মযবুত ঈমান

বইটির পটভূমি

 

ইসলামী আন্দোলনের  ও সংগঠনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমি তীব্রভাবে উপলব্ধি করেছি যে, ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝা সত্ত্বেও ইসলামের দাবি পূরণে অনেকেই ব্যৰ্থ হয়। ধীরে সুস্থে বিবেক-বুদ্ধি যথাযথভাবে প্রয়োগ করে ইসলামী আন্দোলনে অগ্রসর হবার পর কেউ কেউ আবার পিছিয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামীর রুকন হিসেবে বেশ কিছুদিন সক্রিয় ভূমিকা পালনের পরও একসময় নিক্রিয় হয়ে পড়ে। ছাত্রজীবনে নেতৃস্থানীয় দায়িত্ব পালন করেও কর্মজীবনে আর এগুতে চায় না। \'বিস্ময় ও বেদনার সাথে আমি এ সব লক্ষ্য করে দীর্ঘদিন কারণ তালাশ করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, ঈমানের দুর্বলতাই এর জন্য দায়ী। ঈমানের দাবি কী, কোন পথে ঈমানে দুর্বলতা আসে এবং মজবুত ঈমানের কী কী শর্ত রয়েছে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। গত কয়েক বছরে ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় পুরুষ, মহিলা, ছাত্র ও ছাত্রীদের আরও সুস্পষ্ট হয়েছে। বিষয়টি এখন পরিপূর্ণ রূপ লাভ করেছে। তাই এ বিষয়টিকে পুস্তিকাকারে পরিবেশন করার প্রয়োজন বোধ করছি। দুর্বল শরীর নিয়ে যেমন কোন কাজ করার ক্ষমতা থাকে না, দুর্বল ঈমান নিয়েও ঈমানের কোন দাবি পূরণ করা সম্ভব হয় না। তাই যারা ঈমানের দাবিদার তাদের এ বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এ প্রয়োজন পূরণে সহযোগিতা করাই এ লেখার উদ্দেশ্য। এ বড় আশা নিয়ে আমি লিখছি যে, যারা একবার ইসলামী আন্দোলনের শরীক হয় তারা যদি ঈমান সম্পর্কে এ সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করে তাহলে কেউ আল্লাহর রহমতে ঈমানের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হবে না। মানুষে মানুষে যোগ্যতার পার্থক্য আছে এবং থাকবে। ঈমানের দিক দিয়ে দুর্বল না হলে প্রত্যেকেই তার যোগ্যতা অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আল্লাহ তাআলা আমার এ আশা পূরণ করুন।

 

গোলাম আযম

 

জুন, ২০০২

 

মজবুত ঈমান

 

এ বিষয়টি ছয়টি পয়েন্টে বিভক্ত করে আলোচনা করতে চাই।

 

১. ঈমান মানে কী? বিশ্বাস বলতে কী বুঝায়? বিশ্বাসের সংজ্ঞা কী? কর্মের সাথে বিশ্বাসের সম্পর্ক কী? বিশ্বাস কত রকম হতে পারে?

 

২. মানব জীবনে বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা কী?

 

৩. ইসলামে ঈমান সম্পর্কিত বিষয় (ঈমানিয়াত) কী কী? কেউ ইসলাম গ্রহন করে মুসলিম হতে চাইলে তাকে কী কীবিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে?

 

৪. আল্লাহর উপর ঈমান আনলে আল্লাহর সাথে কেমন সম্পর্ক কায়েম হয়?

 

৫. ঈমান কী কারণে দুর্বল হয়? কোন পথে ঈমানে দুর্বলতা আসে?

 

৬. মযবুত ঈমানের শর্ত কী কী? কোন কোন শর্ত পূরণ হলে ঈমান মযবুত হয়?

 

১. ঈমান মানে কী?

 

ঈমানী আরবী শব্দ। এর সহজ অর্থ হলো বিশ্বাস। বিশ্বাস বলতে কী বুঝায়? এটা অত্যন্ত গুরত্বপুর্ণ বিষয়।

 

একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। ধরুন এক পরিচিতি লোক এসে আমাকে বললেন, ভাই, আমাকে এক হাজার টাকা ধার দিন। আমি এক মাস পরই ফেরত দিয়ে যাব।

 

এক মাস পর টকাটা ফেরত দেবে কি না সে বিষয়ে আমার সরাসরি জানা নেই। আমি তাকে কী বলবো? তাকে তো আর একথা বলা যায় না যে, এক মাস পর ফেরত দেন কি না আগে দেখে নিই। তাহলে তাকে কী বলব? আমার কাছে লোকটি ধার চেয়েছে, হয় তাকে ধার দেব, আর না হয় ধার দিতে অস্বীকার করব। ধার দেব কি দেব না এ বিষয়ে কিভাবে আমি সিদ্ধান্ত নেব? টাকা সত্যি ফেরত দেবে কি না সে বিষয়ে ডাইরেক্ট নলেজ বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান তো নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে পরোক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি তাকে যতটুকু জানি তাতে আামার মনে এ বিশ্বাস হয় কি না যে, লোকটি ওয়াদা পালন করবে। যদি তার উপর আমার বিশ্বাস হয় যে, এ লোক টাকা ফেরত দেবে তাহলে আমি তাকে ধার দেব। মোট কথা, ধার দেওয়ার এই সিদ্ধান্তটার ভিত্তিই হলো বিশ্বাস। যদি তার অতীত আচরণ থেকে তার উপর আমার এ বিশ্বাস না হয় যে, টাকাটা ফেরত দেবে, তাহলে আমি ধার দেব না। আমি যে তাকে অবিশ্বাস করলাম, তাও পরোক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে। তাকে ধার দিতে অস্বীকার করলে সে নিশ্চয়ই বলবে, আমাকে বিশ্বাস করেন না? আমি যে তাকে অবিশ্বাস করলাম, এটাও কিন্তু বিশ্বাস। অর্থাৎ আমার বিশ্বাস যে, সে টাকা ফেরত দেবে না। তাকে আমি টাকা দিলামই না। কী করে জানলাম যে, সে টাকা ফেরত দেবে না? পরোক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমেই আমি এ বিশ্বাসে পৌছেছি।

 

তাহলে বিশ্বাসের সংজ্ঞা কী দাঁড়াল? যে বিষয়ে সরাসরি জ্ঞান নেই, অথচ সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচেছ ; তখন পরোক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় নেই; এভাবে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তারই নাম বিশ্বাস।

 

একটি বড় উদাহরণ

 

মৃত্যুর পর আবার জীবিত হতে হবে কি না এ বিষয়ে সরাসরি জ্ঞান নেই। কিন্তু এ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকারও উপায় নেই। যদি মৃত্যুর পর আরও একটি জীবন থাকে তাহলে আমাকে সে হিসাব মনে রেখেই দুনিয়ায় চলতে হবে। যদি না থাকে তাহলে বেপরোয়া চলা সহজ মনে হতে পারে। তাই এ বিষয়ে চুপ থাকার উপায় নেই। হয় আছে মনে করতে হবে আর না হয় নেই বলে ধারণা করতে হবে এবং স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে।

 

এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কিভাবে নেব? কেউ ঐপারে থেকে ফিরে আসে না। এপার থেকে উঁকি মেরে দেখাও সম্ভব নয়। পরকাল একেবারেই অদৃশ্য। পবিত্র কুরআনে অনেক সূরায় শুধু আখিরাতকে বিশ্বাস করার জন্য যুক্তি পেশ করা হয়েছে। এসব জ্ঞানের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জানা যায় যে,  পরকাল অবশ্যই আছে।

 

পরকাল সম্পর্কে সরাসরি জ্ঞান নেই, অথচ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত পৌঁছাতেই  হবে। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই ঐ সিদ্ধন্ত পরোক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমেই সম্ভব। এভাবেই অদৃশ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ সিদ্ধন্তটাই বিশ্বাস।

 

বিশ্বাসের তিন অবস্থা

 

যে দুটো উদাহরণ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে এর ভিক্তিতে বিশ্বাসের তিনটি অবস্থা হলোঃ

 

১. ইতিবাচক বিশ্বাস

 

ক. আমার বিশ্বাস হয় যে,  লোকটিকে ধার দিলে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে।

 

খ. আমার বিশ্বাস হয় যে,  মৃত্যুর পর আবার জীবিত হতে হবে।

 

২. নেতিবাচক বিশ্বাস

 

ক.আমার বিশ্বাস যে, লোকটি ধার নিলে টাকা ফেরত দেবে না।

 

খ. আমার বিশ্বাস যে, মৃত্যর পর আর কোনো জীবন নেই।

 

৩. সন্দেহ

 

ক. লোকটি টাকা ফেরত দিতেও পারে নাও দিতে পারে।

 

খ. মৃত্যুর পর আবার জীবিত হতেও পারে নাও হতে পারে।

 

সন্দেহ মানে কোনো রকম বিশ্বাস এখনো জন্মেনি। ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো বিশ্বাস না হওয়াই সন্দেহ।

 

বিশ্বাস ও কর্মের সম্পর্ক

 

বিশ্বাসের সাথে কর্মের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। যে ধরনের বিশ্বাস হয় সে অনুযায়ীই কর্ম হয়ে থাকে। বিশ্বাসের বিপরীত কর্ম হয় না। বিশ্বাস তিন রকম হলেও কর্ম তিন রকম হয় না। ইতিবাচক বিশ্বাসের কর্ম এক রকম। আর নেতিবাচক বিশ্বাস ও সন্দেহের ভিত্তিতে কর্ম একই রকম হয়। যেমনঃ যদি আমার বিশ্বাস হয় যে লোকটি টাকা ফেরত দেবে তাহলে আমি তাকে টাকা ধার দেব।

 

যদি বিশ্বাস হয় যে ফেরত দেবে না তাহলে আমি তাকে ধার দেব না। সন্দেহ হলেও ধার দেব না।

 

যে রকম বিশ্বস হয় সে অনুযায়ীই কর্ম হয়। কর্মের পেছনে অবশ্যই বিশ্বাস রয়েছে। বিশ্বাস ছাড়া কর্ম হতে পারে না। বিশ্বাসের বিপীতও কর্ম হয় না। বিশ্বাস ও কর্ম একেবারেই ঘনিষ্ঠ।

 

২.মানব জীবনে বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা কী?

 

সরাসরি জ্ঞানের উৎস হলো পাঁচটি ইন্দ্রিয়। এ দ্বারা অতি সামান্য জ্ঞানই হাসিল করা যায়। শুধু এটুকু জ্ঞানের দ্বারা মানুষের জীবন চলে না। সামান্য কিছু ক্ষেত্র ছাড়া মানুষকে বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই চলতে হয়।

 

১. শৈশবে মা বলে দিয়েছেন যে, অমুক আমার বাবা। বিশ্বাস করেছি। এ বিষয়ে সরাসরি জ্ঞানের কোনো সুযোগ নেই।

 

২. বাংলা ভাষা শিখার জন্য অ,আ, ক, খ, তে বিশ্বাস করেই এ ভাষা শিখতে হয়েছে।

 

৩. অসুখ হলে ডাক্তারের উপর বিশ্বাস না করলে চিকিৎসা পাওয়া অসম্ভব।

 

৪. ফসল হবে এ কথা বিশ্বাস না হলে কৃষক চাষাবাদই করতে পারবে না।

 

৫. বিচারকের মনে সাক্ষী প্রমাণ নিয়ে আসামি দোষি বলে বিশ্বাস সৃষ্টি হলেই শাস্তি দেয়, বিশ্বাস না হলে বা সন্দেহে হলে শাস্তি দেয় না।

 

৬. যে কোন সময় মৃত্যু আসতে পারে। তবু মানুষ আরও বেঁচে  থাকবে বিশ্বাস করে বলেই জীবন সচল আছে।

 

৭. মানুষে মানুষে সম্পর্ক বিশ্বাসের উপরই কায়েম থাকে। স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক, ভাই –ভাইয়ে সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ব্যবসায়-বাণিজ্যের সম্পর্ক সবই বিশ্বাসনির্ভর।

 

হিসাব করলে দেখা যাবে যে, বিশ্বাস ছাড়া একদিনও মানুষ চলতে পারে না। বিশ্বাসই গোটা জীবনকে ঘিরে রেখেছে।

 

না দেখে বিশ্বাস করি না

 

আজব মগজের এমন কিছু লোক আছে, যারা বহু বিষয়েই বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করে, কিন্তু আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বসের বেলায় বলে, ‘না দেখে বিশ্বাস করি না’।

 

মযবুত ঈমান সম্পর্কে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সমাবেশ আলোচনাকালে ‘না দেখে বিশ্বাস করি না’ কথাটার অসারতা প্রমাণ করার জন্য একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে থাকি। আমার হাতের মুঠোয় এক গুচ্ছ চাবি রেখে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলি, ‘আমি দাবি করে বলছি যে, আমার হাতে এক গুচ্ছ চাবি আছে, তোমরা কি এ কথা বিশ্বাস কর’? ছেলেরা বলে, হ্যাঁ; বিশ্বাস করি। আবার জিজ্ঞেস করি, কেন বিশ্বাস কর? জবাবে বলে, আমরা বিশ্বাস করি যে, আপনি মিথ্যা বলেন না। তাই আপনি যখন বলছেন, চাবি আছে তখন আমরা এ কথা বিশ্বাস করি।

 

মুষ্টি খুলে চাবিটি দেখিয়ে আবার জিজ্ঞেস করি, এটা চাবি তা বিশ্বাস কর? তখন কেউ কেউ বলে ফেলে, হ্যাঁ; বিশ্বাস করি। আমি বলি, যখন চাবিটি অদৃশ্য ছিল তখনই বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল। চাবিটি দেখার পর বিশ্বাসের আর প্রয়োজন রইল না। যারা দেখার পরও বিশ্বাস করি বলেছ তারা বিশ্বাসের বাজে খরচ করেছ। দেখলে আর বিশ্বাসের দরকার হয় না। না দেখলেই বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়। তাই ‘না দেখে বিশ্বাস করি না’  কথাটি একেবারেই হাস্যকর ও অযৌক্তিক। বোকাদের পক্ষেই এমন কথা বলা সম্ভব। কোনো নাস্তিকও তার মাকে এ কথা বলতে পারবে না, মা ছোট সময় না বুঝে তোমার কথা মেনে নিয়ে বিশ্বাস করেছি যে, অমুক আমার বাবা, এখন আমি না দেখে কোনো কিছু বিশ্বাস করি না। তাই আমাকে দেখাও কেমন করে ঐ লোক আমার বাবা। এ কথা না দেখেও বিশ্বাস করে। শুধু আল্লাহর বেলায় না দেখে সে বিশ্বাস করে না।

 

বাস্তব জীবনে বিশ্বাস ছাড়া মানুষ একদিনও চলতে পারে না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে ও তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য বিশ্বাসের আশ্রয় নিতে হয়। এ অবস্থায় আল্লাহ, ওহী, রাসূল, আখিরাত ইত্যাদি বিরাট বিরাট বিষয়ে বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার না করা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়।

 

জ্ঞান চর্চা বিশ্বাস দিয়েই শুরু হয়

 

সকল জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই নিকট রয়েছে। প্রত্যেক বিষয়ে জ্ঞানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু আল্লাহই জানেন।  তিনিই শুরু, তিনিই শেষ। যে কোনো জ্ঞান চর্চা করতে হলে প্রথমেই কতক বিষয়কে বিশ্বাস করতে হয়। A,B,C,D বা ক,খ,গ, যেভাবে লেখা আছে এগুলোকে বিনা যুক্তিতে মেনে নিয়েই ভাষা শেখা শুরু করতে হয়। কেই যদি তর্ক করে যে, এভাবে কেন, অন্যভাবে লিখলে দোষ কী? তাহলে তার ভাষা শেখা শুরু করাই সম্ভব হবে না।

 

জ্যামিতি পড়তে হলে প্রথমেই কতক Axiom বা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়ে বিশ্বাস করতে হয় । যেমন বিশ্বাস করতে হয় যে, বিন্দুর (Pount) দৈর্ঘ্য, প্ৰস্থ, উচ্চতা কোনটাই নেই, তবু বিন্দুর অস্তিত্ব আছে। যদিও পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী এটা একেবারেই অযৌক্তিক। তথাপি এটা বিশ্বাস না করলে জ্যামিতি শেখা শুরুই করা যায় না।

 

বিজ্ঞান চর্চা প্ৰথমে হাইপথেসিস (কল্পনা, অনুমান) দিয়েই শুরু হয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কারক নিউটন সম্পর্কে জানা যায় যে, ফলের বাগানে বসা অবস্থায় তাঁর সামনে গাছ থেকে একটা আপেল নিচে পড়লো। এর আগেতো বহুবার তিনি আপেল পড়তে দেখেছেন; কিন্তু সেদিন তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলো যে, উপরেও শূন্য নিচেও শূন্য। তাহলে ফলটি উপরের দিকে না যেয়ে নিচের দিকে নামল কেন? তাঁর মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, পৃথিবীর মধ্যে এমন কোন শক্তি আছে যা বস্তুকে আকর্ষণ করে। এভাবে বিশ্বাসের ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূচনা হয়।

 

জ্ঞানের ময়দানে কোন বিষয়েই জ্ঞানের শুরু বা শেষ মানুষের আয়ত্তে নেই। প্ৰথমে বিশ্বাস দিয়ে জ্ঞান চর্চা শুরু হয় এবং একটি পৰ্যায় পর্যন্ত যেয়ে চর্চা থেমে যায়। জ্ঞানের শেষ পর্যন্ত পৌছার সাধ্য মানুষের নেই।

 

৩. ইসলামে ঈমান সম্পর্কিত বিষয় কী কী?

 

ইসলাম গ্রহণ করতে হলে বা মুসলিম হতে হলে ৭টি বিসয়ের উপর ঈমান আনতে হবে। ইসলমে ঈমান বলতে এ সাতটি বিষয়ের ইপর দৃঢ় বিশ্বাসকে বুঝায় ॥

 

এগুলোকে ঈমানে মুফসসাল তথা বিস্তারিত ঈমান বলা হয়। আরবীতে এগুলোকে শিখতে হয়।

 

امَنْتُ بِاللهِ وَمَلئِكَتِه وَكُتُبِه وَرَسُوْلِه وَالْيَوْمِ الْاخِرِ وَالْقَدْرِ خَيْرِه وَشَرِّه مِنَ اللهِ تَعَالى وَالْبَعْثِ بَعْدَالْمَوْتِ

 

 অর্থাৎ আমি ঈমান আনলাম আল্লাহ, তার ফেরশতাগণ, তার কিতাবসমূহ, তার রাসূলগণ, শেষ দিন (পরকাল), তাকদীরের ভালো ও মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয় এবং মৃত্যুর পর পনরুজ্জীবন এর প্রতি।

 

ঈমানের প্রধান বিসয় তিনটি তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। ঐ৭টি বিষয় এ তিনটিরই অর্ন্তভূক্ত। তাওহিদের মধ্যে শামিল রয়েছে তিনটি-  আল্লাহ, ফেরেশতাগণও তাকদীর।রিসালতের মধ্যে দুটি কিতাবসমূহ ও রাসূলগণ। আর আখিরাতের মধ্যে দুটি-  শেষ দিন ও মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন।

 

তাওহীদের মধ্যে আল্লাহর সাথে ফেরেশতাকে এ জন্যই শামিল করা হয়েছে যে, ফেরেশতাদের সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করা হত। আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে, ফেরেশতারা আল্লাহর দাসও কর্মচারী মাত্র। তারা আল্লাহর কোনো ক্ষমতায় সামান্যতম শরীকও নয়। তাদের সম্পর্কে এ ধারণা থাকলে আল্লাহর সাথে কোনো দিক দিয়েই তাদেরকে শরীক করার আশঙ্কা থাকে না।

 

তাকদীর মানে সর্ববিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে। যে বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত তিনি করেন, সেটাই তাকদীর। মানুষের জীবনে ভালো ও মন্দ যাই ঘটে তা আল্লাহর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ঘটে থাকে। সেখানে অনথ্য কোন শক্তির হাত নেই। আল্লাহর এই একচ্ছত্র আধিপত্য ও কর্তৃত্ব তাওহূদেরই অর্ন্তভূক্ত।

 

৪.আল্লাহর সাথে সম্পর্কের বাস্তব রূপ কী?

 

আল্লাহর উপর ঈমান আনলে আল্লাহর সাথে বান্দাহর বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তায়াল এ সম্পর্ককে সূরা নাস এ তিনভাবে প্রকাশ করেছেনে।

 

১. رَبِّ النَّاس মানুষের রব বা প্রতিপালক। যাবতীয় প্রয়োজন পূরণকারী রক্ষণাবেক্ষণকারী ইত্যাদি। আর মানুষ তার দয়ার ভিখারি তার একান্ত অনুগৃহীত ও প্রতিপালিত।

 

২. مَلِكِ النَّاسِ   মানুষের বাদশাহ। তিনি রাজা আর মানুষ তার প্রজা। কোনো অবস্থায়ই কারো পক্ষে তার রাজত্বের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। তার রাজ্যের নিয়ম কানুন ও বিধি বিধান মানুষ আবদ্ধ। ভালো বা মন্দ কিছু করার ইচ্ছা ও চেষ্টার ইখতিয়ারটুকু শুধু মানুষকে দেওয়া হয়েছে। কিন্ত কোন কাজ সমাধা করার কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। কর্ম সমাধা করা আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ নিভরশীল। শুধু ইচ্ছা ও চেষ্টা করা হলেই মানুষ কর্মের পুরস্কার বা শাস্তি পাবে। কর্ম সম্পন্ন না হলেও এর বদলা পাবে। ইচ্ছা ও চেষ্টার সামান্য ইখতিয়ারটুকু ছাড়া আল্লাহ তার প্রজাকে ক্ষমতাই দেননি।

 

৩. إِلَٰهِ النَّاسِ  আল্লহই মানুষের একমাত্র ইলাহ মাবুদ হুকুমদাতা প্রভু ও মুনিব। তার হুকুমের বিরোধী কোনো হুকুম মানার অধিকার মানুষের নেই।

 

রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

 

স্রষ্টাকে অমান্য করে কোনো সৃষ্টির আনুগত্য চলে না।

 

এসব সম্পর্কের স্বাভাবিক দাবি

 

যে আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর উপর ঈমান আনে তার ঈমানের দাবি সে পূরণ করতে সক্ষম হয়।

 

১. সে আল্লাহর একমাত্র রব হিসেবে মেনে নেয়। যা কিছু সে দুনিয়ায় ভোগ করে এর জন্য সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর প্রতিই জ্ঞাপন করে। তার দেহে যত নিয়ামত আছে তার অন্তরে যত সুকামনা আসে তার মনে যত সুচিন্তা আসে নেক কাজের যত ইচ্ছা মনে জাগে সৎকাজের জন্য চেষ্টা করার যতটুকু তাওফীক হয় আল্লাহর সৃষ্টি জগতের যা কিছু ব্যবহার করা ও ভোগ করার সুযোগ সে পায় এ সকল বিষয়েই সে একমাত্র আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জানায়। একমাত্র তারই প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করে এবং মনে তারই অনুগ্রহের তৃপ্তি বোধ করে। প্রতিটি আপদ বিপদকে তার পক্ষ থেকে মনে করে। সে আল্লাহকেই একমাত্র রিযকদাতা ও প্রয়োজন পূরণকারী মনে করে। কঠিন মুসীবতেও সে পেরেশান হয় না। কোনো অবস্থায়ই তার রব থেকে নিরাশ হয় না। সব কিছুর মধ্যে আল্লাহ তার জন্য মঙ্গল ও কল্যাণ রেখেছেন বলে বিশ্বাস করে। একমাত্র তারই উপর নির্ভর করে মনে সান্তনা বোধ করে।

 

২. সে আল্লাহকে একমাত্র বাদশাহ মনে করে এবং আর কোনো শক্তির পরওয়া সে করে না। কোনো বড় শক্তিই তার নিকট বড় নয়। যিনি সকল বাদশাহর বাদশাহ সে নিজেকে তারই স্নেহভাজন প্রজা মনে করে। কারো দাপটে সে ভীত হয় না। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো শক্তিকে ভয় করার সামান্য প্রয়োজনও সে বোধ করে না। কেউ তার কোনো ক্ষতি করতে পারে বলে সে মনে করে না। সে পরম সাহসী ও চরম নির্ভীক। দুনিয়া ও আখিরাতে সে আল্লাহকেই একমাত্র ওলী বা স্নেহপরায়ণ অভিভাবক মনে করে। সর্বাবাস্থায় সে অন্তরে প্রাশান্তি বোধ করে। কোনো অবস্থায়ই বিচলিত হওয়া প্রয়োজন মনে করে না। নিজেকে সে আল্লাহর সৈনিক মনে করে এবং তার বাদশাহর রাজত্ব কায়েম করা ও কায়েম রাখা সবচেয়ে বড় কর্তব্য মনে করে। আল্লাহর অপছন্দনীয় সবকিছু উৎখাত করার জযবা রাখে। সে আল্লাহ তাআলাকেই আর সব কিছু থেকে ভালোবাসে তার সন্তুষ্টি লাভের চেয়ে বড় কোনো আকাঙক্ষা তার থাকে না। মালিকের সন্তষ্টির জন্য জান কুরবান করার মধ্যেই সে গৌরব বোধ করে। শয়তানের রাজত্ব উৎখাত করে আল্লাহর রাজত্ব কায়েমের লক্ষ্যে জান ও মাল কুরবান করার জন্য সর্বাত্মাক চেষ্টা করাই জান্নাত লাভের সোপান মনে করে।

 

৩. আল্লহই একমাত্র ইলাহ বলে বিশ্বাস করে। তার হুকুমের বিরোধী কারো হুকুম পালান করতে সে এক বিন্দু প্রস্তুত নয়। তার আদেশ পালন করা ও তার নিষেধ থেকে নিজেকে বিরত রাখাই তার দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন ও আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের সাফল্যের একমাত্র উপায় বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এটাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের একমাত্র পথ বলে সে মনে করে। দুনিয়ার শাস্তি ও আখিরাতের মুক্তির জন্য আর কোন বিকল্প উপায় আছে বলে সে বিশ্বাস করে না।

 

৫. কীভাবে ঈমানে দুর্বলতা দেখা দেয়?

 

আল্লাহ তায়ালার প্রতি সত্যিকার ঈমান থাকলে তার সাথে যে সব সর্ম্পক গড়ে উঠে এ সম্পর্কের দাবি পূরণ করাই মুমিনের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু ঈমানের দাবিদার হওয়া সত্তেবও ঈমানের দাবি পূরণে সেই ব্যর্থ হয় যার ঈমান দুর্বল। তাই প্রত্যেক মুমিনেরই এ বিষয়ে সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন যে কোন পথে ঈমনে দুবর্লতা আসে। যখনই ঈমানে দুবলতা দেখা দেবে তখনই আল্লাহর সাথে সর্ম্পক ছিন্ন হয়ে যাবে। এটা বিরাট কথা। এ বিষয়ে চরম সতর্কতা প্রয়োজন।

 

আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় বহু কিছুর সাথে আমাদের ভালোবাসার সর্ম্পক গড়েছেন। সেসব সর্ম্পক ত্যাগ করার অনুমতিও তিনি দেননি। বরং এসব সর্ম্পককে তিনি সজ্জা  বলে ঘোষণা করেছেনেঃ

 

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ۗ ذَٰلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَاللَّهُ عِندَهُ حُسْنُ الْمَآبِ

 

মানুষের জন্য তাদের পছন্দসই জিনিস নারী সন্তান সোনা রুপার স্তপ বাছাই করা ঘোড়া পালিত পশু ও চাষের জমি খুবই কামনার বিষয় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব দুনিয়ার কদিনের জীবিকা মাত্র। আসলে যা ভালো আশ্রয় তা তো আল্লাহর কাছেই আছে। (সূরা আলে ইমারান :১৪)

 

এসব ভালোবাসার বিষয় দ্বারা মানুষের জীবনকে সাজিয়ে দেওয়া  হয়েছে বলে আল্লাহর স্বয়ং ঘোষণা করলেন। এসব ভালোবাসার সজ্জাকে ত্যাগ করে বৈরাগী বা সন্ন্যাসী হয়ে গেলে আল্লাহর নিকট অপরাধী সাব্যস্ত হবে। দুনিয়ায় যেসব জিনিসের সাথে আল্লাহ নিজে এ ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন, এসব ভালোবাসার পরিমাণও তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। ঐ পরিমাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসলেই ঈমান দুর্বল হয়। আল্লাহ বলেন,

 

قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

 

(হে রাসূল! আপনি তাদেরকে) বলুন, তোমাদের পিতামাতা, সন্তানাদি,ভাই বোন, স্ত্রীগণ আত্মীয়Ñস্বজন, ঐ মাল যা তোমরা অজর্ন করেছ, তোমাদের ঐ কারবার তোমরা যার মন্দার ভয় কর এবং তোমাদের ঐ বাড়ি যা তোমরা পছন্দ কর (এসব) যদি তোমাদের নিকট আল্লাহ, তার রাসূল ও তার পথে জিহাদের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা (মৃত্যু) আসা পযর্ন্ত অপেক্ষা কর। আল্লাহ ফাসিকদেরকে হেদায়াত করেন না।(সূরা তাওবা:২৪)

 

এ আয়াতে অতি স্পষ্ট ভাষায় দুনিয়ার ভালোবাসার জিনিসগুলোকে কী পরিমাণ ভালোবাসা যাবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ, রাসূল ও আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসলেই ঈমান দুর্বল বলে প্রমাণিত হবে। যখন ঐ আটটি জিনিসের ভালোবাসা এ তিনটির চেয়ে বেশি হবে তখনি ঈমানের বিপদ। আল্লাহ, রাসূল, জিহাদের ভালোবাসার সাথে ঐ ৮টি জিনিসের ভালোবাসার যখনি টক্কর হবে, তখন তিনটির ভালোবাসা নিষিদ্ধ নয়; বরং কর্তব্য। কিন্তু ঈমান নিরাপদ থাকবে। ঐ আটটির ভালোবাসা নিষিদ্ধ নয়; বরং কর্তব্য। কিন্তু তিনটির চেয়ে ঐ ৮টির ভালোবাসা বেশি হলেই প্রমাণিত হবে যে, ঈমান দুর্বল।

 

একটি চমৎকার উদাহরণ এ কথাটিকে সুন্দর ভাবে স্পষ্ট করে দেয়। পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া জীবন বাঁচে না বলেই এ কথাটি বলা হয়। কিন্তু মানুষ কি পানিতে ডুবে মরে না? তাহলে পানিকে জীবন বলা যায় কী করে? আসল কথা হলো, এক বিশেষ পরিমাণ পানি অবশ্যই জীবন। এ পরিমাণের বেশি হলে পানিই মরণ। তেমনিভাবে আল্লাহ, রাসূল ও জিাহাদের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে ঐ আটটি জিনিসের ভালোবাসা কম হলে এটাই ঈমানের জীবন। আর ৩টি থেকে ৮টির বালোবাসা বেশি হলেই ঈমানের মরণ।

 

আল্লাহ, রাসূল ও ইসলামী আন্দোলনের প্রতি দায়িত্ব পালনের পথে যখন ঐ আটটি ভালোবাসার বস্তু প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তখন ঐ দায়িত্ব পালনে বাধার সৃষ্টি হয়। এ বাধা দূর করতে পারলে, অর্থাৎ তিনটির ভালোবাসার খাতিরে যদি আটটির ভালোবাসা কুরবানী দেওয়া যায়, তাহলে প্রমাণিত হবে যে, ঈমান দুর্বল নয়। ঈমান দুর্বল হলে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ তখন আর ঈমানের দাবি পূরণ করার শক্তি থাকে না।

 

সম্পদ ও সন্তানকে আল্লাহ্‌ সজ্জা ও বলেছে , ফিতনাও বলেছেন-

 

الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِندَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا

 

সম্পদ ও সন্তানাদি দুনিয়ার জীবনের সজ্জা।(সূরা কাহফ:৪৬)

 

إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ

 

নিশ্চয়ই তোমাদের মাল ও সন্তান ফিতনা’ (সূরা তাগাবুন:১৫)

 

ঐ আটটি ও তিনটির ভালোবাসায় যদি ভারসাম্য রক্ষা কর হয় তাহলে সম্পদ ও সন্তান জীবনের সজ্জা। আর যদি আটটির ভালোবাসা বেশি হয় তাহলে সম্পদ ও সন্তান ফিতনা। ইসলামী পরিভাষায়, আল্লাহর হুকুম পালনে বাধাকেই ফিতনা বলা হয়। এর শাব্দিক অর্থ  পরীক্ষা, বিপদ, গোলাযোগ, আকর্ষণ, বিশৃঙ্খলা, ইত্যাদি।

 

সূরা মুনাফিকূনের দ্বিতীয় রুকুর প্রথম আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ ۚ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ

 

হে ঐসব লোক যারা ঈমান এনেছে শোন! তোমাদের মাল ও আওলাদ (সম্পদও সন্তান) যেন তোমাদরেকে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে না দেয়। এসবের ভালোবাসায় এমন মগ্ন হয়ে যেয়ো না, যার কারণে ঈমানের দাবি পূরণে অবহেলা হয়ে যায়।

 

৬. মযবুত ঈমানের শর্ত কী কী?

 

মযবুত ঈমানের প্রধান শর্ত দুটোঃ

 

১. র্শিকমুক্ত ঈমান বা নির্ভেজাল তাওহীদ।

 

২. ঈমানের দাবিদারকে তাগূতের কাফির হতে হবে।

 

সুতরাং মযবুত ঈমানের অধিকারীকে তাওহীদ, শিরক  তাগূত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হবে।

 

তাওহীদ ও শিরক

 

তাওহীদের সম্পূর্ণ বিপরীত পরিভাষা হলো শিরক  । তাওহীদ শব্দের অর্থ হলো অদ্বিতীয়তাবাদ।সাধারণ এর অর্থ করা হয় একাত্ববাদ। এ অর্থটি ত্রুটিপূর্ণ। আরবী ওয়াহিদ শব্দের অর্থ এক, আর আহাদ অর্থ অদ্বিতীয়।

 

قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ  বল যে, আল্লাহ অদ্বিতীয়। একের পর দুই, তিন ইত্যাদি সংখ্যা রয়েছে। তাই একাত্ববাদ বললে মূল মর্মটি বুঝায় না।অদ্বিতীয় মানে, যার কোনো সমকক্ষ নেই, এমনকি যার সাথে তুলনা করার মতোও কেউ নেই।

 

তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে র্শিক সম্বন্ধে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ তাওহীদ মানেই র্শিক না থাকা। তাওহীদের সবচেয়ে স্পষ্টও সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞাই হলো র্শিকমুক্ত ঈমান। যেমন আলোর সহজ সংজ্ঞা হলো অন্ধকার না থাকা। তাই শিরক সম্পর্ক বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

 

যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তারা কাফির। যারা শিরক করে তারা আল্লাহকো অস্বীকার করে না। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে বটে কিন্তু আল্লাহর সাথে অন্যান্য সত্তা বা শক্তিকে বিভিন্ন ভাবে শরীক করে। তাদেরকে মুশরিক বলা হয়।

 

শিরক শব্দটির অর্থ হলো শরীক করা। আল্লাহর সাথে কী কী ভাবে শরীক করা হয় তা বুঝতে পারলে শিরক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে এবং শিরক থেকে বেচে থাকাও সহজ হবে।

 

মাওলানা মওদূদী (র) তার বিখ্যাত তাফসীর তাফহীমুল কুরআনে সূরা আনআমের ১২৮নং টীকায় শিরক সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেনে এর সমামানের কোন আলোচনা আমি পাইনি। কুরআন মাজীদে শত শত আয়তে শিরকের কথা আছে এবং ঐসব জায়গায়ই টীকাও আছে। আমার জানা মতে সূরা আনআমের ১২৮নং টীকাতে শিরকের পূর্ণঙ্গ ব্যাখা পাওয়া যায়। অন্যান্য শত শত টীকায় কোথাও ১০% কোথাও ৫০% ব্যাখ্যা আছে।১২৮নং টাকাটি ভালোভাবে হজম করতে পারলে অন্যান্য টীকা পড়ার দরকারই হবে না। আমি সে ব্যাখাটিই এখানে পেশ করছি।

 

শিরক চার প্রকার

 

যারা আল্লাহর সাথে অন্য সত্তাকে শরীক করে তারা এ কাজটি চারভাবে করে থাকে।

 

১. আল্লাহর সত্তার (Person) সাথে শরীক করে।

 

যেমন কাউকে আল্লাহর পুত্র, কন্যা বা স্ত্রী সাব্যস্ত করে। কুরআনে আছে ঃ

 

وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ

 

ইহুদীরা হযরত ওযায়িরকে আল্লাহর পুত্র বলে। আর খ্রিষ্টানরা মাসীহ (আ) কে আল্লাহর পুত্র বলে। (সূরা তাওবাঃ ৩০)

 

খ্রিষ্টানরা হযরত ঈসা (আ) এর মা হযরত মারইয়াম (আ) কে আল্লাহর স্ত্রী মনে করে।

 

ফেরেশতাগণকে আল্লাহর কন্যা মনে করা হত বলে কুরআনে বহু জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। দেব দেবীদেরকেও আল্লাহর বংশ বলে বিশ্বাস করা হয়। কতক স্বৈরশাসক নিজেদেকে স্রষ্টার বংশধর বলে দাবি করেছে। এভাবেই আল্লাহর যাতের সাথে অন্য সত্তাকে শরীক করা হয়।

 

২. আল্লাহর গুণাবলির সাথে শরীক করা।

 

যেসব গুণ একান্তেই আল্লাহর সেসব গুণ কারো মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। যেমন গায়েবী ইলম বা অদৃশ্য স¤পর্কে জ্ঞান। কারো সম্পর্কে এমন ধারণা করা যে তিনি সবকিছু জানেন দেখেন বা শুনেন এবং সব দোষ ত্র“টি থেকে মুক্ত।

 

৩.  আল্লাহর ক্ষমতায় অন্য কোনো সত্তাকে শরীক করা। যেসব ক্ষমতা শুধু আল্লাহর সেসব ক্ষমতা আর কারো মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। যেমন

 

ক. আইন দেওয়া ক্ষমতা হালাল ও হারাম বা জায়েয ও না জায়েয এর সীমা নির্ধারণ করা। মানবজীবনের জন্য বিধি বিধান রচনা করা একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ার। আল্লাহর দেওয়া আইন রচনার ক্ষমতা আছে কিন্তু মৌলিক আইন রচনার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই।

 

খ.অলৌকিকভাবে কারো উপকার বা ক্ষতি করা প্রয়োজন পূরণ করা, হেফাযত করা রক্ষণাবেক্ষণ করা দোআ শোনা ও কবুল করা ভাগ্য গড়া ও ভাঙা ইত্যাদি আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে করার ক্ষমতা আছে মনে করা।

 

গ. সন্তান দান করা রোগ দেওয়া ও আরোগ্য করা রিযক দান আপদ বিপদ দেওয়া ও দূর করা ইত্যাদি শুধু আল্লাহর একক ক্ষমতা। এতে কেউ শরীক নেই।

 

৪.  আল্লাহর অধিকারে আর কাউকে শরীক করা।

 

যেমন রুকু ও সিজদা করা হাত বেধে নত হয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা দেখানো পশু কুরবানী করা বিপদ আপদে কাতরভাবে দোআ করা দয়া ও অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় কোনো কিছু দান করা ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য বা হক।

 

প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কারো অসন্তুষ্টির ভয় করা প্রয়োজন পূরণের ও বিপদ দূর করার জন্য দোআ করা নিঃশর্ত আনুগত্য করা সত্য ও অসত্যের মাপকাঠি গণ্য করা ইত্যাদি শুধু আল্লাহর হক। এসব হকের কোনোটি পাওয়ার যোগ্যতা অন্য কোনো সত্তার আছে বলে মনে করা শিরক। কুরআন মাজীদে বারবার ঘোষণা করা হয়েছে যে আল্লাহ তায়ালা শিরকের গুনাহ মাফ করবেন না। উপর্যুক্ত ৪ প্রকার শিরকের ১নং শিরক মুসলমারদের মধ্যে নেই। কিন্তু বাকি সব রকমের শিরকই মুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। এর প্রধান কারণ হলো শিরক সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা।

 

প্রচলিত শিরকের উদাহরণ

 

১. আমাদের দেশে মানুষের মনগড়া আইন চালু আছে। আল্লাহর আইন কায়েমের চেষ্টা না করলে বুঝা গেল যে মানুষের তৈরি চালু আইনকে মন থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এসব আইন বৈধ মনে করা যে শিরক তা অনেকেই বুঝে না। যারা এসব অবৈধ আইন উৎখাত করে আল্লাহর আইন চালু করার চেষ্টা করে তারা শিরক থেকে বেচে গেল।

 

২. রিযকের মালিক একমাত্র আল্লাহ। যে পেশাই গ্রহণ করা হোক ঐ পেশা রাযযাক নয়। ঐ পেশা নষ্ট হলেও আল্লাহ অন্য উপায়ে রিযক দিতে সক্ষম।

 

কোন স্কুল, কলেজ বা মাদরাসার শিক্ষক ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। ঐ সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রিযক বন্ধ করার ভয় দেখিয়ে দীনের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। যদি কেউ চাকরি চলে যাবার ভয়ে ইকামাতে দীনের কাজ বন্ধ করে দেয় তাহলে বুঝা গেল যে সে আল্লাহকে একমাত্র রাযযাক মনে করে না। সে চাকরিকেও রিযকদাতা হিসেবে আল্লাহর সাথে শরীক মনে করে। এভাবেই শিরক ঈমানকে দুর্বল করে। ঈমান শিরকমুক্ত না হলে মযবুত হতে পারে না। যে চাকরি বাচানোর জন্য আল্লাহর পথে জিহাদ করা বন্ধ করল আল্লাহর সাথে তার ঈমানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল।

 

কয়েক বছর আগে খুলনা থেকে এক যুবক আলেম আমার সাথে দেখা করলেন। বললেন আমি খুলনায় এক মসজিদের ইমাম ছিলাম। আমি প্রকাশ্যে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী হিসেবে দয়িত্ব পালন করছিলাম। মসজিদ কমিটিতে চরমোনাইর পীরের মুরীদদের সংখ্যই বেশি। তারা আমাকে জানালেন যে জামায়াতে ইসলামী ত্যাগ না করলে আমাকে ইমামতী ত্যাগ করতে হবে। আমি চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি। কারণ আমি বুঝে শুনে জামায়াতে কাজ করছিলাম।

 

যদি তিনি চাকরিতে বহাল থাকার জন্য জামায়াত ত্যাগ করতেন তাহলে এটা শিরক হতো এবং আল্লাহর সাথে তার ঈমানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেত। তিনি শিরক থেকে মুক্ত ছিলেন বলেই সাহস করে চাকরি ছেড়ে দিলেন।

 

এর বিপরীত উদাহরণই বেশি পাওয়া যায়। কুমিল্লা জেলার এক দাখিল মাদরাসার দু জন তরুণ শিক্ষক আমার সাথে দেখা করতে এলো। পরিচয় দিতে গিয়ে বলল আমরা দুজনই ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথী ছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা যেখানে শিক্ষকতা করছ ওখানে জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন নেই? জওয়াবে বলল, অবশ্যই আছে। বললাম, তাহলে জামায়াতের সাথে কী সম্পর্ক তা তো বললে না। বলল, মাদ্রাসার সুপার এত জামায়াতবিরোধী যে, আমরা জামায়াত করছি জানলে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেবে।

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি আল্লাহকে রায্যাক মনে কর না? বিস্মিত হয়ে এ কথা কেন বললাম তা জানতে চাইলে। বললাম, তোমরা ঐ মাদ্রসাকেও চাকরী বাচানোর জন্য দীনের দায়িত্ব অবহেলা করছে। এতে ঈমানের দুর্বলতাই প্রকাশ পেল। এতে আল্লাহর সাথে ঈমানী সম্পর্কটাই ছিন্ন হয়ে গেল কি না তোমরা ভেবে দেখ।

 

৩. আমাদের ধেশে অনেক লোক আজমীরে হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি (রা:) এবং বাগদাদে হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রা:) এর মাযারে গিয়ে তাদের নিকট সন্তানের জন্য, বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য, রোগ দূর করে দেওয়ার জন্য এবং আরও বিভিন্ন রকম মকসূদ হাসিলের উদ্দেশ্যে দোয়া করে। এসব দোয়া শুধু আল্লাহরই দরবারেই করা প্রয়োজন। বুজুর্গদের মাযারে গিয়ে দোয়া করা সুস্পষ্ট র্শিক। ওখানে গিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করাও সঠিক নয়। আল্লাহর কাছে চাওয়ার জন্য সেখানে যাওয়া অর্থহীন।

 

মাযার ও কবরের সাথে সম্পর্তিত বহু রকমের র্শিক ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে চালু রয়েছে।

 

তাগূতের অর্থ

 

তাগূত শব্দের অর্থ সীমালঙ্ঘনকারী। আল্লাহ তায়ালা আয়াতুল কুরসীতে তার সার্বভৌম গুণাবলি উল্লেখ করে তারপর বলেনঃ فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انفِصَامَ لَهَا ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

 

অতএব যে কেউ তাগূতকে অস্বীকার করে আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, সে এমন মযবুত রশি ধরেছে যা কখনও ছিড়বে না। আল্লাহ সব কিছু শুনেন ও জানেন। (সূরা বাকারাঃ ২৫৬)

 

আল্লহ তায়ালা গুণাবলি উল্লেখ করে এ আয়াতে যা বলা হয়েছে তা খুবই তাৎপর্যপূণ। বলা হয়েছে কেউ যদি উপর্যুক্ত গুণাবলিসম্পন্ন আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে চায় তাহলে প্রথমে তাকে তাগূতের কাফির হতে হবে। তাগূতের কাফির না হয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলে তাগূতের চাপে ও দাপটে সে ঈমানের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হবে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলে আল্লাহর সাথে যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তাগূতের চাপে ঐ সম্পর্ক বহাল থাকে না। তাগূতকে মানতে অস্বীকার করলে অর্থাৎ তাগূতের চাপকে অগ্রাহ্য করার হিম্মত করলে আল্লাহতর সাথে ঈমানের সম্পর্ক এমন মযবূত হয় যে তা আর ছিন্ন হয় না। আয়াতে ঈমানের এ সম্পর্কটিকে রশি বা রজ্জুর সাথে তুলনা করা হয়েছে।

 

এ কারণেই মযবুত ঈমানের শর্ত হিসেবে তাগূতকে অস্বীকার করতে হবে বা তাগূতের কাফির হতে হবে। তাই তাগূত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন বা তাগূতকে ঠিকমত চিনে নেওয়া দরকার।

 

তাগূত সম্পকর্কে তাফহীমুল কুরআনের টীকা পড়েও মনে তৃপ্তি বোধ না করায় সরাসরি মাওলানা মওদূদীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি যা বললেন তা নিম্নরুপ ঃ

 

আল্লাহতাআলা তার হুকুম মেনে চলার জন্য যেমন বাধ্য করেননি অমান্য করতেও বাধ্য করেননি। মানা ও না মানার ইখতিয়ার মানুষকে দিয়েছেন। আল্লাহর নাফরমানীর দুটো সীমা রয়েছে। প্রাথমিক সীমা হলো ফিসক আর চূড়ান্ত ও শেষ সীমা হচ্ছে কুফর। যে আল্লাহর হুকুম স্বীকার করে বটে কিন্তু পালন করে না সে ফাসিক। আর যে হুকুম কে স্বীকার করে না সে কাফির। যে নাফারমানীর এ দুটো সীমা লঙ্ঘন করে সেই তাগূত।

 

ব্যক্তিগত ভাবে কেউ ফাসিক বা কেউ কাফির হতে পারে। এটা যার যার ইখতিয়ার বা স্বাধীন ইচ্ছা। আল্লাহর নাফারমানীর এ দুটো সীমা রয়েছে। যে এ সীমাও লঙ্ঘন করে সে হলো তাগূত। এ দুটো সীমা লঙ্ঘন করার মানে কী? কেমন করে এ সীমা লঙ্ঘন করা হয়? এটা বুঝলেই তাগূতকে চেনা সহজ হবে।

 

যে নিজে ফাসিক এবং অন্য মানুষকেও ফাসিক বানানোর চেষ্টা করে সেই তাগূত। সে নাফরমানীর প্রাথমিক সীমা লঙ্ঘন করলো। যে নিজে কাফির এবং অন্যকেও কাফির বানানোর চেষ্টা করে সেই তাগূত। যে আল্লাহর নাফরমানীর শেষ সীমাও লঙ্ঘন করলো।

 

এখানে একটি কথা বিশেষভাবে বোঝার আছে। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকে নিজস্ব সত্তা দিয়ে আলাদাভোবে পয়দা করেন। যে দুনিয়ায় আসার সময় যেমন একা আসে, যাওয়ার সময়ও একাই যায়। আখিরাতে তাকে তার কৃতকর্মের ফল আলাদাভাবেই দেওয়া হবে।

 

তার শাস্তি সে একাই ভোগ করবে। পুরস্কারও যে একাই পাবে। তার কর্মের জন্য সেই দায়ী হবে। তাই তাকে আল্লাহর হুকুম অমান্য করার ইখতিয়ার এককভাবেই দেওয়া হয়েছে। অন্য মানুষকে আল্লাহর নাফরমান এবং বানানোর কোন ইখতিয়ার কাউকে দেওয়া হয়নি। যারা নিজে নাফরমানীর সীমা লঙ্ঘন করেÑ এরাই তাগূত।

 

তাগূতের পরিচয়

 

তাগূতকে মানতে অস্বীকার করতে হলে কে কে তাগূত তা জানতের হবে। কুরআনে তালাশ করলে ৫ প্রকার তাগূত পাওয়া যায়।

 

১.নাফস ও হাওয়া নাফস মানে প্রবৃত্তি, আর হাওয়া মানে কুপ্রবৃত্তি। দেহের যাবতীয় দাবিকে একসাথে নাফস বলা হয়। যে দাবি মন্দ তাকেই হওয়া বলে।

 

দেহের ভালো ও মন্দের কোনো ধারণা নেই। এ ধারণা আছে বিবেকের।রূহের সিদ্ধান্তই বিবেক। নাফস বা দেহের দাবি মন্দ বলেই ধরে নিতে হবে। বিবেক যাচাই করে বলে দেয় কোন দাবিটা ভালো বা মন্দ। সূরা ইউসূফের ৫৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ   নিশ্চয়ই নাফস মন্দেরই হুকুম দেয়। আল্লাহর নাফরমানীয় জন্য তাগিদ দেয় বলেই নাফস তাগূত।

 

যদি কেউ সত্যিই আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই নাফসের কাফির হতে হবে। কেউ যদি উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে চায় তাহলে প্রথমেই তাকে দৃঢ় সিদ্ধান্ত দিতে হবে, আমি নাফসের কথা মেনে চলব না-না-না। অর্থাৎ আমি বিবেকের বিরুদ্ধে চলব না-না-না।

 

এ সিদ্ধান্ত না নিলে যে আল্লাহর প্রতি আনা সত্তেও নাফসের গোলামউ থেকে যাবে। সে আল্লাহকে ইলাহ বা হুকুমকর্তা স্বীকার করা সত্তেও নাফস বা হাওয়াকে ইলাহ হিসেবেই মেনে চলবে।

 

সূরা ফুরকানের ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,   أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ

 

সুরা জাছিয়ার ২৩নং আয়াতে আছে,  أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ   অর্থ: তুমি কি তাকে দেখেছ, যে তার কুপ্রবৃত্তিকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছে? কুরআনের অনুবাদে অনেকেই তাগূত অর্থ লিখেছেন শয়তান। শয়তান আল্লাহর নাফরমানী করার জন্য উসকে দেয় বলে শয়তান অবশ্যই তাগূত। কিন্তু তাগূত অর্থ শয়তান নয়। যারা তাগূতের অর্থ শয়তান লিখেছেন, তারা তাগূতের সঠিক পরিচয় জানেন না। আমি শয়তানকে পৃথকভাবে তাগূত গণ্য করি না। কারণ শয়তান মানুষের নাফসকে বিভ্রান্ত করেই নাফরমানীর জন্য ওয়সওয়াসা দেয়। তাই প্রথম নম্বর তাগূতের মধ্যেই শয়তান অন্তর্ভূক্ত। সে হিসেবে নাফস ও শয়তানকে একই সাথে তালিাকর ১নম্বরে রাখা যায়।

 

২.শরীআতবিরোধী প্রচলিত কুপ্রথা ও সামাজিক কুসংস্কার ও তাগূত। (Customs and traditions)

 

সূরা বাকারায় আল্লাহ বলেন:  وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا ۗ

 

যখন তাদেরকে বলা হলো যে, আল্লাহ যা (ওহীযোগে) নাযিল করেছেন তা মেনে চল, তখন তারা বলল, আমাদের বাপ দাদাকে যা মেনে চলতে দেখেছি,আমরা তাই মেনে চলব।(সূরা বাকারা : ১৭০)

 

সমাজে বহু কুপ্রথা প্রচলিত আছে যা শরীআত বিরোধী।ধর্মের নামেও বহু শরীআতবিরোধী প্রথা চালু আছে। বিয়ে শাদিতে তো কুপ্রথার ব্যাপক প্রচলন আছে। কুপ্রথাগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। এসবকে অমান্য করতে গেলে বিরাট বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কুপ্রথাগুলো আইনের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। আইন চালু করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার (Law Enforcement Agency) প্রয়োজন হয়। কুপ্রথা নিজেন শক্তি বলেই চালু থাকে। আইন করেও তা দুর করা সহজ নয়। এ কারণেই সামাজিক কুসংস্কারগুলোও তাগূত। এসবকে মানতে অস্বীকার না করলে ঈমারের দাবি পূরণ করা যায় না। এগুলো আল্লাহর হুকুমের বিরোধী। এসব কে মেনে চললে আল্লাহকে অমান্য করা হয়।

 

৪. শাসন শক্তিও তাগূত। শাসন শক্তি বললে শুধু গভর্নমেন্টই বোঝায় না। স্বামী স্ত্রী সংসারে স্বামীও শাসন শক্তি। পরিবারে পিতা শাসক শক্তি। কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শাসন শক্তি। কিছু লোকের উপর কতৃত্ব করার সুযোগ যার আছে সেই শাসক শক্তি। একটি দেশে সরকার হলো সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক শক্তি। কুরআনে ফিরাউন ও নমরুদকে শাসক শক্তি হিসেবেই তগিূত বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মূসা (আ) কে ফিরাউনের নিকট যাওয়ার আদেশ যে ভাষায় দিলেন সেখানেও ফিরাউনকে সীমালঙ্ঘনকারী বলেই উল্লেখ করেছেন।

 

اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ

 

হে মূসা ফিরাউনের নিকট যাও। নিশ্চয়ই সে সীমালঙ্ঘন করেছে। সূরা ত্বাহা ঃ২৪

 

শাসক শক্তি প্রয়োগ করে অধীনস্থদের উপর আল্লাহর আইনের বিরোধী নিয়ম কানুন চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তারা আল্লাহর নাফারমানী করায় বাধ্য করতে পারে।তাই এসব তাগূত। আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবি হলো আল্লাহর নফারমানী করতে অস্বীকার করা। তা না করলে ঈমানে দুর্বলতাই প্রকাশ পায়।

 

৫. রিযক বন্ধ করার ভয় দেখানোর শক্তি ও তাগূত। এ তাগূতটি শাসন শক্তিরই অন্তর্ভুত।চাকরি থেকে সরিয়ে দিয়ে রিযক বন্ধ করার ক্ষমতা যাদের আছে তারা শাসক শক্তি বটে। তবু এটা পৃথকভাবে গণ্য করার যোগ্য তাগূত। শাসন শক্তি প্রয়োগ করে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দিতে পারে ও বিভিন্নভাবে ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু চাকরি থেকে বরখাস্ত করার শাস্তিটি চরম যুলম বলেই রিযক বন্ধ করার ভয় দেখানোর শক্তিকে শাসন শক্তি থেকে আলাদাভাবে গণ্য করা হলো। এ শক্তি প্রয়োগ করে  অধীনস্থদেরকে আল্লাহর নফারমানী করতে বাধ্য করা যায় বলেই এটা ও তাগূত।

 

৬. অন্ধভাবে মেনে চলার দাবিদার শক্তিও তাগূত। সমাজে এমন কতক লোক আছে যারা তাদেরকে অন্ধভাবে মেনে চলার জন্য নৈতিক প্রভাব প্রয়োগ করতে সক্ষম। তাদের দাবি হলো বিনা যুক্তিতে তাদের কথা মেনে চলতে হবে। বিনা প্রশ্নে তাদের আনুগত্য করতে হবে।বিনা বাক্য ব্যয়ে তাদের হুকুম পালনের অধিকার তারা দাবি করে।

 

অথচ আল্লাহ ও রাসূল (সা) ছাড়া এ দাবি আর কারো অধিকার নেই। যেহেতু আল্লাহ নির্ভুল এবং রাসূল (স) আল্লাহর ওহী দ্বারা পরিচালিত বলে তিনিও নির্ভুল সেহেতু এ দু সত্তাকে বিনা দ্বিধায় শর্তহীন ভাবে মেনে চলতে হবে।

 

এছাড়া আর কারো এ জাতীয় আনুগত্যের দাবিদার হওয়ার অধিকার নেই। তাই যারা এ দাবি করে তারাও তাগূত। সুরা তওবার ৩১নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,   اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ

 

তারা তাদের ওলামা ও পীরদেরকে আল্লাহর বদলে তাদের রব হিসেবে গ্রহন করেছে।

 

হদীসে এর অর্থ বলা হয়েছে যে তাদেরকে অন্ধভাবে মেনে নিয়েছে। তারা হালাল ও হারামের ব্যাপারে যে ফায়সালাই দেয় তা অন্ধভাবে স্বীকার করে নেয়। অন্ধভাবে মেনে নেওয়ার দাবিদার শক্তি ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেমন আছে, রাজনৈতিক ময়দানেও রয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত, নেতা বা নেত্রীর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক মনে হলেও অন্ধভাবে তা মানতে হয়, না মানলে দল থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে, এ ভয়ে মেনে নিতে বাধ্য হয়। তাই এ জাতীয় শক্তিও তাগূত। তাদের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের কারণে দীনের পথে বাধার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন একপীর সাহেব মুরীদদেরকে বললেন যে, তোমরা মওলানা মওদূদীর বই পড়বে না। পীরের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের কারণে যারা বই পড়লো না, তারা ইকামাতে দীনের পথ চিনতে ব্যর্থ হলো। আমার কয়েকজন তাবলীগী ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে মাওলানা মওদূদূীর বই পড়তে দিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ পর আরও বই নিয়ে গেলাম। আগের দেওয়া বই ফেরত চাইলাম। বই ফেরত দিলেন এবং আর কোনো বই নিতেই রাজি হলেন না।জিজ্ঞেস করলাম, বই কি পড়েছিলেন? জওয়াবে বললেন, এসব বই পড়তে মুরুব্বীরা মানা করেছেন। আমি বললাম, মুরুব্বীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন কেন? এর জওয়াবে যা বললেন তাতে বুঝলাম যে, এসব বই পড়েই আমি গুমরাহ হয়েছি বলে তাদেরকে পড়তে নিষেধ করেছেন। আমি বললাম, যদি কোনো বই পড়লেই ঈমান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে এমন দুর্বল ঈমান কী করে রক্ষা করবেন?

 

আমার খুব আফসোস হলো। যাদেরকে বই পড়তে দিয়েছিলাম তারা তাবলীগ জামায়াতেআমার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাদের একজন আমার হতেই রিক্রুট হয়েছেন। তারা তাগূতের খপ্পরে পড়ে ইকামাতে দীনের পথ চেনার সুযোগ না পাওয়ায় তাদের জন্য বেদনা বোধ করেছি। এ দীর্ঘ আলোচনায় পাঁচ রকমের তাগূত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল। মযবুত ঈমানের জন্য তাগূতকে অস্বীকার করা এ কারণেই অত্যন্ত জরুরি। সুরা নাহলের ৩৬ নং এ আয়াতটিতে আল্লাহ বলেন, আমি প্রত্যেক উম্মতের নিকট (এ নির্দেশ দিয়ে) রাসূল পাঠিয়েছি যে, তোমরা (একমাত্র) আল্লাহর দাসত্ব কর এবং তাগূত থেকে দুরে থাক।

 

নমরূদ ও ফিরাউন খোদায়ী দাবি করেছিল বলে বল হয়। কিন্তু তারা আসমান যমীন সৃষ্টি করার দাবি করেনি। তারা মানুষকে তাদের হুকুমের দাস বানিয়ে রেখেছিল। মানুষকে আল্লাহর দাস হতে বাধা দিয়ে নিজেদের দাস হতে বাধ্য করেছিল। এ অর্থেই তাদের সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা খোদায়ী দাবি করেছিল। তারা আধুনিক যুগের পরিভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ছিল মাত্র। তাগূতের কাজই হলো, আল্লাহর দাসত্ব থেকে ফিরিয়ে রেখে তার দাসত্ব করতে বাধ্য করা। তাই যারা আল্লাহর দাসত্ব করতে আগ্রহী তাদেরকে সচেতন ভাবে সবরকম তাগূতী শক্তিকে পরিহার করে তাদের থেকে বেচে থাকতে হবে।

 

কালেমায়ে তাইয়েবা তাগূত বিরোধী

 

কালোমায়ে তাইয়েবা لَا اِلَهَ اِلاَّ اللهُ    এর মূল কথা হলো, আল্লাহই একমাত্র ইলাহ, আর কোন ইলাহ নেই।এ বক্তব্য প্রকাশ করার জন্য واحد اِلَهَ الله বললেই তো চলতো। তা না করে لَا   দিয়ে কেন শুরু করা হলো? لَا মানে নেই। নেই দিয়ে কেন শুরু করা হলো? মানব সমাজে বহু হুকুমকর্তা রয়েছে। মানবমনের উপর এরা রাজত্ব করে। মানব এদের হুকুম মেনে চলে; হয় বাধ্য হয়ে, না হয় লোভে পড়ে। এসব হুকুমকর্তা (ইলাহ) হলো আসলে তাগূত। তাই যারাই কালেমায় তাইয়েবা কবুল করতে চায়। তাদেরকে মহান আল্লাহর উপর ঈমান আনার আগেই তাগূতকে অস্বীকার করতে হবে। এতে প্রমাণিত হলো যে, সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে যে ফরমে فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ    বলা হয়েছে সে ফরমেই প্রথমে অস্বীকার দ্বারা শুরু করা হয়েছে। ঐ আয়াতে আল্লাহর প্রতি ঈমার আনার আগেই তাগূতের কুফরী করতে বলা হয়েছে।আল্লাহ দ্বারা তাগূতকে অস্বীকার করার ঘোষণা দেওয়ার পরে   اِلاَّ اللهُ   বলে আল্লাহর প্রতি ঈমানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এটা বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। যারা তাগূতের পরিচয় জানে, তারা

 

লা ইলাহা’ দ্বারা কাদেরকে অস্বীকার করা হচ্ছে তা বুঝতেই পারে না। তারা না বুঝে তোতাপাখির মত কালেমা উচ্চারণ করে থাকে এবং তাগূদের দাসত্ব করতে থাকে।

 

একটি সহজ উদাহরণ

 

জমিতে ধানের বজি বপন করতে হলে প্রথমেই জমিকে আগাছামুক্ত করতে হবে।আগাছা দূর না করে ধান ফেললে ফসল তো দূরের কথ,বীজ ধানও ফিরে পাওয়া যাবে না।কৃষি জমি যেমন খালি থাকে না মানুষের মনের জমিও খালি থাকে না। ঐ রকম তাগূত মানবমন দখল করে থাকে। মনে ঈমানের বীজ ফেলতে হলে মন থেকে সব তাগূত কে তাড়াতে হবে। তা না হলে মনের যমীন ঈমানের বীজ বপনের জায়গাই হবে না।

 

তাগূতের সারকথা

 

আল্লাহ তআলা মানুষ ও জিনকে আল্লাহর দাসত্ব করার জন্য পয়দা করেছেন। আল্লাহ সূরা আয যারিয়াতের ৫৬নং আয়াতে ঘোষনা করেন,   وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

 

‘আমি জিন ও ইনসানকে আমার দাসত্ব করা ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। ‘

 

এ কথার একটি মর্ম হলো,  আল্লাহ শুধু তারই দাসত্ব করার জন্য তাদের কে সৃষ্টি করেছেন আর কারো দাসত্ব করার জন্য নয়। তাই যারা আল্লাহর দাসত্বের বদলে কোনো সৃষ্টি দাসত্ব করে তারা নিজেদেরকেই হেয় করে এবং মানুষ হিসেবে মার্যাদা হারায় তারা পশুর পর্যায়ে গণ্য হয়।

 

ঐ কথাটির অপর মর্ম হলো,  যারা আল্লাহর দাসত্ব করার সীমাবদ্ধ না থেকে প্রভুত্ব করার অপচেষ্টা চালায় তারাই তাগূতে পরিণত হয়। তারা আল্লাহর বান্দাদেরকে তাদের বান্দাহ বানায়। শাসন শক্তি রিযক বন্ধ করে দেওয়ার ভয় দেখানোর শক্তি ও অন্ধ আনুগত্যের দাবিদার শক্তি হিসেবে তারা আল্লাহর বন্দাহদের উপর প্রভুত্ব কায়েম করে চরম সীমালঙ্ঘনকারীতে পরিণত হয়।

 

এসব শক্তি আল্লাহর দাসত্ব করা থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখে এবং তাদের দাসত্ব করতে বাধ্য করে। তাই আল্লাহর দাসত্ব করতে হলে এসব শক্তি কে মানতে অস্বীকার করার সাহস থাকতে হবে। এ সাহস যাদের নেই তারা আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবিদার হলেও পদে পদে তাগূতের নিকট পরাজিত হতে থাকবে।

 

সূরা আনকবূতের প্রথম আয়াতেই আল্লাহ তাআলা বলেন - أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ

 

‘মানুষ কি মনে করে যে, আল্লাহর প্রতি ঈমন এনেছি বললেই তাদেরকে বিনা পরীক্ষায় ছেড়ে দেওয়া হবে?

 

ঈমানের পরীক্ষা আসে তাগূতের মাধ্যমে। তাগূতকে অমান্য করার সিদ্ধন্ত না থাকলে পরীক্ষায় অবশ্যই ফেল করবে।

 

মযবুত ঈমানের সুফল

 

আগেই বলা হয়েছে যে,  আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহকে র্‌  বাদশাহ ও ইলাহ হিসেবে মেনে চলার সিদ্ধান্তই ঈমান। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হলে ঈমানের দাবি পূরণ করতে হবে। ঈমানের দাবি পূরণ করতে হলে ঈমানকে দুবর্ল হতে দেওয়া চলবে না। ঈমানকে শুধু দুর্বলমুক্ত রাখাই যথেষ্ট নয়, ঈমানকে অত্যন্ত মযবুত করার জন্য ঐ দুটো শর্ত পূরণ করতে হবে।

 

যে মযবুত ঈমানের অধিকারী সে

 

১. দীনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধায় ভোগে না। সব অবস্থায় মনে প্রশান্তি ভোগ করে এবং তৃপ্তি বোধ করে। এ প্রশান্তি ও তৃপ্তি এমন বেহেশতী নিয়ামত, যার কোনো তুলনা নেই।

 

২. আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের সাফল্যের তীব্র কামনা এমন ভাবে অন্তর দখল করে রাখে যে, দুনিয়ার কোনো বড় স্বার্থের লোভেও বিভ্রান্ত হয় না।

 

৩. আল্লাহ সবসময় সাথে আছেন এ চেতনার ফলে দুঃখ কষ্ট, আপদ বিপদ ও রোগ শোকে বিচলিত ও পেরেশান হয় না এবং তাওয়াক্কুল আলল্লাহ ও সবরের নিয়ামত লাভ করে।

 

৪. একমাত্র আল্লাহর ভয় ছাড়া মৃত্যুভয়সহ সকল ভয় থেকে মুক্ত থাকে। মৃত্যুকে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার মহাসুযোগ মনে করে এবং শহীদী মৃত্যুই কামনা করে।

 

৫. দুনিয়ার যেসব জিনিসের ভালোবাসার দায়িত্ব আল্লাহ দিয়েছেন এসবের আকর্ষণ সত্ত্বেও আল্লাহ রাসুল (সা) ও জিহাদী ফী সাবীলিল্লহকে প্রাধান্য দেওয়ার যোগ্যতা হাসিল করে।

 

৬. সকল প্রকার শিরক থেকে ঈমানকে মুক্ত রেখে তাওহীদের দাবি পূরণ করতে সক্ষম হয়।

 

৭. সকল প্রকার তাগূতকে অস্বীকার করার হিম্মত রাখে এবং ঈমানের দাবি পূরণ করে তৃপ্তিবোধ করে।

 

সহীহ ইলম

 

ইলম মানে কী?

 

ইলম শব্দের আভিধানিক অর্থ জ্ঞান। কুরআনে ও হাদীসে কোনো কোনো স্থানে এ সাধারন অর্থে শব্দটি  ব্যবহার করা হলেও ইসলামী পরিভাষায় ইলম মানে ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান। রাসূল (সা) বলেছেন, ইলম তালাশ করা ফরয। যদি এখানে সব জ্ঞানই ফরয বুঝায় তাহলে নবীর পক্ষেও এ ফরয পালন করা সম্ভব নয়।

 

ইলম মানে জানার বিষয়। কোন প্রাণীই ইলম ছাড়া বাচতে পারে না। পশু পক্ষী এবং কীট পতঙ্গের ও জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে। পাখিকে উড়তে জানতে হবে। হাঁসকে সাঁতার জানতে হবে। মৌমাছির ফুল থেকে মধূ সংগ্রহ করার জ্ঞান দরকার। প্রতিটি জীবকেই বেঁচে থাকার জন্য খেতে হয়। সবার খাদ্য এক রকম নয়। কার খাদ্য কোনটা তা জানতেই হবে।

 

প্রত্যেক প্রাণীই নিজস্ব বাসস্থান প্রয়োজন। পাখি গাছে বাসা বানাতে জানে। শেয়াল মাটিতে গর্ত করে থাকার ব্যবস্থা করে। এ ব্যবস্থা করতে না জানলে তা করতে পারতো না।

 

জ্ঞান কোথা থেকে পাওয়া যায়?

 

যিনি সক প্রাণী সৃষ্টি করেছেন তিনি জ্ঞানের একমাত্র উৎস। মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণীর কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার হয় না। তাদের জ্ঞান অর্জনের জন্য স্কুল কলেজের প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিগতভাবেই তাদেরকে যার যার প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করেন। মৌমাছিকে মৌচাকের কতো চমৎকার শিল্প রচনার শিক্ষা তিনিই দিয়েছেন বলে কুরআনে উল্লেখ করেছেন এবং তা ওহীর মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন।

 

আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকেই ওহী বলা হয়। ওহীর শাব্দিক অর্থ হলো ইশারা, ইঙ্গিত, গোপনে দেওয়া ইত্যাদি। যার কাছে ওহী আসে সে তার চেষ্টা ছাড়াই তা পায়। স্রষ্টা গোপনে তাকে তা দেন। হাঁসের বাচ্চাকে তিনি গোপনেই সাঁতার শিক্ষা দেন। সে বিনা চেষ্টাই এ শিক্ষা পেয়ে যায়।

 

মানুষের কেন আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়?

 

মানুষ আর সব প্রণীর মতো নয়। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সেরা (আশরাফুল মাখলুকাত) হওয়ার মর্যাদা দান করেছেন। সকল প্রাণীই দেহসর্বস্থ, কিন্তু মানুষ দেহসর্বস্থ নয়। মানুষের দেহটি আসল মানুষ নয়। মানুষের দেহটি পশুই বটে। আসল মানুষটি কুরআনের ভাষায় ‘রূহ’। মানুষের দেহটি বস্তু দিয়ে তৈরি। মানুষ যা কিছু খায় ও পান করে তাতে যেসব বস্তু উপাদান রয়েছে সেসব উপাদান দিয়ে মানুষের দেহ তৈরি হয়েছে। তাই ঐসব খাদ্য ও পানীয় মানব দেহে ফিট হয়। অন্য কোনো উপাদান দেহ গ্রহণ করবে না। বিষ খেলে দেহের মৃত্যু হবেই।

 

‘রূহ’ কোন বস্তু সত্তা নয়। আমরা বিবেক বলতে যা বুঝি সেটা ‘রূহ’। এটা নৈতিক সত্তা। ভালো ও মন্দের চেতনাই হলো রূহ। এটাই আসল মানুষ। গোটা সৃষ্টিজগৎ মানুষের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে বলে কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। সব সৃষ্টিকে কাজে লাগানোর উপযোগী হিসেবেই দেহটি দান করা হয়েছে।

 

আল্লাহ তায়ালা সকল সৃষ্টির জন্যই প্রতিটি সৃষ্টির উপযোগী বিধান তৈরি করে তা নিজেই তাদের উপর চালু করে দিয়েছেন। মানুষের দেহের জন্যও তিনি বিধান তৈরি করে , নিজেই জারী করেছেন। এসব বিধান নবীর মাধ্যমে পাঠানো হয়নি। নবীর মাধ্যমে যেসব বিধান পাঠানো হয়েছে তা আল্লাহ্‌ নিজে জারী করেননা । নিজেই জারী করার সিদ্ধান্ত থাকলে নবীর মাধ্যমে পাঠাতেন না। নবীর নিকত ওহির মাধ্যমে প্রেরিত বিধান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে চালু করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নবীর উপর ও নবীর উপর যারা ইমান আনে তাদের উপর। বিধানটি অবশ্যই আল্লাহর। তার পক্ষ থেকে তার প্রতিনিধি (খলীফা) হিসেবে ঐ বিধান জারী করার দায়িত্বটিই খিলাফতের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে করতে হলে মানুষকে তার ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টা সাধনা প্রয়োগ করতে হবে। এ কাজ সচেতনভাবে করা ছাড়া উপায় নেই। অন্যান্য প্রণী বিনা পরিকল্পনায় চেতনাহীণ ও গতানুগতিক ধারায় জীবন যাপন করে। আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাদেরকে এভাবে পরিচালনা করেন। এর কোন চেতনা তাদের নেই।

 

মানুষকে সচেতনভাবে ও ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে সুপরিকল্পিতভাবে তার দেহসত্তাকে পরিচালনা করা এবং সৃষ্টিজগতকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর দেওয়া বিধানকে বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েচে। এ দায়িত্বই আল্লাহর খিলাফতের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে চেষ্টা করে অর্জন করতে হবে। তাই দুনিয়ায় মানুষের নৈতিক গুনাবলি অর্জনের জন্য সচেতনভাবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়। অন্যান্য পশুর প্রয়োজনীয় গুনাবলী যেমন তাদের মধ্যে আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়, মানুষের বেলায় তা হতে পারে না।

 

জ্ঞানই শক্তি

 

  এ কথাটি স্কুল জীবনেই পাঠ্য বইতে পড়েছি। কিন্তু এর মর্ম তখনো ভালোভাবে বুঝিনি। জ্ঞানের বলেই মানুষ শক্তিমান বিশালকায় প্রাণী এমনকি হিংস্র পশুকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জ্ঞানের শক্তিতেই মানুষও মানুষের উপর কর্তৃত্ব করে। রাসূল (সাঃ) এর নেতৃত্বে দায়িত্ব পালন করে এবং যতদিন ইসলামী শিক্ষার সাথে সাথে অন্যান্য শিক্ষায়ও তাদের প্রাধান্য ছিল ততদিনই তারা মানব জাতির নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছেন। মুসলিম জাতি ইসলামী আদর্শের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া সত্বেও জ্ঞান বিজ্ঞানে তাদের প্রাধান্যর কারণেই কয়েক’শ বছর বিশ্বে কর্তৃত্বের আসন দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু যখন মুসলিম জাতি রাষ্ট্রক্ষমতাকে ভোগের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করল এবং জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাদের শাগরিদারই পাশ্চাত্য মুসলিমদের থেকেও অগ্রসর হয়ে গেল তখন তারা জ্ঞানের প্রাধান্য বলেই মুসলিম দেশগুলো দখল করে নিলো। আজও বিশ্বে তাদের নের্তৃত্ব এ জ্ঞান শক্তির দরুনই অব্যাহত রয়েছে।

 

ওহীর জ্ঞানের শক্তি

 

সকল শক্তির উৎস আল্লাহ তায়ালা। তাই ওহীর জ্ঞানের শক্তিকে তিনি অন্যান্য জ্ঞানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরামের যুগে ওহীর জ্ঞানকে বাস্তব প্রয়োগ করার ফলে সে যুগের অন্যান্য জ্ঞানে উউনত রোম সম্রাজ্য ও পারস্য সম্রাজ্য মুসলিম জাতির নেতৃত্ব নিতে বাধ্য হয়। মুসলিম জাতি পার্থিব যাবতীয় জ্ঞানের শক্তি আহরণ করে মানব জাতির নের্র্তৃত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়।আজ ও আবার মুসলিম জাতি ওহির জ্ঞানকে মানব সমাজে বিজয়ী করার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারলে অতীতের মতোই রাষ্ট্র শক্তির অধিকারী হয়ে মানব জাতির নের্তৃত্বের মর্যাদা পুনরুদ্ধার এগিয়ে যেতে পারে।ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি নামক পুস্তকে মাওলানা মওদূদী বলিষ্ঠ যুক্তি ও বাস্তব উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে ইসলামী নৈতিকতা ও মৌলিক মানবীয় গুণের সমন্বয় হলে শুধু মানবীয় গুণের অধিকারীরা তাদের যাবতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সত্ত্বেও মুসলিমদের নিকট পরাজিত হতে বাধ্য।

 

ওহীর জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহ অবশ্যই বহাল রাখেন। কিন্তু ওহীর জ্ঞানকে বিজয়ী করার দায়িত্বে অবহেলা করে মুসলিম জাতি শুধু পার্থিব অন্যান্য জ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে ব্যর্থ হবে। কারন এ বিষয়ে আল্লাহর সাহায্য থেকে তারা বঞ্চিত থাকবে। দায়িত্বে অবহেলার অপরাধে দোষী সাব্যস্থ হওয়ার কারণেই তারা নেতৃত্বের অযোগ্য বলে গণ্য।

 

জ্ঞানের উৎস কী কী?

 

জ্ঞানের উৎস চারটি। যথা

 

১. ইন্দ্রিয়ঃ চক্ষু কর্ণ নাসিকা জিহ্বা ও ত্বকের সাহায্যে মানুষ জন্মের পর থেকেই জ্ঞান আহরণ করতে থাকে। এ জ্ঞান সরাসরি প্রত্যক্ষ পদ্ধতি তে অর্জিত হয়। এসব হাতিয়ার ও জানার বিষয়ের মাঝখানে আর কোনো মাধ্যম নেই। এ চারটি যন্ত্রের এক একটি দ্বারা বিশেষ ধরনের বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা যায়। এক যন্ত্র দিয়ে অপর যন্ত্রের উপযোগী বিষয় জানা যায় না। গন্ধের জ্ঞান শুধু নাক দিয়েই হাসিল করা যায়। অন্য চারটি যন্ত্রের সাহায্য তা জানার উপায় নেই। ইংরেজিতে এ সবকে ++++++ বলা হয়।

 

২. বুদ্ধিঃ আরবীতে আকল। মানুষ বুদ্ধির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জ্ঞান আহরণ করে থাকে। জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণের জন্য বুদ্ধি ই সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। ইন্দ্রিয় দ্বারা যতটুকু জানা যায় এরপর বুদ্ধিই মানুষকে জ্ঞানের ময়দানে আরও এগিয়ে দেয়।

 

চোখ দিয়ে কোথাও ধোয়া দেখা গেল। বুদ্ধি বলে উঠলো আগুন লেগেছে। চোখ কিন্তু আগুন তখনো দেখেনি । বুদ্ধি জানে যে আগুন লাগলেই ধোয়া হয়। কার্যকারণের যুক্তি বুঝবার ও বিশ্লেষণ করার শক্তিকেই বুদ্ধি বলে। এ শক্তি বলেই মানুষ জ্ঞানের মহাসমুদ্র থেকে জ্ঞান ভান্ডার আহরণ করে। গবেষণা ও জ্ঞান সাধনার প্রধান হাতিয়ার বুদ্ধি। এ শক্তি বলেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মানুষ দ্রুত এগিয়ে চলছে। সৃষ্টিজগৎ কে জানা এবং তাকে লাগাবার যোগ্যতা অর্জন করা বুদ্ধির সাহায্যেই সম্ভব হয়।

 

৩. ইলহামঃ এটা বুদ্ধির ঊর্ধ্বের এক বিশেষ উৎস। যারা যে বিষয়েই চিন্তা ভাবনা গবেষণা ও সাধনায় গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন, কখনো কখনো হঠাৎ কোনো জ্ঞান তাদের বুদ্ধির নিকট এসে ধরা দেয়। হয়তো দীর্ঘদিন বুদ্ধির প্রয়োগ করেও কোনো তত্ত্ব আয়ত্ত করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না হঠাৎ ঐ তত্ত্বটি তার জ্ঞানে এসে গেল। এ ধরনের জ্ঞানকেই ইলহামী জ্ঞান বলাহয়। এর বাংলা পরিভাষা প্রজ্ঞা হতে পারে। ইংরেজিতে +++অর্থ অভিধানে যা পাওয়া যায় তা হলো ===অর্থাৎ যুক্তি ছাড়াই হাঠাৎ মনে কোনো ধারণা সুষ্টি হওয়া। আরবীতে ইলহাম শব্দটি আরও স্পষ্ট। বুদ্ধি শক্তি প্রয়োগ করেও যে তত্ত্বটির নাগাল পাওয়া গেল না হঠাৎ তা বুদ্ধির আওতায় এসে গেল। তাই আমরা জ্ঞানের এ উৎসটিকে ইলহাম বলেই উল্লেখ করা যাথর্থ মনে করি। বাংলায় এর অনুবাদের প্রয়োজন নেই।

 

এটা অবশ্যই সত্য যে যারা জ্ঞান সাধনায় লিপ্ত ইলহামী জ্ঞান তাদেরই আয়ত্তে আসে যদিও ঐ জ্ঞানটি সাধনার সরাসরি ফসল নয়।

 

এ জাতীয় জ্ঞানের কয়েকটি উদাহরণ

 

ক. ইমাম আবূ হানীফা (র) কুরআন ও হাদীস গবেষণ করে বাস্তব জীবনে পালন করার উদ্দেশ্য ইজতিহাদ করে মাসআলা মাসায়েল বের করেছেন। কোনো সময় এমন ঘটনা ঘটেছে যে দীর্ঘ সময় চিন্তা গবেষণা করেও যে মাসআলাটির মীমাংসা করতে পারেননি তা এক সময় হঠাৎ তার মনে ধরা দিল। সকল মুজাতাহিদের জীবনেই হয়তো এমন ঘটনা ঘটে।

 

খ. আধুনিক বিজ্ঞানের জনক হিসেবে গণ্য মহাবিজ্ঞানী নিউটনের জীবনের একটা ছোট্র ঘটনা উল্লেখ করছি। তিনি আপেলের বাগানে বসে আছেন। তার সামনেই গাছ থেকে একটা আপেল মাটিতে খসে পড়লো। জীবনে বহুবার ই এমন দৃশ্য তিনি দেখেছেন। কিন্তু হঠাৎ সেদিন তার মনে এ প্রশ্ন বিরাট হয়ে দেখা দিল যে আপেলটি উপরে বা ডানে বায়ে না যেয়ে সোজা মাটির দিকে কেন আসল? চারদিকেই তো শূন্যতা বিরাজ করছে। কোনো দিকে না যেয়ে শুধু নিচের দিকে কেন এলো? তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হলো যে নিশ্চয়ই এমন কোনো শক্তি রয়েছে যা আপেলটিকে মাটির দিকে টেনে এনেছে। এই হাইপথেসিস এর উপর চালিয়ে শেষ পযর্ন্ত তিনি বিখ্যাত মতবাদ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করেন।

 

গ. গ্রীক বিজ্ঞানী আকিমেডিসের ঘটনা। বিজ্ঞানের একটি সূত্র তালাশ করে না পেয়ে তিনি রীতিমতো বিষণ্ণ ও বিমর্ষ অবস্থায় পানির টবে গোসল করছিলেন। যারা পানি ভর্তি টবে গোসল করে তারা উলঙ্গ অবস্থায়ই পানিতে নাক জাগিয়ে শুয়ে থাকে। তিনিও ঐ অবস্থায়ই ছিলেন। হঠাৎ ঐ সূত্রটি তার জ্ঞানে এসে ধরা দিল। সাফল্যের আনন্দে তিনি টব থেকে নেমে ইউরেকা ইউরেকা (পেয়েছে, পেয়েছি) বলে চিৎকার করে উঠলেন। বস্ত্রহীন অবস্থায়ই তিনি বাথরুম থেকে বের হয়ে গেলেন। খুশির আতিশয্যে গায়ে জামা পরার হুশ ও রইল না।

 

৪. ওহীঃ জ্ঞানের এ মহা উৎসটি কোনো মানুষের আয়ত্তে নেই। আল্লহ তাআলা যাকে নবী রাসূল নিয়োগ করেন তার নিকটই তিনি বিশেষ পদ্ধতিতে ওহীর জ্ঞান পরিবেশন করেন। এজ্ঞান নবী রাসূলের চেষ্টা সাধনার ফসল নয়। সরাসরি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে তারা লাভ করেন।

 

হদীস থেকে জানা যায় যে কিভাবে রাসূল (সা) এর নিকট ওহীর জ্ঞান পৌছতো। কয়েক পদ্ধতি তে ওহী লাভ করতেন।

 

ক. স্বপ্নযোগে ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি জ্ঞান লাভ করতেন।

 

খ. কোনো কোনো সময় ঘণ্টার আওয়াজ শুনতে পেতেন। তখন তিনি স্থির হয়ে থাকতেন এবং ওহী লাভ করতেন। এ পদ্ধতিটি তার জন্য বেশ কষ্টকর হতো। তিনি প্রচন্ড চাপ বোধ করতেন। শীতের সময়ও তার চেহারা মুবারক থেকে ঘামের ফোটা টপকে পড়তো। উটের পিঠে বসা থাকলে চাপের কারণে উট মাটিতে বসে পড়তে বাধ্য হতো।

 

গ. কখনো কখনো হযরত জিবরাঈল (আ) মানুষের আকারে এসে রাসূল (সা) কে তিলাওয়াত করে শুনিয়ে দিতেন।

 

ঘ. রাসূল (সা) এর মনে ওহীর জ্ঞান ঢেলে দেওয়া হতো।

 

দ্বিতীয় ও তৃতীয় পদ্ধতিতে প্রাপ্ত জ্ঞনই ভাষাসহ নাযিল হতো এবং তা কুরআনের অংশ হিসেবে গণ্য হতো। এ প্রকারের ওহীকে ওহী মাতলূ বলা হয় যা তিলাওয়াত করা হয়।

 

প্রথম ও চতুর্থ পদ্ধতিতে যে ওহী আসতো তাতে রাসূল (সা) এর মনে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভাবের আকারে জ্ঞান দেওয়া হতো। কুরআনের আয়াতের মতো ভাষায় নাযিল হতো না। রাসূল (সা) আল্লাহর দেওয়া ঐ সব ভাবকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করতেন। এসব জ্ঞানই হাদীস হিসেবে পরিচিত। এ ওহী হলো গাইরি মাতলূ যা কুরআনের মতো তিলাওয়াত করার জন্য নয়।

 

ওহীর জ্ঞান অত্যন্ত ব্যাপক। কুরআনের বাইরে ওহীর জ্ঞানের বিরাটা ভাণ্ডার রয়েছে। রাসূল (সাঃ) যা বলেছেন যা করেছেন ও সাহাবায়ে কেরামের যেসব কথা ও কাজকে আপত্তিজনক বলে উল্লেখ করেননি তা সবই ওহীর জ্ঞানের মধ্যে শামিল।

 

কুরআনে যা আছে এর ভাব ও ভাষা সম্পূর্ণ আল্লাহর। তাই কোনো কিছু মানতে অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যায়।আর বাকি ওহীর কোনো কথা যুক্তির ভিক্তিতে গ্রহন করতে অস্বীকার করলে কাফির বলে গণ্য করা হয় না। রাসূল (সা) এর কথা কাজ ও অনুমোদনকে হাদীস বলা হয়। হাদীস থেকে মুহাদ্দিসগণ ও ফকীহগণ যা সুন্নাহ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন তা কুরআনেরই বাস্তব ব্যাখা।কুরআন ও সুন্নাহ মিলেই ইসলাম। যারা সুন্নহ কে অস্বীকার করে তারা মুসলিম হিসেবে গণ্য নয়।

 

সহীহ ইলমের গুরুত্ব

 

সকলজ্ঞানই বিশুদ্ধ বা খাঁটি নয়। নির্ভূল জ্ঞানকেই আরবীতে সহীহ বলা হয়। যেমন বুখারী শরীফের নাম সহীহ আল বুখারী।

 

জ্ঞান ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না। যা ই করা হোক সে বিষয়ে জ্ঞান ছাড় তা করা সম্ভব নয়। কর্মের পিছনে জ্ঞনই চালিকা শক্তি।  কিন্তু জ্ঞান যদি নির্ভুল না হয় তাহলে কর্মের উদ্দেশ্যেই ব্যর্থ হতে বাধ্য। শুধূ তাই নয়, সহীহ জ্ঞান না থাকলে জীবনই বিপন্ন হতে পারে। গাড়ির ড্রাইভার যদি সঠিক জ্ঞানের অধিকারী না হয় তাহলে এক্সিডেন্ট করে গাড়ি ধ্বংসের সাথে সাথে নিজের জীবনও হারাতে পারে। তাই সব বিষয়েই যা সঠিক জ্ঞান তা অর্জন করতে হবে। ভূল জ্ঞান মারাত্মক।

 

এ বিষয়ে একটি উদাহরণই যথেষ্ট সকল মানুষই সুখ শান্তি চায়। এমন একজন মানুষও পাওয়া যাবে না, যে সুখ শান্তি পছন্দ করে না। যে যাই করে নিজের মঙ্গলের উদ্দেশেই করে। এমনকি যে আত্মহত্যা করে সেও সুখ শান্তি পাওয়ার নিয়তেই করে। সে মনে করে যে তার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওায়াই বেশি ভালে। এ বিষয়ে তার নিয়ত যতই সহীহ হোক তার জ্ঞান মোটেই সহীহ নয়।

 

দুনিয়ায় সবাই সুখ শান্তি চায় । যা কিছু সে করে এ উদ্দেশ্যেই করে। অথচ কয়জন সত্যিকার অর্থে শান্তি ভোগ করে? সুখ শান্তি পাওয়ার নিয়তেই সন্ত্রাস,চাঁদাবাজি ,চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ ,খুন ইত্যাদি করে এবং পরিনামে দুনিয়াতেই চরম অশান্তি ভোগ করে। এর একমাত্র কারনই হল, সহীহ জ্ঞানের অভাব । এবং কোন মেশিন যে বানায় সেই  এবং এর সঠিক ব্যবাহারের সহীহ জ্ঞান রাখে। তাই ঐ মেশিন কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তা স্পষ্ট ভাষায় ছবি এঁকে লিখে দেয়। ঐ নিয়মে ব্যবহার করলেই মেশিন ব্যবাহরের উদ্দেশ্যে সফল হবে। ঐ সহীহ জ্ঞানের বদলে যদি ভুল নিয়মে ব্যবহার করে তাহলে মেশিনেইবিনষ্ট হয়ে যেতে পারে।

 

আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে তার নিজের দেহ ও দুনিয়ার যাবতীয় বস্তু কিভাবে ব্যবাহার করতে হবে সে বিষয়ে নবী রাসূলের মাধ্যমে সহীহ জ্ঞান দিয়েছেন। এ জন্য প্রথম মানুষটিকে নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন , যাতে সহীহ  জ্ঞানের অভাব কেউ বিপদে না পড়ে।

 

আধুনিক বিশ্বে যারা নিজ দেশের বা মানব জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা  এর কোন প্রয়োজনই বোধ করেন না। তাঁরা মেধা, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসেস শিক্ষাকেই যথেষ্ট মরে করেন। তাই তারা মানব সমাজকে সুখ শান্তি দেবার সহীহ নিয়ত থাকা সত্ত্বে ও চরম অশান্তি ভোগ করতে বাধ্য করেছেন। সূরা রূমের ৪১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,  ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ

 

‘জলে স্থলে যে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে তা মানুষের দু হাতের কামাই’।

 

আল্লাহ তায়ালা বলতে চান যে, অশান্তি ও বিপর্যয় তিনি জোর করে মানব সমাজের উপর চাপিয়ে দেননি। মানুষ নিজেরাই নিজেদের মনগড়া ভ্রান্ত জ্ঞানের কারণে অশান্তি ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছে।

 

সহীহ ইলমের উৎস

 

উপরে যে চারটি জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এ সবের মধ্যে একমাত্র ওহীর জ্ঞানকেই নিশ্চিতরূপে সহীহ মনে করতে হবে। অন্য তিনটি উৎস থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান শুদ্ধও হতে পারে, অশুদ্ধও হতে পারে। তাই ওহীর জ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করেই অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান সহীহ কিনা, সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডার বিশাল ও ব্যাপক। যুগে যুগে বহু মনীষীর আহরিত জ্ঞান ঐ মহা ভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে। কোন জ্ঞান অমুসলিম মনিষীর চিন্তার ফসল হলেও ওহীর কষ্টিপাথারে যাচাই না করে তা পরিত্যাগ করা মোটেই উচিত নয়। আর মুসলিম কোনো মনীষীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকেও ওহীর মানদন্ডে যাচাই না  করে সহীহ বলে গ্রহণ করা উচিত নয়।

 

তাই মানব জাতির মধ্যে প্রতিটি দেশই ওহীর জ্ঞানে সমৃদ্ধ একদল মানুষ সকল যুগেই গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিশেষ করে যারা নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করবে তারা ওহীর জ্ঞানে আলোকিত না হলে মানব সমাজের কেমন দুর্দশা হয় তা আধূনিক বিশ্বে বাস্তব প্রমাণিত।

 

কোন ইলম তালাশ করা ফরয?

 

রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন:  طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ

 

‘প্রত্যেক মুসলিমের (নর নারী) উপর ইলম তালাশ করা ফরয’।এখানে ইলম দ্বারা একমাত্র ওহীর ইলম বুঝতে হবে। দুনিয়ার সকল ইলম হাসিলের চেষ্টা করা ফরয হতে পারে না। কোন অসম্ভব কাজের দায়িত্ব রাসূল (সাঃ) মানুষের উপর চাপাতে পারে না। কারণ তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকেই ওহীর জ্ঞানে পরিচালিত। আগেই বলেছি, কুরআন ও হাদীসের পরিভাষা হিসেবে ইলম মানেই ওহীর ইলম।

 

ইলম কতটুকু ফরয?

 

ফরয মানে অবশ্য পালনীয়, যা পালন না করলে আল্লাহ শান্তি দেবেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, ওহীর ইলম তো বিশাল ও ব্যাপক। ৩০ পারা কুরআন এবং লক্ষ লক্ষ হাদীস সবইতো ওহীর ইলম। যদি এ ইলমের সবটুকু অর্জন করা ফরয হয় তাহলে রাসূল (সাঃ) ছাড়া আর কারে পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাহলে নিশ্চয়ই ওহীর সবটুকু ইলমই তালাশ করা ফরয হতে পারে না।

 

তাহলে এটা কেমন করে নির্ণয় করা যাবে যে, কতটুকু ইলম হাসিল করা ফরয? এটা খুবই গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ প্রশ্নের সঠিক জওয়াব না জানলে মুসলিম হিসেবে সঠিকভাবে জীবন যাপন করা একেবারেই অসম্ভব।

 

একটি বাস্তব উদাহরণ দিলে এ প্রশ্নে সঠিক জওয়াব সহজেই বুঝে আসবে। যার উপর হজ্জ যাকাত ফরয নয়, তার ঐ বিষয়ে জানা আবশ্যক নয়। যার উপর যাকাত ফরয তাকে এ দায়িত্ব পালন করতে হলে ওহীর ইলম থেকে জানতে হবে যে,কোন কোন সম্পদের কী পরিমাণের মালিক হলে যাকাত ফরয হয় এবং এর হিসাব কিভাবে করতে হয়, কত মালের কত পরিমাণ যাকাত আদায় করতে হয় এবং কোন কোন খাতে যাকাত খরচ করলে ফরযটি সঠিক ভাবে আদায় হবে। যার উপর যাকাত ফরয নয় তার এসব বিষয়ে জানা জরুরী নয়।

 

এ একটি মাত্র উদাহরণ থেকে ঐ প্রশ্নের সহীহ জওয়াব পাওয়া যায়। জওয়াবটি তাহলে এভাবে প্রকাশ করলে বুঝতে সহজ হবে।

 

যার উপর যে দায়িত্ব পালন করা ফরয, সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের প্রয়োজনে ওহীর যতটুকু ইলম জানা জরুরী ততটুকু ইলম অর্জনই ফরয। এ দায়িত্ব বলতে শুধু ধর্মীয় বিষয়ই বুঝায় না। মানুষ হিসেবে দুনিয়ায় জীবন যাপন করতে হলে যত রকম দায়িত্ব পালন করতে হয় সে সবই এর আওতায় পড়ে।কেননা মুমিনের জীবনে দুনিয়াদারি ও দীনদারিতে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহর হুকুম ও রাসূল (সাঃ) এর তরীকা অনুযায়ী যে কাজ করা হয় তা ই দীনদারি। আয় রোজগার, ব্যবসা বাণিজ্য, বিয়ে শাদী ইত্যাদি দায়িত্ব শরীআত মোতাবেক করাও দীনদারি। লোক দেখাবার উদ্দেশ্যে লাখ টাকার কুরবানী দিলে বা নিজের নামে আলহাজ্জ লেখার নিয়তে হজ্জ করলে তা দুনিয়াদারিতে পরিণত হয়। দানশীল হিসেবে সুনামের উদ্দেশ্যে দান খয়রাত করার পুরস্কার আখিরাতে পাবে না এবং বীর ও বাহাদুর হিসেবে খ্যাতি লাভের জন্য জিহাদের ময়দানে শহীদ হলেও দোযখে যেতে হবে বলে রাসূল (সাঃ) বলেছেন।

 

মুমিনের দু দফা ঘোষণা

 

আসলে মুমিন ও মুসলিম ঐ লোককেই বলা হয়েছে, যে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের সাঃ তরীকা অনুযায়ী জীবন যাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ উচ্চারণ করা মানে না বুঝে কোন মন্ত্র জপা নয়; আসলে এ দুটো ঘোষণা জীবনের নীতি নির্ধারণী দফা ==

 

প্রথম দফা হলো, আমি আল্লাহর হুকুম মেনে চলব, এর বিপরীত কোন হুকুমই মানব না।

 

দ্বিতীয় দফা হলো, আল্লাহর প্রতিটি হুকুম আমি একমাত্র রাসূলের শেখানো তরীকা অনূযায়ী পালন করব, আর কোন তরীকা আমি গ্রহণ করব না।

 

এ দুটো ঘোষণা অনুযায়ী দুনিয়ার জীবনে যে কাজই করা হোক তা দীনদারি হিসেবে গণ্য।

 

ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো কতক ধর্মীয় অনুষ্ঠানসর্বস্ব নয়। দীন ইসলাম মানে ইসলাম ধর্ম নয়। দীন ইসলাম মানে ইসলামী জীবনব্যবস্থা। দীন মানে আনুগত্য। আল্লাহর আনুগত্যের ভিত্তিতে জীবন যাপনের বিধানের নামই দীন ইসলাম। এর অনুবাদ ইসলাম ধর্ম নয়। এ অনুবাদে ইসলামকে নিছক একটি ধর্ম বুঝায়। তাই ‘ইসলাম ধর্ম’ কথাটি মারাক্তক ভুল অনুবাদটি। আল্লাহ্‌ ও কোরআন   শব্দ দুটোর অনুবাদ না করেই আমারা বলে থাকি। দীন ইসলমের ও অনুবাদের  প্রয়োজন নেই। এর মর্ম বুঝে নিলেই যথেষ্ট। যেমন আল্লাহ,কুরআন ও রাসূল বললে আমরা অনুবাদ ছাড়াই বুঝি। কালেমা তাইয়্যেবার এ ব্যাখ্যা যারা সঠিক মনে করে তারা দুনিয়াদারি দীনদারিকে আলাদা মনে করে না। তাই তার পার্থিব দায়িত্ব ও আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা অনুযায়ী পালন করতে হবে বলে বিশ্বাস করে। তাই প্রতিটি দায়িত্বের ব্যাপারেই আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা জানা ফরয।

 

কতক উদাহরণ

 

১. আজ একজন যুবক ও একজন যুবতীর মধ্যে বিবাহের বন্ধন হলো। তাদেরকে মুসলিম স্বামী ও মুসলিম স্ত্রী হিসেবে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা মেনে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে হবে। তাই এ বিষয়ে যতটুকু ওহীর ইলম জানা প্রয়োজন তা অর্জন করা ফরয। গতকাল পর্যন্ত ও তা জানা ফরয ছিল না। যদি তারা তা না জানে তাহলে তারা কাফির দম্পত্তির মতোই জীবন যাপন করবে।

 

২. যেদিন এ দম্পত্তির ঘরে সন্তান আসবে সেদিন পিতা ও মাতার দায়িত্ব সম্পর্কে ওহির  জ্ঞান তালাশ তাদের জন্য ফরয হয়ে যাবে।

 

৩. একজন ব্যবসায়ী যদি মুসলিম হিসেবে ব্যবসা করতে চান তাহলে এ বিষয়ে ওহীর জ্ঞান হাসিল কর হার উপর ফরয। যদি তা তিনি না জানেন তাহলে তিনি কাফির ব্যবসায়ীর মতোই দায়িত্ব পালন করবেন।

 

৪. যদি কোন মুসলিমের উপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় তাহলে এ সংক্রান্ত যাবতীয় ইরম হাসিল করা তার উপর ফরয হয়ে যাবে। তা না জানলে তিনি কাফির শাসকের মতেই দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি নিজেকে ধর্ম নিরপেক্ষ বরে দাবি করুন আর নাই করুন, বাস্তব তিনি মুসলিম শাসক হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন না।

 

যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি বিচারকের আসনে বসেন তাহলে তাকে বিচার সম্পর্কে শরীআতের যাবতীয় বিধান আয়ত্ত করতে হবে। তা না হলে কাফির বিচারকের মতো তাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে । বিচারকের আইন রচনার ক্ষমতা নেই। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাঁকে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। এসত্ত্বে ও ন্যায় বিচারের দায়িত্ব পালনের জন্য শরীআতের বিধান তাকে জানতে হবে এবং যথাসাধ্য তা প্রয়োগ করতে হবে।

 

নফল ইলমের মর্যাদা কী?

 

যার উপর যাকাত ফরয নয় তার জন্য তো ঐ বিষয়ে জীবন সম্পর্কে ওহীর ইলম তালাশ করা ফরয নয়; কিন্তু সে যদি তা অর্জন করে তাহলে তা নফল হিসেবেই গণ্য হবে। এখন প্রশ্ন হলো, নফল ইলম হাসিলের মর্যাদা কতটুকু?

 

তেমনিভাবে যে এখনও বিয়ে করেনি সে যদি দম্পত্য জীবন সম্পর্কে ওহীর ইলম অর্জন করে তাহলে এ কাজটি কি বেহুদা বা ফালতু কাজ বলে গণ্য হবে?

 

যার উপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেই যদি এ বিষয়ে ইলম অর্জন করে তাহলে এটাকে কি বেগার শ্রম মনে করা হবে?

 

একটি হাদিসে থেকে এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট জওয়াব পাওয়া যায়। হাদীসটি হলো,

 

রাতের কিছু সময় ইলম চর্চা করা (শেখানো ও শেখা) সারা রাত জেগে (অন্য নফল ইবাদত) থাকার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

 

এ হাদিসে থেকে জানা গেল যে, সকল নফল ইবাদতের মধ্যে নফল ইলম চর্চা করা শ্রেষ্ঠ ইবাদত। এ কারণেই যে আলেম নয় শুধু আবেদ তার তুলনায় আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব হাদিসে চমৎকার ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছেঃ যে দীনের একজন আলেম শ্রেষ্ঠ, যদি ও তিনি এত নফল এবাদত হয়তো করেন না। এর দ্বারা সকল নফল ইবাদতের মধ্যে নফল ইলম চর্চার মর্যাদা অনেক বেশি বলে প্রমাণিত হয়। এ বিষয়ে ৩টি হাদিসই যথেষ্ট। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন-

 

১.  فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِى عَلَى أَدْنَاكُمْ

 

আবেদের উপর আলেমের তেমনি শ্রেষ্টত্ব যেমন তোমাদের একজন সাধারণ লোকের উপর আমার মর্যাদা ( তিরমিজি হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩, সনদ হাসান।)

 

২. আবেদের উপর আলেমের তেমনি শ্রেষ্ঠত্ব যেমন সকল তারকার উপর পূর্ণিমার চাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব।

 

৩.শয়তানের উপর একজন ফকীহ একজন ফকীহ (ইসলামী বিধানে জ্ঞানী) ব্যক্তি এক হাজার আবেদের চেয়েও শক্তিমান।

 

ওহীর ইলমের এ মর্যাদার কারণেই প্রত্যেক শিক্ষিত মুসলিমের জন্য ইসলামের জ্ঞান অর্জনের সকল সুযোগ গ্রহণ করা উচিত। যদি সব সময় ইসলামী সাহিত্যে সঙ্গে রাখা হয় তাহলে সুযোগ পেলেই তা থেকে ইলম হাসিল করা যায়। আর সুযোগ তো পাওয়াই যায়।

 

১. কারো সাথে দেখা করতে গেলে কোন কারণে কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হলে সময় পাওয়া যায়। যিকর করে বা দরূদ পড়েও এ সময়টা কাটানো যায়। কিন্তু ইলম হাসিলে করার মর্যাদা অনেক বেশি।

 

২. জলপথে, সড়ক পথে ও বিমানে প্রচুর সময় বেকার কেটে যায়। সাথে ইসলামী বই থাকলে সময়টা শ্রেষ্ঠ কাজে লাগানো যায়।

 

৩. শহরে যানজটে পড়লে দীর্ঘ সময় নষ্ট হয়ে যায়। সাথে ইসলামী সাহিত্যে থাকলে সময়টা সেরা কাজে ব্যয় হতে পারে।

 

৪. বিছানার পাশে ইসলামী বই থাকলে ঘুম আসবার আগে কিছু ইলম হাসিল করা যায়।

 

৫. বই সাথে থাকলে কোথাও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময়টাকেও অপচয় থেকে বাঁচানো যায়।

 

পার্থিব অন্যান্য জ্ঞানের কোনো শরয়ী মর্যাদা আছে কী?

 

কৃষিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা ইত্যাদি জ্ঞান ওহীর ইলম নয় বটে, কিন্তু এ সবের কোনো মর্যাদা ইসলামী দৃষ্টিতে আছে কিনা? এসব বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা তো স্বীকার করতেই হবে, তবে এ সব বিদ্যা অর্জন করাটা কি নিছক দুনিয়াদারি ব্যাপার? এসবের কি কোন শরয়ী মর্যাদা আছে?

 

একটি হাদীস থেকে এবিষয়ে আমরা এর সঠিক জওয়াব জানতে পারি।

 

‘অন্য সব ফরযের পর হালাল রুজী তালাশ করাও ফরয।‘

 

এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, হালাল উপায়ে রোজগারের চেষ্টা করা ফরয। তাহলে আয় রোজগারের উদ্দেশ্যে কোন নাকোন পেশা অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। যে পেশাই গ্রহণ করা হোক এর জন্য নির্দিষ্ট বিদ্যা অজর্ন করতেই হবে। ডাক্তারি পেশা গ্রহণ করলে তাকে ডাক্তারি বিদ্যা শিক্ষা করতেই হবে। চিকিৎসা করে রোগীদের নিকট থেকে টাকা নিয়েইযারা রুজী যোগাড় করে তারা যদি চিকিৎসা বিদ্যা ভালোভাবে আয়ত্ত না করে, যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন সে বিষয়েও প্রেসক্রিপশন লিখে রোগীর সাথে প্রতারণা করে তাহলে তার আয় হালাল হবে না। তাই তার আয় হালাল করার প্রয়োজনেই তাকে ঐ বিদ্যা যথাযথভাবে অর্জন করতে হবে। ডাক্তারি বিদ্যা না শিখেই হাতুড়ে চিকিৎসকরা যে আয় করে তা কি হালাল হতে পারে?

 

তাহলে একথা প্রমাণিত হলে যে, হালাল রেজগারের চেষ্টা করা ফরয এবং রুজী হালাল করার প্রয়োজনে পেশাগত বিদ্যা যথাযথ শিক্ষা করা জরুরী। সুতরাং পার্থিব সব বিদ্যা অর্জন করা সরাসরি ফরয নয় বটে, কিন্তু পরোক্ষভাবে তাও ফরযের মর্যাদার অধিকারী। যিনি শিক্ষক তাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তার রুজীকে হালাল করতে হলে তাকে তার বিষয়ের যথাযথ জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে তাকে পাঠ দানের বিদ্যাও আয়ত্ত করতে হবে। যে শিক্ষকের ক্লাসে ছাত্ররা পাঠদানে সন্তুষ্ট নয় তার বেতন হালাল হবে কি? যে শিক্ষক যোগ্যতার সাথে পড়ান ছাত্ররা তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। ছাত্রদের মন্তব্য থেকেই জানা যায় যে, কে ভালো শিক্ষক, আর কে ভালো নয়। এভাবেই আমরা পেশাগত বিদ্যার শরয়ী মূল্যায়ন করতে পারি।

 

শখের বিদ্যার মর্যাদার কী?

 

পেশার অতিরিক্ত কোন বিদ্যা শখ করে কেউ কেউ শিখে থাকে। যেমন হস্তরেখা বিদ্যা, জোতিবিদ্যা, ভাস্কর্যও চিত্রঙ্গণ বিদ্যা, যাদু বিদ্যা, গার্ডেনিং ইত্যাদি। মানব সমাজের জন্য কল্যাণকর যে কোন বিদ্যাই শিক্ষা করা যেতে পারে পেশাগত বিদ্যা তো রজী রোজগারের জন্য শিখতেই হয়। কেউ সৌখিন হয়ে অন্য কোন বিদ্যা শিখলে শরীআতে কোন আপত্তি আছে কি না?

 

এ বিষয়ে নীতিগত কথা হলো, যে পেশা গ্রহণ করা হালাল নয় সে পেশাগত বিদ্যা অর্জন করা ও জায়েয নয়। হস্তরেকা বিদ্যা শিখে তা পেশা হিসেবে গ্রহণ করা জায়েয নয়। এ দ্বারা মানুষের কোন কল্যাণ হয় না; বরং হস্তরেখা দেখে কারো কিসমত বা আয়ু সম্পর্কে মতামত দেওয়া প্রতারণা মাত্র। এটা কোন নিশ্চিত বিষয় না। এ মতামত দ্বারা কারো কল্যাণ হবার কারণ নেই।

 

জীবের চিত্র অংকনের বিরুদ্ধে হাদিসে খুব কোঠর মন্তব্য আছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য অংকন , ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদিতে শরীয়তের কোন আপত্তি নেই। তাই এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহন করায়ও কোন দোষ নেই ।

 

এ বিষয়ে বিস্তর মত পার্থক্যের সুযোগ আছে। মানুষের রুচি বিচিত্র। তাই এসব নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই। যাদুকরের শিল্প বা হাতের সাফাই মানুষকে নির্মল আনন্দ দান করে। এর মধ্যে অশ্লীলতা না থাকারই কথা। বিনোদন হিসেবে তা দেখা যায়। কিন্তু এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা আপত্তি নেই। তাই এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করায়ও দোষ নেই।

 

মুমিন আখিরাতের সাফল্যকেই জীবনের প্রধান  লক্ষ্য মনে করে। তাই সাবধানেই তাকে পেশা বাছাই করতে হয়। সে হিসাব কষেই শখের বিদ্যা সম্পর্কেও তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

নেক আমল

 

আরবী ‘আমল’ শব্দের বাংলা অনুবাদ হলো কর্ম বা কাজ। কাজের সূচনা হয় চিন্তা থাকে। মানুষ যখন কোন কাজ করতে চায় তখন বুঝা যায়, সে ঐ কাজ করার চিন্তা ভাবনা করছে। চিন্তার সাথে সাথেই কাজ শুরু হয়ে যায় না। যখন সে ইচ্ছাকৃতভাবে ঐ কাজের উদ্দেশ্যে চেষ্টা করে তখন কাজটি শুরু করা হয়েছে বলা যায়। অর্থাৎ ইচ্ছা ও চেষ্টার সমন্বয়েই কাজ শুরু হয়। ইচ্ছা করাকে আরবীতে নিয়ত বলা হয়। এর অর্থ হলো কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেই কাজটি শুরু হয় না। ইচ্ছা, নিয়ত বা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চেষ্টা করলে কাজটি শুরু হয়েছে বলে বুঝা গেল।

 

নেক বলতে কী বুঝায়?

 

নেক শব্দটি র্ফাসি ভাষার। এ উপমহাদেশে দীর্ঘ ৬ শতাব্দীর মুসলিম শাসনামলে ফার্সিই রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদায় ছিল। তাই বাংলা ভাষায় অগনিত ফার্সি শব্দ চালু হয়ে আছে। ইসলামের অনেক মৌলিক পরিভাষাও আরবীর বদলে ফার্সি পরিভাষায় চালু হয়েছে। আরবী সালাত ও সাওম নামায ও রোযা পরিভাষায় প্রচলিত। এমনকি স্বয়ং আল্লাহও খোদা হিসেবে এদেশে পরিচিত হয়েছেন। খোদা মানে খোদÑআ। অর্থাৎ যিনি নিজেই অস্তিত্বে এসেছেন। সূরা ইখলাসের ‘লাম ইউলাদ’  শব্দটির মানেই খোদা। অর্থাৎ তাকে কেউ পয়দা করেনি। তিনি স্বয়ং অস্তিত্ববান।

 

কুরআনের যে শব্দটি হলো ‘সালেহ’ ।  এ শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। যেমন,  ভালো, সৎ, যোগ্য, উপযুক্ত, যথাযথ, ভালো কাজ, পুণ্য ইত্যাদি। কুরআনে বহু আয়াতে বেহেশতের সুসংবাদ দিতে গিয়ে বল হয়েছে, ++ যারা ঈমান এনেছে ও সালেহ আমল করেছে তারাই জান্নাতবাসী হবে। শুধু ঈমান আনলেই চলবে না, নেক আমল ও করতে হবে, যদি বেহেশতে কেউ যেতে চায়। নেক আমলের অভাব হলে ঈমান থাকা সত্ত্বেও প্রথমে দোযখেই যেতে হবে। অবশ্য শাস্তির মেয়াদ শেষ হরে ইমানদার ব্যক্তি এক সময়ে বেহেশতে যেতে পারবে। কিন্তু সালেহ আমল ছাড়া শুধু ইমানের কারণে কেউ প্রথমে বেহেশতে যেতে পারবে না।

 

কুরআনের বহু আয়াতে এবং অগণিত হাদীস ++ কথাটি পাওয়া যায়। এর অর্থ করা হয়Ñ ভালো কাজের আদেশ করা ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা। এখানে ভালো অর্থে যে শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে তা আরবীতে মারূফ এবং মন্দ অর্থে মুনকার শব্দ ব্যবহার কর হয়েছে। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ্ এ দুটো শব্দের আভিধানিক অর্থ পসম্পর ভিন্ন।

 

++ শব্দটির অর্থ হলো পরিচিত। অথচ এ শব্দটি ভালো কাজ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আর ++ শব্দের মানে হলো যা প্রত্যাখ্যাত, অস্বীকৃত, পরিত্যাজ্য। অথচ এ শব্দটি মন্দ কাজ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এর তাৎপর্য বুঝতে হবে।

 

আল্লাহ তায়ালা সকল মানুষের মধ্যেই নৈতিক চেতনা দান করেছেন। তাইসে কোনটা ভালো, আর কোনটা মন্দ তা বোঝে। এ চেতনাকেই আমরা বিবেক বলে থাকি। নাফসের তাড়নায় ও শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ মন্দ কাজ করে বটে, কিন্তু তার বিবেক জানে যে, কাজ টি মন্দ। এমন কোন অপরাধী নেই, যে অপরাধ করে কিন্তু সে বুঝে না যে, এটা অপরাধ। বিবেককে ফাঁসি দেবার সাধ্য কারো নেই।

 

এই বিকেকের নিকট যা যা ভারে তা পরিচিত। সে ভালো করেই চেনে কোনটা ভালো। তাই কুরআনে ভালো কাজ বুঝাবার জন্য মারুফ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার এ শব্দ চয়ন কতই না চমৎকার! আল্লাহ বলতে চান যে, হে মানুষ! তোমাদেরকে আমি যা কিছু করতে হুকুম করেছি, তা যে ভালো তা তো তোমাদের অবশ্যই জানা আছে। নাফসের গোলামি কবুল করলে আলাদা কথা। তা না হলে আমার হুকুম তোমাদের জন্য যে কল্যাণকর তা তোমাদের অজানা নয়।

 

যা মন্দ তা মানুষের বিবেকের নিকট পরিত্যাজ্য। মনুষ্যত্ববোধ কোন মন্দকে ভালো বলে স্বীকার করে না। তাই আল্লাহ তায়ালা মন্দ কাজের অর্থে মুনকার শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ বলতে চান যে, তোমার বিবেক যা ভালো বলে স্বীকার করে না তাই মন্দ এবং আমি মন্দ কাজ করতেই নিষেধ করেছি। আমার নিষেধাজ্ঞা তোমার বিবেকের নিকট সঠিক।

 

নাফস, রূহ ও কালবের ফাংশন বা কর্মতৎপরতা

 

নাফস মানে দেহের যাবতীয় দাবি। খিদে লাগলে খেতে চায়, বোধ করলে ঠাণ্ডা চায়, সুন্দর কিছু পেলে দেখতে চায়, ভোগের উপকরণ পেলে ভোগ করতে চায়। দেহের কোন নৈতিক চেতনা বলে সে যা চায় তা নৈতিক দিক দিয়ে মন্দ হতেই পারে। তাই মানু ষখন কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় তখনি সে কাজটি নৈতিক দিক দিয়ে আপত্তিকর হলে রূহ আপত্তি জানায়। তখন নাফস ও রূহের মধ্যে লড়াই চলে। সব মানুষেরই এ তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। বঙ্কিম চন্দ্র রোহিনী উপন্যাসে এ লড়াই এর দুপক্ষের সুন্দর নাম দিয়েছেনÑ সুমতি ও কুমতি। সুমতি বলে যে, এটা করা ঠিক নয়। কুমতি বলে, এমন মজা কি ত্যাগ করা য়ায়? রূহ ও নাফসের এ লড়াইতে যার জয় হয় তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কর্ম সম্পাদন করা হতয়। এ কর্ম সম্পাদনী শক্তিই হচ্ছে কালব। কালব শব্দের অর্থ পরিবর্তনশীল। এক সময় সে রূহের আনুগত্য করে, আর এক সময় নাফসের। সে এক অবস্থায় থাকতে পারে না বলেই নাম কালব।

 

একটা সহজ উদাহরণ দিলে কথাটি স্পষ্ট হতে পারে। রাষ্ট্রে যে সরকার থাকে এর তিনটা বিভাগ আছেÑ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগÑ === আইন বিভাগ সিদ্ধান্ত দেয় যে, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এটাই নাফসের ফাংশন। বিচার বিভাগ ঐ আইনটি শাসনতন্ত্রের নীতির বিরোধী হলে আপত্তি জানায়। এটা হলো রূহের ফাংশন। এ বিরোধ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলার পর এক পর্যায়ে হয় করকার বিচার বিভাগের কথা মেনে নেয়, অথবা বিচার বিভাগ তার আপত্তি তুলে নেয়। তখন যার কথা টিকল তাই শাসন বিভাগ কার্যকর করে। এটাই কালবের ফাংশন।

 

কর্ম সম্পাদনের কোন ক্ষমতা বাইখতিয়ার মানুষের নেই

 

মানুষকে আল্লাহ তায়ালা কোন কাজের জন্য ইচ্ছা করা ও চেষ্টা করার ক্ষমতা এবং দায়িত্ব দিয়েছেন। কাজটি সমাধা বা সম্পন্ন করার কোন ইখতিয়ারই দিননি। কাজটি ভালো হোক, আর মন্দ হোক তা সম্পন্ন করবার ইখতিয়ার সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। মানুষ ইচ্ছা করেচে বলেই কাজটি সম্পন্ন হয়ে যাবে না, না চাইলে যত চেষ্টাই করা হোক কাটটি সম্পন্ন হবে না।

 

যেহেতু কর্ম সম্পাদনের ক্ষমতা মানুষের হাতে নয়, সেহেতু ভালো কাজের পুরস্কার ও মন্দ কাজের শাস্তির জন্য কর্মটি সমাধা হওয়া শর্ত নয়। কেউ কোন ভালো কাজের ইচ্ছা ও চেষ্টা করলে কাজটি সমাধা না হলে ও সে কাজটি সমাধা করেছে বলে গন্য করে পুরস্কার দেওয়াযাবে। কারণ তার ইখতিয়ার যা ছিল তা সে করেছে। যা তার ক্ষমতার বাইরে এর জন্য তার পুরস্কার আটকে থাকবে কেন?

 

যেমন এক ব্যক্তি হজ্জে যাবার ইচ্ছা করল এবং রওয়ানা হয়ে গেল। ইচ্ছাও চেষ্টার দায়িত্ব সে পালন করল; কিন্তু পথে সে মারা গেল। সে হজ্জ সমাধা করেছে বলে গন্য করা হবে। কারণ যদি হাশরের ময়দানে তাকে চার্জ করা হয় যে, তুমি হজ্জ করলে না কেন? তাহলে সে বলবে, আমি তো হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। তুমি আমাকে মুত্যু দিলে কেন? তাই আল্লাহ তাকে চার্জই করবেন না। হজ্জ করার পুরস্কার তাকে দিয়ে দেবেন।

 

মন্দ কাজের উদাহরণ দেওয়া যাকঃ এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তিকে খুন করার ইচ্ছা করল এবং সে উদ্দেশ্যে শাবল মাথার উপর উঁচিয়ে মারতে উদ্যত হলো। দুজন লোক দৌড়ে এস শাবল ধরে বিরত করল। আদালতে মামলায় প্রমাণ হলোযে, সে খুন করার জন্য ইচ্ছাকুতভাবে চেষ্টা করেছে। আইনের ভাষায় == আমদের দেশের আইনে এ করতে চেয়েছিল তাকে একটু চিমটিও কাটেনি। তাহলে শাস্তি কেন? প্রমাণীত হলো যে, শাস্তি কমপক্ষে তিন বছরের জেল। অথচ অপরাধী যাকে খুন করতে চেয়েছিলা তাকে একটু ইচ্ছাও করেনি, চেষ্টা ও কাটেনি। তাহলে শাস্তি কেন? প্রমাণিত হলো যে, শাস্তি কর্ম সম্পাদনের উপর নির্ভর করে না। ইচ্ছা ও চেষ্টা সম্পন্ন হলেই কর্ম সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য।

 

আরও একটা উদাহরণ দিচ্ছিঃ এক ব্যক্তি পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে গাছে গুলি চালাল। সেখানে এক লোক ছিল। কিন্তু শিকারী জানতো না। ঐ লোকের গায়ে গুলি লাগলো। এবং লোকটি মারা গেল। খুনের কর্ম সম্পাদন হলো বটে, কিন্তু এর জন্য বন্দুকের মালিক ইচ্ছাও করেনি, চেষ্টাও করেনি। তাই আদালতে এ কথা প্রমাণ হলে তার কোন শাস্তি ও হবে না। অথচ খুনের কর্মটি কিন্তু হয়েই গেল।

 

দুনিয়ায় যেমন, আখিরাতে ও তেমনি পুরস্কার ও শাস্তি ইচ্ছা ও চেষ্টার ফল, কর্মের বদলা নয়।

 

এ কথা বুঝে আসলে তাকদীরও আর রহস্য থাকে না। মানুষ যা করতে ইচ্ছা ও চেষ্টা করে তা সম্পন্ন হবে যদি আল্লাহর তার তাকদীরে রেখে থাকেন। আর নেক আমল সম্পন্ন হওয়া তাকদীরে না থাকলেও এর পুরস্কার অবশ্যই পাবে। তেমনি তার মন্দ কাজ সমাধা না হলেও সে শাস্তি পাবেই। তাই তাকদীরের কোন দোষ নেই। কাজের বদলা (ভালো বা মন্দ) তাকদীরের উপর নির্ভর করে না। আল্লাহর এ নিয়মে কোন অবিচার নেই। প্রত্যেকেই তার নিয়ত ও চেষ্টা অনুযায়ী বদলা পাবে। তাই তাকদীরে যাই থাকুক তাতে তার লাভও নেই, ক্ষতিও নেই। তাকদীর নিয়ে পেরেশান হবার কোন প্রয়েঅজনই নেই। তবে তাকদীরে বিশ্বাস করা জরুরী। এ বিশ্বাস মানে, আল্লাহ যা নির্ধারিত করেছেন তাই হবে। কারো চেষ্টায় তাকদীর বদলে যাবে না।

 

সহীহ নিয়ত ছাড়া পুরস্কার পাওয়া যাবে না

 

রাসূল (সাঃ) ঘোষণা করেছেন, +++ নিশ্চায়ই প্রতিটি কাজ নিয়ত হিসেবেই বিবেচ্য।

 

কাজটি বাহ্যত খুব ভালো হলেও কী নিয়তে কাজটি করা হলো সে বিষয়টি বিবেচনা করেই আল্লাহ তায়ালা ঐ কাজটি মূল্যায়ন করবেন। যদি কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের সাফল্যের নিয়তে করা হয় তবে তা তিনি কবুল করবেন। আল্লাহর নিকট পুরস্কার পাওয়ার নিয়ত ছাড়া যদি কেউ দুনিয়ায় মানুষ বীর ও বাহাদুর বলবে আশা করে জিহাদের ময়দানের শহীদ ও হয় তবু সে দোযখেই যাবে বলেরাসূল (সাঃ) ঘোষণা করেছেন। হাদীসে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে যে, কাজটি যত নেকই হোক তা ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে করলেই পুরস্কারের যোগ্য বিবেচিত হবে। কাজটি ঈমানের দাবি পূরণের উদ্দেশ্যে ও এর বদলায় সওয়াব পাওয়ার নিয়তে করতে হবে।

 

সাধারণত মানুষ সুনামের উদ্দেশ্যে জনকল্যাণমূলক কাজ করে থাকে। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে রিয়া বা লোক দেখানো কাজ বলা হয়। জনগণ দানশীল হিসেবে সম্মান করবে বা নেতা বানাবে এ আশায় দান করা হয়। যে নিয়তে সে করেছে তা দুনিয়তেই সে পেয়ে যায়। সে আিিখরাতে কোন পুরস্কার পাবে? সে উদ্দেশ্যে তো সে তা করেনি। তাই নিয়তের ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

চেষ্টা না করা পর্যন্ত শুধু ইচ্ছা করার কোন ফল আছে কি?

 

কেউ কোন একটি ভালো বা মন্দ কাজ করার ইচ্ছা করলো, কিন্তু ঐ ইচ্ছা অনুযায়ী কাজটি করার চেষ্টা করার সুযোগ পেল না। এ রকম ইচ্ছা করার কোন ফল আছে কি না?

 

বান্দদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা বড়ই মেহেরবান। সহীহ বুখারী থেকে জানা যায়, যদি কেউ কোন নেক কাজের নিয়ত করে আর তা কাজে পরিণত করার সুযোগ না পায় তবুও তাকে একটি পূর্ণ সওয়াব দেওয়া হবে। আর যদি কেউ কোন মন্দ কাজের ইচ্ছা করার পর তা কাজে পরিণত না করে, তবে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার পুরস্কার হিসেবে একটি কাজের পূর্ণ সওয়াব পাবে।

 

মৃত্যুর পরও কি আমল জারী থাকে?

 

রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় এ প্রশ্নের জওয়াব দিয়েছেন। ++

 

যখন কেউ মারা যায়া তখন তার আমল করা বন্দ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি জিনিস (বাকি থেকে যায়) ১. সদকায়ে জারিয়া (যে দান চালু থাকে), ২. এমন বিদ্যা যা থেকে উপকার পাওয়া যায় এবং ৩. এমন নেক সন্তান যে পিতা মাতার জন্য দোআ করতে থাকে।

 

এ হাদীসটি খুবই তাৎপর্যপূণ। মানুষ যে কাজ করে যদি তার জের চলতে থাকে তাহলে যতদিন জের চলবে ততদিন সে কাজ করছে বলে গণ্য হবে। যেমন –

 

১. জনগণের সুবিধার জন্য সওয়াব নিয়তে কেউ একটা রাস্তা তৈরি করে দেয় তাহলে যতদিন রাস্তাটি টিকে থাকবে ততদিন পর্যন্ত এর সওয়াব তার আমলনামায় জমা হতে থাকবে।

 

২. কেউ যদি তার সন্তানকে আল্লাহর নেক বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলে তহলে ঐ সন্তান আজীবন যত নেক আমল করবে এর সওয়াব সমপরিমাণে তার আমলনামায় জমা হতে থাকবে। তার সন্তান ও যদি তারই মতো তার সন্তান কে গড়ে তোলে তাহলে এর সওয়াবও তাদের আমলনামায় জমা হতে থাকবে।

 

৩. কেউ যদি সওয়াবের নিয়তে মানুষকে এমন কোনো বিদ্যা শিক্ষা দেয়, যা মানুষের জন্য কল্যাণকর, তাহলে যতদিন ঐ কল্যাণ চালু থাকবে ততদিন তার আমলনামায় সওয়াব জমা হতে থাকবে।

 

মন্দ কাজের বেলায়ও গুনাহ জারি থাকবে। যেমন –

 

১. কেউ যদি ডাকাতি করে এবং অন্য কাউকে ডাকাতি শিক্ষা দেয় তাহলে তার মৃত্যুর পর তার শাগরিদের গুনাহও উস্তাদের আমলনামায় জমা হে ব।

 

২. কেউ যদি কাউকে কোনো মন্দ কাজে সাহায্য করে বা উৎসাহিত করে তাহলে সে নিজে মন্দ কাজ না করলেও ঐ মন্দ কাজের গুনাহ তার আমলনামায় শামিল করা হবে।

 

৩. কেউ যদি কোনো কুপ্রথা বা নৈতিকতা বিরোধী কোনো কাজ সমাজে চালু করে, তাহলে তার মৃত্যুর পরও যতদিন তা সমাজে চালু থাকবে ততদিন এর গুনাহ তার আমলনামায় জমা হতে থাকবে।

 

এদ্বারা বুঝা গেল যে, কারো মুত্যুর সাথে সাথে তার আমলের একাউন্ট (হিসাবের খাতা) বন্ধ হয়ে যায় না। কোনো কোনো ভালো ও মন্দ কাজের জের কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকতে পারে। তাই দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার পরই আমলের খাতা লেখা বন্ধ হবে।

 

হাদীসে আছে, মানুষ যখন আমলনামা হাতে পাবে তখন তার কাজের দীর্ঘ হিসাব দেখে চিৎকার করে বলে উঠবে, হে আল্লাহ আমি তো এত কিছু করিনি। এতগুলো আমার হিসাবে কেমন করে এলো? একথা শুধু বদ লোকেরাই বলবে না, নেক লোকেরাও বলবে। উভয় প্রকার লোককে একই জওয়াব দেওয়া হবে – এটা ঠিক যে তুমি নিজে এত কিছু করনি, কিন্তু তুমি অন্যদেরকে শিক্ষা দিয়েছ, অন্যদেরকে উৎসাহ দিয়েছ, তোমাকে দেখে তারা শিখেছে বা উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তাই অন্যদের আমরও তোমার হিসাবে ধরা হয়েছে। সূরা ইনফিতারের ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে,++++

 

(কিয়ামতের পর) প্রত্যেক মানুষ জানতে পারবে যে, সে আগে কী (আমল) পাঠিয়েছে এবং পরে সে কী করেছে। এখানে আগে করেছে মানে জীবিতকালে করেছে আর পরে করেছে মানে মৃত্যুর পরে করা হয়েছে বলে ধরা হয়েছে।

 

তাই দুনিয়ায় অতি সতর্কতার সাথে আখিরাতের হিসাবের কথা খেয়ালে রেখে আমল করতে হবে।

 

আমল সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা

 

আমল মানে কাজ। কিন্তু কোনো কিছু হাসিল করার জন্য কোনো দুআ পড়াকেও সাধারণত আমল বলাহয়। মাওলানা মওদুদী (র) কে খুলনায় এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন হুযুর আমার আয়ের কোন পথ নেই। বেকার অবস্থায় আছি। এক হুযুর আমাকে এ দোআটি সোয়া লাখ বার পড়তে বলেছেন। এটা নাকি রিযিক হাসিলের আমল।

 

মাওলানা তাকে বললেন, আপনি এ দোআটি বসে বসে পড়লে রিযিকের আমল হবে না। আপনি আয়ের জন্য চেষ্টা করতে থাকবেন এবং এ দোআটি পড়তে থাকবেন। সোয়া লাখবার হলো কিনা সে হিসাবের দরকার নেই। যতদিন পর্যন্ত আয়ের উপায় নাহয় ততদিন পড়তে থাকবেন এবং আয়ের পথ তালাশ করতে থাকবেন।

 

লোকটি চলে গেলে মাওলানা মন্তব্য করলেন যে জাতি আমল না করাকে আমল মনে করে সে জাতির কেমন করে উন্নতি হবে?

 

হাদীসে আছে, যখন কেউ মারা যায় তখন তার লাশের সাথে তিনটি জিনিস কবর পর্যন্ত যায়। ১. আত্মীয় স্বজন ২. কিছু মাল ৩.তার আমল। দাফনের পর দুটো জিনিস ফিরে আসে, আর শুধু একটি জিনিস তার সাথে যায়। সে জিনিসটি হলো তার আমল।

 

--- সমাপ্ত ---

', 'মযবুত ঈমান', '', 'publish', 'closed', 'closed', '', '%e0%a6%ae%e0%a6%af%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%a4-%e0%a6%88%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8', '', '', '2019-10-26 16:00:08', '2019-10-26 10:00:08', '

\"\"

 

মযবুত ঈমান

 

অধ্যাপক গোলাম আযম

 


 

স্ক্যান কপি ডাউনলোড

 


বইটির অডিও শুনুনhttp://shibircloud.com/audio/lq/mojbut_iman.mp3

লো কোয়ালিটি ডাউনলোডহাই কোয়ালিটি ডাউনলোড

 


 

বইটির পটভূমি

 

ইসলামী আন্দোলনের  ও সংগঠনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমি তীব্রভাবে উপলব্ধি করেছি যে, ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝা সত্ত্বেও ইসলামের দাবি পূরণে অনেকেই ব্যৰ্থ হয়। ধীরে সুস্থে বিবেক-বুদ্ধি যথাযথভাবে প্রয়োগ করে ইসলামী আন্দোলনে অগ্রসর হবার পর কেউ কেউ আবার পিছিয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামীর রুকন হিসেবে বেশ কিছুদিন সক্রিয় ভূমিকা পালনের পরও একসময় নিক্রিয় হয়ে পড়ে। ছাত্রজীবনে নেতৃস্থানীয় দায়িত্ব পালন করেও কর্মজীবনে আর এগুতে চায় না। \'বিস্ময় ও বেদনার সাথে আমি এ সব লক্ষ্য করে দীর্ঘদিন কারণ তালাশ করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, ঈমানের দুর্বলতাই এর জন্য দায়ী। ঈমানের দাবি কী, কোন পথে ঈমানে দুর্বলতা আসে এবং মজবুত ঈমানের কী কী শর্ত রয়েছে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। গত কয়েক বছরে ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় পুরুষ, মহিলা, ছাত্র ও ছাত্রীদের আরও সুস্পষ্ট হয়েছে। বিষয়টি এখন পরিপূর্ণ রূপ লাভ করেছে। তাই এ বিষয়টিকে পুস্তিকাকারে পরিবেশন করার প্রয়োজন বোধ করছি। দুর্বল শরীর নিয়ে যেমন কোন কাজ করার ক্ষমতা থাকে না, দুর্বল ঈমান নিয়েও ঈমানের কোন দাবি পূরণ করা সম্ভব হয় না। তাই যারা ঈমানের দাবিদার তাদের এ বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এ প্রয়োজন পূরণে সহযোগিতা করাই এ লেখার উদ্দেশ্য। এ বড় আশা নিয়ে আমি লিখছি যে, যারা একবার ইসলামী আন্দোলনের শরীক হয় তারা যদি ঈমান সম্পর্কে এ সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করে তাহলে কেউ আল্লাহর রহমতে ঈমানের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হবে না। মানুষে মানুষে যোগ্যতার পার্থক্য আছে এবং থাকবে। ঈমানের দিক দিয়ে দুর্বল না হলে প্রত্যেকেই তার যোগ্যতা অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আল্লাহ তাআলা আমার এ আশা পূরণ করুন।

 

গোলাম আযম

 

জুন, ২০০২

 

মজবুত ঈমান

 

এ বিষয়টি ছয়টি পয়েন্টে বিভক্ত করে আলোচনা করতে চাই।

 

১. ঈমান মানে কী? বিশ্বাস বলতে কী বুঝায়? বিশ্বাসের সংজ্ঞা কী? কর্মের সাথে বিশ্বাসের সম্পর্ক কী? বিশ্বাস কত রকম হতে পারে?

 

২. মানব জীবনে বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা কী?

 

৩. ইসলামে ঈমান সম্পর্কিত বিষয় (ঈমানিয়াত) কী কী? কেউ ইসলাম গ্রহন করে মুসলিম হতে চাইলে তাকে কী কীবিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে?

 

৪. আল্লাহর উপর ঈমান আনলে আল্লাহর সাথে কেমন সম্পর্ক কায়েম হয়?

 

৫. ঈমান কী কারণে দুর্বল হয়? কোন পথে ঈমানে দুর্বলতা আসে?

 

৬. মযবুত ঈমানের শর্ত কী কী? কোন কোন শর্ত পূরণ হলে ঈমান মযবুত হয়?

 

১. ঈমান মানে কী?

 

ঈমানী আরবী শব্দ। এর সহজ অর্থ হলো বিশ্বাস। বিশ্বাস বলতে কী বুঝায়? এটা অত্যন্ত গুরত্বপুর্ণ বিষয়।

 

একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। ধরুন এক পরিচিতি লোক এসে আমাকে বললেন, ভাই, আমাকে এক হাজার টাকা ধার দিন। আমি এক মাস পরই ফেরত দিয়ে যাব।

 

এক মাস পর টকাটা ফেরত দেবে কি না সে বিষয়ে আমার সরাসরি জানা নেই। আমি তাকে কী বলবো? তাকে তো আর একথা বলা যায় না যে, এক মাস পর ফেরত দেন কি না আগে দেখে নিই। তাহলে তাকে কী বলব? আমার কাছে লোকটি ধার চেয়েছে, হয় তাকে ধার দেব, আর না হয় ধার দিতে অস্বীকার করব। ধার দেব কি দেব না এ বিষয়ে কিভাবে আমি সিদ্ধান্ত নেব? টাকা সত্যি ফেরত দেবে কি না সে বিষয়ে ডাইরেক্ট নলেজ বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান তো নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে পরোক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি তাকে যতটুকু জানি তাতে আামার মনে এ বিশ্বাস হয় কি না যে, লোকটি ওয়াদা পালন করবে। যদি তার উপর আমার বিশ্বাস হয় যে, এ লোক টাকা ফেরত দেবে তাহলে আমি তাকে ধার দেব। মোট কথা, ধার দেওয়ার এই সিদ্ধান্তটার ভিত্তিই হলো বিশ্বাস। যদি তার অতীত আচরণ থেকে তার উপর আমার এ বিশ্বাস না হয় যে, টাকাটা ফেরত দেবে, তাহলে আমি ধার দেব না। আমি যে তাকে অবিশ্বাস করলাম, তাও পরোক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে। তাকে ধার দিতে অস্বীকার করলে সে নিশ্চয়ই বলবে, আমাকে বিশ্বাস করেন না? আমি যে তাকে অবিশ্বাস করলাম, এটাও কিন্তু বিশ্বাস। অর্থাৎ আমার বিশ্বাস যে, সে টাকা ফেরত দেবে না। তাকে আমি টাকা দিলামই না। কী করে জানলাম যে, সে টাকা ফেরত দেবে না? পরোক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমেই আমি এ বিশ্বাসে পৌছেছি।

 

তাহলে বিশ্বাসের সংজ্ঞা কী দাঁড়াল? যে বিষয়ে সরাসরি জ্ঞান নেই, অথচ সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচেছ ; তখন পরোক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় নেই; এভাবে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তারই নাম বিশ্বাস।

 

একটি বড় উদাহরণ

 

মৃত্যুর পর আবার জীবিত হতে হবে কি না এ বিষয়ে সরাসরি জ্ঞান নেই। কিন্তু এ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকারও উপায় নেই। যদি মৃত্যুর পর আরও একটি জীবন থাকে তাহলে আমাকে সে হিসাব মনে রেখেই দুনিয়ায় চলতে হবে। যদি না থাকে তাহলে বেপরোয়া চলা সহজ মনে হতে পারে। তাই এ বিষয়ে চুপ থাকার উপায় নেই। হয় আছে মনে করতে হবে আর না হয় নেই বলে ধারণা করতে হবে এবং স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে।

 

এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কিভাবে নেব? কেউ ঐপারে থেকে ফিরে আসে না। এপার থেকে উঁকি মেরে দেখাও সম্ভব নয়। পরকাল একেবারেই অদৃশ্য। পবিত্র কুরআনে অনেক সূরায় শুধু আখিরাতকে বিশ্বাস করার জন্য যুক্তি পেশ করা হয়েছে। এসব জ্ঞানের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জানা যায় যে,  পরকাল অবশ্যই আছে।

 

পরকাল সম্পর্কে সরাসরি জ্ঞান নেই, অথচ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত পৌঁছাতেই  হবে। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই ঐ সিদ্ধন্ত পরোক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমেই সম্ভব। এভাবেই অদৃশ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ সিদ্ধন্তটাই বিশ্বাস।

 

বিশ্বাসের তিন অবস্থা

 

যে দুটো উদাহরণ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে এর ভিক্তিতে বিশ্বাসের তিনটি অবস্থা হলোঃ

 

১. ইতিবাচক বিশ্বাস

 

ক. আমার বিশ্বাস হয় যে,  লোকটিকে ধার দিলে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে।

 

খ. আমার বিশ্বাস হয় যে,  মৃত্যুর পর আবার জীবিত হতে হবে।

 

২. নেতিবাচক বিশ্বাস

 

ক.আমার বিশ্বাস যে, লোকটি ধার নিলে টাকা ফেরত দেবে না।

 

খ. আমার বিশ্বাস যে, মৃত্যর পর আর কোনো জীবন নেই।

 

৩. সন্দেহ

 

ক. লোকটি টাকা ফেরত দিতেও পারে নাও দিতে পারে।

 

খ. মৃত্যুর পর আবার জীবিত হতেও পারে নাও হতে পারে।

 

সন্দেহ মানে কোনো রকম বিশ্বাস এখনো জন্মেনি। ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো বিশ্বাস না হওয়াই সন্দেহ।

 

বিশ্বাস ও কর্মের সম্পর্ক

 

বিশ্বাসের সাথে কর্মের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। যে ধরনের বিশ্বাস হয় সে অনুযায়ীই কর্ম হয়ে থাকে। বিশ্বাসের বিপরীত কর্ম হয় না। বিশ্বাস তিন রকম হলেও কর্ম তিন রকম হয় না। ইতিবাচক বিশ্বাসের কর্ম এক রকম। আর নেতিবাচক বিশ্বাস ও সন্দেহের ভিত্তিতে কর্ম একই রকম হয়। যেমনঃ যদি আমার বিশ্বাস হয় যে লোকটি টাকা ফেরত দেবে তাহলে আমি তাকে টাকা ধার দেব।

 

যদি বিশ্বাস হয় যে ফেরত দেবে না তাহলে আমি তাকে ধার দেব না। সন্দেহ হলেও ধার দেব না।

 

যে রকম বিশ্বস হয় সে অনুযায়ীই কর্ম হয়। কর্মের পেছনে অবশ্যই বিশ্বাস রয়েছে। বিশ্বাস ছাড়া কর্ম হতে পারে না। বিশ্বাসের বিপীতও কর্ম হয় না। বিশ্বাস ও কর্ম একেবারেই ঘনিষ্ঠ।

 

২.মানব জীবনে বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা কী?

 

সরাসরি জ্ঞানের উৎস হলো পাঁচটি ইন্দ্রিয়। এ দ্বারা অতি সামান্য জ্ঞানই হাসিল করা যায়। শুধু এটুকু জ্ঞানের দ্বারা মানুষের জীবন চলে না। সামান্য কিছু ক্ষেত্র ছাড়া মানুষকে বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই চলতে হয়।

 

১. শৈশবে মা বলে দিয়েছেন যে, অমুক আমার বাবা। বিশ্বাস করেছি। এ বিষয়ে সরাসরি জ্ঞানের কোনো সুযোগ নেই।

 

২. বাংলা ভাষা শিখার জন্য অ,আ, ক, খ, তে বিশ্বাস করেই এ ভাষা শিখতে হয়েছে।

 

৩. অসুখ হলে ডাক্তারের উপর বিশ্বাস না করলে চিকিৎসা পাওয়া অসম্ভব।

 

৪. ফসল হবে এ কথা বিশ্বাস না হলে কৃষক চাষাবাদই করতে পারবে না।

 

৫. বিচারকের মনে সাক্ষী প্রমাণ নিয়ে আসামি দোষি বলে বিশ্বাস সৃষ্টি হলেই শাস্তি দেয়, বিশ্বাস না হলে বা সন্দেহে হলে শাস্তি দেয় না।

 

৬. যে কোন সময় মৃত্যু আসতে পারে। তবু মানুষ আরও বেঁচে  থাকবে বিশ্বাস করে বলেই জীবন সচল আছে।

 

৭. মানুষে মানুষে সম্পর্ক বিশ্বাসের উপরই কায়েম থাকে। স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক, ভাই –ভাইয়ে সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ব্যবসায়-বাণিজ্যের সম্পর্ক সবই বিশ্বাসনির্ভর।

 

হিসাব করলে দেখা যাবে যে, বিশ্বাস ছাড়া একদিনও মানুষ চলতে পারে না। বিশ্বাসই গোটা জীবনকে ঘিরে রেখেছে।

 

না দেখে বিশ্বাস করি না

 

আজব মগজের এমন কিছু লোক আছে, যারা বহু বিষয়েই বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করে, কিন্তু আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বসের বেলায় বলে, ‘না দেখে বিশ্বাস করি না’।

 

মযবুত ঈমান সম্পর্কে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সমাবেশ আলোচনাকালে ‘না দেখে বিশ্বাস করি না’ কথাটার অসারতা প্রমাণ করার জন্য একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে থাকি। আমার হাতের মুঠোয় এক গুচ্ছ চাবি রেখে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলি, ‘আমি দাবি করে বলছি যে, আমার হাতে এক গুচ্ছ চাবি আছে, তোমরা কি এ কথা বিশ্বাস কর’? ছেলেরা বলে, হ্যাঁ; বিশ্বাস করি। আবার জিজ্ঞেস করি, কেন বিশ্বাস কর? জবাবে বলে, আমরা বিশ্বাস করি যে, আপনি মিথ্যা বলেন না। তাই আপনি যখন বলছেন, চাবি আছে তখন আমরা এ কথা বিশ্বাস করি।

 

মুষ্টি খুলে চাবিটি দেখিয়ে আবার জিজ্ঞেস করি, এটা চাবি তা বিশ্বাস কর? তখন কেউ কেউ বলে ফেলে, হ্যাঁ; বিশ্বাস করি। আমি বলি, যখন চাবিটি অদৃশ্য ছিল তখনই বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল। চাবিটি দেখার পর বিশ্বাসের আর প্রয়োজন রইল না। যারা দেখার পরও বিশ্বাস করি বলেছ তারা বিশ্বাসের বাজে খরচ করেছ। দেখলে আর বিশ্বাসের দরকার হয় না। না দেখলেই বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়। তাই ‘না দেখে বিশ্বাস করি না’  কথাটি একেবারেই হাস্যকর ও অযৌক্তিক। বোকাদের পক্ষেই এমন কথা বলা সম্ভব। কোনো নাস্তিকও তার মাকে এ কথা বলতে পারবে না, মা ছোট সময় না বুঝে তোমার কথা মেনে নিয়ে বিশ্বাস করেছি যে, অমুক আমার বাবা, এখন আমি না দেখে কোনো কিছু বিশ্বাস করি না। তাই আমাকে দেখাও কেমন করে ঐ লোক আমার বাবা। এ কথা না দেখেও বিশ্বাস করে। শুধু আল্লাহর বেলায় না দেখে সে বিশ্বাস করে না।

 

বাস্তব জীবনে বিশ্বাস ছাড়া মানুষ একদিনও চলতে পারে না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে ও তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য বিশ্বাসের আশ্রয় নিতে হয়। এ অবস্থায় আল্লাহ, ওহী, রাসূল, আখিরাত ইত্যাদি বিরাট বিরাট বিষয়ে বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার না করা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়।

 

জ্ঞান চর্চা বিশ্বাস দিয়েই শুরু হয়

 

সকল জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই নিকট রয়েছে। প্রত্যেক বিষয়ে জ্ঞানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু আল্লাহই জানেন।  তিনিই শুরু, তিনিই শেষ। যে কোনো জ্ঞান চর্চা করতে হলে প্রথমেই কতক বিষয়কে বিশ্বাস করতে হয়। A,B,C,D বা ক,খ,গ, যেভাবে লেখা আছে এগুলোকে বিনা যুক্তিতে মেনে নিয়েই ভাষা শেখা শুরু করতে হয়। কেই যদি তর্ক করে যে, এভাবে কেন, অন্যভাবে লিখলে দোষ কী? তাহলে তার ভাষা শেখা শুরু করাই সম্ভব হবে না।

 

জ্যামিতি পড়তে হলে প্রথমেই কতক Axiom বা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়ে বিশ্বাস করতে হয় । যেমন বিশ্বাস করতে হয় যে, বিন্দুর (Pount) দৈর্ঘ্য, প্ৰস্থ, উচ্চতা কোনটাই নেই, তবু বিন্দুর অস্তিত্ব আছে। যদিও পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী এটা একেবারেই অযৌক্তিক। তথাপি এটা বিশ্বাস না করলে জ্যামিতি শেখা শুরুই করা যায় না।

 

বিজ্ঞান চর্চা প্ৰথমে হাইপথেসিস (কল্পনা, অনুমান) দিয়েই শুরু হয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কারক নিউটন সম্পর্কে জানা যায় যে, ফলের বাগানে বসা অবস্থায় তাঁর সামনে গাছ থেকে একটা আপেল নিচে পড়লো। এর আগেতো বহুবার তিনি আপেল পড়তে দেখেছেন; কিন্তু সেদিন তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলো যে, উপরেও শূন্য নিচেও শূন্য। তাহলে ফলটি উপরের দিকে না যেয়ে নিচের দিকে নামল কেন? তাঁর মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, পৃথিবীর মধ্যে এমন কোন শক্তি আছে যা বস্তুকে আকর্ষণ করে। এভাবে বিশ্বাসের ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূচনা হয়।

 

জ্ঞানের ময়দানে কোন বিষয়েই জ্ঞানের শুরু বা শেষ মানুষের আয়ত্তে নেই। প্ৰথমে বিশ্বাস দিয়ে জ্ঞান চর্চা শুরু হয় এবং একটি পৰ্যায় পর্যন্ত যেয়ে চর্চা থেমে যায়। জ্ঞানের শেষ পর্যন্ত পৌছার সাধ্য মানুষের নেই।

 

৩. ইসলামে ঈমান সম্পর্কিত বিষয় কী কী?

 

ইসলাম গ্রহণ করতে হলে বা মুসলিম হতে হলে ৭টি বিসয়ের উপর ঈমান আনতে হবে। ইসলমে ঈমান বলতে এ সাতটি বিষয়ের ইপর দৃঢ় বিশ্বাসকে বুঝায় ॥

 

এগুলোকে ঈমানে মুফসসাল তথা বিস্তারিত ঈমান বলা হয়। আরবীতে এগুলোকে শিখতে হয়।

 

امَنْتُ بِاللهِ وَمَلئِكَتِه وَكُتُبِه وَرَسُوْلِه وَالْيَوْمِ الْاخِرِ وَالْقَدْرِ خَيْرِه وَشَرِّه مِنَ اللهِ تَعَالى وَالْبَعْثِ بَعْدَالْمَوْتِ

 

 অর্থাৎ আমি ঈমান আনলাম আল্লাহ, তার ফেরশতাগণ, তার কিতাবসমূহ, তার রাসূলগণ, শেষ দিন (পরকাল), তাকদীরের ভালো ও মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয় এবং মৃত্যুর পর পনরুজ্জীবন এর প্রতি।

 

ঈমানের প্রধান বিসয় তিনটি তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। ঐ৭টি বিষয় এ তিনটিরই অর্ন্তভূক্ত। তাওহিদের মধ্যে শামিল রয়েছে তিনটি-  আল্লাহ, ফেরেশতাগণও তাকদীর।রিসালতের মধ্যে দুটি কিতাবসমূহ ও রাসূলগণ। আর আখিরাতের মধ্যে দুটি-  শেষ দিন ও মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন।

 

তাওহীদের মধ্যে আল্লাহর সাথে ফেরেশতাকে এ জন্যই শামিল করা হয়েছে যে, ফেরেশতাদের সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করা হত। আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে, ফেরেশতারা আল্লাহর দাসও কর্মচারী মাত্র। তারা আল্লাহর কোনো ক্ষমতায় সামান্যতম শরীকও নয়। তাদের সম্পর্কে এ ধারণা থাকলে আল্লাহর সাথে কোনো দিক দিয়েই তাদেরকে শরীক করার আশঙ্কা থাকে না।

 

তাকদীর মানে সর্ববিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে। যে বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত তিনি করেন, সেটাই তাকদীর। মানুষের জীবনে ভালো ও মন্দ যাই ঘটে তা আল্লাহর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ঘটে থাকে। সেখানে অনথ্য কোন শক্তির হাত নেই। আল্লাহর এই একচ্ছত্র আধিপত্য ও কর্তৃত্ব তাওহূদেরই অর্ন্তভূক্ত।

 

৪.আল্লাহর সাথে সম্পর্কের বাস্তব রূপ কী?

 

আল্লাহর উপর ঈমান আনলে আল্লাহর সাথে বান্দাহর বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তায়াল এ সম্পর্ককে সূরা নাস এ তিনভাবে প্রকাশ করেছেনে।

 

১. رَبِّ النَّاس মানুষের রব বা প্রতিপালক। যাবতীয় প্রয়োজন পূরণকারী রক্ষণাবেক্ষণকারী ইত্যাদি। আর মানুষ তার দয়ার ভিখারি তার একান্ত অনুগৃহীত ও প্রতিপালিত।

 

২. مَلِكِ النَّاسِ   মানুষের বাদশাহ। তিনি রাজা আর মানুষ তার প্রজা। কোনো অবস্থায়ই কারো পক্ষে তার রাজত্বের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। তার রাজ্যের নিয়ম কানুন ও বিধি বিধান মানুষ আবদ্ধ। ভালো বা মন্দ কিছু করার ইচ্ছা ও চেষ্টার ইখতিয়ারটুকু শুধু মানুষকে দেওয়া হয়েছে। কিন্ত কোন কাজ সমাধা করার কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। কর্ম সমাধা করা আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ নিভরশীল। শুধু ইচ্ছা ও চেষ্টা করা হলেই মানুষ কর্মের পুরস্কার বা শাস্তি পাবে। কর্ম সম্পন্ন না হলেও এর বদলা পাবে। ইচ্ছা ও চেষ্টার সামান্য ইখতিয়ারটুকু ছাড়া আল্লাহ তার প্রজাকে ক্ষমতাই দেননি।

 

৩. إِلَٰهِ النَّاسِ  আল্লহই মানুষের একমাত্র ইলাহ মাবুদ হুকুমদাতা প্রভু ও মুনিব। তার হুকুমের বিরোধী কোনো হুকুম মানার অধিকার মানুষের নেই।

 

রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

 

স্রষ্টাকে অমান্য করে কোনো সৃষ্টির আনুগত্য চলে না।

 

এসব সম্পর্কের স্বাভাবিক দাবি

 

যে আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর উপর ঈমান আনে তার ঈমানের দাবি সে পূরণ করতে সক্ষম হয়।

 

১. সে আল্লাহর একমাত্র রব হিসেবে মেনে নেয়। যা কিছু সে দুনিয়ায় ভোগ করে এর জন্য সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর প্রতিই জ্ঞাপন করে। তার দেহে যত নিয়ামত আছে তার অন্তরে যত সুকামনা আসে তার মনে যত সুচিন্তা আসে নেক কাজের যত ইচ্ছা মনে জাগে সৎকাজের জন্য চেষ্টা করার যতটুকু তাওফীক হয় আল্লাহর সৃষ্টি জগতের যা কিছু ব্যবহার করা ও ভোগ করার সুযোগ সে পায় এ সকল বিষয়েই সে একমাত্র আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জানায়। একমাত্র তারই প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করে এবং মনে তারই অনুগ্রহের তৃপ্তি বোধ করে। প্রতিটি আপদ বিপদকে তার পক্ষ থেকে মনে করে। সে আল্লাহকেই একমাত্র রিযকদাতা ও প্রয়োজন পূরণকারী মনে করে। কঠিন মুসীবতেও সে পেরেশান হয় না। কোনো অবস্থায়ই তার রব থেকে নিরাশ হয় না। সব কিছুর মধ্যে আল্লাহ তার জন্য মঙ্গল ও কল্যাণ রেখেছেন বলে বিশ্বাস করে। একমাত্র তারই উপর নির্ভর করে মনে সান্তনা বোধ করে।

 

২. সে আল্লাহকে একমাত্র বাদশাহ মনে করে এবং আর কোনো শক্তির পরওয়া সে করে না। কোনো বড় শক্তিই তার নিকট বড় নয়। যিনি সকল বাদশাহর বাদশাহ সে নিজেকে তারই স্নেহভাজন প্রজা মনে করে। কারো দাপটে সে ভীত হয় না। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো শক্তিকে ভয় করার সামান্য প্রয়োজনও সে বোধ করে না। কেউ তার কোনো ক্ষতি করতে পারে বলে সে মনে করে না। সে পরম সাহসী ও চরম নির্ভীক। দুনিয়া ও আখিরাতে সে আল্লাহকেই একমাত্র ওলী বা স্নেহপরায়ণ অভিভাবক মনে করে। সর্বাবাস্থায় সে অন্তরে প্রাশান্তি বোধ করে। কোনো অবস্থায়ই বিচলিত হওয়া প্রয়োজন মনে করে না। নিজেকে সে আল্লাহর সৈনিক মনে করে এবং তার বাদশাহর রাজত্ব কায়েম করা ও কায়েম রাখা সবচেয়ে বড় কর্তব্য মনে করে। আল্লাহর অপছন্দনীয় সবকিছু উৎখাত করার জযবা রাখে। সে আল্লাহ তাআলাকেই আর সব কিছু থেকে ভালোবাসে তার সন্তুষ্টি লাভের চেয়ে বড় কোনো আকাঙক্ষা তার থাকে না। মালিকের সন্তষ্টির জন্য জান কুরবান করার মধ্যেই সে গৌরব বোধ করে। শয়তানের রাজত্ব উৎখাত করে আল্লাহর রাজত্ব কায়েমের লক্ষ্যে জান ও মাল কুরবান করার জন্য সর্বাত্মাক চেষ্টা করাই জান্নাত লাভের সোপান মনে করে।

 

৩. আল্লহই একমাত্র ইলাহ বলে বিশ্বাস করে। তার হুকুমের বিরোধী কারো হুকুম পালান করতে সে এক বিন্দু প্রস্তুত নয়। তার আদেশ পালন করা ও তার নিষেধ থেকে নিজেকে বিরত রাখাই তার দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন ও আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের সাফল্যের একমাত্র উপায় বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এটাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের একমাত্র পথ বলে সে মনে করে। দুনিয়ার শাস্তি ও আখিরাতের মুক্তির জন্য আর কোন বিকল্প উপায় আছে বলে সে বিশ্বাস করে না।

 

৫. কীভাবে ঈমানে দুর্বলতা দেখা দেয়?

 

আল্লাহ তায়ালার প্রতি সত্যিকার ঈমান থাকলে তার সাথে যে সব সর্ম্পক গড়ে উঠে এ সম্পর্কের দাবি পূরণ করাই মুমিনের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু ঈমানের দাবিদার হওয়া সত্তেবও ঈমানের দাবি পূরণে সেই ব্যর্থ হয় যার ঈমান দুর্বল। তাই প্রত্যেক মুমিনেরই এ বিষয়ে সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন যে কোন পথে ঈমনে দুবর্লতা আসে। যখনই ঈমানে দুবলতা দেখা দেবে তখনই আল্লাহর সাথে সর্ম্পক ছিন্ন হয়ে যাবে। এটা বিরাট কথা। এ বিষয়ে চরম সতর্কতা প্রয়োজন।

 

আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় বহু কিছুর সাথে আমাদের ভালোবাসার সর্ম্পক গড়েছেন। সেসব সর্ম্পক ত্যাগ করার অনুমতিও তিনি দেননি। বরং এসব সর্ম্পককে তিনি সজ্জা  বলে ঘোষণা করেছেনেঃ

 

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ۗ ذَٰلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَاللَّهُ عِندَهُ حُسْنُ الْمَآبِ

 

মানুষের জন্য তাদের পছন্দসই জিনিস নারী সন্তান সোনা রুপার স্তপ বাছাই করা ঘোড়া পালিত পশু ও চাষের জমি খুবই কামনার বিষয় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব দুনিয়ার কদিনের জীবিকা মাত্র। আসলে যা ভালো আশ্রয় তা তো আল্লাহর কাছেই আছে। (সূরা আলে ইমারান :১৪)

 

এসব ভালোবাসার বিষয় দ্বারা মানুষের জীবনকে সাজিয়ে দেওয়া  হয়েছে বলে আল্লাহর স্বয়ং ঘোষণা করলেন। এসব ভালোবাসার সজ্জাকে ত্যাগ করে বৈরাগী বা সন্ন্যাসী হয়ে গেলে আল্লাহর নিকট অপরাধী সাব্যস্ত হবে। দুনিয়ায় যেসব জিনিসের সাথে আল্লাহ নিজে এ ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন, এসব ভালোবাসার পরিমাণও তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। ঐ পরিমাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসলেই ঈমান দুর্বল হয়। আল্লাহ বলেন,

 

قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

 

(হে রাসূল! আপনি তাদেরকে) বলুন, তোমাদের পিতামাতা, সন্তানাদি,ভাই বোন, স্ত্রীগণ আত্মীয়Ñস্বজন, ঐ মাল যা তোমরা অজর্ন করেছ, তোমাদের ঐ কারবার তোমরা যার মন্দার ভয় কর এবং তোমাদের ঐ বাড়ি যা তোমরা পছন্দ কর (এসব) যদি তোমাদের নিকট আল্লাহ, তার রাসূল ও তার পথে জিহাদের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা (মৃত্যু) আসা পযর্ন্ত অপেক্ষা কর। আল্লাহ ফাসিকদেরকে হেদায়াত করেন না।(সূরা তাওবা:২৪)

 

এ আয়াতে অতি স্পষ্ট ভাষায় দুনিয়ার ভালোবাসার জিনিসগুলোকে কী পরিমাণ ভালোবাসা যাবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ, রাসূল ও আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসলেই ঈমান দুর্বল বলে প্রমাণিত হবে। যখন ঐ আটটি জিনিসের ভালোবাসা এ তিনটির চেয়ে বেশি হবে তখনি ঈমানের বিপদ। আল্লাহ, রাসূল, জিহাদের ভালোবাসার সাথে ঐ ৮টি জিনিসের ভালোবাসার যখনি টক্কর হবে, তখন তিনটির ভালোবাসা নিষিদ্ধ নয়; বরং কর্তব্য। কিন্তু ঈমান নিরাপদ থাকবে। ঐ আটটির ভালোবাসা নিষিদ্ধ নয়; বরং কর্তব্য। কিন্তু তিনটির চেয়ে ঐ ৮টির ভালোবাসা বেশি হলেই প্রমাণিত হবে যে, ঈমান দুর্বল।

 

একটি চমৎকার উদাহরণ এ কথাটিকে সুন্দর ভাবে স্পষ্ট করে দেয়। পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া জীবন বাঁচে না বলেই এ কথাটি বলা হয়। কিন্তু মানুষ কি পানিতে ডুবে মরে না? তাহলে পানিকে জীবন বলা যায় কী করে? আসল কথা হলো, এক বিশেষ পরিমাণ পানি অবশ্যই জীবন। এ পরিমাণের বেশি হলে পানিই মরণ। তেমনিভাবে আল্লাহ, রাসূল ও জিাহাদের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে ঐ আটটি জিনিসের ভালোবাসা কম হলে এটাই ঈমানের জীবন। আর ৩টি থেকে ৮টির বালোবাসা বেশি হলেই ঈমানের মরণ।

 

আল্লাহ, রাসূল ও ইসলামী আন্দোলনের প্রতি দায়িত্ব পালনের পথে যখন ঐ আটটি ভালোবাসার বস্তু প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তখন ঐ দায়িত্ব পালনে বাধার সৃষ্টি হয়। এ বাধা দূর করতে পারলে, অর্থাৎ তিনটির ভালোবাসার খাতিরে যদি আটটির ভালোবাসা কুরবানী দেওয়া যায়, তাহলে প্রমাণিত হবে যে, ঈমান দুর্বল নয়। ঈমান দুর্বল হলে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ তখন আর ঈমানের দাবি পূরণ করার শক্তি থাকে না।

 

সম্পদ ও সন্তানকে আল্লাহ্‌ সজ্জা ও বলেছে , ফিতনাও বলেছেন-

 

الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِندَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا

 

সম্পদ ও সন্তানাদি দুনিয়ার জীবনের সজ্জা।(সূরা কাহফ:৪৬)

 

إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ

 

নিশ্চয়ই তোমাদের মাল ও সন্তান ফিতনা’ (সূরা তাগাবুন:১৫)

 

ঐ আটটি ও তিনটির ভালোবাসায় যদি ভারসাম্য রক্ষা কর হয় তাহলে সম্পদ ও সন্তান জীবনের সজ্জা। আর যদি আটটির ভালোবাসা বেশি হয় তাহলে সম্পদ ও সন্তান ফিতনা। ইসলামী পরিভাষায়, আল্লাহর হুকুম পালনে বাধাকেই ফিতনা বলা হয়। এর শাব্দিক অর্থ  পরীক্ষা, বিপদ, গোলাযোগ, আকর্ষণ, বিশৃঙ্খলা, ইত্যাদি।

 

সূরা মুনাফিকূনের দ্বিতীয় রুকুর প্রথম আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ ۚ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ

 

হে ঐসব লোক যারা ঈমান এনেছে শোন! তোমাদের মাল ও আওলাদ (সম্পদও সন্তান) যেন তোমাদরেকে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে না দেয়। এসবের ভালোবাসায় এমন মগ্ন হয়ে যেয়ো না, যার কারণে ঈমানের দাবি পূরণে অবহেলা হয়ে যায়।

 

৬. মযবুত ঈমানের শর্ত কী কী?

 

মযবুত ঈমানের প্রধান শর্ত দুটোঃ

 

১. র্শিকমুক্ত ঈমান বা নির্ভেজাল তাওহীদ।

 

২. ঈমানের দাবিদারকে তাগূতের কাফির হতে হবে।

 

সুতরাং মযবুত ঈমানের অধিকারীকে তাওহীদ, শিরক  তাগূত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হবে।

 

তাওহীদ ও শিরক

 

তাওহীদের সম্পূর্ণ বিপরীত পরিভাষা হলো শিরক  । তাওহীদ শব্দের অর্থ হলো অদ্বিতীয়তাবাদ।সাধারণ এর অর্থ করা হয় একাত্ববাদ। এ অর্থটি ত্রুটিপূর্ণ। আরবী ওয়াহিদ শব্দের অর্থ এক, আর আহাদ অর্থ অদ্বিতীয়।

 

قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ  বল যে, আল্লাহ অদ্বিতীয়। একের পর দুই, তিন ইত্যাদি সংখ্যা রয়েছে। তাই একাত্ববাদ বললে মূল মর্মটি বুঝায় না।অদ্বিতীয় মানে, যার কোনো সমকক্ষ নেই, এমনকি যার সাথে তুলনা করার মতোও কেউ নেই।

 

তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে র্শিক সম্বন্ধে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ তাওহীদ মানেই র্শিক না থাকা। তাওহীদের সবচেয়ে স্পষ্টও সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞাই হলো র্শিকমুক্ত ঈমান। যেমন আলোর সহজ সংজ্ঞা হলো অন্ধকার না থাকা। তাই শিরক সম্পর্ক বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

 

যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তারা কাফির। যারা শিরক করে তারা আল্লাহকো অস্বীকার করে না। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে বটে কিন্তু আল্লাহর সাথে অন্যান্য সত্তা বা শক্তিকে বিভিন্ন ভাবে শরীক করে। তাদেরকে মুশরিক বলা হয়।

 

শিরক শব্দটির অর্থ হলো শরীক করা। আল্লাহর সাথে কী কী ভাবে শরীক করা হয় তা বুঝতে পারলে শিরক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে এবং শিরক থেকে বেচে থাকাও সহজ হবে।

 

মাওলানা মওদূদী (র) তার বিখ্যাত তাফসীর তাফহীমুল কুরআনে সূরা আনআমের ১২৮নং টীকায় শিরক সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেনে এর সমামানের কোন আলোচনা আমি পাইনি। কুরআন মাজীদে শত শত আয়তে শিরকের কথা আছে এবং ঐসব জায়গায়ই টীকাও আছে। আমার জানা মতে সূরা আনআমের ১২৮নং টীকাতে শিরকের পূর্ণঙ্গ ব্যাখা পাওয়া যায়। অন্যান্য শত শত টীকায় কোথাও ১০% কোথাও ৫০% ব্যাখ্যা আছে।১২৮নং টাকাটি ভালোভাবে হজম করতে পারলে অন্যান্য টীকা পড়ার দরকারই হবে না। আমি সে ব্যাখাটিই এখানে পেশ করছি।

 

শিরক চার প্রকার

 

যারা আল্লাহর সাথে অন্য সত্তাকে শরীক করে তারা এ কাজটি চারভাবে করে থাকে।

 

১. আল্লাহর সত্তার (Person) সাথে শরীক করে।

 

যেমন কাউকে আল্লাহর পুত্র, কন্যা বা স্ত্রী সাব্যস্ত করে। কুরআনে আছে ঃ

 

وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ

 

ইহুদীরা হযরত ওযায়িরকে আল্লাহর পুত্র বলে। আর খ্রিষ্টানরা মাসীহ (আ) কে আল্লাহর পুত্র বলে। (সূরা তাওবাঃ ৩০)

 

খ্রিষ্টানরা হযরত ঈসা (আ) এর মা হযরত মারইয়াম (আ) কে আল্লাহর স্ত্রী মনে করে।

 

ফেরেশতাগণকে আল্লাহর কন্যা মনে করা হত বলে কুরআনে বহু জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। দেব দেবীদেরকেও আল্লাহর বংশ বলে বিশ্বাস করা হয়। কতক স্বৈরশাসক নিজেদেকে স্রষ্টার বংশধর বলে দাবি করেছে। এভাবেই আল্লাহর যাতের সাথে অন্য সত্তাকে শরীক করা হয়।

 

২. আল্লাহর গুণাবলির সাথে শরীক করা।

 

যেসব গুণ একান্তেই আল্লাহর সেসব গুণ কারো মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। যেমন গায়েবী ইলম বা অদৃশ্য স¤পর্কে জ্ঞান। কারো সম্পর্কে এমন ধারণা করা যে তিনি সবকিছু জানেন দেখেন বা শুনেন এবং সব দোষ ত্র“টি থেকে মুক্ত।

 

৩.  আল্লাহর ক্ষমতায় অন্য কোনো সত্তাকে শরীক করা। যেসব ক্ষমতা শুধু আল্লাহর সেসব ক্ষমতা আর কারো মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। যেমন

 

ক. আইন দেওয়া ক্ষমতা হালাল ও হারাম বা জায়েয ও না জায়েয এর সীমা নির্ধারণ করা। মানবজীবনের জন্য বিধি বিধান রচনা করা একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ার। আল্লাহর দেওয়া আইন রচনার ক্ষমতা আছে কিন্তু মৌলিক আইন রচনার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই।

 

খ.অলৌকিকভাবে কারো উপকার বা ক্ষতি করা প্রয়োজন পূরণ করা, হেফাযত করা রক্ষণাবেক্ষণ করা দোআ শোনা ও কবুল করা ভাগ্য গড়া ও ভাঙা ইত্যাদি আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে করার ক্ষমতা আছে মনে করা।

 

গ. সন্তান দান করা রোগ দেওয়া ও আরোগ্য করা রিযক দান আপদ বিপদ দেওয়া ও দূর করা ইত্যাদি শুধু আল্লাহর একক ক্ষমতা। এতে কেউ শরীক নেই।

 

৪.  আল্লাহর অধিকারে আর কাউকে শরীক করা।

 

যেমন রুকু ও সিজদা করা হাত বেধে নত হয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা দেখানো পশু কুরবানী করা বিপদ আপদে কাতরভাবে দোআ করা দয়া ও অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় কোনো কিছু দান করা ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য বা হক।

 

প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কারো অসন্তুষ্টির ভয় করা প্রয়োজন পূরণের ও বিপদ দূর করার জন্য দোআ করা নিঃশর্ত আনুগত্য করা সত্য ও অসত্যের মাপকাঠি গণ্য করা ইত্যাদি শুধু আল্লাহর হক। এসব হকের কোনোটি পাওয়ার যোগ্যতা অন্য কোনো সত্তার আছে বলে মনে করা শিরক। কুরআন মাজীদে বারবার ঘোষণা করা হয়েছে যে আল্লাহ তায়ালা শিরকের গুনাহ মাফ করবেন না। উপর্যুক্ত ৪ প্রকার শিরকের ১নং শিরক মুসলমারদের মধ্যে নেই। কিন্তু বাকি সব রকমের শিরকই মুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। এর প্রধান কারণ হলো শিরক সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা।

 

প্রচলিত শিরকের উদাহরণ

 

১. আমাদের দেশে মানুষের মনগড়া আইন চালু আছে। আল্লাহর আইন কায়েমের চেষ্টা না করলে বুঝা গেল যে মানুষের তৈরি চালু আইনকে মন থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এসব আইন বৈধ মনে করা যে শিরক তা অনেকেই বুঝে না। যারা এসব অবৈধ আইন উৎখাত করে আল্লাহর আইন চালু করার চেষ্টা করে তারা শিরক থেকে বেচে গেল।

 

২. রিযকের মালিক একমাত্র আল্লাহ। যে পেশাই গ্রহণ করা হোক ঐ পেশা রাযযাক নয়। ঐ পেশা নষ্ট হলেও আল্লাহ অন্য উপায়ে রিযক দিতে সক্ষম।

 

কোন স্কুল, কলেজ বা মাদরাসার শিক্ষক ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। ঐ সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রিযক বন্ধ করার ভয় দেখিয়ে দীনের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। যদি কেউ চাকরি চলে যাবার ভয়ে ইকামাতে দীনের কাজ বন্ধ করে দেয় তাহলে বুঝা গেল যে সে আল্লাহকে একমাত্র রাযযাক মনে করে না। সে চাকরিকেও রিযকদাতা হিসেবে আল্লাহর সাথে শরীক মনে করে। এভাবেই শিরক ঈমানকে দুর্বল করে। ঈমান শিরকমুক্ত না হলে মযবুত হতে পারে না। যে চাকরি বাচানোর জন্য আল্লাহর পথে জিহাদ করা বন্ধ করল আল্লাহর সাথে তার ঈমানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল।

 

কয়েক বছর আগে খুলনা থেকে এক যুবক আলেম আমার সাথে দেখা করলেন। বললেন আমি খুলনায় এক মসজিদের ইমাম ছিলাম। আমি প্রকাশ্যে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী হিসেবে দয়িত্ব পালন করছিলাম। মসজিদ কমিটিতে চরমোনাইর পীরের মুরীদদের সংখ্যই বেশি। তারা আমাকে জানালেন যে জামায়াতে ইসলামী ত্যাগ না করলে আমাকে ইমামতী ত্যাগ করতে হবে। আমি চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি। কারণ আমি বুঝে শুনে জামায়াতে কাজ করছিলাম।

 

যদি তিনি চাকরিতে বহাল থাকার জন্য জামায়াত ত্যাগ করতেন তাহলে এটা শিরক হতো এবং আল্লাহর সাথে তার ঈমানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেত। তিনি শিরক থেকে মুক্ত ছিলেন বলেই সাহস করে চাকরি ছেড়ে দিলেন।

 

এর বিপরীত উদাহরণই বেশি পাওয়া যায়। কুমিল্লা জেলার এক দাখিল মাদরাসার দু জন তরুণ শিক্ষক আমার সাথে দেখা করতে এলো। পরিচয় দিতে গিয়ে বলল আমরা দুজনই ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথী ছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা যেখানে শিক্ষকতা করছ ওখানে জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন নেই? জওয়াবে বলল, অবশ্যই আছে। বললাম, তাহলে জামায়াতের সাথে কী সম্পর্ক তা তো বললে না। বলল, মাদ্রাসার সুপার এত জামায়াতবিরোধী যে, আমরা জামায়াত করছি জানলে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেবে।

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি আল্লাহকে রায্যাক মনে কর না? বিস্মিত হয়ে এ কথা কেন বললাম তা জানতে চাইলে। বললাম, তোমরা ঐ মাদ্রসাকেও চাকরী বাচানোর জন্য দীনের দায়িত্ব অবহেলা করছে। এতে ঈমানের দুর্বলতাই প্রকাশ পেল। এতে আল্লাহর সাথে ঈমানী সম্পর্কটাই ছিন্ন হয়ে গেল কি না তোমরা ভেবে দেখ।

 

৩. আমাদের ধেশে অনেক লোক আজমীরে হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি (রা:) এবং বাগদাদে হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রা:) এর মাযারে গিয়ে তাদের নিকট সন্তানের জন্য, বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য, রোগ দূর করে দেওয়ার জন্য এবং আরও বিভিন্ন রকম মকসূদ হাসিলের উদ্দেশ্যে দোয়া করে। এসব দোয়া শুধু আল্লাহরই দরবারেই করা প্রয়োজন। বুজুর্গদের মাযারে গিয়ে দোয়া করা সুস্পষ্ট র্শিক। ওখানে গিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করাও সঠিক নয়। আল্লাহর কাছে চাওয়ার জন্য সেখানে যাওয়া অর্থহীন।

 

মাযার ও কবরের সাথে সম্পর্তিত বহু রকমের র্শিক ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে চালু রয়েছে।

 

তাগূতের অর্থ

 

তাগূত শব্দের অর্থ সীমালঙ্ঘনকারী। আল্লাহ তায়ালা আয়াতুল কুরসীতে তার সার্বভৌম গুণাবলি উল্লেখ করে তারপর বলেনঃ فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انفِصَامَ لَهَا ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

 

অতএব যে কেউ তাগূতকে অস্বীকার করে আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, সে এমন মযবুত রশি ধরেছে যা কখনও ছিড়বে না। আল্লাহ সব কিছু শুনেন ও জানেন। (সূরা বাকারাঃ ২৫৬)

 

আল্লহ তায়ালা গুণাবলি উল্লেখ করে এ আয়াতে যা বলা হয়েছে তা খুবই তাৎপর্যপূণ। বলা হয়েছে কেউ যদি উপর্যুক্ত গুণাবলিসম্পন্ন আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে চায় তাহলে প্রথমে তাকে তাগূতের কাফির হতে হবে। তাগূতের কাফির না হয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলে তাগূতের চাপে ও দাপটে সে ঈমানের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হবে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলে আল্লাহর সাথে যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তাগূতের চাপে ঐ সম্পর্ক বহাল থাকে না। তাগূতকে মানতে অস্বীকার করলে অর্থাৎ তাগূতের চাপকে অগ্রাহ্য করার হিম্মত করলে আল্লাহতর সাথে ঈমানের সম্পর্ক এমন মযবূত হয় যে তা আর ছিন্ন হয় না। আয়াতে ঈমানের এ সম্পর্কটিকে রশি বা রজ্জুর সাথে তুলনা করা হয়েছে।

 

এ কারণেই মযবুত ঈমানের শর্ত হিসেবে তাগূতকে অস্বীকার করতে হবে বা তাগূতের কাফির হতে হবে। তাই তাগূত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন বা তাগূতকে ঠিকমত চিনে নেওয়া দরকার।

 

তাগূত সম্পকর্কে তাফহীমুল কুরআনের টীকা পড়েও মনে তৃপ্তি বোধ না করায় সরাসরি মাওলানা মওদূদীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি যা বললেন তা নিম্নরুপ ঃ

 

আল্লাহতাআলা তার হুকুম মেনে চলার জন্য যেমন বাধ্য করেননি অমান্য করতেও বাধ্য করেননি। মানা ও না মানার ইখতিয়ার মানুষকে দিয়েছেন। আল্লাহর নাফরমানীর দুটো সীমা রয়েছে। প্রাথমিক সীমা হলো ফিসক আর চূড়ান্ত ও শেষ সীমা হচ্ছে কুফর। যে আল্লাহর হুকুম স্বীকার করে বটে কিন্তু পালন করে না সে ফাসিক। আর যে হুকুম কে স্বীকার করে না সে কাফির। যে নাফারমানীর এ দুটো সীমা লঙ্ঘন করে সেই তাগূত।

 

ব্যক্তিগত ভাবে কেউ ফাসিক বা কেউ কাফির হতে পারে। এটা যার যার ইখতিয়ার বা স্বাধীন ইচ্ছা। আল্লাহর নাফারমানীর এ দুটো সীমা রয়েছে। যে এ সীমাও লঙ্ঘন করে সে হলো তাগূত। এ দুটো সীমা লঙ্ঘন করার মানে কী? কেমন করে এ সীমা লঙ্ঘন করা হয়? এটা বুঝলেই তাগূতকে চেনা সহজ হবে।

 

যে নিজে ফাসিক এবং অন্য মানুষকেও ফাসিক বানানোর চেষ্টা করে সেই তাগূত। সে নাফরমানীর প্রাথমিক সীমা লঙ্ঘন করলো। যে নিজে কাফির এবং অন্যকেও কাফির বানানোর চেষ্টা করে সেই তাগূত। যে আল্লাহর নাফরমানীর শেষ সীমাও লঙ্ঘন করলো।

 

এখানে একটি কথা বিশেষভাবে বোঝার আছে। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকে নিজস্ব সত্তা দিয়ে আলাদাভোবে পয়দা করেন। যে দুনিয়ায় আসার সময় যেমন একা আসে, যাওয়ার সময়ও একাই যায়। আখিরাতে তাকে তার কৃতকর্মের ফল আলাদাভাবেই দেওয়া হবে।

 

তার শাস্তি সে একাই ভোগ করবে। পুরস্কারও যে একাই পাবে। তার কর্মের জন্য সেই দায়ী হবে। তাই তাকে আল্লাহর হুকুম অমান্য করার ইখতিয়ার এককভাবেই দেওয়া হয়েছে। অন্য মানুষকে আল্লাহর নাফরমান এবং বানানোর কোন ইখতিয়ার কাউকে দেওয়া হয়নি। যারা নিজে নাফরমানীর সীমা লঙ্ঘন করেÑ এরাই তাগূত।

 

তাগূতের পরিচয়

 

তাগূতকে মানতে অস্বীকার করতে হলে কে কে তাগূত তা জানতের হবে। কুরআনে তালাশ করলে ৫ প্রকার তাগূত পাওয়া যায়।

 

১.নাফস ও হাওয়া নাফস মানে প্রবৃত্তি, আর হাওয়া মানে কুপ্রবৃত্তি। দেহের যাবতীয় দাবিকে একসাথে নাফস বলা হয়। যে দাবি মন্দ তাকেই হওয়া বলে।

 

দেহের ভালো ও মন্দের কোনো ধারণা নেই। এ ধারণা আছে বিবেকের।রূহের সিদ্ধান্তই বিবেক। নাফস বা দেহের দাবি মন্দ বলেই ধরে নিতে হবে। বিবেক যাচাই করে বলে দেয় কোন দাবিটা ভালো বা মন্দ। সূরা ইউসূফের ৫৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ   নিশ্চয়ই নাফস মন্দেরই হুকুম দেয়। আল্লাহর নাফরমানীয় জন্য তাগিদ দেয় বলেই নাফস তাগূত।

 

যদি কেউ সত্যিই আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই নাফসের কাফির হতে হবে। কেউ যদি উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে চায় তাহলে প্রথমেই তাকে দৃঢ় সিদ্ধান্ত দিতে হবে, আমি নাফসের কথা মেনে চলব না-না-না। অর্থাৎ আমি বিবেকের বিরুদ্ধে চলব না-না-না।

 

এ সিদ্ধান্ত না নিলে যে আল্লাহর প্রতি আনা সত্তেও নাফসের গোলামউ থেকে যাবে। সে আল্লাহকে ইলাহ বা হুকুমকর্তা স্বীকার করা সত্তেও নাফস বা হাওয়াকে ইলাহ হিসেবেই মেনে চলবে।

 

সূরা ফুরকানের ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,   أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ

 

সুরা জাছিয়ার ২৩নং আয়াতে আছে,  أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ   অর্থ: তুমি কি তাকে দেখেছ, যে তার কুপ্রবৃত্তিকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছে? কুরআনের অনুবাদে অনেকেই তাগূত অর্থ লিখেছেন শয়তান। শয়তান আল্লাহর নাফরমানী করার জন্য উসকে দেয় বলে শয়তান অবশ্যই তাগূত। কিন্তু তাগূত অর্থ শয়তান নয়। যারা তাগূতের অর্থ শয়তান লিখেছেন, তারা তাগূতের সঠিক পরিচয় জানেন না। আমি শয়তানকে পৃথকভাবে তাগূত গণ্য করি না। কারণ শয়তান মানুষের নাফসকে বিভ্রান্ত করেই নাফরমানীর জন্য ওয়সওয়াসা দেয়। তাই প্রথম নম্বর তাগূতের মধ্যেই শয়তান অন্তর্ভূক্ত। সে হিসেবে নাফস ও শয়তানকে একই সাথে তালিাকর ১নম্বরে রাখা যায়।

 

২.শরীআতবিরোধী প্রচলিত কুপ্রথা ও সামাজিক কুসংস্কার ও তাগূত। (Customs and traditions)

 

সূরা বাকারায় আল্লাহ বলেন:  وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا ۗ

 

যখন তাদেরকে বলা হলো যে, আল্লাহ যা (ওহীযোগে) নাযিল করেছেন তা মেনে চল, তখন তারা বলল, আমাদের বাপ দাদাকে যা মেনে চলতে দেখেছি,আমরা তাই মেনে চলব।(সূরা বাকারা : ১৭০)

 

সমাজে বহু কুপ্রথা প্রচলিত আছে যা শরীআত বিরোধী।ধর্মের নামেও বহু শরীআতবিরোধী প্রথা চালু আছে। বিয়ে শাদিতে তো কুপ্রথার ব্যাপক প্রচলন আছে। কুপ্রথাগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। এসবকে অমান্য করতে গেলে বিরাট বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কুপ্রথাগুলো আইনের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। আইন চালু করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার (Law Enforcement Agency) প্রয়োজন হয়। কুপ্রথা নিজেন শক্তি বলেই চালু থাকে। আইন করেও তা দুর করা সহজ নয়। এ কারণেই সামাজিক কুসংস্কারগুলোও তাগূত। এসবকে মানতে অস্বীকার না করলে ঈমারের দাবি পূরণ করা যায় না। এগুলো আল্লাহর হুকুমের বিরোধী। এসব কে মেনে চললে আল্লাহকে অমান্য করা হয়।

 

৪. শাসন শক্তিও তাগূত। শাসন শক্তি বললে শুধু গভর্নমেন্টই বোঝায় না। স্বামী স্ত্রী সংসারে স্বামীও শাসন শক্তি। পরিবারে পিতা শাসক শক্তি। কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শাসন শক্তি। কিছু লোকের উপর কতৃত্ব করার সুযোগ যার আছে সেই শাসক শক্তি। একটি দেশে সরকার হলো সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক শক্তি। কুরআনে ফিরাউন ও নমরুদকে শাসক শক্তি হিসেবেই তগিূত বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মূসা (আ) কে ফিরাউনের নিকট যাওয়ার আদেশ যে ভাষায় দিলেন সেখানেও ফিরাউনকে সীমালঙ্ঘনকারী বলেই উল্লেখ করেছেন।

 

اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ

 

হে মূসা ফিরাউনের নিকট যাও। নিশ্চয়ই সে সীমালঙ্ঘন করেছে। সূরা ত্বাহা ঃ২৪

 

শাসক শক্তি প্রয়োগ করে অধীনস্থদের উপর আল্লাহর আইনের বিরোধী নিয়ম কানুন চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তারা আল্লাহর নাফারমানী করায় বাধ্য করতে পারে।তাই এসব তাগূত। আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবি হলো আল্লাহর নফারমানী করতে অস্বীকার করা। তা না করলে ঈমানে দুর্বলতাই প্রকাশ পায়।

 

৫. রিযক বন্ধ করার ভয় দেখানোর শক্তি ও তাগূত। এ তাগূতটি শাসন শক্তিরই অন্তর্ভুত।চাকরি থেকে সরিয়ে দিয়ে রিযক বন্ধ করার ক্ষমতা যাদের আছে তারা শাসক শক্তি বটে। তবু এটা পৃথকভাবে গণ্য করার যোগ্য তাগূত। শাসন শক্তি প্রয়োগ করে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দিতে পারে ও বিভিন্নভাবে ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু চাকরি থেকে বরখাস্ত করার শাস্তিটি চরম যুলম বলেই রিযক বন্ধ করার ভয় দেখানোর শক্তিকে শাসন শক্তি থেকে আলাদাভাবে গণ্য করা হলো। এ শক্তি প্রয়োগ করে  অধীনস্থদেরকে আল্লাহর নফারমানী করতে বাধ্য করা যায় বলেই এটা ও তাগূত।

 

৬. অন্ধভাবে মেনে চলার দাবিদার শক্তিও তাগূত। সমাজে এমন কতক লোক আছে যারা তাদেরকে অন্ধভাবে মেনে চলার জন্য নৈতিক প্রভাব প্রয়োগ করতে সক্ষম। তাদের দাবি হলো বিনা যুক্তিতে তাদের কথা মেনে চলতে হবে। বিনা প্রশ্নে তাদের আনুগত্য করতে হবে।বিনা বাক্য ব্যয়ে তাদের হুকুম পালনের অধিকার তারা দাবি করে।

 

অথচ আল্লাহ ও রাসূল (সা) ছাড়া এ দাবি আর কারো অধিকার নেই। যেহেতু আল্লাহ নির্ভুল এবং রাসূল (স) আল্লাহর ওহী দ্বারা পরিচালিত বলে তিনিও নির্ভুল সেহেতু এ দু সত্তাকে বিনা দ্বিধায় শর্তহীন ভাবে মেনে চলতে হবে।

 

এছাড়া আর কারো এ জাতীয় আনুগত্যের দাবিদার হওয়ার অধিকার নেই। তাই যারা এ দাবি করে তারাও তাগূত। সুরা তওবার ৩১নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,   اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ

 

তারা তাদের ওলামা ও পীরদেরকে আল্লাহর বদলে তাদের রব হিসেবে গ্রহন করেছে।

 

হদীসে এর অর্থ বলা হয়েছে যে তাদেরকে অন্ধভাবে মেনে নিয়েছে। তারা হালাল ও হারামের ব্যাপারে যে ফায়সালাই দেয় তা অন্ধভাবে স্বীকার করে নেয়। অন্ধভাবে মেনে নেওয়ার দাবিদার শক্তি ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেমন আছে, রাজনৈতিক ময়দানেও রয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত, নেতা বা নেত্রীর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক মনে হলেও অন্ধভাবে তা মানতে হয়, না মানলে দল থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে, এ ভয়ে মেনে নিতে বাধ্য হয়। তাই এ জাতীয় শক্তিও তাগূত। তাদের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের কারণে দীনের পথে বাধার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন একপীর সাহেব মুরীদদেরকে বললেন যে, তোমরা মওলানা মওদূদীর বই পড়বে না। পীরের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের কারণে যারা বই পড়লো না, তারা ইকামাতে দীনের পথ চিনতে ব্যর্থ হলো। আমার কয়েকজন তাবলীগী ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে মাওলানা মওদূদূীর বই পড়তে দিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ পর আরও বই নিয়ে গেলাম। আগের দেওয়া বই ফেরত চাইলাম। বই ফেরত দিলেন এবং আর কোনো বই নিতেই রাজি হলেন না।জিজ্ঞেস করলাম, বই কি পড়েছিলেন? জওয়াবে বললেন, এসব বই পড়তে মুরুব্বীরা মানা করেছেন। আমি বললাম, মুরুব্বীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন কেন? এর জওয়াবে যা বললেন তাতে বুঝলাম যে, এসব বই পড়েই আমি গুমরাহ হয়েছি বলে তাদেরকে পড়তে নিষেধ করেছেন। আমি বললাম, যদি কোনো বই পড়লেই ঈমান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে এমন দুর্বল ঈমান কী করে রক্ষা করবেন?

 

আমার খুব আফসোস হলো। যাদেরকে বই পড়তে দিয়েছিলাম তারা তাবলীগ জামায়াতেআমার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাদের একজন আমার হতেই রিক্রুট হয়েছেন। তারা তাগূতের খপ্পরে পড়ে ইকামাতে দীনের পথ চেনার সুযোগ না পাওয়ায় তাদের জন্য বেদনা বোধ করেছি। এ দীর্ঘ আলোচনায় পাঁচ রকমের তাগূত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল। মযবুত ঈমানের জন্য তাগূতকে অস্বীকার করা এ কারণেই অত্যন্ত জরুরি। সুরা নাহলের ৩৬ নং এ আয়াতটিতে আল্লাহ বলেন, আমি প্রত্যেক উম্মতের নিকট (এ নির্দেশ দিয়ে) রাসূল পাঠিয়েছি যে, তোমরা (একমাত্র) আল্লাহর দাসত্ব কর এবং তাগূত থেকে দুরে থাক।

 

নমরূদ ও ফিরাউন খোদায়ী দাবি করেছিল বলে বল হয়। কিন্তু তারা আসমান যমীন সৃষ্টি করার দাবি করেনি। তারা মানুষকে তাদের হুকুমের দাস বানিয়ে রেখেছিল। মানুষকে আল্লাহর দাস হতে বাধা দিয়ে নিজেদের দাস হতে বাধ্য করেছিল। এ অর্থেই তাদের সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা খোদায়ী দাবি করেছিল। তারা আধুনিক যুগের পরিভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ছিল মাত্র। তাগূতের কাজই হলো, আল্লাহর দাসত্ব থেকে ফিরিয়ে রেখে তার দাসত্ব করতে বাধ্য করা। তাই যারা আল্লাহর দাসত্ব করতে আগ্রহী তাদেরকে সচেতন ভাবে সবরকম তাগূতী শক্তিকে পরিহার করে তাদের থেকে বেচে থাকতে হবে।

 

কালেমায়ে তাইয়েবা তাগূত বিরোধী

 

কালোমায়ে তাইয়েবা لَا اِلَهَ اِلاَّ اللهُ    এর মূল কথা হলো, আল্লাহই একমাত্র ইলাহ, আর কোন ইলাহ নেই।এ বক্তব্য প্রকাশ করার জন্য واحد اِلَهَ الله বললেই তো চলতো। তা না করে لَا   দিয়ে কেন শুরু করা হলো? لَا মানে নেই। নেই দিয়ে কেন শুরু করা হলো? মানব সমাজে বহু হুকুমকর্তা রয়েছে। মানবমনের উপর এরা রাজত্ব করে। মানব এদের হুকুম মেনে চলে; হয় বাধ্য হয়ে, না হয় লোভে পড়ে। এসব হুকুমকর্তা (ইলাহ) হলো আসলে তাগূত। তাই যারাই কালেমায় তাইয়েবা কবুল করতে চায়। তাদেরকে মহান আল্লাহর উপর ঈমান আনার আগেই তাগূতকে অস্বীকার করতে হবে। এতে প্রমাণিত হলো যে, সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে যে ফরমে فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ    বলা হয়েছে সে ফরমেই প্রথমে অস্বীকার দ্বারা শুরু করা হয়েছে। ঐ আয়াতে আল্লাহর প্রতি ঈমার আনার আগেই তাগূতের কুফরী করতে বলা হয়েছে।আল্লাহ দ্বারা তাগূতকে অস্বীকার করার ঘোষণা দেওয়ার পরে   اِلاَّ اللهُ   বলে আল্লাহর প্রতি ঈমানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এটা বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। যারা তাগূতের পরিচয় জানে, তারা

 

লা ইলাহা’ দ্বারা কাদেরকে অস্বীকার করা হচ্ছে তা বুঝতেই পারে না। তারা না বুঝে তোতাপাখির মত কালেমা উচ্চারণ করে থাকে এবং তাগূদের দাসত্ব করতে থাকে।

 

একটি সহজ উদাহরণ

 

জমিতে ধানের বজি বপন করতে হলে প্রথমেই জমিকে আগাছামুক্ত করতে হবে।আগাছা দূর না করে ধান ফেললে ফসল তো দূরের কথ,বীজ ধানও ফিরে পাওয়া যাবে না।কৃষি জমি যেমন খালি থাকে না মানুষের মনের জমিও খালি থাকে না। ঐ রকম তাগূত মানবমন দখল করে থাকে। মনে ঈমানের বীজ ফেলতে হলে মন থেকে সব তাগূত কে তাড়াতে হবে। তা না হলে মনের যমীন ঈমানের বীজ বপনের জায়গাই হবে না।

 

তাগূতের সারকথা

 

আল্লাহ তআলা মানুষ ও জিনকে আল্লাহর দাসত্ব করার জন্য পয়দা করেছেন। আল্লাহ সূরা আয যারিয়াতের ৫৬নং আয়াতে ঘোষনা করেন,   وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

 

‘আমি জিন ও ইনসানকে আমার দাসত্ব করা ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। ‘

 

এ কথার একটি মর্ম হলো,  আল্লাহ শুধু তারই দাসত্ব করার জন্য তাদের কে সৃষ্টি করেছেন আর কারো দাসত্ব করার জন্য নয়। তাই যারা আল্লাহর দাসত্বের বদলে কোনো সৃষ্টি দাসত্ব করে তারা নিজেদেরকেই হেয় করে এবং মানুষ হিসেবে মার্যাদা হারায় তারা পশুর পর্যায়ে গণ্য হয়।

 

ঐ কথাটির অপর মর্ম হলো,  যারা আল্লাহর দাসত্ব করার সীমাবদ্ধ না থেকে প্রভুত্ব করার অপচেষ্টা চালায় তারাই তাগূতে পরিণত হয়। তারা আল্লাহর বান্দাদেরকে তাদের বান্দাহ বানায়। শাসন শক্তি রিযক বন্ধ করে দেওয়ার ভয় দেখানোর শক্তি ও অন্ধ আনুগত্যের দাবিদার শক্তি হিসেবে তারা আল্লাহর বন্দাহদের উপর প্রভুত্ব কায়েম করে চরম সীমালঙ্ঘনকারীতে পরিণত হয়।

 

এসব শক্তি আল্লাহর দাসত্ব করা থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখে এবং তাদের দাসত্ব করতে বাধ্য করে। তাই আল্লাহর দাসত্ব করতে হলে এসব শক্তি কে মানতে অস্বীকার করার সাহস থাকতে হবে। এ সাহস যাদের নেই তারা আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবিদার হলেও পদে পদে তাগূতের নিকট পরাজিত হতে থাকবে।

 

সূরা আনকবূতের প্রথম আয়াতেই আল্লাহ তাআলা বলেন - أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ

 

‘মানুষ কি মনে করে যে, আল্লাহর প্রতি ঈমন এনেছি বললেই তাদেরকে বিনা পরীক্ষায় ছেড়ে দেওয়া হবে?

 

ঈমানের পরীক্ষা আসে তাগূতের মাধ্যমে। তাগূতকে অমান্য করার সিদ্ধন্ত না থাকলে পরীক্ষায় অবশ্যই ফেল করবে।

 

মযবুত ঈমানের সুফল

 

আগেই বলা হয়েছে যে,  আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহকে র্‌  বাদশাহ ও ইলাহ হিসেবে মেনে চলার সিদ্ধান্তই ঈমান। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হলে ঈমানের দাবি পূরণ করতে হবে। ঈমানের দাবি পূরণ করতে হলে ঈমানকে দুবর্ল হতে দেওয়া চলবে না। ঈমানকে শুধু দুর্বলমুক্ত রাখাই যথেষ্ট নয়, ঈমানকে অত্যন্ত মযবুত করার জন্য ঐ দুটো শর্ত পূরণ করতে হবে।

 

যে মযবুত ঈমানের অধিকারী সে

 

১. দীনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধায় ভোগে না। সব অবস্থায় মনে প্রশান্তি ভোগ করে এবং তৃপ্তি বোধ করে। এ প্রশান্তি ও তৃপ্তি এমন বেহেশতী নিয়ামত, যার কোনো তুলনা নেই।

 

২. আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের সাফল্যের তীব্র কামনা এমন ভাবে অন্তর দখল করে রাখে যে, দুনিয়ার কোনো বড় স্বার্থের লোভেও বিভ্রান্ত হয় না।

 

৩. আল্লাহ সবসময় সাথে আছেন এ চেতনার ফলে দুঃখ কষ্ট, আপদ বিপদ ও রোগ শোকে বিচলিত ও পেরেশান হয় না এবং তাওয়াক্কুল আলল্লাহ ও সবরের নিয়ামত লাভ করে।

 

৪. একমাত্র আল্লাহর ভয় ছাড়া মৃত্যুভয়সহ সকল ভয় থেকে মুক্ত থাকে। মৃত্যুকে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার মহাসুযোগ মনে করে এবং শহীদী মৃত্যুই কামনা করে।

 

৫. দুনিয়ার যেসব জিনিসের ভালোবাসার দায়িত্ব আল্লাহ দিয়েছেন এসবের আকর্ষণ সত্ত্বেও আল্লাহ রাসুল (সা) ও জিহাদী ফী সাবীলিল্লহকে প্রাধান্য দেওয়ার যোগ্যতা হাসিল করে।

 

৬. সকল প্রকার শিরক থেকে ঈমানকে মুক্ত রেখে তাওহীদের দাবি পূরণ করতে সক্ষম হয়।

 

৭. সকল প্রকার তাগূতকে অস্বীকার করার হিম্মত রাখে এবং ঈমানের দাবি পূরণ করে তৃপ্তিবোধ করে।

 

সহীহ ইলম

 

ইলম মানে কী?

 

ইলম শব্দের আভিধানিক অর্থ জ্ঞান। কুরআনে ও হাদীসে কোনো কোনো স্থানে এ সাধারন অর্থে শব্দটি  ব্যবহার করা হলেও ইসলামী পরিভাষায় ইলম মানে ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান। রাসূল (সা) বলেছেন, ইলম তালাশ করা ফরয। যদি এখানে সব জ্ঞানই ফরয বুঝায় তাহলে নবীর পক্ষেও এ ফরয পালন করা সম্ভব নয়।

 

ইলম মানে জানার বিষয়। কোন প্রাণীই ইলম ছাড়া বাচতে পারে না। পশু পক্ষী এবং কীট পতঙ্গের ও জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে। পাখিকে উড়তে জানতে হবে। হাঁসকে সাঁতার জানতে হবে। মৌমাছির ফুল থেকে মধূ সংগ্রহ করার জ্ঞান দরকার। প্রতিটি জীবকেই বেঁচে থাকার জন্য খেতে হয়। সবার খাদ্য এক রকম নয়। কার খাদ্য কোনটা তা জানতেই হবে।

 

প্রত্যেক প্রাণীই নিজস্ব বাসস্থান প্রয়োজন। পাখি গাছে বাসা বানাতে জানে। শেয়াল মাটিতে গর্ত করে থাকার ব্যবস্থা করে। এ ব্যবস্থা করতে না জানলে তা করতে পারতো না।

 

জ্ঞান কোথা থেকে পাওয়া যায়?

 

যিনি সক প্রাণী সৃষ্টি করেছেন তিনি জ্ঞানের একমাত্র উৎস। মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণীর কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার হয় না। তাদের জ্ঞান অর্জনের জন্য স্কুল কলেজের প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিগতভাবেই তাদেরকে যার যার প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করেন। মৌমাছিকে মৌচাকের কতো চমৎকার শিল্প রচনার শিক্ষা তিনিই দিয়েছেন বলে কুরআনে উল্লেখ করেছেন এবং তা ওহীর মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন।

 

আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকেই ওহী বলা হয়। ওহীর শাব্দিক অর্থ হলো ইশারা, ইঙ্গিত, গোপনে দেওয়া ইত্যাদি। যার কাছে ওহী আসে সে তার চেষ্টা ছাড়াই তা পায়। স্রষ্টা গোপনে তাকে তা দেন। হাঁসের বাচ্চাকে তিনি গোপনেই সাঁতার শিক্ষা দেন। সে বিনা চেষ্টাই এ শিক্ষা পেয়ে যায়।

 

মানুষের কেন আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়?

 

মানুষ আর সব প্রণীর মতো নয়। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সেরা (আশরাফুল মাখলুকাত) হওয়ার মর্যাদা দান করেছেন। সকল প্রাণীই দেহসর্বস্থ, কিন্তু মানুষ দেহসর্বস্থ নয়। মানুষের দেহটি আসল মানুষ নয়। মানুষের দেহটি পশুই বটে। আসল মানুষটি কুরআনের ভাষায় ‘রূহ’। মানুষের দেহটি বস্তু দিয়ে তৈরি। মানুষ যা কিছু খায় ও পান করে তাতে যেসব বস্তু উপাদান রয়েছে সেসব উপাদান দিয়ে মানুষের দেহ তৈরি হয়েছে। তাই ঐসব খাদ্য ও পানীয় মানব দেহে ফিট হয়। অন্য কোনো উপাদান দেহ গ্রহণ করবে না। বিষ খেলে দেহের মৃত্যু হবেই।

 

‘রূহ’ কোন বস্তু সত্তা নয়। আমরা বিবেক বলতে যা বুঝি সেটা ‘রূহ’। এটা নৈতিক সত্তা। ভালো ও মন্দের চেতনাই হলো রূহ। এটাই আসল মানুষ। গোটা সৃষ্টিজগৎ মানুষের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে বলে কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। সব সৃষ্টিকে কাজে লাগানোর উপযোগী হিসেবেই দেহটি দান করা হয়েছে।

 

আল্লাহ তায়ালা সকল সৃষ্টির জন্যই প্রতিটি সৃষ্টির উপযোগী বিধান তৈরি করে তা নিজেই তাদের উপর চালু করে দিয়েছেন। মানুষের দেহের জন্যও তিনি বিধান তৈরি করে , নিজেই জারী করেছেন। এসব বিধান নবীর মাধ্যমে পাঠানো হয়নি। নবীর মাধ্যমে যেসব বিধান পাঠানো হয়েছে তা আল্লাহ্‌ নিজে জারী করেননা । নিজেই জারী করার সিদ্ধান্ত থাকলে নবীর মাধ্যমে পাঠাতেন না। নবীর নিকত ওহির মাধ্যমে প্রেরিত বিধান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে চালু করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নবীর উপর ও নবীর উপর যারা ইমান আনে তাদের উপর। বিধানটি অবশ্যই আল্লাহর। তার পক্ষ থেকে তার প্রতিনিধি (খলীফা) হিসেবে ঐ বিধান জারী করার দায়িত্বটিই খিলাফতের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে করতে হলে মানুষকে তার ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টা সাধনা প্রয়োগ করতে হবে। এ কাজ সচেতনভাবে করা ছাড়া উপায় নেই। অন্যান্য প্রণী বিনা পরিকল্পনায় চেতনাহীণ ও গতানুগতিক ধারায় জীবন যাপন করে। আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাদেরকে এভাবে পরিচালনা করেন। এর কোন চেতনা তাদের নেই।

 

মানুষকে সচেতনভাবে ও ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে সুপরিকল্পিতভাবে তার দেহসত্তাকে পরিচালনা করা এবং সৃষ্টিজগতকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর দেওয়া বিধানকে বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েচে। এ দায়িত্বই আল্লাহর খিলাফতের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে চেষ্টা করে অর্জন করতে হবে। তাই দুনিয়ায় মানুষের নৈতিক গুনাবলি অর্জনের জন্য সচেতনভাবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়। অন্যান্য পশুর প্রয়োজনীয় গুনাবলী যেমন তাদের মধ্যে আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়, মানুষের বেলায় তা হতে পারে না।

 

জ্ঞানই শক্তি

 

  এ কথাটি স্কুল জীবনেই পাঠ্য বইতে পড়েছি। কিন্তু এর মর্ম তখনো ভালোভাবে বুঝিনি। জ্ঞানের বলেই মানুষ শক্তিমান বিশালকায় প্রাণী এমনকি হিংস্র পশুকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জ্ঞানের শক্তিতেই মানুষও মানুষের উপর কর্তৃত্ব করে। রাসূল (সাঃ) এর নেতৃত্বে দায়িত্ব পালন করে এবং যতদিন ইসলামী শিক্ষার সাথে সাথে অন্যান্য শিক্ষায়ও তাদের প্রাধান্য ছিল ততদিনই তারা মানব জাতির নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছেন। মুসলিম জাতি ইসলামী আদর্শের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া সত্বেও জ্ঞান বিজ্ঞানে তাদের প্রাধান্যর কারণেই কয়েক’শ বছর বিশ্বে কর্তৃত্বের আসন দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু যখন মুসলিম জাতি রাষ্ট্রক্ষমতাকে ভোগের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করল এবং জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাদের শাগরিদারই পাশ্চাত্য মুসলিমদের থেকেও অগ্রসর হয়ে গেল তখন তারা জ্ঞানের প্রাধান্য বলেই মুসলিম দেশগুলো দখল করে নিলো। আজও বিশ্বে তাদের নের্তৃত্ব এ জ্ঞান শক্তির দরুনই অব্যাহত রয়েছে।

 

ওহীর জ্ঞানের শক্তি

 

সকল শক্তির উৎস আল্লাহ তায়ালা। তাই ওহীর জ্ঞানের শক্তিকে তিনি অন্যান্য জ্ঞানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরামের যুগে ওহীর জ্ঞানকে বাস্তব প্রয়োগ করার ফলে সে যুগের অন্যান্য জ্ঞানে উউনত রোম সম্রাজ্য ও পারস্য সম্রাজ্য মুসলিম জাতির নেতৃত্ব নিতে বাধ্য হয়। মুসলিম জাতি পার্থিব যাবতীয় জ্ঞানের শক্তি আহরণ করে মানব জাতির নের্র্তৃত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়।আজ ও আবার মুসলিম জাতি ওহির জ্ঞানকে মানব সমাজে বিজয়ী করার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারলে অতীতের মতোই রাষ্ট্র শক্তির অধিকারী হয়ে মানব জাতির নের্তৃত্বের মর্যাদা পুনরুদ্ধার এগিয়ে যেতে পারে।ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি নামক পুস্তকে মাওলানা মওদূদী বলিষ্ঠ যুক্তি ও বাস্তব উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে ইসলামী নৈতিকতা ও মৌলিক মানবীয় গুণের সমন্বয় হলে শুধু মানবীয় গুণের অধিকারীরা তাদের যাবতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সত্ত্বেও মুসলিমদের নিকট পরাজিত হতে বাধ্য।

 

ওহীর জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহ অবশ্যই বহাল রাখেন। কিন্তু ওহীর জ্ঞানকে বিজয়ী করার দায়িত্বে অবহেলা করে মুসলিম জাতি শুধু পার্থিব অন্যান্য জ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে ব্যর্থ হবে। কারন এ বিষয়ে আল্লাহর সাহায্য থেকে তারা বঞ্চিত থাকবে। দায়িত্বে অবহেলার অপরাধে দোষী সাব্যস্থ হওয়ার কারণেই তারা নেতৃত্বের অযোগ্য বলে গণ্য।

 

জ্ঞানের উৎস কী কী?

 

জ্ঞানের উৎস চারটি। যথা

 

১. ইন্দ্রিয়ঃ চক্ষু কর্ণ নাসিকা জিহ্বা ও ত্বকের সাহায্যে মানুষ জন্মের পর থেকেই জ্ঞান আহরণ করতে থাকে। এ জ্ঞান সরাসরি প্রত্যক্ষ পদ্ধতি তে অর্জিত হয়। এসব হাতিয়ার ও জানার বিষয়ের মাঝখানে আর কোনো মাধ্যম নেই। এ চারটি যন্ত্রের এক একটি দ্বারা বিশেষ ধরনের বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা যায়। এক যন্ত্র দিয়ে অপর যন্ত্রের উপযোগী বিষয় জানা যায় না। গন্ধের জ্ঞান শুধু নাক দিয়েই হাসিল করা যায়। অন্য চারটি যন্ত্রের সাহায্য তা জানার উপায় নেই। ইংরেজিতে এ সবকে ++++++ বলা হয়।

 

২. বুদ্ধিঃ আরবীতে আকল। মানুষ বুদ্ধির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জ্ঞান আহরণ করে থাকে। জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণের জন্য বুদ্ধি ই সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। ইন্দ্রিয় দ্বারা যতটুকু জানা যায় এরপর বুদ্ধিই মানুষকে জ্ঞানের ময়দানে আরও এগিয়ে দেয়।

 

চোখ দিয়ে কোথাও ধোয়া দেখা গেল। বুদ্ধি বলে উঠলো আগুন লেগেছে। চোখ কিন্তু আগুন তখনো দেখেনি । বুদ্ধি জানে যে আগুন লাগলেই ধোয়া হয়। কার্যকারণের যুক্তি বুঝবার ও বিশ্লেষণ করার শক্তিকেই বুদ্ধি বলে। এ শক্তি বলেই মানুষ জ্ঞানের মহাসমুদ্র থেকে জ্ঞান ভান্ডার আহরণ করে। গবেষণা ও জ্ঞান সাধনার প্রধান হাতিয়ার বুদ্ধি। এ শক্তি বলেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মানুষ দ্রুত এগিয়ে চলছে। সৃষ্টিজগৎ কে জানা এবং তাকে লাগাবার যোগ্যতা অর্জন করা বুদ্ধির সাহায্যেই সম্ভব হয়।

 

৩. ইলহামঃ এটা বুদ্ধির ঊর্ধ্বের এক বিশেষ উৎস। যারা যে বিষয়েই চিন্তা ভাবনা গবেষণা ও সাধনায় গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন, কখনো কখনো হঠাৎ কোনো জ্ঞান তাদের বুদ্ধির নিকট এসে ধরা দেয়। হয়তো দীর্ঘদিন বুদ্ধির প্রয়োগ করেও কোনো তত্ত্ব আয়ত্ত করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না হঠাৎ ঐ তত্ত্বটি তার জ্ঞানে এসে গেল। এ ধরনের জ্ঞানকেই ইলহামী জ্ঞান বলাহয়। এর বাংলা পরিভাষা প্রজ্ঞা হতে পারে। ইংরেজিতে +++অর্থ অভিধানে যা পাওয়া যায় তা হলো ===অর্থাৎ যুক্তি ছাড়াই হাঠাৎ মনে কোনো ধারণা সুষ্টি হওয়া। আরবীতে ইলহাম শব্দটি আরও স্পষ্ট। বুদ্ধি শক্তি প্রয়োগ করেও যে তত্ত্বটির নাগাল পাওয়া গেল না হঠাৎ তা বুদ্ধির আওতায় এসে গেল। তাই আমরা জ্ঞানের এ উৎসটিকে ইলহাম বলেই উল্লেখ করা যাথর্থ মনে করি। বাংলায় এর অনুবাদের প্রয়োজন নেই।

 

এটা অবশ্যই সত্য যে যারা জ্ঞান সাধনায় লিপ্ত ইলহামী জ্ঞান তাদেরই আয়ত্তে আসে যদিও ঐ জ্ঞানটি সাধনার সরাসরি ফসল নয়।

 

এ জাতীয় জ্ঞানের কয়েকটি উদাহরণ

 

ক. ইমাম আবূ হানীফা (র) কুরআন ও হাদীস গবেষণ করে বাস্তব জীবনে পালন করার উদ্দেশ্য ইজতিহাদ করে মাসআলা মাসায়েল বের করেছেন। কোনো সময় এমন ঘটনা ঘটেছে যে দীর্ঘ সময় চিন্তা গবেষণা করেও যে মাসআলাটির মীমাংসা করতে পারেননি তা এক সময় হঠাৎ তার মনে ধরা দিল। সকল মুজাতাহিদের জীবনেই হয়তো এমন ঘটনা ঘটে।

 

খ. আধুনিক বিজ্ঞানের জনক হিসেবে গণ্য মহাবিজ্ঞানী নিউটনের জীবনের একটা ছোট্র ঘটনা উল্লেখ করছি। তিনি আপেলের বাগানে বসে আছেন। তার সামনেই গাছ থেকে একটা আপেল মাটিতে খসে পড়লো। জীবনে বহুবার ই এমন দৃশ্য তিনি দেখেছেন। কিন্তু হঠাৎ সেদিন তার মনে এ প্রশ্ন বিরাট হয়ে দেখা দিল যে আপেলটি উপরে বা ডানে বায়ে না যেয়ে সোজা মাটির দিকে কেন আসল? চারদিকেই তো শূন্যতা বিরাজ করছে। কোনো দিকে না যেয়ে শুধু নিচের দিকে কেন এলো? তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হলো যে নিশ্চয়ই এমন কোনো শক্তি রয়েছে যা আপেলটিকে মাটির দিকে টেনে এনেছে। এই হাইপথেসিস এর উপর চালিয়ে শেষ পযর্ন্ত তিনি বিখ্যাত মতবাদ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করেন।

 

গ. গ্রীক বিজ্ঞানী আকিমেডিসের ঘটনা। বিজ্ঞানের একটি সূত্র তালাশ করে না পেয়ে তিনি রীতিমতো বিষণ্ণ ও বিমর্ষ অবস্থায় পানির টবে গোসল করছিলেন। যারা পানি ভর্তি টবে গোসল করে তারা উলঙ্গ অবস্থায়ই পানিতে নাক জাগিয়ে শুয়ে থাকে। তিনিও ঐ অবস্থায়ই ছিলেন। হঠাৎ ঐ সূত্রটি তার জ্ঞানে এসে ধরা দিল। সাফল্যের আনন্দে তিনি টব থেকে নেমে ইউরেকা ইউরেকা (পেয়েছে, পেয়েছি) বলে চিৎকার করে উঠলেন। বস্ত্রহীন অবস্থায়ই তিনি বাথরুম থেকে বের হয়ে গেলেন। খুশির আতিশয্যে গায়ে জামা পরার হুশ ও রইল না।

 

৪. ওহীঃ জ্ঞানের এ মহা উৎসটি কোনো মানুষের আয়ত্তে নেই। আল্লহ তাআলা যাকে নবী রাসূল নিয়োগ করেন তার নিকটই তিনি বিশেষ পদ্ধতিতে ওহীর জ্ঞান পরিবেশন করেন। এজ্ঞান নবী রাসূলের চেষ্টা সাধনার ফসল নয়। সরাসরি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে তারা লাভ করেন।

 

হদীস থেকে জানা যায় যে কিভাবে রাসূল (সা) এর নিকট ওহীর জ্ঞান পৌছতো। কয়েক পদ্ধতি তে ওহী লাভ করতেন।

 

ক. স্বপ্নযোগে ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি জ্ঞান লাভ করতেন।

 

খ. কোনো কোনো সময় ঘণ্টার আওয়াজ শুনতে পেতেন। তখন তিনি স্থির হয়ে থাকতেন এবং ওহী লাভ করতেন। এ পদ্ধতিটি তার জন্য বেশ কষ্টকর হতো। তিনি প্রচন্ড চাপ বোধ করতেন। শীতের সময়ও তার চেহারা মুবারক থেকে ঘামের ফোটা টপকে পড়তো। উটের পিঠে বসা থাকলে চাপের কারণে উট মাটিতে বসে পড়তে বাধ্য হতো।

 

গ. কখনো কখনো হযরত জিবরাঈল (আ) মানুষের আকারে এসে রাসূল (সা) কে তিলাওয়াত করে শুনিয়ে দিতেন।

 

ঘ. রাসূল (সা) এর মনে ওহীর জ্ঞান ঢেলে দেওয়া হতো।

 

দ্বিতীয় ও তৃতীয় পদ্ধতিতে প্রাপ্ত জ্ঞনই ভাষাসহ নাযিল হতো এবং তা কুরআনের অংশ হিসেবে গণ্য হতো। এ প্রকারের ওহীকে ওহী মাতলূ বলা হয় যা তিলাওয়াত করা হয়।

 

প্রথম ও চতুর্থ পদ্ধতিতে যে ওহী আসতো তাতে রাসূল (সা) এর মনে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভাবের আকারে জ্ঞান দেওয়া হতো। কুরআনের আয়াতের মতো ভাষায় নাযিল হতো না। রাসূল (সা) আল্লাহর দেওয়া ঐ সব ভাবকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করতেন। এসব জ্ঞানই হাদীস হিসেবে পরিচিত। এ ওহী হলো গাইরি মাতলূ যা কুরআনের মতো তিলাওয়াত করার জন্য নয়।

 

ওহীর জ্ঞান অত্যন্ত ব্যাপক। কুরআনের বাইরে ওহীর জ্ঞানের বিরাটা ভাণ্ডার রয়েছে। রাসূল (সাঃ) যা বলেছেন যা করেছেন ও সাহাবায়ে কেরামের যেসব কথা ও কাজকে আপত্তিজনক বলে উল্লেখ করেননি তা সবই ওহীর জ্ঞানের মধ্যে শামিল।

 

কুরআনে যা আছে এর ভাব ও ভাষা সম্পূর্ণ আল্লাহর। তাই কোনো কিছু মানতে অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যায়।আর বাকি ওহীর কোনো কথা যুক্তির ভিক্তিতে গ্রহন করতে অস্বীকার করলে কাফির বলে গণ্য করা হয় না। রাসূল (সা) এর কথা কাজ ও অনুমোদনকে হাদীস বলা হয়। হাদীস থেকে মুহাদ্দিসগণ ও ফকীহগণ যা সুন্নাহ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন তা কুরআনেরই বাস্তব ব্যাখা।কুরআন ও সুন্নাহ মিলেই ইসলাম। যারা সুন্নহ কে অস্বীকার করে তারা মুসলিম হিসেবে গণ্য নয়।

 

সহীহ ইলমের গুরুত্ব

 

সকলজ্ঞানই বিশুদ্ধ বা খাঁটি নয়। নির্ভূল জ্ঞানকেই আরবীতে সহীহ বলা হয়। যেমন বুখারী শরীফের নাম সহীহ আল বুখারী।

 

জ্ঞান ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না। যা ই করা হোক সে বিষয়ে জ্ঞান ছাড় তা করা সম্ভব নয়। কর্মের পিছনে জ্ঞনই চালিকা শক্তি।  কিন্তু জ্ঞান যদি নির্ভুল না হয় তাহলে কর্মের উদ্দেশ্যেই ব্যর্থ হতে বাধ্য। শুধূ তাই নয়, সহীহ জ্ঞান না থাকলে জীবনই বিপন্ন হতে পারে। গাড়ির ড্রাইভার যদি সঠিক জ্ঞানের অধিকারী না হয় তাহলে এক্সিডেন্ট করে গাড়ি ধ্বংসের সাথে সাথে নিজের জীবনও হারাতে পারে। তাই সব বিষয়েই যা সঠিক জ্ঞান তা অর্জন করতে হবে। ভূল জ্ঞান মারাত্মক।

 

এ বিষয়ে একটি উদাহরণই যথেষ্ট সকল মানুষই সুখ শান্তি চায়। এমন একজন মানুষও পাওয়া যাবে না, যে সুখ শান্তি পছন্দ করে না। যে যাই করে নিজের মঙ্গলের উদ্দেশেই করে। এমনকি যে আত্মহত্যা করে সেও সুখ শান্তি পাওয়ার নিয়তেই করে। সে মনে করে যে তার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওায়াই বেশি ভালে। এ বিষয়ে তার নিয়ত যতই সহীহ হোক তার জ্ঞান মোটেই সহীহ নয়।

 

দুনিয়ায় সবাই সুখ শান্তি চায় । যা কিছু সে করে এ উদ্দেশ্যেই করে। অথচ কয়জন সত্যিকার অর্থে শান্তি ভোগ করে? সুখ শান্তি পাওয়ার নিয়তেই সন্ত্রাস,চাঁদাবাজি ,চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ ,খুন ইত্যাদি করে এবং পরিনামে দুনিয়াতেই চরম অশান্তি ভোগ করে। এর একমাত্র কারনই হল, সহীহ জ্ঞানের অভাব । এবং কোন মেশিন যে বানায় সেই  এবং এর সঠিক ব্যবাহারের সহীহ জ্ঞান রাখে। তাই ঐ মেশিন কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তা স্পষ্ট ভাষায় ছবি এঁকে লিখে দেয়। ঐ নিয়মে ব্যবহার করলেই মেশিন ব্যবাহরের উদ্দেশ্যে সফল হবে। ঐ সহীহ জ্ঞানের বদলে যদি ভুল নিয়মে ব্যবহার করে তাহলে মেশিনেইবিনষ্ট হয়ে যেতে পারে।

 

আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে তার নিজের দেহ ও দুনিয়ার যাবতীয় বস্তু কিভাবে ব্যবাহার করতে হবে সে বিষয়ে নবী রাসূলের মাধ্যমে সহীহ জ্ঞান দিয়েছেন। এ জন্য প্রথম মানুষটিকে নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন , যাতে সহীহ  জ্ঞানের অভাব কেউ বিপদে না পড়ে।

 

আধুনিক বিশ্বে যারা নিজ দেশের বা মানব জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা  এর কোন প্রয়োজনই বোধ করেন না। তাঁরা মেধা, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসেস শিক্ষাকেই যথেষ্ট মরে করেন। তাই তারা মানব সমাজকে সুখ শান্তি দেবার সহীহ নিয়ত থাকা সত্ত্বে ও চরম অশান্তি ভোগ করতে বাধ্য করেছেন। সূরা রূমের ৪১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,  ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ

 

‘জলে স্থলে যে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে তা মানুষের দু হাতের কামাই’।

 

আল্লাহ তায়ালা বলতে চান যে, অশান্তি ও বিপর্যয় তিনি জোর করে মানব সমাজের উপর চাপিয়ে দেননি। মানুষ নিজেরাই নিজেদের মনগড়া ভ্রান্ত জ্ঞানের কারণে অশান্তি ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছে।

 

সহীহ ইলমের উৎস

 

উপরে যে চারটি জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এ সবের মধ্যে একমাত্র ওহীর জ্ঞানকেই নিশ্চিতরূপে সহীহ মনে করতে হবে। অন্য তিনটি উৎস থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান শুদ্ধও হতে পারে, অশুদ্ধও হতে পারে। তাই ওহীর জ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করেই অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান সহীহ কিনা, সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডার বিশাল ও ব্যাপক। যুগে যুগে বহু মনীষীর আহরিত জ্ঞান ঐ মহা ভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে। কোন জ্ঞান অমুসলিম মনিষীর চিন্তার ফসল হলেও ওহীর কষ্টিপাথারে যাচাই না করে তা পরিত্যাগ করা মোটেই উচিত নয়। আর মুসলিম কোনো মনীষীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকেও ওহীর মানদন্ডে যাচাই না  করে সহীহ বলে গ্রহণ করা উচিত নয়।

 

তাই মানব জাতির মধ্যে প্রতিটি দেশই ওহীর জ্ঞানে সমৃদ্ধ একদল মানুষ সকল যুগেই গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিশেষ করে যারা নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করবে তারা ওহীর জ্ঞানে আলোকিত না হলে মানব সমাজের কেমন দুর্দশা হয় তা আধূনিক বিশ্বে বাস্তব প্রমাণিত।

 

কোন ইলম তালাশ করা ফরয?

 

রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন:  طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ

 

‘প্রত্যেক মুসলিমের (নর নারী) উপর ইলম তালাশ করা ফরয’।এখানে ইলম দ্বারা একমাত্র ওহীর ইলম বুঝতে হবে। দুনিয়ার সকল ইলম হাসিলের চেষ্টা করা ফরয হতে পারে না। কোন অসম্ভব কাজের দায়িত্ব রাসূল (সাঃ) মানুষের উপর চাপাতে পারে না। কারণ তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকেই ওহীর জ্ঞানে পরিচালিত। আগেই বলেছি, কুরআন ও হাদীসের পরিভাষা হিসেবে ইলম মানেই ওহীর ইলম।

 

ইলম কতটুকু ফরয?

 

ফরয মানে অবশ্য পালনীয়, যা পালন না করলে আল্লাহ শান্তি দেবেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, ওহীর ইলম তো বিশাল ও ব্যাপক। ৩০ পারা কুরআন এবং লক্ষ লক্ষ হাদীস সবইতো ওহীর ইলম। যদি এ ইলমের সবটুকু অর্জন করা ফরয হয় তাহলে রাসূল (সাঃ) ছাড়া আর কারে পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাহলে নিশ্চয়ই ওহীর সবটুকু ইলমই তালাশ করা ফরয হতে পারে না।

 

তাহলে এটা কেমন করে নির্ণয় করা যাবে যে, কতটুকু ইলম হাসিল করা ফরয? এটা খুবই গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ প্রশ্নের সঠিক জওয়াব না জানলে মুসলিম হিসেবে সঠিকভাবে জীবন যাপন করা একেবারেই অসম্ভব।

 

একটি বাস্তব উদাহরণ দিলে এ প্রশ্নে সঠিক জওয়াব সহজেই বুঝে আসবে। যার উপর হজ্জ যাকাত ফরয নয়, তার ঐ বিষয়ে জানা আবশ্যক নয়। যার উপর যাকাত ফরয তাকে এ দায়িত্ব পালন করতে হলে ওহীর ইলম থেকে জানতে হবে যে,কোন কোন সম্পদের কী পরিমাণের মালিক হলে যাকাত ফরয হয় এবং এর হিসাব কিভাবে করতে হয়, কত মালের কত পরিমাণ যাকাত আদায় করতে হয় এবং কোন কোন খাতে যাকাত খরচ করলে ফরযটি সঠিক ভাবে আদায় হবে। যার উপর যাকাত ফরয নয় তার এসব বিষয়ে জানা জরুরী নয়।

 

এ একটি মাত্র উদাহরণ থেকে ঐ প্রশ্নের সহীহ জওয়াব পাওয়া যায়। জওয়াবটি তাহলে এভাবে প্রকাশ করলে বুঝতে সহজ হবে।

 

যার উপর যে দায়িত্ব পালন করা ফরয, সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের প্রয়োজনে ওহীর যতটুকু ইলম জানা জরুরী ততটুকু ইলম অর্জনই ফরয। এ দায়িত্ব বলতে শুধু ধর্মীয় বিষয়ই বুঝায় না। মানুষ হিসেবে দুনিয়ায় জীবন যাপন করতে হলে যত রকম দায়িত্ব পালন করতে হয় সে সবই এর আওতায় পড়ে।কেননা মুমিনের জীবনে দুনিয়াদারি ও দীনদারিতে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহর হুকুম ও রাসূল (সাঃ) এর তরীকা অনুযায়ী যে কাজ করা হয় তা ই দীনদারি। আয় রোজগার, ব্যবসা বাণিজ্য, বিয়ে শাদী ইত্যাদি দায়িত্ব শরীআত মোতাবেক করাও দীনদারি। লোক দেখাবার উদ্দেশ্যে লাখ টাকার কুরবানী দিলে বা নিজের নামে আলহাজ্জ লেখার নিয়তে হজ্জ করলে তা দুনিয়াদারিতে পরিণত হয়। দানশীল হিসেবে সুনামের উদ্দেশ্যে দান খয়রাত করার পুরস্কার আখিরাতে পাবে না এবং বীর ও বাহাদুর হিসেবে খ্যাতি লাভের জন্য জিহাদের ময়দানে শহীদ হলেও দোযখে যেতে হবে বলে রাসূল (সাঃ) বলেছেন।

 

মুমিনের দু দফা ঘোষণা

 

আসলে মুমিন ও মুসলিম ঐ লোককেই বলা হয়েছে, যে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের সাঃ তরীকা অনুযায়ী জীবন যাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ উচ্চারণ করা মানে না বুঝে কোন মন্ত্র জপা নয়; আসলে এ দুটো ঘোষণা জীবনের নীতি নির্ধারণী দফা ==

 

প্রথম দফা হলো, আমি আল্লাহর হুকুম মেনে চলব, এর বিপরীত কোন হুকুমই মানব না।

 

দ্বিতীয় দফা হলো, আল্লাহর প্রতিটি হুকুম আমি একমাত্র রাসূলের শেখানো তরীকা অনূযায়ী পালন করব, আর কোন তরীকা আমি গ্রহণ করব না।

 

এ দুটো ঘোষণা অনুযায়ী দুনিয়ার জীবনে যে কাজই করা হোক তা দীনদারি হিসেবে গণ্য।

 

ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো কতক ধর্মীয় অনুষ্ঠানসর্বস্ব নয়। দীন ইসলাম মানে ইসলাম ধর্ম নয়। দীন ইসলাম মানে ইসলামী জীবনব্যবস্থা। দীন মানে আনুগত্য। আল্লাহর আনুগত্যের ভিত্তিতে জীবন যাপনের বিধানের নামই দীন ইসলাম। এর অনুবাদ ইসলাম ধর্ম নয়। এ অনুবাদে ইসলামকে নিছক একটি ধর্ম বুঝায়। তাই ‘ইসলাম ধর্ম’ কথাটি মারাক্তক ভুল অনুবাদটি। আল্লাহ্‌ ও কোরআন   শব্দ দুটোর অনুবাদ না করেই আমারা বলে থাকি। দীন ইসলমের ও অনুবাদের  প্রয়োজন নেই। এর মর্ম বুঝে নিলেই যথেষ্ট। যেমন আল্লাহ,কুরআন ও রাসূল বললে আমরা অনুবাদ ছাড়াই বুঝি। কালেমা তাইয়্যেবার এ ব্যাখ্যা যারা সঠিক মনে করে তারা দুনিয়াদারি দীনদারিকে আলাদা মনে করে না। তাই তার পার্থিব দায়িত্ব ও আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা অনুযায়ী পালন করতে হবে বলে বিশ্বাস করে। তাই প্রতিটি দায়িত্বের ব্যাপারেই আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা জানা ফরয।

 

কতক উদাহরণ

 

১. আজ একজন যুবক ও একজন যুবতীর মধ্যে বিবাহের বন্ধন হলো। তাদেরকে মুসলিম স্বামী ও মুসলিম স্ত্রী হিসেবে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা মেনে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে হবে। তাই এ বিষয়ে যতটুকু ওহীর ইলম জানা প্রয়োজন তা অর্জন করা ফরয। গতকাল পর্যন্ত ও তা জানা ফরয ছিল না। যদি তারা তা না জানে তাহলে তারা কাফির দম্পত্তির মতোই জীবন যাপন করবে।

 

২. যেদিন এ দম্পত্তির ঘরে সন্তান আসবে সেদিন পিতা ও মাতার দায়িত্ব সম্পর্কে ওহির  জ্ঞান তালাশ তাদের জন্য ফরয হয়ে যাবে।

 

৩. একজন ব্যবসায়ী যদি মুসলিম হিসেবে ব্যবসা করতে চান তাহলে এ বিষয়ে ওহীর জ্ঞান হাসিল কর হার উপর ফরয। যদি তা তিনি না জানেন তাহলে তিনি কাফির ব্যবসায়ীর মতোই দায়িত্ব পালন করবেন।

 

৪. যদি কোন মুসলিমের উপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় তাহলে এ সংক্রান্ত যাবতীয় ইরম হাসিল করা তার উপর ফরয হয়ে যাবে। তা না জানলে তিনি কাফির শাসকের মতেই দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি নিজেকে ধর্ম নিরপেক্ষ বরে দাবি করুন আর নাই করুন, বাস্তব তিনি মুসলিম শাসক হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন না।

 

যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি বিচারকের আসনে বসেন তাহলে তাকে বিচার সম্পর্কে শরীআতের যাবতীয় বিধান আয়ত্ত করতে হবে। তা না হলে কাফির বিচারকের মতো তাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে । বিচারকের আইন রচনার ক্ষমতা নেই। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাঁকে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। এসত্ত্বে ও ন্যায় বিচারের দায়িত্ব পালনের জন্য শরীআতের বিধান তাকে জানতে হবে এবং যথাসাধ্য তা প্রয়োগ করতে হবে।

 

নফল ইলমের মর্যাদা কী?

 

যার উপর যাকাত ফরয নয় তার জন্য তো ঐ বিষয়ে জীবন সম্পর্কে ওহীর ইলম তালাশ করা ফরয নয়; কিন্তু সে যদি তা অর্জন করে তাহলে তা নফল হিসেবেই গণ্য হবে। এখন প্রশ্ন হলো, নফল ইলম হাসিলের মর্যাদা কতটুকু?

 

তেমনিভাবে যে এখনও বিয়ে করেনি সে যদি দম্পত্য জীবন সম্পর্কে ওহীর ইলম অর্জন করে তাহলে এ কাজটি কি বেহুদা বা ফালতু কাজ বলে গণ্য হবে?

 

যার উপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেই যদি এ বিষয়ে ইলম অর্জন করে তাহলে এটাকে কি বেগার শ্রম মনে করা হবে?

 

একটি হাদিসে থেকে এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট জওয়াব পাওয়া যায়। হাদীসটি হলো,

 

রাতের কিছু সময় ইলম চর্চা করা (শেখানো ও শেখা) সারা রাত জেগে (অন্য নফল ইবাদত) থাকার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

 

এ হাদিসে থেকে জানা গেল যে, সকল নফল ইবাদতের মধ্যে নফল ইলম চর্চা করা শ্রেষ্ঠ ইবাদত। এ কারণেই যে আলেম নয় শুধু আবেদ তার তুলনায় আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব হাদিসে চমৎকার ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছেঃ যে দীনের একজন আলেম শ্রেষ্ঠ, যদি ও তিনি এত নফল এবাদত হয়তো করেন না। এর দ্বারা সকল নফল ইবাদতের মধ্যে নফল ইলম চর্চার মর্যাদা অনেক বেশি বলে প্রমাণিত হয়। এ বিষয়ে ৩টি হাদিসই যথেষ্ট। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন-

 

১.  فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِى عَلَى أَدْنَاكُمْ

 

আবেদের উপর আলেমের তেমনি শ্রেষ্টত্ব যেমন তোমাদের একজন সাধারণ লোকের উপর আমার মর্যাদা ( তিরমিজি হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩, সনদ হাসান।)

 

২. আবেদের উপর আলেমের তেমনি শ্রেষ্ঠত্ব যেমন সকল তারকার উপর পূর্ণিমার চাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব।

 

৩.শয়তানের উপর একজন ফকীহ একজন ফকীহ (ইসলামী বিধানে জ্ঞানী) ব্যক্তি এক হাজার আবেদের চেয়েও শক্তিমান।

 

ওহীর ইলমের এ মর্যাদার কারণেই প্রত্যেক শিক্ষিত মুসলিমের জন্য ইসলামের জ্ঞান অর্জনের সকল সুযোগ গ্রহণ করা উচিত। যদি সব সময় ইসলামী সাহিত্যে সঙ্গে রাখা হয় তাহলে সুযোগ পেলেই তা থেকে ইলম হাসিল করা যায়। আর সুযোগ তো পাওয়াই যায়।

 

১. কারো সাথে দেখা করতে গেলে কোন কারণে কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হলে সময় পাওয়া যায়। যিকর করে বা দরূদ পড়েও এ সময়টা কাটানো যায়। কিন্তু ইলম হাসিলে করার মর্যাদা অনেক বেশি।

 

২. জলপথে, সড়ক পথে ও বিমানে প্রচুর সময় বেকার কেটে যায়। সাথে ইসলামী বই থাকলে সময়টা শ্রেষ্ঠ কাজে লাগানো যায়।

 

৩. শহরে যানজটে পড়লে দীর্ঘ সময় নষ্ট হয়ে যায়। সাথে ইসলামী সাহিত্যে থাকলে সময়টা সেরা কাজে ব্যয় হতে পারে।

 

৪. বিছানার পাশে ইসলামী বই থাকলে ঘুম আসবার আগে কিছু ইলম হাসিল করা যায়।

 

৫. বই সাথে থাকলে কোথাও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময়টাকেও অপচয় থেকে বাঁচানো যায়।

 

পার্থিব অন্যান্য জ্ঞানের কোনো শরয়ী মর্যাদা আছে কী?

 

কৃষিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা ইত্যাদি জ্ঞান ওহীর ইলম নয় বটে, কিন্তু এ সবের কোনো মর্যাদা ইসলামী দৃষ্টিতে আছে কিনা? এসব বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা তো স্বীকার করতেই হবে, তবে এ সব বিদ্যা অর্জন করাটা কি নিছক দুনিয়াদারি ব্যাপার? এসবের কি কোন শরয়ী মর্যাদা আছে?

 

একটি হাদীস থেকে এবিষয়ে আমরা এর সঠিক জওয়াব জানতে পারি।

 

‘অন্য সব ফরযের পর হালাল রুজী তালাশ করাও ফরয।‘

 

এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, হালাল উপায়ে রোজগারের চেষ্টা করা ফরয। তাহলে আয় রোজগারের উদ্দেশ্যে কোন নাকোন পেশা অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। যে পেশাই গ্রহণ করা হোক এর জন্য নির্দিষ্ট বিদ্যা অজর্ন করতেই হবে। ডাক্তারি পেশা গ্রহণ করলে তাকে ডাক্তারি বিদ্যা শিক্ষা করতেই হবে। চিকিৎসা করে রোগীদের নিকট থেকে টাকা নিয়েইযারা রুজী যোগাড় করে তারা যদি চিকিৎসা বিদ্যা ভালোভাবে আয়ত্ত না করে, যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন সে বিষয়েও প্রেসক্রিপশন লিখে রোগীর সাথে প্রতারণা করে তাহলে তার আয় হালাল হবে না। তাই তার আয় হালাল করার প্রয়োজনেই তাকে ঐ বিদ্যা যথাযথভাবে অর্জন করতে হবে। ডাক্তারি বিদ্যা না শিখেই হাতুড়ে চিকিৎসকরা যে আয় করে তা কি হালাল হতে পারে?

 

তাহলে একথা প্রমাণিত হলে যে, হালাল রেজগারের চেষ্টা করা ফরয এবং রুজী হালাল করার প্রয়োজনে পেশাগত বিদ্যা যথাযথ শিক্ষা করা জরুরী। সুতরাং পার্থিব সব বিদ্যা অর্জন করা সরাসরি ফরয নয় বটে, কিন্তু পরোক্ষভাবে তাও ফরযের মর্যাদার অধিকারী। যিনি শিক্ষক তাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তার রুজীকে হালাল করতে হলে তাকে তার বিষয়ের যথাযথ জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে তাকে পাঠ দানের বিদ্যাও আয়ত্ত করতে হবে। যে শিক্ষকের ক্লাসে ছাত্ররা পাঠদানে সন্তুষ্ট নয় তার বেতন হালাল হবে কি? যে শিক্ষক যোগ্যতার সাথে পড়ান ছাত্ররা তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। ছাত্রদের মন্তব্য থেকেই জানা যায় যে, কে ভালো শিক্ষক, আর কে ভালো নয়। এভাবেই আমরা পেশাগত বিদ্যার শরয়ী মূল্যায়ন করতে পারি।

 

শখের বিদ্যার মর্যাদার কী?

 

পেশার অতিরিক্ত কোন বিদ্যা শখ করে কেউ কেউ শিখে থাকে। যেমন হস্তরেখা বিদ্যা, জোতিবিদ্যা, ভাস্কর্যও চিত্রঙ্গণ বিদ্যা, যাদু বিদ্যা, গার্ডেনিং ইত্যাদি। মানব সমাজের জন্য কল্যাণকর যে কোন বিদ্যাই শিক্ষা করা যেতে পারে পেশাগত বিদ্যা তো রজী রোজগারের জন্য শিখতেই হয়। কেউ সৌখিন হয়ে অন্য কোন বিদ্যা শিখলে শরীআতে কোন আপত্তি আছে কি না?

 

এ বিষয়ে নীতিগত কথা হলো, যে পেশা গ্রহণ করা হালাল নয় সে পেশাগত বিদ্যা অর্জন করা ও জায়েয নয়। হস্তরেকা বিদ্যা শিখে তা পেশা হিসেবে গ্রহণ করা জায়েয নয়। এ দ্বারা মানুষের কোন কল্যাণ হয় না; বরং হস্তরেখা দেখে কারো কিসমত বা আয়ু সম্পর্কে মতামত দেওয়া প্রতারণা মাত্র। এটা কোন নিশ্চিত বিষয় না। এ মতামত দ্বারা কারো কল্যাণ হবার কারণ নেই।

 

জীবের চিত্র অংকনের বিরুদ্ধে হাদিসে খুব কোঠর মন্তব্য আছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য অংকন , ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদিতে শরীয়তের কোন আপত্তি নেই। তাই এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহন করায়ও কোন দোষ নেই ।

 

এ বিষয়ে বিস্তর মত পার্থক্যের সুযোগ আছে। মানুষের রুচি বিচিত্র। তাই এসব নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই। যাদুকরের শিল্প বা হাতের সাফাই মানুষকে নির্মল আনন্দ দান করে। এর মধ্যে অশ্লীলতা না থাকারই কথা। বিনোদন হিসেবে তা দেখা যায়। কিন্তু এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা আপত্তি নেই। তাই এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করায়ও দোষ নেই।

 

মুমিন আখিরাতের সাফল্যকেই জীবনের প্রধান  লক্ষ্য মনে করে। তাই সাবধানেই তাকে পেশা বাছাই করতে হয়। সে হিসাব কষেই শখের বিদ্যা সম্পর্কেও তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

নেক আমল

 

আরবী ‘আমল’ শব্দের বাংলা অনুবাদ হলো কর্ম বা কাজ। কাজের সূচনা হয় চিন্তা থাকে। মানুষ যখন কোন কাজ করতে চায় তখন বুঝা যায়, সে ঐ কাজ করার চিন্তা ভাবনা করছে। চিন্তার সাথে সাথেই কাজ শুরু হয়ে যায় না। যখন সে ইচ্ছাকৃতভাবে ঐ কাজের উদ্দেশ্যে চেষ্টা করে তখন কাজটি শুরু করা হয়েছে বলা যায়। অর্থাৎ ইচ্ছা ও চেষ্টার সমন্বয়েই কাজ শুরু হয়। ইচ্ছা করাকে আরবীতে নিয়ত বলা হয়। এর অর্থ হলো কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেই কাজটি শুরু হয় না। ইচ্ছা, নিয়ত বা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চেষ্টা করলে কাজটি শুরু হয়েছে বলে বুঝা গেল।

 

নেক বলতে কী বুঝায়?

 

নেক শব্দটি র্ফাসি ভাষার। এ উপমহাদেশে দীর্ঘ ৬ শতাব্দীর মুসলিম শাসনামলে ফার্সিই রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদায় ছিল। তাই বাংলা ভাষায় অগনিত ফার্সি শব্দ চালু হয়ে আছে। ইসলামের অনেক মৌলিক পরিভাষাও আরবীর বদলে ফার্সি পরিভাষায় চালু হয়েছে। আরবী সালাত ও সাওম নামায ও রোযা পরিভাষায় প্রচলিত। এমনকি স্বয়ং আল্লাহও খোদা হিসেবে এদেশে পরিচিত হয়েছেন। খোদা মানে খোদÑআ। অর্থাৎ যিনি নিজেই অস্তিত্বে এসেছেন। সূরা ইখলাসের ‘লাম ইউলাদ’  শব্দটির মানেই খোদা। অর্থাৎ তাকে কেউ পয়দা করেনি। তিনি স্বয়ং অস্তিত্ববান।

 

কুরআনের যে শব্দটি হলো ‘সালেহ’ ।  এ শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। যেমন,  ভালো, সৎ, যোগ্য, উপযুক্ত, যথাযথ, ভালো কাজ, পুণ্য ইত্যাদি। কুরআনে বহু আয়াতে বেহেশতের সুসংবাদ দিতে গিয়ে বল হয়েছে, ++ যারা ঈমান এনেছে ও সালেহ আমল করেছে তারাই জান্নাতবাসী হবে। শুধু ঈমান আনলেই চলবে না, নেক আমল ও করতে হবে, যদি বেহেশতে কেউ যেতে চায়। নেক আমলের অভাব হলে ঈমান থাকা সত্ত্বেও প্রথমে দোযখেই যেতে হবে। অবশ্য শাস্তির মেয়াদ শেষ হরে ইমানদার ব্যক্তি এক সময়ে বেহেশতে যেতে পারবে। কিন্তু সালেহ আমল ছাড়া শুধু ইমানের কারণে কেউ প্রথমে বেহেশতে যেতে পারবে না।

 

কুরআনের বহু আয়াতে এবং অগণিত হাদীস ++ কথাটি পাওয়া যায়। এর অর্থ করা হয়Ñ ভালো কাজের আদেশ করা ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা। এখানে ভালো অর্থে যে শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে তা আরবীতে মারূফ এবং মন্দ অর্থে মুনকার শব্দ ব্যবহার কর হয়েছে। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ্ এ দুটো শব্দের আভিধানিক অর্থ পসম্পর ভিন্ন।

 

++ শব্দটির অর্থ হলো পরিচিত। অথচ এ শব্দটি ভালো কাজ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আর ++ শব্দের মানে হলো যা প্রত্যাখ্যাত, অস্বীকৃত, পরিত্যাজ্য। অথচ এ শব্দটি মন্দ কাজ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এর তাৎপর্য বুঝতে হবে।

 

আল্লাহ তায়ালা সকল মানুষের মধ্যেই নৈতিক চেতনা দান করেছেন। তাইসে কোনটা ভালো, আর কোনটা মন্দ তা বোঝে। এ চেতনাকেই আমরা বিবেক বলে থাকি। নাফসের তাড়নায় ও শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ মন্দ কাজ করে বটে, কিন্তু তার বিবেক জানে যে, কাজ টি মন্দ। এমন কোন অপরাধী নেই, যে অপরাধ করে কিন্তু সে বুঝে না যে, এটা অপরাধ। বিবেককে ফাঁসি দেবার সাধ্য কারো নেই।

 

এই বিকেকের নিকট যা যা ভারে তা পরিচিত। সে ভালো করেই চেনে কোনটা ভালো। তাই কুরআনে ভালো কাজ বুঝাবার জন্য মারুফ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার এ শব্দ চয়ন কতই না চমৎকার! আল্লাহ বলতে চান যে, হে মানুষ! তোমাদেরকে আমি যা কিছু করতে হুকুম করেছি, তা যে ভালো তা তো তোমাদের অবশ্যই জানা আছে। নাফসের গোলামি কবুল করলে আলাদা কথা। তা না হলে আমার হুকুম তোমাদের জন্য যে কল্যাণকর তা তোমাদের অজানা নয়।

 

যা মন্দ তা মানুষের বিবেকের নিকট পরিত্যাজ্য। মনুষ্যত্ববোধ কোন মন্দকে ভালো বলে স্বীকার করে না। তাই আল্লাহ তায়ালা মন্দ কাজের অর্থে মুনকার শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ বলতে চান যে, তোমার বিবেক যা ভালো বলে স্বীকার করে না তাই মন্দ এবং আমি মন্দ কাজ করতেই নিষেধ করেছি। আমার নিষেধাজ্ঞা তোমার বিবেকের নিকট সঠিক।

 

নাফস, রূহ ও কালবের ফাংশন বা কর্মতৎপরতা

 

নাফস মানে দেহের যাবতীয় দাবি। খিদে লাগলে খেতে চায়, বোধ করলে ঠাণ্ডা চায়, সুন্দর কিছু পেলে দেখতে চায়, ভোগের উপকরণ পেলে ভোগ করতে চায়। দেহের কোন নৈতিক চেতনা বলে সে যা চায় তা নৈতিক দিক দিয়ে মন্দ হতেই পারে। তাই মানু ষখন কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় তখনি সে কাজটি নৈতিক দিক দিয়ে আপত্তিকর হলে রূহ আপত্তি জানায়। তখন নাফস ও রূহের মধ্যে লড়াই চলে। সব মানুষেরই এ তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। বঙ্কিম চন্দ্র রোহিনী উপন্যাসে এ লড়াই এর দুপক্ষের সুন্দর নাম দিয়েছেনÑ সুমতি ও কুমতি। সুমতি বলে যে, এটা করা ঠিক নয়। কুমতি বলে, এমন মজা কি ত্যাগ করা য়ায়? রূহ ও নাফসের এ লড়াইতে যার জয় হয় তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কর্ম সম্পাদন করা হতয়। এ কর্ম সম্পাদনী শক্তিই হচ্ছে কালব। কালব শব্দের অর্থ পরিবর্তনশীল। এক সময় সে রূহের আনুগত্য করে, আর এক সময় নাফসের। সে এক অবস্থায় থাকতে পারে না বলেই নাম কালব।

 

একটা সহজ উদাহরণ দিলে কথাটি স্পষ্ট হতে পারে। রাষ্ট্রে যে সরকার থাকে এর তিনটা বিভাগ আছেÑ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগÑ === আইন বিভাগ সিদ্ধান্ত দেয় যে, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এটাই নাফসের ফাংশন। বিচার বিভাগ ঐ আইনটি শাসনতন্ত্রের নীতির বিরোধী হলে আপত্তি জানায়। এটা হলো রূহের ফাংশন। এ বিরোধ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলার পর এক পর্যায়ে হয় করকার বিচার বিভাগের কথা মেনে নেয়, অথবা বিচার বিভাগ তার আপত্তি তুলে নেয়। তখন যার কথা টিকল তাই শাসন বিভাগ কার্যকর করে। এটাই কালবের ফাংশন।

 

কর্ম সম্পাদনের কোন ক্ষমতা বাইখতিয়ার মানুষের নেই

 

মানুষকে আল্লাহ তায়ালা কোন কাজের জন্য ইচ্ছা করা ও চেষ্টা করার ক্ষমতা এবং দায়িত্ব দিয়েছেন। কাজটি সমাধা বা সম্পন্ন করার কোন ইখতিয়ারই দিননি। কাজটি ভালো হোক, আর মন্দ হোক তা সম্পন্ন করবার ইখতিয়ার সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। মানুষ ইচ্ছা করেচে বলেই কাজটি সম্পন্ন হয়ে যাবে না, না চাইলে যত চেষ্টাই করা হোক কাটটি সম্পন্ন হবে না।

 

যেহেতু কর্ম সম্পাদনের ক্ষমতা মানুষের হাতে নয়, সেহেতু ভালো কাজের পুরস্কার ও মন্দ কাজের শাস্তির জন্য কর্মটি সমাধা হওয়া শর্ত নয়। কেউ কোন ভালো কাজের ইচ্ছা ও চেষ্টা করলে কাজটি সমাধা না হলে ও সে কাজটি সমাধা করেছে বলে গন্য করে পুরস্কার দেওয়াযাবে। কারণ তার ইখতিয়ার যা ছিল তা সে করেছে। যা তার ক্ষমতার বাইরে এর জন্য তার পুরস্কার আটকে থাকবে কেন?

 

যেমন এক ব্যক্তি হজ্জে যাবার ইচ্ছা করল এবং রওয়ানা হয়ে গেল। ইচ্ছাও চেষ্টার দায়িত্ব সে পালন করল; কিন্তু পথে সে মারা গেল। সে হজ্জ সমাধা করেছে বলে গন্য করা হবে। কারণ যদি হাশরের ময়দানে তাকে চার্জ করা হয় যে, তুমি হজ্জ করলে না কেন? তাহলে সে বলবে, আমি তো হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। তুমি আমাকে মুত্যু দিলে কেন? তাই আল্লাহ তাকে চার্জই করবেন না। হজ্জ করার পুরস্কার তাকে দিয়ে দেবেন।

 

মন্দ কাজের উদাহরণ দেওয়া যাকঃ এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তিকে খুন করার ইচ্ছা করল এবং সে উদ্দেশ্যে শাবল মাথার উপর উঁচিয়ে মারতে উদ্যত হলো। দুজন লোক দৌড়ে এস শাবল ধরে বিরত করল। আদালতে মামলায় প্রমাণ হলোযে, সে খুন করার জন্য ইচ্ছাকুতভাবে চেষ্টা করেছে। আইনের ভাষায় == আমদের দেশের আইনে এ করতে চেয়েছিল তাকে একটু চিমটিও কাটেনি। তাহলে শাস্তি কেন? প্রমাণীত হলো যে, শাস্তি কমপক্ষে তিন বছরের জেল। অথচ অপরাধী যাকে খুন করতে চেয়েছিলা তাকে একটু ইচ্ছাও করেনি, চেষ্টা ও কাটেনি। তাহলে শাস্তি কেন? প্রমাণিত হলো যে, শাস্তি কর্ম সম্পাদনের উপর নির্ভর করে না। ইচ্ছা ও চেষ্টা সম্পন্ন হলেই কর্ম সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য।

 

আরও একটা উদাহরণ দিচ্ছিঃ এক ব্যক্তি পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে গাছে গুলি চালাল। সেখানে এক লোক ছিল। কিন্তু শিকারী জানতো না। ঐ লোকের গায়ে গুলি লাগলো। এবং লোকটি মারা গেল। খুনের কর্ম সম্পাদন হলো বটে, কিন্তু এর জন্য বন্দুকের মালিক ইচ্ছাও করেনি, চেষ্টাও করেনি। তাই আদালতে এ কথা প্রমাণ হলে তার কোন শাস্তি ও হবে না। অথচ খুনের কর্মটি কিন্তু হয়েই গেল।

 

দুনিয়ায় যেমন, আখিরাতে ও তেমনি পুরস্কার ও শাস্তি ইচ্ছা ও চেষ্টার ফল, কর্মের বদলা নয়।

 

এ কথা বুঝে আসলে তাকদীরও আর রহস্য থাকে না। মানুষ যা করতে ইচ্ছা ও চেষ্টা করে তা সম্পন্ন হবে যদি আল্লাহর তার তাকদীরে রেখে থাকেন। আর নেক আমল সম্পন্ন হওয়া তাকদীরে না থাকলেও এর পুরস্কার অবশ্যই পাবে। তেমনি তার মন্দ কাজ সমাধা না হলেও সে শাস্তি পাবেই। তাই তাকদীরের কোন দোষ নেই। কাজের বদলা (ভালো বা মন্দ) তাকদীরের উপর নির্ভর করে না। আল্লাহর এ নিয়মে কোন অবিচার নেই। প্রত্যেকেই তার নিয়ত ও চেষ্টা অনুযায়ী বদলা পাবে। তাই তাকদীরে যাই থাকুক তাতে তার লাভও নেই, ক্ষতিও নেই। তাকদীর নিয়ে পেরেশান হবার কোন প্রয়েঅজনই নেই। তবে তাকদীরে বিশ্বাস করা জরুরী। এ বিশ্বাস মানে, আল্লাহ যা নির্ধারিত করেছেন তাই হবে। কারো চেষ্টায় তাকদীর বদলে যাবে না।

 

সহীহ নিয়ত ছাড়া পুরস্কার পাওয়া যাবে না

 

রাসূল (সাঃ) ঘোষণা করেছেন, +++ নিশ্চায়ই প্রতিটি কাজ নিয়ত হিসেবেই বিবেচ্য।

 

কাজটি বাহ্যত খুব ভালো হলেও কী নিয়তে কাজটি করা হলো সে বিষয়টি বিবেচনা করেই আল্লাহ তায়ালা ঐ কাজটি মূল্যায়ন করবেন। যদি কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের সাফল্যের নিয়তে করা হয় তবে তা তিনি কবুল করবেন। আল্লাহর নিকট পুরস্কার পাওয়ার নিয়ত ছাড়া যদি কেউ দুনিয়ায় মানুষ বীর ও বাহাদুর বলবে আশা করে জিহাদের ময়দানের শহীদ ও হয় তবু সে দোযখেই যাবে বলেরাসূল (সাঃ) ঘোষণা করেছেন। হাদীসে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে যে, কাজটি যত নেকই হোক তা ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে করলেই পুরস্কারের যোগ্য বিবেচিত হবে। কাজটি ঈমানের দাবি পূরণের উদ্দেশ্যে ও এর বদলায় সওয়াব পাওয়ার নিয়তে করতে হবে।

 

সাধারণত মানুষ সুনামের উদ্দেশ্যে জনকল্যাণমূলক কাজ করে থাকে। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে রিয়া বা লোক দেখানো কাজ বলা হয়। জনগণ দানশীল হিসেবে সম্মান করবে বা নেতা বানাবে এ আশায় দান করা হয়। যে নিয়তে সে করেছে তা দুনিয়তেই সে পেয়ে যায়। সে আিিখরাতে কোন পুরস্কার পাবে? সে উদ্দেশ্যে তো সে তা করেনি। তাই নিয়তের ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

চেষ্টা না করা পর্যন্ত শুধু ইচ্ছা করার কোন ফল আছে কি?

 

কেউ কোন একটি ভালো বা মন্দ কাজ করার ইচ্ছা করলো, কিন্তু ঐ ইচ্ছা অনুযায়ী কাজটি করার চেষ্টা করার সুযোগ পেল না। এ রকম ইচ্ছা করার কোন ফল আছে কি না?

 

বান্দদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা বড়ই মেহেরবান। সহীহ বুখারী থেকে জানা যায়, যদি কেউ কোন নেক কাজের নিয়ত করে আর তা কাজে পরিণত করার সুযোগ না পায় তবুও তাকে একটি পূর্ণ সওয়াব দেওয়া হবে। আর যদি কেউ কোন মন্দ কাজের ইচ্ছা করার পর তা কাজে পরিণত না করে, তবে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার পুরস্কার হিসেবে একটি কাজের পূর্ণ সওয়াব পাবে।

 

মৃত্যুর পরও কি আমল জারী থাকে?

 

রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় এ প্রশ্নের জওয়াব দিয়েছেন। ++

 

যখন কেউ মারা যায়া তখন তার আমল করা বন্দ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি জিনিস (বাকি থেকে যায়) ১. সদকায়ে জারিয়া (যে দান চালু থাকে), ২. এমন বিদ্যা যা থেকে উপকার পাওয়া যায় এবং ৩. এমন নেক সন্তান যে পিতা মাতার জন্য দোআ করতে থাকে।

 

এ হাদীসটি খুবই তাৎপর্যপূণ। মানুষ যে কাজ করে যদি তার জের চলতে থাকে তাহলে যতদিন জের চলবে ততদিন সে কাজ করছে বলে গণ্য হবে। যেমন –

 

১. জনগণের সুবিধার জন্য সওয়াব নিয়তে কেউ একটা রাস্তা তৈরি করে দেয় তাহলে যতদিন রাস্তাটি টিকে থাকবে ততদিন পর্যন্ত এর সওয়াব তার আমলনামায় জমা হতে থাকবে।

 

২. কেউ যদি তার সন্তানকে আল্লাহর নেক বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলে তহলে ঐ সন্তান আজীবন যত নেক আমল করবে এর সওয়াব সমপরিমাণে তার আমলনামায় জমা হতে থাকবে। তার সন্তান ও যদি তারই মতো তার সন্তান কে গড়ে তোলে তাহলে এর সওয়াবও তাদের আমলনামায় জমা হতে থাকবে।

 

৩. কেউ যদি সওয়াবের নিয়তে মানুষকে এমন কোনো বিদ্যা শিক্ষা দেয়, যা মানুষের জন্য কল্যাণকর, তাহলে যতদিন ঐ কল্যাণ চালু থাকবে ততদিন তার আমলনামায় সওয়াব জমা হতে থাকবে।

 

মন্দ কাজের বেলায়ও গুনাহ জারি থাকবে। যেমন –

 

১. কেউ যদি ডাকাতি করে এবং অন্য কাউকে ডাকাতি শিক্ষা দেয় তাহলে তার মৃত্যুর পর তার শাগরিদের গুনাহও উস্তাদের আমলনামায় জমা হে ব।

 

২. কেউ যদি কাউকে কোনো মন্দ কাজে সাহায্য করে বা উৎসাহিত করে তাহলে সে নিজে মন্দ কাজ না করলেও ঐ মন্দ কাজের গুনাহ তার আমলনামায় শামিল করা হবে।

 

৩. কেউ যদি কোনো কুপ্রথা বা নৈতিকতা বিরোধী কোনো কাজ সমাজে চালু করে, তাহলে তার মৃত্যুর পরও যতদিন তা সমাজে চালু থাকবে ততদিন এর গুনাহ তার আমলনামায় জমা হতে থাকবে।

 

এদ্বারা বুঝা গেল যে, কারো মুত্যুর সাথে সাথে তার আমলের একাউন্ট (হিসাবের খাতা) বন্ধ হয়ে যায় না। কোনো কোনো ভালো ও মন্দ কাজের জের কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকতে পারে। তাই দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার পরই আমলের খাতা লেখা বন্ধ হবে।

 

হাদীসে আছে, মানুষ যখন আমলনামা হাতে পাবে তখন তার কাজের দীর্ঘ হিসাব দেখে চিৎকার করে বলে উঠবে, হে আল্লাহ আমি তো এত কিছু করিনি। এতগুলো আমার হিসাবে কেমন করে এলো? একথা শুধু বদ লোকেরাই বলবে না, নেক লোকেরাও বলবে। উভয় প্রকার লোককে একই জওয়াব দেওয়া হবে – এটা ঠিক যে তুমি নিজে এত কিছু করনি, কিন্তু তুমি অন্যদেরকে শিক্ষা দিয়েছ, অন্যদেরকে উৎসাহ দিয়েছ, তোমাকে দেখে তারা শিখেছে বা উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তাই অন্যদের আমরও তোমার হিসাবে ধরা হয়েছে। সূরা ইনফিতারের ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে,++++

 

(কিয়ামতের পর) প্রত্যেক মানুষ জানতে পারবে যে, সে আগে কী (আমল) পাঠিয়েছে এবং পরে সে কী করেছে। এখানে আগে করেছে মানে জীবিতকালে করেছে আর পরে করেছে মানে মৃত্যুর পরে করা হয়েছে বলে ধরা হয়েছে।

 

তাই দুনিয়ায় অতি সতর্কতার সাথে আখিরাতের হিসাবের কথা খেয়ালে রেখে আমল করতে হবে।

 

আমল সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা

 

আমল মানে কাজ। কিন্তু কোনো কিছু হাসিল করার জন্য কোনো দুআ পড়াকেও সাধারণত আমল বলাহয়। মাওলানা মওদুদী (র) কে খুলনায় এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন হুযুর আমার আয়ের কোন পথ নেই। বেকার অবস্থায় আছি। এক হুযুর আমাকে এ দোআটি সোয়া লাখ বার পড়তে বলেছেন। এটা নাকি রিযিক হাসিলের আমল।

 

মাওলানা তাকে বললেন, আপনি এ দোআটি বসে বসে পড়লে রিযিকের আমল হবে না। আপনি আয়ের জন্য চেষ্টা করতে থাকবেন এবং এ দোআটি পড়তে থাকবেন। সোয়া লাখবার হলো কিনা সে হিসাবের দরকার নেই। যতদিন পর্যন্ত আয়ের উপায় নাহয় ততদিন পড়তে থাকবেন এবং আয়ের পথ তালাশ করতে থাকবেন।

 

লোকটি চলে গেলে মাওলানা মন্তব্য করলেন যে জাতি আমল না করাকে আমল মনে করে সে জাতির কেমন করে উন্নতি হবে?

 

হাদীসে আছে, যখন কেউ মারা যায় তখন তার লাশের সাথে তিনটি জিনিস কবর পর্যন্ত যায়। ১. আত্মীয় স্বজন ২. কিছু মাল ৩.তার আমল। দাফনের পর দুটো জিনিস ফিরে আসে, আর শুধু একটি জিনিস তার সাথে যায়। সে জিনিসটি হলো তার আমল।

 

--- সমাপ্ত ---

মযবুত ঈমান

অধ্যাপক গোলাম আযম

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড