জ্ঞান ইসলামীকরণঃ স্বরূপ ও প্রয়োগ

প্রথম পরিচ্ছেদ

 

জ্ঞান ইসলামীকরণের স্বরূপ

 

 

 

ইসলামী জ্ঞান তত্ত্বের আলোকে জ্ঞানের বিভিন্ন উৎস রয়েছে। ওহী ভিত্তিক জ্ঞান (Revealed Knowledge ও মানব অর্জিত জ্ঞান (Acquired Knowledge) । মানব জ্ঞান আল্লাহ তা’য়ালার মহা দান। তাঁর প্রদত্ত জ্ঞান তথা ওহী ও ইলহামের মাধ্যমে জ্ঞান মানব সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখছে। কিন্তু যুগে যুগে মানব সমাজে এমন অনেক কিছু জ্ঞান হিসেবে প্রচলিত হয়েছে, যা সত্যিকার অর্থে জ্ঞান নয় কিংবা বিকৃত জ্ঞান। অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীতে পশ্চিমা জগতের পণ্ডিতবর্গ জ্ঞানের বিন্যাস ও আহরণ প্রক্রিয়াকে ইসলামী ধ্যান-ধারণা থেকে দূরে নিয়ে স্থাপন করেছেন। এসব কিছু ইসলামী চিন্তা চেতনার আলোকে পুনরায় সাজাতে হবে। এর মাঝেই জ্ঞানের ইসলামীকরণ ধারণাটি নিহিত।

 

অন্যভাবে বলতে গেলে ‘ইসলামী জ্ঞান তত্বের (Epistemology) আলোকে জ্ঞান হলো সেই সুনির্দিষ্ট ধারণা বা বোধ ও প্রত্যয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে এবং তাঁর লক্ষ্য উদ্দেশ্যে ও নির্দেশনা সম্পর্কে দায়িত্বশীলতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও দায়িত্ব পালনের বাস্তবতা সৃষ্টি হয়। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ এবং উভয়ের নির্দেশনাকে বুঝার ও সেই বুঝার ভিত্তিতে চলার সচেতনতা, অভিজ্ঞতার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই জ্ঞান। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইহ-পারত্রিক, পারত্রিক ও সামাজিক জ্ঞান বিজ্ঞানকে ইসলামী ভাবধারায় বিন্যাস, বিচার-বিশ্লেষণ এবং গ্রহণ-বর্জন করার প্রক্রিয়া Process কে জ্ঞানের ইসলামীকরণ বুঝায়।

 

অবশ্য জ্ঞান ইসলামীকরণ বিষয়টিকে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও চিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে বুঝাতে চেষ্ঠা করেছেন। নিম্নে কটি মন্তব্য উল্লেখ্য:

 

ড. ইসমাইল রাজী আল ফারুকী বলেন, জ্ঞান ইসলামীকরণ মানে জ্ঞানের নতুন সংজ্ঞা দিতে হবে এবং তথ্যাদিকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তথ্যাদির কার্যকারণ ও সম্পর্ক নিয়ে পুনর্বার চিন্তাভাবনা করতে হবে, উপসংহারগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে, উদ্দেশ্যের পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং তা এমনভাবে করতে হবে যাতে বিষয়গুলোর দর্শনকে সমৃদ্ধ করে এবং ইসলামের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এই লক্ষ্যে ইসলামের পদ্ধতিকরণ ক্যাটেগরিগুলোকে যথা-সত্যের ঐক্য, জ্ঞানের ঐক্য, মানবতার ঐক্য, জীবনের ঐক্য এবং সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য-মানুষের প্রতি সৃষ্টির আনুগত্য এবং সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি মানুষের আনুগত্য-এ চিন্তাধারার আলোকে পাশ্চাত্য ধারণাগুলোকে অবশ্যই সংশোধন করতে হবে এবং বাস্তবতাকে উপলদ্ধি ও বিন্যস্ত করার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। তদ্রুপ, পাশ্চাত্য মূল্যবোধের স্থলে ইসলামী মূল্যবোধকে পুন:স্থাপন করা উচিত এবং তদনুযায়ী প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যার্জনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।

 

ড. ইমাদুদ্দীন খলীল বলেন, The term `Islamization of knowledge’ means ( i.e. Discovering, compiling, piecing together, communicating and publishing) intellectual activity based on the islamic concept of the universe, life and man.

 

তিনি অন্য স্থানে আরো বলেন,

 

The Islamization of knowledge means involvement in intellectual pursuits, by examination, summarization, correlation, and publication, from the perspective of an Islamic outlook on life, humanity, and the Universe.4

 

ড. ত্বাহা জাবির আলওয়ানী জ্ঞান ইসলামীকরণের স্বরূপ সম্পর্কে অনেকগুলো মন্তব্য করেন। যেমন এক স্থানে তিনি বলেন, The Islamization of knowledge may be understood as a cultural and intellectual project aspiring to correct the processes of thinking within the Muslim mind so that it can produce islamic, social, and humanistic knowledge based on the two sources Muslims accept as the established source for knowing the truth: wahy ( divine revelation) and wujud (existence). In this endeavor, we shall use reason and the senses to help us acquire such knowledge that cannot be established on revelation and existence.

 

তিনি আরো বলেন, বস্তুত জ্ঞানের ইসলামীকরণ বলতে এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তা চেতনাগত পদ্ধতিভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে পরিচালিত কার্যক্রমের নাম। এটি মূলত একাধিক কার্যক্রমের সমষ্টি বিশেষ। যাতে জ্ঞানের ইসলামী উৎসের মূল্যায়নের আবেদন উপস্থাপন করা, জ্ঞানের বিন্যাস ও বিভাজনে ইসলামী ভাবধারা তথা তাওহীদ ভিত্তিক চেতনার প্রতিফলন করা, অমুসলিম সমাজে প্রচলিত উপকারী জ্ঞানের সাথে কুরআন সুন্নাহ কেন্দ্রিক জ্ঞানের সমন্বয়, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইসলামের তত্ত্ব ও তথ্য সংযোজন করা, ইসলামী চিন্তাধারার আলোকে চিন্তনপদ্ধতি অনুসরণ করা, সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ইসলামের আবেদন তুলে ধরা, নতুন নতুন সমস্যায় ইজতিহাদ করা ইত্যাদি কার্যসম্পাদন অন্তর্ভূক্ত থাকে।

 

এটি প্রাতিষ্ঠানিক বা শিক্ষা কারিকুলামের ক্ষেত্রে হতে পারে, আবার অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে জীবন চলার পথে বিভিন্ন দিকে গৃহীত চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রেও হতে পারে। এটি কোন বিলাসিতা নয় কিংবা কোন অসার সৌন্দর্যবর্ধক তথা কসমেটিক সংযোজন Cosmic Addition)  নয় যে, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কিত এক দুটি কুরআনের আয়াত বা হাদীছ সংযোজন বা ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করলেই ইসলামী করণ হয়ে গেল! বরং জ্ঞানের ইসলামীকরণ বলতে প্রচলিত জ্ঞানতত্বের আমূল পরিবর্তন বুঝায়। জ্ঞানকে ইসলামের আলোকে নতুন করে বিন্যাস ও বিভাজন করতে হবে। যে সব কথার উপর তত্ত্ব ও বা সিদ্ধান্ত ও অনুসিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা পুনর্মুল্যায়ন করতে হবে। মানব সমাজে অনুপ্রবেশকারী ভ্রান্ত জ্ঞানকে নিরূপিত করে সেখানে সত্য জ্ঞান তথা ইসলামী ভাবধারা প্রতিস্থাপন করতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

 

জ্ঞান ইসলামীকরণের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। মানব জীবনে যদি ইসলামের প্রয়োজনীয়তা থাকে, তা হলে ইসলামীকরণের গুরুত্বও রয়েছে। এ বিষয়টির বিভিন্ন দিক রয়েছে। নিম্নে প্রধান কটি দিক আলোচনা করা হলো:

 

 

 

আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণ:

 

মানুষের দেহই মূল মানুষ নয়। দেহ ও রূহের সমন্বয়ে মানুষ। নিচের চিত্রে বিষয়টি দেখানো যায়:

 

 

 

মানুষ সত্তা:- 1) দেহ-> মাটির তৈরী যা পঁচনশীলও সদা।

 

         ২) রূহ-> আল্লাহর আদেশ যা অবিনশ্বরও

 

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, “যখন আপনার পালনকর্তা ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি মাটির মানুষ সৃষ্টি করব। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার সামনে সেজদায় নত হয়ে যেও।” (সূরা সাদ: 71-72) মানুষের দেহের যেমনি চাহিদা পূরণ করতে হবে। খোরাক দিতে হবে। না হয়, জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। এ রূহের খোরাক হলো আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখা, আল্লাহর ইবাদত করা, আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের চর্চা ইত্যাদি। অথচ বর্তমানে সকল ধরণের জ্ঞান চর্চা করে দেহ আত্মার চাহিদার সমন্বিত পূরণের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এটা সম্ভব জ্ঞান ইসলামী করণের মাধ্যমে।

 

ইসলামের লক্ষ্য মানব সমাজের কল্যাণ প্রতিষ্ঠা:

 

জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজটি অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক ও বাস্তবতার চাহিদা প্রতিফলন বিশেষ। কারণ ইসলাম মানব জীবনের কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত। দুনিয়া ও আখেরাতে সার্বিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠাই ইসলামের লক্ষ্য। মানুষের বৈষয়িক চাহিদাকে কোন ভাবেই উপেক্ষা করে না। বরং ইসলামই সুন্দরভাবে মানুষের বৈষয়িক চাহিদা পূরণেও ব্যবস্থাদি দিয়েছে।

 

ইসলামী শারী’আতের লক্ষ্য বর্ণনায় ইমাম গাযালী বলেন,

 

শারী’আতের গূঢ় উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে তাদের ‘আকীদা বিশ্বাস, জীবন, বুদ্ধিবৃত্তি, সন্তান-সন্তুতি ও সম্পদের সংরক্ষণ করা। যা কিছু এই পাঁচটি বিষয় সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করে তা-ই জনস্বার্থ বলে গণ্য এবং সে বিষয়টিই কাম্য।’

 

ইমাম শাতেবী মানব কল্যাণে নিয়োজিত ইসলামের লক্ষ্যকে তিনভাগে বিভক্ত করেন- ক. জরুরিয়াত/আবশ্যকীয় ((Necessities) এগুলো পাঁচটি: দীন রক্ষা করা, জীবন রক্ষা করা, বংশ রক্ষা করা, সম্পদ রক্ষা করা, বিবেক বুদ্ধি রক্ষা করা।

 

খ. হাজিয়া/ প্রয়োজনীয় (Requirement), যা জীবন যাত্রাকে সহজ করে দেয়, যেমন যানবাহন।

 

গ. তাহসিনিয়্যাত বা সৌন্দর্যবর্ধক ( Beautification) ।

 

ইমাম ইবনুল কায়্যিম বলেন,

 

The objective of the sharah (Islam) is wisdom and welfare. Anything that departs from wisdom to folly, from generosity to misery, from welfare to hardship has nothing to do with the shariah.\"

 

(শারী’আহ তথা ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে মানুষের প্রজ্ঞা এবং দুনিয়া ও আখেরাতে জনগণের কল্যাণ সাধন। আর কল্যাণ নিহিত রয়েছে সার্বিক আদল ( ন্যায়বিচার), দয়ামমতা, কল্যাণকামিতা ও প্রজ্ঞার মধ্যে। যেখানে আদলের পরিবর্তে যুলম, দয়া মমতার পরিবর্তে নিষ্ঠুরতা, কল্যাণকামিতার পরিবর্তে দু:খ দুর্দশা এবং প্রজ্ঞার পরিবর্তে নির্বুদ্ধিতা বা বোকামি স্থান পায়, তার সাথে শারীআতের কোন সম্পর্ক নেই।”)

 

উপরোক্ত আলোচনায় শারীআতের ক্ষেত্র ও বিষয়বস্তু স্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং শারীআতের জ্ঞান তথা ইসলামী জ্ঞান মানুষের কল্যাণেই নিয়োজিত। এর প্রসার ঘটালে মানুষের কল্যাণই নিশ্চিত হবে। তাই মানুষের কল্যাণের জন্য জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম প্রয়োজন।

 

মুসলিম মনন ও চিন্তাধারার পুনর্গঠন:

 

জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী ও আন্দোলন। এর টার্গেট প্রথমত মুসলিম সমাজের সংষ্কার। মুসলমানদের চিন্তাধারায় অনেক অ-ইসলামী ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। জীবন কাজ করে তাকদীরের উপর নির্ভরশীলতা, অলসতা, অতিকল্পনা বিলাসপ্রবণতা, আবেগ উদ্দীপনার অধিক ব্যবহার, সুশৃঙ্খল ও পদ্ধতিগত চিন্তনের অভাব ইত্যাদি বিষয় মুসলিম মানসকে আক্রান্ত করেছে। চিন্তা জগতে ঘুনে ধরা এ মুসলিম সমাজকে সংষ্কারের জন্য প্রয়োজন কুরআন সুন্নাহের আলোকে ইসলামী চিন্তাধারার পুনর্গঠন। জ্ঞান ইসলামীকরণের মাধ্যমেই তাই করা হয়।

 

সত্য সন্ধানে ওহী জ্ঞানের প্রতি আস্থা সৃষ্টিকরণ:

 

সমসাময়িক বিশ্বের বৈজ্ঞানিক মানস এককথায় সব ধর্মীয় কিতাব বর্জন করে থাকে। যদিও এ সবের কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে নমনীয় ভাব প্রদর্শন করে। তবুও এসব গ্রন্থের ম্যাথডোলজি, বুনিয়াদি স্থাপনাগত এককত্ব, চূড়ান্ত কাঠামোকে তারা প্রত্যাখ্যান করে। তারা জোর দিয়েই বলে থাকে যে, এসব ধর্মীয় গ্রন্থাদির ক্ষেত্র বিশ্বাসগত তুষ্টি ও অদৃশ্যমান জগত পর্যন্ত সীমিত থাকা উচিত। অনন্তর ঐ দাম্ভিকদের মতে অদৃশ্যজগত ও বাস্তবতার মাঝে সমন্বিত অধ্যয়ন করা অসম্ভব। তারা বলে থাকেন, এ ধর্মীয গ্রন্থ সমূহে যে সব গায়েবী বা অদৃশ্য জগত সম্পর্কে কথাবার্তা আছে, তা তো বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার উপযুক্ত ক্ষেত্র হতে পারে না। যদি তাই করা হয়, তা হলে এর যে কোন একটিকে অবান্তর ঘোষণা করতে হবে অথবা জোরাতালিমূলক সমঝোতা করতে হবে ও সমাধানে আসতে হবে। আসমানী কিতাবসমূহ অদৃশ্যজগত সম্পর্কে যে ইঙ্গিত দিয়ে থাকে বা কিছু কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করে, তা সমসাময়িক কালের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার আয়ত্বাধীন নয়। এ বিষয়ে গবেষণাকে বৈজ্ঞানিক মর্যাদা দেয়া যাবে না। এ জন্য বর্তমান বিশ্বের জন্য ইউনেসকো জ্ঞানের একটি সংজ্ঞা পরিবেশন করেছে। তার ঘোষণায় বলা হয়:‘ যে জ্ঞাত বিষয় ইন্দ্রয়গাহ্য ও অভিজ্ঞতা লব্দ তাই জ্ঞান।’

 

কিন্তু তারা সকল ধর্ম গ্রন্থকে একই মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করে ভুল করেছে। আল কুরআন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আল কুরআন ও সুন্নাহর বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এসবের অনেক কিছু অন্য নামে মানব সমাজে প্রচলিত আছে। যেমন সামাজিক বিজ্ঞানের অংশ প্রশাসন বিদ্যায় প্রশাসনে কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব তথা ‍সাংগঠনিক তত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। একটি হলো যান্ত্রিক মতবাদ। এ মতবাদে বলা হয়, কর্মচারীদের নিকট থেকে কঠোর নিয়মের আওতায় তথা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজ আদায় করে নিতে হবে। অপর আরেকটি মতবাদ হলো মনত্বাত্ত্বিক মতবাদ। এ মতবাদে বলা হয়, মানুষের পারিপার্শ্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বিবেচনা করে কাজ নিতে হবে। এতে অনেকটা শিথিল মনোভাব পোষণ করা হয়। অন্য দিকে এতদুভয়ের মাঝামাঝি আরেকটি মতবাদ রয়েছে যাকে বলা হয় আধুনিক মতবাদ। তার কথা হলো এমন কঠোরতা আরোপ করা যাবে না, যাতে কর্মচারী সাধ্যাতীত হয়ে যায়। আবার এত শিথিল করা যাবে না যাতে নিয়ম শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। বরং উভয়ের মাঝে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উল্লেখ্য, ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটি কুরআন হাদীছ সম্মত। অথচ মানব সমাজে এটি আধুনিকতার নামে প্রচলিত। তাই এরূপ বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে। কুরআন হাদীছের জ্ঞানের স্বরূপ তুলে ধরে এর প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি করা সম্ভব। জ্ঞান ইসলামীকরণের মাধ্যমে এটি করা যায়।

 

এমনিভাবে আলকুরআনে বলা হয়, ‘প্রত্যেকই আপন কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান।’ আধুনিক বিজ্ঞানও তাই বলছে। সুতরাং হিন্দু পৌরাণিক তথ্যে বলা হচ্ছে, পৃথিবীর চতুর্পার্শ্বে সূর্য ঘূর্ণায়মান। অপরদিকে আলকুরআন যা বলছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। অতএব আলকুরআনকে অন্য সকল ধর্মগ্রন্থের সাথে একই পাল্লায় পরিমাপ করা ইনসাফপূর্ণ নয়।

 

এছাড়া, আল কুরআন মানব সমাজে এমন সময় এমন সব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য তুলে ধরেছে, যখন সেসব তথ্য আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপকরণ ব্যবহার করে জানা সম্ভব ছিল না। এ দ্বারা বুঝা যায়, এটি আল্লাহ প্রদত্ত সত্য জ্ঞান সমৃদ্ধ। জীবন ও জগতের অনেক বিষয় আছে, যা গায়েবের সাথে জড়িত। তাই প্রত্যক্ষ জগতের বিভিন্ন বিষয় যদি বৈজ্ঞানিক সত্য বলে স্বীকৃত হয়, তা হলে স্বাভাবিকভাবে গায়েবের বিষয়াদিও সত্য বলে মনে নিতে হবে। এ ছাড়া জীবন ও জগতের অনেক কিছুর ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। আধুনিক বাস্তববাদী (Realism) দর্শন এ সব ক্ষেত্রে নিরব। সুতরাং কুরআনিক জ্ঞান বিজ্ঞান উপস্থাপনের মাধ্যমে ওহী জ্ঞানের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পায়। জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রচেষ্ঠার মাধ্যমে কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান উপস্থাপন করা হয়।

 

 

 

শিক্ষা ও চিন্তাধারায় ঈমানী নৈতিকতার সংযোজন:

 

আজকে শিক্ষিত মানুষের মাঝে অপরাধ প্রবণতা বেশি। বড় বড় অপরাধের সাথে শিক্ষিত মানুষেরাই অধিক জড়িত। এর কারণ হলো নৈতিক শিক্ষার অভাব। শিক্ষা ক্ষেত্রের সমস্যাই সমাজে সকল সমস্যার মূল। (Problem of education is the main root our problems) । কিন্তু খোদ নৈতিকতার ভিত্তিতেই সমস্যা রয়েছে। নৈতিকতার ভিত্তি হলো: ব্যক্তিস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আবেদন তুলে ধরার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ব্যক্তি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর চিন্তা করে কেউ ধুমপান থেকে বিরত থাকে না। জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে কেউ জাতীয় সম্পদ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকে না। রাজনৈতিক সংঘর্ষে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংঘর্ষে জাতীয় সম্পদ রক্ষা পায় না। তাই নৈতিকতার ঐ দর্শন ও ভিত্তি অকার্যকর। কিন্তু ইসলামী নৈতিকতার ভিত্তি তাকওয়া। তাই জ্ঞান আহরণ ও বিতরণ প্রক্রিয়া তথা শিক্ষা ব্যবস্থায় এ তাকওয়া কেন্দ্রিক নৈতিকতা দিয়ে সাজাতে হবে। সুতরাং এ কাজ করতে হলে শিক্ষা ও জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রয়োজন। এর মাধ্যমেই শিক্ষা ও মূল্যবোধের ভূমিকা সম্পর্কে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন-“...Science without religion is lame, Religion without science is blind.\"

 

Stanly Hull বলেছেন- \"If  you teach your children the three R\'s ( Reading, writing and Arithmetic) and and leave the fourth R ( i. e. Religion), you will get a fifth R (Rascality).\"

 

বর্তমানে দ্বীনি শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার যে দুটি ধারা দেখা যায়, এর প্রভাবে একদিকে সৃষ্টি হচ্ছে এক শ্রেণির দ্বীনি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি যারা, বহুলাংশে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে নেই। আবার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের মাঝে দ্বীনি ইলমের বেশ অভাব।

 

এতে ইসলামের জ্ঞান বা শিক্ষার সুমহান বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। পৃথিবীতে বড় ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত মূল ব্যক্তিটি দেখা যায় শিক্ষিত-বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। আবার দ্বীনি জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিটির মধ্যে সেই সব অপরাধের সাথে জড়িত না থাকলেও তারমধ্যে সেই সব ভয়াবহ পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার যোগ্যতার অভাব। দুনিয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের বেশ এগিয়ে যাবার পরেও শুনা যায়-

 

“টেকনোলজির বাড়ছে প্রভাব, কাণ্ড জ্ঞানের পড়ছে অভাব, দেখি মানুষের সেই পশু স্বভাব, দুনিয়ার এই চিত্রপটে।”

 

দু:খ করে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:) বলেছিলেন-

 

“চারদিকে দেও-দানব ও জানোয়ার দেখতে দেখতে আমার বিরক্তি ধরে গেছে, আমি এখন মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছি।

 

সেই কাঙ্খিত মানের মানুষ গড়ে উঠতে পারে ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী মূল্যবোধের অভাব থাকাতে কাঙ্খিত মানের মানুষ গড়ে উঠছেনা। ডাক্তার হয়ে অর্থের লোভে অনেকেই অনৈতিক কাজ করছে, ইঞ্জিনিয়ার বা আমলা হয়ে ঘুষ-দূর্নীতি হয়ে পড়ছে। মানুষ কিন্তু মূল্যবোধহীন মানুষ গড়ে উঠছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় Secular ভাবধারা, নৃতত্ত্বে ডারউইনের মতবাদ, সমাজ বিজ্ঞানে মার্কসীয়, ফ্রয়েডিয় মতবাদ, ইতিহাস ইহজগৎকেন্দ্রিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামী ভাবধারার পরিবর্তে পাশ্চাত্য ভাবধারা গ্রহণ করে শিক্ষিত নামধারী কিছু নৈতিকতা বিবর্জিত ইসলামী মূল্যবোধহীন, সমাজ সংসারের জন্য অনিষ্টকর, দুর্নীতিগ্রস্থ, ঘুষখোর, অহংকারী, খুনি, চক্রান্তকারী কিছু পশু স্বভাবের লোক পাওয়া যাচ্ছে।

 

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলে তাকওয়াবান, তাওয়াক্কুলকারী শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ইত্যদি নানা পেশার লোক পাওয়া যেত। সেই সব লোকেরা হবে Practising Muslim. তারা হবে দেশ সমাজের সংসারের জন্য মঙ্গলময়। তাই জ্ঞান ও শিক্ষা ইসলামীকরণের মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধের চর্চায় বিকশিত হবে ঈমানী চেতনা ও প্রকৃত মানবতা।

 

কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক সমাজ গঠন:

 

কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক সমাজ গঠন করতে হলেও সমাজে প্রচলিত জ্ঞানকে ইসলামীকরণ করতে হবে। না হয়, ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে সমাজ পরিচালিত হবে না। তা হলে সহজেই ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। গোটা মানবজাতিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সুস্থ ব্যবস্থার অধীনে গড়ে তোলা জ্ঞানের ইসলামীকরণের লক্ষ্য।

 

ইসলামী কার্যধারায় পদ্ধতিগত চিন্তার পুন:স্থাপন:

 

যুগে যুগে আসা নবী রাসূল আ: গণ সমাজ সংষ্কারে পদ্ধতিগত চিন্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ সা: ও তাঁর সাহাবীগণও পদ্ধতিগত চিন্তনের পথ অনুসরণের করতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ের মুসলমানরা অনেক সময় এ ব্যাপারে সচেতন ছিল না। বিশেষত মানব সমাজে শিল্প বিপ্লবের পর এর সমস্যাগুলো স্বভাবত জটিল আকার ধারণ করছে। এখন এগুলো সমাধানে পদ্ধতিগত চিন্তাধারার প্রয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এখন যারা পদ্ধতিগত চিন্তন প্রয়োগ করবে,তারাই টিকে থাকবে। অতএব জ্ঞান ইসলামীকরণের আওতাভূক্ত এ পদ্ধতিগত চিন্তার পুন:স্থাপনের মাধ্যমে মুসলমানরা পুনরায় বিশ্ব নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে।

 

যুগ সমস্যা নিরসনে ইজতিহাদে নিবেশ করানো:

 

জ্ঞান ইসলামীকরণের অন্যতম শর্ত হলো ইজতিহাদে মনোনিবেশ করানো ইজতিহাদের মাধ্যমে নতুন নতুন সমস্যার সমাধান দিতে না পারলে ইসলামকে সে ক্ষেত্রের জ্ঞানের জন্য অকার্যকর বলে ঘোষণা করা হবে। তাই বৈচিত্রময় জীবনে নানান সমস্যা নিরসনে ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই ইসলামীকরণ কর্মসূচীর আওতায় মুসলিম স্কলারদেরকে ইজতিহাদে গভীরভাবে মনোনিবেশ করা যায়।

 

 

 

বিশ্ব দরবারে ইসলামের মৌলিকত্ব তুলে ধরা:

 

জ্ঞান ইসলামী করণের মাধ্যমে ইসলামের মৌলিকত্ব ফুটে উঠবে। বিশ্ব দরবারে ইসলামকে উপস্থাপনের জন্য ইসলামের মৌলিকত্ব স্পষ্ট করতে হবে।

 

 

 

সভ্যতার সংঘাত নয় বরং সংলাপ সৃষ্টি:

 

ইসলামী সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা বিশ্ব সমাজে তুলে ধরার জন্যও জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম প্রয়োজন। এর মাধ্যমেই মানব সভ্যতার অর্থপূর্ণ যোগাযোগ ও বিনিময় প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব। সভ্যতার সংলাপে বসতে হলে ইসলামী চিন্তাধারার মৌলিক উপস্থাপন পেশ করতে হবে। তুলনার জন্য ও সংলাপের জন্য তুল্য বিষয়ের মৌলিকতা প্রয়োজন। মানব জাতিকে ঐশী সত্য (Divine truth) সম্পর্কে অবহিত করতে হলে কার্যকর বিনিময় প্রক্রিয়া শুরু হওয়া প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অগ্রসর নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে তাই করা হয়। এ জন্য ফ্রান্সের মুসলিম স্কলার রজার জারোদী ( Roger Garaudy)  বলেন, It is a means and an approach in the dialogue of civilization\".

 

ড. ত্বহা জাবির আলওয়ানী বলেন, In our estimation, the Islamization of knowledge, in its wider perspective, provides Muslims with the intellectual underpinnings for a complete civilizational transformation.\"

 

তিনি আরো বলেন, \"Recent international developments and the frightening destructive capabilities of the major technological powers   should be enough to make this assertion apparent to all. Doubtless, dialogue between nations, as well as their exchange of ideas and appreciation for one another\'s cultures, promote the kind of understanding presently required. The Islamization of knowledge will contribute positively to this dialogue.\"

 

হান্টিংটন সভ্যতার সংঘাত (Clash of civilizations) নামে থিওরি দিয়ে বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টিতে সহায়তা করেছেন। তাই জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সভ্যতার সংলাপ সৃষ্টি করা হবে। এর মাধ্যমে সংঘাত নয়, বরং শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে মানব সমাজের সমস্যা নিরসনের প্রচেষ্ঠা চালানো হবে। তাই বিশ্বসভ্যতায় এ কার্যক্রমের গুরুত্ব অপরিসীম।

 

মুসলিম উম্মাহর মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা:

 

আধুনিক শিল্পবিপ্লবের কারণে নতুন নতুন ব্যবস্থাপনা ও উদ্ভাবনার সামনে মুসলিম উম্মাহর মাঝে হীনমন্যতা ( Inferiority complex) সৃষ্টি হয়েছে। তাদের স্কলারদের কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছে যে, পশ্চিমাদেরই অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু তারা হয়তো ভুলে গেছেন যে, মুসলিম উম্মাহ এক সময়ে জ্ঞান বিজ্ঞানে নেতৃত্ব দিয়েছে। পশ্চিমারা মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞান সমূহ সংস্কার ও উন্নয়ন করেই এতসব নবনব উদ্ভাবন উপহার দিচ্ছে। ইসলামী মূলনীতির আলোকে ইজতিহাদ করা হলে আবারও জ্ঞানের জগতে প্রাধান্য বিস্তার করা সম্ভব। তাই জ্ঞান ইসলামীকরণের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

 

 

 

সমাজের ভয়াবহ অবক্ষয়রোধ ও ইসলামী দাওয়াহ:

 

আজকের মানব সমাজ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা সকল দিক দিয়ে ভয়াবহ অবক্ষয় ও তীব্র সংকটের মুখোমুখি। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থায় ধ্বস নেমে এসেছে। এ ভয়াবহ ও পরিস্থিতিতে মুক্তি দিতে পারে ইসলাম। অমুসলিম সমাজে প্রচলিত জ্ঞান বিজ্ঞানের স্থলে ইসলামের সত্যজ্ঞান যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারলে তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করবে। ফলে সে সব সমাজে ইসলামী দাওয়াহও সম্প্রসারিত হবে। তাই দাওয়াতের স্বার্থে এবং মানব সমাজের অবক্ষয় রোধে জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম প্রয়োজন। এটা তখন কোন ধর্ম কেন্দ্রিক প্রয়োজনীয়তা হিসেবে দেখা হবে না। মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এটার প্রয়োজনীয়তা প্রতিভাত হবে। এর প্রয়োজনীয়তা সভ্যতাগত।

 

 

 

 

 

জ্ঞান ইসলামীকরণ একটি কুরআনিক মিশন:

 

আল কুরআনে যেমনিভাবে কুরআন অধ্যয়ন করতে বলা হয়েছে, তেমনিভাবে বিশ্বজগত সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে বলা হয়েছে। এ জন্য প্রথম ওহীতেই দুধরণের পাঠ তথা অধ্যয়নের কথা বলা হয়। ইরশাদ হয়েছে:

 

ইক্বরা’ বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক্ব। খালাক্বাল ইনসানা মিন আলাক। ইক্বরা’ ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আল্লাযি আল্লামা বিল ক্বালাম।

 

“পাঠ করুন আপনার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার প্রভু মহা দয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।” ( সূরা আলাক: ১-৪)।

 

তাই আল কুরআনের জ্ঞান ও বিশ্বজগতের জ্ঞানের মাঝে সমন্বয় সাধন করতে হবে। তা কুরআন বুঝার জন্য এবং তা প্রয়োগ করার জন্যও। অতএব জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজটি কুরআনিক মিশনের আওতাভুক্ত।

 

 

 

সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইসলাম পশ্চাতপদ নয়:

 

প্রতি যুগেই সমসাময়িক কিছু প্রসঙ্গ বা সমস্যা থাকে, যা কোন কোন ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। যেমন: ব্যভিচার প্রমাণ করার জন্য আলকুরআনের বিধান হলো চারজন সাক্ষী প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান মেডিকেল সাইন্সের কথা হলো সংশ্লিষ্ট নর নারীকে পরীক্ষার মাধ্যমে ‍তা প্রমাণ করা যায়। তা হলে চার জন সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। তাহলে কি আলকুরআনের এ বিধান আজকের সমাজে অকার্যকর। এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় বলা যায়, না অকার্যকর নয়। কারণ মেডিকেল রিপোর্টেও ভুল হতে পারে। তাই চারজন ডাক্তার যদি কোন রিপোর্টের উপর একমত হয়, তা হলেই এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এভাবে সমন্বয় করা যেতে পারে।

 

এভাবে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভবের প্রেক্ষাপটে কুরআন সুন্নাহর আলোকে সমাধান দেয়া এবং বিকল্প তৈরী করে দেয়ার জন্য জ্ঞান ইসলামী করণ কার্যক্রমের প্রয়োজন। ইসলাম কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এসবের আলোকে কিয়ামত পর্যন্ত সমাধান দিতে হবে।এ ক্ষেত্রে মুসলিম স্কলারদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। এ ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইসলাম পশ্চাদপদ নয়।

 

মুসলিম উম্মাহ আব্বাসীয় আমলে গ্রীক সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন মোকাবেলা করেছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে উম্মাহকে বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। সুতরাং সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহ ইসলামীকরণের উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে।

 

 

 

বিশ্বায়নের যুগে সভ্যতার সঞ্চালন:

 

উনবিংশ শতাব্দীতে প্যান ইসলাম মতবাদের মাধ্যমে জামাল উদ্দীন আফগানী বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ইসলামী চিন্তা চেতনা ও সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য, আজও ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশ্বায়ন প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বায়ন মানে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিশ্বায়ন। এর বিকল্প হিসাবে একমাত্র বিশ্বজনীন জীবন ব্যবস্থা ইসলাম। এর প্রসারের মাধ্যমেই কাঙ্খিত বিশ্বায়ন সম্ভব। মুসলিম উম্মাহর উদ্ভব যেহেতু বিশ্বমানবের জন্য, সেহেতু উম্মাহভিত্তিক এ কাজ করা সকল মুসলমানের কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম অবদান রাখতে পারে।

 

 

 

স্বনির্ভর মুসলিম বিশ্ব গড়া:

 

জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহকে পরনির্ভর হলে কাঙ্খিত উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব নয়। মুসলিম বিশ্ব জনশক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও স্বনির্ভর হতে পারছে না। কারণ এগুলোর চালিকাশক্তি হলো জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি। অথচ এ ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ পশ্চাতপদ। প্রতিটি সভ্যতার অধিকারীরা নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্যের আলোকে তাদের প্রযুক্তির বিন্যাস করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই সে সব প্রযুক্তি মুসলিম সমাজে আমদানী করার পর সেগুলো ইসলামী মূল্যবোধের কিছু পরিপন্থী কিছু দেখলেই সাধারণ মুসলমান তা প্রত্যাখ্যান করছে কিংবা ঈমান হারার আশংকায় সেগুলো যথাযথ ব্যবহার থেকে দূরে থাকছে। যেমন: তথ্য প্রযুক্তির বিষয়টি। তাই ইসলামী মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের আলোকে জ্ঞান বিজ্ঞানগুলোকে সাজাতে হবে এবং মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে সেগুলোর উন্নয়ন করতে হবে। তা হলেই এগুলো কার্যকর হবে। আর এ কাজে জ্ঞান ইসলামীকরণ ছাড়া মুসলিম উম্মাহর গত্যন্তর নেই।

 

মোট উম্মাহর পুনর্গঠন করতে হলে, দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করতে হলে জ্ঞান ইসলামীকরণের বিকল্প নেই। উম্মাহর প্রয়োজনেই বিজাতীয় রীতিনীতি, বিনোদন মাধ্যম, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চর্চা, অসাড় শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি বিস্তারের প্রধান বাহন জ্ঞান তত্ত্ব, জ্ঞান আহরণ ও বিতরণ প্রক্রিয়া ইসলামীকরণ করা। দ্বিমুখী শিক্ষা মুসলমানদের অধ:পতনের মূল কারণ। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে উম্মাহর পুনর্গঠন এবং আল্লাহ তায়ালার অর্পিত দায়িত্ব পালনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হবে। তাই এ ক্ষেত্রে মুসলিম চিন্তাবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। জ্ঞানের বিষয় বা শাখা হিসাবে মানবিক, সমাজবিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ইসলামী দর্শনের আলোকে পুনর্গঠিত করতে হবে। প্রতিটি বিষয় পদ্ধতি কৌশল, উপাত্ত, সমস্যা লক্ষ্য ও আকাঙ্খার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইসলামী নীতিমালার আলোকে ঢেলে সাজানো আবশ্যক। যতদিন জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ইসলামের আলোকে না সাজানো হবে- যতদিন ইসলামী মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরী না হবে, ততদিন ইহকালে ও পরকালে শান্তি আশা করা কল্পনাবিলাস মাত্র্র। আর এ কাজটি করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন জ্ঞান বা শিক্ষার ইসলামীকরণ করা।

 

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

 

জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রমের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ:

 

উৎপত্তি:

 

ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বের আলোকে জ্ঞানের উতস আল্লাহ তাআলা। তিনিই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন জ্ঞান, যা তারা জানত না। ইরশাদ হয়েছে: আলকুরআনে আরো বলা হয়: ক্বালা তাআলা: আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম।

 

‘তিনি মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জ্ঞাত ছিল না।’ (সূরা আলাক্ব: ৫)

 

তিনি প্রথম মানুষ আদম আ: কে সৃষ্টি করে জ্ঞান দান করেন। ইরশাদ হয়েছে: ক্বালা তাআলা: ওয়া আল্লামা আদামাল আসমা আকুল্লাহা।

 

তিনি আদমকে সকল কিছুর নাম পরিচয় শিক্ষা দেন। (সূরা বাকারা: ৩১)।

 

তিনি আদম আ: জীবন চলার জন্য সঠিক জ্ঞান দান করেন এবং প্রশিক্ষণের জন্য জান্নাতে কিছুদিন বসবাস করার অনুমতি দেন। তখন মানব জাতির দুশমন ইবলিস শায়তান এসে ভ্রান্ত জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করে বলে আমি কী তোমাকে এমন একটি গাছ সম্পর্কে জ্ঞান দান করব, যার ফল ভক্ষণ করলে তুমি চিরস্থায়ীভাবে জান্নাতে থেকে যাবে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে: ‍ফাওয়াসওসা ইলাইহিশ শায়তানু ক্বালা ইয়া আদামা হাল আদুল্লুকা আলা শাজারাতিল খুলদি ওয়া মুলকিল লা এবলা।

 

‘শায়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। আর বলল, হে আদম! আমি কী তোমাকে চিরঞ্জীবনী গাছ ও রাজত্বের সন্ধান দিব যা কোন দিন শেষ হবে না।’ (সূরা: ত্বহা: ১২০)

 

যা হোক শায়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রতারণামূলক তথ্য বা জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেন। পরিণতিতে তাকে জান্নাত থেকে বের হতে হয়। শায়তান প্রদত্ত জ্ঞান সংশোধন করে আল্লাহ পাক আদমকে অবহিত করেন যে, এ তোমার শত্রু। তার ব্যাপারে তুমি সতর্ক থাকবে। এভাবেই জ্ঞানের ইসলামীকরণ কার্যক্রমের উন্মেষ ঘটে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে: ফাআযাল্লাহুমুশ শায়তানু আনহা ফাআখরজাহুমা মিম্মা কানা ফীহি ওয়াক্বুলনাহ বিত্বূ বা’ধুকুম লিবা’ধিন আদুউল্লাকুম ফিল আরদ্বি মুসতাক্বাররাউঁ ওয়া মাতাআন ইলা হীন। ফাতালাক্বা আদামা মির রব্বিহী কালিমাতিং ফাতাবা ইলাইহি। ইন্নাহু হুয়াততাওয়াবুর রহীম। ক্বুলনাহ বিত্বূ মিনহা জামীআ। ফাইম্মা এ’তিয়ান্নাকুম মিন্নী হুদাং ফামাং তাবিআ হুদা এফালা খাওফুন আলাইহিম ওলা হুম এহ‌যানূন।

 

‘শায়তান আদম ও হাওয়াকে বিচ্যুত করল এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে বের করে দিল। আমি তখন বললাম, তোমরা সকল যমীনে নেমে যাও পরষ্পরে শত্রু হিসেবে। এ যমীনে নির্দিষ্টকাল তোমাদের জন্য অবস্থান স্থল ও ভোগ্য বস্তু রয়েছে। অত:পর আদম তার প্রভুর নিকট থেকে কতিপয় বাণী প্রাপ্ত হন। এর ভিত্তিতে তিনি তাওবা করেন তথা ইসলামী চেতনা গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাওবা কবুলকারী দয়াময়।

 

আমি বললাম তোমরা সকলে যমীনে নেমে যাও। যখন আমার নিকট থেকে পথ নির্দেশ আসবে তখন যারা আমার পথনির্দেশ অনুসরণ করবে, তাদের জন্য কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্থও হবে না।’ (সূরা বাকারা: 3৩৬-৩৮)।

 

এভাবে জ্ঞান ইসলামীকরণের কার্যক্রম উন্মেষের পর এটি বর্তমানকাল পর্যন্ত কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করে। যা নিম্নরূপ:

 

ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়:

 

প্রথম পর্যায়: নবুওয়াতী ধারা:

 

হযরত আদম আ: এর পর মানব জাতি যখনই আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও হেদায়েত থেকে বিচ্যুত হয়ে অজ্ঞানতার প্রতি, মিথ্যার প্রতি ধাবিত হয়েছে, তখনই যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে। তারা মানব সমাজে প্রচলিত জ্ঞান সংশোধন করেন এবং ইসলামী জ্ঞানকে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেন। তাদের সকলের কাজ জ্ঞান ইসলামী করণ কাজের আওতাভুক্ত। এভাবে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সা: আগমন করেন এবং জ্ঞান ইসলামীকরণে সামগ্রিক প্রচেষ্টা নিয়োগ করেন। তাঁর মাধ্যমে প্রাপ্ত কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান ও তাঁর যুগ এ ক্ষেত্রে সকল যুগের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট মডেল।

 

দ্বিতীয় পর্যায়: মধ্যযুগে গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানের আগ্রাসন মোকাবেলা:

 

নবুওয়াতী ধারায় রচিত জ্ঞান ভাণ্ডারে পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবীগণের যুগ অতিবাহিত হয়। তারা নতুন কোন সমস্যা দেখা দিলে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ব্যক্তিগতভাবে এবং সামষ্টিকভাবে ইজতিহাদ করেছেন। ইসলামীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবস্থাদি চালু করেছেন। এভাবে তাবেঈন তথা উমাইয়াদের যুগ অতিবাহিত হয়। কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির প্রেক্ষাপটে মুসলমানগণ এমন এমন এলাকায় গমন করেন, যেখানে গ্রীক রোমান জ্ঞান বিজ্ঞান প্রচলিত ছিল। তখন অতি উতসাহ ভরে ও অমুসলিমদের প্রভাবে কিছু মুসলিম পণ্ডিত আব্বাসীয় আমলে গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞান আরবীতে অনুবাদ করে আলোচনা শুরু করেন। তখন চার ধরণের দৃষ্টিভঙ্গীর উন্মেষ ঘটে।

 

 

 

ক. প্রচণ্ড প্রভাবিত হওয়া:

 

বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক পর্যায়ে মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিজ্ঞানের উপর অফুরন্ত নির্ভরশীলতার উন্মেষ ঘটে। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে মুসলিম মুতাযেলী সম্প্রদায়। তারা গ্রীক দর্শনের প্রচণ্ড ভক্ত বনে যায়। তাদের মধ্যে একদল গ্রীক যুক্তি বিদ্যায় আকৃষ্ট হয়ে জ্ঞানের সকল পর্যায়ে গ্রীক মানতিক তথা যুক্তিবিদ্যা প্রয়োগ করতে শুরু করে। তাদের বুদ্ধিভিত্তিক মূলনীতির বাইরে কিছু হলে তা পরিহার বা উপেক্ষা করতে শুরু করে।

 

 

 

খ. প্রত্যাখ্যান:

 

অপরদিকে কুরআন সুন্নাহে আকড়িয়ে ধরা উলামায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিছগণ গ্রীক দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞান প্রত্যাখ্যান করে। তারা মনে করেন, জীবন পরিচালনার জন্য কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানই যথেষ্ট।

 

গ. সমন্বয় সাধনের চেষ্টা:

 

গ্রীক দর্শন অধ্যয়ন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় লিপ্ত কিছু ব্যক্তি মুসলিম দার্শনিক বলে আত্মপ্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে মুতাযেলা সহ অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিও ছিলেন। তার মধ্যে আবু নসর ফারাবীর মত কিছু ব্যক্তি ইসলামী চিন্তাধারা ও গ্রীক চিন্তাধারার মাঝে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন।

 

ঘ. অসারতা প্রমাণ:

 

অপরদিকে আবুল হাসান আশআরীর মতো কিছু কালাম শাস্ত্রবিদ মুতাযেলী মতবাদ পরিত্যাগ করে মুতাযেলী মতবাদ ও গ্রীক দর্শনের বিভিন্ন তত্ত্ব ও  তথ্য খন্ডন করার কাজে আত্ম নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে ইমাম আবু হামেদ গাযালী এসে তাহাফাতুল ফালাসাফা লিখে গ্রীক দর্শনের খন্ডন করেন এবং এর অসারতা প্রমাণ করেন। অত:পর ইবন তাইমিয়া প্রমাণ করেন যে, শুধু গ্রীক দর্শন অসার নয়, বরং এ দর্শন যে ভিত্তি ও পদ্ধতির উপর প্রতিষ্টিত তাও অসার। এ বিষয়ে তিনি আর রাদ্দু আলাল মানতিকিয়্যিন নামক গ্রন্থ লেখে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

 

তৃতীয় পর্যায়: দ্বীনী জ্ঞান বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবিতকরণের প্রয়াস:

 

এ পর্যায়ে এসে উলামায়ে কেরাম গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিবর্তে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবীতকরণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এক্ষেত্রে পথিকৃত হলেন ইমাম আবু হামেদ গাযালী। এ লক্ষ্যে তিনি রচনা করেন ‘ইহইয়াউ উলুমিদ দ্বীন’ (দ্বীনি জ্ঞান সমূহের পুনরুজ্জীবীতকরণ)। অবশ্য কিছু রচনায় গ্রীক যুক্তিবিদ্যা তথা মানতিক থেকে তিনি একেবারে বের হয়ে আসেন নি। তবে তিনি তা ইসলামী ভাবধারায় গ্রহণ বর্জন করেছেন। এর প্রতিফলন ঘটে উসূলে ফিকহ তথা ইসলামী গবেষণা পদ্ধতির উপর লেখা তাঁর অমর গ্রন্থ ‘আল মুস্তাসফা ফী ইলমিল উসূল’ নামক গ্রন্থে। এর ভূমিকায় তিনি মানতিকী তথা যুক্তি বিদ্যার স্টাইলে ব্যাপক আলোচনা করেছেন।

 

একই ধারায় শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া এ ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। বিশেষত তার রচিত কয়েকটি গ্রন্থে। তন্মধ্যে: আর রাদ্দু আলাল মানতিকিয়্যিন, ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম, কিতাবুল ঈমান, রাফউল মালাম আন আইয়্যিম্মাতিল আলাম, বিভিন্ন ফাতাওয়া ইত্যাদি গ্রন্থে। এ জন্যে জ্ঞান ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে ইবন তাইমিয়াকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়।

 

 

 

একইভাবে তাঁর শিষ্য ইবনুল কায়্যিমও ব্যাপক অবদান রাখেন। বিশেষত তাঁর রচিত মাদারিজুস সালিকীন, আস সাওয়াইকুল মুরসালা, কিতাবুর রুহ, ইলামুল মুওয়াক্কিয়িন, আত তুরুকুল হিকামিয়্যা ইত্যাদি গ্রন্থে। অপরদিকে স্পেনের বিভিন্ন মুসলিম শিক্ষায়তনে অধ্যয়ন করে তাদের প্রভাবে খ্রিস্টান স্কলাস্টিক বা ধর্মবিদরা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে সেন্ট টমাস একুইনাসের আমল থেকে গ্রীক দর্শনের আলোকে খ্রিস্টীয় মতবাদ সংস্কারের চেষ্টা করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জ্ঞানকে খ্রিস্টিয় ধারায় সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে কেউ কেউ একে খ্রিস্টায়নের সূচনা বলে আখ্যায়িত করেন।

 

 

 

চতুর্থ পর্যায়: ইজতিহাদে মন্দাভাব ও উম্মাহর পশ্চাতপদতা:

 

থ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর পর থেকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে মাযহাবী চেতনার ব্যাপক প্রসারের কারণে কুরআন ও সুন্নাহের উপর সরাসরি ইজতিহাদের মাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। তখন সুফী, আশআরী ও যাহেরী ফকীহগণের মাধ্যমে ওহী জ্ঞান ও আকলের মাঝে দ্বন্ধ সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে মন্দাভাব দেখা যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের পর এ মন্দাভাবটির আরো প্রসার ঘটে।

 

অপরদিকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে মুসলিম জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রভাবে আলোকিত যুগ শুরু হয়। সেখানে ধর্মীয় স্তর থেকে নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটলে নতুন নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। এগুলো মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার পর ইজতিহাদের দৈন্যতার কারণে মুসলিম স্কলারগণ এগুলোকে ইসলামের আলোকে মূল্যায়নে যথাযথ গুরুত্বারোপ করেননি। ফলে মুসলিম শাসকবর্গ এ সব দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপ থেকে আমদানী করতে শুরু করেন। বিশেষত তুরস্কের উসমানী খিলাফতের মাধ্যমে এগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটে।

 

এভাবে মুসলমানগণ জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতৃত্ব হারায়। যদিও তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মতাত্ত্বিক ও বৈষয়িক বিষয়ের সমন্বয় ছিল, কিন্তু বৈষয়িকতায় পশ্চাতপদতার কারণে তা সমসাময়িক বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে যথাযথ সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেনি।

 

-------------------

 

৬. দ্র: ড. ত্বাহা জাবির আলওয়ানী, ইবন তাইমিয়া ওয়া ইসলামিয়্যাতুল মা’রিফা।

 

৭. ঢাকাস্থ ইসলামী একাডেমী কর্তৃক আয়োজিত ডিসকের্সে ড. এমাজ উদ্দীন একে খ্রিস্টায়ন বলে আখ্যায়িত করেন। ( গ্রন্থনা: ইশারফ হোসেন)।

 

 

 

অবশ্য সে সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (১৭৬২ খ্রি.) ও হিজাযে শায়খ মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব নজদী ( মৃ. ১৭৮৭ খ্রি.) সংস্কারের চেষ্টা করেন এবং মুক্তভাবে ইজতিহাদ করার প্রয়াস চালান। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ: এর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের নির্যাস তুলে ধরে সমাজের জন্য তার কল্যাণকারিতা তুলে ধরে চেষ্টা করেন। এ পদক্ষেপটিকেও জ্ঞান ইসলামীকরণের প্রচেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম প্রশাসকগণ এ সব প্রচেষ্টা দ্বারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত হননি।

 

 

 

পঞ্চম পর্যায়: নব জাগরণ ও আধুনিকায়ন:

 

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ও উনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম সমাজে আধুনিকায়নের জোয়ার বয়ে যায়। ইউরোপীয় রেনেসাঁয় ‘জ্ঞানবিপ্লব’ ঘটে। কিন্তু আধুনিকায়নের মানদণ্ড কি হবে। এ নিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও উলামার মাঝে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে কটি নিম্নরূপ:

 

ক. সেকুলারায়নের প্রচেষ্টা:

 

অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশেষত ইউরোপে চার্চের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় শাসক শ্রেণী ও বিজ্ঞানীদের যৌথ অবস্থান গ্রহণ করায় সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism) এর জন্ম নেয়। তখন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সমাজবিজ্ঞানীগণ ধর্মকে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করে লেখালেখি শুরু করে। ফলে রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ধর্মের প্রভাভমুক্ত করার প্রয়াস চলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদিতার প্রসারের সাথে সাথে এসব অঞ্চলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সয়লাব বয়ে যায়। তারা তাদের সুবিধার্থেই মুসলিম সমাজকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা আয়োজন করে। যে জন্য চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা চালায় এবং ইসলামী শিক্ষা সংস্কার ও আধুনিকায়নের নামে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানকে খাট ছাট করতে শুরু করে। বিশেষ করে বৃটিশ বেনিয়ারা ভারত এবং সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্স মিসর দখল করার পর এ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল।

 

 

 

খ. পাশ্চাত্যায়নের প্রচেষ্টা:

 

‍ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বের কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবি ও নেতা মুসলিম সমাজকে পাশ্চাত্যের মডেলে পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন। তুরস্কের উসমানী খিলাফত বিশেষত সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ (১৮০৮-১৮৩৯ খ্রি.) পাশ্চাত্যের মডেলে সামরিক বিভাগ সংস্কার করতে যেয়ে প্রশাসনিক ও শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার আনার জন্য সভাসদীয় কিছু আলেমের সাথে পরামর্শ করেন। তারাও এ ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করে। ফলে তখন তুরস্কে পাশ্চাত্য ব্যবস্থা ব্যপকভাবে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে উসমানী খিলাফতের পতনের পর তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্য মুছে ফেলে ইউরোপের আদলে তুরস্ককে গড়ার জন্য সর্বোত চেষ্টা নিয়োজিত করে। এদিকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার যেসব অঞ্চল বৃটিশ, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালরা দখল করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে সে সব এলাকাতেও পাশ্চাত্যায়নের চেষ্টা চালায়। এ ক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়া ও কাজ করার জন্য ইউরোপ থেকে কিছু প্রাচ্যবিদ (Orientalist) বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসে। এমনকি সে অঞ্চলে দেশীয় মুসলিমও এগিয়ে আসে তাদের সহযোগিতায়। যেমন মিসরের ত্বহা হোসাইন, মুহাম্মদ সালামা প্রমূখ মিসরকে পাশ্চাত্যায়নের জন্য সামগ্রিক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিল।

 

 

 

গ. সমন্বয়ের প্রচেষ্ঠা

 

মুসলিম চিন্তাধারা ও সমাজকে আধুনিকায়নের নামে পাশ্চাত্যায়ন প্রচেষ্টার পাশাপাশি আরেকদল মুসলিম বুদ্ধিজীবী পাশ্চাত্য দর্শন ও ব্যবস্থাপনার সাথে ইসলামের সমন্বয় সাধনেরও চেষ্টা করেছিলেন। তন্মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের স্যার সৈয়দ আহমদ (মৃ. ১৮৯৮), মিসরের আলী আবদুর রাজ্জাক, মুহাম্মদ আলী জাওহারী প্রমূখ এ ক্ষেত্রে কিছু কাজ করেন। কিন্তু এ কাজ করতে যেয়ে পাশ্চাত্যের চিন্তা চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে এর সাথে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে খাট ছাট করতে বা ব্যাখ্যা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি।

 

 

 

ঘ. প্যান ইসলামিযম আন্দোলন:

 

পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন একত্রিত হয়ে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের মধ্যে বাটোয়ারা করে দখল করছিল, তখন বিশ্বের সমস্ত মুসলমানকে একই খলীফার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য প্যান ইসলামিযম (Pan -Islamism) বা বিশ্ব ইসলামীবাদ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। এ আন্দোলনের অগ্রনায়ক ছিলেন আফগানিস্তানের বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী সায়্যিদ জামাল উদ্দিন আফগানী (মৃত: ১৯৭০ খ্রি.) এছাড়া, তুরস্কের সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ ছিলেন এ আন্দোলনের একজন বড় সমর্থক। জামাল উদ্দীন আফগানী সারা বিশ্ব ঘুরে মুসলমানদেরকে সচেতন করতে থাকেন। তিনি মিসরে শায়খ মুহাম্মদ আবদুহু (মৃত ১৯০৫) ও সায়্যিদ রাশীদ রেদার মত কিছু শিষ্য পেয়ে যান। তাঁর নিজের ও শিষ্যদের বক্তব্য ছিল, পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ নয়। ইসলামী চিন্তা ধারা ও সমাজ সংস্কার করতে হবে। মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ কাজে তারা আল উরওয়াতুল উসকা নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর মাত্র সতেরটি সংখ্যার মাধ্যমে মুসলিম চিন্তা ধারা সংস্কারের ব্যাপক কর্মসূচী উপস্থাপন করা হয়। অত:পর সায়্যিদ রেদা প্রকাশিত আল মানার পত্রিকাটিও একই ভূমিকা পালন করে। এ জন্য জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে এ আন্দোলনটি একটি মাইলফলক। কিন্তু পরবর্তীতে সে খিলাফতের পতনের পর এ আন্দোলন তুরস্কে ম্লান হয়ে গেলেও এ আন্দোলনের ছোয়ায় মুসলিম উম্মাহর মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে। বরং ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হয়।

 

 

 

ঙ. ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ:

 

প্যান ইসলামীবাদের প্রভাবে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে মুসলিম বিশ্বে এমনকিছু চিন্তাবিদের উদ্ভব হয়, যারা পাশ্চাত্য দর্শনের প্রাধান্যকে সমালোচনার সুম্মুখীন করেন। তারা পশ্চিমা বিশ্বের ভাল ভাল বিষয়গুলো গ্রহণ করা এবং যা ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তা বর্জন করার আহবান জানান। সাথে সাথে কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য ব্যাপক চিন্তাভাবনা ও গবেষণা চালান এবং মুসলিম সমাজ সংস্কার ও সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। এ ক্ষেত্রে মিসরের হাসানুল বান্না ও তার প্রতিষ্টিত ইখওয়ানুল মুসলিমীন ( প্রতিষ্ঠা ১৯২৮খ্রি.) এর সাথে জড়িত ও সমর্থনকারী আলেমগণের অবদান সবচেয়ে বেশী। তন্মধ্যে: শহীদ আবদুল কাদের আওদা, সায়্যিদ কুতুব, মুহাম্মদ কুতুব, মুহাম্মদ গাযালী প্রমূখের নাম উল্লেখ্য। এমনিভাবে তৎকালীন ভারতের আল্লামা শিবলী নোমানী, রেনেসার কবি ড. আল্লামা ইকবার (মৃত ১৯৩৮) ও মাওলানা আবুল আলা মওদুদী প্রমূখ এক্ষেত্রে অবদান রাখেন। মাও. মওদুদী তার তরজুমানুল কুরআন পত্রিকা ও অন্যান্য বই পুস্তকের মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। উপরে বর্ণিত সকল মুসলিম চিন্তাবিদ প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যেন, ইসলাম ও পশ্চিমা সভ্যতার মাঝে পার্থক্য আছে। তাই ঢালাওভাবে সবকিছু গ্রহণ করা যাবে না। কুরআন সুন্নাহর আলোকে আধুনিক যুগ প্রেক্ষাপটেও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তারা প্রচলিত অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও আইন ইত্যাদি ইসলামীকরণের জন্য প্রচুর লেখালেখি করেন এবং গ্রন্থাদি রচনা করেন।

 

 

 

৬ষ্ঠ পর্যায়: শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামায়ন:

 

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুসলিম উম্মাহর প্রাজ্ঞ উলামা ও নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করতে শুরু করলেন যে, মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণের পথ শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামের আলোকে সংষ্কার ও আধুনিকায়ন। এর মাধ্যমেই মানব সমাজ ইসলামীকরণ করা সম্ভব। ১৯০৮ সালেই বঙ্গীয় অঞ্চলে মাও. আবু নসর ওহীদ সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার মাঝে সমন্বয়ধর্মী একটি পরিকল্পনা তৈরী করেন। এ জন্য তিনি মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, ভারতে মাওলানা শিবলী নোমানী সহ অনেক পণ্ডিতের সাথে মতবিনিময়। তৎকালীন বৃটিশ ভারতের ইংরেজ শাসক ও বুদ্ধিজীবিরা এতে উষ্মা প্রকাশ করলেও একে এ রিপোর্টকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় অঞ্চলে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। ইসলাম প্রচার ও বিশেষজ্ঞ তৈরীর জন্য ১৯১৫ সালে মাও: মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী কর্তৃক ‘আরবী বিশ্ববিদ্যালয়’ পরিকল্পনা এবং বৃটিশ সরকার কর্তৃক গঠিত মাওলাবক্স কমিটি (১৯৩৮) মাদরাসা শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে এ অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Islamic Learning)  প্রতিষ্ঠার রিপোর্ট তৈরী করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ বেনিয়া তা বাস্তবায়ন করেনি।

 

ইতোমধ্যে ১৯৩০ সালে মিসরের আল আযহার ও মরক্কো ফাসের কায়রোয়ান বিশ্ববিদ্যালয় সংষ্কার ও উন্নয়ন করা হয়। তাতেও আধুনিক শিক্ষার বিভিন্ন শাখার আলোকে বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে সে সব শাখায় ইসলামী চিন্তা চেতনা প্রবিষ্ট করানোর প্রয়াস চলে।

 

অপরদিকে ভারতে দেওবন্দ মাদরাসায় হাদীছ ও দরসের পাশাপাশি দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়নের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সমসাময়িক কালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের নদওয়াতুল উলামার শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী ও প্রচলিত অর্থে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে কারিকুলাম তৈরী করে তা পঠন পাঠনের ব্যবস্থা করা হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন মাও: সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী।

 

অত:পর বঙ্গীয় অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন থেমে যায়নি। এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (১৯৬৩) প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়। এ কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. এস এম হোসাইন (তাঁর একটি গ্রন্থ আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যভুক্ত) এর নেতৃত্বে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত একটি স্কীম প্রণয়ন করে সরকারের নিকট পেশ করেন। সমকালীন মুসলিম বিশ্বের শিক্ষার ইতিহাসে বঙ্গীয় অঞ্চলের এ রিপোর্টটি শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামীকরণ আন্দোলনে একটি মাইলফলক। কিন্তু ততকালীন সরকার তাও বাস্তবায়ন করেনি। এটি বাস্তবায়ন করলে হয়তো ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রটি এ ক্ষেত্রে ততকালীন মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মডেল হতে পারতো।

 

এভাবে বাংলাদেশরই আরেক কৃতি সন্তান প্রফেসর ড. সৈয়দ আলী আশরাফ বর্তমান সৌদি আরবের জেদ্দাস্থ কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে অধ্যাপক থাকাবস্থায় বাংলাদেশীয় শিক্ষা আন্দোলনকে গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ১৯৭৫ সালে গবেষণা ও পরিকল্পনা করেন। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অধ্যয়ন ও উলামার সাথে পর্যালোচনা করেন একটি শিক্ষাদর্শন সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেন এবং সে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থার উন্নতি করতে হলে সেই শিক্ষা দর্শনের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামীকরণ করতে হবে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ততকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আবদুল্লাহ উমর নাসীফ ও ততকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী শায়খ আহমদ সালাহ জামজুম, তথ্য মন্ত্রী ড. শায়খ আবদুহু ইয়ামেনী প্রমূখ এ পরিকল্পনা সমর্থন করে এতে সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তাদের সহযোগিতায় ড. সৈয়দ আলী আশরাফ গোটা মুসলিম বিশ্ব থেকে মুসলিম শিক্ষাবিদদের নিয়ে মক্কায় বিশ্বমুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে পবিত্র নগরী মক্কায় এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫০ জন মন্ত্রীসহ প্রায় ৪৫০ জন বুদ্ধিজীবী প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করে। গোটা মুসলিম বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামীকরণের পথে এ সম্মেলনটি ছিল একটি মাইল ফলক।

 

এ সম্মেলনে সারা বিশ্বের মুসলিম চিন্তাবিদ এবং কয়েকজন অতিথি চিন্তাবিদ একত্রিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পৃথক পৃথক সেশনে জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে ৭দিন ব্যাপী আলোচনা শেষে তারা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার উপর জোর দেন। এবং প্রথমে কুরআনিক জ্ঞান তত্ত্বেরও আলোকে জ্ঞানের শ্রেণি বিভাগ ও শিক্ষার সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন। তারা ঐক্যমত্যে পৌঁছেন যে, শিক্ষা মানে শুধু জ্ঞান চর্চা নয়, বরং শিক্ষার মর্মমূলে বিশ্বাস, ধর্ম থাকতে হবে। অর্থাত ইসলামী জীবনাদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। মুসলিম সমাজ ও বিভিন্ন মুসলিম দেশে মুসলমানদের মধ্যে দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রচলিত ধর্মীয় শিক্ষা বা মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণা, আলাপ আলোচনা এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের সাথে আধুনিক শিক্ষিতদের সম্পর্ক সৃষ্টি ও সমন্বয়।

 

সম্মেলনের সুপারিশ সমূহ কার্যকর করার জন্য একটি ফলোআপ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে শায়খ আহমদ সালাহ জামজুম এবং সেক্রেটারী হিসেবে ড. সৈয়দ আলী আশরাফ মরহুমকে নির্বাচিত করা হয়।

 

একই বৎসর ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) উদ্যোগে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সৌদি আরবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড সেন্টার ফর ইসলামিক এডুকেশন’। এর পরিচালক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন ড. সৈয়দ আলী আশরাফ।

 

এ সম্মেলনেরই ধারাবাহিকতায় আরো পাঁচটি আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ নিয়ে সর্বমোট ৬টি সম্মেলন। এগুলোর আলোচ্য বিষয়সহ কিছু তথ্যাদি নিম্নরূপ:

 

 

 

 

 

ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন বিষয় সাল স্থান দেশ
প্রথম ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি ১৯৭৭ মক্কা সৌদিআরব
দ্বিতীয় শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন ১৯৮০ ইসলামাবাদ পাকিস্তান
তৃতীয় পাঠ্যপুস্তক রচনা ১৯৮১ ঢাকা বাংলাদেশ
চতুর্থ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ১৯৮২ জাকার্তা ইন্দোনেশিয়া
পঞ্চম পূর্ববর্তী সম্মেলন সমূহের মূল্যায়ন ১৯৮৭ কায়রো মিসর
ষষ্ঠ ইসলামী শিক্ষার কর্মশালা বিশেষত স্কুল প্রতিষ্ঠার কৌশল ও কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন ইত্যাদি ১৯৯৬ কেপটাউন দক্ষিণ আফ্রিকা

 

 সপ্তম পর্যায়: জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলন

 

জ্ঞান ইসলামীকরণ’ প্রত্যয়টি প্রথম ব্যবহার করেন মালয়েশিয়ান ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ড. সায়্যিদ মুহাম্মদ নকীব আল্ আত্তাস। তিনি ১৯৬৭ সালে পাশ্চাত্যায়নের বিকল্প হিসেবে ইসলামায়ন (Islamization) শব্দটি একটি প্রবন্ধে ব্যবহার করেন একটি অঞ্চলকে ইসলামীকরণ কার্যক্রম প্রসঙ্গে আলোচনায়। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল:  Priliminary statement on a general theory of the Islamization of the Malay-Indonesian Archipelago  এটি ১৯৬৯ সালে কুয়ালালামপুরথেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালে তিনি আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর থাকাবস্থায় Secular-Secularization-Secularism শিরোনামে প্রবন্ধে Islamization of knowledge এবং The Dewestemization of knowledge  প্রত্যয় ব্যবহার করেন।

 

১৯৭৭ সালে মক্কায় শিক্ষা সম্মেলনে ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী উপস্থিত ছিলেন। তিনি সম্মেলনের বক্তব্যে মতামত ব্যক্ত করে বলেন, শিক্ষা তথা জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের মূলে যে জ্ঞান তা ইসলামীকরণ করতে হবে। এ জন্য মুসলিম উম্মাহর চিন্তা জগতে ও পদ্ধতিতে সংস্কার আনতে হবে। জ্ঞানের ভিত্তি মূলে ইসলামী ধ্যান ধারণা কিভাবে প্রাচীনকালে মুসলিম চিন্তাবিদরা বিভিন্ন জ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন, তার সঙ্গে আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য জ্ঞানীরা ধর্মকে বাদ দিয়ে যেসব ধারণার বশবর্তী হয়ে নানাবিধ জ্ঞান চর্চা করেছেন, এই ধ্যান ধারণাগুলোর তুলনা করে পাশ্চাত্য সেকুলার ধ্যান ধারণাকে ইসলামীকরণের প্রস্তাব করেন। ফলে একই বতসরে ইউরোপে কিছু মুসলিম স্কলারদের উদ্যোগে সুইজারল্যান্ডে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেন। সেখানে মুসলিম উম্মাহর মানস সংকট সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এ দুটি সম্মেলনের যৌথ চিন্তার আলোকে মনে করেন, উম্মাহর মানস সংকট উত্তরণের জন্য জ্ঞান ইসলামীকরণই বেশি জরুরী। ফলে তিনি জ্ঞান ইসলামীকরণের উপর আশির দশকের শুরুতে একটি গ্রন্থই রচনা করেন ( ১৯৮২ সালে প্রকাশিত)। ইতোমধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপে প্রবাসী কয়েখজন আরব মুসলিম স্কলারের সহায়তায় মুসলিম উম্মাহর চিন্তা ও মননের সংস্কার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে উত্তর আমেরিকায় তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জেনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট, International Institute of Islamic Thout সংক্ষেপে IIIT. এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নিয়োগ লাভ করেন ড. ইসমাঈল আল রাজী ফারুকী। এ প্রতিষ্ঠান এবং পাকিস্তান হিজরী নতুন শতাব্দী উদযাপন কমিটির যৌথ উদ্যোগে পরবর্তী বছরে অর্থাত ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের ইসলামাদে ‘জ্ঞান ইসলামীকরণ’ বিষয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তখন থেকেই ড. সৈয়দ আলী আশরাফের নেতৃত্বে মক্কাভিত্তিক ‘শিক্ষা ইসলামীকরণ আন্দোলন’ এবং ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর নেতৃত্বে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট, International Institute of Islamic Thout সংক্ষেপে IIIT আমেরিকা ভিত্তিক ‘জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলন’ হিসেবে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। যদিও উভয়ের লক্ষ্য মুসলিম উম্মাহর শিক্ষা ও জ্ঞানগত উন্নয়ন। তবুও উভয়ের মাঝে পদ্ধতিগত ও পরিধিগত পার্থক্য ফুটে উঠে। ড. সৈয়দ আলী আশরাফের পদ্ধতি হলো মানব প্রকৃতি ও জ্ঞান আহরণ সম্পর্কিত ইসলামী ধ্যানধারণার আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা। এটি অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক। অপরদিকে ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর নেতৃত্বে স্কলার গণের পদ্ধতি হলো উম্মাহর চিন্তাধারা ও জ্ঞান তত্ত্বের সংস্কার। অত:পর এর আলোকে সামাজিক বিজ্ঞান সমূহের ইসলামীকরণের উপর গুরুত্বারোপ করা। এ জন্য ট্রিপল আইটি থেকে American Journal of Islamic Social Science নামে একটি জার্নাল প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ সংস্থার সাথে যোগ দিয়েছে আমেরিকা ইউরোপভিত্তিক ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এসোসিয়েশন অব মুসলিম সোসিয়েল সাইন্টিস্ট (Association of Muslim Social Scientists)।

 

তাছাড়া, তারা মনে করেন, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে নয়, সামাজিকভাবেও জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। এ দিক দিয়ে এর পরিধি আরো ব্যাপক। উপরোক্ত দু ব্যক্তির ধারা অনুসারে দু ধরণের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। যেমন: ড. আলী আশরাফ মরহুম মানুষের আধ্যাত্মিক দিকটি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন, অপরদিকে ড. রাজী ও তার অনুসারীগণ সামাজিক বিজ্ঞানের উপর তথা মানব সমাজের বহিস্থ দিকের উপর প্রাধান্য দিচ্ছিলেন।

 

জ্ঞান ইসলামীকরণে সে সময়ে ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর সাথে মুসলিম সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে আরো যারা কাজ করছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, তৎকালীন রিয়াদস্থ মুহাম্মদ ইবন সাউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল হামিদ আবু সোলায়মান এবং ড. ত্বহা জাবির আলওয়ানী প্রমূখ। তারা উভয়ে বর্তমানের ট্রিফল আইটির দায়িত্বশীল। ড. আবু সোলায়মান ১৯৮৪ সালে মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর নিয়োগ লাভ করলে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি সহযোগি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়। যে জন্য ১৯৮৪ সালে ও ২০০০ সালে সে বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রিফল আইটির যৌথ উদ্যোগে জ্ঞান ইসলামীকরণের উপর দুটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে ট্রিফল আইটির উদ্যোগে আরে কটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। যেমন: ১৯৮৭ সালে খার্তুমে সম্মেলন। এসব সম্মেলনে শতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপিত ও আলোচিত হয়। এভাবে ট্রিফল আইটি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় শাখা প্রতিষ্ঠা করে। তন্মধ্যে: সৌদিআরব, বাংলাদেশ, সুদান, মিসর, নাইজেরিয়া, ব্রুনাই ইত্যাদি মুসলিম দেশের রাজধানী শহরে শাখা আছে। এমনিভাবে মালয়েশিয়াতে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট এণ্ড সিভিলাইজেশন ( International Institute of Islamic Thought And Civilization)। নামে কিছু পার্থক্য থাকলেও সারা বিশ্বব্যাপী এসব প্রতিষ্ঠান জ্ঞান ইসলামীকরণের উপর গবেষণা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রকাশনা ইত্যাদির মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে।

 

অষ্টম পর্যায়: জ্ঞান ও শিক্ষা ইসলামীকরণের মাঝে সমন্বয়:

 

জানা যায়, জীবনের শেষ সময়ে এসে বিশেষত ১৯৮৭ সালের দিকে ড. সৈয়দ আলী আশরাফ ও ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী উভয়ে একমত হন যে, পৃথকভাবে নয়, বরং জ্ঞান ও শিক্ষা উভয়টি ইসলামীকরণ করা প্রয়োজন। এটিই সর্বশেষ পর্যায়। ড. উমর নাসীফ এক সাক্ষাতকারেও ড. সৈয়দ আলী আশরাফের সর্বশেষ মত হিসেবে জ্ঞান ও শিক্ষার ইসলামীকরণ কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করেন। এমনকি এ পর্যায়ে তাকে পথিকৃত হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রকৃতপক্ষে উভয়টির মাঝে কোন দ্বন্ধ নেই। কারণ জ্ঞান হলো লক্ষ্য, আর শিক্ষা হলো জ্ঞান আহরণের উপায়। অন্যভাবে বলতে গেলে শিক্ষাকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বলাও বাস্তবভিত্তিক নয়। কারণ সামাজিক শিক্ষা ও গণমাধ্যমেরর মাধ্যমেও শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। সুতরাং উভয়টির সমন্বিত ইসলামীকরণ কার্যক্রমই অধিক কার্যকর এবং যথার্থ।

 

 

 

 

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

 

জ্ঞান ইসলামীকরণের পদ্ধতি

 

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর মতে জ্ঞানের ইসলামীকরণের পদ্ধতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা:১০

 

ক. মুসলিম উম্মাহর চিরাচরিত পদ্ধতি (Traditional Methodology)

 

খ. কাঙ্খিত ইসলামিক পদ্ধতি ( Islmic Methodology)

 

মুসলিম উম্মাহর চিরাচরিত পদ্ধতি:

 

জ্ঞানের ইসলামীকরণের চিরাচরিত পদ্ধতিটি ত্রুটিযুক্ত। ষষ্ঠ ও সপ্তম হিজরী শতাব্দিতে অমুসলিমরা উম্মাহর উপর গুরুতর আঘাত হানার ফলে মুসলিম নেতারা তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। প্রাচ্য থেকে উম্মাহর উপর হামলা চালায় এবং পাশ্চাত্য থেকে খৃস্টান ক্রুসেডরা। মুসলমানরা তাদের ধ্বংসোমুখ অবস্থা দেখে অতিরিক্ত রক্ষণশীল হয়ে পড়ে এবং তাদের পরিচয়ের স্বাক্ষর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ইসলামকে রক্ষার জন্য যে কোন পরিবর্তনের চিন্তা পরিহার করে এবং অক্ষরে অক্ষরে শরীয়াতের নির্দেশ মেনে চলার প্রতি অটল থাকে। এরপর তারা আইনের সৃজনশীলতার প্রধান উতস অর্থাত ইজতিহাদকে পরিত্যাগ করে তারা ইজতিহাদের দরজা বন্ধ বলে ঘোষণা করে। তাদের অভিমত হলো পূর্ব পুরুষদের কাজের মধ্য দিয়েই শরীয়াতের কাজ শেষ হয়ে গেছে। শরীয়াত থেকে নতুন প্রথা প্রবর্তন করাকে শরীয়াতের খেলাফ বলে ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন মাযহাবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী শরীয়া একটা গতিহীন সত্তায় পরিণত হলো। বলা হলো, শরীয়াতের কাজ হবে ইসলামকে টিকিয়া রাখা। ইসলাম টিকে থাকলো, এমনকি ৮ম থেকে দ্বাদশ শতাব্দিতে রুশ, বলকান অঞ্চল মধ্য ও দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত মুসলিম বিজয় ও সম্প্রসারণ সত্ত্বেও রক্ষণশীল প্রথা ও ব্যবস্থা খতম হয়নি। মুসলমানরা ব্যাপকভাবে তাসাউফ ও তার তরিকাগুলো গ্রহণ করার ফলে সৃজনশীলতার উতস হিসাবে ইজতিহাদের অভাবে সৃষ্ট অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। সুতরাং আধুনিককাল পর্যন্ত শরীয়া স্থবির হয়ে যায়। ফলে আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরী জ্ঞান পাশ্চাত্যকে মুসলমানদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা দান করে এবং তাদেরকে পরাভূত করে।

 

  1. \n
  2. ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী, জ্ঞান: ইসলামী রূপায়ন, বঙ্গানু. মুহা. সানাউল্লাহ আখুঞ্জী. পৃ. ৩৫-৫৭।
  3. \n

 

 

 

ক. ফিকহ ও ফকীহ ইজতিহাদ ও মুজতাহিদু

 

ফিকহ শব্দের অর্থ হচ্ছে পাণ্ডিত্য বা শরীয়াতের জ্ঞান। ফকীহ হচ্ছে, এই জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ। সাধারণ ফিকহ বলতে বুঝায় ইসলামের সকল মাযহাবে শরীয়াতের জ্ঞান। প্রাথমিক যুগের প্রকৃতপক্ষে এক-একজন এনসাইক্লোপেডিয়া ছিলেন। আজকের ফকীহদের জ্ঞান বা প্রজ্ঞা কোন অবস্থাতেই সেই মানের নয়। বর্তমান তাকলীদ পন্থী মুজতাহিদরা মাযহাবের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। এই চৌহদ্দির বাইরে তারা তাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে অক্ষম। এখন পরিস্থিতির দাবী হচ্ছে উসূল অর্থাত ইসলামী জ্ঞানের উতস অনুধাবনের জন্য একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা।

 

 

 

খ. ওহী ও আকলের পরস্পর বিচ্ছিন্নতা:

 

কোন কোন মুসলমানের উপর গ্রীক যুক্তিবিদ্যার প্রভাবের দরুণ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারা ইসলামের সত্য রূপের প্রতি অমুসলমানদের আকৃষ্ট করার জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।

 

 

 

গ. কর্ম থেকে চিন্তার বিচ্ছিন্নকরণ:

 

ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের নেতারা ছিলেন চিন্তাবিদ এবং চিন্তাবিদরাই ছিলেন নেতা। পরবর্তীতে শাসকরা বিদ্বান ব্যক্তিদের পরামর্শ ছাড়াই শাসনকার্য চালাতে থাকেন। চিন্তার দৈন্য তাদেরকে নানাবিধ সংকটের আবর্তে নিক্ষেপ করে। শাসক ও শাসিতের মধ্যে দুরত্বের সৃষ্টি হয়। মুসলিম চিন্তাবিদরা তাসাউফ চর্চা করে নিজেদের সমাজ সংসার থেকে দূরে রাখতে থাকে। প্রাথমিক যুগে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক বিষয়ের মধ্যে যে ভারসাম্য ছিল তা নষ্ট হয়ে যায়।

 

 

 

ঘ. সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দ্বৈততা:

 

ইসলামের প্রাথমিক যুগে সিরাতুল মুস্তাকীমের বৈশিষ্ট্য ছিল মুসলমানদের চিন্তা ও কর্মের জগতকে একটি অভিন্ন কাঠামোর সুসংহত করা। কিন্তু অবসয়ের যুগে এই সংহতরূপ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়-পার্থিব জগত ও পুন্যের জগত। পুন্যের জগতে সুফী চর্চার মাধ্যমে এমনসব ধ্যান ধারণার জন্ম দেয় যা খোদ ইসলামের পরিপন্থী। পক্ষান্তরে বৈষয়িক জগত একটা নৈতিকতাহীন ব্যবসা হিসেবে গড়ে উঠে। এক সময় উপনিবেশ শক্তি নিজস্ব শিক্ষা ও সংস্কৃতি চালু করে। তখন মুসলমানরা স্রেফ নিন্দা করার মধ্য দিয়েই এর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছিল। সামগ্রিক জেহাদ ঘোষণার ক্ষমতা তাদের ছিল না।

 

 

 

কাঙ্খিত ইসলামী পদ্ধতি:

 

ইসলামী চেতনার আলোকে জ্ঞানের ইসলামীকরণ করতে চাইলে কতিপয় নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার তত্ব ও পদ্ধতি, নীতিমালা ও লক্ষ্য নির্ধারণ করা। এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত মৌলিক বিষয় বিবেচনা করতে হবে।

 

১. আল্লাহর একত্ব

 

ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের প্রথম নীতি হচ্ছে আল্লাহ পাকের একত্ব বা তাওহীদ। আল্লাহ তায়ালাই সকল ক্রিয়ার তাতক্ষণিক চরম কারণ ও উদ্দেশ্য। এর বাইরে সকল কল্পনা, জ্ঞান অথবা মূল্যায়ন অস্তিত্বহীন, মিথ্যা, মূল্যহীন ও বিকৃত।

 

২. সৃষ্টির ঐক্য

 

ক. মহা জাগতিক শৃঙ্খলা:

 

বস্তুত মহাজগতে সংগতিপূর্ণ শৃঙ্খলা বিরাজমান বলেই আমরা পদার্থের অস্তিত্ব এবং ঘটনা প্রবাহের আবর্তনের কার্যকরণ সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। মহাজাগতিক শৃঙ্খলা ছাড়া কার্যকরণ ও কর্মফলের প্রশ্ন উঠতো না।

 

 

 

খ. সৃষ্টি জগত

 

আল্লাহ পাক সবকিছু সুনির্দিষ্ট পরিমাপ সহ সৃষ্টি করেছেন। জগতের সব সত্তা চূড়ান্ত ভাবে বা উপায় ও লক্ষ্য হিসাবে পারস্পরিক কার্যকরণসূত্র আবদ্ধ। মুসলমানরা সৃষ্টিকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসাবেই জানে এবং এর প্রতিটি অংশ প্রকট বা প্রচ্ছন্নভাবে কোন না কোন ভাবে কোন উদ্দেশ্য সাধন করে চলছে-যা সবটা মানুষের জানার বিষয় নয়। কিন্তু এই জ্ঞান তাদের ঈমানেরই ফলশ্রুতি।

 

 

 

গ. তাসখীর ( সৃষ্টি মানুষের জন্য)

 

আল্লাহ তাআলা গোটা জগতকে মানুষের জন্য একটি অস্থায়ী উপঢৌকন ও কর্মশালা হিসাব প্রদান করেছেন। সকল বস্তুকে মানুষের অধীন করে দিয়েছেন।

 

 

 

৩. সত্য ও জ্ঞানের ঐক্য:

 

ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞান তত্ত্বের প্রকৃত রূপ সত্যের ঐক্যের মধ্যেই নিহিত। এই ঐক্য মহান আল্লাহর একত্বের ধারণা থেকেই উতসারিত। আল্লাহ পাকের অপর নাম হচ্ছে আল হাক্ব বা সত্য।

 

প্রথমত: সত্যের ঐক্য এই নির্দেশ করে যে, বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ নয় এমন কোন বিষয়কে ওহীর আলোকে ব্যাখ্যা দেয়া চলবে না।

 

দ্বিতীয়ত: সত্যের ঐক্যে সূত্র অর্থাত স্রস্টার সৃষ্টিরীতির সাথে প্রাকৃতির বিধানের সুসংগতি এই শিক্ষাই দেয় যে সৃষ্টির ধারা বা এর কোন অংশ সম্পর্কে কোন সমীক্ষা শেষ ও চূড়ান্ত নয়।

 

যে যত বড় জ্ঞানীই হোক না কেন তার প্রায় নিশ্চিত সিদ্ধান্তের পরেও তাকে সব সময় এ কথা অবশ্যই বলতে হবে যে প্রকৃত সত্য আল্লাহই ভাল জানেন।

 

 

 

৪. জীবনের ঐক্য

 

ক. ঐশী আমানত

 

আল্লাহপাক দেয়া আমানত একমাত্র মানুষই বহন করেছে। আর আল্লাহ পাক জীন- মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁরই ইবাদতের ( একমাত্র আল্লাহর) জন্য। ফেরেশতাদের আল্লাহ পাক মানুষের সামনে সেজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মানুষের মর্যাদা অতি উচ্চে। মানুষ ইচ্ছে করলেই ভাল মন্দ কাজ করতে পারে। মানুষই নৈতিকতার দাবী অনুযায়ী সকল পাপাচার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পারে বলেই উন্নততর মূল্যবোধের গুরুত্ব উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়। মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত আমানতের মর্যাদা রাখতে হবে।

 

খ. খলিফা:

 

মানুষের ঐ আমানত বহনের দায়িত্ব নিয়েছে বলেই সে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষের পরিচয় সে আল্লাহর দাস ও আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষ যে আল্লাহর খলিফা এ কথা স্মরণ রাখতে হবে।

 

গ. ব্যাপকতা:

 

মানব জীবনের প্রতিটি দিক ইসলামের সাথে সাযুজপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই ব্যাপক। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের সাযুজ্যের সংজ্ঞা ও প্রায়োগিকতা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব মুসলিম চিন্তাবিদদের উপর অর্পিত হয়ে আছে।

 

 

 

৫. মানবতার ঐক্য:

 

আল্লাহ পাকের বাণী- হে মানব মণ্ডলী আমি তোমাদেরকে এক জোড়া পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পার।( ৪৯: ১৩) সকল মানুষের কল্যাণের বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। ইসলামী পদ্ধতির মাধ্যমে জ্ঞানের ইসলামীকরণের কাজ চালাতে হবে।

 

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

 

জ্ঞান ইসলামীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ

 

জ্ঞান ইসলামীকরণের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। নিম্নে কয়েক জনের মতামত উল্লেখ করা হলো:-

 

 

 

*ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর মতামত:

 

আধুনিক বিশ্বে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনের অগ্রপথিক হলেন ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী। তার মতে আধুনিক জ্ঞানের ইসলামীকরণ একটি মহান পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে, যদি সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের অংশ হিসাবে মুসলিম বিশ্বে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বাধ্যতামূলক কোর্স হিসেবে চালু করা হয়।

 

জ্ঞানের ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি যেসব মতামত দিয়েছেন, তা অতি সংক্ষেপে নিম্নরূপ-

 

প্রথম ধাপ: আধুনিক জ্ঞান আয়ত্তে আনা ও শ্রেণিবিন্যাসকরণ:

 

পশ্চিমা আধুনিক জ্ঞানের শাখাগুলোকে অবশ্যই শ্রেণি, নীতি, পদ্ধতি, সমস্যা ও বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিন্যস্ত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সূচীপত্রের তালিকা বা কোর্সের সিলেবাসের আলোকেই এই বিন্যাস করতে হবে।

 

 

 

দ্বিতীয় ধাপ: জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জরিপ:

 

জ্ঞানের প্রতিটি শাখার উপর জরিপ চালাতে হবে এবং এ সম্পর্কিত নিবন্ধে এর উতপত্তি ও ঐতিহাসিক বিকাশ, বিকাশের পদ্ধতি, দৃষ্টিপাতের ব্যাপকতা এবং এর পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের অবদানের উপর আলোকপাত করতে হবে। এ ধাপের উদ্দেশ্য হলো পাশ্চাত্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে উতকর্ষ সাধিত হয়েছে মুসলমানদেরকে সে সম্পর্কে অনুধাবন করতে সাহায্য করা।

 

 

 

তৃতীয় ধাপ: ইসলামী জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জন ও আয়ত্তে আনা:

 

জ্ঞানের সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সাথে ইসলামের বিস্তৃত সামুজ্য অন্বেষণের আগেই ঐ বিষয় সম্পর্কে ইসলামী জ্ঞান কী বলতে চায় তা উদঘাটন করা আবশ্যক। এই ৩য় ধাপের আধুনিক জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাথে সম্পর্কযুক্ত ইসলামী জ্ঞান অধ্যয়নের জন্য এর কয়েক খণ্ড সংকলন প্রণয়ন করতে হবে।

 

চতুর্থ ধাপ:

 

অতীতের মনীষীরা তাদের সমকালীন সমস্যার প্রেক্ষিতে ইসলামী জ্ঞান অধ্যয়ন করেছেন। তাদের গবেষণাকর্ম সে সময়ের ঐতিহাসিক পটভূমিতে বিশ্লেষণ এবং জীবন ও চিন্তার অন্যান্য বিভাগের সাথে সমসাময়িক সমস্যার সম্পর্ক চিহ্নিত করে তুলতে হবে। ইসলামী জ্ঞানের অবদানের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের ফলে নি:সন্দেহে ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপর ব্যাপক আলোকপাত হবে। ইসলামী জ্ঞানের বিশ্লেষণ বিক্ষিপ্তভাবে করলে চলবে না। ইসলামী চিন্তাবিদদেরকে এর একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করে ক্রমবিন্যাস করতে হবে।সর্বোপরি প্রধান নীতিসমূহ, প্রধান সমস্যাদি এবং বর্তমান সমস্যার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলো ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা কৌশলের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

 

 

 

পঞ্চম ধাপ: বর্তমান জ্ঞান শাখাগুলোর সাথে ইসলামের সুনির্দিষ্ট সাযুজ্য স্থাপন:

 

উপরি উল্লিখিত ৪টি ধাপ ইসলামী চিন্তাবিদদের সামনে সমস্যার রূপরেখা তুলে ধরেছেন। এখন জ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ের সাথে ইসলামী জ্ঞানের সুনির্দিষ্ট প্রাসঙ্গিকতা উভয়ের অভিন্ন অবদানের আলোকে নির্ণয় করতে হবে। প্রথমত: আধুনিক জ্ঞানের সংশ্লিষ্ট শাখা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে সে ব্যাপারে ইসলামী জ্ঞান কুরআন নাজিল হওয়া থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কী অবদান রেখেছে। দ্বিতীয়ত: জ্ঞানের ঐ বিষয়ের সাথে ইসলামের অবদান কতটুকু সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য পূর্ণ? ইসলামী জ্ঞান আধুনিক জ্ঞানের কোন কোন ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ, অপূর্ণ বা প্রেক্ষিত ও পরিধি অতিক্রম করে গেছে। তৃতীয়ত: আধুনিক জ্ঞানের যেসব শাখায় ইসলামী জ্ঞানের অবদান সামান্য বা শূন্য। সেক্ষেত্রে মুসলমানরা ঐ ঘাটতিপূরণ, সমস্যা নির্ণয় ও প্রেক্ষিত প্রসারিত করার লক্ষ্যে কোন পন্থায় অগ্রসর হবে?

 

ষষ্ঠ ধাপ: আধুনিক জ্ঞানের বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা:

 

এ পর্যায়ে আধুনিক জ্ঞানকে ইসলামের দৃষ্টিতে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। জ্ঞানের ইসলামীকরণের লক্ষ্যে এটি একটি প্রধান পদক্ষেপের মর্যাদা রাখে।

 

সপ্তম ধাপ: ইসলামী জ্ঞানের উৎস পর্যালোচনা: উৎকর্ষ

 

আধুনিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যার প্রেক্ষিতে ঐশী বাণী উপলদ্ধি সাযুজ্য ৩টি ক্ষেত্রে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। প্রথমত: সরাসরি ওহীর সূত্র এবং ইতিহাসে প্রাপ্ত রাসূল সা: (অর্থাত কুরআন ও হাদীস), তাঁর সাহাবী রা: এবং তাদের উত্তরসূরীদের সুষ্পষ্ট দৃষ্টান্তের আলোকে ইসলামী দর্শন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বব্যাপী উম্মাহর বর্তমান চাহিদা এবং তৃতীয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাবতীয় আধুনিক জ্ঞান। মানব জীবনের ইসলামী জ্ঞানের অবদান মূল্যায়নের এই গুরুদায়িত্ব অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের উপরেই ন্যস্ত হওয়া আবশ্যক। তাদেরকে একই সাথে মুসলমানদের চাহিদা এবং আধুনিক জ্ঞানে অভিজ্ঞ হতে হবে। ইসলামী জ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যথাসম্ভব পর্যাপ্ত ও সঠিক উপলদ্ধি অর্জনে তাদেরকে সাহায্য করবেন।

 

 

 

অষ্টম ধাপ: উম্মাহর প্রধান সমস্যাবলী জরিপ করা:

 

উম্মাহর সমস্যাদির সামগ্রিক কারণ, লক্ষণ, অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সাথে সংঘাত এবং পরিণাম সম্পর্কে বাস্তব ও পুংখানুপুংখ পর্যালোচনা তথা জরিপ করা আবশ্যক।

 

নবম ধাপ: মানব জাতির সমস্যা জরিপ:

 

ইসলামী চিন্তাবিদদের দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামের আলোকে আজকের বিশ্বের সমস্যা সমাধানে ব্রতী হওয়া সমগ্র মানবজাতির সমস্যা জরিপ করতে হবে। কেননা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের দায়িত্ব ইসলামী দর্শনের উপর ন্যস্ত।

 

দশম ধাপ: সৃজনশীল বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ:

 

মানবজীবনের প্রত্যেক বিভাগের ইসলাম সম্মত রূপ কি এবং কিভাবে উভয় জ্ঞানের সমন্বিত কাঠামোকে উম্মাহ ও মানবজাতির কল্যাণে এগিয়ে নেয়া হবে? একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা সমস্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিশেষ প্রকৃতির প্রেক্ষিতে মুসলমানদের জন্য কোন পন্থা বেছে নেয়া বৈধ? এটা নিশ্চিত যে, প্রত্যেক বিষয়েই বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনের সুযোগ রয়েছে যা ইসলামী আদর্শের নিকটবর্তী বা দূরবর্তী হতে পারে, হতে পারে কম বা বেশি কার্যকর কিংবা যা ইসলামী লক্ষ্য অর্জন ত্বরান্বিত বা বাধাগ্রস্থ করতে পারে। এর মধ্যে কোন পথটি সম্ভব, প্রয়োজনীয়, অপরিহার্য, বাঞ্ছনীয় বা বৈধ? সংশ্লিষ্ট সমস্যার সাথে ইসলামের কার্যকারিতা পরিমাপ করা হবে? সৃজনশীল সমন্বিত তত্ত্বের অবদান প্রকাশ, পরীক্ষা ও মূল্যায়নের নীতিই বা কি হবে? কোন নীতির আলোকে এতে সংশোধন ও পরিবর্তন আনা হবে এবং এগুলোর অগ্রগতি ও ফলপ্রসূতা পর্যবেক্ষণ-মূল্যায়ন করা হবে? সমস্যা সমাধান প্রচেষ্টায় উপরি উল্লিখিত প্রশ্নগুলো গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে।

 

একাদশ ধাপ: ইসলামী কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন বিষয়ের পুনর্বিন্যাস ও পাঠ্যপুস্তক রচনা:

 

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক নতুন নতুন ধ্যান ধারণার আলোকেই লিখে যেতে হবে শুধু তা নয়, বরং বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে ব্যক্তি বিশেষের রচনাবলী ব্যাপকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ইসলামী জ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট আধুনিক জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা ও সামঞ্জস্য বিধান করা যায়। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যপুস্তক রচনা জ্ঞানের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত ধাপ। এ কাজটিই পূর্বোল্লিখিত সকল ধাপের প্রক্রিয়ার সাফল্যের মুকুট পরিয়ে দেয়।

 

দ্বাদশ ধাপ: ইসলামী জ্ঞানের প্রসার:

 

রচিত পুস্তকাদি উদ্দেশ্য যেন একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের জন্য না হয়। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দ্বীনের জন্য প্রণীত রচনাবলী কাগজ, কালি ও ছাপা বাঁধাইয়ের খরচ যে যোগাতে পারবে সেই তা প্রকাশের অধিকার রাখবে। দ্বিতীয়ত: এসব পুস্তক রচনার উদ্দেশ্য থাকবে সমগ্র মানবজাতির জন্য। তৃতীয়ত: এই কর্ম পরিকল্পনার আওতায় রচিত বইপত্র মুসলিম বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানাতে হবে। স্বভাবত সেগুলো বিভিন্ন দেশের স্ব-স্ব ভাষায় অনুবাদও করতে হবে।

 

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী জ্ঞানের ইসলামী রূপায়নে এছাড়াও সহায়ক উপায় হিসেবে নিম্নোক্ত কাজগুলোর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন-

 

১. সম্মেলন ও সেমিনার করতে।

 

২. ফ্যাকাল্টি প্রশিক্ষণের জন্য শ্রেণি কর্মশালার আয়োজন করা উচিত। তিনি জ্ঞানের ইসলামীকরণের বাস্তবায়ন সম্পর্কে আরো বলেন-

 

ক) এ ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের জন্য সম্মানী নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

 

খ) শিক্ষা সংক্রান্ত বইপত্র প্রণয়নের জন্য কেবল যোগ্যতম ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের যাতে নিয়োগ করা হয় সেদিকে সর্বতোভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।

 

৩. বইপত্র প্রণয়নের কাজটি বৃহদাকার হলে তা ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন বিদ্বানকে দেয়া উচিত যাতে নির্দিষ্ট সময়ে কাজটি শেষ হয়।

 

৪. জ্ঞানের ইসলামীকরণ কাজের জন্য প্রতিটি মুসলিম দেশ থেকে তহবিল সংগ্রহ করা প্রয়োজন।১১

 

*প্রফেসর ড. সৈয়দ আলী আশরাফ এর মতামত:

 

ড. সৈয়দ আলী আশরাফ রহ. এর মতে জ্ঞানকে প্রথমে নিম্নরূপ বিভাজন করে কারিকুলাম তৈরী করতে হবে-

 

 

 

 

 

আল্লাহ তাআলা সব জ্ঞানের উৎস:

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

১) আল্লাহ তাআলার সাথে মানুষের সম্পর্ক এর ভিত্তিতে যে জ্ঞান, সেটা হলো ধর্মভিত্তিক। যথা: কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, উসূলে ফিকহ, আকিদা ইত্যদি।

 

২)মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, এর ভিত্তিতে যে জ্ঞান সেটা হলো মানব বিজ্ঞান।যথা: বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি।

 

৩) মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক এর ভিত্তিতে যে জ্ঞান, সেটা হলো প্রকৃতি বিজ্ঞান। যথা: অংক, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ইত্যাদি।

 

 

 

অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলী আশরাফ রহ. এর মতে জ্ঞান ও শিক্ষা ইসলামীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ হবে নিম্নরূপ:-

 

ক. এমন একটি শিক্ষায়তন গড়ে তুলতে হবে যেখানে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা লাভ করবে।

 

খ. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষাদান করাতে দক্ষক রে তুলতে হবে।

 

11 ড. ফারুকী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮-৬৬।

 

 

 

গ. একটি গবেষণাগার থাকবে যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জ্ঞান বিজ্ঞানের ভিত্তিমূলে Secular ভাবধারার পরিবর্তে ইসলামী ভাবধারা প্রতিষ্ঠার কাজ চালাতে এবং সেই ভাবধারার ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যসংক্রান্ত অন্যান্য যাবতীয় বস্তু তৈরীর ব্যবস্থা থাকবে।

 

ঘ. এ সমস্ত জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে মানুষকে সে পথে পরিচালিত করা যে পথ অনুসরণ করে মানুষ আল্লাহর খলিফা হবার যোগ্যতা অর্জন করে।

 

জ্ঞানের বা শিক্ষার ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে তিনি Faith Based Education  এর কথা বলেছেন।

 

ড. ত্বাহা জাবির আলওয়ানীর মতামত:

 

আলকুরআন ও মহাবিশ্ব অধ্যয়নের মাঝে সমন্বয় ধারা রচনার গুরুত্ব দায়িত্ব সেই পালন করতে পারবে যে আলকুরআনের জ্ঞান অর্জন করেছে এবং অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানে যথেষ্ট পরিমাণ অংশ আয়ত্ত করেছে। যেন উভয় প্রকার জ্ঞান দ্বারা আলকুরআন, মহাবিশ্ব ও মানুষের সংমিশ্রিত ম্যাথডোলজি উন্মোচিত করা যায়। এ জন্য ‘ইসলামীকরণ’ Islamization এর মূলনীতি সমূহ নিম্নবর্ণিত ভিত্তির উপর দাড় করানো হয়:

 

এক: জ্ঞানের জগতে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী পুনর্গঠন করা। যে দৃষ্টিভঙ্গী নির্মল নিখাদ ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ধ্যান-ধারণার মৌলিক উপাদান ও বৈশিষ্ট্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেন কোন বিষয় উপেক্ষা না করেই মৌলিক চূড়ান্ত প্রশ্নমালার উত্তর দিতে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা সক্ষম বলে গণ্য করা সম্ভব হয়। শিক্ষা সমীক্ষণে সক্ষম ব্যক্তিসত্তার শক্তি সামর্থ্য গড়ে তুলতে হবে। সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে যা আয়ত্ত করা ও চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। একই সময়ে তা পদ্ধতি বিজ্ঞান উদ্ভাবনেও সামর্থ্য প্রদান করবে। এমনিভাবে তা জ্ঞান গত ব্যাখ্যায় সামর্থবান করে তুলবে। যে ব্যাখ্যা আবেগ উদ্দীপনার উপর নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

 

দুই: আল কুরআনের পদ্ধতি বিজ্ঞানের আলোকে ও নির্দেশনায় ইসলামী পদ্ধতি বিজ্ঞানের মূলনীতি গঠন, রূপায়ন ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পুনর্গঠন। কেননা একক ও আংশিক অধ্যয়নের ফলে ঐ ইসলামী পদ্ধতি বিজ্ঞান নানা দিক দিয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যে অধ্যয়ন আলকুরআনকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করেছে, জীবন জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। অপরদিকে ঐ একক ও বিচ্ছিন্ন অধ্যয়ন প্রক্রিয়া পূর্বে ও বর্তমানেও আলকুরআনের গণ্ডিবহির্ভূত অবস্থানে থেকে সৃষ্টিজগত ও মানুষকে অধ্যয়ন করছে। তাই ইসলামি পদ্ধতি বিজ্ঞানকে পুনর্গঠন করতে হবে, যেন মুসলিম মানস ঐসব চিন্তাধারাগত ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারে। যে সব ব্যাধি সে মুসলিম মানসকে পঙ্গু করে দিয়েছে। যেমন গায়েব তথা অদৃশ্যের সঙ্গে দৃশ্যমান জগতের সম্পর্ক, ওহীর সঙ্গে যুক্তির সম্পর্ক, ঘটনাসমূহের সাথে কার্যকরণের সম্পর্ক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় অনুধাবনে সে মুসলিম মানস কিংকর্তব্যবিমূঢ় হচ্ছে। এতে স্থিতিশীলতার পরিচয় দিতে পাচ্ছেনা।

 

 

 

তিন: এ পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গীতে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সাথে আচরণের পদ্ধতিও পুনর্গঠন করা। যেখানে আলকুরআনকে পথ, পদ্ধতি, জ্ঞানের উতস এবং কৃষ্টি ও সভ্যতার সৌধ নির্মাণের উপাদান সমূহের উতস হিসেবে গণ্য করা হবে। এর জন্য এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উলূমুল কুরআন তথা কুরআনিক জ্ঞান বিজ্ঞান সমূহের পুননির্মাণ ও পুনর্গঠন করা চাই। আল কুরআনের আয়াতসমূহের খেদমতে যে সব ধ্যান ধারণা সৃষ্টি হয়েছে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে মিলেছে, তার অনেক কিছুই হয়ত এ পুনর্গঠন ক্ষেত্রে এড়িয়ে যেতে হবে। আরব জনগণ আলকুরআন বুঝেছে তার রচনার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যসমূহের ভিত্তিতে। যে সব বৈশিষ্ট্য প্রথম দিকে ছিল খুবই সহজ সরল প্রকৃতির এবং সামাজিক দিক দিয়েও চিন্তাধারায় ছিল ভাষাগত ধাচে এবং শ্রুত বিষয়াদি হিসেবে। যে সব শ্রুত বিষয়ে প্রধান বিবেচ্য বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিল, সনদ বা বর্ণনাগত সূত্রের সহীহ হওয়া তথা বিশুদ্ধতা আছে কি না, তা লক্ষ্য রাখা এবং সুদৃঢ় করার বিষয়টি সে সময়ে সর্বোন্নত জ্ঞানের বিষয় হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছিল। আলকুরআন ও হাদীসে নববী সংশ্লিষ্ট জ্ঞান বিজ্ঞান যখন সরকারীভাবে সংকলিত হচ্ছিল, তখন তাতে ঐ বৈশিষ্ট্যসমূহও প্রতিভাত হয়। এমনিভাবে এর পাশাপাশি ঐ সংকলন পর্যায়ে আরবী ভাষা ও তার আলংকরিক বৈশিষ্ট্যসমূহও প্রকাশিত হয়। আর তার দাবী অনুসারে শব্দ ও বাক্য গঠন প্রক্রিয়ার মাঝে পার্থক্য করার প্রবণতারও উন্মেষ ঘটেছিল। আর এটাই ছিল সে সময়ে প্রচলিত পদ্ধতি বিজ্ঞান। কিন্তু বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিষয়ের পদ্ধতিগত অনুধাবনের চেতনা প্রাধান্য লাভ করেছে। যেমনি এখন আরো প্রাধান্য লাভ করেছে বিভিন্ন সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী সম্পর্কের বিশ্লেষণ ও যুক্তি ভিত্তিক পর্যালোচনা করার প্রবণতা। যাতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক নিয়ম নীতিমালা ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এ সবকে সমাজ ও সভ্যতার বিভিন্ন বিষয়ের সাথে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। সুতরাং আলকুরআন অনুধাবন ও অধ্যয়নে সহায়ক সকল জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি নতুনভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন। তাই এ মহা গ্রন্থটি অধ্যয়নের সাথে মহাবিশ্ব অধ্যয়নের সমন্বয় ও আন্তসম্পর্কীয় পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এমনিভাবে এ প্রক্রিয়াটিকে মুক্ত করতে হবে ঐ পর্যায়ের তাফসীর  ও তাবীলের অনেক কিছু থেকে। প্রত্যাখ্যাত ইসরাঈলী বর্ণনার মত আরো অনেক কিছু আনুপাতিক হারে  পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে নিবিষ্ট হতে হবে। আল কুরআন অধ্যয়ন পদ্ধতিকে আয়াত নাযিল হওয়ার পন্থা, এ সবের পূর্বাপর  সম্পর্কের সাথে পূর্ণ মিলন ঘটাতে হবে। যেন এর দ্বারা মহামহিম কিতাব আলকুরআনের চ্যালেঞ্জের বিভিন্ন দিক সমূহ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আর সে গ্রন্থের অলৌকিকতার বিভিন্ন দিকের সাথে তার সামাজিক ও পদ্ধতি বিজ্ঞানগত দিকটিও সংযোজন করা উচিত। যেন তার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জটি অনিমেষ রূপে প্রমাণিত হয় এবং তার অলৌকিকতা বিদিত হয়। আর এটাই তো তার সাধারণী হওয়া ও সার্বিকতার পক্ষে প্রথম পদ্ধতিগত দলীল।

 

চার: পদ্ধতি বিজ্ঞানের ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে পবিত্র সুন্নতে নববীর সাথে আচরণ পদ্ধতিও পুনর্গঠন করতে হবে। যেখানে বিশুদ্ধ ও পবিত্র সুন্নতে নববীকেও পথ, পদ্ধতি ও জ্ঞানের উতস এবং কৃষ্টি ও সভ্যতার সৌধ নির্মাণের উপাদান সমূহের উতস হিসেবে গণ্য করা হবে। রাসূলুল্লাহ সা: এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারতেন, তারা তার অনুসরণ ও অনুকরণ করতেন। সে পর্যায়টি ছিল সরাসরি যোগাযোগের যুগ। যখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার নিকট থেকে তোমাদের হজ্জ্ব সম্পাদনের কার্যাবলী শিখে নাও। তিনি আরো বলেছিলেন, তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছো, সেভাবে সালাত আদায় কর। সুতরাং বাস্তবে অনুসরণ ও অনুকরণের বিষয়দ্বয় রাসূল সা: এর কর্মতৎপরতার উপর নির্ভরশীল। রাসূল সা: আল কুরআনের শিক্ষাকে নিজ কাজে রূপায়ন করতেন। তিনি তা রূপায়ন করতেন বাস্তবতার ভিত্তিতে এবং আলকুরআনের নির্দেশনা ও জীবনের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে। মহানবী সা: কর্তৃক আল কুরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত কুরআনিক পদ্ধতির উপাদান সমূহ এবং ততকালীন সমাজ বাস্তবতার মাঝে পার্থক্যের পরিধি সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। যে বাস্তবতা বিরাজমান ছিল সে সমাজ সদস্যদের বুদ্ধিবৃত্তি, চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানের পরিমাপ বা সামর্থের ভিত্তিতে এবং সেখানে প্রচলিত জ্ঞান পরিমণ্ডলে সেই বাস্তবতার সামাজিক ও চিন্তা-চেতনাগত বাধ্যবাধকতা বা শর্ত সমূহের আলোকে। এ জন্য সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যারা হাদীস বর্ণনা করতেন, তারা মহানবী সা: এর জীবনের কোন অংশ সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকতে চাইতেন না। তাঁর জীবনের সকল দিক সম্পর্কে জানার জন্য তারা পাগলপারা তথা প্রচণ্ড আগ্রহ পোষণ করতেন। কেননা বিভিন্ন বিষয়ে পদ্ধতি সম্পর্কে অবহতির জন্য এটাই ছিল একমাত্র অবলম্বন। এ জন্য দেখা যায়, সুন্নাহর ক্ষেত্রে রাসূল সা: এর বাণী, কাজ ও সম্মতিসমূহের বিশাল সমাবেশ ঘটেছে। একই কারণে আমরা তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পেয়েছি। যাতে আমরা এমনকি তাঁর সকাল সন্ধায় দৈনন্দিন কার্যাবলী, তার সন্ধি স্থাপন, যুদ্ধ, শিক্ষা-দীক্ষা, বিচার ফয়সালা, নেতৃত্ব, ফাতওয়া, মানবীয় আচার আচরণ ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। এ সব ক্ষেত্রে তাঁর অনুসৃত কর্মপন্থা সমাজ পরিষ্থিতির সাথে তাঁর আচার আচরণ পদ্ধতি বা নিয়মনীতি স্পষ্ট করে দিয়েছে। মহানবী সা: যে পরিবেশে বসবাস করেছেন ও কর্মততপর ছিলেন, এসব বিস্তারিত তথ্যসমূহ সে পরিবেশ ও বাস্তবতার বৈশিষ্ট্যসমূহ স্পষ্ট করে দিয়েছে। ঐ বাস্তব অবস্থাটি গঠন ও মননে বর্তমান আমাদের অবস্থা থেকে নি:সন্দেহে ভিন্ন ছিল।

 

রাসূল সা: তাঁর সুন্নাহর মাধ্যমে কুরআনিক পদ্ধতি ও বাস্তবতার মাঝে বন্ধন রচনা করতেন। সুতরাং মহানবী সা: যে বাস্তবতায় বসবাস করতেন, তা এড়িয়ে গেলে তার সুন্নাহর অনেক কিছুই অনুধাবন করা কঠিন হবে। তিনি ভাস্কর্য নির্মাণ ও চিত্রাঙ্কনের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন এবং যারা মূর্তি তৈরী করে বা চিত্রাঙ্কন করে, তাদেরকে কিয়ামত দিবসে ১২ তথা আখেরাতে                                                        মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হিসেবে গণ্য করেন।  কিন্তু এটা বুঝা উচিত নয় যে, তখন তার সে নিষেধাজ্ঞাটি ছিল দেহাবয়ব কেন্দ্রিক সকল প্রকার নান্দনিকতার বিরুদ্ধে। তার সে নিষেধাজ্ঞাটি সাধারণী ও সর্বব্যাপী ছিল না। যদি এ নিষেধাজ্ঞাটির দ্বারা তাই বুঝানো হয়, তা হলে এটা আল্লাহর নবী হযরত সুলায়মান আ: কর্তৃক শিল্পকর্ম ও সে সম্পর্কে তার ধারণার সাথে পরস্পর বিরোধী হয়ে যাবে। কেননা হযরত সুলায়মান তার সৈন্যবাহিনীর অন্তর্গত জিনদেরকে তার চাহিদানুসারে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও চিত্রাঙ্কন করতে নিয়োগ করেছিলেন। তাই এটা মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা: এর নিষেধাজ্ঞার সাথে পরষ্পর বিরোধী হয়ে যাবে, যদি এ নিষেধাজ্ঞাটিকে সর্বব্যাপী ধরা হয়। এমনিভাবে বর্তমান সমসাময়িক কালে এ বিষয়ে অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন বা যুক্তি তর্ক সৃষ্টি করে বলেন, এ সব শিল্প কর্মের দ্বারা আমাদের এসব ভাস্কর্যের ইবাদাত করা লক্ষ্য নয়। তা হলে এ চিত্রাঙ্কন বা শিল্পকর্ম হারাম হবে কেন? সুতরাং মহানবী সা: এর ঐ নিষেধাজ্ঞাটি এ দাবীর সাথেও পরস্পর বিরোধী নয়। এছাড়া, কোন খন্ডিত ফাতওয়ার মাধ্যমে ঐ ধরণের চিত্রকর্ম তৈরীর বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে না যে, এ ধরণের চিত্রকর্ম হালাল আর ঐ ধরণের চিত্রকর্ম নিষিদ্ধ। বরং এসব ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ও পদ্ধতির প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার পদ্ধতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিতে গিয়ে যেখানে তিনি বলে ছিলেন, তোমার জাতি যদি নওমুসলিম না হতো, কুফরী অবস্থা থেকে সদ্যমুক্ত না হতো,তাহলে আমি এ কাজটি অবশ্যই করতাম, অবশ্যই করতাম।’১৩

 

বস্তুত, মূর্তি ভাস্কর্য পূজা থেকে সদ্যমুক্ত একটি জাতির মধ্যে রাসূল সা: মূর্তি শিল্প এবং এর প্রচার প্রসারের মূলোচ্ছেদ করছিলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মহানবী সা: এর বানী ও সুন্নাহকে বিচ্ছিন্ন ভাবে না ধরে তার ভিত্তিতে একটি সুব্যবস্থিত ও সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে পৌঁছানো প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনা করতে যেয়ে দেখা যায়, তার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বলা কথাগুলোকে মতানৈক্যকারীগণ পৃথক পৃথক মতামতে রূপান্তর করেছেন। এ পর্যায়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বলা ঐসব কথার ভিত্তিতে কখনো কখনো একটি বিষয়ে যা ধরে নিতে হয়, আবার এর বিপরীতও ধরে নেয়া যায়। এ যেন বিভিন্ন মাযহাবের ইমামগণের মতামতের ন্যায় অবস্থা। যেখানে একই বিষয়ে তাদের পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া যায়।

 

----------------------

 

১২ এ মর্মে হাদীসটি (কিয়ামতের দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে মূর্তি তৈয়ারকারীরা ও চিত্রকররা) ইমাম নাসাঈ তার সুনান গ্রন্থের ঈমান ও তার শাখা অধ্যায়ের ‘সবচেয়ে কঠিন শাস্তি যে মানুষকে দেয়া হবে’ নামক পরিচেছদে বর্ণনা করেন ( পৃ. ৫৩-৫৬)।

 

১৩ এখানে হাদীসটি ইমাম নাসাঈ তার সুনানে যাকাত অধ্যায়ের ‘কাবা তৈরীকরণ’ পরিচ্ছেদে বর্ণনা করেন। যেখানে উল্লেখ আছে: হে আয়েশা! তোমার জাতি যদি কুফুরী অবস্থা থেকে সদ্য মুক্ত না হতো, তাহলে এ কাবাঘর ভেঙ্গে হযরত ইবরাহীম আ: যে ভিত্তির উপর তৈরী করেছিলেন একে আমি সে ভিত্তির উপর দাড় করাতাম। আর আমি এর পশ্চাত দরজা রাখতাম...।

 

প্রকৃতপক্ষে যাকে রাসূল সা: এর অনুসরণ ও অনুকরণ বলে অভিহিত করা যায়, আল কুরআন নাযিল হওয়ার যুগে আরব সমাজ তাতেই ছিল ব্যাপৃত ও নিবিষ্ট। তারা তাঁর নিকট থেকে একটি ব্যবহারিক মডেল বা আদর্শ লাভ করে। তাদের জীবন যাপন যাত্রা প্রণালী ও বাস্তবতা অনুসারে সে মডেলটি একটি পদ্ধতির রূপ নেয়। এ পর্যায়ে রাসূল সা: এর ঐ অনুসরণ ও অনুকরণের পথ ধরেই হাদীস ও অন্যান্য বর্ণিত বিষয়সমূহের সাথে ব্যবহারিক নীতিমাল সংক্রান্ত ধারণাসমূহের উন্মেষ ঘটে। তবে এর সাথে খন্ডিত ব্যবহার থেকে হাদীসের কার্যকারিতা হ্রাস করার প্রচেষ্টা উদ্ভুত হয়। আর এর অন্তরালে দেখা যায়, কেউ কেউ বাতেনী ব্যাখ্যা, প্রতীকী ও ইশারা-ইঙ্গিত ভিত্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আশ্রয় নেয়। হাদীসের বাহ্য অর্থের গন্ডি মুক্ত হতেই হয়ত তারা এ পদক্ষেপটি নিয়ে থাকে।  কিন্তু বিষয়টি এখানেই থেমে যায়নি। বরং এ ক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল অবস্থা বা বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়। এরপর মাথাচাড়া দিয়ে উঠে গোটা সুন্নাহ বা তার অংশ বিশেষের যথার্থ ও যৌক্তিকতা সম্পর্কিত সমস্যাসমূহ। আমরা এখনো যার ঝামেলা বহন করছি ও গ্লানি টেনে যাচ্ছি। হাঁ, আমরা যদি সুন্নাহর ব্যবহার নীতিমালা সম্পর্কে কুরআনিক ম্যাথডোলজি পর্যন্ত পুরাপুরি পৌঁছতে পারতাম, যে ম্যাথডোলজি সুন্নাহের সকল শাখা প্রশাখার সাথে আচরণ বিধি নিয়ন্ত্রণ করতো, তা হলে এর আওতায় সুন্নাহর ঐ সব শাখা প্রশাখায় বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন বিষয়াদি অনুধাবন করা যেত। এসব অনুধাবন করা যেত শরীআর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমূহ স্পষ্ট করার ভিত্তিতে।

 

সমসাময়িক বুদ্ধিবৃত্তিক মানসব সব সময় বিভিন্ন বিষয়ের সুশৃঙ্খল বাস্তব ব্যবস্থাপনা অনুসন্ধান করে। এ বুদ্ধিগত মনোবৃত্তি চেষ্টা করে এমন একটি ম্যাথডোলজি অনুসরণ ও কার্যকর করতে যার বিভিন্ন দিক পরিপূর্ণ। এ ম্যাথডোলজির মাধ্যমেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা হবে। কুরআন সুন্নাহ এবং বিশ্বজনীন ও আঞ্চলিক পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রে চিন্তাধারা গত আন্দোলনের এটাই হবে বাস্তব ভিত্তিক মডেল বা ছাঁচ। এ ম্যাথডোলজির মাধ্যমেই কুরআন মাজীদের লক্ষ্য সমূহে পৌঁছা যাবে, ‍সুন্নতে নববী অনুধাবন করা যাবে। তখন কেউ অতীতের গর্ভে আশ্রয় নেয়া বা বাতেনী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার কাজে নিপতিত হবে না। এমনিভাবে কেউ নিপতিত হবে না তাজদীদী কাজে তথা নব নব সংস্কারমূলক প্রচেষ্টাতেও। যার ভিত্তিতে পুনর্বিন্যাস মূলক নবসংযোজন বিয়োজন বা বর্তমান যুগোপযোগী করার জন্য অতীতকে নতুন বেশে ভূষিত করা। না, কুরআন সুন্নাহর পদ্ধতি বিজ্ঞান অনুসরণ করতে পারলে এসবের দরকার হবে না।

 

পাঁচ: আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামী ঐতিহ্য তথা জ্ঞান ভান্ডার অধ্যয়ন ও অনুধাবন কাজটিও পুনর্গঠন করতে হবে। এগুলো জ্ঞান ও যুক্তি ভিত্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, যাচাই বাছাই, সমালোচনা, পর্যালোচনা মূলক পাঠ করতে হবে। এর মাধ্যমেই আমরা তিনটি চক্র বা বৃত্ত থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব। যে তিনটি চক্র আধুনিক কালে আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান ভান্ডারের সাথে আচরণ বিধি নিয়ন্ত্রণ করছে। এ তিনটি চক্র হলো: অতীত উত্তরাধিকার ভান্ডারের সব কিছু প্রত্যাখ্যানকারী চক্র, সবকিছু গ্রহণকারীচক্র, ম্যাথডোলজি ব্যাতিরেকেই বাছাই করে চলার চক্র। আমাদের উত্তরাধিকার জ্ঞান ভান্ডারের সাথে যথাযথ আচরণ করার ক্ষেত্রে এ তিন চক্রের মাধ্যমে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব নয়। এমনিভাবে এ ভান্ডার থেকে যে সব ক্ষেত্রে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন, তা ঐ তিন চক্রের মাধ্যমে সম্ভব নয়।

 

ছয়:সমসাময়িক মানব সমাজে বিরাজমান উত্তরাধিকার সম্পদ জ্ঞান ভান্ডার তথা পশ্চিমা উত্তরাধিকার জ্ঞান ভান্ডার ব্যবহার পদ্ধতিও পুনর্গঠন করতে হবে। এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে যেন এর মাধ্যমে বর্তমানে অনুসৃত আচরণ পদ্ধতিসমূহ থেকে মুসলিম মানস বের হয়ে আসতে পারে। বর্তমানের এসব পদ্ধতি বিভিন্ন দিক দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালানোর পরিবর্তে মুসলমানদেরকে পশ্চাতে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ এ প্রচেষ্টা সমূহ হওয়া দরকার ছিল পশ্চিমা উত্তরাধিকার সম্পদকে কাছে নিয়ে এসে নিবিড় করা, অত:পর তুলনা করা, তারপর পরস্পর মুখোমুখি করা। কিন্তু তা না করার কারণে যা হওয়ার তাই হয়েছে। পরিণতিতে হয় সবকিছু প্রত্যাখ্যান, না হয় বিনা বাক্যে সবকিছু গ্রহণ, অথবা বিপক্ষে না যেয়েই অন্ধভাবে বাছাই  করা হয়। ১৪

 

এ ৬টি পদক্ষেপ বা অক্ষ বলয় বা দায়িত্ব যাই বলি না কেন- এগুলোকেই বলা হয় “জ্ঞানের ইসলামীকরণ’ (Islamization of knowledge) বা জ্ঞানের তাওহীদ ভিত্তিক পদ্ধতি (Unity of Allah Based Mathod of Knowledge) বা মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান সমূহের ইসলামীকরণ (Islamization of Humanities and Social Science) এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সমূহের ইসলামী দিকনির্দেশনা প্রদান অথবা বিজ্ঞানসমূহকে ইসলামী ভিত্তিমূলে প্রতিস্থাপন। ১৫

 

 প্রফেসর ড. এম শমসের আলীর মতামত:

 

অধ্যাপক ড. এম. শমসের আলীর মতে-

 

১. ৬টি world conference on Musilim Education এর Document গুলো সম্পর্কে সচেতনতা awarences সৃষ্টি করতে হবে।

 

২. ওয়ার্কসপ করে জ্ঞান ইসলামীকরণ সম্পর্কে স্কলারদের জানাতে হবে।

 

৩. বাংলাদেশ সহ অনেক মুসলিম দেশের সরকার যে মক্কা ঘোষণা এর স্বাক্ষরকারী এ বিষয়ে প্রতিটি বিষয়ে মুসলিম দেশের সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।

 

----------

 

১৪ ড. ত্বহা জাবির আলওয়ানী, আলকুরআন ও মহাবিশ্ব অধ্যয়ন: সমন্বিত ধারা, বঙ্গানুবাদ ড. আবদুর রহমান আনওয়ারী, ঢাকা: বি আই আই টি.

 

১৫ এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দ্র: Dr. Tahe Zabir Alwani, Islamization of knowledge: Past and present.

 

 

 

৪. সাধারণ শিক্ষা জেনারেল এডুকেশন এবং মাদরাসা শিক্ষা এর ধর্মানুসারী মুসলমানদের এক জায়গায় বসে সমন্বিত পাঠ্যক্রম তৈরী করতে হবে।

 

* লেখকের নিম্ন মতামত:

 

আমার মতে জ্ঞান ইসলামীকরণে প্রধান কটি পদক্ষেপ নিম্নরূপ:

 

১। জ্ঞানের উতস বিবেচনা তথা ইন্দ্রিয়জ ও বুদ্ধিভিত্তিক উতসের পাশাপাশি কুরআন ও সুন্নাহকে জ্ঞানের উতস হিসেবে বিবেচনার আবেদন রাখা।

 

২. জ্ঞানের বিভাজন পুনর্মূল্যায়ন: পাশ্চাত্য সমাজে যেভাবে জ্ঞানের বিভাজন করেছে ধর্ম নিরপেক্ষভাবে, তা বের হয়ে আসতে হবে। এবং মানুষ ও সৃষ্টির সাথে আল্লাহর সম্পর্কে ভিত্তিতে জ্ঞানের বিভাজন করা।

 

৩. জ্ঞানের নতুনভাবে বিন্যাস করা: অর্থাত তাওহীদের আলোকে জ্ঞানের বিন্যাস করা।

 

৪. সমন্বয় সাধন করা: অর্থাত ইসলামের মূলনীতি ঠিক রেখে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের উদ্ভাবিত নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য  থেকে উপকৃত হওয়ার লক্ষ্যে উভয় ধরণের জ্ঞানের মাঝে যৌক্তিক সমন্বয় সাধন করা।

 

৫. জ্ঞানের জগতে ইসলাম প্রদত্ত তত্ত্ব ও তথ্য সংযোজন করা।

 

৬. জ্ঞান বিশ্লেষণ, আহরণ ও বিতরণ পদ্ধতিতে ইসলামী মূল্যবোধ সংযোজন করা তথা ইসলামী চিন্তন পদ্ধতি উন্নয়ন ও অনুসরণ করা।

 

৭. গোটা বিশ্বে সর্বত্র ইসলামের আবেদন তুলে ধরা।

 

৮. যথোপযুক্ত গ্রন্থ রচনা ও সমসাময়িক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে উদাহরণ ও উপমার সংযোজন করা।

 

৯। ইসলামের যে সব তত্ত্ব ও মানব সমাজে প্রচলিত অন্য নামে, তা কুরআন সুন্নাহের আলোকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

 

১০। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে উদ্ভাবিত নতুন নতুন সমস্যার ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধের আলোকে সমাধানে শুরা ভিত্তিক ইজতিহাদ তথা গবেষণা চালানো।

 

১১। জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রসারিত করা।

 

উপরি উল্লিখিত আলোচনার পাশাপাশি এ কথাটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, জ্ঞানের ইসলামীকরণের জন্য পূর্বশর্ত হলো ব্যক্তি মানুষটি হবে তাকওয়াবান মুসলমান এবং চাই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

 

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

 

জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে সমস্যা ও সম্ভাবনা

 

জ্ঞান ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। যেমন:

 

এক. বহুমূখী শিক্ষা ব্যবস্থা:

 

জ্ঞানের ইসলামীকরণের পথে একটি প্রকট সমস্যা হচ্ছে দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা। একমুখী শিক্ষা হলে দ্রুত সংষ্কার করা যেত। দুমুখী বা বহুমুখী শিক্ষার কারণে সমাজের অধিবাসীদের মধ্যে চিন্তা চেতনার ফারাক শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষায় পশ্চিমা জ্ঞান বিজ্ঞান কোন বাছ বিচার না করেই গ্রহণ করা হচ্ছে। পরিবেশ এমনভাবে তৈরী করা হয়, বিভিন্নমুখী শিক্ষার ফলে জ্ঞানের প্রতি বিভিন্ন ধর্মী দৃষ্টিভঙ্গী লালন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

দুই: দীর্ঘকালের স্থবিরতা:

 

দীর্ঘকালের স্থবিরতার কারণে মুসলমানরা চিন্তা চেতনায় ইসলামী জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন অ ইসলামী জ্ঞানই যেন স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়েছে। ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি অনীহা উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িক চিন্তাভাবনার প্রতি মুসলিম যুব সমাজ ঝুকে পড়েছে আধুনিকতার চাকচিক্যে।

 

তিন: চাকরী বা কর্মক্ষেত্রের দৈন্যতা:

 

ধর্মীয় জ্ঞানের চর্চায় চাকরী নেই। আদর্শিক জীবন গঠনে ধর্মীয় জ্ঞানের অবদান থাকলেও তার প্রতি অবহেলা করা হয়। এমনকি ধর্মীয় জ্ঞানের মাঝে নিহিত বৈষয়িক ব্যবস্থা থাকলেও তা জীবনে কার্যকর করা হচ্ছে না। কারণ সে সব নৈতিকতা পূর্ণ। তাই উপনিবেশিক আমল থেকে দূর্নীতিপরায়ন প্রশাসনের অধীনে গড়ে উঠা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ইসলামী জ্ঞানের আলোকে চাকুরী ক্ষেত্র নিরূপিত না হওয়ায় এ ক্ষেত্রে দিন দিন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

চার: মুসলিম নেতৃবৃন্দের উদ্যোগের অভাব:

 

মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইসলামের কার্যকলাপের প্রতি খুব একটা উদ্যোগী নন। তাদের কার্যকলাপ পরিকল্পনা ভিত্তিক না হয়ে অধিকাংশ সময়ে আবেগতাড়িত বা অন্ধ ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা দ্বিধা দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত হয়। জ্ঞান ইসলামীকরণে তেমন উদ্যোগ নেয় না বা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও করে না।

 

পাঁচ: আধুনিক পশ্চিমা জ্ঞানের অভাব:

 

মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের প্রভাবে ধর্মের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ পশ্চিমাদের জ্ঞানের মূল উতস ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণা থাকলে তারা সে ধরণের চেতনায় প্রভাবিত হতো না।

 

 

 

ছয়: মিডিয়ায় মুসলমানদের আধিপত্যের অভাব:

 

সমগ্র বিশ্বে দ্রুত তথ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মিডিয়া যথা- টিভি, স্যাটেলাইট, মোবাইল রেডিও ইন্টারনেট পত্রিকা ইত্যাদি শক্তিশালী মিডিয়া ব্যবহৃত হচ্ছে। মিডিয়ায় ইসলাম বিরোধী ইয়াহুদী ব্লক সহ পশ্চিমা বিশ্ব তথা আমেরিকা, ইংল্যান্ডের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে মুসলমানদের সম্পর্কে যে কোন বানোয়াট তথ্য মুহর্তে বিশ্বের আনাচে কানাচে পৌছিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে মুসলমানদের কর্তৃত্ব নেই বললেই চলে। ইসলামী জ্ঞানের প্রতি বিশ্বজনমত বিষিয়ে তোলা হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে মিথ্যাচার করে। এটিও একটি বড় সমস্যা।

 

সাত: পর্যাপ্ত উপকরণের অভাব

 

ইসলামের আলোকে জ্ঞান তত্ত্বের উপর বইয়ের অভাব রয়েছে। জ্ঞানকে কিভাবে ইসলামীকরণ করা যাবে, তার উপর সহজ সাবলীল গ্রন্থ বাজারে তেমনটি নেই। এ বিষয়টি এখনো বিশেষজ্ঞদের কাজ বলে প্রচলিত। সাধারণ শিক্ষিতদের ধরা ছোয়ার বাইরে এর অবস্থান হওয়ার কারণে এটি মুসলিম সমাজকে তেমনভাবে আকৃষ্ট করতে পারছে না। এ ছাড়া, এ বিষয়ে পত্র পত্রিকা ও জার্ণালের অভাব রয়েছে। যে জন্য উন্নয়নকৃত ধারণাগুলো দ্বারা সহজে উপকৃত হওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে উপকরণসমূহের অভাব রয়েছে এবং যা আছে, তাও দুস্প্রাপ্য। এছাড়া জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার আলোকে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় রচিত বইয়ের সংখ্যা একান্তই নগন্য।

 

আট: উন্নত কারিকুলাম ও সিলেবাসের অভাব:

 

জ্ঞান ইসলামীকরণের আলোকে উন্নত কারিকুলাম ও সিলেবাসের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে শুধু মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোন স্কুল বা কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে কার্যকর করার মতো পূর্ণাঙ্গ কারিকুলাম ও সিলেবাস নেই। মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েও চাকুরীর বাজারের কথা চিন্তা করে ইসলামীকরণের আলোকে সিলেবাস ও কারিকুলাম কার্যকর করা থেকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে আসছে।

 

নয়: মুসলমানদের ঐক্য ও ভাতৃত্ববোধের অভাব

 

মুসলিম সমাজের মূল সূত্র হচ্ছে ঐক্য ও ভাতৃত্ববোধ। কিন্তু বর্তমানে এ ক্ষেত্রেই সংকট বিরাজমান। যে জন্য ইন্টেলেকচুয়াল পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেও অনৈক্যের কারণে উদ্যোগ সমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না। মুসলিম সমাজের বাস্তবতার আলোকে তাদের জ্ঞান ও শিক্ষা কাঠামো ও বিন্যাস কি ধরণের হবে এ ব্যাপারে আজোবধি ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।

 

দশ: ইসলামী চেতনার অভাব:

 

মুসলিম সমাজে কাঙ্খিত চেতনার অভাব রয়েছে। মুসলিম উম্মাহ নিজেদের ঈমান ও স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন নয়। এমনকি মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েও ইসলামীকরণের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের যৌথ নীলনক্সার সামনে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগসমূহ ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

 

বার: অর্থনৈতিক সংকট:

 

এক সময় আরব বিশ্বের পেট্রো ডলারে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনটি সারাবিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সন্ত্রাসের অপবাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী প্রতিষ্ঠান সমূহের অর্থসম্পদ আমেরিকা ও ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ আটকিয়ে দিচ্ছে। এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সরকার ও জনগণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করছে সে সব প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন না করার জন্য এবং অর্থ সঞ্চালন না করার জন্য। জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রতিষ্ঠান সমূহ বর্তমানে এ সমস্যার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

 

মোটকথা: জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজটি ইসলামী দাওয়াতী কাজের অংশ। তাই ইসলামী দাওয়াতকে ঠেকাতে যেয়ে ইসলাম বিরোধী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ পথে বিভিন্ন বাধা সৃষ্টি করছে। যে কারণে বিভিন্ন দিক দিয়ে জ্ঞান ইসলামীকরণ তৎপরতাটিও আক্রান্ত হচ্ছে।

 

সম্ভাবনা:

 

এত কিছুর পরও এ ক্ষেত্রে সফলতার সম্ভাবনাও বিশাল। যেমন:

 

এক: ইসলাম সম্পর্কে মুসলমানগণ নিকট অতীত থেকে একটু বেশি সচেতন। তাদের এ সচেতনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

দুই: ইসলামের প্রতি ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াবাসী অমুসলিমদের আগ্রহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

তিন: জ্ঞান ইসলামীকরণে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। অতীতে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান দেখা যায়নি।

 

চার: এ বিষয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাধর্মী জার্ণাল প্রকাশিত হচ্ছে।

 

পাঁচ: এ বিষয়ে গবেষণায় ক্রমেই বুদ্ধিজীবীমহলে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হচ্ছে।

 

ছয়: জ্ঞানের জগতে পশ্চিমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

 

সাত: পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যায়ের ন্যায় মুসলমানরাও কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের মডেল ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এতে জ্ঞান ইসলামীকরণের পথকে সুগম করেছে।

 

আট: বিশ্বে অনেক মুসলিম দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে বিন্যাস করতে চাইছে এবং এ লক্ষ্যে নতুন নতুন চাকরীর ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে। জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে এটিও একটি ইতিবাচক দিক।

 

 

 

উপসংহার:

 

জ্ঞান ইসলামীকরণ করতে হবে। পাশ্চাত্যের সবকিছু বিনা বিচারে গ্রহণ করা সঠিক পদ্ধতি নয়। তাদের নির্দিষ্ট দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। সেভাবেই তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিন্যাস করেছে। তাই এটা ইসলামী সমাজ দর্শনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই মিল না থাকলে বিপর্যয় দেখা দেবে। যেমন: রক্তের গ্রুপ না মিলিয়ে রক্ত পুশ করলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। তাই মেচিং এর গুরুত্ব আছে। পরিশেষে বলতে চাই জ্ঞান ও শিক্ষা উভয়টি ইসলামীকরণ প্রয়োজন। শুধু জ্ঞান ইসলামীকরণই যথেষ্ট নয়। কারণ জ্ঞান বিতরণ প্রক্রিয়া যদি ইসলামীকরণ না হয়, তাহলে জ্ঞান যথাযথভাবে উপস্থাপিত না হয়ে বিকৃত আকারেও উপস্থাপিত হতে পারে।

 

বাংলাভাষায় রচিত লেখকের কতিপয় গ্রন্থ

 

  1. \n
  2. বাংলাদেশে ইসলামী দাওয়াতের পথে সমস্যা ও সমাধান।
  3. \n
  4. তাফসীরুল কুরআন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
  5. \n
  6. মাতৃভাষা আন্দোলন ও ইসলাম
  7. \n
  8. ইসলামী দা’ওয়াহ বিষয়ের ভূমিকা
  9. \n
  10. ইসলামী দাওয়াতের পদধতি ও আধুনিক প্রেক্ষাপট
  11. \n
  12. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস
  13. \n
  14. পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণের দাওয়াত
  15. \n
  16. মহানবী সা: এর দাওয়াত
  17. \n
  18. সুন্নাতে রাসূল সা: এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ও তার জবাব
  19. \n
  20. ইসলামী শারীয়াতের ইজতিহাদের স্বরূপ
  21. \n
  22. যুগে যুগে ইসলামী দাওয়াহ
  23. \n
  24. ইসলাম ও বিশ্বায়ন
  25. \n
  26. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলাম
  27. \n
  28. ইসলামী দাওয়াহ বিজ্ঞান: উতপত্তি ও ক্রমবিকাশ
  29. \n
  30. ইসলামী দাওয়াহ বিজ্ঞানের স্বরূপ
  31. \n
  32. তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব: পরিচয় ও ইতিহাস
  33. \n
  34. বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম
  35. \n
  36. জ্ঞান ইসলামীকরণ: স্বরূপ ও প্রয়োগ
  37. \n
  38. তুলনামূলক আইন ব্যবস্থা
  39. \n
  40. ইসলামী শারীআতের সুন্নাতে রাসূল সা: এর মর্যাদা
  41. \n
  42. তুলনামূলক আইন ও ইসলাম (দুখন্ড)
  43. \n

 

 

 

সমাপ্ত

 

 

 

 

', 'জ্ঞান ইসলামীকরণঃ স্বরূপ ও প্রয়োগ', '', 'publish', 'closed', 'closed', '', '%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9e%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%80%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%a3%e0%a6%83-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%aa', '', '', '2015-04-26 11:09:55', '2015-04-26 05:09:55', '

 

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণঃ স্বরূপ ও প্রয়োগ

\r\n

ড. মুহাম্মদ আব্দুর রহমান আনওয়ারী

\r\n\r\n\r\n


\r\n\r\n

স্ক্যান কপি ডাউনলোড

\r\n

 

\r\n

 

\r\n\r\n

প্রথম পরিচ্ছেদ

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণের স্বরূপ

\r\n

 

\r\n

ইসলামী জ্ঞান তত্ত্বের আলোকে জ্ঞানের বিভিন্ন উৎস রয়েছে। ওহী ভিত্তিক জ্ঞান (Revealed Knowledge ও মানব অর্জিত জ্ঞান (Acquired Knowledge) । মানব জ্ঞান আল্লাহ তা’য়ালার মহা দান। তাঁর প্রদত্ত জ্ঞান তথা ওহী ও ইলহামের মাধ্যমে জ্ঞান মানব সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখছে। কিন্তু যুগে যুগে মানব সমাজে এমন অনেক কিছু জ্ঞান হিসেবে প্রচলিত হয়েছে, যা সত্যিকার অর্থে জ্ঞান নয় কিংবা বিকৃত জ্ঞান। অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীতে পশ্চিমা জগতের পণ্ডিতবর্গ জ্ঞানের বিন্যাস ও আহরণ প্রক্রিয়াকে ইসলামী ধ্যান-ধারণা থেকে দূরে নিয়ে স্থাপন করেছেন। এসব কিছু ইসলামী চিন্তা চেতনার আলোকে পুনরায় সাজাতে হবে। এর মাঝেই জ্ঞানের ইসলামীকরণ ধারণাটি নিহিত।

\r\n

অন্যভাবে বলতে গেলে ‘ইসলামী জ্ঞান তত্বের (Epistemology) আলোকে জ্ঞান হলো সেই সুনির্দিষ্ট ধারণা বা বোধ ও প্রত্যয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে এবং তাঁর লক্ষ্য উদ্দেশ্যে ও নির্দেশনা সম্পর্কে দায়িত্বশীলতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও দায়িত্ব পালনের বাস্তবতা সৃষ্টি হয়। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ এবং উভয়ের নির্দেশনাকে বুঝার ও সেই বুঝার ভিত্তিতে চলার সচেতনতা, অভিজ্ঞতার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই জ্ঞান। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইহ-পারত্রিক, পারত্রিক ও সামাজিক জ্ঞান বিজ্ঞানকে ইসলামী ভাবধারায় বিন্যাস, বিচার-বিশ্লেষণ এবং গ্রহণ-বর্জন করার প্রক্রিয়া Process কে জ্ঞানের ইসলামীকরণ বুঝায়।

\r\n

অবশ্য জ্ঞান ইসলামীকরণ বিষয়টিকে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও চিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে বুঝাতে চেষ্ঠা করেছেন। নিম্নে কটি মন্তব্য উল্লেখ্য:

\r\n

ড. ইসমাইল রাজী আল ফারুকী বলেন, জ্ঞান ইসলামীকরণ মানে জ্ঞানের নতুন সংজ্ঞা দিতে হবে এবং তথ্যাদিকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তথ্যাদির কার্যকারণ ও সম্পর্ক নিয়ে পুনর্বার চিন্তাভাবনা করতে হবে, উপসংহারগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে, উদ্দেশ্যের পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং তা এমনভাবে করতে হবে যাতে বিষয়গুলোর দর্শনকে সমৃদ্ধ করে এবং ইসলামের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এই লক্ষ্যে ইসলামের পদ্ধতিকরণ ক্যাটেগরিগুলোকে যথা-সত্যের ঐক্য, জ্ঞানের ঐক্য, মানবতার ঐক্য, জীবনের ঐক্য এবং সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য-মানুষের প্রতি সৃষ্টির আনুগত্য এবং সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি মানুষের আনুগত্য-এ চিন্তাধারার আলোকে পাশ্চাত্য ধারণাগুলোকে অবশ্যই সংশোধন করতে হবে এবং বাস্তবতাকে উপলদ্ধি ও বিন্যস্ত করার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। তদ্রুপ, পাশ্চাত্য মূল্যবোধের স্থলে ইসলামী মূল্যবোধকে পুন:স্থাপন করা উচিত এবং তদনুযায়ী প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যার্জনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।

\r\n

ড. ইমাদুদ্দীন খলীল বলেন, The term `Islamization of knowledge’ means ( i.e. Discovering, compiling, piecing together, communicating and publishing) intellectual activity based on the islamic concept of the universe, life and man.

\r\n

তিনি অন্য স্থানে আরো বলেন,

\r\n

The Islamization of knowledge means involvement in intellectual pursuits, by examination, summarization, correlation, and publication, from the perspective of an Islamic outlook on life, humanity, and the Universe.4

\r\n

ড. ত্বাহা জাবির আলওয়ানী জ্ঞান ইসলামীকরণের স্বরূপ সম্পর্কে অনেকগুলো মন্তব্য করেন। যেমন এক স্থানে তিনি বলেন, The Islamization of knowledge may be understood as a cultural and intellectual project aspiring to correct the processes of thinking within the Muslim mind so that it can produce islamic, social, and humanistic knowledge based on the two sources Muslims accept as the established source for knowing the truth: wahy ( divine revelation) and wujud (existence). In this endeavor, we shall use reason and the senses to help us acquire such knowledge that cannot be established on revelation and existence.

\r\n

তিনি আরো বলেন, বস্তুত জ্ঞানের ইসলামীকরণ বলতে এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তা চেতনাগত পদ্ধতিভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে পরিচালিত কার্যক্রমের নাম। এটি মূলত একাধিক কার্যক্রমের সমষ্টি বিশেষ। যাতে জ্ঞানের ইসলামী উৎসের মূল্যায়নের আবেদন উপস্থাপন করা, জ্ঞানের বিন্যাস ও বিভাজনে ইসলামী ভাবধারা তথা তাওহীদ ভিত্তিক চেতনার প্রতিফলন করা, অমুসলিম সমাজে প্রচলিত উপকারী জ্ঞানের সাথে কুরআন সুন্নাহ কেন্দ্রিক জ্ঞানের সমন্বয়, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইসলামের তত্ত্ব ও তথ্য সংযোজন করা, ইসলামী চিন্তাধারার আলোকে চিন্তনপদ্ধতি অনুসরণ করা, সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ইসলামের আবেদন তুলে ধরা, নতুন নতুন সমস্যায় ইজতিহাদ করা ইত্যাদি কার্যসম্পাদন অন্তর্ভূক্ত থাকে।

\r\n

এটি প্রাতিষ্ঠানিক বা শিক্ষা কারিকুলামের ক্ষেত্রে হতে পারে, আবার অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে জীবন চলার পথে বিভিন্ন দিকে গৃহীত চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রেও হতে পারে। এটি কোন বিলাসিতা নয় কিংবা কোন অসার সৌন্দর্যবর্ধক তথা কসমেটিক সংযোজন Cosmic Addition)  নয় যে, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কিত এক দুটি কুরআনের আয়াত বা হাদীছ সংযোজন বা ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করলেই ইসলামী করণ হয়ে গেল! বরং জ্ঞানের ইসলামীকরণ বলতে প্রচলিত জ্ঞানতত্বের আমূল পরিবর্তন বুঝায়। জ্ঞানকে ইসলামের আলোকে নতুন করে বিন্যাস ও বিভাজন করতে হবে। যে সব কথার উপর তত্ত্ব ও বা সিদ্ধান্ত ও অনুসিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা পুনর্মুল্যায়ন করতে হবে। মানব সমাজে অনুপ্রবেশকারী ভ্রান্ত জ্ঞানকে নিরূপিত করে সেখানে সত্য জ্ঞান তথা ইসলামী ভাবধারা প্রতিস্থাপন করতে হবে।

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

\r\n\r\n

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। মানব জীবনে যদি ইসলামের প্রয়োজনীয়তা থাকে, তা হলে ইসলামীকরণের গুরুত্বও রয়েছে। এ বিষয়টির বিভিন্ন দিক রয়েছে। নিম্নে প্রধান কটি দিক আলোচনা করা হলো:

\r\n

 

\r\n

আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণ:

\r\n

মানুষের দেহই মূল মানুষ নয়। দেহ ও রূহের সমন্বয়ে মানুষ। নিচের চিত্রে বিষয়টি দেখানো যায়:

\r\n

 

\r\n

মানুষ সত্তা:- 1) দেহ-> মাটির তৈরী যা পঁচনশীলও সদা।

\r\n

         ২) রূহ-> আল্লাহর আদেশ যা অবিনশ্বরও

\r\n

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, “যখন আপনার পালনকর্তা ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি মাটির মানুষ সৃষ্টি করব। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার সামনে সেজদায় নত হয়ে যেও।” (সূরা সাদ: 71-72) মানুষের দেহের যেমনি চাহিদা পূরণ করতে হবে। খোরাক দিতে হবে। না হয়, জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। এ রূহের খোরাক হলো আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখা, আল্লাহর ইবাদত করা, আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের চর্চা ইত্যাদি। অথচ বর্তমানে সকল ধরণের জ্ঞান চর্চা করে দেহ আত্মার চাহিদার সমন্বিত পূরণের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এটা সম্ভব জ্ঞান ইসলামী করণের মাধ্যমে।

\r\n

ইসলামের লক্ষ্য মানব সমাজের কল্যাণ প্রতিষ্ঠা:

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজটি অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক ও বাস্তবতার চাহিদা প্রতিফলন বিশেষ। কারণ ইসলাম মানব জীবনের কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত। দুনিয়া ও আখেরাতে সার্বিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠাই ইসলামের লক্ষ্য। মানুষের বৈষয়িক চাহিদাকে কোন ভাবেই উপেক্ষা করে না। বরং ইসলামই সুন্দরভাবে মানুষের বৈষয়িক চাহিদা পূরণেও ব্যবস্থাদি দিয়েছে।

\r\n

ইসলামী শারী’আতের লক্ষ্য বর্ণনায় ইমাম গাযালী বলেন,

\r\n

শারী’আতের গূঢ় উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে তাদের ‘আকীদা বিশ্বাস, জীবন, বুদ্ধিবৃত্তি, সন্তান-সন্তুতি ও সম্পদের সংরক্ষণ করা। যা কিছু এই পাঁচটি বিষয় সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করে তা-ই জনস্বার্থ বলে গণ্য এবং সে বিষয়টিই কাম্য।’

\r\n

ইমাম শাতেবী মানব কল্যাণে নিয়োজিত ইসলামের লক্ষ্যকে তিনভাগে বিভক্ত করেন- ক. জরুরিয়াত/আবশ্যকীয় ((Necessities) এগুলো পাঁচটি: দীন রক্ষা করা, জীবন রক্ষা করা, বংশ রক্ষা করা, সম্পদ রক্ষা করা, বিবেক বুদ্ধি রক্ষা করা।

\r\n

খ. হাজিয়া/ প্রয়োজনীয় (Requirement), যা জীবন যাত্রাকে সহজ করে দেয়, যেমন যানবাহন।

\r\n

গ. তাহসিনিয়্যাত বা সৌন্দর্যবর্ধক ( Beautification) ।

\r\n

ইমাম ইবনুল কায়্যিম বলেন,

\r\n

The objective of the sharah (Islam) is wisdom and welfare. Anything that departs from wisdom to folly, from generosity to misery, from welfare to hardship has nothing to do with the shariah.\"

\r\n

(শারী’আহ তথা ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে মানুষের প্রজ্ঞা এবং দুনিয়া ও আখেরাতে জনগণের কল্যাণ সাধন। আর কল্যাণ নিহিত রয়েছে সার্বিক আদল ( ন্যায়বিচার), দয়ামমতা, কল্যাণকামিতা ও প্রজ্ঞার মধ্যে। যেখানে আদলের পরিবর্তে যুলম, দয়া মমতার পরিবর্তে নিষ্ঠুরতা, কল্যাণকামিতার পরিবর্তে দু:খ দুর্দশা এবং প্রজ্ঞার পরিবর্তে নির্বুদ্ধিতা বা বোকামি স্থান পায়, তার সাথে শারীআতের কোন সম্পর্ক নেই।”)

\r\n

উপরোক্ত আলোচনায় শারীআতের ক্ষেত্র ও বিষয়বস্তু স্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং শারীআতের জ্ঞান তথা ইসলামী জ্ঞান মানুষের কল্যাণেই নিয়োজিত। এর প্রসার ঘটালে মানুষের কল্যাণই নিশ্চিত হবে। তাই মানুষের কল্যাণের জন্য জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম প্রয়োজন।

\r\n

মুসলিম মনন ও চিন্তাধারার পুনর্গঠন:

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী ও আন্দোলন। এর টার্গেট প্রথমত মুসলিম সমাজের সংষ্কার। মুসলমানদের চিন্তাধারায় অনেক অ-ইসলামী ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। জীবন কাজ করে তাকদীরের উপর নির্ভরশীলতা, অলসতা, অতিকল্পনা বিলাসপ্রবণতা, আবেগ উদ্দীপনার অধিক ব্যবহার, সুশৃঙ্খল ও পদ্ধতিগত চিন্তনের অভাব ইত্যাদি বিষয় মুসলিম মানসকে আক্রান্ত করেছে। চিন্তা জগতে ঘুনে ধরা এ মুসলিম সমাজকে সংষ্কারের জন্য প্রয়োজন কুরআন সুন্নাহের আলোকে ইসলামী চিন্তাধারার পুনর্গঠন। জ্ঞান ইসলামীকরণের মাধ্যমেই তাই করা হয়।

\r\n

সত্য সন্ধানে ওহী জ্ঞানের প্রতি আস্থা সৃষ্টিকরণ:

\r\n

সমসাময়িক বিশ্বের বৈজ্ঞানিক মানস এককথায় সব ধর্মীয় কিতাব বর্জন করে থাকে। যদিও এ সবের কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে নমনীয় ভাব প্রদর্শন করে। তবুও এসব গ্রন্থের ম্যাথডোলজি, বুনিয়াদি স্থাপনাগত এককত্ব, চূড়ান্ত কাঠামোকে তারা প্রত্যাখ্যান করে। তারা জোর দিয়েই বলে থাকে যে, এসব ধর্মীয় গ্রন্থাদির ক্ষেত্র বিশ্বাসগত তুষ্টি ও অদৃশ্যমান জগত পর্যন্ত সীমিত থাকা উচিত। অনন্তর ঐ দাম্ভিকদের মতে অদৃশ্যজগত ও বাস্তবতার মাঝে সমন্বিত অধ্যয়ন করা অসম্ভব। তারা বলে থাকেন, এ ধর্মীয গ্রন্থ সমূহে যে সব গায়েবী বা অদৃশ্য জগত সম্পর্কে কথাবার্তা আছে, তা তো বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার উপযুক্ত ক্ষেত্র হতে পারে না। যদি তাই করা হয়, তা হলে এর যে কোন একটিকে অবান্তর ঘোষণা করতে হবে অথবা জোরাতালিমূলক সমঝোতা করতে হবে ও সমাধানে আসতে হবে। আসমানী কিতাবসমূহ অদৃশ্যজগত সম্পর্কে যে ইঙ্গিত দিয়ে থাকে বা কিছু কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করে, তা সমসাময়িক কালের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার আয়ত্বাধীন নয়। এ বিষয়ে গবেষণাকে বৈজ্ঞানিক মর্যাদা দেয়া যাবে না। এ জন্য বর্তমান বিশ্বের জন্য ইউনেসকো জ্ঞানের একটি সংজ্ঞা পরিবেশন করেছে। তার ঘোষণায় বলা হয়:‘ যে জ্ঞাত বিষয় ইন্দ্রয়গাহ্য ও অভিজ্ঞতা লব্দ তাই জ্ঞান।’

\r\n

কিন্তু তারা সকল ধর্ম গ্রন্থকে একই মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করে ভুল করেছে। আল কুরআন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আল কুরআন ও সুন্নাহর বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এসবের অনেক কিছু অন্য নামে মানব সমাজে প্রচলিত আছে। যেমন সামাজিক বিজ্ঞানের অংশ প্রশাসন বিদ্যায় প্রশাসনে কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব তথা ‍সাংগঠনিক তত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। একটি হলো যান্ত্রিক মতবাদ। এ মতবাদে বলা হয়, কর্মচারীদের নিকট থেকে কঠোর নিয়মের আওতায় তথা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজ আদায় করে নিতে হবে। অপর আরেকটি মতবাদ হলো মনত্বাত্ত্বিক মতবাদ। এ মতবাদে বলা হয়, মানুষের পারিপার্শ্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বিবেচনা করে কাজ নিতে হবে। এতে অনেকটা শিথিল মনোভাব পোষণ করা হয়। অন্য দিকে এতদুভয়ের মাঝামাঝি আরেকটি মতবাদ রয়েছে যাকে বলা হয় আধুনিক মতবাদ। তার কথা হলো এমন কঠোরতা আরোপ করা যাবে না, যাতে কর্মচারী সাধ্যাতীত হয়ে যায়। আবার এত শিথিল করা যাবে না যাতে নিয়ম শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। বরং উভয়ের মাঝে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উল্লেখ্য, ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটি কুরআন হাদীছ সম্মত। অথচ মানব সমাজে এটি আধুনিকতার নামে প্রচলিত। তাই এরূপ বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে। কুরআন হাদীছের জ্ঞানের স্বরূপ তুলে ধরে এর প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি করা সম্ভব। জ্ঞান ইসলামীকরণের মাধ্যমে এটি করা যায়।

\r\n

এমনিভাবে আলকুরআনে বলা হয়, ‘প্রত্যেকই আপন কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান।’ আধুনিক বিজ্ঞানও তাই বলছে। সুতরাং হিন্দু পৌরাণিক তথ্যে বলা হচ্ছে, পৃথিবীর চতুর্পার্শ্বে সূর্য ঘূর্ণায়মান। অপরদিকে আলকুরআন যা বলছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। অতএব আলকুরআনকে অন্য সকল ধর্মগ্রন্থের সাথে একই পাল্লায় পরিমাপ করা ইনসাফপূর্ণ নয়।

\r\n

এছাড়া, আল কুরআন মানব সমাজে এমন সময় এমন সব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য তুলে ধরেছে, যখন সেসব তথ্য আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপকরণ ব্যবহার করে জানা সম্ভব ছিল না। এ দ্বারা বুঝা যায়, এটি আল্লাহ প্রদত্ত সত্য জ্ঞান সমৃদ্ধ। জীবন ও জগতের অনেক বিষয় আছে, যা গায়েবের সাথে জড়িত। তাই প্রত্যক্ষ জগতের বিভিন্ন বিষয় যদি বৈজ্ঞানিক সত্য বলে স্বীকৃত হয়, তা হলে স্বাভাবিকভাবে গায়েবের বিষয়াদিও সত্য বলে মনে নিতে হবে। এ ছাড়া জীবন ও জগতের অনেক কিছুর ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। আধুনিক বাস্তববাদী (Realism) দর্শন এ সব ক্ষেত্রে নিরব। সুতরাং কুরআনিক জ্ঞান বিজ্ঞান উপস্থাপনের মাধ্যমে ওহী জ্ঞানের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পায়। জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রচেষ্ঠার মাধ্যমে কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান উপস্থাপন করা হয়।

\r\n

 

\r\n

শিক্ষা ও চিন্তাধারায় ঈমানী নৈতিকতার সংযোজন:

\r\n

আজকে শিক্ষিত মানুষের মাঝে অপরাধ প্রবণতা বেশি। বড় বড় অপরাধের সাথে শিক্ষিত মানুষেরাই অধিক জড়িত। এর কারণ হলো নৈতিক শিক্ষার অভাব। শিক্ষা ক্ষেত্রের সমস্যাই সমাজে সকল সমস্যার মূল। (Problem of education is the main root our problems) । কিন্তু খোদ নৈতিকতার ভিত্তিতেই সমস্যা রয়েছে। নৈতিকতার ভিত্তি হলো: ব্যক্তিস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আবেদন তুলে ধরার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ব্যক্তি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর চিন্তা করে কেউ ধুমপান থেকে বিরত থাকে না। জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে কেউ জাতীয় সম্পদ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকে না। রাজনৈতিক সংঘর্ষে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংঘর্ষে জাতীয় সম্পদ রক্ষা পায় না। তাই নৈতিকতার ঐ দর্শন ও ভিত্তি অকার্যকর। কিন্তু ইসলামী নৈতিকতার ভিত্তি তাকওয়া। তাই জ্ঞান আহরণ ও বিতরণ প্রক্রিয়া তথা শিক্ষা ব্যবস্থায় এ তাকওয়া কেন্দ্রিক নৈতিকতা দিয়ে সাজাতে হবে। সুতরাং এ কাজ করতে হলে শিক্ষা ও জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রয়োজন। এর মাধ্যমেই শিক্ষা ও মূল্যবোধের ভূমিকা সম্পর্কে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন-“...Science without religion is lame, Religion without science is blind.\"

\r\n

Stanly Hull বলেছেন- \"If  you teach your children the three R\'s ( Reading, writing and Arithmetic) and and leave the fourth R ( i. e. Religion), you will get a fifth R (Rascality).\"

\r\n

বর্তমানে দ্বীনি শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার যে দুটি ধারা দেখা যায়, এর প্রভাবে একদিকে সৃষ্টি হচ্ছে এক শ্রেণির দ্বীনি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি যারা, বহুলাংশে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে নেই। আবার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের মাঝে দ্বীনি ইলমের বেশ অভাব।

\r\n

এতে ইসলামের জ্ঞান বা শিক্ষার সুমহান বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। পৃথিবীতে বড় ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত মূল ব্যক্তিটি দেখা যায় শিক্ষিত-বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। আবার দ্বীনি জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিটির মধ্যে সেই সব অপরাধের সাথে জড়িত না থাকলেও তারমধ্যে সেই সব ভয়াবহ পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার যোগ্যতার অভাব। দুনিয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের বেশ এগিয়ে যাবার পরেও শুনা যায়-

\r\n

“টেকনোলজির বাড়ছে প্রভাব, কাণ্ড জ্ঞানের পড়ছে অভাব, দেখি মানুষের সেই পশু স্বভাব, দুনিয়ার এই চিত্রপটে।”

\r\n

দু:খ করে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:) বলেছিলেন-

\r\n

“চারদিকে দেও-দানব ও জানোয়ার দেখতে দেখতে আমার বিরক্তি ধরে গেছে, আমি এখন মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছি।

\r\n

সেই কাঙ্খিত মানের মানুষ গড়ে উঠতে পারে ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী মূল্যবোধের অভাব থাকাতে কাঙ্খিত মানের মানুষ গড়ে উঠছেনা। ডাক্তার হয়ে অর্থের লোভে অনেকেই অনৈতিক কাজ করছে, ইঞ্জিনিয়ার বা আমলা হয়ে ঘুষ-দূর্নীতি হয়ে পড়ছে। মানুষ কিন্তু মূল্যবোধহীন মানুষ গড়ে উঠছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় Secular ভাবধারা, নৃতত্ত্বে ডারউইনের মতবাদ, সমাজ বিজ্ঞানে মার্কসীয়, ফ্রয়েডিয় মতবাদ, ইতিহাস ইহজগৎকেন্দ্রিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামী ভাবধারার পরিবর্তে পাশ্চাত্য ভাবধারা গ্রহণ করে শিক্ষিত নামধারী কিছু নৈতিকতা বিবর্জিত ইসলামী মূল্যবোধহীন, সমাজ সংসারের জন্য অনিষ্টকর, দুর্নীতিগ্রস্থ, ঘুষখোর, অহংকারী, খুনি, চক্রান্তকারী কিছু পশু স্বভাবের লোক পাওয়া যাচ্ছে।

\r\n

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলে তাকওয়াবান, তাওয়াক্কুলকারী শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ইত্যদি নানা পেশার লোক পাওয়া যেত। সেই সব লোকেরা হবে Practising Muslim. তারা হবে দেশ সমাজের সংসারের জন্য মঙ্গলময়। তাই জ্ঞান ও শিক্ষা ইসলামীকরণের মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধের চর্চায় বিকশিত হবে ঈমানী চেতনা ও প্রকৃত মানবতা।

\r\n

কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক সমাজ গঠন:

\r\n

কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক সমাজ গঠন করতে হলেও সমাজে প্রচলিত জ্ঞানকে ইসলামীকরণ করতে হবে। না হয়, ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে সমাজ পরিচালিত হবে না। তা হলে সহজেই ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। গোটা মানবজাতিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সুস্থ ব্যবস্থার অধীনে গড়ে তোলা জ্ঞানের ইসলামীকরণের লক্ষ্য।

\r\n

ইসলামী কার্যধারায় পদ্ধতিগত চিন্তার পুন:স্থাপন:

\r\n

যুগে যুগে আসা নবী রাসূল আ: গণ সমাজ সংষ্কারে পদ্ধতিগত চিন্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ সা: ও তাঁর সাহাবীগণও পদ্ধতিগত চিন্তনের পথ অনুসরণের করতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ের মুসলমানরা অনেক সময় এ ব্যাপারে সচেতন ছিল না। বিশেষত মানব সমাজে শিল্প বিপ্লবের পর এর সমস্যাগুলো স্বভাবত জটিল আকার ধারণ করছে। এখন এগুলো সমাধানে পদ্ধতিগত চিন্তাধারার প্রয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এখন যারা পদ্ধতিগত চিন্তন প্রয়োগ করবে,তারাই টিকে থাকবে। অতএব জ্ঞান ইসলামীকরণের আওতাভূক্ত এ পদ্ধতিগত চিন্তার পুন:স্থাপনের মাধ্যমে মুসলমানরা পুনরায় বিশ্ব নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে।

\r\n

যুগ সমস্যা নিরসনে ইজতিহাদে নিবেশ করানো:

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণের অন্যতম শর্ত হলো ইজতিহাদে মনোনিবেশ করানো ইজতিহাদের মাধ্যমে নতুন নতুন সমস্যার সমাধান দিতে না পারলে ইসলামকে সে ক্ষেত্রের জ্ঞানের জন্য অকার্যকর বলে ঘোষণা করা হবে। তাই বৈচিত্রময় জীবনে নানান সমস্যা নিরসনে ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই ইসলামীকরণ কর্মসূচীর আওতায় মুসলিম স্কলারদেরকে ইজতিহাদে গভীরভাবে মনোনিবেশ করা যায়।

\r\n

 

\r\n

বিশ্ব দরবারে ইসলামের মৌলিকত্ব তুলে ধরা:

\r\n

জ্ঞান ইসলামী করণের মাধ্যমে ইসলামের মৌলিকত্ব ফুটে উঠবে। বিশ্ব দরবারে ইসলামকে উপস্থাপনের জন্য ইসলামের মৌলিকত্ব স্পষ্ট করতে হবে।

\r\n

 

\r\n

সভ্যতার সংঘাত নয় বরং সংলাপ সৃষ্টি:

\r\n

ইসলামী সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা বিশ্ব সমাজে তুলে ধরার জন্যও জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম প্রয়োজন। এর মাধ্যমেই মানব সভ্যতার অর্থপূর্ণ যোগাযোগ ও বিনিময় প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব। সভ্যতার সংলাপে বসতে হলে ইসলামী চিন্তাধারার মৌলিক উপস্থাপন পেশ করতে হবে। তুলনার জন্য ও সংলাপের জন্য তুল্য বিষয়ের মৌলিকতা প্রয়োজন। মানব জাতিকে ঐশী সত্য (Divine truth) সম্পর্কে অবহিত করতে হলে কার্যকর বিনিময় প্রক্রিয়া শুরু হওয়া প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অগ্রসর নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে তাই করা হয়। এ জন্য ফ্রান্সের মুসলিম স্কলার রজার জারোদী ( Roger Garaudy)  বলেন, It is a means and an approach in the dialogue of civilization\".

\r\n

ড. ত্বহা জাবির আলওয়ানী বলেন, In our estimation, the Islamization of knowledge, in its wider perspective, provides Muslims with the intellectual underpinnings for a complete civilizational transformation.\"

\r\n

তিনি আরো বলেন, \"Recent international developments and the frightening destructive capabilities of the major technological powers   should be enough to make this assertion apparent to all. Doubtless, dialogue between nations, as well as their exchange of ideas and appreciation for one another\'s cultures, promote the kind of understanding presently required. The Islamization of knowledge will contribute positively to this dialogue.\"

\r\n

হান্টিংটন সভ্যতার সংঘাত (Clash of civilizations) নামে থিওরি দিয়ে বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টিতে সহায়তা করেছেন। তাই জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সভ্যতার সংলাপ সৃষ্টি করা হবে। এর মাধ্যমে সংঘাত নয়, বরং শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে মানব সমাজের সমস্যা নিরসনের প্রচেষ্ঠা চালানো হবে। তাই বিশ্বসভ্যতায় এ কার্যক্রমের গুরুত্ব অপরিসীম।

\r\n

মুসলিম উম্মাহর মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা:

\r\n

আধুনিক শিল্পবিপ্লবের কারণে নতুন নতুন ব্যবস্থাপনা ও উদ্ভাবনার সামনে মুসলিম উম্মাহর মাঝে হীনমন্যতা ( Inferiority complex) সৃষ্টি হয়েছে। তাদের স্কলারদের কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছে যে, পশ্চিমাদেরই অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু তারা হয়তো ভুলে গেছেন যে, মুসলিম উম্মাহ এক সময়ে জ্ঞান বিজ্ঞানে নেতৃত্ব দিয়েছে। পশ্চিমারা মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞান সমূহ সংস্কার ও উন্নয়ন করেই এতসব নবনব উদ্ভাবন উপহার দিচ্ছে। ইসলামী মূলনীতির আলোকে ইজতিহাদ করা হলে আবারও জ্ঞানের জগতে প্রাধান্য বিস্তার করা সম্ভব। তাই জ্ঞান ইসলামীকরণের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

\r\n

 

\r\n

সমাজের ভয়াবহ অবক্ষয়রোধ ও ইসলামী দাওয়াহ:

\r\n

আজকের মানব সমাজ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা সকল দিক দিয়ে ভয়াবহ অবক্ষয় ও তীব্র সংকটের মুখোমুখি। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থায় ধ্বস নেমে এসেছে। এ ভয়াবহ ও পরিস্থিতিতে মুক্তি দিতে পারে ইসলাম। অমুসলিম সমাজে প্রচলিত জ্ঞান বিজ্ঞানের স্থলে ইসলামের সত্যজ্ঞান যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারলে তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করবে। ফলে সে সব সমাজে ইসলামী দাওয়াহও সম্প্রসারিত হবে। তাই দাওয়াতের স্বার্থে এবং মানব সমাজের অবক্ষয় রোধে জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম প্রয়োজন। এটা তখন কোন ধর্ম কেন্দ্রিক প্রয়োজনীয়তা হিসেবে দেখা হবে না। মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এটার প্রয়োজনীয়তা প্রতিভাত হবে। এর প্রয়োজনীয়তা সভ্যতাগত।

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণ একটি কুরআনিক মিশন:

\r\n

আল কুরআনে যেমনিভাবে কুরআন অধ্যয়ন করতে বলা হয়েছে, তেমনিভাবে বিশ্বজগত সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে বলা হয়েছে। এ জন্য প্রথম ওহীতেই দুধরণের পাঠ তথা অধ্যয়নের কথা বলা হয়। ইরশাদ হয়েছে:

\r\n

ইক্বরা’ বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক্ব। খালাক্বাল ইনসানা মিন আলাক। ইক্বরা’ ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আল্লাযি আল্লামা বিল ক্বালাম।

\r\n

“পাঠ করুন আপনার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার প্রভু মহা দয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।” ( সূরা আলাক: ১-৪)।

\r\n

তাই আল কুরআনের জ্ঞান ও বিশ্বজগতের জ্ঞানের মাঝে সমন্বয় সাধন করতে হবে। তা কুরআন বুঝার জন্য এবং তা প্রয়োগ করার জন্যও। অতএব জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজটি কুরআনিক মিশনের আওতাভুক্ত।

\r\n

 

\r\n

সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইসলাম পশ্চাতপদ নয়:

\r\n

প্রতি যুগেই সমসাময়িক কিছু প্রসঙ্গ বা সমস্যা থাকে, যা কোন কোন ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। যেমন: ব্যভিচার প্রমাণ করার জন্য আলকুরআনের বিধান হলো চারজন সাক্ষী প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান মেডিকেল সাইন্সের কথা হলো সংশ্লিষ্ট নর নারীকে পরীক্ষার মাধ্যমে ‍তা প্রমাণ করা যায়। তা হলে চার জন সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। তাহলে কি আলকুরআনের এ বিধান আজকের সমাজে অকার্যকর। এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় বলা যায়, না অকার্যকর নয়। কারণ মেডিকেল রিপোর্টেও ভুল হতে পারে। তাই চারজন ডাক্তার যদি কোন রিপোর্টের উপর একমত হয়, তা হলেই এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এভাবে সমন্বয় করা যেতে পারে।

\r\n

এভাবে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভবের প্রেক্ষাপটে কুরআন সুন্নাহর আলোকে সমাধান দেয়া এবং বিকল্প তৈরী করে দেয়ার জন্য জ্ঞান ইসলামী করণ কার্যক্রমের প্রয়োজন। ইসলাম কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এসবের আলোকে কিয়ামত পর্যন্ত সমাধান দিতে হবে।এ ক্ষেত্রে মুসলিম স্কলারদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। এ ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইসলাম পশ্চাদপদ নয়।

\r\n

মুসলিম উম্মাহ আব্বাসীয় আমলে গ্রীক সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন মোকাবেলা করেছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে উম্মাহকে বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। সুতরাং সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহ ইসলামীকরণের উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে।

\r\n

 

\r\n

বিশ্বায়নের যুগে সভ্যতার সঞ্চালন:

\r\n

উনবিংশ শতাব্দীতে প্যান ইসলাম মতবাদের মাধ্যমে জামাল উদ্দীন আফগানী বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ইসলামী চিন্তা চেতনা ও সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য, আজও ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশ্বায়ন প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বায়ন মানে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিশ্বায়ন। এর বিকল্প হিসাবে একমাত্র বিশ্বজনীন জীবন ব্যবস্থা ইসলাম। এর প্রসারের মাধ্যমেই কাঙ্খিত বিশ্বায়ন সম্ভব। মুসলিম উম্মাহর উদ্ভব যেহেতু বিশ্বমানবের জন্য, সেহেতু উম্মাহভিত্তিক এ কাজ করা সকল মুসলমানের কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম অবদান রাখতে পারে।

\r\n

 

\r\n

স্বনির্ভর মুসলিম বিশ্ব গড়া:

\r\n

জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহকে পরনির্ভর হলে কাঙ্খিত উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব নয়। মুসলিম বিশ্ব জনশক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও স্বনির্ভর হতে পারছে না। কারণ এগুলোর চালিকাশক্তি হলো জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি। অথচ এ ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ পশ্চাতপদ। প্রতিটি সভ্যতার অধিকারীরা নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্যের আলোকে তাদের প্রযুক্তির বিন্যাস করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই সে সব প্রযুক্তি মুসলিম সমাজে আমদানী করার পর সেগুলো ইসলামী মূল্যবোধের কিছু পরিপন্থী কিছু দেখলেই সাধারণ মুসলমান তা প্রত্যাখ্যান করছে কিংবা ঈমান হারার আশংকায় সেগুলো যথাযথ ব্যবহার থেকে দূরে থাকছে। যেমন: তথ্য প্রযুক্তির বিষয়টি। তাই ইসলামী মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের আলোকে জ্ঞান বিজ্ঞানগুলোকে সাজাতে হবে এবং মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে সেগুলোর উন্নয়ন করতে হবে। তা হলেই এগুলো কার্যকর হবে। আর এ কাজে জ্ঞান ইসলামীকরণ ছাড়া মুসলিম উম্মাহর গত্যন্তর নেই।

\r\n

মোট উম্মাহর পুনর্গঠন করতে হলে, দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করতে হলে জ্ঞান ইসলামীকরণের বিকল্প নেই। উম্মাহর প্রয়োজনেই বিজাতীয় রীতিনীতি, বিনোদন মাধ্যম, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চর্চা, অসাড় শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি বিস্তারের প্রধান বাহন জ্ঞান তত্ত্ব, জ্ঞান আহরণ ও বিতরণ প্রক্রিয়া ইসলামীকরণ করা। দ্বিমুখী শিক্ষা মুসলমানদের অধ:পতনের মূল কারণ। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে উম্মাহর পুনর্গঠন এবং আল্লাহ তায়ালার অর্পিত দায়িত্ব পালনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হবে। তাই এ ক্ষেত্রে মুসলিম চিন্তাবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। জ্ঞানের বিষয় বা শাখা হিসাবে মানবিক, সমাজবিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ইসলামী দর্শনের আলোকে পুনর্গঠিত করতে হবে। প্রতিটি বিষয় পদ্ধতি কৌশল, উপাত্ত, সমস্যা লক্ষ্য ও আকাঙ্খার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইসলামী নীতিমালার আলোকে ঢেলে সাজানো আবশ্যক। যতদিন জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ইসলামের আলোকে না সাজানো হবে- যতদিন ইসলামী মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরী না হবে, ততদিন ইহকালে ও পরকালে শান্তি আশা করা কল্পনাবিলাস মাত্র্র। আর এ কাজটি করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন জ্ঞান বা শিক্ষার ইসলামীকরণ করা।

\r\n

\r\n\r\n

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রমের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ:

\r\n

উৎপত্তি:

\r\n

ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বের আলোকে জ্ঞানের উতস আল্লাহ তাআলা। তিনিই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন জ্ঞান, যা তারা জানত না। ইরশাদ হয়েছে: আলকুরআনে আরো বলা হয়: ক্বালা তাআলা: আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম।

\r\n

‘তিনি মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জ্ঞাত ছিল না।’ (সূরা আলাক্ব: ৫)

\r\n

তিনি প্রথম মানুষ আদম আ: কে সৃষ্টি করে জ্ঞান দান করেন। ইরশাদ হয়েছে: ক্বালা তাআলা: ওয়া আল্লামা আদামাল আসমা আকুল্লাহা।

\r\n

তিনি আদমকে সকল কিছুর নাম পরিচয় শিক্ষা দেন। (সূরা বাকারা: ৩১)।

\r\n

তিনি আদম আ: জীবন চলার জন্য সঠিক জ্ঞান দান করেন এবং প্রশিক্ষণের জন্য জান্নাতে কিছুদিন বসবাস করার অনুমতি দেন। তখন মানব জাতির দুশমন ইবলিস শায়তান এসে ভ্রান্ত জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করে বলে আমি কী তোমাকে এমন একটি গাছ সম্পর্কে জ্ঞান দান করব, যার ফল ভক্ষণ করলে তুমি চিরস্থায়ীভাবে জান্নাতে থেকে যাবে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে: ‍ফাওয়াসওসা ইলাইহিশ শায়তানু ক্বালা ইয়া আদামা হাল আদুল্লুকা আলা শাজারাতিল খুলদি ওয়া মুলকিল লা এবলা।

\r\n

‘শায়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। আর বলল, হে আদম! আমি কী তোমাকে চিরঞ্জীবনী গাছ ও রাজত্বের সন্ধান দিব যা কোন দিন শেষ হবে না।’ (সূরা: ত্বহা: ১২০)

\r\n

যা হোক শায়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রতারণামূলক তথ্য বা জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেন। পরিণতিতে তাকে জান্নাত থেকে বের হতে হয়। শায়তান প্রদত্ত জ্ঞান সংশোধন করে আল্লাহ পাক আদমকে অবহিত করেন যে, এ তোমার শত্রু। তার ব্যাপারে তুমি সতর্ক থাকবে। এভাবেই জ্ঞানের ইসলামীকরণ কার্যক্রমের উন্মেষ ঘটে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে: ফাআযাল্লাহুমুশ শায়তানু আনহা ফাআখরজাহুমা মিম্মা কানা ফীহি ওয়াক্বুলনাহ বিত্বূ বা’ধুকুম লিবা’ধিন আদুউল্লাকুম ফিল আরদ্বি মুসতাক্বাররাউঁ ওয়া মাতাআন ইলা হীন। ফাতালাক্বা আদামা মির রব্বিহী কালিমাতিং ফাতাবা ইলাইহি। ইন্নাহু হুয়াততাওয়াবুর রহীম। ক্বুলনাহ বিত্বূ মিনহা জামীআ। ফাইম্মা এ’তিয়ান্নাকুম মিন্নী হুদাং ফামাং তাবিআ হুদা এফালা খাওফুন আলাইহিম ওলা হুম এহ‌যানূন।

\r\n

‘শায়তান আদম ও হাওয়াকে বিচ্যুত করল এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে বের করে দিল। আমি তখন বললাম, তোমরা সকল যমীনে নেমে যাও পরষ্পরে শত্রু হিসেবে। এ যমীনে নির্দিষ্টকাল তোমাদের জন্য অবস্থান স্থল ও ভোগ্য বস্তু রয়েছে। অত:পর আদম তার প্রভুর নিকট থেকে কতিপয় বাণী প্রাপ্ত হন। এর ভিত্তিতে তিনি তাওবা করেন তথা ইসলামী চেতনা গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাওবা কবুলকারী দয়াময়।

\r\n

আমি বললাম তোমরা সকলে যমীনে নেমে যাও। যখন আমার নিকট থেকে পথ নির্দেশ আসবে তখন যারা আমার পথনির্দেশ অনুসরণ করবে, তাদের জন্য কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্থও হবে না।’ (সূরা বাকারা: 3৩৬-৩৮)।

\r\n

এভাবে জ্ঞান ইসলামীকরণের কার্যক্রম উন্মেষের পর এটি বর্তমানকাল পর্যন্ত কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করে। যা নিম্নরূপ:

\r\n

ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়:

\r\n

প্রথম পর্যায়: নবুওয়াতী ধারা:

\r\n

হযরত আদম আ: এর পর মানব জাতি যখনই আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও হেদায়েত থেকে বিচ্যুত হয়ে অজ্ঞানতার প্রতি, মিথ্যার প্রতি ধাবিত হয়েছে, তখনই যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে। তারা মানব সমাজে প্রচলিত জ্ঞান সংশোধন করেন এবং ইসলামী জ্ঞানকে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেন। তাদের সকলের কাজ জ্ঞান ইসলামী করণ কাজের আওতাভুক্ত। এভাবে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সা: আগমন করেন এবং জ্ঞান ইসলামীকরণে সামগ্রিক প্রচেষ্টা নিয়োগ করেন। তাঁর মাধ্যমে প্রাপ্ত কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান ও তাঁর যুগ এ ক্ষেত্রে সকল যুগের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট মডেল।

\r\n

দ্বিতীয় পর্যায়: মধ্যযুগে গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানের আগ্রাসন মোকাবেলা:

\r\n

নবুওয়াতী ধারায় রচিত জ্ঞান ভাণ্ডারে পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবীগণের যুগ অতিবাহিত হয়। তারা নতুন কোন সমস্যা দেখা দিলে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ব্যক্তিগতভাবে এবং সামষ্টিকভাবে ইজতিহাদ করেছেন। ইসলামীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবস্থাদি চালু করেছেন। এভাবে তাবেঈন তথা উমাইয়াদের যুগ অতিবাহিত হয়। কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির প্রেক্ষাপটে মুসলমানগণ এমন এমন এলাকায় গমন করেন, যেখানে গ্রীক রোমান জ্ঞান বিজ্ঞান প্রচলিত ছিল। তখন অতি উতসাহ ভরে ও অমুসলিমদের প্রভাবে কিছু মুসলিম পণ্ডিত আব্বাসীয় আমলে গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞান আরবীতে অনুবাদ করে আলোচনা শুরু করেন। তখন চার ধরণের দৃষ্টিভঙ্গীর উন্মেষ ঘটে।

\r\n

 

\r\n

ক. প্রচণ্ড প্রভাবিত হওয়া:

\r\n

বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক পর্যায়ে মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিজ্ঞানের উপর অফুরন্ত নির্ভরশীলতার উন্মেষ ঘটে। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে মুসলিম মুতাযেলী সম্প্রদায়। তারা গ্রীক দর্শনের প্রচণ্ড ভক্ত বনে যায়। তাদের মধ্যে একদল গ্রীক যুক্তি বিদ্যায় আকৃষ্ট হয়ে জ্ঞানের সকল পর্যায়ে গ্রীক মানতিক তথা যুক্তিবিদ্যা প্রয়োগ করতে শুরু করে। তাদের বুদ্ধিভিত্তিক মূলনীতির বাইরে কিছু হলে তা পরিহার বা উপেক্ষা করতে শুরু করে।

\r\n

 

\r\n

খ. প্রত্যাখ্যান:

\r\n

অপরদিকে কুরআন সুন্নাহে আকড়িয়ে ধরা উলামায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিছগণ গ্রীক দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞান প্রত্যাখ্যান করে। তারা মনে করেন, জীবন পরিচালনার জন্য কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানই যথেষ্ট।

\r\n

গ. সমন্বয় সাধনের চেষ্টা:

\r\n

গ্রীক দর্শন অধ্যয়ন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় লিপ্ত কিছু ব্যক্তি মুসলিম দার্শনিক বলে আত্মপ্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে মুতাযেলা সহ অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিও ছিলেন। তার মধ্যে আবু নসর ফারাবীর মত কিছু ব্যক্তি ইসলামী চিন্তাধারা ও গ্রীক চিন্তাধারার মাঝে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন।

\r\n

ঘ. অসারতা প্রমাণ:

\r\n

অপরদিকে আবুল হাসান আশআরীর মতো কিছু কালাম শাস্ত্রবিদ মুতাযেলী মতবাদ পরিত্যাগ করে মুতাযেলী মতবাদ ও গ্রীক দর্শনের বিভিন্ন তত্ত্ব ও  তথ্য খন্ডন করার কাজে আত্ম নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে ইমাম আবু হামেদ গাযালী এসে তাহাফাতুল ফালাসাফা লিখে গ্রীক দর্শনের খন্ডন করেন এবং এর অসারতা প্রমাণ করেন। অত:পর ইবন তাইমিয়া প্রমাণ করেন যে, শুধু গ্রীক দর্শন অসার নয়, বরং এ দর্শন যে ভিত্তি ও পদ্ধতির উপর প্রতিষ্টিত তাও অসার। এ বিষয়ে তিনি আর রাদ্দু আলাল মানতিকিয়্যিন নামক গ্রন্থ লেখে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

\r\n

তৃতীয় পর্যায়: দ্বীনী জ্ঞান বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবিতকরণের প্রয়াস:

\r\n

এ পর্যায়ে এসে উলামায়ে কেরাম গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিবর্তে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবীতকরণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এক্ষেত্রে পথিকৃত হলেন ইমাম আবু হামেদ গাযালী। এ লক্ষ্যে তিনি রচনা করেন ‘ইহইয়াউ উলুমিদ দ্বীন’ (দ্বীনি জ্ঞান সমূহের পুনরুজ্জীবীতকরণ)। অবশ্য কিছু রচনায় গ্রীক যুক্তিবিদ্যা তথা মানতিক থেকে তিনি একেবারে বের হয়ে আসেন নি। তবে তিনি তা ইসলামী ভাবধারায় গ্রহণ বর্জন করেছেন। এর প্রতিফলন ঘটে উসূলে ফিকহ তথা ইসলামী গবেষণা পদ্ধতির উপর লেখা তাঁর অমর গ্রন্থ ‘আল মুস্তাসফা ফী ইলমিল উসূল’ নামক গ্রন্থে। এর ভূমিকায় তিনি মানতিকী তথা যুক্তি বিদ্যার স্টাইলে ব্যাপক আলোচনা করেছেন।

\r\n

একই ধারায় শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া এ ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। বিশেষত তার রচিত কয়েকটি গ্রন্থে। তন্মধ্যে: আর রাদ্দু আলাল মানতিকিয়্যিন, ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম, কিতাবুল ঈমান, রাফউল মালাম আন আইয়্যিম্মাতিল আলাম, বিভিন্ন ফাতাওয়া ইত্যাদি গ্রন্থে। এ জন্যে জ্ঞান ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে ইবন তাইমিয়াকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়।

\r\n

 

\r\n

একইভাবে তাঁর শিষ্য ইবনুল কায়্যিমও ব্যাপক অবদান রাখেন। বিশেষত তাঁর রচিত মাদারিজুস সালিকীন, আস সাওয়াইকুল মুরসালা, কিতাবুর রুহ, ইলামুল মুওয়াক্কিয়িন, আত তুরুকুল হিকামিয়্যা ইত্যাদি গ্রন্থে। অপরদিকে স্পেনের বিভিন্ন মুসলিম শিক্ষায়তনে অধ্যয়ন করে তাদের প্রভাবে খ্রিস্টান স্কলাস্টিক বা ধর্মবিদরা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে সেন্ট টমাস একুইনাসের আমল থেকে গ্রীক দর্শনের আলোকে খ্রিস্টীয় মতবাদ সংস্কারের চেষ্টা করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জ্ঞানকে খ্রিস্টিয় ধারায় সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে কেউ কেউ একে খ্রিস্টায়নের সূচনা বলে আখ্যায়িত করেন।

\r\n

 

\r\n

চতুর্থ পর্যায়: ইজতিহাদে মন্দাভাব ও উম্মাহর পশ্চাতপদতা:

\r\n

থ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর পর থেকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে মাযহাবী চেতনার ব্যাপক প্রসারের কারণে কুরআন ও সুন্নাহের উপর সরাসরি ইজতিহাদের মাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। তখন সুফী, আশআরী ও যাহেরী ফকীহগণের মাধ্যমে ওহী জ্ঞান ও আকলের মাঝে দ্বন্ধ সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে মন্দাভাব দেখা যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের পর এ মন্দাভাবটির আরো প্রসার ঘটে।

\r\n

অপরদিকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে মুসলিম জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রভাবে আলোকিত যুগ শুরু হয়। সেখানে ধর্মীয় স্তর থেকে নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটলে নতুন নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। এগুলো মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার পর ইজতিহাদের দৈন্যতার কারণে মুসলিম স্কলারগণ এগুলোকে ইসলামের আলোকে মূল্যায়নে যথাযথ গুরুত্বারোপ করেননি। ফলে মুসলিম শাসকবর্গ এ সব দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপ থেকে আমদানী করতে শুরু করেন। বিশেষত তুরস্কের উসমানী খিলাফতের মাধ্যমে এগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটে।

\r\n

এভাবে মুসলমানগণ জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতৃত্ব হারায়। যদিও তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মতাত্ত্বিক ও বৈষয়িক বিষয়ের সমন্বয় ছিল, কিন্তু বৈষয়িকতায় পশ্চাতপদতার কারণে তা সমসাময়িক বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে যথাযথ সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেনি।

\r\n

-------------------

\r\n

৬. দ্র: ড. ত্বাহা জাবির আলওয়ানী, ইবন তাইমিয়া ওয়া ইসলামিয়্যাতুল মা’রিফা।

\r\n

৭. ঢাকাস্থ ইসলামী একাডেমী কর্তৃক আয়োজিত ডিসকের্সে ড. এমাজ উদ্দীন একে খ্রিস্টায়ন বলে আখ্যায়িত করেন। ( গ্রন্থনা: ইশারফ হোসেন)।

\r\n

 

\r\n

অবশ্য সে সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (১৭৬২ খ্রি.) ও হিজাযে শায়খ মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব নজদী ( মৃ. ১৭৮৭ খ্রি.) সংস্কারের চেষ্টা করেন এবং মুক্তভাবে ইজতিহাদ করার প্রয়াস চালান। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ: এর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের নির্যাস তুলে ধরে সমাজের জন্য তার কল্যাণকারিতা তুলে ধরে চেষ্টা করেন। এ পদক্ষেপটিকেও জ্ঞান ইসলামীকরণের প্রচেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম প্রশাসকগণ এ সব প্রচেষ্টা দ্বারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত হননি।

\r\n

 

\r\n

পঞ্চম পর্যায়: নব জাগরণ ও আধুনিকায়ন:

\r\n

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ও উনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম সমাজে আধুনিকায়নের জোয়ার বয়ে যায়। ইউরোপীয় রেনেসাঁয় ‘জ্ঞানবিপ্লব’ ঘটে। কিন্তু আধুনিকায়নের মানদণ্ড কি হবে। এ নিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও উলামার মাঝে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে কটি নিম্নরূপ:

\r\n

ক. সেকুলারায়নের প্রচেষ্টা:

\r\n

অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশেষত ইউরোপে চার্চের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় শাসক শ্রেণী ও বিজ্ঞানীদের যৌথ অবস্থান গ্রহণ করায় সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism) এর জন্ম নেয়। তখন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সমাজবিজ্ঞানীগণ ধর্মকে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করে লেখালেখি শুরু করে। ফলে রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ধর্মের প্রভাভমুক্ত করার প্রয়াস চলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদিতার প্রসারের সাথে সাথে এসব অঞ্চলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সয়লাব বয়ে যায়। তারা তাদের সুবিধার্থেই মুসলিম সমাজকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা আয়োজন করে। যে জন্য চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা চালায় এবং ইসলামী শিক্ষা সংস্কার ও আধুনিকায়নের নামে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানকে খাট ছাট করতে শুরু করে। বিশেষ করে বৃটিশ বেনিয়ারা ভারত এবং সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্স মিসর দখল করার পর এ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল।

\r\n

 

\r\n

খ. পাশ্চাত্যায়নের প্রচেষ্টা:

\r\n

‍ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বের কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবি ও নেতা মুসলিম সমাজকে পাশ্চাত্যের মডেলে পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন। তুরস্কের উসমানী খিলাফত বিশেষত সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ (১৮০৮-১৮৩৯ খ্রি.) পাশ্চাত্যের মডেলে সামরিক বিভাগ সংস্কার করতে যেয়ে প্রশাসনিক ও শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার আনার জন্য সভাসদীয় কিছু আলেমের সাথে পরামর্শ করেন। তারাও এ ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করে। ফলে তখন তুরস্কে পাশ্চাত্য ব্যবস্থা ব্যপকভাবে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে উসমানী খিলাফতের পতনের পর তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্য মুছে ফেলে ইউরোপের আদলে তুরস্ককে গড়ার জন্য সর্বোত চেষ্টা নিয়োজিত করে। এদিকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার যেসব অঞ্চল বৃটিশ, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালরা দখল করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে সে সব এলাকাতেও পাশ্চাত্যায়নের চেষ্টা চালায়। এ ক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়া ও কাজ করার জন্য ইউরোপ থেকে কিছু প্রাচ্যবিদ (Orientalist) বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসে। এমনকি সে অঞ্চলে দেশীয় মুসলিমও এগিয়ে আসে তাদের সহযোগিতায়। যেমন মিসরের ত্বহা হোসাইন, মুহাম্মদ সালামা প্রমূখ মিসরকে পাশ্চাত্যায়নের জন্য সামগ্রিক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিল।

\r\n

 

\r\n

গ. সমন্বয়ের প্রচেষ্ঠা

\r\n

মুসলিম চিন্তাধারা ও সমাজকে আধুনিকায়নের নামে পাশ্চাত্যায়ন প্রচেষ্টার পাশাপাশি আরেকদল মুসলিম বুদ্ধিজীবী পাশ্চাত্য দর্শন ও ব্যবস্থাপনার সাথে ইসলামের সমন্বয় সাধনেরও চেষ্টা করেছিলেন। তন্মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের স্যার সৈয়দ আহমদ (মৃ. ১৮৯৮), মিসরের আলী আবদুর রাজ্জাক, মুহাম্মদ আলী জাওহারী প্রমূখ এ ক্ষেত্রে কিছু কাজ করেন। কিন্তু এ কাজ করতে যেয়ে পাশ্চাত্যের চিন্তা চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে এর সাথে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে খাট ছাট করতে বা ব্যাখ্যা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি।

\r\n

 

\r\n

ঘ. প্যান ইসলামিযম আন্দোলন:

\r\n

পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন একত্রিত হয়ে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের মধ্যে বাটোয়ারা করে দখল করছিল, তখন বিশ্বের সমস্ত মুসলমানকে একই খলীফার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য প্যান ইসলামিযম (Pan -Islamism) বা বিশ্ব ইসলামীবাদ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। এ আন্দোলনের অগ্রনায়ক ছিলেন আফগানিস্তানের বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী সায়্যিদ জামাল উদ্দিন আফগানী (মৃত: ১৯৭০ খ্রি.) এছাড়া, তুরস্কের সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ ছিলেন এ আন্দোলনের একজন বড় সমর্থক। জামাল উদ্দীন আফগানী সারা বিশ্ব ঘুরে মুসলমানদেরকে সচেতন করতে থাকেন। তিনি মিসরে শায়খ মুহাম্মদ আবদুহু (মৃত ১৯০৫) ও সায়্যিদ রাশীদ রেদার মত কিছু শিষ্য পেয়ে যান। তাঁর নিজের ও শিষ্যদের বক্তব্য ছিল, পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ নয়। ইসলামী চিন্তা ধারা ও সমাজ সংস্কার করতে হবে। মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ কাজে তারা আল উরওয়াতুল উসকা নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর মাত্র সতেরটি সংখ্যার মাধ্যমে মুসলিম চিন্তা ধারা সংস্কারের ব্যাপক কর্মসূচী উপস্থাপন করা হয়। অত:পর সায়্যিদ রেদা প্রকাশিত আল মানার পত্রিকাটিও একই ভূমিকা পালন করে। এ জন্য জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে এ আন্দোলনটি একটি মাইলফলক। কিন্তু পরবর্তীতে সে খিলাফতের পতনের পর এ আন্দোলন তুরস্কে ম্লান হয়ে গেলেও এ আন্দোলনের ছোয়ায় মুসলিম উম্মাহর মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে। বরং ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হয়।

\r\n

 

\r\n

ঙ. ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ:

\r\n

প্যান ইসলামীবাদের প্রভাবে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে মুসলিম বিশ্বে এমনকিছু চিন্তাবিদের উদ্ভব হয়, যারা পাশ্চাত্য দর্শনের প্রাধান্যকে সমালোচনার সুম্মুখীন করেন। তারা পশ্চিমা বিশ্বের ভাল ভাল বিষয়গুলো গ্রহণ করা এবং যা ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তা বর্জন করার আহবান জানান। সাথে সাথে কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য ব্যাপক চিন্তাভাবনা ও গবেষণা চালান এবং মুসলিম সমাজ সংস্কার ও সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। এ ক্ষেত্রে মিসরের হাসানুল বান্না ও তার প্রতিষ্টিত ইখওয়ানুল মুসলিমীন ( প্রতিষ্ঠা ১৯২৮খ্রি.) এর সাথে জড়িত ও সমর্থনকারী আলেমগণের অবদান সবচেয়ে বেশী। তন্মধ্যে: শহীদ আবদুল কাদের আওদা, সায়্যিদ কুতুব, মুহাম্মদ কুতুব, মুহাম্মদ গাযালী প্রমূখের নাম উল্লেখ্য। এমনিভাবে তৎকালীন ভারতের আল্লামা শিবলী নোমানী, রেনেসার কবি ড. আল্লামা ইকবার (মৃত ১৯৩৮) ও মাওলানা আবুল আলা মওদুদী প্রমূখ এক্ষেত্রে অবদান রাখেন। মাও. মওদুদী তার তরজুমানুল কুরআন পত্রিকা ও অন্যান্য বই পুস্তকের মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। উপরে বর্ণিত সকল মুসলিম চিন্তাবিদ প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যেন, ইসলাম ও পশ্চিমা সভ্যতার মাঝে পার্থক্য আছে। তাই ঢালাওভাবে সবকিছু গ্রহণ করা যাবে না। কুরআন সুন্নাহর আলোকে আধুনিক যুগ প্রেক্ষাপটেও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তারা প্রচলিত অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও আইন ইত্যাদি ইসলামীকরণের জন্য প্রচুর লেখালেখি করেন এবং গ্রন্থাদি রচনা করেন।

\r\n

 

\r\n

৬ষ্ঠ পর্যায়: শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামায়ন:

\r\n

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুসলিম উম্মাহর প্রাজ্ঞ উলামা ও নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করতে শুরু করলেন যে, মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণের পথ শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামের আলোকে সংষ্কার ও আধুনিকায়ন। এর মাধ্যমেই মানব সমাজ ইসলামীকরণ করা সম্ভব। ১৯০৮ সালেই বঙ্গীয় অঞ্চলে মাও. আবু নসর ওহীদ সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার মাঝে সমন্বয়ধর্মী একটি পরিকল্পনা তৈরী করেন। এ জন্য তিনি মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, ভারতে মাওলানা শিবলী নোমানী সহ অনেক পণ্ডিতের সাথে মতবিনিময়। তৎকালীন বৃটিশ ভারতের ইংরেজ শাসক ও বুদ্ধিজীবিরা এতে উষ্মা প্রকাশ করলেও একে এ রিপোর্টকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় অঞ্চলে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। ইসলাম প্রচার ও বিশেষজ্ঞ তৈরীর জন্য ১৯১৫ সালে মাও: মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী কর্তৃক ‘আরবী বিশ্ববিদ্যালয়’ পরিকল্পনা এবং বৃটিশ সরকার কর্তৃক গঠিত মাওলাবক্স কমিটি (১৯৩৮) মাদরাসা শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে এ অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Islamic Learning)  প্রতিষ্ঠার রিপোর্ট তৈরী করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ বেনিয়া তা বাস্তবায়ন করেনি।

\r\n

ইতোমধ্যে ১৯৩০ সালে মিসরের আল আযহার ও মরক্কো ফাসের কায়রোয়ান বিশ্ববিদ্যালয় সংষ্কার ও উন্নয়ন করা হয়। তাতেও আধুনিক শিক্ষার বিভিন্ন শাখার আলোকে বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে সে সব শাখায় ইসলামী চিন্তা চেতনা প্রবিষ্ট করানোর প্রয়াস চলে।

\r\n

অপরদিকে ভারতে দেওবন্দ মাদরাসায় হাদীছ ও দরসের পাশাপাশি দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়নের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সমসাময়িক কালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের নদওয়াতুল উলামার শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী ও প্রচলিত অর্থে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে কারিকুলাম তৈরী করে তা পঠন পাঠনের ব্যবস্থা করা হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন মাও: সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী।

\r\n

অত:পর বঙ্গীয় অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন থেমে যায়নি। এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (১৯৬৩) প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়। এ কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. এস এম হোসাইন (তাঁর একটি গ্রন্থ আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যভুক্ত) এর নেতৃত্বে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত একটি স্কীম প্রণয়ন করে সরকারের নিকট পেশ করেন। সমকালীন মুসলিম বিশ্বের শিক্ষার ইতিহাসে বঙ্গীয় অঞ্চলের এ রিপোর্টটি শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামীকরণ আন্দোলনে একটি মাইলফলক। কিন্তু ততকালীন সরকার তাও বাস্তবায়ন করেনি। এটি বাস্তবায়ন করলে হয়তো ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রটি এ ক্ষেত্রে ততকালীন মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মডেল হতে পারতো।

\r\n

এভাবে বাংলাদেশরই আরেক কৃতি সন্তান প্রফেসর ড. সৈয়দ আলী আশরাফ বর্তমান সৌদি আরবের জেদ্দাস্থ কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে অধ্যাপক থাকাবস্থায় বাংলাদেশীয় শিক্ষা আন্দোলনকে গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ১৯৭৫ সালে গবেষণা ও পরিকল্পনা করেন। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অধ্যয়ন ও উলামার সাথে পর্যালোচনা করেন একটি শিক্ষাদর্শন সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেন এবং সে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থার উন্নতি করতে হলে সেই শিক্ষা দর্শনের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামীকরণ করতে হবে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ততকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আবদুল্লাহ উমর নাসীফ ও ততকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী শায়খ আহমদ সালাহ জামজুম, তথ্য মন্ত্রী ড. শায়খ আবদুহু ইয়ামেনী প্রমূখ এ পরিকল্পনা সমর্থন করে এতে সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তাদের সহযোগিতায় ড. সৈয়দ আলী আশরাফ গোটা মুসলিম বিশ্ব থেকে মুসলিম শিক্ষাবিদদের নিয়ে মক্কায় বিশ্বমুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে পবিত্র নগরী মক্কায় এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫০ জন মন্ত্রীসহ প্রায় ৪৫০ জন বুদ্ধিজীবী প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করে। গোটা মুসলিম বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামীকরণের পথে এ সম্মেলনটি ছিল একটি মাইল ফলক।

\r\n

এ সম্মেলনে সারা বিশ্বের মুসলিম চিন্তাবিদ এবং কয়েকজন অতিথি চিন্তাবিদ একত্রিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পৃথক পৃথক সেশনে জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে ৭দিন ব্যাপী আলোচনা শেষে তারা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার উপর জোর দেন। এবং প্রথমে কুরআনিক জ্ঞান তত্ত্বেরও আলোকে জ্ঞানের শ্রেণি বিভাগ ও শিক্ষার সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন। তারা ঐক্যমত্যে পৌঁছেন যে, শিক্ষা মানে শুধু জ্ঞান চর্চা নয়, বরং শিক্ষার মর্মমূলে বিশ্বাস, ধর্ম থাকতে হবে। অর্থাত ইসলামী জীবনাদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। মুসলিম সমাজ ও বিভিন্ন মুসলিম দেশে মুসলমানদের মধ্যে দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রচলিত ধর্মীয় শিক্ষা বা মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণা, আলাপ আলোচনা এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের সাথে আধুনিক শিক্ষিতদের সম্পর্ক সৃষ্টি ও সমন্বয়।

\r\n

সম্মেলনের সুপারিশ সমূহ কার্যকর করার জন্য একটি ফলোআপ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে শায়খ আহমদ সালাহ জামজুম এবং সেক্রেটারী হিসেবে ড. সৈয়দ আলী আশরাফ মরহুমকে নির্বাচিত করা হয়।

\r\n

একই বৎসর ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) উদ্যোগে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সৌদি আরবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড সেন্টার ফর ইসলামিক এডুকেশন’। এর পরিচালক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন ড. সৈয়দ আলী আশরাফ।

\r\n

এ সম্মেলনেরই ধারাবাহিকতায় আরো পাঁচটি আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ নিয়ে সর্বমোট ৬টি সম্মেলন। এগুলোর আলোচ্য বিষয়সহ কিছু তথ্যাদি নিম্নরূপ:

\r\n

 

\r\n

 

\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n\r\n

ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন বিষয় সাল স্থান দেশ
প্রথম ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি ১৯৭৭ মক্কা সৌদিআরব
দ্বিতীয় শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন ১৯৮০ ইসলামাবাদ পাকিস্তান
তৃতীয় পাঠ্যপুস্তক রচনা ১৯৮১ ঢাকা বাংলাদেশ
চতুর্থ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ১৯৮২ জাকার্তা ইন্দোনেশিয়া
পঞ্চম পূর্ববর্তী সম্মেলন সমূহের মূল্যায়ন ১৯৮৭ কায়রো মিসর
ষষ্ঠ ইসলামী শিক্ষার কর্মশালা বিশেষত স্কুল প্রতিষ্ঠার কৌশল ও কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন ইত্যাদি ১৯৯৬ কেপটাউন দক্ষিণ আফ্রিকা

\r\n

 সপ্তম পর্যায়: জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলন

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণ’ প্রত্যয়টি প্রথম ব্যবহার করেন মালয়েশিয়ান ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ড. সায়্যিদ মুহাম্মদ নকীব আল্ আত্তাস। তিনি ১৯৬৭ সালে পাশ্চাত্যায়নের বিকল্প হিসেবে ইসলামায়ন (Islamization) শব্দটি একটি প্রবন্ধে ব্যবহার করেন একটি অঞ্চলকে ইসলামীকরণ কার্যক্রম প্রসঙ্গে আলোচনায়। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল:  Priliminary statement on a general theory of the Islamization of the Malay-Indonesian Archipelago  এটি ১৯৬৯ সালে কুয়ালালামপুরথেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালে তিনি আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর থাকাবস্থায় Secular-Secularization-Secularism শিরোনামে প্রবন্ধে Islamization of knowledge এবং The Dewestemization of knowledge  প্রত্যয় ব্যবহার করেন।

\r\n

১৯৭৭ সালে মক্কায় শিক্ষা সম্মেলনে ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী উপস্থিত ছিলেন। তিনি সম্মেলনের বক্তব্যে মতামত ব্যক্ত করে বলেন, শিক্ষা তথা জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের মূলে যে জ্ঞান তা ইসলামীকরণ করতে হবে। এ জন্য মুসলিম উম্মাহর চিন্তা জগতে ও পদ্ধতিতে সংস্কার আনতে হবে। জ্ঞানের ভিত্তি মূলে ইসলামী ধ্যান ধারণা কিভাবে প্রাচীনকালে মুসলিম চিন্তাবিদরা বিভিন্ন জ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন, তার সঙ্গে আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য জ্ঞানীরা ধর্মকে বাদ দিয়ে যেসব ধারণার বশবর্তী হয়ে নানাবিধ জ্ঞান চর্চা করেছেন, এই ধ্যান ধারণাগুলোর তুলনা করে পাশ্চাত্য সেকুলার ধ্যান ধারণাকে ইসলামীকরণের প্রস্তাব করেন। ফলে একই বতসরে ইউরোপে কিছু মুসলিম স্কলারদের উদ্যোগে সুইজারল্যান্ডে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেন। সেখানে মুসলিম উম্মাহর মানস সংকট সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এ দুটি সম্মেলনের যৌথ চিন্তার আলোকে মনে করেন, উম্মাহর মানস সংকট উত্তরণের জন্য জ্ঞান ইসলামীকরণই বেশি জরুরী। ফলে তিনি জ্ঞান ইসলামীকরণের উপর আশির দশকের শুরুতে একটি গ্রন্থই রচনা করেন ( ১৯৮২ সালে প্রকাশিত)। ইতোমধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপে প্রবাসী কয়েখজন আরব মুসলিম স্কলারের সহায়তায় মুসলিম উম্মাহর চিন্তা ও মননের সংস্কার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে উত্তর আমেরিকায় তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জেনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট, International Institute of Islamic Thout সংক্ষেপে IIIT. এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নিয়োগ লাভ করেন ড. ইসমাঈল আল রাজী ফারুকী। এ প্রতিষ্ঠান এবং পাকিস্তান হিজরী নতুন শতাব্দী উদযাপন কমিটির যৌথ উদ্যোগে পরবর্তী বছরে অর্থাত ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের ইসলামাদে ‘জ্ঞান ইসলামীকরণ’ বিষয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তখন থেকেই ড. সৈয়দ আলী আশরাফের নেতৃত্বে মক্কাভিত্তিক ‘শিক্ষা ইসলামীকরণ আন্দোলন’ এবং ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর নেতৃত্বে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট, International Institute of Islamic Thout সংক্ষেপে IIIT আমেরিকা ভিত্তিক ‘জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলন’ হিসেবে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। যদিও উভয়ের লক্ষ্য মুসলিম উম্মাহর শিক্ষা ও জ্ঞানগত উন্নয়ন। তবুও উভয়ের মাঝে পদ্ধতিগত ও পরিধিগত পার্থক্য ফুটে উঠে। ড. সৈয়দ আলী আশরাফের পদ্ধতি হলো মানব প্রকৃতি ও জ্ঞান আহরণ সম্পর্কিত ইসলামী ধ্যানধারণার আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা। এটি অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক। অপরদিকে ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর নেতৃত্বে স্কলার গণের পদ্ধতি হলো উম্মাহর চিন্তাধারা ও জ্ঞান তত্ত্বের সংস্কার। অত:পর এর আলোকে সামাজিক বিজ্ঞান সমূহের ইসলামীকরণের উপর গুরুত্বারোপ করা। এ জন্য ট্রিপল আইটি থেকে American Journal of Islamic Social Science নামে একটি জার্নাল প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ সংস্থার সাথে যোগ দিয়েছে আমেরিকা ইউরোপভিত্তিক ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এসোসিয়েশন অব মুসলিম সোসিয়েল সাইন্টিস্ট (Association of Muslim Social Scientists)।

\r\n

তাছাড়া, তারা মনে করেন, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে নয়, সামাজিকভাবেও জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। এ দিক দিয়ে এর পরিধি আরো ব্যাপক। উপরোক্ত দু ব্যক্তির ধারা অনুসারে দু ধরণের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। যেমন: ড. আলী আশরাফ মরহুম মানুষের আধ্যাত্মিক দিকটি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন, অপরদিকে ড. রাজী ও তার অনুসারীগণ সামাজিক বিজ্ঞানের উপর তথা মানব সমাজের বহিস্থ দিকের উপর প্রাধান্য দিচ্ছিলেন।

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণে সে সময়ে ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর সাথে মুসলিম সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে আরো যারা কাজ করছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, তৎকালীন রিয়াদস্থ মুহাম্মদ ইবন সাউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল হামিদ আবু সোলায়মান এবং ড. ত্বহা জাবির আলওয়ানী প্রমূখ। তারা উভয়ে বর্তমানের ট্রিফল আইটির দায়িত্বশীল। ড. আবু সোলায়মান ১৯৮৪ সালে মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর নিয়োগ লাভ করলে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি সহযোগি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়। যে জন্য ১৯৮৪ সালে ও ২০০০ সালে সে বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রিফল আইটির যৌথ উদ্যোগে জ্ঞান ইসলামীকরণের উপর দুটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে ট্রিফল আইটির উদ্যোগে আরে কটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। যেমন: ১৯৮৭ সালে খার্তুমে সম্মেলন। এসব সম্মেলনে শতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপিত ও আলোচিত হয়। এভাবে ট্রিফল আইটি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় শাখা প্রতিষ্ঠা করে। তন্মধ্যে: সৌদিআরব, বাংলাদেশ, সুদান, মিসর, নাইজেরিয়া, ব্রুনাই ইত্যাদি মুসলিম দেশের রাজধানী শহরে শাখা আছে। এমনিভাবে মালয়েশিয়াতে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট এণ্ড সিভিলাইজেশন ( International Institute of Islamic Thought And Civilization)। নামে কিছু পার্থক্য থাকলেও সারা বিশ্বব্যাপী এসব প্রতিষ্ঠান জ্ঞান ইসলামীকরণের উপর গবেষণা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রকাশনা ইত্যাদির মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে।

\r\n

অষ্টম পর্যায়: জ্ঞান ও শিক্ষা ইসলামীকরণের মাঝে সমন্বয়:

\r\n

জানা যায়, জীবনের শেষ সময়ে এসে বিশেষত ১৯৮৭ সালের দিকে ড. সৈয়দ আলী আশরাফ ও ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী উভয়ে একমত হন যে, পৃথকভাবে নয়, বরং জ্ঞান ও শিক্ষা উভয়টি ইসলামীকরণ করা প্রয়োজন। এটিই সর্বশেষ পর্যায়। ড. উমর নাসীফ এক সাক্ষাতকারেও ড. সৈয়দ আলী আশরাফের সর্বশেষ মত হিসেবে জ্ঞান ও শিক্ষার ইসলামীকরণ কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করেন। এমনকি এ পর্যায়ে তাকে পথিকৃত হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রকৃতপক্ষে উভয়টির মাঝে কোন দ্বন্ধ নেই। কারণ জ্ঞান হলো লক্ষ্য, আর শিক্ষা হলো জ্ঞান আহরণের উপায়। অন্যভাবে বলতে গেলে শিক্ষাকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বলাও বাস্তবভিত্তিক নয়। কারণ সামাজিক শিক্ষা ও গণমাধ্যমেরর মাধ্যমেও শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। সুতরাং উভয়টির সমন্বিত ইসলামীকরণ কার্যক্রমই অধিক কার্যকর এবং যথার্থ।

\r\n

 

\r\n

 

\r\n\r\n

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণের পদ্ধতি

\r\n

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর মতে জ্ঞানের ইসলামীকরণের পদ্ধতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা:১০

\r\n

ক. মুসলিম উম্মাহর চিরাচরিত পদ্ধতি (Traditional Methodology)

\r\n

খ. কাঙ্খিত ইসলামিক পদ্ধতি ( Islmic Methodology)

\r\n

মুসলিম উম্মাহর চিরাচরিত পদ্ধতি:

\r\n

জ্ঞানের ইসলামীকরণের চিরাচরিত পদ্ধতিটি ত্রুটিযুক্ত। ষষ্ঠ ও সপ্তম হিজরী শতাব্দিতে অমুসলিমরা উম্মাহর উপর গুরুতর আঘাত হানার ফলে মুসলিম নেতারা তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। প্রাচ্য থেকে উম্মাহর উপর হামলা চালায় এবং পাশ্চাত্য থেকে খৃস্টান ক্রুসেডরা। মুসলমানরা তাদের ধ্বংসোমুখ অবস্থা দেখে অতিরিক্ত রক্ষণশীল হয়ে পড়ে এবং তাদের পরিচয়ের স্বাক্ষর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ইসলামকে রক্ষার জন্য যে কোন পরিবর্তনের চিন্তা পরিহার করে এবং অক্ষরে অক্ষরে শরীয়াতের নির্দেশ মেনে চলার প্রতি অটল থাকে। এরপর তারা আইনের সৃজনশীলতার প্রধান উতস অর্থাত ইজতিহাদকে পরিত্যাগ করে তারা ইজতিহাদের দরজা বন্ধ বলে ঘোষণা করে। তাদের অভিমত হলো পূর্ব পুরুষদের কাজের মধ্য দিয়েই শরীয়াতের কাজ শেষ হয়ে গেছে। শরীয়াত থেকে নতুন প্রথা প্রবর্তন করাকে শরীয়াতের খেলাফ বলে ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন মাযহাবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী শরীয়া একটা গতিহীন সত্তায় পরিণত হলো। বলা হলো, শরীয়াতের কাজ হবে ইসলামকে টিকিয়া রাখা। ইসলাম টিকে থাকলো, এমনকি ৮ম থেকে দ্বাদশ শতাব্দিতে রুশ, বলকান অঞ্চল মধ্য ও দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত মুসলিম বিজয় ও সম্প্রসারণ সত্ত্বেও রক্ষণশীল প্রথা ও ব্যবস্থা খতম হয়নি। মুসলমানরা ব্যাপকভাবে তাসাউফ ও তার তরিকাগুলো গ্রহণ করার ফলে সৃজনশীলতার উতস হিসাবে ইজতিহাদের অভাবে সৃষ্ট অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। সুতরাং আধুনিককাল পর্যন্ত শরীয়া স্থবির হয়ে যায়। ফলে আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরী জ্ঞান পাশ্চাত্যকে মুসলমানদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা দান করে এবং তাদেরকে পরাভূত করে।

\r\n\r\n

  1. \r\n
  2. ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী, জ্ঞান: ইসলামী রূপায়ন, বঙ্গানু. মুহা. সানাউল্লাহ আখুঞ্জী. পৃ. ৩৫-৫৭।
  3. \r\n

\r\n

 

\r\n

ক. ফিকহ ও ফকীহ ইজতিহাদ ও মুজতাহিদু

\r\n

ফিকহ শব্দের অর্থ হচ্ছে পাণ্ডিত্য বা শরীয়াতের জ্ঞান। ফকীহ হচ্ছে, এই জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ। সাধারণ ফিকহ বলতে বুঝায় ইসলামের সকল মাযহাবে শরীয়াতের জ্ঞান। প্রাথমিক যুগের প্রকৃতপক্ষে এক-একজন এনসাইক্লোপেডিয়া ছিলেন। আজকের ফকীহদের জ্ঞান বা প্রজ্ঞা কোন অবস্থাতেই সেই মানের নয়। বর্তমান তাকলীদ পন্থী মুজতাহিদরা মাযহাবের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। এই চৌহদ্দির বাইরে তারা তাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে অক্ষম। এখন পরিস্থিতির দাবী হচ্ছে উসূল অর্থাত ইসলামী জ্ঞানের উতস অনুধাবনের জন্য একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা।

\r\n

 

\r\n

খ. ওহী ও আকলের পরস্পর বিচ্ছিন্নতা:

\r\n

কোন কোন মুসলমানের উপর গ্রীক যুক্তিবিদ্যার প্রভাবের দরুণ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারা ইসলামের সত্য রূপের প্রতি অমুসলমানদের আকৃষ্ট করার জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।

\r\n

 

\r\n

গ. কর্ম থেকে চিন্তার বিচ্ছিন্নকরণ:

\r\n

ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের নেতারা ছিলেন চিন্তাবিদ এবং চিন্তাবিদরাই ছিলেন নেতা। পরবর্তীতে শাসকরা বিদ্বান ব্যক্তিদের পরামর্শ ছাড়াই শাসনকার্য চালাতে থাকেন। চিন্তার দৈন্য তাদেরকে নানাবিধ সংকটের আবর্তে নিক্ষেপ করে। শাসক ও শাসিতের মধ্যে দুরত্বের সৃষ্টি হয়। মুসলিম চিন্তাবিদরা তাসাউফ চর্চা করে নিজেদের সমাজ সংসার থেকে দূরে রাখতে থাকে। প্রাথমিক যুগে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক বিষয়ের মধ্যে যে ভারসাম্য ছিল তা নষ্ট হয়ে যায়।

\r\n

 

\r\n

ঘ. সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দ্বৈততা:

\r\n

ইসলামের প্রাথমিক যুগে সিরাতুল মুস্তাকীমের বৈশিষ্ট্য ছিল মুসলমানদের চিন্তা ও কর্মের জগতকে একটি অভিন্ন কাঠামোর সুসংহত করা। কিন্তু অবসয়ের যুগে এই সংহতরূপ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়-পার্থিব জগত ও পুন্যের জগত। পুন্যের জগতে সুফী চর্চার মাধ্যমে এমনসব ধ্যান ধারণার জন্ম দেয় যা খোদ ইসলামের পরিপন্থী। পক্ষান্তরে বৈষয়িক জগত একটা নৈতিকতাহীন ব্যবসা হিসেবে গড়ে উঠে। এক সময় উপনিবেশ শক্তি নিজস্ব শিক্ষা ও সংস্কৃতি চালু করে। তখন মুসলমানরা স্রেফ নিন্দা করার মধ্য দিয়েই এর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছিল। সামগ্রিক জেহাদ ঘোষণার ক্ষমতা তাদের ছিল না।

\r\n

 

\r\n

কাঙ্খিত ইসলামী পদ্ধতি:

\r\n

ইসলামী চেতনার আলোকে জ্ঞানের ইসলামীকরণ করতে চাইলে কতিপয় নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার তত্ব ও পদ্ধতি, নীতিমালা ও লক্ষ্য নির্ধারণ করা। এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত মৌলিক বিষয় বিবেচনা করতে হবে।

\r\n

১. আল্লাহর একত্ব

\r\n

ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের প্রথম নীতি হচ্ছে আল্লাহ পাকের একত্ব বা তাওহীদ। আল্লাহ তায়ালাই সকল ক্রিয়ার তাতক্ষণিক চরম কারণ ও উদ্দেশ্য। এর বাইরে সকল কল্পনা, জ্ঞান অথবা মূল্যায়ন অস্তিত্বহীন, মিথ্যা, মূল্যহীন ও বিকৃত।

\r\n

২. সৃষ্টির ঐক্য

\r\n

ক. মহা জাগতিক শৃঙ্খলা:

\r\n

বস্তুত মহাজগতে সংগতিপূর্ণ শৃঙ্খলা বিরাজমান বলেই আমরা পদার্থের অস্তিত্ব এবং ঘটনা প্রবাহের আবর্তনের কার্যকরণ সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। মহাজাগতিক শৃঙ্খলা ছাড়া কার্যকরণ ও কর্মফলের প্রশ্ন উঠতো না।

\r\n

 

\r\n

খ. সৃষ্টি জগত

\r\n

আল্লাহ পাক সবকিছু সুনির্দিষ্ট পরিমাপ সহ সৃষ্টি করেছেন। জগতের সব সত্তা চূড়ান্ত ভাবে বা উপায় ও লক্ষ্য হিসাবে পারস্পরিক কার্যকরণসূত্র আবদ্ধ। মুসলমানরা সৃষ্টিকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসাবেই জানে এবং এর প্রতিটি অংশ প্রকট বা প্রচ্ছন্নভাবে কোন না কোন ভাবে কোন উদ্দেশ্য সাধন করে চলছে-যা সবটা মানুষের জানার বিষয় নয়। কিন্তু এই জ্ঞান তাদের ঈমানেরই ফলশ্রুতি।

\r\n

 

\r\n

গ. তাসখীর ( সৃষ্টি মানুষের জন্য)

\r\n

আল্লাহ তাআলা গোটা জগতকে মানুষের জন্য একটি অস্থায়ী উপঢৌকন ও কর্মশালা হিসাব প্রদান করেছেন। সকল বস্তুকে মানুষের অধীন করে দিয়েছেন।

\r\n

 

\r\n

৩. সত্য ও জ্ঞানের ঐক্য:

\r\n

ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞান তত্ত্বের প্রকৃত রূপ সত্যের ঐক্যের মধ্যেই নিহিত। এই ঐক্য মহান আল্লাহর একত্বের ধারণা থেকেই উতসারিত। আল্লাহ পাকের অপর নাম হচ্ছে আল হাক্ব বা সত্য।

\r\n

প্রথমত: সত্যের ঐক্য এই নির্দেশ করে যে, বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ নয় এমন কোন বিষয়কে ওহীর আলোকে ব্যাখ্যা দেয়া চলবে না।

\r\n

দ্বিতীয়ত: সত্যের ঐক্যে সূত্র অর্থাত স্রস্টার সৃষ্টিরীতির সাথে প্রাকৃতির বিধানের সুসংগতি এই শিক্ষাই দেয় যে সৃষ্টির ধারা বা এর কোন অংশ সম্পর্কে কোন সমীক্ষা শেষ ও চূড়ান্ত নয়।

\r\n

যে যত বড় জ্ঞানীই হোক না কেন তার প্রায় নিশ্চিত সিদ্ধান্তের পরেও তাকে সব সময় এ কথা অবশ্যই বলতে হবে যে প্রকৃত সত্য আল্লাহই ভাল জানেন।

\r\n

 

\r\n

৪. জীবনের ঐক্য

\r\n

ক. ঐশী আমানত

\r\n

আল্লাহপাক দেয়া আমানত একমাত্র মানুষই বহন করেছে। আর আল্লাহ পাক জীন- মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁরই ইবাদতের ( একমাত্র আল্লাহর) জন্য। ফেরেশতাদের আল্লাহ পাক মানুষের সামনে সেজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মানুষের মর্যাদা অতি উচ্চে। মানুষ ইচ্ছে করলেই ভাল মন্দ কাজ করতে পারে। মানুষই নৈতিকতার দাবী অনুযায়ী সকল পাপাচার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পারে বলেই উন্নততর মূল্যবোধের গুরুত্ব উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়। মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত আমানতের মর্যাদা রাখতে হবে।

\r\n

খ. খলিফা:

\r\n

মানুষের ঐ আমানত বহনের দায়িত্ব নিয়েছে বলেই সে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষের পরিচয় সে আল্লাহর দাস ও আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষ যে আল্লাহর খলিফা এ কথা স্মরণ রাখতে হবে।

\r\n

গ. ব্যাপকতা:

\r\n

মানব জীবনের প্রতিটি দিক ইসলামের সাথে সাযুজপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই ব্যাপক। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের সাযুজ্যের সংজ্ঞা ও প্রায়োগিকতা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব মুসলিম চিন্তাবিদদের উপর অর্পিত হয়ে আছে।

\r\n

 

\r\n

৫. মানবতার ঐক্য:

\r\n

আল্লাহ পাকের বাণী- হে মানব মণ্ডলী আমি তোমাদেরকে এক জোড়া পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পার।( ৪৯: ১৩) সকল মানুষের কল্যাণের বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। ইসলামী পদ্ধতির মাধ্যমে জ্ঞানের ইসলামীকরণের কাজ চালাতে হবে।

\r\n

\r\n\r\n

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। নিম্নে কয়েক জনের মতামত উল্লেখ করা হলো:-

\r\n

 

\r\n

*ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর মতামত:

\r\n

আধুনিক বিশ্বে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনের অগ্রপথিক হলেন ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী। তার মতে আধুনিক জ্ঞানের ইসলামীকরণ একটি মহান পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে, যদি সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের অংশ হিসাবে মুসলিম বিশ্বে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বাধ্যতামূলক কোর্স হিসেবে চালু করা হয়।

\r\n

জ্ঞানের ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি যেসব মতামত দিয়েছেন, তা অতি সংক্ষেপে নিম্নরূপ-

\r\n

প্রথম ধাপ: আধুনিক জ্ঞান আয়ত্তে আনা ও শ্রেণিবিন্যাসকরণ:

\r\n

পশ্চিমা আধুনিক জ্ঞানের শাখাগুলোকে অবশ্যই শ্রেণি, নীতি, পদ্ধতি, সমস্যা ও বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিন্যস্ত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সূচীপত্রের তালিকা বা কোর্সের সিলেবাসের আলোকেই এই বিন্যাস করতে হবে।

\r\n

 

\r\n

দ্বিতীয় ধাপ: জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জরিপ:

\r\n

জ্ঞানের প্রতিটি শাখার উপর জরিপ চালাতে হবে এবং এ সম্পর্কিত নিবন্ধে এর উতপত্তি ও ঐতিহাসিক বিকাশ, বিকাশের পদ্ধতি, দৃষ্টিপাতের ব্যাপকতা এবং এর পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের অবদানের উপর আলোকপাত করতে হবে। এ ধাপের উদ্দেশ্য হলো পাশ্চাত্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে উতকর্ষ সাধিত হয়েছে মুসলমানদেরকে সে সম্পর্কে অনুধাবন করতে সাহায্য করা।

\r\n

 

\r\n

তৃতীয় ধাপ: ইসলামী জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জন ও আয়ত্তে আনা:

\r\n

জ্ঞানের সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সাথে ইসলামের বিস্তৃত সামুজ্য অন্বেষণের আগেই ঐ বিষয় সম্পর্কে ইসলামী জ্ঞান কী বলতে চায় তা উদঘাটন করা আবশ্যক। এই ৩য় ধাপের আধুনিক জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাথে সম্পর্কযুক্ত ইসলামী জ্ঞান অধ্যয়নের জন্য এর কয়েক খণ্ড সংকলন প্রণয়ন করতে হবে।

\r\n

চতুর্থ ধাপ:

\r\n

অতীতের মনীষীরা তাদের সমকালীন সমস্যার প্রেক্ষিতে ইসলামী জ্ঞান অধ্যয়ন করেছেন। তাদের গবেষণাকর্ম সে সময়ের ঐতিহাসিক পটভূমিতে বিশ্লেষণ এবং জীবন ও চিন্তার অন্যান্য বিভাগের সাথে সমসাময়িক সমস্যার সম্পর্ক চিহ্নিত করে তুলতে হবে। ইসলামী জ্ঞানের অবদানের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের ফলে নি:সন্দেহে ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপর ব্যাপক আলোকপাত হবে। ইসলামী জ্ঞানের বিশ্লেষণ বিক্ষিপ্তভাবে করলে চলবে না। ইসলামী চিন্তাবিদদেরকে এর একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করে ক্রমবিন্যাস করতে হবে।সর্বোপরি প্রধান নীতিসমূহ, প্রধান সমস্যাদি এবং বর্তমান সমস্যার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলো ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা কৌশলের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

\r\n

 

\r\n

পঞ্চম ধাপ: বর্তমান জ্ঞান শাখাগুলোর সাথে ইসলামের সুনির্দিষ্ট সাযুজ্য স্থাপন:

\r\n

উপরি উল্লিখিত ৪টি ধাপ ইসলামী চিন্তাবিদদের সামনে সমস্যার রূপরেখা তুলে ধরেছেন। এখন জ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ের সাথে ইসলামী জ্ঞানের সুনির্দিষ্ট প্রাসঙ্গিকতা উভয়ের অভিন্ন অবদানের আলোকে নির্ণয় করতে হবে। প্রথমত: আধুনিক জ্ঞানের সংশ্লিষ্ট শাখা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে সে ব্যাপারে ইসলামী জ্ঞান কুরআন নাজিল হওয়া থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কী অবদান রেখেছে। দ্বিতীয়ত: জ্ঞানের ঐ বিষয়ের সাথে ইসলামের অবদান কতটুকু সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য পূর্ণ? ইসলামী জ্ঞান আধুনিক জ্ঞানের কোন কোন ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ, অপূর্ণ বা প্রেক্ষিত ও পরিধি অতিক্রম করে গেছে। তৃতীয়ত: আধুনিক জ্ঞানের যেসব শাখায় ইসলামী জ্ঞানের অবদান সামান্য বা শূন্য। সেক্ষেত্রে মুসলমানরা ঐ ঘাটতিপূরণ, সমস্যা নির্ণয় ও প্রেক্ষিত প্রসারিত করার লক্ষ্যে কোন পন্থায় অগ্রসর হবে?

\r\n

ষষ্ঠ ধাপ: আধুনিক জ্ঞানের বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা:

\r\n

এ পর্যায়ে আধুনিক জ্ঞানকে ইসলামের দৃষ্টিতে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। জ্ঞানের ইসলামীকরণের লক্ষ্যে এটি একটি প্রধান পদক্ষেপের মর্যাদা রাখে।

\r\n

সপ্তম ধাপ: ইসলামী জ্ঞানের উৎস পর্যালোচনা: উৎকর্ষ

\r\n

আধুনিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যার প্রেক্ষিতে ঐশী বাণী উপলদ্ধি সাযুজ্য ৩টি ক্ষেত্রে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। প্রথমত: সরাসরি ওহীর সূত্র এবং ইতিহাসে প্রাপ্ত রাসূল সা: (অর্থাত কুরআন ও হাদীস), তাঁর সাহাবী রা: এবং তাদের উত্তরসূরীদের সুষ্পষ্ট দৃষ্টান্তের আলোকে ইসলামী দর্শন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বব্যাপী উম্মাহর বর্তমান চাহিদা এবং তৃতীয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাবতীয় আধুনিক জ্ঞান। মানব জীবনের ইসলামী জ্ঞানের অবদান মূল্যায়নের এই গুরুদায়িত্ব অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের উপরেই ন্যস্ত হওয়া আবশ্যক। তাদেরকে একই সাথে মুসলমানদের চাহিদা এবং আধুনিক জ্ঞানে অভিজ্ঞ হতে হবে। ইসলামী জ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যথাসম্ভব পর্যাপ্ত ও সঠিক উপলদ্ধি অর্জনে তাদেরকে সাহায্য করবেন।

\r\n

 

\r\n

অষ্টম ধাপ: উম্মাহর প্রধান সমস্যাবলী জরিপ করা:

\r\n

উম্মাহর সমস্যাদির সামগ্রিক কারণ, লক্ষণ, অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সাথে সংঘাত এবং পরিণাম সম্পর্কে বাস্তব ও পুংখানুপুংখ পর্যালোচনা তথা জরিপ করা আবশ্যক।

\r\n

নবম ধাপ: মানব জাতির সমস্যা জরিপ:

\r\n

ইসলামী চিন্তাবিদদের দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামের আলোকে আজকের বিশ্বের সমস্যা সমাধানে ব্রতী হওয়া সমগ্র মানবজাতির সমস্যা জরিপ করতে হবে। কেননা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের দায়িত্ব ইসলামী দর্শনের উপর ন্যস্ত।

\r\n

দশম ধাপ: সৃজনশীল বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ:

\r\n

মানবজীবনের প্রত্যেক বিভাগের ইসলাম সম্মত রূপ কি এবং কিভাবে উভয় জ্ঞানের সমন্বিত কাঠামোকে উম্মাহ ও মানবজাতির কল্যাণে এগিয়ে নেয়া হবে? একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা সমস্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিশেষ প্রকৃতির প্রেক্ষিতে মুসলমানদের জন্য কোন পন্থা বেছে নেয়া বৈধ? এটা নিশ্চিত যে, প্রত্যেক বিষয়েই বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনের সুযোগ রয়েছে যা ইসলামী আদর্শের নিকটবর্তী বা দূরবর্তী হতে পারে, হতে পারে কম বা বেশি কার্যকর কিংবা যা ইসলামী লক্ষ্য অর্জন ত্বরান্বিত বা বাধাগ্রস্থ করতে পারে। এর মধ্যে কোন পথটি সম্ভব, প্রয়োজনীয়, অপরিহার্য, বাঞ্ছনীয় বা বৈধ? সংশ্লিষ্ট সমস্যার সাথে ইসলামের কার্যকারিতা পরিমাপ করা হবে? সৃজনশীল সমন্বিত তত্ত্বের অবদান প্রকাশ, পরীক্ষা ও মূল্যায়নের নীতিই বা কি হবে? কোন নীতির আলোকে এতে সংশোধন ও পরিবর্তন আনা হবে এবং এগুলোর অগ্রগতি ও ফলপ্রসূতা পর্যবেক্ষণ-মূল্যায়ন করা হবে? সমস্যা সমাধান প্রচেষ্টায় উপরি উল্লিখিত প্রশ্নগুলো গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে।

\r\n

একাদশ ধাপ: ইসলামী কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন বিষয়ের পুনর্বিন্যাস ও পাঠ্যপুস্তক রচনা:

\r\n

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক নতুন নতুন ধ্যান ধারণার আলোকেই লিখে যেতে হবে শুধু তা নয়, বরং বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে ব্যক্তি বিশেষের রচনাবলী ব্যাপকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ইসলামী জ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট আধুনিক জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা ও সামঞ্জস্য বিধান করা যায়। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যপুস্তক রচনা জ্ঞানের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত ধাপ। এ কাজটিই পূর্বোল্লিখিত সকল ধাপের প্রক্রিয়ার সাফল্যের মুকুট পরিয়ে দেয়।

\r\n

দ্বাদশ ধাপ: ইসলামী জ্ঞানের প্রসার:

\r\n

রচিত পুস্তকাদি উদ্দেশ্য যেন একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের জন্য না হয়। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দ্বীনের জন্য প্রণীত রচনাবলী কাগজ, কালি ও ছাপা বাঁধাইয়ের খরচ যে যোগাতে পারবে সেই তা প্রকাশের অধিকার রাখবে। দ্বিতীয়ত: এসব পুস্তক রচনার উদ্দেশ্য থাকবে সমগ্র মানবজাতির জন্য। তৃতীয়ত: এই কর্ম পরিকল্পনার আওতায় রচিত বইপত্র মুসলিম বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানাতে হবে। স্বভাবত সেগুলো বিভিন্ন দেশের স্ব-স্ব ভাষায় অনুবাদও করতে হবে।

\r\n

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী জ্ঞানের ইসলামী রূপায়নে এছাড়াও সহায়ক উপায় হিসেবে নিম্নোক্ত কাজগুলোর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন-

\r\n

১. সম্মেলন ও সেমিনার করতে।

\r\n

২. ফ্যাকাল্টি প্রশিক্ষণের জন্য শ্রেণি কর্মশালার আয়োজন করা উচিত। তিনি জ্ঞানের ইসলামীকরণের বাস্তবায়ন সম্পর্কে আরো বলেন-

\r\n

ক) এ ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের জন্য সম্মানী নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

\r\n

খ) শিক্ষা সংক্রান্ত বইপত্র প্রণয়নের জন্য কেবল যোগ্যতম ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের যাতে নিয়োগ করা হয় সেদিকে সর্বতোভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।

\r\n

৩. বইপত্র প্রণয়নের কাজটি বৃহদাকার হলে তা ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন বিদ্বানকে দেয়া উচিত যাতে নির্দিষ্ট সময়ে কাজটি শেষ হয়।

\r\n

৪. জ্ঞানের ইসলামীকরণ কাজের জন্য প্রতিটি মুসলিম দেশ থেকে তহবিল সংগ্রহ করা প্রয়োজন।১১

\r\n

*প্রফেসর ড. সৈয়দ আলী আশরাফ এর মতামত:

\r\n

ড. সৈয়দ আলী আশরাফ রহ. এর মতে জ্ঞানকে প্রথমে নিম্নরূপ বিভাজন করে কারিকুলাম তৈরী করতে হবে-

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

আল্লাহ তাআলা সব জ্ঞানের উৎস:

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

 

\r\n

১) আল্লাহ তাআলার সাথে মানুষের সম্পর্ক এর ভিত্তিতে যে জ্ঞান, সেটা হলো ধর্মভিত্তিক। যথা: কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, উসূলে ফিকহ, আকিদা ইত্যদি।

\r\n

২)মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, এর ভিত্তিতে যে জ্ঞান সেটা হলো মানব বিজ্ঞান।যথা: বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি।

\r\n

৩) মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক এর ভিত্তিতে যে জ্ঞান, সেটা হলো প্রকৃতি বিজ্ঞান। যথা: অংক, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ইত্যাদি।

\r\n

 

\r\n

অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলী আশরাফ রহ. এর মতে জ্ঞান ও শিক্ষা ইসলামীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ হবে নিম্নরূপ:-

\r\n

ক. এমন একটি শিক্ষায়তন গড়ে তুলতে হবে যেখানে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা লাভ করবে।

\r\n

খ. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষাদান করাতে দক্ষক রে তুলতে হবে।

\r\n

11 ড. ফারুকী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮-৬৬।

\r\n

 

\r\n

গ. একটি গবেষণাগার থাকবে যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জ্ঞান বিজ্ঞানের ভিত্তিমূলে Secular ভাবধারার পরিবর্তে ইসলামী ভাবধারা প্রতিষ্ঠার কাজ চালাতে এবং সেই ভাবধারার ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যসংক্রান্ত অন্যান্য যাবতীয় বস্তু তৈরীর ব্যবস্থা থাকবে।

\r\n

ঘ. এ সমস্ত জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে মানুষকে সে পথে পরিচালিত করা যে পথ অনুসরণ করে মানুষ আল্লাহর খলিফা হবার যোগ্যতা অর্জন করে।

\r\n

জ্ঞানের বা শিক্ষার ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে তিনি Faith Based Education  এর কথা বলেছেন।

\r\n

ড. ত্বাহা জাবির আলওয়ানীর মতামত:

\r\n

আলকুরআন ও মহাবিশ্ব অধ্যয়নের মাঝে সমন্বয় ধারা রচনার গুরুত্ব দায়িত্ব সেই পালন করতে পারবে যে আলকুরআনের জ্ঞান অর্জন করেছে এবং অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানে যথেষ্ট পরিমাণ অংশ আয়ত্ত করেছে। যেন উভয় প্রকার জ্ঞান দ্বারা আলকুরআন, মহাবিশ্ব ও মানুষের সংমিশ্রিত ম্যাথডোলজি উন্মোচিত করা যায়। এ জন্য ‘ইসলামীকরণ’ Islamization এর মূলনীতি সমূহ নিম্নবর্ণিত ভিত্তির উপর দাড় করানো হয়:

\r\n

এক: জ্ঞানের জগতে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী পুনর্গঠন করা। যে দৃষ্টিভঙ্গী নির্মল নিখাদ ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ধ্যান-ধারণার মৌলিক উপাদান ও বৈশিষ্ট্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেন কোন বিষয় উপেক্ষা না করেই মৌলিক চূড়ান্ত প্রশ্নমালার উত্তর দিতে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা সক্ষম বলে গণ্য করা সম্ভব হয়। শিক্ষা সমীক্ষণে সক্ষম ব্যক্তিসত্তার শক্তি সামর্থ্য গড়ে তুলতে হবে। সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে যা আয়ত্ত করা ও চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। একই সময়ে তা পদ্ধতি বিজ্ঞান উদ্ভাবনেও সামর্থ্য প্রদান করবে। এমনিভাবে তা জ্ঞান গত ব্যাখ্যায় সামর্থবান করে তুলবে। যে ব্যাখ্যা আবেগ উদ্দীপনার উপর নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

\r\n

দুই: আল কুরআনের পদ্ধতি বিজ্ঞানের আলোকে ও নির্দেশনায় ইসলামী পদ্ধতি বিজ্ঞানের মূলনীতি গঠন, রূপায়ন ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পুনর্গঠন। কেননা একক ও আংশিক অধ্যয়নের ফলে ঐ ইসলামী পদ্ধতি বিজ্ঞান নানা দিক দিয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যে অধ্যয়ন আলকুরআনকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করেছে, জীবন জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। অপরদিকে ঐ একক ও বিচ্ছিন্ন অধ্যয়ন প্রক্রিয়া পূর্বে ও বর্তমানেও আলকুরআনের গণ্ডিবহির্ভূত অবস্থানে থেকে সৃষ্টিজগত ও মানুষকে অধ্যয়ন করছে। তাই ইসলামি পদ্ধতি বিজ্ঞানকে পুনর্গঠন করতে হবে, যেন মুসলিম মানস ঐসব চিন্তাধারাগত ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারে। যে সব ব্যাধি সে মুসলিম মানসকে পঙ্গু করে দিয়েছে। যেমন গায়েব তথা অদৃশ্যের সঙ্গে দৃশ্যমান জগতের সম্পর্ক, ওহীর সঙ্গে যুক্তির সম্পর্ক, ঘটনাসমূহের সাথে কার্যকরণের সম্পর্ক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় অনুধাবনে সে মুসলিম মানস কিংকর্তব্যবিমূঢ় হচ্ছে। এতে স্থিতিশীলতার পরিচয় দিতে পাচ্ছেনা।

\r\n

 

\r\n

তিন: এ পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গীতে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সাথে আচরণের পদ্ধতিও পুনর্গঠন করা। যেখানে আলকুরআনকে পথ, পদ্ধতি, জ্ঞানের উতস এবং কৃষ্টি ও সভ্যতার সৌধ নির্মাণের উপাদান সমূহের উতস হিসেবে গণ্য করা হবে। এর জন্য এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উলূমুল কুরআন তথা কুরআনিক জ্ঞান বিজ্ঞান সমূহের পুননির্মাণ ও পুনর্গঠন করা চাই। আল কুরআনের আয়াতসমূহের খেদমতে যে সব ধ্যান ধারণা সৃষ্টি হয়েছে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে মিলেছে, তার অনেক কিছুই হয়ত এ পুনর্গঠন ক্ষেত্রে এড়িয়ে যেতে হবে। আরব জনগণ আলকুরআন বুঝেছে তার রচনার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যসমূহের ভিত্তিতে। যে সব বৈশিষ্ট্য প্রথম দিকে ছিল খুবই সহজ সরল প্রকৃতির এবং সামাজিক দিক দিয়েও চিন্তাধারায় ছিল ভাষাগত ধাচে এবং শ্রুত বিষয়াদি হিসেবে। যে সব শ্রুত বিষয়ে প্রধান বিবেচ্য বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিল, সনদ বা বর্ণনাগত সূত্রের সহীহ হওয়া তথা বিশুদ্ধতা আছে কি না, তা লক্ষ্য রাখা এবং সুদৃঢ় করার বিষয়টি সে সময়ে সর্বোন্নত জ্ঞানের বিষয় হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছিল। আলকুরআন ও হাদীসে নববী সংশ্লিষ্ট জ্ঞান বিজ্ঞান যখন সরকারীভাবে সংকলিত হচ্ছিল, তখন তাতে ঐ বৈশিষ্ট্যসমূহও প্রতিভাত হয়। এমনিভাবে এর পাশাপাশি ঐ সংকলন পর্যায়ে আরবী ভাষা ও তার আলংকরিক বৈশিষ্ট্যসমূহও প্রকাশিত হয়। আর তার দাবী অনুসারে শব্দ ও বাক্য গঠন প্রক্রিয়ার মাঝে পার্থক্য করার প্রবণতারও উন্মেষ ঘটেছিল। আর এটাই ছিল সে সময়ে প্রচলিত পদ্ধতি বিজ্ঞান। কিন্তু বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিষয়ের পদ্ধতিগত অনুধাবনের চেতনা প্রাধান্য লাভ করেছে। যেমনি এখন আরো প্রাধান্য লাভ করেছে বিভিন্ন সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী সম্পর্কের বিশ্লেষণ ও যুক্তি ভিত্তিক পর্যালোচনা করার প্রবণতা। যাতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক নিয়ম নীতিমালা ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এ সবকে সমাজ ও সভ্যতার বিভিন্ন বিষয়ের সাথে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। সুতরাং আলকুরআন অনুধাবন ও অধ্যয়নে সহায়ক সকল জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি নতুনভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন। তাই এ মহা গ্রন্থটি অধ্যয়নের সাথে মহাবিশ্ব অধ্যয়নের সমন্বয় ও আন্তসম্পর্কীয় পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এমনিভাবে এ প্রক্রিয়াটিকে মুক্ত করতে হবে ঐ পর্যায়ের তাফসীর  ও তাবীলের অনেক কিছু থেকে। প্রত্যাখ্যাত ইসরাঈলী বর্ণনার মত আরো অনেক কিছু আনুপাতিক হারে  পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে নিবিষ্ট হতে হবে। আল কুরআন অধ্যয়ন পদ্ধতিকে আয়াত নাযিল হওয়ার পন্থা, এ সবের পূর্বাপর  সম্পর্কের সাথে পূর্ণ মিলন ঘটাতে হবে। যেন এর দ্বারা মহামহিম কিতাব আলকুরআনের চ্যালেঞ্জের বিভিন্ন দিক সমূহ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আর সে গ্রন্থের অলৌকিকতার বিভিন্ন দিকের সাথে তার সামাজিক ও পদ্ধতি বিজ্ঞানগত দিকটিও সংযোজন করা উচিত। যেন তার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জটি অনিমেষ রূপে প্রমাণিত হয় এবং তার অলৌকিকতা বিদিত হয়। আর এটাই তো তার সাধারণী হওয়া ও সার্বিকতার পক্ষে প্রথম পদ্ধতিগত দলীল।

\r\n

চার: পদ্ধতি বিজ্ঞানের ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে পবিত্র সুন্নতে নববীর সাথে আচরণ পদ্ধতিও পুনর্গঠন করতে হবে। যেখানে বিশুদ্ধ ও পবিত্র সুন্নতে নববীকেও পথ, পদ্ধতি ও জ্ঞানের উতস এবং কৃষ্টি ও সভ্যতার সৌধ নির্মাণের উপাদান সমূহের উতস হিসেবে গণ্য করা হবে। রাসূলুল্লাহ সা: এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারতেন, তারা তার অনুসরণ ও অনুকরণ করতেন। সে পর্যায়টি ছিল সরাসরি যোগাযোগের যুগ। যখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার নিকট থেকে তোমাদের হজ্জ্ব সম্পাদনের কার্যাবলী শিখে নাও। তিনি আরো বলেছিলেন, তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছো, সেভাবে সালাত আদায় কর। সুতরাং বাস্তবে অনুসরণ ও অনুকরণের বিষয়দ্বয় রাসূল সা: এর কর্মতৎপরতার উপর নির্ভরশীল। রাসূল সা: আল কুরআনের শিক্ষাকে নিজ কাজে রূপায়ন করতেন। তিনি তা রূপায়ন করতেন বাস্তবতার ভিত্তিতে এবং আলকুরআনের নির্দেশনা ও জীবনের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে। মহানবী সা: কর্তৃক আল কুরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত কুরআনিক পদ্ধতির উপাদান সমূহ এবং ততকালীন সমাজ বাস্তবতার মাঝে পার্থক্যের পরিধি সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। যে বাস্তবতা বিরাজমান ছিল সে সমাজ সদস্যদের বুদ্ধিবৃত্তি, চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানের পরিমাপ বা সামর্থের ভিত্তিতে এবং সেখানে প্রচলিত জ্ঞান পরিমণ্ডলে সেই বাস্তবতার সামাজিক ও চিন্তা-চেতনাগত বাধ্যবাধকতা বা শর্ত সমূহের আলোকে। এ জন্য সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যারা হাদীস বর্ণনা করতেন, তারা মহানবী সা: এর জীবনের কোন অংশ সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকতে চাইতেন না। তাঁর জীবনের সকল দিক সম্পর্কে জানার জন্য তারা পাগলপারা তথা প্রচণ্ড আগ্রহ পোষণ করতেন। কেননা বিভিন্ন বিষয়ে পদ্ধতি সম্পর্কে অবহতির জন্য এটাই ছিল একমাত্র অবলম্বন। এ জন্য দেখা যায়, সুন্নাহর ক্ষেত্রে রাসূল সা: এর বাণী, কাজ ও সম্মতিসমূহের বিশাল সমাবেশ ঘটেছে। একই কারণে আমরা তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পেয়েছি। যাতে আমরা এমনকি তাঁর সকাল সন্ধায় দৈনন্দিন কার্যাবলী, তার সন্ধি স্থাপন, যুদ্ধ, শিক্ষা-দীক্ষা, বিচার ফয়সালা, নেতৃত্ব, ফাতওয়া, মানবীয় আচার আচরণ ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। এ সব ক্ষেত্রে তাঁর অনুসৃত কর্মপন্থা সমাজ পরিষ্থিতির সাথে তাঁর আচার আচরণ পদ্ধতি বা নিয়মনীতি স্পষ্ট করে দিয়েছে। মহানবী সা: যে পরিবেশে বসবাস করেছেন ও কর্মততপর ছিলেন, এসব বিস্তারিত তথ্যসমূহ সে পরিবেশ ও বাস্তবতার বৈশিষ্ট্যসমূহ স্পষ্ট করে দিয়েছে। ঐ বাস্তব অবস্থাটি গঠন ও মননে বর্তমান আমাদের অবস্থা থেকে নি:সন্দেহে ভিন্ন ছিল।

\r\n

রাসূল সা: তাঁর সুন্নাহর মাধ্যমে কুরআনিক পদ্ধতি ও বাস্তবতার মাঝে বন্ধন রচনা করতেন। সুতরাং মহানবী সা: যে বাস্তবতায় বসবাস করতেন, তা এড়িয়ে গেলে তার সুন্নাহর অনেক কিছুই অনুধাবন করা কঠিন হবে। তিনি ভাস্কর্য নির্মাণ ও চিত্রাঙ্কনের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন এবং যারা মূর্তি তৈরী করে বা চিত্রাঙ্কন করে, তাদেরকে কিয়ামত দিবসে ১২ তথা আখেরাতে                                                        মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হিসেবে গণ্য করেন।  কিন্তু এটা বুঝা উচিত নয় যে, তখন তার সে নিষেধাজ্ঞাটি ছিল দেহাবয়ব কেন্দ্রিক সকল প্রকার নান্দনিকতার বিরুদ্ধে। তার সে নিষেধাজ্ঞাটি সাধারণী ও সর্বব্যাপী ছিল না। যদি এ নিষেধাজ্ঞাটির দ্বারা তাই বুঝানো হয়, তা হলে এটা আল্লাহর নবী হযরত সুলায়মান আ: কর্তৃক শিল্পকর্ম ও সে সম্পর্কে তার ধারণার সাথে পরস্পর বিরোধী হয়ে যাবে। কেননা হযরত সুলায়মান তার সৈন্যবাহিনীর অন্তর্গত জিনদেরকে তার চাহিদানুসারে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও চিত্রাঙ্কন করতে নিয়োগ করেছিলেন। তাই এটা মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা: এর নিষেধাজ্ঞার সাথে পরষ্পর বিরোধী হয়ে যাবে, যদি এ নিষেধাজ্ঞাটিকে সর্বব্যাপী ধরা হয়। এমনিভাবে বর্তমান সমসাময়িক কালে এ বিষয়ে অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন বা যুক্তি তর্ক সৃষ্টি করে বলেন, এ সব শিল্প কর্মের দ্বারা আমাদের এসব ভাস্কর্যের ইবাদাত করা লক্ষ্য নয়। তা হলে এ চিত্রাঙ্কন বা শিল্পকর্ম হারাম হবে কেন? সুতরাং মহানবী সা: এর ঐ নিষেধাজ্ঞাটি এ দাবীর সাথেও পরস্পর বিরোধী নয়। এছাড়া, কোন খন্ডিত ফাতওয়ার মাধ্যমে ঐ ধরণের চিত্রকর্ম তৈরীর বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে না যে, এ ধরণের চিত্রকর্ম হালাল আর ঐ ধরণের চিত্রকর্ম নিষিদ্ধ। বরং এসব ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ও পদ্ধতির প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার পদ্ধতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিতে গিয়ে যেখানে তিনি বলে ছিলেন, তোমার জাতি যদি নওমুসলিম না হতো, কুফরী অবস্থা থেকে সদ্যমুক্ত না হতো,তাহলে আমি এ কাজটি অবশ্যই করতাম, অবশ্যই করতাম।’১৩

\r\n

বস্তুত, মূর্তি ভাস্কর্য পূজা থেকে সদ্যমুক্ত একটি জাতির মধ্যে রাসূল সা: মূর্তি শিল্প এবং এর প্রচার প্রসারের মূলোচ্ছেদ করছিলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মহানবী সা: এর বানী ও সুন্নাহকে বিচ্ছিন্ন ভাবে না ধরে তার ভিত্তিতে একটি সুব্যবস্থিত ও সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে পৌঁছানো প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনা করতে যেয়ে দেখা যায়, তার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বলা কথাগুলোকে মতানৈক্যকারীগণ পৃথক পৃথক মতামতে রূপান্তর করেছেন। এ পর্যায়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বলা ঐসব কথার ভিত্তিতে কখনো কখনো একটি বিষয়ে যা ধরে নিতে হয়, আবার এর বিপরীতও ধরে নেয়া যায়। এ যেন বিভিন্ন মাযহাবের ইমামগণের মতামতের ন্যায় অবস্থা। যেখানে একই বিষয়ে তাদের পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া যায়।

\r\n

----------------------

\r\n

১২ এ মর্মে হাদীসটি (কিয়ামতের দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে মূর্তি তৈয়ারকারীরা ও চিত্রকররা) ইমাম নাসাঈ তার সুনান গ্রন্থের ঈমান ও তার শাখা অধ্যায়ের ‘সবচেয়ে কঠিন শাস্তি যে মানুষকে দেয়া হবে’ নামক পরিচেছদে বর্ণনা করেন ( পৃ. ৫৩-৫৬)।

\r\n

১৩ এখানে হাদীসটি ইমাম নাসাঈ তার সুনানে যাকাত অধ্যায়ের ‘কাবা তৈরীকরণ’ পরিচ্ছেদে বর্ণনা করেন। যেখানে উল্লেখ আছে: হে আয়েশা! তোমার জাতি যদি কুফুরী অবস্থা থেকে সদ্য মুক্ত না হতো, তাহলে এ কাবাঘর ভেঙ্গে হযরত ইবরাহীম আ: যে ভিত্তির উপর তৈরী করেছিলেন একে আমি সে ভিত্তির উপর দাড় করাতাম। আর আমি এর পশ্চাত দরজা রাখতাম...।

\r\n

প্রকৃতপক্ষে যাকে রাসূল সা: এর অনুসরণ ও অনুকরণ বলে অভিহিত করা যায়, আল কুরআন নাযিল হওয়ার যুগে আরব সমাজ তাতেই ছিল ব্যাপৃত ও নিবিষ্ট। তারা তাঁর নিকট থেকে একটি ব্যবহারিক মডেল বা আদর্শ লাভ করে। তাদের জীবন যাপন যাত্রা প্রণালী ও বাস্তবতা অনুসারে সে মডেলটি একটি পদ্ধতির রূপ নেয়। এ পর্যায়ে রাসূল সা: এর ঐ অনুসরণ ও অনুকরণের পথ ধরেই হাদীস ও অন্যান্য বর্ণিত বিষয়সমূহের সাথে ব্যবহারিক নীতিমাল সংক্রান্ত ধারণাসমূহের উন্মেষ ঘটে। তবে এর সাথে খন্ডিত ব্যবহার থেকে হাদীসের কার্যকারিতা হ্রাস করার প্রচেষ্টা উদ্ভুত হয়। আর এর অন্তরালে দেখা যায়, কেউ কেউ বাতেনী ব্যাখ্যা, প্রতীকী ও ইশারা-ইঙ্গিত ভিত্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আশ্রয় নেয়। হাদীসের বাহ্য অর্থের গন্ডি মুক্ত হতেই হয়ত তারা এ পদক্ষেপটি নিয়ে থাকে।  কিন্তু বিষয়টি এখানেই থেমে যায়নি। বরং এ ক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল অবস্থা বা বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়। এরপর মাথাচাড়া দিয়ে উঠে গোটা সুন্নাহ বা তার অংশ বিশেষের যথার্থ ও যৌক্তিকতা সম্পর্কিত সমস্যাসমূহ। আমরা এখনো যার ঝামেলা বহন করছি ও গ্লানি টেনে যাচ্ছি। হাঁ, আমরা যদি সুন্নাহর ব্যবহার নীতিমালা সম্পর্কে কুরআনিক ম্যাথডোলজি পর্যন্ত পুরাপুরি পৌঁছতে পারতাম, যে ম্যাথডোলজি সুন্নাহের সকল শাখা প্রশাখার সাথে আচরণ বিধি নিয়ন্ত্রণ করতো, তা হলে এর আওতায় সুন্নাহর ঐ সব শাখা প্রশাখায় বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন বিষয়াদি অনুধাবন করা যেত। এসব অনুধাবন করা যেত শরীআর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমূহ স্পষ্ট করার ভিত্তিতে।

\r\n

সমসাময়িক বুদ্ধিবৃত্তিক মানসব সব সময় বিভিন্ন বিষয়ের সুশৃঙ্খল বাস্তব ব্যবস্থাপনা অনুসন্ধান করে। এ বুদ্ধিগত মনোবৃত্তি চেষ্টা করে এমন একটি ম্যাথডোলজি অনুসরণ ও কার্যকর করতে যার বিভিন্ন দিক পরিপূর্ণ। এ ম্যাথডোলজির মাধ্যমেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা হবে। কুরআন সুন্নাহ এবং বিশ্বজনীন ও আঞ্চলিক পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রে চিন্তাধারা গত আন্দোলনের এটাই হবে বাস্তব ভিত্তিক মডেল বা ছাঁচ। এ ম্যাথডোলজির মাধ্যমেই কুরআন মাজীদের লক্ষ্য সমূহে পৌঁছা যাবে, ‍সুন্নতে নববী অনুধাবন করা যাবে। তখন কেউ অতীতের গর্ভে আশ্রয় নেয়া বা বাতেনী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার কাজে নিপতিত হবে না। এমনিভাবে কেউ নিপতিত হবে না তাজদীদী কাজে তথা নব নব সংস্কারমূলক প্রচেষ্টাতেও। যার ভিত্তিতে পুনর্বিন্যাস মূলক নবসংযোজন বিয়োজন বা বর্তমান যুগোপযোগী করার জন্য অতীতকে নতুন বেশে ভূষিত করা। না, কুরআন সুন্নাহর পদ্ধতি বিজ্ঞান অনুসরণ করতে পারলে এসবের দরকার হবে না।

\r\n

পাঁচ: আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামী ঐতিহ্য তথা জ্ঞান ভান্ডার অধ্যয়ন ও অনুধাবন কাজটিও পুনর্গঠন করতে হবে। এগুলো জ্ঞান ও যুক্তি ভিত্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, যাচাই বাছাই, সমালোচনা, পর্যালোচনা মূলক পাঠ করতে হবে। এর মাধ্যমেই আমরা তিনটি চক্র বা বৃত্ত থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব। যে তিনটি চক্র আধুনিক কালে আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান ভান্ডারের সাথে আচরণ বিধি নিয়ন্ত্রণ করছে। এ তিনটি চক্র হলো: অতীত উত্তরাধিকার ভান্ডারের সব কিছু প্রত্যাখ্যানকারী চক্র, সবকিছু গ্রহণকারীচক্র, ম্যাথডোলজি ব্যাতিরেকেই বাছাই করে চলার চক্র। আমাদের উত্তরাধিকার জ্ঞান ভান্ডারের সাথে যথাযথ আচরণ করার ক্ষেত্রে এ তিন চক্রের মাধ্যমে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব নয়। এমনিভাবে এ ভান্ডার থেকে যে সব ক্ষেত্রে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন, তা ঐ তিন চক্রের মাধ্যমে সম্ভব নয়।

\r\n

ছয়:সমসাময়িক মানব সমাজে বিরাজমান উত্তরাধিকার সম্পদ জ্ঞান ভান্ডার তথা পশ্চিমা উত্তরাধিকার জ্ঞান ভান্ডার ব্যবহার পদ্ধতিও পুনর্গঠন করতে হবে। এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে যেন এর মাধ্যমে বর্তমানে অনুসৃত আচরণ পদ্ধতিসমূহ থেকে মুসলিম মানস বের হয়ে আসতে পারে। বর্তমানের এসব পদ্ধতি বিভিন্ন দিক দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালানোর পরিবর্তে মুসলমানদেরকে পশ্চাতে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ এ প্রচেষ্টা সমূহ হওয়া দরকার ছিল পশ্চিমা উত্তরাধিকার সম্পদকে কাছে নিয়ে এসে নিবিড় করা, অত:পর তুলনা করা, তারপর পরস্পর মুখোমুখি করা। কিন্তু তা না করার কারণে যা হওয়ার তাই হয়েছে। পরিণতিতে হয় সবকিছু প্রত্যাখ্যান, না হয় বিনা বাক্যে সবকিছু গ্রহণ, অথবা বিপক্ষে না যেয়েই অন্ধভাবে বাছাই  করা হয়। ১৪

\r\n

এ ৬টি পদক্ষেপ বা অক্ষ বলয় বা দায়িত্ব যাই বলি না কেন- এগুলোকেই বলা হয় “জ্ঞানের ইসলামীকরণ’ (Islamization of knowledge) বা জ্ঞানের তাওহীদ ভিত্তিক পদ্ধতি (Unity of Allah Based Mathod of Knowledge) বা মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান সমূহের ইসলামীকরণ (Islamization of Humanities and Social Science) এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সমূহের ইসলামী দিকনির্দেশনা প্রদান অথবা বিজ্ঞানসমূহকে ইসলামী ভিত্তিমূলে প্রতিস্থাপন। ১৫

\r\n

 প্রফেসর ড. এম শমসের আলীর মতামত:

\r\n

অধ্যাপক ড. এম. শমসের আলীর মতে-

\r\n

১. ৬টি world conference on Musilim Education এর Document গুলো সম্পর্কে সচেতনতা awarences সৃষ্টি করতে হবে।

\r\n

২. ওয়ার্কসপ করে জ্ঞান ইসলামীকরণ সম্পর্কে স্কলারদের জানাতে হবে।

\r\n

৩. বাংলাদেশ সহ অনেক মুসলিম দেশের সরকার যে মক্কা ঘোষণা এর স্বাক্ষরকারী এ বিষয়ে প্রতিটি বিষয়ে মুসলিম দেশের সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।

\r\n

----------

\r\n

১৪ ড. ত্বহা জাবির আলওয়ানী, আলকুরআন ও মহাবিশ্ব অধ্যয়ন: সমন্বিত ধারা, বঙ্গানুবাদ ড. আবদুর রহমান আনওয়ারী, ঢাকা: বি আই আই টি.

\r\n

১৫ এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দ্র: Dr. Tahe Zabir Alwani, Islamization of knowledge: Past and present.

\r\n

 

\r\n

৪. সাধারণ শিক্ষা জেনারেল এডুকেশন এবং মাদরাসা শিক্ষা এর ধর্মানুসারী মুসলমানদের এক জায়গায় বসে সমন্বিত পাঠ্যক্রম তৈরী করতে হবে।

\r\n

* লেখকের নিম্ন মতামত:

\r\n

আমার মতে জ্ঞান ইসলামীকরণে প্রধান কটি পদক্ষেপ নিম্নরূপ:

\r\n

১। জ্ঞানের উতস বিবেচনা তথা ইন্দ্রিয়জ ও বুদ্ধিভিত্তিক উতসের পাশাপাশি কুরআন ও সুন্নাহকে জ্ঞানের উতস হিসেবে বিবেচনার আবেদন রাখা।

\r\n

২. জ্ঞানের বিভাজন পুনর্মূল্যায়ন: পাশ্চাত্য সমাজে যেভাবে জ্ঞানের বিভাজন করেছে ধর্ম নিরপেক্ষভাবে, তা বের হয়ে আসতে হবে। এবং মানুষ ও সৃষ্টির সাথে আল্লাহর সম্পর্কে ভিত্তিতে জ্ঞানের বিভাজন করা।

\r\n

৩. জ্ঞানের নতুনভাবে বিন্যাস করা: অর্থাত তাওহীদের আলোকে জ্ঞানের বিন্যাস করা।

\r\n

৪. সমন্বয় সাধন করা: অর্থাত ইসলামের মূলনীতি ঠিক রেখে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের উদ্ভাবিত নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য  থেকে উপকৃত হওয়ার লক্ষ্যে উভয় ধরণের জ্ঞানের মাঝে যৌক্তিক সমন্বয় সাধন করা।

\r\n

৫. জ্ঞানের জগতে ইসলাম প্রদত্ত তত্ত্ব ও তথ্য সংযোজন করা।

\r\n

৬. জ্ঞান বিশ্লেষণ, আহরণ ও বিতরণ পদ্ধতিতে ইসলামী মূল্যবোধ সংযোজন করা তথা ইসলামী চিন্তন পদ্ধতি উন্নয়ন ও অনুসরণ করা।

\r\n

৭. গোটা বিশ্বে সর্বত্র ইসলামের আবেদন তুলে ধরা।

\r\n

৮. যথোপযুক্ত গ্রন্থ রচনা ও সমসাময়িক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে উদাহরণ ও উপমার সংযোজন করা।

\r\n

৯। ইসলামের যে সব তত্ত্ব ও মানব সমাজে প্রচলিত অন্য নামে, তা কুরআন সুন্নাহের আলোকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

\r\n

১০। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে উদ্ভাবিত নতুন নতুন সমস্যার ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধের আলোকে সমাধানে শুরা ভিত্তিক ইজতিহাদ তথা গবেষণা চালানো।

\r\n

১১। জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রসারিত করা।

\r\n

উপরি উল্লিখিত আলোচনার পাশাপাশি এ কথাটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, জ্ঞানের ইসলামীকরণের জন্য পূর্বশর্ত হলো ব্যক্তি মানুষটি হবে তাকওয়াবান মুসলমান এবং চাই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

\r\n

\r\n\r\n

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে সমস্যা ও সম্ভাবনা

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। যেমন:

\r\n

এক. বহুমূখী শিক্ষা ব্যবস্থা:

\r\n

জ্ঞানের ইসলামীকরণের পথে একটি প্রকট সমস্যা হচ্ছে দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা। একমুখী শিক্ষা হলে দ্রুত সংষ্কার করা যেত। দুমুখী বা বহুমুখী শিক্ষার কারণে সমাজের অধিবাসীদের মধ্যে চিন্তা চেতনার ফারাক শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষায় পশ্চিমা জ্ঞান বিজ্ঞান কোন বাছ বিচার না করেই গ্রহণ করা হচ্ছে। পরিবেশ এমনভাবে তৈরী করা হয়, বিভিন্নমুখী শিক্ষার ফলে জ্ঞানের প্রতি বিভিন্ন ধর্মী দৃষ্টিভঙ্গী লালন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

\r\n

দুই: দীর্ঘকালের স্থবিরতা:

\r\n

দীর্ঘকালের স্থবিরতার কারণে মুসলমানরা চিন্তা চেতনায় ইসলামী জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন অ ইসলামী জ্ঞানই যেন স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়েছে। ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি অনীহা উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িক চিন্তাভাবনার প্রতি মুসলিম যুব সমাজ ঝুকে পড়েছে আধুনিকতার চাকচিক্যে।

\r\n

তিন: চাকরী বা কর্মক্ষেত্রের দৈন্যতা:

\r\n

ধর্মীয় জ্ঞানের চর্চায় চাকরী নেই। আদর্শিক জীবন গঠনে ধর্মীয় জ্ঞানের অবদান থাকলেও তার প্রতি অবহেলা করা হয়। এমনকি ধর্মীয় জ্ঞানের মাঝে নিহিত বৈষয়িক ব্যবস্থা থাকলেও তা জীবনে কার্যকর করা হচ্ছে না। কারণ সে সব নৈতিকতা পূর্ণ। তাই উপনিবেশিক আমল থেকে দূর্নীতিপরায়ন প্রশাসনের অধীনে গড়ে উঠা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ইসলামী জ্ঞানের আলোকে চাকুরী ক্ষেত্র নিরূপিত না হওয়ায় এ ক্ষেত্রে দিন দিন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

\r\n

চার: মুসলিম নেতৃবৃন্দের উদ্যোগের অভাব:

\r\n

মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইসলামের কার্যকলাপের প্রতি খুব একটা উদ্যোগী নন। তাদের কার্যকলাপ পরিকল্পনা ভিত্তিক না হয়ে অধিকাংশ সময়ে আবেগতাড়িত বা অন্ধ ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা দ্বিধা দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত হয়। জ্ঞান ইসলামীকরণে তেমন উদ্যোগ নেয় না বা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও করে না।

\r\n

পাঁচ: আধুনিক পশ্চিমা জ্ঞানের অভাব:

\r\n

মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের প্রভাবে ধর্মের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ পশ্চিমাদের জ্ঞানের মূল উতস ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণা থাকলে তারা সে ধরণের চেতনায় প্রভাবিত হতো না।

\r\n

 

\r\n

ছয়: মিডিয়ায় মুসলমানদের আধিপত্যের অভাব:

\r\n

সমগ্র বিশ্বে দ্রুত তথ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মিডিয়া যথা- টিভি, স্যাটেলাইট, মোবাইল রেডিও ইন্টারনেট পত্রিকা ইত্যাদি শক্তিশালী মিডিয়া ব্যবহৃত হচ্ছে। মিডিয়ায় ইসলাম বিরোধী ইয়াহুদী ব্লক সহ পশ্চিমা বিশ্ব তথা আমেরিকা, ইংল্যান্ডের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে মুসলমানদের সম্পর্কে যে কোন বানোয়াট তথ্য মুহর্তে বিশ্বের আনাচে কানাচে পৌছিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে মুসলমানদের কর্তৃত্ব নেই বললেই চলে। ইসলামী জ্ঞানের প্রতি বিশ্বজনমত বিষিয়ে তোলা হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে মিথ্যাচার করে। এটিও একটি বড় সমস্যা।

\r\n

সাত: পর্যাপ্ত উপকরণের অভাব

\r\n

ইসলামের আলোকে জ্ঞান তত্ত্বের উপর বইয়ের অভাব রয়েছে। জ্ঞানকে কিভাবে ইসলামীকরণ করা যাবে, তার উপর সহজ সাবলীল গ্রন্থ বাজারে তেমনটি নেই। এ বিষয়টি এখনো বিশেষজ্ঞদের কাজ বলে প্রচলিত। সাধারণ শিক্ষিতদের ধরা ছোয়ার বাইরে এর অবস্থান হওয়ার কারণে এটি মুসলিম সমাজকে তেমনভাবে আকৃষ্ট করতে পারছে না। এ ছাড়া, এ বিষয়ে পত্র পত্রিকা ও জার্ণালের অভাব রয়েছে। যে জন্য উন্নয়নকৃত ধারণাগুলো দ্বারা সহজে উপকৃত হওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে উপকরণসমূহের অভাব রয়েছে এবং যা আছে, তাও দুস্প্রাপ্য। এছাড়া জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার আলোকে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় রচিত বইয়ের সংখ্যা একান্তই নগন্য।

\r\n

আট: উন্নত কারিকুলাম ও সিলেবাসের অভাব:

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণের আলোকে উন্নত কারিকুলাম ও সিলেবাসের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে শুধু মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোন স্কুল বা কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে কার্যকর করার মতো পূর্ণাঙ্গ কারিকুলাম ও সিলেবাস নেই। মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েও চাকুরীর বাজারের কথা চিন্তা করে ইসলামীকরণের আলোকে সিলেবাস ও কারিকুলাম কার্যকর করা থেকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে আসছে।

\r\n

নয়: মুসলমানদের ঐক্য ও ভাতৃত্ববোধের অভাব

\r\n

মুসলিম সমাজের মূল সূত্র হচ্ছে ঐক্য ও ভাতৃত্ববোধ। কিন্তু বর্তমানে এ ক্ষেত্রেই সংকট বিরাজমান। যে জন্য ইন্টেলেকচুয়াল পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেও অনৈক্যের কারণে উদ্যোগ সমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না। মুসলিম সমাজের বাস্তবতার আলোকে তাদের জ্ঞান ও শিক্ষা কাঠামো ও বিন্যাস কি ধরণের হবে এ ব্যাপারে আজোবধি ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।

\r\n

দশ: ইসলামী চেতনার অভাব:

\r\n

মুসলিম সমাজে কাঙ্খিত চেতনার অভাব রয়েছে। মুসলিম উম্মাহ নিজেদের ঈমান ও স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন নয়। এমনকি মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েও ইসলামীকরণের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের যৌথ নীলনক্সার সামনে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগসমূহ ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

\r\n

বার: অর্থনৈতিক সংকট:

\r\n

এক সময় আরব বিশ্বের পেট্রো ডলারে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনটি সারাবিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সন্ত্রাসের অপবাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী প্রতিষ্ঠান সমূহের অর্থসম্পদ আমেরিকা ও ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ আটকিয়ে দিচ্ছে। এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সরকার ও জনগণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করছে সে সব প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন না করার জন্য এবং অর্থ সঞ্চালন না করার জন্য। জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রতিষ্ঠান সমূহ বর্তমানে এ সমস্যার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

\r\n

মোটকথা: জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজটি ইসলামী দাওয়াতী কাজের অংশ। তাই ইসলামী দাওয়াতকে ঠেকাতে যেয়ে ইসলাম বিরোধী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ পথে বিভিন্ন বাধা সৃষ্টি করছে। যে কারণে বিভিন্ন দিক দিয়ে জ্ঞান ইসলামীকরণ তৎপরতাটিও আক্রান্ত হচ্ছে।

\r\n

সম্ভাবনা:

\r\n

এত কিছুর পরও এ ক্ষেত্রে সফলতার সম্ভাবনাও বিশাল। যেমন:

\r\n

এক: ইসলাম সম্পর্কে মুসলমানগণ নিকট অতীত থেকে একটু বেশি সচেতন। তাদের এ সচেতনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

\r\n

দুই: ইসলামের প্রতি ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াবাসী অমুসলিমদের আগ্রহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

\r\n

তিন: জ্ঞান ইসলামীকরণে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। অতীতে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান দেখা যায়নি।

\r\n

চার: এ বিষয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাধর্মী জার্ণাল প্রকাশিত হচ্ছে।

\r\n

পাঁচ: এ বিষয়ে গবেষণায় ক্রমেই বুদ্ধিজীবীমহলে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হচ্ছে।

\r\n

ছয়: জ্ঞানের জগতে পশ্চিমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

\r\n

সাত: পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যায়ের ন্যায় মুসলমানরাও কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের মডেল ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এতে জ্ঞান ইসলামীকরণের পথকে সুগম করেছে।

\r\n

আট: বিশ্বে অনেক মুসলিম দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে বিন্যাস করতে চাইছে এবং এ লক্ষ্যে নতুন নতুন চাকরীর ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে। জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে এটিও একটি ইতিবাচক দিক।

\r\n

 

\r\n

উপসংহার:

\r\n

জ্ঞান ইসলামীকরণ করতে হবে। পাশ্চাত্যের সবকিছু বিনা বিচারে গ্রহণ করা সঠিক পদ্ধতি নয়। তাদের নির্দিষ্ট দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। সেভাবেই তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিন্যাস করেছে। তাই এটা ইসলামী সমাজ দর্শনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই মিল না থাকলে বিপর্যয় দেখা দেবে। যেমন: রক্তের গ্রুপ না মিলিয়ে রক্ত পুশ করলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। তাই মেচিং এর গুরুত্ব আছে। পরিশেষে বলতে চাই জ্ঞান ও শিক্ষা উভয়টি ইসলামীকরণ প্রয়োজন। শুধু জ্ঞান ইসলামীকরণই যথেষ্ট নয়। কারণ জ্ঞান বিতরণ প্রক্রিয়া যদি ইসলামীকরণ না হয়, তাহলে জ্ঞান যথাযথভাবে উপস্থাপিত না হয়ে বিকৃত আকারেও উপস্থাপিত হতে পারে।

\r\n

বাংলাভাষায় রচিত লেখকের কতিপয় গ্রন্থ

\r\n\r\n

  1. \r\n
  2. বাংলাদেশে ইসলামী দাওয়াতের পথে সমস্যা ও সমাধান।
  3. \r\n
  4. তাফসীরুল কুরআন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
  5. \r\n
  6. মাতৃভাষা আন্দোলন ও ইসলাম
  7. \r\n
  8. ইসলামী দা’ওয়াহ বিষয়ের ভূমিকা
  9. \r\n
  10. ইসলামী দাওয়াতের পদধতি ও আধুনিক প্রেক্ষাপট
  11. \r\n
  12. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস
  13. \r\n
  14. পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণের দাওয়াত
  15. \r\n
  16. মহানবী সা: এর দাওয়াত
  17. \r\n
  18. সুন্নাতে রাসূল সা: এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ও তার জবাব
  19. \r\n
  20. ইসলামী শারীয়াতের ইজতিহাদের স্বরূপ
  21. \r\n
  22. যুগে যুগে ইসলামী দাওয়াহ
  23. \r\n
  24. ইসলাম ও বিশ্বায়ন
  25. \r\n
  26. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলাম
  27. \r\n
  28. ইসলামী দাওয়াহ বিজ্ঞান: উতপত্তি ও ক্রমবিকাশ
  29. \r\n
  30. ইসলামী দাওয়াহ বিজ্ঞানের স্বরূপ
  31. \r\n
  32. তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব: পরিচয় ও ইতিহাস
  33. \r\n
  34. বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম
  35. \r\n
  36. জ্ঞান ইসলামীকরণ: স্বরূপ ও প্রয়োগ
  37. \r\n
  38. তুলনামূলক আইন ব্যবস্থা
  39. \r\n
  40. ইসলামী শারীআতের সুন্নাতে রাসূল সা: এর মর্যাদা
  41. \r\n
  42. তুলনামূলক আইন ও ইসলাম (দুখন্ড)
  43. \r\n

\r\n

 

\r\n

সমাপ্ত

\r\n

 

\r\n

 

জ্ঞান ইসলামীকরণঃ স্বরূপ ও প্রয়োগ

ড. মুহাম্মদ আব্দুর রহমান আনওয়ারী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড