহীত হাদীসসমূহকে ‘মুসনাদ’ গ্রন্হ প্রণয়ন রীতিতে গ্রন্হাবদ্ধ করেন নাই। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহওয়াই, উসমান ইবনে আবূ শায়াবাহ এবং তাঁহাদের ন্যায় অন্যান্য বড় মুহাদ্দিসগণও এই রীতি অবলম্বন করিয়াছেন। এবং কোন কোন হাদীস সংকলক অধ্যায়-সংযোজন এব‌ং মুসনাদ-নীতি উভয়কেই অনুসরণ করিয়া হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন- যেমন আবূ বকর ইবনে আবূ শায়বাহ।[********************]

পূর্বে যেমন বলা হইয়াছে, অধ্যায় হিসাবে গ্রন্হ প্রণয়ন এবং মুসনাদ রীতি অনুযায়ী হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রহিয়াছে। অধ্যায় হিসাবে গ্রন্হ প্রণয়ন হয় বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে হাদীস সজ্জায়ন, এক এক বিষয়ের হাদীস এক একটি অধ্যায়ে সজ্জিত করা। যেমন নামায সম্পর্কিত হাদীস এক অধ্যায়ে, রোযা সম্পর্কিত হাদীস রোযার অ্ধ্যায়ে, তাকওয়া পরহিযগারী সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসূমহ স্বতন্ত্র এক অধ্যায়ে সংযোজিত করা। পক্ষান্তরে মুসনাদ প্রণয়ন রীতি এই হয় যে, প্রত্যেক সাহাবীর বর্ণিত সমস্ত হাদীস বিষয়বস্তু নির্বিশেষে একত্রিত করা- তাহা নামায সম্পর্কে হউক, রোযা সম্পর্কে হউক, কি তাকওয়া পরহেযগারী সম্পর্কিত হাদীসই হউক না কেন। যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) হইতে যত হাদীসই বর্ণিত হইয়াছে, তাহা যে কোন বিষয় সম্পর্কেই হউক না কেন একত্রিক করিয়া ‘মুসনাদে আবূ বকর সিদ্দীকি’ শিরোনামের অধীন লিপিবদ্ধ করা মুসনাদ গ্রন্হ প্রণয়নের রীতি। এই উভয় রীতির মধ্যে পার্থক্য কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রামাণ্যতার দৃষ্টিতে বিচার করিলেও এই উভয় রীতির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হইবে। অধ্যায় রীতিতে সংকলিত হাদীস-গ্রন্হের প্রথমে থাকে সেইসব বর্ণনা যাহা আকীদা বা আমলের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। এইজন্য তাঁহারা সাধারণ প্রমাণ ও দলীল হিসাবে উল্লেখযোগ্য হাদীসসমূহই সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে একত্রিত করেন, ইহার বর্ণনাকারী যে সাহাবীই হউন না কেন। কিন্তু মুসনাদ প্রণেতাদের একমাত্র কাজ হইতেছে সকল প্রকার হাদীসসমূহ সংগ্রহ, সন্নিবিষ্ট ও একত্রিত করিয়া দেওয়া। এই কারণে মূল হাদীস সহীহ কি অসহীহ তাহার বিচার না করিয়াই তাঁহারা হাদীসসমূহ একত্র করিয়া দেন।

অধ্যায় ও মুসনাদ রীতির মধ্যে পার্থক্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী উভয় রীতিতে হাদীস সংযোজিত করা ও উহার শিরোনাম নির্ধারণের কায়দা দেখাইয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেনঃ ‘মুসনাদ’ রীতিতে হাদীস সংগ্রহ করা হইলে শিরোনাম এইরূপ হইবেঃ

******************************************************

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক কর্তৃক নবী করীম (স) হইতে বর্ণিত সমস্ত হাদীস বর্ণনা বা উল্লেখ।

এবং ইহার অধীন হযরত আবূ বকর কর্তৃক বর্ণিত সমস্ত হাদীসই উদ্ধৃত হইবে।

ইহার পর দ্বিতীয় শিরোনাম হইবেঃ

******************************************************

কায়স ইবনে আবূ হাযেম হযরত আবূ বকর (রা) হইতে যেসব হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন তাহার উল্লেখ।

এইখানে গ্রন্হকারকে এমন সমস্ত হাদীসই উল্লেখ করিতে হয়, যাহা কায়সের সূত্রে হযরত আবূ বকর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তাহা সহীহ কি অসহীহ সে বিচার করার প্রয়োজন হয় না।

কিন্তু অধ্যায় হিসাবে হাদীসগ্রন্হ সংকলন করা হইলে প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শিরোনাম বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন তখন শিরোনাম হইবেঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স) হইবে তাহারাত নামায কিংবা ইবাদতের অপর কোন বিষয়ে যাহা সহীহরূপে প্রমাণিত ও বর্ণিত হইয়াছে, তাহার উল্লেখ।[********************]

এই পার্থক্য প্রদর্শন প্রসঙ্গে ইবনে হাজার আসকালানী অন্যত্র লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অধ্যায় হিসাবে, হাদীস- গ্রন্হ প্রণয়নের রীতি এই যে, তাহাতে কেবল সেই সব বর্ণনার উল্লেখ করা হইবে, যাহা প্রমাণ বা দলীল হইবার যোগ্য। পক্ষান্তরে যাঁহারা মুসনাদ প্রণয়ন করেন, তাঁহাদের পদ্ধতি আলাদা হয়। কেননা তাঁহাদের আসল উদ্দেশ্যই হয় কেবলমাত্র হাদীসের বর্ণনাসমূহ সন্নিবেশিত করিয়া দেওয়া।[********************]

মুসনাদ গ্রন্হসমূহ মূলতঃ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহের এক বিরাট স্তুপ। তাহা হইতে হাদসের শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা করা খুব সহজ হয়। এইরূপ গ্রন্হ প্রণয়নের উদ্দেশ্যই হয় এক এক সূত্রে বর্ণিত সমস্ত হাদীস একত্রিত করা, যেন বর্ণিত কোন হাদীসই অসংকলিত থাকিয়া না যায়। সহীহ গায়ের-সহীহ নির্বিশেষে সমস্ত বর্ণিত হাদীস যখন একত্রিত ও এক স্থানে সংকলিত পাওয়া যায় তখন প্রত্যেকটি হাদীস বিজ্ঞানে পারদর্শী ও সূক্ষ্ম বিচারক সমালোচক সমালোচনার কষ্টিপাথরে প্রত্যেকটি বর্ণনাকে যাঁচাই ও পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন এবং কোন হাদীসটি সহীহস কোনটি নয়, কোন সূত্রটি নির্দোষ, কোনটি দোষমুক্ত, তাহা বিচার করিতে পারেন। এমনকি এক একটি হাদীস কতবার এবং কোন কোন সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে তাহার মধ্যে কোন কোন সূত্রে কি কি শব্দে হাদীসটি বর্ণিত হইয়াছে, আর কোন সূত্রের কি অবস্থা, এই সব কিছু নির্ধারণ করা এই ‘মুসনাদ’ গ্রন্হের ভিত্তিতেই সম্ভব এবং সহজ।

মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী লিখিয়াছেনঃ

ইসলামে এই মুসনাদ গ্রন্হসমূহে যাহা গ্রন্হাবন্ধ হইয়াছে, তাহাতে সাহাবাদের বর্ণিত হাদীসসমূহই সংযোজিত হইয়াছে। ইহার মধ্যে বর্ণনা সূত্রসমূহ নির্ভরযোগ্য আছে, আর দোষমুক্তও রহিয়াছে। যেমন, উবাইদুল্লাহ ইবনে মুসার মুসনাদ এবং আবু দাউদ সুলাইমান ইবনে দাউদ তায়ালিসীর মুসনাদ। বস্তুত ইসলামে এই দুইজন মুহাদ্দিসই সর্বপ্রথম বর্ণনাকারী ব্যক্তির ভিত্তিতে মুসনাদ প্রণয়ন শুরু করেন। [কাহারো মতে সর্বপ্রথম মুসনাদ রচনা করেন দাউদ তায়ালিসী [********************] এই দুইজনের পরে আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে ইবরাহীম হানযালী, আবূ খায়সামা, জুহাইর ইবনে হারব ও উবায়দুল্লাহ ইবনে উমর কাওয়ারীরী মুসনাদ গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। অতঃপর ব্যক্তির ভিত্তিতে মুসনাদ প্রণয়নের কাজ বহু হইয়াছে। আর এইভাবে হাদীস সংযোজনে দোষযুক্ত ও নির্দোষ হাদীস-সূত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নাই।[********************]

হাকেম মুসনাদ গ্রন্হ সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোর ভাষা প্রয়োগা করিয়াছেন। সব কয়খানি মুসনাদ গ্রন্হ সম্পর্কে তিনি এইরূপ ধারণা প্রকাশ করিয়াছেন, অবশ্য অধিকংশ গ্রন্হই যে এই পর্যায়ের, তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু সব কয়টি মুসনাদ গ্রন্হ এই দোষে দোষী নহে। কোন কোন মুসনাদ-প্রণেতা হাদীস চয়নে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করিয়া স্বীয় গ্রন্হে সংযোজিত করিয়াছেন, তাহা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। যেমন আল্লামা সুয়ুতী ইসহাক ইবনে রাহওয়াই সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ জুরয়া আর-রাযী যেমন উল্লেখ করিয়াছেন, ইসহাক যে সাহাবীর বর্ণিত যে হাদীস উত্তম ও গ্রহনযোগ্য কেবল তাহাই সেই সাহাবীর নামে উল্লেখ করিয়াছেন।[********************]

মুসান্নাফ আবূ বকর ইবনে শায়বাহ

এই পর্যায়ে ইমাম আবূ বকর ইবনে শায়বার হাদীস গ্রন্হাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহার সংকলিত ‘মুসনাদ’ ও মুসন্নাফ’ তৃতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত হাদীস গ্রন্হ। ‘মুসান্নাফ’ এক অতুলনীয় গ্রন্হ বলিয়া মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা তাঁহাদের দৃষ্টিতে এক গৌরবের বস্তুও বটে। হাফেজ ইবনে কাসীর এতদূর বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘মুসান্নাফ’ এমনই একখানি গ্রন্হ যে, এইরূপ একখানি গ্রন্হ কেহ কখনো সংকলন করেন নাই, না ইহার পূর্বৈ না ইহার পরে।[********************]

হাফেজ ইবনে হাজম আন্দালূসী ইহাকে ‘মূয়াত্তা ইমাম মালিক’ হইতেও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন গ্রন্হ বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।[********************] বস্তুত সহীহ মুসলিম, সুনানে আবূ দাউদ ও সুনানে ইবনে মাজাহ- সিহাহ সিত্তার এই প্রখ্যাত গ্রন্হত্রয়ে ‘মুয়াত্তা’ অপেক্ষা বেশী হাদীস আবূ বকর ইবনে শায়বার এই ‘মুসান্নাফ’ হইতে গ্রহণ করা হইয়াছে।

এই গ্রন্হ কেবলমাত্র ‘আহকাম’ সম্পর্কিত হাদীস গৃহীত হইয়াছে- যাহা হইতে ফিকাহর কোন না কোন মাসায়ালা প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাহাতে যেমন বিশেষ কোন ফিকাহকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় নাই, তেমনি কোনটির প্রতি অধিক গুরুত্বও আরোপ করা হয় নাই। বরং হিজায ও ইরাক অঞ্চলের হাদীস বর্ণনাকারীদের নিকট যত হাদীসই পাওযা গিয়াছে তাহা সবই সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নীতিতে এই গ্রন্হে গ্রহণ করা হইয়াছে। ফলে এই গ্রন্হ হইতে প্রত্যেক ফিকাহবিদই নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে নিজের মত গ্রহণ ও উহার অনুকূলে হাদীসের ভিত্তি বা প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারেন।

এই গ্রন্হের আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে প্রত্যেকটি ‘হাদীস নববী’র সঙ্গে সঙ্গে সাহাবা ও তাবেয়ীনের কথা ও ফতোয়াও উদ্ধৃত হইয়াছে। ফলে প্রত্যেকটি হাদীস সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীদের কি মত ছিল, তাহা সহজেই জানা যাইতে পারে। ‘কাশফুজ্জুনুন’ প্রণেতা এই গ্রন্হ সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইহা এক বিরাট গ্রন্হ। ইহাতে তাবেয়ীদের ফতোয়া, সাহাবীদের বানী ও রাসূল (স)- এর হাদীসসমূহ মুহাদ্দিসদের রীতি অনুযায়ী সনদ সহকারে সন্নিবেশিত করা হইয়াছে এবং ফিকাহর কিতাব সংকলনের ধারা অনুযায়ী ইহার অধ্যায় ও পরিচ্ছেদসমূহ সজ্জিত করা হইয়াছে।[********************]

ইবনে আবূ শায়বার বিশিষ্টি ছাত্র শায়খুল ইসলাম বাকী ইবনে মাখলাদ যখন এই গ্রন্হখানা লইয়া আন্দালুসিয়া গমন করেন, তখন কোন মহলে ইহার বিরোধিতা করিলেও তথাকার শাসনকর্তা মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান ইহার আদ্যোপান্ত শ্রবণ করেন এবং রাজকীয় গ্রন্হালয়ের ভারপ্রাপ্তকে এই বলিয়া নির্দেশ দিলেনঃ

******************************************************

ইহা, এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্হ যে, আমাদের গ্রন্হালয়ে ইহার বিশেষ প্রয়োজন রহিয়াছে। অতএব উহার অনুলিপি গ্রহণের ব্যবস্থা কর।[********************]

মুসনাদ ইমাম আহমদ

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) সংকলিত হাদীস গ্রন্হ- মুসনাদ আহমদ- এই শতকের এক বিরাট ও অপূর্ব অতুলনীয় গ্রন্হ। ইহাকে হাদীস শাস্ত্রের বিশ্বকোষ বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। পূর্ববতী ও পরবর্তীকালের সকল পর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ ইহার অসাধারণ মূল্য ও গুরুত্ব উদাত্ত কণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মুসনাদ আহমদ বুখারী-মুসলিম-এর পরে হাদীসরে সর্বাধিক সমন্বাকারী ও বিশুদ্বতমগ্রন্হ। মুসলমানের ব্যবহারিক জীবনের দ্বীন ও দুনিয়া সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সমস্ত হাদীস এই বিরাট গ্রন্হে সংকলিত ও লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে।[********************]

ইমাম আহমদ (র) দীর্ঘদিনের অপরিসীম ও অবিশ্রান্ত সাধনা ও অভিনিবেশের ফলে এই গ্রন্হখানি প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি হাদীস অধ্যায়নকাল হইতেই হাদীস মুখস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে উহা লিখিয়া লইতে শুরু করেন। বয়সের হিসাবে তাঁহার এই কাজ শুরু হয় তখন, যখন তাঁহার বয়স মাত্র ১৬ বৎসর।[********************] অতঃপর সমস্ত জীবন ভরিয়া তিনি কেবলমাত্র এই কাজই করিয়াছেন। তাহার জীবনের লক্ষ্য এই হাদীস গ্রন্হখানিকে সর্বতোভাবে ব্যাপক ও সমস্ত প্রয়োজনীয় হাদীসের আকর করিয়া তোলার দিকে। হাদীসসমূহ তিনি আলাদা আলাদা পৃষ্ঠায় লিখিয়া রাখিতেন। শেষ পর্যন্ত উহা এক বিরাট গ্রন্হের পাণ্ডুলিপিতে পরিণত হয়।

কিন্তু ইমাম আহমদের চরম বাসনা ও সাধনা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তাহাঁর আয়ূষ্কাল খতম হইয়া যায়। তিনি মৃত্যুর পদধ্বনি শ্রবণ করিয়াই সর্বপ্রথম যে কাজ করিলেন তাহা এই যে, তাঁহার সন্তান ও পরিবারের লোকজনকে একত্রিত করিয়া হাদীসের এই বিরাট সংকলনটি আদ্যোপান্ত পাছ করিয়া শুনাইয়া দিলেন এবং উহাকে স্বতন্ত্র ও পরিচ্ছন্নভাবে লিখিয়া দেন। কিন্তু ইমাম আহমদ (র) তাঁহার সারা জীবনের সাধনার ফলে সংকলিত হাদীসসমূহকে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া গ্রন্হাকারে সজ্জিত ও সুসংবদ্ধ করিয়া যাইতে পারেন নাই।[********************]

শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

মুসনাদ আহমদ যদিও এই মহান সম্মানিত ইমামের সংকলিত হাদীসগ্রন্হ, কিন্তু উহাতে দুইজন লোক পরে আরও অনেক হাদীস সংযোজিত করিয়াছেন। একজন তাঁহার পুত্র আবদুল্লাহ এবং অপরজন আবদুল্লাহ হইতে এই গ্রন্হের বর্ণনাকারী আবূ বকর আল-কাতিয়ী।[********************]

এই গ্রন্হে মোট কত হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে, এ সম্পর্কে মুহাদ্দিস ঐতিহাসিকগণ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘মুসনাদে আহমদ’ গ্রন্হে মূলত ত্রিশ হাজার হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে। আর তাঁহার পুত্রের সংযোজনের ফলে শেয় পর্যন্ত উহার সংখ্যা দাঁড়াইয়াছে চল্লিশ হাজার হাদীস।[********************]

কেহ কেহ বলিয়াছেন, ইহার মোট হাদীসের সংখ্যা হইতেছে চল্লিশ হাজার, কিন্তু পুনারবৃত্তি বাদ দিলে ইহার সংখ্যা দাঁড়ায় ত্রিশ হাজার।[********************]

ইমাম আহমদ এই গ্রন্হখানিকে ঠিক মুসনাদ রীতিতে সংকলিত করিয়াছেন। তিনি এক-একজন সাহাবী (রা)-এর নাম উল্লেখ করিয়াছেন। তাহার পর সেই সাহাবী কর্তৃক নবী করীম (স)-এর যত হাদীস বর্ণিত হইয়াছে, তাহা পর পর উল্লেখ করিয়াছেন। এই হাদীসসমূহের উল্লেখ শেষ হইয়া গেলে তিনি অপর এক সাহাবী এবং তাঁহার বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। তিনি ইহাকে বিষয়বস্তু দৃষ্টিতে সজ্জিত করেন নাই। ফলে ইহাতে হদ সম্পর্কে উদ্ধৃত একটি হাদীসের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যাইবে ইবাদত ও পরকালের ভয় সম্পর্কিত হাদীস।[********************]

এই গ্রন্হে মাত্র আঠারখানি মুসনাদ উল্লেক করা হইয়াছে। প্রথমে জান্নাতের সসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবীর মুসনাদ উল্লেখ করা হইয়াছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আহলে বায়ত-এর মুসনাদ, তৃতীয় পর্যায়ে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, চতুর্থ আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের মুসনাদ, পঞ্চম আবদুল্লাহই ইবনে আমর ও আবূ মারমাসা, ষষ্ঠ হযরত আব্বাস, সপ্তম আবূ হুরায়রার মুসনাদ, অষ্টম আনাস ইবনে মালিক, নবম আবূ সাঈদ খুদরীর মুসনাদ, দশম জবির ইবনে আবদুল্লাহর মুসনাদ, একাদশ মক্কী সাহাবীদের মুসনাদ, দ্বাদশ মাদানী সাহাবীদের মুসনাদ, ত্রয়োদশ সুফফার অধিবাসী সাহাবী চতুর্দশ বসরার অধিবাসী সাহাবী, পঞ্চাদশ সিরিয়ার অধিবাসী সাহাবী, ষোড়শ আনাসর ও সপ্তাদশ হযরত আয়েশার মুসনাদ- মোটামুটি মুসনাদ গ্রন্হখানি একশত বাহাত্তর অংশে বিভক্ত।[********************]

ইমাম আহমদ এই গ্রন্হখানিকে সহীহ হাদীসসমূহের এক অতুলনীয় আকররূপে সজ্জিত করিতে চাহিয়াছিলেন। হাদীস চর্চকারীদের মধ্যে কোন হাদীস সম্পর্কে মতবিরোধের সৃষ্টি হইলে এই গ্রন্হই যেন উহার চূড়ান্ত মীমাংসাকারী হইতে পারে; হাদীসসমূহের সনদ সম্পর্কে ইহা এক নির্ভরযোগ্য দস্তাবেজ হইতে পারে, ইহাই ছিল তাঁহার ঐকান্তিক কামনা।

ইমাম আহমদের পুত্র আবদুল্লাহ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেনঃ

******************************************************

আপনি গ্রন্হ প্রণয়ন অপছন্দ করেন কেন? অথচ আপনি নিজেই মুসনাদ গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন?

ইহার জওয়াবে ইমাম আহমদ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই গ্রন্হখানিকে ‘ইমাম’ স্বরূপ প্রণয়ন করিয়াছি। লোকদের মধ্যে যখন রাসূলে করীম (স)-এর কোন সুন্নাত বা হাদীস সম্পর্কে মতভেদ হইবে তখন যেন তাহারা ইহার নিকট হইতে চূড়ান্ত মীমাংসা লাভ করিতে পার।[********************]

ইমাম আহমদের ভ্রাতুস্পুত্র হাম্বল ইবনে ইসহাক বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার সম্মানিত চাচা ইমাম আহমদ (র) আমাকে ও তাঁহার দুই পুত্র সালেহ ও আবদুল্লাহকে একত্রিত করিয়া আমাদের সম্মুখে এই মুসনাদ গ্রন্হখানি আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া শুনাইয়াছেন। আমাদের ব্যতীত অপর কেহ গ্রন্হখানি তাঁহার মুখে সম্পর্ণ শ্রবণ করিতে পারে নাই। তিনি আমাদিগকে বলিয়াছেন, ‘এই গ্রন্হখানিকে আমি সাড়ে সাত লক্ষেরও অধিক সংখ্যক হাদীসের বর্ণনা হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া সংকলিত ও প্রণয়ন করিয়াছি। রাসূলে করীম (স)-এর যে হাদীস সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ হইবে, সেই হাদীস পাওয়ার জন্যই তোমরা এই কিতাবের দিকে প্রত্যাবর্তন কর (অর্থাৎ সেই হাদীসটি এই কিতাবে তালাশ ও সন্ধান কর)। ইহাতে যদি তাহা পাওয়া যায়, তবে তো ভালই, আর পাওয়া না গেলে উহাকে প্রামাণ্য বা প্রতিষ্ঠিত হাদীস মনে করা যাইবে না।[********************]

উপরিউক্ত দীর্ঘ উদ্ধৃতির শেষাংশে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের উক্তিটি বিশ্লেষণ সাপেক্ষ। ইমাম যাহবী ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদের এই কথাটি সাধারণ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণীয়। অন্যথায় মুসলিম, বুখারী, সুনান গ্রনহাবলী ও অন্যান্য জুজ গ্রন্হে আমরা এমন সব সহীহ হাদীস পাই, যাহা মুসনাদ গ্রন্হে নাই।[********************]

হাফেজ শামসুদ্দিন জজরী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদ (র) তাঁহার এই কথা দ্বারা হাদীসসমূহের মূলের দিকেই ইশারা করিতে চাহিয়াছেন। আর ইহা সত্য কথা। কেননা সম্ভবত এমন কোন হাদীসই নাই, যাহার ‘মূল’এই মুসনাদ গ্রন্হে উল্লিখিত হয় নাই।[********************]

ইমাম আহমদ সংকলিত হাদীস গ্রন্হখানি এই উচ্চ মর্যাদাই লাভ করিতে পারিত; কিন্তু তিনি নিজে ইহার সংকলন কার্য সম্পূর্ণরূপে সমাপ্ত করিয়া যাইতে পারেন নাই বলিয়া বহু সহীহ হাদীস এবং বহু সংখ্যক সাহাবীর বর্ণনা ইহার অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে নাই। হাফেজ ইবনে কাসীর এই সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদ (র) সংকলিত এই মুসনাদ গ্রন্হখানি হাদীস বর্ণনা সূত্রের বিপুলতাও রচনাসৌকর্যে অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও ইহা হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস সম্পূর্ণ বাদ পড়িয়া গিয়াছে। বরং বলা হয় যে, প্রায় দুইশত সাহাবীর বর্ণিত কোন হাদীসই ইহাতে উদ্ধৃত হয় নাই, অথচ বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হে তাঁহাদের বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।[********************]

কিন্তু এইসব সত্ত্বেও মুসনাদে আহমদের বৈশিষ্ট্য কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। উহাতে যে স্বকপোলকল্পিত নিজস্ব রচিত ও অমুলক একটি হাদীসও নাই, তাহা সর্বসম্মত সত্য। ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখিয়াছেন, এই ধরনের একটি হাদীসও মুসনাদ গ্রন্হে নাই।[********************] পরন্তু সহীহ হাদীসসমূহের এতবড় সমষি।ট দ্বিতীয়টি নাই। হাফেজ নূরুদ্দীন হায়সামী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সহহি হাদীস হিসাবে মুসনাদে আহমদ অপর হাদীস গ্রন্হসমূহের তুলনায় অধিকতর সহীহ।[********************]

ইমাম আহমদ তাঁহার নিজের মানদণ্ডে ওযন করিয়া হাদীসসূহ সংকলন করিয়াছেন। মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদ তাঁহার গ্রন্হে স্বীয় শর্তানুযায়ী বিশেষ সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করিবেন না বলিয়া সিদ্ধা্ন্ত করিয়াছিলেন।[********************]

পূর্বেই বলিয়াছি, ইমাম আহমদ নিজের জীবনে এই গ্রন্হখানিকে সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারেন নাই। এই কারণে ইহাতে ইমামপূ্রত আবদুল্লাহ এবং হাফেজ আবূ বকর আল-কাতীয়ী কর্তৃক সংযোজিত বহু হাদীস পরিদৃষ্ট হইতেছে।

আল্লামা আহমাদুল বান্না এই বিরাট গ্রন্হখানির পূর্ণ সম্পাদনা এবং অধ্যায় ও বিষয়বস্তু দৃষ্টিতে পূনর্বিন্যাস করিয়াছেন। সম্প্রতি উহার বৃহদায়তন ২১ খণ্ডগ্রন্হ মিসর হইতে ‘ফতহুল রব্বানী’ নামে প্রকাশিত হইয়াছে এবং উহার সহিত তাঁহারই কৃত বিশদ ‘শারহ’ বুলুগুল আমানী’ নামে শামিল রহিয়াছে। আমাদের মতে বর্তমানে ইহা এক বিরাট তুলনাহীন হাদীস সম্পদ।

আহমদুল বান্না মুসনাদের হাদীসসমূহ সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

‘মুসনাদ’ গ্রন্হের হাদীস সমূহের যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া আমি দেখিলাম যে, ইহাতে মোট ছয় প্রকারের হাদীস রহিয়াছে। প্রথম আবূ আবদুর রহমান আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমদ বর্ণিত হাদীস, যাহা তিনি স্বয়ং ইমামের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছেন। মূলত ইহাই মুসনাদে আহমদ এবং ইহা বর্তমান গ্রন্হের চার ভাগের তিন ভাগ।

দ্বিতীয়, যেসব হাদীস আবদুল্লাহ ইমাম আহমদ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছেন। ইহার সংখ্যা অত্যন্ত কম।

তৃতীয়, যেসব হাদীস আবদুল্লাহ তাঁহার পিতা ছাড়া অপরাপর মুহাদ্দিসের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছেন, তাহা যাওয়ায়িদে আবদুল্লাহ’ বা ‘আদুল্লাহ সংযোজন’ নামে পিরিচিত। এই হাদীসের সংখ্যা বিপুল।

চতৃর্থ, যেসব হাদীষ আবদুল্লাহ নিজে তাঁহার পিতার সম্মুখে পাঠ করিয়াছেন ও তাঁহাকে শুনাইয়াছেন; কিন্তু তিনি তাঁহার পিতার নিকট হইতে শুনেন নাই- ইহার সংখ্যাও কম।

পঞ্চম, যেসব হাদীস আবদুল্লাহ তাঁহার পিতার নিকট পাঠ করেন নাই, তাঁহা নিকট হইতে শুনিতেও পান নাই, বরং যাহা তিনি তাঁহার পিতার গ্রন্হে তাঁহার পিতার স্বতস্ত লিখিত অবস্থায় পাইয়াছেন- ইহার সংখ্যাও কম।

ষষ্ঠ, যেসব হাদীস প্রখ্যাত ও সর্ব জনমান্য মুহাদ্দিস হাফেজ আবূ বকর আল কাতায়ী কর্তৃক আবদুল্লাহ এবং তাঁহার পিতা ইমাম আহমদ ব্যতীত অপরাপর মুহাদ্দিসের নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেন-ইহার সংখ্যা সর্বাপেক্ষা কম।

 

হাদীস সংকলনের চূড়ান্ত পর্যায়

পূর্বের আলোচনা হইতে পাঠকদের নিকট একথা সুস্পষ্ট হইয়াছে যে, তৃতীয় হিজরী শতকে হাদীসের চর্চা, প্রচার, সংকলন ও গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ অধিকতর উন্নতি, বিকাশ সম্প্রসারণ ও উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে। ইহার এক একটি বিভাগ স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মর্যাদা সহকারে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। মুহাদ্দিস ও হাদীস বর্ণনাকারীগণ এই শতকে হাদীস শিক্ষা ও চর্চার দিকে পূর্বের তুলনায় অনেক ব্যাপক ভিত্তিতে মনোনিবেশ করিয়াছেন। হাদীস সংগ্রহকারিগণ হাদীসের সন্ধানে মুসলিম জাহানের প্রত্যেকটি কেন্দ্রে পর্যটন করিয়াছেন, প্রত্যেকটি স্থানে উপস্থিত হইয়া বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও সংকলন করিয়াছেন। সংগ্রহীত হাদীসসমূহকে একত্রে সংকলিত করিয়া বহু সংখ্যক মূল্যবান ও বৃহদাকারের গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।

এই শমতকে মুসলিম সমাজে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যাহার ফলে হাদীস-বিজ্ঞান নামে স্বতন্ত্র এক জ্ঞান বিভাগের উদ্ভাবন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হইয়া পড়ে। হাদীস-বিজ্ঞানের পরিভাষায় ইহার নাম হইতেছে ******************** ‘হাদীস পর্যালোচনা ও সামালোচনা বিজ্ঞান’। হাদীস পর্যালোচনা ও সমালোচনা বিভাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করার জন্য উপরোক্ত পরিস্থিতির বিস্তারিত আলোচনা আবশ্যক।

তৃতীয় শতকের মুসলিম সমাজ

তৃতীয় শতকের মুসলিম সমাজক এক কথায় বহুবিধ ইসলাম বিরোধী ভাবধারা ও ফিতনা-ফাসাদে জর্জরিত বলিয়া অভিহিত করিতে হয়। খুলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম সময় হইতেই ইসলামের উপর মুহুর্মুহু যে প্রচণ্ড আঘাত আসিতে থাকে, উহাকে সামরিক পরিভাষায় ‘বহিরাক্রমণ’ বলা যাইতে পারে। বিশেষত হযরত উসমান (রা) ও হযরত আলী (রা)-এর সময়কালীন আঘাতসমূহকে এই পর্যায়ে গণ্য করা যায়। কিন্তু ইসলাম এই সকল বহিরাক্রমণকে উহার অন্তর্নিহিত প্রবণ শক্তি ও দৃঢ়তার বলে প্রতিহত করিয়া দেয়। পরবর্তীকালে ইসলামী খিলাফতকে চূর্ণ করিয়া দিয়া জাহিলিয়াতের সর্বপ্লাবী সয়লাবে ইসলামের নাম-নিশানা পর্যণ্ত ধুইয়া মুছিয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু সাহাবা-উত্তরকালে একনিষ্ঠ তাবেয়ীনের অক্লান্ত চেষ্টা-সাধনা ও অভিনিবেশের ফরে ইসলাম  উহার আদর্শিক বুনিয়াদকে মজবুত ও অটল করিয়া রাখিতে সমর্থ হয়। ইসলামের দুশমনগণ বহিরাক্রমণের আঘাতে উহাকে খতম করিতে ব্যর্থ হইয়া উহার অভ্যন্তর হইতে গোপন ষড়যন্ত্রের সাহায্যে চরম বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত করে। এই পর্যায়ে ইসলামের দুশমনগণ ইসলামের নামে এমন সব চিন্তু, মত, আকীদা ও বিশ্বাস সর্বসাধারণ মুসলমানের মধ্যে অবলীলাক্রমে প্রচার করিতে থাকে, যাহার ফলে তৈলহীন প্রদীপের মত ভিতর হইতেই নিঃশেষে ইসলামের চির নির্বাণ লাভের উপক্রম হয়।

 মুসলিম সমাজে এই পর্যায়ে যেসব বাতিল চিন্তা ও মতবাদের উদ্ভব হয়, তন্মধ্যে সর্বপ্রথম হইতেছে বল্গাহীন বুদ্ধিবাদ ও যুক্তিবাদের প্রবল প্রবণতা। বুদ্ধির কষ্টিপাথরে ইসলামের মৌলিক আকীদা বিশ্বাস পর্যন্ত ওজন ও যাচাই করা শুরু হয়। যাহা মানুষের সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ বুদ্ধি ও বিবেকের তুলাদন্ডে উত্তীর্ণ হয় না, তাহা প্রত্যাখ্যাত হইতে থাকে। ইহাতে ইসলামের কয়েকটি মৌলিক আকীদা- যাহার উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত – পরিত্যক্ত হইতে সুস্পষ্ট ভাষায় অস্বীকৃত হইতে থাকে।

ইহার পর কুরআন ‘মখলূক’ (সৃষ্ট) কি ‘গায়র মখলূক’ (অসৃষ্ট কাদীম) এই পর্যায়ে মুসলিম সমাকে আলোচনা ও বিতর্কের এক প্রচণ্ড তাণ্ডবের সৃষ্টি হয়। ফলে কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশসমূহ নিষ্ঠা সহকারে পালন করিয়া চলার প্রবণতা বিলুপ্ত হয়, মানুষ এই নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ও অবান্তর বিতর্কে পড়িয়া বিভ্রান্ত ও গোমরাহ হইতে শুরু করে।

আব্বাসী যুগের শেষভাগে মুসলিম সমাজে নাস্তিকতাবাদ একটি আকীদা ও বিশ্বাস হিসাবে প্রসার লাভ করিতে শুরু করে। এই সময়কার নাস্তিকতাবাদগণ প্রকাশ্যভাবে নিজেদেরকে মুসলিম বলিয়া দাবি জানাইত বটে; কিন্তু ভিতরে তাহারা গোটা ‘দ্বীন’কেই সম্পূর্ণরূফে অস্বীকার করিয়া চলিত। এই যুগের দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত গ্রীক গ্রন্হাবলী আরবী ভাষায় অনুদিত হয় এবং মুসিলম সমাজে ইহা ব্যাপকভাবে পঠিত ও  চর্চা হইতে শুরু হয়। ফলে নাস্তিকতাবাদ ও ধর্মহীনতার চিন্তা এক বিজ্ঞানসম্মত মত হিসাবেই জনগণের নিকট গৃহীত হইতে থাকে।

প্রাচীনকালে অমূলক কিসসা-কাহিনীও এই সময় মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করিতে শুরু করে। স্বকপোলকল্পিত কাহিনীতে রঙ-চঙ লাগাইয়া জনগনের নিকট অধিকতর আকর্ষনীয় করিয়া তুলিবার জন্য সর্ব প্রযত্নে চেষ্টা করা হয়। উহাকে হাদীসের ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি অনুযায়ী রূপ দিতে ও রাসূলের হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিতেও দ্বিধাবোধ করা হইত না। ফলে কুরআন ও রাসূলের হাদীস হইতে সাধারণ মুসলমানের দৃষ্টি ফিরিয়া উহার বিপরীত দিকেই সম্পূর্ণরূপে নিবদ্ধ হয়। বস্তুত এই সকল ব্যাপারই ছিল ইসলামের পক্ষে মারাত্মক ফিতনা এবং হাদীস জালকরণের ব্যাপক প্রবণতাই এই ফিতনার বাস্তব রূপ।

উল্লিখিত ফিতনাসমূহের প্রত্যেকটি পর্যায়ে বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, রাসূলের হাদীস হইতে সমর্থন গ্রহণের জন্য দূরন্ত চেষ্টা চালানো হইয়াছে। কিন্তু রাসূলের প্রকৃত হাদীসসমূহে যখন উহার একটির প্রতিও একবিন্দু সমর্থন পাওয়া যায় নাই, তখন তাহারা সকলেই-  এই ফিতনাসমূহের প্রায় সকল ধারকই-  নিজস্বভাবে কথা রচনা করিয়া রাসূলের নামে হাদীস বর্ণনাসূত্র (সনদ) জুড়িয়া দেওয়া হয় এবং উহাকে এমনভাবে পেশ করা হইতে থাকে, যেন সকলেই উহাকে রাসূলের মুখ নিঃসৃত বাণী বলিয়া বিশ্বাস করিয়া লয়- অন্তত এই দিক দিয়া সন্দেহ করার কোন প্রকাশ্য কারণ না থাকে। ঠিক এই অবস্থায় প্রত্যেকটি হাদীস সমালোচনার কষ্টিপাথরে ওজন ও যাচাই করিয়া লওয়ার অপরিহার্য প্রয়োজন দেখা দেয় এবং হাদীস নামে বর্ণিত প্রত্যেকটি কথাকে যাচাই পরীক্ষা করিয়া কোনচি প্রকৃতপক্ষে রাসূলের বাণী ও কোনটি নয়, তাহা নির্ধারণ করার জন্য কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য উপায় পদ্ধতি হিসেবে হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞান পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়।[******************** গ্রন্হের ৩৬১ পৃষ্ঠা হইতে ৩৪২ পর্যন্ত আলোচনা ছায়া অবলম্বনে।] ইহার ফলে ইসলামকে খতম করার এই ভিতরের দিক হইতে আসা আক্রমণও শেষ পর্যন্ত চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সহজেই চিন্তা করা যায়, এই সময় যদি হাদীস যাচাই ও পরীক্ষা করার দিকে উক্ত রূপ গুরুত্ব সহকারে লক্ষ্য আরোপ করা না হইত, তাহা হইলে মিথ্যা হাদীসের স্তূপ মুসলিম মানসকে সর্বাত্মকভাবে আচ্ছন্ন ও পূর্ণমাত্রায় গোমরাহ করিয়া ফেলিত, তাহাতে একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ নাই। উপরিউল্লিখিত প্রত্যেকটি ফিতনার সময় যখনই মুসলিমদের দৃষ্টি কুরআন হাদীস হইতে ভিন্নদিকে ফিরিয়া যাইতে শুরু করিয়াছে, তখনি সমাজে এমন সব মহান ব্যক্তির অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা গিয়াছে, যাঁহারা প্রবল শক্তিতে হাদীস হেফাজতের ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছেন, পুঞ্জীভূত আবর্জনা দূরে নিক্ষেপ করিয়া প্রকৃত হাদীসে রাসূলকে জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন এবং মুসলিম মানসলোককে রাসূলের প্রকৃত হাদীসরে অম্লান আলো বিকিরণে সমুদ্ভাসিত করিয়া তুলিয়াছেন। এই ব্যাপারে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে যে ব্যাপক প্রচেষ্টা নিয়োজিত হইয়াছে, তাহা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ইতিহাসে চির উজ্জ্বল হইয়া থাকিবে।

খিলাফতে রাশেদার পরে উমাইয়া বংশের লোক উমর ইবনে আবদুল আযীয খলীফা নির্বাচিত হইয়া হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের জন্য যে ব্যাপক ব্যবস্থা সরকারী পর্যায়ে গ্রহণ করিয়াছিলেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে পেশ করা হইয়াছে। এই পর্যায়ে এ কথা পুনরায় ঘোষণা করা যাইতে পারে যে, হাদীস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের এই ব্যবস্থা গৃহীত না হইলে রাসূলে করীমের বিপুল সংখ্যক দুনিয়ার বুক হইতে বিলীন হইয়া যাইত।

বনু আব্বাসীয়দের সময়েও যখন হাদীসের উপর সমূহ বিপদের ঘনঘটা সমাচ্ছন্ন হইয়া আসিয়াছিল তখনো একজন খলীফা (আসলে বাদশাহ) হাদীস সংরক্ষণ ও উহার সঠিক প্রচারে উদ্যোগী হন। তিনি হইতেছেন আল-মুতাওয়াককিল আলাল্লাহ (২৩২ হিঃ)। তিনি স্বভাবতই সুন্নাতে রাসূলের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াই মুসলিম জাহানের সর্বত্র হাদীস সংরক্ষণ ও উহার ব্যাপক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ পাঠাইলেন। এই সময়কার শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ আবূ বকর ইবনে শায়বা জামে রাসাফা’য় হাদীস শিক্ষাদান শুরু করেন। ফলে তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষার জন্য মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে প্রায় ত্রিশ সহস্র ব্যক্তি সমবেত হয়, অপর দিকে তাঁহারই সহোদর উসমান ইবনে আবূ বকর জামে আল মনসুর এ হাদীস অধ্যাপনা শুরু করেন। তাঁহার সম্মুখেও অনুরূপ সংখ্যক হাদীস শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়।

হাদীস শিক্ষা ও সংরক্ষণের প্রতি আল-মুতাওয়াককিলের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখিয়া সমস্ত মুসলিম জনতার দিল আল্লাহর নিকট তাঁহার জন্য আকুল প্রার্থনায় উচ্ছাসিত হইয়া উঠে; তাঁহার প্রশংসা তাহারা বাকমুখর হইয়া উঠে, সকলেই তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধ ও সম্মান প্রদর্শন করিতে থাকে। এমনকি এই সময় জনগনের নিম্নোক্ত কথাটি একটি সাধারণ উক্তিতে পরিণত হয়ঃ

******************************************************

খলীফা তো মাত্র তিনজনঃ মুরতাদগণকে দমন ও হত্যা করার ব্যাপারে হযরত আবূ বকর, জুলুম-অত্যাচার বন্ধ করণে উমর ইবনে আবদুল আযীয এবং হাদীস ও সুন্নাতের পুনরুজ্জীবন এবং বাতিল পন্হীদের দমন ও ধ্বংস সাধনে আল মুতাওয়াককিল।[********************]

অপরদিকে হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও বাছাই-ছাঁটাইর পর সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হাদীসের সমন্বয়ে উন্নত ধরণের গ্রন্হ প্রণয়নের কাজও এই শতকের অপূর্ব গুরুত্ব, মর্যাদা এবং ব্যাপকতা ও গভীরতা সহকারে সুসম্পন্ন হইয়াছে। এই বিরাট ও দুরূহ কাজের জন্য যে প্রতিভা ও দক্ষতা অপরিহার্য ছিল, আল্লাহর অনুগ্রহে তাহাতে ভূষিত হইয়াছে কয়েকজন ব্যক্তি আবির্ভূত হন। তাঁহারা হইতেছেন ছয়খানি সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্হ- প্রণেতা- ছয়জন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদঃ

১. ইমাম বুখারী, ২. ইমাম মুসলিম, ৩. ইমাম নাসায়ী, ৪. ইমাম তিরমিযী, ৫. ইমাম আবূ দাউদ এবং ৬. ইমাম ইবনে মাজাহ। তাঁহাদের প্রত্যেকের সংকলিত হাদীস গ্রন্হ জ্ঞান ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক একটি বিস্ময়।

এখানে আমরা প্রথমে এক একজন হাদীসবিদের জীবনালেখ্য সংক্ষেপে আলোচনা করিব এবং পরে তাঁহাদের সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহের বিস্তারিত পরিচয় স্বতন্ত্রভাবে পেশ করিব। এই আলোচনা হইতে এই শতকে হাদীসের চরম পর্যায়ের উৎকর্ষতা লাভ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ সম্ভব হইবে।

 

ইলমে হাদীসের ছয়জন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি

ইমাম বুখারী (র)

ইমাম বুখারী (র)-এর পূর্ণ নাম আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম। তিনি মুসলিম অধ্যুীষত এবং ইসলাম সংস্কৃতি ও সভ্যতার লীলাকেন্দ্র বুখারা নগরে ১৯৪ হিজরীর ‌১৩ ই শওয়াল শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকালেই তাঁহার পিতা ইহলোক ত্যাগ করেন। মায়ের স্নেহময় ক্রোড়ে তিনি শৈশব লালিত পালিত হন। তিনি যখন মকতবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভে রত ছিলেন, সেই সময়েই তাঁহার মনে হাদীস শিক্ষালাভের উদগ্র বাসনা জাগ্রত হয়। এ্ই সম্পর্কে ইমাম বুখারী (র) নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মতবের প্রাথমিক লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকার সময়ই হাদীস মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমার মনে ইলহাম হয়।[********************]

এই সময় তাঁহার বয়স কত ছিল জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিয়াছেনঃ ‘দশ বৎসর কিংবা তাহারও কম।[********************]

একাদশ বৎসর বয়সে হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ইমাম বুখারীর বিস্ময়কর প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে। এই সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এই সময় (******************** ) সুফিয়ান আবূয যুবাইর হইতে ও আবূয যুবাইর ইবরাহীম হইতে- এই বর্ণনা সূত্রে হাদীস জনসমক্ষে প্রচার করা হইতেছিল। তদানিন্তন মুহাদ্দিস দাখেলীর নিকট এই সূত্র শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলিয়া উঠিলেনঃ

এই সূত্র ঠিক নহে, কেননা -******************** - ‘আবূয যুবাইর ইবরাহীমের নিকট হইতে কোন হাদীস আদৌ বর্ণনা করেন নাই।

মুহাদ্দিস দাখেলী একাদশ বৎসরের এই বালকের স্পর্ধা দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তিনি বালককে ধমক দিলেন। তখন ইমাম বুখারী (র) বলিলেনঃ

******************************************************

আপনার নিকট মূল গ্রন্হ বর্তমান থাকিলে একবার তাহাই খুলিয়া দেখুন (ও আমার কথার সত্যতা যাচাই করুন) # বুখারা নগর উজবেকিস্তান প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত। বর্তমানে এই নগরটি মধ্য এশিয়ার রুশ সাম্রাজ্যের  অন্তর্ভুক্ত। মা- আরায়িন- নহর এলাকায় একটি প্রধান নগররূপে গণ্য- জীহুন নদীর তীরে। ইরানের সমরকন্দ হইতে ৩০০ কিলোমিটার দূরে।

ইমাম বুখারী বলিলেনঃ ‘এখানে এই সূত্রে ‘আবূয যুবাইর’ ভূল বলা হইতেছে, আসলে বর্ণনার সূত্র হইবে ‘যুবাইর ইবনে আদী ইবরাহীম হইতে- এইরূপ’।

অতঃপর মুহাদ্দিস দাখেলী মূল গ্রন্হ খুলিয়া দেখিলেন, বালক আবূ আবদুল্লাহর কথাই সত্য, মূল গ্রন্হে অনুরূপই লিখিত রহিয়াছে।[********************]

ইমাম বুখারী যখন ষোল বৎসর বয়স অতিক্রম করিয়াছিলেন তখন তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক ও ইমাম অকী’র সংকলিত হাদীসগ্রন্হ সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন।[********************]

ইহার পর ইমাম বুখারী তাঁহার মা ও ভাই সমাভিব্যাহারে হজ্জে গমন করেন। ইহার পূর্বে তিনি বুখারায় অবস্থানকারী সকল মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ সমাপ্ত করিয়াছিলেন। তাঁহার এই সফর অনুষ্ঠিত হয় ২১০ হিজরী সনে।[********************] হজ্জে আগমন করিয়া তিনি একাধারে ছয় বৎসর পর্যন্ত হিজাযে অবস্থান করেন। তখন তিনি একদিকে যেমন ব্যাপকভাবে হাদীস শিক্ষায় মনোযোগ দিয়াছিলেন, অনুরূপভাবে ইহার সঙ্গে সঙ্গেই তিন লেখনীও পরিচালনা করিয়াছিলেন পূর্ণমাত্রায়। ইমাম বুখারী তাঁহার এই সময়কার লেখন পরিচালনা ও গ্রন্হ প্রণয়ন সম্পর্কে নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি আঠারো বৎসর অতিক্রম করিতেছিলাম, তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের বিচার-ফয়সালা সম্পর্কে একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করি। অতঃপর আমি মদীনায়ী রাসূলে করীম (স)-এর কবরের নিকটে বসিয়া ‘আততারীখুল কবীর’ গ্রন্হ রচনা করি। আর চন্দ্রদীপ্ত রাত্রিতে এই লেখনীর কাজ চালাইতাম।[********************]

হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইমাম বুখারী বহু দেশ ও শহর পরিভ্রমন করিয়াছেন। এক-একটি শহরে উপস্থিত হইয়া সম্ভাব্য সকল হাদীস তিনি আয়ত্ত করেন। তাঁহার পর তিনি অন্য শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এইভাবে বিশাল ইসলাম রাজ্যের উল্লেখযোগ্য কোন শহর এমন ছিল না, যেখানে তিনি উপস্থিত হইয়া হাদীস হাদীস সংগ্রহ করেন নাই। আল্লামা যাহবী এই প্রসঙ্গে বলেন, বাগদাদ, মক্কা, বসরা, কূফা, আসকালান, হিমস, দামেশক প্রভৃতি শহরের নাম উল্লেখ করিয়াছেন এবং কোন শহরের কোন মুহাদ্দিস হইতে ইমাম বুখারী হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাঁহার নামও লিখিয়া দিয়াছেন।[********************]

কিন্তু এই তালিকা সম্পূর্ণ নয় বলিয়াই মনে হয়। আল্লামা খতীব বাগদাদী ইমাম বুখারীর এই দেশ সফর সম্পর্কে এক কথায় বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইলমে হাদসের সন্ধানে সমগ্র শহরের সকল মুহাদ্দিসের নিকটই তিনি উপস্থিত হইয়াছেন।[********************]

তাঁহার এই পরিভ্রমন সম্পর্কে একটি ব্যাপক ধারণা দানের উদ্দেশ্যে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি সিরিয়া,মিসর ও জযীরায় দুই দইবার করিয়া উপস্থিত হইয়াছি। বসরা গিয়াছি চারবার। হিজাযে ক্রমাগত ছয় বৎসর পর্যন্ত অবস্থান করিয়াছি। আর কূফা ও বাগদাদে যে আমি কতবার গমন করিয়াছি ও মুহাদ্দিদের খিদমতে হাযির হইয়াছি, তাহা আমি গণনা করিতে পারিব না।[********************]

ইমাম বুখারী (র) একবার সমরকন্দে উপস্থিত হইলেন। তখন প্রায় চারশত মুহাদ্দিস তাঁহার সম্মুখে সমবেত হন। তাঁহারা ইমাম বুখারীর হাদীস সম্পর্কে গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের খ্যাতি পূর্বেই শুনিতে পাইয়াছিলেন। এই কারণে তাঁহারা ইমাম বুখারীকে পরীক্ষা করিতে ইচ্ছা করিলেন। তাঁহারা এই উদ্দেশ্যে কতকগুলি হাদীসের মূল বাক্যাংশ উহার সনদ সূত্র হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া অপর একটি হাদীসের সনদের সহিত জুড়িয়া দিলেন এবং সনদগুলিও উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া রাখিলেন। অতঃপর ইহা ইমাম বুখারী (র)-এর সম্মুখে পাঠ করেন এবং উহার সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ করেন। ইমাম বুখারী (র)-র নিকট এই সমস্ত হাদীসই ছিল দর্পণের মত উজ্জ্বল। কাজেই কোথায় মূলকথা ও উহার সনদে ওলট-পালট করা হইয়াছে, তাহা তাঁহার বুঝিতে এতটুকু অসুবিধা হইল না, এতটুকু সময়ও লাগিল না। তিনি এক একটি হাদীস পাঠ করিয়া উহার দোষক্রটি উল্লেখ করিতে শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি হাদীসকে তিনি উহার আসল রূপে উহার নিজস্ব সনদসহ সজ্জিত করিয়া সমাগত মুহাদ্দিসগণের সম্মুখে পেশ করিলেন। মুহাদ্দিসগণ ইমাম বুখারী (র)-এর এই জওয়াবকে একান্তু সত্য বলিয়া গ্রহণ না করিয়া পারিলেন  না। ঐতিহাসিকগণ লিখিয়াছেন, বাগদাদেও ইমাম বুখারীর প্রতি অনুরূপ প্রশ্ন করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত জবাব শুনিয়া মুহাদ্দিসগণ ইমাম বুখারী (র)-এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিতে বাধ্য হন।[********************]

ইমাম বুখারীর তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির কথা উল্লেখ করিয়া বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

তিনি একবার মাত্র কিতাব পড়িতেন এবং একবার দেখিয়াই সমস্ত কিতাব মুখস্থ করিয়া ফেলিতেন।[********************]

হাদীসে তাঁহার যে কি বিপুল,ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান ছিল, তাহা দুনিয়ার মুহাদ্দিসদের অকপট স্বীকৃতি হইতেই সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। এখানে কয়েকজনের উক্তি উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ

ইবনে খুযায়মা (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আসমানের তলে রাসূলের হাদীসের বড় আলিম এবং উহার বড় হাফেজ মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈলুল বুখারী অপেক্ষা আর কাহাকেও আমি দেখি নাই।[********************]

ইমাম মুসলিম একদিন ইমাম বুখারী (র)-এর নিকট উপস্থিত হইলেন ও তাঁহার কপোলে চুম্বন করিলেন। বলিলেনঃ

******************************************************

আমাকে আপনার পদযুগল চুম্বন করার অনুমতি দিন হে সমস্ত উস্তাদের উস্তাদ মুহাদ্দিসদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং হাদসের ‘রোগের চিকিৎসক’।[********************]

ইমাম বুখারী অত্যন্ত ভদ্র, বীর ও পবিত্র স্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আত্মসম্মানবোধে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ ও নিতান্ত চেতনাসম্পন্ন। তিনি রাজা-বাদশাহর দরবারের ধারই ধারিতেন না, উহা হইতে বরং শত যোজন দূরে থাকিতেন চেষ্টা করিতেন প্রাণপণে।

এই সময় বুখারার শাসনকর্তা ছিলেন খালিদ ইবনে আহমদ আয-যাহলী। তিনি ইমাম বুখারী (র)-এর নিকট লোক মারফত নির্দেশ পাঠাইলেনঃ

******************************************************

আপনি আপনার সংকলিত হাদীস-গ্রন্হ ও ইতিহাস-গ্রন্হ লইয়া আমর নিকট আসুন, আমি আপনার নিকট হইতে উহার শ্রবণ করিতে চাহি।

ইমাম বুখারী (র) এই নির্দেশ মানিয়া লইতে সুস্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করিলেন এবং দূতকে বলিয়া পাঠাইলেনঃ

******************************************************

বাদশাহকে আমার এই কথা পৌঁছাইয়া দাও যে, আমি হাদীসকে অপমান করিতে ও উহাকে রাজা- বাদশাহদের দরবারে লাইয়া যাইতে পারিব না। তাঁহার এই জিনিসের প্রয়োজন হইলে তিনি যেন আমার নিকট মসিজিদে কিংবা আমর ঘরে উপস্থিত হন। আর আমর এই প্রস্তাব তাঁহার পছন্দ না হইলে কি করা যাইবে, তিনি তো বাদশাহ..........।

ইবনে হাজার আসকালানী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইহাই ইমাম বুখারী ও বাদশাহর মধ্যে দূরত্ব ও মনোমালিন্য সৃষ্টির কারণ হইয়া দাঁড়ায়।[********************]

কিন্তু ইমাম হাকেম এই মনোমালিন্যের অন্য কারণ উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ আবদুল্লাহ যে কারণে বুখারা শহর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যান, তাহা এই যে, বাদশাহ খালিদ ইবনে আহমদ তাঁহাকে বাদশাহর প্রাসাদে উপস্থিত হইয়া তাঁহার সন্তানাদিগকেক ইতিহাস ও হাদীস-গ্রন্হ পড়াইবার আদেশ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইমাম বুখারী এই আদেশ পালন করিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন এবং বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, এই কিতাব আমি বিশেষভাবে কিছু লোককে শুনাইব ও কিছু লোককে শুনাইব না, তাহা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না।[********************]

অতঃপর ইমাম বুখারী (র) সমরকন্দের নিকটে অবস্থিত খরতংক নামক শহরে চলিয়া যান এবং আল্লাহর নিকট দ্বীন-ইসলামের এই কঠিন বিপদ হইতে তাঁহাকে রক্ষা করার জন্য আকুল আবেদন করেন। এই সময় রাত্রিকালে নামাযান্তে তিনি যে দোয়া করিতেন, তাহাতে তিনি বলিতেনঃ

******************************************************

হে আল্লাহ! এই বিশাল পৃথিবী আমার প্রতি সংকীর্ণ হইয়ায গিয়াছে অতএব এখন তুমি আমাকে তোমার নিকট লইয়া যাও।[********************]

ইমাম বুখারী  এই খরতংক শহরে ২৫৬ হিজরী সনের ৩০শে রজব ৬২ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইমাম বুখারী (র) ইহজগত ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন; কিন্তু পশ্চাতে বিশ্ব-মুসলিমের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস হিসাবে কয়েকখানি অমূল্য ও বিরাট গ্রন্হ। তাঁহার মহামূল্য গ্রন্হাবলীর মধ্যে দুইখানি বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠ। একখানি ‘সহীহুল বুখারী’- হাদীস সংকলন এবং অপরখানি ‘তারীখুল কবীর’।[********************]

ইমাম মুসলিম (র)

ইমাম মুসলিম (র)-এর পূর্ণ নাম আবূল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশাইরী আন-নিশাপুরী। তিনি ২০৪ হিজরী সনে খুরাসান অন্তঃপাতী নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মুসলিম জাহানের সব কয়টি কেন্দ্রই গমন করেন। ইরাক, হিজায, সিরিয়া, মিসর প্রভৃতি শহরে উপস্থিত হইয়া তথায় অবস্থানকারী হাদীসের বড় বড় উস্তাদও মুহাদ্দিসদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন।

ইমাম বুখারী (র) যখন নিশাপুর উপস্থিত হন, তখন ইমাম মুসলিম (র) তাঁহার সঙ্গ ধারণ করেন। তাঁহার বিরাট হাদীস জ্ঞান হইতে তিনিও যথেষ্ট মাত্রায় অংশগ্রহন করেন। এই শহরে ইমাম বুখারী (র)-এর বিরুদ্ধে প্রবণ প্রচারণা চলিতে শুরু করিলে ইমাম মুসলিম ইহার প্রতিরোধ করিত চেষ্টিত হন। একদিন একটি ঘটনা ঘটিয়া যায়। তিনি তাঁহার হাদীসের উস্তাদ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া আযলীর মজলিসে অন্যান্য শিক্ষার্থীর সহিত উপস্থিত ছিলেন। মুহাদ্দিস যাহলী সহসা ঘোষণা করেনঃ

******************************************************

বিশেষ একটি মাসায়ালায় যে লোক ইমাম বুখারীর মত বিশ্বাস করে ও তাঁহার রায় কবুল করে, সে যেন আামার এই মজলিস হইতে উঠিয়া যায়।

ইহা শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে ইমাম মুসলিম উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া এই উস্তাদের নিকট হইতে শ্রুত ও গৃহীত হাদীসসমূহের লিখিত সম্পদ ফেরত পাঠাইয়া দিলেন। অতঃপর তিনি যাহলীর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেন।[********************]

ইমাম মুসলিম হাদীস সম্পর্কে বিরাট ও বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি যে হাদীসের ইমাম ছিলেন। এ বিষয়ে হাদীসজ্ঞ ব্যক্তিগণ সম্পূর্ণ একমত।[********************] সেকালের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্সা ও গ্রহণ করিয়াছেন। এই পর্যায়ে আবূ হাতিম আর-রাযী, মূসা ইবনে হারুন, আহমদ ইবনে সালমা, ইয়াহইয়া ইবনে সায়েদ, মুহাম্মদ ইবনে মাখলাদ এবং ইমাম তিরমিযী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহারা ইমাম মুসলিমের বিরাটত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে একমত। হাদীসে ইমাম মুসলিমের অতি উচ্চ মর্যাদা ও স্থানের কথা তাঁহারা সকলেই স্বীকার করিয়াছেন। উপরস্তু ইমাম মুসলিম (র)-এর মহামূল্য গ্রন্হাবলী ও তাঁহার গভীর পাণ্ডিত্যের কথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে। তন্মধ্যে তাঁহার সহীহ মুসলিম, আল-মুসনাদুল কবীর ও আল-জামেউল কবীর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম মুসলিম ২৬১ হিজরী সনে ৫৭ বৎসর বয়সে নিশাপুরে ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইমাম নাসায়ী (র)

 ইমাম নাসায়ী (র)-এর পূর্ণ নাম আবদুর রহমান আমদ ইবনে শুয়াইব ইবনে আলী ইবনে বাহর ইবনে মান্নান ইবনে দীনার আন-নাসায়ী। খুরাসান অন্তঃপাতী নাসা নামক শহরে ২১৫ হিজরী সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।[********************]

ইমাম নাসায়ী (র) হাদীসরে বড় হাফেজ ছিলেন। হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি পনের বৎসর বয়সেই বিদেশ সফরে গমন করেন। প্রথমে তিনি কুতাইবা ইবনে সায়ীদুল বালখীর নিকট উপস্থিত হন এবং এক বৎসর দই মাস কাল তথায় অবস্থান করিয়া তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। অতঃপর তিনি মিসর গমন করেন। মিসরে তিনি দীর্ঘকাল অবস্থান করেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি কয়েকখানি গ্রন্হ প্রণয়ন সমাপ্ত করেন। এই গ্রন্হসমূহ জনগনের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি লাভ করে। লোকেরা তাঁহার নিকট হইতে এই সময়ই হাদীস শ্রবণ করিতে শুরু করে।

মিসর হইতে বাহির হইয়া ৩০২ হিজরী সনে তিনি দামেশক উপস্থিত হন। এখানে তিনি হযরত আলী ও খান্দানের রাসুলের প্রশংসামূলক গ্রন্হ রচনা সমাপ্ত করেন। তিনি দেখিতে পাইয়াছিলেন যে, উমাইয়া বংশের শাসন-প্রভাবে জনগণ হযরত আলী (রা) ও রাসূল (স)-এর খান্দানের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করিতে শুরু করিয়াছেন। তিনি এই প্রবণতা দূরীভূতকরণ কিংবা উহার প্রচণ্ডতা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে দামেখকের জামে মসজিদে তিনি উহা পাঠ করিতে শুরু করিলে এক ব্যক্তি উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলঃ আপনি মুয়াবিয়ার প্রশংসাসূচক কিছু লিখিয়াছেন কি? ইমাম নাসায়ী বলিলেনঃ ‘মুয়াবিয়া সমান সমানে নিষ্কৃতি পাইলেই তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট। তাঁহার প্রশংসা করার কি আছে?

এই কথা বলা সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে হইতে আওয়াজ উঠিলঃ ‘এই লোক শিয়া, এই লোক শিয়া’। এই বলিয়া তাঁহাকে বেদম প্রহার করিতে থাকে। ইহাতে ইমাম নাসায়ী মারাত্মক আহত ও কাতর হইয়া পড়েন। তিনি বলিলেনঃ আমাকে তোমরা মক্কা শরীফ পৌঁছাইয়া দাও, যেন শেষ নিঃশ্বাস সেখানেই ত্যাগ করিতে পারি। তাঁহাকে মক্কায় পৌঁছানো হইলে তিনি তথায় হিঃ ৩০৩ সনে ৮৯ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে তাঁহাকে দাফন করা হয়।[********************]

ইমাম নাসায়ী হাদীস ও ইলমে হাদীস সম্পর্কিত বিষয়ে বহু মুল্যবান গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ‘সুনানে কুবরা’ ও ‘সুনানে সুগনা’- যাহাকে ‘আল মুজতাবা’ও বলা হয়- প্রভৃতি তাঁহার প্রসিদ্ধ গ্রন্হ।[********************]

ইমাম আবূ দাউদ (র)

ইমাম আবূ দাউদের পূর্ণ নাম সুলাইমান ইবনুল আশযাস ইবনে ইসহাক আল আসাদী আস-সিজিস্তানী। কান্দাহার ও চিশত-এর নিকটে সীস্তান নামক এক স্থানে তিনি ২০২ হিজরী সনে (৮১৯ খৃঃ) জন্মগ্রহণ করেন।[********************]

হাদীস শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে মিসর, সিরিয়া, হিজাজ, ইরাক ও খুরাসান প্রভৃতি প্রখ্যাত হাদীস-কেন্দ্রসমূহ পরিভ্রমন করেন এবং তদানীন্তন সুবিখ্যাত মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, উসমান ইবনে আবূ সাইবা, কুতাইবা ইবনে সায়ীদ প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণই হইতেছেন তাঁহার ইলমে হাদীসের উস্তাদ।[********************]

হাদীসে তাঁহার যে অসাধারণ জ্ঞান ও গভীর পারদর্শিতা ছিল, তাহা এ যুগের সকল মনীষীই উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন এবং তাঁহার তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির প্রশংসা করিয়াছেন। সেই সঙ্গে তাঁহার গভীর তাকওয়া ও পরহেজগারীর কথাও সর্বজনস্বীকৃতি লাভ করিয়াছেন।

ইমাম হাকেম বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ দাঊদ তাঁহার যুগে হাদীসবিদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁহার এই শ্রেষ্ঠত্ব ছিল নিরংকুশ ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি মিসর, হিজাজ, কূফা ও বসরা এবং খোরাসানে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন।[********************]

ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসায়ী হাদীসে তাঁহার ছাত্র। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল একদিকে ইমাম আবূ দাউদ (র)-এর উস্তাদ, অপর দিকে ইমাম আহমদ (র)-এর কোন কোন উস্তাদ ইমাম আবূ দাউদ হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম আহমদ নিজেও কোন কোন হাদীস ইমাম আবূ দাউদ হইতে গ্রহণ ও বর্ণনা করিয়াছেন।

তিনি ২৭৫ হিজরী সনের ১৬ই শাওয়াল বসরা নগের ইন্তেকাল করেন।

ইমাম তিরমিযী (র)

ইমা তিরমিযীর পূর্ণ নাম আল-ইমামুল হাফেজ আবূ ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সওরাতা ইবনে মুসা ইবনে জাহকুস সুলামী আত-তিরমিযী। তিতি জীহুল নদীর বেলাভুমে অবস্থিত তিরমিযী নামক প্রাচীন শহরে ২০৯ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাদীসে অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁহা বর্ণিত হাদীসসমূহ সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাস্য ও অকাট্য দলিল হিসাবে গণ্য। তিনি তাঁহার সময়কার বড় বড় হাদীসবিদদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও গ্রহণ করিয়াছেন। কুতাইবা ইবনে সায়ীদ, ইসহাক ইবনে মূসা, মাহমুদ ইবনে গালীন, সায়ীদ ইবনে আবদুর রহমান, মুহাম্মদ ইবন বিশ্বার, আলী ইবনে হাজার, আহমদ ইবনে মুনী, মুহাম্মদ ইবনুল মাসান্না, সুফিয়ান ইবন অকী এবং মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইলুল বুখারী প্রমুখ মুহাদ্দিস ইমাম তিরমিযীর উস্তাদ।[********************]

ইমাম বুখারী তাঁহার সম্পর্কে অনেক প্রশংসাসূচক কথা বলিয়াছেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁহাকে ইমাম বুখারীর খলীফা বলিয়া উল্লেক করিয়াছেন। ইমাম বুখারী নিজেও তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]

ইমাম তিরমিযী মুসলিম জাহানের প্রখ্যাত হাদীস-কেন্দ্রসমূহ সফর করিয়া হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছেন। কূফা, বসরা, রাই, খুরাসান, ইরাকও হিজাযে হাদীস সংগ্রহের জন্য তিনি বছরের পর বছর পরিভ্রমন করিত থাকেন।

ইমম তিরমিযী তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। একারব শুনিয়াই তিনি বহু সংখ্যক হাদীস মুখস্থ করিয়া লইতে সমর্থ হইতেন। জনৈক মুহাদ্দিসের বর্ণিত কয়েকটি হাদীসাংশ তিনি শ্রবণ করিয়াছিলেন; কিন্তু সেই মুহাদ্দিসের সহিত তাঁহার কোন দিন সাক্ষাৎ ছিল না, তাঁহার মুখেও তাহা শ্রবণ করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। ফলৈ তিনি মনে মনে সেই মুহাদ্দিসের সন্ধানে উদগ্রীব হইয়াছিলেন। একদিন পথিমধ্যে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইয়া তাঁহার নিকট হইতে সম্পূর্ণ হাদীস শ্রবণের বাসনা প্রকাশ করিলেন। তিনি তাঁহার অনুরোধক্রমে সমস্ত হাদীস পথের মধ্যে দাঁড়াইয়া থাকা অবস্থায়ই মুখস্থ পাঠ করিলেন, ইহা শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসসূহ ইমাম তিরমিযী এই হাদীসসমূহ ইতিপূর্ব কখনো শুনি তে পান নাই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই একবার মাত্র শ্রবণ করিয়া তাহা সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইলেন এবং তখনি একবার পাঠ করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান উস্তাদকে শুনাইয়া দিলেন। ইহাতে তাঁহার একটি শব্দেরও ভূল ছিল না।[********************]

ইমাম তিরমিযী বহু মূল্যবান গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। আল জামেউত তিরমিযী, কিতাবুল আসাম, আলকুনী, শামায়েলুত তিরমিযী, তাওয়ারীখ ও কিতাবুয যুহদ প্রভৃতি তাঁহার যুগান্তকারী গ্রন্হ।[********************]

শেষ জীবনে ইমাম তিরমিযীর দৃষ্টিশক্তি বিলুপ্ত হয়। তিরমিয শহরেই তিনি ২৭৯ হিজরী সনে সত্তর বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইমাম ইবনে মাজাহ (র)

ইমাম ইবনে মাজাহর পূর্ণ নাম আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়যিদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাজাহ আল কাজভীনী। হাদীস, তাফসীর ও ইতিহাস সম্পর্কে তিনি অতীব বড় আলিম ছিলেন।

তিনি ২০৯ হিজরী সনে (৮২৮ খৃঃ) ‘কাজভীন’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।[********************] এই শহর তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা)-এর সময় বিজিত হওয়ার পর হইতেই ইসলামী জ্ঞানে-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসাবে গণ্য। তৃতীয় হিজরী শতকের শুরু হইতেই ইহা ইলমে হাদীসের চর্চায় বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে; ফলে ইবনে মাজাহ বাল্যকাল হইতেই হাদীস শিক্ষার অপূর্ভ সুযোগ লাভ করেন। এই সময় কয়েকজন বড় বড় মুহাদ্দিস কাজভীন শহরে হাদীসের দারস দিতেন। তন্মধ্যে তিনি আলী ইবনে মুহাম্মদ আবুল হাসান তানাফেসী (মৃঃ ২৩৩ হিঃ), আমর ইবনে রাফে’ আবূ হাজার বিযলী (মৃঃ ২৩৮ হিঃ), ইসমাঈল ইবনে তওবা আবূ সাহল কাজভীনী (মৃঃ ২৪৭ হিঃ), হারুন ইবনে মূসা ইবনে হায়ান তামীমী (মৃঃ ২৮৮ হিঃ) এবং মুহাম্মদ ইবনে আবূ খালেদ আবূ বকর কাজভীনী প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করেন।

অতঃপর তিনি মদীনা, মক্কা, কূফা, বসরা, বাগদাদ, ওয়াসাত, দামেশক, হিমস, মিসর, তিন্নীস, ইসফাহান, নিশাপুর প্রভৃতি হাদীসের কেন্দ্র স্থানসমুহ সফর করিয়া হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। তাঁহার হাদীসের উস্তাদ অগণিত। তাঁহার নিকট হইতেও বিপুল সংখ্যক হাদীস-শিক্ষাথী হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন।

তিনি বহু গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। হাদীসের ভিত্তিতে কুরআন মজীদের একখানি বিরাট তাফসীর গ্রন্হও তিনি রচনা করেন। ‘তারিখে মলীহ’ তাঁহার অপর একখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ। ইহাতে সাহাবাদের যুগ হইতে গ্রন্হাকারের সময় পর্যন্ত বিস্তারিত ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। হাদীসে তাঁহার গ্রন্হ ‘আস সুনান’ সুবিখ্যাত ও সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভূক্ত এক বিরাট কিতাব। তিনি ২৭৩ হিজরী সনে (৮৮৬ খৃঃ০ সোমবার ৬৪ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

 

ছয়খানি বিশিষ্ট হাদীসগ্রন্হ

হিজরী তৃতীয় শতকের প্রথমার্ধে মুসলিম জাহানের দিকে দিকে বিক্ষিপ্ত ও বিভিন্ন স্থানে রক্ষিত হাদীসসমূহ যখন ‘মূসনাদ’ আকারে সংগৃহীত ও গ্রন্হাবদ্ধ হইল, তখন পরবর্তীকালের মুহাদ্দিসগণ হাদীস যাচাই, ছাঁটাই-বাছাই ও সংক্ষিপ্ত আকারে কেবলমাত্র বিশুদ্ধ হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়নের উদ্যোগী হইলেন। এই উদ্যোগের ফলেই এই শতকের মাঝামাঝি ও শেষার্ধে ছয়খানি সুবিখ্যাত সহীহ হাদীস গ্রন্হ জনসমক্ষে উপস্থাপতি হয়। এই ছয়খানি হাদীসগ্রন্হ সংকলনের ইতিহাস এবং প্রত্যেক খানি গ্রন্হের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য আমরা এখানে আলোচনা করিতে চাই।

সহীহুল বুখারী

এই ছয়খানি বিশুদ্ধতম হাদীস গ্রন্হের মধ্যে সর্ব প্রথম উল্লেখযোগ্য, সর্বাধিক খ্যাতিসম্পন্ন ও সর্বাপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধ হাদীসপূর্ণ গ্রন্হ হইতেছে ইমাম বুখারী সংকলিত ‘সহীহুল বুখারী’। ইমাম বুখারী এই গ্রন্হ প্রণয়নের প্রেরণা তাঁহার বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক ইবনে রাহওয়াইর মজলিস হইতে লাভ করিয়াছিলেন।[********************] তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি ইসহাক ইবনে রাহওয়াইর নিকট উপস্থিত ছিলাম। মজলিসে উপস্থিত তাঁহার লোকজনের মধ্য হইতে কেহ বলিলেনঃ কেহ যদি রাসূল (স) হইতে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস ও সুন্নাতসমূহের সমন্বয়ে এমন একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করিতেন, যাহা সংক্ষিপ্ত হইবে এবং বিশুদ্ধাতর দিক দিয়া চরম পর্যায়ে উন্নীত হইবে, তাহা হইলে খুবই উত্তম হইত এবং আমলকারীদের পক্ষেও শরীয়াত পালন করা সহজ হইত। সেইজন্য তাহাদিগকে মুজতাদিদের প্রতি মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হইত না।[********************]

এই কথা শ্রবণ করার সঙ্গে সঙ্গে ইমাম বুখারী (র) –এর মনে এইরূপ একখানি হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের বাসনা জাগ্রত হইল। উপরিউক্ত কথাটি যদিও ছিল এক সাধারণ পর্যায়ের, সম্বোধনও ছিল মজলিসে উপস্থিত সকল লোকদের প্রতি নির্বিশেষে; কিন্তু উহার বাস্তবায়ন সম্পর্কে ইচ্ছা জাগ্রত হইল এমন ব্যক্তির হৃদয়ে, বুখারী শরীফের ন্যায় এক অতুলনীয় হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নের মর্যাদা লাভ আল্লাহ তা’আলা যাহার ভাগ্যলিপি করিয়া দিয়াছিলেন।

ইমাম বুখারী (র) বলেনঃ

******************************************************

এই কথাটি আমার হৃদয়পটে মুদ্রিত হইয়া গেল এবং অনুতিবিলম্বে আমি এই কিতাব প্রণয়নের কাজ শুরু করিয়া দিলাম।[********************]

বুখারী গ্রন্হ প্রণয়নে উদ্যেগী হওয়ার মূল ইমাম বুখারী হইতে অন্য একটি কারণেরও উল্লেখ করা হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-কে স্বপ্নে দেখিলাম। দেখিলাম আমি যেন তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান, আমার হাতে একটি পাখা যাহার দ্বারা আমি রাসূল (স)-এর প্রতি বাতাস করিতেছি ও মাছির আক্রমণ প্রতিরোধ করিতেছি। অতঃপর স্বপ্নের ব্যাখ্যাদানকারী কাহারো নিকট ইহার ব্যাখ্যা জানিতে চাহিলাম। ব্যাখ্যাদানকারী বলিলেন যে, তুমি রাসূলের প্রতি আরোপিত সমস্ত মিথ্যার প্রতিরোধ করিবে। বস্তুত এই স্বপ্ন ও ইহার এই ব্যাখ্যাদানকারী কাহারো নিকট ইহার ব্যাখ্যা জানিতে চাহিলাম। ব্যাখ্যাদানকারী বলিলেন যে, তুমি রাসূলের প্রতি আরোপিত সমস্ত মিথ্যার প্রতিরোধ করিবে। বস্তুত এই স্বপ্ন ও ইহার এই ব্যাখ্যাই আমাকে এই সহীহ হাদীস সম্বলিত বিরাট গ্রন্হ প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করেন।[********************]

গ্রন্হ প্রণয়নে উদ্বদ্ধ হওয়ার মূলে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনায় দুই প্রকারে কারণের উল্লেখ হইলেও এই কারদ্বয়ের মধ্যে কোন মৌলিক বিরোধ নাই। ইহা খুবই সম্ভব যে, ইমাম বুখারী ইসহাক ইবন রাহওয়াইর মজলিস হইতে হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ণের প্রেরণা ও বাসনা লইয়া চলিয়া আসার পর তিনি উহারই অনুকূল ও উহারই সমর্থনে এই শুব স্বপ্নটিও দেখিয়াছিলেন। এই স্বপ্নও এই কথাই তাঁহাকে জানাইয়া দিল যে, তিনি যে, বিশুদ্ধ হাদীসের সমন্বয়ে একখানি গ্রন্হ প্রণয়নের সংকল্প করিয়াছেন, তাহা রাসূলের দরবারেও মঞ্জুরীপ্রাপ্ত হইয়াছে এবং তাঁহার এই কাজ প্রকৃতপক্ষে রাসূলে করীম (স)-কে উহার তীব্র শরাঘত হইতে প্রতিরক্ষার কাজ হইবে।

ইতিপূর্বে বিভিন্ন অধ্যায় ও পর্যায়ে হাদীসের যেসব বিরাট বিরাট গ্রন্হ প্রণয়ন করা হইয়াছে, ইমাম বুখারী এই অভিনব গ্রন্হ প্রণয়নের ব্যাপারে সেইসব গ্রন্হ হইতে যথেষ্ট ফায়দা গ্রহণ করিয়াছেন এবং তাঁহার নিজের সংগৃহীত হাদীসসমূহ হইতে তাঁহার স্থাপিত কঠিন শর্তের মানদণ্ডে ওজন করিয়া হাদীসের এক বিরাট ও অমুল্য গ্রন্হ প্রণয়ন করিলেন।[********************]

পূর্ববর্তী হাদীস গ্রন্হসমূহে সহীহ, হাসান ও যয়ীফ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার গুণের হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছিল। একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে উহা হইতে কেবলমাত্র সহীহ হাদীস বাছাই করিয়া লওয়া বড়ই কঠিন ব্যাপার ছিল; বং ইহা সম্ভব হইত কেবলমাত্র বিশিষ্ট পারদর্শী ও হাদীস-শাস্ত্রজ্ঞানে ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের পক্ষে। অনুরূপভাবে বিশেষ একটি বিষয়ে শরীয়াতের বিশেষ নির্দেশ সম্পর্কে সমস্ত হাদীস একত্র করা বড় দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। কেননা পূর্ববর্তী গ্রন্হাবলীর উদ্দেশ্যেই ছিল শুধুমাত্র রাসূলে করীম (স)-এর হাদীসসমূহ সংগ্রহ করা ও ধ্বংসের করাল গ্রাস হইতে তাহা রক্ষা করা। কাজেই তাহাতে একই বিষয়ের হাদীস একস্থানে সাজাইয়া দেওয়ার কাজ বড় একটা হয় নাই। ফলে উহা পাঠ করিয়া শরীয়াত সম্পর্কে রাসূলের বিস্তারিত কথা জানিবার কোন উপায় ছিল না। এই সমস্ত কারণই একত্র হইয়া ইমাম বুখারীকে নূতন প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে হাদীসের এক নবতর সকংলন প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল।[********************]

ইমাম বুখারী এই হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ণের কাজ শুরু করেন ‘বায়তুল হারাম’- আল্লাহর ঘরের অভ্যন্তরে বসিয়া। পরে উহার বিভিন্ন অধ্যায় ও ‘তারজুমাতুল বার’ সংযোজনের কাজ সম্পন্ন করেন মদীনায় মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে মিম্বর ও রাসূলের রওযা মুবারকের মধ্যবর্তী স্থানে বসিয়া।[********************]

হাদীসসমূহ লিখিবার সময় ইমাম বুখারী (র) এক অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর পদ্ধতি অবলম্বন করিয়াছেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই সহীহ গ্রন্হে এক একটি হাদীস লিখিবার পূর্বে গোসল করিয়াছি ও দুই রাক’আত নফল নামায পড়িয়া লইয়াছি- ইহা ব্যতীত আমি একটি হাদীসও লিখি নাই।[********************]

প্রত্যেকটি হাদীস লিখিবার পূর্বে গোসল করা ও দুই রাক’আত নফল নামায পড়ার পদ্ধতি মক্কা ও মদীনা উভয় স্থানেই তিনি রক্ষা করিয়াছিলেন। এক একটি হাদীস লিখিবার পূর্বে তিনি সে সম্পর্কে সর্বতোভাবে সতর্কতাত অবলম্বন করিয়াছেন। হাদীসটি প্রকৃত রাসূলের হাদীস কি না এই সম্পর্কে দৃঢ়নিশ্চত না হইয়া তিনি একটি হাদীসও ইহাতে উদ্ধৃত করেন নাই। তিনি নিজেই এই সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি প্রত্যেকটি হাদীস সম্পর্কে আল্লাহর নিকট হইতে ইস্তেখারার মারফত না জানিয়া লইয়া, নফল নামায না পড়িয়া ও উহার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে দৃঢ়নিশ্চিত ও অকাট্যভাবে বিশ্বাসী না হইয়া উহাতে আমি একটি হাদীসও সংযোজিত করি নাই।[********************]

বস্তুত ইমাম বুখারীর এই হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন পরিক্রমা যে কত কঠিন ও কঠোর সাধনার ব্যাপার ছিল, তাহা উপরিউক্ত সমূহ হইতে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হইতেছে। একট চিন্তা করিলেই ইহার অন্তর্নিহিত বিরাট সত্য উপলদ্ধি করা যায়। এইরূপ অনন্যসাধারণ পরিশ্রম ও অক্নান্ত সাধনা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলিতে থাকে দীর্ঘ ষোলটি বৎসর পর্যন্ত। এ বিষয়ে ইমাম বুখারীর নিজের উক্তি হইলঃ

******************************************************

আমি এই গ্রন্হ প্রণয়ন কাজটি পূর্ণ ষোল বৎসরে সম্পূর্ণ করিয়াছি।[********************]

ইমাম বুখারী (র) বুখারী শরীফ প্রণয়নের কাজ শুরু করেন  মোট ছয় লক্ষ হাদীস সম্মুখে রাখিয়া। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

প্রায় ছয় লক্ষ হাদীস হইতে আমি এই বুখারী গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করি।[********************]

এই ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্যে ইমাম বুখারীর নিজের সম্পূর্ণ মুখস্ত ছিল এক লক্ষ সহীহ হাদীস। ইমাম বুখারী (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এক লক্ষ হাদীস মুখস্থ বলিতে পারিতাম।[********************]

বলা বাহুল্য ইহ সমগ্র সহীহ হাদীসের মোট সংখ্যা নহে এবং ইমাম বুখারী কেবল এই এক লক্ষ হাদীসই মাত্র মুখস্থ ছিল না, ইহা অপেক্ষা আরো অনেক হাদীসও তাঁহার মুখস্থ ছিল। তবে তাঁহার মুখস্থ হাদীসসমূহের মধ্যে কেবলমাত্র সহীহ হাদীসের সংখ্যাই হইতেছে এক লক্ষ। প্রায় দুই লক্ষ গায়ের সহীহ হাদীসও তাঁহার মুখস্থ ছিল।[********************]

ইমাম বুখারীর নিকট এই হাদীস প্রণয়নের সময়ে কতকগুলি হাদীস সঞ্চিত ছিল এবং সমস্ত সহীহ হাদীসই তিনি বুখারী গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়াছেন কিনা, এই সম্পর্কে তাঁহার নিম্নোক্ত কথা হইতে সুস্পষ্ট ধারণা করা যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি আমার এই হাদীস গ্রন্হে কেবল সহীহ ও বিশুদ্ধ হাদীসই সংযোজিত করিয়াছি। এতদ্ব্যতীত আরো বহু সহীহ হাদীস আমি ছাড়িয়া দিয়াছি। গ্রন্হের আকার দীর্ঘ ও বিরাট হওয়ার আশঙ্কায় তাহা এই গ্রন্হে শামিল করি নাই।[********************]

এই সম্পর্কে ইমাম বুখারীর আর একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই গ্রন্হে কেবলমাত্র সহীহ হাদীস সংযোজিত করিয়াছি। আর আমি যাহা রাখিয়া দিয়াছি, তাহার সংখ্যা সংযোজিত হাদীসের তুলনায় অনেক বেশী। আর ইহা করিয়াছি গ্রন্হের বৃহদায়তন হইয়া যাওয়ার আশঙ্কায় মাত্র।[********************]

এইভাবে ইমাম বুখারী যে গ্রন্হখানি সুসংবদ্ধ করিয়া বিশ্ববাসীর সম্মুখে উপস্থাপিত করিলেন, উহার নামকরণ হইয়াছেঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স)-এর যাবতীয় ব্যাপার- কাজকর্ম, সুন্নাত ও সমকালীন অবস্থা সম্পর্কে নির্ভূল সনদযুক্ত হাদীসসমুহের সংক্ষিপ্ত পূর্ণাঙ্গ সংকলন।[********************]

ইমাম এই গ্রন্হখানিকে আমার ও আল্লাহার মধ্যবর্তী ব্যাপারের জন্য একটি অকাট্য দলিলরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।[********************]

ইমাম বুখারী (র)-এর এই উক্তি যে কত সত্য এবং হাদীসের এই গ্রন্হ যে দ্বীন-ইসলামের এক অক্ষয় স্তম্ভ, বুখারী শরীফ পাঠ করিয়াছেন এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই তাহা অনুধাবন করিতে পারেন।

বুখারী শরীফে একাধিকবার উদ্ধৃত হাদীসসমূহ সর্বমোট হাদীস হইতেছে নয় হাজার বিরাশী (৯০৮২)-টি। উহার মুয়াল্লিক মুতাবি’আত বাদ দিলে হাদীসের সংখ্যা দাঁড়ায় সাত হাজার তিনশথ সাতানব্বই (৭৩৯৭)-টি। আর একাধিকবার উল্লেখিত হাদীস বাদ দিয়া হিসাব করিলে মোট হাদীস হয় দুই হাজার ছয়শত দুই (২৬০২)-টি। অপর এক হিসাব মতে, এই পর্যায়ে হাদীসের সংখ্যা হয় দুই হাজার সাতশত একষট্টি (২৭৬১)-টি।[********************]

কিন্তু আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (র) বুখারী শরীফের হাদীস সংখ্যা সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

বুখারী শরীফে সন্নিবেশিত সনদযুক্ত মোট হাদীস হইতেছে সাত হাজার দুইশত পঁচাত্তত (৭২৭৫)-টি। ইহাতে পুনরুল্লিখিত হাদীসসমূহ গণ্য। আর উহা বাদ দিয়া হিসাব করিলে হয় প্রায় চার হাজার হাদীস।[********************]

সংখ্যা গণনায় এই পার্থক্যের মূলে একটি প্রধান কারণ রহিয়াছেনঃ ইমাম বুখারীর এই মহামূল্য গ্রন্হের প্রণয়নকার্য যদিও ষোল বৎসরের মধ্যে সমাপ্ত হইয়াছিল, তথাপি ইহাতে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন, পরিবর্জনের কাজ ইহার পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত চলিতে থাকে। এই কারণে ইমাম বুখারীর নিকট হইতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছাত্র ইহা শ্রবণ করিয়াছেন বলিয়া তাঁহাদের নিকট রক্ষিত গ্রন্হের হাদীসের সংখ্যায় পার্থক্য সূচিত হইয়াছে। প্রথম পর্যায়ে ছাত্রদের নিকট সেই হাদীসসমূহই লিখিত রহিয়াছে, যাহা তখন পর্যন্ত  ইহাতে সংযোজিত হইয়াছিল। পরে উহাতে পরিবর্তন করা হইয়াছে, গ্রন্তকার প্রাথমিক সংকলন হইতে কোন কোন হাদীস বাদ দিয়া অনেক নূতন হাদীস ইহাতে শামিল করিয়াছেন। ফলে এই পর্যায়ে যাঁহারা উহা শ্রবণ করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট পূর্বের তুলনায় বেশী সংখ্যক ও নবসংযোজিত হাদীসও পৌছিঁয়াছে।[********************]

কথাটি নিম্নোক্ত আলোচনায় আরো সুস্পষ্টরূপে পরিস্ফূট হইবে। ইমাম বুখারীর নিকট হইতে তাঁহার এই হাদীসগ্রন্হ শ্রবণ করিয়াছেন শত সহস্র লোক। কিন্তু ইমাম বুখারীর যে কয়জন ছাত্রের সূত্রে ইহার বর্ণনার মূল ধারা চলিয়াছে, তাঁহারা হইতেছেন প্রধানতঃ চারজন।

১.         ইবরাহীম ইবনে মা’কাল ইবনুল হাজ্জাজ আন-নাসাফী (মৃঃ ২৯৪ হিঃ)

২.‌         হাম্মাদ ইবনে শাকের আন-নাসাফী (মৃঃ ৩১১ হিঃ)

৩.         মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ আল-ফারবারী (মৃঃ ৩২০)

৪.         আবূ তালহা মনসূর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে কারীমা আল বজদুভী (মৃঃ ৩২৯ হিঃ)

ফারবারী সহীহুল বুখারী গ্রন্হ ইমাম বুখারীর নিকট হইতে দুইবার শ্রবণ করিয়াছেন। একবার ফারবার নামক স্থানে ২৪৮ হিজরী সনে; যখন ইমাম বুখারী এখানে আগমন করিয়াছিলেন। আর দ্বিতীয়বার ২৫২ হিজরী সনে তিনি নিজে বুখারায় উপস্থিত হইয়া।[********************]

হাম্মাদ ইবনে শাকের বুখারী শরীফের যে সংস্করণ বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা ফারবারী বর্ণিত সংস্করণে দুইশত হাদীস অধিক রহিয়াছে। আর ইবরাহীম ইবনে মা’কাল বর্ণিত সংস্করণ অপেক্ষা উহাতে তিনশত হাদীস বেশি। ইহা হইতে সুস্পষ্টরূপৈ প্রমাণিত হয় যে, বুখারী গ্রন্হে ইমাম বুখারী ক্রমশ হাদীসের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছেন এবং প্রথম পর্যায়ের ছাত্রদের নিকট হইতে বর্ণিত সংস্করণে পরবর্তীকালের ছাত্রদের বর্ণিত সংস্করণের তুলনায় কম হাদীস ছিল।[********************]

ইমাম বুখারী তাঁহার গ্রন্হ প্রণয়ন সমাপ্ত করার পর উহা তদানীন্তন অপরাপর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসের সম্মুখে পেশ করেন। তাঁহাদের মধ্যে প্রধান হইতেছেন আলী ইবনে মাদানী, আহম্মদ ইবনে হাম্বল ও ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (র)। তাঁহারা প্রত্যেকেই গ্রন্হখানি দেখিয়া

******************************************************

ইহাকে খুবই পছন্দ করিলেন, অতি উত্তম গ্রন্হ বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং উহা একখানি বিশুদ্ধ গ্রন্হ বলিয়া স্পষ্ট ভাষায় সাক্ষ্য দিলেন।[********************]

বুখারী শরীফের শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য ঘোষণা করিয়া প্রত্যেক যুগের আলিম ও মুহাদ্দিসগণ অনেক উক্তি করিয়াছেন। মওলানা আহমদ আলী উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীসের সমস্ত আলিম এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত যে, গ্রন্হবদ্ধ হাদীসের কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বাধিক সহীহ হইতেছে বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হ। আর অধিকাংশের মতে এই দুইখানির মধ্যে অধিক সহীহ এবং জনগনকে অধিক ফায়দা দানকারী হইতেছে বুখারী শরীফ।[********************]

এই পর্যায়ে নিম্নোদ্ধৃত উক্তিটিও সর্বজনপ্রিয় ও সকলের মুখে ধ্বনিতঃ

******************************************************

আল্লাহর কিতাবের পর আসমানের নীচে সর্বাধিক সহীহ গ্রন্হ হইতেছে সহীহুল বুখারী।[********************]

ইমাম নাসায়ী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীসের এই সমস্ত কিতাবের মধ্যে বুখারী গ্রন্হ অপেক্ষা অধিক উত্তম আর কোন গ্রন্হ নাই।[********************]

মুসলিম জাতি এই গ্রন্হখানির প্রতি অপূর্ব ও অতুলনীয় গুরুত্ব দান করিয়াছেন। মুসলিম মনীষিগণ ইহার অসংখ্য ও বিরাট শরাহ  গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। কাশফুজ্জুনূন প্রণেতা বলিয়াছেন, ইহার শরাহ গ্রন্হের সংখ্যা বিরাশিখানি। তন্মধ্যে ফতহুল বারী, কস্তালানী ও উমদাতুলকারীই উত্তম।[********************]

সহীহ মুসলিম শরীফ

ইমাম মুসলিমের সহীহ হাদীসগ্রন্হ হইতেছে ‘সহীহ মুসলিম’। ইমাম মুসলিম সরাসরি উস্তাদদের নিকট হইতে শ্রুত তিনলক্ষ হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই  ও চয়ন করিয়া এই গ্রন্হখানি প্রণয়ন করিয়াছেন।[********************]

হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন সমাপ্ত হইলে পর তিনি ইহা তদানীন্তন প্রখ্যত হাফেজে হাদীস ইমাম আবূ যুরয়ার সম্মুখে উপস্থাপিত করেন। ইমাম মুসলিম নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই গ্রন্হখানি ইমা আবূ যুরয়া রাযীর নিকট পেশ করিয়াছি। তিনি যে যে হাদীসের সনদে দোষ আছে বলিয়া ইঙ্গিত করিয়াছেন, আমি তাহা পরিত্যাগ করিয়াছি (গ্রন্হ হইতে খারিজ করিয়া দিয়াছি), আর যে যে  হাদীস সম্পর্কে তিনি মত দিয়াছেন যে, উহা সহীহ এবং উহাতে কোন প্রকার ক্রটি নাই, আমি তাহাই এই গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়াছি।[********************]

ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম মুসলিম কেবলমাত্র নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেচনার উপর নির্ভর করিয়াই কোন হাদীসকে সহীহ মনে করিয়া তাঁহার এই গ্রন্হে শামিল করেন নাই বরং প্রত্যেকটি হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সমসাময়িক অন্যান্য মুহাদ্দিসের নিকটও পরামর্শ চাহিয়াছেন এবং সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণ যে হাদীসের শুদ্ধতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত হইয়াছেন, কেবল তাহাই তিনি তাঁহার এই অমূল্য গ্রন্হে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। এই সম্পর্কে তাঁহার নিজের উক্তিই অধিকতর প্রামাণ্য হইবে। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কেবল আমার বিবেচনায় সহীহ হাদীসসমূহই আমি কিতাবে শামিল করি নাই। বরং এই কিতাব কেবল সেইসব হাদীসই সন্নিবেশিত করিয়াছি, যাহার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ একমত।[********************]

এইভাবে দীর্ঘ পনেরো বৎসর অবিশ্রান্ত সাধনা, গবেষনা ও যাচাই-ছাঁটাই পরিচালনার পর সহীহ হাদীসসমূহের এক সুসংবদ্ধ সংকলন তৈয়ার করা হয়।[********************]

এই গ্রন্হে সর্বমোট বারো হাজার  হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে। একাধিকবার উদ্ধৃত হাদীসও ইহার অন্তর্ভূক্ত। আর তাহা বাদ দিয়া হিসাব করিলে মোট হাদীস হয় প্রায় চার হাজার।[********************]

এই হাদীস গ্রন্হে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম মুসলিম (র) নিজেই দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মুহাদ্দিসগণ দুইশত বৎসর পর্যন্তও যদি হাদীস লিখিতে থাকেন, তবুও তাহাদিগকে অবশ্যই এই সনদযুক্ত বিশুদ্ধ গ্রন্হের উপর নির্ভর করিতে হইবে।[********************]

ইমাম মুসলিমের এই দাবি মিথ্যা নয়, উহা এক বাস্তব সত্যরূপেই পরবর্তীকালের মুহাদ্দিসদের নিকট প্রতিভাত হইয়া উঠিয়াছে। আজ প্রায় এগারো শত বৎসরেরও অধিক অতিক্রান্ত হইয়াছে, কিন্তু সহীহ মুসলিমের সমান মানের কিংবা উহা হইতেও উন্নত মর্যাদার কোন গ্রন্হ প্রণয়ন করা সম্ভব হয় নাই। আজিও উহার সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতা অম্লান হইয়া বিশ্বমানবকে বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন জ্ঞানের আলো দান করিতেছে। হাফেজ মুসলিম ইবনে কুরতবী সহীহ মুসলিম শরীফ সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইসলামে এইরূপ আর একখানি গ্রন্হ কেহই প্রণয়ন করিতে পারে নাই।[********************]

শুধু তাহাই নয়, পরবর্তীকালের কয়েকজন যুগ-শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসের মতে বুখারী শরীফের তুলনায় মুসলিম শরীফ অধিক বিশুদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ।

কাযী ইয়ায একজন বড় মুহাদ্দিস। তিনি বলিয়াছেন যে, তাহার কয়েকজন হাদীসের উস্তাদ-যাঁহারা একজন অতি বড় মুহাদ্দিস, বুখারী অপেক্ষ মুসলিম শরীফকেই অগ্রাধিকার দিতেন।[********************]

হাফেজ ইবনে মানদাহ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি আবূ আলী নিশাপুরীকে- যাঁহার মত হাদীসের বড় হাফেজ আর একজনও দেখি নাই- এই কথা বলিতে শুনিয়াছি যে, আকাশের তলে ইমাম মুসলিমের হাদীস-গ্রন্হ অপেক্ষা বিশুদ্ধতর কিতাব একখানিও দেখি নাই।[********************]

এই উদ্ধৃতি হইতে এই কথাও প্রমাণিত হয় যে, হাফেজ ইবনে মানদাহর এই মত। আর আবূ আলী কি রকমের মুহাদ্দিস ছিলেন তাহা মুসতাদরাক গ্রন্হ প্রণেতা হাকেম নিশাপুরীর প্রদত্ত পরিচিত হইতে স্পষ্ট ধারণা জন্মে। তিনি আবূ আলীর পরিচয় দান প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস গ্রন্হ মুখস্থ করা, বিষয়বস্তুর উপর দক্ষতাপূর্ণ সতর্কতা, হাদীস পর্যালোচনা ও হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়নে তিনি যুগের একক ও অবিসংবাদী ছিলেন।[********************]

ইমাম মুসলিমের সংকলিত এই হাদীস গ্রন্হখানি তাঁহার নিকট হইতে বহু ছাত্রই শ্রবণ করিয়াছেন এবং তাঁহার সূত্রে ইহা বর্ণনাও করিয়াছেন। কিন্তু ঠিক যাহার সূত্রে এই গ্রন্হখানি বর্ণনা ধারা সর্বত্র- বিশেষভাবে এতদুদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক যুগ পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে, তিনি হইতেছেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আবূ ইসহাক ইবারহীম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সুফিয়ান নিশাপুরী। তিনি ৩০৮ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।

এই সম্পর্কে ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অবিচ্ছিন্ন সনদসূত্রে ইমাম মুসলিম হইতে এই গ্রন্হের বর্ণনা পরম্পরা এতদুদ্দেশ্যে ও সাম্প্রতিককালে কেবলমাত্র আবূ ইসহাক ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সুফিয়ানের বর্ণনার উপরই নির্ভরশীল।[********************] এই ইবরাহীম ইবনে সুফিয়ানের সহিত ইমাম মুসলিমের এক বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছিল। তিনি সব সময়ই ইমাম মুসলিমের সাহচর্যে থাকিতেন ও তাঁহার নিকট হাদীস অধ্যয়ন করিতেন।

ইমাম মুসলিমের আর একজন ছাত্র আবূ মুহাম্মদ আহমদ ইবন আলী কালানসী। তাঁহার সূত্রেও সহীহ মুসলিম বর্ণিত হইয়াছে; এই সূত্রে বর্ণনা পরম্পরা যেমন সম্পূর্ণ নহে, তেমনি তাহা বেশি দিন চলিতেও পারে নাই।

সুনানে নাসায়ী

ইমাম নাসায়ী প্রথমে ‘সুনানুল কুবরা’ নামে একখানি হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। তাহাতে সহীহ ও দোষমুক্ত উভয় প্রকারের হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছিল। অতঃপর উহারই এক সংক্ষিপ্ত সংস্করণ তৈরী করেন। উহার নাম ‘আসসুনানুস সুগরা’। ইহার অপর এক নাম হইতেছে ‘আল-মুজতবা’- সঞ্চয়িতা’।

এই শেষোক্ত সঞ্চয়নে ইমাম নাসায়ী ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের গ্রন্হ প্রণয়ন রীতির অনুসরণ করিয়াছেন। এই উভয়েল প্রবর্তিত রীতির সমন্বয় ঘটিয়াছে ইমাম নাসায়ীর এই গ্রন্হে। হাফেজ আবূ আবদুল্লাহ ইবনে রুশাইদ (মৃঃ ৭২১ হিঃ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুনানে পর্যায়ে হাদীসের যত গ্রন্হই প্রণয়ন করা হইয়াছে, তন্মধ্যে এই গ্রন্হখানি অতি আনকোরা রীতিতে প্রণয়ন করা হইয়াছে। আর সংযোজন ও সজ্জায়নের দৃষ্টিতেও উহা এক উত্তম গ্রন্হ। উহাতে বুখারী ও মুসলিম উভয়েরই রচনারীতির সমন্বয় হইয়াছে। হাদীসের ‘ইল্লাহ’ ও ইহাতে এক বিশেষ অংশে উদ্ধৃত হইয়াছে।[********************]

এই গ্রন্হখানির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম নাসায়ী নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘হাদীসের সঞ্চয়ন’–মুজতাবা নামের গ্রন্হখানিতে উদ্ধৃত সমস্ত হাদীসই বিশুদ্ধ।[******************** অবশ্য হাফেজ যাহবী এই সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষন করেন। তিনি বলিয়াছেনঃ এই ‘আল-মুজতবা’ ইমাম নাসায়ীর কৃত নহে বরং তাঁহার ছাত্র ইবনে সামালী কৃত ********************]

বস্তুত ইমাম নাসায়ীর বর্ণিত হাদীসসমূহ সম্পর্কে প্রায় সকল শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসেরই মত এই যে, অন্যান্যের বর্ণিত হাদীসের তুলনায় শুদ্ধতার দিক দিয়া উহা অধিকতর নির্ভরযোগ্য হইবে।

হাফেজ ইমাম আবুল হাসান মুযাফেরী (মৃঃ ৪০৩ হিঃ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মুহাদ্দিসগণের বর্ণিত হাদীসসমূহ সম্পর্কে তুমি যখনি বিচার-বিবেচনা করিবে তখন একথা বুঝিতে পারিবে যে, ইমাম নাসায়ীর বর্ণিত হাদীস অপরে বর্ণিত হাদীসের তুলনায় শুদ্ধতার অধিক নিকটবর্তী হইবে।[********************]

ইমাম নাসায়ীর নিকট হইতে তাঁহার এই গ্রন্হ যদিও বহু ছাত্রই শ্রবণ করিয়াছেন, কিন্তু দশজন বড় মুহাদ্দিস এই গ্রন্হের ধারাবাহিক বর্ণনা করিয়াছেন।

ইমাম নাসায়ীর নিকট হইতে তাঁহার এই গ্রন্হ যদিও বহু ছাত্রই শ্রবণ করিয়াছেন, কিন্তু দশজন বড় বড় মুহাদ্দিস এই গ্রন্হের ধারাবাহিক বর্ণনা করিয়াছেন।

ইমাম নাসায়ীর এই গ্রন্হখানির শরাহ লিখিয়াছেন জালালুদ্দীন সুয়ূতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) ও মুহাম্মদ ইবনে আবদুল হাদীস আসসমদী (মৃঃ ১১৩৮ হিঃ)। সুয়ূতী লিখিত শরাহ গ্রন্হের নাম- ********************

সুনানে আবূ দাউদ

ইমাম আবূ দাউদ পাঁচ লক্ষ হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই ও চয়ন করিয়া তাঁহার এই গ্রন্হ সংকলন করেন। ইহাতে মোট চার হাজার আটশত হাদীস স্থান পাইয়াছে। এই হাদীসসমূহ সবই আহকাম সম্পর্কিত এবং উহার অধিকাংশই ‘মশহূর’ পর্যায়ের হাদীস।[********************] এই সম্পর্কে তাঁহার নিজের উক্তি এইঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-এর পাঁচ লক্ষ হাদীস লিপিবদ্দ করিয়াছিলাম। তন্মধ্য হইতে ছাঁটাই-বাছাই কারিয়া মনোনীত হাদীস এই গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়াছি।[********************]

মনে রাখা আবশ্যক যে, ইমাম আবূ দাউদ ফিকাহর দৃষ্টিভঙ্গিতে হাদীসসমূহ চয়ন করিয়াছেন। তিনি ইমা বুখারীর পরে অন্যান্য সিহাহ-সিত্তা প্রণেতাদের তুলনায় ফিকাহ সম্পর্কে অধিক ব্যাপক ও উজ্জ্বল দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। এই কারণে তাঁহার এই কিতাবখানি মূলত হাদীস সংকলন হইলেও কার্যত ফিকাহ শাস্ত্রের রীতিতে সজ্জিত হইয়াছে; ফিকাহর সমস্ত বিষয়ই ইহাতে আলোচিত হইয়াছে এবং সমসাময়িক ও পরবর্তি যুগের সকল ফিকাহবিদই তাঁহার সংকলিত হাদীস হইতে দলীল ও প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছেন। এই কারণেই ফিকাহবিগণ মনে করেনঃ

******************************************************

একজন মুজতাহিদের পক্ষে ফিকাহর মাসয়ালা বাহির করার জন্য আল্লাহর কিতাব কুরআন মজীদের পরে এই সুনানে আবূ দাউদ গ্রন্হই যথেষ্ট।[********************]

ফিকাহর দৃষ্টিতেই তিনি উহার অধ্যায় নির্ধারণ করিয়াছেন এবং তাহাতে এমন কথার উল্লেখ করিয়াছেন, যাহা উহার নিম্নে উদ্ধৃত হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় এবং কোন না কোন ফকীহ সেই হাদীস হইতে উক্তরূপ মত গ্রহণ করিয়াছেন। ফলে ফিকাহবিদদের নিকট এই কিতাবখানি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে।[********************]

এই বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই ইমাম হাফেজ আবূ জাফর ইবনে যুবাইর গরনাতী (মৃঃ ৭০৮ হিঃ) সিহাহ-সিত্তার সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে সুনানে আবূ দাউদ সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ফিকাহ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ সামগ্রিক ও নিরংকুশভাবে সংকলিত হওয়ার কারণে সুনানে আবূ দাউদের যে বিশেষত্ব, তাহা সিহাহ-সিত্তার অপর কোন গ্রন্হেরই নাই।[********************]

সুনানে আবূ দাঊদের ব্যবহারিক গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে ইমাম গাযযালী ও স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন যে, ‘হাদীসের মধ্যে এই একখানি গ্রন্হই মুজতাহিদের জন্য যথেষ্ট’।[********************]

মুহাদ্দিস যাকারিয়া সাজী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইসলামের মূল হইতেছে আল্লাহর কিতাব, আর ইসলামের ফরমান হইতেছে সুনানে আবূ দাউদ।[********************]

ইমাম আবূ দাউদ তাঁহার এই গ্রন্হখানির সংকলনকার্য যৌবন বয়সে সমাপ্ত করিয়া লইয়াছিলেন। এই সময় হাদীসের জ্ঞানে তাঁহার যে কি দক্ষতা অর্জিত হইয়াছিল, তাহা ইবরাহীম আল- হারবীর নিম্নোদ্ধৃত উক্তি হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবু দাউদ যখন তাঁহার এই গ্রন্হখানি সংকলন করেন তখন তাঁহার জন্য হাদীসকে নরম ও সহজ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, ঠিক যেমন নরম করিয়া দেওয়া হইয়াছিল হযরত দাউদ নবীর জন্য লৌহকে।[********************]

গ্রন্হ সংকলন সমাপ্ত করার পর তিনি উহাকে তাঁহার হাদীসের উস্তাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের সম্মুখে উপস্থাপিত করেন। ইমাম আহমদ উহাকে খুবই পছন্দ করেন ও উহা একখানি উত্তম হাদীস গ্রন্হ বলিয়া প্রশংসা করেন।[********************]

অতঃপর ইহা সর্বসাধারণের সমক্ষে উপস্থাপিত করা হয়। আর আল্লাহ তা’আলা উহাকে এত বেশি জনপ্রিয়তা ও জনগনের নিকট মর্যাদা দান করিয়াছেন, যাহা সিহাহ সিত্তার মধ্যে অপর কোন গ্রন্হই লাভ করিতে পারে নাই। এইদিকে ইঙ্গিত করিয়া ইমাম আবূ দাউদের ছাত্র হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে মাখলাস দুয়ারী (মৃঃ ৩৩১ হিঃ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ দাউদ যখন সুনান গ্রন্হখানি প্রণয়ন সম্পন্ন করিলেন এবং উহা লোকদিগকে পাঠ করিয়া গুনাইলেন, তখনি উহা মুহাদ্দিসদের নিকট (কুরআ মজীদের মতই) অনুসরনীয় পবিত্র গ্রন্হ হইয়া গেল।[********************]

এই গ্রন্হে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহ সম্পর্কে ইমাম আবূ দাউদ নিজেই দাবি করিয়াছেনঃ

******************************************************

জনগণ কতৃক সর্বসম্মতভাবে পরিত্যক্ত কোন হাদীসই আমি ইহাতে উদ্ধৃত করি নাই।[********************]

ইমাম আবূ দাউদের নিকট হইতে তাঁহার এই গ্রন্হখানি ধারাবাহিক সূত্র পরম্পরায় প্রায় নয়-দশজন বড় বড় মুহাদ্দিস কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছেন।[********************]

ইমাম আবূ দাউদ ২৭৫ হিজরী সনে সর্বশেষ বারের তরে এই গ্রন্হখানি ছাত্রদের দ্বারা লিখাইয়াছিলেন এবং এই বৎসরই ১৬ই শাওয়াল শুক্রবার দিন তিনি অনন্ত ধামে যাত্র করেন।[********************]

জামে তিরমিযী

ইমাম তিরমিযীর হাদীসগ্রন্হ ‘জামে তিরমিযী’ নামে খ্যাত। উহাকে ‘সুনান

 ও বলা হয়। কিন্তু প্রথমোক্ত নামই অধিকাংশ হাদীসবিদ গ্রহণ করিয়াছেন।[********************]

ইমাম তিরমিযী তাঁহার গ্রন্হখানি ইমাম আবূ দাউদ ও ইমাম বুখারী অনুসৃত গ্রন্হ প্রণয়ন রীতি অনুযায়ী তৈয়ার করিয়াছেন। প্রথমত উহাতে ফিকাহর অনুরূপ অধ্যায় রচনা করা হইয়াছে। তাহাতে ব্যবহারিক প্রয়োজনসম্পন্ন হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত করিয়াছেন। কিন্তু সমগ্র গ্রন্হখানি কেবল ব্যবহারিক প্রয়োজন সম্বলিত হাদীস দ্বারাই পূর্ণ করিয়া দেন নাই বরং সঙ্গে তিনি বুখারী শরীফের ন্যায় অন্যান্য অধ্যায়ের হাদীসও উহাতে সংযোজিত করিয়া দিয়াছেন। ফলে গ্রন্হখানি এক অপূর্ব সমন্বয়, এক ব্যাপকগ্রন্হে পরিণত হইয়াছে। এই কারণে উহার ‘জামে তিরমিযী নাম সার্থক হইয়াছে। বিভিন্ন বিষয়ে জরুরী হাদীস উহাতে সুন্দরভাবে সজ্জিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে। এই কারণে হাফেজ আবূ জাফর ইবনে যুবাই ( মৃঃ ৭০৮ হিঃ) সিহাহ-সিত্তা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম তিরমিযী বিভিন্ন বিষয়ের হাদীস একত্র করিয়া গ্রন্হখানি প্রণয়ন করায় যে বৈশিষ্ট্য লাভ করিয়াছেন, তাহাতে তিনি অবিসংবাদিত।[********************]

ইমাম তিরমিযী তাঁহার এই গ্রন্হ প্রণয়ন সমাপ্ত করিয়া তদানীন্তন মুসলিম জাহানের হাদীসবিদ লোকদের নিকট ইহা যাচাই করিবার জন্য পেশ করেন। এই সম্পর্কে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই হাদীস সনদযুক্ত গ্রন্হখানি প্রণয়ন সম্পূর্ণ করিয়া উহাকে হিজাযের হাদীসবিদদের সমীপে পেশ করিলাম। তাঁহারা ইহা দেখিয়া খুবই পছন্দ করিলেন ও সন্তোষ প্রকাল করিলেনে। অতঃপর আমি উহাকে খুরাসানের হাদীসবিদদের খেদমতে পেশ করিলাম। তাঁহারাও ইহাকে অত্যন্ত পছন্দ করেন, সন্তোষ প্রকাশ করেন।[********************]

ইমাম তিরমিযী তাঁহার এই  গ্রন্হখানি সম্পর্কে নিজেই এক অতি বড় দাবি পেশ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যাহার ঘরে এই কিতাবখানি থাকিবে, মনে করা যাইবে যে, তাঁহার ঘরে স্বয়ং নবী করীম (স) অবস্থান করিতেছেন ও নিজে কথা বলিতেছেন।[********************]

বস্তুত হাদীসগ্রন্হ-বিশেষত সহীহ হাদীসসমূহের কিতাবের ইহাই সঠিক মর্যাদা এবং ইহা কেবলমাত্র তিরমিযী শরীফ সম্পর্কেই সত্য নহে, সকল সহীহ হাদীসগ্রন্হ সম্পর্কেই একথা প্রযোজ্য ও অকাট্য সত্য।

তিরমিযী শরীফ সাধারণ পাঠকদের জন্য একখানি সুখপাঠ্য ও সহজ বোধ্য হাদীসগ্রন্হ। শায়খুল ইসলাম আল হাফেজ ইমাম আবূ ইসমাঈল আবদুল্লাহ আনসারী (মৃঃ ৪৮১ হিঃ) তিরমিযী শরীফ সম্পর্কে এক আলোচনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার দৃষ্টিতে তিরমিযী শরীফ বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হদ্বয় অপেক্ষা অধিক ব্যবহারোপযোগী। কেননা বুখারী ও মুসলিম এমন হাদীসগ্রন্হ যে, কেবলমাত্র বিশেষ পারদর্শী আলেম ভিন্ন অপর কেহই তাহা হইতে ফায়দা লাভ করিতে সমর্থ হয় না। কিন্তু ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযীর গ্রন্হ হইতে যে কেহ ফায়দা গ্রহণ করিতে পারে।[********************]

ইমাম তিরমিযী হইতে তাঁহার এই গ্রন্হখানি যদিও শ্রবণ করিয়াছেন বহু সংখ্যক লোক; কিন্তু উহার বর্ণনা পরম্পরা অব্যহত ও ধারাবাহিকভাবে চলিয়াছে মোট ছয়জন বড় বড় মুহাদ্দিস হইতে।[********************]

উপরে মোট পাঁচখানি প্রধান হাদীসগ্রন্হ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হইয়াছে। বিশ্বের হাদীসবিদ বড় বড় আলেমগণ এই পাঁচখানি হাদীসগ্রন্হের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশিষ্টতা অকপটে ও উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন এবং এই পর্যায়ে কাহারো কোন মতভেদ দেখা দেয় নাই। হাফেজ আবূ তাহের সলফী (মৃঃ ৫৭৬ হিঃ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সকল হাদীসবিদ আলিমগণ এই পাঁচখানি গ্রন্হের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত।[********************]

ষষ্ঠ গ্রন্হ কোনখানি?

কিন্তু এই পাঁচখানি গ্রন্হের পর ষষ্ঠ মর্যাদার গ্রন্হ যে কোনখানি তাহা লইয়া মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হইয়াছে।[********************] প্রাথমিক পর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ এবং শেষ পর্যায়ের অনেক হাদীসবিদই প্রধান হাদীস গ্রন্হ হিসাবে উপরোক্ত পাঁচাখানিকেই গণ্য করিয়াছেন। কিন্তু শেষ পর্যায়ের (মুতায়াখখেরীন) মুহাদ্দিসদের মধ্যে কেহ কেহ ইহার বিপরীত মত প্রকাশ করিয়াছেন। এই ছয়খানির মধ্যে ষষ্ঠ গ্রন্হ লইয়াও যথেষ্ট মতভেধ রহিয়াছে। কাহারো মতে সিহাহ সিত্তার ষষ্ঠ গ্রন্হ হইতেছে ইবনে মাজাহ শরীফ, আবার কাহারো মতে মুয়াত্তা ইমাম মালিক। কিন্তু এই পর্যায়ের হাদীসবিদদের দৃষ্টিতে ‘মুয়াত্তা’র তুলনায় ‘ইবনে মাজাহ’ অনেক উন্নত ও জনসাধারণের পক্ষে ব্যবহারোপযোগী। বিধায় ইহাই হইতেছে সিহাহ-সিত্তার ষষ্ঠ গ্রন্হ। হাফেজ আবুল ফযল ইবনে তাহের  মাখদাসী (মৃঃ ৫০৭ হিঃ) সর্বপ্রথম সিহাহ-সিত্তার ষষ্ঠ গ্রন্হ হিসাবে ‘ইবনে মাজাহর’ নাম ঘোষণা করেন।[********************] অতঃপর হাফেজ আবদুল গনী আলমাকদাসী ও এই কথাই মানিয়া লন।[********************] মুহাদ্দিস আবুল হাসান সনদী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

শেষ পর্যায়ের অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মত এই যে, ইবনে মাজাহ শরীফ-ই সিহাহ-সিত্তার ষষ্ঠ গ্রন্হ।[********************]

কোন কোন মুহাদ্দিস সুনানে ইবনে মাজাহ অপেক্ষা সুনানে দারেমীকে অধিকতর উন্নত ও দোষমুক্ত হাদীসগ্রন্হ বলিয়া মনে করেন। তাঁহারা সিহাহ-সিত্তার ষষ্ঠ গ্রন্হ হিসাবে উহার নাম পেশ করিয়াছেন। কিন্তু এই সব কথার কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়। সুনানে ইবনে মাজাহ যেকোন দিক দিয়াই মুয়াত্তা ও সুনানে দারেমী অপেক্ষা উন্নত। তাই এই ষষ্ঠ গ্রন্হ হিসাবে সুনানে ইবনে মাজাহই উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান (মৃঃ ৬৮১ হিঃ) ইবনে মাজাহ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার হাদীস গ্রন্হখানি সিহাহ-সিত্তার অন্যতম।[********************]

সুনানে ইবনে মাজাহ

সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীসের একখানি বিশেষ মূল্যবান গ্রন্হ। ইমাম ইবনে মাজাহ প্রণয়ন কার্য সমাপ্ত করিয়া উহাকে যখন তাঁহার উস্তাদ ইমাম আবূ যুরয়ার নিকট পেশ করিলেন, তখন উহা দেখিয়া তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

আমি মনে করি, এই কিতাবখানি লোকদের হাতে পৌঁছিলে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রণীত সমস্ত বা অধিকাংশ হাদীসগ্রন্হই অপ্রয়োজনীয় হইয়া যাইবে।[********************]

বস্তুত ইমাম আবূ যুরয়ার এই ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক ও সত্য প্রমাণিত হইয়াছে। এই গ্রন্হখানি দুইটি দিক দিয়া সমস্ত সিহাহ-সিত্তা গ্রন্হাবলীর মধ্যে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী। প্রথম, উহার রচনা, সংযোজন, সজ্জায়ন ও সৌকর্য। উহাতে হাদীসসমূহ এক বিশেষ সজ্জায়ন পদ্ধতিতে ও অধ্যায় ভিত্তিতে সাজানো হইয়াছে, কোথাও পুনারাবৃত্তি ঘটে নাই। অপর কোন কিতাবে কোন কিতাবে এই সৌন্দর্য দেখিতে পাওয়া যায় না। ইহা তৎপূর্বকালীন প্রায় সকল হাদীস গ্রন্হকেই জনপ্রিয়তা দিক দিয়া ম্লান করিয়া দিয়াছে। মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (র) ‘ইবনে মাজাহ’ গ্রন্হের উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

প্রকৃতপক্ষে সজ্জায়ন-সৌন্দর্য ও পূনারাবৃত্তি ব্যতীত হাদীসসমূহ একের পর এক উল্লেখ করা এবং এবং তদুপরি সংক্ষিপ্ত প্রভৃতি বিশেষত্ব এই কিতাবে যাহা পাওয়া যায়, অপর কোন কিতাবে তাহা দূর্লভ।[********************]

হাফেজ ইবনে কাসীর (র) ইবনে মাজাহ প্রণীত গ্রন্হটি সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইহা অত্যন্ত কল্যাণপ্রদ গ্রন্হ, ফিকাহর দৃষ্টিতে উহার অধ্যায়সমূহ খুবই সুন্দর ও মজবুত করিয়া সাজানো হইয়াছে।[********************]

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম ইবনে মাজাহর সুনান গ্রন্হ অত্যন্ত ব্যাপক হাদীস সমন্বিত এবং উত্তম।[********************]

এই গ্রন্হের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে এমন সব হাদীস উল্লিখিত হইয়াছে, যাহা সিহাহ-সিত্তার অপর কোন গ্রন্হে উল্লিখিত হয় নাই। এই কারণে ইহার ব্যাবহারিক মূল্য অন্যান্য গ্রন্হাবলীর তুলনায় অনেক বেশি। আল্লামা আবুল হাসান সনদী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এই গ্রন্হকার ইহাতে হযরত মুয়ায ইবনে জাবালের রীতি অনুসরণ করিয়াছেন। অনেক কয়টি অধ্যায় তিনি এমন সব হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন, যাহা অপর প্রখ্যাত পাঁচখানি সহীহ গ্রন্হে পাওয়া যায় না।[********************]

‘হযরত মুয়াযের রীতি অনুসরণ করার’ অর্থ এই যে, হযরত মুয়ায (রা) প্রায়ই এমন সব হাদীস বর্ণনা করিতেন, যাহা অন্যান্য সাহাবীর শ্রুতিগোচর হয় নাই। ইমাম ইবনে মাজাহ তাঁহার গ্রন্হে অন্যান্য গ্রন্হের মোকাবিলা এইরূপ অনেক হাদীস এককভাবে বর্ণনা করিয়াছেন। আল্লামা আবূল হাসান সনদী বলেনঃ - ******************** ‘হযরত মুয়ায লোকদিগকে অধিক ফায়দা দানের উদ্দেশ্যে এই কাজ করিতেন’।[********************]

সুনানে ইবনে মাজাহ ইমাম মুহাদ্দিস আবূ যুরয়ার উক্তি এই প্রসঙ্গে আলোচনার সূচনায়ই উল্লিখিত হইয়াছে। আবূ যুরয়া এই গ্রন্হখানিকে খুবই পছন্দ করিয়াছেন তাহা নিঃসন্দেহ; কিন্তু ইহাতে তাঁহার দৃষ্টিতে যতটুকু ক্রটি ধরা পড়িয়াছে তাহাও তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করিয়াছেন। এই সম্পর্কে আবূ যুরয়ার উক্তি উদ্ধৃত করিয়া বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

ইমাম আবূ যুরয়া বলিয়াছেনঃ আমি আবূ আবদুল্লাহ ইবনে মাজাহর হাদীস-গ্রন্হ অধ্যয়ন করিয়াছি। কিন্তু উহাতে খুব অল্প হাদীসই এমন পাইয়াছি যাহাতে কিছুটা ক্রটি রহিয়াছে। ইহা ছাড়া আর কোন দোষ আমি পাই নাই। অতঃপর এই পর্যায়ে তিনি প্রায় দশটির মত হাদীসের উল্লেখ করিলেন।[********************]

(যদিও এই উক্তির সনদ সম্পর্কে হাদীস-বিজ্ঞানিগণ আপত্তি তুলিয়াছেন।)

সে যাহাই হউক, ইমাম ইবনে মাজাহ অপরিসীম শ্রম-সাধনা এবং যাচাই-বাছাইর পর এই গ্রন্হখানির প্রণয়নকার্য সম্পন্ন করেন। লক্ষ-লক্ষ হাদীস হইতে বাছাই করিয়া চার হাজার হাদীসকে বিভিন্ন অধ্যায়ে সাজাইয়া দিয়াছেন। কিন্তু সিহাহ-সিত্তার অপর পাঁচখানি গ্রন্হের তুলনায় ইহাতে যয়ীফ হাদীসের সংখ্যা বেশী হওয়ার কারণে ছয়খানি হাদীসগ্রন্হের মধ্যে উহার স্থান সর্বশেষে। মুহাদ্দিস সনদী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যাহাই হউক, মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়া ইবনে মাজাহর গ্রন্হ অপর পাঁচখানি গ্রন্হের নীচেও পরে অবস্থিত।[********************]

এমনকি উহা আবূ দাউদ ও সুনানে নাসায়ীরও পরেই গণ্য। আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুনানে ইবনে মাজাহ আবূ দাউদ ও সুনানে নাসায়ীর পরে গণ্য হইবে।[********************]

কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, অপর পাঁচখানি হাদীসগ্রন্হে উদ্ধৃত প্রত্যেকটি হাদীসও বুঝ এককভাবে ইবনে মাজাহর বর্ণিত প্রত্যেকটি হাদীস অপেক্ষা উন্নত ও বিশুদ্ধতায় অগ্রগণ্য। কেননা ইবনে মাজাহ গ্রন্হে এমন সব হাদীসও উদ্ধৃত হইয়াছে, যাহা সহীহ বুখারীর হাদীসসমূহ অপেক্ষা অধিক সহীহ।

সুনানে ইবনে মাজাহ মোট ৩২টি পরিচ্ছেদ পনেরো শত অধ্যায় এবং চার হাজার হাদীস উদ্ধৃত রহিয়াছে।[********************]

ইবনে মাজাহ গ্রন্হে প্রধানত চারজন বড় মুহাদ্দিস ধারাবাহিক বর্ণনা পরম্পরা সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহারা হইতেছেনঃ

১। আবূল হাসান ইবনে কাত্তান

২। সুলাইমান ইবনে ইয়াযীদ

৩। আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবনে ঈসা

৪। আবূ বকর হামেদ আযহারী।

 

চতুর্থ শতকে ইলমে হাদীস

হিজরীর চতুর্থ শতকে ইলমে হাদীস পূর্ণ পরিণতি লাভ করে। তৃতীয় শতকে ইলমে হাদীসের যে চর্চা ও উন্নয়ন সাধিত হয়, তাহা অতীত সকল কাজকে অতিক্রম করিয়া যায়। এই শতকেই অনেক বড় বড় মুহাদ্দিস, হাদীসের হাফেজ ও হাদীস বিজ্ঞানের ইমাম আবির্ভূত হন। বিশ্ব-বিশ্রুত ছয়খানি সহীহ হাদীস গ্রন্হেও এই শতকেই গ্রন্হাবদ্ধ হয় এবং সহীহ হাদীসসমূহ প্রায় সবই এই গ্রন্হাবলীতে সন্নিবদ্ধ হয়। প্রত্যেক হাদীসের সনদ, সনদে উল্লিখিত প্রত্যেক বর্ণনাকারীর জীবন-ইতিহাস ও চরিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত ও পুংখানুপুংখ আলোচনা সম্বলিত বহু সংখ্যক গ্রন্হ এই শতকেই বিরচিত হয়। ফলে ইলমে হাদীস সর্বোতভাবে এক স্বয়ংসম্পুর্ণ বিজ্ঞান হিসাবে গড়িয়া উঠে।

চতুর্থ শতকে পূর্ব শতকেরই কাজ কর্মেরই জের চলিতে থাকে। তবে হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নে এই শতকে স্বতন্ত্রভাবে কোন কাজই সম্পাদিত হয় নাই এমন নহে। এই পর্যায়ে যাহা কিছু হইয়াছে তাহা প্রায় সবই পূর্ববর্তী হাদীসবিদদের নিকট হইতে প্রাপ্ত ও সংরক্ষিত হাদীসসমূহের ভিত্তিতে নূতন হাদীসগ্রন্হ প্রণয়ন করা মাত্র। উপরন্তু তাহাতে সহীহ ও যয়ীফ হাদীসের মধ্যে পার্থক্য করার কাজও বিশেষ সতর্কতা সহকারে সম্পাদিত হয়।

এই শতকের অনেক মুহাদ্দিসই পূর্ববর্তীদের গ্রন্হাবলীতে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে রক্ষিত হাদীসসমূহ সংগ্রহ করেন। উহাতে দীর্ঘ সনদ-সূত্রসমূহকে সংক্ষিপ্ত করা হয়। উহার সজ্জায়ন ও সংযোজনের কাজ পূর্ণ দক্ষতার সহিত সম্পন্ন করা হয়। তাঁহাদের প্রায় সকলেরই কাজ পূর্বগামী মুহাদ্দিসের কাজের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু তবুও এই শতকে এমন কয়েকজন বড়বড় মুহাদ্দিসের আবির্ভাব ঘটে, যাঁহারা স্বাধীনভাবে পূর্বগামীদের রীতি অনুযায়ী স্বতন্ত্র হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। হাদীস বর্ণনা ও সনদ-সূত্র সন্ধানে তাঁহাদের গভীর পাণ্ডিত্য বর্তমান ছিল।[********************] তাঁহাদের সম্পর্কে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা যাইতেছেঃ

মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী (র)

মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী চতুর্থ হিজরী শতকের একজন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ। তিনি প্রধানত ইমাম বুখারী ও মুসলিমের গ্রন্হ প্রণয়নের পর অবশিষ্ট সহীহ হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও উহার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। উহার নাম হইতেছে ‘আল মুস্তাদরাক’।

ইহা সর্বজনবিদিত যে, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম যে দুইখানি হাদীসগ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন, ইলমে হাদীসের জগতে তাহাই সর্বাধিক সহীহ। কিন্তু তাঁহার অর্থ এই নয় যে, সমস্ত সহীহ হাদীসই এই গ্রন্হদ্বয়ে  সন্নিবেশিত হইয়াছে, উহার বাহিরে আর কোন সহীহ হাদীস থাকিয়া যায় নাই। বস্তুত উক্ত গ্রন্হদ্বয়ের উল্লিখিত হাদীসসমূহ সহীহ, কিন্তু উহার বাহিরেও বহু হাদীস এমন রহিয়া গিয়াছে যাহা গ্রন্হদ্বয়ের অন্তর্ভুক্ত হাদীসসমূহের সমান পর্যায়ের সহীহ। উপরোক্ত ইমামদ্বয় কোন হাদীসকে সহিহ বলিয়া গ্রহণ করার জন্য যে শর্ত আরোপ করিয়াছিলেন এবং সহীহ হাদীস বাছিয়া লইবার জন্য যে মানদণ্ড স্থাপন করিয়াছিলেন সেই শর্ত ও মানদণ্ডে উত্তীর্ণ আরো বহু হাদীস বাহিরে থাকিয়া গিয়াছিল। যাহা শুধু গ্রন্হদ্বয়ের আকার অসম্ভব রকমে বিরাট হইয়া যাওয়ার আশংকায় তাহাতে শামিল করা হয় নাই। ইমাম হাকেম এই ধরনের হাদীসসমূহ অনুসন্ধান করিয়া ও তুলাদণ্ডে ওজন করিয়া উহার সমন্বয়ে ‘মুস্তাদরাক’ নামে আলোচ্য গ্রন্হখানি প্রণয়ন করেন।[********************]

ইমাম হাকেম এতদ্ব্যতীত হাদীসের আরো কয়েকখানি মূল্যবান গ্রন্হ রচনা করেন। তাঁহার গ্রন্হাবলীর মোট খণ্ড হইতেছে এক হাজার পাঁচশত। তিনি হাদীসের সন্ধানে ইরাক ও হিজাযে দুইবার সফর করেন। এই সফরে তিনি বহু হাদীস সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করিয়াছেন। তিনি ৪০৫ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইমাম দারে কুতনী (র)

দারে কুতনীর পূর্ণ নাম হইতেছে আলী ইবনে উমর ইবনে আহমদ। তিনি হাদীসের একজন যুগশ্রেষ্ঠ হাফেজ ও ইমাম। তিনি বহু সংখ্যক উস্তাদের নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন এবং তিনি উহার ভিত্তিতে তিনি বহু সংখ্যক উন্নতমানের গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। বিশেষত হাদীস যাচাই-পরীক্ষা করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী। তাঁহার গ্রন্হ ‘আল-ইলজামাত’ মুস্তাদরাক- এর মতই এক অনবদ্য হাদীস গ্রন্হ। তাঁহার আর একখানি কিতাবের নাম ‘কিতাবুস সুনান’।

তিনি ৩০৬ হিজরী সনে বাগদাদের প্রখ্যাত ‘দারেকুতন’ মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি বাগদাদের সকল মহাদ্দিসের নিকট উপস্থিত হইয়াছেন এবং পরে এই উদ্দেশ্যেই তিনি কূফা, বসরা, সিরিয়া, ওয়াসিত, মিসর ও অন্যান্য হাদীস কেন্দ্রসমূহ পরিভ্রমন করেন। তিনি শৈশবকাল হইতেই অসাধারণ স্মরণশক্তি ও অনুধাবন শক্তিতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন। তিনি ৩৮৫ হিজরী সনে বাগদাদেই ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইবনে হাব্বান (র)

তাঁহার পূর্ণ নাম হইতেছে মুহাম্মদ ইবনে হাব্বান আহমদ ইবনে হাব্বান আবূ হাতেম আল-বসতী। তিনি হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন। হাদীসের তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্থানসমূহ তিনি সফর করেন ও বহু সংখ্যক মুহাদ্দিসের নিকট হাদীস শ্রবণ করেন। ঐতিহাসিক ইবনে সাময়ানী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ হাতেম ইবনে হাব্বান ছিলেন হাদীস-জ্ঞানে যুগশ্রেষ্ঠ। তিনি হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শাশ হইতে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত সুদূল পথ সফর করেন।[********************]

খতীব বাগদাদী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন। তাঁহার বহুসংখ্যক হাদীস গ্রন্হও রহিয়াছে।[]

তাঁহার হাদীস সংগ্রহ অভিযান সম্পর্কে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি শাশ হইতে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ পথ সফর করিয়া সম্ভবত এক হাজার উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছি।[********************]

এই শতকের প্রায় সকল মুহাদ্দিসের মত এই যে, বুখারী ও মুসলিমের পর যাঁহারা প্রকৃত সহীহ হাদীসের সমন্বয়ে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে প্রথমে যদি ইবনে খুযাইমার নাম উল্লেখ করিতে হয়, তবে তাঁহার পরই উল্লেখ করিতে হয় ইবনে হাব্বানকে।[ ক. ********************]

ইবনে হাব্বান ৩৫৪ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইমাম তাবারানী (র)

ইমাম তাবারানীর পূর্ণ নাম হইতেছে আবূল কাসেম সুলাইমান ইবনে আহমদ আত-তাবারানী। তিনি তিনভাগে ‘আল-মু’জিম’ নামে হাদীসগ্রন্হ সংকলন করেন। প্রতি ভাগের নাম যথাক্রমেঃ

১. ********************

২. ********************

৩. ********************

প্রথম ভাগে তিনি হযরত আবূ হুরায়রা ব্যতীত অপরাপর সাহাবীদের সনদ সূত্রে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত করিয়াছেন। হযরত আবূ হুরায়রা মুসনাদসমূহ তিনি স্বতন্ত্র এক খণ্ডে একত্রিত করেন। মু’জি-এর এই খণ্ডে তিনি প্রায় বিশ হাজার ও পাঁচশত হাদীস (মুসনাদ) একত্রিক করিয়াছেন। ইহাতে তিনি সাহাবীদের নামের আক্ষরিক ক্রমিকতা অবলম্বন করিয়াছেন।

তৃতীয় ভাগের গ্রন্হে তিনি তাঁহার প্রায় দুই হাজার উস্তাদের নিকট হইতে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ প্রত্যেক উস্তাদের নামের সনদে একত্রিত করিয়াছেন। বলা হয় যে, ইহাতে প্রায় ত্রিশ হাজার সনদে বর্ণিত হাদীস রহিয়াছে এবং তাহা ছয়টি স্বতন্ত্র খণ্ডে বিভক্ত।

দ্বিতীয় ভাগের গ্রন্হখানি একখণ্ডে সম্পূর্ণ। উহাতে এক হাজার উস্তাদের নিকট হইতে গৃহীত প্রায় পনেরো শত হাদীস একত্রিত করা হইয়াছে।[********************]

ইমাম তাহাভী (র)

 ইমাম তাহাভীর পূর্ণ নাম আবূ জা’ফর আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আত-তাহাভী। তিনি এই শতকের একজন অন্যতম মুহাদ্দিস। তিনি ২২৮ হিজরী সনে মিসরে ‘তাহা’ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[********************] এই সময় কিছু ধর্মবিমুখ লোক ইসলামের হুকুম আহকাম সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিতে থাকে। তাহারা অভিযোগ করে যে, ইসলামের আদেশ নিষেধসমূহ পরস্পর বিরোধী। এই কারণে ইমাম তাহাভীর বন্ধু-বান্ধবগণ তাঁহাকে হাদীসের এমন একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করিবার জন্য অনুরোধ করেন, যাহা হইতে ইসলামের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও ব্যবহারিক বিধান অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইবে। অতঃপর ইমাম তাহাভী হাদীসের এক অনন্য সাধারণ গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]

তিনি ৩২১ হিজরী সনে আশি বৎসরাধিক বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

এই শতকের অন্যান্য মুহাদ্দিসীন

তাঁহাদের ব্যতীত এই শতকে আরো কায়েকজন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহাদের মধ্যে কাসেম ইবনে আসবাগ (মৃঃ৩৪০ হিঃ) এবং ইবনুস-সাকান (মৃঃ ৩৫৩ হিঃ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহারা উভয়েই ‘সহীহ আলমুনতাকা’ নামে দুইখানি হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]

 

চতুর্থ শতকের পরে হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়ন

চতুর্থ শথকের মুহাদ্দিস ও হাদীস-গ্রন্হ প্রণেতাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ইতিপূর্বে পেশ করা হইয়াছে। ইহারা প্রায় সকলেই প্রকৃত অর্থে ‘মুহাদ্দিস’ ছিলেন। তাঁহারা নিজেদের সংগৃহীত হাদীসের খ্যাতনামা উস্তাদদের নিকট হইতে শ্রুত হাদীসসমূহের সমন্বয়ে হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়ন করিতেন। গ্রন্হ প্রণয়নের ব্যাপারে তাঁহারা পূর্ণ মাত্রায়ই তৃতীয় শতকের হাদীস গ্রন্হ প্রণেতাদের অনুসৃত রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া চলিয়াছিলেন। এইভাবে চতুর্থ শতকের সোনালী দিনগুলি অতিবাহিত হইয়া যায়।

কিন্তু ইহার পরবর্তী শতকে যে মুহাদ্দিসগণ ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব ও মর্যাদা লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসদের সমান মানের প্রতিভাসম্পন্ন ছিলেন না। বিশেষত পূর্বগামীদের প্রণীত হাদীস গ্রন্হের অনুরূপ কোন মৌলিক গ্রন্হ প্রণয়ন করা আর কাহারো পক্ষেই সম্ভব হয় নাই। কিন্তু হাদীস সম্পর্কে তাঁহাদের দক্ষতা, জ্ঞানের ব্যাপকতা ও গভীরতা এবং দৃষ্টির সূক্ষ্মতা প্রসারতা কিছুমাত্র নগণ্য ছিল না। এই শতকের মুহাদ্দিসগণ মৌলিকভাবে কোন হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করিতে সমর্থ না হইলেও তাঁহার পূর্ববর্তীদের মৌলিক গ্রন্হাবলীকে ভিত্তি করিয়া হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের নবতর পদ্ধতির প্রবর্তন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তাঁহারা বিভিন্ন গ্রন্হাবলীর হাদীসসমূহ একত্রিত করিয়া এবং উহাকে সুসংবদ্ধভাবে সজ্জিত করিয়া বিপুল সংখ্যক অভিনব গ্রন্হ সমাজ সমক্ষে উপস্থাপিত করিতে সক্ষম হইয়াছেন। আমরা এখানে এই পর্যায়ের কয়েকখানি প্রখ্যাত হাদীস সংগ্রহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করিতেছি।[********************]

বুখারী ও মুসলিমের হাদীস একত্রায়ন

বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম হইতে হাদীস চয়ন ও একত্র সংযোজনপূর্বক স্বতন্ত্র গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইসমাঈল ইবনে আহমদ নামক এক মুহাদ্দিস- যিনি- ‘ইবনুল ফুরাত’ নামে খ্যাত ছিলেন (মৃঃ ৪১৪ হিঃ) – এই ধরনের একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। মুহাম্মদ ইবনে নসর আল হুমাইদী আর আন্দালুসী (মৃঃ ৪৮৮ হিঃ) অপর একখানি হাদীস-গ্রন্হ রচনা করেন। হুসাইন ইবনে মাসঊদ আল-বগভী (মৃঃ ৫১৬ হিঃ) , মুহাম্মদ ইবনে আবদুল হক আল-আশবিলী (মৃঃ ৫৮২হিঃ) এবং আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আল-কুরতুবী (মৃঃ ৬৪২ হিঃ) প্রমুখ মুহাদ্দিসগণও এই ধরণের একখানি হাদীস গ্রন্হ সংকলন করেন।[********************]

সিহাহ-সিত্তার হাদীস সঞ্চয়ন

কেবলমাত্র সিহাহ-সিত্তার গ্রন্হাবলী হইতে হাদীস সংগ্রহ করিয়া স্বতন্ত্র গ্রন্হ প্রণয়নের কাজও এই পর্যায়ের যথেষ্ট হইয়াছে। এই গ্রন্হসমূহ সাধারণত ‘তাজরীদুস-সিহাহ-সিত্তা’র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ নামেই পরিচিত। এই ধরনের গ্রন্হ প্রণেতাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১. আহমদ ইবনে রুজাইন ইবনে মুরাবীয়াত আল-আবদারী আস-সারকাসতী (মৃঃ ৫৩৫ হিঃ)। তাঁহার সংকলিত হাদীস গ্রন্হের নাম তাজরীদুস সিহাহ। তাঁহার এই গ্রন্হখানি সুন্দররূপে সজ্জিত ও সুসংবদ্ধরূপে প্রণীত হয় নাই। সিহাহ-সিত্তার অনেক হাদীসই ইহা হইতে বাদ পড়িয়া গিয়াছে। উত্তরকালে মুবারক ইবনে মুহাম্মদ ইবনুল আসরি আল-জাজরী নামে খ্যাত (মৃঃ ৬০৬ হিঃ)। এই গ্রন্হখানির সম্পাদনা ও সুসংবদ্ধকরণের কাজ করেন। অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে উহাকে সুন্দররূপে সাজাইয়া দেন এবং প্রথমে ইহাতে যেসব হাদীস শামিল করা হয় নাই, তাহা ইহাতে শামিল করিয়া দেওয়া হয়। ইহার কঠিন ও অপরিচিত শব্দসমূহের ব্যাখ্যাও দান করা হয় এবং উহার নামকরণ হয়ঃ ******************** ফলে ইহা একখানি সহজবোধ্য অমূল্য গ্রন্হে পরিণত হয়। মিসরে এই গ্রন্হখানি মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইয়াছে। ইহা দশখণ্ডে বিভক্ত। জামে আজহারের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আবদে রাব্বিহি ইবনে সুলাইমান ইহার ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন। তিনি উহার নাম রাখিয়াছেনঃ ********************

২. আবদুল ইবনে আবদুর রহমান আল-আশ-বেলী ইবনে খারাত নামে খ্যাত (মৃঃ ৫৮২ হিঃ) সিহাহ-সিত্তার সমন্বয়ে আর একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]

বিভিন্ন গ্রন্হ হইতে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন

হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্হাবলী হইতে হাদীস সংগ্রহ করিয়া স্বতন্ত্র হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের কাজও এই পর্যায়ে যথেষ্ট হইয়াছে। কয়েকখানি গ্রন্হের নাম ও পরিচয় উল্লেখ করা যাইতেছে।

১. মাসাবীহুস-সুন্নাহ- ইমাম হুসাইন ইবনে মাসউদ আল বাগাভী (মৃঃ ৫২৬ হিঃ) ইহার সম্পাদনা করিয়াছেন। ইহাতে প্রথমে সহীহ, হাসান প্রভৃতি হাদীস সংযোজিত হয়। পরবর্তীকালের আলিম সমাজ এই হাদীস সংকলনখানির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব ও আগ্রহ প্রকাশ করেন। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-খতীব ইহাকে সুসংবদ্ধরূপে সজ্জিত করেন। হাদীসের মূল বর্ণনাকারী সাহাবীর নাম এবং যে গ্রন্হ হইতে ইহা সংগ্রহ করা হইয়াছে তাহারও উল্লেখ করা হইয়াছে। প্রথমে প্রত্যেক অধ্যায়ে মাত্র দুইটি করিয়া পর্যায় (********************) সন্নিবেশিত ছিল; কিন্তু এক্ষণে উহাতে তৃতীয় পর্যায়ের (********************) হাদীস সংযোজিত হয়। ইহা ৭৩৭ হিজরী সনের ঘটনা। শেষ পর্যন্ত নামকরণ হয় মিশকাতুল মাসাবীহ (********************) বহু মুহাদ্দিসই ইহার ব্যাখ্যার বিরাট গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।[********************]

২. জামেউল মাসেনীদ আল-আলকাব- ইহা আবুল ফারজ আবদুল ইবনে আলী আল জাওযীর (মৃঃ ৫৯৭ হিঃ) সংকলিত হাদীস গ্রন্হ। ইহাতে বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ ও তিরমিযী শরীফ হইতে হাদীস সংগ্রহ করা হইয়াছে।

৩. বহরুল আসানীদ- ইমাম হাফেজ আল-হাসান ইবনে আহমদ সমরকান্দী (মৃঃ ৪৯১ হিঃ) কর্তৃক ইহা সংকলিত। ইহাতে এক লক্ষ হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে। এই গ্রন্হখানি সম্পর্কে বলা হয়ঃ

******************************************************

ইসলামের ইহার দৃষ্টান্ত নাই।[********************]

আহকাম ও নসীহতমুলক হাদীস সংকলন

এই পর্যায়ে আহকাম ও ওয়াজ-নসীহতমূলক হাদীস বিভিন্ন হাদীসগ্রন্হ হইতে সঞ্চয়ন করিয়াও বিভিন্ন হাদীসগ্রন্হ প্রণয়ন করা হয়। তন্মধ্যে নিম্নোলিখিত গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্যঃ

১. মুনতাকাল আখবার ফিল আহকাম‑  ইহা হাফেজ মাজদুদ্দীন আবুল বারাকাত আবদুস সালাম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবুল কাসেম আল হাররানীর সংকলিত। তিনি ইবনে তাইমিয়া নামে খ্যাত। মনে রাখা আবশ্যক যে, তিনি প্রখ্যাত মুজাদ্দিদ ইবনে তাইমিয়া নহেন এবং তিনি মুজাদ্দিদ ইবনে তাইমিয়ার দাদ- পিতামহ। এই গ্রন্হ প্রণেতা ইবনে তাইমিয়াও একজন বড় মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি ৫৯০ হিজরী স নে জন্মগ্রহন করেন এবং ৬৫২ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

এই গ্রন্হে বুখারী, মুসলিম, আবূ দাঊদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও সুনানে আহমদ প্রৃভৃতি সহীহ ও সর্বজনমান্য গ্রন্হাবলী হইতে হাদীসসমূহ সংকলিত ও সংযোজিত হইয়াছে। ইয়ামেনের মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে আলী শওকানী (মৃঃ ১২৫০ হিঃ) ‘নায়লুল আওতার’ নামে নয় খণ্ডে ইহার ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন।

২. আস-সুনানুল কুবরা ইমাম আহমদ ইবনে হুসাইন আল-বায়হাকী(মৃঃ ৪৫৮ হিঃ) সংকলিত। ইবনে সালাহর মতে, হাদীসের দলীলসমূহ এই গ্রন্হে যত সামগ্রিকতা ব্যাপকতা সহকারে সন্নিবেশিত হইয়াছে, তত আর কোন গ্রন্হেই নহে। ইহাতে  প্রয়োজনীয় কোন হাদীসই পরিত্যক্ত হয় নাই। ইমাম বায়হাকীর আর একখানি হাদীস সংকলন রহিয়াছে উহার নাম ********************। [********************] বলা হয়ঃ

******************************************************

ইসলামের এইরূপ আর একখানি গ্রন্হও প্রণয়ন করা হয় নাই।[********************]

৩. আল-আহকামুস- সগরা- ইহা হাফেজ আবূ মুহাম্মদ আবদুল হক আল-আশবেলী(ইবনে খারাত নামে খ্যাত) কর্তৃক সংকলিত। তিনি ৫৮২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। ইহাতে একদিকে যেমন মুসলিম জীবনের ব্যবহারিক ও আদেশ-নিষেধ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হইয়াছে, অনুরূপভাবে ওয়াজ-নসীহত এবং পরকাল সম্পর্কে সতর্কতামূলক হাদীসও সংযোজিত হইয়াছে।[********************]

৪. উমদাতুল আহকাম- ইহা ইমাম হাফেজ আবদুল গনী ইবনে আবদুল ওয়াহিদ আল-মাকদাসী দামেশকী(মৃঃ ৬০০ হিঃ) সংকলিত। বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হে আহকাম সম্পর্কিত যে সব হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহই ইহাতে সংকলিত হইয়াছে।

৫. আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব- হাফেজ আবদুল আযীয ইবনে ইবদুল কভী ইবনে আবদুল্লাহ আল- মুনযেরী (মৃঃ ৬৫৬ হিঃ) সংকলিত। হাদীস সংগ্রহ ও উহার গুণাগুণ নির্ধারণ দৃষ্টিতে এই গ্রন্হখানি অতি উত্তম।

 

সপ্তম ও অষ্টম শতকে হাদীস চর্চা

পূর্ববর্তী আলোচনা প্রায় সাড়ে ছয়শত বৎসর পর্যন্ত বিস্তৃত। হিজরী সপ্তম শতকের শেষাধ্যে মুসলিম জাহানের উপর ধ্বংস ও বিপর্যয়ের এক প্রবণ ঝঞ্ঝা- বাত্যা প্রাবাহিত হইয়া যায়। ৬৫৮ হিজরী সনে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ার বিশাল অঞ্চলে তাতারদের সর্বগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় তাহারা ‘হলব’ ধ্বংস করিয়া দামেশকের দিকে অগ্রসর হয়। মিসরে তখন আইয়ুবী শাসন অবস্থিত; কিন্তু তাহাও তৈলহীন প্রদীপের মত নিস্প্রভ প্রায় হইয়া আসিয়াছিল। মামলুকদের কর্তৃত্বই সর্বত্র প্রধান ও প্রবল হইয়া উঠে। সপ্তম শতকের মুসলিম জাহানের উপর তুর্কী প্রাধান্য স্থাপিত হইতে শুরু করে। অপর দিকে সমগ্র মাগরিব (উত্তর পশ্চিম আফ্রিকা) এলাকায় মাগরেবী বার্বার জনগোষ্ঠীর শাসন সংস্থাপিত হয়।

এক কথায়, এই সময় সমগ্র মুসলিম জাহানের উপর সভ্যতার সূর্যাস্তকালীন অবস্থা বিরাজিত ছিল। মুসলিমগণ চরিত্র, ঈমান ও শৌর্য-বীর্য সকল দিক দিয়াই দুর্বলতর হইয়া পড়ে। তাহাদের পারস্পরিক প্রবল হিংসা-বিদ্বেশ, মতবিরোধ ও অবসাদ তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে নিস্প্রাণ ও মৃত্যু-প্রায় করিয়া দিয়াছিল। মুসলিমগণের এক দেশ হইতে অন্য দেশ পরিভ্রমণ ও বিরাট মুসলিম জনতার সহিত গভীর ঐক্য সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার কোন প্রবণতাই কোথাও পরিলক্ষিত হইত না। এমন কি হাদীসের সন্ধানে যে মুসলিমদের দেশ পর্যটন ছিল এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গৌরবের বিষয়, এই শতকে জ্ঞান-কেন্দ্র ও দূরে দূরে অব্স্থানকারী মনীষী ও মুহাদ্দিসদের মধ্যে জ্ঞানগত সম্পর্কসূত্র সম্পূর্ণ ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল।

 এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদের চিন্তা ও মনীষা ভোঁতা হইয়া যাইতে লাগিল, জ্ঞান-পিপাসুদের মধ্যে দূর-দূরান্তর পরিভ্রমনের সুযোগে জ্ঞান আহরণের কোন তৎপরতাই ছিল না। ফলে হাদীস সংগ্রহ ও উহার বর্ণনা পরস্পরার ধারাবাহিকতার পথ রুদ্ভ হইয়া আসে। এক্ষণে কেবলমাত্র উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস বর্ণনার অনুমতি লওয়া ও কিছু সংখ্যক হাদীস তাঁহার নিকট হইতে লিখিয়া লওয়ার মধ্যেই হাদীস চর্চার সময় কাজ সীমাবদ্ধ হইয়া পড়ে। হাদীসের সন্দ এই সময় কেবলমাত্র এক ‘বরকত’ লাভের উপায়ে পরিণত হয়।

কিন্তু ইহা চূড়ান্ত এ একমাত্র কথা নহে। এই সময়ও কিছু সংখ্যক তেজস্বী মনীষীর সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁহারা হাদীস-সন্ধান ও সংগ্রহেনর প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত তৎপরতার পুনরুজ্জীবন সাধন করেন। তাঁহারা দূর দূর কেন্দ্রে পরিভ্রমণ করেন ও মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস লিখিয়া লইবার উদ্দেশ্যে তাঁহার সম্মুখে আসন গাড়িয়া বসিতে লাগিলেন। এই পদ্ধতিতে হাদীস শিক্ষাদান হাদীস-বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ইমলা’ (********************)। মুহাদ্দিস মসজিদের একপাশে সপ্তাহের নির্দিষ্ট একদিনে আসন গাড়িয়া বসিতেন, তাঁহাকে ঘিরিয়া চতুর্দিকে বসিতেন হাদীস শিক্ষার্থী লোকেরা। মুহাদ্দিস মুখে হাদীস পাঠ করিতেন, শিক্ষার্থিগণ তাহা নিজ নিজ কাগজে লিখিয়া লইতেন। এই পর্যায়ের মুহাদ্দিসের মধ্যে আল-হাফেজ আবুল ফযল জয়নুদ্দীন আবদুর রহীম ইবনুল হুসাইন আল-ইরাকীর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি যেমন  হাদীসের যুগ-ইমামা ছিলেন, তেমনি ছিলেন বহু সংখ্যক মুল্যবান গ্রন্হের প্রণেতা। তিনি হাদীস লিখাইবার জন্য চার শতেরও অধিক মজলিস অনুষ্ঠান করিয়াছেন। তাঁহার ছাত্র ইবনে হাজার বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি ৭৯৬ হিজরী সনে হাদীস লিখাইতে শুরু করেন। ফলে রাসূলের হাদীস চর্চা বন্ধ হইয়া যাওয়ার পর তনি উহাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি চার শতেরও অধিক মজলিসের অনুষ্ঠান করেন এবং ইহার অধিকাংশ বৈঠকে তিনি কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যেই সুসংবদ্ধ ও সুরক্ষিত এবং কল্যাণাদানকারী হাদীসসমুহ লিখাইয়া দিয়াছেন।[********************]

তিনি ৮০৬ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।

এই পর্যায়ে দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য মনীষী হইতেছেন শিহাবুদ্দীন আবুল ফযল আহমদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাজার আল-আসকালানী। তিনি হাদসের শুধু হাফেজই ছিলেন না, এই শতকের হাদীসের হাফেজদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। এই শতকে তাঁহার সমতুল্য মুহাদ্দিস আর কেহই ছিলেন না। তিনি ৮৫২ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। তাঁহার সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস সংগ্রহের জন্য দেশভ্রমণ ও দুনিয়ায় হাদীস চর্চার প্রাধান্য সামগ্রিকভাবে তাঁহার পর্যন্ত আসিয়া শেষ হইয়া যায়। তাঁহার সমসাময়িক যুগে তিনি ব্যতীত অপর কেউই হাদীসের হাফেজ হন নাই। তিনি বিপুল সংখ্যক গ্রন্হ রচনা করিয়াছেন ও এক হাজারেরও অধিক মজলিস অনুষ্ঠান করিয়া হাদীস লিখাইয়াছেন।[********************]

হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানীর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্হ হইতেছে বুখারী শরীফের শরাহ ‘ফতহুল বারী’। ইহা বিরাট দশটি খণ্ডে বিভক্ত। ইহার ভূমিকা স্বতন্ত্র এক গ্রন্হ হিসাবে প্রকাশিত, উহার নামঃ ********************।[********************]

তাঁহার নিজস্ব একখানি হাদীস সংকলনও রহিয়াছে। তাহা হইতেছে ******************** ইহা আহকাম সংক্রান্ত হাদীসের এক বিশেষ সংকলন।

আলেম সমাজে এই গ্রন্হখানিও বিশেষভাবে সমাদৃত হইয়াছে।[********************]

ইবনে হাজারের ছাত্র ইমাম সাখাভীও এই পর্যায়েল এক উল্লেখযোগ্য প্রতিভা। তিনি তাঁহার বিখ্যাত ‘ফতহুল মুগীস’ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ******************************************************

আমি মক্কা শরীফে  হাদীস লিখিয়াছি। কাহেরার বিভিন্ন ও বহু সংখ্যক স্থানেও এই কাজ করিয়াছি এবং এখন পর্যন্ত যতগুলি মজলিসে হাদীস লিখাইবার কাজ করিয়াছি, তাহার সংখ্যা প্রায় ছয়শত হইবে।............. আর সব কাজেরই মূল হইতেছে নিয়্যত।[********************]

কিন্তু হাদীস ‘ইমলা’ করানোর এই পদ্ধতিও আর বেশি দিন কার্যকর হইয়া থাকিতে পারে নাই। পরবর্তী সময়ের হাদীসবিদগণ পূর্ববর্তীদের সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহ লইয়াই অধিক মশগুল থাকেন। উহা হইতে হাদীস সঞ্চয়ন, সংক্ষিপ্ত সংস্করণ রচনা, হাদীস গ্রন্হের ব্যাখ্যা প্রণয়ন প্রভৃতি কাজেই তাঁহারা মনোযোগ দান করেন। আর ইহাও মুসলিম জাহানের মাত্র কয়েকটি শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং অতি অল্প সংখ্যক লোকই এই কাজে মনোনিবেশ করিয়াছিলেন মাত্র।

 

বিভিন্ন দেশে হাদীস চর্চা

সপ্তম, অষ্টম ও উহার পরবর্তী শতকসমূহে মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চলে হাদীসের চর্চা, শিক্ষাদান ও প্রচার সাধিত হইয়াছে। এই সময়ে মাগরেবী দেশসমূহেই (উত্তর পশ্চিম আফ্রিকায়) ইহার প্রসারতা সর্বাধিক ছিল। কিন্তু উহার পর দুইটি বিরাট মুসলিম দেশে হাদীস চর্চার ব্যাপকতা পরিলক্ষিত হয়, একটি মিসর এবং অপরটি হিন্দুস্থান (ভারতবর্ষ)। বাগদাদে তাতারী আক্রমণের ফলে আব্বাসীয় খিলাফতের পতন মুসলিম মনীষা ও  ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এক মর্মান্তিক ঘটনা। তাতারগণ বাগদাদের ইসলামী গ্রন্হাগার হইতে লক্ষ লক্ষ গ্রন্হ হরণ করিয়া লইয়া দজলা নদীতে নিক্ষেপ করে ও উহার উপর এই গ্রন্হস্তুপ দ্বারা পুল নির্মাণ করিয়া দেয়- যেন তাহাদের সৈন্যবাহিনী সহজেই নদী অতিক্রম করিতে পারে। ইহার পরই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎসকেন্দ্র  বাগদাদ হইতে অন্যত্র স্থানান্তরিত হইয়া যায়। প্রথমে মিসর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান- বিশেষত ইলমে হাদীসে সমৃদ্ধ ও ফুলে-ফলে সুশোভিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। এই সময়ে মিসরে হাদীসের যেরূপ চর্চা ও প্রসার হয় তাহাকে অনায়াসেই তৃতীয় হিজরী শতকের হাদীস চর্চার সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। কিন্তু অতঃপর এখানেও হাদীস চর্চার এই প্রচণ্ড মার্তণ্ড অস্তোন্মুখ হইয়া পড়ে। হাদীসের জ্ঞান-চর্চা অতঃপর অন্যান্য দেশের দিকে প্রবাহিত হয়। দেখা যায়, হাদীস জ্ঞানের সূর্য মিসরে অস্তমিত হইয়া ভারতের  আকাশে উদিত ও ভাস্বর হইয়া দেখা দিয়াছে। ভারতে তখন প্রকৃতপক্ষেই হাদীস-চর্চার স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। ( বিস্তারিত আলোচনার জন্য এই গ্রন্হের ‘পাক ভারতে ইলমে হাদীস’ শীর্ষক  অধ্যায়  দ্রষ্টব্য।)

মিসরের এই পতন যুগেও হাদীসের চর্চা মোটেই হয় নাই, একথা বলা যায় না। বরং ইতিহাস আমাদের সম্মুখে এই সময়ও ইলমে হাদীসের বিরাট ও অবিস্মরনীয় খেদমতের দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করে। মিসরে তখন মামলুকদেরই রাজত্ব কায়েম ছিল। এই মামলূক বাদশাহদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞান-স্পৃহা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। বহু বাদশাহ ছাত্র হিসাবে একালের মুহাদ্দিসদের সম্মুখে আসন গাড়িয়া বসিয়াছেন। রাজ ভাণ্ডার উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিয়াছেন হাদীস শিক্ষার বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে।

এই সময়ও মিসরে কয়েকজন হাদীসের ইমাম বর্তমান ছিলেন। হাদীসসমূহ উহার পূর্ণ ও বিশুদ্ধ সনদসহ তাঁহারা মুখস্থ করিয়াছেন। পিপাসুরা তাঁহাদের নিকট হইতেই হাদীস শিক্ষা করিতেন এবং হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে লোকেরা তাঁহাদের সম্মুখেই ভীড় জমাইত।

তাঁহাদের মধ্যে নিম্নলিখিত হাদীসবিদগণ উল্লেখযোগ্যঃ

১. জাহের বরকুক ২. ইমাম আকমালূদ্দীন আল-বাবরতী ৩. ইবনে আবুল মজদ  ৪. আল-মুয়াইয়িদ ৫. শামসুদ্দীন আদ-দেয়ারী আল-মুহদ্দিস।[********************]

 

পরিশিষ্ট-১

উপরের পৃষ্ঠাসমূহে হাদীসের সংখ্যা ও হাদীস সংকলনের দীর্ঘ ইতিহাস সবিস্তারে আলোচিত হইয়াছে। ইতিহাসের বিভিন্ন স্তারে হাদীস সংরক্ষণ, হাদীস সংকলন ও হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের বিরাট-মহান কর্মতৎপরতার সহিত পাঠকদের পরিচিত সংস্থাপিত হইয়াছে। পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা বিভিন্ন স্তরে রকম-বেরকমের হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নের সহিতও পরিচিত হইয়াছি। এখানে বিভিন্ন পদ্ধতি ও ধরনের হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে এক আলোচনা পেশ করা হইয়াছে।

হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নের বিভিন্ন ধরণ ও পদ্ধতি (Technique) রহিয়াছে। এই বিভিন্ন ধরনের প্রণীত গ্রন্হের নামও বিভিন্ন। যথাঃ

১. আলজামে-  যেসব হাদীসগ্রন্হ আকায়েদ (বিশ্বাস) আহকাম (আদেশ-নিষেধ ও শরীয়াতের ব্যবহারিক নিয়ম), দয়া-সহানুভূতি, পানাহারের আচার, বিদেশ-সফর ও একস্থানে অবস্থান, কুরআনের তাফসীর, ইতিহাস, যুদ্ধ-সন্ধি , শক্রদের মুকাবিলায় বাহিনী প্রেরণ, ফিতনা-বিপর্যয়, প্রশংসা ও মর্যাদা বর্ণনা প্রভৃতি সকল প্রকারের হাদীস বিভিন্ন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়, এই সব গ্রন্হকে আল-জামে বলা হয়।[********************] সিহাহ-সিত্তার মধ্যে নিম্নোক্ত গ্রন্হদ্বয় এই পর্যায়ে গণ্যঃ

(ক) আল-জামেউস সহীহুল বুখারী এবং (খ) আল-জামেউত তিরমিযী। সহীহ মুসলিম এই পর্যায়ে গণ নয়। কেননা উহাতে তাফসীল ও কিরাত সংক্রান্ত হাদীস সন্নিবেশিত হয় নাই।২[********************]

২. আল-মুসনাদ (********************)-  যে সব গ্রন্হে সাহাবীদের হইতে বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁহাদের নামের আক্ষরিক ক্রমিকতার ভিত্তিতে পর পর সংকলিত হয়; কিন্তু ফিকাহর প্রণয়ন পদ্ধতিতে সজ্জিত করা হয় না, সেই সব গ্রন্হ ‘আল-মুসনাদ’ বা ‘আল-মাসানীদ’ নামে পরিচিত। যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীকের বর্ণিত সমস্ত হাদীস উহার বিষয়বস্তু নির্বিশেষে একত্রে লিপিবদ্ধ করা, তাঁহার পর অপর এক সাহাবীর বর্ণিত হাদীস একস্থানে একত্রিত করা।

ইহার সংকলন দুইভাবে হইতে পারেঃ আক্ষরিক ক্রমিকতা সহাকারে, যেমন প্রথমে হযরত আবূ বকরের বর্ণিত হাদীস, তাঁহার পর হযরত উসামা ইবনে যায়দ বর্ণিত হাদীস।

অথবা বর্ণনাকারী সাহাবীর পদমর্যাদার বা বংশ ম র্যঅদার ভিত্তিতেও হাদীসসমূহ সজ্জিত হইতে পারে। যেমন প্রথমে ক্রমিক ধারায় খুলাফায়ে রাশেদুন বর্ণিত হাদীসসমূহ, তাঁহাদের পরে অন্যান্য সাহাবীদের হাদীসসমূহ উল্লেখ করা।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল সংকলিত হাদীস গ্রন্হ এই পদ্ধতিতেই সজ্জিত বলিয়া উহাকে ‘আল-মুসনাদ’ বলা হয়।

৩. আস সুনান (********************)-যেসব হাদীস গ্রন্হে কেবলমাত্র শরীয়াতের হুকুম আহকাম এবং ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মনীতি ও আদেশ-নিষেধমূলক হাদীস একত্র করা হ য়, আর ফিকাহর কিতাবের অনুরূফ বিভিন্ন  অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে সজ্জিত হয়, তাহাই ‘সুনান’ নামে পরিচিত। যেমন সুনানে আবূ দাঊদ, সুনানে নাসায়ী ও সুনানে ইবনে মাজাহ।  তরমিযী শরীফও এক হিসাবে ‘সুনান’ পর্যায়ভুক্ত।

৪. আল-মুজিম (********************)-যেসব হাদীস গ্রন্হে মুসনাদ পদ্ধতিতে এক একজন হাদীসের উস্তাদের নিকট হইতে প্রাপ্ত হাদীস পর্যায়ক্রমে সাজানো হয়, তাহা আল-মু’জিম গ্রন্হ। যেমন তাবারানী সংকলিত তিনখানি গ্রন্হ।

৫. আল-জুয (********************)-যেসব হাদীসগ্রন্হে একজন বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হইবে, সেই ব্যক্তি সাহাবীই হউক, কি তাঁহার পরবর্তী কোন উস্তাদের হাদীস। যেমনঃ ****************************************************** ।[********************]

কিন্তু অপর কতিপয় হাদীস-বিজ্ঞানীর মতে ইহাকে ভ্রৎপ্ট বরা বলা হয় না, বলা হয় ‘আল-মুফরাদ’। তাঁহারেদ মতে ******************** বলা হয় এমন সব গ্রন্হকে যাহাতে একই বিষয় সংক্রান্ত হাদীসসমূহ একত্রিত করা হয়। যেমনঃ ইমাম বুখারীকৃত ******************** ও ******************** ।[********************]

৬. আল-গরীবা (********************)-হাদীসের কোন উস্তাদ যদি তাঁহার বহু সংখ্যক ছাত্রের মধ্য হইতে মাত্র একজনকে বিশেষ কিছু হাদীস লখাইয়া দেন এবং অপর কাহাকেও তাহা না দেন, তবে এইসব হাদীসের সংকলনকে ‘আল-গরীবা’ বলা হইবে।[********************]

৭. আল মুস্তাখরাজাত (********************)- যে কিতাবে উল্লিখিত হাদীসসমূহ (কিংবা উহার অংশ বিশেষ) সংকলিত হয় এবং উহার ‘মতন’ মূল হাদীস ও নিজস্ব সনদ উল্লিখিত হয়, তাহাকে আল-মুস্তাখরাজ বলা হয়। এইরূপ বহু গ্রন্হ বিরচিত হইয়াছে। সহীহ বুখারীর হাদীসসমূ এইভাবে ও এই পদ্ধতিতে অনেকেই আলাদা আলাদা গ্রন্হে সংকলিত করিয়াছেন। তন্মধ্যে ইসমাঈলী, বরকানী, ইবনে আহমদ আল-গাতরিফী, আবূ আবদুল্লাহ ইবনে আবূ যাহল ও আবূ বকর ইবনে মুরদুইয়া প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। [********************] অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমের হাদীসসমূহকেও সংকলন করা হইয়াছে। যাঁহারা করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে হাফেজ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক  আল-ইসফারায়েনী, আবূ জা’ফর ইবনে হামদান, আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে রাজা নিশাপুরী, আবূ বকর আল-জাওকী, আবূ হামেদ শায়েকী, আবুল অলীদ হাসান ইবনে মুহাম্মদ আল কারাশী প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ প্রধাণ।

আর আবূ নয়ীম ইসফাহানী, আবূ আবদুল্লাহ ইবনুল আহজাম, আবূ যার আল-হারভী, আবূ মুহাম্মদ আল-খালাল প্রমুক মুহাদ্দিসগণ বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হের হাদীসসমূহকে একত্রে সংকলন করিয়াছেন।

তবে উপরে যে হাফেজ ইয়াকুবের ‘আল-মুস্তাখরাজ’ গ্রন্হের উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহা যেমন সম্পূর্ণ, তেমনি বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য। ইহা জার্মানীর গ্রন্হাগারে এই সেদিন পর্যন্তও মজুদ ছিল।[********************]

৮. আল-মুস্তাদরাক (********************)।যেসব হাদীস বিশেষ কোন হাদীস গ্রন্হে শামিল করা হয় নাই অথচ তাহা সেই গ্রন্হাকারের অনুসৃত শর্তে পূর্ণমাত্রায় উত্তীর্ণ হয়, তাহা যে গ্রন্হে একত্র করা হয়, তাহাকে ‘আল-মুস্তাদরাক’ বলা হয়। যেমন ইমাম হাফেজ সংকলিত ‘আল-মুস্তাদরাক’[********************]

ইমাম হাকেম বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করিয়া স্বতন্ত্র দুই খণ্ডবিশিষ্ট গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। তাঁহার বিশ্বাস বা ধারণা  এই যে, এই সমস্ত হাদীসই ইমাম বুখারীর হাদীস গ্রহণের শর্তে পূর্ণামাত্রায় উত্তীর্ণ এবং সহীহ কিন্তু বুখারী শরীফে তাহা করা হয় নাই। যদিও হাদীস-বিজ্ঞানীদের মতে ইহাতে বহু যয়ীফ ও মনগড়া (********************) হাদীসও রহিয়াছে।[********************]

এতদ্ব্যতীত বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হকারের শর্তের ভিত্তিতে হাদীস সংগ্রহ করিয়া আর একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন হাফেজ আবূ যায় আবদ ইবনে হুমাইদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (মৃঃ ৪৩৩ হিঃ)।[********************]

৯. কিতাবুল-ইলাল’ (********************)।দোষমুক্ত হাদীসসমূহ এক গ্রন্হে সংকলিত করা হইল ও সেই সঙ্গে হাদীসসমূহের দোষ বা ক্রটিও বর্ণনা করা হইলে উহাকে ‘কিতাবুল-ইলাল’ বলা হয়। ইমাম মুসলিম (র) ও ইমাম হাফেজ আবূ ইয়াহইয়া(র) এই ধরণের গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইমাম যাহবী উল্লেখ করিয়াছেন যে, মুহাদ্দিস শাজীও এই পর্যায়ে এক গুরুত্বপূর্ণূ  কিতাব রচনা করিয়াছেন।[********************]

১০. কিতাবুল আতরাফ (********************)-হাদীসসমূহের এমন কোন অংশের উল্লেখ করা, যাহা হইতে অবশিষ্ট অংশও বুঝা যায়। এইরূপ গ্রন্হকে ‘কিতাবুল আতরাফ’ বলা হয়। ইহাতে হাদীসের সনদ সম্পূর্ণ উল্লেখ করা হয়। এই পর্যায়েও বহু সংখ্যক গ্রন্হ প্রণয়ন করা হইয়াছে। তন্মধ্যে পরবর্তী পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত গ্রন্হদ্বয় উল্লেখযোগ্যঃ

১. ‘আল-আশরাফ আলিা তুহফাতিল আতরাফ’।

২. তুহফাতুল আশরাফ বি-মা’রিফাতিল আতরাফ।[********************]

হাদীস গ্রন্হসমূহের পর্যায় বিভাগ

ইসলামী শরীয়াতের নিয়ম-বিধান ও ইসলামের আদেশ-নিষেধ সবিস্তারে জানিবার একমাত্র উপায় হইতেছে রাসূলের হাদীস। আর রাসূলের হাদীস জানিবারও একমাত্র উপায় হইতেছে রাসূল হইতে শুরু হওয়া বর্ণনাসমূহ যাচাই-বাছাই করা- তাহা স্বয়ং রাসূল হইতে সূচিত কিংবা কোন সাহাবী বা কোন তাবেয়ী হইতে সূচিত হউক না কেন। তবে বর্ণনা ধারার বিশুদ্ধতা, নির্ভূলতা ও অকাট্যতার প্রতি পূর্ণ সজাগ দৃষ্টি অবশ্যই রাখিতে হইবে। আর রাসূলের হাদীসসমূহের বর্ণনা ধারা অনুসন্ধান করা এবং সে সবের যাচাই-বাছাই করার ও বর্তমানকালে সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহ পর্যালোচনা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় থাকিতে  পারে না। কেননা বর্তমনা কালে রাসূলের এমন কোন হাদীসের সন্ধান লাভ ও উহার সনদ সুরক্ষিত ও নির্ভরযোগ্যভাবে পাওয়া= যাহা ইতিপূর্বৈ কোন হাদীষ গ্রন্হেই সংকলিত হয় নাই- একেবারে অসম্ভব ব্যাপার।[********************]

অতঃপর সকল প্রকার হাদীস এবং সে সবের সনদ লাভ করার জন্য একালের সমস্ত মানুষকেই কেবলমাত্র সংকলিত ও সুরক্ষিত হাদীস গ্রন্হসমূহেরই আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে, একান্তভাবে উহারই উপর নির্ভর করিতে হইবে। আর এইজন্য। হাদীসগ্রন্হসমূহ সম্পর্কে আমাদিগকে বিস্তারিত ও সম্যক ধারনা হাসিল করিতে হইবে। জানিতে হইবে সে সবের শ্রেণী, স্থান ও মর্যাদা।

হাদীস গ্রন্হসমূহ প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধতার দিক দিয়া চারটি শ্রেণীতে পর্যায়িত। কেননা হাদীসসমূহই বিভিন্ন পর্যায়ের। সর্বোচ্চ পর্যায়ের হইতেছে সেই সব হাদীস, যাহা বর্ণনা পরম্পরায় পূর্ণ ধারাবাহিকতা সহকারে বর্ণিত (********************) এবং যাহা কবুল করা ও তদানুযায়ী আমল করার ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মত সম্পূর্ণ একমত।

অতঃপর সেই সব হাদীস, যাহা বিভিন্ন সূত্র হইতে বর্ণিত ও প্রাপ্ত, যাহাতে কোন প্রকার সন্দেহ বা সংশয়ের স্পর্শ পর্যন্ত লাগে নাই এবং যাহাকে ভিত্তি করিয়া সমগ্র ফিকাহবিদ আমল করিয়াছেন। অন্তত মক্কা-মদীনার হাদীসবিদগণ যেসব হাদীস সম্পর্কে কোনরূপ মতভেদ প্রকাশ করেন নাই। কেননা এই স্থানদ্বয় খুলাফায়ে রাশেদুনের জীবন যাপন ও কর্মকেন্দ্র, হাদীসের  সকল দেশীয় আলিমগণের ইহা মিলনকেন্দ্র- সব সময়ই তাঁহাদের যাতায়াত রিহয়াছে, এক শ্রেণীর পর পরবর্তী শ্রেণীর মুহাদ্দিসদের অবিচ্ছিন্ন যাতায়াত রহিয়াছে এই কেন্দ্রদ্বয়ে। এই কারণে হাদীসে কোন প্রকার বাহ্যিক দোষ বা ভূল রহিয়াছে বলিয়া কিছুতেই ধারণা করা যায় না। আর সেই হাদীস বিরাট মুসলিম জাহানে প্রখ্যাত ও অনুসৃত হইয়া রহিয়াছে সব সময়ই এবং সাহাবী ও তাবেয়ী পর্যায়েল বিপুল সংখ্যক লোক হইতে তাহা বর্ণিতও হইয়াছে।

ইহার পর হইতেছে সেই সব হাদীসের স্থান, যাহা বিশুদ্ধ প্রমাণিত, যাহার সনদ উত্তম-নির্দোষ, হাদীসবিদগণ সেই সব হাদীস সম্পর্কে এই সাক্ষ্যই দিয়াছেন। উহা পরিত্যক্তও হয় নাই। বরং উহা গ্রন্হে সংকলিত হওয়ার পূর্ব ও পরে সব সময়ই কার্যত অনুসৃত হইয়াছে। হাদীসের ইমামগণ পূর্ব হইতেই উহার বর্ণনা শুরু করিয়াছেন। ফিকাহবিদগণ উহার ভিত্তিতে ফিকাহ রচনা করিয়াছেন, উহার উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করিয়াছেন।

প্রথম পর্যায়ের গ্রন্হ

যেসব হাদীস গ্রন্হ এই দুই ধরণের গুণ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হইবে, তাহা প্রথম পর্যায়ের গ্রন্হ। এইভাবেই পর পর হাদীষ গ্রন্হসমূহের মর্যাদা নির্ধারিত হইবে।

এই দৃষ্টিতে হাদীস গ্রন্হসমূহ যাচাই-পরীক্ষা করিয়া দেখিলে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত হাদীস গ্রন্হের মধ্যে মাত্র তিনখানি কিতাব এই পর্যায়ে গণ্য হইতে পারে। তাহা যথাক্রমে এইঃ (ক) মুয়াত্তা ইমাম মালিক (খ) সহীহ বুখারী ও (গ) সহীহ মুসলিম।[এই সমস্ত কথাই ******************** হইতে গৃহীত।]

এই গ্রন্হত্রয়ে উদ্ধৃত হাদীসসমূহে দুই-তৃতীয়াংশ বর্ণনাকারী (********************) প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত। এই হাদীসসমূহ আইন ও ব্যবহারিক বিষয়াদির সহিত সম্পর্কশীল। আর এক-তৃতীয়াংশ হাদীস হইতেছে তৃতীয় পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের বর্ণিত। চতুর্থ পর্যায়ের কোন বর্ণনাকারীর বর্ণিত কোন হাদীসই এই গ্রন্হত্রয়ে স্থান পায় নাই। সর্বাধিক বিশুদ্ধ, ধারাবাহিক ও অবিচ্ছিন্ন সনদ সম্বলিত হাদীস এ গ্রন্হত্রয়েই সন্নিবেশিত হইয়াছে। মুসলিম জাহানের আলিমগণ এই গ্রন্হত্রয়ের প্রতি যত বেশী ঔৎসুক্য ও শ্রদ্ধা-ভক্তি পোষণ করেন, তত আর কোন গ্রন্হের প্রতিই নহে।[********************]

দ্বিতয় পর্যায়ের গ্রন্হ

এই পর্যায়ে এমন সব গ্রন্হ গণ্য যাহা উপরোল্লিখিত গুণ-বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া মুয়াত্তা ও বুখারীর মুসলিমের সমমর্যাদার নহে। কিন্তু উহার কাছাকাছি নিশ্চয়ই। সে সবের গ্রন্হকারগণ নির্ভরযোগ্য অকাট্যতা, বিশ্বাস-পরায়ণতা, স্মরণশক্তি ও যথাযথভাবে হাদীস বর্ণনা করা এবং হাদীস-বিজ্ঞান সম্পর্কিত সকল সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম জ্ঞানে পূর্ণ পারদর্শিতার দিক দিয়া বিশেষ খ্যাত। তাঁহপাদের গ্রন্হাবলীতে তাঁহারাপ এক বিন্দু উপেক্ষা বা গাফলতির প্রশ্রয় দেন নাই। হাদীস গ্রহণের জন্য যে শর্ত তাঁহারা নিজেরা নির্ধারণ করিয়াছিলেন, প্রত্যেকটি হাদীসকে উহারই সূক্ষ্ম নিক্তিতে ওজন করিয়া করিয়া গ্রহণ ও গ্রন্হাবদ্ধ করিয়াছেন। অতঃপর প্রত্যেক পর্যায়ের মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদগণ উহার যথাযথ গুরুত্ব স্বীকার করিয়াছেন এবং মুসলিম জনগণের মধ্যে উহা ব্যাপক প্রচারও লাভ করিয়াছেন। আলিমগণ উহাদের ব্যাখ্যা করিয়া গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।

এই পর্যায়ে সুনানে আবূ দাঊদ, জামে তিরমিযী ও সুনানে নাসায়ী- এই গ্রন্হত্রয় গণ্য। ইমাম রুজাইন তাঁহার ‘তাজরিদুস সিহাহ’ এবং ইমাম ইবনুল আমীর তাঁহার ‘জামেউল উসূল’ গ্রন্হে এই হাদীসসমূহ সংকলন করিয়াছেন।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল সংকলিত ‘মুসনাদ’ গ্রন্হও এই পর্যায়ে গণ্য বলিয়া মহাদ্দিসগণ উল্লেখ করিয়াছেন।[********************]

প্রথমোক্ত তিনখানি গ্রন্হে তৃতীয় পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস হইতেছে  প্রায় অর্ধেক। অবশিষ্ট  অর্ধেকের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ হইতেছে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের লোকদের বর্ণিত হাদীস। আর এক-তৃতীয়াংশ হইতেছে চতুর্থ পর্যায়েল বর্ণনাকারীদের বর্ণিত। অবশিষ্ট কিতাবসমূহে তৃতীয় পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস অর্ধেকেরও বেশী।

তৃতীয় পর্যায়ের গ্রন্হ

তৃতীয় পর্যায়ের হাদীসের সেইসব গ্রন্হ গণ্য, যাহা বুখারী মুসলিম সংকলিত হওয়ার পূর্বৈ, সমকালে ও পরবর্তী সময়ে গ্রন্হাবদ্ধ হইয়াছে। ইহাতে সহীহ, হাসান, যয়ীফ প্রভৃতি সকল প্রকারের হাদীসই সন্নিবেশিত হইয়াছে। এইসব হাদীস যদিও একেবারে অপরিচিত থাকিয়া যায় নাই; কিন্তু তবুও আলিমদের নিকট তাহা খুবই বেশি খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে নাই। ফিকাহ রচনাকারিগণ সেসব হাদীসের প্রতি খুব বেশী ভ্রূক্ষেপ করেন নাই। মুহাদ্দিসগণও উহার দোষ-ক্রটি সম্পর্কে আলোচনা করার বিশেষ কোন প্রয়োজন বোধ করেন নাই। এই পর্যায়ে এমন সব গ্রন্হ রহিয়াছে, যাহার দুর্বোধ্য ভাষা বা শব্দের দুর্বোধ্যতা বিদূরণের জন্য বিশেষ কোন কাজ করা হয় নাই। কোন ফিকাহবিদ উহাতে সংকলিত হাদীসসমূহকে পূর্ববর্তী ইমামদের মতামতের সহিত মিলাইয়া দেখিবারও প্রয়োজন মনে করেন নাই। কোন হাদীস বিজ্ঞানী উহার অসানঞ্জস্যতা বর্ণনা ও প্রকাশ করার চেষ্টা করেন নাই। কোন ঐতিহাসিক এই হাদীসসমূহের বর্ণনাকারীদের জীবন সম্পর্কে কোন আলোকপাতও করেন নাই। এখানে অবশ্য শেষ যুগের ঐতিহাসিকদের কথা বলা হইতেছে না, বলা হইতেছে প্রাথমিক যুগের ঐতিহাসিকদের কথা। ফলে এই ধরনের গ্রন্হাবলী অপ্রকাশিত ও জনগণে অগোচরীভূত হইয়াই রহিয়া  গিয়াছে।

নিমোক্ত হাদীস গ্রন্হাবলী এই পর্যায়ে গণ্যঃ

১) মুসনাদে আবূ আলী ২) মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩) মুসান্নাফ বকর ইবনে শাইবা ৪) মুসনাদ আবদ ইবনে হুমাইদ ৫) মুসনাদে তায়ালিসী ৬) ইমাম বায়হাকীল গ্রন্হাবলী ৭) ইমাম তাহাভীর গ্রন্হাবলী ৮) ইমাম তাবারানীর গ্রন্হাবলী।

এই গ্রন্হকারদের গ্রন্হ প্রণয়নের মূল একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিল তাঁহাদের প্রাপ্ত হাদীসসমূহ শুধু সংগ্রহ করা। উহাকে সুসংবদ্ধ কিংবা সুষ্ঠুরূপে সজ্জিতকরণ অথবা ব্যবহারোপযোগী করিয়া তোলা তাঁহাদের লক্ষ্য ছিল না।[********************]

এই গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হাদীসসমূহের এক-তৃতীয়াংশেরও অধিক বর্ণনাকারী হইতেছেন তৃতীয় পর্যায়ের এবং এক-তৃতীয়াংশ বর্ণনাকারী চতুর্থ পর্যায়ের। এই গ্রন্হাবলীর মধ্যে কোন কোন কিতাব অপরাপর কিতাব হইতে অপেক্ষাকৃত দুঢ়মূল ও মজবুত বলিয়া মুহাদ্দিসগণের নিকট স্বীকৃত।

চতুর্থ পর্যায়ের গ্রন্হ

এই পর্যায়ের সেই সব হাদীস গ্রন্হ গণ্য, যে সবের গ্রন্হকারগণ দীর্ঘকাল পর  এমন হাদীস সংকলন করিয়াছেন, যাহা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়েল গ্রন্হাবলীতে সন্নিবেশিত হয় নাই। বরং তাহা অপ্রখ্যাত ও অজ্ঞাতনামা গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়া পড়িয়াছিল। উত্তরকালে এই পর্যায়েল গ্রন্হকারগণ এই হাদীসসমূহের মূল্য স্বীকার করিয়াছেন। ইহা এমন সব লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হইত, যাহাদের নিকট হইতে পূর্বকালের মুহাদ্দিস ও হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নকারিগণ তাহা গ্রহণ করিতে ও নিজেদের গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিতে প্রস্তুত হন নাই। কিংবা তাহা উচ্ছৃঙ্খল কি দুর্বল বর্ণনাকারীদের কর্তৃক বর্ণিত হইত, অথবা তাহা সাহাবী কিংবা তাবেয়ীদের উক্তি ছিল; কিংবা তাহা ছিল বনী-ইসরাঈলের কিসসা-কাহিনী, দার্শনিক কিংবা ওয়ায়েজদের কথা, যাহাকে পরবর্তীকালের বর্ণনাকারিগণ ভ্রান্তিবশত রাসূলের হাদীসের সহিত সংমিশ্রিত করিয়া ফেলিয়াছিলেন।

ইবনে হাব্বান ও কামেল ইবনে আদী প্রণীত ‘কিতাবুল যুয়াফা’ খতীব আবূ নয়ীম, ঞ্জইবনে আসাকির, ইবনে নাজ্জার ও দায়লামী রচিত গ্রন্হাবলী এই পর্যায়ে গণ্য। মুসনাদে খাওয়ারিজিমীও এই পর্যায়ের গ্রন্হ বলিয়া মনে হয়।[********************]

পঞ্চম পর্যায়ের গ্রন্হ

এই গ্রন্হাবলীর একটি পঞ্চম পর্যায়ও রহিয়াছে। এই পর্যায়ে সেই সব হাদীস গণ্য যাহা ফিকাহবিদ সূফী ও ঐতিহাসিক প্রমুখদের মুখে মুখে প্রচারিত হইয়াছে। উপরোক্ত চার পর্যায়ের হাদীসের সহিত ইহার কোন সামঞ্জস্য নাই।

বে-দ্বীন, বাক-চতুর লোকদের মনগড়া হাদীসও এই পর্যায়ে গণ্য। ইহারা সেই সব হাদীসের সহিত এমন সনদ বা বর্ণনাসূত্র যোগ করিয়া দিয়াছে যাহাতে কোন প্রকার আপত্তি উত্থাপিত হইতে না পারে। আর এমন সুন্দরভাবে কথাগুলি সাজাইয়া পেশ করিয়াছে যে, রাসূলে করীম (স) এই কথা বলেন নাই তাহা বাহ্যত জোর করিয়া বলা শক্ত।

বস্তুত এই লোকেরাই ইসলামের এক কঠিন বিপদের সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই বিপদের ঘনঘটা ইসলামের সাংস্কৃতিক আকাশকে বেশী দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন করিয়া রাখিতে পারে নাই। হাদীস বিজ্ঞানিগণ সমালোচনার কষ্টিপাথরে এই হাদীসসমূহের যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন, রাসূলের অনুরূপ ভাবধারার হাদীসসমূহের সহিত উহা মিলিয়া দেখিয়াছেন এবং উহার ‘মনগড়া’ হওয়া রহস্য অকাট্যভাবে উদঘাটন করিয়াছেন। ফলে কোন মনগড়া হাদীসই হাদীস পর্যায়ে গণ্য হইবার সুযোগ পাইতে সমর্থ হয় নাই।[********************]

উপরোক্ত আলোচনায় দুইখানি প্রখ্যাত হাদীসগ্রন্হের জন্য কোন পর্যায় উল্লেখ বা নির্ধারণ করা হয় নাই। গ্রন্হদ্বয় হইলঃ (ক) ইবনে মাজাহ (খ) সুনানে দারেমী। এই গ্রন্হদ্বয় কোন পর্যায়ে গণ্য তাহা আলোচনা সাপেক্ষ।

মুহাদ্দিস আবূ হাসান সনদী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

মোটকথা ইবনে মাজাহ মর্যাদার দিক দিয়া প্রধান পাঁচখানি গ্রন্হের পরে ও নিম্নে অবস্থিত।[********************]

আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম ইয়ামানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সুনানে ইবনে মাজাহ আবূ দাঊদ ও সুনানে নাসায়ীর পরবর্তী পর্যায়ের গ্রন্হ। উহার হাদীসসমূহ পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করা আবশ্যক। কেননা উহাতে ফযীলত সংক্রান্ত অধ্যায়ে একটি মওযু হাদীস রহিয়াছে।[********************]

এই সব উদ্ধৃতি হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইবনে মাজাহ তৃতীয় পর্যায়ের হাদীস গ্রন্হ।

সুনানে দারেমী সম্পর্কেও হাদীস বিজ্ঞানিগণ এই মতই প্রকাশ করিয়াছেন। শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলবী (র উহাকে এই তৃতীয় পর্যায়েল গ্রন্হাবলীর মধ্যে গণ্য করিয়াছেন। শাহ ওলীউল্লাহ দেহল্‌বী (র)-রও এই মত।[********************]

হাদীস বর্ণনায় রাসূল (স)-এর নৈকট্য

হাদীস গ্রন্হ-প্রণেতাগণ সাধারণত হাদীষ বর্ণনার এমন সব সূত্রের অনুসন্ধান করিয়াছেন, যাহার মাধ্যমে রাসূলের সহিত নিকটতর সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। অর্থাৎ হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নকারী মুহাদ্দিসগণ রাসূলের নিকট হইতে যত কম সংখ্যক বর্ণনাকারীর মাধ্যমে হাদীস লাভ করিতে পারিতেন তাহার জন্য তাঁহারা বিশেষভাবে চেষ্টা করিতেন। ফলে যে হাদীস যত কম সংখ্যক বর্ণনাকারীর মাধ্যমে গ্রন্হকার পর্যন্ত পৌঁছিত, মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে উহার গুরুত্ব ও মর্যাদা ততই বেশি হইত, ততই তাহা  নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হইত। কেননা হাদীস বর্ণনার সূত্রে মধ্যবর্তী লোক যতই কম হয়, হাদীস গ্রন্হ সংকলনকারীর পক্ষে রাসূলে করীমের ততই নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, হাদীস বর্ণনা পরম্পরা (********************) যতই সংক্ষিপ্ত ও অপেক্ষাকৃত অল্প সংখ্যক বর্ণনাকারী সম্বলিত হয়, তাঁহাদের অবস্থান যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করা ততই সহজসাধ্য হয়। হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ভূল-ভ্রান্তিও ততই কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই দিক দিয়া সমস্ত হাদীস গ্রন্হ প্রণেতার মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর স্থান সর্বোচ্চ। ইহার কারণ এই যে, তিনি অন্তত চারজন সাহাবীল সরাসরি সাক্ষাৎ পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলেন।

হাদীষ বর্ণনা সূত্রে দীর্ঘতা ও স্বল্পতার দিক দিয়া কয়েকটি পরিভাষার উদ্ভব হইয়াছে। এখানে উহাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

‌১. যেসব হাদীস রাসূলে করীম (স) হইতে  গ্রন্হ প্রণয়নকারী পর্যন্ত মাত্র একজন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে পৌঁছিয়াছে, সেইসব হাদীসকে বলা হয় ‘ওয়াহদানীয়াত’ (********************) ‘এক বর্ণনাকারী সম্বলিত হাদীস’।

ইমাম আবূ হানীফা সংকলিত হাদীস গ্রন্হ এই ধরণের কয়েকটি হাদীসই উদ্ধৃত হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে একটি হাদীস উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

******************************************************

আবূ হানীফা বলিয়াছেন, আমি আয়েশা বিনতে আজরাদকে বলিতে শুনিয়াছিঃ নবী (স) বলিয়াছেনঃ আল্লাহর সবচেয়ে অধিক সংখ্যক সৈন্য হইতেছে জুরাদ-(বিশেষ জাতীয় ফড়িং), আমি নিজে উহা খাই না, আর উহাকে হারামও বলি না।[ এই হাদীসটি মুসনাদ আবূ হানীফা ******************** গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীনের ইতিহাস গ্রন্হেও ইহা উদ্ধৃত হইয়াছে ।*******************

উদ্ধৃত হাদীসটি রাসূলের নিকট হইতে আবূ হানীফা পর্যন্ত মাত্র একজন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে পৌঁছিয়াছে। তিনি হইতেছেন হযরত আয়েশা বিনতে আজরাদ নামের একজন মহিলা সাহাবী। এই কারণে এই হাদীসটি ‘ওয়াহদানীয়াত’- এক ব্যক্তির মধ্যস্ততাসম্পন্ন হাদীসের পর্যায়ভুক্ত।

বহু সংখ্যক হাদীস এমন রহিয়াছে, যাহা মাত্র দুই পর্যায়ের বর্ণনাকারীর মাধ্যমেই আবূ হানীফা (র) পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে। তিনি নিজে অপর তাবেয়ীদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন। তাবেয়ী উহা শ্রবণ করিয়াছেন সাহাবীদের নিকট হইতে। হাদীস গ্রন্হ সংকলনকারী পর্যন্ত রাসূলের নিকট হইতে এই হাদীসটি পৌঁছিতে মাত্র দুই স্তরের বর্ণনাকারীর মাধ্যম রহিয়াছে। অতএব পরিভাষার এই হাদীসসমূহে বলা হয় ‘সুনায়ীয়াত (********************)- দুই স্তরের বর্ণনকারী সম্বলিত হাদীস। ইমাম আবূ হানীফা সংকলিত ‘কিতাবুল আ-সা-র’ গ্রন্হে এই ধরনের বহু হাদীসই উদ্ধৃত হইয়াছে। এখানে মাত্র দুইটি হাদীসের সনদ উল্লেখ করা হইয়াছে।

(১)

******************************************************

আবূ হানীফা বলেনঃ আমার নিকট আবূয-যুবাইর, তিনি জাবির ইবনে আবদুল্লাহ হইতে, তিনি রাসূলে করীম (স) হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।.............

এই সনদে বর্ণিত হাদীসটিতে ইমাম আবূ হানীফা ও রাসূলে করীমের মাঝখানে ‘আবুয-যুবাইর তাবেয়ী ও জাবির ইবনে আবদুল্লাহ সাহাবীর মধ্যস্থতা রহিয়াছে।

(২)

******************************************************

আবু হানীফা বলিয়াছেনঃ নাফে আমাদের নিকট ইবনে উমর হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, রাসূলে করীম (স) নিষেধ করিয়াছেন।...........

এই সনদে ইমাম আবূ হানীফা পর্যন্ত রাসূলের হাদীস পৌঁছিতে তাবেয়ী নাফে ও সাহাবী ইবন উমর – এই দুই স্তরের বর্ণনাকারীর মাধ্যমে রহিয়াছে মাত্র।

ইমাম মালিক যেহেতু তাবেয়ী নহেন, তিনি হইতেছেন তাবেয়ীদের পরবর্তী স্তরের লোক-  তাবে-তাবেয়ী, সেই কারণে তাঁহার সংকলিত হাদীসসমূহের অধিকাংশই এই ‘সুনায়িয়াত পর্যায়ভুক্ত। ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম ইবনে  হাম্বল কোন তাবেয়ীরও সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারেন নাই। এই কারণে তাঁহাদের সংকলিত হাদীস প্রায়ই সুলাসীয়াত- তিন স্তরের বর্ণনাকারী সম্বলিত হাদীসের পর্যায়ভুক্ত। সুনানে দারেমী গ্রন্হে পনেরটি হাদীস এমন রহিয়াছে, যাহা তিনি রাসূলের পর তিন স্তরের বর্ণনাকারীর মাধ্যমে শুনিতে পাইয়াছিলেন।[********************]

সিহাহ-সিত্তা প্রণেতাগণের মধ্যে ইমাম বুখারী, ইমাম ইবনে মাজাহ, ইমাম আবূ দাউদ এবং ইমাম তিরমিযীও কোন কোন তাবেয়ীর সাক্ষাৎ পাইয়াছেন; তাঁহাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা, সংগ্রহ ও বর্ণনা করিয়াছেন। এই কারণে সনদের উচ্চতার দিক দিয়া তাঁহারাও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের সামন স্তরে রহিয়াছেন। যদিও ইমাম শাফেয়ীর ইন্তেকালের সময়ে (মৃঃ ২০৪ হিঃ) ইমাম বুখারীর বয়স হইয়াছিল মাত্র দশ বৎসর, ইমাম আবূ দাঊদের ছিল মাত্র দুই বৎসর, ইমাম ইবনে মাজাহ তো তখন পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করেন নাই।[********************] ইহাদের গ্রন্হাবলীতে উপরোক্ত তিন স্তরের বর্ণনাকারী সম্বলিত হাদীসের সনদের সংখ্যা নিম্নরূপঃ

১) সহীহ বুখারী শরীফে ২২টি, ২).সুনানে ইবনে মাজাহ ৫টি, ৩) সুনানে আবূ দাঊদ ১টি ৪) জামে তিরমিযী ১টি।

ইমাম মুসলিম ও ইমাম নাসায়ী সরাসরি কোন তাবেয়ী হইতে হাদীস বর্ণনা করেন নাই। এইজন্য তাঁহাদের বর্ণিত সমস্ত হাদীসই চার স্তরের বর্ণনাকারী সম্বলিত।

হাদীস জালকরণ ও উহার কারণ

হাদীস সংকলনের যে দীর্ঘ ইতিহাস ইতিপূর্বে পাঠকদের সম্মুখে পেশ করা হইয়াছে তাহা হইতে এই কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে যে, হাদীসের উৎপত্তিকাল হইতে গ্রন্হকারে সংকলিত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি স্তরে উহা সংরক্ষণের জন্য সকল প্রকার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হইয়াছে। রাসুলের হাদীস যাহাতে সর্বোত্তমভাবে সংরক্ষিত থাকে, উহাতে কোন প্রকার সংমিশ্রণ না ঘটে এবং উহা বিলীন হইয়া না যায় সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রৃহণে কোন এক স্তরেই এক বিন্দু উপেক্ষা, অসতর্কতা বা গাফিলতির প্রশয় দেওয়া হয় নাই। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, হাদীসের এই দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় এমন এক-একটি অব্স্থা দেখা দিয়াছে, যখন দুষ্ট লোকেরা স্বার্থ কিংবা অসদুদ্দেশ্যে প্রণোদিত হইয়া নিজেদের ‘কথা’কে রাসূলের হাদীস নামে চালাইয়া দিতে চেষ্টা করিয়াছে এবং এমন কিছু কিছু ‘কথা’ রাসূলের বিরাট হাদীস সমুদ্রের সহিত মিশিয়া যাইবার সুযোগ লাভ করিয়াছে।

রাসূলের হাদীস সংরক্ষণের এই অবিমিশ্র ও নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতায় এইরূপ একটি দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটিতে পারিল, তাহা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি তাহা ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ সাপেক্ষও।

আমরা এখানে হাদীস জালকরণের এই ইতিহাস সংক্ষিপ্ত ও ব্যাপকভাবে আলোচনা করিব।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতার পুংখানুপুংখভাবে পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় সর্বপ্রথম হাদীস জালকরণের কাজ প্রখ্যাত ‘খাওয়ারিজ’দের কর্তৃক সূচিত হয়। সিফফীন যুদ্ধে (৩৬ হিঃ) সন্ধিসূত্র লইয়া হযরত আলী (রা)-এর সমর্থকদের মধ্যে মারাত্মক মতভেদ দেখা দেয় এবং তাহারা এই সন্ধিকে মানিয়া লইতে বিন্দুমাত্র রাযী হয় না। অতঃপর তাহারা এক স্বতন্ত্র ধর্মীয় দলের রূপ ধারণ করে।

খাওয়ারিজগণ হাদীস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। তাহারা অন্যান্য লোকের নিকট হইতে কোন কথাকেই সত্যরূপে গ্রহণ করিতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। তাহারা মিথ্যুককে মনে করিত কাফির। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাহারা হাদীস জালকরণের কাজ করিতে ও রাসূলের নামে মিথ্যা প্রচার করিতে শুরু করে। আর ইহার মূলে তাহাদের উদ্দেশ্যে ছিল নিজেদের বিশেষ মতের সমর্থন যোগানো মাত্র।

আল্লামা ইবনুল জাওজী তাঁহার ‘কিতাবুল মওজুআত’ নামক গ্রন্হে ইবনে লাহইয়ার নিম্নোক্ত উক্তির উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

এই হাদীস দ্বীন-ইসলামের অন্যতম ভিত্তি। দ্বীনের এই ভিত্তিগত জিনিস তোমরা  যাহার নিকট হইতে গ্রহণ কর, তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিও। কেননা আমরা যখন যাহা ইচ্ছা করিতাম তখনি উহাকে হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিতাম।

অর্থাৎ এই ব্যক্তি পূর্বে খাওয়ারিজ দলভুক্ত ছিল এবং তখন ইচ্ছামত কথা রাসূলের হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিত। খাওয়ারিজদের কর্তৃক হাদীস জালকরণের গোড়ার কথা ইহাই।

ইহারি পর আমরা শিয়া সম্প্রদায়কেও হাদীস জালকরণ কাজে লিপ্ত দেখিতে পাই। তাহারা আসলে ছিল ইসলামের উৎকট দুশমন। ইসলামের মূল বুনিয়াদের উ পর আঘাত হানিবার অবাধ সুযোগ লাভের কুমতলবে তাহারা শিয়া মতবাদের চরম বিভ্রান্তির আশ্রয় লইয়াছিল। প্রথমে তাহারা কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত চরম বিকৃতি ও কদর্থ প্রবিষ্ট করাইতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাহাতে তাহারা কোন সাফল্য লাভ করিতে পারিবে না মনে করিয়া রাসূলের হাদীসের প্রতি লক্ষ্য আরোপ করে এবং রাসূলের হাদীসের নামে অসংখ্য মিথ্যা কথা চালাইয়া দিতে চেষ্টা করে। তাহারা হযরত আলীর উচ্চ প্রশংসা ও হযরত মুয়াবিয়ার মর্যাদা লাঘবের উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক হাদীস জাল করে। হযরত আলীর স্বপক্ষে এমন অনেক হাদীস তাহারা চালাইয়া দিয়াছে, যাহার কোন কোনটি হইতে হযরত আলীর নবুয়্যাত এবং কোন কোনটি দ্বারা রাসূলের পরে হযরত আলীর খিলাফতের অধিকার প্রমাণিত হয়।

শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বপ্রধান ‘হাদীস রচনাকারী’ হইতেছে মুখতার ইবনে আবূ উবাইদ। তিনি প্রথমে ছিলেন খাওয়ারিজ দলভুক্ত। পরে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সমর্থকদের মধ্যে শামিল হন। আর শেষ পর্যন্ত তিনি সম্পূর্ণ শিয়া মত ধারণ ও শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়া যান। তিনি প্রকাশ্যভাবে হাদীস জাল করিতেন। তিনি যখন কূফার আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সহিত সাক্ষাৎ করেন, তখন জনৈক মুহাদ্দিসকে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার জন্য রাসূলের নামে এমন কিছু হাদীস রচনা করিয়া দাও, যাহা হইতে প্রমাণিত হইবে যে, তিনি (মুখতার) তাহার পরই খলীফা হইবেন।

মুসলমানদের মধ্যে যাহারা দুর্বল ঈমানদার তাহারাও রাসূলের নামে অনেক হাদীস জাল করিতে শুরু করে। তাহারা হযরত আলীর সম্মান লাঘব এবং হযরত আবূ বকর ও হযরত উমরের অধিক মর্যাদা প্রমাণের জন্য ও বহু হাদীস রচনা করে।

হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস জালকরণের এক নূতন ফিতনা জাগ্রত হয়। লোকেরা কিসসা-কাহিনী, মিথ্যঅ ও অমূলক কিংবদন্তী হাদীসের রূপে বর্ণনা পরম্পরা সূত্র সহকারে প্রচার করিতে শুরু করে। এই সময়কার হাদীস রচয়িতাদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থবাদী, কিসসা-কাহিনী বর্ণনাকারী ও গোপনে ধর্মদ্রোহিতাকারী লোকেরাই প্রধান হইয়া দেখা দেয়।[এই দীর্ঘ আলোচনার উৎসঃ ********************]

উপরোক্ত ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, মোটামুটি তিনটি কারণে ইসলামে হাদীস জালকরণের ফিতনার উদ্ভব হয়ঃ

ক) রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজেদের মতের প্রতিষ্ঠা ও প্রাধান্য স্থাপন, নিজেদের আচরিত রাজনৈতিক মতাদর্শকে সপ্রমাণিতকরণ ও জনগণের নিকট উহাকে গ্রহণযোগ্য করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে হাদীস জালকরণ।

খ) জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচার, ওয়ায-নসীহত দ্বারা জনগণকে অধিক ধর্মপ্রাণ বানানো, ইবাদত বন্দেগীতে অধিকতর উৎসাহী বানানো এবং পরকালের ভয়ে অধিক ভীত করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে হাদীস জালকরণ।

গ) ব্যক্তিগত স্বার্থ লাভ উহাকে সহজসাধ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে মনগড়া কথাকে ‘হাদীস’ নামে চালাইয়া দেওয়া।

বিশেষ রাজনৈতিক কারণে হাদীস রচনা করা হয় প্রথমত হযরত আলী (রা)-কে কেন্দ্র করিয়া। নবী করীমের পরে তিনিই যে খলীফা হইবার অধিকারী- অন্য কেহ নয়, এই কথা প্রমাণ করাই এইরূপ হাদীস রচনার উদ্দেশ্য ছিল। এই পর্যায়ের তিনটি জাল হাদীসের দৃষ্টান্ত পেশ করা যাইতেছেঃ

ক) নবী করীম (স) বিদায় হজ্জ হইতে প্রত্যাবর্তনের সময় ‘গাদীরে খাম’ নামক স্থানে যে ভাষণ দান করেন, তাহাতে তিনি হযরত আলীর প্রতি ইশারা করিয়া নিম্নোক্ত কথাও বলিয়াছিলেন বলিয়া প্রচার করা হয়ঃ

(ক)    ******************************************************

এই ব্যক্তিই আমার উত্তরাধিকারী, আমার ভাই, আমার পরে এই-ই খলীফা; অতএব তোমরা সকলে তাহার কথা শোন এবং তাহাকেই মানিয়া চল।

(খ)- ******************************************************

আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ এমন এক পূণ্য যে, ইহা থাকিলে কোন পাপই তাহার ক্ষতি করিতে পারিবে না। পক্ষান্তরে, আলীর প্রতি হিংসা ও শক্রতা পোষণ এমন এক পাপ যে, কোন নেক কাজই তাহাকে কোন ফায়দা দিতে পারে না।

******************************************************

যে ব্যক্তি হযরত আলীর প্রতি হিংসা পোষণ করা অবস্থায় মরিবে, সে হয় ইয়াহুদী কিংবা নাসারা হইয়া মৃত্যুমুখে  পতিত হইবে।

হাদীস নামে প্রচারিত এই বাক্যত্রয় যে কিছুতেই হাদীসে রাসূল হইতে পারে না; বরং ইহা নিছক রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে স্বকপোলকল্পিত তাহা প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝিতে পারা যায়।[********************]

হযরত আলী নবী করীমের উত্তরাধিকারী প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে শিয়াগণ যে কত শত হাদীস জাল করিয়া চালাইয়াছে, তাহার ইয়াত্তা নাই। কিন্তু তাহাদের প্রত্যেকটি কথাই যে সুস্পষ্ট মিথ্যা, তাহা হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস হইতেও প্রমাণিত হয় এবং তাহা সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির অগম্য বিবেচিত হয়।

ইহার বিপরীত দিকে হযরত আবূ বকর ও উমরের অতিরিক্ত প্রশংসায় যেসব জাল হাদীস প্রচার করা হইয়াছে তাহাও অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বিবেচিত হইতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না।

দৃষ্টান্তস্বরূপ এই পর্যায়ের দুইটি হাদীস উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ

******************************************************

আমাকে যখন আকাশের দিকে মি’রাজে লইয়া যাওয়া হইল, তখন আমি বলিলামঃ হে আল্লাহ! আমার পরে আলী ইবনে আবূ তালিবকে খলীফা বানাও। তখন আকাশ-জগত কম্পিত হইয়া উঠিল এবং সর্বদিক হইতে ফেরেশতাগণ অদৃশ্য ধ্বনি করিয়া উঠিলেনঃ হে মুহাম্মদ! আল্লাহর এই আয়াত পাঠ কর, (যাহার অর্থ) তোমরা কিছু চাহিতে পারিবে না, আল্লাহ যাহা চাহিবেন তাহাই হইবে। আর আল্লাহ ইচ্ছা করিয়াছেন যে, তোমার পরে আবূ বকর সিদ্দীকই খলীফা হইবে।

******************************************************

বেহেশতের প্রত্যেকটি বৃক্ষের প্রত্যেকটি পত্রে লিখিত আছেঃ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, আবূ বকর, উমর ফারুক ও উসমান যুন্নুরাইন।

হযরত মুয়াবিয়ার প্রশংসায়ও হাদীস জাল করা হইয়াছে। যেমনঃ

******************************************************

তোমরা যখন মুয়াবিয়াকে আমার মিম্বারে দাঁড়াইয়া খুতবা দিতে দেখিবে, তখন তাঁহাকে তোমরা গ্রহণ করিও, কেননা সে বড়ই বিশ্বস্ত-আমানতদার ও সুরক্ষিত।

এইভাবে জনগণের মধ্যে ভিত্তিহীন ও নিতান্ত অমুলক অনেক কথাই রাসূলের হাদীস নামে প্রচার করা হইয়াছে। এখানে এই পর্যায়ের আরো তিনটি কথা উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

(ক)****************************************************** - জন্মভূমির প্রেম ঈমানের অংশ।

(খ)******************************************************- হে মুহাম্মদ! তোমাকে যদি সৃষ্টি করিতে না হইত, তাহা হইলে এই আকাশমণ্ডল ও জগতই সৃষ্টি করিতাম না’।

(গ)******************************************************- আলী ইবনে আবূ তালিবের জন্য অস্তমি সূর্যকে পুনরুত্থিত করা হয়।[আহমদ ইবনে হাম্বল বলিয়াছেনঃ ******************** এই হাদীসের কোন ভিত্তি নাই। ইবনে জাওজী দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ ******************** “ইহা হাদীস নয়, রচিত কথা। অবশ্য ইমাম সয়ূতী ও তাহাভী সহীহ বলিয়া দাবি করিয়াছেন। ********************]

এই তিনটি কথাই হাদীসরূপে সমাজে প্রচারিত হইয়াছে এবং ওয়াজকারীদের মুখে মুখে ব্যাপক প্রচার লাভ করিয়াছে। কিন্তু প্রকৃতপকেষ এই তিনটি কথাই সম্পূর্ণ মিথ্যা- জাল।

হাদীস জালকরণের প্রতিরোধ ব্যবস্থা

খাওয়ারিজগণ প্রথমত নিজেদের গরজে হাদীস জাল করিতে শুরু করিলেও ইহা বেশী  দূর চলিতে পারে নাই। খাওয়ারিজদের নিজস্ব আকীদা বিশ্বাসই তাহাদিগকে এই পথে বেশী দূর অগ্রসর হইতে দেয় নাই।

১. খাওয়ারিজদের আকীদা ছিলঃ যে লোক মিথ্যাবাদী যে কাফির! ফলে তাহাদের মধ্যে মিথ্যা কথা ও হাদীস জালকরণের প্রবণতা আপনা হইতেই খতম হইয়া যায়।

২. খাওয়ারিজগণ ছিল বেদুঈন, স্বভাবত কঠোর ও রূঢ় প্রকৃতির। তাহারা অন্যান্য জাতি বা গোত্রের কোন কথা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত ছিল না। এই কারণে পারস্যবাসী ও ইয়াহুদীদের- যাহারা প্রধানত শিয়া মত গ্রহণ করিয়াছিল ও জাল হাদীস রচনা করিয়াছিল- কোন কথাই তাহাদের নিকট কোন গুরুত্ব লাভ করিতে পারে নাই।

৩. খাওয়ারিজগণ প্রতিপক্ষের সহিত লড়াই করার ব্যাপারে তাহাদের নিজেদের বীরত্ব, শক্তি-সামথ্য ও অস্ত্রশসস্ত্রের উপর অধিক নির্ভরশীল ছিল। এইজন্য তাহারা মিথ্যা কথার আশ্রয় ******************** লইতে কখনো প্রস্তুত হয় নাই। আর প্রতিপক্ষকে তাহারা কাফির মনে করিত বলিয়া মিথ্যার আশ্রয় লওয়ার কোন প্রয়েঅজন বোধ করে নাই। কেননা কাফিরদিগকে দমন করার জন্য তরবারির ব্যবহার ভিন্ন অন্য কোন হাতিয়ার ব্যবহার করা যায় বলিয়া তাহারা মনেই করিত না।

এই তিনটি কারণেই অন্যান্য ফাসাদ ও বিপর্যয়কারী উপদল অপেক্ষা খাওয়ারিজ দের দ্বারা খুব কম সংখ্যকই জাল হাদীস রচিত হইয়াছে। আর যে দুই চারটি হাদীস তাহারা জাল করিয়াছে, ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ মুসলিম সমাজ তাহা সহজেই চিনিতে ও উহা প্রত্যাহার করিতে সমর্থ হইয়াছে। ফলে এই পর্যায়ে হাদীস জালকরণের কাজ যতটুকুই হইয়াছে তাহা তেমন কোন বিপদের কারণ হইয়া দেখা দেয় নাই।

কিন্তু পরবর্তীকালে শিয়া সম্প্রদায়ের রচিত হাদীসসমূহ মুসলিম সমাজে মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব করে। অবশ্য আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহ এই পর্যায়ে মুসলিমদের ঈমান ও দ্বীন রক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করিয়া দেয়। খাওয়ারিজ, শিয়া ও তাহাদের মত অন্যান্য ভ্রান্ত ও অসৎ প্রকৃতির দল-উপদল ছিল একদিকে- ইসলামের মূলোৎপাটনে আত্ম নিয়োজিত; কিন্তু ইহার বিপরীত দিকে অচলায়তন হইয়া দাঁড়াইয়াছিল সুসংবদ্ধ মুসলিম সমাজ ও ইসলামী জনতা। তাহাদিগকে খাওয়ারিজ ও শিয়াদের ভ্রান্ত মতবাদ ও অমূলক প্রচারণা কিছুমাত্র প্রভাবান্বিত করিতে পারে নাই। বরং তাঁহারা অত্যন্ত দৃঢ়তাসহকারে কুরআন ও সহীহ হাদীসকে আঁকাড়াইয়া ধরিয়া থাকে। সেই সঙ্গে তাঁহারা বিশুদ্ধ ও সহীহ হাদীসসমূহের ব্যাপক শিক্ষা দান ও প্রচারে নিযুক্ত হন। এই সময় পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক সাহাবী বাচিঁয়াছিলেন, তাঁহাদের সঙ্গে ছিল উহাদেরই সর্বপ্রযত্নে তৈরী করা ইসলামী জ্ঞানে দীক্ষিত তাবেয়ীনের এক বিরাট জামা’আত। তাঁহারা সকলেই সমবেতভাবে হাদীস জালকরণের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিয়াছেন, ইসলামের স্বচ্ছ  বিধানে গোলক ধাঁধা সৃষ্টির সকল ষড়যন্ত্রের জাল তাঁহারা ছিন্ন ভিন্ন করিয়া দেন এবং মিথ্যাবাদীদের মিথ্যাকে একটি একটি করিয়া জনসমক্ষে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়া ধরেন।

এই সময় মুসলিম সমাজ ‘হাদীস’ নামে কোন কথা গ্রহণের ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন হইয়া উঠে। কেবলমাত্র বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হইলেই কোন কথাকে হাদীস বলিয়া গ্রহণ করিতে তাঁহারা আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। বরং তাঁহারা উহার সনদ সূত্রকে যাচাই করিতে শুরু করেন, উহাতে উল্লিখিত প্রত্যেকটি ব্যক্তি চরিত্র, তাকওয়া, ইলম, স্মরণশক্তি ও বর্ণনাকারীদের পারস্পরিক সাক্ষাৎ সম্পর্কে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে খোঁজ-খবর লইতে শুর করেন।

ইমাম মুসলিম সহীহ মুসলিমের ভূমিকায় [১১ পৃষ্ঠা] ইবনে সিরিন তাবেয়ীর এই উক্তিটি উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

মুসলমানগণ পূর্বে হাদীসের সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেন না, কিন্তু পরে যখন ফিতনা ও বিপর্যয় দেখা দেয়, তখন তাঁহারা বলিতে শুরু করেনঃ বর্ণনাকারীদের নাম বল, তাহাদের মধ্যে যাহারা আহলে সুন্নাত, তাহাদের নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করা হইবে; আর যাহারা বিদয়াতপন্হী, তাহাদের বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যান করা হইবে।

এইভাবে তাবেয়ী মুহাদ্দিসগণ সাহাবীদের নিকট হাদীস বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেন। ভাল-মন্দের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য করা ও অন্ধভাবে সব কথা গ্রহণ না করাই ছিল এই জিজ্ঞাসাবাদের মূল উদ্দেশ্য।

এই সময় গোটা মুসলিম সমাজ হাদীসের ব্যাপরে অত্যন্ত কঠিন ও অনমনীয় হইয়া উঠে। মিথ্যা কথা প্রচারকারী লোক হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে মসজিদে সাহাবীদের  নিকট  আসিয়া বসিত, তখন সাহাবিগণ তাহাদিগকে কঠোর ভাষায় ভৎসনা করিতেন ও মসজিদ হইতে বিতাড়িত করিয়া দিতেন। অনেক সময় এই ধরনের লোকদিগকে তাড়াইবার জন্য পুলিশের সাহায্যও গ্রহণ করা হইত।

একবার একজন কিসসা-কাহিনী বর্ণনাকারী ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর নিকটে আসিয়া বসে। তিনি তখন তাহাকে সেখান হইতে উঠিয়া যাইতে বলেন। কিন্তু সে উঠিয়া যাইতে অস্বীকার করে। তখন হযরত ইবনে উমর (রা) পুলিশ ডাকিয়াপাঠান ও তাহার সাহায্যে তাহাকে বিতাড়িত করেন।

এই ধরনের অনেক ঘটনারই উল্লেখ পাওয়া যায় হাদীসের কিতাবসমূহে। তাহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবী ও তাবেয়ীনের যুগে হাদীস জালকারী ব্যক্তিগণ সাধারণ্যে পরিচিত ও চিহ্নিত ছিল। তাঁহারা ইহাদের শয়তানী তৎপরতা ধরিয়া ফেলিতেন, ফলে জনসাধারণ তাহাদের বিভ্রান্তির জালে কখনোই জড়াইয়া পড়িতে পরিত না।

এই সময়কার হাদীসবিদগণ কেবল মিথ্যাবাদী ও হাদীস জালকারীদের ষড়যন্ত্র জাল ছিন্ন করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই; বরং এই গ্রন্হের পূর্ববর্তী আলোচনা প্রমাণ করে যে, এই সময় অপর দিকে তাঁহারা সহীহ হাদীসসমূহ নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংগ্রহ ও সংকলনের কাজেও পূর্ণরূপে আত্মানিয়োগ করিয়াছিলেন।[********************]

 শুধু তাহাই নয়, এই সময় হাদীস সমালোচনা করা এবং যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া প্রত্যেকটি হাদীস গ্রহণের জন্য স্থায়ী মানদণ্ডও নির্ধারিত হয়। ইহার ফলেই হাদীস সমালোচনা-বিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়।

হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞানের উৎপত্তি

উপরে যে হাদীস জালকরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হইয়াছে, উহারই প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে এক স্বতন্ত্র হাদীস-বিজ্ঞান রচিত হয়। উহাকে (******************************************************

) –‘হাদীস জালকারণ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা’ বলা হয়। এই জ্ঞানের সংজ্ঞা দান প্রসঙ্গে নওয়াব সিদ্দীক হাসান লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস জালকরণ সম্পর্কিত ইলম এমন এক প্রকারের বিজ্ঞান, যাহা দ্বারা কোন হাদীসটি জাল এবং কোনটি প্রমাণিত-প্রতিষ্ঠিত তাহা জানিতে ও চিনিতে পারা যায় এবং উহা দ্বারা জালকারীর অবস্থাও জানা যায় যে, সে উহা সত্য বলিয়াছে, না মিথ্যা। এই বিশেষ জ্ঞানের উদ্দেশ্য হইতেছে সত্য ও মিথ্যা হাদীস এবং সত্য বর্ণনাকারী ও মিথ্যা বর্ণনাকারীর মধ্যস্থিত পার্থক্য বুঝিবার প্রতিভা ও যোগ্যতা অর্জন। এই জ্ঞানের লক্ষ্য ও ফায়দা এই যে, ইহার সাহায্যে এই ধরনের মিথ্যা ও জাল হাদীস হইতে আত্মরক্ষা করা সম্ভব হয়। অথবা হাদীসটি বর্ণনা করার সঙ্গে সঙ্গে উহা যে জাল তাহাও বলিয়া দেওয়া সম্ভব হয়। হাদীসের ক্ষেত্রে ইহা অত্যন্ত জরুরী ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান। কেননা নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি আমার প্রতি কোন মিথ্যা কথা আরোপ করে, যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় বানাইয়া লয়।[********************]

এইরূপ জ্ঞানের উৎপত্তি হওয়ার ফলে সকল প্রকার জাল হাদীস হএত মুসলিম সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব হইয়াছে। এই পর্যায়ে হাদীসজ্ঞান সম্পর্কে পারদর্শী মনীষিগণ অভাবিতপূর্ব ও অতি প্রয়োজনীয় এবং বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয় দান করিয়াছেন। মনীষিগণ এমন অনেক নীতিগত (theoritical) নিয়ম-নীতি রচনা করিয়া দিয়াছেন, যাহার সাহায্যে মওজু বা জাল হাদীস অতি সহজেই চিনিতে পারা যায়। এইজন্যই তাঁহারা কতকগুলি লক্ষণ ও চিহ্নিত করিয়া দিয়াছেন। সেই সব লক্ষণ যে সব হাদসে পরিলক্ষিত হইবে, সে সবের জাল হওয়া সম্পকে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকিবে না।

আর দ্বিতীয়পন্হা হইতেছে practical- ব্যবহারিক ও বাস্তবঃ এই পর্যায়ে তাঁহারা হাদীস জালকরণে অভ্যস্ত লোকদের বিস্তারিত পরিচয় জনসমক্ষে পেশ করিয়া দিয়াছেন। জনগণের সহিত তাহাদিগকে সবিস্তারে পরিচিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং তাহাদের মনগড়াভাবে রচিত ও মিথ্যা-মিথ্যি প্রচারিত ‘হাদীসসমূহ’ও সকলের সম্মুখে উপস্থাপিত করা হইয়াছে।

মনীষিগণ এই পর্যায়ে বহুসংখ্যক মূল্যবান গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। এই গ্রন্হাবলী ‘কিতাবুল মওজুয়াত’ নামেই পরিচিত। একদিকে যেমন রাসূলে করীম (স)-এর প্রকৃত হাদীসসমূহ সহীহ, জামে, সুনান ও মুসনাদ প্রভৃতি ধরনের হাদীস গ্রন্হাবলীতে সন্নিবদ্ধ ও সুসংকলিত হইয়াছে, অপরদিকে তেমনি মিথ্যা ও রচিত হাদীসসমূহ হাদীসবিদ আলিমের নিকট স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। ফলে প্রকৃত হাদীস ও উহার মর্যাদা জানিয়া লওয়া উহা ‘সহীহ’ কিংবা ‘হাসান’ বা যয়ীফ কিংবা মওজু তাহা চিনিতে পারা খুবই সহজ হইয়া পড়িয়াছে। হাদীস-বিজ্ঞানীদের এই অবদান ইসলামী জ্ঞান-চর্চার ইতিহাসে চির উজ্জ্বল হইয়া থাকিবে।

জাল হাদীসের কয়েকটি লক্ষণ

পূর্বেই বলিয়াছি জাল হাদীস চিনিয়া লইবার জন্য মনীষিগণ এমন সব নিয়ম নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, যাহা বাস্তবিকই অব্যর্থ ও সর্বতোভাবে নির্ভরযোগ্য। কেননা হাদীস সমালোচনা ও যাচাই পরীক্ষা করার সুদৃঢ় ও তীক্ষ্ণ জ্ঞান এবং প্রতিভা তাঁহাদের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বর্তমান ছিল। এখানে আমরা কয়েকটি নিয়মের উল্লেখ করিতেছিঃ

১. জাল হাদীস বর্ণনাকারীর মধ্যে এমন লক্ষণ দেখা যায়, যাহার ভিত্তিতে সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, বর্ণনাকারী সম্পূর্ণ মিথ্যঅ কথা রচনা করিয়া রাসূলের হাদীস হিসাবে চালাইয়া দিয়াছে।

এখানে দুইটি জাল হাদীসের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিয়া কথাটিকে স্পষ্ট করিয়া তুলিতে চেষ্টা করা যাইতেছেঃ

(ক) সাইন ইবনে উমর তামামী বলেন, আমি সায়াদ ইবনে জরীফের নিকট উপস্থিত ছিলাম। এই সময় তাহার পুত্র একখানি কিতাব হাতে লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে উপস্থিত হইল। জিজ্ঞাসা  করিলঃ তোমার কি হইয়াছে? পুত্র বলিলঃ আমাকে শিক্ষক মারিয়াছেন। তখন সে বলিলঃ ‘আমি আজ তাহাকে নিশ্চয়ই লজ্জিত করিব’। ইবনে  আব্বাস হইতে ইকরামা রাসূলের এই কথাটি বর্ণনা করিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমাদের বালকদের শিক্ষকগণ তোমাদের মধ্যে অধিক দুষ্ট লোক, ইয়াতীম ছেলেদের প্রতি তাহারা খুবই কম দয়াশীল এবং মিসকীনের প্রতি অন্যন্ত কঠোর।

(খ) মা’মুন ইবনে আহমদ আল হারাভীকে লক্ষ্য করিয়া একজন বলিলঃ শাফেয়ী ও তাঁহার খুরাসানী অনুসরণকারীদের সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? নবী করীম (স) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ

******************************************************

‘আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি হইবে, যাহার নাম হইবে মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস। সে আমার উম্মতের পক্ষে ইবলীস হইতেও ক্ষতিকর। আমার উম্মতের মধ্যে আর এক ব্যক্তি হইবে, যাহার নাম আবূ হানীফা, সে আমার উম্মতের জন্য প্রদীপস্বরূপ।

এই হাদীস দুইটির বর্ণনাকারী যে স্বার্থ ও হিংসা-প্রণোদিত হইয়া রাসূলের নামে মিথ্যা কথাকে হাদীস বলিয়াচালাইয়া দিয়াছে তাহা বুঝিতে একটুও কষ্ট হয় না।

২. বর্ণিত হাদীসের মধ্যে এমন  লক্ষণ পাওয়া যায়, যাহা হাদীসটির জাল হওয়ার কথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে। যেমন হাদীসের মূল কথায় এমন কোন শব্দের উল্লেখ থাকা, যাহার অর্থ অত্যন্ত হাস্যকর কিংবা শব্দ ও অর্থ উভয়ই বাচালতাপূর্ণ। কেবল শব্দটি যদি হাস্যকর হয় তাহা হইলেই হাদীসটি জাল হইবে এমন কথা সাধারণভাবে বলা যায় না। কেননা হাদীসটি হয়ত মূল অর্থের দিক দিয়া সহীহ, কিন্তু উহার কোন পরবর্তী বর্ণনাকারী শব্দে কিছুটা পরিবর্তন সূচিত করিয়া নিজের ইচ্ছামত কোন শব্দ বসাইয়া দিয়াছে। অথচ মূলতঃ হাদীসটি রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণিত। তবে বর্ণনাকারী যদি এই দাবি করেন যে, হাদীসের ভাষা ও শব্দসমূহ সবই রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণিত, তাহা হইলে তাহাকে মিথ্যাবাদী না বলিয়া উপায় নাই। কেননা, নবী করীম (স) ছিলেন আরবদের মধ্যে অত্যন্ত শুদ্ধ ও মিষ্টভাষী। এইরূপ অবস্থায় হাদীসের একটি শব্দও যদি হাস্যকর বা হালকা ধরনের হয় তাহা অবশ্যই জাল এবং মিথ্যা হইবে।[********************]

হাস্যকর অর্থ সম্বলিত একটি জাল হাদীস এইরূপঃ

******************************************************

তোমরা মোরগকে গালাগালি করিও না, কেননা উহা আমার বন্ধু।[এই গোটা হাদীসটি জাল হইলেও উহার প্রথম অংশ রাসূলেরই কথা। আবূ দাউদ উত্তম সনদে উহা উদ্ধৃত করিয়াছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ  ******************** মোরগকে গাল দিও না, কেননা উহা নামাযের জন্য সজাগ করে। ********************]

ইহা নবী করীম(স)-এর কথা হইতে পারে না, তাহা কে-না বুঝিতে পারে?.

৩. হাদীস জাল হওয়ার আল একটি লক্ষণ হইতেছে উহার স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেকের বিপরীত হওয়া। হাদীস যদি স্বাভাবিক বুদ্ধি ও বিবেকের বিপরীত হয় এবং উহার গ্রহণযোগ্য কোন তাৎপর্য দান সম্ভব না হয়, অথবা উহা যদি সাধারণ অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণের বিপরীত হয়, তবে তাহাও জাল বলিয়া প্রতিপন্ন হইবে। যেমন দুই বিপরীত জিনিসকে একত্র করার সংবাদ দান; কিংবা সৃষ্টি কর্তাকে অস্বীকারের কোন কথা। কেননা শরীয়াতের কোন বিধান স্বাভাবিক ও সুষ্থ বিবেকবুদ্ধির বিপরীত হইতে পারে না।

একটি জাল হাদীস এইরূপঃ

******************************************************

আল্লাহ অশ্ব সৃষ্টি করিলেন। উহাকে চালাইলেন। ফলে উহার খুব ঘাম বাহির হইল। অতঃপর উহা হইতে তিনি নিজেকে সৃষ্টি করিলেন।

কোন সুস্থ বুদ্ধির লোক-ই কি এইরূপ হাস্যকর কথা বলিতে পারে?

দ্বিতীয়টি এইরূপঃ

******************************************************

‘বাজেঞ্জান বেগুন সকল প্রকার রোগের ঔষধি’।

ইহা সম্পূর্ণ বাতিল ও ভিত্তিহীন কথা। কেননা পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হইয়াছে যে, বাজেঞ্জান রোগের মাত্রা বৃদ্ধি করে ও উহাকে কঠিন করিয়া দেয়। এই হাদীসটি (?) শুনিলেই সাধারণ বুদ্ধি (common sense) বলিয়া উছে, ইহা মিথ্যা।[********************]

৪. হাদীস যদি ক কুরআনের স্পষ্ট বিধানের কিংবা মুতাওয়াতির হাদীস বা অকাট্য ধরনের ইজমার বিপরীত হয়, তবে তাহাকে জাল বা মওজু মনে করিতে হইবে।[********************]

 এই দৃষ্টিতেই যেসব হাদীসে দুনিয়ার অবশিষ্ট আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হইয়াছে সাত হাজার বৎসর, সে সবকে মিথ্যা বলিয়া  ঘোষণা ক রা হইয়াছে। কেননা তাহা কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের বিপরীত। আল্লাহা তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে নবী! লোকেরা তোমার নিকট জিজ্ঞাসা করে কিয়ামত কখন কায়েম হইবে। তুমি বলিয়া দাও যে, এ সম্পর্কিত জ্ঞান কেবলমাত্র আমার আল্লাহরই আয়ত্ত, তিনিই উহা উহার সঠিক সময়ে উঘাটিত করিবেন।[********************]

হাদীসবিদ নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটিকে বাতিল ও মওজু ঘোষণা করিয়াছেন।[********************]

******************************************************

অবৈধ সন্তান বেহেশতে প্রবেশ করিতে পারিবে না।

কেননা উহা কুরআনের নিম্নোক্ত স্পষ্ট ঘোষণার বিপরীত। আল্লাহ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কোন বোঝা বহনকারীই অপর কাহারো (পাপের) বোঝা বহন করিবে না।[********************]

এইভাবে যেসব ‘হাদীস’ এই ধরনের অর্থ প্রকাশ করে যে, যাহার নাম আহমদ কি মুহাম্মদ সে কখনো দোযখে যাইবে না। কেননা এ কথা সর্বজনবিদিত যে, কেবলমাত্র নাম বা উপনাম কি উপাধি কখনই দ্বীন পালনের প্রয়োজন পূর্ণ করিতে পারে না। অতএব কেবল নাম বা উপনাম উপাধির সাহায্যেই কেহ দোযখ হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে না। তাহা রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় হইতেছে ‘আমালুস সালেহ’- নেক আমল।

৫. যেসব হাদীসে বিপুল সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত কোন ঘটনার উল্লেখ থাকে; কিন্তু তাহা না সাহাবীদের যুগে ব্যাপক প্রচার লাভ করিতে পারিয়াছে, না অল্প সংখ্যক লোক ব্যতীত অপর কেহ তাহার বর্ণনা করিয়াছে। এইরূপ হাদীস যে জাল, তাহাতে সন্দেহ নাই। এক শ্রেণীর শিয়াদের নিম্নোক্ত দাবিটিও এই পর্যায়ের জাল হাদীসঃ

******************************************************

বিদায় হজ্জ হইতে প্রত্যাবর্তনের সময় গদীরে খাম-এর এক লক্ষেরও অধিক সাহাবীর উপস্থিতিতে নাবী করীম (স) হযরত আলী (রা)-কে খিলাফত দান করিয়াছিলেন।

দাবি করা হইয়াছে যে, বিপুল সংখ্যক- এক লক্ষেরও অধিক সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতিতে নবী করীম (স) হযরত আলী (রা)-কে খিলাফত দান করিয়াছিলেন; কিন্তু সাধারণভাবে সাহাবীগণ ইহার কোন গুরুত্বই দিলেন না, নবী করীমের ইন্তেকালের পরে খলীফা নির্ধারণের সময়ে এই কথা কোন সাহাবীর স্মরণই হইল না, ইহা এক অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই ইহা সম্পূর্ণ স্বকপোলকল্পিত।

৬. সাধারণ যুক্তি ও সুস্থ বিবেক-বিরোধী কোন কথা কোন হাদীসে উল্লিখিত হইলেও তাহাকে জাল মনে করিত হইবে। যেমন হাদীস বলিয়া পরিচিত  একটি কথায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

******************************************************

না তুর্কিদের জুলুম ভালো, না আরবদের সুবিচার।

কেননা জোর জুলুম সাধারণভাবেই নিন্দিত, যেমন সুবিচার সকল অবস্থায়ই প্রশংসনীয়।

৭. হাদীসের বর্ণনাকারী যদি রাফেযী মতাবলম্বী হয় এবং হাদীসে যদি রাসূলের বংশের লোকদের ফযীলত বর্ণিত হয়, বুঝিতে হইবে যে তাহা জাল। কেননা রাফেযী মতের লোকেরা সাধারণতই রাসূলের বংশের লোকদের অমূলক প্রশংসায় এই ধরনের কথা রাসূলের নামে চালাইয়া দিতে এবং সাহাবীদের গালাগাল ও কুৎসা বর্ণনায় অভ্যস্ত। বিশেষতঃ তাহারা প্রথম দুই খলীফার প্রতি রীতিমত শক্রতা পোষণ করে এবং তাঁহাদিগকে খিলাফতের ব্যাপারে হযরত আলীর অধিকার হরণকারী বলিয়া মনে করে।

৮. কোন হাদীসের উল্লেখিত ঘটনা যদি বিশুদ্ধ নির্ভরযোগ্য ও সপ্রমাণিত ইতিহাসের বিপরীত হয়, তবে বুঝিতে হইবে যে, তাহা নিঃসন্দেহে জাল। যেমন এক হাদীসে বলা হইয়াছে যে, খায়বারবাসীদের উপর হইতে জিযিয়া প্রত্যাহার করা হইয়াছিল হযরত সায়াদ ইবনে মুয়ায- এর শাহাদাতের কারণে। ইহা প্রকৃত ইতিহাসের বিপরীত কথা। কেননা হযরত সায়াদ খন্দক যুদ্ধে শহীদ হইয়াছিলেন এবং তাহা খায়বার যুদ্ধের পূর্বে অনুষ্ঠিত ঘটনা। দ্বিতীয়তঃ ‘জিযিয়া’ খায়বার যুদ্ধকালে বিধিবদ্ধও হয় নাই, বরং তাবুক যুদ্ধের পূর্বে তাহা সাহাবীদের নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিতই ছিল। তৃতীয়তঃ উহাতে বলা হইয়াছে যে, উহা মুয়াবিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ান লিখিয়াছেন। অথচ মুয়াবিয়া তো মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম কবুল করিয়াছিলেন। খায়বার যুদ্ধকালে তিনি মুসলমানই ছিলেন না।

৯. কেহ যদি আল্লাহর নির্ধারিত সাধারণ আয়ূষ্কালের অধিক আয়ূ লাভের দাবি করে এবং বহু পূর্বকালে অতীত কোন ব্যক্তির সাক্ষাত লাভ করিয়াছে বলিয়া প্রচার করে, বুঝিতে হইবে যে, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যেমন রতনহিন্দীস দাবি করিয়াছে যে, নবী করীম (স)- এর সাক্ষাৎ পাইয়াছে। অথচ এই ব্যক্তি ব্যক্তি জীবিত ছিল ছয়শত হিজরী সনে। জাহেল লোকদের ধারণা এই যে, এই ব্যক্তি  নবী করীমের সহিত একত্রিত হইয়াছিল, তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছে এবং রাসূল তাঁহার দীর্ঘায়ু লাভের জন্য দোয়া করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ এইরূপ দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কেননা নবী করীম (স)- এর সহিত সাক্ষাৎপ্রাপ্ত সাহাবাগণের অধিকাংশই ঊনষাট হিজরী সনের পূর্বেই অন্তর্ধান করেন। তখন কেবলমাত্র হযরত আবূত-তোফাইল জীবিত ছিলেন। আর তিন যখন ইন্তেকাল করেন, তখন লোকেরা এই বলিয়া কাঁদিয়াছিলঃ

******************************************************

নবী করীমের সাক্ষাৎপ্রাপ্ত লোকদের মধ্যে ইনিই সর্বশেষ ব্যক্তি।

১০. সূফীগণ রাসূলের নিকট হইতে কোন ধারাবাহিক সনদ সূত্র ব্যতীত কাশফ বা স্বপ্নযোগে হাদীস লাভ করিয়াছেন, এইরূপ দাবিও সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। দ্বীন-ইসলামের সকল আলিমই এই সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত যে, স্বপ্ন বা কাশফ এর সূত্রে শরীয়াতের কোন সত্য প্রমাণিত হয় না। কেননা তাহা আদৌ নির্ভরযোগ্য নহে। উহা বরং শরীয়াতের মূল বিধানের উপর অমূলক বাড়াবাড়ি মাত্র। কুরআন এবং ধারাবাহিক ও বিশুদ্ধ সনদসূত্রে বর্ণিত হাদীস ব্যতীত শরীয়াতের তৃতীয় কোন ভিত্তি নাই, আছে বলিয়া কেহ মনে করিলেও তাহা মিথ্যা এবং প্রত্যাখ্যানযোগ্য।[এই পর্যন্তকার দীর্ঘ আলোচনা গৃহীত হইয়াছে ******************** গ্রন্হের ৪৭৯-৪৮৫ পৃষ্ঠা হইতে এবং ******************** হইতে সাহায্য গ্রহণ করা হইয়াছে।]

হাদীস সমালোচনার পদ্ধতি

হাদীস-সমালোচনা বিজ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা জাল হাদীস চিনিবার বিভিন্ন উপায়ের উল্লেখ করিয়াছি। হাদীস জালকরণের এই পরিস্থিতিতে সূক্ষ্ম ও অকাট্য মানদণ্ডের ভিত্তিতে হাদীস যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া কোনটি জাল আর কোনটি বিশুদ্ধ তাহা স্পষ্টরূপে যাচাই করার তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়। এই জন্য প্রত্যেকটি হাদীসের সনদ, সনদের সহিত সংশ্নিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তি তাহাদের পারস্পরিক সাক্ষাত, হাদীস শ্রবণ ও গ্রহণ অবস্থা, হাদীসের মূল উৎস প্রভৃতি আঁতিপাতি করিয়া খুঁজিয়া দেখার কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয়। এই সময়ে মুসলিম সমাজের বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত করা হয় যে, কেবলমাত্র বিশুদ্ধ ও নির্ভূল হাদীসই গ্রহণ করা হইবে, তাহা ব্যতীত অপর কোন ‘হাদীস’ই গ্রহণ করা হইবে না। কেননা হাদীস গ্রহণ ও তদানুযায়ী কাজ করা ঠিক তখনই সম্ভব, যখন প্রমাণিত হইবে যে, ইহা প্রকৃতই রাসূলের বানী এবং ইহার হাদীস হওয়ার ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নাই। আর হাদীসের এই প্রমাণ নির্ভর করে উহার বর্ণনা পরম্পরা বা সনদের বিশুদ্ধতার উপর, সনদে উল্লিখিত প্রত্যেক বর্ণনাকারীর বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার উপর, সমালোচনা আঘাতে তাঁহাদের মধ্যে কাহারো ‘আহত’ না হওয়ার উপর। হাদীসের সনদ এইসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে দ্বিতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা ও যাচাই করিতে হইবে মূল হাদীসের নিজস্ব গুণাগুণ; মূল বক্তব্যের যথার্থতা ও বিশ্বাস্যতা। হাদীস বিজ্ঞানের পরিভাষায় প্রথম পদ্ধতিকে বলা হয় ‘রিওয়ায়েত’- যাচাই করা। আর দ্বিতীয়টিকে বলা হয় দিরায়েত- বুদ্ধি ও সুস্থ বিবেকের কষ্টিপাথরে মূল কথাটির যাচাই করা।

সনদ-পরীক্ষার কাজ

সনদের দিক দিয়া হাদীসের সত্যাসত্য যাচাই করা এক বিশেষ বিজ্ঞান। বিশেষজ্ঞগণ সংজ্ঞা দান করিয়াছেন এই ভাষায়ঃ

******************************************************

রাসূলে করীম, সাহাবী ও তাবেয়ীনের যে কথা, কাজ, সমর্থন অনুমোদন বা কোন গুণ বর্ণনা করা হইবে, উহার বর্ণনা-পরম্পরাকে খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিবেচনা করার উপরই এই বিজ্ঞান নির্ভরশীল।[********************]

হাদীস গ্রহণযোগ্য কিনা, তাহা নির্ধারণের জন্য সর্বপ্রথম হাদীসেন বর্ণনা সূত্রে যাচাই করিতে হইবে। এই পর্যঅয়ে হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির বিভিন্ন দিক দিয়া পরীক্ষা করা অপরিহার্য। বর্ণনাকারী কি ধরনের বা কি চরিত্রের লোক, ইসলামী জ্ঞান ও বিদ্যা তাঁহার কতখানি আয়ত্ত, বোধশক্তি কতখানি তীব্র ও উন্নত, প্রতিভা ও স্মরণশক্তিই বা কিরূপ, তাঁহার আকিদা, বিশ্বাস, চিন্তা ও মতবাদ নির্ভুল কিনা, ইসলাম মুতাবিক কিনা, বিদয়াতপন্হী নয়তো? সে সুস্থ বিবেক ও চিন্তাশক্তিসম্পন্ন কিনা, মাসনিক রোগগ্রস্ত নয় তো, সত্য কথাকে যথাযথরূপে বলিতে অভ্যস্ত, না মিথ্যা কথাও কখনো কখনো বলিয়া থাকে, সৎকর্মশীল ও চরিত্রবান, না চরিত্রহীন ও দুষ্কৃতি অনুরাগী, হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পর্কে সমালোচনা বিজ্ঞানে এই ধরনের প্রশ্নই প্রধান। ইহার পরও জানিবার বিষয় হইতেছে, সে কোথায় কাহার নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও শিক্ষা করিয়াছে। যাহার নিকট হইতে সে হাদীস বর্ণনা করে, তাহার সহিত তাহার প্রকৃতই সাক্ষাৎ হইয়াছে কিনা, হইয়া থাকিলে কোথায়, কখন   এবং তখন তাঁহার বয়স কত ছিল, এইসব বিষয়ও পুংখানুপংখরূপে বিচার্য।

বস্তুত ইহা এক বিশেষ জ্ঞান, ইহাকেই বলা হয়ঃ ******************** ইহার সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

ইহা এমন এক বিজ্ঞান, যাহাতে বিশেষ শব্দে হাদীস বর্ণনাকারীদের সমালোচনা করা হয় এবং তাহাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়।

এইজন্য হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির বিস্তারিত জীবনচরিত সম্পর্কে গভীর সূক্ষ্মজ্ঞান অর্জন অপরিহার্য। এই জ্ঞানকে বলা হয়ঃ

******************************************************

লোকদের নাম-পরিচয় সংক্রান্ত বিদ্যা ও জ্ঞান।

ইহার ব্যাখ্যা করিয়া বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

অর্থাৎ হাদীসের সনদে উল্লেখিত সাহাবী, তাবেয়ী ও সকল বর্ণনাকারী সম্পর্কে জ্ঞান। কেননা এই জ্ঞান হইতেছে হাদীস জ্ঞানের অর্ধেক।[********************]

এই জ্ঞানের প্রয়োনজনীয়তা সম্পর্কে সুফিয়ান সওরী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সনদসূত্র ও সনদ সম্পর্কিত জ্ঞান হইতছে ঈমানদার লোকদের হাতিয়ার বিশেষ, আর তাহার নিকট যদি হাতিয়ারই না থাকিল তবে সে কি জিনিস লইয়া যুদ্ধ (শক্রপক্ষের সহিত মুকাবিলা) করিবে?।[********************]

ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সনদসূত্র ও তৎসংক্রান্ত জ্ঞান ব্যতীতই যে লোক হাদীস সন্ধান ও গ্রহণ করে, সে ঠিক রাত্রির অন্ধকারে কাষ্ঠ আহরণকারীর মত লোক। সে কাষ্ঠের বোঝা বহন করিতেছে, অথচ তাহার মধ্যে বিষধর সর্প রহিয়াছে। উহা তাহাকে দংশন করে; কিন্তু সে টেরই পায় না।[********************]

হাদীষ বর্ণনাকারী সকল পর্যায়ের ও স্তরের লোকদের সমালোচনা ও যাঁচাই পরীক্ষা করা এবং তাঁহাদের মধ্যে নির্ভরযোগ্য লোকদিগকে যথাযোগ্য মর্যাদা দান ইসলামে এক অতীব জরুরী কার্যক্রম। আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়াছেনঃ

******************************************************

হে ঈমানদারগণ! কোন ফাসিক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন খবর লইয়া আসিলে তোমরা উহার সত্যতা যাচাই করিয়া লও। অন্যথায় অজ্ঞতাবশত কোন জাতির উপর বিপদ টানিয়া আনিতে পার এবং ফলে তোমরা লজ্জিতও হইতে পার।[********************]

এই স্পষ্ট নির্দেশের কারণেই সাহাবায়ে কিরাম প্রত্যেকটি কথা বা হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে বিশেষ কড়াকড়ি ও সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। যাহার-তাহর কথা বা হাদীস অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণ-সাক্ষ্য ব্যতীত গ্রহণ করিতে তাঁহারা প্রস্তুত হইতেন না। পরবর্তীকালে ইলমে হাদীসৈর ক্ষেত্রে ইহাই ‘হাদীস-সমালোচনার বিজ্ঞান’ উৎপত্তির ভিত্তি স্থাপন করে। ‘ইলমে আসমাউর রিজাল’ এই কারণেই রচিত হয়। হাদীস কোনটি গ্রহণযোগ্য, সে বিষয়ে ফায়সালা করার জন্য এই বিজ্ঞান একান্তই অপরিহার্য। এ সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির সমালোচনা ও যথাযোগ্য মর্যদা দান সম্পর্কে কথা বলা রাসূলে করীম, বিপুল সংখ্যক সাহাবী এবং তাবেয়ীন হইতে প্রমাণিত। তাঁহাদের পরেও এই কাজ চলিয়াছে। তাঁহারা সকলেই এই কাজকে বিধিসম্মত মনে করিয়াছেন ইসলামের শরীয়াতকে মিথ্যা ও জালিয়াতের করাল গ্রাস হইতে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে, লোকদিগকে নিছক আঘাত দান বা দোষী প্রমাণের উদ্দেশ্যে নহে।[]

মুহাম্মদ ইবনে সিরীন তাবেয়ী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

নিশ্চয় জানিও, এই জ্ঞান দ্বীন-ইসলামের মৌলিক ব্যাপার, অতএব তোমরা কাহার নিকট হইতে দ্বীন গ্রহণ করিতেছে, তাহা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবশ্যই দেখিয়া লইবে।[]

হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞঅন উৎপত্তির ইতিহাস বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি আরো বলিয়াছেনঃ

******************************************************

পূর্বে লোকেরা হাদীসের সনদ ও বর্ণনাকারীদের পরিচয় জানিতে চাহিত না। কিন্তু যখন ফেতনা শুরু হইয়া গেল তখন তাহারা বলিতে লাগিলঃ তোমাদের বর্ণনাকারীদের নাম পরিচয় বল। প্রকৃত হাদীস ধারণকারী লোক হইলে তাহাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা হইবে আর বিদয়াত-পন্হী হইলে তাহাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা হইবে না।[]

হাদীস যাচাই সংক্রান্ত এই জরুরী ইলম- ‘ইলমে আসমাউর রিজাল’ সম্পর্কে প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ডাঃ স্প্রিংগার বলিয়াছেনঃ

মুসলিমদের আসমাউর রিজাল- এর মত বিরাট ও ব্যাপক চরিতবিজ্ঞান সৃষ্টি করিতে পারিয়াছে এমন অপর কোন জাতি দুনিয়ায় কোন দিন ছিল না, বর্তমানেও এইরূপ অপর কোন জাতির অস্তিত্ব দুনিয়ায় নাই। এই বিজ্ঞানের সাহায্যেই আজ পাঁচ লক্ষ্য হাদীস বর্ণনাকারী লোকদের বিস্তারিত জীবনচরিত সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যাইতে পারে।[******************** গ্রন্হের ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকা (কলিকাতায় মুদ্রিত ১৮৫৩ সন।)]

হাদীস সমালোচনার ব্যাপারে হাদীস-বিজ্ঞানিগণ অশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছেন। কোন স্মরণ-শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি যদি ষাট বৎসর বয়সে স্মরণশক্তি হারাইয়া ফেলে ও ভুলিয়া যাওয়ার রোগে আক্রান্ত হয়, তাহা হইলে তাহার জীবন চরিতে একথা অবশ্যই লিখিত হইয়াছে যে, ‘এই ব্যক্তি প্রথম জীবনে স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিল; কিন্তু ষাট বৎসর বয়সে তাহার স্মরণশক্তি বিলুপ্ত হইয়াছে। কাজেই তাহার বর্ণিত কেবল সেই সব হাদীসই গ্রহণ করা যাইবে, যাহা সে স্মরণশক্তি বর্তমান থাকা অবস্থায় বর্ণনা করিয়াছে, এ্ই দুর্ঘটনার পরে বর্ণিত কোন হাদীসই তাহার নিকট হইতে গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। এই চরিত-বিজ্ঞান রচনার ব্যাপারে রচয়িতাগণ কর্তৃক কোন পক্ষপাতিত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, বিশেষ কাহারো প্রতি অকারণ ঝোঁক ও কাহারো সম্পর্কে মাতাতিরিক্ত প্রশংসা করার মত মারাত্মক ক্রটি প্রদর্শিত হয় নাই। তাঁহারা প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্ণ সত্যের উপর নির্ভর করিয়া বাস্তব ঘটনার বিশ্নেষণ করিয়াছেন। তাঁহাদের দৃষ্টি ছিল সম্পূর্ণ সত্যের উপর নির্ভর করিয়াবাস্তব ঘটনার বিশ্নেষণ করিয়াছেন। তাঁহাদের দৃষ্টি ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও আবিলতা বিমুক্ত। যাহার যতটুকু মর্যাদা ও স্থান, তাহাকে ঠিক ততটুকুই দিয়াছেন, দিতে কোন প্রকার কার্পণ্য বা সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিচয় দেন নাই।

হাদীস সমালোচনার পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এখানে দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি কথার উল্লেখ করা যাইতেছে। (অবশ্য নীতিগত আলোচনা পূর্বেও করা হইয়াছে।)

মুহাদ্দিস শেখ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক শেয়খ উবাদ ইবনে কাসীর সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁহার তাকওয়া পরহিযগারির তো বিপুল প্রশংসা করিয়াছেন, কিন্তু বলিয়াছেন যে, নৈতিক কারণে তাঁহার বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা যাইবে না।

ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে হাকেমকে এক ব্যক্তি একটি হাদীস শুনাইল। ইমাম, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ এই হাদীসটি তুমি কাহার নিকট হইতে কখন শুনিয়াছ? সে উত্তরে বলিলঃ ‘আবদ ইবনে হুমাইদের নিকট হইতে অমুক সনে আমি এই হাদীসটি শ্রবণ করিয়াছি’।

তখন ইমাম আবদুল্লাহ তাঁহার সম্মুখে সমবেত ছাত্রদের লক্ষ্য করিয়াবলিলেনঃ ‘দেখ, এই লোকটির মতে আবদ ইবনে হুমাইদ তাঁহার মৃত্যুর সাত বছর পরে এই ব্যক্তির নিকট হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন’।

কেননা সেই ব্যক্তি আবদ ইবনে হুমাইদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণের যে সনের উল্লেখ করিয়াছিল, তাহার সাত বৎসর পূর্বেই আবদ ইবনে হুমাইদ ইন্তেকাল করিয়াছেন। অর্থাৎ এই ব্যক্তি তাঁহার নিকট হইতে যে হাদীস শ্রবণের দাবী করিয়াছে তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য।

ইয়াহুদীরা মুসলিম খলীফার নিকট  রাসূল কর্তৃক লিখানো একখানি দস্তাবেজ পেশ করিয়া দাবি করে যে, আমাদের উপর ধার্যকৃত জিযিয়া প্রত্যাহার হওয়া উচিত। দস্তাবেজে লিখিত ছিল যে, খায়বার অধিবাসী ইয়াহুদীদের জিযিয়া মাফ করিয়া দেওয়া হইল। খলীফা এবং শাসন পরিচালকদের পক্ষে ইহা অবনত মস্তকে মানিয়া লওয়া ও ইয়াহুদীদের জিযিয়া প্রত্যাহার করা ভিন্ন গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু হাদীস বিজ্ঞানিগণ যখন দস্তাবেজখানা পাঠ করিলেন, দেখিলেন, উহাতে হযরত সায়াদ ইবনে মুয়াযের সাক্ষ্য উদ্ধৃত হইয়াছে। অথচ তিনি খায়বার যুদ্ধের পূর্বেই ইন্তেকাল করিয়াছেন।

দ্বিতীয়ত, এই দলীলের, লেখক হিসাবে মুয়াবিয়া ইবনে আবূ সূফিয়ানের নাম লিখিত রহিয়াছে, অথচ ইহা সর্বজনবিদিত যে, খায়বার যুদ্ধ পর্যন্ত মুয়াবিয়া ইসলামই কবুল করেন নাই।

তৃতীয়ত, উক্ত দলীলে যে সময়ের উল্লেখ করা হইয়াছে, তখন পর্যন্ত জিযিয়া সম্পর্কিত আল্লাহর ফরমান নাযিলই হয় নাই, নাযিল হইয়াছে তাহার অনেক পর। আর চতুর্থ, এই যে, যেসব ইয়াহুদী ইসলামের শক্রতা পরিহার করিয়া ইসলামের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে, এই দলীল হইতে কেবল তাহাদের জিযিয়া মাফ করাই প্রমাণিত হয়। কিন্তু ইসলামের শক্রতায় যাহারা জর্জরিত, তাহাদের জিযিয়া মাফ করার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না।

মুহাদ্দিসগণ এইসব যুক্তি অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে ঘোষণা করিলেন যে, এই দস্তাবেজখানি সম্পূর্ণ জাল। অতএব উহা প্রত্যাহারযোগ্য।

হাদীসের সমালোচনা-বিজ্ঞানের বাস্তব কার্যক্রম সম্পর্কে ইহা কয়েকটি দৃষ্টান্তমাত্র। এইরূপ সমালোচনা ও যাচাই পরীক্ষার কষ্টিপাথরে হাদীস বিজ্ঞানিগণ এক একটি হাদীসের সমালোচনা, যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। আর এই বিরাট মহান কার্য সম্পাদন সম্ভব হইয়াছে কেবলমাত্র ‘আসমাউর-রিজাল’ শাস্ত্রের সাহায্যে। ইহার ভিত্তি কুরাআন মজীদের পূর্বোক্ত আয়াতের উপর স্থাপিত। সাহাবায়ে কিরাম ইহার পূর্ণ অনুসরণ করিয়াছেন। পরবর্তীকালে মুহাদ্দিসগণ এই মানদণ্ডের সাহায্যে সত্য ও মিথ্যা হাদীসের পার্থক্য করিয়াছেন।

হাদীস-সমালোচনা পর্যায়ে যাঁহারা কিছু না কিছু কাজ করিয়াছেন, তাঁহাদের নাম নিম্নে পর্যায়ক্রমে উল্লেক করা যাইতেছেঃ

সাহাবীদের পর্যায়েঃ ১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবাস (মৃঃ ৬৮ হিঃ), ২. উবাদাহ ইবনে সামিত (মৃঃ ৩৪ হিঃ), ৩. আনাম ইবনে মালিক (মৃঃ ৯৩ হিঃ)।

তাবেয়ীদের পর্যায়েঃ আমের শা’বী (মৃঃ ১০৪ হিঃ), ইবনে সিরীন (মৃঃ ১৬০ হিঃ), সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যিব (মৃঃ ৯৩ হিঃ)।

দ্বিতীয় শতকের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণ ইতেছেন, ইমাম শো’বা (মৃঃ১৬০ হিঃ), আনাস ইবনে মালিক (মৃঃ ১৭৯ হিঃ), মা’মর (মৃঃ ১৫৩ হিঃ), হিশাম আদাস্তাওয়ায়ী (মৃঃ ১৫৪ হিঃ), ইমাম আওযায়ী (মৃঃ ১৫৬ হিঃ), সুফিয়ান  আস-সওরী (মৃঃ ১৬১ হিঃ) ইবনুল মাজেশূন (মৃঃ ১৬৩ হিঃ), হাম্মাদ ইবনে সালমা (মৃঃ ১৬৭ হিঃ), লাইস ইবনে সায়াদ (মৃঃ ১৭৫ হিঃ)।

তাঁহাদের পরবর্তী পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য হইতেছেনৎ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (মৃঃ ১৮১ হিঃ), হুশাইম ইবনে বুশাইর (মৃঃ ১৮৮ হিঃ), আবূ ইসহাক আলফাজারী (মৃঃ ১৮৫ হিঃ), আল-মুয়াফী ইবনে ইমরান আল-মুসেলী (মৃঃ ১৮৫ হিঃ), বিশর ইবনুল মুফাযাযল (মৃঃ ১৯৬ হিঃ), ইবনে উয়াইনাহ (মৃঃ ১৯৭ হিঃ)। তাঁহাদের পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য হইতেছেঃ ইবনে আলীয়া (মৃঃ ১৯৩ হিঃ), ইবনে অহব (মৃঃ ১৯৭ হিঃ) ও অকীত ইবনে জাররাহ (মৃঃ১৯৭ হিঃ)।

এই যুগে দুইজন বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। তাঁহারা হইতেছেনঃ ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাতাব (মৃঃ ১৮৯ হিঃ) ও আবদুর রহমান ইবনে মাহদী (মৃঃ ১৯৮ হিঃ)।

তাঁহাদের পরের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হইতেছেনঃ ইয়াযীদ ইবনে হারূন (মৃঃ ২০৬ হিঃ), আবূ দাঊদ তায়ালিসী (মৃঃ ২০৪ হিঃ), আবদুর রাযযাক ইবনে হাম্মান (মৃঃ ২১১ হিঃ) ও আসেম নাবীল ইবনে মাখলাদ (মৃঃ ২১২ হিঃ)।

তাঁহাদের পরে উল্লেখযোগ্য হইতেছে সমালোচনা বিজ্ঞানের গ্রন্হকারগণ। এই পর্যায়ে প্রধান উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হইতেছেনঃ ইয়াইয়া ইবনে মুয়ীন (মৃঃ ২৩৩ হিঃ), আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে সায়াদ (মৃঃ ২৩০ হিঃ), আবূ খায়সামা যুবাইর ইবনে হারব (মৃঃ ২৩৪ হিঃ), আবূ জাফর আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ নবীল, আলী ইবনে মদীনী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ নুমাইর (মৃঃ ২৩৪ হিঃ), আবূ বকর ইবনে আবী শাইবা (মৃঃ ২৩৫ হিঃ), আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল কাওয়ারীরী (মৃঃ ২৩৫ হিঃ), ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় ইমামে খুরাসান (মৃঃ ২৩৭ হিঃ), আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আম্মার আলমুসেলী (মৃঃ ২৪২ হিঃ), আহমদ ইবনে সালেহ- হাফেজে মিসর (মৃঃ ২৪৮ হিঃ), হারূন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাম্মাল (মৃঃ ২৪৩ হিঃ)।

তাঁহাদের পরে ইসহাক আল কাওসাজ (মৃঃ ২৫১ হিঃ), ইমাম দারেমী (মৃঃ ২৫৫ হিঃ), ইমাম বুখারী (মৃঃ ২৫৬ হিঃ), হাফেজ আল-আজলী, ইমাম আবূ জুরয়া (মৃঃ ২৬৪ হিঃ), আবূ হাতেম (মৃঃ ২৭৭ হিঃ), ইমাম মুসলিম (মৃঃ ২৬১ হিঃ), আবূ দাঊদ সিজিস্তানী (মৃঃ ২৭৫ হিঃ), বাকী ইবনে মাখলাদ (মৃঃ ২৭৬ হিঃ), আবূ জুরয়া দেমাশকী (মৃঃ ২৮১ হিঃ)।

তাঁহাদের পরে উল্লেখযোগ্য আবদুর রহমান ইউসুফ আল বাগদাদী। তিনি হাদীস সমালোচনা পর্যায়ে একখানি গ্রন্হও রচনা করেন। ইবরাহীম ইবনে ইসহাক আল-হারবী (মৃঃ ২৮৫ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে অজ্জাহ (মৃঃ ২৮৯ হিঃ), হাফেজ কুরতবা আবূ বকর ইবনে আবূ আসেম (মৃঃ ২৮৭ হিঃ০ আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ (মৃঃ ২৯০ হিঃ), সালেহ জাজরা (মৃঃ ২৯৩ হিঃ), আবূ বকর আল বাযযার (মৃঃ ২৯২ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে নসর আল-মারওয়াযী (মৃঃ ২৯৪ হিঃ)-ও এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।

এইভাবে প্রত্যেক যুগেই বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের উদ্ভব হইয়াছে, যাঁহারা হাদীসের সমালোচনা করিয়া উহার যথার্থতা যাচাই করিয়াছেন। ফলে কোন সময়ই নিতান্ত জাল ও মিথ্যা হাদীস ‘হাদীস’ নামে পরিচিত হইতে ও প্রচারিত হইয়া হাদীসরূপে টিকিয়া থাকিতে পারে নাই। সাহাবীদের যুগ হইতে অষ্টম হিজরী শতক পর্যন্ত এইরূপ অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে।

এই পর্যায়ে যেই সব গ্রন্হ রচিত হইয়াছে, তন্মধ্যে এইখানে কয়েকখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্হের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া যাইতেছেঃ

১. তাবকাতে ইবনে সায়াদ। ইহা বিরাটায়তন গ্রন্হ’ পনের খণ্ডে বিভক্ত ও সমাপ্ত।

২. ইমাম সুয়ূতী উক্ত গ্রন্হের সংক্ষিপ্তাসার রচনা করিয়াছেন। উহার নাম-

******************************************************

৩. ইমাম বুখারী রচিত তারীখে কবীর; তারীখে সগীর ও তারীখে আওসাত।

৪, ইবনুল মাদীনী লিখিত ইতিহাস দশ খণ্ডে সমাপ্ত।

৫. ইবনে হাব্বান রচিত ********************* দশ খণ্ডে সমাপ্ত।

৬. কিতাবুত তাকমীল- ইমাম ইবনে কাসীল রচিত। পূণ নামঃ

******************************************************

হাদীস বর্ণনার দুইটি পদ্ধতি

নবী করীম (স) ইতে হাদীস বর্ণনার দুইটি পদ্ধতি রহিয়াছে। নবী করীমের মুখ-নিসৃত কথা- যেভাবে যেসব শব্দ সহকারে তিনি কথাটি বলিয়াছেন, হুবহু সেইভাবে ও সেই সব শব্দ সহকারে বহু হাদীস বর্ণনা করা হইয়াছে। বর্ণনাকারী উহার ভাষা ও শব্দের কোনরূপ পরিবর্তন করেন নাই। এইরূপ বর্ণনাকে বলা হয় রেওয়ায়েত বিল- লাফজ- শাব্দিক বর্ণনা বা রাসূলের ব্যবহৃত শব্দ ও ভাষায় বর্ণনা করা।

আর রাসূলের মূল বক্তব্যকে নিজস্ব ভাষায় ব্যক্ত ও বর্ণনা করা হইলে এই পদ্ধতিকে বলা হয় রেওয়ায়েত বিল মা’না- ভাব বর্ণনা বা নিজের ভাষায় মূল কথাটি বলিয়া দেওয়া। কিন্তু ইহাতে জরুরী শর্ত এই যে, রাসূলের ব্যবহৃত শব্দ ও ভাষার পরিবর্তে যে শব্দ ও ভাষা ব্যবহৃত হইবে, তাহা অবশ্যই মূল ভাব ও অর্থের ধারক ও প্রকাশক হইতে হইবে। অর্থাৎ রাসূল যাহা বলিতৈ চাহিয়াছেন তাহাকে নিজস্ব ভাষায় এমনভাবে বলিতে হইবে যেন, তাহাতে মূল বক্তব্য যথাযথভাবে প্রকাশ করা হয়, শ্রোতার মনে যেন সেই ভাব ও অর্থই জাগ্রত হয়, যাহা জাগ্রত হইয়াছিল রাসূলের নিকট হইতে উহার প্রথম শ্রবণকারীদের মনে। ইহাতে কোন প্রকার পার্থক্য সৃষ্টি হইলে কিংবা মূল কথার কমবেশী হইয়া গেলে বর্ণনার দায়িত্ব সঠিকরূপে পালন হইতে পারে না।

 এই শেষোক্ত পদ্ধতিতেও রাসূলের হাদীস বর্ণনা করা সম্পূর্ণ বিধিসম্মত। অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতে বর্তমান হাদীসসমূহের অধিকাংশই এই পদ্ধতিতে বর্ণিত। অর্থাৎ রাসূলের কথাটিকে নিজস্ব ভাষায় বর্ণনা করা হইয়াছে।

একজন সাহাবী নবী করীম ( স)-এর খেদমতে আরয করিলেন, ‘আমরা আপনার হাদীস শ্রবণ করি; কিন্তু উহাকে শব্দে বর্ণনা করার সামর্থ্য আমাদের হয় না। (এখন আমরা কি করিব?) নবী করীম (স) বলিলেনঃ ‘তোমরা যখন হালালকে হারাম ও  হারামকে   হালালে পরিণত কর না, বরং মূল কথাটিকেই নিজস্ব ভাষায় পৌঁছাইয়া দাও, তখন উহাতে কোনই দোষ নাই।[*********************]

হাদীস বর্ণনাকারীদের শ্রেণী বিভাগ

(গুণগত)

হাদীস বর্ণনাকারী লোক গুণগত দিক দিয়াচার শ্রেণীতে বিভক্ত। এই শ্রেণী-পার্থক্যের দৃষ্টিতেই তাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের পর্যায় ও মর্যাদা নির্ণীত হইয়া থাকে।

প্রথম শ্রেণীর হাদীস বর্ণনাকারী তাঁহারা, যাঁহারা অত্যন্ত মুত্তাকী, শরীয়াতের পাবন্দ, তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিসম্পন্ন, ইসলামের বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞাননে পারদর্শী, সূক্ষ্ম বুদ্ধিমান, সুবিবেচক, মুখস্থ করা হাদীসসমূহের পূর্ণ হেফাজতকারী এবং বিদয়াত-বিরোধী।

দ্বিতীয় শ্রেণীর বর্ণনাকারী তাঁহারা, যাঁহাদের গুণ সর্বদিক দিয়াই প্রথম শ্রেণীর  বর্ণনাকারীদের সমান। কিন্তু কেবল স্মরণশক্তির দিকদিয়া প্রথম শ্রেণী অপেক্ষা কম। এই পর্যায়ে দুই ধরনের লোক পাওয়া যায়। এক ধরনের লোক- যাঁহারা হাদীস লিখিয়া রাখিতেন, কেবলমাত্র স্মরণশক্তির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিলেন না। আর দ্বিতীয় ধরনের লোক- যাঁহারা হাদীস লিখিয়া রাখিতেন না। ফলে মূল হাদীসের কোন কোন শব্দ ভূলিয়া যাওয়ার কারণে বর্ণনা করার সময় উহার সম-অর্থবোধক শব্দ তদস্থলে ব্যবহার করিতেন।

তৃতীয় শ্রেণীর বর্ণনাকারী তাঁহারা, যাঁহারা শরীয়াতের অনুসরণকারী মুত্তাকী ছিলেন; জ্ঞান-বুদ্ধি, বোধশক্তি ও অন্তর্দৃষ্টির দিক দিয়া দ্বিতীয় শ্রেণীর বর্ণনাকারীদের সমান নহেন। যাহা তাঁহাদের স্মরণে রক্ষিত আছে, কেবল তাহাই মূলধন; যাহা ভুলিয়া গিয়াছেন, সেদিকে তাঁহাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নাই। ভুলিয়া যাওয়ার অংশকে তাঁহারা কল্পনার সাহায্যে পুরণ করিয়া দিতেন।

চতুর্থ শ্রেণীর বর্ণনাকারী, যাঁহারা দ্বীন-ইসলামের অনুসরণকারী ও শরীয়াত পালনকারী বটে; কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনা ও দূরদৃষ্টির দিক দিয়া তাঁহারা পশ্চাৎপদ। লোকদিগকে নসীহত করা, পরকালীন শান্তির আশ্বাস এবং আযাবের ভয় প্রদর্শনের জন্য হাদীস রচনা করাকে তাঁহারা জায়েয মনে করিতেন। এই লোকদের আবার চারটি পর্যায় রহিয়াছে। প্রথম তাঁহারা, যাঁহারা বৈষয়িক মান-সম্মান লাভের উদ্দেশ্যে হাদীসসমূহের রদ-বদল কিংবা নূতন হাদীস রচনা করিতে দ্বিধাবোধ করিতেন না। দ্বিতীয়, তাঁহারা, যাঁহারা নিজেদের খুঁটিনাটি মাসলা সম্পর্কিত মতের সমর্থনে উস্তাদের নিজস্বভাবে প্রয়োগকৃত শব্দ হাদীসের মধ্যে শামিল করিয়া দিতেন। তৃতীয় তাঁহারা যাঁহারা বৃদ্ধি-বিবেচনা কম হওয়ার কারণে উস্তাদের উল্লিখিত ব্যাখ্যাদানকারী শব্দসমূহকে মূল হাদীসেরই অংশ মনে করিতেন। চতুর্থ হইতেছে ইসলামের সেইসব দুশনম লোক, যাহারা মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে দলাদলি, বিভেদ-বিচ্ছেদ ও কোন্দল সৃষ্টি এবং উহাতে ইন্ধন যোগাইবার অসদুদ্দেশ্যে হাদীস রচনা করিয়া প্রচার করিতে বিন্দুমাত্র ভয় পাইত না।[*********************]

হাদীস গ্রহণের শর্তাবলী

কোন ধরনের হাদীস গ্রহণ করা হইবে এবং কোন ধরনের হাদীস গ্রহণ করা যাইবে না, তাহা নির্ধারণ ও এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইলমে হাদীসের ইমামগণ বিভিন্ন শর্ত নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। পূর্বেই বলা হইয়াছে, কেবলমাত্র সহীহ হাদীস ছাড়া অপর কিছুই গ্রহণ করা হইবে না, এই কথায় হাদীসের সকল ইমামই সম্পূর্ণ একমত ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। কিন্তু কি কি গুণে একটি হাদীস ‘সহীহ হাদীস’ নামে অভিহিত হইতে পারে, এই পর্যায়ে হাদীসের প্রত্যেক ইমাম নিজস্বভাবে চিন্তা ও গবেষণা পরিচালনা করিয়াছেন। তবে যেহেতু এই গবেষণা ও চর্চা এবং হাদীস-বিজ্ঞানের উন্নয়ন একই সময় ও সকল মুহাদ্দিসের একত্র উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয় নাই, বরং বিভিন্ন সময়ে হাদীস-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ-ধারার বিভিন্ন স্তরে ইহা অনুষ্ঠিত হইয়াছে, সেই কারণে ইহাতে বিভিন্ন পর্যায়ে সম্প্রসারণ সূচিত হইয়াছে। ফলে বাহ্যদৃষ্টিতে ইহাতে কিছু মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হইতেছে। আমরা এখান বিভিন্ন ইমামের আরোপিত শর্তাবলীর উল্লেক করিতেছি।

ইমাম আজম (র)

ইমাম আজম আবূ হানীফা (র) হাদীসের ‘সহীহ’ হওয়ার জন্য যে শর্ত আরোপ করিয়াছেন, তাহা অপরাপর মুহাদ্দিসের আরোপিত শর্তের তুলনায় অত্যন্ত কঠিন বলিয়া মনে হয়। আর প্রকৃতপক্ষে তিনি এই দিক দিয়া বড়ই কঠোর প্রকৃতির লোক ছিলেন। ইমাম বুখারীর উস্তাদ শেখ অকী বলেনঃ ইমাম আজমের ন্যায় কঠিন শর্ত সাধারণভাবে আরোপিত হইলে সহীহ হাদীসের সংখ্যা হ্রাস পাইয়া যাওয়ার আশংকা রহিয়াছে।[*********************]

ইমাম আবূ হানীফার শর্তাবলী নিম্নরূপঃ

১. হাদীস বর্ণনাকারীকে অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর বর্ণনাকারীদের অন্তভূক্ত হইতে হইবে।

২. হাদীসের বর্ণনা শাব্দিক- রাসূলের ব্যবহৃত শব্দসমূহ হুবহু উল্লেখ সহকারে (*********************) হইতে হইবে। মূল হাদীসের অর্থ বা নিজস্ব ভাষায় বর্ণনা করিলে (*********************) তাহা গ্রহণ করা যাইবে না।

৩. হাদীস-দরসের বৈঠকে নিয়োজিত উচ্চ ঘোষণাকারীর (*********************) মুখে হাদীস শ্রবণ করিয়া থাকিলে এই শ্রবণকারিগণ পরবর্তীদের নিকট ********************* (অমুকে আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন) বলিয়া হাদীস বর্ণনা করিতে পারিবেন না। (করিলে সে হাদীস গ্রাহ্য হইবে না।)

৪. যেসবমুহাদ্দিসদেরনিকটলিখিতভাবেহাদীস-সম্পদসুরক্ষিতরহিয়াছে, হাদীসেরপ্রতিটিশব্দযদিতাঁহাদেরস্মরণেথাকে, তবেতাঁহাদেরমৌখিকবর্ণনাকবুলকরাযাইবে। অন্যথায়উক্তলিখিতহাদীসসম্মুখেরাখিয়াইহাদীসবর্ণনাকরিতেহইবে। (এইরূপনাকরিয়াথাকিলেসেহাদীসগ্রহণযোগ্যহইতেপারেনা)।

৫. এইসময়পর্যন্তযেসবহাদীসের (*********************) অর্থ ও ভাব বর্ণিত হইয়াছে, শব্দগতভাবে বর্ণিত হয় নাই, তবে উহাদের বর্ণনাকারী যদি ফিকাহ-পারদর্শী হন অন্তত বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য, সত্যবাদী ও সুবিবেচক এবং ‘দিরায়তের’ দৃষ্টিতেও যদি তাঁহার বর্ণিত কথা নির্ভূল হয়, তবে তাহা ‘সহীহ হাদীস’ রূপে কবুল করা যাইবে।

৬. নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ কারবার, লেন-দেন ও ইবাদত সম্পর্কে যদি কোন ‘খবরে-ওয়াহিদ’ বর্ণিত হয়, তবে উহার সমর্থনে ও অনুকুলে সাক্ষী হিসাবে অপর বর্ণনা সূত্র বা সনদ পেশ করিতে হইবে। গ্রহণযোগ্য ‘সাক্ষী’ না পাওয়া গেলে অন্তত দিরায়াতের বিচারে মূল হাদীসটিকে অবশ্যই বিশুদ্ধ ও সহীহ হইতে হইবে।

সিহাহ-সিত্তাহ সংকলকদের শর্তাবলী

‘সিহাহ-সিত্তাহ’ গ্রন্হাবলী সংকলকগণও হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে নিজস্বভাবে বহু জরুরী শর্ত আরোপ করিয়াছেন। এখানে প্রত্যেকের আরোপিত শর্তাবলী স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা যাইতেছে।

ইমাম বুখারী (র)

১. হাদীসের বর্ণনাসূত্রের পরস্পরা (*********************) ধারাবাহিক, সংযুক্ত ও অবিচ্ছিন্ন (*********************) হইবে। হাকেম আবূ আবদুল্লাহ নিশাপুরূ (র) লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

প্রথম শ্রেণীর সহীহ হাদীস সেইটি, যাহাকে প্রখ্যাত সাহাবী রাসূলে করীমের নিকট হইতে বর্ণনা করিবেন এবং সেই হাদীসের অন্তত আরো দুইজন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী থাকিবেন। অতঃপর সেই সাহাবীর নিকট হইতে এমন একজন তাবেয়ী উহার বর্ণনা করিবেন, যিনি সাধারণত সাহাবীর নিকট হইতেই হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে প্রখ্যাত এবং এই পর্যায়েরও উহার উপর দুইজন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী থাকিবেন। তাহার পর এমন তাবে-তাবেয়ীন উহার বর্ণনা করিবেন, যাঁহারা হাদীসের হাফেজ ও অতিশয় সতর্ক। এক পর্যায়ে বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য। তাহার পর হইবেন ইমাম বুখারীর উস্তাদ- হাদীসের হাফেজ ও হাদীস বর্ণনায় বিশ্বস্ততা রক্ষা করার দিক দিয়া প্রখ্যাত।[*********************]

২. হাদীসের বর্ণনাকারীকে তাহার উস্তাদদের সাহচর্যে অধিক দিন বসবাসকারী হইতে হইবে।

৩. বর্ণনাকরীকে প্রথম শ্রেণীর বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য, প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হইতে হইবে।

৪. যিনি যাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিবেন, তাঁহাদের পরস্পরের সহিত বাস্তব সাক্ষাৎ প্রমাণিত হইতে হইবে।

ইমাম মুসলিম (র)

শায়খ আবূ আমর ইবনুস সালাহ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম মুসলিম তাঁহার সহীহ গ্রন্হে হাদীস গ্রহণের জন্য এই শর্ত করিয়াছেন যে, হাদীসের সনদসূত্র অবশ্যই ‘মুত্তাসিল’ পরস্পর সংযুক্ত ও অবিচ্ছিন্ন হইবে, একজন ‘সিকাহ’ ব্যক্তি অপর ‘সিকাহ’’ ব্যক্তির নিকট হইতে বর্ণনা করিবেন, প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত এই অবস্থাই হইবে এবং উহা ‘শায’ (*********************) ও ‘ইল্লাত’ (*********************) হইতে বিমুক্ত হইবে।

২. হাদীস যিনি যাঁহার নিকট হইতে বর্ণনা করিবেন, তাঁহাদের উভয়ের একই যুগের ও একই সময়ের লোক হইতে হইবে।

৩. হাদীসের কোন বর্ণনাকারীই ‘মজহুল’ (*********************) অজ্ঞাত পরিচয় হইবেন না। তাহাদের সর্বজন পরিচিত হইতে হইবে।

৪. মূল হাদীসে কোন দোষক্রটির অস্তিত্ব থাকিবে না।

হাদীস গ্রহণের শর্তে ইমাম বুখারী ও মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য রহিয়াছে। এই কারণে বহু হাদীস ইমাম বুখারীর নিকট সহীহ কিন্তু ইমাম মুসলিমের নিকট সহীহ নয় বরং ইহার বিপরীত। এই কারণে যাঁহাদের নিকট হইতে ইমাম বুখারী হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন, কন্তু ইমাম মুসলিম গ্রহণ করেন নাই, আর ইমাম মুসলিম গ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু ইমাম বুখারী গ্রহণ করেন নাই- এমন শায়খ বা হাদীসের উস্তাদদের সংখ্যা ৬২৫ জন।[]

ইমাম নাসায়ী ও ইমাম আবূ দাঊদ (র)

১. সহীহ হাদীসের প্রধান দুইখানি গ্রন্হ বুখারী ও মুসলিম  শরীফে যেসব হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে সেসব সনদসূত্রে; তাহা সবই এই ইমামদ্বয়ের নিকট অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।

২. প্রধান হাদীস-গ্রন্হদ্বয়ে হাদীস গ্রহণের যে শর্ত অনুসৃত হইয়াছে তাহাতে উত্তীর্ণ সকল হাদীসই গ্রহণযোগ্য।

৩. যেসব হাদীস সর্ববাদী সম্মতভাবে ও মুহাদ্দিসীনের ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরিত্যক্ত হয় নাই ও যে সবের সনদ ‘মুত্তাসিল’- ধারাবাহিক বর্ণনা পরম্পরাসূত্রে কোন বর্ণনাকারীই উহ্য নহে, তাহা অবশ্যই গ্রহণ করা হইবে। মূল হাদীস সহীহ হইলে এবং ‘মুরসাল’ (*********************) কিংবা ‘মুনকাতা’ (*********************) না হইলে তাহাও গ্রহণযোগ্য।

৪. চতুর্থ পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের মধ্যে উত্তম বর্ণনাকারী হইতে বর্ণিত হাদীও গ্রহণযোগ্য।

৫. প্রকৃত সহীহ হাদীসের সমর্থন  পাওয়া গেলে ইমাম আবূ দাঊদ এমন হাদীসও গ্রহণ করেন, যাহার বর্ণনাকারী যঈফ, দুর্বল ও অজ্ঞাতনামা।

এইসব শর্ত ইমাম নাসায়ী ও ইমাম আবূ দাঊদের নিকট  সমভাবে গৃহীত। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে ইমাম নাসায়ীর আরোপিত শর্ত ইমাম আবূ দাঊদ অপেক্ষা অধিক উন্নত এবং কড়া। ইমাম নাসায়ী হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহাদের অবস্থা সম্পর্কে অধিকতর খোঁজ-খবর লওয়ার প্রয়োজন মনে করিয়াছেন। এই কারণেই ইমাম নাসায়ী এমন অনেক বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেন নাই, যাঁহাদের নিকট হইতে ইমাম আবূ দাঊদ ও ইমাম তিরমিযী হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন। হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী (র) এই সম্পর্কে বলিয়াছেন, তাঁহাদের বর্ণিত হাদীসও গ্রহণযোগ্য।

******************************************************

এমন অনেক বর্ণনাকারীই আছেন, যাঁহাদের নিকট হইতে ইমাম আবূ দাঊদ ও তিরমিযী হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু ইমাম নাসায়ী তাঁহাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ হইতে বিরত রহিয়াছেন। বরং বুখারীও মুসলিম শরীফে যাঁহাদের হাদীস গৃহীত হইয়াছে এমন এক বিরাট সংখ্যক বর্ণনাকারীরও হাদীস গ্রহণ করিতে ইমাম নাসায়ী  প্রস্তুত হন নাই।[*********************]

ইমাম তিরমিযী (র)

১. প্রথম দুইখানি সহীহ গ্রন্হ বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত সমস্ত হাদীসই গ্রহণযোগ্য।

২. প্রধানত মুহাদ্দিস ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের আরোপিত শর্তে আর যেসব হাদীসই উত্তীর্ণ ও সহীহ প্রমাণিত হইবে তাহা গ্রহণীয়।

৩. ইমাম আবূ দাঊদ ও ইমাম নাসায়ী যেসব হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন ও উহাদের দোষ-ক্রটি দূর করিয়া দিয়াছেন, তাহাও গ্রহণীয়।

৪. ফিকাহবিদগণ যেসব হাদীস অনুযায়ী আমল করিয়াছেন, তাহাও গ্রহণীয়।

৫. যেসব হাদীসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হইবে এমন এক নির্দেশ, যাহা সব সময়ই কার্যকর হইয়াছে, তাহা ও গ্রহণীয়।

৬. যেসব সিকাহ বর্ণনাকারীর সমালোচনা করা হইয়াছে এবং তাঁহাদের সম্পর্কে সবকিছু সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত হইয়াছে, তাঁহাদের হাদীসসমূহও গ্রহণীয়।

৭. যেসব বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসসমূহের সমালোচনা করা হইয়াছে এবং তাঁহাদের বিশ্বস্ততাও প্রমাণিত হইয়াছে তাঁহাদের বর্ণিত হাদীসও গ্রহণযোগ্য।

ইমাম ইবনে মাজাহ (র)

১.    প্রথমোক্ত  পাঁচজন মুহাদ্দিস যেসব হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন তাহা তাঁহার নিকটও গ্রহণীয়।

২. পূর্বোক্ত পাঁচজনের আরোপিত শর্তে অন্যান্য যেসব হাদীস উত্তীর্ণ হইতে পারে তাহাও গ্রহণীয়।

৩. বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য আলেমগণ যেসব হাদীস অনুযায়ী আমল করেন তাহাও গ্রহণযোগ্য।

৪. চতুর্থ পর্যায়ের উত্তম বর্ণনাকারীদের বর্ণিত সেইসব হাদীসও গ্রহণীয়, যাহা যাচাই ও পরীক্ষা করার পর সহীহ প্রমাণিত হইয়াছে।

বস্তুত ইলমে হাদীসের ইমামগণের আরোপিত শর্তসমূহ ও হাদীস সমালোচনার পদ্ধতির গুরুত্ব এবং যথার্থতা ইসলামের দুশমনগণও স্বীকার করিতে বাধ্য।[*********************]

দিরায়াত বা মূল হাদীস যাচাই করার পন্হা

কেবলমাত্র সনদের দিক দিয়া হাদীসের যাচাই, ওজন ও পরীক্ষা করার নিয়ম পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাসমূহে আলোচিত হইয়াছে। ইহার দ্বিতীয় কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য পন্হা হইতেছে মূল হাদীসের (*********************)- যথার্থতা যাচাই করা। হাদীস-বিজ্ঞানের পরিভাষায় ইহাকে বলা হয় ‘দিরায়ত’। এই প্রকিয়ার বিভিন্ন দিক রহিয়াছে। তবে ইহার সারকথা এই যে, ইহাতে হাদীস বর্ণনাকারীদের সমালোচনা ও যাচাই না করিয়া মূল হাদীসটিকে যুক্তিবাদের কষ্টিপাথরে ওজন করিয়া দেখা হয়। ‘রওয়ায়েত’ বা সনদ যাচাই করার প্রক্রিয়া কেবলমাত্র হাদীস বর্ণনাকারীদের ব্যক্তিগত গুণ-চরিত্র ও পারস্পরিক সম্পর্ক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু  হাদীসের মর্মকথায় কোন ভূল, অসত্য, অবস্তবতাএবং কুরআন ও সহীহ হাদীসের পরিপন্হী কিছু থাকিলে এই পন্হার যাচাই-পরীক্ষায় তাহা ধরা পড়িতে পারে না। অতএব কেবলমাত্র এই পদ্ধতিতে যাচাই করিয়া কোন হাদীস উত্তীর্ণ পাইলেই তাহা গ্রহণ করা যাইতে পারে না। এই কারণে মূল হাদীস (*********************)- হাদীসের মর্মবাণীটুকু তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিবেচনার মানদন্ডে যাচাই করার উদ্দেশ্যে এই ‘দিরায়াত’ প্রক্রিয়ার প্র য়োগ করা হইয়া থাকে। হাদীস যাচাই-পরীক্ষার ব্যাপারে ‘দিরায়াত’ নীতির প্রয়োগ ‘রওয়ায়েত’ নীতির মতই কুরআন ও হাদীস সম্মত। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই কেবলমাত্র ‘রওয়ায়েতের’ উপর নির্ভরশীল কোন ‘কথা’ গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ন করিতে নিষেধ করিয়াছেন।

হযরত আয়েশা (রা) সম্পর্কে মদীনার মুনাফিকগণ দুর্নাম রটাইয়া দিলে কিছুসংখ্যক মুসলমানও তাহাতে প্রভাবান্বিত হইয়া পড়েন। তখন আল্লাহ তা’আলা তাহাদের সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা যখন সে কথা শুনিতে পাইয়াছিলে, তখন তোমরা (শুনিয়াই) কেন বলিলে না যে, এই ধরনের কথা বলা আমাদের কিছুতেই উচিত নহে। তখন বলা উচিত ছিল যে, আল্লাহ পবিত্র মহান, ইহা এক সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা ও বিরাট দোষারোপ ছাড়া আর কিছুই নহে। (ইহা সত্য হওয়া কিছুতেই সম্ভবপর নহে)।[*********************]

অর্থাৎ মূল সংবাদটি শ্রবণমাত্রই একথা মনে করা উচিত ছিল যে, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। অতএব তখনই ইহার প্রচার ও প্রসার বন্ধ করিয়া দেওয়া কর্তব্য ছিল। এই ‘দোষারোপ’ শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গেই উহাকে মিথ্যা বলিয়া বাতিল করার এই খোদায়ী তাগীদ ‘দিরায়াত’ প্রয়োগেরই নির্দেশ।

বস্তুত হাদীস যাচাইয়ের ব্যাপারে দিরায়াত রীতি এক সর্বোন্নত ও সর্বাধিক তীক্ষ্ণ শাণিত হাতিয়ার। এই পর্যায়ে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির প্রতি দৃষ্টি রাখা হয়ঃ

১. যে ঘটনা শত-সহস্র লোকের সম্মুখে সংঘটিত হইয়াছে- যে ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময়ই বিপুল সংখ্যক লোকের গোচরীভূত না হইয়া পারে না, সেই ঘটনা কিংবা অনুরূপ কোন ঘটনার কথা যদি মাত্র একজন বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত হইয়া থাকে, তবে উহার  সত্যতা সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের উদ্রেক হইবে। এইরূপ ঘটনা বহু সংখ্যক সাহাবী হইতে বর্ণিত না হইলে এই একজন ব্যক্তির বর্ণনাকে কিছুতেই ‘সহীহ হাদীস’ মনে করা ও নিঃশংকচিত্তে উহাকে গ্রহণ করা যাইতে পারে না।

২. যে ঘটনা এমন লোকদের হইতে বর্ণিত হইয়াছে, যাঁহাদের মূল ঘটনা বা উহার ক্ষেত্রের সহিত সাক্ষাৎ সম্পর্কে থাকার কোন কারণ নাই কিংবা তাহা অসম্ভব, এইরূপ বর্ণনার সমর্থন যদি মূল ঘটনা ও ঘটনাস্থলের সহিত নিকট-সম্পর্কশীল লোকদের বর্ণনা হইতে না পাওয়া যায় অথবা তাহাদের হইতে যদি উহার বিপরীত বর্ণনা পাওয়া যায়, তাহা ইলে প্রথমোক্ত বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস ‘সহীহ হাদীস’ রূপে গ্রহণ করা যাইবে না। তাহাদের পরিবর্তে মূল ঘটনার সহিত নিকটতর সম্পর্কশীল লোকদের বর্ণিত হাদীসই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে। যেমন নবী করীম (স)-এর দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে যদি কোন হাদীস প্রথমত এমন লোক হইতে বর্ণিত হয়, যে লোক কোন দিক দিয়াই হযরতের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয় কিংবা কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট শ্রবণও করে নাই, তবে তাহার বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। কিন্তু এইরূপ হাদীস যদি রাসূলের এই জীবনাংশের সহিত কোন না কোন দিক দিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির- যেমন রাসূলের কোন স্ত্রী কিংবা নিকটাত্মীয়ের- তরফ হইতে বর্ণিত হয় অথবা এই ধরনের কোন ব্যক্তির নিকট হইতে শ্রবণ করিয়া বর্ণনা করা হয়, তবে তাহা অবশ্যই  গ্রহণযোগ্য হইতে পারে।

৩. যে হাদীসের বর্ণনাকারী হাদীসের ব্যবহারিক মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাঁহার বর্ণিত হাদীস অন্য ধরনের  হাদীসের ব্যবহারিক মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নহেন এমন বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসের তুলনায় অধিক গ্রহণযোগ্য। এমনকি, কাহারো কাহারো মতে ফকীহ তাবেয়ী যদি সাহাবীর নাম উল্লেখ না করিয়াই রাসূল হইতে সরাসরি হাদীস বর্ণনা করেন, তবে তাহাও উপরোক্ত নীতি অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য হইবে। সাহাবীদের যুগে হাদীস যাচাই করার এই দিরায়াত পদ্ধতির নিয়ম-কানুন বিস্তারিতরূপে রচিত হয় নাই। তবে সে যুগে এই প্রকিয়ার দৃষ্টিতে হাদীস যাচাইয়ের কয়েকটি দৃষ্টান্ত  পশ করা যাইতেছেঃ

১। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কৃর্তক বর্ণিত হাদীসঃ

******************************************************

আমি রাসূল (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি, আগুনে উত্তপ্ত জিনিস গ্রহণ করার পর (নামায পড়ার জন্য) অযু কর।

এই হাদীস শুনিয়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়া উঠিলেনঃ ‘তবে তো অযু থাকা-অবস্থায় গরম পানি ব্যবহার করিলেও আবার অযু করিতে হইবে?[তিরমিযী- কিতাবুত তাহারাত] অন্য কথায় ‘দিরায়াত’ প্রক্রিয়ায় এই হাদীস সহীহ বলে প্রতিপন্ন হয় না।

২। অপর এক হাদীসে উল্লিখিত হইয়াছেঃ

******************************************************

জুময়ার দিন এমন একটি মুহূর্ত আছে, যখন কোন মুসলিম যদি নামায পড়িতে থাকা অবস্থায় আল্লাহর নিকট কোন কল্যাণের প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তাহাকে তাহা বিশেষভাবে দান করেন।

এই চরম মুহূর্তটি যে ঠিক কখন, তাহা নিশ্চিতরূপে জানিবার জন্য সাহাবায়ে কিরাম বিশেষ আগ্রহান্বিত হন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা) জানিতে পারিলেন যে, জুমুয়ার দিনের শেষ মুহূর্তেই এই চরম সময়টি অবস্থিত। কিন্তু হযরত আবূ হুরায়রা (রা) ইহা শুনিয়া বলিলেনঃ ‘তাহা কিরূপে হইতে পারে? রাসূল তো বলিয়াছেনঃ নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় যদি কেহ আল্লাহর নিকট দোয়া করে তবে তাহা তিনি মঞ্জুর করিবেন। কিন্তু দিনের শেষ মুহূর্তে তো কোন নামায পড়া জায়েয নহে। কাজেই এই হাদীস হইতে  এইরূপ সময় নির্ধারণ যুক্তিসঙ্গত নহে।[আবূ দাউদ-কিতাবুস সালাত]

প্রথমোক্ত হাদীসে মূল কথায় যথার্থতা ‘দিরায়াত’- এর ভিত্তিতে যাচাই করা হইয়াছে, আর দ্বিতীয় হাদীসে হাদীসের বিশেষ ব্যাখ্যার যাচাই করা হইয়াছে।

‘দিরায়াত’-এর ভিত্তিতে হাদীস যাচাই করার কাজে হযরত আয়েশার বিশেষ দক্ষতা ও প্রতিভা ছিল। তিনি ইহার ভিত্তিতে কতকগুলি হাদীস সম্পর্কে আপত্তি তুলিয়াছেন এবং তাঁহার আপত্তির ভিত্তিতে দিরায়াতের কতকগুলি মূলনীতি নির্ধারণ করা সম্ভব হইয়াছে। যেমন-

১. তাঁহার সম্মুখে যখন রাসূলের কথা বলিয়া নিম্নোক্ত বাক্য উল্লেখ করা হইলঃ

******************************************************

মৃত ব্যক্তির জন্য তাহার পরিবাবর্গেল কান্নাকাটির কারণে তাহাকে আযাব দেওয়া হইবে।

তখন তিনি বলিলেনঃ ইহা সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না। কেননা কুরআন মজীদ সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেঃ

******************************************************

কোন লোকই অপর কাহারো গুনাহর বোঝা বহন করিবে না।

ইহা হইতে দিরায়াতের দৃষ্টিতে হাদীস যাচাই করার এই মূলনীতি প্রমাণিত হইল যে, কুরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণার বিপরীত কোন হাদীস গ্রহণ করা যাইতে পারে না।[*********************]

২. সাহাবীদের যুগে জনসাধারণের মধ্যে এই হাদীস প্রচারিত হইয়া পড়ে যে, মি’রাজের রাত্রে নবী করীম (স) আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাক্ষাত লাভ করিয়াছেন। হযরত আয়েশা (রা) ইহা শুনিয়া বলিলেনঃ এই হাদীসের বর্ণনাকারী সুস্পষ্ট মিথ্যাবাদী। কেননা কুরআন মজীদ স্পষ্ট বলিয়াছেঃ

******************************************************

কোন সৃষ্টি আল্লাহকে আয়ত্ত করিতে পারে না, তিনিই সমস্ত সৃষ্টি আয়ত্ত করিয়া থাকেন।

পূর্বের বিস্তারিত আলোচনা হইতে দিরায়াত প্রক্রিয়ার যে কয়টি মূলনীতি প্রকাশিত হয়, তাহা এখানে একত্রে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১। হাদীস কুরআনের সুস্পষ্ট দলীলের বিপরীত হইবে না।

২। হাদীস মুতাওয়াতির সূত্রে প্রমাণিত সুন্নাতের বিপরীত হইবে না।

৩। হাদীস সাহাবায়ে কিরামের সুস্পষ্ট ও অকাট্য ইজামার বিপরীত হইবে না।

৪। হাদীস সুস্পষ্ট বিবেক-বুদ্ধির বিপরীত হইবে না।

৫। হাদীস শরীয়াতের চির সমর্থিত ও সর্ব-সম্মত নীতির বিপরীত হইবে না।

৬।    কোন হাদীস বিশুদ্ধ ও নির্ভূলভাবে গৃহীত হাদীসের বিপরীত হইবে না।

৭। হাদীসের ভাষা আরবী ভাষায় রীতি-নীতির বিপরীত হইবে না। কেননা নবী করীম (স) কোন কথাই আরবী রীতি-নীতির বিপরীত ভাষায় বলেন নাই।

৮। হাদীস এমন কো অর্থ প্রকাশ করিবে না, যাহা অত্যন্ত হাস্যকর, নবীর মর্যাদা বিনষ্টকারী।

উসূলে হাদীস-এর গ্রন্হসমূহে এই পর্যায়ে আরো অনেক মূলনীতির উল্লেখ করা হইয়াছে।

হাদীস যাচাই করা এবং সহীহ কি গায়বে সহীহ পরখ করার জন্য উপরে বর্ণিত দুইটি পন্হা- ‘রেওয়ায়াত’ ও ‘দিরায়াত’- প্রয়োগ করার ব্যাপারে হাদীস-বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। এক শ্রেণীর লোক কেবলমাত্র রেওয়ায়াত- প্রক্রিয়া বা সনদ যাচাইর উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়া থাকেন। তাঁহাদের দৃষ্টিতে সনদ ঠিক থাকিলেই এবং উহার ধারাবাহিকতা ও সুস্থাতা-বিশুদ্ধতা যথাযথভাবে রক্ষিত হইলেই হাদীস নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য হইতে পারে। আরি অপরদের মতে সনদ ঠিক হওয়ার তুলনায় মূল হাদীসটি যুক্তিসংগত হওয়া-দিরায়াত-প্রক্রিয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এই দিক দিয়া কোন হাদীস সঠিকরূপে উত্তীর্ণ না হইলে তাহা গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। এমনকি সনদ ঠিক হইলেও এবং সনদ বিচারে তাহা গ্রহণযোগ্য প্রমাণিত হইলেও তাহা গ্রহণ করা যাইতে পারে না।

কিন্তু প্রকৃত মুহাক্কিক আলিমের দৃষ্টিতে এককভাবে এই দুইটি পন্হাই ভারসাম্যহীন। উহার একটি একান্তভাবে সনদ নির্ভর, সনদ ছাড়া সেখানে আর কিছুই বিচার্য নহে। আর সনদ ঠিক ও নির্ভরযোগ্য হইলেও সে হাদীস একান্তই গ্রহণীয়। দ্বিতীয়টি নিরংকুশভাবে বুদ্ধিভিত্তিক। সাধারণ বুদ্ধি ও যুক্তির দৃষ্টিতে মূল হাদীসটি গ্রহণযোগ্য হইলে উহার সনদ বিচারের কোন প্রয়োজনই মনে হয় না। অথচ প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র সনদ কোন কথাকে সত্য ও সঠিক প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট হইতে পারে না, যেমন যথেষ্ট নয় কেবলমাত্র বুদ্ধি ও যক্তি-বিচার! এই কারণে এই দুইটি প্রক্রিয়ার মাঝে পূর্ণ সামঞ্জস্য স্থাপন ও ভারাসাম্য রক্ষা করা অপরিহার্য।

হাদীস সমালোচনার সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি

হাদীস যাচাই করার সামঞ্জস্যপূর্ণ পন্হা কি হইতে পারে, তাহা বাস্তবিকই গবেষণা সাপেক্ষ। এই সম্পর্কে সুচিন্তিত অভিমত এই যে, প্রথমে সনদ যাচাই করিতে হইবে এবং তাহার হাদীমের মূল বাণী ********************* টুকু পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে। সনদ যদি ঠিক হয় এবং মূল হাদীসটুকুও ‘দিরায়াতে’র মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়, তবে সেই হাদীস সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য।

তবে অনেক হাদীস এমন রহিয়াছে যাহার সনদ নির্ভূল, আর মূল হাদীসের কথাটুকু সাধারণ বুদ্ধির অগম্য, এই ক্ষেত্রে দেখিবার ও বিবেচনার বিষয় শুধু এতটুকু যে, উহা কুরআনের খেলাফ নয় তো; কুরআন যাহা হালাল করিয়াছে, হাদীস তাহা হারাম কিংবা ইহার বিপরীত কিছু প্রমাণ করিতেছে না তো। কেননা সকলেই জানেন, মি’রাজ সম্পর্কীয় হাদীস ২৫ জন সাহাবী ও তিনশত তাবেয়ী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, অথচ ইহা সাধারণ বুদ্ধির পক্ষে দূরধিগম্য। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ইহা অবশ্যই সত্য ও বিশুদ্ধ হাদীসরূপে গ্রহণীয়। কেননা ইহা যেমন অসম্ভব ব্যাপার কিছু নয়, তেমনি কুরআনের সহিত পূর্ণ সামঞ্জস্যসম্পন্নও। ইহা কুরআনের অস্পষ্ট বা মোটামুটিভাবে উল্লিখিত বিষয়ের ব্যাখ্যা।

অনুরূপভাবে হাদীসসমূহের শব্দ ও ভাষা যাচাই করিয়াও নিশ্চিতরূপে বুঝিতে পারা যায় যে, উহা প্রকৃতই রাসুলে করীমের কথা কিনা। কোন হাদীসে রাসূলের যুগে অব্যবহৃত কোন পরিভাষার উল্লেখ থাকিলে তাহা রাসূলের হাদীস হইতে পারে না। যথাঃ

ক) হাদীসের কিাতবে উদ্ধৃতি পাওয়া যায়ঃ

******************************************************

কাদরীয়া পন্হীরা এই উম্মতের অগ্নিপূজক এবং রাফেযীরা এই উম্মতের ইয়াহুদী।

ইহার ভাষা ও শব্দসমূহ স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, ইহা কিছুতেই রাসূলের কথা হইতে পারে না। দ্বিতীয়ত ‘আল-কাদারী’ ও ‘রাফেযী’ ইত্যাদি শব্দ বিশেষ পরিভাষার পরিচয় বহন করে। আর এই ভাষা রাসূলে করীমের যুগে আদৌ প্রচলিত ছিল না বলিয়া রাসূল কর্তৃক ইহার প্রয়োগ হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না।

খ) নিম্নোক্ত কথাটিও ‘হাদীস’ নামে কথিতঃ

******************************************************

যে লোক ‘কুরআন মখলুক’ মনে করে সে কাফির।

কুরআন ‘মখলূক’ কি মখলুক নয়’- ইহা লইয়া আব্বাসীয় যুগে তদানীন্তন মনীষীদের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। রাসূলে করীমের যুগে এই ধরনের কথা ধারণা পর্যন্ত করা যায় নাই। কাজেই এই ধরনের কথা কখনো রাসূলের মুখ হইতে নিঃসৃত হইয়াছে বলিয়া বিশ্বাষ করা যাইতে পারে না।

হাদীস যাচাই পর্যায়ে ‘দিরায়াত’ রীতি প্রয়োগ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে জাওযী মুহাদ্দিসের যে নীতি ও পদ্ধতির উল্লেখ করিয়াছেন তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ

******************************************************

যেসব হাদীস সাধারণ বুদ্ধির বিপরীত পাইবে কিংবা সাধারণ মূলনীতির উল্টা দেখিবে, মনে করিবে যে, তাহা মওজু বা মনগড়া হাদীস। অতঃপর উহার বর্ণনাকারীদের যাচাই-পরখ করার কোন প্রয়োজন করে না। অনুরূপভাবে সেইসব হাদীসও মওজু যাহা সাধারণ অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে বাতিল প্রমাণিত হইয়াছে। যাহা কুরআন, মুতাওয়াতির হাদীস ও অকাট্য ইজমার খেলাফ এবং  যাহার কোন ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, তাহাও মওজু অথবা যেসব হাদীসে সাধারণ ও গুরুত্বহীন কথার উপর কঠোর আযাবের ভীতি প্রদর্শন করা হয়; কিংবা সামান্য কাজের ফলে বিরাট পুরস্কার দানের ওয়াদার উল্লেখ হয়, তাহাও মওজু- এই ধরনের হাদীস সাধারণত ওয়ায়েজ ও সুফীদের বর্ণনাসনূত্রে পাওয়া যায়।[*********************]

এতদ্ব্যতীত মনস্তাত্ত্বিক তুলাদণ্ডেও হাদীস যাচাই করার প্রয়োজন রহিয়াছে। যে ব্যক্তি রাসূলের হাদীস ব্যাপক ও নিরবচ্ছিন্নভাবে অধ্যায়ন করিবে, চর্চা করিবে, গভীর সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে উহা লইয়া গবেষণা করিবে, তাহার অন্তর্লোকে এক তীব্র স্বচ্ছ আলোকচ্ছটা প্রস্ফূটিতে হইয়া উঠিবে। সে সহজেই  বুঝিতে পারিবে কোনটি প্রকৃতই রাসূলের হাদীস, কোনটি নয়; রাসূল কোন ধরনের কথা বলিতে পারেন, কোন ধরনের কাজ নয়, কি ধরনের কথা বা কাজ তাঁহার সমর্থিত হইতে পারে, আর কোন ধরনের নয়।................. তাহা উপলীব্ধি করা তাহার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন হইবে না।[*********************]

এই পর্যায়ে চূড়ান্ত অভিমত এই যে, হাদীসের গ্রহণীয় হওয়া না হওয়া সম্পর্কে শেষ ফয়সালা সনদ ও মূল হাদীস (মতন) উভয়ের যথাযথ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যাচাই করার ভিত্তিতেই হওয়া আবশ্যক।

 

পরিশিষ্ট-২

উপমহাদেশে ইলমে হাদীস

উপমহাদেশে সাহাবীদের আগমন

এই উপমহাদেশের সহিত আরব দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক অতিশয় প্রাচীন। কাজেই ষষ্ট ঈসায়ী শতকে আরব সাগরের পশ্চিম উপকূলে- আরব দেশে- যে বিপ্লব সাধিত হইয়াছিল, পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এই উপমহাদেশে উহার প্রথম তরংগাভিঘাত আসিয়া পৌঁছা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। নির্ভরযোগ্য ইতিহাস হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী বিপ্লবের প্রথম কয়েক বৎসরে- নবূয়্যাত ও প্রথম খলীফার আমলে- না হইলেও দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূক (রা)-এর খিলাফতকালে বিশ্ব নবীর সাহাবিগণের কেহ কেহ এই উপমহাদেশে আগমন করিয়াছেন। এই সময়ে যে কয়জন সাহাবীর ভারত আগমনের সন্ধান পাওয়া যায়, তাঁহারা হইতেছেন- (১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবান, (২) হযরত আসেম ইবনে আমর আততমীমী, (৩) হযরত সুহার ইবনে আল-আবদী, (৪) হযরত সুহাইব ইবনে আদী এবং (৫) হযরত আল-হাকেম ইবনে আবিল আস আসসাকাফী (রা)।[সিয়ারুস সাহাবা, ৬ষ্ঠ খণ্ড।]

অতঃপর হযরত উসমান, হযরত আলী ও আমীর মুয়াবিয়ার শাসনামলেও ভারতে সাহাবীদের আগমন অব্যাহত থাকে। কিন্তু এই যুগে ভারত আগমনকারী মাত্র তিনজন সাহাবীর সন্ধান পাওয়া যায়। হযরত উসমানের খিলাফতকালে যে দুইজন সাহাবী ভারতবর্ষে আগমন করেন, তাঁহারা হইতেছেন (১) হযরত উবাইদুল্লাহ ইবনে মা’মর আততামীমী ও (২) হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা ইবনে হাবীর ইবনে আবদে শামস। আর হযরত আমীর মুয়াবিয়ার যুগে আসেন হযরত সিনান ইবনে সালমাহ ইবনে আল মুহাব্বিক আল- হযালী। তদানীন্তন ইরাক শাসনকর্তা যিয়াদ তাঁকে ভারত সীমান্তের শাসনকর্তা নিযুক্ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন।

উপমহাদেশে তাবেয়ীদের আগমন

সাহাবাদের পর বহু সংখ্যক তাবেয়ী ভারতে আগমন করিয়াছেন, ইতিহাস হইতে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমীর মুয়াবিয়ার যুগে সর্ব প্রথম যে তাবেয়ী ভারত আগমন করেন, তিনি হইতেছেন মূলহাব ইবনে আবূ সফরা। তিনি ৪৪ হিজরী সনে হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা সাহাবীল সঙ্গে একজন সেনাধ্যক্ষ হিসাবে এখানে পদার্পণ করেন। তিনি সিজিস্তান ও কাবুল সীমান্ত অতিক্রম করিয়া লাহোরে আসিয়া উপনীত হন।

উপমহাদেশে হাদীস প্রচার

সাহাবায়ে কিরামই ছিলেন ইলমে হাদীস প্রচারের সর্বপ্রথম বাহন। তাঁহারা ছিলেন দ্বীন-ইসলাম প্রচারের বাস্তব নমুনা ও অগ্রদূত। তাঁহারা যেখানেই গিয়াছেন, সেখানেই ইসলাম তখা কুরআন-হাদীস প্রচারে আত্মনিয়োগ করিয়াছেন। কাজেই এই দেশেও যে তাঁহারা কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসের প্রচারের কাজও করিয়াছেন তাহাতে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না। এই কারণে এই কথা বিশ্বাস করা যাইতে পারে যে, প্রথম হিজরী শতকের প্রথমার্ধে এই এলাকায় ইলমে হাদীসের কিরণ বিচ্ছুরিত হইয়াছে, যদিও তাহার বিস্তারিত ইতিহাস জানিবার কোন উপায় নাই।

সিন্দুদেশে ইলমে হাদীস

এই উপমহাদেশের সীমান্ত এলাকায় ক্রমাগত কয়েক বৎসর পর্যন্ত মুসলিম অভিসান পরিচালিত হয়। সিনান ইবনে সালমাহ ‘কুসদার’ দখল করেন। অতঃপর হুরী ইবনে হুরী বাহেলী এক ব্যাপক অভিযানের সাহায্যে সিন্ধুর অধিকাংশ এলাকার উপর ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেন।[বালাযুরী, ৪৩৯ও ৪৪০ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]

৯৩ হিজরী সনে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম সিন্ধু বিজয় সম্পূর্ণ করিয়া উহাকে ইসলামী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশে পরিণত করেন। মূলতান, মনসুরা, আলোর, দেবল, সিন্দান, কুসদার ও কান্দাবীল প্রভৃুতি স্থানে আরবারা উপনিবেশে স্থাপন করেন। মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের সঙ্গে ৫০ সহস্র অশ্বারোহী সৈনিক স্থায়ীভাবে বর্তমান। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্যে এই সময় এদেশের বহু সংখ্যক আরব আগমন করেন। ফলে উল্লিখিত সকল স্থানেই ইসলামী শিক্ষার- কুরআন ও হাদীস শিক্ষাদানের- কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এই আরবদের মধ্যে ব হু হাফেজে কুরআন ও হাদীসের হাফেজ লোকও বর্তমান ছিলেন। তাঁহাদের চেষ্টা যত্নে এই এলাকায় কুরআন-হাদীসের শিক্ষা ব্যাপক প্রচার লাভ করে। তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা বিশেষভাবে হাদীস প্রচারের কাজ করিয়াছেন তাঁহাদের কয়েকজনের নাম পরিচয় এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১. মূসা ইবনে ইয়াকুব আসসাকাফী। তিনি সিন্ধুদেশে বিচারপতি (কাযী) হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। ইলমে হাদীসে তাঁহার বিশেষ পারদর্শিতা ছিল।

 ২. ইয়াযীদ ইবনে আবী কাবশী আদ-দেমাশকী (মৃঃ ৯৭ হিঃ)। তিনি ছিলেন তাবেয়ী, হযরত দারদা শারাহবীল ইবনে আওজ ও মারওয়ান ইবনে হাকাম প্রমুখ সাহাবীর নিকট হইতে তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবেও তিনি স্বীকৃত ছিলেন।

৩. মুফাযযল ইবনে মুহালাব ইবনে আবূ সাফরা (মৃঃ ১০২ হিঃ) তাবেয়ী। হাদীস বর্ণনায় তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা অবলম্বন করেন। সাহাবী হযরত নুমান ইবনে বশীল হইতে তিনি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন এবং তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন (তাঁহার পুত্র) হাজিব, সা-বিতুল বানানী ও জরীর ইবনে হাযেম।

৪. আবূ মূসা ইসরাঈল ইবনে মূসা আল বসরী (মৃঃ ১৫৫ হিঃ) সিদ্ধী। তিনি বসরা হইতে ব্যবসার উপলক্ষে ভারতে আগমন করেন। তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত হাদীস বর্ণনাকারী। সুফিয়ান সওরী (মৃঃ ১৬১ হিঃ), সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) ও ইয়াহইয়া ইবনে সায়াদুল কাত্তান (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) প্রভৃতি প্রখ্যাত হাদীস পারদর্শিগণ তাঁহার ছাত্র। ইলমে হাদীসে আবূ মূসার মর্যাদা যে কত উচ্চ, তাহা এই বিবরণ হইতেই সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। ইমাম বুখারী তাঁহার হাদীস গ্রন্হে আবূ মুসার সূত্রে বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

৫. আমর ইবনে মুসলিম আল বাহেলী, তিনি খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীযের অধীনে প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসাবে সিন্ধু আগমন করেন। তিনি ইয়ালা ইবনে উবাইদ হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

৬. রবী ইবনে সবীহ আস-সায়দী আল-বসরী (মৃঃ ১৭০ হিঃ) তিনি বহু হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন; হাদীস গ্রন্হও তিনি সংকলন করিয়াছেন। ১৬০ হিজরীতে তিনি ভারত পদার্পণ করেন।

আরব উপনিবেশসমূহে হাদীস প্রচার

দেবল

আরব শাসনাধীন দেবল (সিন্ধু প্রদেশ) শহরে হাদীসের বিশেষ চর্চা ও প্রচার সাধিত হয়। ফলে এখানে কয়েকজন প্রখ্যাত হাদীস বর্ণনাকারীর উদ্ভব হয়। নিম্নে তাঁহাদের কয়েকজনের নাম পরিচয়ের উল্লেখ করা যাইতেছে-

১। আবূ জা’ফর দেবলী (মৃঃ ৩২২ হিঃ)। তিনি মূসা ইবনে হারূন বাজ্জাজ (মৃঃ ২৯৪ হিঃ) ও মুহাম্মদ ইবনে আলী আস সাইফ (মৃঃ ২৯১ হিঃ) হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

৩। আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ দবলী (মৃঃ ৩৪৬ হিঃ)। তিনি মুহাদ্দিস আবূ জা’ফরের ছাত্র। তিনি চতুর্থ শতকের বিপুল সংখ্যক হাদীস প্রচারকারীরূপে খ্যাত।

৪। মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ দেবলী (মৃঃ ৩৪৬ হিঃ)। তিনি খলীফা আবূ আল কাযীর (মৃঃ ৩০৫) নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। প্রখ্যাত মনীষী হাকিম নিশাপুরূ তাঁহার ছাত্র।

৫। আল হাসান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আসাদ দেবলী (মৃঃ ৩৫০ হিঃ)। ৩৪০ হিজরীতে তিনি দামেশকে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার হাদীস বর্ণনা সূত্রে সূচনা হয় হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) সাহাবী হইতে।

৬। খালফ ইবনে মুহাম্মদ দেবলী (মৃঃ ৩৬০ হিঃ)। তিনি প্রথমে দেবলেই আলী ইবনে মূসা দেবলীর নিকট হাদীস শিক্ষালাভ করেন। পরে তিনি বাগদাদ গমন করেন ও তথায় হাদীসের দারস দিতে শুরু করেন।

৭।   আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হারূন দেবলী (মৃঃ ৩৭০ হিঃ)। তিনি বাগদাদে জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ ফারেয়াবীর নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। কূফা নগরে আহমদ ইবনে শরীফের নিকটও তিনি হাদীস অধ্যায়ন করেন।

৮। হাসান ইবনে হামীদ দেবলী (মৃঃ ৪০৭ হিঃ)। তিনি বড় ব্যবসায়ী ছিলেন এবং ব্যবসায়ের সঙ্গে সঙ্গে হাদীস চর্চা করিয়া তাহাতেও যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সায়ীদ মুচেলী (মৃঃ ৩৫৯ হিঃ), দা’লাজ (মৃঃ ৩৫১ হিঃ), মুহাম্মদ নক্কশ (মৃঃ ৩৫১ হিঃ), এবং আবু আলী তুমারী (মৃঃ ৩৬০ হিঃ) তাঁহার উস্তাদ ছিলেন। তিনি যখন হাদীস বর্ণনা করিতেন, তখন তাঁহার হৃদয় ভাবাবেগে এতই আর্দ্র উচ্ছ্বাসিত হইয়া উঠিত যে, তিনি কাঁদিয়া ফেলিতেন।

৯। আবূল কাসেম শুয়াইব ইবনে মুহাম্মদ দেবলী (মৃঃ ৪০০ হিঃ)। তিনি আবূ কাতান নামে পরিচিত। তিনি মিসরে গমন করেন এবং তথায় একটি সংঘ গঠন করিয়া হাদীস শিক্ষাদান করিতে থাকেন।

আল-মনসূরা

আল-মনসূরা বর্তমনা সিন্ধু-হায়দাবাদ হইতে উত্তর-পূর্বদিকে ৪৭ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। এই শহর প্রথম মুসলিম অধিকারের যুগ হইতেই ইসলামী ভাবধারায় পূর্ণ ছিল। ইহার অধিকাংশ অধিবাসীই হাদীসের অনুসারী ছিল। তাই এই শহরে হাদীস চর্চায় চরম উন্নতি লাভ ঘটে বলিয়া ধারণ করা চলে। বিভিন্ন মসজিদে হাদীসের অধ্যাপনা চলিত। বিশেষজ্ঞগণ হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁহাদের মধ্যে  কাযী আবুল আব্বাস আল-মনসূরী হাদীসের শিক্ষাগুরু ও গ্রন্হ সংকলকরূপে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

এই শহরে অপরাপর যেসব হাদীসবিদ ছিলেন, তাঁহাদের নাম পরিচয় নিম্নে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১। আহমদ আবুল আব্বাস আল-মনসুরী। ফারেসে আবুল আব্বাস ইবনে আসরামের (মৃঃ ৩৩৬ হিঃ) নিকট এবং বসরায় আহমদ হিজ্জানীর (আবূ রওক নামে খ্যাত, মৃঃ ৩৩২ হিঃ) নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করেন।

২। আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আল-মনসূরী (মৃঃ ৩৮০ হিঃ)। তিনি ফারেসেও বসরায় হাদীস শিক্ষালাভ করেন। চতুর্থ শতকে তিনি মুহাদ্দিস হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন।

৩। আবূ আবদুল্লাহ ইবনে জা’ফর মুররা আল-মনসূরী (মৃঃ ৩৯০ হিঃ)। তিন হাসান ইবনে আল মুকাররামের ছাত্র। আল হাকিম নিশাপুরীর উস্তাদ হিসাবে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

কাসদার

বর্তমান কালাত রাজ্যের খোশদার নাকম স্থানই সেকালে কাসদার নামে পরিচিত ছিল। হযরত সিনান ইবনে সালমাহম হুযালীর সমাধি এখানে অবস্থিত। আরব শাসন আমলে ইহা তুরান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ইহা একটি ব্যবসায় কেন্ত্র হিসাবে সমাধিক গুরুত্ব লাভ করিয়াছিল। হাদীস চর্চায় এই শহরে বিশেষ স্থান অধিকার করে। এখানকার কয়েকজন হাদীসবিদের নাম এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১। জা’ফর ইবনে খাত্তাব কাসদারী (মৃঃ ৪৫০ হিঃ)। তিনি আবূ মুহাম্মদ নামে খ্যাত। উত্তরকালে তিনি বলখ শহরে বসবাস শুরু করেন। তিনি ‘সিকাহ’ হাদীস বর্ণনাকারীরূপে স্বীকৃত। আবুল ফুতুহ আবদুল গফুর কাশঘরী (মৃঃ ৪৭৪ হিঃ) ‘হাফেজে হাদীস’ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিতেন। ৫ম শতকে তিনি মুহাদ্দিস হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন।

২। সীবাওয়াইহ ইবনে ইসমাঈল কাসদারী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ)। আস আবুল কাসেম আলী ইবনে মুহাম্মদ হুসাইনী, ইয়াহইয়া ইবনে ইবরাহীম ও রাজা ইবনে আবদুল ওয়াহিদ তাঁহার উস্তাদে হাদীস। তিনি মক্কায় গমন করেন ও তথায় হাদীস দারস দান শুরু করেন। আবুল ফিতাইয়ান আমর ইবনে হাসান রাওয়াসী (মৃঃ ৫০৩ হিঃ) তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

উত্তর ভারতে হাদীস চর্চা

দ্বিতীয় হিজরী শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সিন্ধুদেশ কেন্দ্রীয় আরব সরকারের অধীন ছিল। তাহার পর এ দেশের বিদ্রোহ, উচ্ছৃঙ্খলতা ও রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। সেকালে গোটা প্রদেশ কতকগুলি ক্ষুদ্র দেশীয় স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হইয়া পড়ে। তৃতীয় শতকে এই রাজ্যগুলিও ধ্বংস হইয়া যায়। অতঃপর এতদঞ্চলে বাতেনী সম্প্রদায়ের প্রভাব বিস্তার লাভ করে। ফলে কিছু কালের জন্য উহার সহিত কেন্দ্রীয় মুসলিম শাসকের সম্পর্ক ছিন্ন হইয়া যায়।

৪১৩ হিজরী সনে সুলতান মাহমুদ গযনভী খাইবারের গিরিপথে পাঞ্জাব আক্রমণ করে লাহোর অধিকার করেন। ইহার ফলে পাক-ভারতের সহিত মুসলিমদের সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হয়। অতঃপর সপ্তম হিজরী শতকের মধ্যে গোটা উপমহাদেশের উপর মুসলিম আধিপত্য বিস্তৃত ও দৃঢ়তর হয়। দিল্লী মুসলিমদের রাজধানীরূপে নির্দিষ্ট হয়। ইহার পর খাইবার গিরিপথ হইতে এশিয়াটিক তুর্কিস্তান, খুরাসান ও আফগানিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলিমগণ দলে দলে ভারতে আগমন করিতে থাকে। প্রথমোক্ত দুইটি দেশ- এশিয়াটিক তুর্কিস্তান ও খুরাসান-হিজরী তৃতীয় শতকে ইলমে হাদীসের পাদপীঠে পরিণত হইয়াছিল। সিহাহ-সিত্তার গ্রন্হ প্রণেতাগণ এই অঞ্চলেরই অধিবাসী ছিলেন। এই দেশে হইতে বিপুল সংখ্যক লোকের আগমনের ফলে ভারতে ইসলামী শিক্ষা ও ইলমে হাদীসের ব্যাপক প্রচার শুরু হইয়া যায়। বিশেষত লাহোর এই সময় হাদীস শিক্ষার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়।

লাহোরে ইলমে হাদীস

লাহোরে ইলমে হাদীস প্রচারের কথা বলিতে গেলে সর্বপ্রথম উল্লেক করিতে হয় শায়খ মুহাম্মদ ইসমাঈল লাহোরীর নাম (মৃঃ ৪৪৮ হিঃ)। তিনি বুখারা হইতে ৩৯৫ হিজরী সনে ভারতে আগমন করেন ও লাহোরে বসবাস করিতে শুরু করেন। এখানে তিনি ইসলামী আদর্শ প্রচার প্রসঙ্গে ইলমে হাদীসের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন ও উহার ব্যাপক প্রচারের কার্যকর পন্হা অবলম্বন করেন। ফলে পরবর্তী একশত বৎসরের মধ্যে লাহোরে অসংখ্য মুহাদ্দিস গড়িয়া উঠেন।

এই সময়কালের লাহোর বসবাসকারী কয়েকজন মুহাদ্দিসের নাম-পরিচয় এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

‌‌‌১। সাইয়েদ মুরতাযা (মৃঃ ৫৮৯ হিঃ)। তিনি হাদীস-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন ও সুলতান শিহাব উদ্দীন ঘোরীর সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন।

২। আবুল হাসান আল ইবনে উমর লাহোরী (মৃঃ ৫২৯ হিঃ)। তিনি বড় মুহাদ্দিস ছিলেন, হাফেজে হাদীস আবুল মুযাফফর সায়ীদীর নিকট তিনি হাদীস শিক্ষা লাভ করেন।

৩। আবুল ফুতহ আবদুস সামাদ ইবনে আদুর রহমান লাহোরী (মৃঃ ৫৫০ হিঃ)। তিনি সমরকন্দে হাদীসের দারস দিতেন।

৪। আবুল কাসেম মুহাম্মদ ইবনে খালফ লাহোরী (মৃঃ ৫৪০ হিঃ)। তিনি পরে ‘ইসফ্রাইন’ চলিয়া যান। তিনি একজন উঁচুদরের হাদীসবিদ আলিম ছিলেন।

সপ্তম শতকের উপমহাদেশীয় মুহাদ্দিস

হিজরী সপ্তম শতকে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব মুহাদ্দিস জীবিত ছিলেন, এখানে তাঁহাদের কয়েকজনের নাম পরিচয় উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

‌১. শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী (মৃঃ ৬৬৬ হিঃ)। তিনি সাহাবী হাব্বান ইবনে আসওয়াদের বংশধর। মক্কা ও মদীনা হইতে তিনি হাদীস শিক্ষা ও তাহাতে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন।

২. কাজী মিহাজুস সিরাজ জুজানী (মৃঃ ৬৬৮ হিঃ)। তিনি বংগদেশের লক্ষণাবতি আগমন করেন।

৩. বুরহান উদ্দীন মাহমুদ ইবনে আবুল খায়ের আসাদ বলখী (মৃঃ ৬৮৭ হিঃ)। তিনি মুহাদ্দিস সাগানীর ছাত্র ছিলেন এবং তাঁহার নিকট হইতে ‘মাশায়ীকুল আনওয়ার’ হাদীস গ্রন্হ বর্ণনা করার সনদ লাভ করেন।

 ৪। কামালুদ্দীন জাহিদ (মৃঃ ৬৮৪ হিঃ)। তাঁহার আসল নাম মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে মুহাম্মদ। তিনি শায়খ নিজামুদ্দীন আউলিয়া উস্তাদে হাদীস হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন।

৫. রাযীউদ্দীন বদায়ূনী (মৃঃ ৭০০ হিঃ)। তিনি সমসাময়িকদের মধ্যে অতিশয় খ্যাতিসম্পন্ন মুহাদ্দিস ছিলেন।

৬. শরফূদ্দীন আবূ তাওয়ামা বুখারী হাম্বলী (মৃঃ ৭০০ হিঃ)। তিনি বুখারা হইতে সপ্তম শতকের শুরুতে দিল্লী আগমন করেন। তিনি বংগদেশের (ঢাকা জিলাধীন) সোনারগাঁয়ে চলিয়া আসেন এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি বিশেষ মনোযোগ সহকারে ইলমে হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। তাঁহার চেষ্টায় সোনার গাঁ অনতিবিলম্বে হাদীস শিক্ষার পাদপীঠে পরিণত হয়। দুঃখের বিষয়, সোনারগাঁয়ে ইলমে হাদীস চর্চার বিস্তারিত বিবরণ এখনো কজ্ঝটিকার অন্ধকারে নিমজ্জিত।

অষ্টম শতকে উপমহাদেশের হাদীস চর্চা

অষ্টম হিজরী শতকে পাক-ভারতে ইলমে হাদীসের ক্রমবিকাশের অধ্যায় সূটিত হয়। দাক্ষিণাত্যের বাহামুনী বাদশাহ মাহমুদ বাহামুনী (৭৮০-৭৯৯ হিঃ) ইলমে হাদীস প্রৃচারের দিকে বিশেষ লক্ষ্য আরোপ করেন। হাদীস শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি বৃত্তির ব্যবস্থা করেন।[ঐতিহাসিক ফিরিশতা] এই সময় ভারতের প্রায় সর্বত্র ফিকাহ, দর্শন ও তাসাউফ চর্চার প্রভাব পরিলক্ষিত হইলেও হাদীস শিক্ষা ব্যাপক কোন অংশে ব্যাহত হয় নাই। বরং বিশিষ্ট তাসাউফ পন্হিগণ ইলমে হাদীস প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সর্বোপরি চারজন প্রখ্যাত তাসাইফবাদীর নেতৃত্বে নিম্নলিখিত চারটি হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র গড়িয়া উঠে।

১. নিজামউদ্দীন আউলিয়ার নেতৃত্বে দিল্লীতে হাদীসের ব্যাপক শিক্ষাদান শুরু হয়।

২. শরফুদ্দীন আল-মুনীরীর নেতৃত্বে ও শিক্ষাদানের ফলে বিহার অঞ্চলে হাদীস শিক্ষার সূচনা হয়।

৩. আল-হামদানীর নেতৃত্বে কাশ্মীরে হাদীস শিক্ষা সূচিত হয়।

৪. যাকারিয়া মুলতানীর নেতৃত্বে মুলতানে ইলমে হাদীসের প্রচার হয়।

উল্লিখিত কেন্দ্রসমূহ হইতে বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস বহির্গত হন। কেন্দ্র ভিত্তিক কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিসের নাম উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

নিজামুদ্দীন আউলিয়ার কেন্দ্র

১) শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া উধী (মৃঃ ৭৪৭ হিঃ)

২) ফখরুদ্দীন জারুবাদী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)

৩) যিয়াউদ্দীন ইবনে মুয়াইয়েদুল মুলক বরনী

৪) মহীউদ্দীন ইবনে জালালউদ্দীন বিন কুতুব উদ্দীন কাশানী (মৃঃ ৭১৯ হিঃ)

৫) নিজামউদ্দীন আল্লানী জাফরাবাদী (মৃঃ ৭৩৫ হিঃ)

৬) শায়খ নসীর উদ্দীন চিরাগে দিল্লী (মৃঃ ৭৫৭ হিঃ)

৭) সাইয়েদ মুহাম্মদ গীসুদরাজ (মৃঃ ৮২৫ হিঃ)

৮) শায়খ অজীহ উদ্দীন

৯) কাজী শিহাব উদ্দীন দওলতাবাদী (মৃঃ ৮৪৯ হিঃ)

১০) মওলানা খাজেগী কুরাবী (মৃঃ ৮৭৮ হিঃ)

শরফুদ্দীন আল-মনীরী কেন্দ্র

১) শায়খ মুজাফফর বলখী (মৃঃ ৭৮৬ হিঃ)

২) হুসাইন ইবনে মুয়েজ বিহারী (মৃঃ ৮৪৫ হিঃ)

৩) আহমদ লংগরে দরিয়া ইবনে হাসান ইবনে মুজাফফর বিহারী (মৃঃ ৮৯১ হিঃ)

আলী হামদানীর কেন্দ্র

কাশ্মীরে আলী হামদানীই সর্বপ্রথম ইলমে হাদীস লইয়া আসেন। তিনি ৭৭৪ হিজরীতে এখানে পদার্পণ করেন। তিনি ও তাঁহার ছাত্রবৃন্দই এইদেশে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচার করেন। তিনি হাদীসের দুইখানি  গ্রন্হও প্রণয়ন করেন। গ্রন্হ দুইটির নামঃ

ক) আস-সাবয়ীন ফী ফাযায়েলে আমীরিল মুমিনীন

খ) আরবায়ীনে আমিরীয়া

মুলতানে শায়খ যাকারিয়ার কেন্দ্র

শায়েখ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানে হাদীস শিক্ষা প্রচারের অগ্রদূত। এই কেন্ত্র হইতে জামাল উদ্দীন উলূচী ও মখদুমে জাহানীয়া সাইয়েদ জালাল উদ্দীন বুখারী মুহাদ্দিস হইয়া বাহির হন।

উপমহাদেশে ইলমে হাদীসের রেনেসাঁ যুগ

নবম শতকে উপমহাদেশে ইলমে হাদীসের রেনেসাঁ যুগ সূচিত হয়। গুজরাটের অধিপতি আহমদ শাহ আরব ও ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্য পথ নূতন করিয়া উম্মক্ত করেন। ফলে আরবদেশ হইতেবহু হাদীদবিদ ভারতবর্ষে আগমন করেন। প্রতিবেশী ইরান সরকার এই সময় শিয়া ধর্মমত গ্রহণ করেন। এই কারণে হাদীস-বিজ্ঞানে পারদর্শী একটি বিরাট জামা’আত সেখানে হইতে ভারতে হিজরত করিয়া আসিতে বাধ্য হন। সঙ্গে তাঁহারা বিপুল পরিমাণ হাদীস সম্পদ এখানে লইয়া আসেন। অপরদিকে মিসরেও এই  সময় ইলমে হাদীসের প্লাবন সৃষ্টি হয় এবং তথা হইতে বড় বড় মুহাদ্দিস ভারত আগমন করেন। এই সময় যেসব মুহাদ্দিস ভারতে আসেন, তাঁহাদের মধ্যে নিম্নলিখিত দুইজন মুহাদ্দিসের নাম সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্যঃ

১. বদরউদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আবী বকর দামায়নী (মৃঃ ৮২৭ হিঃ)। তিনি ইয়েমেনের জামে জাবীদ-এ হাদীসের অধ্যাপক ছিলেন। এখানে তিনি বুখারী শরীফের একখানি ভাষ্য (Commentary) রচনা করেন। উহার নাম ‘মাসাবীহুল জামে’ (*********************)। তিনি ৮২০ সনের শাবান মাসে ভারতের গুজরাটে আগমন করেন। এখানে নিম্নলিখিত তিনখানি গ্রন্হ রচনা করেনঃ (ক) তা’লীকুল ফরায়েয (*********************) (খ) ‘তুহফাতুল গরীব, শরহে আল-মুগনীউল লবীব’ এবং (গ) ‘আইনুল হায়াতফী খুলাসাতে হায়াতুল হাইয়ান’।

২। আবুল ফুতুহ নুরউদ্দীন আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ শিরাজী তয়ূসী (মৃঃ ৮৫০ হিঃ)।

তিনি সম্ভবত ৮১৪-৮৪৪ সনে গুজরাটে আসনে। তিনি মাজদুদ্দীন ফিরোজাবাদী, শামসউদ্দীন জাজারী, সাইয়েদ শরীফ জুরজানী ও বাবা ইউসুফ হারাভীর ছাত্র।

মিসরের ইবনে হাজার আসকালানী প্রতিষ্ঠিত হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র হইতে যাঁহারা ভারতে আসেন, তাঁহাদের মধ্যে নিম্নলিখিত দুইজন মুহাদ্দিস উল্লেখযোগ্যঃ

১. ইয়াহইয়া ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবুল খায়ের হাশেমী (মৃঃ ৮৪৩ হিঃ)

২. খাজা ইমাদ সাখাভী প্রতিষ্ঠিত হাদীস কেন্দ্র হইতে নিম্নলিখিত মুহাদ্দিসগণ ভারতে আসেনঃ

১) আবুল ফাতাহ আর-রাযী আল-মক্কী (মৃঃ ৮৮৬ হিঃ)

২) আহমদ ইবনে সালেহ মালভী

৩) উমর ইবনে মুহাম্মদ দামেশকী (মৃঃ ৯০০ হিঃ)

৪) আবদুল আযীয ইবনে মাহমুদ তুসী (মৃঃ ৯১০ হিঃ)

৫) অজীহুদ্দীন মুহাম্মদ মালাকী (মৃঃ ৯১৯ হিঃ)

৬) হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আওলিয়া কিরমানী (মৃঃ ৯৩০ হিঃ)

৭) জামালুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে উমর হাজরানী (মৃঃ ৯৩০ হিঃ)

৮) রফীউদ্দীন সাকাভী (মৃঃ ৯৫৪ হিঃ)

যাকারিয়া আল-আনসারী প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র হইতে আগত মুহাদ্দিসগণের নামঃ

১) আবদুল মু’তী হাজরানী ( মৃঃ ৯৮৯ হিঃ)

২) শিহাবুদ্দীন আব্বাসী (৯৩২ হিঃ)

ইবনে হাজার হায়সামী প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র হইতে আগত মুহাদ্দিসগণের নামঃ

১) শায়খ ইবেন আবদুল্লাহ আইদরুসী (মৃঃ ৯৯১ হিঃ)

২) আবূ সায়াদাত মুহাম্মদ আল ফকহী (মৃঃ ৯৯২ হিঃ)

৩) মীর মুরতাযা শরীফ শিরাজী (মৃঃ ৯৭৪ হিঃ)

৪) মীর কাঁলঅ মুহাদ্দিস  আকবারাবাদী (মৃঃ ৯৮৩ হিঃ)

মিশকাত শরীফের প্রসিদ্ধ ভাষ্য ‘মিরকাত’- এর গ্রন্হকার মুল্লা আলী কারী এই কাঁলাই ছাত্র।

অতঃপর পাক-ভারতের নিম্নলিখিত স্থানসমূহে হাদীস শিক্ষার কেন্দ্র গড়িয়া উঠে।

১) দাক্ষিণাত্যে- এখানে বহু সংখ্যক মুহাদ্দিসের আগমন হয়। (২) গুজরাট (৩) মালওয়া (৪) খান্দেশ (৫) সিন্ধু- পাঁচ শত বৎসর পর দশম হিজরী শতকে এখানে নূতনভাবে ইলমে হাদীস শিকা ও প্রচারকার্য শুরু হয়। (৬) লাহোর- মওলানা মুহাম্মদের (মৃঃ ১০০০ হিঃ) নেতৃত্বে এই শহর হাদীস শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়। (৭) ঝাঁসী ও কালপী- সাইয়েদ মুহাম্মদ ইবরাহীম নামক এক বাগদাদী মুহাদ্দিস ১০ম হিজরী শতকে এখানে আগমন করেন ও হাদীস শিক্ষা দান শুরু করেন। (৮) আগ্রা- এখানে এক সঙ্গে তিনটি হাদীস কেন্দ্র স্থাপিত হয়ঃ ক. রফীউদ্দীন সাফাবীর  মাদ্রাসা খ. হাজী ইবরাহীম মুহাদ্দিস আকবরাবাদীর (মৃঃ১০১০  হিঃ) মাদ্রাসা এবং গ) সাইয়েদ শাহমীর (মৃঃ ১০০০হিঃ) মাদ্রাসা (৯) লক্ষ্ণৌ- দশম শতকের শেষার্ধে এই শহর হাদীসশাস্ত্র আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়, যখন মদীনা হইতে শায়খ যিয়াউদ্দীন মুহাদ্দিস এখানে আসিয়া বসবাস ও হাদীস শিক্ষা দান শুরু করেন। (১০) জৌনপুরী-সম্ভবত ইমাম সাখাভীর ছাত্র মুহাযযহাব জৌনপুরীরর মাধ্যমে এখানে হাদীস প্রচার হয়। (১১) বিহার- অষ্টম শতকে শরফূদ্দীন মুনীরীর ছাত্র সাইয়েদ মিনহাজুদ্দীন রাস্তীর মাধ্যমে বিহারস্থ ফুলওয়ারী শরীফে ইলমে হাদীস পৌঁছায়। দশম শতকে ইহা বিকাশ ও উন্নতি লাভ করে।

হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে উপমহাদেশীয়দের বিদেশ সফর

৮২০ হিজরী হইতে ৯৯২ হিজরীর (ইং ১৪১৭- ১৫৮৪) মধ্যে উপমহাদেশে বিদেশী মুহাদ্দিসগণের আগমনে হাদীস শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নব জোয়ারের সূচনা হয় এবং তখন হইতেই এই দেশের বিদ্যোৎসাহী ও জ্ঞান পিপাসু ব্যক্তিগণ হাদীস শিক্ষার মহান উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরে বহির্গত হইতে শুরু করেন। তাঁহাদের এই বিদেশ যাত্রা কেবল ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হইয়া থাকে নাই- সুদূর মক্কা-মদীনা পর্যন্ত তাঁহারা ইলমে হাদীসে উচ্চ শিক্ষা লাভ করার উদ্দেশ্যে সফর করেন। এই যুগেও তাঁহারা উত্তাল তরঙ্গ মুখর সমুদ্র পরিক্রমার ঝুঁকি গ্রহণ করিতে এক বিন্দু কুণ্ঠিত বা ভীত হন নাই। এই যুগের মুহাদ্দিস আবদুল আউয়াল আল-হুসাইনী (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ) হইতে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (মৃঃ ১১৭২ হিঃ) পর্যন্ত প্রায় সকল হাদীসবিদই হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে এইরূপ সফর করিয়াছেন।

এই পর্যন্ত সর্বপ্রথম এই দুর্গম সফরে গমন করেন জামালুল্লাহ গুলবাগী। তিনি মক্কায় হাদীস শিক্ষা করেন। অতঃপর আরো বহু লোক হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে মক্কা ও মদীনা গমন করেন এবং এইরূপ সফর অব্যহতভাবে চলিতে থাকে। ভারতের প্রথম হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র    দেওবন্দ ও সাহারানপুর মাদ্রাসা স্থাপিত হওয়ার সময় পর্যন্ত।

এই সময় নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ হাদীস-বিজ্ঞানে বিশেষ পারদশিতা লাভ করেনঃ

১. আবূ বকর ইবনে মুহাম্মদ আল-বহরুজী (মৃঃ ৯১৫ হিঃ)। তিনি আল-জাজারী সংকলিত ‘হিসনে হাসীন’ গ্রন্হের ফারসী অনুবাদ এবং উহার টীকা রচনা করেন। ‘আইনুল ওফা ফী তরজমায়ে শিফা’ নামে কাজী ইয়াযের গ্রন্হেরও তিনি ফরাসী অনুবাদ করেন।

২. মীর সাইয়েদ আবদুল আউয়াল আল-হুসাইনী গুজরাটী জৌনপুরী (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ)। তিনি মুহাদ্দিস আবুল ফাতাহর সমসাময়িক। মক্কা মদীনায় হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি হাদীসের উচ্চলিক্ষা লাভের জন্য বিশেষ কষ্ট ও শ্রম স্বীকার করেন এবং ‘ফায়যুলবারী ফী শরহিল বুখারী’ ও ‘মুন্তাখাবে কিতাবে সাফরুস সায়াদাত’ নামে দুইখানি  গ্রন্হ রচনা করেন। খান-খানান আকবরের আমলের প্রাথমিক যুগে তাঁহাকে গুজরাট হইতে দিল্লী আমন্ত্রণ করেন।

৩. খাজা মুবারক ইবনে মখদুম আর রাজানী বানারসী (মৃঃ ৯৮১ হিঃ)। তিনি ‘মাদরিজুল আখবার’ নামে একখানি হাদীসগ্রন্হ সংকলন করেন।

৪. শায়খ ভিকারী কাকুরী (৮৯০-৯৮১ হিঃ)। তাঁহার আসল নাম ছিল নিজামুদ্দীন ইবনে আরম সাইফুদ্দীন।তিনি খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি হাফেজ সাকাভীর নিকট হাদীস শ্রবণ ও অধ্যায়ন করেন। হাদীসের খেদমতে তিনি জীবন উৎসর্গ করেন। সহীহ বুখারী তাঁহার সম্পূর্ণ মুখস্থ ছিল।

৬. জামালুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে তাহের ইবনে আলী ফাত্তানী (মৃঃ ৯১৪ হিঃ)। তিনি ‘মালেকুল মুহাদ্দিসীন’ (মুহাদ্দিসদের বাদশাহ) নামে খ্যাত হইয়াছিলেন। মক্কা শরীফে আলী মুত্তাকীল হাদীস শিক্ষা কেন্দ্রে ৯৪৪ হিজরী সনে হাদীস শিক্ষার জন্য ভর্তি হন এবং দীর্ঘ ছয় বৎসর পর্যন্ত তথায় হাদীস অধ্যায়ন করেন। তিনি তাঁহার নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলীর কারণে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন।

ক) মাজমাউল বিহারুল আনওয়ার (********************)

খ) তাযকরিাতুল মওজুয়াত

গ) কানুনূল মওজুয়াত অজজয়ীফ

ঘ) আসমাউর-রিজাল

ঙ) আলমুগীনী ফী জাবতির রজাল

৭. শায়খ তাইয়েব সিন্ধী (মৃঃ ৯৯৯ হিঃ)। তিনি তা’লিকাতে মিশকাতুল মাসাবীহ’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন।

৮. শায়খ আবদুল্লাহ আনসারী সুলতানপুরী (মৃঃ৯৯০ হিঃ)। সম্রাট আকবরের আমলে তিনিই ভারতের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আলিম ছিলেন। তাঁহার উল্লেখযোগ্য দুইখানি গ্রন্হের নাম এইঃ

৯) শরহে আলা শামায়েলুন্নবী গাংগুহী (মৃঃ ৯৯০ হিঃ)। তিনি ইবনে হাজার হায়সামীর নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। আকবরের আমলে তিনি ইসলামের জন্য বিপ্লবাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেন।

হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্যঃ

ক) সুনানুল হুদা-ফী-মুতাবিয়াতিল মুস্তফা

খ) আযায়েফুল ইয়াওম আল্লাইল

১০. শায়খ অজীহুদ্দীণ আলাভী গুজরাটী (মৃঃ ৯৯০ হিঃ)। তিনি অন্যূন ২৩ খানা গ্রন্হ রচনা করেন। শরহে জামী, তাফসীরে বায়যায়ী, নুজহাতুন্নযার ফী শরহে মুখবাতুল ফিকর প্রভৃতি তাঁহার বিখ্যাত রচনা।

১১. শায়খ তাহের ইবনে ইউসুফ সিন্দী বুরহানপুরী (মৃঃ ১০০৪ হিঃ)। তাঁহার রচিত গ্রন্হের সংখ্যা চারঃ

ক)  তালখীস শরহে আসমাউর-রিজাল আল-বুখারী কিরমানী

খ) মুলকাত জামেউল জাওয়ামি

গ) শরহুল বুখারী

ঘ) রিয়াযুস সালেকীন

১২. শায়খ ইবনে হাসান সায়ফী কাশ্মীরী (মৃঃ ১০০৩ হিঃ)। তিনি শায়খ আহমদ সরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানীর উস্তাদ। তাঁহার গ্রন্হাবলীর নামঃ

ক) শরহে সহীহুল বুখারী

খ) তফসীরুল কুরআন

গ) রিসালায়ে আযকার

ঘ) মাগাযীউন্নাবুয়্যাত।

১৩. হাজী মুহাম্মদ  কাশ্মীরী (মৃঃ ১০০৬ হিঃ)। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নোক্ত গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্যঃ

ক) শরহে শামায়েলুন্নবী

খ) শরহে মাশারিকুল আনওয়ার

গ) কিতাব খুলাসাতুল জামে ফী জামেউল হাদীস

ঘ) শরহে হিসনে হাসীন

১৫. শায়খ মুনাওয়ার ইবনে আবদুল মজীদ ইবনে আবদুস শকুর  লাহোরী (মৃঃ ১০১০ হিঃ) তিনি আকবরের আমলে একজন বিপ্লবী আলিমের ভূমিকা অবলম্বন করেন। এইজন্য তিনি কারাবরণ করিতেও বাধ্য হন এবং কারাগারে থাকিয়া তিনি তাঁহার গ্রন্হ ‘দুরুন্নাজম ফী তরতীবিল আওয়ায়েলুস সুয়রুল করীম’ সম্পূর্ণ করেন ও কাজী শিহাবুদ্দীনের ‘আল বহরুল মাওয়াজ’ নামক তাফসীর মুখস্থ করেন। তিনি সাগানীর ‘মাশারিকুল আনওয়ার’ ও জাজারীর হিসনে হাসীনেরও ব্যাখ্যা লিখেনে।

১৬. মুহীউদ্দীন আবদুল কাদের ইবনে শায়খ ইবনে আবদুল্লাহ (মৃঃ ১০৩৭ হিঃ)। তিনি বহু গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার পাঁচখানি গ্রন্হ উল্লেখযোগ্যঃ

ক) আল মিনহুল বারী বি-খাতমে সহীহিল বুখারী

খ) ইকদুল লাইল ফী ফাযায়েলিল লায়াল

গ) রিসালা ফী মানাকিবিল বুখারী

ঘ) আল কাওলুল জামে ফী বয়ানে ইলমুন নাফে

ঙ) কিতাবুল আনফুসেল্লাতীফ ফী আহলি বদরিশ শরীফ।

১৭. আবদুন্নবী শাত্তারী (মৃঃ ১০৩৯ হিঃ)। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নোক্ত পাঁচখানি গ্রন্হ উল্লেখযোগ্যঃ

ক) জাহরিয়াতুন নাজাত ফী শারহীল মিশকাত (মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা)

খ) শরহে নুখবাতুল ফিকর

গ) শরহে হাদীস ********************

ঘ) শরহে হাদীস ********************

ঙ) লাউমীউল আনওয়ার ফী মানাকীবিস সায়াদাতিল আতহার।

মুজাদ্দিদে আলফেসানীর যুগ

মুজাদ্দিদে আলফেসানীর নাম শায়খ আহমদ ইবনে আবদুল আহাদ ফারুকী সরহিন্দী (মৃঃ ১০৩৪ হিঃ)। তিনি শায়খ ইয়াকুব সাইফীর নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করেন এবং বুখারী শরীফ, তাবরিজীর মিশকাত ও সুয়ূতীর জামেউস-সগীর শিক্ষা দেওয়ার অনুমতি লাভ করেন। কাযী বহলূল বদখাশানীর নিকট হইতে সিহাহ সিত্তাহ বর্ণনা করার অনুমতি লাভ করেন। তিনি হাদীস সম্পর্কে ‘হাদীসে আরবায়ীন’ গ্রন্হ ব্যতীত অপর কোন গ্রন্হ রাখিয়া যান নাই। তিনি কুরআন-হাদীসের ভিত্তিতে মুসলিম সমাজ সংস্কার ও সংশোধনের এক বিরাট আন্দোলন পরিচালনা করেন। তাঁহার ‘মকতুবাত’ গ্রন্হে কুরআন-হাদীস শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। ফলে বহু লোক ইলমে হাদীস শিক্ষা করিয়া উহাতে পারদর্শিতা লাভ করিতে উদ্বুদ্ধ ও আগ্রহান্বিত হন। এই সময়কার কয়েকজন মুহাদ্দিসের নাম উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১. শায়খ সায়ীদ ইবনে আহমদ সরহিন্দী (মৃঃ ১০৭০ হিঃ)

২. শায়খ সায়ীদের পুত্র ফরুখ শাহ (মৃঃ ১১১২ হিঃ)

৩. সিরাজ আহমদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৩০ হিঃ) । তাঁহার তিনখানি গ্রন্হ উল্লেখযোগ্যঃ

ক) মুসলিম শরীফের ফারসী তরজমা

খ) জামে তিরমিযীর ফারসী তরজমা

গ) খাদ্য ও পানীয় সম্পর্কিত হাদীসসমূহের সমষ্টি।

৪. শায়খ মা’সুম ইবনে আহমদ সরহিন্দী (মৃঃ ১০৮০ হিঃ)

৫. খাজা আজম ইবনে সায়ফুদ্দীন সরহিন্দী (মৃঃ ১১১৪ হিঃ)।

তিনি বাদশাহ আলমগীরের আমলে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস  ছিলেন। ‘ফায়যুল বারী শারহে সহীহিল বুখারী’ নামে তিনি বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্হ রচনা করেন।

৬. শাহ আবূ সায়ীদ ইবনে সাফিউল কাদর মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৫০)

৭. শাহ আবদুল গনী ইবনে সায়ীদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৯৬ হিঃ)

তিনি ‘ইনজাহুল হাজা শরহে ইবনে মাজাহ’ নামে ইবনে মাজা হাদীস গ্রন্হের রচনা করেন।

শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভীর যুগ

শায়খ আবদুল হক মক্কা শরীফে শায়খ আবদুল ওহাব মুত্তাকীর (মৃঃ ১০১০ হিঃ) নিকট হাদীস অধ্যায়ন করেন ও তাঁহার নিকট হইতে সিহাহ সিত্তা সম্পর্কে ‘অনুমতি’ লাভ করেন। হাদীস সম্পর্কে তাঁহা নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলী চিরস্থায়ী ও মহামূল অবদানঃ

ক) ‘আততারীকুল কাভীম ফী শরহে সিরাতিল মুস্তাকীম। ‘সফরুস সায়াদাত’ গ্রন্হের ফারসী ব্যাখ্যা।

খ)আশরাতুল-লুময়াত ফিল মিশকাত (মিশাকত শরীফের ফারসী ব্যাখ্যা)।

গ) ‘লাময়াতুত-তানকীহ ফী শরহে মিশকাতিল মাসাবীহ’।

ঘ) আল-ইকামাল ফী আসমাইর রিজাল

ঙ) জামেউল বরাকাত মুনতাখাব শরহিল-মিশকাত

চ) ‘মা সাবাতা বিস সুন্নাহ ফী আইয়ামিস সানাহ

ছ) ‘আল-হাদীসুল আরবায়ীন’

জ) ‘তরজুমাতুল আহদীসিল আরবায়ীন’

ঝ) ‘দস্তুরে ফায়যুন নূর’

১০. ‘যিকরুল ইজাজাতিল হাদীস ফিল কাদীম আল-হাদীস’

শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী তাঁহার এই বিরাট হাদীস সাধনা এবং গ্রন্হজগতে তাঁহার এই অবিস্মরণীয় অবদানের ফলে এদেশের হাদীস শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হয়।

‘তারীখে উলামায়ে হিন্দ’ গ্রন্হ প্রণেতা তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ভারতে ইলমে হাদীসের বীজ তিনিই সর্বপ্রথম বপন করেন।

তিনি স্থায়ীভাবে হাদীসের দারস দানের কাজ করেন। তাঁহার বংশধরদের মধ্যে বহু ব্যাক্তি শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসাবে মর্যাদা পাইবার অধিকারী হন। এখানে তাঁহাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১. শায়খ নূরুল হক (মৃঃ ১০৭৩ হিঃ)। তিনি তাঁহার পিতার নিকটই ইলমে হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। তাঁহার হাদীস সম্পর্কীয় গ্রন্হ দুইখানিঃ

ক) তাইসীরুল কারী ফি শরহে সহীহিল বুখারী

খ) শরহে শামায়েলুন্নবী

২. হাফেজ আবদুর সামাদ ফখরুদ্দীন ইবনে মুহিব্বুল্লাহ (মৃঃ ১১৬০ হিঃ)। তাঁহার গ্রন্হাবলী এইঃ

ক) মানবাউল ইলম ফী শারহে সহীহিল মুসলিম। মূলত ইহা তাঁহার পিতার লিখিত গ্রন্হ; তিনি ইহার সম্পাদনা করেন মাত্র।

খ) শরহে আইনুল ইলম

গ) শরহে হিসনে হাসীন

৩. শায়খুল ইসলাম ইবনে হাফেজ ফখরুদ্দীন (মৃঃ ১১৮০ হিঃ)। তাঁহার হাদীস গ্রন্হ তিনখানিঃ

ক) শরহে সহীহুল বুখারী

খ) রিসালা  কাশফুল গিতা-আম্মা লাজিমা লিল মাওতা অল আহইয়া (মুয়াত্তা গ্রন্হের ব্যাখ্যা)।

রিসালা তরদুল আওহাম আন আসরিল ইমামূল হুমাম।

৪. সালামুল্লাহ ইবনে শায়খুল ইসলাম মুহাদ্দিস (মৃঃ ১২২৯ )। তিনি ‘মুহাদ্দীসে রামপুরী’ নামে খ্যাত। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্য

১) আল মুহাল্লাহ বি আসরারিল মুয়াত্তা।

২) তরজমায়ে ফারসী সহীহিল বুখারী

৩) তরজমায়ে ফারসী শামায়েলুন্নবী

৪) রিসালা ফী উসুলিল হাদীস

৫. শায়খ সাইফুল্লাহ ইবনে নূরুল্লাহ বিন নূরুল হক। তিন সম্রাট আলমগীরের আমলে ‘আশরাফুল অসায়েল ফী শারহিশ শামায়েল’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন।

শায়খ আবদুল হকের ছাত্রবৃন্দ

১) খাজা খারেন্দ মুয়ীনুদ্দীন (মৃঃ ১০৮৫ হিঃ), (২) খাজা হায়দার পাতলু (মৃঃ ১০৫৭ হিঃ), (৩) বাবা দায়ুদুল মিশতাকী কাশ্মীরী, (৪) শায়খ এনায়েতুল্লাহ মাহাদ্দিসে কাশ্মীরী (মৃঃ ১১৯৫ হিঃ),- ইনি ৩৬ বৎসর পর্যণ্ত হাদীসের দারস দিয়াছেন। (৫) মীর সাইয়েদ মুবারক বিলগিরামী (মৃঃ ১১১৫ হিঃ),- তিনি শামায়েলুন্নবী ও হিসনে হাসীনের ফারসী ব্যাখ্যা লিখেন। (৬) মীর আবদুল জলীল বিলগিরামী (মৃঃ ১১৩৮ হিঃ),- তিনি আসমাউল রিজাল বিষয়ে পারদর্শী মুহাদ্দিস ছিলেন, (৭) মীর আযাদ বিলগিরামী (মৃঃ ১২০০ হিঃ),- তাঁহার হাদীস সম্পর্কিত গ্রন্হাবলীর নামঃ

ক) আজ জুয়ুদ্দরারী শরহে সহীহিল বুখারী

খ) শামামাতুল আম্বর ফী মা আরাদা ফিলহিন্দে মিন সাইয়েদিল বাশার

গ) সুবহাতুল মুরজান ফী আসারে হিন্দুস্থান।

ঘ) মখদুম সায়াদ ফী হুসনে খাতিমাতুল সায়াদা।

নিম্নলিখিত মুহাদ্দিসগণ হিজরী একাদশ শতকের মধ্যভাগ হইতে দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত খ্যাতি লাভ করেনঃ

১) মুহাম্মদ সিদ্দীক ইবনে শরীফ (মৃঃ ১০৪০ হিঃ), ২) শায়ক হুসাইনুল হুসাইনী (মৃঃ ১০৪৩ হিঃ) ৩) সাইয়েদ জা’ফর বদরে আলম (মৃঃ ১০৮৫ হিঃ)- তিনি ‘আল ফায়জুততারী ফী শরহে সহীহিল বুখারী’ ও ‘রাওজাতুশ-শাহ’ নামে দুইখনি গ্রন্হ রচনা করেন, ৪) আবুল মাজদ মাহবুবে আলম (মৃঃ১১১১ হিঃ)- তিনি ‘ যীনাতুন নুকাত ফী শারহিল মিশকাত’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন, ৫) শায়খ ইয়াকুব বানানী লাহোরী (মৃঃ১০৯৮ হিঃ)- তিনি নিম্নলিখিত তিনখানি গ্রন্হ রচনা করেনঃ

ক) আল খায়রুল জারী ফী শরহে সহীহিল বুখারী

খ) আল মু’লিম ফী শরহে সহীহিল মুসলিম

গ) কিতাবুল মুসাফফা ফী শরহে মুয়াত্তা

৬) মওলানা নয়ীম সিদ্দীকী (মৃঃ ১১২০ হিঃ)- তিনি মিশকাতুল মাসাবীহর একখানি ব্যাখ্যাগ্রন্হ রচনা করেন, (৭) শায়খ মুহাম্মদ আকরাম ইবনে আবদুর রহমান (মৃঃ ১১৩০ হিঃ)। (৮) শায়খ ইয়াহইয়া ইবনে আমীর আল-আব্বাসী (মৃঃ ১১১৪ হিঃ)- ইনি (ক) ‘ইয়ানাতুল কারী শরহে মুলাসীয়াতে বুখারী (খ) আরবায়ীন (গ) তাযকিরাতুল আসহাব প্রভৃতি গ্রন্হ রচনা করেন, (৯) শায়খ মুহাম্মদ ফাখের ইলাহবাদী (মৃঃ ১১৬৪ হিঃ)- তিনি হাদীস বিষয় নিম্নলিখিত ৪ খানা গ্রন্হ রচনা করেনঃ ক) কুররাতুল আইন ফী ইসবাতে রাফয়ে ইয়াদাইন খ) রিসালায়ে নাজাতীয়া দর আকায়েদে হাদীসীয়া (গ) নজমে ইবরাতে সফরুস সায়াদ (ঘ) মসনভী দর তা’রীফে হাদীস। (১০) মওলানা আমীনুদ্দীন মুহাম্মদ উমারী (মৃঃ ১১৪৫ হিঃ), (১১) মওলানা নূরুদ্দীন ইবনে সালেহ আহমদাবাদী (মৃঃ ১১৫৫ হিঃ)- তিনি ‘নূরুল কারী শরহে সহীহিল বুখারী’ নামে বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা রচনা করেন, (১২) মীর্যা মুহাম্মদ ইবনে রুস্তাম বাদাখশী (মৃঃ ১১৯৫ হিঃ)। তাঁহার নিম্নলিখিত হাদীস গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্যঃ

ক) মিফতাহুন নাজা ফী মানকিবিল আবা

খ) তারাজিমুল হুফফাজ

গ) নুযুলুল আবরার বিমা সাহহা মিন মানাকিবে আহলিল বায়তিল আতহার

ঘ) তুহফাতুল মুহিব্বীন ফী মানাকিবে খুলাফায়ে রাশেদীন।

(১৩) মীর্যা জান জলন্ধরী বিরাকী (মৃঃ ১১০০ হিঃ)- তিনি ‘নজমুদ দরার অল মরজান’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন।

(১৪)  মুহাম্মদ সিদ্দীক লাহোরী (মৃঃ১১৯৩ হিঃ)- তিনি ‘ইযালাতুল ফাসাদাত ফী শরহে মানাকিবিস সায়াদাত’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন।

(১৫) শায়খ হাশেম ইবনে আবদুল গফুর সিন্দী। তিনি সহীহ বুখারী শরীফকে সাহাবাদের ক্রমিক পর্যায় পরম্পরানুযায়ী নূতনভাবে সজ্জিত ও সুবিন্যাস্ত করেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর যুগ

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর যুগে উপমহাদেশে হাদীস শাস্ত্রের চরম বিকাশের অধ্যায় সূচিত হয়। এই সময়ই ইহা একটি উন্নত বিজ্ঞান হিসাবে মর্যাদা লাভ করে। ইহার পশ্চাতে যুগ-ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহর দান অপরিসীম ও অতুলনীয়। তিনি ১১১৪ হিজরী সনের ১৪ই শাওয়াল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার ইন্তেকাল হয় ১১৭৬ হিজরীতে। তিনি হাদীসে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য মক্কা ও মদীনায় গমন করেন। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্যঃ

ক) হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা

খ) আরবায়ীন

গ) অসীকাতুল আখইয়ার

ঘ) আদদুররুস সামীন ফী মুবাশশরাতিন্নবীয়িল আমীন

ঙ) আল ফযলুল মুবীন ফিল মুসালসাল মিন হাদীসিন্নবীয়িল আমীন

চ) আল ইরশাদ ইলা মুহিম্মাতিল ইসনাদ

ছ) তারাজিমুল বুখারী

জ) শরহে তারাজীমে আবওয়াবিল বুখারী

ঝ) মুসাফফা শরহে মুয়াত্তা

ঞ) মুসাওয়া শরহে মুয়াত্তা

ট) আসারূল মুহাদ্দিসীন।

শাহ ওয়ালীউল্লাহর প্রভাবাধীন যেসব মুহাদ্দিসের আবির্ভাব হয়, তাঁহাদের নাম নিম্নে দেওয়া গেলঃ

১)  কাযী সানাউল্লাহ পানিপতি (মৃঃ১২২৫ হিঃ)। তিনি ‘আল-লুবাব’ নামে একখানি হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।

২) শাহ আবদুল আযীয ইবনে ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (মৃঃ ১২৩৬ হিঃ)। তিনি প্রায় ষাট বৎসর পর্যন্ত হাদীস শিক্ষাদানে ব্যাপৃত থাকেন। ফলে তাঁহার অসংখ্য ছাত্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে হাদীস শিক্ষা ও প্রচারে নিযুক্ত হন। তাঁহাদের কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১) শাহ রফী উদ্দীন দেহলভী (মৃঃ ১২৪৯ হিঃ) (২), শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল শহীদ (শাহাদাতঃ ১২৪৬ হিঃ) (৩) শাহ মুহাম্মদ মকসুদুল্লাহ (মৃঃ ১২৭৩ হিঃ) (৪) মুন্সী সদরুদ্দীন দেহলভী (মৃঃ ১২৫৮ হিঃ) (৫) হাসান আলী মুহাদ্দিস লখনভী, (৬) হুসাইন আহমদ (মৃঃ ১২৭৫ হিঃ) (৭) শাহ রউফ আহমদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৪৯ হিঃ) (৮) শাহ ফজলূর রহমান গঞ্জ মুরাদাবাদী (মৃঃ ১৩১৫ হিঃ), (৯) খুররম আলী বলহারী (মৃঃ ১২৭১ হিঃ) তিনি আসসাগীনার ‘মুশারিকুল আনওয়ার’ ও শাহ ওয়ালীউল্লাহর ‘আরবায়ীন’ গ্রন্হের উর্দূ অনুবাদ করেন। (১০) শাহ আবূ সায়ীদ (মৃঃ ১২৫০ হিঃ) (১১) মুহাম্মাদ শকুর (মৃঃ ১৩০০ হিঃ) (১২) শাহ যহুরুল হক ফুলওয়ারী, (১৩) আওলাদ হুসাইন, (১৪) করম উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (মৃঃ ১২৫৮ হিঃ) (১৫) আলামাতুল্লাহ বদায়ীনী।

শাহ আবদুল আযীযের হাদীস সম্পর্কীত গ্রন্হাবলী মাত্র দুইখানি। তাহা এইঃ

ক) বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন (ফার্সী), খ) উজালায়ে নাফেয়া।

৩) শাহ ইসহাক ইবনে আফযাল ফারূকী দেহলভী (মৃঃ ১২৬২)- তিনি ২০ বৎসর পর্যন্ত হাদীস শিক্ষাদানে নিযুক্ত থাকেন। সমগ্র ভারতে তাঁহার ছাত্রগণ ছড়াইয়া পড়েন। (৪) মাযহাব নানুতুবী (মৃঃ ১৩২০ )। (৫) আহমাদ আলী সাহারানপুরী (মৃঃ ১২৯৭)- তিনি মক্কা ও মদীনায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। তিনি তা’লীকাতে বুখারী, মুকাদ্দামায়ে বুখারী ও তিরমিযী শরীফের হাশিয়া (Marginal notes) ইত্যাদি রচনা্ করেন। (৬) মওলানা কাসেম নানুতুবী (মৃঃ ১২৯৭) (৭) মিয়া সাহেব সাইয়েদ নযীর হুসাইন (মৃঃ১৩২০)। (৮) মওলাবী নওয়াব মুহাম্মদ কুতুবুদ্দীন মুহাদ্দিস-ই দেহলভী- শাহ ইসাহক দেহলভীর নিকট তিনি ইলমে হাদীস শিক্ষা করেন। অতঃপর মক্কা ও মদীনায় গমন করিয়া হাদীসের উচ্চতর সনদ লাভ করেন। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নলিখিত গ্রন্হদ্বয় উল্লেখযোগ্যঃ

ক) মাজাহিরে হক- মিশকাত শরীফের উর্দূ অনুবাদ ও ভাষ্য খ) তরজমা হিসনে হাসীন।

শাহ ইসহাক সাহেবের পর হাদীস শিক্ষাদানের বিভিন্ন কেন্দ্র গড়িয়া উঠে। পূর্বোক্ত মনীষীগণেরই ছাত্রগণ পাক-ভারতের বিভিন্ন স্থানে নিজস্বভাবে ইলমে হাদীসের শিক্ষাদান ও প্রচারাকর্য শুরু করেন। শাহ আবূ সায়ীদ মুজাদ্দিসীর উত্তরাধিকারী শাহ আবদুল গনীর নিকট বহু লোক হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ হাদীস বিজ্ঞানের পারদর্শী মনীষীরূপে খ্যাতিলাভ করেন।

১) মওলানা আবদুল হাই লখনভী (মৃঃ ১৩০৪), মওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী, মওলানা কাসেম, মওলানা ইয়াকুব, মওলানা আবদুল হক ইলাহাবাদী, শায়খ হাবিবুর রহমান রুদোলভী, মওলানা মুহাম্মদ হুসাইন ইলাহাবাদী, শায়খ মুহাম্মদ মা’সুম মুজাদ্দিদি, মওলানা জাফরী, মওলানা আলীমুদ্দীন বলখী, শায়খ মঞ্জুর আহমদ হিন্দী।

মওলানা আবদুল হাই মরহুম ফিরিঙ্গী মহলে হাদীস শিক্ষাদান কেন্দ্র স্থাপন করেন। তাঁহার নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকেরা হাদীসশাস্ত্রে যথেষ্ট পারদর্শিতা লাভ করেন। এই পর্যায়ের কয়েকজন মুহাদ্দিসের নাম এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

(১) মওলানা জহীর আহমদ ‘শওক’। তিনি আ-সা-রিস-সুনান (********************) নামে একখানি হাদীসগ্রন্হ প্রণয়ন করেন। (২) মওলানা আবদুল হাদী আজীমাবাদী (৩) মওলানিা মুহাম্মদ হুসাইন ইলাহাবাদী, (৪) হাফেজে হাদীস মাওলানা ইদরীস সাসরামী (৫) মওলানা আবদুল গফুর রমযানপুরী (৬) মওলানা আবদুল করীম পাঞ্জাবী (৭) শাহ সুলায়মান ফুলওয়ারী – তিনি এককালে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানা ছিলেন। (৮) মওলানা আবদুল হাই (৯) মওলানা আবদুল ওয়াহাব বিহারী (১০) মওলানা আবদুল বারী – তিনি ‘আ-সা-রিস-সুনান গ্রন্হের’ ব্যাখ্যা রচনা করেন।

মওলানা সাইয়েদ নজীর হুসাইন দেহলভীর (মৃঃ ১৩২০ হিঃ) মারফতে এই উপমহাদেশে ইলমে হাদীস ব্যাপক প্রচার লাভ করে। তিনি আহলে হাদীস জামায়াতের নেতা ছিলেন। শত সহস্র ছাত্র তাঁহার নিকট ইলমে হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়া উপমহাদেশের বিভিন্ন দিকে ছড়াইয়া পড়েন। এই পর্যায়ে মুহাদ্দিসগণের মধ্য হইতে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

(১) মওলানা শামসুল হক দাহানূভূ। তিনি ‘গায়াতুর মকসুদ’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন। (২) মওলানা আশরাফ আলী। তিনি ‘আইনুল মা’বুদ নামে গ্রন্হ রচনা করেন। (৩) মওলানা আবদুর রহমান  মুবারকাপুরী- তিনি ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ নামে তিরমিযী শরীফের একখানি বিরাট শরাহ কিতাব লিখেন। (৪) মওলানা সায়াদাত হুসাইন- তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার ইলমে হাদীসের অধ্যাপক ছিলেন। (৫) মওলানা আমীর আলী মলীহাবাদী- তিনি হিদায়া (ফিকাহ গ্রন্হের) টিকা রচনা করিয়াছেন। (৬) মওলানা জমীল আনাসারী- তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় হাদীসের দারস দিতেন। (৭) মওলানা আহমদুল্লাহ (মৃঃ ১৩৬২)- তিনি দিল্লীর রহমানিয়া মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস ছিলেন। (৮) মওলানা আলম আলী নগীনুভী, রামপুরে হাদীস শিক্ষাদানে সাইয়েদ আবূ মুহাম্মদ বরকত আলী শাহ, মওলানা হাসান শাহ, মওলানা মুনাওয়ার আলী এবং তাঁহার ছাত্র মাওলানা বেলায়েত হুসাইন প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিস আবির্ভূত হন।

মওলানা শাহ আবদুল গনীর ছাত্র মওলানা মুহাম্মদ কাসেক ও মওলানা রশীদ আহমদ দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বিগত কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান হইতে কয়েক সহস্র মুহাদ্দিস পাক-ভারতের দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছেন। মওলানা খলীল আহমদ সাহেব এই পর্যায়ের বড় মুহাদ্দিস। তিনি ‘বযলুল মজহুদ’ নামে আবূ দাঊদ শরীফের এক উচ্চমানের জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা-গ্রন্হ রচনা করেন।

মওলানা মাহমুদুল হাসান (শায়খুল হিন্দ) দীর্ঘকাল পর্যন্ত দেওবন্দ মাদ্রাসার শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিস ছিলেন ও বহুশত লোক তাঁহার নিকট হলমে হাদীসের শিক্ষালাভ করেন। মওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। তিনি বুখারী  ও তিরমিযী শরীফ পড়াইবার সময় যে ভাষণ দিয়াছেন তাহা তাঁহার ছাত্রদের কর্তৃক লিপিবদ্ধ হইয়াছে এবং যথাক্রমে ‘ফয়যুলবারী’ শরহে বুখারী ও ‘আল-আরফুশ-শাযী শরহে তিরমিযী ‘ নাম প্রকাশিত হইয়াছে।

মওলানা আহমদ আলী সাহারানপুরীর নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়া বহু লোক বাংলা-আসামে হাদীসের দারস দানে ব্যাপৃত হন। তাঁহার ছাত্রদের মধ্যে মুফতী আবদুল্লাহ টুংকী ও মওলানা নাজের হাসান দেওবন্দী সর্বাধিক খ্যাতিলাভ করেন। পূর্ব বাংলা ও আসাম এলাকায় তাঁহাদের ছাত্র এবং এই গ্রন্হকারের খাস উস্তাদ মওলানা মুহাম্মদ হুসাইন সিলহটী ও মওলানা মুমতাযদ্দীন সাহেবান বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন।[এই পর্যায়ের আলোচনা সুসংবদ্ধভাবে খুব বেশমী সংখ্যক গ্রন্হে পাওয়া যায় না। এই আলোচনারঞ্জ যাবতীয় গ্রন্হ নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলী হইতে গৃহীত। (1) জনাব ডাঃ ইসহাক সাহেবের গবেষণামূলক গ্রন্হ Indian’s Contribution to the Study of Hadith Literature, (২) মওলানা মুফতী আমীমুল ইহসান লিখিত ******************** (৩)******************** (৪)******************** মওলানা আবদুল গফফার হাসান সংকলিত ******************** এর ভূমিকা ইত্যাদি। ‘মানের-এর বিখ্যাত হাদীসবিদ শায়খ মাখদুমুল মূলক তাঁহার নিকট সুদীর্ঘ ২২ বৎসর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ইলমে হাদীস ও অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। (মানাকিবুল আসফিয়া) (Islamic Culture, vol-xxvll- No-1]

বঙ্গদেশে ইলমে হাদীস

গৌড় পাণ্ডুয়া

আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ ইবনে সাইয়েদ আশরাফ মক্কী ৯০০ হিজরী হইতে ৯২৪ হিজরী পর্যন্ত বঙ্গদেশে রাজত্ব করেন। তিনি সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন করেন। শুধু তাহাই নহে, তাঁহার শাসনাধীন এলাকায় কুরআন ও হাদীস শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন করার ব্যাপারেও তাঁহার দান অবিস্মরণীয়। তিনি দূর ও নিকটবর্তী এলাকা হইতে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী লোকদিগকে তাঁহার রাজ্যে আসিবার ও এখানে বসবাস করিবার জন্য আহবান জানাইলেন। ৯০৭ হিজরী সনে (১৫০২ ইং) তিনি গৌড়স্থ গুরবায়ে শহীদ নামক স্থানে (বর্তমান মালদহ জিলার অন্তর্ভূক্ত) এখটি উন্নত ধরনের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পাণ্ডুয়াতে একটি কালেজও তিনি স্থাপন করেন। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইলমে হাদীসের শিক্ষাদান করা হইত। ৯১১ হিজরী সনে (১৫০৩ ইং) মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজদান বখশ (খাজেগীর শিরওয়ানী নামে খ্যাত) সহীহ বুখারীকে তিন খণ্ডে নকল করেন। ইহা বাকীপুরস্থ অরিয়েন্টাল লাইব্রেরীতে রক্ষিত আছে।

সোনারগাঁও

পূর্বেই উল্লেকিত হইয়াছে যে, মুহাদ্দিস শরফূদ্দীন আবূ তাওয়ামা বুখারী হাম্বলী (মৃঃ ৭০০ হিঃ) সপ্তম শতকে ঢাকা জিলাধীন সোনার গাঁও আগমন করেন এবং এখানে হাদীস শিক্ষার ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে ইহা ইলমে হাদীসের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁহার ইন্তেকালের পরও কিছুদিন পর্যন্ত এই অবস্থা অব্যাহত থাকে। এই সময় এতদঞ্চলে সায়াদাতের (৯০০-৯৪৫ হিঃ) রাজত্ব ছিল। পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসাবে সোনার গাঁয়ে বহু সংখ্যক হাদীস বিশারদ সমবেত হন এবং এই স্থানেও বহু লোক ইলমে হাদীস শিক্ষা করিয়া পারদর্শিতা লাভ করেন। এই যুগে এতদঞ্চলে হাদীস চর্চার এতই ব্যাপকতা ছিল যে, বহু মসজিদ ও বহু খানাকা এই উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করা হয়। প্রসিদ্ধ হাদীসবিজ্ঞ তকীউদ্দীন আইনুদ্দীন (৯২৯ হিঃ)- এর চেষ্টায় এখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন নুসরত ইবনে হুসাইন শাহ-এর রাজত্ব। কাজেই একথা বলিষ্ঠভাবেই বলা যাইতে পারে যে, সায়াদাতের শাসন আমলেই সোনার গাঁও হাদীস শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হইয়াছিল। সম্ভবত পূর্ব বাংলার মুসলিম শাসনের শেষ পর্যায় পর্যন্তই উহার এই গৌরব অব্যাহত ও অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু পরবর্তী বৃটিশ শাসন আমলে সোনার গাঁওয়েল স্বর্ণকিরণ নিঃশেষে বিলীন হইয়া যায়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হইতে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক বড় বড় মাদ্রাসায় ইলমে হাদীসের উচ্চশিক্ষা দানের কাজ চালু হয়। ফলে প্রতি বৎসর যথেষ্ট সংখ্যক লোক হাদীসের শিক্ষা লাভ করিয়া দ্বীন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির সহিত পরিচিত হন। যদিও শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রটির দরুন তাহারা পূর্বকালের হাদীস শিক্ষার্থীদের ন্যায় উপকৃত হইতে ও অনুরূপ পারদর্শিতা লাভ করিতে সমর্থ হন নাই।

উপমহাদেশে হাদীস গ্রন্হ সংকলন

উপমহাদেশের আযাদী উত্তর যুগে ইলমে হাদীস চর্চাও ব্যাপক প্রচারের দিকে মনীষীদের বিশেষ লক্ষ্য আরোপিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। বিশেষত ইসলামের মূল উৎস ও ভিত্তির সহিত জনগণকে পরিচিত করার উদ্দেশ্যে কিছু কিছু চেষ্টাও শুরু হইয়াছে। নূতনভাবে হাদীসগ্রন্হ সংকলন এবং উর্দূ ও বাংলা ভাষায় হাদীসের তরজমা ও ব্যাখ্যা রচনার কাজও শুরু হইয়াছে। অদূর ভবিষ্যতে ইহা ব্যাপক রূপ লাভ করিবে বলিয়া আশা করা যায়।[ডঃ ইসহাক লিখিত Indian’s Contribution to the Study of Hadith Literatur অবলম্বনে লিখিত এবং তাহা হইতে সংগৃহীত।]

ইলমে হাদীস বনাম অমুসলিম মনীষীবৃন্দ

হাদীস মুসলমানদের নিকট অমূল্য সম্পদ। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় হইতেই ইহার প্রতি অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে এবং ইহার রক্ষণাবেক্ষণ, প্রচার ও শিক্ষাদানের উপযুক্ত ব্যবস্থা প্রথম হইতেই অব্যাহত রহিয়াছে। কুরআনের পরই হাদীসের এই মর্যাদার কথা মুসলিমগণ কোন দিনই বিস্মৃত হইতেপারে নাই। কিন্তু অমুসলিম মনীষীদের মনে হাদীস সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হইয়াছে। কোন কোন মনীষী ইহাকে উদার দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইহার গুরুত্ব অনুধাবন ও উহার অকপট স্বীকৃতি দানে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হন নাই।

কিন্তু কোন কোন ইউরোপীয় চিন্তাবিদ হাদীসের গুরুত্ব স্বীকার করিতে পারেন নাই। এমনকি অনেক লোক এমনও আছেন, যাঁহারা হাদীসের গুরুত্ব অস্বীকার সম্ভব নয় বলিয়াই উহার মধ্যে নানা প্রকার দোষক্রটি আবিস্খার করিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছেন।

বর্তমান নিবন্ধে আমরা এই উভয় শ্রেণীর লোকদের কিছু কিছু উক্তি পেশ করিতে চাই। যাঁহারা কোন না কোন দিক দিয়া ইলমে হাদীস, উহার সংগ্রহ এবং মুহাদ্দিসণের হাদীস যাচাই বাছাই পদ্ধতির উপর কোনরূপ কটাক্ষ করিয়াছেন তাঁহাদের কথার উত্তরে আমাদের বক্তব্যও সেই সঙ্গে পেশ করা হইবে।

হাদীসের সমর্থনে ইউরোপীয় মনীষী

১. প্রখ্যাত ইউরোপীয় ঐতিহাসক এডওয়ার্ড গীবন লিখিয়াছেনঃ ‘প্রত্যেক জাতির প্রতিষ্ঠাতার জীবন-চরিত দ্বারা তাঁহার লিখিত জ্ঞানসম্পদ পরিপূর্ণতা লাভ করে। হযতর মুহাম্মদের হাদীসসমূহ প্রকৃত সর্ত কথার পূর্ণাঙ্গ উপদেশ, তাঁহার কাজকর্ম, সততা ও নেক কাজের বাস্তব প্রতীক’।(********************)

২. মিসরের ‘ওয়াতন’ পত্রিকায় জনৈক খৃষ্টান মনীষী লিখিয়াছেনঃ ‘মুসলিমগণ কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে গবেষণা করিলে তাহাদের ধর্মীয় ও বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণের সুব্যবস্থা তাহাতে পাইতে পরিবে।

৩. প্রসিদ্ধ রুশ দার্শনিক টলষ্টয় স্বীয় দেশ ও জাতির নৈতিক সংশোধনের জন্য হাদীসসমূহের এক সংকলন নিজ ভাষায় প্রকাশ করিয়াছিলেন।

(******************************************************)

৪. মুসলিমদের মধ্যে হাদীসের সূত্রে যেসব নৈতিক নিয়ম-কানুন প্রচলিত রহিয়াছে, হাইটিংগার উহার এক লা’চওড়া তালিকা প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার দৃষ্টিতে মানুষকে কার্যত নেক কাজের দিকে আকৃষ্ট করার এবং পাপ হইতে বিরত রাখার এতদপেক্ষা উত্তম কর্মপ্রণালী আর কিছুই হইতে পারে না।(********************)

৫. স্যার উহিলয়াম ম্যূর লিখিয়াছেনঃ

‘প্রাথমিক যুগে মুসলিমদের জন্য সর্বাপেক্ষা অধিক উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তার বিষয়বস্তু সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তির কথা ও কাজ ছাড়া আর কি হইতে পারে। ............. এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিই এই বিশ্বজয়ী জাতির অস্তিত্ব ও উত্থান লাভের একমাত্র কারণ। তিনিই মুসলিমদের হস্তে ইহকাল ও পরকাল উভয়েরই কুঞ্জিকা সমর্পণ করিয়া দিয়াছিলেন। এই কারণে হযতর মুহাম্মদের অনুসারীদের মধ্যে বেশীর ভাগ কথাবার্তা তাঁহার সম্পর্কেই হইত। এইসব উপায় উপাদানের কারণে হাদীস বিজ্ঞান যথেষ্ট উন্নতি লাভ করিয়াছে। (Life of Muhammad)

রাসূলে করীমের কণ্ঠ নিঃসৃত বাণী, তাঁহার কার্যকলাপের বিবরণ এবং তাঁহার নিকট অনুমোদন প্রাপ্ত কোন কতা, কাজ বা আচরণকেই বলা হয় হাদীস। এই হাদীসের বিশ্বস্ততা ও অকাট্যতা স্বভাবতঃই নির্ভর করে সঠিক সময়ে ও নির্ভূল পদ্ধতিতে হাদীস সংকলিত হওয়ার উপর। আর অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে একথা সুস্পষ্ট ও অনস্বীকার্য হইয়া উঠিয়াছে যে, পৃকৃত পক্ষে হাদীস রাসূলের জীবদ্দশায়ই রাসূলের হিদায়ত অনুযায়ীই লিপিবদ্ধ হইতে শুরু হইয়াছিল। ইলমে হাদীসের ইতিহাস অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিই ইহা অস্বীকার করিতে পারেন না। কিন্তু কোন কোন পাশ্চাত্য মনীষীর আচরণ এই ব্যাপারে নৈরাশ্যজনক। তাঁহারা হাদীসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকরূপে অবহিত না হইয়ই এমন সব উক্তি করিয়াছেন, যাহার ফলে হাদীসের সঠিক সময়ে ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ ও সুরক্ষিত হওয়া সম্পর্কে অনভিজ্ঞ পাঠকদের মনে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হইতে পারে।

আলফ্রেড-এর সন্দেহ

এই প্রসঙ্গে আমরা Alfred Guillame-Fr Islam গ্রন্হ হইতে একটি উক্তি উদ্ধৃত করিতে চাই। তাঁহার উক্ত গ্রন্হের ৮৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখিয়াছেনঃ

Exactly when records of the deeds and words of the Prophet were first written down we do not know; indeed early tradition is at variance with itselt on this very point. Some say that the Prophet authorized the writing of his saying; others assert that the forbade it.

ঠিক কখন যে হযরতের বাণী ও কার্যাবলীর বিবরণ প্রথম লিখিত হয়, তাহা আমরা জানি না। বাস্তবিকপক্ষে প্রথম যুগের হাদীসসমূহ এই বিষয়টি সম্পর্কে স্ববিরোধী। কেহ কেহ বলেন, রাসূল তাহার বাণী লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিয়াছিলেন। আবার অন্যরা দাবি করেন যে, তিনি উহা নিষিদ্ধ করিয়াছেন।

উদ্ধৃত উক্তিতে একই সঙ্গে কয়েকটি আপত্তিকর ইঙ্গিত করা হইয়াছে। ‘হাদীস ঠিক কখন লিপিবদ্ধ করা হইয়াছিল তাহা আমাদের জানা নাই’ বলিয়া লোকদের মনে হাদীসের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক করার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। দ্বিতীয়ত রাসূলের ‘নিষেধ’ ও “অনুমতির’ মধ্যে বাস্তত সামঞ্জস্য স্থাপন না করিয়া এক চরম দ্বিধা ও সংশয় জাগাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অথচ এই বিরাট গ্রন্হের এতদসংশ্লিষ্ট আলোচনা প্রমাণ করে যে, কুরআনের সহিত হাদীস মিলিয়া মিশিয়া গিয়া মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব করিতে না পারে কেবল এই উদ্দেশ্যেই ইসলামী দাওয়াতের একবারে প্রাথমিক স্তরে হাদীস লিখিতে নিষেধ করা হইয়াছিল। কিন্তু অনতিবিলম্বেই এই নিষেধ আদেশে পরিবর্তিত হয় এবং সাহাবিগণ দ্বিধাসংকোচহীন মনে হাদীস লিখিয়া রাখিতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে এই কথাও মনে রাখিতে হইবে যে, একেবারে প্রথম যুগে কুরআন লিখার সঙ্গে সঙ্গে হাদীস লিখিতে নিষেধ করার ফলে উহার লিপিবদ্ধকরণ বন্ধ হইলেও উহার মৌখিক বর্ণনা এবং পারস্পরিক চর্চা ও আলোচনা বিন্দুমাত্র বন্ধ হইয়া যায় নাই। কেননা লিখিতে নিষেধ করা হইয়াছিল মাত্র। পরস্পরের নিকট মৌখিত বর্ণনা করিতে নিষেধ করা হয় নাই।

এতদ্ব্যতীত Goldziher এবং Sprenger নামে দুইজন প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদও এই পর্যায়ে জনমেনে সন্দেহের সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। Goldziher তাঁহার রচিত Muhammadanische Studim নামক গ্রন্হের দ্বিতীয় খণ্ডে পৃষ্ঠা ২৪১-২৫০ বহু সংখ্যক দলীল দিয়া প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, হিজরী দ্বিতীয় শতকের শুরুতে হাদীস সংকলিত হইয়াছে। যদিও তিনি এই গ্রন্হেরই প্রথম ভাগে পৃষ্ঠা ১০-১২ এমন কিছু কথাও লিখিয়াছেন, যাহা হইতে রাসূলের যুগেই কতিপয় হাদীস সংকলন-সহীফা-সংকলিত হওয়া সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু একটু পরেই তিনি এই সহীফাসমূহের সত্যতার প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাষ সৃষ্টিাকারী অনেক তত্ত্বই করিয়াছেন।

তাঁহার এই রূপ ভূমিকার পশ্চাতে দুইটি উদ্দেশ্য নিহিত রহিয়াছে। প্রথম উদ্দেশ্য হইল হাদীস ও সুন্নাতের শুধু মুখস্থ করিয়া রাখার কথা বলিয়া উহার প্রমাণা মর্যদাকে দুর্বল করিয়া তোলা এবং হাদীস দ্বিতীয় হিজরী শতকে লিপিবদ্ধ হইয়াছে বলিয়া জনগণকে এক মারাত্মক বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত করা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হইল হাদীস সংকলনকারিগণ নিজেদের ধারণা ও অভিমতের সমর্থনে এবং নিজেদের ‘অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মতলবেঃ হাদীস রচনা করিয়াছেন বলিয়া গোটা হাদীস ও সুন্নাহকে অকেজো ও সমর্থন-অযোগ্য প্রমাণ করা। এই প্রাচ্যবিদ হাদীস সংকলনের ইতিহাস জানান উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় দলীলাদি সংগ্রহ করার জন্য কোন কষ্ট স্বীকার করার উদ্দেশ্যেই চিন্তা ও গবেষণা চালাইয়াছেন। আসলে এইরূপ কাজ নিতান্ত স্বার্থবাদী ও উদ্দেশ্যে প্রণোদিত ব্যক্তিদের দ্বারাই সম্ভব হইতে পারে।

স্প্রেংগান তাঁহার Dao Traditious wesen dei den Arabern 1856, 1-17 Dans নামক গ্রন্হে রাসূলের নিকট হইতে নিভূলভাবে হাদীস পৌঁছার কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা পাইয়াছেন। হাদীস সংকলন পর্যায়ে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করিয়াছেন যে, হাদীস রাসূলের জীবনকার নয়, দ্বিতীয় হিজরী শতকে সংকলিত হইয়াছে। মূলত এই প্রাচ্যবিদের উদ্দেশ্যও শুভ নহে।

অবশ্য ডোজী স্বীকার করিয়াছেন যে, রাসূলের বিপুল সংখ্যক হাদীস মুখস্থ রাখা হইয়াছে এবং তাহা হইতেই গ্রন্হাকারে সংকলিত হইয়াছে। তবে তাহাতে অনেক রচিত ও মিথ্যা ‘হাদীস’ও শামিল হইয়াছে। ডোজীর এইরূপ উক্তিতে অনেক লোকের মনেই হাদীসের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হইতে পারে। অথচ তাঁহার এই উক্তির পশ্চাতে কোন সদিচ্ছা লুক্কায়িত নাই। বরং হাদীস ও সুন্নাতের ব্যাপারে লোকদের, বিশেষত যাহারা হাদীস সংকলনের নির্ভূল ইতিহাস জানে না তাহাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করাই তাঁহার উদ্দেশ্য।

এই পর্যায়ে আমাদের বক্তব্য হইল, আমাদের অতীতকাল ও মুসলিম সংস্কৃতির প্রাথমিক ইতিহাসের সত্যাসত্য প্রমাণের জন্য তথাকথিত প্রাচ্যবিদদের অসংলগ্ন উক্তি ও ভিত্তিহীন কথাবার্তার প্রতি আমরা মোটেই ভ্রূক্ষেপ করিতে রাযী নহি। রাসূলের জীবনে হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংগৃহীত হওয়ার কথা পশ্চিমা পণ্ডিতরা স্বীকার করুক আর না-ই করুক, তাহাতে মুসলমানদের কিছুই আসে যায় না। কেননা ‘ঘরের লোকেরাই ঘরের অবস্থা সম্পর্কে অধিক অবহিত’- নবী করীমের সামনেই হাদীস লিখিত হইয়াছে, সংকলিত হইয়াছে হাদীসের বিপুল সম্পদ- সহীফা আকারে, ব্যক্তিগত নোট বই হিসাবে, একথা অকাট্য প্রমাণসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্হাবলী হইতেই অনস্বীকার্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। সেকালের সংকলিত সমস্ত হাদীস সম্পদই যে উত্তরকালে গ্রন্হাকারে সংকলিত ও সংযোজিত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। দৃষ্টান্তসরূপ বলা যায়, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের ‘মুসনাদ’ গ্রন্হে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স ও হযরত আবূ হুরায়রার সংকলিত বিপুল হাদীস-সহীফা- পুরাপুরি অন্তভূক্ত হইয়াছে।

অরিয়েন্টালিস্টরা মনে করেন, হাদীস লিখন ও সংকলন কিংবা উহা হইতে নিষেধ করার যেসব বাণী ও উক্তি উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা সবই মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদদের এক ধরনের মত পোষণের ফলে বিরচিত হইয়াছে। তাঁহারা নাকি নিজ নিজ মত ও রায়ের সমর্থনে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জয়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে হাদীস রচনা করিয়াছেন।

কিন্তু ইহা চরম মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর উক্তি। এই বিভ্রান্তির প্রধান হোতা হইলেন গোল্ডজেহের (Goldziher)। কেননা তাঁহার পূর্ববর্তী প্রাচ্যবিদ স্প্রেংগার খতীব বাগদাদী লিখিত ******************** গ্রন্হখানি ১৮৫৫ সনে আবিষ্কার করেন এবং লেখার মূল ও অগ্রগতি (origin and progress of writing) শীর্ষক এক প্রবন্ধ রচনা করেন।(Asiatic Sociaty of Bangal XXV, 303-329) এই প্রবন্ধে তিনি আরব সমাজে লেখা প্রচলন, তদসংক্রান্ত প্রমাণাদির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, রাসূলের যুগে বিপুল সংখ্যক হাদীস লিখিত ও সংকলিত হইয়া থাকিবে।অথচ গোল্ডজেহের এইসব বিবরণকেই অসত্য মনে করিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন এবং উত্তরকালে পরস্পরবিরোধী লোকেরা এইসব কথা রচনা করিয়াছেন বলিয়া প্রচার করিয়াছেন।

মূলত নিতান্ত কুমতলবে ও ইসলামের সংস্কৃতি বিকাশের প্রতি বিদ্বেষ পোষণবশত এইরূপ মিথ্যা প্রচারণা চালানো হইয়াছে। নতুবা বাস্তব দৃষ্টিতে বিচার করিলে এই ধরনের উক্তির কোন হেতুই থাকিতে পারে না। বহু সংখ্যক সাহাবী নবী করীমের জীবদ্দশায়ই যে হাদীস লিখন ও সংকলনের কাজ বিশেস গুরুত্ব সহকারে করিয়াছেন, তাহা এক অকাট্য সত্য। এই ব্যাপারে যে কোনরূপ সন্দেহ পোষণের কোনই কারণ থাকিতে পারে না, তাহা বলাই বাহুল্য। তবে এই কথা সত্য যে, সেকালে লিখিত ও সংকলিত সহীফার সংখ্যা খুব বিরাট এবং বেশী কিছু ছিল না। কিন্তু হাদীস যে লিখিত ও সংকলিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ করার কোনই হেতু নাই।

মিঃ ম্যূরের উক্তি

স্যার ইউলিয়াম ম্যূর তাঁহার গ্রন্হ Life of Muhammad- এ মুহাদ্দিসগণের হাদীস যাচাই পদ্ধতি সম্পর্কে একর্টি অমূলক উক্তি করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

মুহাদ্দিসগণ কি ধরনের হাদীস সমালোচনা ও যাচাই পরখ করিতেন তাহা সুস্পষ্ট। তাহা এতদুর কঠোর যে, গড়ে শতকরা নিরানব্বইটি হাদীসকেই গ্রহণ-অযোগ্য গণ্য করিয়াছেন।

বস্তুত মিঃ ম্যূরের এই কথাটিরও কোন মৌলিক ভিত্তি নাই। তিনি মুহাদ্দিসদের হাদীস-যাচাই-বাচাই পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিকরূপে অবহিত হইলে এইরূপ উক্তি কখনো করিতেন না। ইমাম বুখারী তাঁহার সংগৃহীত ছয় লক্ষ  হাদীসের মধ্য হইতে অন্তত নয় হাজার হাদীস সম্বলিত হাদীস বুখারী প্রণয়ন করিয়াছেন, ঠিক ইহা হইতেই মিঃ ম্যূরের উপরোক্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে। কিন্তু ইমাম বুখারী তাঁহার গ্রন্হ সমাপ্ত করার পর বলিয়াছেন যে, বহু সহস্র সহীহ হাদীস এই গ্রন্হের অন্তর্ভূক্ত হইতে পারে নাই। ইহার সুস্পষ্ট অর্থ এই যে, তিনি যেসব হাদীস তাঁহার গ্রন্হে শামিল করেন নাই,তাহা অশুদ্ধ বা গ্রহণ অযোগ্য নহে এবং তাঁহার গ্রন্হে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহ ছাড়াও আরো বহু সহস্র সহীহ হাদীস বর্তমান রহিয়াছে। মিঃ ম্যূর ইহা হইতে সন্দেহ করিয়া বসিয়াছেন যে, যেসব হাদীস বুখারী গ্রন্হে সন্নিবেশিত হয় নাই ইমাম বুখারী বুঝি সেই-সবকে ‘অশুদ্ধ’ ও ‘অগ্রহণযোগ্য; বলিয়াই মনে করেন। ইমাম বুখারীর অগৃহীত হাদীসসমূহের সবই যদি বাস্তবিক গ্রহণের অযোগ্য হইত, তাহা হইলে তিনি উহাদের মধ্যে ‘সহীহ হাদীস রহিয়া গেল’ এমন কিছুতেই বলিতেন না। বস্তুত প্রত্যেক গ্রন্হ প্রণেতাই স্বীয় গ্রন্হের উপযোগী তথ্য বিপুল পরিমাণে সংগ্রহ করিয়া থাকেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত উহার সবকিছুকেই গ্রন্হে সন্নিবেশিত না করিলে যে তাহা সবই ‘অশুদ্ধ’ হইয়া যাইবে এমন কোন কথাই হইতে পারে না। এই তত্ত্ব বোধ হয় ম্যূর সাহেবের অজ্ঞাত রহিয়াছে। তিনি বোধ হয় ইহাও জানিতেন না যে, একজন মুহাদ্দিস কোন সব কারণে একটি হাদীসকে গ্রহণ- অযোগ্য ঘোষণা করিয়া থাকেন। এক একটি হাদীস বহুসংখ্যক সূত্রের মারফতে গ্রন্হকার পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে, তিনি তাঁহার নিজস্ব মানদণ্ড অনুযায়ী উহাদের প্রত্যেকটি সূত্রেরই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। যেসব সূত্রকে তিনি নির্ভরযোগ্য পাইয়াছেন, সেই সূত্র তিনি উক্ত হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন, আর যেসব সূত্রের উপর তিনি নির্ভর করিতে পারেন নাই, অথবা যাহা প্রয়োজনাতিরিক্ত হইয়াছে তাহা তিনি পরিহান করিয়াছেন। কিন্তু ইহার দরুন বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত সেই মূল হাদীসটি কখনো অগ্রহণযোগ্য হইয়া যায় না। বস্তুত হাদীসের সংখ্যা গণনা করা হয় উহার মতন-এর দৃষ্টিতে নয়, বরং বর্ণনা পরম্পরাসূত্রের ত্মঃশুস্ফত্র হিসাবে। এই কারণে ইমাম বুখারীর নিকট সংগ্রহীত মূল হাদীস কত সংখ্যক ছিল এবং তাহা কত কত সূত্রের মারফতে তাঁহার নিকট পৌঁছিয়াছিল, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না।

ডাঃ স্প্রেংগারের সমালোচনা

ডাঃ স্প্রেংগার বিশেষভাবে ইমাম বুখারীর হাদীস যাচাই পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন। তিনি তাঁহার গ্রন্হ Life of Muhammad- এ লিখিয়াছেনঃ

‘তিনি (ইমাম বুখারী) যেসব নীতি পদ্ধতির অনুসরণ করিয়াছেন, তাহাকে ‘হাদীস-সমালোচনা’ বলিয়া অভিহিত করা যায় না। তিনি কেবল দেখিতেন, বর্ণনাকারীদের পরম্পরা সুত্রের ধারাবাহিকতা সুরক্ষিত আছে কিনা, কোথাও তাহা বিচ্ছিন্ন হইয়া যায় নাই তো! এতদ্ব্যতীত হাদীস বর্ণনাকারীদের চালচলন- তথা চরিত্রেরও তিনি বিচার করিতেন। যেহেতু তাঁহার নীতি ছিল এই যে, যে হাদীস তাঁহার ‘বিদ্বেষ দুষ্ট’ মতের অনুকূল নহে তাহা তিনি প্রত্যাখ্যান করিতেন। এইজন্য তাঁহার কোন হাদীস প্রত্যাখ্যান করার অথ্য কোন মতেই ইহা হইতে পারে না যে, সেই হাদীস আসলেও গ্রহণ অযোগ্য। কিন্তু তাঁহার ‘জামে’ গ্রন্হ অন্যান্য মুসনাদ গ্রন্হ হইতে এই দিক দিয়া পৃথক ছিল যে, তাহা বিশেষ কোন ফিকাহ মতের অনুসারী ছিল না; বরং বর্ণনাকারীদের সততার উপরই নির্ভরশীল ছিল’।

ডাঃ স্প্রেংগারের এই কথা যাচাই করিলে সুস্পস্টরূপে মনে হয় যে, তিনি যেমন হাদীসের পরিভাষাসমূহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নহেন, তেমনি মুহাদ্দিসদের কর্মনীতি অবস্থা সম্পর্কেও তাঁহার কোন অভিজ্ঞতা নাই। উপরন্তু ইলমে হাদীসের বিভিন্ন শর্ত সম্পর্কেও তাঁহার সুস্পষ্ট কোন ধারণা নাই।

মুহাদ্দিসগণ প্রথম ‘দেরায়াত’ নীতির মানদণ্ডে হাদীস যাচাই করেন। কুরআন হাদীস এবং সাহাবায়ে কিরামের আমলেও তাঁহার অনুসৃত কর্মপদ্ধতি হইতেই এই নীতি গৃহীত হইয়াছে। ইহা সকলের পক্ষে অনিবার্যরূপে অনুসরণীয়। ইহা যেহেতু সাধারণ ও প্রচলিত মূলনীতি বিশেষ, সেইজন্য ইহা প্রকাশ করা মুহাদ্দিসদের পক্ষে কোন প্রয়োজনীয় কজ নহে। যেহেতু সকলেরই একথা জানা আছে যে, মুহাদ্দিসগণ হাদীসসমূহকে এই সকল নীতির উপর অবশ্যই যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। এই যাচাই পরীক্ষার ব্যাপারে কাহারো কোন ভূল থাকিলে তাহা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার। প্রত্যেক মুহাদ্দিসই নিজস্ব সংগ্রহীত হাদীসসমূহের বর্ণনাপরম্পরা ধারা সঠিক ও দোষমুক্ত রাখার জন্য যারপরই নাই গবেষণা ও চেষ্টা চালাইয়া থাকেন। ইহা ছাড়া তাঁহারা কোন হাদীসই গ্রহণ করিতে আদৌ প্রস্তুত হইতে পারে না। এই কারণে প্রত্যেক মুহাদ্দিসই হাদীস বর্ণনাকারীদের যাচাই পরীক্ষা ও নিরীক্সা করিয়া নিজস্ব একটি বর্ণনাপরম্পরা সূত্র স্থাপন করিয়া থাকেন এবং সেই সূত্র হইতে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করিয়া থাকেন।

মনে হয় সহীহ বুখারী শরীফ কি ধরনের গ্রন্হ ‘জামে’ না ‘মুসনাদ’, ডাঃ স্প্রেংগার তাহাও ঠিকতম জানেন না। কেননা তিনি তো বুখারী শরীফকে ‘মুসনাদ’ ধরনের গ্রন্হ মনে করিয়া লইয়াছেন।

ডাঃ স্প্রেংগার ইমাম বুখারীর উপর হিংসা বিদ্বেষের অভিযোগ করিয়াছেন। ইহা সম্পূর্ণ অমূলক কথা। ইমাম বুখারী হিংসা বিদ্বেষ-দুষ্ট ছিলেন, এমন মনে করার কোন কারণ নাই। আসলে তিনি ইহা হইতে সর্বতোভাবে পবিত্র ও মুক্ত ছিলেন। এইজন্যই দেখিতে পাই যে, তিনি শিয়া মতাবলম্বী না হইয়াও তাঁহার অদ্বিতীয় হাদীস গ্রন্হে শিয়া বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ ও উহার অন্তর্ভূক্ত করিয়াছেন। উপরন্তু তিনি ছিলেন শাফেয়ী মতাবলম্বী, কিন্তু তাঁহার সংকলিত গ্রন্হে শাফেয়ী মতের বিপরীত অনেক হাদীস গ্রহণ করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই। মনে হয় এই সব কথা ডাঃ স্প্রেংগারেরে একেবারেই অজ্ঞাত।

মিঃ ম্যূরের অপরাপর উক্তি

এই প্রসঙ্গে মিঃ ম্যূরের আরো কয়েকটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁহার Life of Muhammad গ্রন্হের এক স্থানে হাদীস যাচই পদ্ধতি সম্পর্কে কটাক্ষ করিয়া বলিয়াছেনঃ

মুহাদ্দিসদের নিকট কোন হাদীসের গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য সেই হাদীসের মূল কথাটির ******************** উল্লেক প্রয়োজনীয় বিবেটিত হইত না। কেবল হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম উল্লেখ করাই যথেষ্ট ছিল।

মিঃ ম্যূরের এই কথা হইতেও প্রমাণিত হয় যে, ইলমে হাদীসের পরিভাষা ও হাদীস যাচাইয়ের রীতিনীতি সম্পর্কে তিনি সবিশেষ অবিহিত নহেন। কেননা হাদীস যাচাই করার জন্য ‘রেওয়ায়েত’ ও ‘দেরায়েত’ এই দুইটি পদ্ধটিই হাদীস জগতে নির্ধারিত ও সর্বজন পরিচিত। হাদীস যাচাইয়ের ইহা অপেক্ষা উত্তম রীতিনীতি আর কিছুই হইতে পারে না। ‘রেওয়ায়েত’ পদ্ধতিতে হাদীসের বর্ণনা পরম্পরা যাচাই করা হয় এবং তখন মূল হাদীস উল্লেখ করার কোন প্রয়োজনই হয় না। পক্ষান্তরে ‘দেরায়েত’ পদ্ধতিতে হাদীসের শুধু মূল বাণী ******************** টুকুর যথার্থতা যাচাই করা হয়, আর তখন- সেইসময়- বর্ণনাকারীদের অবস্থা যাচাই করা অবান্তর হইয়া দাঁড়ায়।

ম্যূর সাহেব আর একটি মারাত্মক ভূল উক্তি করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, মুহাদ্দিসগণের হাদীস অনুসন্ধান ও যাচাই পরখের নীতি এবং পদ্ধতি সম্পর্কে পরস্পরের প্রতি কোন আস্থা ও উদারতার ভাব বর্তমান ছিল না। এইজন্য প্রত্যেক মুহাদ্দিসই নিজম্ব পদ্ধতি অনুযায়ী হাদীস গ্রহণ এবং বর্জন করিয়াছেন। মুহাদ্দিসদের সম্পর্কে এই উক্তিটি অমূলক। এই ধরনের কথা একমাত্র সেই ব্যক্তিই বলিতে পারেন ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে যাঁহার বিন্দুমাত্র ধারণা বা শ্রদ্ধা নাই অথবা ইসলামের দুশমনী করা্ই যাঁহার স্থিরসংকল্প। ইজতিহাদ-নীতিও এই সম্পর্কীয় মত-পার্থক্যের ম্যূর সাহেব পারস্পরিক অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা বলিয়া অভিহিত করিতে চাহেন। কিন্তু প্রকৃপক্ষে ইহা কোন অনাস্তার ব্যাপার নহে। ইহা প্রত্যেকের ইজতিহাদ নীতি ও মত বা রায়ের পার্থক্য মাত্র। এই জন্যই দেখিতে পাই- ইমাম মুসলিম ইমাম বুখারীর কোন কোন মত বা পদ্ধতির সমালোচনা করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহাকে ‘সাইয়েদুল মুহাদ্দিসীন- শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস’ বলিয়া মান্য করিতে ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠত হইতেন না। বস্তুত মত-পার্থক্যের কারণেই হাদীসের সূত্র বা সনদসমূহ যাচাই করার প্রয়োজন দেখা দেয়।

মুহাদ্দিসদের পারস্পরিক মত-পার্থক্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ইমাম বুখারী ‘যে ব্যক্তি যাহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছে’  ******************** এতদুভয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষাত ও দীর্ঘদিন একত্র থাকার প্রয়োজনীয়তার উপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু ইমাম মুসলিম মনে করেন, উভয়ের সমসাময়িক ও একই যুগের হওয়াই যথেষ্ট। ইমাম বুখারী কেবল সেইসব বর্ণনাকারীর হাদীসই গ্রহণ করার পক্ষপাতী, যাঁহাদের ‘সিকাহ’‘বিশ্বস্ত’ ও ‘নির্ভরযোগ্য’ হওয়া সম্পর্কে সকলেই একমত। কিন্তু ইমাম নাসায়ী এমন লোকের বর্ণিত হাদীসও গ্রহণ করিতেন, যাহাদের ‘সিকাহ’ হওয়া সম্পর্কে সকলের একমত নহেন। বস্তুত পারস্পরিক আস্থাহীনতার কিংবা হিংসা-বিদ্বেষের কারণে এইরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় নাই, বরং ইহা নিছক মতবিরোধ- রায়- পার্থক্য মাত্র এব রায়- পার্থক্য ভিন্ন ইহা আর কিছুই নহে। পরবর্তিকালে মুহদ্দিসগণ যদি হাদীস বর্ণনাপরম্পরার নূতন কোন বিশ্বস্ত সূত্র পাইতেন, তবে ‘ছয়জন ইমামে হাদীসে’র মধ্য হইতে কোন একজনের নির্ধারিত মূল নীতি অনুযায়ী কোন হাদীস গ্রহণ করিতেন। ইহা ক্ষেত্র প্রশস্ততারই পরিচায়ক।

--- সমাপ্ত ---

হাদীস সংকলনের ইতিহাস

মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ)

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড