খতমে নবুয়্যাত

বর্তমান যুগে ইসলামের বিরুদ্ধে যে সকল ফেৎনার উদ্ভব হয়েছে তন্মধ্যে নতুন নবুয়্যাতের দাবী অতি মারাত্মক। এই নতুন নবুয়্যাতের দাবী মুসলিম জাতির মধ্যে বিরাট গোমরাহীর সৃষ্টি করে  চলছে। সাধারণত দ্বীন সম্পর্কে মুসলমানদের পরিপূর্ণ ও সঠিক ধারণা না থাকার কারণেই এই ফেৎনার উদ্ভব ও তার বিকাশ সম্ভব হয়েছে। দ্বীন সম্পর্কে যদি মুসলমানগণ অনভিজ্ঞ না হ’তো এবং খত্‌মে নবুয়্যাতকে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারতো তবে কিছুতেই বিংশ শতাব্দীতে এই ফেৎনার উদ্ভব ও বিকাশ সম্ভব হতো না বলেই আমাদের বিশ্বাস।

 

খত্‌মে নবুয়্যাত বিশ্বাসের তাৎপর্য ও তার গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে অবগত ও অবহিত করানোই হচ্ছে এই ফেৎনাকে নির্মূল করার সঠিক কার্যপন্থা। এ ছাড়া অন্যকোন পথ নেই এবং হতেও পারেনা। এ ব্যাপারে মুসলমানদের মনে যে সকল সশয় সন্দেহের সৃষ্টি করা হয় তার যুক্তিপূর্ণ ও যথার্থ সমালোচনা এবং জবাবের প্রয়োজন।

 

আধুনিক বিশ্বের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তানায়ক আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ১৯৬২ সা?লে “খত্‌মে নবুয়্যাত” নামক একটি পুস্তিকা রচনা করেন। উর্দু আত্মপ্রকাশের অব্যবহিত পরেই উপরোক্ত বইটির বাংলা তরজমা পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হয়। অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই বইটি নিঃশেষ হয়ে যায়। পাঠক সমাজের বারবার তাগাদার কারণে ১৯৬৭ সালে বইটির ২য় সংস্করণ এবং ১৯৭৭ সালে ৩য় সংস্করণ পাঠক সমাজের সম্মুখে পেশ করা সম্ভবপর হয়নি, কিন্তু এ সংস্করণও শিগগিরই নিঃশেষ হয়ে যায়। বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বর্তমানে এর চতুর্থ সংস্করণ পাঠক সমাজের সম্মুখে উপস্থাপিত করা হলো। খত্‌মে নবুয়্যাত সম্পর্কে মুসলিম সমাজে যে বিভ্রান্তিকর মতবাদ সৃষ্টি করা হচ্ছে তাকে প্রতিহত করার কাজে সুধীবৃন্দ এই পুস্তিকা হতে সামান্যতম উপকৃত হলে আমাদের শ্রম সার্থক মনে করবো।

 

-প্রকাশক

 

শেষ নবী

 

(আরবী **********)

 

“মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের কারুর পিতা নন। বরং তিনি আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী। এবং আল্লাহ সব জিনিসের ইলম রাখেন।”

 

আয়াতটি সূরা আহ্‌যাবের পঞ্চম রুকুতে উদ্ধৃত হয়েছে। হযরত জয়নবের (রা) সঙ্গে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের বিবাহের বিরুদ্ধে যেসব কাফের ও মুনাফিক মিথ্যা প্রচারণা শুরু করে দিয়েছিলো এই রুকুতে আল্লাহতায়ালা তাঁদের জবাব দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য ছিল এই: জয়নব (রা) হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পালিত পুত্র হযরত জায়েদের (রা) স্ত্রী। অর্থাৎ তিনি রসূলুল্লাহর (স) পুত্রবধু। কাজেই জায়েদের তালাক দেবার পর রসূলুল্লাহ (স) নিজের পুত্রবধুকে বিয়ে করেছেন। এর জবাবে আল্লাহতায়ালা উপরোক্ত সূরার ৩৭ নম্বর আয়অতে বলেন: আমার নির্দেশেই এই বিবাহ সম্পাদিত হয়েছে এবং এজন্য হয়েছে যে, নিজের পালিত পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিবাহ করায় মুসলমানদের কোনো দোষ নেই। অতঃপর ৩৮ এবং ৩৯ নম্বর আয়াতে বলেন: নবীর ওপর যে কাজ আল্লাহ ফরয করে দিয়েছেন কোন শক্তি তাঁকে তা সম্পাদন করা থেকে বিরত রাখতে পারেনা। নবীদের কাজ মানুষকে ভয় করা নয়, আল্লাহকে ভয় করা। নবীদের ব্যাপারে আল্লাহর চিরাচরিত পদ্ধতি হলো এই যে, কারুর পরোয়া না করেই তাঁরা সব সময় আল্লাহর পয়গাম দুনিয়ায় পৌঁছান এবং নিঃসংশয় চিত্তে তাঁর নির্দেশ পালনস করে থাকেন। এরপরই পেশ করেছেন আলোচ্র আয়াতটি। এই আয়াতটি বিরুদ্ধবাদীদের যাবতীয় প্রশ্ন এবং অপপ্রচারের মূলোৎপাটন করে দিয়েছে।

 

তাদের প্রথম প্রশ্ন হলো: আপনি নিজের পুত্রবধুকে বিবাহ করেছেন। অথচ আপনার নিজের শরীয়তও একথা বলে যে, পুত্রের বিবাহিত স্ত্রী পিতার জন্য হারাম।এর জবাবে বলা হলো: “মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের কারুর পিতা নন।” অর্থাৎ যে ব্যক্তি তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিবাহ করা হলো, সে কি মুহাম্মদের (সা) পুত্র ছিল? তোমরা সবাই জান যে, মুহাম্মদের (সা) কোন পুত্র নেই।

 

তাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো: পালিত পুত্র নিজের গর্ভজাত পুত্র নয়, একথা মেনে নিয়েও বলা যায় যে, তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিবাহ করা জায়েজ হতে পারে, কিন্তু তাকে অবশ্যই বিবাহ করতে হবে এবং প্রয়োজনটা কোথায়? এর জবাবে বলা হলো: “কিন্তু তিনি আল্লাহর রসূল।” অর্থাৎ যে হালাল বস্তু তোমাদের রসম-রেওয়াজের বদৌলতে অযথা হারামে পরিণত হয়েছে, সে সম্পর্কে যাবতীয় বিদ্বেষ এবং পক্ষপাতিত্ব খতম করে তার হালাল হওয়াকে নিঃসন্দেহ এবং নিঃসংশয় করে তোলা রসূলের অবশ্য করণীয় কাজ। [‘খত্‌মে নবুয়্যাত’ অস্বীকারকারীরা এখানে প্রশ্ন উঠায় যে, কাফের এবং মুনাফেকদের এই প্রশ্নটি কোন্‌ হাদীসে উল্লিীখত হয়েছে? কিন্তু এই প্রশ্নটি আসলে কোরআন সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারই ফল। কোরআন মজীদের বহু জায়গায় আল্লাহতায়ালা বিরোধীদলের প্রশ্ন নকল না করেই তাদের জবাব দিয়ে গেছেন এবং জবাব থেকেই একথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ হয়েছে যে, যে প্রশ্নটির জবাব দেয়া হচ্ছে সেটি কি ছিলো। এখানেও একই ব্যাপার। এখানেও জবাব নিজেই প্রশ্নের বিষয়বস্তু বিবৃত করছে। প্রথম বাক্যটির পর শব্দ দিয়ে দ্বিতীয় বাক্যটি শুরু করার প্রমাণ হলো যে, প্রথম বাক্যে প্রশ্নকারীর একটি কথার জবাব হয়ে যাবার পরও তার আর একটি প্রশ্ন বাকি রয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বাক্যে তার জবাব দেয়া হয়েছে।মুহাম্মদ (স) নিজের পুত্রবধুকে বিবাহ করেছেন- তাদের এই প্রশ্নের জবাব তারা প্রথম বাক্যে পেয়ে গেছে। অতঃপর তাদের প্রশ্ন ছিল যে, একাজটা করার এমন কি প্রয়োজন ছিল? এর জবাবে বলা হলো: “কিন্তু তিনি আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী।” অন্য কথায় বলা যায়, যেমন কেউ বললো, জায়েদ দাঁড়ায়নি কিন্তু বকর দাঁড়িয়েছে। এর অর্থ হলো এই যে, “জায়েদ দাঁড়ায়নি” কথা থেকে একটি প্রশ্নের জবাব পাওয়ার পরও প্রশ্নকারীর আর একটি প্রশ্ন বাকি রয়ে গেছে। অর্থাৎ যদি জায়েদ না দাঁড়িয়ে থাকে, তবে কে দাঁড়ালো? এই প্রশ্নের জবাবে “কিন্তু বকর দাঁড়িয়েছে” বাক্যটি বলা হলো।]

 

আবার অতিরিক্ত জোর দেবার জন্য বলেন: “এবং শেষ নবী।” অর্থাৎ তাঁর যুগে আইন এবং সমাজ সংস্কারমূলক কোনো বিধি প্রবর্তিত না হয়ে থাকলে, এই কাজ সমাধা করার জন্য তাঁর পর কোনো রসূল তো নয়ই, কোনো নবীও আসবেন না। কাজেই জাহেলী যুগের রসম-রেওয়াজ খতম করে দেবার প্রয়োজন এখনই দেখা দিয়েছে এবং তিনি নিজেই একাজটা সমাধা করে যাবেন।

 

অতঃপর আরো জোর দিয়ে বলেন: “এবং আল্লাহ সব জিনিসের ইলম রাখেন।” অর্থাৎ এই মুহূর্তে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সাহায্যে এই বদ রসমটা খতম করিয়ে দেবার প্রয়োজনটা কি এবং এটা না করায় কি ক্ষতি-একথা একমাত্র আল্লাহই জানেন। তিনি জানেন যে, তাঁর পক্ষথেকে আর কোন নবী আসবেন না। কাজেই শেষ নবীর সাহায্যে যদি এই বদ রসমটা খতম করিয়ে না দেয়া হয়, তাহলেএর পরে আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি আসবেন না, যিনি একে নির্মূল করে দিতে চাইলে সমগ্র দুনিয়ায় মুসলমানদের মধ্য হতে চিরকালের জন্য এটি নির্মুল হয়ে যাবে। পরবর্তীকালেল সংস্কারকগণ এটা নির্মূল করে দিলেও তাঁদের কারুর কাজের পেছনে এমন কোন চিরন্তন এবং বিশ্বজনীন কর্তৃত্ব থাকবেনা, যার ফলে প্রত্যেক দেশ এবং প্রত্যেক যুগের লোকেরা তাঁদের অনুসরণ করতে বাধ্য হবে এবং তাঁদের কারুর ব্যক্তিত্বও এতোটা পাক-পবিত্র বলে গণ্য হবেনা যে, কোনো কাজ নিছক তাঁর সুন্নাত হবার দরুন মানুষের হৃদয় হতে সে সম্পর্কে যাবতীয় ঘৃণা, দ্বিধা এবং সন্দেহ মুহূর্তের মধ্যে নির্মল হয়ে যাবে।

 

কোরআনের পূর্বাপর বিবৃতির ফায়সালা

 

বর্তমান যুগে একটি দল নতুন নবুয়্যাতের ফিত্‌না সৃষ্টি করেছে। এরা ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’ শব্দের অর্থ করে “নবীদের মোহর”। এরা বুঝাতে চায় যে, রসূলুল্লাহ (স) তাঁর মোহরাংকিত হয়ে আরো অনেক নবী দুনিয়ায় আগমন করবেন। অথবা অন্য কথায় বলা যায়,যতক্ষণ পর্যন্ত কারুর নবুয়্যাত রসূলুল্লাহর মোহরাংকিত না হয়, ততক্ষণ তিনি নবী হতে পারবেন না।

 

কিন্তু “খাতিমুন নাবিয়ীন” শব্দ সম্বলিত আয়াতটি যে ঘটনা পরম্পরায় বিবৃত হয়েছে, তাকে সেই বিশেষ পরিবেশে রেখে বিচার করলে, তা থেকে এ অর্থ গ্রহণের কোন সুযোগই দেখা যায় না। অধিকন্তু এ অর্থ গ্রহণ করার পর এ পরিবেশে শব্দটির ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাই বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। এটা কি নিতান্ত অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক কথা নয় যে, জয়নবের নিকাহর বিরুদ্ধে কথিত প্রতিবাদ এবংতাথেকে সৃষ্ট নানাপ্রকার সংশয়-সন্দেহের জবাব দিতে দিতে হঠাৎ মাঝখানে বলে দেয়া হলো: মুহাম্মদ (সা) নবীদের মোহর। অর্থাৎ ভবিষ্যতে যত নবী আসবেন তাঁরা সবাই তাঁর মোহরাংকিত হবেন। আগে পিছের এই ঘটনার মাঝখানে একথাটির আকস্মিক আগমন শুধু অবান্তরই নয়, এ থেকে প্রতিবাদকারীদের জবাবে যে যুক্তি পেশ করা হচ্ছিল, তাও দুর্বল হয়ে পড়ে। এহেন পরিস্থিতিতে প্রতিবাদকারীদের হাতে একটা চমৎকার সুযোগ আসতো এবং তারা সহজেই বলতে পারতো যে, আপনার জীবনে যদি এ কাজটা সম্পন্ন না করতেন, তাহলে ভালই হতো, কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকতো না, এই বদ রসমটা বিলুপ্ত করার যদি এতোই প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে আপনার পরে আপনার মোহরাংকিত হয়ে যেসব নবী আসবেন, এ কাজটা তাঁদের হাতেই সম্পন্ন হবে।

 

উল্লিখিত দলটি শব্দটির আর একটি বিকৃত অর্থ নিয়েছে: ‘খাতিমুন নাবিয়ীন” অর্থ হলো: “আফজালুন নাবিয়ীন।” অর্থাৎ নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্তই রয়েছে, তবে কিনা নবুয়্যাত পূর্ণতা লাভ করেছে রসূলুল্লাহর ওপর। কিন্তু এ অর্থ গ্রহণ করতে গিয়েও পূর্বোল্লিখিত বিভ্রান্তির পুনাবির্ভাবের হাত থেকে নিস্তার নেই। অগ্র-পশ্চাতের সাথে এরও কোন সম্পর্ক নেই।বরং এটি পূর্বাপরের ঘটনা পরম্পরার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থবহ। কাফের ও মুনাফিকরা বলতে পারতো: ‘জনাব, আপনার চাইতে কম মর্যাদার হলেও আপনার পরে যখন আরোনবী আসছেন, তখন একাজটা না হয় তাদের ওপরই ছেড়ে দিতেন। এই বদ রসমটাও যে আপনাকেই মিটাতে হবে, এরই বা কি এমন যৌক্তিকতা আছে!

 

আভিধানিক অর্থ

 

তাহলে পূর্বাপর ঘটনাবলীল সাথে সম্পর্কের দিক দিয়ে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, এখানে খাতিমুন নাবিয়ীন শব্দের অর্থ নবুয়্যাতের সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘোষণা। অর্থাৎ রসূলুল্লাহর (স) পর আর কোন নবী আসবেননা। কিন্তু শুধু পূর্বাপর সম্বন্ধের দিক দিয়েই নয়, আভিধানিক অর্থের দিক দিয়েও এটিই একমাত্র সত্য। আরবী অভিধান এবং প্রবাদ অনুযায়ী ‘খতম’ শব্দের অর্থ হলো: মোহর লাগানো, বন্ধ করা, শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া এবং কোনো কাজ শেষ করে দায়িত্বথেকে অব্যাহতি লাভ করা।

 

খাতামাল আমাল (******) অর্থ হলো: ফারেগা মিনাল আমল (*****) অর্থাৎ কাজ শেষ করে ফেলেছৈ। খাতামাল এনায়া (*****) অর্থ হলো: পাত্রের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে এবং তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, যাতে করে তার ভেতর থেকে কোনো জিনিস বাইরে আসতে এবং বাইরে থেকে কিছু ভেতরে যেতে না পারে।

 

খাতামাল কিতাব (*****) অর্থ হলো: পত্র বন্ধ করে তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, ফলে পত্রটি সংরক্ষিত হবে।

 

খাতামা আলাল কাল্‌ব (******) অর্থ হলো: দিলের ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে। এরপর বাইরের কোনো কথা আর সে বুঝতে পারবে না এবং তার ভেতরের স্থিতিশীল কোনো কথা বাইরে বেরুতে পারবে না।

 

খিতামুল কুল্লি মাশরুব (****) অর্থ হলো: কোনো পানীয় পান করার পর যে স্বাদ অনুভূত হয়।

 

খাতিমাতু কুল্লি শাইয়েন আকিবাতুহু ওয়া আখিরাতুহ (আরবী ***********) অর্থাৎ] প্রত্যেক জিনিসের খাতিমা অর্থ হলো তার পরিণাম এবং শেষ।

 

খাতামাশ্‌ শাইয়ে বালাগা আখিরাহ (আরবী ***********) অর্থাৎ কোনো জিনিসকে খতম করার অর্থ হলো তা শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। -খত্‌মে কোরআন বলতে এই অর্থ গ্রহণ করা হয় এবং এর অর্থের ভিত্তিতেই প্রত্যেক সূরার শেষ আয়াতকে বলা হয় ‘খাওয়াতিম’।

 

খাতিমুল কওমে আখেরুহুম (আরবী *********) অর্থাৎ খাতিমুল কওম অর্থ জাতির শেষ ব্যক্তি (দ্রষ্টব্য: লিসানুল আরব, কামুস এবং আকরাবুল মাওয়ারিদ।) [এখানে আমি মাত্র তিনটি অভিধানের উল্লেখ করলাম। কিন্তু শুধু এই তিনটি অভিধানই কেন, আরবী ভাষার যে কোন নির্ভরযোগ্য অভিধান খুলে দেখুন সেখানে ‘খতম’ শব্দের উপরোল্লিখিত ব্যাখ্যাই পাবেন। কিন্তু ‘খতমে নবুয়্যাত’ অস্বীকারকারীরা খোদার দ্বীনের সুরক্ষিত গৃহে সিঁদ লাগাবার জন্য এক আভিধানিক অর্থকে পুর্ণরূপে এড়িয়ে গেছেন। তারা বলতে চান, কোন ব্যক্তিকে ‘খাতামুশ শোয়ারা’, খাতামুল ফোকাহা’ অথবা ‘খাতামুল মুফাসসিরিন’ বললে এ অর্থ গ্রহণ করা হয় না যে, যাকে ঐ পদবী দেয়া হয়, তার পরে আর কোনো শায়ের কোন ফকিহ অথবা মুফাস্‌সরি পয়দা হননি। বরং এর অর্থ এই হয় যে, ঐ ব্যক্তির ওপররে উল্লিীখত বিদ্যা অথবা শিল্পের পূর্ণতার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। অথবা কোন বস্তুকে অত্যাধিক ফুটিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে এই ধরনেসর পদবী ব্যবহারের ফলে কখনো খতম-এর আভিধানিক অর্থ ‘পূর্ণ’ অথবা ‘শ্রেষ্ঠ’ হয় না এবং ‘শেষ’ অর্ এর ব্যবহার ত্রুটিপূর্ণ বলৌ গন্য হয় না।

 

একমাত্র ব্যাকরণ-রীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিই এ ধরনের কথা বলতে পারেন। কোন ভাষারই নিয়ম এ নয় যে, কোন একটি শব্দ তার আসল অর্থের পরিবর্তে কখনো কখনো দূর সম্পর্কের অন্য কোন অর্থে ব্যবহৃরিত হলেসেটাই আসল অর্থে পরিণত হবে এবং আসল আভিধানিক অর্থে তার ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। আপনিয খন কোন আরবের সম্মুখে বলবেন:

 

(জাআ খাতামুল কওম)-তখন কখনো সে মনে করবে না যে গোত্রের শ্রেষ্ঠ অথবাপ কামেল ব্যক্তি এসেছে। বরং সে মনে করবে যে, গোত্রের সবাই এসে গেছে, এমনকি শেষ ব্যক্তিটি পর্যন্তও।]

 

এজন্যই সমস্ত অভিধান বিশারত এবং তাফসীরকারগণ একযোগে ‘খাতিমুন নাবিয়ীনা’ শব্দের অর্থ নিয়েছেন, আখেরুন নাবিয়ীন-অ অর্থাৎ নবীদের শেষ। আরবী অভিধান এবং প্রবাদ অনুযায়ী ‘খাতিম’ –এর অর্থ যাকঘরের মোহর নয়, যা চিঠির ওপর লাগিয়ে চিঠি পোস্ট করা হয়; বরং সেই মোহর যা খামের মুখে এই উদ্দেশ্যে লাগানো হয় যে, তার ভেতর থেকে কোনো জিনিস বাইরে বেরুতে পারবে না এবং বাইরের কোনো জিনিস ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।

 

রাসূলুল্লাহর বাণী

 

পূর্বাপর সম্বন্ধ এবং আভিধানিক অর্থের দিক দিয়ে শব্দটির যে অর্থ হয়, রসুলুল্লাহর (স) বিভিন্ন ব্যাখ্যাও এর সমর্থন করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে কতিপয় হাদীসের উল্লেখ করছি:

 

(আরবী *********)

 

(১) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: বনি ইসরাঈলদের নেতৃত্ব করতেন্‌ আল্লাহর রসূলগণ। যখন কোনো নবী ইন্তেকাল করতেন, তখন অন্য কোনো নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। কিন্তু আমার পরে কোনো নবীহবে না, হবে শুধু খলিফা।

 

(আরবী *********)

 

(২) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমি আমার পূর্ববর্তী নবীদের দৃষ্টান্ত হলো এই যে, এক ব্যক্তি একটি দালান তৈরী করলো এবং খুব সুন্দর ও শোভনীয় করে সেটি সজ্জিত করলো।কিন্তু তার এক কোণে একটি ইটের স্থান শূন্য ছিল। দালানটির চতুর্দিকে মানুষ ঘুরে ঘুরে তার সৌন্দর্য দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছিল এবং বলছিল, ‘এ স্থানে একটা ইট রাখা হয়নি কেন? কাজেই আমি সেই ইট এবং আমিই শেষ নবী।’ (অর্থাৎ আমার আসার পর নবুয়্যাতের দালান পূর্ণতা লাভ করেছে, এখন এর মধ্যে এমন কোন শূন্যস্থান নেই যাকে পূর্ণ করার জন্য আবার কোনো নবীর প্রয়োজন হবে)।

 

এই ধরনের চারটি হাদীস মুসলিম শরীফে কিতাবুল ফাজায়েলের বাবু খাতিমুন নাবিয়ীনে উল্লিখিত হয়েছে। এবং শেষ হাদীসটিতে এতোটুকুন অংশ বর্ধিত হয়েছে: (আরবী *********) “অতঃপর আমি এলাম এবং আমি নবীদের সিলসিলা খতম করে দিলাম।”

 

হাদীসটি তিরমিজী শরীফে একই শব্দ সম্বলিত হয়ে ‘কিতাবুল মানাকিবের বাবু ফাজলিন নবী’ এবং কিতাবুল আদাবের ‘বাবুল আমসালে’ বর্ণিত হয়েছে।

 

মুসনাদে আবু দাউদ তিয়ালাসীতে হাদীসটি জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত হাদীসের সিলসিলায় উল্লিখিত হয়েছে এবং এর শেষ অংশটুকু হলো (আরবী *********) “আমার মাধ্যমে নবীদের সিলসিলা খতম করা হলো।”

 

মুসনাদে আহমদে সামান্য শাব্দিক হেরফেরের সাথে এই ধরনের হাদীস হযরত উবাই ইবনে কা’ৎব, হযরত আবু সাঈদ খুদরী এবং হযরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে।

 

(আরবী *********)

 

(৩) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: “ছ’টা ব্যাপারে অন্যান্য নবীদের ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে: (১) আমাকে পূর্ণ অর্থব্যঞ্জক সংক্ষিপ্ত কথা বলার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। (২) আমাকে শক্তিমত্তা ও প্রতিপত্তি দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। (৩) আমাকে গনীমাতের অর্থ-সম্পদ আমার জন্য হালাল করা হয়েছে। (৪) পৃথিভীর জমীনকে আমার জন্য মসজিদে (অর্থাৎ আমার শরীয়তে নামায কেবল বিশেষ ইবাদতগাহে নয়, দুনিয়ার প্রত্যেক স্থানে পড়া যেতে পারে) এবং মাটিকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে (শুধু পানিই নয়, মাটির সাহায্যে তায়াম্মুম করেও পবিত্রতা হাসিল অর্থাৎ অজু এবং গোসলের কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে) পরিণত করা হয়েছে। (৫) সমগ্র দুনিয়ার জন্য আমাকে রসূল হিসাবে পাঠানো হয়েছে এবং (৬) আমার ওপর নবীদের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে।”

 

(৪) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: ‘রিসালাত এবং নবুয়্যাতের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে। আমার পর কোনো রসূল এবং নবী আসবে না।”

 

(আরবী *********)

 

(৫) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: “আমি মুহাম্মদ। আমি আহমদ। আমি বিলুপ্তকারী, আমার সাহায্যে কুফরকে বিলুপ্ত করা হবে। আমি সমবেতকারী, আমার পরে লোকদেরকে হাশরের ময়দানে সমবেত করা হবে (অর্থাৎ আমার পরে শুধু কিয়ামতই বাকি আছে) আমি সবার শেষে আগমনকারী (এবং সবার শেষে আগমনকারী হলো সেই) যার পরে আর নবী আসবে না।”

 

(আরবী *********)

 

রসূলুল্লাহ (স) বলেন: “আল্লাহ নিশ্চয়ই এমন কোনো নবী পাঠাননি যিনি তাঁর উম্মতকে দাজ্জাল সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করেননি। (কিন্তু তাদের যুগে সে বহির্গত হয়নি)। এখন আমিই শেষ নবী এবং তোমরা শেষ উম্মত। দাজ্জাল নিঃসন্দেহে এখন তোমাদের মধ্যে বহির্গত হবে।”

 

(আরবী *********)

 

(৭) আবদুর রহমান ইবনে জোবায়ের বলেন: আমি আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে আস্‌’কে বলতে শুনেছি যে, একদিন রসূলুল্লাহ (সা) নিজের গৃহ থেকে বের হয়ে আমাদের মধ্যে তাশরীফ আনলেন। তিনি এভাবে আসলেন যেন আমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তিনবার বললেন, আমি উম্মী নবী মুহাম্মদ। অতঃপর বললেন, আমার পর আর কোন নবী নেই।

 

(আরবী *********)

 

(৮) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমার পরে আর কোনো নবুয়্যাত নেই। আছে শুধু সুসংবাদ দানকারী কথার সমষ্টি। জিজ্ঞেস করা হলো, হে খোদার রসূল, সুসংবাদ দানকারী কথাগুলো কি? জবাবে তিনি বললেন: ভালো স্বপ্ন। অথবা বললেন, কল্যাণময় স্বপ্ন। (অর্থাৎ খোদার অহি নাযীল হবার এখন আর সম্ভাবনা নেই। বড় জোর এতোটুকু বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে যদি কাউকে কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়, তাহলে শুধু ভালো স্বপ্নের মাধ্যমেই তা দেয়া হবে)।

 

(আরবী *********)

 

(৯) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমার পরে যদি কোনো নবী হতো, তাহলে উমর ইবনে খাত্তাম সে সৌভাগ্য লাভ করতো।

 

(আরবী *********)

 

(১০) রসূলুল্লাহ (স)  হযরত আলীকে (রা) বলেন: আমার সাথে তোমার সম্পর্ক মুসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মতো। কিন্তু আমার পরে আর কোনো নবী নেই।

 

বুখারী এবং মুসলিম তাবুক যুদ্ধের বর্ণনা প্রসংগেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে আহমদে এই বিষয়বস্তু সম্বলিত দু’টি হাদীস হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি বণনার শেষাংশ হলো: (আরবী *********) “কিন্তু আমার পরে আর কোনো নবুয়্যাত নেই।” আবু দাউদ তিয়ালাসি, ইমাম আহমদ এবং মুহাম্মদ ইসহাক এ সম্পর্কে যে বিস্তারিত বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, তাবুক যুদ্ধে রওয়ানা হবার পূর্বে রসূলুল্লাহ (স) হযরত আলীকে (রা) মদীনা তাইয়েবার হেফাজত এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেখে যাবার ফায়সালা করেন। এ ব্যাপারটি নিয়ে মুনাফিকরা বিভিন্ন কথা বলতে লাগলো। হযরত আলী (রা) রসূলুল্লাহকে (স) বললেন, ‘হে খোদার রসূল, আপনি কি আমাকে শিশু এবং মেয়েদের মধ্যে ছেড়ে যাচ্ছেন? রসূলুল্লাহ (স) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন: ‘আমার সাথে তোমার সম্পর্কতো মূসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মতো। অর্থাৎ কোহেতুরে যাবার সময় হযরত মূসা (আ) যেমন বনী ইসরাঈলদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হযরত হারুনকে পেছনে রেখে গিয়েছিলেন অনুরূপভাবে মদীনার হেফাজতের জন্য আমি তোমাকে পেছনে রেখে যাচ্ছি। কিন্তু সংগে সংগে রসূলুল্লাহর মনে এই সন্দেহও জাগলো যে, হযরত হারুনের সংগে এভাবে তুলনা করার ফলে হয়তো পরে এ থেকে কোনো ফিত্‌না সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই পরমুহূর্তেই তিনি কথাটা স্পষ্ট করে দিলেন যে, ‘আমার পর কোনো ব্যক্তি নবী হবে না।’

 

(আরবী *********)

 

(১১) হযরত সাওবান বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আর কথা হচ্ছে এই যে, আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যাবাদী হবে। তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী করবে। অথচ আমার পর আর কোনো নবী নেই।

 

এই বিষয়বস্তু সম্বলিত আর একটি হাদীস আবু দাউদ ‘কিতাবুল মালাহেমে’ হযরত আবু হোরায় (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযীও হযরত সাওবান এবং হযরত আবু হোরায় (রা) থেকে এ হাদীস দু’টি বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় বর্ণনাটির শব্দ হলো এই:

 

(আরবী *********)

 

অর্থাৎ এমন কি তিরিশ জনের মতো প্রতারক আসবে। তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকেই দাবীকরবে যে, সে আল্লাহর রসূল।

 

(১২) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমাদের পূর্বে যেসব বনি ইসরাঈল গুজরে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক লোক এমন ছিলেন, যাঁদের সংগে কালাম করা হয়েছে, অথচ তাঁরা নবী ছিলেন না। আমার উম্মতের মধ্যে যদি এমন কেউ হয়, তাহলে সে হবে উমর।

 

মুসলিমে এই বিষয়বস্তু সম্বলিত যে হাদীস উল্লিখিত হয়েছে, তাতে (****) এর পরিবর্তে (****) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মুকাল্লিম এবং মুহাদ্দিস শব্দ দুটি সমার্থক। অর্থাৎ এমন ব্যক্তি যার সংগে আল্লাহতায়ালা কালাম করেছেন অথবা যার সাথে পর্দার পেছন থেকে কথা বলা হয়। এ থেকে জানা যায় যে, নবুয়্যাত ছাড়াও যদি এই উম্মতের মধ্যে কেউ আল্লাহর সাথে কালাম করার সৌভাগ্যঅর্জন করেন, তাহলে তিনি একমাত্র হযরত উমরই হবেন।

 

(আরবী *********)

 

(১৩) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমার পরে আর কোনো নবী নেই এবং আমার উম্মতের পর আর কোনো উম্মত (অর্থাৎ কোনো ভবিষ্যত নবীর উম্মত) নেই।

 

(আরবী *********)

 

(১৪) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমি শেষ নবী এবং আমার মসজিদ (অর্থাৎ মসজিদে নববী) শেষ মসজিদ। [খত্‌মে নবুয়্যাত অস্বীকারকারীরা এই হাদীস থেকে প্রমাণ করে যে, রসূলুল্লাহ (স) যেমন তাঁর মসজিদকে শেষ মসজিদ বলেছেন, অথচ এটি শেষ মসজিদ নয়; এর পরও দুনিয়ার বেশুমার মসজিদ নির্মিত হয়েছে অনুরূপভাবে তিনি বলেছেন, যে তিনি শেষ নবী। এর অর্থ হলো এই যে, তাঁর পরেও নবী আসবেন। অবশ্য শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে তিনি হলেন শেষ নবী এবং তাঁর মসজিদ শেষ মসজিদ। কিন্তু আসলে এ ধরনের বিকৃত অর্থই একথা প্রমাণ করে যে, এই লোকগুলো আল্লাহ এবং রসূলের কালামের অর্থ অনুধাবন করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। মুসলিম শরীফের যে স্থানে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সেখানে এই বিষয়ে সমস্ত হাদীস সম্মুখে রাখলেই একথা পরিস্ফূট হবে যে, রসূলুল্লাহ (স) তাঁর মসজিদকে শেষ মসজিদ কোন্‌ অর্থে বলেছেন। এখানে হযরত আবুহোরায় (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) এবং হযরত মায়মুনার (রা) যে বর্ণনা ইমাম মুসলিম উদ্ধৃত করেছেন, তাতে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ার মাত্র তিনটি মসজিদ এমন রয়েছে যেগুলো সাধারণ মসজিদগুলোর ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। সেখানে নামায পড়লে অন্যান্য মসজিদের চেয়ে হাজার গুণ বেশী সওয়াব হাসিল হয় এবং এজন্য একমাত্র এই তিনটি মসজিদে নামায পড়ার জন্য সফর করা জায়েজ। দুনিয়ার অবশিষ্ট মসজিদগুলোর মধ্যে সমস্ত মসজিদকে বাদ দিয়ে বিশেষ করে একটি মসজিদে নামায পড়বার জন্য সেদিকে সফর করা জায়েজ নয়। এর মধ্যে ‘মসজিদুল হারাম’ হলো প্রথম মসজিদ। হযরত ইবরাহীম (আ) এটি বানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি হলো ‘মসজিদে আক্‌সা’। হযরত সুলায়মান (আ) এটি নির্মাণ করেছিলেন এবং তৃতীয়টি মদীনা তাইয়েবার ‘মসজিদে নববী’। এটি নির্মাণ করেন রসূলুল্লাহ (স)। রসূলুল্লাহ (স) এরশাদের অর্থ হলো এই যে, এখন যেহেতু আমার পর আর কোনো নবী আসবেনা, সেহেতু আমার মসিজদের পর দুনিয়ায় আর চতুর্থ এমন কোনো মসজিদ নির্মিত হবেনা, যেখানে নামায পড়ার সওয়াব অন্যান্য মসজিদের তুলনায় বেশী হবে এবং সেখানে নামায পড়ার উদ্দেশ্যে সেদিকে সফর করা জায়েজ হবে।

 

রসূলুল্লাহ (স) নিকট থেকে বহু সাহাবা হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন এবং বহু মুহাদ্দিস অত্যন্ত শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য সনদসহ এগুলো উদ্ধৃত করেছেন। এগুলো অধ্যয়ন করার পর স্পষ্ট জানা যায় যে, রসুল্লাহ (স) বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার করে একথা পরিষ্কার করেদিয়েছেন যে, তিনি শেষ নবী। তাঁর পর কোনো নবীআসবে না। নবুয়্যঅতের সিলসিলা তাঁর ওপর খতম হয়ে গেছে এবং তাঁর পরে যে ব্যক্তি রসূল অথবা নবী হবার দাবী করবে, সে হবে দাজ্জাল এবং কাজ্জাব। কোরআনের ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’ শব্দের এর চাইতে বেশী শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্য এবং প্রমাণ্য ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে। রসূলুল্লাহ বাণীই এখঅনে চরম সনদ এবং প্রমাণ। উপরন্তু যখন তা কোরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা করে তখন তা আরো অধিক শক্তিশালী প্রমাণে পরিণত হয়। এখন প্রশ্ন হলো এই যে, মুহাম্মদের (স) চেয়ে বেশী কে কোরআনকে বুঝেছে এবং তাঁর চাইতে বেশী এর ব্যাখ্যার অধিকার কার আছে? এমন কে আছে যে, খতমে নবুয়্যাতের অন্য কোনো অর্থ বর্ণনা করবে এবং তা মেনে নেয়া তো দূরের কথা, সে সম্পর্কে চিন্তা করতেও আমরা প্রস্তুত হবো?

 

সাহাবাদের ইজমা

 

কোরআন এবং সুন্নাহর পর সাহায়ে কেরামের ইজমা বা মতৈক্য হলো তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমস্ত নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে প্রমাণ হয় যে, রসূলুল্লাহর (স)। ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই যেসব লোক নবুয়্যাতের দাবী করে এবং যারা তাদের নবুয়্যাত স্বীকার করে নেয়, তাদের সবার বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করেছিলেন। এসম্পর্কে মুসাইলামা কাজ্জাবের ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে রসূলুল্লাহর (স) নবুয়্যাত অস্বীকার করছিল না; বরং সে দাবী করছিল যে, রসূলুল্লাহ্‌র নবুয়্যাতে তাকেও অংশীদার করা হয়েছে। রসূলুল্লাহর ইন্তেকালের পূর্বেসে তাঁর নিকট যে চিঠি পাঠিয়েছিল তার আসল শব্দ হলো এই:

 

“অর্থাৎ আল্লাহর রসূল মুসাইলামার তরফ হতে আল্লাহর রসূল মুহাম্মদের নিকট। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আপনি জেনে রাখুন, আমাকে আপনার সাথে নবুয়্যাতের কাজে শরীক করা হয়েছে।”

 

এভাবে স্পষ্ট করে রিসালাতে মুহাম্মদীকে স্বীকার করে নেবার পরও তাকে ইসলাম বহির্ভূত বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে। ইতিহাস থেকে একথাও প্রমাণ হয় যে, বনূ হোনায়পা সরল অন্তঃকরণে তার ওপর ঈমান এনেছিল। অবশ্য তারা এই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছিল যে, মুহাম্মদ (স) নিজেই তাকে তার নবুয়্যাতের কাজে শরীক করেছেন। এ ছাড়াও আর একটা কথা হলো এই যে, মদীনা তাইয়েবা থেকে এক ব্যক্তি কোরআনের শিক্ষা গ্রহণ করেছিল এবং বনু হোনায়ফার নিকটে গিয়ে সে কোরআনের আয়াতকে মুসাইলামার নিকট অবতীর্ণ আয়াতরূপে পেশ করেছিল।

 

(আরবী *********)

 

কিন্তু এ সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম তাকে মুসলমান বলে স্বীকার করেননি এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। [শেষ নবুয়্যাতে অবিশ্বাসীরা নবী করিমের (স)-হাদীসেরবিপরীতে হযরত আয়েশার (রা) বলে কথিত নিম্নোক্ত বর্ণনা উদ্ধৃতি দেয়: “বল নিশ্চয়ই তিনি খাতামুন নাবিয়ীন, এ কথা বলো না যে তার পর নবী নেই।” প্রথমত নবী করিমের (স) সুস্পষ্ট আদেশকে অস্বীকার করার জন্রহযরত আয়েশার (রা) উদ্ধৃতি দেয়া একটা ধৃষ্টতা। অধিকন্তু হযরত আয়েশার (রা) বলে কথিত উপরোক্ত উদ্ধৃতি মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। হাদীস শাস্ত্রের কোন প্রামাণিক গ্রন্থেই হযরত আয়েশার (রা) উপরোক্ত উক্তির উল্লেখ নেই। কোন বিখ্যাত হাদীস লিপিবদ্ধকারী এ হাদীসটি লিপিবদ্ধ বা উল্লেখ করেননি।

 

উপরোক্ত হাদীসটি ‘দার-ই মানহুর’ নামক তাফসীর এবং ‘তাকমিলাহ মাজমা-উল-বিহার’ নামক অপরিচিত হাদীস সংকলণ থেকে নেয়া হয়েছে; কিন্তু এর উৎপত্তি বা বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই। রসূল (স) সুস্পষ্ট হাদীস বা বিখ্যাত হাদীস বর্ণনাকারীরা খুবই নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে বর্ণনা করেছেন, তাকে অস্বীকার করার জন্য হযরত আয়েশার (রা) কথার উল্লেখ চূড়ান্ত ধৃষ্টতা মাত্র।] অতঃপর একথা বলার সুযোগ নেই যে, ইসলাম বহির্ভূত হবার কারণে সাহাবাগণ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি বরং বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছিল। ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে বিদ্রোহী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলেও তাদের যুদ্ধবন্দীদেরকে গোলামে পরিণত করা যেতে পারে না। বরং শুধু মুসলমানই নয়, জিম্মীও (অমুসলিম) বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, গ্রেফতার করার পর তাকে গোলামে পরিণত করা জায়েজ নয়। কিন্তু মুসাইলামা এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) ঘোষণা করেন যে, তাদের মেয়েদের এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেদেরকে গোলাম বানানো হবে এবং গ্রেফতার করার পর দেখা গেলো, সত্যি সত্যিই তাদেরকে গোলাম বানানো হয়েছে। হযরত আলী (রা) তাদের মধ্যথেকেই জনৈক যুদ্ধ বন্দিনীর মালিক হন। এই যুদ্ধ বন্দিনীর গর্ভজাত পুত্র মুহাম্মদ ইবনে হানিফাই হলেন পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে সর্বজন পরিচিত ব্যক্তি।

 

(আরবী *********) এ থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম যে অপরাধের কারণে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তা কোন বিদ্রোহের অপরাধ ছিলনা বরং সে অপরাধ ছিল এইযে, এক ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পরে নবুয়্যাতের দাবী করে এবং অন্য লোকেরা তার নবুয়্যাতের ওপর ঈমান আনে। রসূলুল্লাহর ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই এই পদক্ষেপ গৃহীত হয়। এর নেতৃত্ব করেন হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) এবং সাহাবাদের সমগ্র দলটি একযোগে তাঁর নেতৃত্বাধীনে এ কাজে অগ্রসর হন। সাহাবাদের ইজমার এর চাইতে সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে।

 

আলেম সমাজের ইজমা

 

শরীয়াতে সাহাবাদের ইজমার পর চতুর্থ পর্যায়ের সব চাইতে শক্তিশালী দলিল হলো সাহাবাগণের পরবর্তী কালের আলেম সমাজের ইজমা। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক যুগের এবং সমগ্র মুসলিম জাহানের প্রত্যেক এলাকার আলেম সমাজ হামেশাই এ ব্যাপারে একমত রয়েছেন যে,

 

“মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পরে কোনো ব্যক্তি নবী হতে পারে না। এবং তাঁর পর যে ব্যক্তি নবুয়্যাতের দাবী করবে এবং যে ব্যক্তি এই মিথ্যা দাবীকে মেনে নেবে, সে কাফের এবং মিল্লাতে ইসলামের মধ্যে তার স্থান নেই।”

 

এ ব্যাপারে আমি কতিপয় প্রমাণ পেশ করছি:

 

(১) ইমাম আবু হানিফার যুগে (৮০-১৫০হি) এক ব্যক্তি নবুয়্যাতের দাবী করে এবংবলে: “আমাকে সুযোগ দাও, আমি নবুয়্যাতের সংকেত চিহ্ন পেশ করব।”

 

একথা শুনে ইমাম সাহেব বলেন: যে ব্যক্তি এর কাছ থেকে নবুয়্যাতের কোনো সংকেত চিহ্ন তলব করবে সেও কাফের হয়ে যাবে। কেননা রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন: (******) আমার পর আর কোন নবী নেই।

 

(আরবী *********)

 

(২) আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী (২২৪-৩১০ হি) তাঁর বিখ্যাত কোরআনের তাফসীরে (আরবী *******) আয়াতটির বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন:

 

(আরবী *******)

 

অর্থাৎ “যে নবুয়্যাতকে খতম করে দিয়েছে এবং তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, কিয়ামত পর্যন্ত এর দরজা আর কারুর জন্য খুলবেনা।” (তাফসীরে ইবনে জারীর, দ্বাবিংশ খণ্ড, ১২ পৃষ্ঠা)

 

(৩) আল্লামা ইবনে হাজাম আন্দালুসী (৩৮৪-৪৫৬ হি) লিখেছেন: নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহর (স) পর অহীর সিলসিলা খতম হয়ে গেছে। এর সপক্ষে যুক্তি এই যে, অহী আসে একমাত্র নবীর কাছে এবং মহান আল্লাহ বলেছেন, “মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারুর পিতা নয়। কিন্তু সে আল্লাহর রসূল এবং সর্বশেষ নবী।” (আল মুহাল্লা, প্রথম খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা)।

 

(৪) ইমাম গাজ্জালী (৪৫০-৫০৫ হি) বলেন: “সমগ্র মুসলিম সমাজ এই বাক্য থেকে একযোগে এই অর্থ নিয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (স) তাঁর পরে কোন রসূল এবং নবী না আসার কথাটি স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন এবং এর কোনো বিশেষ অর্থ গ্রহণ অথবা বাক্যটিকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে এবং টেনে-হিঁচড়ে এ থেকে কোনো দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণের সুযোগই এখানে নেই। অতঃপর যে ব্যক্তি টেনে-হিঁচড়ে এথেকে কোনো দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করবে, তার বক্তব্য হবে উদ্ভট ও নিছক কল্পনা প্রসূত এবং তার বক্তব্যের ভিত্তিতে তার ওপর কুফরীর ফতোয়া দেবার ব্যাপারে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা কোরআনে যে আয়াত সম্পর্কে সমগ্র মুসলিম সমাজ একযোগে এই মত পোষণ করেন যে, তার কোনো দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে না এবং টেনে-হিঁচড়ে অন্য কোনো অর্থও তা থেকে বের করা যেতে পারেনা, সে আয়াতকে সে মিথ্যা প্রমাণ করেছে।” (আল ইকতিসাদ ফিল ইতিকাদ, ১১৩ পৃষ্ঠা)

 

(৫) মুহিউদ সূন্নাহ বাগাবী (মৃত্যু ৫১০ হি) তাঁর তাফসীরে আলিমুত তানজীল-এ লিখেছেন: রসূলুল্লাহ্‌র (স) মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা নবুয়্যাতের সিলসিলা খতম করেছেন। কাজেই তিনি সর্বশেষ নবী এবং ইবনে আব্বাস বলেন যে, আল্লাহতায়ালা এই আয়াতে ফায়সালা করে দিয়েছেন যে, মুহাম্মদের (স) পর কোন নবী নেই। (তৃতীয় খণ্ড, ১৫৮ পৃষ্ঠা)

 

(৬) আল্লাম জামাখশরী (৪৬৭-৫৩৮ হি) তাফসীরৈ কাশ্‌শাফে লিখেছেন: যদি তোমরা বল যে, রসূলুল্লাহ (স) শেষ নবী কেমন করে হলেন, কেননা হযরত ঈসা(আ) শেষ যুগে অবতীর্ণ হবেন, তাহলে আমি বলবোযে, রসূলুল্লাহর শেষ নবী হবার অর্থ হলো এই যে, তাঁর পরে আর কাউকে নবীর পদে প্রতিষ্ঠিত করা হবেনা। হযরত ঈসাকে (আ) রসূলুল্লাহর (স) পূর্বে নবী বানানো হয়েছে। অবতীর্ণ হবার পর তিনি রসূলুল্লাহর অনুসারী হবেন এবং তাঁর কেবলার দিকে মুখ করে নামায পড়বেন। অর্থাৎ তিনি হবেন রসূলুল্লাহর উম্মতের মধ্যে শামিল। (দ্বিতীয় খণ্ড, ১১৫ পৃষ্ঠা)

 

(৭) কাজী ইয়অয (মৃত্যু: ৫৪৪ হি) লিখেছেন: যে ব্যক্তি নিজে নবুয়্যাতের দাবী করে অথবাএ কথাকে বৈধ মনে করে যে, যে কোনো ব্যক্তি নিজের প্রচেষ্টায় নবুয়্যাত হাসিল করতে পারে এবং অন্তত পরিশুদ্ধির মাধ্যমে নবীর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে (যেমন কোনো কোনো দার্শনিক এবং বিকৃতমনা সূফী মনে করেন) এবং এভাবে যে ব্যক্তি নবুয়্যাতের দাবীকরেনা অথচ একথার দাবী জানায় যে, তার ওপর অহী নাযিল হয়, -এ ধরনের সমস্ত লোক কাফের এবং তারা রসূলুল্লাহর নবুয়্যাতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে। কেননা তিনি খবর দিয়েছেন যে, তিনি শেষ নবী এবং তাঁর পর কোনো নবী আসবে না এবং তিনি আল্লাহতায়ালার তরফ থেকে এ খবর পৌঁছিয়েছেন যে, তিনি নবুয়্যাতকে খতম করে দিয়েছেন এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে। সমগ্র মুসলিম সমাজ এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে কথাটির বাহ্যিক অর্থটিই গ্রহণীয় এবং এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে কথাটির বাহ্যিক অর্থটিই গ্রহণীয় এবং এর দ্বিতীয় কোনো অর্থ গ্রহণ করার সুযোগই এখানে নেই। কাজেই উল্লিখিত দলগুলোর কাফের হওয়া সম্পর্কে কোরআন, হাদীস এবং ইজমার দৃষ্টিতে কোনো সন্দেহ নেই। (শিফা দ্বিতীয় খণ্ড, ২৭০-২৭১ পৃষ্ঠা)

 

(৮) আল্লামা শাহারিস্তানী (মৃত্যু: ৫৪৮ হি) তাঁর মশহুর কিতাব আল মিলাল ওয়ান নিহালে লিখেছেন: এবং যে এভাবেই বলে যে, “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পরও কোনো নবী আসবে (হযরত ঈসা (আ) ছাড়া) তাহলে তার কাফের হওয়া সম্পার্কে যে কোন দু’জন ব্যক্তি মধ্যেই কোনো মতবিরোধ থাকতে পারে না। (তৃতীয় খণ্ড ২৪৯ পৃষ্ঠা)

 

(৯) ইমাম রাজী (৫৪৩-৬০৬ হি) তাঁর তাফসীরে কবীরে ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’ শব্দের ব্যাখ্যা প্রসংগে বলেন: এ বর্ণনায় খাতিমুন নামিয়ীন শব্দ এজন্য বলা হয়েছে যে, যে নবীর পর অন্য কোনো নবী আসবেন তিনি যদি উপদেশ এবং নির্দেশাবলীর ব্যাখ্যার ব্যাপারে কিছু অতৃপ্তি রেখে যান, তাহলে তাঁর পর আগমনকারী নবীতা পূর্ণ করতে পারেন। কিন্তু যার পর আর কোনো নবী আসবে না, তিনি নিজের উম্মতের ওপর খুব বেশী স্নেহশীল হন এবং তাদেরকে সুস্পষ্ট নেতৃত্ব দান করেন। কেননা তাঁর দৃষ্টান্ত এমন একটি পিতার ন্যায় যিনি জানেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর পুত্রের দ্বিতীয কোনো অভিভাবক এবং পৃষ্ঠপোষক থাকবে না। (ষষ্ঠ খণ্ড, ৫৮১ পৃষ্ঠা)

 

(১০) আল্লামা বায়জাবী (মৃত্যু: ৬৮৫ হি) তাঁর তাফসীরে আনওয়ারুত্‌ তানজীল-এ লিখেছেন: অর্থাৎ তিনিই শেষ নবী। তিনি নবীদের সিলসিলা খতম করে দিয়েছেন। অথবা তাঁর কারণেই নবীদের সিলসিলার ওপর মোহর লাগানো হয়েছে। এবং তাঁর পর হযরত ঈসার (আ) নাযীল হবার কারণে খতমে নবুয়্যাতের ওপর কোনো দোষ আসছে না। কেননা তিনি রসূলুল্লাহর (স) দ্বীনের মধ্যেই নাযিল হবেন। (চতুর্থ খণ্ড, ১৬৪ পৃষ্ঠা)

 

(১১) আল্লামা হাফিজ উদ্দীন নাসাফী (মৃত্যু: ৮১০ হি) তাঁর তাফসীরে মাদারেকুত তানজীল-এ লিখেছেন: এবং রসূলুল্লাহ (স) খাতিমুন নাবিয়ীন। অর্থাৎ তিনিই সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আর কোনো ব্যক্তিকে নবী করা হবে না। হযরত ঈসা (আ) হলো এই যে, তাঁকে রসূলুল্লাহ্‌র পূর্বে নবীর পদে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এবং পরে যখন তিনি নাযিল হবেন, তখন তিনি হবেন রসূলুল্লাহর শরীয়তের অনুসারী। অর্থাৎ তিনি হবেন রসূলুল্লাহর উম্মত। (৪৭১ পৃষ্ঠা)

 

(১২) আল্লামা আলাউদ্দীন বাগদাদী (মৃত্যু: ৭২৬ হি) তাঁর তাফসীরে ‘খাজিন’-এ লিখেছেন: (আরবী *****) অর্থাৎ আল্লাহর রসূলুল্লাহ্‌র নবুয়্যাত খতম করে দিয়েছেন। কাজেই তাঁর পরে আর কোনো নবুয়্যাত নেই এবং এ ব্যাপারে কেউ তাঁর অংশীদারও নয়।

 

(আরবী ********) অর্থাৎ আল্লাহ একথা জানেন যে, তাঁর পর আর কোনো নবী নেই’ (৩৭১-৪৭২ পৃষ্ঠা)

 

(১৩) আল্লামা ইবনে  কাসীর (মৃত্যু: ৭৭৪ হি) তাঁর মশুহর তাফসীরে লিখেছেন: অতঃপর আলোচ্য আয়াত থেকে একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, যখন রসূলুল্লাহ্‌র পর কোনো নবী নেই, তখন অপর কোনো রসূলের প্রশ্নই উঠতে পারে না। কেননা রিসালাত একটা বিশেষ পদমর্যাদা এবং নবুয়্যাতের পদমর্যাদা এর চাইতে বেশী সাধারণধর্মী। প্রতেক রসূল নবী হন, কিন্তু প্রত্যেক নবী রসূল হন না। রসূলুল্লাহর পর যে ব্যক্তিই এই পদমর্যাদার দাবী করবে, সেই হবে মিথ্যাবাদী, প্রতারক, দাজ্জাল এবং গোমরাহ। যতোই সে প্রাকৃতিক নিয়মে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ও যাদুর ক্ষমতাসম্পন্ন হোক না কেন, তার দাবী মানবার নয়। কিয়ামত পর্যন্ত যেসব ব্যক্তি এই পদমর্যাদার দাবী করবে, তাদের প্রত্যেকেরই অবস্থা হবে এই ধরনের। (তৃতীয় খণ্ড, ৪৯৩-৪৯৪ পৃষ্ঠা)

 

(১৪) আল্লামা জালালুদ্দীন সিউতী (মৃত্যু: ৯১১ হি) তাঁর তাফসীরে জালালায়েন-এ লিখেছেন: ‘অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা জানেন যে রসূলুল্লাহর (স) পর আর কোনো নবী নেই। এবং হযরত ঈসা (আ) নাযীল হবার পর রসূরুল্লাহর শরীয়ত মোতাবেকই আমল করবেন।’ (৭৬৮ পৃষ্ঠা)

 

(১৫) আল্লামা ইবনে নাজীম (মৃত্যু: ৯৭০ হি) উসুলে ফিকাহর বিখ্যাত পুস্তক আল ইশবাহ ওয়ান নাজায়েরে ‘কিতাবুস সিয়ারের’ ‘বাবুর রুইয়ায়’ লিখেছেন: যদি কেউ একথা না মনে করে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম শেষ নবী, তাহলে সে মুসলমান নয়। কেননা কথাগুলো জানা এবং স্বীকার করে নেয়া দ্বীনের অত্যধিক প্রয়োজনের মধ্যে শামিল। (১৭৯ পৃষ্ঠা)

 

(১৬) মুল্লা আলী কারী (মৃত্যু: ১০১৬ হি) ‘শারহে ফিকহে আকবর’-এ লিখেছেন: ‘আমাদের রসূলের (স) পর অন্য কোনো ব্যক্তির নবুয়্যাতের দাবী করা সর্ববাদীসম্মতভঅবে কুফর। (২০২ পৃষ্ঠা)

 

(১৭) শায়খ ইসমাইল হাক্কী (মৃত্যু: ১১৩৭ হি) তাফসীরে রুহুল বয়ান-এ উল্লিখিত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন: আলেম সমাজ ‘খাতাম’ শব্দটির তে-এর উপর জবর লাগিয়ে পড়েছেন, -এর অর্থ হয় খতম করবার যন্ত্র, যার সাহায্যে মোহর লাগানো হয়।

 

অর্থাৎ রসূলুল্লাহ (স) সমস্ত নবীর শেষে এসেছেন এবং তাঁর সাহায্যে নবীদের সিলসিলার ওপর মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ফারসীতে আমরা একে বলবো ‘মোহর পয়গম্বর’ অর্থাৎ তাঁর সাহায্যে নবুয়্যাতের দরজার মোহর লাগিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং পয়গম্বরদের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে। অন্য পাঠকরাতো এর নীচে জের লাগিয়ে পড়েছেন ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’। অর্থাৎ রসূলুল্লাহ্‌ ছিলেন মোহর দানকারী। অন্য কথায় বলা যাবে পয়গম্বরদের ওপর মোহরকারী। এভাবে এ শব্দার্থ ‘খাতাম’-এর সমার্থক হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে রসূলুল্লাহর (স) পর তাঁর উম্মতের আলেম সমাজ তাঁর কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাবেনএকমাত্র তাঁর প্রতিনিধিত্ব। তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথেই নবুয়্যাতের উত্তরাধিকারেরও পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং তাঁর পরে হযরত ঈসার (আ) নাযিল হবার ব্যাপারটি তাঁর নবুয়্যাতকে ত্রুটিযুক্ত করবেনা। কেননা খাতিমুন নাবিয়ীন হবার অর্থ হলো এই যে, তাঁর পর আর কাউকে নবী বানানো হবেনা এবং হযরত ঈসাকে (আ) তাঁদের পূর্বেই নবী বানানো হয়েছে। কাজেই তিনি রসূলুল্লাহ্‌র অনুসারীর মধ্যে শামিল হবেন, রসূলুল্লাহর কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়বেনএবং তাঁরই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হবেন। তখন হযরত ঈসার (আ) নিকট অহী নাযীল হবেনা এবং তিনি কোনোনতুন আহকামও জারি করবনে না, বরং তিনি হবেন রসূলুল্লাহর প্রতিনিধি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এ ব্যাপারে একমত যে, আমাদের নবীর পর আর কোনো নবী নেই। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেছেন: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম শেষ নবী। এবং রসূলুল্লাহ বলেছেন: আমার পরে কোনো নবী নেই। কাজেই এখনযে বলবে যে মুহাম্মদ (স) এর পর নবী আছে, তাকে কাফের বলা হবে। কেননা সে কোরআনকে অস্বীকার করেছে এবং অনুরূপভবেসেই ব্যক্তিকেও কাফের বলা হবে যে এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে। কেননা সুস্পষ্ট যুক্তি প্রমাণের পর হক বাতিল থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এবং যে ব্যক্তি মুহাম্মদ (স)-এর পর নবুয়্যাতের দাবী করবে, তার দাবী বাতিল হয়ে যাবে। (দ্বাবিংশ খণ্ড, ১৮৮ পৃষ্ঠা)

 

(১৮) শাহানশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীরের নির্দেশে বার’শ হিজরীতে পাক-ভারতের বিশিষ্ট আলেমগণ সম্মিলিতভাবে ‘ফতোয়া আলমগিরী’ নামে যে কিতাবটি লিপিবদ্ধ করেন তাতে উল্লিখিত হয়েছে: যদি কেউ মনে করে যে, মুহাম্মদ (স) শেষ নবী নয়, তাহলেসে মুসলমান নয় এবং যদি সে বলে যে, সে আল্লাহর রসূল অথবা পয়গম্বর, তাহলে তার ওপর কুফরীর ফতোয়া দেয়া হবে। (দ্বিতীয়খণ্ড, ২৬৩ পৃষ্ঠা)

 

(১৯) আল্লামা শওকানী (মৃত্যু: ১২৫৫ হি) তাঁর তাফসীর ফাতহুল কাদীরে লিখেছেন: সমগ্র মুসলিম সমাজ ‘খাতিম’ শব্দটির তে-এর নীচে জের লাগিয়ে পড়েছেন এবং একমাত্র আসে জবরের সাথে পড়েছেন। প্রথমটা অর্থ হলো এই যে, রসূলুল্লাহ সমস্ত পয়গম্বরকে খতম করেছেন অর্থাৎ তিনি সবার শেষে এসেছেন এবং দ্বিতীয়টির অর্থ হলো এই যে, তিনি সমস্ত পয়গম্বরদের জন্য মোহর স্বরূপ্ এবং এর সাহায্যে নবীদের সিলসিলা মোহর এঁটে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে তাঁদের দলীটর সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছে। (চতুর্থ খণ্ড, ২৭৫ পৃষ্ঠা)

 

(২০) আল্লামা আলুসি (মৃত্যু: ১২৮০ হি) তাফসীরে রুহুল মায়ানীতে লিখেছেন: নবী শব্দটি রসূলের চাইতে বেশী সাধারণ অর্থব্যঞ্জক। কাজেই রাসূলের খাতিমুন নাবিয়ীন হবার অর্থ হলো এই যে, তিনি খাতিমুল মুরসালীনও। তিনি শেষ নবী এবং শেষ রসূল-একথার অর্থ হলো এই যে, দুনিয়ায় তাঁর নবুয়্যাতের গুণে গুণান্বিত হবার পরেই মানুষ এবং জিনের মধ্য থেকে এ গুণটি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। (দ্বাবিংশ খণ্ড, ৩২ পৃষ্ঠা)

 

রসূলুল্লাহর পর যে ব্যক্তি নবুয়্যাতের অহীর দাবী করবে, তাকে কাফের বলে গণ্য করা হবে। এ ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিমতের অবকাশ নেই। (দ্বাবিংশ খণ্ড, ৩৮ পৃষ্ঠা)

 

“রসূলুল্লাহ শেষ নবী-একথাটি কোরআন দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে, রসূলুল্লাহর সুন্নাত এটিকে সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করেছে এবং সমগ্র মুসলিম সমাজ এর ওপর আমল করেছে। কাজেই যে ব্যক্তি এর বিরোধী কোনো দাবী করবে, তাকে কাফের বলে গণ্য করা হবে।” (দ্বাবিংশ খণ্ড, ৩৯ পৃষ্ঠা)

 

বাংলা পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে মররোক্ত ও আন্দালুসিয়া এবং তুর্কী থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ আলেম, ফকীহ, মুহাদ্দিস এবং তাফসীরকারগণের ব্যাখ্যা এবং মতামত আমি এখানে উল্লেখ করলাম। তাঁদের নামের সাথে সাথে তাঁদের জন্ম এবং মৃত্যু তারিখও উল্লেখ করেছি। এ থেকেই ধারণা করা যাবে যে, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ আলেমগণ এর মধ্যে শামিল আছেন। হিজরীর চতুর্দশ শতাব্দীর আলেম সমাজের মতামতও আমি এখানে উল্লেখ করতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছা করেই তাঁদেরকে ছেড়ে দিয়েছি। কেননা তাঁরা মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর সমসাময়িক। এবং হয়তো অনেকে বলতে পারেন যে, মীর্জা সাহেবের বিরোধিতার মনোভাব নিয়েই তাঁরা খতমে নবুয়্যাতের এই অর্থ বিবৃত করেছেন। এজন্য মীর্জা সাহেবের পূর্ববর্তী যুগের আলেম সমাজের মতামতের উদ্ধৃতিই এখানে পেশ করেছি- যেহেতু মীর্জা সাহেবের সাথে তাঁদের বিরোধের প্রশ্নই উঠতে পারে না। এইসব মতামত থেকে একথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সমগ্র মুসলিমজাহান একযোগে খাতিমুন নাবিয়ীন শব্দের অর্থ নিয়েছে শেষ নবী। প্রত্যেক যুগের মুসলমানই এই একই আকীদা পোষণ করেছেন যে, রসূলুল্লাহর পর নবুয়্যাতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। একথা তাঁরা একযোগে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পর নবী অথবা রসূল হবার দাবী করেএবং যে তার দাবীকে মেনে নেয়, সে কাফের হয়ে যায়, এ ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোনো যুগে তুচ্ছতম মতবিরোধেরও সৃষ্টি হয়নি। কাজেই এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিই ফায়সালা করতে পারেন যে, ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’ শব্দের যে অর্থ আরবী অভিধান থেকে প্রমাণিত হয়, কোরআনের আয়াতের পূর্বাপর বর্ণনা থেকে যে অর্থ প্রতীয়মান হয়, রসূলুল্লাহ (স) নিজেই যা ব্যাখ্যা করেছেন, সাহাবায়ে কেরাম যে সম্পর্কে মতৈক্য পোষণ করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র মুসলিমসমাজ একযোগে দ্ব্যার্থহীনভাবে যা স্বীকার করে আসছেন, তার বিপক্ষে দ্বিতীয় কোনো অর্থ গ্রহণ অর্থাৎ কোনো নতুন দাবীদারের জন্য নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত করার অবকাশ ও সুযোগ থাকে কি? এবং এই ধরনের লোকদেরকে কেমন করে মুসলমান বলে স্বীকার করা যায়, যারা নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত করার নিছক ধারণাই প্রকাশ করেনি বরং ঐ দরজা দিয়ে এক ব্যক্তি নবুয়্যাদের দালানে প্রবেশ করেছে এবং তারা তার ‘নবুয়্যাতের’ ওপর ঈমান পর্যন্ত এনেছে?

 

এ ব্যাপরে তিনটি কথা বিবেচনা করতে হবে।

 

আমাদের ঈমানের সংগে খোদার কি কোনো শত্রুতা আছে?

 

প্রথম কথা হলো এই যে, নবুয়্যাতের ব্যাপারটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনের দৃষ্টিতে এ বিষয়টি ইসলামের বুনিয়াদী আকিদার অন্তর্ভুক্ত, এটি স্বীকার করার বা না করার ওপর মানুষের ঈমান ও কুফরী নির্ভর করে। যদি কোনো ব্যক্তি নবী থাকেন এবং লোকেরা তাঁকে না মানে, তাহলে তারা কাফের হয়ে যায়। আবার কোনো ব্যক্তি নবী না হওয়া সত্ত্বেও যারা তাকে নবী বলে স্বীকার করে, তারাও কাফের হয়ে যায়। এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে যে কোনো প্রকার অসতর্কতার আশা করা যায় না। যদি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পর কোনো নবী আসার কথা থাকতো তাহলে আল্লাহ নিজেই কোরআনে স্পষ্ট এবং দ্ব্যার্থহীন ভাষায় তা ব্যক্ত করতেন, রসূলুল্লাহর মাধ্যমে প্রকাশ্যভাবে তা ঘোষণা করতেন এবং রসূলুল্লাহ কখনো এ দুনিয়া থেকে তাশরীফ নিয়ে যেতেন না; যতক্ষণ না তিনি সমগ্র উম্মতকে এ ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত করতেন যে, তাঁর পর আরো নবী আসবেন এবং আমরা সবাই তাঁদেরকে মেনে নিতে বাধ্য থাকবো। রসূলুল্লাহর পর নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত থাকবে এবং এই দরজা দিয়ে কোনো নবী প্রবেশ করবে, যার ওপর ঈমান না আনলে আমরা মুসলমান থাকতে পারি না অথচ আমাদেরকে এ সম্পর্কে শুধু বেখবরই রাখা হয়নি বরং বিপরীতপক্ষে আল্লাহ এবং তাঁর রসূল একযোগে এমন সব  কথা বলেছৈন, যার ফলে তের’শ বছর পর্যন্ত সমস্ত উম্মত একথা মনে করেছিলো এবং আজও মনে করে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পর আর কোনো নবী আসবেন না- আমাদের সাথে আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের এ ধরনের ব্যবহার কেন? আমাদের দ্বীন এবং ঈমানের বিরুদ্ধে আল্লাহ এবংতাঁর রসূলের তো কোনো শত্রুতা নেই!

 

তর্কের খাতিরে যদি একথা মেনে নেয়া যায় যে, নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত আছে এবং কোনোনবী আসার পর আমরা যদি নির্ভয়ে এবং নিশ্চিন্তে তাঁকে অস্বীকার করে বসি, তাহলে ভয় থাকতে পারে একমাত্র আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসাবাদের! কিন্তু কিয়ামতের দিনতিনি আমাদের নিকট থেকে এ সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করলে, আমরা সোজাসুজি উল্লিখিত রেকর্ডগুলো তাঁর আদালতে পেশকরবো। এ থেকে অন্তত প্রমাণহয়েযাবে যে, (মায়াযাল্‌লাহ) আল্লাহ্‌র কিতাব এবং রসূলের সুন্নাতই আমাদেরকে এই কুফরীর মধ্যে নিক্ষেপ করছে! আমরা নির্ভয়ে বলতে পারি যে, এইসব রেকর্ড দেখার পর কোনো নতুন নবীর ওপর ঈমান না আনার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে শাস্তি দেবেন না। কিন্তু যদি সত্যি সত্যি নবুয়্যাতের দরজাবন্ধ গিয়ে থাকে এবং কোনো নবুন নবী যদি না আসতে পারে এবং এইসব সত্ত্বেও কেউ কোনো নবুয়্যাতের দাবীদারদের ওপর যদি ঈমান আনে, তাহলে তার চিন্তা করা উচিত যে, এই কুফরীর অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য সে আল্লাহর দরবারে এমনকি রেকর্ড পেশ করতে পারবে, যার ফলে সে মুক্তি লাভের আশা করতে পারে। আদালতে হাযির হবার পূর্বে তার নিজের জবাবদিহির জন্য সংগৃহীত দলিল প্রমাণগুলো এখানেই বিশ্লেষণ করে নেয়া উচিত। এবং আমরা যেসব দলিল-প্রমাণ পেশ করেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিচার করা উচিত যে, নিজের জন্য যে সাফাইয়ের ওপর নির্ভল করে সে একাজ করছে, কোনো বুদ্ধিশান ব্যক্তি কি এর ওপর নির্ভর করে কুফরীর শাস্তি ভোগ করার বিপদকে স্বাগতম জানাতে পারে?

 

এখন নবীর প্রয়োজনটা কেন?

 

দ্বিতীয় কথা হলো এই যে, ইবাদাত এবংনেক কাজে তরক্কী করে কোনো ব্যক্তি নিজের মধ্যে নবুয়্যাতের গুণ পয়দা করতে পারে না। নবুয়্যাতের যোগ্যতা কোনো অর্জন করার জিনিস নয়। কোনো বিরাট খেদমতের পুরস্কার স্বরূপ মানুষকে নবুয়্যাত দান করা হয় না। বরং বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে এই মর্যাদা দান করে থাকেন। এই প্রয়োজনের সময় যখন উপস্থিত হয় তখনই আল্লাহতায়ালা এক ব্যক্তিকে এই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং যখন প্রয়োজন পড়ে না অথবা থাকে না, তখন খামাখা আল্লাহতায়ালা এক ব্যক্তিকে এই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং যখন প্রয়োজন পড়ে না অথবা থাকে না, তখন খামাখা আল্লাহতায়ালা নবীর পর নবী প্রেরণ করতে থাকেন না। কোরআন মজিদ থেকে যখন আমরা একথা জানবার চেষ্টা করি যে, কোন্‌ পরিস্থিতিতে নবী প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সেখানে এ ধরনের চারটি অবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়:

 

** কোনো বিশেষ জাতির মধ্যে নবী প্রেরণের প্রয়োজন এজন্য দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে ইতিপূর্বে কোন নবী আসেননি এবং অন্য কোনো জাতির মধ্যে প্রেরিত নবীর পয়গামও তাদের নিকট পৌঁছেনি।

 

** নবী পাঠাবার প্রয়োজন এজন্য দেখা যায় যে, সংশ্লিষ্ট জাতি ইতিপূর্বৈ প্রেরিত নবীদের শিক্ষা ভুলে যায় অথবা তা বিকৃত হয়ে যায় এবং তাঁদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।

 

**ইতিপূর্বে প্রেরিত নবীদের মাধ্যমে জনগণের শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি এবং দ্বীনের পূর্ণতার জন্য অতিরিক্ত নবীর প্রয়োজন হয়।

 

** কোনো নবীল সংগে তাঁর সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আর একজন নবীর প্রয়োজন হয়।

 

উপরের আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, রসূলুল্লাহ্‌র পর কোনো নবীর প্রয়োজন নেই।

 

কোরআন নিজেই বলছে যে, রসূলুল্লাহকে সমগ্র দুনিয়ার জন্য হেদায়াতকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে। দুনিয়ার সাংস্কৃতিক ইতহিাস একথা বলে যে, তাঁর নবুয়্যাত প্রাপ্তির পর থেকে সমগ্র দুনিয়ায় এমন অবস্থা বিরাজ করছে, যাতে করে তাঁর দাওয়াত সব সময় দুনিয়ার সকল জাতির মধ্যে পৌঁছতে পারে। এর পরেও প্রত্যেক জাতির মধ্যে পৃথক পৃথক পয়গাম্বর প্রেরণের কোনো প্রয়োজন থাকে না।

 

কোরআন একথাও বলে এবং একই সংগে হাদীস এবং সীরাতের যাবতীয় বর্ণনাও একথার সাক্ষ্যবহ যে, রসূলুল্লাহর শিক্ষা পুরোপুরি নির্ভুল এবং নির্ভেজাল আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে কোনো প্রকার বিকৃতি বা রদবদল হয়নি। তিনি যে কোরআন এনেছিলেন, তার মধ্যে আজ পর্যন্ত একটি শব্দেরও কম-বেশী হয়নি। এবং কিয়ামত পর্যন্তও তা হতে পারে না। নিজের কথা ও কর্মের মাধ্যমে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাও আজ আমরা এমনভাবে পেয়ে যাচ্ছি, যেন আমরা তাঁরই যুগে বাস করছি। কাজেই দ্বিতীয় প্রয়োজনটাও খতম হয়ে গেছে।

 

আবার কোরআন মজীদ স্পষ্টভাষায় একথাও ব্যক্ত করে যে, রসূলুল্লাহর মাধ্যমে খোদার দ্বীনকে পূর্ণতা দান করা হয়েছে। কাজেই দ্বীনের পূর্ণতার জন্যও এখন আর কোনো নবীর প্রয়োজন নেই।

 

এখন বাকি থাকে চতুর্থ প্রয়োজন। এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য হলো এই যে, এজন্য যদি কোনো নবীর প্রয়োজন হতো তাহলে রসূলুল্লাহর যুগে তাঁর সংগেই তাকে প্রেরণ করা হতো।কিন্তু একথা সবাই জানেন যে, এমনকোনো নবী রসূলুল্লাহর যুগে প্রেরণ করা হয়নি কাজেই এ কারণটা বাতিল হয়ে গেছে।

 

এখন আমরা জানতে চাই যে, রসূলুল্লাহর পর আর একজন নতুন নবী আসবার পঞ্চম কারণটা কি? যদি কেউ বলেন যে, সমগ্র উম্মত বিগড়ে গেছে, কাজেই তাদের সংস্কারের জন্য আর একজন নতুন নবীর প্রয়োজন, তাহলে তাকে আমরা জিজ্ঞেস করবো: নিছক সংস্কারের জন্য দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত কি কোন নবী এসেছে যে শুধু এই উদ্দেশ্যেই আর একজন নতুন নবীর আবির্ভাব হলো? অহী নাযিল করার জন্যই তো নবী প্রেরণ করা হয়। কেননা নবীর নিকটেই অহী নাযিল করা হয়। আর অহীর প্রয়োজন পড়ে কোনো নতুন পয়গাম দেবার অথবা পূর্ববর্তী পয়গামকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। আল্লাহর কোরআন এবং রসূলুল্লাহর সুন্নাত সংরক্ষিত হয়ে যাবার পর যখন আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণ হয়েগেছে এবং অহীর সমস্ত সম্ভাব্য প্রয়োজন খতম হয়ে গেছে, তখন সংস্কারের জন্য একমাত্র সংস্কারকে প্রয়োজনই বাকী রয়ে গেছে- নবীর প্রয়োজন নয়।

 

নতুন নবুয়্যাত বর্তমানে মুসলমানদের জন্য রহমত নয়, লা’নতের শামিল

 

তৃতীয় কথা হলো এই যে, যখনই কোনো জাতির মধ্যে নবীর আগমন হবে, তখনই সেখানেই প্রশ্ন উঠবে কুফর ও ঈমানের। যারা ঐ নবীকে স্বীকার করে নেবে, তারা এক উম্মতভুক্ত হবে এবং যারা তাকে অস্বীকার করবে তারা অবশ্যই একটি পৃথক উম্মতের শামিল হবে। এই দুই উম্মতের মতবিরোধ কোনোআংশিক মতবিরোধের পর্যায়ে নেমে আসবে, যার ফলে তাদের একটি দল যতদিন না নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করবে, ততদিন পর্যন্ত তারা দুই দল কখনো একত্রিত হতে পারবে না। এ ছাড়াও কার্যত তাদের প্রত্যেকের জন্য হেদায়াত এবং আইনের উৎস হবে বিভিন্ন। কেননা একটি দল তাদের নিজেদের নবীর অহী এবং সুন্নাত থেকে আইন প্রণয়ন করবে এবং দ্বিতীয়দলটি এদু’টিকে তাদের আইনের উৎস হিসেবে মেনে নিতেই প্রথমত অস্বীকার করবে। কাজেই তাদের উভয়ের সম্মিলনে একটি সমাজ সৃষ্টি কখনো সম্ভব হবেনা।

 

এই প্রোজ্জ্বল সত্যগুলো পর্যবেক্ষণ করার পর যে কোনো ব্যক্তি স্পষ্ট বুঝতে পারবেন যে, ‘খত্‌মে নবুয়্যাত’ মুসলিম জাতির জন্য আল্লাহ তায়ালার একটি বিরাট রহমত স্বরূপ। এর বদৌলতেই সমগ্র মুসলিম জাতি একটি চিরন্তন বিশ্বব্যাপী ভ্রাতৃত্বে শামিল হতে পেরেছে। এ জিনিসটা মুসলমানদেরকে এখন সব মৌলিক মতবিরোধ থেকে রক্ষা করেছে, যা তাদের মধ্যে চিরন্তন বিচ্ছেদের বীজ পবন করতো। কাজেই যেব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে হেদায়াত দানকারী এবং নেতা বলে স্বীকার করে এবং তিনি যে শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া অন্য কোন হেদায়াত উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায় না, সে আজ এই ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। নবুয়্যাতের দরজা বন্ধ না হয়ে গেলে মুসলিম জাতি কখনো এই ঐক্যের সন্ধান পেতোনা। কেননা প্রত্যেক নবীর আগমনের পর এ ঐক্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো।

 

মানুষের বিবেক-বুদ্ধিও একথাই সমর্থন করে যে, একটি বিশ্বজনীন এবং পরিপূর্ণ দ্বীন দিয়ে দেবার এবং তাকে সকল প্রকার বিকৃতি ও রদবদল থেকে সংরক্ষিত করার পর নবুয়্যাতের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়াই উচিত। এর ফলে সম্মিলিতভাবে এই শেষ নবীর আগমন করে সমগ্র দুনিয়ার মুসলমান চিরকালের জন্য একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারবে এবং বিনা প্রয়োজনে নতুন নতুন নবীদের আগমনে উম্মতের মধ্যে বারবার বিভেদ সৃষ্টি হতে পারবে না। নবী ‘যিল্লী’ হোক অথবা ‘বুরুজী ওম্মতওয়ালা শরীয়ত ওয়ালা এবং কিতাবওয়ালা- যে কোন অবস্থায়ই যিনি নবী হবেন এবং খোদার পক্ষহতে তাঁকে প্রেরণ করা হবে, তাঁর আগমনের অবশ্যম্ভাবী ফল দাঁড়াবে এই যে, তাকে যারা মেনে নেবে, তারা হবে একটি উম্মত আর যারা মানবেনা তারা কাফের বলে গণ্য হবে। যখন নবী প্রেরণের সত্যিকার প্রয়োজন দেখা যায়, তখন-শুধুমাত্র তখনই-এই বিভেদ অবশ্যম্ভাবী হয়। কিন্তু যখন তার আগমনের কোন প্রয়োজন থাকেনা, তখন খোদার হিকমত এবংতাঁর রহমতের নিকট কোনক্রমেই আশা করা যায়না যে, তিনি নিজের বান্দাদেরকে খামাখা কুফর ও ঈমানের সংঘর্ষে লিপ্ত করবেন এবং তাদেরকে সম্মিলিতভাবে একটি উম্মতভুক্ত হবার সুযোগ দেবেননা। কাজেই কোরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা থেকে যা কিছু প্রমাণিত হয়, মানুষের বিবেক-বুদ্ধিও তাকে নির্ভুল বলে স্বীকার করে এবং তাথেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান নবুয়্যঅতের দরজা বন্ধ থাকাই উচিত।

 

‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ এর তাৎপর্য

 

নতুন নবুয়্যাতের দিকে আহ্বানকারীরা সাধারণত অজ্ঞ মুসলমানদের বলে থাকে যে, হাদীসে ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ এর আগমনের খবর দেয়া হয়েছে। আর মসীহ নবী ছিলেন। কাজেই তাঁর আগমনের ফলে খতমে নবুয়্যাত কোনো দিক দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছেনা। বরং খত্‌মে নবুয়্যাত এবং ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ এর আগমন দুটোই সমপর্যায়ে সত্য।

 

এই প্রসংগে তারা আরো বলে যে, হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ নন। তাঁর মৃত্যু হয়েছে। হাদীসেযাঁর আগমনের খবর দেয়া হয়েছে তিনি হলেন ‘মসীলে মসীহ’ –অর্থাৎ হযরত ঈসার অনুরূপ একজন মসীহ। এবং তিনি ‘অমুক’ ব্যক্তি যিনি সম্প্রতি আগমন করেছেন। তাঁকে মেনে নিলে খত্‌মে নবয়্যাত বিশ্বাসের বিরোধিতা করা হয়না।

 

এই প্রতারণার পর্দা ভেদ করবার জন্য আমি এখানে হাদীসের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো থেকে এই ব্যাপারে উল্লিখিত প্রমাণ্য হাদীস সমূহ সূত্রসহ নকল করছি। এই হাদীসগুলো প্রত্যক্ষ করে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারবেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কি বলেছিলেন এবং আজ তাকে কিভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে।

 

হযরত ঈসা (আ) নুযুল সম্পর্কিত হাদীস

 

(আরবী **********)

 

(১) হযরত আবু হোরায় (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন: সেই মহান সত্তার কছম যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ইবনে মরিয়ম ন্যায়বিচারক শাসকরূপে অবতীর্ণ হবেন। অতঃপর তিনি ক্রশ ভেঙ্গে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন। [ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলার এবং শুকর হত্যা করার অর্থ হলো এই যে, একটি পৃথক ধর্ম হিসেবে ধর্মের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ঈসায়ী ধর্মের সমগ্র কাঠামো এই আকীদার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর একমাত্র পুত্রকে (অর্থাৎ হযরত ঈসাকে (আ) ক্রশে বিদ্ধ কলে ‘লানত’ পূর্ণ মৃত্যু দান করেছেন। এবং এতেই সমস্ত মানুষেরগোনাহর কাফ্‌ফারা হয়ে গেছে। অন্যান্য নবীদের উম্মতের সংগে ঈসায়ীদের পার্থক্য হলো এই যে, এরা শুধু আকীদাটুকু গ্রহণ করেছে, অতঃপর খোদার সমস্ত শরীয়ত নাকচ করে দিয়েছে। এমনকি শুকরকেও এরা হালাল করে নিয়েছে- যা সকল নবীর শরীয়তে হারাম।

 

কাজেই হযরত ঈসা (আ) নিজে এসে যখন বলবেন, আমি খোদার পুত্র নই, আমাকে ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়নিএবং আমি কারুর গোনাহর কাফফারা হইনি, তখন ঈসায়ী ধর্মবিশ্বাসের বুনিয়াদ সমূলে উৎপাটিত হবে। অনুরূপভাবে যখন তিনি বলবেন, আমার অনুসারীদের জন্র আমি শুকুর হালাল করিনি এবং তাদেরকে শরীয়তের বিধিনিষেধ থেকে মুক্তিও দেইনি, তখন ঈসায়ী ধর্মের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যও নির্মূল হয়ে যাবে।

 

অন্য কথায় বলা যায়, তখন ধর্মের বৈষম্য ঘুচিয়ে মানুষ একমাত্র দ্বীন ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হবে। এর ফলে আর যুদ্ধের প্রয়োজন হবেনা এবং কারুর জিজিয়াও আদায় করা হবেনা। পরবর্তী ৫ এবং ১৫ নং হাদীস একথাই প্রমাণ করেছে।] এবং যুদ্ধ খতম করে দেবেন (বর্ণনান্তরে যুদ্ধের পরিবর্তে ‘জিজিয়া’ শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে অর্থাৎ জিজিয়া খতম করে দেবেন)। তখন ধনের পরিমাণ এতো বৃদ্ধি পাবে যে, তা গ্রহণ করার লোক থাকবে না এবং (অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছবে যে, মানুষখোদার জন্য) একটি সিজদা করে নেয়াটাকেই দুনিয়া এবং দুনিয়ার বস্তুর চাইতে বেশী মূল্যবান মনে করবে।

 

(২) অন্য একটি হাদীসে হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেন যে (আরবী **********)

 

ঈসা ইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না....” এবং এর পর বলা হয়েছে তা উপরোল্লিখিত হাদীসের সংগে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল।– (বুখারী, কিতাবুল মাজালেম, বাবু কাসরিক সালিব, ইবনে মাজা, কিতাবুল ফিতান, বাবু ফিতনাতিদ দাজ্জাল)

 

(আরবী **********)

 

(৩) হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স) বলেন, কেমনহবে তোমরা যখন তোমাদের মধ্যে ইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ হবেন এবং তোমাদের ইমাম নিজেদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হবেন? [অর্থাৎ হযরত ঈসা (আ) নামাজে ইমামতি করবেননা। মুসলমানদের পূর্ব নিযুক্ত ইমামের পেছনে তিনি এক্তেদা করবেন।]

 

(আরবী **********)

 

(৪) হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেন: ঈসাইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ হবেন। অতঃপর তিনি শুকর হত্যা করবেন। ক্রুশ ধ্বংস করবেন। তাঁর জন্য একাধিক নামাজ এক ওয়াক্তে পড়া হবে। তিনি এতো ধন বিতরণ করবেন যে, অবশেষে তা গ্রহীতা পাওয়া যাবে না। তিনি খিরাজ মওকুফ করে দেবেন। রওহা [রওহা মদীনা থেকে ২৫ মাইল দূরে একটি স্থানের নাম।] নামক স্থানে অবস্থান করেতিনি সেখান থেকে হজ্ব অথবা ওমরাহ করবেন অথবা দুটোই করবেন। (রসূলুল্লাহ এর মধ্যে কোন্‌টি বলেছিলেন- এ ব্যাপারে বর্ণনাকারীর সন্দেহ রয়ে গেছে)।

 

(আরবী **********)

 

(৫) হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, দাজ্জালের নির্গমন বর্ণনার পর রসূলুল্লাহ বলেন: ইত্যবসরে যখন মুসলমানরা তাঁর সংগে লড়াইয়ের প্রস্তুতি করতে থাকবে, কাতারবন্দি করতে থাকবে এবং নামাজের জন্য ‘একমত’ পাঠ করা শেষ হবে, তখন ঈসা ইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ হবেন এবং নামাজে মুসলমানদের ইমামতি করবেন। খোদার দুশমন দাজ্জালতাঁকে দেখতেই এমনভাবে গলিত হতে থাকবে যেমন পানিতে লবণ গলে যায়। যদি ঈসা (আ) তাকে এই অবস্থায় পরিত্যাগ করেন, তাহলেও সে বিগলিত হয়ে মৃত্যু বরণ করবে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা তাকে হযরত ঈসার (আ) হাতে কতল করবেন। তিনি দাজ্জালের রক্তে রঞ্জিত নিজের বর্শাফলক মুসলমানদের দেখাবেন।

 

(আরবী **********)

 

(৬) হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন: আমার এবং তাঁর (অর্থাৎ হযরত ঈসার) মাঝখানে আর কোনো নবী নেই। এবং তিনি অবতীর্ণ হবেন। তাঁকে দেখা মাত্রই তোমরা চিনে নিয়ো। তিনি মাঝারি ধরনের লম্বা হবেন। বর্ণ লাল সাদায় মেশানো। পরনে দু’টো হলুদ রঙের কাপড়। তাঁর মাথার চুল থেকে মনে হবে এই বুঝি পানি টপকে পড়লো। অথচ তা মোটেই সিক্ত হবেনা। তিনি ইসলামের জন্য মানুষের সংগে যুদ্ধ করবেন। ক্রুশ ভেঙ্গে টুক্‌রো টুক্‌রো করবেন। শূকর হত্যা করবনে। জিজিয়া কর রহিত করবেন। তাঁর জামানায় আল্লাহ সমস্ত মিল্লাতকেই নির্মূল করবেন। তিনি মসীহ দাজ্জালকে হত্যা করবেন এবং দুনিয়া চল্লিশ বছর অবস্থান করবেন। অতঃপর তাঁর ইন্তেকাল হবে এবং মুসলমানরা তাঁর জানাযায় নামাজ পড়বে।

 

(আরবী **********)

 

(৭) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, আমি রসূলুল্লাহকে (স) বলতে শুনেছি:... অতঃপর ঈসা ইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ হবেন। মুসলমানদের আমীর তাঁকে বলবেন, আসুন, আপনি নামাজ পড়ান। কিন্তু তিনি বলবেন, না, তোমরা নিজেরাই একে অপরের আমীর। [অর্থাৎ তোমাদের আমীর তোমাদের নিজেদের মধ্যথেকে হওয়া উচিত।] আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতকে যে ইজ্জত দান করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একথা বলবেন।

 

(আরবী **********)

 

(৮) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (ইবনে সাইয়াদ প্রসংগে) বর্ণনা করেছেন যে, অতঃপর উমর ইবনে খাত্তাব আরজ করলেন, হে রসূলুল্লাহ। অনুমতি দিন, আমি তাকে কতল করি। রসূলুল্লাহ (স) বললেন, যদি এ সেই ব্যক্তি (অর্থাৎ দাজ্জাল) হয়ে থাকে, তাহলে তোমরা এর হত্যাকারী নও, বরং ঈসা ইবনে মরিয়ম একে হত্যা করবেন এবং যদি এ সেই ব্যক্তি না হয়েথাকে, তাহলে জিম্মীদের মধ্য থেকে কাউকে হত্যা করার তোমাদের কোনো অধিকার নেই।

 

(আরবী **********)

 

(৯) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেন যে, (দাজ্জাল প্রসংগে রসূলুল্লাহ বলেছেন:) সেইসময় ঈসা ইবনে মরিয়ম হঠাৎ মুসলমানদের মধ্যে এসে উপস্থিত হবেন। অতঃপর লোকেরা নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে যাবে। তাঁকে বলা হবে, হে রুহুল্লাহ! অগ্রসর হন। কিন্তু তিনি বলবেন, না, তোমাদের ইমামের অগ্রবর্তী হওয়া উচিত, তিনিই নামাজ পড়াবেন। অতঃপর ফজরের নামাজের পর মুসলমানরা দাজ্জালের মুকাবিলায় বের হবে। (রসূলুল্লাহ) বলেছেন: যখন সেই কাজ্জাব (মিথ্যাবাদী) হযরত ঈসাকে দেখবে, তখন বিগলিত হতে থাকবে যেমন লবণ পানিতে গলে যায়। অতঃপর তিনি দাজ্জালের দিকে অগ্রসর হবেন এবং তাকে কতল করবেন। তখন অবস্থা এমন হবে যে, গাছপালা এবং প্রস্তরখন্ড ফুকারে বলবে, হে রুহুল্লাহ! ইহুদীটা এই আমার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে! দাজ্জালের অনুগামীদের কেউ বাঁচবেনা, সবাইকে কতল করা হবে।

 

(আরবী **********)

 

(১০) হযরত নওয়াস ইবনে সাময়ান কেলাবী (দাজ্জাল প্রসংগে) বর্ণনা করছেন যে, (রসূলুল্লাহ বলেছেন:) দাজ্জাল তখন এসব করতে থাকবে, ইত্যবসরে আল্লাহতায়ালা মসীহ ইবনে মরিয়মকে প্রেরণ করবেন। তিনি দামেশকের পূর্ব অংশে সাদা মিনারের সন্নিকটে দুটো হলুদ বর্ণের কাপড় পরিধান করে দুজনফেরেশতার কাঁধে হাত রেখে নামাবেন। তিনি মাথা নীচু করলে পানি টপকাচ্ছে বলে মনে হবে। আবার মাথা উঁচু করলে মনে হবে যেন বিন্দু বিন্দু পানি মোতির মতো চমকাচ্ছে। তাঁর নিঃশ্বাসের হাওয়া যে কাফেরের গায়ে লাগবে- এবং এর গতি হবে তাঁর দৃষ্টিসীমাপর্যন্ত-সে জীবিত থাকবে না। অতঃপর ইবনে মরিয়ম দাজ্জালের পশ্চাদ্ধাবন করবেন এবং লুদের [এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, লূদ (Lydda) ফিলিস্তিনের অন্তর্গত বর্তমান ইসরাঈল রাষ্ট্রের রাজধানী তেলআবীব থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। ইহুদীরা এখানে একটি বিরাট বিমান বন্দর নির্মাণ করেছে] দ্বারপ্রান্তে তাকে গ্রেফতার করে হত্যা করবেন।

 

(আরবী **********)

 

(১১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স)বলেন: দাজ্জাল আমার উম্মতের মধ্যে বের হবে এবং চল্লিশ (আমি জানিনা চল্লিশদিন, চল্লিশ মাস অথবা চল্লিশ বছর) [এটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমরের কথা] অবস্থান করবে। অতঃপর আল্লাহ ঈসা ইবনে মরিয়মকে পাঠাবেন।তাঁর চেহারা উরওয়া ইবনে মাসউদের (জনৈক সাহাবী) মতো। তিনি দাজ্জালের পশ্চাদ্ভাবন করবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। অতঃপর সাত বছর পর্যন্ত মানুষ এমন অবস্থায় থাকবে যে, দুজনলোকের মধ্যে শত্রুতা থাকবেনা।

 

(আরবী **********)

 

(১২) হযরত হোজায়ফা ইবনে আসীদ আল গিফারী (রা) বর্ণনা করেছেনযে, একবার রাসূলুল্লাহ (স) আমাদের মজলিসে তাশরীফ আনলেন। তখন আমরা নিজেদের মধ্যে আলোনায় লিপ্ত ছিলাম। রসূলুল্লাহ (স) জিজ্ঞেস করলেন: তোমরা কি আলোচনা করছো? লোকেরা বললো, আমরা কিয়ামতের কথা আলোচনা করছি। তিনি বললেন: দশটিনিশানা প্রকাশ না হবার পূর্বে তা কখনো কায়েম হবেনা। অতঃপর তিনি দশটি নিশানা বলে গেলেন। এক: ধোঁয়া, দুই: দাজ্জাল, তিন: মৃত্তিকার প্রাণী, চার: পশ্চিম দিক হতে সুর্যোদয়, পাঁচ ঈসা ইবনে মরিয়মের অবতরণ, ছয়: ইয়াজুজ ও মাজুজ, সাত: তিনটি প্রকাণ্ড জমি ধ্বংস (Landslide) একটি পূর্বে, আট: একটি পশ্চিমে, নয়: আর একটি আরব উপদ্বীপে, দশ: সর্বশেষ একটি প্রকাণ্ড অগ্নি ইয়েমেন থেকে উঠবে এবং মানুষকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে হাশরের ময়দানের দিকে।

 

(আরবী **********)

 

(১৩) রসূলুল্লাহর (স) আজাদকৃত গোলাম সাওবান (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ বলেন: আমার উম্মতের দু’টো সেনাদলকে আল্লাহতায়ালা দোজখের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে একটি হলো- যারা হিন্দুস্থানের ওপর হামলা করবে আর দ্বিতীয়টি ঈসা ইবনে মরিয়মের সংগে অবস্থানকারী।

 

(আরবী **********)

 

(১৪) মাজমা ইবনে জারিয়া আনসারী (রা) বলেন, আমি রসূলুল্লাহকে (স) বলতে শুনেছি: ইবনে মরিয়ম দাজ্জালকে লুদের দ্বারপ্রান্তে কতল করবেন।

 

(আরবী **********)

 

(১৫) আবু উমামা বাহেলী (এক দীর্ঘ হাদীসে দাজ্জাল প্রসংগে) বর্ণনা করেছেন যে, ফজরের নামায পড়বার জন্য মুসলমানদের ইমাম যখন অগ্রবর্তী হবেন, ঠিক সেইসময় ঈসা ইবনে মরিয়ম তাদের ওপর অবতীর্ণ হবেন। ইমাম পিছনে সরে আসবেনঈসাকে (আ) অগ্রবর্তী করার জন্য কিন্তু ঈসা (আ) তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলবেন: না, তুমিই নামাজ পড়াও। কেননা এরা তোমার জন্যই দাঁড়িয়েছে। কাজেই তিনিই (ইমাম) নামাজ পড়াবেন। সালাম ফেরার পরঈসা (আ) বলবেন: দরজা খোলো। দরজা খোলা হবে। বাইরে দাজ্জাল ৭০ হাজার সশষ্ত্র ইহুদী সৈন্য নিয়ে অপেক্ষা করবে। তার দৃষ্টি হযরত ঈসার (আ) ওপর পড়া মাত্রই সে এমনভাবে বিগলিত হতে থাকবে, যেমন লবণ পানিতে গলে যায়। এবং সে পৃষ্ঠদর্শন করবে। ঈসা (আ) বলবেন: আমার নিকট তোর জন্য এমন এক আঘাত আছে যার হাত থেকে তোর কোনক্রমেই নিষ্কৃতি নেই। অতঃপর তিনি তাকে লূদের পূর্ব দ্বারদেশে গিয়ে গ্রেফতার করবেন এবং আল্লাহতায়ালা ইহুদীদেরকে পরাজয়দান করবেন..... এবং জমিন মুসলমানদের দ্বারা এমনভাবে ভরপুর হবে যেমন পাত্র পানিতে ভরে যায়। সবাই একই কালেমায় বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং দুনিয়ায় আল্লাহ ছাড়া আর কারুর বন্দেগী করা হবেনা।

 

(আরবী **********)

 

(১৬) উসমান ইবনে আবিল আস (রা) বলেন, আমি রসূলুল্লাহকে (স) বলতে শুনেছি:...... এবংঈসা ইবনে মরিয়ম আলাইহিস সালাম ফজরের নামাজের সময় অবতরণ করবেন। মুসলমানদের আমীর তাঁকে বলবেন, হে রুহুল্লাহ! আপনি নামাজ পড়ান! তিনি জবাব দেবেন: এই উম্মতের লোকেরা নিজেরাই নিজেদের আমীর। তখন মুসলমানদের আমীর অগ্রবর্তী হয়ে নামায পড়াবেন। অতঃপর নামাজ শেষ করে ঈসা (আ) নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে দাজ্জালের দিকে অগ্রসর হবেন। তিনি নিজের অস্ত্র দিয়ে দাজ্জালকে কতল করবেন এবং তার দলবল পরাজিত হয়ে পৃষ্ঠপদর্শন করবে। কিন্তু কোথাও তারা আত্মগোপন করার জায়গা পাবেনা। এমন কি বৃক্ষও ফুকারে বলবে: হে মুমিন, এখানে কাফের লুকিয়ে আছে। এবং প্রস্তর খণ্ডও ফুকারে বলবে: হে মুমিন, এখানে কাফের লুকিয়ে আছে।

 

(আরবী **********)

 

(১৭) সামুরা ইবনে জুনদুব (এক দীর্ঘ হাদীসে) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স) বলেন: অতঃপর সকাল বেলা ঈসা ইবনে মরিয়ম মুসলমানদের মধ্যে আসবেন এবং আল্লাহতায়ালা দাজ্জাল এবং তার সেনাবাহিনীকে পরাজয় দান করবেন। এমন কি প্রাচীর এবং বৃক্ষের কাণ্ডও ফুকারে বলবে: হে মুমিন, এখানে কাফের আমার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে। এসো, একে কতল করো!

 

(আরবী **********)

 

(১৮) ইবনে হোসাইন বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমাদের উম্মতের মধ্যে হামেশা একটি দল হকের ওপর কায়েম থাকবে এবং তারা বিরোধী দলের ওপর প্রতিপত্তি বিস্তার করবে। অবশেষে আল্লাহতায়ালার ফয়সালা এসে যাবে এবং ঈসা ইবনে মরিয়ম আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হবেন।

 

(আরবী **********)

 

(১৯) হযরত আয়েশা রাজিআল্লাহ আন্‌হা (দাজ্জাল প্রসংগে) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ বলেন: অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হবেন। তিনি দাজ্জালকে কতল করবেন। অতঃপর ঈসা(আ) চল্লিশ বছর আদিল ইমাম এবং ন্যায়নিষ্ঠ শাসক হিসেবে দুনিয়ায় অবস্থান করবেন।

 

(আরবী **********)

 

(২০) রসূলুল্লাহর আজাদকৃত গোলাম সাফীনা (রা) (দাজ্জাল প্রসংগে) বর্ণনা করেছেন, যে রসূলুল্রাহ (স) বলেন: অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হবেন এবং আল্লাহতায়ালা উফায়েকের পর্বতে পথের [উফায়েককে বর্তমান ফায়েক বলা হয়। সিরিয়া এবং ইসরাইল সীমান্তে বর্তমান সিরিয়া রাষ্ট্রের সর্বশেষ শঞর। এর পরে পশ্চিমের দিকেকয়েক মাইল দূরে তাবারিয়া নামক একটি হ্রদ আছে। এখানে জর্দান নদরি উৎপত্তিস্থল। এর দক্ষিণ-পশ্চিমে পাহাড়েরর মধ্যভাগে নিম্ন ভূমিতে একটি রাস্তা রয়েছে। এই রাস্তাটি প্রায় দেড় হাজার ফুট গভীরে নেমে গিয়ে সেই স্থানে পৌঁছায় যেখানথেকে জর্দান নদী তাবারিয়া মথ্যহতে নির্গত হচ্ছে। এই পার্বত্য পথকেইবলা ‘আকাবায়ে উফায়েক” (উফায়েকের নিম্ন পার্বত্য পথ)।] সন্নিকটে তাকে (দাজ্জালকে) মেরে ফেলবেন।

 

(আরবী **********)

 

(২১) হযরত হোজায়ফা ইবনে ইয়ামান (দাজ্জাল প্রসংগে) বর্ণনা করেছেনযে, রসূলুল্লাহ বলেন: অতঃপর যখন মুসলমানরা নামাজের জন্য তৈরী হবে, তখন তাদের চোখের সম্মুখে ঈসা ইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ হবেন। তিনি মুসলমানদের নামাজ পড়াবেন অতঃপর সালাম ফিরিয়ে লোকদের বলবেন যে, আমার এবং খোদার এই দুশমনের মাঝখান থেকে সরেযাও.... এবং আল্লাহতায়ালা দাজ্জালের দলবলের ওপর মুসলমানদেরকে প্রতিপত্তি দান করবেন।

 

মুসলমানরা তাদেরকে বেধড়ক হত্যা করতে থাকবে। অবশেষে বৃক্ষ এবং প্রস্তর খণ্ডও ফুকারে বলবে: হে আল্লাহর বান্দা, হে রহমানেসর বান্দা, হে মুসলমান!দেখো, এখানে একজন ইহুদী, একে হত্যা করো। এভাবে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দেবেন এবং মুসলমানগণ বিজয় লাভ করবে। তারা ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলবে, শুকর হত্যা করবে এবং জিজিয়া মওকুফ করে দেবে। [মুসলিমেও হাদীসটি সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে এবং হাফেজ ইবনে হাজার আসকালীণ ফাতহুল বারীর ষষ্ঠ খণ্ডে ৫৫০ পৃষ্ঠায় এটিকে ‘ছহীহ’ বলে গণ্য করেছেন।

 

এই ২১টি হাদীস ১৪ জন সাহাবায়ে মারফত নির্ভুল সনদসহ হাদীসের নির্ভরযোগ্য কিতাবগেুলোয় উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও এ ব্যাপারে আরো অসংখ্য হাদীস অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু আলোচনা দীর্ঘ হবার ভয়ে আমি সেগুলো এখানে উল্লেখ করলাম না। বর্ণনা এবং সনদের দিক অধিকতর শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য হাদীসগুলোই শুধু এখানে উদ্ধৃত করলাম।

 

এই হাদীসগুলো থেকে কি প্রমাণ হয়?

 

যে কোনো ব্যক্তি এ হাদীসগুলো পড়ে নিজেই বুঝতে পারবেনযে, এখানে কোনো ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’, “মছীলে মসীহ” বা “বুরুজী মসীহ”র কোনো উল্লেখই করা হয়নি। এমন কি বর্তমান কালে কোনো পিতার ঔরসে মায়ের গর্ভ জন্মগ্রহণ করে কোনো ব্যক্তির একথা বলার অবকাশ নেই যে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম যে মসীহ সম্পর্কে ভবিষদ্বাণী করেছিলেন তিনিই সেই মসীহ। আজ থেকে দু’হাজার বছর আগে পিতা ছাড়াই হযরত মরিয়মের (আ) গর্ভে যে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম হয়েছিল এই হাদীসগুলোর দ্ব্যার্থহীন বক্তব্যথেকে তাঁরই অবতরণের সংবাদ শ্রুত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি ইন্তেকাল করেছেন, না জীবিত অবস্থায় কোথাও রয়েছেন- এ আলোচনা সম্পূর্ণ অবান্তর। তর্কের খাতিরে যদি এ কথা মেনে নেয়া হয় যে, তিনি ইন্তেকাল করেছেন তাহলেও বলা যায় যে, আল্লাহ তাঁকে জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন। [যারা আল্লাহর এই পুনরুজ্জীবনের ক্ষমতা অস্বীকার করেন তাদের সূরা বাকারার ২৫৯ নম্বর আয়াতটির অনুধাবন করাউচিত। এ আয়াতে আল্লাহ বলেন যে, তিনি তাঁর এক বান্দাকে ১০০ বছর পর্যন্ত মৃত অবস্থায় রাখার পর আবার তাকে জীবিত করেন।] উপরন্তু আল্লাহ তাঁর এক বান্দাকে তাঁর এই বিশাল সৃষ্টি জগতের কোনো এক স্থানে হাজার বছর জীবিত অবস্থায় রাখার পর নিজের ইচ্ছামতো যে কোনো সময়তাঁকে এই দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনতে পারেন। আল্লাহর অসীম ক্ষমতার প্রেক্ষিতে একথা মোটেই অস্বাভাবিক মনে হয়না। বলা বাহুল্য, যে ব্যক্তি হাদীসকে সত্য বলে স্বীকার করে তাকে অবশ্যই ভবিষ্যতে আগমনকারী ব্যক্তিকে উল্লিখিত ঈসা ইবনে মরিয়ম বলে স্বীকার করতেই হবে। তবে যে ব্যক্তি হাদীস অস্বীকার করে সে আদতে কোনো আগমনকারীর অস্তিত্বই স্বীকার করতে পারেনা। কারণ আগমনকারীর আগমন সম্পর্কে যে বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে হাদীস ছাড়া আর কোথাও তার ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কিন্তু এই অদ্ভূত ব্যাপারটি শুধু এখানেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আগমনকারীর আগমন সম্পর্কিত ধারণা বিশ্বাস গ্রহণ করা হচ্ছে হাদীস থেকে কিন্তু সেই হাদীসগুলোই আবার যখন সুস্পষ্ট করে এ বক্তব্য তুলে ধরছে যে, উক্ত আগমনকারী কোনো ‘মছীলে মসীহ’ (মসীহ-সম ব্যক্তি) নন বরং তিনি হবেন স্বয়ং ঈসা ইবনে মরিয়ম আলাইহস সালাম তখন তা অস্বীকার করা হচ্ছে।

 

এই হাদীসগুলো থেকে দ্বিতীয় যে বক্তব্যটি সুস্পষ্ট ও দ্ব্যার্থহীনভাবে ফুটে উঠেছে তা হচ্ছে এই যে, হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ) দ্বিতীয়বার নবী হিসেবে অবতরণ করবেন না। তাঁর ওপর অহী নাযিল হবেনা। খোদার পক্ষ থেকে তিনি কোনো নতুন বাণী বা বিধান আনবেন না। শরীয়তে মুহাম্মদীর মধ্যেও তিনি হ্রাস বৃদ্ধি করবেননা। দ্বীন ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্যও তাঁকে দুনিয়ায় পাঠানো হবে না। তিনি এসে লোকদেরকে নিজের ওপর ঈমান আনার আহ্বান জানাবেননাএবং তাঁর প্রতি যারা ঈমান আনবে তাদেরকে নিয়ে পৃথক উম্মতও গড়ে তুলবেননা। [পূর্বপবর্ত আলেমগণ এ বিষয়টিকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। আল্লামা আফ্‌তাবানী (হিঃ ৭২২-৭৯২) শরহে আকায়েদে নাসাফী গ্রন্থে লিখেছেন: “মুহাম্মদ (স) সর্বশেষ নবী, একথা প্রমাণিত সত্য... যদি বলা হয়, তাঁর পর হাদীসে হযরত ঈসার (আ) আগমনের কথা বর্ণিত হয়েছে তাহলে আমি বলবো, হাঁ হযরত ঈসা (আ) আগমনের কথা বলা হয়েছে সত্য, তবে তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের অনুসারী হবেন। কারণ তাঁর শরীয়ত বাতিল হয়ে গেছে। কাজেই তাঁর ওপর অহী নাযিল হবেনা এবং তিনি নতুন বিধানও নির্ধারণ করবেন না। বরং তিনি মুহাম্মদ রসূলুল্লাহর (স) প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন।” (মিসরে মুদ্রিত, ১৩৫ পৃষ্ঠা)

 

আল্লামা আলুসী তাঁর ‘রুহুল মা’নী’ নামক তাফসীর গ্রন্থেও প্রায় একই বক্তব্য পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন: “অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হবেন। তিনি অবশ্য তাঁর পূর্ব প্রদত্ত নবুয়্যাতের পদমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। কাণ তিনি নিজের আগের পদমর্যাদা থেকেতো অপসারিত হবেননা। কিন্তু নিজের পূর্বের শরীয়তের অনুসারী হবেননা। কারণ তা তাঁর নিজের ও অন্যসব লোকদের জন্য বাতিল হয়ে গেছে। কাজেই বর্তমানে তিনি মূলনীতি থেকে খুঁটিনাটি ব্যাপার পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের বিধানও নির্ধারণ করবেননা। “বরং তিনি মুহাম্মদ রসূলুল্লাহর (স) প্রতিনিধি এবং তাঁর উম্মতের মধ্যস্থিত মুহাম্মদী মিল্লাতের শাসকদের মধ্য থেকে একজন শাসক হবেন।”) (২২শ খণ্ড, ৩২ পৃষ্ঠা)

 

ইমাম রাজী এ কথাটিকে আরো সুস্পষ্ট করে নিম্নোক্ত ভাষায় পেশ করেছেন: “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম পর্যন্ত নবীদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের আগমনের পর নবীদের আগমন শেষ হয়ে গেছে। কাজেই বর্তমানে ঈসার (আ) অবতহরণের পর তিনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের অনুসারী হবেন একথা মোটেই অযৌক্তিক নয়।” (তাফসীরে কবীর, ৩য় খণ্ড, ৩৪৩ পৃষ্ঠা)] তাঁকে কেবলমাত্র একটি পৃথক দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠানো হবে। অর্থাৎ তিনি দাজ্জালের ফিত্‌নাকে সমূহে বিনাশ করবেন। এজন্য তিনি এমনভাবে অবতরণ করবেন যার ফলে তাঁর অবতরণের ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ থাকবেনা। যেসব মুসলমানের মধ্যে তিনি অবতরণ করবেন তারা নিঃসংশয়ে বুঝতে পারবে যে, রসূলুল্লাহ (স) যে ঈসা ইবনে মরিয়ম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনিই সেই ব্যক্তি এবং রসূলুল্লাহর কথা অনুযায়ী তিনি যথা সময়ে অবতরণ করেছেন, তিনি এসে মুসলমানদের দলে শামিল হয়ে যাবেন। মুসলমানদের তদানীন্তন ইমামের পিছনে তিনি নামাজ পড়বেন। [যদিও দুটি হাদীসে (৫ ও ২১ নং) বলা হয়েছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করার পর প্রথম নামাজটি নিজে পড়াবেন। কিন্তু অধিকাংশ এবং বিশেষ করে শক্তিশালী কতিপয় হাদীস (৩, ৭, ৯, ১৫ ও ১৬ নয়) থেকে জানা যায় যে, তিনি নামাজে ইমামতি করতে অস্বীকার করবেন এবং মুসলমানদের তৎকালীন ইমাম ও নেতাকে অগ্রবর্তী করবেন। মুহাদ্দিস ও মুফাস্‌সিরগণ সর্বসম্মতভাবে এ মতটি গ্রহণ করেছেন।] তৎকালে মুসলমানদের যিনি নেতৃত্ব দেবেন তিনি তাঁকেই অগ্রবর্তী করবেন যাতে এই ধরনের সন্দেহের কোনো অবকাশই না থাকে যে, তিনি নিজের পয়গম্বরী পদমর্যাদা সহকারে পুনর্বার পয়গম্বরীর দায়িত্ব পালন করার জন্য ফিরে এসেছেন। নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, কোনো দলে খোদার পয়গম্বরের উপস্থিতিতে অন্য কোনো ব্যক্তি ইমাম বা নেতা হতে পারেন না। কাজেই নিছক এক ব্যক্তি হিসেবে মুসলমানদের দলে তাঁর অন্তর্ভুক্তি স্বতঃস্ফুর্তভাবে এ কথাই ঘোষণা করবে যে, তিনি পয়গম্বর হিসেবে আগমন করেননি। এজন্যতাঁর আগমনে নবুয়্যাতের দুয়ার উন্মুক্ত হবার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা।

 

নিঃসন্দেহে তাঁর আগমন বর্তমান ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধানের আমলে প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের আগমনের সাথে তুলনীয়। এ অবস্থায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের অধীনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অংশগ্রহণ করতে পারন। সাধারণ বোধ সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি সহজেই এ কথা বুঝতে পারেন যে, এক রাষ্ট্রপ্রধানের আমলে অন্য একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের নিছক আগমনেই আইন ভেঙ্গে যায় না। তবে দুটি অবস্থায় আইনের বিরুদ্ধাচরণ অনিবার্য হয়ে পড়ে। এক, প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান এসে যদি আবার নতুন করে রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন। দুই, কোনো ব্যক্তি যদি তাঁর প্রধান রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা ও দায়িত্ব অস্বীকার করে বসেন। কারণ এটা হবে তাঁর রাষ্ট্র থাকাকালে যেসব কাজ হয়েছিল সেগুলোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার নামান্তর। এই দু’টি অবস্থার কোনো একটি না হলে প্রাক্তন রাষ্ট্র-প্রধানের নিছক আগমনেই আইনগত অবস্থাকে কোনো প্রকারে পরিবর্তিত করতে পারেনা। হযরত ঈসার (আ) দ্বিতীয় আগমনের ব্যাপারটিও অনুরূপ। তাঁর নিছক আগমনেই খতমে নবুয়্যাতের দুয়ার ভেঙ্গে পড়েনা। তবে তিনি এসে যদি নবীর পদে অধিষ্ঠিত হন এবং নবুয়্যাতের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন অথবা কোনো ব্যক্তি যদি তাঁর প্রাক্তন নবুয়্যাতের মর্যাদাও অস্বীকার করে বসে, তাহলে এক্ষেত্রে আল্লাহর নবুয়্যাত বিধি ভেঙ্গে পড়ে। হাদীসে একদিকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে যে, মুহাম্মদ রসূলুল্লাহর (স) পর আর কোনো নবী নেই এবং অন্যদিকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম পুনর্বার অবতরণ করবেন। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, তাঁর এ দ্বিতীয় আগমন নবুয়্যাতের দায়িত্ব পালন করার উদ্দেশ্যে হবেনা।

 

অনুরূপভাবে তাঁর আগমনে  মুসলমানদের মধ্যে কুফর ও ঈমানের কোনো নতুন প্রশ্ন দেখা দেবেনা। আজও কোনো ব্যক্তি তাঁর পূর্বের নবুয়্যাতের ওপর ঈমান না আনলে কাফের হয়ে যাবে। মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ (স) নিজেও তাঁর ঐ নবুয়্যাতের প্রতি ঈমান রাখতেন। মুহাম্মদ রসূলুল্লাহর (স) সমগ্র উম্মতও শুরু থেকেই তাঁর ওপর ঈমান রাখে। হযরত ঈসার (আ) পুনর্বার আগমনের সময়ও এই একই অবস্থা অপরিবর্তিত থাকবে। মুসলমানরা কোনো নতুন নবুয়্যাতের প্রতি ঈমান আনবে না, বরং আজকের ন্যায় সেদিনও তারা ঈসা ইবনে মরিয়মের (আ) পূর্বের নবুয়্যাতের ওপরই ঈমান রাখবে। এ অবস্থাটি বর্তমানে যেমন খতমে নবুয়্যাত বিরোধী নয়, তেমনি সেদিনও বিরোধীহবেনা।

 

সর্বশেষ যে কথাটি এই হাদীসগুলো এবং অন্যান্য বহুবিধ হাদীস থেকে আনা যায় তা হচ্ছে এই যে, হযরত ঈসাকে (আ) যে দাজ্জালের বিশ্বব্যাপী ফিত্‌না নির্মূল করার জন্য পাঠানো হবে সে হবে ইহুদী সংশোদ্ভূত। সে নিজেকে ‘মসীহ’ রূপে পেশ করবে। ইহুদীদের ইতিহাস ও তাদের ধর্মীয় চিন্তা-বিশ্বাস সম্পর্কে অনবহিত কোনো ব্যক্তি এ বিষয়টির তাৎপরর্য অনুধান করতে সক্ষম হবেনা। হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের মৃত্যুর পর যখন বনি ইসরাঈলরা সামাজিক ধর্মীয় অবক্ষয় ও রাজনৈতিক পতনের শিকার হলো এবং তাদের এ পতন দীর্ঘায়িত হতে থাকলো, এমন কি অবশেষে ব্যবিলেন ও আসিরিয়া অধিপতিরা তাদেরকে পরাধীন করে দেশ থেকে বিতাড়িত করলো এবং দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত করে দিলো, তখন বনি ইসরাইলের নবীগণ তাদেরকে সুসংবাদ দিতে থাকলেন যে, খোদার পক্ষ থেকে একজন ‘মসীহ’ এসে তাদেরকে এই চরম লাঞ্চনা থেকে মুক্তি দেবেন। এইসব ভবিষ্যদ্বাণীর প্রেক্ষিতে ইহুদীরা একজন মসীহের আগমনের প্রতীক্ষারত ছিল। তিনি হবেন বাদশাহ। তিনি যুদ্ধ করে দেশ জয় করবেন। বনি ইসরাঈলদেরকে বিভিন্ন দেশ থেকে এনে ফিলিস্তিনে একত্রিত করবেন এবং তাদের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কায়েম করবেন। কিন্তু তাদের এসব আশা-আকাংখাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ) খোদার পক্ষ থেকে ‘মসীহ’ হয়ে আসলেন এবং কোনো সেনাবাহিনী ছাড়াই আসলেন, তখন ইহুদীরা তাঁকে ‘মসীহ’ বলে মেনে নিতে অস্বীকার করলো। তারা তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত ইহুদী দুনিয়া সেই প্রতিশ্রুত মসীহর প্রতীক্ষা করছে, যার আগমনের সুসংবাদ তাদেরকে দেয়া হয়েছিল। তাদের সাহিত্য সেই বাঞ্চিত যুগের সুখ-স্বপ্ন কল্প-কাহিনীতে পরিপূর্ণ। তালমুদ ও রাববীর সাহিত্য গ্রন্থসমূহে এর যে নক্‌শা তৈরী করা হয়েছে তার কল্পিত স্বাদ আহরণ করে শত শত বছর থেকে ইহুদী জাতি জীবন ধারণ করছে। তাদের বুক ভরা আশা নিয়ে বসে আছে যে, এই প্রতিশ্রুত মসীহ হবেন একজন শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক নেতা। তিনি নীল নদ থেকে ফোরাত পর্যন্ত সমগ্র এলাকা, যে এলাকাটিকে ইহুদীরা নিজেদের ‘উতর্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এলাকা’ মনে করে, আবার ইহুদীদের দখলে আনবেন এবং সারা দুনিয়া থেকে ইহুদীদেরকে এনে এখানে একত্রিত করবেন।

 

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করে রসূলুল্লাহর (স) ভবিষ্যদ্বাণীর আলোকে ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মহানবীর (স) কথামত ইহুদীদের ‘প্রতিশ্রুত মসীহর’ ভূমিকা পালনকারী প্রধানতম দাজ্জালের আগমনের জন্য মঞ্চ সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনের বৃহত্তম এলাকা থেকে মুসলমানদের বেদখল করা হয়েছে। সেখানে ইরাঈল নামে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীরা দলে দলে এখানে বাসস্থান গড়ে তুলছে। আমেরিকা, বৃটেন ও ফ্রান্স তাকে একটি বিরাট সামরিক শক্তিকে পরিণত করেছে। ইহুদী পুঁজিপতিদের সহায়তায় ইহুদী বৈজ্ঞানিক ও শিল্পবিদগণ দ্রুত উন্নতির পথে েএগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। চারপাশের মুসলিম দেশগুলোর জন্য তাদের এ শক্তি এক মহাবিপদে পরিণত হয়েছে। এই রাষ্ট্রের শাসকবর্গ তাদের এই ‘উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দেশ’ দখল করার আকাংখাটি মোটেই

 

(মানচিত্র *****************)

 

লুকিয়ে রাখেননি। দীর্ঘকাল থেকে ভবিষ্যত ইহুদী রাষ্ট্রের যে নীল নক্‌শা তারা প্রকাশ করে আসছে পরের পাতায় তার একটি প্রতিকৃতি দেয়া হলো। এ নক্‌শায় দেখা যাবে, সিরিয়া, লেবানন ও জর্দানের সমগ্র এলাকা এবং প্রায় সমগ্র ইরাক ছাড়াও তুরস্কের ইস্কান্দোরুন, মিসরের সিনাই ও ব-দ্বীপ এলাকা এবং মদীনা মুনাওয়ারাসহ আরবের অন্তর্গত হেজাজ ও নজ্‌দের উচ্চভূমি পর্যন্ত তারা নিজেদের সাম্রাজ্র বিস্তার করতে  চায়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, আগামীতে কোনোএকটি বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে তারা ঐসব  এলাকা দখল করার চেষ্টার করবে এবং ঐ সময়ই কথিত প্রধানতম দাজ্জাল তাদের প্রতিশ্রুত মসীহরূপে আগমন করবে। রসূলুল্লাহ (স) কেবল তার আগমন সংবাদ দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং এই সংগে একথাও বলেছেন যে, সে সময় মুসলমানদের ওপর বিপদের পাহাড় ভেঙে পড়বে এবং এক একটি দিন তাদের নিকট এক একটি বছর মনে হবে। এজন্য তিনি নিজে মসীহ দাজ্জালের ফিত্‌না থেকে খোদার নিকট আশ্রয় চেয়েছেন এবং মুসলমানদেরকেও আশ্রয় চাইতে বলেছেন।

 

এই মসীহ দাজ্জালের মোকাবিলা করার জন্য আল্লাহ কোনো ‘মসীলে মসীহ’কে পাঠাবেন না বরং আসল মসীহকে পাঠাবেন। দু’হাজার বছর আগে ইহুদীরা এই আসল মসীহকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলএবং নিজেদের জানা মতে তারা তাঁকে শূলবিদ্ধ করে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। এই আসল মসীহ ভারত, আফ্রিকা বা আমেরিকায় অবতরণ করবেন না বরং তিনি অবতরণ করবেন দামেশ্‌কে। কারণ তখন সেখানেই যুদ্ধ চলতে থাকবে। মেহেরবানী করে পরের পাতার নকশাটিও দেখুন। এতে দেখা যাচ্ছে, ইসরাঈলের সীমান্ত থেকে দামেশক মাত্র ৫০ থেকে ৬০ মাইলের মধ্যে অবস্থিত। ইতিপূর্বে আমি যে হাদীস উল্লেখ করে এসেছি, তার বিষয়বস্তু মনে থাকলে সহজেই একথা বোধগম্য হবে যে, মসীহ দাজ্জাল ৭০ হাজার ইহুদী সেনাদল নিয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করবে এবং দামেশকের সামনে উপস্থিত হবে। ঠিক সেই মুহুর্তে দামেশকের পূর্ব অংশের একটি সাদা মিনারের নিকট সুব্‌হে সাদেকের পর হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন এবং ফজর নামায শেষে মুসলমানদের নিয়ে দাজ্জালের মুকাবিলায় বের হবেন। তাঁর প্রচণ্ড আক্রমণে দাজ্জাল পশ্চাদপসরণ করে উফাইকের পার্বত্য পথ দিয়ে (২১১ নম্বর হাদীসে দেখুন) ইসরাঈলের দিকে ফিরে যাবে। কিন্তু তিনি তার পশ্চাদ্ধাবন করতেই থাকনে। অবশেষে লিড্ডা বিমান বন্দরে সে তাঁর হাতে মারা পড়বে (১০, ১৪ ও ১৫ নং হাদীস)। এরপর ইহুদীদেরকে সব জায়গা থেকে ধরে ধরে হত্যা করা হবে এবং ইহুদী জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে (৯, ১৫ ও ২১ নম্বর হাদীস)। হযরত ঈসার (আ) পক্ষ থেকে সত্য প্রকাশের পর ঈসায়ী ধর্মও বিলুপ্ত হয়ে যাবে (১, ২, ৪ ও ৬ নম্বর হাদীস( এবং মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে সমস্ত মিল্লাতে একীভূত হয়ে যাবে (৬ ও ১৫ নম্বর হাদীস)।

 

কোনোপ্রকার জড়তা ও অস্পষ্টতা ছাড়াই এই দ্ব্যার্থহীন সত্যটিই হাদীস থেকে ফুটে উঠেছে। এই সুদীর্ঘ আলোচনার পর এ ব্যাপারে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ থাকেনা যে, “প্রতিশ্রুত মসীহ”র নামে আমাদের দেশে যে কারবার চালানো হচ্ছে তা একটি প্রকাণ্ড জালিয়াতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

এই জালিয়অতির সবচাইতে হাস্যকর দিকটি এবার আমি উপস্থাপিত করতে চাই। যে ব্যক্তি নিজেকে এই ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লিখিত মসীহর সাথে অভিন্ন বলে ঘোষণা করেছেন, তিনি নিজে ঈসা ইবনে মরিয়ম হবার জন্য নিম্নোক্ত রসালো বক্তব্যটি পেশ করেছেন:

 

“তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ) বারাহীনে আহমদীয়ার তৃতীয় অংশে আমার নাম রেখেছেন মরিয়ম। অতঃপর যেমন বারাহীনে আহামদীয়ায় প্রকাশিত হয়েছে, দু’বছর পর্যন্ত আমি মরিয়মের গুণাবলী সহকারে লালিত হই.... অতঃপর ..... মরিয়মের ন্যায় ঈসার রহ আমার মধ্যে ফুৎকারে প্রবেশ করানো এবং রূপকার্থে আমাকে গর্ভবতী করা হয়। অবশেষে কয়েকমাস পরে, যা দশ মাসের চাইতে বেশী হবেনা, সেই এলহামের মাধ্যমে, যা বারাহীনে আহমাদীয়ার চতুর্থ অংশে উল্লিখিত হয়েছে, আমাকে মরিয়ম থেকে ঈসায় পরিণত করা হয়েছে। কাজেই এভাবে আমি হলাম ঈসা ইবনে মরিয়ম।” (কিশতীয়ে নুহ, ৮৭, ৮৮, ৮৯ পৃষ্ঠা)

 

অর্থাৎ প্রথমে তিনি মরিয়ম হন অতঃপর নিজে নিজেই গর্ভবতী হন। তারপর নিজের পেট থেকে নিজেই ঈসা ইবনে মরিয়ম রূপে জন্ম নেন। এরপরও সমস্যা দেখা দিলো যে, হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী ঈসা ইবনে মরিয়ম দামেশকে অবতরণ করবে। দামেশকে কয়েক হাজার বছর থেকে সিরিয়ার একটি প্রসিদ্ধ ও সর্বজন পরিচিত শহর। পৃথিবীর মানচিত্রে আজও এই শহরটি এই নামেই চিহ্নিত। কাজেই অন্য একটি রসাত্মক বক্তব্যের মাধ্যমে এ সমস্যাটির সমাধান দেয়া হয়েছে:

 

“উল্লেখ্য যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দামেশকে শব্দের অর্থ আমার নিকট এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যে, এ স্থানে এমন একটি শহরের নাম দামেশ্‌ক রাখা হয়েছে যেখানে এজিদের স্বভাব সম্পন্ন ও অপবিত্র এজিদের অভ্যাস ও চিন্তার অনুসারী লোকদের বাস।..... এই কাদিয়ান শহরটি এখানকার অধিকাংশ এজিদী স্বভাব সম্পন্ন লোকের অধিবাসের কারণে দামেশকের সাথে সামঞ্জস্র ও সম্পর্ক রাখে।” (এযালায়ে আওহাম, ফুটনোট: ৬৩ থেকে ৭৩ পৃষ্ঠা)।

 

আর একটি জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। হাদীসের বক্তব্য অনুসারে ইবনে মরিয়ম একটি সাদা মিনারের নিকট অবতরণ করবেন। এ সমস্যার সমাধান সহজেই করে ফেলা হয়েছে অর্থাৎ মসহি সাহেব নিজেই এসে নিজের মিনারটি তৈরী করে নিয়েছেন। এখন বলুন, কে তাঁকে বুঝাতে যাবে যে, হাদীসের বর্ণনা অনুসারে দেখা যায় ইবনে মরিয়মের অবতরণের পূর্বে মিনারটি সেখানে মওজুদ থাকবে। অথচ েএখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিশ্রুত মসীহ সাহেবের আগমনের পর মিনারটি তৈরী হচ্ছে।

 

সর্বশেষ ও সবচাইতে জটিল সসনস্যাটি এখনো রয়ে গেছে। অর্থাৎ হাদীসের বর্ণনা মতে ঈসা ইবচনে মরিয়ম (আ) লিড্ডার প্রবেশ দ্বারো দাজ্জালকে হত্যা করবেন। এ সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে প্রথমে আবোল তাবোল অনেক কথাই বলা হয়েছে। কখনো স্বীকার করা হয়েছে যে, বায়তুল মুকাদ্দাসের একটি গ্রামের নাম লিড্ডা (এযালায়ে আওহাম, আঞ্জুমানে আহমদীয়া, লাহোর কর্তৃক প্রকাশিত, ক্ষুদ্রাকার, ২২০ পৃষ্ঠা)। আবার কখনো বলা হয়েছে, “লিড্ডা এমন সব লোককে হয় যারা অযথা ঝগড়া করে।... যখন দাজ্জালের অযথা ঝগড়া চরমে পৌঁছে যাবে তখন প্রতিশ্রুত মসীহের আবির্ভাব হবে এবং তার সমস্ত ঝগড়া শেষ করে দেবে” (এযালায়ে আওহাম, ৭৩০ পৃষ্ঠা)। কিন্তু এত করেও যখন সমস্যার সমাধান হলো তখন পরিষ্কার বলে দেয়া হলো যে, লিড্ডা (আরবীতে লুদ) অর্থ হচ্ছে পাঞ্জাবের লুদিয়ানা শহর। আর লুদিয়ানার প্রবেশ দ্বারে দাজ্জালকে হত্যা করার অর্থ হচ্ছে দুষ্টুদের বিরোধিতা সত্ত্বেও মীর্জা গোলাম আহমদ সাহেবের হাতে এখানেই সর্বপ্রথম বাইয়াত হয়। (আলহুদা, ৯১ পৃষ্ঠা)।

 

যে কোনো সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি এইসব বক্তব্য বর্ণনার নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হবেন যে, এখানে প্রকাশ্য দিবালোকে ‍মিথ্যুক ও বহুরূপীর অভিনয় করা হয়েছে।

 

-:সমাপ্ত:-

', 'খতমে নবুয়্যাত', '', 'publish', 'closed', 'closed', '', '%e0%a6%96%e0%a6%a4%e0%a6%ae%e0%a7%87-%e0%a6%a8%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a7%9f%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%a4', '', '', '2015-07-12 11:22:21', '2015-07-12 05:22:21', '

 

\r\n

খতমে নবুয়্যাত

\r\n

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী

\r\n

অনুবাদক: আবদুল মান্নান তালিব

\r\n\r\n\r\n


\r\n\r\n

স্ক্যান কপি ডাউনলোড

\r\n

বর্তমান যুগে ইসলামের বিরুদ্ধে যে সকল ফেৎনার উদ্ভব হয়েছে তন্মধ্যে নতুন নবুয়্যাতের দাবী অতি মারাত্মক। এই নতুন নবুয়্যাতের দাবী মুসলিম জাতির মধ্যে বিরাট গোমরাহীর সৃষ্টি করে  চলছে। সাধারণত দ্বীন সম্পর্কে মুসলমানদের পরিপূর্ণ ও সঠিক ধারণা না থাকার কারণেই এই ফেৎনার উদ্ভব ও তার বিকাশ সম্ভব হয়েছে। দ্বীন সম্পর্কে যদি মুসলমানগণ অনভিজ্ঞ না হ’তো এবং খত্‌মে নবুয়্যাতকে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারতো তবে কিছুতেই বিংশ শতাব্দীতে এই ফেৎনার উদ্ভব ও বিকাশ সম্ভব হতো না বলেই আমাদের বিশ্বাস।

\r\n

খত্‌মে নবুয়্যাত বিশ্বাসের তাৎপর্য ও তার গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে অবগত ও অবহিত করানোই হচ্ছে এই ফেৎনাকে নির্মূল করার সঠিক কার্যপন্থা। এ ছাড়া অন্যকোন পথ নেই এবং হতেও পারেনা। এ ব্যাপারে মুসলমানদের মনে যে সকল সশয় সন্দেহের সৃষ্টি করা হয় তার যুক্তিপূর্ণ ও যথার্থ সমালোচনা এবং জবাবের প্রয়োজন।

\r\n

আধুনিক বিশ্বের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তানায়ক আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ১৯৬২ সা?লে “খত্‌মে নবুয়্যাত” নামক একটি পুস্তিকা রচনা করেন। উর্দু আত্মপ্রকাশের অব্যবহিত পরেই উপরোক্ত বইটির বাংলা তরজমা পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হয়। অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই বইটি নিঃশেষ হয়ে যায়। পাঠক সমাজের বারবার তাগাদার কারণে ১৯৬৭ সালে বইটির ২য় সংস্করণ এবং ১৯৭৭ সালে ৩য় সংস্করণ পাঠক সমাজের সম্মুখে পেশ করা সম্ভবপর হয়নি, কিন্তু এ সংস্করণও শিগগিরই নিঃশেষ হয়ে যায়। বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বর্তমানে এর চতুর্থ সংস্করণ পাঠক সমাজের সম্মুখে উপস্থাপিত করা হলো। খত্‌মে নবুয়্যাত সম্পর্কে মুসলিম সমাজে যে বিভ্রান্তিকর মতবাদ সৃষ্টি করা হচ্ছে তাকে প্রতিহত করার কাজে সুধীবৃন্দ এই পুস্তিকা হতে সামান্যতম উপকৃত হলে আমাদের শ্রম সার্থক মনে করবো।

\r\n

-প্রকাশক

\r\n\r\n

শেষ নবী

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

“মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের কারুর পিতা নন। বরং তিনি আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী। এবং আল্লাহ সব জিনিসের ইলম রাখেন।”

\r\n

আয়াতটি সূরা আহ্‌যাবের পঞ্চম রুকুতে উদ্ধৃত হয়েছে। হযরত জয়নবের (রা) সঙ্গে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের বিবাহের বিরুদ্ধে যেসব কাফের ও মুনাফিক মিথ্যা প্রচারণা শুরু করে দিয়েছিলো এই রুকুতে আল্লাহতায়ালা তাঁদের জবাব দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য ছিল এই: জয়নব (রা) হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পালিত পুত্র হযরত জায়েদের (রা) স্ত্রী। অর্থাৎ তিনি রসূলুল্লাহর (স) পুত্রবধু। কাজেই জায়েদের তালাক দেবার পর রসূলুল্লাহ (স) নিজের পুত্রবধুকে বিয়ে করেছেন। এর জবাবে আল্লাহতায়ালা উপরোক্ত সূরার ৩৭ নম্বর আয়অতে বলেন: আমার নির্দেশেই এই বিবাহ সম্পাদিত হয়েছে এবং এজন্য হয়েছে যে, নিজের পালিত পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিবাহ করায় মুসলমানদের কোনো দোষ নেই। অতঃপর ৩৮ এবং ৩৯ নম্বর আয়াতে বলেন: নবীর ওপর যে কাজ আল্লাহ ফরয করে দিয়েছেন কোন শক্তি তাঁকে তা সম্পাদন করা থেকে বিরত রাখতে পারেনা। নবীদের কাজ মানুষকে ভয় করা নয়, আল্লাহকে ভয় করা। নবীদের ব্যাপারে আল্লাহর চিরাচরিত পদ্ধতি হলো এই যে, কারুর পরোয়া না করেই তাঁরা সব সময় আল্লাহর পয়গাম দুনিয়ায় পৌঁছান এবং নিঃসংশয় চিত্তে তাঁর নির্দেশ পালনস করে থাকেন। এরপরই পেশ করেছেন আলোচ্র আয়াতটি। এই আয়াতটি বিরুদ্ধবাদীদের যাবতীয় প্রশ্ন এবং অপপ্রচারের মূলোৎপাটন করে দিয়েছে।

\r\n

তাদের প্রথম প্রশ্ন হলো: আপনি নিজের পুত্রবধুকে বিবাহ করেছেন। অথচ আপনার নিজের শরীয়তও একথা বলে যে, পুত্রের বিবাহিত স্ত্রী পিতার জন্য হারাম।এর জবাবে বলা হলো: “মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের কারুর পিতা নন।” অর্থাৎ যে ব্যক্তি তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিবাহ করা হলো, সে কি মুহাম্মদের (সা) পুত্র ছিল? তোমরা সবাই জান যে, মুহাম্মদের (সা) কোন পুত্র নেই।

\r\n

তাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো: পালিত পুত্র নিজের গর্ভজাত পুত্র নয়, একথা মেনে নিয়েও বলা যায় যে, তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিবাহ করা জায়েজ হতে পারে, কিন্তু তাকে অবশ্যই বিবাহ করতে হবে এবং প্রয়োজনটা কোথায়? এর জবাবে বলা হলো: “কিন্তু তিনি আল্লাহর রসূল।” অর্থাৎ যে হালাল বস্তু তোমাদের রসম-রেওয়াজের বদৌলতে অযথা হারামে পরিণত হয়েছে, সে সম্পর্কে যাবতীয় বিদ্বেষ এবং পক্ষপাতিত্ব খতম করে তার হালাল হওয়াকে নিঃসন্দেহ এবং নিঃসংশয় করে তোলা রসূলের অবশ্য করণীয় কাজ। [‘খত্‌মে নবুয়্যাত’ অস্বীকারকারীরা এখানে প্রশ্ন উঠায় যে, কাফের এবং মুনাফেকদের এই প্রশ্নটি কোন্‌ হাদীসে উল্লিীখত হয়েছে? কিন্তু এই প্রশ্নটি আসলে কোরআন সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারই ফল। কোরআন মজীদের বহু জায়গায় আল্লাহতায়ালা বিরোধীদলের প্রশ্ন নকল না করেই তাদের জবাব দিয়ে গেছেন এবং জবাব থেকেই একথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ হয়েছে যে, যে প্রশ্নটির জবাব দেয়া হচ্ছে সেটি কি ছিলো। এখানেও একই ব্যাপার। এখানেও জবাব নিজেই প্রশ্নের বিষয়বস্তু বিবৃত করছে। প্রথম বাক্যটির পর শব্দ দিয়ে দ্বিতীয় বাক্যটি শুরু করার প্রমাণ হলো যে, প্রথম বাক্যে প্রশ্নকারীর একটি কথার জবাব হয়ে যাবার পরও তার আর একটি প্রশ্ন বাকি রয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বাক্যে তার জবাব দেয়া হয়েছে।মুহাম্মদ (স) নিজের পুত্রবধুকে বিবাহ করেছেন- তাদের এই প্রশ্নের জবাব তারা প্রথম বাক্যে পেয়ে গেছে। অতঃপর তাদের প্রশ্ন ছিল যে, একাজটা করার এমন কি প্রয়োজন ছিল? এর জবাবে বলা হলো: “কিন্তু তিনি আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী।” অন্য কথায় বলা যায়, যেমন কেউ বললো, জায়েদ দাঁড়ায়নি কিন্তু বকর দাঁড়িয়েছে। এর অর্থ হলো এই যে, “জায়েদ দাঁড়ায়নি” কথা থেকে একটি প্রশ্নের জবাব পাওয়ার পরও প্রশ্নকারীর আর একটি প্রশ্ন বাকি রয়ে গেছে। অর্থাৎ যদি জায়েদ না দাঁড়িয়ে থাকে, তবে কে দাঁড়ালো? এই প্রশ্নের জবাবে “কিন্তু বকর দাঁড়িয়েছে” বাক্যটি বলা হলো।]

\r\n

আবার অতিরিক্ত জোর দেবার জন্য বলেন: “এবং শেষ নবী।” অর্থাৎ তাঁর যুগে আইন এবং সমাজ সংস্কারমূলক কোনো বিধি প্রবর্তিত না হয়ে থাকলে, এই কাজ সমাধা করার জন্য তাঁর পর কোনো রসূল তো নয়ই, কোনো নবীও আসবেন না। কাজেই জাহেলী যুগের রসম-রেওয়াজ খতম করে দেবার প্রয়োজন এখনই দেখা দিয়েছে এবং তিনি নিজেই একাজটা সমাধা করে যাবেন।

\r\n

অতঃপর আরো জোর দিয়ে বলেন: “এবং আল্লাহ সব জিনিসের ইলম রাখেন।” অর্থাৎ এই মুহূর্তে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সাহায্যে এই বদ রসমটা খতম করিয়ে দেবার প্রয়োজনটা কি এবং এটা না করায় কি ক্ষতি-একথা একমাত্র আল্লাহই জানেন। তিনি জানেন যে, তাঁর পক্ষথেকে আর কোন নবী আসবেন না। কাজেই শেষ নবীর সাহায্যে যদি এই বদ রসমটা খতম করিয়ে না দেয়া হয়, তাহলেএর পরে আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি আসবেন না, যিনি একে নির্মূল করে দিতে চাইলে সমগ্র দুনিয়ায় মুসলমানদের মধ্য হতে চিরকালের জন্য এটি নির্মুল হয়ে যাবে। পরবর্তীকালেল সংস্কারকগণ এটা নির্মূল করে দিলেও তাঁদের কারুর কাজের পেছনে এমন কোন চিরন্তন এবং বিশ্বজনীন কর্তৃত্ব থাকবেনা, যার ফলে প্রত্যেক দেশ এবং প্রত্যেক যুগের লোকেরা তাঁদের অনুসরণ করতে বাধ্য হবে এবং তাঁদের কারুর ব্যক্তিত্বও এতোটা পাক-পবিত্র বলে গণ্য হবেনা যে, কোনো কাজ নিছক তাঁর সুন্নাত হবার দরুন মানুষের হৃদয় হতে সে সম্পর্কে যাবতীয় ঘৃণা, দ্বিধা এবং সন্দেহ মুহূর্তের মধ্যে নির্মল হয়ে যাবে।

\r\n\r\n

কোরআনের পূর্বাপর বিবৃতির ফায়সালা

\r\n

বর্তমান যুগে একটি দল নতুন নবুয়্যাতের ফিত্‌না সৃষ্টি করেছে। এরা ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’ শব্দের অর্থ করে “নবীদের মোহর”। এরা বুঝাতে চায় যে, রসূলুল্লাহ (স) তাঁর মোহরাংকিত হয়ে আরো অনেক নবী দুনিয়ায় আগমন করবেন। অথবা অন্য কথায় বলা যায়,যতক্ষণ পর্যন্ত কারুর নবুয়্যাত রসূলুল্লাহর মোহরাংকিত না হয়, ততক্ষণ তিনি নবী হতে পারবেন না।

\r\n

কিন্তু “খাতিমুন নাবিয়ীন” শব্দ সম্বলিত আয়াতটি যে ঘটনা পরম্পরায় বিবৃত হয়েছে, তাকে সেই বিশেষ পরিবেশে রেখে বিচার করলে, তা থেকে এ অর্থ গ্রহণের কোন সুযোগই দেখা যায় না। অধিকন্তু এ অর্থ গ্রহণ করার পর এ পরিবেশে শব্দটির ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাই বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। এটা কি নিতান্ত অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক কথা নয় যে, জয়নবের নিকাহর বিরুদ্ধে কথিত প্রতিবাদ এবংতাথেকে সৃষ্ট নানাপ্রকার সংশয়-সন্দেহের জবাব দিতে দিতে হঠাৎ মাঝখানে বলে দেয়া হলো: মুহাম্মদ (সা) নবীদের মোহর। অর্থাৎ ভবিষ্যতে যত নবী আসবেন তাঁরা সবাই তাঁর মোহরাংকিত হবেন। আগে পিছের এই ঘটনার মাঝখানে একথাটির আকস্মিক আগমন শুধু অবান্তরই নয়, এ থেকে প্রতিবাদকারীদের জবাবে যে যুক্তি পেশ করা হচ্ছিল, তাও দুর্বল হয়ে পড়ে। এহেন পরিস্থিতিতে প্রতিবাদকারীদের হাতে একটা চমৎকার সুযোগ আসতো এবং তারা সহজেই বলতে পারতো যে, আপনার জীবনে যদি এ কাজটা সম্পন্ন না করতেন, তাহলে ভালই হতো, কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকতো না, এই বদ রসমটা বিলুপ্ত করার যদি এতোই প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে আপনার পরে আপনার মোহরাংকিত হয়ে যেসব নবী আসবেন, এ কাজটা তাঁদের হাতেই সম্পন্ন হবে।

\r\n

উল্লিখিত দলটি শব্দটির আর একটি বিকৃত অর্থ নিয়েছে: ‘খাতিমুন নাবিয়ীন” অর্থ হলো: “আফজালুন নাবিয়ীন।” অর্থাৎ নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্তই রয়েছে, তবে কিনা নবুয়্যাত পূর্ণতা লাভ করেছে রসূলুল্লাহর ওপর। কিন্তু এ অর্থ গ্রহণ করতে গিয়েও পূর্বোল্লিখিত বিভ্রান্তির পুনাবির্ভাবের হাত থেকে নিস্তার নেই। অগ্র-পশ্চাতের সাথে এরও কোন সম্পর্ক নেই।বরং এটি পূর্বাপরের ঘটনা পরম্পরার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থবহ। কাফের ও মুনাফিকরা বলতে পারতো: ‘জনাব, আপনার চাইতে কম মর্যাদার হলেও আপনার পরে যখন আরোনবী আসছেন, তখন একাজটা না হয় তাদের ওপরই ছেড়ে দিতেন। এই বদ রসমটাও যে আপনাকেই মিটাতে হবে, এরই বা কি এমন যৌক্তিকতা আছে!

\r\n\r\n

আভিধানিক অর্থ

\r\n

তাহলে পূর্বাপর ঘটনাবলীল সাথে সম্পর্কের দিক দিয়ে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, এখানে খাতিমুন নাবিয়ীন শব্দের অর্থ নবুয়্যাতের সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘোষণা। অর্থাৎ রসূলুল্লাহর (স) পর আর কোন নবী আসবেননা। কিন্তু শুধু পূর্বাপর সম্বন্ধের দিক দিয়েই নয়, আভিধানিক অর্থের দিক দিয়েও এটিই একমাত্র সত্য। আরবী অভিধান এবং প্রবাদ অনুযায়ী ‘খতম’ শব্দের অর্থ হলো: মোহর লাগানো, বন্ধ করা, শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া এবং কোনো কাজ শেষ করে দায়িত্বথেকে অব্যাহতি লাভ করা।

\r\n

খাতামাল আমাল (******) অর্থ হলো: ফারেগা মিনাল আমল (*****) অর্থাৎ কাজ শেষ করে ফেলেছৈ। খাতামাল এনায়া (*****) অর্থ হলো: পাত্রের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে এবং তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, যাতে করে তার ভেতর থেকে কোনো জিনিস বাইরে আসতে এবং বাইরে থেকে কিছু ভেতরে যেতে না পারে।

\r\n

খাতামাল কিতাব (*****) অর্থ হলো: পত্র বন্ধ করে তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, ফলে পত্রটি সংরক্ষিত হবে।

\r\n

খাতামা আলাল কাল্‌ব (******) অর্থ হলো: দিলের ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে। এরপর বাইরের কোনো কথা আর সে বুঝতে পারবে না এবং তার ভেতরের স্থিতিশীল কোনো কথা বাইরে বেরুতে পারবে না।

\r\n

খিতামুল কুল্লি মাশরুব (****) অর্থ হলো: কোনো পানীয় পান করার পর যে স্বাদ অনুভূত হয়।

\r\n

খাতিমাতু কুল্লি শাইয়েন আকিবাতুহু ওয়া আখিরাতুহ (আরবী ***********) অর্থাৎ] প্রত্যেক জিনিসের খাতিমা অর্থ হলো তার পরিণাম এবং শেষ।

\r\n

খাতামাশ্‌ শাইয়ে বালাগা আখিরাহ (আরবী ***********) অর্থাৎ কোনো জিনিসকে খতম করার অর্থ হলো তা শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। -খত্‌মে কোরআন বলতে এই অর্থ গ্রহণ করা হয় এবং এর অর্থের ভিত্তিতেই প্রত্যেক সূরার শেষ আয়াতকে বলা হয় ‘খাওয়াতিম’।

\r\n

খাতিমুল কওমে আখেরুহুম (আরবী *********) অর্থাৎ খাতিমুল কওম অর্থ জাতির শেষ ব্যক্তি (দ্রষ্টব্য: লিসানুল আরব, কামুস এবং আকরাবুল মাওয়ারিদ।) [এখানে আমি মাত্র তিনটি অভিধানের উল্লেখ করলাম। কিন্তু শুধু এই তিনটি অভিধানই কেন, আরবী ভাষার যে কোন নির্ভরযোগ্য অভিধান খুলে দেখুন সেখানে ‘খতম’ শব্দের উপরোল্লিখিত ব্যাখ্যাই পাবেন। কিন্তু ‘খতমে নবুয়্যাত’ অস্বীকারকারীরা খোদার দ্বীনের সুরক্ষিত গৃহে সিঁদ লাগাবার জন্য এক আভিধানিক অর্থকে পুর্ণরূপে এড়িয়ে গেছেন। তারা বলতে চান, কোন ব্যক্তিকে ‘খাতামুশ শোয়ারা’, খাতামুল ফোকাহা’ অথবা ‘খাতামুল মুফাসসিরিন’ বললে এ অর্থ গ্রহণ করা হয় না যে, যাকে ঐ পদবী দেয়া হয়, তার পরে আর কোনো শায়ের কোন ফকিহ অথবা মুফাস্‌সরি পয়দা হননি। বরং এর অর্থ এই হয় যে, ঐ ব্যক্তির ওপররে উল্লিীখত বিদ্যা অথবা শিল্পের পূর্ণতার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। অথবা কোন বস্তুকে অত্যাধিক ফুটিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে এই ধরনেসর পদবী ব্যবহারের ফলে কখনো খতম-এর আভিধানিক অর্থ ‘পূর্ণ’ অথবা ‘শ্রেষ্ঠ’ হয় না এবং ‘শেষ’ অর্ এর ব্যবহার ত্রুটিপূর্ণ বলৌ গন্য হয় না।

\r\n

একমাত্র ব্যাকরণ-রীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিই এ ধরনের কথা বলতে পারেন। কোন ভাষারই নিয়ম এ নয় যে, কোন একটি শব্দ তার আসল অর্থের পরিবর্তে কখনো কখনো দূর সম্পর্কের অন্য কোন অর্থে ব্যবহৃরিত হলেসেটাই আসল অর্থে পরিণত হবে এবং আসল আভিধানিক অর্থে তার ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। আপনিয খন কোন আরবের সম্মুখে বলবেন:

\r\n

(জাআ খাতামুল কওম)-তখন কখনো সে মনে করবে না যে গোত্রের শ্রেষ্ঠ অথবাপ কামেল ব্যক্তি এসেছে। বরং সে মনে করবে যে, গোত্রের সবাই এসে গেছে, এমনকি শেষ ব্যক্তিটি পর্যন্তও।]

\r\n

এজন্যই সমস্ত অভিধান বিশারত এবং তাফসীরকারগণ একযোগে ‘খাতিমুন নাবিয়ীনা’ শব্দের অর্থ নিয়েছেন, আখেরুন নাবিয়ীন-অ অর্থাৎ নবীদের শেষ। আরবী অভিধান এবং প্রবাদ অনুযায়ী ‘খাতিম’ –এর অর্থ যাকঘরের মোহর নয়, যা চিঠির ওপর লাগিয়ে চিঠি পোস্ট করা হয়; বরং সেই মোহর যা খামের মুখে এই উদ্দেশ্যে লাগানো হয় যে, তার ভেতর থেকে কোনো জিনিস বাইরে বেরুতে পারবে না এবং বাইরের কোনো জিনিস ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।

\r\n\r\n

রাসূলুল্লাহর বাণী

\r\n

পূর্বাপর সম্বন্ধ এবং আভিধানিক অর্থের দিক দিয়ে শব্দটির যে অর্থ হয়, রসুলুল্লাহর (স) বিভিন্ন ব্যাখ্যাও এর সমর্থন করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে কতিপয় হাদীসের উল্লেখ করছি:

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(১) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: বনি ইসরাঈলদের নেতৃত্ব করতেন্‌ আল্লাহর রসূলগণ। যখন কোনো নবী ইন্তেকাল করতেন, তখন অন্য কোনো নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। কিন্তু আমার পরে কোনো নবীহবে না, হবে শুধু খলিফা।

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(২) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমি আমার পূর্ববর্তী নবীদের দৃষ্টান্ত হলো এই যে, এক ব্যক্তি একটি দালান তৈরী করলো এবং খুব সুন্দর ও শোভনীয় করে সেটি সজ্জিত করলো।কিন্তু তার এক কোণে একটি ইটের স্থান শূন্য ছিল। দালানটির চতুর্দিকে মানুষ ঘুরে ঘুরে তার সৌন্দর্য দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছিল এবং বলছিল, ‘এ স্থানে একটা ইট রাখা হয়নি কেন? কাজেই আমি সেই ইট এবং আমিই শেষ নবী।’ (অর্থাৎ আমার আসার পর নবুয়্যাতের দালান পূর্ণতা লাভ করেছে, এখন এর মধ্যে এমন কোন শূন্যস্থান নেই যাকে পূর্ণ করার জন্য আবার কোনো নবীর প্রয়োজন হবে)।

\r\n

এই ধরনের চারটি হাদীস মুসলিম শরীফে কিতাবুল ফাজায়েলের বাবু খাতিমুন নাবিয়ীনে উল্লিখিত হয়েছে। এবং শেষ হাদীসটিতে এতোটুকুন অংশ বর্ধিত হয়েছে: (আরবী *********) “অতঃপর আমি এলাম এবং আমি নবীদের সিলসিলা খতম করে দিলাম।”

\r\n

হাদীসটি তিরমিজী শরীফে একই শব্দ সম্বলিত হয়ে ‘কিতাবুল মানাকিবের বাবু ফাজলিন নবী’ এবং কিতাবুল আদাবের ‘বাবুল আমসালে’ বর্ণিত হয়েছে।

\r\n

মুসনাদে আবু দাউদ তিয়ালাসীতে হাদীসটি জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত হাদীসের সিলসিলায় উল্লিখিত হয়েছে এবং এর শেষ অংশটুকু হলো (আরবী *********) “আমার মাধ্যমে নবীদের সিলসিলা খতম করা হলো।”

\r\n

মুসনাদে আহমদে সামান্য শাব্দিক হেরফেরের সাথে এই ধরনের হাদীস হযরত উবাই ইবনে কা’ৎব, হযরত আবু সাঈদ খুদরী এবং হযরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে।

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(৩) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: “ছ’টা ব্যাপারে অন্যান্য নবীদের ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে: (১) আমাকে পূর্ণ অর্থব্যঞ্জক সংক্ষিপ্ত কথা বলার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। (২) আমাকে শক্তিমত্তা ও প্রতিপত্তি দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। (৩) আমাকে গনীমাতের অর্থ-সম্পদ আমার জন্য হালাল করা হয়েছে। (৪) পৃথিভীর জমীনকে আমার জন্য মসজিদে (অর্থাৎ আমার শরীয়তে নামায কেবল বিশেষ ইবাদতগাহে নয়, দুনিয়ার প্রত্যেক স্থানে পড়া যেতে পারে) এবং মাটিকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে (শুধু পানিই নয়, মাটির সাহায্যে তায়াম্মুম করেও পবিত্রতা হাসিল অর্থাৎ অজু এবং গোসলের কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে) পরিণত করা হয়েছে। (৫) সমগ্র দুনিয়ার জন্য আমাকে রসূল হিসাবে পাঠানো হয়েছে এবং (৬) আমার ওপর নবীদের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে।”

\r\n

(৪) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: ‘রিসালাত এবং নবুয়্যাতের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে। আমার পর কোনো রসূল এবং নবী আসবে না।”

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(৫) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: “আমি মুহাম্মদ। আমি আহমদ। আমি বিলুপ্তকারী, আমার সাহায্যে কুফরকে বিলুপ্ত করা হবে। আমি সমবেতকারী, আমার পরে লোকদেরকে হাশরের ময়দানে সমবেত করা হবে (অর্থাৎ আমার পরে শুধু কিয়ামতই বাকি আছে) আমি সবার শেষে আগমনকারী (এবং সবার শেষে আগমনকারী হলো সেই) যার পরে আর নবী আসবে না।”

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

রসূলুল্লাহ (স) বলেন: “আল্লাহ নিশ্চয়ই এমন কোনো নবী পাঠাননি যিনি তাঁর উম্মতকে দাজ্জাল সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করেননি। (কিন্তু তাদের যুগে সে বহির্গত হয়নি)। এখন আমিই শেষ নবী এবং তোমরা শেষ উম্মত। দাজ্জাল নিঃসন্দেহে এখন তোমাদের মধ্যে বহির্গত হবে।”

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(৭) আবদুর রহমান ইবনে জোবায়ের বলেন: আমি আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে আস্‌’কে বলতে শুনেছি যে, একদিন রসূলুল্লাহ (সা) নিজের গৃহ থেকে বের হয়ে আমাদের মধ্যে তাশরীফ আনলেন। তিনি এভাবে আসলেন যেন আমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তিনবার বললেন, আমি উম্মী নবী মুহাম্মদ। অতঃপর বললেন, আমার পর আর কোন নবী নেই।

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(৮) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমার পরে আর কোনো নবুয়্যাত নেই। আছে শুধু সুসংবাদ দানকারী কথার সমষ্টি। জিজ্ঞেস করা হলো, হে খোদার রসূল, সুসংবাদ দানকারী কথাগুলো কি? জবাবে তিনি বললেন: ভালো স্বপ্ন। অথবা বললেন, কল্যাণময় স্বপ্ন। (অর্থাৎ খোদার অহি নাযীল হবার এখন আর সম্ভাবনা নেই। বড় জোর এতোটুকু বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে যদি কাউকে কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়, তাহলে শুধু ভালো স্বপ্নের মাধ্যমেই তা দেয়া হবে)।

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(৯) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমার পরে যদি কোনো নবী হতো, তাহলে উমর ইবনে খাত্তাম সে সৌভাগ্য লাভ করতো।

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(১০) রসূলুল্লাহ (স)  হযরত আলীকে (রা) বলেন: আমার সাথে তোমার সম্পর্ক মুসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মতো। কিন্তু আমার পরে আর কোনো নবী নেই।

\r\n

বুখারী এবং মুসলিম তাবুক যুদ্ধের বর্ণনা প্রসংগেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে আহমদে এই বিষয়বস্তু সম্বলিত দু’টি হাদীস হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি বণনার শেষাংশ হলো: (আরবী *********) “কিন্তু আমার পরে আর কোনো নবুয়্যাত নেই।” আবু দাউদ তিয়ালাসি, ইমাম আহমদ এবং মুহাম্মদ ইসহাক এ সম্পর্কে যে বিস্তারিত বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, তাবুক যুদ্ধে রওয়ানা হবার পূর্বে রসূলুল্লাহ (স) হযরত আলীকে (রা) মদীনা তাইয়েবার হেফাজত এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেখে যাবার ফায়সালা করেন। এ ব্যাপারটি নিয়ে মুনাফিকরা বিভিন্ন কথা বলতে লাগলো। হযরত আলী (রা) রসূলুল্লাহকে (স) বললেন, ‘হে খোদার রসূল, আপনি কি আমাকে শিশু এবং মেয়েদের মধ্যে ছেড়ে যাচ্ছেন? রসূলুল্লাহ (স) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন: ‘আমার সাথে তোমার সম্পর্কতো মূসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মতো। অর্থাৎ কোহেতুরে যাবার সময় হযরত মূসা (আ) যেমন বনী ইসরাঈলদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হযরত হারুনকে পেছনে রেখে গিয়েছিলেন অনুরূপভাবে মদীনার হেফাজতের জন্য আমি তোমাকে পেছনে রেখে যাচ্ছি। কিন্তু সংগে সংগে রসূলুল্লাহর মনে এই সন্দেহও জাগলো যে, হযরত হারুনের সংগে এভাবে তুলনা করার ফলে হয়তো পরে এ থেকে কোনো ফিত্‌না সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই পরমুহূর্তেই তিনি কথাটা স্পষ্ট করে দিলেন যে, ‘আমার পর কোনো ব্যক্তি নবী হবে না।’

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(১১) হযরত সাওবান বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আর কথা হচ্ছে এই যে, আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যাবাদী হবে। তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী করবে। অথচ আমার পর আর কোনো নবী নেই।

\r\n

এই বিষয়বস্তু সম্বলিত আর একটি হাদীস আবু দাউদ ‘কিতাবুল মালাহেমে’ হযরত আবু হোরায় (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযীও হযরত সাওবান এবং হযরত আবু হোরায় (রা) থেকে এ হাদীস দু’টি বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় বর্ণনাটির শব্দ হলো এই:

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

অর্থাৎ এমন কি তিরিশ জনের মতো প্রতারক আসবে। তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকেই দাবীকরবে যে, সে আল্লাহর রসূল।

\r\n

(১২) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমাদের পূর্বে যেসব বনি ইসরাঈল গুজরে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক লোক এমন ছিলেন, যাঁদের সংগে কালাম করা হয়েছে, অথচ তাঁরা নবী ছিলেন না। আমার উম্মতের মধ্যে যদি এমন কেউ হয়, তাহলে সে হবে উমর।

\r\n

মুসলিমে এই বিষয়বস্তু সম্বলিত যে হাদীস উল্লিখিত হয়েছে, তাতে (****) এর পরিবর্তে (****) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মুকাল্লিম এবং মুহাদ্দিস শব্দ দুটি সমার্থক। অর্থাৎ এমন ব্যক্তি যার সংগে আল্লাহতায়ালা কালাম করেছেন অথবা যার সাথে পর্দার পেছন থেকে কথা বলা হয়। এ থেকে জানা যায় যে, নবুয়্যাত ছাড়াও যদি এই উম্মতের মধ্যে কেউ আল্লাহর সাথে কালাম করার সৌভাগ্যঅর্জন করেন, তাহলে তিনি একমাত্র হযরত উমরই হবেন।

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(১৩) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমার পরে আর কোনো নবী নেই এবং আমার উম্মতের পর আর কোনো উম্মত (অর্থাৎ কোনো ভবিষ্যত নবীর উম্মত) নেই।

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(১৪) রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমি শেষ নবী এবং আমার মসজিদ (অর্থাৎ মসজিদে নববী) শেষ মসজিদ। [খত্‌মে নবুয়্যাত অস্বীকারকারীরা এই হাদীস থেকে প্রমাণ করে যে, রসূলুল্লাহ (স) যেমন তাঁর মসজিদকে শেষ মসজিদ বলেছেন, অথচ এটি শেষ মসজিদ নয়; এর পরও দুনিয়ার বেশুমার মসজিদ নির্মিত হয়েছে অনুরূপভাবে তিনি বলেছেন, যে তিনি শেষ নবী। এর অর্থ হলো এই যে, তাঁর পরেও নবী আসবেন। অবশ্য শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে তিনি হলেন শেষ নবী এবং তাঁর মসজিদ শেষ মসজিদ। কিন্তু আসলে এ ধরনের বিকৃত অর্থই একথা প্রমাণ করে যে, এই লোকগুলো আল্লাহ এবং রসূলের কালামের অর্থ অনুধাবন করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। মুসলিম শরীফের যে স্থানে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সেখানে এই বিষয়ে সমস্ত হাদীস সম্মুখে রাখলেই একথা পরিস্ফূট হবে যে, রসূলুল্লাহ (স) তাঁর মসজিদকে শেষ মসজিদ কোন্‌ অর্থে বলেছেন। এখানে হযরত আবুহোরায় (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) এবং হযরত মায়মুনার (রা) যে বর্ণনা ইমাম মুসলিম উদ্ধৃত করেছেন, তাতে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ার মাত্র তিনটি মসজিদ এমন রয়েছে যেগুলো সাধারণ মসজিদগুলোর ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। সেখানে নামায পড়লে অন্যান্য মসজিদের চেয়ে হাজার গুণ বেশী সওয়াব হাসিল হয় এবং এজন্য একমাত্র এই তিনটি মসজিদে নামায পড়ার জন্য সফর করা জায়েজ। দুনিয়ার অবশিষ্ট মসজিদগুলোর মধ্যে সমস্ত মসজিদকে বাদ দিয়ে বিশেষ করে একটি মসজিদে নামায পড়বার জন্য সেদিকে সফর করা জায়েজ নয়। এর মধ্যে ‘মসজিদুল হারাম’ হলো প্রথম মসজিদ। হযরত ইবরাহীম (আ) এটি বানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি হলো ‘মসজিদে আক্‌সা’। হযরত সুলায়মান (আ) এটি নির্মাণ করেছিলেন এবং তৃতীয়টি মদীনা তাইয়েবার ‘মসজিদে নববী’। এটি নির্মাণ করেন রসূলুল্লাহ (স)। রসূলুল্লাহ (স) এরশাদের অর্থ হলো এই যে, এখন যেহেতু আমার পর আর কোনো নবী আসবেনা, সেহেতু আমার মসিজদের পর দুনিয়ায় আর চতুর্থ এমন কোনো মসজিদ নির্মিত হবেনা, যেখানে নামায পড়ার সওয়াব অন্যান্য মসজিদের তুলনায় বেশী হবে এবং সেখানে নামায পড়ার উদ্দেশ্যে সেদিকে সফর করা জায়েজ হবে।

\r\n

রসূলুল্লাহ (স) নিকট থেকে বহু সাহাবা হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন এবং বহু মুহাদ্দিস অত্যন্ত শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য সনদসহ এগুলো উদ্ধৃত করেছেন। এগুলো অধ্যয়ন করার পর স্পষ্ট জানা যায় যে, রসুল্লাহ (স) বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার করে একথা পরিষ্কার করেদিয়েছেন যে, তিনি শেষ নবী। তাঁর পর কোনো নবীআসবে না। নবুয়্যঅতের সিলসিলা তাঁর ওপর খতম হয়ে গেছে এবং তাঁর পরে যে ব্যক্তি রসূল অথবা নবী হবার দাবী করবে, সে হবে দাজ্জাল এবং কাজ্জাব। কোরআনের ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’ শব্দের এর চাইতে বেশী শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্য এবং প্রমাণ্য ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে। রসূলুল্লাহ বাণীই এখঅনে চরম সনদ এবং প্রমাণ। উপরন্তু যখন তা কোরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা করে তখন তা আরো অধিক শক্তিশালী প্রমাণে পরিণত হয়। এখন প্রশ্ন হলো এই যে, মুহাম্মদের (স) চেয়ে বেশী কে কোরআনকে বুঝেছে এবং তাঁর চাইতে বেশী এর ব্যাখ্যার অধিকার কার আছে? এমন কে আছে যে, খতমে নবুয়্যাতের অন্য কোনো অর্থ বর্ণনা করবে এবং তা মেনে নেয়া তো দূরের কথা, সে সম্পর্কে চিন্তা করতেও আমরা প্রস্তুত হবো?

\r\n\r\n

সাহাবাদের ইজমা

\r\n

কোরআন এবং সুন্নাহর পর সাহায়ে কেরামের ইজমা বা মতৈক্য হলো তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমস্ত নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে প্রমাণ হয় যে, রসূলুল্লাহর (স)। ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই যেসব লোক নবুয়্যাতের দাবী করে এবং যারা তাদের নবুয়্যাত স্বীকার করে নেয়, তাদের সবার বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করেছিলেন। এসম্পর্কে মুসাইলামা কাজ্জাবের ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে রসূলুল্লাহর (স) নবুয়্যাত অস্বীকার করছিল না; বরং সে দাবী করছিল যে, রসূলুল্লাহ্‌র নবুয়্যাতে তাকেও অংশীদার করা হয়েছে। রসূলুল্লাহর ইন্তেকালের পূর্বেসে তাঁর নিকট যে চিঠি পাঠিয়েছিল তার আসল শব্দ হলো এই:

\r\n

“অর্থাৎ আল্লাহর রসূল মুসাইলামার তরফ হতে আল্লাহর রসূল মুহাম্মদের নিকট। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আপনি জেনে রাখুন, আমাকে আপনার সাথে নবুয়্যাতের কাজে শরীক করা হয়েছে।”

\r\n

এভাবে স্পষ্ট করে রিসালাতে মুহাম্মদীকে স্বীকার করে নেবার পরও তাকে ইসলাম বহির্ভূত বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে। ইতিহাস থেকে একথাও প্রমাণ হয় যে, বনূ হোনায়পা সরল অন্তঃকরণে তার ওপর ঈমান এনেছিল। অবশ্য তারা এই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছিল যে, মুহাম্মদ (স) নিজেই তাকে তার নবুয়্যাতের কাজে শরীক করেছেন। এ ছাড়াও আর একটা কথা হলো এই যে, মদীনা তাইয়েবা থেকে এক ব্যক্তি কোরআনের শিক্ষা গ্রহণ করেছিল এবং বনু হোনায়ফার নিকটে গিয়ে সে কোরআনের আয়াতকে মুসাইলামার নিকট অবতীর্ণ আয়াতরূপে পেশ করেছিল।

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

কিন্তু এ সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম তাকে মুসলমান বলে স্বীকার করেননি এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। [শেষ নবুয়্যাতে অবিশ্বাসীরা নবী করিমের (স)-হাদীসেরবিপরীতে হযরত আয়েশার (রা) বলে কথিত নিম্নোক্ত বর্ণনা উদ্ধৃতি দেয়: “বল নিশ্চয়ই তিনি খাতামুন নাবিয়ীন, এ কথা বলো না যে তার পর নবী নেই।” প্রথমত নবী করিমের (স) সুস্পষ্ট আদেশকে অস্বীকার করার জন্রহযরত আয়েশার (রা) উদ্ধৃতি দেয়া একটা ধৃষ্টতা। অধিকন্তু হযরত আয়েশার (রা) বলে কথিত উপরোক্ত উদ্ধৃতি মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। হাদীস শাস্ত্রের কোন প্রামাণিক গ্রন্থেই হযরত আয়েশার (রা) উপরোক্ত উক্তির উল্লেখ নেই। কোন বিখ্যাত হাদীস লিপিবদ্ধকারী এ হাদীসটি লিপিবদ্ধ বা উল্লেখ করেননি।

\r\n

উপরোক্ত হাদীসটি ‘দার-ই মানহুর’ নামক তাফসীর এবং ‘তাকমিলাহ মাজমা-উল-বিহার’ নামক অপরিচিত হাদীস সংকলণ থেকে নেয়া হয়েছে; কিন্তু এর উৎপত্তি বা বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই। রসূল (স) সুস্পষ্ট হাদীস বা বিখ্যাত হাদীস বর্ণনাকারীরা খুবই নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে বর্ণনা করেছেন, তাকে অস্বীকার করার জন্য হযরত আয়েশার (রা) কথার উল্লেখ চূড়ান্ত ধৃষ্টতা মাত্র।] অতঃপর একথা বলার সুযোগ নেই যে, ইসলাম বহির্ভূত হবার কারণে সাহাবাগণ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি বরং বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছিল। ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে বিদ্রোহী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলেও তাদের যুদ্ধবন্দীদেরকে গোলামে পরিণত করা যেতে পারে না। বরং শুধু মুসলমানই নয়, জিম্মীও (অমুসলিম) বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, গ্রেফতার করার পর তাকে গোলামে পরিণত করা জায়েজ নয়। কিন্তু মুসাইলামা এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) ঘোষণা করেন যে, তাদের মেয়েদের এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেদেরকে গোলাম বানানো হবে এবং গ্রেফতার করার পর দেখা গেলো, সত্যি সত্যিই তাদেরকে গোলাম বানানো হয়েছে। হযরত আলী (রা) তাদের মধ্যথেকেই জনৈক যুদ্ধ বন্দিনীর মালিক হন। এই যুদ্ধ বন্দিনীর গর্ভজাত পুত্র মুহাম্মদ ইবনে হানিফাই হলেন পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে সর্বজন পরিচিত ব্যক্তি।

\r\n

(আরবী *********) এ থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম যে অপরাধের কারণে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তা কোন বিদ্রোহের অপরাধ ছিলনা বরং সে অপরাধ ছিল এইযে, এক ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পরে নবুয়্যাতের দাবী করে এবং অন্য লোকেরা তার নবুয়্যাতের ওপর ঈমান আনে। রসূলুল্লাহর ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই এই পদক্ষেপ গৃহীত হয়। এর নেতৃত্ব করেন হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) এবং সাহাবাদের সমগ্র দলটি একযোগে তাঁর নেতৃত্বাধীনে এ কাজে অগ্রসর হন। সাহাবাদের ইজমার এর চাইতে সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে।

\r\n\r\n

আলেম সমাজের ইজমা

\r\n

শরীয়াতে সাহাবাদের ইজমার পর চতুর্থ পর্যায়ের সব চাইতে শক্তিশালী দলিল হলো সাহাবাগণের পরবর্তী কালের আলেম সমাজের ইজমা। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক যুগের এবং সমগ্র মুসলিম জাহানের প্রত্যেক এলাকার আলেম সমাজ হামেশাই এ ব্যাপারে একমত রয়েছেন যে,

\r\n

“মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পরে কোনো ব্যক্তি নবী হতে পারে না। এবং তাঁর পর যে ব্যক্তি নবুয়্যাতের দাবী করবে এবং যে ব্যক্তি এই মিথ্যা দাবীকে মেনে নেবে, সে কাফের এবং মিল্লাতে ইসলামের মধ্যে তার স্থান নেই।”

\r\n

এ ব্যাপারে আমি কতিপয় প্রমাণ পেশ করছি:

\r\n

(১) ইমাম আবু হানিফার যুগে (৮০-১৫০হি) এক ব্যক্তি নবুয়্যাতের দাবী করে এবংবলে: “আমাকে সুযোগ দাও, আমি নবুয়্যাতের সংকেত চিহ্ন পেশ করব।”

\r\n

একথা শুনে ইমাম সাহেব বলেন: যে ব্যক্তি এর কাছ থেকে নবুয়্যাতের কোনো সংকেত চিহ্ন তলব করবে সেও কাফের হয়ে যাবে। কেননা রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন: (******) আমার পর আর কোন নবী নেই।

\r\n

(আরবী *********)

\r\n

(২) আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী (২২৪-৩১০ হি) তাঁর বিখ্যাত কোরআনের তাফসীরে (আরবী *******) আয়াতটির বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন:

\r\n

(আরবী *******)

\r\n

অর্থাৎ “যে নবুয়্যাতকে খতম করে দিয়েছে এবং তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, কিয়ামত পর্যন্ত এর দরজা আর কারুর জন্য খুলবেনা।” (তাফসীরে ইবনে জারীর, দ্বাবিংশ খণ্ড, ১২ পৃষ্ঠা)

\r\n

(৩) আল্লামা ইবনে হাজাম আন্দালুসী (৩৮৪-৪৫৬ হি) লিখেছেন: নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহর (স) পর অহীর সিলসিলা খতম হয়ে গেছে। এর সপক্ষে যুক্তি এই যে, অহী আসে একমাত্র নবীর কাছে এবং মহান আল্লাহ বলেছেন, “মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারুর পিতা নয়। কিন্তু সে আল্লাহর রসূল এবং সর্বশেষ নবী।” (আল মুহাল্লা, প্রথম খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা)।

\r\n

(৪) ইমাম গাজ্জালী (৪৫০-৫০৫ হি) বলেন: “সমগ্র মুসলিম সমাজ এই বাক্য থেকে একযোগে এই অর্থ নিয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (স) তাঁর পরে কোন রসূল এবং নবী না আসার কথাটি স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন এবং এর কোনো বিশেষ অর্থ গ্রহণ অথবা বাক্যটিকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে এবং টেনে-হিঁচড়ে এ থেকে কোনো দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণের সুযোগই এখানে নেই। অতঃপর যে ব্যক্তি টেনে-হিঁচড়ে এথেকে কোনো দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করবে, তার বক্তব্য হবে উদ্ভট ও নিছক কল্পনা প্রসূত এবং তার বক্তব্যের ভিত্তিতে তার ওপর কুফরীর ফতোয়া দেবার ব্যাপারে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা কোরআনে যে আয়াত সম্পর্কে সমগ্র মুসলিম সমাজ একযোগে এই মত পোষণ করেন যে, তার কোনো দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে না এবং টেনে-হিঁচড়ে অন্য কোনো অর্থও তা থেকে বের করা যেতে পারেনা, সে আয়াতকে সে মিথ্যা প্রমাণ করেছে।” (আল ইকতিসাদ ফিল ইতিকাদ, ১১৩ পৃষ্ঠা)

\r\n

(৫) মুহিউদ সূন্নাহ বাগাবী (মৃত্যু ৫১০ হি) তাঁর তাফসীরে আলিমুত তানজীল-এ লিখেছেন: রসূলুল্লাহ্‌র (স) মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা নবুয়্যাতের সিলসিলা খতম করেছেন। কাজেই তিনি সর্বশেষ নবী এবং ইবনে আব্বাস বলেন যে, আল্লাহতায়ালা এই আয়াতে ফায়সালা করে দিয়েছেন যে, মুহাম্মদের (স) পর কোন নবী নেই। (তৃতীয় খণ্ড, ১৫৮ পৃষ্ঠা)

\r\n

(৬) আল্লাম জামাখশরী (৪৬৭-৫৩৮ হি) তাফসীরৈ কাশ্‌শাফে লিখেছেন: যদি তোমরা বল যে, রসূলুল্লাহ (স) শেষ নবী কেমন করে হলেন, কেননা হযরত ঈসা(আ) শেষ যুগে অবতীর্ণ হবেন, তাহলে আমি বলবোযে, রসূলুল্লাহর শেষ নবী হবার অর্থ হলো এই যে, তাঁর পরে আর কাউকে নবীর পদে প্রতিষ্ঠিত করা হবেনা। হযরত ঈসাকে (আ) রসূলুল্লাহর (স) পূর্বে নবী বানানো হয়েছে। অবতীর্ণ হবার পর তিনি রসূলুল্লাহর অনুসারী হবেন এবং তাঁর কেবলার দিকে মুখ করে নামায পড়বেন। অর্থাৎ তিনি হবেন রসূলুল্লাহর উম্মতের মধ্যে শামিল। (দ্বিতীয় খণ্ড, ১১৫ পৃষ্ঠা)

\r\n

(৭) কাজী ইয়অয (মৃত্যু: ৫৪৪ হি) লিখেছেন: যে ব্যক্তি নিজে নবুয়্যাতের দাবী করে অথবাএ কথাকে বৈধ মনে করে যে, যে কোনো ব্যক্তি নিজের প্রচেষ্টায় নবুয়্যাত হাসিল করতে পারে এবং অন্তত পরিশুদ্ধির মাধ্যমে নবীর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে (যেমন কোনো কোনো দার্শনিক এবং বিকৃতমনা সূফী মনে করেন) এবং এভাবে যে ব্যক্তি নবুয়্যাতের দাবীকরেনা অথচ একথার দাবী জানায় যে, তার ওপর অহী নাযিল হয়, -এ ধরনের সমস্ত লোক কাফের এবং তারা রসূলুল্লাহর নবুয়্যাতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে। কেননা তিনি খবর দিয়েছেন যে, তিনি শেষ নবী এবং তাঁর পর কোনো নবী আসবে না এবং তিনি আল্লাহতায়ালার তরফ থেকে এ খবর পৌঁছিয়েছেন যে, তিনি নবুয়্যাতকে খতম করে দিয়েছেন এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে। সমগ্র মুসলিম সমাজ এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে কথাটির বাহ্যিক অর্থটিই গ্রহণীয় এবং এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে কথাটির বাহ্যিক অর্থটিই গ্রহণীয় এবং এর দ্বিতীয় কোনো অর্থ গ্রহণ করার সুযোগই এখানে নেই। কাজেই উল্লিখিত দলগুলোর কাফের হওয়া সম্পর্কে কোরআন, হাদীস এবং ইজমার দৃষ্টিতে কোনো সন্দেহ নেই। (শিফা দ্বিতীয় খণ্ড, ২৭০-২৭১ পৃষ্ঠা)

\r\n

(৮) আল্লামা শাহারিস্তানী (মৃত্যু: ৫৪৮ হি) তাঁর মশহুর কিতাব আল মিলাল ওয়ান নিহালে লিখেছেন: এবং যে এভাবেই বলে যে, “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পরও কোনো নবী আসবে (হযরত ঈসা (আ) ছাড়া) তাহলে তার কাফের হওয়া সম্পার্কে যে কোন দু’জন ব্যক্তি মধ্যেই কোনো মতবিরোধ থাকতে পারে না। (তৃতীয় খণ্ড ২৪৯ পৃষ্ঠা)

\r\n

(৯) ইমাম রাজী (৫৪৩-৬০৬ হি) তাঁর তাফসীরে কবীরে ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’ শব্দের ব্যাখ্যা প্রসংগে বলেন: এ বর্ণনায় খাতিমুন নামিয়ীন শব্দ এজন্য বলা হয়েছে যে, যে নবীর পর অন্য কোনো নবী আসবেন তিনি যদি উপদেশ এবং নির্দেশাবলীর ব্যাখ্যার ব্যাপারে কিছু অতৃপ্তি রেখে যান, তাহলে তাঁর পর আগমনকারী নবীতা পূর্ণ করতে পারেন। কিন্তু যার পর আর কোনো নবী আসবে না, তিনি নিজের উম্মতের ওপর খুব বেশী স্নেহশীল হন এবং তাদেরকে সুস্পষ্ট নেতৃত্ব দান করেন। কেননা তাঁর দৃষ্টান্ত এমন একটি পিতার ন্যায় যিনি জানেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর পুত্রের দ্বিতীয কোনো অভিভাবক এবং পৃষ্ঠপোষক থাকবে না। (ষষ্ঠ খণ্ড, ৫৮১ পৃষ্ঠা)

\r\n

(১০) আল্লামা বায়জাবী (মৃত্যু: ৬৮৫ হি) তাঁর তাফসীরে আনওয়ারুত্‌ তানজীল-এ লিখেছেন: অর্থাৎ তিনিই শেষ নবী। তিনি নবীদের সিলসিলা খতম করে দিয়েছেন। অথবা তাঁর কারণেই নবীদের সিলসিলার ওপর মোহর লাগানো হয়েছে। এবং তাঁর পর হযরত ঈসার (আ) নাযীল হবার কারণে খতমে নবুয়্যাতের ওপর কোনো দোষ আসছে না। কেননা তিনি রসূলুল্লাহর (স) দ্বীনের মধ্যেই নাযিল হবেন। (চতুর্থ খণ্ড, ১৬৪ পৃষ্ঠা)

\r\n

(১১) আল্লামা হাফিজ উদ্দীন নাসাফী (মৃত্যু: ৮১০ হি) তাঁর তাফসীরে মাদারেকুত তানজীল-এ লিখেছেন: এবং রসূলুল্লাহ (স) খাতিমুন নাবিয়ীন। অর্থাৎ তিনিই সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আর কোনো ব্যক্তিকে নবী করা হবে না। হযরত ঈসা (আ) হলো এই যে, তাঁকে রসূলুল্লাহ্‌র পূর্বে নবীর পদে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এবং পরে যখন তিনি নাযিল হবেন, তখন তিনি হবেন রসূলুল্লাহর শরীয়তের অনুসারী। অর্থাৎ তিনি হবেন রসূলুল্লাহর উম্মত। (৪৭১ পৃষ্ঠা)

\r\n

(১২) আল্লামা আলাউদ্দীন বাগদাদী (মৃত্যু: ৭২৬ হি) তাঁর তাফসীরে ‘খাজিন’-এ লিখেছেন: (আরবী *****) অর্থাৎ আল্লাহর রসূলুল্লাহ্‌র নবুয়্যাত খতম করে দিয়েছেন। কাজেই তাঁর পরে আর কোনো নবুয়্যাত নেই এবং এ ব্যাপারে কেউ তাঁর অংশীদারও নয়।

\r\n

(আরবী ********) অর্থাৎ আল্লাহ একথা জানেন যে, তাঁর পর আর কোনো নবী নেই’ (৩৭১-৪৭২ পৃষ্ঠা)

\r\n

(১৩) আল্লামা ইবনে  কাসীর (মৃত্যু: ৭৭৪ হি) তাঁর মশুহর তাফসীরে লিখেছেন: অতঃপর আলোচ্য আয়াত থেকে একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, যখন রসূলুল্লাহ্‌র পর কোনো নবী নেই, তখন অপর কোনো রসূলের প্রশ্নই উঠতে পারে না। কেননা রিসালাত একটা বিশেষ পদমর্যাদা এবং নবুয়্যাতের পদমর্যাদা এর চাইতে বেশী সাধারণধর্মী। প্রতেক রসূল নবী হন, কিন্তু প্রত্যেক নবী রসূল হন না। রসূলুল্লাহর পর যে ব্যক্তিই এই পদমর্যাদার দাবী করবে, সেই হবে মিথ্যাবাদী, প্রতারক, দাজ্জাল এবং গোমরাহ। যতোই সে প্রাকৃতিক নিয়মে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ও যাদুর ক্ষমতাসম্পন্ন হোক না কেন, তার দাবী মানবার নয়। কিয়ামত পর্যন্ত যেসব ব্যক্তি এই পদমর্যাদার দাবী করবে, তাদের প্রত্যেকেরই অবস্থা হবে এই ধরনের। (তৃতীয় খণ্ড, ৪৯৩-৪৯৪ পৃষ্ঠা)

\r\n

(১৪) আল্লামা জালালুদ্দীন সিউতী (মৃত্যু: ৯১১ হি) তাঁর তাফসীরে জালালায়েন-এ লিখেছেন: ‘অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা জানেন যে রসূলুল্লাহর (স) পর আর কোনো নবী নেই। এবং হযরত ঈসা (আ) নাযীল হবার পর রসূরুল্লাহর শরীয়ত মোতাবেকই আমল করবেন।’ (৭৬৮ পৃষ্ঠা)

\r\n

(১৫) আল্লামা ইবনে নাজীম (মৃত্যু: ৯৭০ হি) উসুলে ফিকাহর বিখ্যাত পুস্তক আল ইশবাহ ওয়ান নাজায়েরে ‘কিতাবুস সিয়ারের’ ‘বাবুর রুইয়ায়’ লিখেছেন: যদি কেউ একথা না মনে করে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম শেষ নবী, তাহলে সে মুসলমান নয়। কেননা কথাগুলো জানা এবং স্বীকার করে নেয়া দ্বীনের অত্যধিক প্রয়োজনের মধ্যে শামিল। (১৭৯ পৃষ্ঠা)

\r\n

(১৬) মুল্লা আলী কারী (মৃত্যু: ১০১৬ হি) ‘শারহে ফিকহে আকবর’-এ লিখেছেন: ‘আমাদের রসূলের (স) পর অন্য কোনো ব্যক্তির নবুয়্যাতের দাবী করা সর্ববাদীসম্মতভঅবে কুফর। (২০২ পৃষ্ঠা)

\r\n

(১৭) শায়খ ইসমাইল হাক্কী (মৃত্যু: ১১৩৭ হি) তাফসীরে রুহুল বয়ান-এ উল্লিখিত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন: আলেম সমাজ ‘খাতাম’ শব্দটির তে-এর উপর জবর লাগিয়ে পড়েছেন, -এর অর্থ হয় খতম করবার যন্ত্র, যার সাহায্যে মোহর লাগানো হয়।

\r\n

অর্থাৎ রসূলুল্লাহ (স) সমস্ত নবীর শেষে এসেছেন এবং তাঁর সাহায্যে নবীদের সিলসিলার ওপর মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ফারসীতে আমরা একে বলবো ‘মোহর পয়গম্বর’ অর্থাৎ তাঁর সাহায্যে নবুয়্যাতের দরজার মোহর লাগিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং পয়গম্বরদের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে। অন্য পাঠকরাতো এর নীচে জের লাগিয়ে পড়েছেন ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’। অর্থাৎ রসূলুল্লাহ্‌ ছিলেন মোহর দানকারী। অন্য কথায় বলা যাবে পয়গম্বরদের ওপর মোহরকারী। এভাবে এ শব্দার্থ ‘খাতাম’-এর সমার্থক হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে রসূলুল্লাহর (স) পর তাঁর উম্মতের আলেম সমাজ তাঁর কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাবেনএকমাত্র তাঁর প্রতিনিধিত্ব। তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথেই নবুয়্যাতের উত্তরাধিকারেরও পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং তাঁর পরে হযরত ঈসার (আ) নাযিল হবার ব্যাপারটি তাঁর নবুয়্যাতকে ত্রুটিযুক্ত করবেনা। কেননা খাতিমুন নাবিয়ীন হবার অর্থ হলো এই যে, তাঁর পর আর কাউকে নবী বানানো হবেনা এবং হযরত ঈসাকে (আ) তাঁদের পূর্বেই নবী বানানো হয়েছে। কাজেই তিনি রসূলুল্লাহ্‌র অনুসারীর মধ্যে শামিল হবেন, রসূলুল্লাহর কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়বেনএবং তাঁরই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হবেন। তখন হযরত ঈসার (আ) নিকট অহী নাযীল হবেনা এবং তিনি কোনোনতুন আহকামও জারি করবনে না, বরং তিনি হবেন রসূলুল্লাহর প্রতিনিধি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এ ব্যাপারে একমত যে, আমাদের নবীর পর আর কোনো নবী নেই। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেছেন: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম শেষ নবী। এবং রসূলুল্লাহ বলেছেন: আমার পরে কোনো নবী নেই। কাজেই এখনযে বলবে যে মুহাম্মদ (স) এর পর নবী আছে, তাকে কাফের বলা হবে। কেননা সে কোরআনকে অস্বীকার করেছে এবং অনুরূপভবেসেই ব্যক্তিকেও কাফের বলা হবে যে এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে। কেননা সুস্পষ্ট যুক্তি প্রমাণের পর হক বাতিল থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এবং যে ব্যক্তি মুহাম্মদ (স)-এর পর নবুয়্যাতের দাবী করবে, তার দাবী বাতিল হয়ে যাবে। (দ্বাবিংশ খণ্ড, ১৮৮ পৃষ্ঠা)

\r\n

(১৮) শাহানশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীরের নির্দেশে বার’শ হিজরীতে পাক-ভারতের বিশিষ্ট আলেমগণ সম্মিলিতভাবে ‘ফতোয়া আলমগিরী’ নামে যে কিতাবটি লিপিবদ্ধ করেন তাতে উল্লিখিত হয়েছে: যদি কেউ মনে করে যে, মুহাম্মদ (স) শেষ নবী নয়, তাহলেসে মুসলমান নয় এবং যদি সে বলে যে, সে আল্লাহর রসূল অথবা পয়গম্বর, তাহলে তার ওপর কুফরীর ফতোয়া দেয়া হবে। (দ্বিতীয়খণ্ড, ২৬৩ পৃষ্ঠা)

\r\n

(১৯) আল্লামা শওকানী (মৃত্যু: ১২৫৫ হি) তাঁর তাফসীর ফাতহুল কাদীরে লিখেছেন: সমগ্র মুসলিম সমাজ ‘খাতিম’ শব্দটির তে-এর নীচে জের লাগিয়ে পড়েছেন এবং একমাত্র আসে জবরের সাথে পড়েছেন। প্রথমটা অর্থ হলো এই যে, রসূলুল্লাহ সমস্ত পয়গম্বরকে খতম করেছেন অর্থাৎ তিনি সবার শেষে এসেছেন এবং দ্বিতীয়টির অর্থ হলো এই যে, তিনি সমস্ত পয়গম্বরদের জন্য মোহর স্বরূপ্ এবং এর সাহায্যে নবীদের সিলসিলা মোহর এঁটে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে তাঁদের দলীটর সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছে। (চতুর্থ খণ্ড, ২৭৫ পৃষ্ঠা)

\r\n

(২০) আল্লামা আলুসি (মৃত্যু: ১২৮০ হি) তাফসীরে রুহুল মায়ানীতে লিখেছেন: নবী শব্দটি রসূলের চাইতে বেশী সাধারণ অর্থব্যঞ্জক। কাজেই রাসূলের খাতিমুন নাবিয়ীন হবার অর্থ হলো এই যে, তিনি খাতিমুল মুরসালীনও। তিনি শেষ নবী এবং শেষ রসূল-একথার অর্থ হলো এই যে, দুনিয়ায় তাঁর নবুয়্যাতের গুণে গুণান্বিত হবার পরেই মানুষ এবং জিনের মধ্য থেকে এ গুণটি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। (দ্বাবিংশ খণ্ড, ৩২ পৃষ্ঠা)

\r\n

রসূলুল্লাহর পর যে ব্যক্তি নবুয়্যাতের অহীর দাবী করবে, তাকে কাফের বলে গণ্য করা হবে। এ ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিমতের অবকাশ নেই। (দ্বাবিংশ খণ্ড, ৩৮ পৃষ্ঠা)

\r\n

“রসূলুল্লাহ শেষ নবী-একথাটি কোরআন দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে, রসূলুল্লাহর সুন্নাত এটিকে সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করেছে এবং সমগ্র মুসলিম সমাজ এর ওপর আমল করেছে। কাজেই যে ব্যক্তি এর বিরোধী কোনো দাবী করবে, তাকে কাফের বলে গণ্য করা হবে।” (দ্বাবিংশ খণ্ড, ৩৯ পৃষ্ঠা)

\r\n

বাংলা পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে মররোক্ত ও আন্দালুসিয়া এবং তুর্কী থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ আলেম, ফকীহ, মুহাদ্দিস এবং তাফসীরকারগণের ব্যাখ্যা এবং মতামত আমি এখানে উল্লেখ করলাম। তাঁদের নামের সাথে সাথে তাঁদের জন্ম এবং মৃত্যু তারিখও উল্লেখ করেছি। এ থেকেই ধারণা করা যাবে যে, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ আলেমগণ এর মধ্যে শামিল আছেন। হিজরীর চতুর্দশ শতাব্দীর আলেম সমাজের মতামতও আমি এখানে উল্লেখ করতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছা করেই তাঁদেরকে ছেড়ে দিয়েছি। কেননা তাঁরা মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর সমসাময়িক। এবং হয়তো অনেকে বলতে পারেন যে, মীর্জা সাহেবের বিরোধিতার মনোভাব নিয়েই তাঁরা খতমে নবুয়্যাতের এই অর্থ বিবৃত করেছেন। এজন্য মীর্জা সাহেবের পূর্ববর্তী যুগের আলেম সমাজের মতামতের উদ্ধৃতিই এখানে পেশ করেছি- যেহেতু মীর্জা সাহেবের সাথে তাঁদের বিরোধের প্রশ্নই উঠতে পারে না। এইসব মতামত থেকে একথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সমগ্র মুসলিমজাহান একযোগে খাতিমুন নাবিয়ীন শব্দের অর্থ নিয়েছে শেষ নবী। প্রত্যেক যুগের মুসলমানই এই একই আকীদা পোষণ করেছেন যে, রসূলুল্লাহর পর নবুয়্যাতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। একথা তাঁরা একযোগে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পর নবী অথবা রসূল হবার দাবী করেএবং যে তার দাবীকে মেনে নেয়, সে কাফের হয়ে যায়, এ ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোনো যুগে তুচ্ছতম মতবিরোধেরও সৃষ্টি হয়নি। কাজেই এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিই ফায়সালা করতে পারেন যে, ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’ শব্দের যে অর্থ আরবী অভিধান থেকে প্রমাণিত হয়, কোরআনের আয়াতের পূর্বাপর বর্ণনা থেকে যে অর্থ প্রতীয়মান হয়, রসূলুল্লাহ (স) নিজেই যা ব্যাখ্যা করেছেন, সাহাবায়ে কেরাম যে সম্পর্কে মতৈক্য পোষণ করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র মুসলিমসমাজ একযোগে দ্ব্যার্থহীনভাবে যা স্বীকার করে আসছেন, তার বিপক্ষে দ্বিতীয় কোনো অর্থ গ্রহণ অর্থাৎ কোনো নতুন দাবীদারের জন্য নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত করার অবকাশ ও সুযোগ থাকে কি? এবং এই ধরনের লোকদেরকে কেমন করে মুসলমান বলে স্বীকার করা যায়, যারা নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত করার নিছক ধারণাই প্রকাশ করেনি বরং ঐ দরজা দিয়ে এক ব্যক্তি নবুয়্যাদের দালানে প্রবেশ করেছে এবং তারা তার ‘নবুয়্যাতের’ ওপর ঈমান পর্যন্ত এনেছে?

\r\n

এ ব্যাপরে তিনটি কথা বিবেচনা করতে হবে।

\r\n\r\n

আমাদের ঈমানের সংগে খোদার কি কোনো শত্রুতা আছে?

\r\n

প্রথম কথা হলো এই যে, নবুয়্যাতের ব্যাপারটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনের দৃষ্টিতে এ বিষয়টি ইসলামের বুনিয়াদী আকিদার অন্তর্ভুক্ত, এটি স্বীকার করার বা না করার ওপর মানুষের ঈমান ও কুফরী নির্ভর করে। যদি কোনো ব্যক্তি নবী থাকেন এবং লোকেরা তাঁকে না মানে, তাহলে তারা কাফের হয়ে যায়। আবার কোনো ব্যক্তি নবী না হওয়া সত্ত্বেও যারা তাকে নবী বলে স্বীকার করে, তারাও কাফের হয়ে যায়। এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে যে কোনো প্রকার অসতর্কতার আশা করা যায় না। যদি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পর কোনো নবী আসার কথা থাকতো তাহলে আল্লাহ নিজেই কোরআনে স্পষ্ট এবং দ্ব্যার্থহীন ভাষায় তা ব্যক্ত করতেন, রসূলুল্লাহর মাধ্যমে প্রকাশ্যভাবে তা ঘোষণা করতেন এবং রসূলুল্লাহ কখনো এ দুনিয়া থেকে তাশরীফ নিয়ে যেতেন না; যতক্ষণ না তিনি সমগ্র উম্মতকে এ ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত করতেন যে, তাঁর পর আরো নবী আসবেন এবং আমরা সবাই তাঁদেরকে মেনে নিতে বাধ্য থাকবো। রসূলুল্লাহর পর নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত থাকবে এবং এই দরজা দিয়ে কোনো নবী প্রবেশ করবে, যার ওপর ঈমান না আনলে আমরা মুসলমান থাকতে পারি না অথচ আমাদেরকে এ সম্পর্কে শুধু বেখবরই রাখা হয়নি বরং বিপরীতপক্ষে আল্লাহ এবং তাঁর রসূল একযোগে এমন সব  কথা বলেছৈন, যার ফলে তের’শ বছর পর্যন্ত সমস্ত উম্মত একথা মনে করেছিলো এবং আজও মনে করে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পর আর কোনো নবী আসবেন না- আমাদের সাথে আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের এ ধরনের ব্যবহার কেন? আমাদের দ্বীন এবং ঈমানের বিরুদ্ধে আল্লাহ এবংতাঁর রসূলের তো কোনো শত্রুতা নেই!

\r\n

তর্কের খাতিরে যদি একথা মেনে নেয়া যায় যে, নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত আছে এবং কোনোনবী আসার পর আমরা যদি নির্ভয়ে এবং নিশ্চিন্তে তাঁকে অস্বীকার করে বসি, তাহলে ভয় থাকতে পারে একমাত্র আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসাবাদের! কিন্তু কিয়ামতের দিনতিনি আমাদের নিকট থেকে এ সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করলে, আমরা সোজাসুজি উল্লিখিত রেকর্ডগুলো তাঁর আদালতে পেশকরবো। এ থেকে অন্তত প্রমাণহয়েযাবে যে, (মায়াযাল্‌লাহ) আল্লাহ্‌র কিতাব এবং রসূলের সুন্নাতই আমাদেরকে এই কুফরীর মধ্যে নিক্ষেপ করছে! আমরা নির্ভয়ে বলতে পারি যে, এইসব রেকর্ড দেখার পর কোনো নতুন নবীর ওপর ঈমান না আনার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে শাস্তি দেবেন না। কিন্তু যদি সত্যি সত্যি নবুয়্যাতের দরজাবন্ধ গিয়ে থাকে এবং কোনো নবুন নবী যদি না আসতে পারে এবং এইসব সত্ত্বেও কেউ কোনো নবুয়্যাতের দাবীদারদের ওপর যদি ঈমান আনে, তাহলে তার চিন্তা করা উচিত যে, এই কুফরীর অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য সে আল্লাহর দরবারে এমনকি রেকর্ড পেশ করতে পারবে, যার ফলে সে মুক্তি লাভের আশা করতে পারে। আদালতে হাযির হবার পূর্বে তার নিজের জবাবদিহির জন্য সংগৃহীত দলিল প্রমাণগুলো এখানেই বিশ্লেষণ করে নেয়া উচিত। এবং আমরা যেসব দলিল-প্রমাণ পেশ করেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিচার করা উচিত যে, নিজের জন্য যে সাফাইয়ের ওপর নির্ভল করে সে একাজ করছে, কোনো বুদ্ধিশান ব্যক্তি কি এর ওপর নির্ভর করে কুফরীর শাস্তি ভোগ করার বিপদকে স্বাগতম জানাতে পারে?

\r\n\r\n

এখন নবীর প্রয়োজনটা কেন?

\r\n

দ্বিতীয় কথা হলো এই যে, ইবাদাত এবংনেক কাজে তরক্কী করে কোনো ব্যক্তি নিজের মধ্যে নবুয়্যাতের গুণ পয়দা করতে পারে না। নবুয়্যাতের যোগ্যতা কোনো অর্জন করার জিনিস নয়। কোনো বিরাট খেদমতের পুরস্কার স্বরূপ মানুষকে নবুয়্যাত দান করা হয় না। বরং বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে এই মর্যাদা দান করে থাকেন। এই প্রয়োজনের সময় যখন উপস্থিত হয় তখনই আল্লাহতায়ালা এক ব্যক্তিকে এই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং যখন প্রয়োজন পড়ে না অথবা থাকে না, তখন খামাখা আল্লাহতায়ালা এক ব্যক্তিকে এই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং যখন প্রয়োজন পড়ে না অথবা থাকে না, তখন খামাখা আল্লাহতায়ালা নবীর পর নবী প্রেরণ করতে থাকেন না। কোরআন মজিদ থেকে যখন আমরা একথা জানবার চেষ্টা করি যে, কোন্‌ পরিস্থিতিতে নবী প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সেখানে এ ধরনের চারটি অবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়:

\r\n

** কোনো বিশেষ জাতির মধ্যে নবী প্রেরণের প্রয়োজন এজন্য দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে ইতিপূর্বে কোন নবী আসেননি এবং অন্য কোনো জাতির মধ্যে প্রেরিত নবীর পয়গামও তাদের নিকট পৌঁছেনি।

\r\n

** নবী পাঠাবার প্রয়োজন এজন্য দেখা যায় যে, সংশ্লিষ্ট জাতি ইতিপূর্বৈ প্রেরিত নবীদের শিক্ষা ভুলে যায় অথবা তা বিকৃত হয়ে যায় এবং তাঁদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।

\r\n

**ইতিপূর্বে প্রেরিত নবীদের মাধ্যমে জনগণের শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি এবং দ্বীনের পূর্ণতার জন্য অতিরিক্ত নবীর প্রয়োজন হয়।

\r\n

** কোনো নবীল সংগে তাঁর সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আর একজন নবীর প্রয়োজন হয়।

\r\n

উপরের আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, রসূলুল্লাহ্‌র পর কোনো নবীর প্রয়োজন নেই।

\r\n

কোরআন নিজেই বলছে যে, রসূলুল্লাহকে সমগ্র দুনিয়ার জন্য হেদায়াতকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে। দুনিয়ার সাংস্কৃতিক ইতহিাস একথা বলে যে, তাঁর নবুয়্যাত প্রাপ্তির পর থেকে সমগ্র দুনিয়ায় এমন অবস্থা বিরাজ করছে, যাতে করে তাঁর দাওয়াত সব সময় দুনিয়ার সকল জাতির মধ্যে পৌঁছতে পারে। এর পরেও প্রত্যেক জাতির মধ্যে পৃথক পৃথক পয়গাম্বর প্রেরণের কোনো প্রয়োজন থাকে না।

\r\n

কোরআন একথাও বলে এবং একই সংগে হাদীস এবং সীরাতের যাবতীয় বর্ণনাও একথার সাক্ষ্যবহ যে, রসূলুল্লাহর শিক্ষা পুরোপুরি নির্ভুল এবং নির্ভেজাল আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে কোনো প্রকার বিকৃতি বা রদবদল হয়নি। তিনি যে কোরআন এনেছিলেন, তার মধ্যে আজ পর্যন্ত একটি শব্দেরও কম-বেশী হয়নি। এবং কিয়ামত পর্যন্তও তা হতে পারে না। নিজের কথা ও কর্মের মাধ্যমে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাও আজ আমরা এমনভাবে পেয়ে যাচ্ছি, যেন আমরা তাঁরই যুগে বাস করছি। কাজেই দ্বিতীয় প্রয়োজনটাও খতম হয়ে গেছে।

\r\n

আবার কোরআন মজীদ স্পষ্টভাষায় একথাও ব্যক্ত করে যে, রসূলুল্লাহর মাধ্যমে খোদার দ্বীনকে পূর্ণতা দান করা হয়েছে। কাজেই দ্বীনের পূর্ণতার জন্যও এখন আর কোনো নবীর প্রয়োজন নেই।

\r\n

এখন বাকি থাকে চতুর্থ প্রয়োজন। এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য হলো এই যে, এজন্য যদি কোনো নবীর প্রয়োজন হতো তাহলে রসূলুল্লাহর যুগে তাঁর সংগেই তাকে প্রেরণ করা হতো।কিন্তু একথা সবাই জানেন যে, এমনকোনো নবী রসূলুল্লাহর যুগে প্রেরণ করা হয়নি কাজেই এ কারণটা বাতিল হয়ে গেছে।

\r\n

এখন আমরা জানতে চাই যে, রসূলুল্লাহর পর আর একজন নতুন নবী আসবার পঞ্চম কারণটা কি? যদি কেউ বলেন যে, সমগ্র উম্মত বিগড়ে গেছে, কাজেই তাদের সংস্কারের জন্য আর একজন নতুন নবীর প্রয়োজন, তাহলে তাকে আমরা জিজ্ঞেস করবো: নিছক সংস্কারের জন্য দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত কি কোন নবী এসেছে যে শুধু এই উদ্দেশ্যেই আর একজন নতুন নবীর আবির্ভাব হলো? অহী নাযিল করার জন্যই তো নবী প্রেরণ করা হয়। কেননা নবীর নিকটেই অহী নাযিল করা হয়। আর অহীর প্রয়োজন পড়ে কোনো নতুন পয়গাম দেবার অথবা পূর্ববর্তী পয়গামকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। আল্লাহর কোরআন এবং রসূলুল্লাহর সুন্নাত সংরক্ষিত হয়ে যাবার পর যখন আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণ হয়েগেছে এবং অহীর সমস্ত সম্ভাব্য প্রয়োজন খতম হয়ে গেছে, তখন সংস্কারের জন্য একমাত্র সংস্কারকে প্রয়োজনই বাকী রয়ে গেছে- নবীর প্রয়োজন নয়।

\r\n\r\n

নতুন নবুয়্যাত বর্তমানে মুসলমানদের জন্য রহমত নয়, লা’নতের শামিল

\r\n

তৃতীয় কথা হলো এই যে, যখনই কোনো জাতির মধ্যে নবীর আগমন হবে, তখনই সেখানেই প্রশ্ন উঠবে কুফর ও ঈমানের। যারা ঐ নবীকে স্বীকার করে নেবে, তারা এক উম্মতভুক্ত হবে এবং যারা তাকে অস্বীকার করবে তারা অবশ্যই একটি পৃথক উম্মতের শামিল হবে। এই দুই উম্মতের মতবিরোধ কোনোআংশিক মতবিরোধের পর্যায়ে নেমে আসবে, যার ফলে তাদের একটি দল যতদিন না নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করবে, ততদিন পর্যন্ত তারা দুই দল কখনো একত্রিত হতে পারবে না। এ ছাড়াও কার্যত তাদের প্রত্যেকের জন্য হেদায়াত এবং আইনের উৎস হবে বিভিন্ন। কেননা একটি দল তাদের নিজেদের নবীর অহী এবং সুন্নাত থেকে আইন প্রণয়ন করবে এবং দ্বিতীয়দলটি এদু’টিকে তাদের আইনের উৎস হিসেবে মেনে নিতেই প্রথমত অস্বীকার করবে। কাজেই তাদের উভয়ের সম্মিলনে একটি সমাজ সৃষ্টি কখনো সম্ভব হবেনা।

\r\n

এই প্রোজ্জ্বল সত্যগুলো পর্যবেক্ষণ করার পর যে কোনো ব্যক্তি স্পষ্ট বুঝতে পারবেন যে, ‘খত্‌মে নবুয়্যাত’ মুসলিম জাতির জন্য আল্লাহ তায়ালার একটি বিরাট রহমত স্বরূপ। এর বদৌলতেই সমগ্র মুসলিম জাতি একটি চিরন্তন বিশ্বব্যাপী ভ্রাতৃত্বে শামিল হতে পেরেছে। এ জিনিসটা মুসলমানদেরকে এখন সব মৌলিক মতবিরোধ থেকে রক্ষা করেছে, যা তাদের মধ্যে চিরন্তন বিচ্ছেদের বীজ পবন করতো। কাজেই যেব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে হেদায়াত দানকারী এবং নেতা বলে স্বীকার করে এবং তিনি যে শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া অন্য কোন হেদায়াত উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায় না, সে আজ এই ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। নবুয়্যাতের দরজা বন্ধ না হয়ে গেলে মুসলিম জাতি কখনো এই ঐক্যের সন্ধান পেতোনা। কেননা প্রত্যেক নবীর আগমনের পর এ ঐক্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো।

\r\n

মানুষের বিবেক-বুদ্ধিও একথাই সমর্থন করে যে, একটি বিশ্বজনীন এবং পরিপূর্ণ দ্বীন দিয়ে দেবার এবং তাকে সকল প্রকার বিকৃতি ও রদবদল থেকে সংরক্ষিত করার পর নবুয়্যাতের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়াই উচিত। এর ফলে সম্মিলিতভাবে এই শেষ নবীর আগমন করে সমগ্র দুনিয়ার মুসলমান চিরকালের জন্য একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারবে এবং বিনা প্রয়োজনে নতুন নতুন নবীদের আগমনে উম্মতের মধ্যে বারবার বিভেদ সৃষ্টি হতে পারবে না। নবী ‘যিল্লী’ হোক অথবা ‘বুরুজী ওম্মতওয়ালা শরীয়ত ওয়ালা এবং কিতাবওয়ালা- যে কোন অবস্থায়ই যিনি নবী হবেন এবং খোদার পক্ষহতে তাঁকে প্রেরণ করা হবে, তাঁর আগমনের অবশ্যম্ভাবী ফল দাঁড়াবে এই যে, তাকে যারা মেনে নেবে, তারা হবে একটি উম্মত আর যারা মানবেনা তারা কাফের বলে গণ্য হবে। যখন নবী প্রেরণের সত্যিকার প্রয়োজন দেখা যায়, তখন-শুধুমাত্র তখনই-এই বিভেদ অবশ্যম্ভাবী হয়। কিন্তু যখন তার আগমনের কোন প্রয়োজন থাকেনা, তখন খোদার হিকমত এবংতাঁর রহমতের নিকট কোনক্রমেই আশা করা যায়না যে, তিনি নিজের বান্দাদেরকে খামাখা কুফর ও ঈমানের সংঘর্ষে লিপ্ত করবেন এবং তাদেরকে সম্মিলিতভাবে একটি উম্মতভুক্ত হবার সুযোগ দেবেননা। কাজেই কোরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা থেকে যা কিছু প্রমাণিত হয়, মানুষের বিবেক-বুদ্ধিও তাকে নির্ভুল বলে স্বীকার করে এবং তাথেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান নবুয়্যঅতের দরজা বন্ধ থাকাই উচিত।

\r\n\r\n

‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ এর তাৎপর্য

\r\n

নতুন নবুয়্যাতের দিকে আহ্বানকারীরা সাধারণত অজ্ঞ মুসলমানদের বলে থাকে যে, হাদীসে ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ এর আগমনের খবর দেয়া হয়েছে। আর মসীহ নবী ছিলেন। কাজেই তাঁর আগমনের ফলে খতমে নবুয়্যাত কোনো দিক দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছেনা। বরং খত্‌মে নবুয়্যাত এবং ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ এর আগমন দুটোই সমপর্যায়ে সত্য।

\r\n

এই প্রসংগে তারা আরো বলে যে, হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ নন। তাঁর মৃত্যু হয়েছে। হাদীসেযাঁর আগমনের খবর দেয়া হয়েছে তিনি হলেন ‘মসীলে মসীহ’ –অর্থাৎ হযরত ঈসার অনুরূপ একজন মসীহ। এবং তিনি ‘অমুক’ ব্যক্তি যিনি সম্প্রতি আগমন করেছেন। তাঁকে মেনে নিলে খত্‌মে নবয়্যাত বিশ্বাসের বিরোধিতা করা হয়না।

\r\n

এই প্রতারণার পর্দা ভেদ করবার জন্য আমি এখানে হাদীসের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো থেকে এই ব্যাপারে উল্লিখিত প্রমাণ্য হাদীস সমূহ সূত্রসহ নকল করছি। এই হাদীসগুলো প্রত্যক্ষ করে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারবেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কি বলেছিলেন এবং আজ তাকে কিভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে।

\r\n\r\n

হযরত ঈসা (আ) নুযুল সম্পর্কিত হাদীস

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১) হযরত আবু হোরায় (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন: সেই মহান সত্তার কছম যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ইবনে মরিয়ম ন্যায়বিচারক শাসকরূপে অবতীর্ণ হবেন। অতঃপর তিনি ক্রশ ভেঙ্গে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন। [ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলার এবং শুকর হত্যা করার অর্থ হলো এই যে, একটি পৃথক ধর্ম হিসেবে ধর্মের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ঈসায়ী ধর্মের সমগ্র কাঠামো এই আকীদার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর একমাত্র পুত্রকে (অর্থাৎ হযরত ঈসাকে (আ) ক্রশে বিদ্ধ কলে ‘লানত’ পূর্ণ মৃত্যু দান করেছেন। এবং এতেই সমস্ত মানুষেরগোনাহর কাফ্‌ফারা হয়ে গেছে। অন্যান্য নবীদের উম্মতের সংগে ঈসায়ীদের পার্থক্য হলো এই যে, এরা শুধু আকীদাটুকু গ্রহণ করেছে, অতঃপর খোদার সমস্ত শরীয়ত নাকচ করে দিয়েছে। এমনকি শুকরকেও এরা হালাল করে নিয়েছে- যা সকল নবীর শরীয়তে হারাম।

\r\n

কাজেই হযরত ঈসা (আ) নিজে এসে যখন বলবেন, আমি খোদার পুত্র নই, আমাকে ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়নিএবং আমি কারুর গোনাহর কাফফারা হইনি, তখন ঈসায়ী ধর্মবিশ্বাসের বুনিয়াদ সমূলে উৎপাটিত হবে। অনুরূপভাবে যখন তিনি বলবেন, আমার অনুসারীদের জন্র আমি শুকুর হালাল করিনি এবং তাদেরকে শরীয়তের বিধিনিষেধ থেকে মুক্তিও দেইনি, তখন ঈসায়ী ধর্মের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যও নির্মূল হয়ে যাবে।

\r\n

অন্য কথায় বলা যায়, তখন ধর্মের বৈষম্য ঘুচিয়ে মানুষ একমাত্র দ্বীন ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হবে। এর ফলে আর যুদ্ধের প্রয়োজন হবেনা এবং কারুর জিজিয়াও আদায় করা হবেনা। পরবর্তী ৫ এবং ১৫ নং হাদীস একথাই প্রমাণ করেছে।] এবং যুদ্ধ খতম করে দেবেন (বর্ণনান্তরে যুদ্ধের পরিবর্তে ‘জিজিয়া’ শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে অর্থাৎ জিজিয়া খতম করে দেবেন)। তখন ধনের পরিমাণ এতো বৃদ্ধি পাবে যে, তা গ্রহণ করার লোক থাকবে না এবং (অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছবে যে, মানুষখোদার জন্য) একটি সিজদা করে নেয়াটাকেই দুনিয়া এবং দুনিয়ার বস্তুর চাইতে বেশী মূল্যবান মনে করবে।

\r\n

(২) অন্য একটি হাদীসে হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেন যে (আরবী **********)

\r\n

ঈসা ইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না....” এবং এর পর বলা হয়েছে তা উপরোল্লিখিত হাদীসের সংগে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল।– (বুখারী, কিতাবুল মাজালেম, বাবু কাসরিক সালিব, ইবনে মাজা, কিতাবুল ফিতান, বাবু ফিতনাতিদ দাজ্জাল)

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(৩) হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স) বলেন, কেমনহবে তোমরা যখন তোমাদের মধ্যে ইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ হবেন এবং তোমাদের ইমাম নিজেদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হবেন? [অর্থাৎ হযরত ঈসা (আ) নামাজে ইমামতি করবেননা। মুসলমানদের পূর্ব নিযুক্ত ইমামের পেছনে তিনি এক্তেদা করবেন।]

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(৪) হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেন: ঈসাইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ হবেন। অতঃপর তিনি শুকর হত্যা করবেন। ক্রুশ ধ্বংস করবেন। তাঁর জন্য একাধিক নামাজ এক ওয়াক্তে পড়া হবে। তিনি এতো ধন বিতরণ করবেন যে, অবশেষে তা গ্রহীতা পাওয়া যাবে না। তিনি খিরাজ মওকুফ করে দেবেন। রওহা [রওহা মদীনা থেকে ২৫ মাইল দূরে একটি স্থানের নাম।] নামক স্থানে অবস্থান করেতিনি সেখান থেকে হজ্ব অথবা ওমরাহ করবেন অথবা দুটোই করবেন। (রসূলুল্লাহ এর মধ্যে কোন্‌টি বলেছিলেন- এ ব্যাপারে বর্ণনাকারীর সন্দেহ রয়ে গেছে)।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(৫) হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, দাজ্জালের নির্গমন বর্ণনার পর রসূলুল্লাহ বলেন: ইত্যবসরে যখন মুসলমানরা তাঁর সংগে লড়াইয়ের প্রস্তুতি করতে থাকবে, কাতারবন্দি করতে থাকবে এবং নামাজের জন্য ‘একমত’ পাঠ করা শেষ হবে, তখন ঈসা ইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ হবেন এবং নামাজে মুসলমানদের ইমামতি করবেন। খোদার দুশমন দাজ্জালতাঁকে দেখতেই এমনভাবে গলিত হতে থাকবে যেমন পানিতে লবণ গলে যায়। যদি ঈসা (আ) তাকে এই অবস্থায় পরিত্যাগ করেন, তাহলেও সে বিগলিত হয়ে মৃত্যু বরণ করবে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা তাকে হযরত ঈসার (আ) হাতে কতল করবেন। তিনি দাজ্জালের রক্তে রঞ্জিত নিজের বর্শাফলক মুসলমানদের দেখাবেন।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(৬) হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন: আমার এবং তাঁর (অর্থাৎ হযরত ঈসার) মাঝখানে আর কোনো নবী নেই। এবং তিনি অবতীর্ণ হবেন। তাঁকে দেখা মাত্রই তোমরা চিনে নিয়ো। তিনি মাঝারি ধরনের লম্বা হবেন। বর্ণ লাল সাদায় মেশানো। পরনে দু’টো হলুদ রঙের কাপড়। তাঁর মাথার চুল থেকে মনে হবে এই বুঝি পানি টপকে পড়লো। অথচ তা মোটেই সিক্ত হবেনা। তিনি ইসলামের জন্য মানুষের সংগে যুদ্ধ করবেন। ক্রুশ ভেঙ্গে টুক্‌রো টুক্‌রো করবেন। শূকর হত্যা করবনে। জিজিয়া কর রহিত করবেন। তাঁর জামানায় আল্লাহ সমস্ত মিল্লাতকেই নির্মূল করবেন। তিনি মসীহ দাজ্জালকে হত্যা করবেন এবং দুনিয়া চল্লিশ বছর অবস্থান করবেন। অতঃপর তাঁর ইন্তেকাল হবে এবং মুসলমানরা তাঁর জানাযায় নামাজ পড়বে।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(৭) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, আমি রসূলুল্লাহকে (স) বলতে শুনেছি:... অতঃপর ঈসা ইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ হবেন। মুসলমানদের আমীর তাঁকে বলবেন, আসুন, আপনি নামাজ পড়ান। কিন্তু তিনি বলবেন, না, তোমরা নিজেরাই একে অপরের আমীর। [অর্থাৎ তোমাদের আমীর তোমাদের নিজেদের মধ্যথেকে হওয়া উচিত।] আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতকে যে ইজ্জত দান করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একথা বলবেন।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(৮) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (ইবনে সাইয়াদ প্রসংগে) বর্ণনা করেছেন যে, অতঃপর উমর ইবনে খাত্তাব আরজ করলেন, হে রসূলুল্লাহ। অনুমতি দিন, আমি তাকে কতল করি। রসূলুল্লাহ (স) বললেন, যদি এ সেই ব্যক্তি (অর্থাৎ দাজ্জাল) হয়ে থাকে, তাহলে তোমরা এর হত্যাকারী নও, বরং ঈসা ইবনে মরিয়ম একে হত্যা করবেন এবং যদি এ সেই ব্যক্তি না হয়েথাকে, তাহলে জিম্মীদের মধ্য থেকে কাউকে হত্যা করার তোমাদের কোনো অধিকার নেই।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(৯) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেন যে, (দাজ্জাল প্রসংগে রসূলুল্লাহ বলেছেন:) সেইসময় ঈসা ইবনে মরিয়ম হঠাৎ মুসলমানদের মধ্যে এসে উপস্থিত হবেন। অতঃপর লোকেরা নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে যাবে। তাঁকে বলা হবে, হে রুহুল্লাহ! অগ্রসর হন। কিন্তু তিনি বলবেন, না, তোমাদের ইমামের অগ্রবর্তী হওয়া উচিত, তিনিই নামাজ পড়াবেন। অতঃপর ফজরের নামাজের পর মুসলমানরা দাজ্জালের মুকাবিলায় বের হবে। (রসূলুল্লাহ) বলেছেন: যখন সেই কাজ্জাব (মিথ্যাবাদী) হযরত ঈসাকে দেখবে, তখন বিগলিত হতে থাকবে যেমন লবণ পানিতে গলে যায়। অতঃপর তিনি দাজ্জালের দিকে অগ্রসর হবেন এবং তাকে কতল করবেন। তখন অবস্থা এমন হবে যে, গাছপালা এবং প্রস্তরখন্ড ফুকারে বলবে, হে রুহুল্লাহ! ইহুদীটা এই আমার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে! দাজ্জালের অনুগামীদের কেউ বাঁচবেনা, সবাইকে কতল করা হবে।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১০) হযরত নওয়াস ইবনে সাময়ান কেলাবী (দাজ্জাল প্রসংগে) বর্ণনা করছেন যে, (রসূলুল্লাহ বলেছেন:) দাজ্জাল তখন এসব করতে থাকবে, ইত্যবসরে আল্লাহতায়ালা মসীহ ইবনে মরিয়মকে প্রেরণ করবেন। তিনি দামেশকের পূর্ব অংশে সাদা মিনারের সন্নিকটে দুটো হলুদ বর্ণের কাপড় পরিধান করে দুজনফেরেশতার কাঁধে হাত রেখে নামাবেন। তিনি মাথা নীচু করলে পানি টপকাচ্ছে বলে মনে হবে। আবার মাথা উঁচু করলে মনে হবে যেন বিন্দু বিন্দু পানি মোতির মতো চমকাচ্ছে। তাঁর নিঃশ্বাসের হাওয়া যে কাফেরের গায়ে লাগবে- এবং এর গতি হবে তাঁর দৃষ্টিসীমাপর্যন্ত-সে জীবিত থাকবে না। অতঃপর ইবনে মরিয়ম দাজ্জালের পশ্চাদ্ধাবন করবেন এবং লুদের [এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, লূদ (Lydda) ফিলিস্তিনের অন্তর্গত বর্তমান ইসরাঈল রাষ্ট্রের রাজধানী তেলআবীব থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। ইহুদীরা এখানে একটি বিরাট বিমান বন্দর নির্মাণ করেছে] দ্বারপ্রান্তে তাকে গ্রেফতার করে হত্যা করবেন।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স)বলেন: দাজ্জাল আমার উম্মতের মধ্যে বের হবে এবং চল্লিশ (আমি জানিনা চল্লিশদিন, চল্লিশ মাস অথবা চল্লিশ বছর) [এটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমরের কথা] অবস্থান করবে। অতঃপর আল্লাহ ঈসা ইবনে মরিয়মকে পাঠাবেন।তাঁর চেহারা উরওয়া ইবনে মাসউদের (জনৈক সাহাবী) মতো। তিনি দাজ্জালের পশ্চাদ্ভাবন করবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। অতঃপর সাত বছর পর্যন্ত মানুষ এমন অবস্থায় থাকবে যে, দুজনলোকের মধ্যে শত্রুতা থাকবেনা।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১২) হযরত হোজায়ফা ইবনে আসীদ আল গিফারী (রা) বর্ণনা করেছেনযে, একবার রাসূলুল্লাহ (স) আমাদের মজলিসে তাশরীফ আনলেন। তখন আমরা নিজেদের মধ্যে আলোনায় লিপ্ত ছিলাম। রসূলুল্লাহ (স) জিজ্ঞেস করলেন: তোমরা কি আলোচনা করছো? লোকেরা বললো, আমরা কিয়ামতের কথা আলোচনা করছি। তিনি বললেন: দশটিনিশানা প্রকাশ না হবার পূর্বে তা কখনো কায়েম হবেনা। অতঃপর তিনি দশটি নিশানা বলে গেলেন। এক: ধোঁয়া, দুই: দাজ্জাল, তিন: মৃত্তিকার প্রাণী, চার: পশ্চিম দিক হতে সুর্যোদয়, পাঁচ ঈসা ইবনে মরিয়মের অবতরণ, ছয়: ইয়াজুজ ও মাজুজ, সাত: তিনটি প্রকাণ্ড জমি ধ্বংস (Landslide) একটি পূর্বে, আট: একটি পশ্চিমে, নয়: আর একটি আরব উপদ্বীপে, দশ: সর্বশেষ একটি প্রকাণ্ড অগ্নি ইয়েমেন থেকে উঠবে এবং মানুষকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে হাশরের ময়দানের দিকে।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১৩) রসূলুল্লাহর (স) আজাদকৃত গোলাম সাওবান (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ বলেন: আমার উম্মতের দু’টো সেনাদলকে আল্লাহতায়ালা দোজখের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে একটি হলো- যারা হিন্দুস্থানের ওপর হামলা করবে আর দ্বিতীয়টি ঈসা ইবনে মরিয়মের সংগে অবস্থানকারী।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১৪) মাজমা ইবনে জারিয়া আনসারী (রা) বলেন, আমি রসূলুল্লাহকে (স) বলতে শুনেছি: ইবনে মরিয়ম দাজ্জালকে লুদের দ্বারপ্রান্তে কতল করবেন।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১৫) আবু উমামা বাহেলী (এক দীর্ঘ হাদীসে দাজ্জাল প্রসংগে) বর্ণনা করেছেন যে, ফজরের নামায পড়বার জন্য মুসলমানদের ইমাম যখন অগ্রবর্তী হবেন, ঠিক সেইসময় ঈসা ইবনে মরিয়ম তাদের ওপর অবতীর্ণ হবেন। ইমাম পিছনে সরে আসবেনঈসাকে (আ) অগ্রবর্তী করার জন্য কিন্তু ঈসা (আ) তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলবেন: না, তুমিই নামাজ পড়াও। কেননা এরা তোমার জন্যই দাঁড়িয়েছে। কাজেই তিনিই (ইমাম) নামাজ পড়াবেন। সালাম ফেরার পরঈসা (আ) বলবেন: দরজা খোলো। দরজা খোলা হবে। বাইরে দাজ্জাল ৭০ হাজার সশষ্ত্র ইহুদী সৈন্য নিয়ে অপেক্ষা করবে। তার দৃষ্টি হযরত ঈসার (আ) ওপর পড়া মাত্রই সে এমনভাবে বিগলিত হতে থাকবে, যেমন লবণ পানিতে গলে যায়। এবং সে পৃষ্ঠদর্শন করবে। ঈসা (আ) বলবেন: আমার নিকট তোর জন্য এমন এক আঘাত আছে যার হাত থেকে তোর কোনক্রমেই নিষ্কৃতি নেই। অতঃপর তিনি তাকে লূদের পূর্ব দ্বারদেশে গিয়ে গ্রেফতার করবেন এবং আল্লাহতায়ালা ইহুদীদেরকে পরাজয়দান করবেন..... এবং জমিন মুসলমানদের দ্বারা এমনভাবে ভরপুর হবে যেমন পাত্র পানিতে ভরে যায়। সবাই একই কালেমায় বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং দুনিয়ায় আল্লাহ ছাড়া আর কারুর বন্দেগী করা হবেনা।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১৬) উসমান ইবনে আবিল আস (রা) বলেন, আমি রসূলুল্লাহকে (স) বলতে শুনেছি:...... এবংঈসা ইবনে মরিয়ম আলাইহিস সালাম ফজরের নামাজের সময় অবতরণ করবেন। মুসলমানদের আমীর তাঁকে বলবেন, হে রুহুল্লাহ! আপনি নামাজ পড়ান! তিনি জবাব দেবেন: এই উম্মতের লোকেরা নিজেরাই নিজেদের আমীর। তখন মুসলমানদের আমীর অগ্রবর্তী হয়ে নামায পড়াবেন। অতঃপর নামাজ শেষ করে ঈসা (আ) নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে দাজ্জালের দিকে অগ্রসর হবেন। তিনি নিজের অস্ত্র দিয়ে দাজ্জালকে কতল করবেন এবং তার দলবল পরাজিত হয়ে পৃষ্ঠপদর্শন করবে। কিন্তু কোথাও তারা আত্মগোপন করার জায়গা পাবেনা। এমন কি বৃক্ষও ফুকারে বলবে: হে মুমিন, এখানে কাফের লুকিয়ে আছে। এবং প্রস্তর খণ্ডও ফুকারে বলবে: হে মুমিন, এখানে কাফের লুকিয়ে আছে।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১৭) সামুরা ইবনে জুনদুব (এক দীর্ঘ হাদীসে) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স) বলেন: অতঃপর সকাল বেলা ঈসা ইবনে মরিয়ম মুসলমানদের মধ্যে আসবেন এবং আল্লাহতায়ালা দাজ্জাল এবং তার সেনাবাহিনীকে পরাজয় দান করবেন। এমন কি প্রাচীর এবং বৃক্ষের কাণ্ডও ফুকারে বলবে: হে মুমিন, এখানে কাফের আমার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে। এসো, একে কতল করো!

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১৮) ইবনে হোসাইন বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স) বলেন: আমাদের উম্মতের মধ্যে হামেশা একটি দল হকের ওপর কায়েম থাকবে এবং তারা বিরোধী দলের ওপর প্রতিপত্তি বিস্তার করবে। অবশেষে আল্লাহতায়ালার ফয়সালা এসে যাবে এবং ঈসা ইবনে মরিয়ম আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হবেন।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(১৯) হযরত আয়েশা রাজিআল্লাহ আন্‌হা (দাজ্জাল প্রসংগে) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ বলেন: অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হবেন। তিনি দাজ্জালকে কতল করবেন। অতঃপর ঈসা(আ) চল্লিশ বছর আদিল ইমাম এবং ন্যায়নিষ্ঠ শাসক হিসেবে দুনিয়ায় অবস্থান করবেন।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(২০) রসূলুল্লাহর আজাদকৃত গোলাম সাফীনা (রা) (দাজ্জাল প্রসংগে) বর্ণনা করেছেন, যে রসূলুল্রাহ (স) বলেন: অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হবেন এবং আল্লাহতায়ালা উফায়েকের পর্বতে পথের [উফায়েককে বর্তমান ফায়েক বলা হয়। সিরিয়া এবং ইসরাইল সীমান্তে বর্তমান সিরিয়া রাষ্ট্রের সর্বশেষ শঞর। এর পরে পশ্চিমের দিকেকয়েক মাইল দূরে তাবারিয়া নামক একটি হ্রদ আছে। এখানে জর্দান নদরি উৎপত্তিস্থল। এর দক্ষিণ-পশ্চিমে পাহাড়েরর মধ্যভাগে নিম্ন ভূমিতে একটি রাস্তা রয়েছে। এই রাস্তাটি প্রায় দেড় হাজার ফুট গভীরে নেমে গিয়ে সেই স্থানে পৌঁছায় যেখানথেকে জর্দান নদী তাবারিয়া মথ্যহতে নির্গত হচ্ছে। এই পার্বত্য পথকেইবলা ‘আকাবায়ে উফায়েক” (উফায়েকের নিম্ন পার্বত্য পথ)।] সন্নিকটে তাকে (দাজ্জালকে) মেরে ফেলবেন।

\r\n

(আরবী **********)

\r\n

(২১) হযরত হোজায়ফা ইবনে ইয়ামান (দাজ্জাল প্রসংগে) বর্ণনা করেছেনযে, রসূলুল্লাহ বলেন: অতঃপর যখন মুসলমানরা নামাজের জন্য তৈরী হবে, তখন তাদের চোখের সম্মুখে ঈসা ইবনে মরিয়ম অবতীর্ণ হবেন। তিনি মুসলমানদের নামাজ পড়াবেন অতঃপর সালাম ফিরিয়ে লোকদের বলবেন যে, আমার এবং খোদার এই দুশমনের মাঝখান থেকে সরেযাও.... এবং আল্লাহতায়ালা দাজ্জালের দলবলের ওপর মুসলমানদেরকে প্রতিপত্তি দান করবেন।

\r\n

মুসলমানরা তাদেরকে বেধড়ক হত্যা করতে থাকবে। অবশেষে বৃক্ষ এবং প্রস্তর খণ্ডও ফুকারে বলবে: হে আল্লাহর বান্দা, হে রহমানেসর বান্দা, হে মুসলমান!দেখো, এখানে একজন ইহুদী, একে হত্যা করো। এভাবে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দেবেন এবং মুসলমানগণ বিজয় লাভ করবে। তারা ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলবে, শুকর হত্যা করবে এবং জিজিয়া মওকুফ করে দেবে। [মুসলিমেও হাদীসটি সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে এবং হাফেজ ইবনে হাজার আসকালীণ ফাতহুল বারীর ষষ্ঠ খণ্ডে ৫৫০ পৃষ্ঠায় এটিকে ‘ছহীহ’ বলে গণ্য করেছেন।

\r\n

এই ২১টি হাদীস ১৪ জন সাহাবায়ে মারফত নির্ভুল সনদসহ হাদীসের নির্ভরযোগ্য কিতাবগেুলোয় উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও এ ব্যাপারে আরো অসংখ্য হাদীস অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু আলোচনা দীর্ঘ হবার ভয়ে আমি সেগুলো এখানে উল্লেখ করলাম না। বর্ণনা এবং সনদের দিক অধিকতর শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য হাদীসগুলোই শুধু এখানে উদ্ধৃত করলাম।

\r\n\r\n

এই হাদীসগুলো থেকে কি প্রমাণ হয়?

\r\n

যে কোনো ব্যক্তি এ হাদীসগুলো পড়ে নিজেই বুঝতে পারবেনযে, এখানে কোনো ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’, “মছীলে মসীহ” বা “বুরুজী মসীহ”র কোনো উল্লেখই করা হয়নি। এমন কি বর্তমান কালে কোনো পিতার ঔরসে মায়ের গর্ভ জন্মগ্রহণ করে কোনো ব্যক্তির একথা বলার অবকাশ নেই যে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম যে মসীহ সম্পর্কে ভবিষদ্বাণী করেছিলেন তিনিই সেই মসীহ। আজ থেকে দু’হাজার বছর আগে পিতা ছাড়াই হযরত মরিয়মের (আ) গর্ভে যে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম হয়েছিল এই হাদীসগুলোর দ্ব্যার্থহীন বক্তব্যথেকে তাঁরই অবতরণের সংবাদ শ্রুত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি ইন্তেকাল করেছেন, না জীবিত অবস্থায় কোথাও রয়েছেন- এ আলোচনা সম্পূর্ণ অবান্তর। তর্কের খাতিরে যদি এ কথা মেনে নেয়া হয় যে, তিনি ইন্তেকাল করেছেন তাহলেও বলা যায় যে, আল্লাহ তাঁকে জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন। [যারা আল্লাহর এই পুনরুজ্জীবনের ক্ষমতা অস্বীকার করেন তাদের সূরা বাকারার ২৫৯ নম্বর আয়াতটির অনুধাবন করাউচিত। এ আয়াতে আল্লাহ বলেন যে, তিনি তাঁর এক বান্দাকে ১০০ বছর পর্যন্ত মৃত অবস্থায় রাখার পর আবার তাকে জীবিত করেন।] উপরন্তু আল্লাহ তাঁর এক বান্দাকে তাঁর এই বিশাল সৃষ্টি জগতের কোনো এক স্থানে হাজার বছর জীবিত অবস্থায় রাখার পর নিজের ইচ্ছামতো যে কোনো সময়তাঁকে এই দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনতে পারেন। আল্লাহর অসীম ক্ষমতার প্রেক্ষিতে একথা মোটেই অস্বাভাবিক মনে হয়না। বলা বাহুল্য, যে ব্যক্তি হাদীসকে সত্য বলে স্বীকার করে তাকে অবশ্যই ভবিষ্যতে আগমনকারী ব্যক্তিকে উল্লিখিত ঈসা ইবনে মরিয়ম বলে স্বীকার করতেই হবে। তবে যে ব্যক্তি হাদীস অস্বীকার করে সে আদতে কোনো আগমনকারীর অস্তিত্বই স্বীকার করতে পারেনা। কারণ আগমনকারীর আগমন সম্পর্কে যে বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে হাদীস ছাড়া আর কোথাও তার ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কিন্তু এই অদ্ভূত ব্যাপারটি শুধু এখানেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আগমনকারীর আগমন সম্পর্কিত ধারণা বিশ্বাস গ্রহণ করা হচ্ছে হাদীস থেকে কিন্তু সেই হাদীসগুলোই আবার যখন সুস্পষ্ট করে এ বক্তব্য তুলে ধরছে যে, উক্ত আগমনকারী কোনো ‘মছীলে মসীহ’ (মসীহ-সম ব্যক্তি) নন বরং তিনি হবেন স্বয়ং ঈসা ইবনে মরিয়ম আলাইহস সালাম তখন তা অস্বীকার করা হচ্ছে।

\r\n

এই হাদীসগুলো থেকে দ্বিতীয় যে বক্তব্যটি সুস্পষ্ট ও দ্ব্যার্থহীনভাবে ফুটে উঠেছে তা হচ্ছে এই যে, হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ) দ্বিতীয়বার নবী হিসেবে অবতরণ করবেন না। তাঁর ওপর অহী নাযিল হবেনা। খোদার পক্ষ থেকে তিনি কোনো নতুন বাণী বা বিধান আনবেন না। শরীয়তে মুহাম্মদীর মধ্যেও তিনি হ্রাস বৃদ্ধি করবেননা। দ্বীন ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্যও তাঁকে দুনিয়ায় পাঠানো হবে না। তিনি এসে লোকদেরকে নিজের ওপর ঈমান আনার আহ্বান জানাবেননাএবং তাঁর প্রতি যারা ঈমান আনবে তাদেরকে নিয়ে পৃথক উম্মতও গড়ে তুলবেননা। [পূর্বপবর্ত আলেমগণ এ বিষয়টিকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। আল্লামা আফ্‌তাবানী (হিঃ ৭২২-৭৯২) শরহে আকায়েদে নাসাফী গ্রন্থে লিখেছেন: “মুহাম্মদ (স) সর্বশেষ নবী, একথা প্রমাণিত সত্য... যদি বলা হয়, তাঁর পর হাদীসে হযরত ঈসার (আ) আগমনের কথা বর্ণিত হয়েছে তাহলে আমি বলবো, হাঁ হযরত ঈসা (আ) আগমনের কথা বলা হয়েছে সত্য, তবে তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের অনুসারী হবেন। কারণ তাঁর শরীয়ত বাতিল হয়ে গেছে। কাজেই তাঁর ওপর অহী নাযিল হবেনা এবং তিনি নতুন বিধানও নির্ধারণ করবেন না। বরং তিনি মুহাম্মদ রসূলুল্লাহর (স) প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন।” (মিসরে মুদ্রিত, ১৩৫ পৃষ্ঠা)

\r\n

আল্লামা আলুসী তাঁর ‘রুহুল মা’নী’ নামক তাফসীর গ্রন্থেও প্রায় একই বক্তব্য পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন: “অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হবেন। তিনি অবশ্য তাঁর পূর্ব প্রদত্ত নবুয়্যাতের পদমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। কাণ তিনি নিজের আগের পদমর্যাদা থেকেতো অপসারিত হবেননা। কিন্তু নিজের পূর্বের শরীয়তের অনুসারী হবেননা। কারণ তা তাঁর নিজের ও অন্যসব লোকদের জন্য বাতিল হয়ে গেছে। কাজেই বর্তমানে তিনি মূলনীতি থেকে খুঁটিনাটি ব্যাপার পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের বিধানও নির্ধারণ করবেননা। “বরং তিনি মুহাম্মদ রসূলুল্লাহর (স) প্রতিনিধি এবং তাঁর উম্মতের মধ্যস্থিত মুহাম্মদী মিল্লাতের শাসকদের মধ্য থেকে একজন শাসক হবেন।”) (২২শ খণ্ড, ৩২ পৃষ্ঠা)

\r\n

ইমাম রাজী এ কথাটিকে আরো সুস্পষ্ট করে নিম্নোক্ত ভাষায় পেশ করেছেন: “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম পর্যন্ত নবীদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের আগমনের পর নবীদের আগমন শেষ হয়ে গেছে। কাজেই বর্তমানে ঈসার (আ) অবতহরণের পর তিনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের অনুসারী হবেন একথা মোটেই অযৌক্তিক নয়।” (তাফসীরে কবীর, ৩য় খণ্ড, ৩৪৩ পৃষ্ঠা)] তাঁকে কেবলমাত্র একটি পৃথক দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠানো হবে। অর্থাৎ তিনি দাজ্জালের ফিত্‌নাকে সমূহে বিনাশ করবেন। এজন্য তিনি এমনভাবে অবতরণ করবেন যার ফলে তাঁর অবতরণের ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ থাকবেনা। যেসব মুসলমানের মধ্যে তিনি অবতরণ করবেন তারা নিঃসংশয়ে বুঝতে পারবে যে, রসূলুল্লাহ (স) যে ঈসা ইবনে মরিয়ম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনিই সেই ব্যক্তি এবং রসূলুল্লাহর কথা অনুযায়ী তিনি যথা সময়ে অবতরণ করেছেন, তিনি এসে মুসলমানদের দলে শামিল হয়ে যাবেন। মুসলমানদের তদানীন্তন ইমামের পিছনে তিনি নামাজ পড়বেন। [যদিও দুটি হাদীসে (৫ ও ২১ নং) বলা হয়েছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করার পর প্রথম নামাজটি নিজে পড়াবেন। কিন্তু অধিকাংশ এবং বিশেষ করে শক্তিশালী কতিপয় হাদীস (৩, ৭, ৯, ১৫ ও ১৬ নয়) থেকে জানা যায় যে, তিনি নামাজে ইমামতি করতে অস্বীকার করবেন এবং মুসলমানদের তৎকালীন ইমাম ও নেতাকে অগ্রবর্তী করবেন। মুহাদ্দিস ও মুফাস্‌সিরগণ সর্বসম্মতভাবে এ মতটি গ্রহণ করেছেন।] তৎকালে মুসলমানদের যিনি নেতৃত্ব দেবেন তিনি তাঁকেই অগ্রবর্তী করবেন যাতে এই ধরনের সন্দেহের কোনো অবকাশই না থাকে যে, তিনি নিজের পয়গম্বরী পদমর্যাদা সহকারে পুনর্বার পয়গম্বরীর দায়িত্ব পালন করার জন্য ফিরে এসেছেন। নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, কোনো দলে খোদার পয়গম্বরের উপস্থিতিতে অন্য কোনো ব্যক্তি ইমাম বা নেতা হতে পারেন না। কাজেই নিছক এক ব্যক্তি হিসেবে মুসলমানদের দলে তাঁর অন্তর্ভুক্তি স্বতঃস্ফুর্তভাবে এ কথাই ঘোষণা করবে যে, তিনি পয়গম্বর হিসেবে আগমন করেননি। এজন্যতাঁর আগমনে নবুয়্যাতের দুয়ার উন্মুক্ত হবার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা।

\r\n

নিঃসন্দেহে তাঁর আগমন বর্তমান ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধানের আমলে প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের আগমনের সাথে তুলনীয়। এ অবস্থায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের অধীনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অংশগ্রহণ করতে পারন। সাধারণ বোধ সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি সহজেই এ কথা বুঝতে পারেন যে, এক রাষ্ট্রপ্রধানের আমলে অন্য একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের নিছক আগমনেই আইন ভেঙ্গে যায় না। তবে দুটি অবস্থায় আইনের বিরুদ্ধাচরণ অনিবার্য হয়ে পড়ে। এক, প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান এসে যদি আবার নতুন করে রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন। দুই, কোনো ব্যক্তি যদি তাঁর প্রধান রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা ও দায়িত্ব অস্বীকার করে বসেন। কারণ এটা হবে তাঁর রাষ্ট্র থাকাকালে যেসব কাজ হয়েছিল সেগুলোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার নামান্তর। এই দু’টি অবস্থার কোনো একটি না হলে প্রাক্তন রাষ্ট্র-প্রধানের নিছক আগমনেই আইনগত অবস্থাকে কোনো প্রকারে পরিবর্তিত করতে পারেনা। হযরত ঈসার (আ) দ্বিতীয় আগমনের ব্যাপারটিও অনুরূপ। তাঁর নিছক আগমনেই খতমে নবুয়্যাতের দুয়ার ভেঙ্গে পড়েনা। তবে তিনি এসে যদি নবীর পদে অধিষ্ঠিত হন এবং নবুয়্যাতের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন অথবা কোনো ব্যক্তি যদি তাঁর প্রাক্তন নবুয়্যাতের মর্যাদাও অস্বীকার করে বসে, তাহলে এক্ষেত্রে আল্লাহর নবুয়্যাত বিধি ভেঙ্গে পড়ে। হাদীসে একদিকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে যে, মুহাম্মদ রসূলুল্লাহর (স) পর আর কোনো নবী নেই এবং অন্যদিকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম পুনর্বার অবতরণ করবেন। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, তাঁর এ দ্বিতীয় আগমন নবুয়্যাতের দায়িত্ব পালন করার উদ্দেশ্যে হবেনা।

\r\n

অনুরূপভাবে তাঁর আগমনে  মুসলমানদের মধ্যে কুফর ও ঈমানের কোনো নতুন প্রশ্ন দেখা দেবেনা। আজও কোনো ব্যক্তি তাঁর পূর্বের নবুয়্যাতের ওপর ঈমান না আনলে কাফের হয়ে যাবে। মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ (স) নিজেও তাঁর ঐ নবুয়্যাতের প্রতি ঈমান রাখতেন। মুহাম্মদ রসূলুল্লাহর (স) সমগ্র উম্মতও শুরু থেকেই তাঁর ওপর ঈমান রাখে। হযরত ঈসার (আ) পুনর্বার আগমনের সময়ও এই একই অবস্থা অপরিবর্তিত থাকবে। মুসলমানরা কোনো নতুন নবুয়্যাতের প্রতি ঈমান আনবে না, বরং আজকের ন্যায় সেদিনও তারা ঈসা ইবনে মরিয়মের (আ) পূর্বের নবুয়্যাতের ওপরই ঈমান রাখবে। এ অবস্থাটি বর্তমানে যেমন খতমে নবুয়্যাত বিরোধী নয়, তেমনি সেদিনও বিরোধীহবেনা।

\r\n

সর্বশেষ যে কথাটি এই হাদীসগুলো এবং অন্যান্য বহুবিধ হাদীস থেকে আনা যায় তা হচ্ছে এই যে, হযরত ঈসাকে (আ) যে দাজ্জালের বিশ্বব্যাপী ফিত্‌না নির্মূল করার জন্য পাঠানো হবে সে হবে ইহুদী সংশোদ্ভূত। সে নিজেকে ‘মসীহ’ রূপে পেশ করবে। ইহুদীদের ইতিহাস ও তাদের ধর্মীয় চিন্তা-বিশ্বাস সম্পর্কে অনবহিত কোনো ব্যক্তি এ বিষয়টির তাৎপরর্য অনুধান করতে সক্ষম হবেনা। হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের মৃত্যুর পর যখন বনি ইসরাঈলরা সামাজিক ধর্মীয় অবক্ষয় ও রাজনৈতিক পতনের শিকার হলো এবং তাদের এ পতন দীর্ঘায়িত হতে থাকলো, এমন কি অবশেষে ব্যবিলেন ও আসিরিয়া অধিপতিরা তাদেরকে পরাধীন করে দেশ থেকে বিতাড়িত করলো এবং দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত করে দিলো, তখন বনি ইসরাইলের নবীগণ তাদেরকে সুসংবাদ দিতে থাকলেন যে, খোদার পক্ষ থেকে একজন ‘মসীহ’ এসে তাদেরকে এই চরম লাঞ্চনা থেকে মুক্তি দেবেন। এইসব ভবিষ্যদ্বাণীর প্রেক্ষিতে ইহুদীরা একজন মসীহের আগমনের প্রতীক্ষারত ছিল। তিনি হবেন বাদশাহ। তিনি যুদ্ধ করে দেশ জয় করবেন। বনি ইসরাঈলদেরকে বিভিন্ন দেশ থেকে এনে ফিলিস্তিনে একত্রিত করবেন এবং তাদের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কায়েম করবেন। কিন্তু তাদের এসব আশা-আকাংখাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ) খোদার পক্ষ থেকে ‘মসীহ’ হয়ে আসলেন এবং কোনো সেনাবাহিনী ছাড়াই আসলেন, তখন ইহুদীরা তাঁকে ‘মসীহ’ বলে মেনে নিতে অস্বীকার করলো। তারা তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত ইহুদী দুনিয়া সেই প্রতিশ্রুত মসীহর প্রতীক্ষা করছে, যার আগমনের সুসংবাদ তাদেরকে দেয়া হয়েছিল। তাদের সাহিত্য সেই বাঞ্চিত যুগের সুখ-স্বপ্ন কল্প-কাহিনীতে পরিপূর্ণ। তালমুদ ও রাববীর সাহিত্য গ্রন্থসমূহে এর যে নক্‌শা তৈরী করা হয়েছে তার কল্পিত স্বাদ আহরণ করে শত শত বছর থেকে ইহুদী জাতি জীবন ধারণ করছে। তাদের বুক ভরা আশা নিয়ে বসে আছে যে, এই প্রতিশ্রুত মসীহ হবেন একজন শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক নেতা। তিনি নীল নদ থেকে ফোরাত পর্যন্ত সমগ্র এলাকা, যে এলাকাটিকে ইহুদীরা নিজেদের ‘উতর্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এলাকা’ মনে করে, আবার ইহুদীদের দখলে আনবেন এবং সারা দুনিয়া থেকে ইহুদীদেরকে এনে এখানে একত্রিত করবেন।

\r\n

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করে রসূলুল্লাহর (স) ভবিষ্যদ্বাণীর আলোকে ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মহানবীর (স) কথামত ইহুদীদের ‘প্রতিশ্রুত মসীহর’ ভূমিকা পালনকারী প্রধানতম দাজ্জালের আগমনের জন্য মঞ্চ সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনের বৃহত্তম এলাকা থেকে মুসলমানদের বেদখল করা হয়েছে। সেখানে ইরাঈল নামে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীরা দলে দলে এখানে বাসস্থান গড়ে তুলছে। আমেরিকা, বৃটেন ও ফ্রান্স তাকে একটি বিরাট সামরিক শক্তিকে পরিণত করেছে। ইহুদী পুঁজিপতিদের সহায়তায় ইহুদী বৈজ্ঞানিক ও শিল্পবিদগণ দ্রুত উন্নতির পথে েএগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। চারপাশের মুসলিম দেশগুলোর জন্য তাদের এ শক্তি এক মহাবিপদে পরিণত হয়েছে। এই রাষ্ট্রের শাসকবর্গ তাদের এই ‘উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দেশ’ দখল করার আকাংখাটি মোটেই

\r\n

(মানচিত্র *****************)

\r\n

লুকিয়ে রাখেননি। দীর্ঘকাল থেকে ভবিষ্যত ইহুদী রাষ্ট্রের যে নীল নক্‌শা তারা প্রকাশ করে আসছে পরের পাতায় তার একটি প্রতিকৃতি দেয়া হলো। এ নক্‌শায় দেখা যাবে, সিরিয়া, লেবানন ও জর্দানের সমগ্র এলাকা এবং প্রায় সমগ্র ইরাক ছাড়াও তুরস্কের ইস্কান্দোরুন, মিসরের সিনাই ও ব-দ্বীপ এলাকা এবং মদীনা মুনাওয়ারাসহ আরবের অন্তর্গত হেজাজ ও নজ্‌দের উচ্চভূমি পর্যন্ত তারা নিজেদের সাম্রাজ্র বিস্তার করতে  চায়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, আগামীতে কোনোএকটি বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে তারা ঐসব  এলাকা দখল করার চেষ্টার করবে এবং ঐ সময়ই কথিত প্রধানতম দাজ্জাল তাদের প্রতিশ্রুত মসীহরূপে আগমন করবে। রসূলুল্লাহ (স) কেবল তার আগমন সংবাদ দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং এই সংগে একথাও বলেছেন যে, সে সময় মুসলমানদের ওপর বিপদের পাহাড় ভেঙে পড়বে এবং এক একটি দিন তাদের নিকট এক একটি বছর মনে হবে। এজন্য তিনি নিজে মসীহ দাজ্জালের ফিত্‌না থেকে খোদার নিকট আশ্রয় চেয়েছেন এবং মুসলমানদেরকেও আশ্রয় চাইতে বলেছেন।

\r\n

এই মসীহ দাজ্জালের মোকাবিলা করার জন্য আল্লাহ কোনো ‘মসীলে মসীহ’কে পাঠাবেন না বরং আসল মসীহকে পাঠাবেন। দু’হাজার বছর আগে ইহুদীরা এই আসল মসীহকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলএবং নিজেদের জানা মতে তারা তাঁকে শূলবিদ্ধ করে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। এই আসল মসীহ ভারত, আফ্রিকা বা আমেরিকায় অবতরণ করবেন না বরং তিনি অবতরণ করবেন দামেশ্‌কে। কারণ তখন সেখানেই যুদ্ধ চলতে থাকবে। মেহেরবানী করে পরের পাতার নকশাটিও দেখুন। এতে দেখা যাচ্ছে, ইসরাঈলের সীমান্ত থেকে দামেশক মাত্র ৫০ থেকে ৬০ মাইলের মধ্যে অবস্থিত। ইতিপূর্বে আমি যে হাদীস উল্লেখ করে এসেছি, তার বিষয়বস্তু মনে থাকলে সহজেই একথা বোধগম্য হবে যে, মসীহ দাজ্জাল ৭০ হাজার ইহুদী সেনাদল নিয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করবে এবং দামেশকের সামনে উপস্থিত হবে। ঠিক সেই মুহুর্তে দামেশকের পূর্ব অংশের একটি সাদা মিনারের নিকট সুব্‌হে সাদেকের পর হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন এবং ফজর নামায শেষে মুসলমানদের নিয়ে দাজ্জালের মুকাবিলায় বের হবেন। তাঁর প্রচণ্ড আক্রমণে দাজ্জাল পশ্চাদপসরণ করে উফাইকের পার্বত্য পথ দিয়ে (২১১ নম্বর হাদীসে দেখুন) ইসরাঈলের দিকে ফিরে যাবে। কিন্তু তিনি তার পশ্চাদ্ধাবন করতেই থাকনে। অবশেষে লিড্ডা বিমান বন্দরে সে তাঁর হাতে মারা পড়বে (১০, ১৪ ও ১৫ নং হাদীস)। এরপর ইহুদীদেরকে সব জায়গা থেকে ধরে ধরে হত্যা করা হবে এবং ইহুদী জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে (৯, ১৫ ও ২১ নম্বর হাদীস)। হযরত ঈসার (আ) পক্ষ থেকে সত্য প্রকাশের পর ঈসায়ী ধর্মও বিলুপ্ত হয়ে যাবে (১, ২, ৪ ও ৬ নম্বর হাদীস( এবং মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে সমস্ত মিল্লাতে একীভূত হয়ে যাবে (৬ ও ১৫ নম্বর হাদীস)।

\r\n

কোনোপ্রকার জড়তা ও অস্পষ্টতা ছাড়াই এই দ্ব্যার্থহীন সত্যটিই হাদীস থেকে ফুটে উঠেছে। এই সুদীর্ঘ আলোচনার পর এ ব্যাপারে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ থাকেনা যে, “প্রতিশ্রুত মসীহ”র নামে আমাদের দেশে যে কারবার চালানো হচ্ছে তা একটি প্রকাণ্ড জালিয়াতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

\r\n

এই জালিয়অতির সবচাইতে হাস্যকর দিকটি এবার আমি উপস্থাপিত করতে চাই। যে ব্যক্তি নিজেকে এই ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লিখিত মসীহর সাথে অভিন্ন বলে ঘোষণা করেছেন, তিনি নিজে ঈসা ইবনে মরিয়ম হবার জন্য নিম্নোক্ত রসালো বক্তব্যটি পেশ করেছেন:

\r\n

“তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ) বারাহীনে আহমদীয়ার তৃতীয় অংশে আমার নাম রেখেছেন মরিয়ম। অতঃপর যেমন বারাহীনে আহামদীয়ায় প্রকাশিত হয়েছে, দু’বছর পর্যন্ত আমি মরিয়মের গুণাবলী সহকারে লালিত হই.... অতঃপর ..... মরিয়মের ন্যায় ঈসার রহ আমার মধ্যে ফুৎকারে প্রবেশ করানো এবং রূপকার্থে আমাকে গর্ভবতী করা হয়। অবশেষে কয়েকমাস পরে, যা দশ মাসের চাইতে বেশী হবেনা, সেই এলহামের মাধ্যমে, যা বারাহীনে আহমাদীয়ার চতুর্থ অংশে উল্লিখিত হয়েছে, আমাকে মরিয়ম থেকে ঈসায় পরিণত করা হয়েছে। কাজেই এভাবে আমি হলাম ঈসা ইবনে মরিয়ম।” (কিশতীয়ে নুহ, ৮৭, ৮৮, ৮৯ পৃষ্ঠা)

\r\n

অর্থাৎ প্রথমে তিনি মরিয়ম হন অতঃপর নিজে নিজেই গর্ভবতী হন। তারপর নিজের পেট থেকে নিজেই ঈসা ইবনে মরিয়ম রূপে জন্ম নেন। এরপরও সমস্যা দেখা দিলো যে, হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী ঈসা ইবনে মরিয়ম দামেশকে অবতরণ করবে। দামেশকে কয়েক হাজার বছর থেকে সিরিয়ার একটি প্রসিদ্ধ ও সর্বজন পরিচিত শহর। পৃথিবীর মানচিত্রে আজও এই শহরটি এই নামেই চিহ্নিত। কাজেই অন্য একটি রসাত্মক বক্তব্যের মাধ্যমে এ সমস্যাটির সমাধান দেয়া হয়েছে:

\r\n

“উল্লেখ্য যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দামেশকে শব্দের অর্থ আমার নিকট এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যে, এ স্থানে এমন একটি শহরের নাম দামেশ্‌ক রাখা হয়েছে যেখানে এজিদের স্বভাব সম্পন্ন ও অপবিত্র এজিদের অভ্যাস ও চিন্তার অনুসারী লোকদের বাস।..... এই কাদিয়ান শহরটি এখানকার অধিকাংশ এজিদী স্বভাব সম্পন্ন লোকের অধিবাসের কারণে দামেশকের সাথে সামঞ্জস্র ও সম্পর্ক রাখে।” (এযালায়ে আওহাম, ফুটনোট: ৬৩ থেকে ৭৩ পৃষ্ঠা)।

\r\n

আর একটি জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। হাদীসের বক্তব্য অনুসারে ইবনে মরিয়ম একটি সাদা মিনারের নিকট অবতরণ করবেন। এ সমস্যার সমাধান সহজেই করে ফেলা হয়েছে অর্থাৎ মসহি সাহেব নিজেই এসে নিজের মিনারটি তৈরী করে নিয়েছেন। এখন বলুন, কে তাঁকে বুঝাতে যাবে যে, হাদীসের বর্ণনা অনুসারে দেখা যায় ইবনে মরিয়মের অবতরণের পূর্বে মিনারটি সেখানে মওজুদ থাকবে। অথচ েএখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিশ্রুত মসীহ সাহেবের আগমনের পর মিনারটি তৈরী হচ্ছে।

\r\n

সর্বশেষ ও সবচাইতে জটিল সসনস্যাটি এখনো রয়ে গেছে। অর্থাৎ হাদীসের বর্ণনা মতে ঈসা ইবচনে মরিয়ম (আ) লিড্ডার প্রবেশ দ্বারো দাজ্জালকে হত্যা করবেন। এ সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে প্রথমে আবোল তাবোল অনেক কথাই বলা হয়েছে। কখনো স্বীকার করা হয়েছে যে, বায়তুল মুকাদ্দাসের একটি গ্রামের নাম লিড্ডা (এযালায়ে আওহাম, আঞ্জুমানে আহমদীয়া, লাহোর কর্তৃক প্রকাশিত, ক্ষুদ্রাকার, ২২০ পৃষ্ঠা)। আবার কখনো বলা হয়েছে, “লিড্ডা এমন সব লোককে হয় যারা অযথা ঝগড়া করে।... যখন দাজ্জালের অযথা ঝগড়া চরমে পৌঁছে যাবে তখন প্রতিশ্রুত মসীহের আবির্ভাব হবে এবং তার সমস্ত ঝগড়া শেষ করে দেবে” (এযালায়ে আওহাম, ৭৩০ পৃষ্ঠা)। কিন্তু এত করেও যখন সমস্যার সমাধান হলো তখন পরিষ্কার বলে দেয়া হলো যে, লিড্ডা (আরবীতে লুদ) অর্থ হচ্ছে পাঞ্জাবের লুদিয়ানা শহর। আর লুদিয়ানার প্রবেশ দ্বারে দাজ্জালকে হত্যা করার অর্থ হচ্ছে দুষ্টুদের বিরোধিতা সত্ত্বেও মীর্জা গোলাম আহমদ সাহেবের হাতে এখানেই সর্বপ্রথম বাইয়াত হয়। (আলহুদা, ৯১ পৃষ্ঠা)।

\r\n

যে কোনো সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি এইসব বক্তব্য বর্ণনার নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হবেন যে, এখানে প্রকাশ্য দিবালোকে ‍মিথ্যুক ও বহুরূপীর অভিনয় করা হয়েছে।

\r\n

-:সমাপ্ত:-

খতমে নবুয়্যাত

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড