মহাগ্রন্থ আল – কোরআন কি ও কেন

লেখকের আরজ

 

বর্বর, বেদুইন, যাযাবর, শিক্ষা ও তামাদ্দুনের আলো হতে বঞ্চিত একটি জাতি মাত্র অর্ধ শতাব্দীর কম সময়ের ভিতরে পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তিদ্বয়কে পর্যুদস্ত ও পরাভূত করে কি করে অর্ধপৃথিবী জয় করে ফেলল? কি করে তাঁরা এই স্বল্পকালীন সময়ের ভিতর মানব সভ্যতার উপরে এক স্থায়ী ও অক্ষয় ছাপ রেখে গেল? সে কথা ভেবে ভেবে আজও ঐতিহাসিকদের পেরেশানীর অন্ত নেই। তাঁরা ভাবতেই পারে না যে, এমন কোন্‌ মহাশক্তির যাদু লেগেছিল, যার ফলে আরব- মুসলমানরা সারা পৃথিবীতে এক প্রলয়কান্ড ঘটিয়ে দিয়েছিল। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের মহাশক্তিই যে আরব- মুসলমানদের এ সফলতার পিছনে মূল শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল, তা বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও চিন্তাবিদদের অনেকেই অম্লান বদনে স্বীকার করেছেন।

 

প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত ইমানুয়েল ডুয়েৎচ বলেছেন, “পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মসমূহের মধ্যে কোরআন যে একটি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী তা স্বীকার করতেই হবে। এ ধরনের যুগান্তকারী সাহিত্যের মধ্যে কোরআন সর্বকনিষ্ঠ বটে; তবে জনসাধারনের উপর প্রভাব বিস্তারে তা কারও অপেক্ষা ন্যুন নহে। কোরআন মানবীয় চিন্তাধারার যেমন এক নতুন ভাবের সৃষ্টি করেছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে এক নতুন চরিত্রের। উহা আরব উপদ্বীপের মরুচারী কতগুলি পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠিকে এক সুমহান বীর জাতিতে পরিনত করেছে”।

 

কোরআন নাযিলের পর থেকে আরম্ভ করে দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় কোরানের উপর অসংখ্য গবেষণামূলক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা বাংলাতে এ ধরনের গবেষণামূলক পুস্তকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই বাংলা ভাষা- ভাষী মুসলিম ভাই-বোনদের খেদমতে পবিত্র কোরানের উপর গবেষণামূলক আমার এ ক্ষুদ্র পুস্তিকাখানি পেশ করছি।

 

ইতিমধ্যে এর দ্বাদশ সংস্করণ শেষ হয়েছে। ত্রয়োদশ সংস্করণ বের করতে পেরে মহান রাব্বুল আলামীনের শুকরিয়া আদায় করছি।

 

-আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ

 

কোরআনের পরিচয়

 

কোরআন আল্লাহ্‌র নাযিলকৃত ঐ কিতাবকে বলা হয়, যা তিনি তাঁর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)- এর উপরে দীর্ঘ তেইশ বৎসর কালব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়, প্রয়োজন মোতাবেক অল্প অল্প করে অবতীর্ণ করেছিলেন। ভাষা এবং ভাব উভয় দিক হতেই কোরআন আল্লাহ্‌র কিতাব। অর্থাৎ কোরআনের ভাব (অর্থ) যেমন আল্লাহ্‌র তরফ হতে আগত তেমনি তাঁর ভাষাও।

 

কোরআন নাযিলের কারণ

 

নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের পরে আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) কে বেহেশত হতে দুনিয়ায় পাঠানোর প্রাক্কালে তায়ালা বলে দিয়েছিলেন যে,

 

قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا ۖ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿٣٨﴾ وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَـٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

 

 “তোমরা সকলেই এখান হতে নেমে পড়। অতঃপর তোমাদের কাছে আমার পক্ষ হতে জীবন বিধান যেতে থাকবে। পরন্তু যারা আমার জীবন বিধান অনুসারে চলবে, তাঁদের ভয় ও চিন্তার কোন কারণ থাকবেনা। (অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তিতে তাঁরা আবার অনন্ত সুখের আধার এ বেহেশতেই ফিরে আসবে)। আর যারা তা অস্বীকার করে আমার নিদর্শন সমুহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে, তাঁরা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানে তাঁরা অনন্তকাল থাকবে”। (সূরা বাকারা, আয়াত নং ৩৮-৩৯)

 

আল্লাহ্‌ তায়ালার উক্ত ঘোষণা মোতাবেকই যুগে যুগে আদম সন্ততির কাছে আল্লাহ্‌র তরফ হতে হেদায়েত বা জীবন বিধান এসেছে। এই জীবন বিধানেরই অন্য নাম কিতাবুল্লাহ। যখনই কোন মানবগোষ্ঠী আল্লাহ্‌র পথকে বাদ দিয়ে নিজেদের মন গড়া ভ্রান্ত পথে চলতে থাকে, তখনই কিতাব নাযিল করে আল্লাহ্‌ মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন।

 

কিতাব নাযিলের ব্যাপারে আল্লাহ্‌ তায়ালার চিরন্তন নীতি হল এই যে, তিনি যখন কোন জাতির জন্য কিতাব নাযিলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, তখনই সেই জাতির মধ্য থেকে মানবীয় গুনের অধিকারী সর্বোৎকৃষ্ট লোক্টিকে পয়গাম্বর হিসেবে বাছাই করে নেন, অতঃপর ওয়াহীর মাধ্যমে তাঁর উপরে কিতাব নাযিল করে থাকেন।

 

মানব সৃষ্টির সুচনা হতে দুনিয়ায় যেমন অসংখ্য নবী-রাসুল এসেছেন, তেমনি তাঁদের উপরে নাযিলকৃত কিতাবের সংখ্যাও অগণিত। নবীদের মধ্যে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যেমন সর্বশেষ নবী, তেমনি তাঁর উপরে নাযিলকৃত কোরআনও আল্লাহ্‌র সর্বশেষ কিতাব। অতঃপর দুনিয়ায় আর কোন নতুন নবীও আসবে না এবং কোন কিতাবও অবতীর্ন হবে না।

 

কোরআনের আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য

 

কোরআনের আলোচ্য বিষয় হল, মানব জাতি। কেননা মানব জাতির প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণের সঠিক পরিচয়ই কোরআনে দান করা হয়েছে। কোরআনের উদ্দেশ্য হল মানব জাতিকে খোদা প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার দিকে পথ প্রদর্শন, যাতে দুনিয়ায়ও নিজের জীবনকে কল্যাণময় করতে পারে এবং পরকালেও শান্তিময় জীবনের অধিকারী হতে পারে।

 

ওয়াহীর সূচনা কিভাবে হয়েছিল

 

বোখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। তাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, “ওয়াহীর সূচনা এভাবে হয়েছিল যে, হুজুর ঘুমের ঘোরে এমন বাস্তব স্বপ্ন দেখতে থাকেন যা উজ্জ্বল প্রভাতের ন্যায় বাস্তবায়িত হতে থাকে’। অতঃপর হুজুরের নিকটে নির্জনবাস আকর্ষনীয় অনুভূত হল এবং তিনি হেরা গুহায় নির্জনবাস শুরু করে দিলেন। এখানে তিনি একাধিক রাত্রি কাটিয়া দিতেন এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য পানীয় ও জরুরী সামগ্রী সাথে নিয়ে যেতেন। তা ফুরিয়ে গেলে আবার ফিরে এসে খাদীজার(রাঃ) নিকট হতে তা নিয়ে গুহায় ফিরে যেতেন। এভাবেই এক শুভক্ষনে হেরায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাঁর কাছে হকের(ওয়াহীর) আগমন ঘটল। ফিরিশতা (জিবরাইল আমিন) এসে তাঁকে বললেন, আপনি পড়ুন। (হুজুর বলেন) আমি বললাম, আমি পাঠক নই। হুজুর বলেন, অতঃপর ফিরিশতা আমাকে বগলে দাবিয়ে ছেড়ে দিলেন। ফলে আমি খুব ক্লান্তি বোধ করতে থাকলাম। আবার তিনি আমাকে পড়তে বললেন এবং আমি একই জওয়াব দিলাম। তিনি আবার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিলেন। এভাবে তিনি তিনবার করলেন এবং তিনবারই হুজুর একই জওয়াব দিলেন। অতঃপর ফিরিশতা পাঠ করলেন,

 

 اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ﴿١﴾ خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ ﴿٢﴾ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ ﴿٣﴾ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ ﴿٤﴾ عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ﴿٥﴾

 

“তুমি পাঠ কর তোমার সেই প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন যিনি সৃষ্টি করেছেন মানব জাতিকে ঘনীভূত রক্ত বিন্দু হতে। তুমি পাঠ কর তোমার সেই মহিমান্বিত প্রভুর নামে যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। যিনি মানব জাতিকে শিখিয়ে দিয়েছেন যা সে জানত না”। (সুরা আলাকঃ ১-৫)

 

অতঃপর হুজুর উক্ত আয়াতসমুহ নিয়ে কম্পিত হৃদয়ে বাড়ি ফিরলেন। আর খাদীজার (রাঃ) ঘরে প্রবেশ করে বললেন, ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও’। এভাবে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়ার কিছুক্ষন পর তার অস্থিরতা কেটে গেল। তিনি হযরত খাদীজাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা শুনালেন এবং বললেন, আমার নিজের জীবন সম্পর্কেই আমার ভয় হচ্ছে। হযরত খাদীজা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আল্লাহর শপথ, আল্লাহ কিছুতেই আপনার কোন অনিষ্ট করবেন না। কেননা আপনি আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, দরিদ্র ও নিরন্নকে সাহায্য করেন, অতিথির সেবা করেন এবং উত্তম কাজের সাহায্য করেন”। অতঃপর হযরত খাদীজা হুজুরকে নিয়ে তার চাচাত ভাই আরাকা বিন নওফেলের কাছে গেলেন। তিনি জাহেলিয়াতে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইবরাণী ভাষা জানতেন। আর ইঞ্জিল হতে উক্ত ভাষায় যা ইচ্ছা নকল করতে পারতেন। তিনি খুবই বৃদ্ধ ছিলেন এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। খাদীজা তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, ভাই আপনি আপনার ভাইপোর ঘটনা শুনুন, আরাকা সব ঘটনা শুনে বললেন, “এতো সেই ফিরিশতা যিনি হযরত মুসার (আঃ) কাছে এসেছিলেন। আফসোস! তোমার লোকেরা তোমাকে যখন দেশ থেকে বের করে দিবে, তখন যদি আমি জীবিত থাকতাম!” হুজুর বললেন, তাহলে কি তারা আমাকে বের করে দিবে? আরাকা বললেন, হ্যাঁ, তুমি যা পেয়েছ ইহা যে যে পেয়েছে তার সাথে অনুরুপ ব্যবহার করা হয়েছে। আমি যদি ঐ দিন জীবিত থাকি, তাহলে তোমাকে সাধ্যমত সাহায্য করব। অতঃপর পুনরায় ওয়াহী নাযিলের আগেই আরাকা ইন্তেকাল করেন।

 

উপরোক্ত ঘটনাটি যেদিন ঘটে সেদিন ছিল ১৭ই রমজান সোমবার। হুজুরের বয়স ছিল তখন চল্লিশ বছর ছয় মাস আট দিন। অর্থাৎ ৬ই আগস্ট ৬১০ খৃস্টাব্দ।

 

ওয়াহী কিভাবে নাযিল হত

 

হুজুরের উপর যখন ওয়াহী অবতীর্ন হত তখন হুজুরের ভিতরে এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হত। চেহারা মোবারক উজ্জ্বল ও রক্তবর্ন হয়ে যেত, কপালে ঘাম দেখা দিত, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে যেত এবং শরীর অত্যধিক ভারী হয়ে যেত। এমন কি উটের পিঠে ছওয়ার অবস্থায় যখন ওয়াহী নাযিল হত, তখন অত্যধিক ভারে উট চলতে অপারগ হয়ে মাটিতে বসে যেত।

 

ওয়াহী নাযিলের সময় কেন এমন অবস্থা হত, এর কারন স্বরূপ বলা চলে যে, নবীগন ছোট বড় সব রকমের গোনাহ হতে পবিত্র থাকার ফলে তাদের স্বভাবে ফিরিশতা স্বভাবের আধিক্য থাকলেও তারা মানবীয় স্বভাবের উর্ধে নন। ফলে আল্লাহ তাঁর পবিত্র কালাম নাযিল হবার পুর্ব মুহুর্তে তাদেরকে এমন এক বিশেষ নুরানী অবস্থায় নিয়ে যেতেন, যেখানে তাদের কল্‌ব মানবীয় সবটুকু বৈশিষ্ট হারিয়ে ফিরিশতা স্বভাবে রুপান্তরিত হত এবং আল্লাহর অনুগ্রহের নূর তাহাদের অন্তর- আত্নাকে মোহিত করে ফেলত। ফলে এক নীরব ও প্রশান্তিময় পরিবেশে আল্লাহ তাঁর কালাম নবীদের উপরে নাযিল করতেন। কেননা আল্লাহর পবিত্র কালাম পুর্ন মনোনিবেশ সহকারে শুনা, উহা অন্তরে গেঁথে রাখা এবং উহার প্রকৃত মর্ম হৃদয়-মন দিয়ে অনুধাবন করার জন্য উপরোক্ত বিশেষ অবস্থায় নবীদেরকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হত।

 

এভাবে যখন ওয়াহী নাযিল হওয়া সমাপ্ত হত, তখন উপরোক্ত অবস্থা কেটে যেত এবং হুজুর পুর্বাবস্থায় ফিরে আসতেন। আর নাযিলকৃত কালাম ছাহাবাদেরকে তেলাওয়াত করে শুনাতেন।

 

ওয়াহি কিভাবে নাযিল হত সে সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে নিম্নলিখিত মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত আছে,

 

“হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা হারিস-বিন হিসাম হুজুরকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনার উপরে ওয়াহী কিরূপে নাযিল হয়? হুজুর বললেন, কখনও কখনও ওয়াহীর আওয়াজ আমার অন্তরে ঘন্টা ধ্বনির ন্যায় ধ্বনিত হতে থাকে, ওয়াহীর এই ধরনটাই আমার জন্য খুব কঠিন হয় এবং আমি ক্লান্তি বোধ করতে থাকি। অতঃপর উহা আমার অন্তরে বিঁধে যায়। আবার কখনও ফিরিশতা মানুষের আকৃতিতে আসেন এবং আমার সাথে কালাম করেন (ওয়াহী নাযিল করেন)। আর আমি মনে গেঁথে নেই। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, অত্যধিক শীতের সময়ও যখন ওয়াহী নাযিল হত, হুজুরের শরীরে তাপ সঞ্চয় হত এবং তাঁহার চেহারা মোবারকে ঘাম দেখা দিত”।

 

উপরোক্ত দুই ধরনের বাইরেও কখনও কখনও আল্লাহ কোন মাধ্যম ব্যতিরেকেই সরাসরি পর্দার আড়াল হতে নবীদের সাথে কথা বলেছেন।

 

বুখারী শরীফের ওয়াহী সম্পর্কীয় হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আইনী তাঁর গ্রন্থে ওয়াহীর বিভাগ সম্পর্কে নিম্নরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন,

 

(১) আল্লাহ কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি কথা বলতেন। যেমন পবিত্র কোরআন এবং বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত মুসা (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে আল্লাহ এ ধরনের কথোপকথন করেছেন।

 

(২) কোন ফিরিশতা পাঠিয়ে তাঁর মাধ্যমে ওয়াহী নাযিল করতেন।

 

(৩) অন্তরে ওয়াহীর শব্দসমূহ ধ্বনিত করে বিঁধে দিতেন। যেমন হুজুর বলেছেনঃ “পবিত্র ফিরিশতা আমার অন্তরে দম করে দিয়েছেন”। হযরত দাউদের (আঃ) উপরে তৃতীয় ধরনের ওয়াহী নাযিল হত।

 

কোরআন নাযিল হওয়ার পদ্ধতি

 

কোরআনকে বুঝা এবং তাকে হৃদয়ঙ্গম করার নিমিত্তে কোরআন নাযিল হওয়ার পদ্ধতি অনুধাবন করা অপরিহার্য। মনে রাখা দরকার যে, কোরআন গ্রন্থাকারে একই সময় নবী করীমের (সাঃ) উপরে অবতীর্ণ হয়নি। বরং যে বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নবী (সাঃ) এবং তাঁর আত্নোৎসর্গিত সাথীদের উপরে আল্লাহ চাপিয়ে ছিলেন, সেই আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে অল্প অল্প করে প্রয়োজনানুসারে পূর্ন তেইশ বছর কালব্যাপী অবতীর্ন হয়েছে। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্ত হন এবং পূর্ণ তেইশ বছর কাল নবী হিসেবে খোদা প্রদত্ত দায়ীত্ব পালন করে তেষট্টি বছর বয়সে দুনিয়া ত্যাগ করেন। এই সুদীর্ঘ তেইশ বছর কালব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়ে কোরআনের বিভিন্ন অংশ আল্লাহর রাসুলের প্রতি অবতীর্ন হতে থাকে।

 

মক্কী-মাদানী

 

নবুয়াত প্রাপ্তির পরে হযরত (সাঃ) তের বৎসর কাল মক্কা শরীফে অবস্থান করেন এবং মক্কা ও উহার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। মক্কায় অবস্থানকালীন এই দীর্ঘ তের বছরে যে সব সূরা নবীর (সাঃ) উপরে অবতীর্ন হয়েছে তাঁকে বলা হয় মক্কী সূরা।

 

অতঃপর আল্লাহর নবী মদীনা শরীফে হিজরত করেন এবং দীর্ঘ দশ বছরকাল মদীনায় অবস্থান করে ইসলামকে একটি জীবন্ত- বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পরকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মদীনায় অবস্থানকালীন এই দশ বছর কালব্যাপী কোরআন মজীদের যে সব সূরা হযরতের (সাঃ) উপরে অবতীর্ন হয়েছে উহাকে বলা হয় মাদানী সুরা।

 

মক্কী সুরাসমুহের বৈশিষ্ট্য

 

ইসলামী দাওয়াত সূচনায় মক্কা শরীফে নবী করীমের (সাঃ) উপরে যে সব সূরা অবতীর্ন হয়েছে তাঁর অধিকাংশ ছিল আকারে ছোট, অথচ অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী। সাধারনত ইসলামের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কীয় বিষয়সমুহ, যেমন- তওহীদ, রেসালাত, আখেরাত ইত্যাদি বিষয়ের ইহাতে যেমন আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি শিরক, কুফরী, নাস্তিকতা পরকাল অস্বীকৃতি প্রভৃতি আকীদা সম্পর্কীয় প্রধান প্রধান পাপ কার্যেরও উহাতে বর্ণনা দান করা হয়েছে। অতীতে যে সব জাতি নবীর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করত একমাত্র আল্লাহ্‌ প্রদত্ত দ্বীন অনুসারে চলে দুনিয়ায়ও অশেষ কল্যাণ লাভ করেছে এবং পরকালেও অনন্ত সুখের অধিকারী হবে, তাদের সম্পর্কে যেমন ইহাতে আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি আলোচনা করা হয়েছে সেই সমস্ত ভাগ্যহীনদের সম্পর্কে যারা নবীর দাওয়াতকে অস্বীকার করে আল্লাহ্‌র দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান করে দুনিয়ায়ও ধ্বংস হয়েছে এবং পরকালেও চরম শাস্তি ভোগ করবে। আর এই ঘটনাগুলি বর্ণনা করা হয়েছে উহা হতে উপদেশ গ্রহন করার জন্য, ইতিহাস আলোচনার জন্য নয়।

 

এ ছাড়াও মক্কী সূরা সমূহে রসুল (সাঃ) এবং তাঁর মুষ্টিমেয় সাথীদেরকে কাফির ও মুশরিকদের অবিরাম নির্যাতনের মুখে যেমন ধৈর্য ধারন করার নছিহত করা হয়েছে, তেমনি কাফির মুশরিকদেরও তাদের হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ির ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।

 

মাদানী সূরার বৈশিষ্ট্য

 

মহানবীর (সাঃ) মাদানী জীবনের সূচনা হয় নবূয়তের তের বছর পরে। মক্কা শরীফে রসুলের দাওয়াতে যারা ইসলাম কবুল করেছিলেন, তারা যেমন ছিলেন প্রভাবহীন তেমনি ছিলেন সংখ্যায় নগন্য। কোরায়েশ এবং মক্কার পার্শবর্তী গোত্রসমূহের নেতৃস্থানীয় লোকেরা ছিল রসুলের দাওয়াতের ঘোরতর বিরোধী।

 

ফলে মুসলমানদের সেখানে কুফরী প্রভাবের অধীনে যথেষ্ট নির্যাতিত জীবন –যাপন করতে হয়েছে। কিন্তু মদীনার অবস্থা ছিল ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। মদীনায় দুটি প্রভাবশালী গোত্র ‘আওস’ ও ‘খাজরাজের’ নেতৃস্থানীয় লোকেরা ইতিপুর্বে হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় এসে রসুলের কাছে ইসলাম গ্রহন করে গিয়েছিলেন। আর তাদেরই অনুসরনে গোত্রের প্রায় সব লোকেরাই ইসলাম কবুল করে ফেলেছিলেন।

 

অতঃপর নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে হুজুর যখন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে মদীনায় হিজরত করলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, মদীনার প্রভাবশালী নেতা এবং তাদের অনুসারীরা শুধু হুজুরের দ্বীনই কবুল করেননি, উপরন্তু তাঁরা তাদের এলাকাটাও হুজুরের নিয়ন্ত্রনে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। ফলে ইসলামের যাবতীয় বিধানাবলী কার্যকর করার ব্যাপারে বাহিরের হস্তক্ষেপ ব্যাতিত ভিতরের দিক থেকে আর তাঁকে কোন প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হবে না। মদীনায় ইহুদীদের যে দুটি গত্র বাস করত, ইতিপুর্বে রসুল (সাঃ) তাদেরকে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন।

 

সুতরাং আল্লাহ্‌র নবী কালবিলম্ব না করে ইসলামকে পূর্নাংগ রূপ দেয়ার নিমিত্ত ছোট অথচ সম্ভাবনাময় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ স্থাপন করলেন। এখন প্রয়োজন ছিল এই রাষ্ট্রের পরিচালনার জন্য যাবতীয় বিধি- ব্যবস্থার। উহাই পর্যায়ক্রমে মাদানী সূরাসমূহের মাধ্যমে নবীর জীবনের বাকী দশ বছরে অবতীর্ণ হতে থাকে।

 

রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা সম্পর্কীয় যাবতীয় মৌলিক আইন যেমন ফৌজদারী কানুন, উত্তরাধিকার সম্পর্কীয় আইন, বিবাহ- তালাক সম্পর্কীয় বিধি ব্যবস্থা, যাকাত- ওশর প্রভৃতি অর্থনৈতিক বিধান এবং যুদ্ধ- সন্ধি সম্পর্কীয় হুকুম- আহকাম হল মাদানী সূরাসমূহের প্রধান আলোচ্য বিষয়।

 

মক্কায় কোন ইহুদি গোত্র বাস করতোনা আর মুনাফিকদেরও (সুবিধাবাদী শ্রেণী) কোন সংগঠিত দল তথায় ছিলনা। ফলে মক্কী সূরা সমূহে এদের সম্পর্কে বিশেষ কোন আলোচনা দেখা যায় না। কিন্তু মদীনায় এ দুটি শ্রেণীই ছিল এবং বাহ্যিক দিক দিয়ে এরা মুসলমানদের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে নিজেদেরকে জাহির করলেও ভিতরে ভিতরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ফলে আল্লাহ্‌ মাদানী সূরাসমূহের মাধ্যমেই এদের কুটিল ষড়যন্ত্রের কথা নবীকে জানিয়ে দেন এবং ইহুদী ও মোনাফেকদের তাদের জঘন্য পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করে দেন।

 

আরববাসীদের উপর কোরআনের আশ্চর্য প্রভাব

 

কোরায়েশদের শত বাধা সত্ত্বেও দিন-দিন ইসলামের প্রভাব আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে চলছিল। এর মূলে ছিল পবিত্র কোরানের অলৌকিক প্রভাব। নিম্নের ঘটনা কয়টিই বাস্তবতা প্রমানের জন্য যথেষ্ট।

 

প্রথম দিকে প্রায় তিন বছর কাল হুজুর (সঃ) ইসলামের দাওয়াত গোপনে দিতে থাকেন। অতঃপর আল্লাহ্‌র নির্দেশে তিনি প্রকাশ্য দাওয়াতের সূচনা করেন, আর এই সময়ই শুরু কোরায়েশদের সাথে সংঘাত। এ সময় কোরায়েশ সর্দাররা একদিকে মুহাম্মাদের (সঃ) দরিদ্র ও দুর্বল সাথীদের উপরে নানারূপ শারিরীক নির্যাতন শুরু করে এবং স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদকে (সঃ) নানারূপ প্রলোভন দ্বারা সত্য পথ হতে বিরত রাখার চেষ্টা করে।

 

নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে কোরায়েশ নেতাদের প্রস্তাবক্রমে তাদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উতবা বিন রাবিয়াকে হযরত মুহাম্মাদের (সঃ) নিকট একটি আপোষ প্রস্তাব দিয়ে পাঠানো হয়। উতবা হুজুরের খেদ্মতে হাজির হয়ে এই মর্মে প্রস্তাব পেশ করেন যে, হে মুহাম্মাদ (সঃ) তুমি এ নতুন মতবাদ পরিত্যাগ কর, তাহলে তোমাকে আমাদের নেতা করে নেব। যদি তুমি ধনের আকাঙ্ক্ষা করো, তাহলে আমরা তোমাকে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী করে দেব। আর যদি তুমি সুন্দরী মহিলার লোভ রাখ, তাহলেও আমরা তোমার সেই বাসনা পুর্ন করে দেব”। হুজুর বললেন, নেতৃত্ব, ধন আর নারী কেন, তোমরা যদি আমার এক হাতে আকাশের সূর্য ও অন্য হাতে চন্দ্রও এনে দাও তবুও আমি এ মতবাদ ত্যাগ করতে পারব না। অতঃপর হুজুর সূরায়ে হামিমের কয়েকটি আয়াত তাঁর সামনে তিলাওয়াত করলেন।

 

উতবা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উহা শ্রবণ করল। তাঁর বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল এবং ভিতর হতে সে তাঁর সমস্ত শক্তি ও সাহস হারিয়ে ফেলল। অতঃপর সে সেখানে ফিরে গেল, যেখানে কোরায়েশ দলপতিরা তাঁর পথ চেয়েছিল এবং মনে মনে একটি শুভ সংবাদের আশা করছিল।

 

উতবা কোরায়েশ নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলল, “দেখ তোমরা মুহাম্মাদকে বাধা দিও না। অতঃপর যখন তাঁর দাওয়াত কোরায়েশদের এলাকার বাইরে চলে যাবে, তখন অকুরায়েশদের সাথে মুহাম্মাদের সংঘর্ষ হবে। সে সংঘর্ষে যদি মুহাম্মাদ পর্যুদস্ত হয়, তাহলেও তোমাদের লাভ। কেননা তোমাদের শত্রু ধ্বংস হল, অথচ তোমাদেরকে সংঘাতে লিপ্ত হতে হল না। আর যদি মুহাম্মাদ জয়ী হয়, তাহলেও তোমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কেননা তোমাদের কোরায়েশ বংশেরই একটি লোক আরবদের নেতা হবে”।

 

এহেন প্রস্তাবে উপস্থিত নেতারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল এবং অনুসন্ধান করে জানতে পারল যে, মুহাম্মাদের (সঃ) মুখ নিঃসৃত কোরআনের বাণী শুনেই উতবা অভিভূত হয়ে পড়েছে, ফলে মুহাম্মাদের সম্পর্কে সে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেছে।

 

অনুরূপ আর একটি ঘটনা ঘটে আবিসিনিয়ায়। তখন নবুয়তের পঞ্চম বর্ষ। কোরায়েশদের উৎপীড়নে জর্জরিত হয়ে হুজুর (সঃ) প্রথমে ষোলজন এবং পরে তিরাশিজন মুসলমান নর নারীর দুটি দলকে আবিসিনিয়ায় প্রেরন করেন। আবিসিনিয়ায় ইসায়ী শাসক নাজাশী ছিলেন অত্যন্ত সুবিচারক এবং প্রজাবৎসল। তিনি মুসলমানদেরকে তাঁর দেশে বসবাসের আদেশ দিয়েছিলেন। এদিকে কোরায়েশ সর্দারগন এটা জানতে পেরে একটি যোগ্য প্রতিনিধি দলকে প্রচুর উপঢৌকনসহ নাজাশীর দরবারে পাঠাল। তাঁরা নাজাশীর খেদমতে হাজির হয়ে উপঢৌকন পেশ করে বলল, মহারাজ, কিছু যুবক- যুবতী কিছু গোলাম আমাদের নেতাদের অবাধ্য হয়ে তাদের অনুমতি (ছাড়পত্র) ছাড়াই আপনার দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদেরকে ফেরত নেয়ার জন্যই আমাদেরকে আপনার খেদমতে পাঠানো হয়েছে। দয়া করে আপনি তাদেরকে আমাদের হাতে সমর্পন করবেন”। দরবারকারীরাও পলাতকদের ফেরত দেয়ার পক্ষে মত দিলেন। কিন্তু বাদশাহ বললেন, তাদের বক্তব্য না শুনে আমি তাদেরকে ফেরত দিতে পারি না। অতঃপর তাদেরকে ডাকা হল এবং কেন তাঁরা দেশ ত্যাগ করে এসেছে তা বলতে বলা হল।

 

মুসলিম দলের নেতা হযরত আলীর ভ্রাতা হযরত জাফর দাঁড়িয়া বললেন, “জাহাঁপনা, আমরা ইতিপুর্বে মুর্তিপুজাসহ নানারূপ কুসংস্কারে লিপ্ত ছিলাম। মারামারি, খুন-খারাবী, রাহাজানি ও লুটতরাজ ছিল আমাদের নিত্য- নৈমিত্তিক কাজ। ইতিমধ্যে আল্লাহ্‌ মেহেরবানী করে আমাদের ভিতরে একজন নবী পাঠালেন। তিনি আমাদেরকে একমাত্র আল্লাহ্‌র দাসত্ব গ্রহণ করতে, সত্য কথা বলতে। আত্নীয়- স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে, গরীব- মিসকিনদের প্রতি সদয় হতে এবং খুন- খারাবী ও লুটতরাজ পরিত্যাগ করে পবিত্র জীবন- যাপন করতে আহবান জানালেন। আমরা তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর দ্বীন গ্রহণ করি। ফলে আমাদের গোত্র নেতারা আমাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে আমাদের পয়গাম্বরের আদেশে আপনার দেশে হিজরত করে এসেছি। এখন যদি আপনি আমাদেরকে এই কোরায়েশ দূতদের হাতে অর্পণ করেন তাহলে আমাদের আর কোন উপায় নেই”।

 

বাদশাহ্‌ হযরত জাফরের এই তেজস্বীনি ও হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য শুনে খুবই প্রীত হলেন এবং বললেন, তোমাদের পয়গাম্বরের উপরে যে কালাম অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর কিছু আমাকে শুনাতে পার? হযরত জাফর , হযরত ঈসা ও হযরত মরিয়ম সম্পর্কীয় সূরায়ে মরিয়মের কয়েকটি আয়াত সুললিত কন্ঠে

 

**************

 

পাঠ করে তাঁকে শোনালেন। নাজাশীর দুচোখ গড়িয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে লাগলো। তিনি অন্তরে এক স্বর্গীয়- শান্তি অনুভিব করলেন এবং বললেন, সৃষ্টিকর্তার শপথ ইঞ্জিল আর যে কালাম এখন আমাকে শুনান হ উভয়ই একই মূল হতে এসেছে। অতঃপর তিনি কোরায়েশ দূতগণকে লক্ষ্য করে বললেন, ফিরে যাও, আমি এ নিরাপরাধ লোকগুলিকে তোমাদের হাতে অর্পন করতে পারব না”

 

এদিকে কোরায়েশরা অধীর আগ্রহে দূতদের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করছিল। তারা ভেবে ছিল পলাতক লোকগুলিকে বন্দী অবস্থায় নিয়ে দূতগণ মক্কায় ফিরবে। কিন্তু দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে দূতগণ যখন খালি হাতে ফিরে এল, তখন তারা আশ্চর্য হয়ে কারণ জানতে চাইল। দূতগণ বলল, জাফরের মুখে কোরআন শুনেই বাদশাহ বিগড়ে গেলেন। নতুবা আমরা তাদেরকে ফেরত আনতে পারতাম।

 

কোরায়েশরা আরেকবার অনুভব করল যে, কোরআনের অলৌকিক প্রভাবই তাদের সর্বনাশের মূল কারণ।

 

কোরআন শুনে কোরআনের অলৌকিক প্রভাবে অভিভূত হয়ে নবূয়তের প্রথম দিকে যারা ঈমান এনেছিলেন, তাদের ভিতরে দক্ষিণ আরবস্থ ইয়ামানী কবি তোফায়েল ইবনে দোসীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরবে তখন কবিদের যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হত। ফলে তোফায়েল ইবনে দোসীর ইসলাম গ্রহণে আরব দেশে এক তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে দোসী গোত্রের সমস্ত লোকই তার প্রভাবে ইসলাম গ্রহণ করে।

 

বনি সলিম গোত্রের বিজ্ঞ ব্যক্তি কায়েস ইবনে নাসিরাও হুজুরের মুখনিঃসৃত কোরআন শুনে ইসলাম কবুল করেছিলেন। পরে তিনি বাড়ী ফিরে গিয়ে তার গোত্রে লোকদের একত্র করে বললেন, দেখ, রোম ও পারস্যের সেরা কবি সাহিত্যিকদের কথাবার্তা ও রচনাদি শুনার ভাগ্য আমার হয়েছে, হামিরের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের কথাবার্তা আমি ঢের শুনেছি। কিন্তু মুহম্মদের মুখনিঃসৃত কোরআনের বাণীর সমতুল্য আমি কারো কাছেই কিছু শুনি নাই। পরবর্তী সময় তাঁর প্রচেষ্টায় তাঁর গোত্রের প্রায় এক হাজার লোক ইসলাম কবুল করেছিলনে।

 

আজাদ গোত্রের সর্দার জামাদ ইবনে ছায়ালাবাও নবীর মুখে কোরআন শুনে ইসলাম গ্রহণ করেন। নেতৃস্থানীয় কোরায়েশ যুবকের ভিতরে হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণও ছিল কোরআনের অলৌকিক প্রভাবে। ঘটনাটি ছিল ‍নিম্নরূপঃ

 

নবুয়তের তখন নবম বর্ষ। আবু জাহেল দ্বারে-নোদয়ায়ে কোরায়েশ নেতাদের এক সম্মেলন ডাকল। অতঃপর সকলকে লক্ষ্য করে জ্বালাময়ী ভাষায় মুহম্মদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে একটি নাতি-দীর্ঘ বক্তৃতা করল। আর কোরায়েশ যুবকদের এই বলে উসকাল,” এই একটি মাত্র লোক আমাদের জাতিধর্ম ইত্যাদি সবকিছু উলট পালট করে দিল। অথচ কেউ এ শত্রুকে নিপাত করতে পারল না। আমি আজ জনসমক্ষে ঘোষণা করছি, যে বীর যুবক মুহম্মদের (সঃ) ছিন্ন মস্তক আমাদের কাছে হাজির করতে পারবে। আমি তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং একশত উট পুরস্কার দিব।”

 

ঘোষণার সাথে সাথে উত্তেজিত জনতার ভিতর হতে বলিষ্ঠ দেহ, বিশাল বক্ষ, যুবক উমর নাংগা তলোয়ার হাতে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বলল,

 

“এই আমিই যাই, মুহম্মদের ছিন্ন মস্তক না নিয়ে আর ফিরব না।” জনতা হর্ষধ্বনি করে উঠল, আর মহাবীর উমর তলোয়ার নিয়ে রওয়ানা হলো।

 

পথিমধ্যে বন্ধু নঈমের সাথে তার সাক্ষাৎ হল। নঈমের এই ক্রোধাবস্থা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল এ অসময় উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তুমি কার সর্বনাশ করতে বের হয়েছ? বলল, ”মুহম্মদের (সঃ) মুন্ডপাত করতে। সে আমাদের সবকিছুই ওলট-পালট করে দিয়েছে।”

 

নঈম যে গোপনে ইসলাম কবুল করেছিলেন, উমর তা জানত না। নঈম রসূলকে (সঃ) উমরের আক্রোশ হতে বাঁচাবার জন্যে বললেন, “ আরে মুহম্মদের মাথা তো নিবে, কিন্তু বাড়ীর খবর রাখো তো? তোমার ভগ্নি ফাতেমা ও ভগ্নিপতি সাঈদও যে ইসলাম কবুল করেছে।” উমর আঁতকে উঠে বলল: “ হায় সর্বনাশ! আমারই ঘরে? আমি এক্ষণেই ঠিক করে দেব,” এই বলে সে বোনের বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো।

 

তখন মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ। সাঈদ ও ফাতেমা কোরআনের লিখিত কিছু অংশ পাঠ করছিলেন। হঠাৎ উমরের আগমনধ্বনি শুনে তারা উহা লুকিয়ে ফেললেন। উমর জিজ্ঞেস করল, এই মাত্র কি পাঠ করছিলে। ফাতেমা বললেন, কই তুমি কি শুনেছ? উমর ক্রোধভরে সাঈদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে প্রহার করা শুরু করল। আর বলল, মুহম্মদের দ্বীন কবুল করেছ, এবার মজা দেখে নাও। ফাতেমা ঠেকাতে গিয়ে আহত হল। তার জখম হতে রক্ত ঝরছিল। উমর রক্ত দেখে থমকে দাঁড়াল এবং বলল, হতভাগিনী মুহম্মদের (সঃ) দ্বীন কবুল করেছিস? ফাতেমাও ছিল মহাবীর খাত্তাবের মেয়ে। জখম হয়ে নির্ভীক কন্ঠে উত্তর দিলেন, “তুমি যত পার মার। মুহম্মদের(সঃ) দ্বীন কবুল করেছি, তা পরিত্যাগ করব না।” বোনের এই কঠোর ও নির্ভীক উক্তিতে উমর সচকিত হল এবং বলল, তোমরা যা পাঠ করছিলে তা আমাকে দাও। ফাতেমা উত্তর দিলেন আগে তুমি অজু করে পবিত্র হও তারপরে দেব। উমর পবিত্র হওয়ার পর তাকে তা দেয়া হল। এতে সূরায়ে তোয়াহার অংশ বিশেষ লেখা ছিল। উমর মনোনিবেশ সহকারে তা পাঠ করল। অতঃপর কোরআনের ভাষা ও অন্তর্নিহিত ভাব উমরকে একেবারেই অতিভূত করে ফেলল। সে একান্তভাবে অনুভব করল যে, এ কালাম কিছুতেই মানব রচিত নয়। কম্পিত কন্ঠে ‍উমর ঘোষণা করলেন,

 

 أَشْهَدُ أنْ لا إلَٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأشْهَدُ أنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ

 

”আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং মুহম্মদ (সঃ) তাঁর রাসূল।”

 

অতঃপর তিনি বললেন,

 

“ কোথায় নূর নবী, আমাকে তাঁর পদপ্রান্তে নিয়ে চল” ফাতেমা আর সাঈদের তখন আনন্দের আর সীমা থাকলো না। তারা হযরত উমরকে নিয়ে হুজুর (সঃ) যে বাড়িতে ছিলেন সেখানে হাজির হলেন। হুজুরের (সঃ) সঙ্গীরা উমরকে আসতে দেখে দারুন বিচলিত হলেন। কিন্তু হুজুর (সঃ) বললেন উমরকে আসতে দাও।

 

উমর ভিতরে প্রবেশ করেই তলোয়ার হুজুরের (সঃ) পদপ্রান্তে রেখে দিয়ে ঘোষণা করলেন,

 

 أَشْهَدُ أنْ لا إلَٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأشْهَدُ أنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ

 

”আমি সাক্ষ্য ‍দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং মুহম্মদ (স) আল্লাহর রাসূল।”

 

হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণের খবর বিদ্যুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। ওদিকে দ্বারে নোদওয়ায়ে মুহম্মদের ছিন্ন মস্তক হস্তে মহাবীর উমরের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় যারা ছিল, তাদের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। তারা বুঝতেই পারাল না যে, এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন কি ঘটনা ঘটল, যার ফলে মাথা নিতে গিয়ে মাথা দিয়ে আসলো।

 

অনুসন্ধান করে জানলো। বোনের বাড়িতে কোরআন পাঠ করেই তাঁর এ দুর্দশা। কোরায়েশরা আর একবার চরমভাবে অনুভব করল যে, কোরআনই তাদের সব অঘটনের মূল।

 

প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত জোবায়ের ইবনে মোতেমও কোরআন শুনে ইসলাম কবুল করেছিলেন। এসব ঘটনা দৃষ্টে কাফের ও মুশরেক নেতাদের আর বুঝতে বাকী থাকল না যে, কোরআনের কারণেই তাদের এ বিপর্যয়। মুহম্মদ (স) তো কোরআন নাযিলের আগেও তাদের ভিতরে ছিল। কিন্তু কই, তখন তো সে তাদের জাতি বা সমাজের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। কোরআন অবতীর্ণের পর হতেই তো তাদের এ বিপর্যয়। কোরআন শুনে ওৎবার মত প্রখর বুদ্ধিমান লোকটি বু্দ্ধি হারিয়ে ফেলল। আবার এই কোরআনের আকর্ষনেই নাজাশী কোরায়েশ দূতদেরকে খালি হাতে ফেরত ‍দিল, উমরের মত পাষাণ হৃদয় কোরআনের যাদু স্পর্শে মাথা নিতে দিয়ে মাথা নিয়ে আসল। প্রসিদ্ধ কবি তোফায়েল বিন দোসী, জামাদ, জোবায়ের, প্রভৃতি গোত্র সর্দারগণ কোরআনের বাণীতে মুগ্ধ হয়েই কোলে আশ্রয় নিল।

 

[কোরআনের এই অলৌকিক প্রভাবের কথা স্বীকার করে প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত ইমানুয়েল ডুয়েৎচ বলেছেন,

 

”এই পুস্তকখানার সাহায্যেই আরবরা আলেকজন্ডার ও রোম অপেক্ষাও বৃহত্তর ভূ-ভাগ জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। রোমের যত শত বছর লেগেছিল তাদের বিজয় সম্পূর্ণ করতে আরবদের লেগেছিল তত দশক। এরই (কোরআনের) সাহায্যে সমস্ত সেমিটিক জাতির মধ্যে কেবল আরবরাই এসেছিল ইউরোপের রাজারূপে। নতুবা ফিনিসীয়রা এসেছিল বণিকরূপে। আর ইহুদীরা পলাতক কিংবা বন্দীরূপে।”]

 

সুতরাং কাফের সর্দারগণ পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, তারা নিজেরাও কোরআন শুনবে না এবং কোরআনের আওয়াজ যাতে কোন লোকের কাছে না পৌঁছে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

আল্লাহ তাদের এ সিদ্ধান্তে কথা নিম্নলিখিত আয়াত দ্বারা রাসূলকে জানিয়ে দিলেন

 

﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَسْمَعُوا لِهَٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ﴾

 

﴿فَلَنُذِيقَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا عَذَابًا شَدِيدًا وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

 

”আর কাফেররা বলে, কেহই কোরআন শুননা এবং কোরআন তেলাওয়াতের সময় শোরগোল কর, তাহলেই তোমাদের পরিকল্পনা কার্যকরী হবে। আমি এসব কাফেরদেরকে কঠোর শাস্তির স্বাদর গ্রহণ করাব এবং তাদেরকে এ অপকর্মের উপযুক্ত প্রতিফল দেব।” (সুরা হামিম সিজদা, আয়াত-২৬-২৭)

 

কোরআনের ঐশী গ্রন্থ হওয়ার কয়েকটি অকাট্য প্রমাণ

 

পবিত্র কোরআন যে আল্লাহ তায়ালারই বাণী এবয় এই ধরনের কিতাব যে মানুষের পক্ষে তৈরী করা আদৌ সম্ভব নয় এর অসংখ্য প্রমাণ স্বয়ং কোরআনেই বর্তমান। নিম্নে তা হতে কয়েকটি উদ্ধৃত হচ্ছে:

 

এক: কোরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মান

 

কোরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মান অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। এর ভাষা যেমন- স্বচ্ছ, তেমনি এর বাক্য বিন্যাসও অত্যন্ত নিখুঁত ও অভিনব। নবী করীম (সঃ) যখন কোরআন তেলাওয়াত করতেন, তখন এর ঝংকার ও সুরমাধুরী তাঁর সমভাষীদের মন মগজকে মোহিত করে তুলত। তারা বাস্তবভাবে উপলব্ধি করত যে, এ কালাম কিছুতেই মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভন নয় তা সে আরবী সাহিত্যের যত বড় পন্ডিতই হোক না কেন। যদিও পূর্ব পুরুষের অন্ধ অনুকরণ, গোত্রীয় অহমিকা ও সংকীর্ণ স্বার্থবোধ কোরআনকে হক বলে গ্রহণ করার পথে তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে রেখেছিল, কিন্তু তারা এ কথা ভালোভাবে উপলব্ধি করত যে, একজন উম্মী লোকের পক্ষে, যে কোনদিন পাঠশালার বারান্দাও মাড়ায়নি এ ধরনের উচ্চমানের কালাম রচনা করে পেশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। স্বয়ং কোরআনই একাধিকবার আরবদেরকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করেছে যে, “ তোমরা যদি একে নবীর (সঃ) রচিত বাণী বলে মনে কর, তাহলে তোমরা এ ধরনের বাণী তৈরী করে দেখাও।”

 

মুশরেকদের প্রাণান্তর বিরোধিতার মুখে মক্কা শরীফে বিভিন্ন সময় উক্ত চ্যালেঞ্জ তিনবার প্রদান করা হয়্। রসূলের মাদানী জিন্দেগীর প্রথম দিকে আর একবার এ চ্যালেঞ্জ পুনরোক্তি করা হয়। মক্কায় একবার সুরা ইউনুসের ভিতরে, একবার সুরা হুদের ভিতরে আর একবার সুরা বনি ইসরাইলের ভিতরে নিম্নরূ চ্যালেঞ্জ দান করা হয়:

 

 ﴿أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾

 

”এরা কি দাবী করে যে, কোরআন (আপনার) বানানো। আপনি বলুন, তোমরা যদি তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও, তাহলে একটি সুরা অন্তত তৈরী করে নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর। সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও”

 

(সুরা ইউনুস, আয়াত-৩৮)

 

﴿أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِّثْلِهِ مُفْتَرَيَاتٍ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾

 

”উহারা নাকি বলে যে, কোরআন রসূলের (সঃ) তৈরী করা, আপনি বলুন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে এ ধরনের রচিত দশটি সুরা নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও।”

 

(সুরা হুদ, আয়াত-১৩)

 

 ﴿قُل لَّئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنسُ وَالْجِنُّ عَلَىٰ أَن يَأْتُوا بِمِثْلِ هَٰذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا﴾

 

আপনি ঘোষণা করে দিন, জগতের সমগ্র মানব ও জ্বীন জাতি মিলেও যদি এ ধরনে একখানা কোরআন তৈরী করার চেষ্টা করে, তাহলেও তারা তা পারবে না, যদিও তারা এ ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করে।”

 

(সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৮৮)

 

নবী করীম (স:) মদীনায় হিজরত করার পরপরই আর একবার সুরায়ে বাকারার ভিতরে উক্ত চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃ্ত্তি নিম্নরূপে করা হয়,

 

 ﴿وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾

 

আর যে কিতাব আমি আমার বান্দার (মুহাম্মদের) উপর নাযিল করেছি, তা আমার পক্ষ হতে কিনা? এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে. তাহলে অনুরূপ একটি সুরা তৈরী করে নিয়ে এসো। আর এ কাজে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্যান্য সাহয্যকারীদেরকে ডেকে নাও যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” (সুরা বাকারা, আয়াত-২৩)

 

আরবদের কঠিন বিরোধিতার মুখে যখন বার বার এ চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছিল, তখন নিশ্চয়ই তারা চুপ করে বসে ছিল না। তাদের ভিতরে বেশ কিছু বড় বড় কবি এবং উচ্চমানের সাহিত্যিক বর্তমান ছিল। এহেন প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের জওয়াব দানের জন্য ইসলাম বিরোধীরা এদের সকলের দ্বারেই ধর্ণা দিয়েছিল। কিন্তু তারা সকলেই তাদেরকে হতাশ করেছিল। তাদের কোন কবি কিংবা কোন সাহিত্যিক প্রতিভার পক্ষেই কোরআনের ছোট্ট একটি সূরার অনুরুপও কোন সূরা তৈরী করে দেয়া সম্ভব হয়েছিল না।

 

আল্লাহ তায়ালা ঘোষিত উক্ত চ্যালেঞ্জ শুধু ঐ সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং কোরআন অবতীর্ণের সময় হতে আরম্ভ করে কিয়ামত পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালব্যাপী কোরআন বিরোধীদের জন্য এটা একটি খোলা চ্যালেঞ্জ। আজও মিসর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশে আরবী বংশজাত বহু খৃস্টান ও ইহুদী পরিবার বর্তমান, যাদের মধ্যে আরবী ভাষার বড় বড় পন্ডিতও আছে। ইচ্ছা করলে তারাও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে পারে। হয়তো তারা তা করে দেখেছেও। কিন্তু পূর্ববর্তীদের ন্যায় তাদের ভাগ্যেও হতাশা ছাড়া আর কিছুই জুটবেনা।

 

যারা আরবী ভাষার পন্ডিত এবং যাদের মাতৃভাষা আরবী তারা এটা ভালভাবেই অনুধাবন করতে পারে যে, কোরআনের ভাষার সাথে মানব রচিত কোন আরবী পুস্তকের ভাষার তুলনাই হয় না। বরং নবী করীমের (স:) ভাষাও কোরআনের ভাষার ন্যায় উচ্চমানের ছিল না। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি যে সব কথাবার্তা বলেছেন, এমনকি নবুয়ত প্রাপ্তি পরও সাধারণভাবে নবী (স:) (ওয়াহী ব্যতীত) যেসব কথা বলতেন তাও ছিল কোরআনের ভাষা হতে নিম্নমানের। ওয়াহীর ভাষার সাথে তার কোন তুলনাই হতো না।

 

সুতরাং কোরআন যে আল্লাহর কিতাব, তার উচ্চাঙ্গের সাহিত্যিক মান, সুনিপুন শব্দ গঠন প্রণালী, অভিনব বাক্যবিন্যাস আর মর্মস্পর্শী সুরঝঙ্কার প্রভৃতিই তার অকাট্য প্রমাণ।

 

দুইঃ কোরআনের আলোচ্য বিষয়সমূহ

 

কোরআনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের আলোচনা করা হয়েছে এবং যেসব দুরূহ সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়েছে। সেটাও কোরআনের ঐশী গ্রন্থ হওয়ার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। কেননা নবী করীম (স:) যে এলাকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে এলাকা ছিল তখনকার সভ্য জগতের বাইরে। কোন সুসংগঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাও যেমন সেখানে ছিল না, তেমনি কোন মার্জিত সভ্যতাও সেখানে গড়ে উঠেনি। দু একটি ছোটখাট শহর ব্যতীত আর সব এলাকার অধিবাসীরাই যাযাবর জীবন যাপন করতো। প্রতিটি গোত্রই আলাদা আলাদা গোত্রীয় শাসন অর্থাৎ গোত্র সর্দারের অনুশাসন মেনে চলত। কদাচিত এক-আধজন লোক সামান্য লেখাপড়া জানলেও কোথাও কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না।

 

এমন এক পরিবেশে জন্ম নিয়ে মুহাম্মদ (স:) শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন এতিমে পরিণত হন। ফলে তাঁর ভাগ্যে কোনরূপ লেখাপড়াই জোটেনি। যৌবনে সিরিয়ার দিকে দুটি সংক্ষিপ্ত বাণিজ্যিক সফর ব্যতীত কোন শিক্ষামূলক সফরও তিনি করেননি। কোন শিক্ষিত জ্ঞানী ব্যক্তির সাহচর্যও তিনি আদৌ পাননি।

 

এমতাবস্থায় এমন একজন উম্মি লোকেরে পক্ষে বহু বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বলিত কোরআনের মত একখানা গ্রন্থ রচনা করে পেশ করা যে আদৌ সম্ভব নয়, তা যে কোন সাধারণ জ্ঞানের লোকও অনুধাবন করতে পারে। সুতরাং কোরআনের আলোচ্য বিষয়সমূহই বলে দেয় যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব।

 

তিন: প্রাগৈতিহাসিক ঘটনাবলীর যথাযথ বর্ণনা

 

পবিত্র কোরআনে এমন ঘটনাসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা ঘটেছিল ইতিহাস সৃ্ষ্টির বহু পূর্বে এবং যার সম্পর্কে ষষ্ঠ শতাব্দীর দুনিয়া বিশেষ কোন খোঁজ-খবর রাখত না। প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ ইহুদীদের ধর্ম গ্রন্থে ছিল বটে, তবে তার অধিকাংশই ছিল অতিরঞ্জিত ও বিকৃত। আবার কিছু কিছু ঘটনার চর্চা যদিও আরব এবং পাশ্ববর্তী এলাকার লোকদের ভিতরে ছিল কিন্তু তা ছিল একেবারেই অস্পষ্ট ও সন্দেহপূর্ণ। আবার এমন বহু ঘটনার বর্ণনা কোরআনে দেখা যায়, যার উল্লেখ না ছিল ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থে আর না ছিল তার চর্চা আরবদের ভিতরে।

 

পবিত্র কোরআন প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত অথচ এমন নিখুঁতাভাবে বর্ণনা করেছে যার সত্যতাকে আজ পর্যন্ত কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। বরং অধুনা প্রত্নতত্ত্ববিদের ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহের নব নব আবিষ্কার এর সত্যতাকে আরও সন্দেহাতীত করে তুলেছে।

 

হযরত আদম-হাওয়া (আ) বৃত্তান্ত, হযরত নূহের ঘটনা, হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসমাইল ও হযরত ইয়াকুবের (আ) কাহিনী, নমরুদ-ফেরাউনের প্রসঙ্গ, হযরত ইউসুফ ও হযরত ইয়াকুবের (আ) কাহিনী, আদ, সামুদ, তুব্বা ও সাবা ইত্যাদি জাতিসমূহের বৃত্তান্ত, জালুত ও হযরত দাউদের প্রসঙ্গ, জুকারনাইন, আছহাবে কাহাফ ও হযরত লোকমানের ঘটনা, হযরত সুলায়মান, হযরত জাকারিয়া, হযরত ইয়াহীয়া ও হযরত ঈসার (আ) বর্ণনাবলী ইত্যাদি এমন একজন উম্মি লোকের পক্ষে যিনি কোনদিন ইতিহাস-পুস্তকের একটি লাইনও পড়েননি, অথবা বিভিন্ন দেশে পর্যটক হিসেবে আদৌ সফর করেননি, নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা যে সম্ভব নয় তা যে কোন লোকই বুঝতে পারে। ইহার প্রমাণ স্বরূপ পবিত্র কোরআন হতে নিম্নে কয়েকটি ঘটনার উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে,

 

(ক) মহানবীর আবির্ভাবের হাজার হাজার বছর আগে এবং মানব সৃষ্টির কেবল অল্পকাল পরেই ছাহেবে শরীয়ত পয়গম্বর হযরত নূহের (আ) আগমন ঘটেছিল। পবিত্র কোরআনে সুরায়ে হুদে আল্লাহ রাব্বুল আলামী হযরত নূহের নবুয়ত প্রাপ্তি, কওমের নিকটে তাঁর দাওয়াত পেশ, কওম কর্তৃক উহা প্রত্যাখ্যান এবং নূহকে (আ) নানারূপ তকলীফ দান, দীর্ঘ চেষ্টা যত্নের পরে নিরাশ হয়ে কওমের ধ্বংসের জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাত, অবশেষে প্রলয়ঙ্করী প্লাবনে হযরত নূহ (আ) এবং তাঁর কতিপয় ঈমানদার সঙ্গী ব্যতীত বাকী সমগ্র মানব গোষ্ঠীর ধ্বংস সাধনের ঘটনাবলী বর্ণনা করার পরে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদকে (স) লক্ষ্য করে বলেন,

 

 ﴿تِلْكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهَا إِلَيْكَ ۖ مَا كُنتَ تَعْلَمُهَا أَنتَ وَلَا قَوْمُكَ مِن قَبْلِ هَٰذَا ۖ فَاصْبِرْ ۖ إِنَّ الْعَاقِبَةَ لِلْمُتَّقِينَ﴾

 

 এ হলো অজ্ঞাত অজানা ঘটনাবলী, যা আমি তোমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ এসব ঘটনা ইতিপূর্বে না তোমার জনা ছিল, না তোমার জাতির। সুতরাং অপেক্ষা করতে থাক অবশ্যই শেষ ফল পরহিজগারদের ভাগ্যে।” (সুরা হুদ, আয়াত-৪৯)

 

(খ) রাসূলের জন্মের প্রায় দু হাজার বছর আগে হযরত ইউসুফের (আ) জীবনে যে বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল, তার বর্ণনা দান প্রসঙ্গে রসূলের উপরে কোরআনের সুরায়ে ইউসুফ নামীয় দীর্ঘ সুরাটি অবতীর্ণ হয়। উক্ত ভাষ্যটিতে আল্লাহ তাঁর নবীকে হযরত ইউসুফের পূর্ণ জীবনের বিচিত্র কাহিনীগুলিকে সংক্ষেপে অতি চমৎকার ও নিখুঁরূপে ওয়াহীর মারফতে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

 

কেমন করে হযরত ইউসুফের ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে কূপে নিক্ষেপ করেছিল, কিভাবে তাঁকে বণিক কাফেলার লোকেরা তুলে নিয়ে মিশরের প্রধানমন্ত্রীর কাছে গোলাম হিসেবে বিক্রি করেছিল, তারপর মন্ত্রীর ভা*র ষড়যন্ত্রে কিভাবে তিনি কারাগারে আবদ্ধ হয়েছিলেন, পরে মিশর রাজের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করে কিরূপে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সেক্রেটারী ও প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োজিত হয়েছিলেন, অবশেষে পিতা-মাতা ও ভাই-ভগ্নিসহ তাঁর সমগ্র পরিবার কেমন করে কেনান হতে মিশরে এসেছিলেন, এর পূর্ণ বিবরণ সুরায়ে ইউসুফের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর ওয়াহী ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে এমন নিখুঁতভাবে জানানো যে সম্ভব হত না তার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,

 

 ﴿ذَٰلِكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ ۖ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ أَجْمَعُوا أَمْرَهُمْ وَهُمْ يَمْكُرُونَ﴾

 

”আর এসব হল অজানা ও অজ্ঞাত ঘটনাবলী যা ( হে নবী) তোমাকে আমি ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ ইউসুফের (আ) ভাইয়েরা যখন ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তাদের পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছিল, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না।” (সুরা ইউসুফ, আয়াত-১০২)

 

(গ) হযরত ঈসার (আ) জননী হযরত মরিয়মের মাতা হান্নাহ কর্তৃক গর্বস্থ সন্তানকে আল্লাহর রাহে বায়তুল মোকাদ্দাসের খেদমত ও দ্বীনের কাজের জন্য উৎসর্গকরণ, অতঃপর তাঁর নামকরণ ও তাঁকে বায়তুল মুকাদ্দাসের যাজকদের হাতে অর্পণ, কে তাঁর লালন-পালন করবে তা ঠিক করার উদ্দেশ্য কোরআর কলম নিক্ষেপ, আশ্চর্য ও অলৌকিক উপায়ে উক্ত কন্যার খাদ্য প্রাপ্তি, তারপর কন্যা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে হযরত জিরাঈলের (আ) তাঁকে সাক্ষাৎ দান ও সুসংবাদ প্রদান ইত্যাদি সম্পর্কীয় অজ্ঞাত কাহিনী বর্ণনা করার আল্লাহ তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে বলেন,

 

 ﴿ذَٰلِكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ ۚ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُونَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُونَ﴾

 

”এ হল অজ্ঞাত ঘটনাবলী, যা আমি (হে মুহাম্মদ) তোমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ তারা যখন (মরিয়মের লালন-পালনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য) ভাগ্য নির্ণয়ে কাঠি নিক্ষেপ করেছিল এবং পরস্পর তর্কে লিপ্ত ছিল, তখন তুমি সেখোনে উপস্থিত ছিলে না।” (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-৪৪)

 

(ঘ) রসূলের (স) জন্মের প্রায় এক হাজার আটশত বছর আগে আফ্রিকার মিসর দেশে হযরত সাঃ ও মিসর রাজা ফেরাউনের বিচিত্র ঘটনাবলী সংগঠিত হয়েছিল। হযরত মূসার ভূমিষ্ঠ হওয়া, তাকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া, ফেরাউনের স্ত্রী কর্তৃক তাকে উত্তোলন ও রাজ পরিবারে ব্যবস্থাপনায় তার লালন পালন, যৌবনে পদার্পণের পর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর ফাঁসির সিদ্ধান্ত, ভীত সন্ত্রস্ত মূসার (আ) দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মাদায়েনে পলায়ন, সেখানে হযরত সোয়াইবের কন্যান পানি গ্রহণ এবং দশ বছরকাল অবস্থান। অতঃপর পরিবার-পরিজনসহ মিশরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা, পথিমধ্যে সিনাই পর্বতের পবিত্র উপত্যকায় নবূয়ত ও ওয়াহী প্রাপ্তি, অবশেষে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত ও দাওয়াত পেশ, ফেরাউন ও তার জাতির সাথে দীর্ঘ দ্বন্ধ ও বিভিন্ন মোযেযা প্রদর্শন, অকৃতকার্য হয়ে কয়েক লক্ষ্য ইসরাইলীদের নিয়ে আল্লাহর আদেশে মিশর ত্যাগ ও ফিলিস্তিনের দিকে রওয়ানা, ফেরাউন ও তার ফওযের পশ্চাদনুসরণ, অতঃপর আল্লাহর অনুগ্রহ হযরত মূসা ও বনি ইসরাইলদের লোহিত সাগর অতিক্রম। ফেরাউনের ও তার লোক-লস্করের সলিল সমাধি, অতঃপর বিস্তীর্ণ সিনাই প্রান্তরে ইসরাইলদের দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাযাবর জীবন যাপন এবং সেখানকার বহু বিচিত্র ঘটনাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনা দান করার পরে আল্লাহ তার নবীকে লক্ষ্য করে বলেন,

 

 وَمَا كُنتَ بِجَانِبِ الْغَرْبِيِّ إِذْ قَضَيْنَا إِلَىٰ مُوسَى الْأَمْرَ وَمَا كُنتَ مِنَ الشَّاهِدِينَ ﴿٤٤﴾ وَلَـٰكِنَّا أَنشَأْنَا قُرُونًا فَتَطَاوَلَ عَلَيْهِمُ الْعُمُرُ ۚ وَمَا كُنتَ ثَاوِيًا فِي أَهْلِ مَدْيَنَ تَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِنَا وَلَـٰكِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ ﴿٤٥﴾ وَمَا كُنتَ بِجَانِبِ الطُّورِ إِذْ نَادَيْنَا وَلَـٰكِن رَّحْمَةً مِّن رَّبِّكَ لِتُنذِرَ قَوْمًا مَّا أَتَاهُم مِّن نَّذِيرٍ مِّن قَبْلِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ ﴿٤٦﴾

 

”সিনাই (তুর) পর্বতের পশ্চিম প্রান্তে মুসাকে (আ) যখন আমি আমার নির্দেশনাবলী দিয়েছিলাম, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না। আর প্রকৃত ব্যাপার হল এই যে, জগতে আমি বহু জাতি সৃষ্টি করেছিলাম, যাদের সৃষ্টির পরে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। আর তুমি (হে মুহাম্মদ (স) তৎকালে মাদায়েন নগরের অধিবাসীদের সাথেও বসবাস করতেন না যে, আমার (সেই সময় সংঘটিত) নিদর্শনাবলীর কথা তাদেরকে বলবে। বরং আমি রসূল প্রেরণ করে থাকি (যাদের কাছে অতীত ঘটনা ওয়াহীর মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়)। আর যখন আমি মুসাকে তুর পাহাড়ের পাদদেশে আহবান করেছিলাম, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না। বরং ইহা হল তোমার প্রভুর পক্ষ হতে রহমত (ওয়াহী) যাতে করে তুমি এমন একটি জাতিকে ভীতি প্রদর্শন করতে পার যাদের কাছে ইতিপূর্বে কোন ভীতি প্রদর্শনকারী (পয়গম্বর) আসেনি। আর এইভাবেই হয়ত তারা উপদেশ গ্রহণ করবে।” (সুরা কাসাস, আয়াত-৪৪-৪৬)

 

(ঞ) অনুরূপভাবে পবিত্র কোরআনের সুরা ত্বহায় মহাজ্ঞানী আল্লাহ হযরত মুসার (আ) জন্ম ও লালন-পালন থেকে আরম্ভ করে তার যৌবন প্রাপ্তি, মাদায়েনে পলায়ন, নবুয়ত প্রাপ্তি, হারুন (আ) সহ মিশর রাজ ফেরাউনের কাছে দাওয়াতত পেশ, বিভিন্ন মোজেজা প্রদর্শন ও ফেরাউনের সাথে দীর্ঘ দ্বন্ধ। অতঃপর ফিলিস্তিনের দিকে হিজরত। আল্লাহ তায়ালার অলৌকিক মহিমায় কয়েক লক্ষ লোকসহ লোহিত সাগর অতিক্রম। অতঃপর মুসার তুর পাহাড়ে গমন এবং খোনে শরীয়িত প্রাপ্তি ইত্যাতি ঘটনা বর্ণনা করার পরে আল্লাহ তাঁ প্রিয় নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

 

 كَذَٰلِكَ نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنبَاءِ مَا قَدْ سَبَقَ ۚ وَقَدْ آتَيْنَاكَ مِن لَّدُنَّا ذِكْرًا ﴿٩٩﴾

 

”এভাবেই আমি আপনার কাছে অতীত ঘটনাবলী বর্ণনা করছি। আর অবশ্যই আমি আপনাকে নিজের নিকট হতে একটি উপদেশনামা দিয়েছি।” (সুরা তাহা আয়াত-৯৯)

 

সুতরাং একথা একন জোর করে বলা জলে যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের এসব ঘটনাবলী সেই মহান সত্তাই বর্ণা করেছেন, যিনি ইতিহাস সৃষ্টি পূর্বে ছিলেন, এখনও আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। কারণ কোরআন তাঁরই শ্বাশতবাণী আর তিনিই উক্ত ঘটনাবলী নবীর কাছে ওয়াহী মারফত বর্ণনা করেছেন।

 

চার: ভবিষ্যত ঘটনাবলী সম্পর্কে সংবাদ দান

 

কোরআন শরীফে এমন বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা সংঘটিত হওয়ার বহু পূর্বেই আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে রসূলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। নিম্নে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে,

 

(ক) ভবিষ্যদ্বানী সম্পর্কীয় এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা আমরা দেখতে পাই পবিত্র কোরআনের সুরায়ে রোমের প্রথমে। রসুলেন হিজরতের প্রায় সাত বছর আগে মক্কা শরীফে এ সুরাটি অবতীর্ণ হয়। সুরার প্রথমে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস কর্তৃক পারস্য সম্রাট খসরুকে পরাজিত করার ভবিষ্যদ্বানী। ঘটনাটি ঘটার প্রায় নয় বছর পূর্বে আল্লাহর নবী ওয়াহীর মাধ্যমে এ খবর শুনিয়ে দিয়েছিলেন। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:

 

ইসলামের অভ্যত্থানের সামান্য আগে সারা পৃথিবীতে দুটি রাষ্ট্রই ছিল বৃহৎ ও শক্তিশালী। আর এদের সীমানাও ছিল পরস্পর সন্নিহিত। এর একটি হল পারস্য সাম্রাজ্য এবং অপরটি হল রোম সাম্রাজ্য। দুনিয়ার অপরাপর ছোট-খাট রাষ্ট্র ছিল এদের প্রভাবাধীন। এ দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিতরে প্রায়ই যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকতো। ৬১৫ খৃষ্টাব্দে রসূলের (স) হিজরতের সাত বছর পূর্বে পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরুর সেনাবাহিনীর হাতে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বাহিনী ভীষণভাবে পরাজিত হয়। পারসিয়ানরা জেরুজালেমস্থ রোমদের পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করে দিয়ে খৃস্টানদের পবিত্র ক্রুশ নিয়ে যায়। এ যুদ্ধে সম্রাট তার গোটা এশিয়ান এলাকাই হারিয়ে কনস্ট্যান্টিনোপলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আর এ সংঘর্ষে রোমক শক্তি এমনভাবে পর‌্যুদস্ত হয়েছিল যে, দুর ভবিষ্যতেও তার পুনরুত্থানের কোন সম্ভাবনাই পরিলক্ষিত হচ্ছিল না।

 

পারস্য সম্রাটের এ বিজয়ের খবর যখন মক্কায় পৌঁছে তখন ছিল নবুয়তের পঞ্চম বর্ষ। পারসিয়ানরা পৌত্তলিক হওয়ার কারণে এ বিজয়ের সংবাদে মক্কার পৌত্তলিকেরাও বিশেষভাবে উৎফুল্ল হয়েছিল এবং মুসলমানদের এ বলে তারা বিদ্রুপ করছিল যে, যেভাবে আহলে কিতাব খৃস্টানরাজ রোম সম্রাট পৌত্তলিক পারসিয়ান সম্রাটের হাতে পর্যুদস্ত ও পরাভূত হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে কিতাবধারী মুহম্মদ (স) এবং তাঁর অনুসারীরাও পৌত্তলিক কোরায়েশদের হাতে পর্যুদস্তু হবে। মোট কথা উক্ত ঘটনাকে মুশরিকগণ মুসলামানদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয়ের একটি শুভ ইঙ্গিত বলে দাবী করছিল।

 

আর প্রকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, এই যুদ্ধের সূচনা হতেই পৌত্তলিক কোরায়েশদের মানসিক সমর্থন ছিল পারসিয়ানদের পক্ষে। আর রোমকরা আহলে কিতাব হওয়ার কারণে মুসলমানদের সমর্থন ছিল রোমকেদের পক্ষে। অতঃপর পারসিয়ানদের বিজয় সংবাদে মক্কার পৌত্তলিকরা যখন বিজয়োৎসব করছিল, তখন রোমকদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করে আল্লাহ তার নবীর উপরে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন,

 

 الم ﴿١﴾ غُلِبَتِ الرُّومُ ﴿٢﴾ فِي أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُم مِّن بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ ﴿٣﴾ فِي بِضْعِ سِنِينَ ۗ لِلَّـهِ الْأَمْرُ مِن قَبْلُ وَمِن بَعْدُ ۚ وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ ﴿٤﴾ بِنَصْرِ اللَّـهِ ۚ يَنصُرُ مَن يَشَاءُ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ ﴿٥﴾

 

”রোমানরা আরবদের নিকটবর্তী ভূ-খন্ডে পরাজয়বরণ করেছে। অতঃপর তারা দশ বছরেরও কম সময়ের ভিতরে বিজয় লাভ করবে। প্রকৃতপক্ষে প্রথমাবস্থায়ও (পরাজয়কালে) যেমন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিল আল্লাহ্‌, তেমনি পরবর্তীকালেও (চিরকাল) চুড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী তিনিই। আর সেদিন (রোমকদের বিজয়কালে) মুসলমানেরা আল্লাহ তায়ালার সাহয্যপ্রাপ্ত হয়ে আনন্দোৎসব করবে।” (সুরা রুম আয়াত ১-৫)

 

আল্লাহ তায়ালাম উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বানী রসূল (স) যখন পাঠ করে শুনালেন, তখন মক্কার মুশরিকেরা এ নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ শুরু করে দিল। কেননা রোমান শক্তি পারসিয়ানদের হাতে এমনভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল যে, তাদের পক্ষে পুনরায় একটি বৃহত্তর শক্তি হিসেবে দাঁড়াবার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না।

 

এমনাবস্থায় এ ধরনের একটি পর্যুস্ত শক্তি মাত্র দশ বছরেরও কম সময়ের ভিতরে একটি বৃহত্তর শক্তিকে পুনর্গঠিত হয়ে বিজয়ী পারসিয়ানদেরকে পরাভূত করবে, এটাকে কল্পনা বিলাসীর কল্পনা বলেই মনে হত।

 

তাছাড়াও উপরোক্ত আয়াতগুলোর ভিতরে আল্লাহ ক্ষুদ্র এবং দুর্বল মুসলিম জামাতকেও অনুরূপ সময়কালেন চিতরে তাদের শক্তিশলিী দুশমনদের উপরে বিজয় লাখের সংবাদ দিয়েছিলেন আর এটা ছিল বাহ্যিক দৃষ্টিতে একেবারেই অসম্ভব।

 

কিন্তু সমগ্র বিশ্বকে আশ্চর্য করে পরাজয়ের মাত্র নয় বছর পর ৬২৪ খৃষ্টাব্ধে পুনর্গঠিত রোমান শক্তি পারসিয়ানদের কাছ থেকে শুধু তাদের এশিয়ার হারানো এলাকাই উদ্ধার করল না বরং মূল পারস্য ভূ খন্ডে পারস্য বাহিনীকে চরম পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করল। আর ওই সময়ই বদরের ময়দানে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী কর্তৃক কোরায়েশদের বিরাট বাহিনী সম্পূর্ন পর্যুদস্ত হল। ফলে কোরআনের ভবিষ্যদ্বানী অক্ষরে অক্ষরে ফলতে দেখে যেমন মুসলমানরা আনন্দিত হয়েছিল, তেমনি মুশরিকরাও ক্ষোভে ও দুঃখে যথেষ্ট মর্মাহত হয়েছিল, তেমনি মুশরিকরাও ক্ষোভে ও দুঃখে যথেষ্ট মর্মাহত হয়েছিল।

 

কোরআন মহান আল্লাহর কালাম বলেই তার পক্ষেই এই ধরনের নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব ছিল। কেননা আল্লাহর কাছে অতীত ও ভবিষ্যৎ বর্তমানের ন্যায়।

 

(খ) অনুরূপ ভবিষ্যৎবাণী সম্পর্কীয় আর একটি ঘটনা আমরা দেখতে পাই সুরায়ে হাশরে। হিজরী পঞ্চম বছরে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মুশরিকদের সম্মিলিত বিরাহ বাহিনী মদীনায় চড়াও হয়ে চতুর্দিক হতে মদীনাকে অবরোধ করে ফেলল। মদীনার ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের এই মর্মে চুক্তি ছিল যে, কোন বিদেশী শক্তি ‍যদি মদীনা আক্রমণ করে, তাহলে তারাও মুসলমানদের সাথে মিলে উক্ত শক্তির বিরুদ্ধে লড়বে। কিন্তু খন্দক যুদ্ধে যখন মুশরিকরা এসে মদীনা আক্রমণ করল, তখন ইহুদীরা উক্ত চুক্তির কোর পরওয়া না করে মুশরিকদের পক্ষই অবলম্বন করল। অতঃপর যুদ্ধে যখন সুবিধা না করতে পেরে মুশরিকরা অবরোধ উঠিয়ে চলে গেল, তখন ইহুদীরা তাদের এ কৃতকর্মের জন্য প্রমাদ গুনলো। আর মুসলমানরা যে এরপর ঘরের শত্রুকে বরদাস্ত করবে না, তা তারা উপলব্ধি করে যথেষ্ট ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। ঠিক এই সময়ে মদীনার মুনাফেকরা ইহুদীদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল যে, মুসলমানেরা তাদেরকে যদি আক্রমন করে, তাহলে তারা তাদেরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে, এমনকি যদি মুসলমানেরা ইহুদীদের মদীনা হতে বের করেও দেয়, তাহলে তারাও তাদের সাথে মদীনা ত্যাগ করে চলে যাবে।

 

মুনাফেকরা যে তাদের এ ওয়াদা পালন করবে না পূর্বাহ্নেই আল্লাহ নিম্নের আয়াত দ্বারা নবীকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন,

 

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ نَافَقُوا يَقُولُونَ لِإِخْوَانِهِمُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَئِنْ أُخْرِجْتُمْ لَنَخْرُجَنَّ مَعَكُمْ وَلَا نُطِيعُ فِيكُمْ أَحَدًا أَبَدًا وَإِن قُوتِلْتُمْ لَنَنصُرَنَّكُمْ وَاللَّـهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ ﴿١١﴾ لَئِنْ أُخْرِجُوا لَا يَخْرُجُونَ مَعَهُمْ وَلَئِن قُوتِلُوا لَا يَنصُرُونَهُمْ وَلَئِن نَّصَرُوهُمْ لَيُوَلُّنَّ الْأَدْبَارَ ثُمَّ لَا يُنصَرُونَ ﴿١٢﴾

 

”হে রাসূল (স) আপনি কি মুনাফেকদের সম্পর্কে অবগত আছেন, যারা তাদের আহলে কিতাব কাফের ভাইদেরকে বলছে- “আল্লাহর শপথ! যদি তোমাদেরকে (মদীনা হতে) বের করে দেয়া হয়, তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে বের হয়ে যাব এবং তোমাদের ব্যাপারে আমরা আদৌ কারও কথা শুনব না। আর যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা তোমাদের সাহায্য করব।” আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফেকরা (তাদের দাবীতে) একেবারেই মিথ্যাবাদী। যদি ইহুদীদের বের করে দেয়া হয়, তাহলে এরা তাদের সাথে বের হয়ে যাবে না। আর যদি তাদের সাথে যুদ্ধ হয়, তাহলে মুনাফেকরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না।” (সুরা হাশর আয়াত-১১-১২)

 

ইতিহাস সাক্ষী পরবর্তী পর্যায়ে যখন ইহুদীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও চুক্তি ভঙ্গের কারণে তাদেরকে অবরোধ করা হল, তখন মুনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গী তাদের সাহায্যের জন্য আদৌ এগিয়ে আসেনি। অতঃপর যখন মদীনার নিরাপত্তার খাতিরে ইহুদীদেরকে মদীনা হতে বের করে দেয়া হল, তখনও মুনাফেকরা তাদের সাথে বের হয়ে যায়নি। আর এভাবেই কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছিল।

 

(গ) এই ধরনের আর একটি ঘটনার উল্লেখ আছে সুরা বাকারায়। নবী করিম (সাঃ) মদীনায় হিযরত করার পরে প্রায় বছরকাল বায়তুল মোকাদ্দেসকে কেবলা করে নামায আদায় করেন। অতঃপর হিজরী ‍দ্বিতীয় বর্ষে কাবা শরীফকে কেবলা করে আয়াত অবতীর্ণ হয়। কেবলা পরিবর্তনের পরে মুনাফেক, ইহুদী তথা ইসলামী বিরোধীদের ভিতরে তার কি প্রতিক্রিয়া হবে এবং তারা কি বলে প্রপাগান্ডা করবে, আল্লাহ আগে-ভাগেই তা ওয়াহীর মাধ্যমে রসূলকে জানিয়ে দিয়েছেলেন,

 

 سَيَقُولُ السُّفَهَاءُ مِنَ النَّاسِ مَا وَلَّاهُمْ عَن قِبْلَتِهِمُ الَّتِي كَانُوا عَلَيْهَا ۚ قُل لِّلَّـهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ ۚ يَهْدِي مَن يَشَاءُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ ﴿١٤٢﴾

 

“শীঘ্রই নির্বোধ লোকেরা বলবে,” যে কেবলার দিকে মুখ করে তাঁরা এতদিন নামায পড়েছে, কি কারণে তাঁরা সেটা হতে ফেরত গেল।” হে নবী, আপনি বলে দিন, পূর্ব-পশ্চিম সব দিকই আল্লাহর। তিনি যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন।” (সুরা বাকারা আয়াত-১৪২)

 

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা মুনাফেক ও ইহুদীরা কেবলা পরিবর্তনের পরে কি ধরনের প্রপাগান্ডা করবে তা পূর্বাহ্নেই নবীকে (স) জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।

 

(ঘ) ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কীয় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমরা সুরায়ে তওবার একাদশ রুকুতে দেখতে পাই। নবম হিজরীতে নবী করীম (স) খবর পেলেন যে, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদীনা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এই উদ্দেশ্যে সিরিয়া ও হেজাজ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে। হুজুর (স) এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই গোটা মুসলিম বাহিনী নিয়ে হেজাজ সীমান্তেই তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। আর যুদ্ধক্ষম প্রতিটি মুসলিমকেই হুকুম দিলেন যে, সকলকেই এ যুদ্ধে শরীক হতে হবে। কেউ বাড়ী থাকতে পারবে না।

 

মদীনায় কিছু সংখ্যক মুনাফেক ছিল, তারা যে যুদ্ধে মুসলমানদের নিশ্চিত বিজয়ের সম্ভাবনা থাকত কেবলে সেগুলিতেই শরীক হত। আর যে যুদ্ধে সম্ভাবনা থাকত না টালবাহানা করে সেগুলো হতে বিরত থাকত।

 

তাবুক অভিযান ছিল এমন একটি শক্তির বিরুদ্ধে যে শক্তিটি তখনকার দুণিয়ায় এক নম্বর শক্তি হিসেবে বিবেচিত হত। তাই মুনাফেকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় অনিবার্য। এছাড়াও তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। মরুভূমিতে প্রচন্ড বেগে লু-হাওয়া বইতেছিল। এমতাবস্থায় মদীনা হতে তাবুক পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশত মাইল পথ অতিক্রম করে এক শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া তাদের কাছে ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামিল। সুতরাং তারা নানারূপ টালবাহানা করে মদীনায় থেকে গেল।

 

অতঃপর অভিযান শেষে নবী করীম (স) যখন মদীনার দিকে রওয়ানা হলেন, তখন পথিমধ্যেই আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে একদিকে যেমন মুনাফেকদের গোপন দুরভিসন্ধির কথা হুজুরকে জানিয়ে দিলেন, অন্যদিকে তেমনি হুজুরের মদীনা প্রত্যাবর্তনের পরে তারা শাস্তির হতে বাঁচার জন্য যে, সব মিথ্যা ওজর পেশ করবে তারও আগাম সংবাদ নবীকে দিয়ে দিলেন,

 

 يَعْتَذِرُونَ إِلَيْكُمْ إِذَا رَجَعْتُمْ إِلَيْهِمْ ۚ قُل لَّا تَعْتَذِرُوا لَن نُّؤْمِنَ لَكُمْ قَدْ نَبَّأَنَا اللَّـهُ مِنْ أَخْبَارِكُمْ ۚ وَسَيَرَى اللَّـهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَىٰ عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿٩٤﴾

 

“হে রসূল, আপনারা যখন মদীনায় মুনাফেকদের কাছে ফিরে যাবেন, তখন তারা ওজর পেশ করবে। আপনি বলুন, তোমাদের ওজর পেশ করার কোন প্রয়োজন নাই। আমরা আর তোমাদের কথা বিশ্বাস করছি না। আল্লাহ (পূর্বাহ্নেই) তোমাদের বিষয় আমাদেরকে অবগত করিয়ে দিয়েছেন।” (সুরা তওবা আয়াত-৯৪)

 

অতঃপর আল্লাহ নবীকে আরও জানিয়ে দিচ্ছেন,

 

سَيَحْلِفُونَ بِاللَّـهِ لَكُمْ إِذَا انقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ لِتُعْرِضُوا عَنْهُمْ ۖ فَأَعْرِضُوا عَنْهُمْ ۖ إِنَّهُمْ رِجْسٌ ۖ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ﴿٩٥﴾

 

“আপনারা যখন (মদীনায়) এদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবেন, তখন এই মুনাফেকরা আপনাদের কাছে এসে আল্লাহর নামে শপথ করবে। যেন আপনারা তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন। আচ্ছা, আপনারা এদেরকে ছেড়ে ‍দিন, এরা এদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ জাহান্নাম ভোগ করবে।” (সুরা তওবা আয়াত-৯৫)

 

يَحْلِفُونَ لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ ۖ فَإِن تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللَّـهَ لَا يَرْضَىٰ عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ ﴿٩٦﴾

 

এরা আপনাদের কাছে এ জন্যই শপথ করবে, যেন আপনারা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। মনে রাখবেন, আপনারা এদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ এসব পাপীদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না।” (সুরা তওবা, আয়াত-৯৬)

 

উপরোক্ত আলোচনায় মাত্র কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করা হল, যার প্রতিটিই হুবহু সত্যে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়াও বহু ভবিষ্যদ্বাণী পবিত্র কোরআনে দেখা যায়, যা ইতিপূর্বেই বাস্তবায়িত হয়েছে।

 

এতদ্ব্যতীত হাশর-নাশর, পরকাল-পুনরুত্থান হিসাব-নিকাশ, বেহেশত-দোযখ ইত্যাদি সম্পর্কীয় অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে যা প্রতিফলিত হওয়ার সময় এখনও আসেনি। এসব নিখুঁত ভবিষ্যদ্বানী নিশ্চয়ই এ কথা প্রমাণ করে যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব, কেননা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ভবিষ্যতের জ্ঞান রাখে না।

 

পাঁচ: মানব জীবনের জন্য সূদুর প্রসারী ও মৌলিক ব্যবস্থা দান

 

কোরআন মানব জীবনের বিভিন্ন ‍দিক সম্পর্কে যে সমস্ত সুসামঞ্জস্য, সুপরিকল্পিতও সূদুরপ্রসারী ব্যবস্থা দান করেছে, তাও কোরআনের ঐশীগ্রন্থ হওয়ার একটি জাজ্জল্যমান প্রমাণ।

 

কোরআনের এসব চমৎকার বিধানবলীর প্রশংসা করতে গিয়ে প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত স্যার ডায়মন্ডবার্স লিখেছেন,

 

“কোরআনের বিধানবলী শাহানশাহ থেকে আরম্ভ করে পর্ণকুটীরের অধিবাসী পর্যন্ত সকলের জন্যই সমান উপযোগী ও কল্যাণকর। দুনিয়ার জন্য কোন ব্যবস্থায় এর বিকল্প খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।”

 

ডক্টর অসওয়েল জনসন বলেন,

 

“কোরআনের প্রজ্ঞাপূর্ণ বিধানবলী এতই কার্যকরী এবং সর্বকালের উপযোগী যে, সর্বযুগের দাবীই উহা পূরণ করতে সক্ষম। কর্ম-কোলাহলপূর্ণ নগরী, মুখর জনপদ, শূণ্য মরুভূমি এবং দেশ হতে দেশান্তর পর্যন্ত সব জায়গায় এ বাণী সমভাবে ধ্বনিত হতে দেখা যায়।”

 

গীবন বলেন,

 

“জীবনের প্রতিটি শাখার কার্যকরী বিধান কোরআন মওজুদ রয়েছে”

 

বিবাহ-তালাক সম্পর্কীয় যাবতীয় বিধান, উত্তরাধিকার সম্পর্কীয় ব্যবস্থাবলী, রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক মূলনীতিসমূহ, যুদ্ধ-সন্ধি সম্পর্কীয় নিয়ম কানুন ইত্যাদি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব। কেননা যে নবীর মুখ থেকে আমরা এ কিতাব পেয়েছি তিনি ছিলেন উম্মি। সুতরাং তিনি কোন আইনের কিতাবও অধ্যয়ন করেননি, কিংবা কোন আইনজ্ঞের কাছে কোন পাঠও গ্রহণ করেননি। কাজেই নবী না হলে তাঁর পক্ষে এ ধরনের চমৎকার বিধানবলী পেশ করা সম্ভব ছিল না।

 

ছয়: বিশ্বলোক ও উর্দ্ধজগত সম্পর্কে নির্ভুল তথ্যের বর্ণনা দান

 

পবিত্র কোরআনে বহু জায়গায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে আল্লাহর অসীম কুদরতের বর্ণনা দান করতে গিয়ে উর্ধ্বর্লোক, ভুমণ্ডল এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যে সব তথ্যে অবতারণা করা হয়েছে, বিজ্ঞানের উন্নতি বিভিন্ন পর্যায় তার বাস্তবতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিম্নে তার কয়েকটি নমুনা পেশ করা হচ্ছে,

 

(ক) মহাশুন্যে বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ যে একটি অপরটিকে আকর্ষণ করে এবং এরই ফলে যে এরা শূণ্যে ভেসে রয়েছে, ১৯৬৫ খৃষ্টাব্দে নিউটনের মধ্যাকর্ষণ থিওরী আবিষ্কারের পূর্বে জগদ্বাসী এর বিশেষ কোন খবর রাখত না। কিন্তু নিউটনের জন্মের প্রায় হাজার বছর আগে এ তথ্য আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে তাঁর নবীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। নিম্নে এ সম্পর্কীয় আয়াত উদ্ধৃত করা হচ্ছে,

 

وَمِنْ آيَاتِهِ أَن تَقُومَ السَّمَاءُ وَالْأَرْضُ بِأَمْرِهِ ۚ ثُمَّ إِذَا دَعَاكُمْ دَعْوَةً مِّنَ الْأَرْضِ إِذَا أَنتُمْ تَخْرُجُونَ ﴿٢٥﴾

 

“এবং আল্লাহ তায়ালার মহা নিদর্শনাবলীর মধ্যে এটাও একটি যে উর্দ্ধলোক ও ভূমন্ডল তারই আমর দ্বারা মহাশূণ্যে প্রতিষ্ঠিত।” (সুরা রুম, আয়াত-২৫)

 

যে মহাশক্তি বলে উর্দ্ধলোকের যাবতীয় বস্তু এবং ভূ মন্ডল শূণ্যে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তাকে আয়াতে “আমরুল্লাহ” বলা হয়েছে। আর সেটাই হচ্ছে নিউটনের আবিস্কৃত মধ্যাকর্ষণ শক্তি।

 

 وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ ﴿١٢﴾

 

“আর সমস্ত নক্ষত্ররাজি তারই আমর দ্বারা বাঁধা (নিয়ন্ত্রিত)। নিশ্চয়ই এর ভিতরে বিজ্ঞ লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সুরা নাহল, আয়াত-১২)

 

উপরোক্ত আয়াতে আমর দ্বারা সেই মহা আকর্ষণ শক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যার আকর্ষণ শক্তি বলে মহাশূণ্য নক্ষত্ররাজি বিক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে পড়ছেনা।

 

إِنَّ اللَّـهَ يُمْسِكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ أَن تَزُولَا ۚ وَلَئِن زَالَتَا إِنْ أَمْسَكَهُمَا مِنْ أَحَدٍ مِّن بَعْدِهِ ۚ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا ﴿٤١﴾

 

নিশ্চয় আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূ মণ্ডলকে এমনভাবে ধারণ করে রেখেছেন যার ফলে উহা বিচ্ছিন্ন হয়ে পতিত হয় না।” (সুরা ফাতের, আয়াত-৪১)

 

বর্ণিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালার ধারণ শক্তি হল নিউটনের আবিষ্কৃত মধ্যাকর্ষণ শক্তি।

 

যদিও খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গ্রীক বিজ্ঞানী টলেমী পৃথিবীর গোলাকৃতি এবং মহাশূন্যে সেটা ঝুলে থাকার তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু কোন শক্তি বলে তা ঝুলে রয়েছে, তার যেমন তিনি সন্ধান দিতে পারেননি, তেমনি তিনি পৃথিবীর গতি সম্পর্কেও কোন খবর দিতে পারেননি।

 

(খ) সৃষ্টির ব্যাপারে বিশ্বের সর্বত্রই যে আল্লাহ তায়ালা দ্বৈত ও জোড়া পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, ফরাসী পদার্থ বিজ্ঞানী দ্য-ব্রগলী ১৯১৫ সনে এই আশ্চর্য দ্বৈতরূপের প্রতি ইঙ্গিত করেন। তার মতে প্রকৃতির সর্বত্র যে দ্বৈতভাব বিরাজ করছে, আলোর দ্বৈতধর্ম তারই একটি দিক মাত্র। অথচ দ্য-ব্রগলীর প্রায় তের শত বছর পূর্বে এই দ্বৈত ভাবের কথা কোরআনের মাধ্যমে মানুষকে জানানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

سُبْحَانَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُونَ ﴿٣٦﴾

 

“ বড়ই মহিমান্বিত সেই সত্ত্বা যিনি দ্বৈতরূপে সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। যা কিছু ভূমি হতে ও তাদের (মানুষের) ভিতর হতে জন্মে এবং এমন বস্তু হতে জন্মে যার খবর তারা রাখেনা।” (সুরা ইয়াসিন, আয়াত-৩৬)

 

وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا ﴿٨﴾

 

“এবং আমি তোমাদেরকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি।” (সুরা নাবা, আয়াত-৮)

 

(গ) চন্দ্র সূর্যসহ বিশ্বের সবকিছুই যে অবিরতভাবে গতিশীল, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন ও আইনিস্টাইন প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের জন্মের বহু পূর্বে কোরআন এ কথা ঘোষণা করেছে,

 

 وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ۚ ذَٰلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ ﴿٣٨﴾ وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّىٰ عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ ﴿٣٩﴾ لَا الشَّمْسُ يَنبَغِي لَهَا أَن تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ ۚ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ ﴿٤٠﴾

 

“সূর্য তার গন্তব্যস্থলের দিকে চলছে। আর এ হল তাঁরই ব্যবস্থাপনা যিনি মহা-পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী। আর চন্দ্রের জন্যও আমি তার মনজিল ঠিক করে দিয়েছি, এমনকি এক সময় উহা পুরান খেজুর শাখের রূপ ধারণ করে। সূর্যের যেমন শক্তি নেই চন্দ্রকে ধরে ফেলার, রাতেরও তেমনি ক্ষমতা নেই দিনকে অতিক্রম করার। আর প্রত্যেকেই মহাশূন্যে সাঁতার কাটছে।” (সুরা ইয়াসীন, আয়াত-৩৮-৪০)

 

 ﴾ وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ ﴿٣٣﴾

 

“তিনিই সৃষ্টি করেছেন দিন ও রাতকে, সূর্য ও চন্দ্র তাঁরই সৃষ্টি। আর সকলেই মহাশূন্যে সাঁতার কাটছে।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৩৩)

 

এবার এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথা শুনুন,

 

“বিশ্বে গতিহীন স্থির কোন কাঠামো নেই। বিশ্ব গতিশীল, নক্ষত্র, নীহারীকা-জগত এবং বহির্বিশ্বের বিরাট মধ্যাকর্ষণীয় জগত সমস্তই অবিরামভাবে গতিশীল।”

 

এ সম্পর্কে স্যার আইজাক নিউটনের মত হলো নিম্নরূপ:

 

“পৌরনীতি প্রবর্তনের সময় সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি বস্তুকে তার অক্ষের উপর প্রদক্ষিণ করার ব্যবস্থা করেন।”

 

(ঘ) সৃষ্টির প্রথমাবস্থায় নক্ষত্র, নীহারিকা ও সৌরজগত যে পরস্পর সংযু্ক্ত ও অবিচ্ছিন্ন ছিল বিজ্ঞানীদের বহু পূর্বে কোরআন আমাদেরকে তার সন্ধান দিয়েছে,

 

 أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا ۖ وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ ۖ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ ﴿٣٠﴾

 

“যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে, তারা কি ইহা অবলোকন করে না যে, আদিতে আকাশ মণ্ডলী ও ভূ-মণ্ডল পরস্পর সংযুক্ত ছিল। অতঃপর আমি উহাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৩০)

 

বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে বেলজিয়াম বিশ্বতত্ত্ববিদ আথেল্য মেতরের কথা হল এই যে,“একটি বিরাটাকায় আদিম অনু হতেই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। অণুটি কালক্রমে বিদীর্ণ হয়ে যায় এবং তার নানা অংশ নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে।”

 

(*********)

 

সম্প্রতি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জর্জ গ্যামো বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্ক নিম্ন লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন,

 

“আদিতে বিশ্বের কেন্দ্র সমজাতীয় আদিম বাষ্পের একটা জ্বলন্ত নরককুন্ড ছিল- ক্রমে ক্রমে এই মহাজাগতিক ভর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে এবং বিভিন্ন অংশের তাপমাত্রা ক্রমেই কমতে থাকে।”

 

উপরোক্ত দু জন খ্যাতনাম বিজ্ঞানীদের মতের সাথে উপরে বর্ণিত ঘোষনাটির আশ্চর্য সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

 

(ঙ) মহাবিশ্বের সৌরজগৎসহ বিভিন্ন জগতের সময়কাল ও দিবা-রাত্রি পরিমাণ যে এক নয়, বর্তমান বিজ্ঞানের অনেক আগে কোরআন এর ইঙ্গিত দিয়েছে,

 

يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ أَلْفَ سَنَةٍ مِّمَّا تَعُدُّونَ ﴿٥﴾

 

“সে মহান সত্ত্বাই আকাশ হতে ভূমণ্ডল পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়গুলোর তদারক করেন। অতঃপর এমন একদিনে সবকিছুই তার নিকট ফিরে আসবে, যে দিনটির সময়কাল হবে তোমাদের গণনা মোতাবেক হাজার বছর।” (সুরা সাজদা, আয়াত-৫)

 

কোরআন অবতীর্ণ হবার সময় কালের এ ব্যবধানটি বোধগম্য না হলেও বর্তমান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তা মানুষের কাছে সহজ ও বোধগম্য করে দিয়েছে।

 

এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তি হল নিম্নরূপ,

 

“প্রত্যেক জগতের একটি নিজস্বকাল আছে। জগতের উল্লেখ না করে কোন ঘটনার কালের উল্লেখের কোন অর্থই হয় না। প্রত্যেক জগতের গতিবেগ অনুসারে স্থান ও কালের পরিবর্তন ঘটে।”

 

বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন,লিংকন বেমিট।

 

সুতরাং আল্লাহ যদি কিয়ামতের দিন আমাদের হিসাব-নিকাশের ব্যবস্থা এমন একটি জগতে করেন, যে জগতকে আলোকিত করবে এমন একটি গ্রহ যে গ্রহকে কেন্দ্র করে উক্ত জগতটি তার অক্ষের উপরে আমাদের পৃথিবীর হাজার বছরে একবার মাত্র ঘুরে আসবে; আর এরই ফলে সেখানকার একদিনের পরিমাণ হবে আমাদের পৃথিবীর হাজার বছরের সমান, তাহলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?

 

(চ) পবিত্র কোরআনের অন্য এক স্থানে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নৈপুণ্যের বর্ণনা দান প্রসঙ্গে বলেন,

 

﴾ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا ۖ مَّا تَرَىٰ فِي خَلْقِ الرَّحْمَـٰنِ مِن تَفَاوُتٍ ۖ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَىٰ مِن فُطُورٍ ﴿٣﴾ ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ ﴿٤﴾

 

“সেই মহান সত্ত্বাই সাত আসমানকে স্তরে স্তরে তৈরী করেছেন। তুমি সে করুণাময়ের সৃষ্টিতে কোথাও কোন ত্রুটি দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফিরাও কোন ত্রুটি দেখতে পাচ্ছ কি? অতঃপর তুমি পুনঃ পুনঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ কর। তোমার দৃষ্টিশক্তি অবনমিত হয়ে ফিরে আসবে।” (অথচ তুমি কোথাও কোন ত্রুটি দেখতে পাবে না।) (সুরা মূলক, আয়াত ৩-৪)

 

এই বৈশিষ্ট্যময় বিশ্ব যে আল্লাহ অহেতুক খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেননি, সে সম্পর্কে কোরআন বলে,

 

وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَاعِبِينَ ﴿٣٨﴾ مَا خَلَقْنَاهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ ﴿٣٩﴾

 

“আমি আকাশ ও ভূমণ্ডল এবং তন্মধ্যস্থ যাবতীয় বস্তু খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। নিশ্চয় আমি উভয়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরী করেছি! কিন্তু অধিকাংশই লোকই তা অনুধাবন করে না।” (সুরা দোখান, আয়াত ৩৮-৩৯)

 

এবার এই নৈপূন্যময় বিশ্ব সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মত শুনুন,

 

আমি একটি সুসামঞ্জস্য ও সুশৃঙ্খল বিশ্বে বিশ্বাসী। অনুসন্ধানী মানুষ একদিন বাস্তব সত্যের সন্ধান পাবে ঐ বিশ্বাস আমি পোষণ করি। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনা যে, জগত নিয়ে সৃষ্টিকর্তা পাশা খেলছেন।” (বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন)।

 

(ছ) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, সে ভয়াবহ দিনে সূর্য ও চন্দ্রে কোন আলো থাকবে না এবং নক্ষত্রগুলিও তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে। আর আল্লাহ এক অভিনব নূর (আলো) দ্বারা সমগ্র হাশর ময়দানটি আলোকিত করে ফেলবেন। যেমন সুরায়ে কিয়ামায় উল্লেখ আছে,

 

 يَسْأَلُ أَيَّانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ ﴿٦﴾ فَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ ﴿٧﴾ وَخَسَفَ الْقَمَرُ ﴿٨﴾ وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ ﴿٩﴾

 

“এরা (রসূলেন কাছে) জিজ্ঞেস করছে যে, কিয়ামত কবে হবে? যেদিন দৃষ্টি শক্তি ঝলসে যাবে এবং চন্দ্রে কোন আলা থাকবে না। আর চন্দ্র, সূর্য একই অবস্থা প্রাপ্ত হবে।” (সুরা কিয়ামাহ, আয়াত ৬-৯)

 

কিয়ামতের বর্ণনা দান প্রসঙ্গে আল্লাহ পবিত্র কোরআনের অন্য এক স্থানে বলেছেন,

 

 إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ ﴿١﴾ وَإِذَا النُّجُومُ انكَدَرَتْ ﴿٢﴾ وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ ﴿٣﴾

 

“যেদিন সূর্য কোন আলো থাকবে না, নক্ষত্রগুলো স্থানচ্যুত হবে, আর পাহাড়-পর্বতগুলিও সরে যাবে।” (সুরা তাকবীর, আয়াত ১-৩)

 

কোরআন নাযিলের সময় যদিও উক্ত কথাগুলি কারো কারো কাছে অসম্ভব বলে মনে হত, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরা চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজির উপরোক্ত অবস্থা প্রাপ্তির কথাকে আর আদৌ অসম্ভব মনে করেন না। বরং তাদের মতামত তাকে সমর্থন করার পক্ষে। যেমন তারা বলেছেন,

 

“সূর্য ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে নিভে যাচ্ছে। তারকাদের অনেকেই এখন পোড়া কয়লা মাত্র। বিশ্বের সর্বত্রই তাপের মাত্রা কমে আসছে। পদার্থ বিকীর্ণ হয়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হচ্ছে এবং কর্মশক্তি মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে বিশ্ব এভাবে তাপ-মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অনেক কোটি বছর পরে বিশ্ব যখন এরূপ অবস্থায় পৌঁছবে, তখন প্রকৃতির সমস্ত প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।”

 

(বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন, পৃঃ নং ১২৩-১২৪)

 

“প্রকৃতির সমস্ত দৃশ্য এবং তথ্যাদি দ্বারা এই একমাত্র সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, অনমনীয় ও অপরিবর্তনীয়ভাবে বিশ্ব এক অন্ধকার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে।” (বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন পৃঃ নং ১২৭)

 

বিজ্ঞানীদের মতে প্রকৃতির সমস্ত প্রক্রিয়া যেদিন স্তব্ধ হয়ে যাবে সেদিন বিশ্ব ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

 

كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ ﴿٢٦﴾ وَيَبْقَىٰ وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ

 

“বিশ্বে যা কিছু আছে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তোমরা একমাত্র প্রতিপালকই অবশিষ্ট থাকবেন, যিনি মহীয়ান ও গরীয়ান।”

 

(সুরা আর-রহমান, আয়াত ২৬-২৭)

 

(জ) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উদ্ভিদ, তরুলতা ও গাছ-গাছড়া ইত্যাদিকে মানব ও জন্তু-জানোয়াররের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

وَالْأَرْضَ بَعْدَ ذَٰلِكَ دَحَاهَا ﴿٣٠﴾ أَخْرَجَ مِنْهَا مَاءَهَا وَمَرْعَاهَا ﴿٣١﴾ وَالْجِبَالَ أَرْسَاهَا ﴿٣٢﴾ مَتَاعًا لَّكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ ﴿٣٣﴾

 

“অতঃপর তিনি জমিনকে বিস্তার করে দিয়েছেন। আর তা হতে পানি ও তরুলতাদি নির্গত করেছেন এবং পাহাড়কে তিনিই সু-প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর তা (গাছ-গাছড়া) হল তোমাদের এবং তোমাদের জন্তু-জানোয়ারদের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ।” (সুরা আন নাজিয়াত, আয়াত নং ৩০-৩৩)

 

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

 

فَلْيَنظُرِ الْإِنسَانُ إِلَىٰ طَعَامِهِ ﴿٢٤﴾ أَنَّا صَبَبْنَا الْمَاءَ صَبًّا ﴿٢٥﴾ ثُمَّ شَقَقْنَا الْأَرْضَ شَقًّا ﴿٢٦﴾ فَأَنبَتْنَا فِيهَا حَبًّا ﴿٢٧﴾ وَعِنَبًا وَقَضْبًا ﴿٢٨﴾ وَزَيْتُونًا وَنَخْلًا ﴿٢٩﴾ وَحَدَائِقَ غُلْبًا ﴿٣٠﴾ وَفَاكِهَةً وَأَبًّا ﴿٣١﴾ مَّتَاعًا لَّكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ ﴿٣٢﴾ فَإِذَا جَاءَتِ الصَّاخَّةُ ﴿٣٣﴾ يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ ﴿٣٤﴾ وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ ﴿٣٥﴾ وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ ﴿٣٦﴾ لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ ﴿٣٧﴾ وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ مُّسْفِرَةٌ ﴿٣٨﴾ ضَاحِكَةٌ مُّسْتَبْشِرَةٌ ﴿٣٩﴾ وَوُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ ﴿٤٠﴾ تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ ﴿٤١﴾ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ ﴿٤٢﴾

 

মানুষের উচিৎ তার খাদ্য বস্তুর দিকে লক্ষ্য করা। এক অত্যাশ্চর্য পদ্ধতিতে আমি পানি বর্ষণ করেছি। অতঃপর অভিনব পদ্ধতিতে আমি জমিনকে বিদীর্ণ করে তা হতে নানা ধরনের শস্য, আঙ্গুর, শাক-সব্জি, জাইতুন, খেজুর, ঘন বৃক্ষরাজি পরিপূর্ণ বাগ-বাগিচা ফল-মূল, তৃণ-রাজি উৎপাদন করেছি। আর এসব হল তোমাদের ও তোমাদের গৃহপালিত পশুগুলির জন্য বিশেষ উপকারী।” (সূরা আবাসা, আয়াত ২৪-৩২)

 

বর্তমান বিজ্ঞানীদের উদ্ভিদ সম্পর্কে নানারূপ গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্রকৃতির মধ্যে মানুষের এবং জন্তু-জানোয়ারদের জন্য উদ্ভিদের চেয়ে পরম বন্ধু আর কিছুই নেই। কেননা উদ্ভিদ শুধু আমাদের খাদ্যই জোগায় না, বরং বায়ু হতে বিষাক্ত গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন তৈরী করে দেয়।

 

উদ্ভিদ শিকড়ের সাহায্যে মাটি হতে পানি শুষে পাতায় নিয়ে আসে এবং পাতা বায়ু হতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস শুষে নেয়। গাছের পাতায় রক্ষিত ক্লোরোফিল (যার কারণে পাতা সবুজ দেখায়) ও সূর্য কিরণের দ্বারা পাতার ভিতরেই এক ধরণের রান্নার কাজ চলে। ফলে তৈরী হয় শর্করা যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। আর বের হয়ে আসে অক্সিজেন যা না হলে আমরা সামান্য সময়ও বাঁচতে পারি না।

 

কাজেই উদ্ভিদ আমাদের জন্য মামুলী সম্পদ নয় বরং মহামূল্যবান সম্পদ। কোরআনে অসংখ্য বার আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর উদ্ভিদরূপ নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন।

 

(ঝ) উদ্ভিদ ও যাবতীয় ধাতব পদার্থের যে জীবনী শক্তি আছে, প্রখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুই নাকি তা সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন। অথচ বসু মহাশয়ের উক্ত আবিষ্কারের প্রায় তেরশত বছর পূর্ব পবিত্র কোরআন আমাদেরকে উদ্ভিদ, পাথর যাবতীয় ধাতব পদার্থ ইত্যাদির জীবনী শক্তি ও অনুভূতি শক্তির সন্ধান দিয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে কোরআন হতে কয়েকটি উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে,

 

﴿تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ ۚ وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ ۗ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا﴾

 

“সপ্ত আকাশ, ভূমণ্ডল ও তন্মধ্যস্থ সকল বস্তুই আল্লাহর গুণগান করে। আর এমন কোন বস্তু নেই যা তার গুণকীর্তন করে না, কিন্তু তোমরা তাদের এ গুণকীর্তন (তাসবীহ পাঠ) উপলব্ধি করতে পারো না। আর তিনি হলেন ধৈর্যশীল ও ক্ষমাকারী।” (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত-৪৪)

 

سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

 

“আকাশ ও ভূমণ্ডলস্থ সকলেই আল্লাহর গুণগানে মশগুল। আর তিনি হলেন মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।” (সুরা ছফ, আয়াত-১)

 

নিম্নের আয়াতটি বিশেষভাবে পাথরের জীবনী শক্তির ইঙ্গিত বহন করে,

 

﴿ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّن بَعْدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ۚ وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ﴾

 

“আর কোন কোন পাথর এমনও হয়ে থাকে যা হতে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়। কোন কোনটি ফেটে গিয়ে তা থেকে পানি নির্গত হয়। আবার কোন কোনটি আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়ে ভূতলে পতিত হয়। আর আল্লাহ তোমাদের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে মোটেই অনবহিত নহেন।”

 

(সুরা বাকারা, আয়াত-৭৪)

 

একদা এক অভিযানকালে হযরত মুহাম্মদ (স) যখন সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, কোন কোন সাহাবী হাতের অস্ত্রের আঘাতে পথিপাশর্স্থ গাছের ডাল-পালা কাটছেন। হুজুর (স) তাদেরকে নিষেধ করলেন, আর বললেন, “ খবরদার অযথা তোমরা গাছ-পালার উপরে আঘাত করবে না। কেননা তাদের প্রাণ আছে তোমাদের আঘাতে তারা কষ্ট পায় ও কাঁদে।”

 

অতিসম্প্রতি রুশ বিজ্ঞানী মানুষের সুখে ও দুঃখে নিকটবর্তী ফুলও যে প্রভাবান্বিত হয়, অর্থাৎ মানুষের সুখে ও আনন্দে নিকটবর্তী ফুলও আনন্দিত হয় এবং মানুষের দুঃখে বেদনা বোধ করে, এ তথ্যটি আবিষ্কার করেছেন।

 

মাত্র কিছুদিন পূর্বে আমেরিকার দুজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী পিটার টস্পকীন এবং ক্রিস্টোফার-বার্ত্ত কর্তৃক লিখিত (the crescent life of plan) নামক পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তারা প্রমাণ করেছেন যে, সব রকমের গাছ-গাছড়া এমনকি মূলা, গাজর, পিঁয়াজ ইত্যাদির শুধু অনুভূতি শক্তিই নেই বুদ্ধি এবং ইচ্ছা শক্তিও আছে।

 

এমনকি অন্য উদ্ভিদের সাথে যোগাযোগ করার ভাষাও আছে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদ্বয় তাদের পুস্তকে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ক্লেপব্যকস্টার, মর্সেল ভোগেল, কেন হার্মিমোট ও ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের মতামতও প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন।

 

শস্যের চারা কিভাবে সঙ্গীতে সাড়া দেয়, বীজ ও কুঁড়ি কিভাবে বৈদ্যুতিক আঘাতে জেগে ওঠে, এ সম্পর্কে কাজাকিস্তানের রুশ বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানের ফলাফলও উক্ত পুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

 

সাত: কোরআনের অভিনব হেফাযত ব্যবস্থা

 

স্মরণাতীত কাল হতে পয়গাম্বরদের উপরে যে সব কিতাব নাযিল হয়েছে তার অধিকাংশই এখন দুষ্প্রা্প্য । যে অল্প কয়েকখানা পাওয়া যায় তাও তার মূল ভাষায় নয়। আর মূল ভাষা হতে যখন কোন গ্রন্থকে অনুবাদ করা হয়, তখন তা অনুবাদ গ্রন্থ, আসল গ্রন্থ নয়। বিশেষ করে মহান আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের অনুবাদ। আর অনুবাদ গ্রন্থের ভাষা গ্রন্থের অনুবাদকের, আল্লাহর নয়।

 

তাছাড়া ঐ সমস্ত গ্রন্থ যে পরিবর্তন মুক্ত নয় তা তাদের বিজ্ঞ অনুসারীদের অনেকেই মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেছেন। কেননা সে যুগে না ছিল কাগজ, আর না ছিল আজকের মত ছাপাখানা। ফলে বৃক্ষপত্র, কাষ্ঠফলক, সমৃণ পাথর-প্লেট অথবা পাতলা চামড়ায় উহা লিখে রাখা হত এবং উহার অতিরিক্ত কপি করা অসম্ভব বিধায় পাদরী পুরোহিতদের কাছে উহার এক আধ কপি তাদের কেন্দ্রীয় উপাসনালয়ে রক্ষিত হত। আর যখনই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোন জাতি তাদের রাজধানী কিংবা নগর আক্রমণ করত, তখন তাদের ধর্মগ্রন্থ ও উপাসনালয়ই হত বিজয়ী জাতির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল। ইসলামের অভ্যুত্থানের পূর্বে এভাবে বহুবার প্রতিদ্বন্দ্বি শক্তি কর্তৃক ইহুদী ও খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অধুনা একখানা পূর্ণাঙ্গ তাওরাত কিংবা ইঞ্জিল তার মূল ভাষায় পাওয়া সাধারণভাবে অসম্ভব।

 

পবিত্র তাওরাত গ্রন্থ যা হযরত মূসার (আ) উপরে অবতীর্ণ হয়েছিল, সেটা কয়েকবারেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে খৃঃ পূঃ ৫৮৬ সনে ব্যাবিলনের অত্যাচারী শাসক বখতে নাছার (নবুকারদোযাহ) জেরুজালেম আক্রমণ করে শহরটিকে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় এবং ইসরাইলী আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে যায়। বখতে নাছার হযরত সুলায়মানের (আ) তৈরী পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ এবং সেখানে রক্ষিত তাওরাত গ্রন্থও ধ্বংস করে দেয়।

 

অতঃপর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে খৃ: পৃ: ৫৩৮ সনে পারস্য সম্রাট মহামতি সাইরাছ ব্যাবিলনের বাদশাহকে পরাজিত করে ইহুদীদের মুক্ত করে দেন এবং ফিলিস্তিনে তাদের পূনর্বাসন, নতুন করে জেরুজালেম নগরী ও বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ পুনঃনির্মাণে সহায়তা করেন। তৎপর ইহুদী আলেমগণ তাওরাতের বিক্ষিপ্ত অংশ যা তাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল এবং যা তাদের মুখস্ত ছিল তা হতে তাওরাত নতুন করে লিপিবদ্ধ করেন। এ সম্পর্কে (the story of bible) নামক গ্রন্থের প্রসিদ্ধ ইউরোপীয়ান লেখকের মত হল নিম্নরূপ:

 

That the original manuscripts were destroyed with Solomon\'s temple and the Ezra made a fresh set from such copies as could be found. (The Story of Bible)

 

“প্ৰকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, তাওরাতের মূল লিপি, হযরত সুলায়মানের পবিত্র মসজিদের সাথেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অত:পর ইজরা বা হযরত ওজায়ের (আ:) যা কিছু সংগ্ৰহ করতে পেরেছিলেন তা দ্বারা নতুন একটি কপি তৈরী করলেন ।\"

 

রোমান ঐতিহাসিক প্রিাণীর মতে জেরোস্তারের উপরে নাযিলকৃত কিতাব জিন্দাবেস্তা মোট বার হাজার গরুর চামড়ায় সোনালী কালিতে লিপিবদ্ধ করে পারসিয়ানদের তদানীন্তীন রাজধানী পার্সেপলিসের বিখ্যাত লাইব্রেরীতে রাখা হয়েছিল। অত:পর গ্ৰীক সম্রাট আলেকজান্ডার যখন উক্ত রাজধানী দখল করে পুড়িয়ে দেয়, তখন লাইব্রেরীটি এবং তাতে রক্ষিত পবিত্র জিন্দাবেস্তা কিতাবখানিও পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। বাইবেল নিউটেস্টামেন্ট (ইঞ্জিল) সম্পর্কে লেখক তার অনুসন্ধানের ফল ব্যক্ত করে বলেন,

 

\"All the New Testment is found, with documents in a manuscript calle the \'Sainaitic Codex\' preserved at Leningrad probably written in Egypt in the 4th century.\" (The Story of Bible P. no. 107)

 

\"সমস্ত নিউটেস্টামেন্টই (ইঞ্জিল) অন্যান্য ডকুমেন্টসহ যে মূল লিপিতে লেনিনগ্রাডে রক্ষিত আছে সেটাকে ‘ছায়ানাইটিক লিপি\' বলা হয় । এটা যথাসম্ভব খৃস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে মিসরে লিখিত হয়।”

 

সুতরাং হযরত ঈসার (আ:) মৃত্যুর চারশত বছর পর যদি তাঁর উপর আছে তা ভাববার বিষয় বটে?

 

আবার কোন কোন ঐশীবাণী (ওয়াহী) পুরুষাক্রুমে ধর্মযাজকগণ তাদের শিষ্যদের তালিম দিতেন। অতঃপর সেটা যখন কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিত, কিংবা ব্যাপকভাবে তাতে বাইরের আখ্যান ইত্যাদি যুক্ত হত, তখনই তাদের কোন জ্ঞানী ব্যক্তি সেটাকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে নিতেন। ফলে উহা হতে যেমন কোন অংশ বাদ পড়ত, তেমনি অনেক বাইরের কথাও তাতে শামিল হয়ে যেত।

 

হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ বৈদিক যুগের অনেক পরে মহাভারতীয় যুগে (কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়) বেদব্যাস মুনি কর্তৃক সঙ্কলিত হয়। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতে বেদ যীশু খৃস্টের জন্মের মাত্র সাত কি আটশত বছর পূর্বের রচনা। অনুরূপভাবে বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটককে তৃতীয় পিটকখানা বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় দুই শত বছর পর মহামতি অশোকের নেতৃত্বে লিপিবদ্ধ করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় পিটকদ্বয়ও বুদ্ধের মৃত্যুর পরে সংকলিত। উপরন্তু কোরআন পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থগুলো যে সব ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল, দুনিয়ার কোথাও আর সে সব ভাষার প্রচলন নেই। জগতের অধিকাংশ পয়গম্বরই ছিলেন বনি ইসরাইল কওমভুক্ত, আর তাদের ভাষা ছিল ইবরানি বা হিব্রু। এ সকল ইবরানী পয়গম্বরদের উপরে নাযিলকৃত সমস্ত কিতাবের ভাষাই ছিল ইবরানি বা হিব্রু। এ সকল ইবরানী পয়গম্বরদের উপরে নাযিলকৃত সমস্ত কিতাবের ভাষাই ছিল হিব্রু। কিন্তু ‍দুনিয়ার কোথাও আজ আর হিব্রু ভাষার তেমন প্রচলন নেই।

 

অনুরূপভাবে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ ও গীতার ভাষা সংস্কৃতেরও যেমন কোন সন্ধান পাওয়া যায় না, তেমনি বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ পিটকের ভাষা পালিতেও এখন আর কেউ কথা বলে না। এসব এখন মৃত ভাষার শামিল।

 

কিন্তু একমাত্র কোরআনের ব্যাপারই এসব থেকে স্বতন্ত্র। যে মূল ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সেই মূল ভাষায়ই তার কোটি কোটি কপি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন লোকের কাছে মওজুদ আছে। কোরআন যে শুধু গ্রন্থাবস্থাই রক্ষিত আছে তাই নয়, বরং কোরআন নাযিলের পর থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে অগণিত লোক তা পুরাপুরি মুখস্থ করে রেখেছেন।

 

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোরআন অল্প অল্প করে তেইশ বছর ধরে অবতীর্ণ হয়েছে। যখনই কোরআনের কোন অংশ হুজুর (স) এর উপরে অবতীর্ণ হত, হুজুর (স) সাথে সাথেই যেমন সেটা কাতিব (ওয়াহী লিপিবদ্ধকারী) দ্বারা লিপিবদ্ধ করিয়ে নিতেন, তেমনি বহু মুসলমান সঙ্গে সঙ্গেই ঐ অংশটুকু মুখস্থ করে ফেলতেন। তেইশ বছর পর যখন কোরআন নাযিল হওয়া সমাপ্ত হলো, তখন একদিকে যেমন কোরআন পুরাপুরি লিপিবদ্ধ হয়ে রক্ষিত হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি অসংখ্য মুসলমান সেটাকে পূর্ণরূপে মুখস্থ করে তার হেফাযতের চমৎকার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। অতঃপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উক্ত হেফাযত ব্যবস্থা যথা নিয়মেই চলে এসছে।

 

কেউ যদি উহা পরীক্ষা করে দেখতে চায়, তাহলে তিনি যেন পূর্ব এশিয়ার কোন এক দেশ হতে একখানা কোরআন সংগ্রহ করেন। অতঃপর উত্তর আফ্রিকার কোন একজন হাফেযের মুখে তা পাঠ করিয়ে শুনে নেন। শব্দ ও অক্ষর তো দূরের কথা একটা জের যবরেরও কোন অমিল পাবে না।

 

তাছাড়াও যে মূল আরবী ভাষায় কোরআন মহানবীর প্রতি নাযিল হয়েছে, আজ চৌদ্দশত বছরের ব্যবধানেও কোরআনের সে ভাষা না পুরান হয়েছে, না পরিত্যক্ত।

 

[আরবী ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করতে গিয়ে প্রখ্যাত আমেরিকান পণ্ডিত জর্জ সার্টন বলেন,

 

“মুসলিম তামুদ্দুন ছিল বিচিত্র প্রকৃতির। মুসলমানেরা ধর্ম ও ভাষারূপ দুটি শক্তিশালী বন্ধন দ্বারা নিজেদেরকে ঐক্যসূত্রে গেথে নিয়েছিল। মুসলমানদের প্রধান কর্তব্যগুলোর ভিতরে একটি হল মূল আরবী ভাষার কোরআন পাঠ করা। এ চমৎকার ধর্মীয় বিধানকে ধন্যবাদ.....। আজকেও যেসব ভাষা পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে, আরবী তাদের অন্যতম। (the life of science by George sarton) লেখক তাঁর পুস্তকের অন্য এক জায়গায় বলেছেন’ “অষ্টম শতকের মধ্য ভাগ হতে একাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত আরবী ভাষা-ভাষীরা এগিয়ে চলছিল মানব জাতির পুরো ভাগে। তাদেরকে ধন্যবাদ, আরবী ভাষা শুধু কোরআনের পবিত্র ভাষা বা আল্লাহর বাণীর বহনরূপেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং তা বিশ্বের সামনে নিজেকে তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক ভাষারূপে।” মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে আরবী রচনাবলী অসীম গুরুত্বের কথা স্বীকার করে লেখক গ্রন্থের অন্য এক জায়গায় লিখেছেন,

 

“ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে যারা অগ্রগামী ছিলেন তারা বুঝতে পারলেন যে, আরবী রচনাবলী শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ তাই নয়, সেগুলো অপরিহার্যও বটে। কারণ তারই মধ্যে সঞ্চিত ছিল জ্ঞানের প্রচুর সম্পদ। এ কথা বললে মোটেই অতিরিক্ত হবে না, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত খৃস্টান পণ্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল আরবী গ্রন্থের ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ।”( the life of science by George sarton)

 

 বরং দুনিয়ার বেশ কয়েক কোটি লোকই উক্ত ভাষায় কথাবার্তা বলে। কোরআনের পাঠক মাত্রই তার এ অভিনব হেফাযত ব্যবস্থায় মুগ্ধ না হয়ে পারবে না।

 

আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ পয়গম্বরের প্রতি নাযিলকৃত তাঁর এ সর্বশেষ কিতাবখানার এ অভিনব হেফাযত ব্যবস্থা যে আল্লাহর নিজেরই পরিকল্পিত সে কথা আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন। এ ঘোষণাটি একবার আমরা দেখতে পাই ‘সুরা কিয়ামাহ’ নামক প্রাথমিক স্তরের একটি মক্কী সুরাতে। আর একবার আমরা দেখতে পাই ‘সুরায়ে হিজর’ নামক অপর একটি মক্কী সুরাতে।

 

মক্কা শরীফের প্রথম যখন জিরারাইল (আ) হুজুরের (স) কাছে উপস্থিত হয়ে ওয়াহী পাঠ করে শুনাতেন, তখন হুজুর (স) জিবরাইলের (আ) সাথে ব্যস্ততার সাথে তা পাঠ করতে থাকতেন, যাতে ওয়াহীর কোন একটা অংশও বাদ না পড়ে। ফলে মহান আল্লাহ নিম্নলিখিত মর্মে হুজুরকে আশ্বস্ত করলেন,

 

﴿لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ﴾

 

﴿إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ﴾

 

﴿فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ﴾

 

﴿ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ﴾

 

“হে রাসূল, দ্রুত কোরআন আয়ত্ব করার জন্যে আপনি আপনার জিহ্বা সঞ্চালন করবেন না। কোরআন পূর্নাঙ্গ করা এবং তা পাঠ করিয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। সুতরাং আমি যখন (জিবরাইলের জবানে) সেটা পাঠ করি, তখন আপনি তা অনুসরণ করুন। অতঃপর তার ব্যাখ্যা দানও আমার জিম্মাদারী।” (সুরা কিয়ামাহ, আয়াত ১৬-১৯)

 

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

 

﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾

 

“নিশ্চয় কোরআন আমিই নাযিল করেছি। আর অবশ্যই তার হেফাযতের দায়িত্ব আমারই।” (সুরা হিজর, আয়াত-৯)

 

সুরা তায়াহায়ও অনুরূপ ধরনের একটি উক্তি দেখা যায়।

 

وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِن قَبْلِ أَن يُقْضَىٰ إِلَيْكَ وَحْيُهُ ۖ وَقُل رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا

 

“কোরআন যখন নাযিল হয়, তখন তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কোরআনের (হেফাযতের) জন্য আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। আর আপনি বলুন, হে আল্লাহ! তুমি আমার ইলম বাড়িয়ে দাও”। (সুরা তায়াহা, আয়াত-১১৪ )

 

কোরআনের এই অত্যাশ্চর্য হেফাযতের ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে মন আপন হতে সাক্ষ্য দিবে যে, এ হেফাযত ব্যবস্থার মূলে তাঁর হাতই ক্রিয়াশীল, ‍যিনি উহা নাযিল করেছেন।

 

আট: কোরআনের ভাষা ও ভাবে আশ্চর্য সাঞ্জস্য

 

দীর্ঘ তেইশ বছর কালব্যাপী অল্প অল্প নাযিল হওয়ার পরেও কোরআনের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত ভাষা, সাহিত্যিক মান, অর্থ ও ভাবে যে আশ্চর্য ধরনের সামঞ্জস্য উহাও প্রমাণ করে যে, কোরআন মানব রচিত কোন গ্রন্হ নয়। কেননা কোন মানুষের পক্ষে উক্ত বিষয়সমূহের ভিতরে এরূপ ধারাবাহিকতা ও সামঞ্জস্য রক্ষা করা দীর্ঘকালব্যাপী সম্ভব ছিল না।

 

 

 

কোরআন রসূলের সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেযা

 

মহান আল্লাহ ‍দুনিয়ার মানব জাতির হেদায়াতের উদ্দেশ্যে যে সব নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদেরকে নবূয়ত ও রিসালাতের প্রমাণ স্বরূপ মোযেযাও দান করেছেন। ‘মোজেযা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল অপরাগ ও ক্ষমতাহীন করে দেয়া, মোকাবেলায় কাবু করে ফেলা ইত্যাদি। আর পারিভাষিক অর্থ হল নবী-রাসূলদের নিজস্ব দাবীর সমর্থনে এমন অলৌকিক ও আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়ে দেখানো, যা পয়গাম্বর ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে ঘটানো আদৌ সম্ভব নয়।

 

সাধারণ মোজেযার বাইরেও আল্লাহ তার কোন কোন রসূলকে বিশেষ মোজেযাও দান করেছিলেন। যেমন মূসার (আ) আসা (লাঠি) ও ইয়াদে বায়যা (উজ্জ্বল হাত)। অর্থাৎ হযরত মূসা (আ) যখন তার লাঠিখানা মাটিতে নিক্ষেপ করতেন, তখন তা এক ভয়াবহ প্রকাণ্ড অজগরের রূপ ধারণ করে মাটিতে ছুটাছুটি করত। আবার যখন তিনি সেটি ধারণ করতেন লাঠিতে রূপান্তরিত হত। অনরূভাবে তিনি তার ডান হাত বগলে দাবিয়ে যখন বের করতেন, তখন উক্ত হাত থেকে এক বিশেষ ধরণের আলো-রশ্নি বের হয়ে চারদিক আলোকিত করে ফেলত। ইহাই । ছিল মূসার (আ) মোজেযা ‘আসা ও ইয়াদে বায়যা উপরে বর্ণিত দুটি বিশেষ মোজেযা ছাড়াও হযরত মূসার (আ) দীর্ঘ জীবনে আরও বহু বিচিত্র ও অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। তন্মেধ্যে লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানিকে বিভক্ত করে ইসরাইলদের জন্য রাস্তা তৈরী করে দেয়া, পাথর খণ্ডের মধ্য হতে বনি ইসরাইলে বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা, আসমান হতে মান্না সালওয়া (আসমানী খাদ্য) নাযিল হওয়া প্রভৃতি অন্যতম।

 

হযরত ঈসার (আ) জীবনেও এ ধরণের বহু অলৌকিক ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায়, তবে তার বিশেষ মোজেযা ছিল দূরারোগ্য ব্যাধি আরোগ্য করা মৃতকে জীবিত করে কথা বলিয়ে নেয়া।

 

আল্লাহ তার শেষ পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদের (স) দ্বারাও বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে অবিশ্বাসীদের সামনে তার নবুয়তের সাক্ষ্য পেশ করেছিলেন। তবে তাঁকে যে সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেযাটি দান করা হয়েছিল সেটা আরবী ভাষায় নাযিলকৃত আল-কোরআন।

 

এমনিতেই দুনিয়ার সর্ব প্রধান ভাষাগুলির মধ্যে আরবী ভাষা ছিল এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তদুপরি রসূলের আবির্ভাবকালে কাব্য ও সাহিত্য চর্চার দিক থেকে আরবরা ছিল শীর্ষস্থানীয়। তারা তাদের জাতীয় আনন্দ অনুষ্ঠানাদিতে প্যান্ডেল ও মঞ্চ সাজিয়ে কাব্য-কলা ও সাহিত্য প্রতিভার প্রদর্শনী করত। উন্নত ও মার্জিত ভাষার অধিকারী এহেন একটি জাতির নিকটে আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে একজন নিরেট নিরক্ষর লোকের কাছে এমন উচ্চাংগের কালাম নাযিল করা শুরু করলেন যার ভাষা ও ভাবের সুউচ্চ মান দর্শনে সমস্ত আরব হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। ভাষার দিক থেকে কোরআনের মোকাবিলা করা যেমন আবরদের জন্য অসম্ভব ছিল, তেমনি ভাব ও বিষয়াবলীর দিকে দিয়েও কোরআনের অনরূপ কালাম তৈরী করা তাদের জন্য সম্ভব ছিল না। কোরআন বার বার তার বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ করেছে যে, যদি মুহম্মদের মুখনিঃসৃত কোরআন সম্পর্কে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যে তা আল্লাহর কালাম নয় বরং মুহাম্মাদের তৈরী, তাহলে কোরআনের অনুরূপ ছোট একটি সূরা অন্তত: তোমরা তৈরী করে নিয়ে এসো।

 

কোরআনের এ চ্যালেঞ্জ তার অন্তর্নিহিত সুষমারাজী, দার্শনিক বিষয়মসমূহ ও জটিল বিধানবলী ইত্যাদির ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। যদি তা হত তাহলে হয়ত আরবরা বলতে পারতো আমরা তোর আর দার্শনিক নই, নীতি-শাস্ত্রও আমরা জানি না, আর জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েই বা আমাদের মাথা ঘামাবার সময় কোথায়। কিন্তু শুধু তাতো নয়, কোরআন ভাবের শ্রেষ্ঠত্বের সাথে সাথে তার ভাষার মানের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করে আরবসহ সারা বিশ্বকে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ দান করেছে যে কোরআনের অনুরূপ একটি ছোট্ট সুরা অন্ততঃ তৈরী করে নিয়ে এসো। আরবী ভাষার মহাপণ্ডিত ও দিকপালরা যেভাবে ভাষাগত দিক দিয়ে কোরআনের কোন মোকাবিলা করতে পারেনি। তেমনি আরবসহ রোম-পারস্যের নীতি শাস্ত্র বিশেষজ্ঞরাও ভাবের দিক দিয়ে কোরআনের মত কোন গ্রন্থ অথবা তার অংশ বিশেষের ন্যায়ও কিছু তৈরী করতে পারেনি। ফলে ভাষা ও ভাব উভয় দিক হতেই কোরআন মহানবীর এক অত্যাশ্চর্য মোজেযারূপে কিয়ামত পর্যন্ত বিরাজ করবে।

 

 

 

কোরআনের গ্রন্থবদ্বকরণ ও শ্রেণীবিন্যাস ব্যবস্থা

 

কোরআন অবতীর্ণের সময় কোরআনের যে অংশই যখন অবতীর্ণ হত, হুজুর (স) ওয়াহী লিপিবদ্ধকারী সাহাবাদের দ্বারা একদিকে যেমন তা লিপিবদ্ধ করিয়ে নিতেন, অন্যদিকে অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম সেটা মুখস্থ করে ফেলতেন। হুজুরের তিরোধান মুহুর্তে পূর্ণাঙ্গ কোরআন যেমন অসংখ্য সাহাবায়ে কেরামের মুখস্থ ছিল, তেমনি বেশ কয়েকজন সাহাবাদের (রা) নিকটে লিপিবদ্ধ আকারেও মওজুদ ছিল। কোরআনের কোন অংশ অবতীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাহাবাদের অনেকেই পাতলা উষ্ট্র চর্মে, মসৃণ পাথর টুকরায়, বৃক্ষপত্রে কিংবা বাকলে লিখে নিতেন। কাতিবে ওয়াহী হযরত জায়েদ ইবনে সাবেতের একটি বর্ণনা হাদীসের কিতাবে দেখা যায়। তিনি বলেছেন,

 

نولف القرآن من الرقاع

 

“আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের কাছে বসে চর্ম টুকরায় কোরআন শরীফ লিখে নিতাম।” (মোসতাদরিক-ইতকান)

 

বোখারীর যে অংশে সাহাবাদের মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের একটি বর্ণনার উল্লেখ আছে যাতে তিনি বলেছেন যে, আমি নবী করীমকে (স) এ কথা বলেতে শুনেছি, “তোমরা কোরআন চার ব্যক্তির কাছ থেকে শিখে নাও। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, সালেম, উবাই বিন কায়াব ও মায়ায ইবনে যাবাল।” (বুখারী)

 

বোখারীর অন্যত্র হযরত আনাসের একটি বর্ণনায় তিনি উল্লেখ করেছেন,

 

“নবী করীমের (স) জামানায় যে চারজন সাহাবী (বিশেষভাবে) কোরআনকে সংগ্রহ করেছিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন আনছার। উবাই-বিন কায়াব, মায়ায-জাবাল, আবু ছায়েদ এবং যায়েদ-ইবনে সাবেত (রা)।” (বুখারী)

 

মোহাদ্দিসীনরা উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এর অর্থ হল যদিও অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম কোরআন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু বিশেষ ভাবে উপরোক্ত চারজন সাহাবী কোরআনের হেফয, তেলাওয়াত, সংরক্ষণ ও সংগ্রহ ইত্যাদির ব্যাপারে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

 

এভাবে তিরোধানের কেবল পরপরই হযরত আবু বককরের খিলাফতের প্রথম ‍দিকে ইয়ামামার যুদ্ধে যখন কয়েক শত হাফেজ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন, তখন হযরত উমর (র) খলিফাতুর-রসূল হযরত আবু বককরের নিকটে এই আরজী নিয়ে হাজির হলেন যে, এখনই কোরআনের সমস্ত অংশগুলিকে ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে একখানা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হোক। নতুবা ব্যাপকভাবে হাফেজে কোরআনের ‍দুনিয়া থেকে উঠে যাওয়ার কারণে হয়তবা কোরআনের কোন অংশ আমরা হারিয়ে ফেলতে পারি। হযরত আবু বকর প্রথমে কিছু ইতস্তত করে পরে হযরত উমরের প্রস্তাবকে অনুমোদন দিলেন এবং কাতিবে ওয়াহী হযরত জায়েদ ইবনে সাবেতকে এ পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত করলেন।

 

ইমাম বোখারী তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ বোখারী শরীফে “কোরআনের গুরুত্ব ও মর্যাদা” অংশে হযরত জায়েদ ইবনে সাবিতের মাধ্যমে নিম্নরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন,

 

“ইয়ামামার যুদ্ধের পর পরই আমাকে হযরত আবু বককর (রা) ডেকে পাঠালেন। আমি উপস্থিত হয়ে হযরত উমরকেও তাঁর পার্শ্বে উপবিষ্ট দেখলাম। অতঃপর হযরত আবু বককর (রা) আমাকে লক্ষ্য করে বললেন,

 

‘দেখ এই উমর (রা) আমার কাছে এসেছে, সে বলে ইয়ামামার যুদ্ধে অসংখ্য হাফেজে কোরআন শাহাদাত বরণ করেছেন। আর আমার আশংকা হচ্ছে; অন্যান্য যুদ্ধেও ‍যদি এইভাবে হাফেজে কোরআন শাহাদাত বরণ করহে থাকেন, তাহলে হয়তো আমরা কোরআনের কোন কোন অংশ হারিয়ে ফেলব। সুতরাং আমার অভিমত আপনি কোরআনকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার হুকুম ‍দিন’ আমি উমরকে জওয়াবে বললাম, যে কার রসূল (স) করেননি তা আমি কি করে করতে পারি? অতঃপর উমর আল্লাহর শপথ করে বললেন যে, অবশ্য কাজটি অত্যন্ত উত্তম ও প্রয়োজনীয়।’ উমরের (রাঃ) এই সব তর্কাতর্কী ও বাদানুবাদের মাধ্যমে আমার অন্তরেও আল্লাহ উক্ত কাজের গুরুত্বের অনুভূতি দান করলেন। আমিও উমরের সাথে একমত হয়েছি।”

 

বর্ণনাকারী হযরত জায়েদ ইবনে সাবিত আরও বলেন যে, অতঃপর হযরত আবু বককর (রা) আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

 

“তুমি যুবক ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কারো কোনরূপ অভিযোগও নেই। উপরন্তু রসূলের সময় তুমি ওয়াহী লিপিবদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত ছিলে। সুতরাং তুমিই পূর্ণাঙ্গ কোরআনকে একখানা গ্রন্থাকারে সাজিয়ে লিপিবদ্ধ কর।” (বোখারী ফাজায়েলুল কোরআন)

 

অতঃপর হযরত জায়েদ (রা) সাহাবায়ে কিরামের কাছে হতে এবং হুজুরের নিজের ঘরে রক্ষিত লিখিত অংশগুলিকে সংগ্রহ করে পরস্পর সাজিয়ে হাফেজ সাহাবাদের তেলাওয়াতের সাথে মিলিয়ে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে ফেললেন।

 

হারেস মোহাসেবী স্বীয় গ্রন্থ “ফাহমুস সনানে” বর্ণনা করেছেন,

 

“কোরআন লিপিবদ্ধ করা কোন অভিনব কাজ ছিল না। স্বয়ং নবী করীমই (স) কোরআন লিপিবদ্ধ করতেন। তবে উহা বিভিন্ন খন্ডাকারে ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক উহার সবগুলোকে একত্র করে গ্রন্তাকারে লিপিবদ্ধ করা হুকুম দিয়েছিলেন। এ কাজটি ছিল এ ধরনের যেমন কোরআন লিপিবদ্ধকারে কতগুলি বিক্ষিপ্ত পৃষ্ঠায় রসূলের (স) ঘরে মওজুদ ছিল। অতঃপর কোন একজন সংগ্রহকারী উহাকে সাজিয়ে সুতা দিয়ে বেঁধে ‍দিলেন যাতে কোন অংশ হারিয়ে যেতে না পারে।”

 

আচ্ছাকাফাতুল ইসলামীয়া। (আল্লামা রাগেব তাব্বাখ)।

 

হযরত জায়েদের সংগ্রহীত ও লিখিত মাছহাফখানা প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের জীবদ্দশায় আমানত হিসেবে তাঁর কাছেই রক্ষিত ছিল এবং প্রয়োজনানুসারে অন্যান্যরা সেটা হতেই কপি করে উমরের নিকট তা সমর্পন করা হয়। হযরত উমরের শাহাদাতের পরে উক্ত মাছহাফ উম্মুল মুমেনীন হযরত হাফসার হেফাযতে দেয়া হয়।

 

কোরআনের পঠন পদ্ধতির সংস্কার

 

একই ভাষা-ভাষীদের সমগ্র এলাকার ভাষা এক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বোল-চাল ও উচ্চারণ ইত্যাদিতে কিছু ব্যবধান ও ব্যতিক্রম অবশ্যই হয়ে থাকে। যেমন নদীয়া ও কুমিল্লার ভাষায় বেশ পার্থক্য দেখা যায়। যেমন দেখা যায়- খুলনা ও চিটাগাংয়ের ভাষায়। অথচ উভয় জেলার ভাষায় বাংলা।

 

অনুরূপভাবে গোটা আরব দেশের ভাষা আরবী হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন এলাকা ও গোত্রের ভাষা, উহার উচ্চারণ, বাচন-ভঙ্গী ও প্রয়োগে বেশ তারতম্য পরিলক্ষিত হত। হুজুর কোরয়শী বিধায় কোরআন শরীফ ‍যদিও কোরায়শী আরবীতে অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু অন্যান্য এলাকার আরবদেরকেও তাদের আঞ্চলিক আরবীতে উহা পাঠ করার ও লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কেননা ইহাতে কোরআনের মূল অর্থ কিংবা ভাবে কোন পরিবর্তন দেখা দিত না। কিন্তু ইসলাম যখন আরবের সীমানা অতিক্রম করে আযমেও প্রসার লাভ করল, তখন পঠন পদ্ধতি ও উচ্চারণের এ ব্যবধান অনারবদের ভিতরে বিশেষ জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। বিষয়টির দিকে তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমানের (রা) দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ইহার গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুধাবন করলেন। অতঃপর তিনি নিম্নে বর্ণিত উপায়ে উদ্ভুত সমস্যার সমাধান করে ফেললেন।

 

প্রথমত: তিনি কোরায়েশদের ভাষায় লিখিত ও রক্ষিত হযরত হাফসার মাছহাফখানা আনিয়ে উহার অনেকগুলো কপি তৈরী করালেন। অতঃপর উহার এক এক খন্ড মুসলিম সাম্রাজ্যের এক এক এলাকায় প্রেরণ করে উহা হতে সকলকে কপি করতে আদেশ দিলেন। আর অ-কোরায়েশদের ভাষায় লিখিত মাছহাবগুলিকে একেবারে নষ্ট করে দিলেন। ফলে বাচন-ভঙ্গি ও উচ্চারণের ব্যবধানটুকুও আর অবশিষ্ট থাকল না।

 

এ সম্পর্কে ইমাম বুখারী, বুখারী শরীফের ‘ফাজায়েলুল কোরআন’ অংশে হযরত আনাসের মাধ্যমে নিম্নলিখিত মর্মে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, “একদা হযরত হোযায়ফা-বিন আর ইয়ামান হযরত ওসমানের (রা) খেদমতে উপস্থিত হলেন। ইতিপূর্বে তিনি কেবল আরমিনিয়া বিজয়ে সামী মোজাহিদের সঙ্গে এবং আজারবাইজানের যুদ্ধে ইরাকী মোজাহিদদের সাথে অংশগ্রহণ করে এসেছিলেন, সেখানে তিনি সীমা ও ইরাকী মুসলমানদের কোরআন পাঠ পদ্ধতির বিরোধ দেখে সংকিত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি যখন তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের খেদমতে হাজির হলেন, তখন তিনি খলিফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমিরুল মোমেনীন, ইহুদী নাছারাদের ন্যায় আল্লাহর কিতাবে বিরোধ করারা পূর্বে আপনি এ উম্মতের কল্যাণের জন্য একটা কিছু করুন।’ এ কথা শুনে হযরত উসমান (রা) উম্মুল মুমেনীন হাফসাকে অনুরোধ করে পাঠালেন যে, হযরত আবু বকরের (রা) সংগ্রহীত গ্রন্থখানা যেন তাকে পাঠান হয়। তিনি উহা নকল করিয়ে আসল কপি আবার তাকে ফেরত দিবেন। অতঃপর হাফসা (রা) হযরত উসমানকে (রা) উক্ত পবিত্র গ্রন্থখানা দিলেন এবং উসমান (রা), হযরত জায়েদ বিন সাবেত, আব্দুল্লাহ বিন জোবায়ের, সাইয়েদ বিন আছ ও আব্দুর রহমান বিন হারিসকে (রা) তা হতে নকল করার কাজ শুরু করালেন। হযরত উসমান (রা) (হযরত জায়েদ বিন সাবেত ব্যতীত) তিনজন কোরায়শী সাহাবীদের বললেন, যদি তোমাদের সাথে জায়েদ বিন সাবেতের কোন অংশ পঠন পদ্ধতির ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে উহা কোরায়েশদের ভাষায় লিখবে। কেননা কোরআন কোরায়েশদের ভাষায়ই নাযিল হয়েছে।”

 

উল্লেখিত সাহাবাগণ হযরত উসমানের আদেশ মোতাবেক যখন পূর্ণ গ্রন্থখানার কপি তৈরী করে ফেললেন, তখন হযরত উসমান (রা) মূল কিতাবখানা হযরত হাফসার (রা) কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং নকলকৃত মাছহাফের এক একখানা সাম্রাজ্যের এক এক এলাকায় পাঠিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলেন যে, তাঁর প্রেরিত মাছহাফ ব্যতীত অন্যান্য মাছহাফ যেখানে আছে উহা যেন নষ্ট করে ফেলা হয়। (বুখারী-ফাজায়েলুল কোরআন)

 

“হযরত উসমানের নকলকৃত মূল কোরআন শরীফের কপি রুশ, মিসর, সিরিয়াসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আজও রক্ষিত আছে। আমাদের নিকটে বর্তমান যে কোরআন শরীফ মওজুদ রয়েছে উহাও সেই মূল সিদ্দীকী গ্রন্থের অনুরূপ যা হতে হযরত উসমান (রা) নকল করিয়ে সরকারী ব্যবস্থাপনায় রাজ্যের বিভিন্ন অংশে প্রেরণ করেছিলেন।”

 

গ্রন্থ সংগ্রহ ও সংরক্ষনের ব্যাপারে এর চেয়ে অধিক ত্রুটিমুক্ত, উন্নতর ও বিজ্ঞান সম্মত পন্থা আর কিছু কি হতে পারে?

 

কোরআনের যে বর্তমান শ্রেণীবিন্যাস ও তরতিবও কোন পরবর্তী মানুষের দেয়া নয়। বরং হযরত নবী (স) হযরত জিরাইলের (আ) নির্দেশে বর্তমান কোরআনকে সুবিন্যস্ত করেছিলেন। আর এই তরতিব অনুসারেই হুজুর (স) নিজে সাহাবায়ে কেরাম নামাযে উহা পাঠ করতেন। আর হাফেজ সাহাবাগণ অনুরূপ তরতিব মোতাবেকই কোরআন মুখস্থ করতেন।

 

কোরআন অল্প অল্প করে নাযিল হওয়ার কারণ

 

সমস্ত কোরআন মাজীদখানা একসঙ্গে অবতীর্ণ না হয়ে কেন অল্প অল্প করে দীর্ঘ তেইশ বছরে কালব্যাপী অবতীর্ণ হল। কেন আল্লাহ তওরাত, জবুর,ইঞ্জিল প্রভৃতি আসমানী কিতাবের ন্যায় কোরআন মাজীদকেও এক সংগে অবতীর্ণ করলেন না, এটাও একটি অনুধাবনযোগ্য বিষয় বটে। পবিত্র কোরআনের ব্যাপারে কাফেরদের এও একটি অভিযোগ ছিল যে, কেন কোরআন মুহাম্মদের (স) উপরে একই সঙ্গে অবতীর্ণ হল না?”

 

কাফেরদের এ উক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,

 

﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْلَا نُزِّلَ عَلَيْهِ الْقُرْآنُ جُمْلَةً وَاحِدَةً ۚ كَذَٰلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِ فُؤَادَكَ ۖ وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلًا﴾

 

“আর কাফেরগণ বলে, কোরআন মুহম্মদের (স) উপরে একই সঙ্গে অবতীর্ন হল না কেন? এরূপ (বিরতি সহকারে) অবতীর্ণের মাধ্যমে আমি আপনার অন্তরকে শক্তিশালী করছি। আর আমি উহাকে বিরতি সহকারে অবতীর্ণ করেছি।” (সুরা আল-ফোরকান, আয়াত-৩২)

 

মানাহেহুল ইরফান ফি উলুমিল কোরআন এর লেখক আল্লামা আব্দুল আজিম স্বীয়-গ্রন্থে কোরআন অল্প অল্প করে নাযিল হওয়ার ভিতরে চারটি বিশেষ হিকমতের কথা উল্লেখ করেছেন।

 

. রসূলের অন্তকে শক্তিশালী করা

 

অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হতে বার বার ওয়াহী বহনকারী সম্মানিত ফিরিশতা হযরত জিবরাইল আমিনের হুজুরের কাছে আগমনে তাঁর অন্তরাত্না আধ্যাত্নিক আনন্দে পরিপূর্ণ থাকত এবং মনের পবিত্র মনিকোঠায় নিয়তই এ ধারণা বদ্ধমুল থাকত যে তাঁর উপরে আসমান থেকে অবারিত ধারে আল্লাহর অনুগ্রহ ও নিয়ামত বর্ষিত হচ্ছে। ফলে হুজুরের অন্তর-আত্না ঈমানের অলৌকিক শক্তিতে ক্রমশই শক্তিশালী হতে থাকে।

 

কোরআন বিরতি সহকারে অল্প অল্প করে নাযিল হওয়ার ফলে হুজুর (স) তা সাথে সাথে মুখস্থ করে ফেলতেন এবং তার অন্তরনিহিত মর্ম উপলব্ধি করে তার হিকমত সম্পর্কে বিশেষভাবে ওয়াকিফহাল হতেন। ফলে হুজুরের পবিত্র অন্তকরণ কোরআনের অভিনব ও অলৌকিক শক্তিবলে নিয়তই শক্তিশালী হতে থাকত।

 

. মুসলিম উম্মতের ধারাবাহিক তরবীয়ত

 

অর্থাৎ নবীর নেতৃত্বে যে নতুন একটি জাতির অভ্যুদয় ঘটেছিল সেই জাতিকে ধারাবাহিক শিক্ষা ও তরবীয়তের মাধ্যমে ধাপে ধাপে অগ্রসর করিয়ে পূর্ণতার প্রান্ত সীমায় নিয়ে যাওয়া। বিরতিসহ অল্প অল্প কোরআনের অংশ নাযিলের মাধ্যমে উক্ত উদ্দেশ্য বিশেষভাবে সাধিত হয়েছিল। কেননা শরীয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম যদি প্রথম ধাপেই একত্রে অবতীর্ণ হত, তাহলে হয়ত সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী নতুন লোকদের পক্ষে উহা পুরাপুরি মেনে চলার অধিকতর কষ্টসাধ্য হত। যেমন আল্লাহ বলেছেন,

 

﴿وَقُرْآنًا فَرَقْنَاهُ لِتَقْرَأَهُ عَلَى النَّاسِ عَلَىٰ مُكْثٍ وَنَزَّلْنَاهُ تَنزِيلًا﴾

 

“আর আমি কোরআনকে ভাগ ভাগ করে এই জন্য অবতীর্ণ করেছি যাতে করে আপনি ইহা লোকদেরকে বিরতি সহকারে পাঠ করে শুনাতে পারেন।” (সুরা ইসরা, আয়াত-১০৬)

 

. নতুন নতুন সমস্যা সমূহের ব্যাপারে পথ প্রদর্শন

 

হুজুর (স) ও তাঁর আত্নোৎসর্গী সঙ্গীদের উপরে ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার যে গুরুদায়িত্ব আল্লাহ অর্পণ করেছিলেন, উহার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্নেরও সম্মুখীন হুজুরকে হতে হয়েছিল। উক্ত সমস্যা সমূহের সমাধান ও প্রশ্ন সমূহের জওয়াব দান প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় কোরআনের বিভিন্ন অংশ নাযিল হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।

 

যেমন একদা একজন মুসলিম মহিলা হযরত খাওলা বিনতে সায়ালাবা রসূলের দরবারে হাজির হয়ে তার স্বামী কর্তৃক তাকে জেহার করার ঘটনা বর্ণনা করে কান্নাকাটি ও হাহুতাশ করতে লাগলেন। কেননা তার কয়েকটি ছোট ছোট সন্তান সন্ততি ছিল। যদি এই সন্তানদেরকে তিনি তাঁর স্বামীর হাতে অর্পণ করেন তাহলে তাদের জীবনই বরবাদ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আবার যদি নিজের কাছে রেখে দেন, তাহলেও অন্নকষ্টে তাদের অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল। ফলে মহিলাটি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে হুজুরের সামনে কান্নাকাটি ও হাহুতাশ করতে লাগলেন।

 

ইসলাম পূর্বে জাহেলিয়াত যুগে জেহার দ্বারায় স্ত্রী তালাক হয়ে যেতো।

 

[জেহার বলা হয় আপন স্ত্রীকে মোহররামাত অর্থাৎ মা, কন্যা ইত্যাদিদের সাথে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার নিয়তে তুলনা করা। যেমন কেহ ‍যদি তার স্ত্রীকে একথা বলে তুমি আমার মায়ের ন্যায়, তাহলে উহা জেহার হবে। জাহেলিয়াত যুগে আরবরা যে স্ত্রীর সাথে জেহার করত তাকে তারা চিরদিনের তরে নিজের জন্য হারাম মনে করত। ইসলাম ইহাকে অনুমোদন দেয়নি। তবে এ ধরনের অশালীন ও অসংগত আচরণের জন্য জেহারকারীর উপর কিছু কাফফারা আরোপ হয়েছে।]

 

মুসলিম সমাজে জেহারের সমস্যা এই প্রথম বারই দেখা দিয়েছিল। হুজুর (স) কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ঠিক এই মুহুর্তে উহার সমাধানে নিম্নলিখিত আয়াত অবতীর্ণ হয়,

 

قَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّتِي تُجَادِلُكَ فِي زَوْجِهَا وَتَشْتَكِي إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ يَسْمَعُ تَحَاوُرَكُمَا ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ﴾

 

﴿الَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنكُم مِّن نِّسَائِهِم مَّا هُنَّ أُمَّهَاتِهِمْ ۖ إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلَّا اللَّائِي وَلَدْنَهُمْ ۚ وَإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ مُنكَرًا مِّنَ الْقَوْلِ وَزُورًا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَعَفُوٌّ غَفُو

 

“যে মহিলাটি তার স্বামীর ব্যাপারে তোমার সাথে ঝগড়াঝাটি করছিল এবং আল্লাহর কাছে অভিযোগ পেশ করছিল। আল্লাহ তোমাদের উভয়ের কথাবার্তাই শুনে নিয়েছিলেন। আর আল্লাহ সবকিছুই শুনেন ও দেখেন। তোমাদের মধ্য হতে যারা আপন স্ত্রীর সাথে জেহার করে তাদের সে জেহারকৃত স্ত্রীরা (প্রকৃতপক্ষে) তাদের মা হয়ে যায় না। তাদের মা তো তারাই যারা তাদেরকে প্রস্রব করেছে।” (সুরা মোজাদালা, আয়াত১-২)

 

একদা মক্কার মুশরিকরা ইহুদীদের প্ররোচনায় হুজুরকে অপ্রস্তুত করার মানসে জুলকারনাইন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল অথচ তখনও জুলকারনাইন সম্পর্কে হুজুরের কিছুই জানা ছিলনা। ফলে মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে জুলকারনাইনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ওয়াহীর মারফত অবগত করিয়ে দেন।

 

﴿وَيَسْأَلُونَكَ عَن ذِي الْقَرْنَيْنِ ۖ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُم مِّنْهُ ذِكْرًا﴾

 

“আর এরা আপনার নিকটে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। আপনি বলুন শীঘ্রই তোমাদেরকে তাঁর বর্ণনা পাঠ করে শুনাচ্ছি।” (সুরা কাহাফ, আয়াত-৮৩)

 

পবিত্র কোরআনের পরে আর কোন আসমানী কিতাব নাযিল হচ্ছে না কেন?

 

মহানবীর আগমনের পূর্বে দুনিয়ায় যেমন অসংখ্য নবী রাসূল এসেছিলেন। তেমনি তাদের উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অসংখ্য কিতাব ও সহীফাও অবতীর্ণ করেছিলেন। কিন্তু মহানবীর তিরোধানের পরে নতুন করে আর কোন আসমানী কিতাব বা সহীফাও অবতীর্ণ হবে না, আর এ অবস্থা কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।

 

প্রশ্ন হতে পারে, কোরআনের পরে কেন আর কোন আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হবে না? এর জওয়াব স্বরূপ একথা বলা চলে যে, মহান আল্লাহ কোরআন অবতীর্ণের মাধ্যমে তাঁর দ্বীনকে মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ কোরআনে উল্লেখ করেছেন,

 

 الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ

 

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামতকেও তোমাদের উপরে সম্পূর্ণ করে দিলাম, আর দ্বীন হিসেবে তোমাদের জন্য আমি ইসলামকেই মনোনীত করলাম।” (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩)

 

সুতরাং দ্বীনের পূর্ণতা প্রাপ্তির পরে নতুন করে আর কোন কিতাব নাযিল করার প্রয়োজন ছিল না।

 

দ্বিতীয়ত: আল্লাহর কিতাবের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, উহার আংশিক কিংবা পূর্ণাঙ্গ বিলুপ্তির কারণেই অতীতে নতুন করে কিতাব নাযিলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর অলৌকিক অনুগ্রহ কোরআন এসব বিপর্যয় হতে একেবারেই নিরাপদ। কোরআনের যেমন কোনরূপ পরিবর্তন, পরিবর্ধন সম্ভব নয়, তেমনি উহার কোন অংশের বিলুপ্তিরও আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই। সুতরাং এমতাবস্থায় আর কোন আসমানী কিতাবের প্রয়োজনীয়তাই নেই।

 

অধুনা যোগাযোগ ব্যবস্থার অস্বাভাবিক উন্নতি, মুদ্রণ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ও সভ্যতার আদান-প্রদানের প্রচুর সুযোগ কোরআন ও কোরআনের বাণীকে দুনিয়ার প্রায় সর্বত্রই পৌঁছিয়ে দিয়েছে। কাজেই দুনিয়ার কোন প্রান্তেই এখন আর কোন আসমানী কিতাব নাযিল করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। সুতরাং হযরত মুহাম্মদের (স) আবির্ভাবের পরে তিনি যেমন সারা বিশ্বের সমগ্র মানব জাতির জন্য কিয়ামত পর্যন্ত একমাত্র নবী, তেমনি কোরআন অবতীর্ণের পরে সমগ্র মানব জাতির জন্য কিয়ামত পর্যন্ত কোরআনই একমাত্র অনুসরণযোগ্য আসমানী কিতাব। অতঃপর আর যেমন কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবেনা, তেমনি আর কোন আসমানী কিতাবও অবতীর্ণ হবে না।

 

 

 

দুনিয়ার বিভিন্ন খেলাফত যুগের কোরআনের কয়েকখানা পান্ডুলিপি

 

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (স) সময়ই নিয়মিতভাবে কোরআন শরীফ লেখার কাজ শুরু হয় এবং হুজুরের জীবদ্দশায়ই বেশ কয়েকজন সাহাবীর কাছে খন্ডাকারে কোরআন লিখিতভাবে মওজুদ ছিল। হযরত আব বকরের (রা) সময় এই লিখিত বিচ্ছিন্ন টুকরাগুলিকে সাজিয়ে একখানা সুসজ্জিত পূর্ণাঙ্গ কিতাবের রূপ দেয়া হয়। অতঃপর হযরত উসমান (রা) হিজরী ২৫ সনে প্রথম হযরত আবু বকরের (রা) ব্যবস্থাপনায় লিখিত অত্র গ্রন্থখানার বেশ কয়েকখানা কপি তৈরী করিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেন।

 

হযরত উসামান (রা) স্বহস্ত লিখিত একখানা মাছহাব তার নিজের কাছেই ছিল। এ মাসহাব খানিকে “মাসহাফুল ইমাম” বলা হতো। আজীবন উহা হযরত উসমানের কাছে ছিল, অতঃপর হযরত আলী (রা) ও হযরত ইমাম হোসেনের হাতে আসে। পরবর্তী পর্যায়ে ইহা স্পেনে এবং তারও পরে উহা মরক্কোর রাজধানী ফাশ-এ গিয়ে পৌঁছে। এরপরে উহা আবার মদীনায় ফিরিয়ে আনা হয়। অতঃপর প্রথম মহাযুদ্ধকালে মদীনা হতে মাসহাফখানা তুরস্কের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে নীত হয় এবং অদ্যাবধি সেখানেই আছে।

 

হযরত উসমানের (রা) স্বহস্ত লিখিত একখানা পান্ডুলিপি যার শেষে এ কথা লিখা আছে যে, এ খানা লিখেছেন হযরত উসমান বিন আফফান।

 

বর্তমানে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে আছে এই মাসহাফখানা তেলাওয়াত করা অবস্থায়ই বিদ্রোহীরা হযরত উসমানকে (রা) শহীদ করে। পরে এখানা দামেস্কে নীত হয় এবং বনু উমাইয়া রাজন্য বর্গের হাতেই তাদের খেলাফতের শেষ পর্যন্ত থাকে। অতঃপর উহা বসরায় নীত হয়। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানা বসরায় দেখতে পান। ১৯৪১ সনে এখানা রাশিয়ার বলসেভিকদের হস্তগত হয় এবং সে হতে এখানা মস্কোতে আছে।

 

হযরত উসমানের (রা) তৈরী আর একখানা পান্ডুলিপি বর্তমানে ফ্রান্সে, একখানা মিসরের খাদুর্বিয়া কতুবখানা, একখানা আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে এবং অন্য একখানা ফ্রান্সের গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে।

 

হযরত আলীর (রা) তৈরী পাঁচখানা পান্ডুলিপির মধ্যে একখারা মাশহাদে, দুখানা কনষ্টান্টিনোপলে ও একখানা বর্তমানে কায়রোর জামে হোসাইনে রক্ষিত আছে। হযরত আলীর (রা) তৈরী আর একখানা পান্ডুলিপি বর্তমানে দিল্লীর জামেয়া মিল্লাতে রয়েছে।

 

হযরত ইমাম হোসেন সঙ্কলিত একখানা পান্ডুলিপিও বর্তমানে দিল্লীর জামেয়া মিল্লিয়ায় রক্ষিত আছে। হযরত ইমাম জয়নাল আবেদিন কৃত একখানা মাসহাফ জামেয়া মিল্লিয়ায় এবং একখানা দেওবন্দের কুতুবখানায় মওজুদ আছে।

 

কোরআনে কখন জের, জবর, পেশ সংযুক্ত করা হয়

 

যাদের মাতৃভাষা আরবী তারা কোনরূপ হরকত ছাড়াই আরবী ভাষায় যে কোন বই-কিতাব পড়তে পারে। কাজেই যে পর্যন্ত ইসলাম আরবের বাইরে সম্প্রসারিত হয়নি ততদিন কোরআন হরকত ছাড়াই লেখা হত। কেননা আরবদের জন্য জের, জবর, ও পেশের সাহায্য ব্যতীরেকেই কোরআন পাঠ সম্ভব ছিল। কিন্তু ইসলাম যখন আরবের সীমানা অতিক্রম করে আযমেও সম্প্রসারিত হল, তখন অনারব মুসলিমদের পক্ষে হরকত বিহীন কোরআন পাঠ মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। ফলে উপরোক্ত সমস্যার সমাধানকল্পে ৮৬ হিজরীতে (৭০৫ খৃস্টাব্দে) বনু উমাইয়া যুগে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কোরআনের হরকত অর্থাৎ জের জবর, পেশ সংযুক্ত করার নির্দেশ দেন।

 

পবিত্র কোরআন সম্পর্কে কতিপয় স্মরণীয় দিন তারিখ

 

১। হিজরী পূর্ব ১৩ সন ১৭ই রমাজান সোমবার হেরা গুহায় সর্বপ্রথম ওয়াহী অবতীর্ণ হওয়া শুরু হয়। (মোতাবেক ৬ই আগস্ট ৬১০ খৃস্টাব্দ)।

 

২। হিজরী ১১ সনের সফর মাসে কোরআন অবতীর্ণ সমাপ্ত হয়।

 

৩। সর্বপ্রথম যে পাঁচটি আয়াত হুজুরের প্রতি অবতীর্ণ হয় উহা ছিল সুরায়ে আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত। যথা-

 

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ﴾

 

﴿خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ﴾

 

﴿اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ﴾

 

﴿الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ﴾

 

﴿عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ﴾

 

৪। সর্বশেষ অবতীর্ণ আয়াত সুরায়ে বাকারার ৩৭ রুকুর শেষ আয়াত।

 

ﻭَﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﻳَﻮْﻣًﺎ ﺗُﺮْﺟَﻌُﻮﻥَ ﻓِﻴﻪِ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺛُﻢَّ

 

ﺗُﻮَﻓَّﻰ ﻛُﻞُّ ﻧَﻔْﺲٍ ﻣَﺎ ﻛَﺴَﺒَﺖْ ﻭَﻫُﻢْ ﻟَﺎ ﻳُﻈْﻠَﻤُﻮﻥَ

 

৫। তেলাওয়াতের সুবিধার জন্য ৮৬ হিজরীতে কোরআনকে পারা ও রুকুতে বিভক্ত করা হয়।

 

৬। হিজরী ৩০ সনে হযরত উসমানের (রা) আদেশে শুধু কোরায়েশী আরবী ব্যতীত অন্যান্য আরবী মাসহাফগুলিকে নষ্ট করে দেয়া হয়।

 

৭। কোরআন পাকের সর্বপ্রথম অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ সুরা সুরায়ে মুদাসসির এবং সর্বশেষ অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ সুরা সুরায়ে নছর। কারও কারও মতে সর্বপ্রথম অবতীর্ণ সুরা-সুরায়ে ফাতেহা।

 

পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন বিষয়ের কয়েকটি পরিসংখ্যান

 

মোট সুরা - ১১৪

 

মক্কী সুরা - ৯৩

 

মাদানী সুরা – ২১

 

রুকু - ৫৫৪

 

আয়াত সংখ্যা - ৬২৩৬

 

কোরআন সম্পর্কে কয়েকজন খ্যাতনামা অমুসলিম পণ্ডিতদের উক্তি

 

১। “ কোরআনের সংগ্রহকারীরা কোরআনের কোন অংশ, বাক্য কিংবা শব্দ বাদ দিয়েছে এমন কখনো শোনা যায়নি। আবার কোরআনের এমন কোন বাক্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি যা বাহির হতে কোরআনে প্রবেশ করেছে। যদি এমন হত, তাহলে অবশ্যই হাদীসের কিতাবে উহার উল্লেখ থাকত, যা থেকে সামান্য বিষয়ও বাদ পড়েনি।” (উইলিয়াম ময়িউর)

 

২। নিঃসন্দেহে কোরআন আরবী ভাষার সর্বোত্তম এবং দুনিয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। কোন মানুষের পক্ষেই এ ধরনের একখানা অলৌকিক গ্রন্থ রচনা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। কোরআন মৃতকে জীবিত করার চেয়েও শ্রেষ্ঠ মোজেযা। একজন অশিক্ষিত লোক কি করে এ ধরণের ত্রুটিমুক্ত ও নজিরবিহীন বাক্যাবলীর রচনা করতে পারে তা ভাবতেও আশ্চর্য লাগে।” (জর্জ সেল)

 

৩। “কেবল মাত্র কোরআনই এমন একখানা গ্রন্থ যাতে তেরশত বছরের ব্যবধানেও কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের এমন কোন নির্ভরযোগ্য ধর্মগ্রন্থ নেই যা আদৌ কোন দিক থেকে কোরআনের সমকক্ষ হতে পারে।” (প্রসিদ্ধ খৃস্টান ঐতিহাসিক মি: বাডলে)

 

৪। “প্রাচীন আরবীতে অবতীর্ণ কোরআন শরীফ অত্যন্ত মনোরম ও আকর্ষণীয়। ইহার বাক্য বিন্যাস পদ্ধতি ও প্রকাশভঙ্গী খুবই মনোমুগ্ধকর। কোরআনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্যগুলিতে যে বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী যু্ক্তির অবতারণা করা হয়েছে তা খুবই চমৎকার। কোরআনের ভাবধারা অন্য ভাষায় যথাযথ প্রকাশ করা খুবই মুসকিল।” (দি উইসডম অফ দি কোরআন- জন ফাস)

 

৫। “ কোরআনের বিধানবলী স্বয়ং সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ।” (প্রিচিং অফ ইসলাম- আর্নল্ড টয়েনবি)

 

৬।“দুনিয়ার কোন গ্রন্থই কোরআনের ন্যায় বেশি পাঠ করা হয় না। বিক্রির দিক দিয়ে হয়ত বাইবেল সংখ্যায় বেশী হবে। কিন্তু মুহম্মদের কোটি কোটি অনুসারীরা যেদিন থেকে কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করে সেদিন থেকে দৈনিক পাঁচবার কোরআনের দীর্ঘ দীর্ঘ আয়াতসমূহ পাঠ করা শুরু করে।” (চার্লস ফ্রান্স পুটার)

 

৭। “ সমস্ত আসমানী গ্রন্থসমূহের মধ্যে কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ। মহান আল্লাহ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে মানব জাতির উদ্দেশ্যে এই সর্বোৎকৃষ্ট কিতাবখানান নাযিল করেছেন। মানুষের কল্যাণ সাধনে ইহা প্রাচীন গ্রীক দর্শনের চেয়েও অধিকতর ফলপ্রসূ। কোরআনের প্রতিটি শব্দ হতেই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের ঝংকার ধ্বনিত হয়।” (ড: মোরসেন ফ্রান্স)

 

৮। “পবিত্র কোরআন শুধুমাত্র কতগুলি ধর্মীয় বিধানবলী সমষ্টিই নয়, বরং উহাতে এমন এমন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধানবলীও রয়েছে যা গোটা মানব জাতির জন্য সমান কল্যালকর।” (ড: মসিজিউন)

 

৯। “ আমি কোরআনের শিক্ষাসমূহ উপরে গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে পোঁছেছি যে, কোরআন নাযিলকৃত আসমানী কিতাব এবং উহার শিক্ষাসমূহ মানব স্বভাবের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল।” (মিস্টার গান্ধী- ভারত)

 

১০। “আমি ইসলামকে পছন্দ করি এবং ইসলামের গয়গম্বরকে দুনিয়ার একজন শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বলে স্বীকার করি। আমি কোরআনের সামাজিক, রাজনৈতিক, আত্নিক ও নৈতিক বিধানবলীকে অন্তরের সহিত পছন্দ করি। হযরত উমরের খেলাফতকালে ইসলামের যে রূপ ছিল উহাকেই আমি ইসলামের বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ রূপ বলে মনে করি।” (লালা লাজ পাত রায়, ভারত)

 

১১। “কোরআনের অধ্যয়নে বিবেক হয়রান হয়ে যায় যে, একজন অশিক্ষিত লোকের মুখ হতে এ ধরনের কালাম (ভাষ্য) কি করে বের হল।” (কোন্ট হেনরী)

 

১২। “মুহম্মদের এ দাবী আমি সর্বান্তকরণে স্বীকার করি যে কোরআন মুহাম্মদের (স) একটি সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ মোজেযা।” (মি: বোরথ সমুখ)

 

১৩।“ কোরআন গরীবের বন্ধু ও কল্যাণকামী। ধনীদের বাড়াবাড়িকে কোরআন সর্বক্ষেত্রেই নিন্দা করেছে।” (গর্ড ফ্রে হগনস)

 

১৪।“ তেরশত বছর পরেও কোরআনের শিক্ষাসমূহ এতই জীবন্ত যে আজও একজন ঝাড়ুদার মুসলমান হয়ে ( কোরআনের প্রতি ঈমান এনে) যে কোন খান্দানী মুসলিমদের সাথে সমতার দাবী করতে পারে।” (মি: ভুপেনন্দ্রেনাথ বোস)

 

১৫।“ইসলামকে যারা প্রতিক্রিয়াশীল ধর্ম বলে নিন্দা করে, তারা কোরআনের শিক্ষাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। এই কোরআনের বদৌলতেই আরবদের কায়া সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিল।” (মোসেউর্মিওব ফ্রান্স)

 

কোরআনের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে মহানবীর (সা) কতিপয় হাদীস

 

تركت فيكم أمرين لن تضلوا ما تمستمسكتُم بهما كتاب الله وسنّة رسوله. (مشكوة - موطا

 

“রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি।এ দুটিকে যে পর্যন্ত তোমরা আকড়ে থাকবে, পথভ্রষ্ট হবে না। উহা হল আল্লাহর কিতাব ও রসুলের সুন্নত।” (মেশকাত-মোয়াত্তা)

 

من قراً القرآن فاستظهرهٔ - فاًحل

 

خلالهٔ و حرم حرامهٔ آذخلهٔ الله به الجنة و شافعهٔ فی عشر من أهل بيته كلهم قد وجبت لة التار. ة

 

“হযরত আলী (রা) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি উত্তমরূপে কোরআন পাঠ করত: উহার হালাল হারাম মেনে চলবে, আল্লাহ তাঁকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। আর তার বংশ হতে তাকে এমন দশজন লোকের সুপারিশ করার অধিকার দিবেন যাদের প্রতি জাহান্নাম ছিল ওয়াজিব।” (আহমদ, তিরমিজি, ইবনে মাযা, দারেমী)

 

و عن ابی سعی در رضایی انتهٔ عنهٔ قال قال رسول الله صلی اللههٔ عليه وسلم يقول الرب تبارك وتعالى. من شغلة القرآن عن ذكرى ومسألتي اعطيتة أفضل ما اعطي السائلين – فضل

 

كلام اللّه على سائر الكلام كفضل الله على خلقه.

 

হযরত আবু সাইয়িদ (রা) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,‘ যে ব্যক্তি কোরআন অধ্যয়নে মগ্ন থাকায় (অতিরিক্ত) জিকর ও দোয়ার সময় পায় না। আমি তাকে দোয়া প্রার্থীদের চেয়েও অধিক দিয়ে থাকি।’ আর যাবতীয় সৃষ্টির উপরে আল্লাহর মর্যাদা যেরূপ, যাবতীয় কালামের উপরে আল্লাহর কালামের মর্যাদা সেরূপ।” (তিরমিজি)

 

 وعن عائشة رضيى الله عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الذي يقراً القرآن وهو ماهير به مع السفرة الكرام البررة والذي يقرأه وهو عليه شاقلة أجران. (بخاري - مسلم

 

“হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। রসূলে করীম (সা) বলেছেন, কোরআনে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি যিনি নিয়মিত কোরআন পাঠ করে থাকেন, তিনি ( কিয়ামতের) নবীদের সঙ্গী হবেন। আর যিনি কষ্ট করে কোরআন পাঠ করেন তিনি দ্বিগুণ প্রতিদান পাবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)

 

 وعن أبى هريرة قال قال رسول الله صلى الة علية وسلم وما اجتمع قوم فى بيتر من بيوتر الله يتلون كتاب الله ويتدارسونة بينهم الأنزلت عليهم السكينة وغشيتهم الرخمة وحفنهم الملائكة وذكرهم فيمن عندهٔ

 

“হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, “নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, যখন কিছু লোক কোন একটি ঘরে আল্লাহর কিতাবের আলোচনার পর্যালোচনায় মগ্ন থাকে, তখন তাদের পরে মহাপ্রশান্তি অবতীর্ণ হতে থাকে এবং আল্লাহর রহমত ও করুণা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আর ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ্‌ স্বয়ং নিকটস্থ ফিরিশতাগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির আমল তাকে পিছন ঠেলবে বংশ মর্যাদা তাকে আগে বাড়াতে পারবে না।” (মুসলিম)

 

“হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, রসূল (স) বলেছেন, যার সিনায় কোরআনের কোন অংশ নাই তার তুলনা হয় বিরান ঘরের সাথে।” (তিরমিযি)

 

“হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা) বলেন, রসূল (স) বলেছেন, অবশ্য অবশ্য আল্লাহ এই কোরআনের সাহায্যে বহ জাতিকে শীর্ষে উঠাবেন, আবার এই কোরআনই (অর্থাৎ কোরআনকে ছেড়ে দেয়ার কারণে) কোন কোন জাতিকে অবনতির নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছবেন।” (মুসলিম)

 

--- সমাপ্ত ---

', 'মহাগ্রন্থ আল - কোরআন কি ও কেন', '', 'publish', 'closed', 'closed', '', '%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%86%e0%a6%b2-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a6%86%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%93-%e0%a6%95%e0%a7%87', '', '', '2017-07-29 09:42:37', '2017-07-29 03:42:37', '

 

 

মহাগ্রন্থ আল - কোরআন কি ও কেন

 

আবুল কালাম মুহাম্মাদ ইউসুফ (মোমতাজুল মোহাদ্দেছিন)

\r\n\r\n\r\n


\r\n\r\n

স্ক্যান কপি ডাউনলোড

\r\n\r\n


 

লেখকের আরজ

 

বর্বর, বেদুইন, যাযাবর, শিক্ষা ও তামাদ্দুনের আলো হতে বঞ্চিত একটি জাতি মাত্র অর্ধ শতাব্দীর কম সময়ের ভিতরে পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তিদ্বয়কে পর্যুদস্ত ও পরাভূত করে কি করে অর্ধপৃথিবী জয় করে ফেলল? কি করে তাঁরা এই স্বল্পকালীন সময়ের ভিতর মানব সভ্যতার উপরে এক স্থায়ী ও অক্ষয় ছাপ রেখে গেল? সে কথা ভেবে ভেবে আজও ঐতিহাসিকদের পেরেশানীর অন্ত নেই। তাঁরা ভাবতেই পারে না যে, এমন কোন্‌ মহাশক্তির যাদু লেগেছিল, যার ফলে আরব- মুসলমানরা সারা পৃথিবীতে এক প্রলয়কান্ড ঘটিয়ে দিয়েছিল। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের মহাশক্তিই যে আরব- মুসলমানদের এ সফলতার পিছনে মূল শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল, তা বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও চিন্তাবিদদের অনেকেই অম্লান বদনে স্বীকার করেছেন।

 

প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত ইমানুয়েল ডুয়েৎচ বলেছেন, “পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মসমূহের মধ্যে কোরআন যে একটি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী তা স্বীকার করতেই হবে। এ ধরনের যুগান্তকারী সাহিত্যের মধ্যে কোরআন সর্বকনিষ্ঠ বটে; তবে জনসাধারনের উপর প্রভাব বিস্তারে তা কারও অপেক্ষা ন্যুন নহে। কোরআন মানবীয় চিন্তাধারার যেমন এক নতুন ভাবের সৃষ্টি করেছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে এক নতুন চরিত্রের। উহা আরব উপদ্বীপের মরুচারী কতগুলি পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠিকে এক সুমহান বীর জাতিতে পরিনত করেছে”।

 

কোরআন নাযিলের পর থেকে আরম্ভ করে দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় কোরানের উপর অসংখ্য গবেষণামূলক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা বাংলাতে এ ধরনের গবেষণামূলক পুস্তকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই বাংলা ভাষা- ভাষী মুসলিম ভাই-বোনদের খেদমতে পবিত্র কোরানের উপর গবেষণামূলক আমার এ ক্ষুদ্র পুস্তিকাখানি পেশ করছি।

 

ইতিমধ্যে এর দ্বাদশ সংস্করণ শেষ হয়েছে। ত্রয়োদশ সংস্করণ বের করতে পেরে মহান রাব্বুল আলামীনের শুকরিয়া আদায় করছি।

 

-আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ

\r\n\r\n

কোরআনের পরিচয়

 

কোরআন আল্লাহ্‌র নাযিলকৃত ঐ কিতাবকে বলা হয়, যা তিনি তাঁর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)- এর উপরে দীর্ঘ তেইশ বৎসর কালব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়, প্রয়োজন মোতাবেক অল্প অল্প করে অবতীর্ণ করেছিলেন। ভাষা এবং ভাব উভয় দিক হতেই কোরআন আল্লাহ্‌র কিতাব। অর্থাৎ কোরআনের ভাব (অর্থ) যেমন আল্লাহ্‌র তরফ হতে আগত তেমনি তাঁর ভাষাও।

\r\n\r\n

কোরআন নাযিলের কারণ

 

নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের পরে আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) কে বেহেশত হতে দুনিয়ায় পাঠানোর প্রাক্কালে তায়ালা বলে দিয়েছিলেন যে,

 

قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا ۖ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿٣٨﴾ وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَـٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

 

 “তোমরা সকলেই এখান হতে নেমে পড়। অতঃপর তোমাদের কাছে আমার পক্ষ হতে জীবন বিধান যেতে থাকবে। পরন্তু যারা আমার জীবন বিধান অনুসারে চলবে, তাঁদের ভয় ও চিন্তার কোন কারণ থাকবেনা। (অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তিতে তাঁরা আবার অনন্ত সুখের আধার এ বেহেশতেই ফিরে আসবে)। আর যারা তা অস্বীকার করে আমার নিদর্শন সমুহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে, তাঁরা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানে তাঁরা অনন্তকাল থাকবে”। (সূরা বাকারা, আয়াত নং ৩৮-৩৯)

 

আল্লাহ্‌ তায়ালার উক্ত ঘোষণা মোতাবেকই যুগে যুগে আদম সন্ততির কাছে আল্লাহ্‌র তরফ হতে হেদায়েত বা জীবন বিধান এসেছে। এই জীবন বিধানেরই অন্য নাম কিতাবুল্লাহ। যখনই কোন মানবগোষ্ঠী আল্লাহ্‌র পথকে বাদ দিয়ে নিজেদের মন গড়া ভ্রান্ত পথে চলতে থাকে, তখনই কিতাব নাযিল করে আল্লাহ্‌ মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন।

 

কিতাব নাযিলের ব্যাপারে আল্লাহ্‌ তায়ালার চিরন্তন নীতি হল এই যে, তিনি যখন কোন জাতির জন্য কিতাব নাযিলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, তখনই সেই জাতির মধ্য থেকে মানবীয় গুনের অধিকারী সর্বোৎকৃষ্ট লোক্টিকে পয়গাম্বর হিসেবে বাছাই করে নেন, অতঃপর ওয়াহীর মাধ্যমে তাঁর উপরে কিতাব নাযিল করে থাকেন।

 

মানব সৃষ্টির সুচনা হতে দুনিয়ায় যেমন অসংখ্য নবী-রাসুল এসেছেন, তেমনি তাঁদের উপরে নাযিলকৃত কিতাবের সংখ্যাও অগণিত। নবীদের মধ্যে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যেমন সর্বশেষ নবী, তেমনি তাঁর উপরে নাযিলকৃত কোরআনও আল্লাহ্‌র সর্বশেষ কিতাব। অতঃপর দুনিয়ায় আর কোন নতুন নবীও আসবে না এবং কোন কিতাবও অবতীর্ন হবে না।

\r\n\r\n

কোরআনের আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য

 

কোরআনের আলোচ্য বিষয় হল, মানব জাতি। কেননা মানব জাতির প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণের সঠিক পরিচয়ই কোরআনে দান করা হয়েছে। কোরআনের উদ্দেশ্য হল মানব জাতিকে খোদা প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার দিকে পথ প্রদর্শন, যাতে দুনিয়ায়ও নিজের জীবনকে কল্যাণময় করতে পারে এবং পরকালেও শান্তিময় জীবনের অধিকারী হতে পারে।

\r\n\r\n

ওয়াহীর সূচনা কিভাবে হয়েছিল

 

বোখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। তাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, “ওয়াহীর সূচনা এভাবে হয়েছিল যে, হুজুর ঘুমের ঘোরে এমন বাস্তব স্বপ্ন দেখতে থাকেন যা উজ্জ্বল প্রভাতের ন্যায় বাস্তবায়িত হতে থাকে’। অতঃপর হুজুরের নিকটে নির্জনবাস আকর্ষনীয় অনুভূত হল এবং তিনি হেরা গুহায় নির্জনবাস শুরু করে দিলেন। এখানে তিনি একাধিক রাত্রি কাটিয়া দিতেন এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য পানীয় ও জরুরী সামগ্রী সাথে নিয়ে যেতেন। তা ফুরিয়ে গেলে আবার ফিরে এসে খাদীজার(রাঃ) নিকট হতে তা নিয়ে গুহায় ফিরে যেতেন। এভাবেই এক শুভক্ষনে হেরায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাঁর কাছে হকের(ওয়াহীর) আগমন ঘটল। ফিরিশতা (জিবরাইল আমিন) এসে তাঁকে বললেন, আপনি পড়ুন। (হুজুর বলেন) আমি বললাম, আমি পাঠক নই। হুজুর বলেন, অতঃপর ফিরিশতা আমাকে বগলে দাবিয়ে ছেড়ে দিলেন। ফলে আমি খুব ক্লান্তি বোধ করতে থাকলাম। আবার তিনি আমাকে পড়তে বললেন এবং আমি একই জওয়াব দিলাম। তিনি আবার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিলেন। এভাবে তিনি তিনবার করলেন এবং তিনবারই হুজুর একই জওয়াব দিলেন। অতঃপর ফিরিশতা পাঠ করলেন,

 

 اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ﴿١﴾ خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ ﴿٢﴾ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ ﴿٣﴾ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ ﴿٤﴾ عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ﴿٥﴾

 

“তুমি পাঠ কর তোমার সেই প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন যিনি সৃষ্টি করেছেন মানব জাতিকে ঘনীভূত রক্ত বিন্দু হতে। তুমি পাঠ কর তোমার সেই মহিমান্বিত প্রভুর নামে যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। যিনি মানব জাতিকে শিখিয়ে দিয়েছেন যা সে জানত না”। (সুরা আলাকঃ ১-৫)

 

অতঃপর হুজুর উক্ত আয়াতসমুহ নিয়ে কম্পিত হৃদয়ে বাড়ি ফিরলেন। আর খাদীজার (রাঃ) ঘরে প্রবেশ করে বললেন, ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও’। এভাবে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়ার কিছুক্ষন পর তার অস্থিরতা কেটে গেল। তিনি হযরত খাদীজাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা শুনালেন এবং বললেন, আমার নিজের জীবন সম্পর্কেই আমার ভয় হচ্ছে। হযরত খাদীজা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আল্লাহর শপথ, আল্লাহ কিছুতেই আপনার কোন অনিষ্ট করবেন না। কেননা আপনি আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, দরিদ্র ও নিরন্নকে সাহায্য করেন, অতিথির সেবা করেন এবং উত্তম কাজের সাহায্য করেন”। অতঃপর হযরত খাদীজা হুজুরকে নিয়ে তার চাচাত ভাই আরাকা বিন নওফেলের কাছে গেলেন। তিনি জাহেলিয়াতে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইবরাণী ভাষা জানতেন। আর ইঞ্জিল হতে উক্ত ভাষায় যা ইচ্ছা নকল করতে পারতেন। তিনি খুবই বৃদ্ধ ছিলেন এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। খাদীজা তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, ভাই আপনি আপনার ভাইপোর ঘটনা শুনুন, আরাকা সব ঘটনা শুনে বললেন, “এতো সেই ফিরিশতা যিনি হযরত মুসার (আঃ) কাছে এসেছিলেন। আফসোস! তোমার লোকেরা তোমাকে যখন দেশ থেকে বের করে দিবে, তখন যদি আমি জীবিত থাকতাম!” হুজুর বললেন, তাহলে কি তারা আমাকে বের করে দিবে? আরাকা বললেন, হ্যাঁ, তুমি যা পেয়েছ ইহা যে যে পেয়েছে তার সাথে অনুরুপ ব্যবহার করা হয়েছে। আমি যদি ঐ দিন জীবিত থাকি, তাহলে তোমাকে সাধ্যমত সাহায্য করব। অতঃপর পুনরায় ওয়াহী নাযিলের আগেই আরাকা ইন্তেকাল করেন।

 

উপরোক্ত ঘটনাটি যেদিন ঘটে সেদিন ছিল ১৭ই রমজান সোমবার। হুজুরের বয়স ছিল তখন চল্লিশ বছর ছয় মাস আট দিন। অর্থাৎ ৬ই আগস্ট ৬১০ খৃস্টাব্দ।

\r\n\r\n

ওয়াহী কিভাবে নাযিল হত

 

হুজুরের উপর যখন ওয়াহী অবতীর্ন হত তখন হুজুরের ভিতরে এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হত। চেহারা মোবারক উজ্জ্বল ও রক্তবর্ন হয়ে যেত, কপালে ঘাম দেখা দিত, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে যেত এবং শরীর অত্যধিক ভারী হয়ে যেত। এমন কি উটের পিঠে ছওয়ার অবস্থায় যখন ওয়াহী নাযিল হত, তখন অত্যধিক ভারে উট চলতে অপারগ হয়ে মাটিতে বসে যেত।

 

ওয়াহী নাযিলের সময় কেন এমন অবস্থা হত, এর কারন স্বরূপ বলা চলে যে, নবীগন ছোট বড় সব রকমের গোনাহ হতে পবিত্র থাকার ফলে তাদের স্বভাবে ফিরিশতা স্বভাবের আধিক্য থাকলেও তারা মানবীয় স্বভাবের উর্ধে নন। ফলে আল্লাহ তাঁর পবিত্র কালাম নাযিল হবার পুর্ব মুহুর্তে তাদেরকে এমন এক বিশেষ নুরানী অবস্থায় নিয়ে যেতেন, যেখানে তাদের কল্‌ব মানবীয় সবটুকু বৈশিষ্ট হারিয়ে ফিরিশতা স্বভাবে রুপান্তরিত হত এবং আল্লাহর অনুগ্রহের নূর তাহাদের অন্তর- আত্নাকে মোহিত করে ফেলত। ফলে এক নীরব ও প্রশান্তিময় পরিবেশে আল্লাহ তাঁর কালাম নবীদের উপরে নাযিল করতেন। কেননা আল্লাহর পবিত্র কালাম পুর্ন মনোনিবেশ সহকারে শুনা, উহা অন্তরে গেঁথে রাখা এবং উহার প্রকৃত মর্ম হৃদয়-মন দিয়ে অনুধাবন করার জন্য উপরোক্ত বিশেষ অবস্থায় নবীদেরকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হত।

 

এভাবে যখন ওয়াহী নাযিল হওয়া সমাপ্ত হত, তখন উপরোক্ত অবস্থা কেটে যেত এবং হুজুর পুর্বাবস্থায় ফিরে আসতেন। আর নাযিলকৃত কালাম ছাহাবাদেরকে তেলাওয়াত করে শুনাতেন।

 

ওয়াহি কিভাবে নাযিল হত সে সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে নিম্নলিখিত মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত আছে,

 

“হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা হারিস-বিন হিসাম হুজুরকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনার উপরে ওয়াহী কিরূপে নাযিল হয়? হুজুর বললেন, কখনও কখনও ওয়াহীর আওয়াজ আমার অন্তরে ঘন্টা ধ্বনির ন্যায় ধ্বনিত হতে থাকে, ওয়াহীর এই ধরনটাই আমার জন্য খুব কঠিন হয় এবং আমি ক্লান্তি বোধ করতে থাকি। অতঃপর উহা আমার অন্তরে বিঁধে যায়। আবার কখনও ফিরিশতা মানুষের আকৃতিতে আসেন এবং আমার সাথে কালাম করেন (ওয়াহী নাযিল করেন)। আর আমি মনে গেঁথে নেই। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, অত্যধিক শীতের সময়ও যখন ওয়াহী নাযিল হত, হুজুরের শরীরে তাপ সঞ্চয় হত এবং তাঁহার চেহারা মোবারকে ঘাম দেখা দিত”।

 

উপরোক্ত দুই ধরনের বাইরেও কখনও কখনও আল্লাহ কোন মাধ্যম ব্যতিরেকেই সরাসরি পর্দার আড়াল হতে নবীদের সাথে কথা বলেছেন।

 

বুখারী শরীফের ওয়াহী সম্পর্কীয় হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আইনী তাঁর গ্রন্থে ওয়াহীর বিভাগ সম্পর্কে নিম্নরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন,

 

(১) আল্লাহ কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি কথা বলতেন। যেমন পবিত্র কোরআন এবং বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত মুসা (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে আল্লাহ এ ধরনের কথোপকথন করেছেন।

 

(২) কোন ফিরিশতা পাঠিয়ে তাঁর মাধ্যমে ওয়াহী নাযিল করতেন।

 

(৩) অন্তরে ওয়াহীর শব্দসমূহ ধ্বনিত করে বিঁধে দিতেন। যেমন হুজুর বলেছেনঃ “পবিত্র ফিরিশতা আমার অন্তরে দম করে দিয়েছেন”। হযরত দাউদের (আঃ) উপরে তৃতীয় ধরনের ওয়াহী নাযিল হত।

\r\n\r\n

কোরআন নাযিল হওয়ার পদ্ধতি

 

কোরআনকে বুঝা এবং তাকে হৃদয়ঙ্গম করার নিমিত্তে কোরআন নাযিল হওয়ার পদ্ধতি অনুধাবন করা অপরিহার্য। মনে রাখা দরকার যে, কোরআন গ্রন্থাকারে একই সময় নবী করীমের (সাঃ) উপরে অবতীর্ণ হয়নি। বরং যে বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নবী (সাঃ) এবং তাঁর আত্নোৎসর্গিত সাথীদের উপরে আল্লাহ চাপিয়ে ছিলেন, সেই আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে অল্প অল্প করে প্রয়োজনানুসারে পূর্ন তেইশ বছর কালব্যাপী অবতীর্ন হয়েছে। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্ত হন এবং পূর্ণ তেইশ বছর কাল নবী হিসেবে খোদা প্রদত্ত দায়ীত্ব পালন করে তেষট্টি বছর বয়সে দুনিয়া ত্যাগ করেন। এই সুদীর্ঘ তেইশ বছর কালব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়ে কোরআনের বিভিন্ন অংশ আল্লাহর রাসুলের প্রতি অবতীর্ন হতে থাকে।

\r\n\r\n

মক্কী-মাদানী

 

নবুয়াত প্রাপ্তির পরে হযরত (সাঃ) তের বৎসর কাল মক্কা শরীফে অবস্থান করেন এবং মক্কা ও উহার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। মক্কায় অবস্থানকালীন এই দীর্ঘ তের বছরে যে সব সূরা নবীর (সাঃ) উপরে অবতীর্ন হয়েছে তাঁকে বলা হয় মক্কী সূরা।

 

অতঃপর আল্লাহর নবী মদীনা শরীফে হিজরত করেন এবং দীর্ঘ দশ বছরকাল মদীনায় অবস্থান করে ইসলামকে একটি জীবন্ত- বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পরকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মদীনায় অবস্থানকালীন এই দশ বছর কালব্যাপী কোরআন মজীদের যে সব সূরা হযরতের (সাঃ) উপরে অবতীর্ন হয়েছে উহাকে বলা হয় মাদানী সুরা।

\r\n\r\n

মক্কী সুরাসমুহের বৈশিষ্ট্য

 

ইসলামী দাওয়াত সূচনায় মক্কা শরীফে নবী করীমের (সাঃ) উপরে যে সব সূরা অবতীর্ন হয়েছে তাঁর অধিকাংশ ছিল আকারে ছোট, অথচ অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী। সাধারনত ইসলামের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কীয় বিষয়সমুহ, যেমন- তওহীদ, রেসালাত, আখেরাত ইত্যাদি বিষয়ের ইহাতে যেমন আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি শিরক, কুফরী, নাস্তিকতা পরকাল অস্বীকৃতি প্রভৃতি আকীদা সম্পর্কীয় প্রধান প্রধান পাপ কার্যেরও উহাতে বর্ণনা দান করা হয়েছে। অতীতে যে সব জাতি নবীর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করত একমাত্র আল্লাহ্‌ প্রদত্ত দ্বীন অনুসারে চলে দুনিয়ায়ও অশেষ কল্যাণ লাভ করেছে এবং পরকালেও অনন্ত সুখের অধিকারী হবে, তাদের সম্পর্কে যেমন ইহাতে আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি আলোচনা করা হয়েছে সেই সমস্ত ভাগ্যহীনদের সম্পর্কে যারা নবীর দাওয়াতকে অস্বীকার করে আল্লাহ্‌র দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান করে দুনিয়ায়ও ধ্বংস হয়েছে এবং পরকালেও চরম শাস্তি ভোগ করবে। আর এই ঘটনাগুলি বর্ণনা করা হয়েছে উহা হতে উপদেশ গ্রহন করার জন্য, ইতিহাস আলোচনার জন্য নয়।

 

এ ছাড়াও মক্কী সূরা সমূহে রসুল (সাঃ) এবং তাঁর মুষ্টিমেয় সাথীদেরকে কাফির ও মুশরিকদের অবিরাম নির্যাতনের মুখে যেমন ধৈর্য ধারন করার নছিহত করা হয়েছে, তেমনি কাফির মুশরিকদেরও তাদের হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ির ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।

\r\n\r\n

মাদানী সূরার বৈশিষ্ট্য

 

মহানবীর (সাঃ) মাদানী জীবনের সূচনা হয় নবূয়তের তের বছর পরে। মক্কা শরীফে রসুলের দাওয়াতে যারা ইসলাম কবুল করেছিলেন, তারা যেমন ছিলেন প্রভাবহীন তেমনি ছিলেন সংখ্যায় নগন্য। কোরায়েশ এবং মক্কার পার্শবর্তী গোত্রসমূহের নেতৃস্থানীয় লোকেরা ছিল রসুলের দাওয়াতের ঘোরতর বিরোধী।

 

ফলে মুসলমানদের সেখানে কুফরী প্রভাবের অধীনে যথেষ্ট নির্যাতিত জীবন –যাপন করতে হয়েছে। কিন্তু মদীনার অবস্থা ছিল ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। মদীনায় দুটি প্রভাবশালী গোত্র ‘আওস’ ও ‘খাজরাজের’ নেতৃস্থানীয় লোকেরা ইতিপুর্বে হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় এসে রসুলের কাছে ইসলাম গ্রহন করে গিয়েছিলেন। আর তাদেরই অনুসরনে গোত্রের প্রায় সব লোকেরাই ইসলাম কবুল করে ফেলেছিলেন।

 

অতঃপর নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে হুজুর যখন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে মদীনায় হিজরত করলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, মদীনার প্রভাবশালী নেতা এবং তাদের অনুসারীরা শুধু হুজুরের দ্বীনই কবুল করেননি, উপরন্তু তাঁরা তাদের এলাকাটাও হুজুরের নিয়ন্ত্রনে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। ফলে ইসলামের যাবতীয় বিধানাবলী কার্যকর করার ব্যাপারে বাহিরের হস্তক্ষেপ ব্যাতিত ভিতরের দিক থেকে আর তাঁকে কোন প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হবে না। মদীনায় ইহুদীদের যে দুটি গত্র বাস করত, ইতিপুর্বে রসুল (সাঃ) তাদেরকে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন।

 

সুতরাং আল্লাহ্‌র নবী কালবিলম্ব না করে ইসলামকে পূর্নাংগ রূপ দেয়ার নিমিত্ত ছোট অথচ সম্ভাবনাময় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ স্থাপন করলেন। এখন প্রয়োজন ছিল এই রাষ্ট্রের পরিচালনার জন্য যাবতীয় বিধি- ব্যবস্থার। উহাই পর্যায়ক্রমে মাদানী সূরাসমূহের মাধ্যমে নবীর জীবনের বাকী দশ বছরে অবতীর্ণ হতে থাকে।

 

রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা সম্পর্কীয় যাবতীয় মৌলিক আইন যেমন ফৌজদারী কানুন, উত্তরাধিকার সম্পর্কীয় আইন, বিবাহ- তালাক সম্পর্কীয় বিধি ব্যবস্থা, যাকাত- ওশর প্রভৃতি অর্থনৈতিক বিধান এবং যুদ্ধ- সন্ধি সম্পর্কীয় হুকুম- আহকাম হল মাদানী সূরাসমূহের প্রধান আলোচ্য বিষয়।

 

মক্কায় কোন ইহুদি গোত্র বাস করতোনা আর মুনাফিকদেরও (সুবিধাবাদী শ্রেণী) কোন সংগঠিত দল তথায় ছিলনা। ফলে মক্কী সূরা সমূহে এদের সম্পর্কে বিশেষ কোন আলোচনা দেখা যায় না। কিন্তু মদীনায় এ দুটি শ্রেণীই ছিল এবং বাহ্যিক দিক দিয়ে এরা মুসলমানদের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে নিজেদেরকে জাহির করলেও ভিতরে ভিতরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ফলে আল্লাহ্‌ মাদানী সূরাসমূহের মাধ্যমেই এদের কুটিল ষড়যন্ত্রের কথা নবীকে জানিয়ে দেন এবং ইহুদী ও মোনাফেকদের তাদের জঘন্য পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করে দেন।

\r\n\r\n

আরববাসীদের উপর কোরআনের আশ্চর্য প্রভাব

 

কোরায়েশদের শত বাধা সত্ত্বেও দিন-দিন ইসলামের প্রভাব আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে চলছিল। এর মূলে ছিল পবিত্র কোরানের অলৌকিক প্রভাব। নিম্নের ঘটনা কয়টিই বাস্তবতা প্রমানের জন্য যথেষ্ট।

 

প্রথম দিকে প্রায় তিন বছর কাল হুজুর (সঃ) ইসলামের দাওয়াত গোপনে দিতে থাকেন। অতঃপর আল্লাহ্‌র নির্দেশে তিনি প্রকাশ্য দাওয়াতের সূচনা করেন, আর এই সময়ই শুরু কোরায়েশদের সাথে সংঘাত। এ সময় কোরায়েশ সর্দাররা একদিকে মুহাম্মাদের (সঃ) দরিদ্র ও দুর্বল সাথীদের উপরে নানারূপ শারিরীক নির্যাতন শুরু করে এবং স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদকে (সঃ) নানারূপ প্রলোভন দ্বারা সত্য পথ হতে বিরত রাখার চেষ্টা করে।

 

নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে কোরায়েশ নেতাদের প্রস্তাবক্রমে তাদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উতবা বিন রাবিয়াকে হযরত মুহাম্মাদের (সঃ) নিকট একটি আপোষ প্রস্তাব দিয়ে পাঠানো হয়। উতবা হুজুরের খেদ্মতে হাজির হয়ে এই মর্মে প্রস্তাব পেশ করেন যে, হে মুহাম্মাদ (সঃ) তুমি এ নতুন মতবাদ পরিত্যাগ কর, তাহলে তোমাকে আমাদের নেতা করে নেব। যদি তুমি ধনের আকাঙ্ক্ষা করো, তাহলে আমরা তোমাকে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী করে দেব। আর যদি তুমি সুন্দরী মহিলার লোভ রাখ, তাহলেও আমরা তোমার সেই বাসনা পুর্ন করে দেব”। হুজুর বললেন, নেতৃত্ব, ধন আর নারী কেন, তোমরা যদি আমার এক হাতে আকাশের সূর্য ও অন্য হাতে চন্দ্রও এনে দাও তবুও আমি এ মতবাদ ত্যাগ করতে পারব না। অতঃপর হুজুর সূরায়ে হামিমের কয়েকটি আয়াত তাঁর সামনে তিলাওয়াত করলেন।

 

উতবা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উহা শ্রবণ করল। তাঁর বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল এবং ভিতর হতে সে তাঁর সমস্ত শক্তি ও সাহস হারিয়ে ফেলল। অতঃপর সে সেখানে ফিরে গেল, যেখানে কোরায়েশ দলপতিরা তাঁর পথ চেয়েছিল এবং মনে মনে একটি শুভ সংবাদের আশা করছিল।

 

উতবা কোরায়েশ নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলল, “দেখ তোমরা মুহাম্মাদকে বাধা দিও না। অতঃপর যখন তাঁর দাওয়াত কোরায়েশদের এলাকার বাইরে চলে যাবে, তখন অকুরায়েশদের সাথে মুহাম্মাদের সংঘর্ষ হবে। সে সংঘর্ষে যদি মুহাম্মাদ পর্যুদস্ত হয়, তাহলেও তোমাদের লাভ। কেননা তোমাদের শত্রু ধ্বংস হল, অথচ তোমাদেরকে সংঘাতে লিপ্ত হতে হল না। আর যদি মুহাম্মাদ জয়ী হয়, তাহলেও তোমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কেননা তোমাদের কোরায়েশ বংশেরই একটি লোক আরবদের নেতা হবে”।

 

এহেন প্রস্তাবে উপস্থিত নেতারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল এবং অনুসন্ধান করে জানতে পারল যে, মুহাম্মাদের (সঃ) মুখ নিঃসৃত কোরআনের বাণী শুনেই উতবা অভিভূত হয়ে পড়েছে, ফলে মুহাম্মাদের সম্পর্কে সে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেছে।

 

অনুরূপ আর একটি ঘটনা ঘটে আবিসিনিয়ায়। তখন নবুয়তের পঞ্চম বর্ষ। কোরায়েশদের উৎপীড়নে জর্জরিত হয়ে হুজুর (সঃ) প্রথমে ষোলজন এবং পরে তিরাশিজন মুসলমান নর নারীর দুটি দলকে আবিসিনিয়ায় প্রেরন করেন। আবিসিনিয়ায় ইসায়ী শাসক নাজাশী ছিলেন অত্যন্ত সুবিচারক এবং প্রজাবৎসল। তিনি মুসলমানদেরকে তাঁর দেশে বসবাসের আদেশ দিয়েছিলেন। এদিকে কোরায়েশ সর্দারগন এটা জানতে পেরে একটি যোগ্য প্রতিনিধি দলকে প্রচুর উপঢৌকনসহ নাজাশীর দরবারে পাঠাল। তাঁরা নাজাশীর খেদমতে হাজির হয়ে উপঢৌকন পেশ করে বলল, মহারাজ, কিছু যুবক- যুবতী কিছু গোলাম আমাদের নেতাদের অবাধ্য হয়ে তাদের অনুমতি (ছাড়পত্র) ছাড়াই আপনার দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদেরকে ফেরত নেয়ার জন্যই আমাদেরকে আপনার খেদমতে পাঠানো হয়েছে। দয়া করে আপনি তাদেরকে আমাদের হাতে সমর্পন করবেন”। দরবারকারীরাও পলাতকদের ফেরত দেয়ার পক্ষে মত দিলেন। কিন্তু বাদশাহ বললেন, তাদের বক্তব্য না শুনে আমি তাদেরকে ফেরত দিতে পারি না। অতঃপর তাদেরকে ডাকা হল এবং কেন তাঁরা দেশ ত্যাগ করে এসেছে তা বলতে বলা হল।

 

মুসলিম দলের নেতা হযরত আলীর ভ্রাতা হযরত জাফর দাঁড়িয়া বললেন, “জাহাঁপনা, আমরা ইতিপুর্বে মুর্তিপুজাসহ নানারূপ কুসংস্কারে লিপ্ত ছিলাম। মারামারি, খুন-খারাবী, রাহাজানি ও লুটতরাজ ছিল আমাদের নিত্য- নৈমিত্তিক কাজ। ইতিমধ্যে আল্লাহ্‌ মেহেরবানী করে আমাদের ভিতরে একজন নবী পাঠালেন। তিনি আমাদেরকে একমাত্র আল্লাহ্‌র দাসত্ব গ্রহণ করতে, সত্য কথা বলতে। আত্নীয়- স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে, গরীব- মিসকিনদের প্রতি সদয় হতে এবং খুন- খারাবী ও লুটতরাজ পরিত্যাগ করে পবিত্র জীবন- যাপন করতে আহবান জানালেন। আমরা তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর দ্বীন গ্রহণ করি। ফলে আমাদের গোত্র নেতারা আমাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে আমাদের পয়গাম্বরের আদেশে আপনার দেশে হিজরত করে এসেছি। এখন যদি আপনি আমাদেরকে এই কোরায়েশ দূতদের হাতে অর্পণ করেন তাহলে আমাদের আর কোন উপায় নেই”।

 

বাদশাহ্‌ হযরত জাফরের এই তেজস্বীনি ও হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য শুনে খুবই প্রীত হলেন এবং বললেন, তোমাদের পয়গাম্বরের উপরে যে কালাম অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর কিছু আমাকে শুনাতে পার? হযরত জাফর , হযরত ঈসা ও হযরত মরিয়ম সম্পর্কীয় সূরায়ে মরিয়মের কয়েকটি আয়াত সুললিত কন্ঠে

 

**************

 

পাঠ করে তাঁকে শোনালেন। নাজাশীর দুচোখ গড়িয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে লাগলো। তিনি অন্তরে এক স্বর্গীয়- শান্তি অনুভিব করলেন এবং বললেন, সৃষ্টিকর্তার শপথ ইঞ্জিল আর যে কালাম এখন আমাকে শুনান হ উভয়ই একই মূল হতে এসেছে। অতঃপর তিনি কোরায়েশ দূতগণকে লক্ষ্য করে বললেন, ফিরে যাও, আমি এ নিরাপরাধ লোকগুলিকে তোমাদের হাতে অর্পন করতে পারব না”

 

এদিকে কোরায়েশরা অধীর আগ্রহে দূতদের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করছিল। তারা ভেবে ছিল পলাতক লোকগুলিকে বন্দী অবস্থায় নিয়ে দূতগণ মক্কায় ফিরবে। কিন্তু দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে দূতগণ যখন খালি হাতে ফিরে এল, তখন তারা আশ্চর্য হয়ে কারণ জানতে চাইল। দূতগণ বলল, জাফরের মুখে কোরআন শুনেই বাদশাহ বিগড়ে গেলেন। নতুবা আমরা তাদেরকে ফেরত আনতে পারতাম।

 

কোরায়েশরা আরেকবার অনুভব করল যে, কোরআনের অলৌকিক প্রভাবই তাদের সর্বনাশের মূল কারণ।

 

কোরআন শুনে কোরআনের অলৌকিক প্রভাবে অভিভূত হয়ে নবূয়তের প্রথম দিকে যারা ঈমান এনেছিলেন, তাদের ভিতরে দক্ষিণ আরবস্থ ইয়ামানী কবি তোফায়েল ইবনে দোসীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরবে তখন কবিদের যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হত। ফলে তোফায়েল ইবনে দোসীর ইসলাম গ্রহণে আরব দেশে এক তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে দোসী গোত্রের সমস্ত লোকই তার প্রভাবে ইসলাম গ্রহণ করে।

 

বনি সলিম গোত্রের বিজ্ঞ ব্যক্তি কায়েস ইবনে নাসিরাও হুজুরের মুখনিঃসৃত কোরআন শুনে ইসলাম কবুল করেছিলেন। পরে তিনি বাড়ী ফিরে গিয়ে তার গোত্রে লোকদের একত্র করে বললেন, দেখ, রোম ও পারস্যের সেরা কবি সাহিত্যিকদের কথাবার্তা ও রচনাদি শুনার ভাগ্য আমার হয়েছে, হামিরের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের কথাবার্তা আমি ঢের শুনেছি। কিন্তু মুহম্মদের মুখনিঃসৃত কোরআনের বাণীর সমতুল্য আমি কারো কাছেই কিছু শুনি নাই। পরবর্তী সময় তাঁর প্রচেষ্টায় তাঁর গোত্রের প্রায় এক হাজার লোক ইসলাম কবুল করেছিলনে।

 

আজাদ গোত্রের সর্দার জামাদ ইবনে ছায়ালাবাও নবীর মুখে কোরআন শুনে ইসলাম গ্রহণ করেন। নেতৃস্থানীয় কোরায়েশ যুবকের ভিতরে হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণও ছিল কোরআনের অলৌকিক প্রভাবে। ঘটনাটি ছিল ‍নিম্নরূপঃ

 

নবুয়তের তখন নবম বর্ষ। আবু জাহেল দ্বারে-নোদয়ায়ে কোরায়েশ নেতাদের এক সম্মেলন ডাকল। অতঃপর সকলকে লক্ষ্য করে জ্বালাময়ী ভাষায় মুহম্মদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে একটি নাতি-দীর্ঘ বক্তৃতা করল। আর কোরায়েশ যুবকদের এই বলে উসকাল,” এই একটি মাত্র লোক আমাদের জাতিধর্ম ইত্যাদি সবকিছু উলট পালট করে দিল। অথচ কেউ এ শত্রুকে নিপাত করতে পারল না। আমি আজ জনসমক্ষে ঘোষণা করছি, যে বীর যুবক মুহম্মদের (সঃ) ছিন্ন মস্তক আমাদের কাছে হাজির করতে পারবে। আমি তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং একশত উট পুরস্কার দিব।”

 

ঘোষণার সাথে সাথে উত্তেজিত জনতার ভিতর হতে বলিষ্ঠ দেহ, বিশাল বক্ষ, যুবক উমর নাংগা তলোয়ার হাতে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বলল,

 

“এই আমিই যাই, মুহম্মদের ছিন্ন মস্তক না নিয়ে আর ফিরব না।” জনতা হর্ষধ্বনি করে উঠল, আর মহাবীর উমর তলোয়ার নিয়ে রওয়ানা হলো।

 

পথিমধ্যে বন্ধু নঈমের সাথে তার সাক্ষাৎ হল। নঈমের এই ক্রোধাবস্থা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল এ অসময় উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তুমি কার সর্বনাশ করতে বের হয়েছ? বলল, ”মুহম্মদের (সঃ) মুন্ডপাত করতে। সে আমাদের সবকিছুই ওলট-পালট করে দিয়েছে।”

 

নঈম যে গোপনে ইসলাম কবুল করেছিলেন, উমর তা জানত না। নঈম রসূলকে (সঃ) উমরের আক্রোশ হতে বাঁচাবার জন্যে বললেন, “ আরে মুহম্মদের মাথা তো নিবে, কিন্তু বাড়ীর খবর রাখো তো? তোমার ভগ্নি ফাতেমা ও ভগ্নিপতি সাঈদও যে ইসলাম কবুল করেছে।” উমর আঁতকে উঠে বলল: “ হায় সর্বনাশ! আমারই ঘরে? আমি এক্ষণেই ঠিক করে দেব,” এই বলে সে বোনের বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো।

 

তখন মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ। সাঈদ ও ফাতেমা কোরআনের লিখিত কিছু অংশ পাঠ করছিলেন। হঠাৎ উমরের আগমনধ্বনি শুনে তারা উহা লুকিয়ে ফেললেন। উমর জিজ্ঞেস করল, এই মাত্র কি পাঠ করছিলে। ফাতেমা বললেন, কই তুমি কি শুনেছ? উমর ক্রোধভরে সাঈদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে প্রহার করা শুরু করল। আর বলল, মুহম্মদের দ্বীন কবুল করেছ, এবার মজা দেখে নাও। ফাতেমা ঠেকাতে গিয়ে আহত হল। তার জখম হতে রক্ত ঝরছিল। উমর রক্ত দেখে থমকে দাঁড়াল এবং বলল, হতভাগিনী মুহম্মদের (সঃ) দ্বীন কবুল করেছিস? ফাতেমাও ছিল মহাবীর খাত্তাবের মেয়ে। জখম হয়ে নির্ভীক কন্ঠে উত্তর দিলেন, “তুমি যত পার মার। মুহম্মদের(সঃ) দ্বীন কবুল করেছি, তা পরিত্যাগ করব না।” বোনের এই কঠোর ও নির্ভীক উক্তিতে উমর সচকিত হল এবং বলল, তোমরা যা পাঠ করছিলে তা আমাকে দাও। ফাতেমা উত্তর দিলেন আগে তুমি অজু করে পবিত্র হও তারপরে দেব। উমর পবিত্র হওয়ার পর তাকে তা দেয়া হল। এতে সূরায়ে তোয়াহার অংশ বিশেষ লেখা ছিল। উমর মনোনিবেশ সহকারে তা পাঠ করল। অতঃপর কোরআনের ভাষা ও অন্তর্নিহিত ভাব উমরকে একেবারেই অতিভূত করে ফেলল। সে একান্তভাবে অনুভব করল যে, এ কালাম কিছুতেই মানব রচিত নয়। কম্পিত কন্ঠে ‍উমর ঘোষণা করলেন,

 

 أَشْهَدُ أنْ لا إلَٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأشْهَدُ أنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ

 

”আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং মুহম্মদ (সঃ) তাঁর রাসূল।”

 

অতঃপর তিনি বললেন,

 

“ কোথায় নূর নবী, আমাকে তাঁর পদপ্রান্তে নিয়ে চল” ফাতেমা আর সাঈদের তখন আনন্দের আর সীমা থাকলো না। তারা হযরত উমরকে নিয়ে হুজুর (সঃ) যে বাড়িতে ছিলেন সেখানে হাজির হলেন। হুজুরের (সঃ) সঙ্গীরা উমরকে আসতে দেখে দারুন বিচলিত হলেন। কিন্তু হুজুর (সঃ) বললেন উমরকে আসতে দাও।

 

উমর ভিতরে প্রবেশ করেই তলোয়ার হুজুরের (সঃ) পদপ্রান্তে রেখে দিয়ে ঘোষণা করলেন,

 

 أَشْهَدُ أنْ لا إلَٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأشْهَدُ أنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ

 

”আমি সাক্ষ্য ‍দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং মুহম্মদ (স) আল্লাহর রাসূল।”

 

হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণের খবর বিদ্যুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। ওদিকে দ্বারে নোদওয়ায়ে মুহম্মদের ছিন্ন মস্তক হস্তে মহাবীর উমরের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় যারা ছিল, তাদের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। তারা বুঝতেই পারাল না যে, এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন কি ঘটনা ঘটল, যার ফলে মাথা নিতে গিয়ে মাথা দিয়ে আসলো।

 

অনুসন্ধান করে জানলো। বোনের বাড়িতে কোরআন পাঠ করেই তাঁর এ দুর্দশা। কোরায়েশরা আর একবার চরমভাবে অনুভব করল যে, কোরআনই তাদের সব অঘটনের মূল।

 

প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত জোবায়ের ইবনে মোতেমও কোরআন শুনে ইসলাম কবুল করেছিলেন। এসব ঘটনা দৃষ্টে কাফের ও মুশরেক নেতাদের আর বুঝতে বাকী থাকল না যে, কোরআনের কারণেই তাদের এ বিপর্যয়। মুহম্মদ (স) তো কোরআন নাযিলের আগেও তাদের ভিতরে ছিল। কিন্তু কই, তখন তো সে তাদের জাতি বা সমাজের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। কোরআন অবতীর্ণের পর হতেই তো তাদের এ বিপর্যয়। কোরআন শুনে ওৎবার মত প্রখর বুদ্ধিমান লোকটি বু্দ্ধি হারিয়ে ফেলল। আবার এই কোরআনের আকর্ষনেই নাজাশী কোরায়েশ দূতদেরকে খালি হাতে ফেরত ‍দিল, উমরের মত পাষাণ হৃদয় কোরআনের যাদু স্পর্শে মাথা নিতে দিয়ে মাথা নিয়ে আসল। প্রসিদ্ধ কবি তোফায়েল বিন দোসী, জামাদ, জোবায়ের, প্রভৃতি গোত্র সর্দারগণ কোরআনের বাণীতে মুগ্ধ হয়েই কোলে আশ্রয় নিল।

 

[কোরআনের এই অলৌকিক প্রভাবের কথা স্বীকার করে প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত ইমানুয়েল ডুয়েৎচ বলেছেন,

 

”এই পুস্তকখানার সাহায্যেই আরবরা আলেকজন্ডার ও রোম অপেক্ষাও বৃহত্তর ভূ-ভাগ জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। রোমের যত শত বছর লেগেছিল তাদের বিজয় সম্পূর্ণ করতে আরবদের লেগেছিল তত দশক। এরই (কোরআনের) সাহায্যে সমস্ত সেমিটিক জাতির মধ্যে কেবল আরবরাই এসেছিল ইউরোপের রাজারূপে। নতুবা ফিনিসীয়রা এসেছিল বণিকরূপে। আর ইহুদীরা পলাতক কিংবা বন্দীরূপে।”]

 

সুতরাং কাফের সর্দারগণ পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, তারা নিজেরাও কোরআন শুনবে না এবং কোরআনের আওয়াজ যাতে কোন লোকের কাছে না পৌঁছে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

আল্লাহ তাদের এ সিদ্ধান্তে কথা নিম্নলিখিত আয়াত দ্বারা রাসূলকে জানিয়ে দিলেন

 

﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَسْمَعُوا لِهَٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ﴾

 

﴿فَلَنُذِيقَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا عَذَابًا شَدِيدًا وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

 

”আর কাফেররা বলে, কেহই কোরআন শুননা এবং কোরআন তেলাওয়াতের সময় শোরগোল কর, তাহলেই তোমাদের পরিকল্পনা কার্যকরী হবে। আমি এসব কাফেরদেরকে কঠোর শাস্তির স্বাদর গ্রহণ করাব এবং তাদেরকে এ অপকর্মের উপযুক্ত প্রতিফল দেব।” (সুরা হামিম সিজদা, আয়াত-২৬-২৭)

\r\n\r\n

কোরআনের ঐশী গ্রন্থ হওয়ার কয়েকটি অকাট্য প্রমাণ

 

পবিত্র কোরআন যে আল্লাহ তায়ালারই বাণী এবয় এই ধরনের কিতাব যে মানুষের পক্ষে তৈরী করা আদৌ সম্ভব নয় এর অসংখ্য প্রমাণ স্বয়ং কোরআনেই বর্তমান। নিম্নে তা হতে কয়েকটি উদ্ধৃত হচ্ছে:

\r\n\r\n

এক: কোরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মান

 

কোরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মান অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। এর ভাষা যেমন- স্বচ্ছ, তেমনি এর বাক্য বিন্যাসও অত্যন্ত নিখুঁত ও অভিনব। নবী করীম (সঃ) যখন কোরআন তেলাওয়াত করতেন, তখন এর ঝংকার ও সুরমাধুরী তাঁর সমভাষীদের মন মগজকে মোহিত করে তুলত। তারা বাস্তবভাবে উপলব্ধি করত যে, এ কালাম কিছুতেই মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভন নয় তা সে আরবী সাহিত্যের যত বড় পন্ডিতই হোক না কেন। যদিও পূর্ব পুরুষের অন্ধ অনুকরণ, গোত্রীয় অহমিকা ও সংকীর্ণ স্বার্থবোধ কোরআনকে হক বলে গ্রহণ করার পথে তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে রেখেছিল, কিন্তু তারা এ কথা ভালোভাবে উপলব্ধি করত যে, একজন উম্মী লোকের পক্ষে, যে কোনদিন পাঠশালার বারান্দাও মাড়ায়নি এ ধরনের উচ্চমানের কালাম রচনা করে পেশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। স্বয়ং কোরআনই একাধিকবার আরবদেরকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করেছে যে, “ তোমরা যদি একে নবীর (সঃ) রচিত বাণী বলে মনে কর, তাহলে তোমরা এ ধরনের বাণী তৈরী করে দেখাও।”

 

মুশরেকদের প্রাণান্তর বিরোধিতার মুখে মক্কা শরীফে বিভিন্ন সময় উক্ত চ্যালেঞ্জ তিনবার প্রদান করা হয়্। রসূলের মাদানী জিন্দেগীর প্রথম দিকে আর একবার এ চ্যালেঞ্জ পুনরোক্তি করা হয়। মক্কায় একবার সুরা ইউনুসের ভিতরে, একবার সুরা হুদের ভিতরে আর একবার সুরা বনি ইসরাইলের ভিতরে নিম্নরূ চ্যালেঞ্জ দান করা হয়:

 

 ﴿أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾

 

”এরা কি দাবী করে যে, কোরআন (আপনার) বানানো। আপনি বলুন, তোমরা যদি তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও, তাহলে একটি সুরা অন্তত তৈরী করে নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর। সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও”

 

(সুরা ইউনুস, আয়াত-৩৮)

 

﴿أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِّثْلِهِ مُفْتَرَيَاتٍ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾

 

”উহারা নাকি বলে যে, কোরআন রসূলের (সঃ) তৈরী করা, আপনি বলুন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে এ ধরনের রচিত দশটি সুরা নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও।”

 

(সুরা হুদ, আয়াত-১৩)

 

 ﴿قُل لَّئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنسُ وَالْجِنُّ عَلَىٰ أَن يَأْتُوا بِمِثْلِ هَٰذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا﴾

 

আপনি ঘোষণা করে দিন, জগতের সমগ্র মানব ও জ্বীন জাতি মিলেও যদি এ ধরনে একখানা কোরআন তৈরী করার চেষ্টা করে, তাহলেও তারা তা পারবে না, যদিও তারা এ ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করে।”

 

(সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৮৮)

 

নবী করীম (স:) মদীনায় হিজরত করার পরপরই আর একবার সুরায়ে বাকারার ভিতরে উক্ত চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃ্ত্তি নিম্নরূপে করা হয়,

 

 ﴿وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾

 

আর যে কিতাব আমি আমার বান্দার (মুহাম্মদের) উপর নাযিল করেছি, তা আমার পক্ষ হতে কিনা? এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে. তাহলে অনুরূপ একটি সুরা তৈরী করে নিয়ে এসো। আর এ কাজে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্যান্য সাহয্যকারীদেরকে ডেকে নাও যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” (সুরা বাকারা, আয়াত-২৩)

 

আরবদের কঠিন বিরোধিতার মুখে যখন বার বার এ চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছিল, তখন নিশ্চয়ই তারা চুপ করে বসে ছিল না। তাদের ভিতরে বেশ কিছু বড় বড় কবি এবং উচ্চমানের সাহিত্যিক বর্তমান ছিল। এহেন প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের জওয়াব দানের জন্য ইসলাম বিরোধীরা এদের সকলের দ্বারেই ধর্ণা দিয়েছিল। কিন্তু তারা সকলেই তাদেরকে হতাশ করেছিল। তাদের কোন কবি কিংবা কোন সাহিত্যিক প্রতিভার পক্ষেই কোরআনের ছোট্ট একটি সূরার অনুরুপও কোন সূরা তৈরী করে দেয়া সম্ভব হয়েছিল না।

 

আল্লাহ তায়ালা ঘোষিত উক্ত চ্যালেঞ্জ শুধু ঐ সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং কোরআন অবতীর্ণের সময় হতে আরম্ভ করে কিয়ামত পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালব্যাপী কোরআন বিরোধীদের জন্য এটা একটি খোলা চ্যালেঞ্জ। আজও মিসর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশে আরবী বংশজাত বহু খৃস্টান ও ইহুদী পরিবার বর্তমান, যাদের মধ্যে আরবী ভাষার বড় বড় পন্ডিতও আছে। ইচ্ছা করলে তারাও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে পারে। হয়তো তারা তা করে দেখেছেও। কিন্তু পূর্ববর্তীদের ন্যায় তাদের ভাগ্যেও হতাশা ছাড়া আর কিছুই জুটবেনা।

 

যারা আরবী ভাষার পন্ডিত এবং যাদের মাতৃভাষা আরবী তারা এটা ভালভাবেই অনুধাবন করতে পারে যে, কোরআনের ভাষার সাথে মানব রচিত কোন আরবী পুস্তকের ভাষার তুলনাই হয় না। বরং নবী করীমের (স:) ভাষাও কোরআনের ভাষার ন্যায় উচ্চমানের ছিল না। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি যে সব কথাবার্তা বলেছেন, এমনকি নবুয়ত প্রাপ্তি পরও সাধারণভাবে নবী (স:) (ওয়াহী ব্যতীত) যেসব কথা বলতেন তাও ছিল কোরআনের ভাষা হতে নিম্নমানের। ওয়াহীর ভাষার সাথে তার কোন তুলনাই হতো না।

 

সুতরাং কোরআন যে আল্লাহর কিতাব, তার উচ্চাঙ্গের সাহিত্যিক মান, সুনিপুন শব্দ গঠন প্রণালী, অভিনব বাক্যবিন্যাস আর মর্মস্পর্শী সুরঝঙ্কার প্রভৃতিই তার অকাট্য প্রমাণ।

\r\n\r\n

দুইঃ কোরআনের আলোচ্য বিষয়সমূহ

 

কোরআনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের আলোচনা করা হয়েছে এবং যেসব দুরূহ সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়েছে। সেটাও কোরআনের ঐশী গ্রন্থ হওয়ার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। কেননা নবী করীম (স:) যে এলাকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে এলাকা ছিল তখনকার সভ্য জগতের বাইরে। কোন সুসংগঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাও যেমন সেখানে ছিল না, তেমনি কোন মার্জিত সভ্যতাও সেখানে গড়ে উঠেনি। দু একটি ছোটখাট শহর ব্যতীত আর সব এলাকার অধিবাসীরাই যাযাবর জীবন যাপন করতো। প্রতিটি গোত্রই আলাদা আলাদা গোত্রীয় শাসন অর্থাৎ গোত্র সর্দারের অনুশাসন মেনে চলত। কদাচিত এক-আধজন লোক সামান্য লেখাপড়া জানলেও কোথাও কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না।

 

এমন এক পরিবেশে জন্ম নিয়ে মুহাম্মদ (স:) শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন এতিমে পরিণত হন। ফলে তাঁর ভাগ্যে কোনরূপ লেখাপড়াই জোটেনি। যৌবনে সিরিয়ার দিকে দুটি সংক্ষিপ্ত বাণিজ্যিক সফর ব্যতীত কোন শিক্ষামূলক সফরও তিনি করেননি। কোন শিক্ষিত জ্ঞানী ব্যক্তির সাহচর্যও তিনি আদৌ পাননি।

 

এমতাবস্থায় এমন একজন উম্মি লোকেরে পক্ষে বহু বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বলিত কোরআনের মত একখানা গ্রন্থ রচনা করে পেশ করা যে আদৌ সম্ভব নয়, তা যে কোন সাধারণ জ্ঞানের লোকও অনুধাবন করতে পারে। সুতরাং কোরআনের আলোচ্য বিষয়সমূহই বলে দেয় যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব।

\r\n\r\n

তিন: প্রাগৈতিহাসিক ঘটনাবলীর যথাযথ বর্ণনা

 

পবিত্র কোরআনে এমন ঘটনাসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা ঘটেছিল ইতিহাস সৃ্ষ্টির বহু পূর্বে এবং যার সম্পর্কে ষষ্ঠ শতাব্দীর দুনিয়া বিশেষ কোন খোঁজ-খবর রাখত না। প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ ইহুদীদের ধর্ম গ্রন্থে ছিল বটে, তবে তার অধিকাংশই ছিল অতিরঞ্জিত ও বিকৃত। আবার কিছু কিছু ঘটনার চর্চা যদিও আরব এবং পাশ্ববর্তী এলাকার লোকদের ভিতরে ছিল কিন্তু তা ছিল একেবারেই অস্পষ্ট ও সন্দেহপূর্ণ। আবার এমন বহু ঘটনার বর্ণনা কোরআনে দেখা যায়, যার উল্লেখ না ছিল ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থে আর না ছিল তার চর্চা আরবদের ভিতরে।

 

পবিত্র কোরআন প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত অথচ এমন নিখুঁতাভাবে বর্ণনা করেছে যার সত্যতাকে আজ পর্যন্ত কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। বরং অধুনা প্রত্নতত্ত্ববিদের ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহের নব নব আবিষ্কার এর সত্যতাকে আরও সন্দেহাতীত করে তুলেছে।

 

হযরত আদম-হাওয়া (আ) বৃত্তান্ত, হযরত নূহের ঘটনা, হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসমাইল ও হযরত ইয়াকুবের (আ) কাহিনী, নমরুদ-ফেরাউনের প্রসঙ্গ, হযরত ইউসুফ ও হযরত ইয়াকুবের (আ) কাহিনী, আদ, সামুদ, তুব্বা ও সাবা ইত্যাদি জাতিসমূহের বৃত্তান্ত, জালুত ও হযরত দাউদের প্রসঙ্গ, জুকারনাইন, আছহাবে কাহাফ ও হযরত লোকমানের ঘটনা, হযরত সুলায়মান, হযরত জাকারিয়া, হযরত ইয়াহীয়া ও হযরত ঈসার (আ) বর্ণনাবলী ইত্যাদি এমন একজন উম্মি লোকের পক্ষে যিনি কোনদিন ইতিহাস-পুস্তকের একটি লাইনও পড়েননি, অথবা বিভিন্ন দেশে পর্যটক হিসেবে আদৌ সফর করেননি, নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা যে সম্ভব নয় তা যে কোন লোকই বুঝতে পারে। ইহার প্রমাণ স্বরূপ পবিত্র কোরআন হতে নিম্নে কয়েকটি ঘটনার উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে,

 

(ক) মহানবীর আবির্ভাবের হাজার হাজার বছর আগে এবং মানব সৃষ্টির কেবল অল্পকাল পরেই ছাহেবে শরীয়ত পয়গম্বর হযরত নূহের (আ) আগমন ঘটেছিল। পবিত্র কোরআনে সুরায়ে হুদে আল্লাহ রাব্বুল আলামী হযরত নূহের নবুয়ত প্রাপ্তি, কওমের নিকটে তাঁর দাওয়াত পেশ, কওম কর্তৃক উহা প্রত্যাখ্যান এবং নূহকে (আ) নানারূপ তকলীফ দান, দীর্ঘ চেষ্টা যত্নের পরে নিরাশ হয়ে কওমের ধ্বংসের জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাত, অবশেষে প্রলয়ঙ্করী প্লাবনে হযরত নূহ (আ) এবং তাঁর কতিপয় ঈমানদার সঙ্গী ব্যতীত বাকী সমগ্র মানব গোষ্ঠীর ধ্বংস সাধনের ঘটনাবলী বর্ণনা করার পরে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদকে (স) লক্ষ্য করে বলেন,

 

 ﴿تِلْكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهَا إِلَيْكَ ۖ مَا كُنتَ تَعْلَمُهَا أَنتَ وَلَا قَوْمُكَ مِن قَبْلِ هَٰذَا ۖ فَاصْبِرْ ۖ إِنَّ الْعَاقِبَةَ لِلْمُتَّقِينَ﴾

 

 এ হলো অজ্ঞাত অজানা ঘটনাবলী, যা আমি তোমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ এসব ঘটনা ইতিপূর্বে না তোমার জনা ছিল, না তোমার জাতির। সুতরাং অপেক্ষা করতে থাক অবশ্যই শেষ ফল পরহিজগারদের ভাগ্যে।” (সুরা হুদ, আয়াত-৪৯)

 

(খ) রাসূলের জন্মের প্রায় দু হাজার বছর আগে হযরত ইউসুফের (আ) জীবনে যে বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল, তার বর্ণনা দান প্রসঙ্গে রসূলের উপরে কোরআনের সুরায়ে ইউসুফ নামীয় দীর্ঘ সুরাটি অবতীর্ণ হয়। উক্ত ভাষ্যটিতে আল্লাহ তাঁর নবীকে হযরত ইউসুফের পূর্ণ জীবনের বিচিত্র কাহিনীগুলিকে সংক্ষেপে অতি চমৎকার ও নিখুঁরূপে ওয়াহীর মারফতে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

 

কেমন করে হযরত ইউসুফের ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে কূপে নিক্ষেপ করেছিল, কিভাবে তাঁকে বণিক কাফেলার লোকেরা তুলে নিয়ে মিশরের প্রধানমন্ত্রীর কাছে গোলাম হিসেবে বিক্রি করেছিল, তারপর মন্ত্রীর ভা*র ষড়যন্ত্রে কিভাবে তিনি কারাগারে আবদ্ধ হয়েছিলেন, পরে মিশর রাজের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করে কিরূপে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সেক্রেটারী ও প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োজিত হয়েছিলেন, অবশেষে পিতা-মাতা ও ভাই-ভগ্নিসহ তাঁর সমগ্র পরিবার কেমন করে কেনান হতে মিশরে এসেছিলেন, এর পূর্ণ বিবরণ সুরায়ে ইউসুফের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর ওয়াহী ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে এমন নিখুঁতভাবে জানানো যে সম্ভব হত না তার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,

 

 ﴿ذَٰلِكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ ۖ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ أَجْمَعُوا أَمْرَهُمْ وَهُمْ يَمْكُرُونَ﴾

 

”আর এসব হল অজানা ও অজ্ঞাত ঘটনাবলী যা ( হে নবী) তোমাকে আমি ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ ইউসুফের (আ) ভাইয়েরা যখন ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তাদের পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছিল, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না।” (সুরা ইউসুফ, আয়াত-১০২)

 

(গ) হযরত ঈসার (আ) জননী হযরত মরিয়মের মাতা হান্নাহ কর্তৃক গর্বস্থ সন্তানকে আল্লাহর রাহে বায়তুল মোকাদ্দাসের খেদমত ও দ্বীনের কাজের জন্য উৎসর্গকরণ, অতঃপর তাঁর নামকরণ ও তাঁকে বায়তুল মুকাদ্দাসের যাজকদের হাতে অর্পণ, কে তাঁর লালন-পালন করবে তা ঠিক করার উদ্দেশ্য কোরআর কলম নিক্ষেপ, আশ্চর্য ও অলৌকিক উপায়ে উক্ত কন্যার খাদ্য প্রাপ্তি, তারপর কন্যা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে হযরত জিরাঈলের (আ) তাঁকে সাক্ষাৎ দান ও সুসংবাদ প্রদান ইত্যাদি সম্পর্কীয় অজ্ঞাত কাহিনী বর্ণনা করার আল্লাহ তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে বলেন,

 

 ﴿ذَٰلِكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ ۚ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُونَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُونَ﴾

 

”এ হল অজ্ঞাত ঘটনাবলী, যা আমি (হে মুহাম্মদ) তোমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ তারা যখন (মরিয়মের লালন-পালনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য) ভাগ্য নির্ণয়ে কাঠি নিক্ষেপ করেছিল এবং পরস্পর তর্কে লিপ্ত ছিল, তখন তুমি সেখোনে উপস্থিত ছিলে না।” (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-৪৪)

 

(ঘ) রসূলের (স) জন্মের প্রায় এক হাজার আটশত বছর আগে আফ্রিকার মিসর দেশে হযরত সাঃ ও মিসর রাজা ফেরাউনের বিচিত্র ঘটনাবলী সংগঠিত হয়েছিল। হযরত মূসার ভূমিষ্ঠ হওয়া, তাকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া, ফেরাউনের স্ত্রী কর্তৃক তাকে উত্তোলন ও রাজ পরিবারে ব্যবস্থাপনায় তার লালন পালন, যৌবনে পদার্পণের পর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর ফাঁসির সিদ্ধান্ত, ভীত সন্ত্রস্ত মূসার (আ) দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মাদায়েনে পলায়ন, সেখানে হযরত সোয়াইবের কন্যান পানি গ্রহণ এবং দশ বছরকাল অবস্থান। অতঃপর পরিবার-পরিজনসহ মিশরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা, পথিমধ্যে সিনাই পর্বতের পবিত্র উপত্যকায় নবূয়ত ও ওয়াহী প্রাপ্তি, অবশেষে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত ও দাওয়াত পেশ, ফেরাউন ও তার জাতির সাথে দীর্ঘ দ্বন্ধ ও বিভিন্ন মোযেযা প্রদর্শন, অকৃতকার্য হয়ে কয়েক লক্ষ্য ইসরাইলীদের নিয়ে আল্লাহর আদেশে মিশর ত্যাগ ও ফিলিস্তিনের দিকে রওয়ানা, ফেরাউন ও তার ফওযের পশ্চাদনুসরণ, অতঃপর আল্লাহর অনুগ্রহ হযরত মূসা ও বনি ইসরাইলদের লোহিত সাগর অতিক্রম। ফেরাউনের ও তার লোক-লস্করের সলিল সমাধি, অতঃপর বিস্তীর্ণ সিনাই প্রান্তরে ইসরাইলদের দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাযাবর জীবন যাপন এবং সেখানকার বহু বিচিত্র ঘটনাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনা দান করার পরে আল্লাহ তার নবীকে লক্ষ্য করে বলেন,

 

 وَمَا كُنتَ بِجَانِبِ الْغَرْبِيِّ إِذْ قَضَيْنَا إِلَىٰ مُوسَى الْأَمْرَ وَمَا كُنتَ مِنَ الشَّاهِدِينَ ﴿٤٤﴾ وَلَـٰكِنَّا أَنشَأْنَا قُرُونًا فَتَطَاوَلَ عَلَيْهِمُ الْعُمُرُ ۚ وَمَا كُنتَ ثَاوِيًا فِي أَهْلِ مَدْيَنَ تَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِنَا وَلَـٰكِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ ﴿٤٥﴾ وَمَا كُنتَ بِجَانِبِ الطُّورِ إِذْ نَادَيْنَا وَلَـٰكِن رَّحْمَةً مِّن رَّبِّكَ لِتُنذِرَ قَوْمًا مَّا أَتَاهُم مِّن نَّذِيرٍ مِّن قَبْلِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ ﴿٤٦﴾

 

”সিনাই (তুর) পর্বতের পশ্চিম প্রান্তে মুসাকে (আ) যখন আমি আমার নির্দেশনাবলী দিয়েছিলাম, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না। আর প্রকৃত ব্যাপার হল এই যে, জগতে আমি বহু জাতি সৃষ্টি করেছিলাম, যাদের সৃষ্টির পরে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। আর তুমি (হে মুহাম্মদ (স) তৎকালে মাদায়েন নগরের অধিবাসীদের সাথেও বসবাস করতেন না যে, আমার (সেই সময় সংঘটিত) নিদর্শনাবলীর কথা তাদেরকে বলবে। বরং আমি রসূল প্রেরণ করে থাকি (যাদের কাছে অতীত ঘটনা ওয়াহীর মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়)। আর যখন আমি মুসাকে তুর পাহাড়ের পাদদেশে আহবান করেছিলাম, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না। বরং ইহা হল তোমার প্রভুর পক্ষ হতে রহমত (ওয়াহী) যাতে করে তুমি এমন একটি জাতিকে ভীতি প্রদর্শন করতে পার যাদের কাছে ইতিপূর্বে কোন ভীতি প্রদর্শনকারী (পয়গম্বর) আসেনি। আর এইভাবেই হয়ত তারা উপদেশ গ্রহণ করবে।” (সুরা কাসাস, আয়াত-৪৪-৪৬)

 

(ঞ) অনুরূপভাবে পবিত্র কোরআনের সুরা ত্বহায় মহাজ্ঞানী আল্লাহ হযরত মুসার (আ) জন্ম ও লালন-পালন থেকে আরম্ভ করে তার যৌবন প্রাপ্তি, মাদায়েনে পলায়ন, নবুয়ত প্রাপ্তি, হারুন (আ) সহ মিশর রাজ ফেরাউনের কাছে দাওয়াতত পেশ, বিভিন্ন মোজেজা প্রদর্শন ও ফেরাউনের সাথে দীর্ঘ দ্বন্ধ। অতঃপর ফিলিস্তিনের দিকে হিজরত। আল্লাহ তায়ালার অলৌকিক মহিমায় কয়েক লক্ষ লোকসহ লোহিত সাগর অতিক্রম। অতঃপর মুসার তুর পাহাড়ে গমন এবং খোনে শরীয়িত প্রাপ্তি ইত্যাতি ঘটনা বর্ণনা করার পরে আল্লাহ তাঁ প্রিয় নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

 

 كَذَٰلِكَ نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنبَاءِ مَا قَدْ سَبَقَ ۚ وَقَدْ آتَيْنَاكَ مِن لَّدُنَّا ذِكْرًا ﴿٩٩﴾

 

”এভাবেই আমি আপনার কাছে অতীত ঘটনাবলী বর্ণনা করছি। আর অবশ্যই আমি আপনাকে নিজের নিকট হতে একটি উপদেশনামা দিয়েছি।” (সুরা তাহা আয়াত-৯৯)

 

সুতরাং একথা একন জোর করে বলা জলে যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের এসব ঘটনাবলী সেই মহান সত্তাই বর্ণা করেছেন, যিনি ইতিহাস সৃষ্টি পূর্বে ছিলেন, এখনও আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। কারণ কোরআন তাঁরই শ্বাশতবাণী আর তিনিই উক্ত ঘটনাবলী নবীর কাছে ওয়াহী মারফত বর্ণনা করেছেন।

\r\n\r\n

চার: ভবিষ্যত ঘটনাবলী সম্পর্কে সংবাদ দান

 

কোরআন শরীফে এমন বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা সংঘটিত হওয়ার বহু পূর্বেই আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে রসূলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। নিম্নে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে,

 

(ক) ভবিষ্যদ্বানী সম্পর্কীয় এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা আমরা দেখতে পাই পবিত্র কোরআনের সুরায়ে রোমের প্রথমে। রসুলেন হিজরতের প্রায় সাত বছর আগে মক্কা শরীফে এ সুরাটি অবতীর্ণ হয়। সুরার প্রথমে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস কর্তৃক পারস্য সম্রাট খসরুকে পরাজিত করার ভবিষ্যদ্বানী। ঘটনাটি ঘটার প্রায় নয় বছর পূর্বে আল্লাহর নবী ওয়াহীর মাধ্যমে এ খবর শুনিয়ে দিয়েছিলেন। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:

 

ইসলামের অভ্যত্থানের সামান্য আগে সারা পৃথিবীতে দুটি রাষ্ট্রই ছিল বৃহৎ ও শক্তিশালী। আর এদের সীমানাও ছিল পরস্পর সন্নিহিত। এর একটি হল পারস্য সাম্রাজ্য এবং অপরটি হল রোম সাম্রাজ্য। দুনিয়ার অপরাপর ছোট-খাট রাষ্ট্র ছিল এদের প্রভাবাধীন। এ দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিতরে প্রায়ই যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকতো। ৬১৫ খৃষ্টাব্দে রসূলের (স) হিজরতের সাত বছর পূর্বে পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরুর সেনাবাহিনীর হাতে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বাহিনী ভীষণভাবে পরাজিত হয়। পারসিয়ানরা জেরুজালেমস্থ রোমদের পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করে দিয়ে খৃস্টানদের পবিত্র ক্রুশ নিয়ে যায়। এ যুদ্ধে সম্রাট তার গোটা এশিয়ান এলাকাই হারিয়ে কনস্ট্যান্টিনোপলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আর এ সংঘর্ষে রোমক শক্তি এমনভাবে পর‌্যুদস্ত হয়েছিল যে, দুর ভবিষ্যতেও তার পুনরুত্থানের কোন সম্ভাবনাই পরিলক্ষিত হচ্ছিল না।

 

পারস্য সম্রাটের এ বিজয়ের খবর যখন মক্কায় পৌঁছে তখন ছিল নবুয়তের পঞ্চম বর্ষ। পারসিয়ানরা পৌত্তলিক হওয়ার কারণে এ বিজয়ের সংবাদে মক্কার পৌত্তলিকেরাও বিশেষভাবে উৎফুল্ল হয়েছিল এবং মুসলমানদের এ বলে তারা বিদ্রুপ করছিল যে, যেভাবে আহলে কিতাব খৃস্টানরাজ রোম সম্রাট পৌত্তলিক পারসিয়ান সম্রাটের হাতে পর্যুদস্ত ও পরাভূত হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে কিতাবধারী মুহম্মদ (স) এবং তাঁর অনুসারীরাও পৌত্তলিক কোরায়েশদের হাতে পর্যুদস্তু হবে। মোট কথা উক্ত ঘটনাকে মুশরিকগণ মুসলামানদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয়ের একটি শুভ ইঙ্গিত বলে দাবী করছিল।

 

আর প্রকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, এই যুদ্ধের সূচনা হতেই পৌত্তলিক কোরায়েশদের মানসিক সমর্থন ছিল পারসিয়ানদের পক্ষে। আর রোমকরা আহলে কিতাব হওয়ার কারণে মুসলমানদের সমর্থন ছিল রোমকেদের পক্ষে। অতঃপর পারসিয়ানদের বিজয় সংবাদে মক্কার পৌত্তলিকরা যখন বিজয়োৎসব করছিল, তখন রোমকদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করে আল্লাহ তার নবীর উপরে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন,

 

 الم ﴿١﴾ غُلِبَتِ الرُّومُ ﴿٢﴾ فِي أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُم مِّن بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ ﴿٣﴾ فِي بِضْعِ سِنِينَ ۗ لِلَّـهِ الْأَمْرُ مِن قَبْلُ وَمِن بَعْدُ ۚ وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ ﴿٤﴾ بِنَصْرِ اللَّـهِ ۚ يَنصُرُ مَن يَشَاءُ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ ﴿٥﴾

 

”রোমানরা আরবদের নিকটবর্তী ভূ-খন্ডে পরাজয়বরণ করেছে। অতঃপর তারা দশ বছরেরও কম সময়ের ভিতরে বিজয় লাভ করবে। প্রকৃতপক্ষে প্রথমাবস্থায়ও (পরাজয়কালে) যেমন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিল আল্লাহ্‌, তেমনি পরবর্তীকালেও (চিরকাল) চুড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী তিনিই। আর সেদিন (রোমকদের বিজয়কালে) মুসলমানেরা আল্লাহ তায়ালার সাহয্যপ্রাপ্ত হয়ে আনন্দোৎসব করবে।” (সুরা রুম আয়াত ১-৫)

 

আল্লাহ তায়ালাম উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বানী রসূল (স) যখন পাঠ করে শুনালেন, তখন মক্কার মুশরিকেরা এ নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ শুরু করে দিল। কেননা রোমান শক্তি পারসিয়ানদের হাতে এমনভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল যে, তাদের পক্ষে পুনরায় একটি বৃহত্তর শক্তি হিসেবে দাঁড়াবার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না।

 

এমনাবস্থায় এ ধরনের একটি পর্যুস্ত শক্তি মাত্র দশ বছরেরও কম সময়ের ভিতরে একটি বৃহত্তর শক্তিকে পুনর্গঠিত হয়ে বিজয়ী পারসিয়ানদেরকে পরাভূত করবে, এটাকে কল্পনা বিলাসীর কল্পনা বলেই মনে হত।

 

তাছাড়াও উপরোক্ত আয়াতগুলোর ভিতরে আল্লাহ ক্ষুদ্র এবং দুর্বল মুসলিম জামাতকেও অনুরূপ সময়কালেন চিতরে তাদের শক্তিশলিী দুশমনদের উপরে বিজয় লাখের সংবাদ দিয়েছিলেন আর এটা ছিল বাহ্যিক দৃষ্টিতে একেবারেই অসম্ভব।

 

কিন্তু সমগ্র বিশ্বকে আশ্চর্য করে পরাজয়ের মাত্র নয় বছর পর ৬২৪ খৃষ্টাব্ধে পুনর্গঠিত রোমান শক্তি পারসিয়ানদের কাছ থেকে শুধু তাদের এশিয়ার হারানো এলাকাই উদ্ধার করল না বরং মূল পারস্য ভূ খন্ডে পারস্য বাহিনীকে চরম পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করল। আর ওই সময়ই বদরের ময়দানে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী কর্তৃক কোরায়েশদের বিরাট বাহিনী সম্পূর্ন পর্যুদস্ত হল। ফলে কোরআনের ভবিষ্যদ্বানী অক্ষরে অক্ষরে ফলতে দেখে যেমন মুসলমানরা আনন্দিত হয়েছিল, তেমনি মুশরিকরাও ক্ষোভে ও দুঃখে যথেষ্ট মর্মাহত হয়েছিল, তেমনি মুশরিকরাও ক্ষোভে ও দুঃখে যথেষ্ট মর্মাহত হয়েছিল।

 

কোরআন মহান আল্লাহর কালাম বলেই তার পক্ষেই এই ধরনের নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব ছিল। কেননা আল্লাহর কাছে অতীত ও ভবিষ্যৎ বর্তমানের ন্যায়।

 

(খ) অনুরূপ ভবিষ্যৎবাণী সম্পর্কীয় আর একটি ঘটনা আমরা দেখতে পাই সুরায়ে হাশরে। হিজরী পঞ্চম বছরে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মুশরিকদের সম্মিলিত বিরাহ বাহিনী মদীনায় চড়াও হয়ে চতুর্দিক হতে মদীনাকে অবরোধ করে ফেলল। মদীনার ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের এই মর্মে চুক্তি ছিল যে, কোন বিদেশী শক্তি ‍যদি মদীনা আক্রমণ করে, তাহলে তারাও মুসলমানদের সাথে মিলে উক্ত শক্তির বিরুদ্ধে লড়বে। কিন্তু খন্দক যুদ্ধে যখন মুশরিকরা এসে মদীনা আক্রমণ করল, তখন ইহুদীরা উক্ত চুক্তির কোর পরওয়া না করে মুশরিকদের পক্ষই অবলম্বন করল। অতঃপর যুদ্ধে যখন সুবিধা না করতে পেরে মুশরিকরা অবরোধ উঠিয়ে চলে গেল, তখন ইহুদীরা তাদের এ কৃতকর্মের জন্য প্রমাদ গুনলো। আর মুসলমানরা যে এরপর ঘরের শত্রুকে বরদাস্ত করবে না, তা তারা উপলব্ধি করে যথেষ্ট ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। ঠিক এই সময়ে মদীনার মুনাফেকরা ইহুদীদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল যে, মুসলমানেরা তাদেরকে যদি আক্রমন করে, তাহলে তারা তাদেরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে, এমনকি যদি মুসলমানেরা ইহুদীদের মদীনা হতে বের করেও দেয়, তাহলে তারাও তাদের সাথে মদীনা ত্যাগ করে চলে যাবে।

 

মুনাফেকরা যে তাদের এ ওয়াদা পালন করবে না পূর্বাহ্নেই আল্লাহ নিম্নের আয়াত দ্বারা নবীকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন,

 

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ نَافَقُوا يَقُولُونَ لِإِخْوَانِهِمُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَئِنْ أُخْرِجْتُمْ لَنَخْرُجَنَّ مَعَكُمْ وَلَا نُطِيعُ فِيكُمْ أَحَدًا أَبَدًا وَإِن قُوتِلْتُمْ لَنَنصُرَنَّكُمْ وَاللَّـهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ ﴿١١﴾ لَئِنْ أُخْرِجُوا لَا يَخْرُجُونَ مَعَهُمْ وَلَئِن قُوتِلُوا لَا يَنصُرُونَهُمْ وَلَئِن نَّصَرُوهُمْ لَيُوَلُّنَّ الْأَدْبَارَ ثُمَّ لَا يُنصَرُونَ ﴿١٢﴾

 

”হে রাসূল (স) আপনি কি মুনাফেকদের সম্পর্কে অবগত আছেন, যারা তাদের আহলে কিতাব কাফের ভাইদেরকে বলছে- “আল্লাহর শপথ! যদি তোমাদেরকে (মদীনা হতে) বের করে দেয়া হয়, তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে বের হয়ে যাব এবং তোমাদের ব্যাপারে আমরা আদৌ কারও কথা শুনব না। আর যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা তোমাদের সাহায্য করব।” আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফেকরা (তাদের দাবীতে) একেবারেই মিথ্যাবাদী। যদি ইহুদীদের বের করে দেয়া হয়, তাহলে এরা তাদের সাথে বের হয়ে যাবে না। আর যদি তাদের সাথে যুদ্ধ হয়, তাহলে মুনাফেকরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না।” (সুরা হাশর আয়াত-১১-১২)

 

ইতিহাস সাক্ষী পরবর্তী পর্যায়ে যখন ইহুদীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও চুক্তি ভঙ্গের কারণে তাদেরকে অবরোধ করা হল, তখন মুনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গী তাদের সাহায্যের জন্য আদৌ এগিয়ে আসেনি। অতঃপর যখন মদীনার নিরাপত্তার খাতিরে ইহুদীদেরকে মদীনা হতে বের করে দেয়া হল, তখনও মুনাফেকরা তাদের সাথে বের হয়ে যায়নি। আর এভাবেই কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছিল।

 

(গ) এই ধরনের আর একটি ঘটনার উল্লেখ আছে সুরা বাকারায়। নবী করিম (সাঃ) মদীনায় হিযরত করার পরে প্রায় বছরকাল বায়তুল মোকাদ্দেসকে কেবলা করে নামায আদায় করেন। অতঃপর হিজরী ‍দ্বিতীয় বর্ষে কাবা শরীফকে কেবলা করে আয়াত অবতীর্ণ হয়। কেবলা পরিবর্তনের পরে মুনাফেক, ইহুদী তথা ইসলামী বিরোধীদের ভিতরে তার কি প্রতিক্রিয়া হবে এবং তারা কি বলে প্রপাগান্ডা করবে, আল্লাহ আগে-ভাগেই তা ওয়াহীর মাধ্যমে রসূলকে জানিয়ে দিয়েছেলেন,

 

 سَيَقُولُ السُّفَهَاءُ مِنَ النَّاسِ مَا وَلَّاهُمْ عَن قِبْلَتِهِمُ الَّتِي كَانُوا عَلَيْهَا ۚ قُل لِّلَّـهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ ۚ يَهْدِي مَن يَشَاءُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ ﴿١٤٢﴾

 

“শীঘ্রই নির্বোধ লোকেরা বলবে,” যে কেবলার দিকে মুখ করে তাঁরা এতদিন নামায পড়েছে, কি কারণে তাঁরা সেটা হতে ফেরত গেল।” হে নবী, আপনি বলে দিন, পূর্ব-পশ্চিম সব দিকই আল্লাহর। তিনি যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন।” (সুরা বাকারা আয়াত-১৪২)

 

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা মুনাফেক ও ইহুদীরা কেবলা পরিবর্তনের পরে কি ধরনের প্রপাগান্ডা করবে তা পূর্বাহ্নেই নবীকে (স) জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।

 

(ঘ) ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কীয় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমরা সুরায়ে তওবার একাদশ রুকুতে দেখতে পাই। নবম হিজরীতে নবী করীম (স) খবর পেলেন যে, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদীনা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এই উদ্দেশ্যে সিরিয়া ও হেজাজ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে। হুজুর (স) এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই গোটা মুসলিম বাহিনী নিয়ে হেজাজ সীমান্তেই তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। আর যুদ্ধক্ষম প্রতিটি মুসলিমকেই হুকুম দিলেন যে, সকলকেই এ যুদ্ধে শরীক হতে হবে। কেউ বাড়ী থাকতে পারবে না।

 

মদীনায় কিছু সংখ্যক মুনাফেক ছিল, তারা যে যুদ্ধে মুসলমানদের নিশ্চিত বিজয়ের সম্ভাবনা থাকত কেবলে সেগুলিতেই শরীক হত। আর যে যুদ্ধে সম্ভাবনা থাকত না টালবাহানা করে সেগুলো হতে বিরত থাকত।

 

তাবুক অভিযান ছিল এমন একটি শক্তির বিরুদ্ধে যে শক্তিটি তখনকার দুণিয়ায় এক নম্বর শক্তি হিসেবে বিবেচিত হত। তাই মুনাফেকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় অনিবার্য। এছাড়াও তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। মরুভূমিতে প্রচন্ড বেগে লু-হাওয়া বইতেছিল। এমতাবস্থায় মদীনা হতে তাবুক পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশত মাইল পথ অতিক্রম করে এক শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া তাদের কাছে ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামিল। সুতরাং তারা নানারূপ টালবাহানা করে মদীনায় থেকে গেল।

 

অতঃপর অভিযান শেষে নবী করীম (স) যখন মদীনার দিকে রওয়ানা হলেন, তখন পথিমধ্যেই আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে একদিকে যেমন মুনাফেকদের গোপন দুরভিসন্ধির কথা হুজুরকে জানিয়ে দিলেন, অন্যদিকে তেমনি হুজুরের মদীনা প্রত্যাবর্তনের পরে তারা শাস্তির হতে বাঁচার জন্য যে, সব মিথ্যা ওজর পেশ করবে তারও আগাম সংবাদ নবীকে দিয়ে দিলেন,

 

 يَعْتَذِرُونَ إِلَيْكُمْ إِذَا رَجَعْتُمْ إِلَيْهِمْ ۚ قُل لَّا تَعْتَذِرُوا لَن نُّؤْمِنَ لَكُمْ قَدْ نَبَّأَنَا اللَّـهُ مِنْ أَخْبَارِكُمْ ۚ وَسَيَرَى اللَّـهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَىٰ عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿٩٤﴾

 

“হে রসূল, আপনারা যখন মদীনায় মুনাফেকদের কাছে ফিরে যাবেন, তখন তারা ওজর পেশ করবে। আপনি বলুন, তোমাদের ওজর পেশ করার কোন প্রয়োজন নাই। আমরা আর তোমাদের কথা বিশ্বাস করছি না। আল্লাহ (পূর্বাহ্নেই) তোমাদের বিষয় আমাদেরকে অবগত করিয়ে দিয়েছেন।” (সুরা তওবা আয়াত-৯৪)

 

অতঃপর আল্লাহ নবীকে আরও জানিয়ে দিচ্ছেন,

 

سَيَحْلِفُونَ بِاللَّـهِ لَكُمْ إِذَا انقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ لِتُعْرِضُوا عَنْهُمْ ۖ فَأَعْرِضُوا عَنْهُمْ ۖ إِنَّهُمْ رِجْسٌ ۖ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ﴿٩٥﴾

 

“আপনারা যখন (মদীনায়) এদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবেন, তখন এই মুনাফেকরা আপনাদের কাছে এসে আল্লাহর নামে শপথ করবে। যেন আপনারা তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন। আচ্ছা, আপনারা এদেরকে ছেড়ে ‍দিন, এরা এদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ জাহান্নাম ভোগ করবে।” (সুরা তওবা আয়াত-৯৫)

 

يَحْلِفُونَ لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ ۖ فَإِن تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللَّـهَ لَا يَرْضَىٰ عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ ﴿٩٦﴾

 

এরা আপনাদের কাছে এ জন্যই শপথ করবে, যেন আপনারা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। মনে রাখবেন, আপনারা এদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ এসব পাপীদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না।” (সুরা তওবা, আয়াত-৯৬)

 

উপরোক্ত আলোচনায় মাত্র কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করা হল, যার প্রতিটিই হুবহু সত্যে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়াও বহু ভবিষ্যদ্বাণী পবিত্র কোরআনে দেখা যায়, যা ইতিপূর্বেই বাস্তবায়িত হয়েছে।

 

এতদ্ব্যতীত হাশর-নাশর, পরকাল-পুনরুত্থান হিসাব-নিকাশ, বেহেশত-দোযখ ইত্যাদি সম্পর্কীয় অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে যা প্রতিফলিত হওয়ার সময় এখনও আসেনি। এসব নিখুঁত ভবিষ্যদ্বানী নিশ্চয়ই এ কথা প্রমাণ করে যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব, কেননা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ভবিষ্যতের জ্ঞান রাখে না।

\r\n\r\n

পাঁচ: মানব জীবনের জন্য সূদুর প্রসারী ও মৌলিক ব্যবস্থা দান

 

কোরআন মানব জীবনের বিভিন্ন ‍দিক সম্পর্কে যে সমস্ত সুসামঞ্জস্য, সুপরিকল্পিতও সূদুরপ্রসারী ব্যবস্থা দান করেছে, তাও কোরআনের ঐশীগ্রন্থ হওয়ার একটি জাজ্জল্যমান প্রমাণ।

 

কোরআনের এসব চমৎকার বিধানবলীর প্রশংসা করতে গিয়ে প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত স্যার ডায়মন্ডবার্স লিখেছেন,

 

“কোরআনের বিধানবলী শাহানশাহ থেকে আরম্ভ করে পর্ণকুটীরের অধিবাসী পর্যন্ত সকলের জন্যই সমান উপযোগী ও কল্যাণকর। দুনিয়ার জন্য কোন ব্যবস্থায় এর বিকল্প খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।”

 

ডক্টর অসওয়েল জনসন বলেন,

 

“কোরআনের প্রজ্ঞাপূর্ণ বিধানবলী এতই কার্যকরী এবং সর্বকালের উপযোগী যে, সর্বযুগের দাবীই উহা পূরণ করতে সক্ষম। কর্ম-কোলাহলপূর্ণ নগরী, মুখর জনপদ, শূণ্য মরুভূমি এবং দেশ হতে দেশান্তর পর্যন্ত সব জায়গায় এ বাণী সমভাবে ধ্বনিত হতে দেখা যায়।”

 

গীবন বলেন,

 

“জীবনের প্রতিটি শাখার কার্যকরী বিধান কোরআন মওজুদ রয়েছে”

 

বিবাহ-তালাক সম্পর্কীয় যাবতীয় বিধান, উত্তরাধিকার সম্পর্কীয় ব্যবস্থাবলী, রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক মূলনীতিসমূহ, যুদ্ধ-সন্ধি সম্পর্কীয় নিয়ম কানুন ইত্যাদি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব। কেননা যে নবীর মুখ থেকে আমরা এ কিতাব পেয়েছি তিনি ছিলেন উম্মি। সুতরাং তিনি কোন আইনের কিতাবও অধ্যয়ন করেননি, কিংবা কোন আইনজ্ঞের কাছে কোন পাঠও গ্রহণ করেননি। কাজেই নবী না হলে তাঁর পক্ষে এ ধরনের চমৎকার বিধানবলী পেশ করা সম্ভব ছিল না।

\r\n\r\n

ছয়: বিশ্বলোক ও উর্দ্ধজগত সম্পর্কে নির্ভুল তথ্যের বর্ণনা দান

 

পবিত্র কোরআনে বহু জায়গায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে আল্লাহর অসীম কুদরতের বর্ণনা দান করতে গিয়ে উর্ধ্বর্লোক, ভুমণ্ডল এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যে সব তথ্যে অবতারণা করা হয়েছে, বিজ্ঞানের উন্নতি বিভিন্ন পর্যায় তার বাস্তবতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিম্নে তার কয়েকটি নমুনা পেশ করা হচ্ছে,

 

(ক) মহাশুন্যে বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ যে একটি অপরটিকে আকর্ষণ করে এবং এরই ফলে যে এরা শূণ্যে ভেসে রয়েছে, ১৯৬৫ খৃষ্টাব্দে নিউটনের মধ্যাকর্ষণ থিওরী আবিষ্কারের পূর্বে জগদ্বাসী এর বিশেষ কোন খবর রাখত না। কিন্তু নিউটনের জন্মের প্রায় হাজার বছর আগে এ তথ্য আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে তাঁর নবীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। নিম্নে এ সম্পর্কীয় আয়াত উদ্ধৃত করা হচ্ছে,

 

وَمِنْ آيَاتِهِ أَن تَقُومَ السَّمَاءُ وَالْأَرْضُ بِأَمْرِهِ ۚ ثُمَّ إِذَا دَعَاكُمْ دَعْوَةً مِّنَ الْأَرْضِ إِذَا أَنتُمْ تَخْرُجُونَ ﴿٢٥﴾

 

“এবং আল্লাহ তায়ালার মহা নিদর্শনাবলীর মধ্যে এটাও একটি যে উর্দ্ধলোক ও ভূমন্ডল তারই আমর দ্বারা মহাশূণ্যে প্রতিষ্ঠিত।” (সুরা রুম, আয়াত-২৫)

 

যে মহাশক্তি বলে উর্দ্ধলোকের যাবতীয় বস্তু এবং ভূ মন্ডল শূণ্যে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তাকে আয়াতে “আমরুল্লাহ” বলা হয়েছে। আর সেটাই হচ্ছে নিউটনের আবিস্কৃত মধ্যাকর্ষণ শক্তি।

 

 وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ ﴿١٢﴾

 

“আর সমস্ত নক্ষত্ররাজি তারই আমর দ্বারা বাঁধা (নিয়ন্ত্রিত)। নিশ্চয়ই এর ভিতরে বিজ্ঞ লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সুরা নাহল, আয়াত-১২)

 

উপরোক্ত আয়াতে আমর দ্বারা সেই মহা আকর্ষণ শক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যার আকর্ষণ শক্তি বলে মহাশূণ্য নক্ষত্ররাজি বিক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে পড়ছেনা।

 

إِنَّ اللَّـهَ يُمْسِكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ أَن تَزُولَا ۚ وَلَئِن زَالَتَا إِنْ أَمْسَكَهُمَا مِنْ أَحَدٍ مِّن بَعْدِهِ ۚ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا ﴿٤١﴾

 

নিশ্চয় আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূ মণ্ডলকে এমনভাবে ধারণ করে রেখেছেন যার ফলে উহা বিচ্ছিন্ন হয়ে পতিত হয় না।” (সুরা ফাতের, আয়াত-৪১)

 

বর্ণিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালার ধারণ শক্তি হল নিউটনের আবিষ্কৃত মধ্যাকর্ষণ শক্তি।

 

যদিও খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গ্রীক বিজ্ঞানী টলেমী পৃথিবীর গোলাকৃতি এবং মহাশূন্যে সেটা ঝুলে থাকার তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু কোন শক্তি বলে তা ঝুলে রয়েছে, তার যেমন তিনি সন্ধান দিতে পারেননি, তেমনি তিনি পৃথিবীর গতি সম্পর্কেও কোন খবর দিতে পারেননি।

 

(খ) সৃষ্টির ব্যাপারে বিশ্বের সর্বত্রই যে আল্লাহ তায়ালা দ্বৈত ও জোড়া পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, ফরাসী পদার্থ বিজ্ঞানী দ্য-ব্রগলী ১৯১৫ সনে এই আশ্চর্য দ্বৈতরূপের প্রতি ইঙ্গিত করেন। তার মতে প্রকৃতির সর্বত্র যে দ্বৈতভাব বিরাজ করছে, আলোর দ্বৈতধর্ম তারই একটি দিক মাত্র। অথচ দ্য-ব্রগলীর প্রায় তের শত বছর পূর্বে এই দ্বৈত ভাবের কথা কোরআনের মাধ্যমে মানুষকে জানানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

سُبْحَانَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُونَ ﴿٣٦﴾

 

“ বড়ই মহিমান্বিত সেই সত্ত্বা যিনি দ্বৈতরূপে সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। যা কিছু ভূমি হতে ও তাদের (মানুষের) ভিতর হতে জন্মে এবং এমন বস্তু হতে জন্মে যার খবর তারা রাখেনা।” (সুরা ইয়াসিন, আয়াত-৩৬)

 

وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا ﴿٨﴾

 

“এবং আমি তোমাদেরকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি।” (সুরা নাবা, আয়াত-৮)

 

(গ) চন্দ্র সূর্যসহ বিশ্বের সবকিছুই যে অবিরতভাবে গতিশীল, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন ও আইনিস্টাইন প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের জন্মের বহু পূর্বে কোরআন এ কথা ঘোষণা করেছে,

 

 وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ۚ ذَٰلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ ﴿٣٨﴾ وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّىٰ عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ ﴿٣٩﴾ لَا الشَّمْسُ يَنبَغِي لَهَا أَن تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ ۚ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ ﴿٤٠﴾

 

“সূর্য তার গন্তব্যস্থলের দিকে চলছে। আর এ হল তাঁরই ব্যবস্থাপনা যিনি মহা-পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী। আর চন্দ্রের জন্যও আমি তার মনজিল ঠিক করে দিয়েছি, এমনকি এক সময় উহা পুরান খেজুর শাখের রূপ ধারণ করে। সূর্যের যেমন শক্তি নেই চন্দ্রকে ধরে ফেলার, রাতেরও তেমনি ক্ষমতা নেই দিনকে অতিক্রম করার। আর প্রত্যেকেই মহাশূন্যে সাঁতার কাটছে।” (সুরা ইয়াসীন, আয়াত-৩৮-৪০)

 

 ﴾ وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ ﴿٣٣﴾

 

“তিনিই সৃষ্টি করেছেন দিন ও রাতকে, সূর্য ও চন্দ্র তাঁরই সৃষ্টি। আর সকলেই মহাশূন্যে সাঁতার কাটছে।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৩৩)

 

এবার এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথা শুনুন,

 

“বিশ্বে গতিহীন স্থির কোন কাঠামো নেই। বিশ্ব গতিশীল, নক্ষত্র, নীহারীকা-জগত এবং বহির্বিশ্বের বিরাট মধ্যাকর্ষণীয় জগত সমস্তই অবিরামভাবে গতিশীল।”

 

এ সম্পর্কে স্যার আইজাক নিউটনের মত হলো নিম্নরূপ:

 

“পৌরনীতি প্রবর্তনের সময় সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি বস্তুকে তার অক্ষের উপর প্রদক্ষিণ করার ব্যবস্থা করেন।”

 

(ঘ) সৃষ্টির প্রথমাবস্থায় নক্ষত্র, নীহারিকা ও সৌরজগত যে পরস্পর সংযু্ক্ত ও অবিচ্ছিন্ন ছিল বিজ্ঞানীদের বহু পূর্বে কোরআন আমাদেরকে তার সন্ধান দিয়েছে,

 

 أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا ۖ وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ ۖ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ ﴿٣٠﴾

 

“যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে, তারা কি ইহা অবলোকন করে না যে, আদিতে আকাশ মণ্ডলী ও ভূ-মণ্ডল পরস্পর সংযুক্ত ছিল। অতঃপর আমি উহাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৩০)

 

বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে বেলজিয়াম বিশ্বতত্ত্ববিদ আথেল্য মেতরের কথা হল এই যে,“একটি বিরাটাকায় আদিম অনু হতেই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। অণুটি কালক্রমে বিদীর্ণ হয়ে যায় এবং তার নানা অংশ নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে।”

 

(*********)

 

সম্প্রতি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জর্জ গ্যামো বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্ক নিম্ন লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন,

 

“আদিতে বিশ্বের কেন্দ্র সমজাতীয় আদিম বাষ্পের একটা জ্বলন্ত নরককুন্ড ছিল- ক্রমে ক্রমে এই মহাজাগতিক ভর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে এবং বিভিন্ন অংশের তাপমাত্রা ক্রমেই কমতে থাকে।”

 

উপরোক্ত দু জন খ্যাতনাম বিজ্ঞানীদের মতের সাথে উপরে বর্ণিত ঘোষনাটির আশ্চর্য সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

 

(ঙ) মহাবিশ্বের সৌরজগৎসহ বিভিন্ন জগতের সময়কাল ও দিবা-রাত্রি পরিমাণ যে এক নয়, বর্তমান বিজ্ঞানের অনেক আগে কোরআন এর ইঙ্গিত দিয়েছে,

 

يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ أَلْفَ سَنَةٍ مِّمَّا تَعُدُّونَ ﴿٥﴾

 

“সে মহান সত্ত্বাই আকাশ হতে ভূমণ্ডল পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়গুলোর তদারক করেন। অতঃপর এমন একদিনে সবকিছুই তার নিকট ফিরে আসবে, যে দিনটির সময়কাল হবে তোমাদের গণনা মোতাবেক হাজার বছর।” (সুরা সাজদা, আয়াত-৫)

 

কোরআন অবতীর্ণ হবার সময় কালের এ ব্যবধানটি বোধগম্য না হলেও বর্তমান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তা মানুষের কাছে সহজ ও বোধগম্য করে দিয়েছে।

 

এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তি হল নিম্নরূপ,

 

“প্রত্যেক জগতের একটি নিজস্বকাল আছে। জগতের উল্লেখ না করে কোন ঘটনার কালের উল্লেখের কোন অর্থই হয় না। প্রত্যেক জগতের গতিবেগ অনুসারে স্থান ও কালের পরিবর্তন ঘটে।”

 

বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন,লিংকন বেমিট।

 

সুতরাং আল্লাহ যদি কিয়ামতের দিন আমাদের হিসাব-নিকাশের ব্যবস্থা এমন একটি জগতে করেন, যে জগতকে আলোকিত করবে এমন একটি গ্রহ যে গ্রহকে কেন্দ্র করে উক্ত জগতটি তার অক্ষের উপরে আমাদের পৃথিবীর হাজার বছরে একবার মাত্র ঘুরে আসবে; আর এরই ফলে সেখানকার একদিনের পরিমাণ হবে আমাদের পৃথিবীর হাজার বছরের সমান, তাহলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?

 

(চ) পবিত্র কোরআনের অন্য এক স্থানে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নৈপুণ্যের বর্ণনা দান প্রসঙ্গে বলেন,

 

﴾ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا ۖ مَّا تَرَىٰ فِي خَلْقِ الرَّحْمَـٰنِ مِن تَفَاوُتٍ ۖ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَىٰ مِن فُطُورٍ ﴿٣﴾ ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ ﴿٤﴾

 

“সেই মহান সত্ত্বাই সাত আসমানকে স্তরে স্তরে তৈরী করেছেন। তুমি সে করুণাময়ের সৃষ্টিতে কোথাও কোন ত্রুটি দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফিরাও কোন ত্রুটি দেখতে পাচ্ছ কি? অতঃপর তুমি পুনঃ পুনঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ কর। তোমার দৃষ্টিশক্তি অবনমিত হয়ে ফিরে আসবে।” (অথচ তুমি কোথাও কোন ত্রুটি দেখতে পাবে না।) (সুরা মূলক, আয়াত ৩-৪)

 

এই বৈশিষ্ট্যময় বিশ্ব যে আল্লাহ অহেতুক খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেননি, সে সম্পর্কে কোরআন বলে,

 

وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَاعِبِينَ ﴿٣٨﴾ مَا خَلَقْنَاهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ ﴿٣٩﴾

 

“আমি আকাশ ও ভূমণ্ডল এবং তন্মধ্যস্থ যাবতীয় বস্তু খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। নিশ্চয় আমি উভয়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরী করেছি! কিন্তু অধিকাংশই লোকই তা অনুধাবন করে না।” (সুরা দোখান, আয়াত ৩৮-৩৯)

 

এবার এই নৈপূন্যময় বিশ্ব সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মত শুনুন,

 

আমি একটি সুসামঞ্জস্য ও সুশৃঙ্খল বিশ্বে বিশ্বাসী। অনুসন্ধানী মানুষ একদিন বাস্তব সত্যের সন্ধান পাবে ঐ বিশ্বাস আমি পোষণ করি। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনা যে, জগত নিয়ে সৃষ্টিকর্তা পাশা খেলছেন।” (বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন)।

 

(ছ) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, সে ভয়াবহ দিনে সূর্য ও চন্দ্রে কোন আলো থাকবে না এবং নক্ষত্রগুলিও তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে। আর আল্লাহ এক অভিনব নূর (আলো) দ্বারা সমগ্র হাশর ময়দানটি আলোকিত করে ফেলবেন। যেমন সুরায়ে কিয়ামায় উল্লেখ আছে,

 

 يَسْأَلُ أَيَّانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ ﴿٦﴾ فَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ ﴿٧﴾ وَخَسَفَ الْقَمَرُ ﴿٨﴾ وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ ﴿٩﴾

 

“এরা (রসূলেন কাছে) জিজ্ঞেস করছে যে, কিয়ামত কবে হবে? যেদিন দৃষ্টি শক্তি ঝলসে যাবে এবং চন্দ্রে কোন আলা থাকবে না। আর চন্দ্র, সূর্য একই অবস্থা প্রাপ্ত হবে।” (সুরা কিয়ামাহ, আয়াত ৬-৯)

 

কিয়ামতের বর্ণনা দান প্রসঙ্গে আল্লাহ পবিত্র কোরআনের অন্য এক স্থানে বলেছেন,

 

 إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ ﴿١﴾ وَإِذَا النُّجُومُ انكَدَرَتْ ﴿٢﴾ وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ ﴿٣﴾

 

“যেদিন সূর্য কোন আলো থাকবে না, নক্ষত্রগুলো স্থানচ্যুত হবে, আর পাহাড়-পর্বতগুলিও সরে যাবে।” (সুরা তাকবীর, আয়াত ১-৩)

 

কোরআন নাযিলের সময় যদিও উক্ত কথাগুলি কারো কারো কাছে অসম্ভব বলে মনে হত, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরা চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজির উপরোক্ত অবস্থা প্রাপ্তির কথাকে আর আদৌ অসম্ভব মনে করেন না। বরং তাদের মতামত তাকে সমর্থন করার পক্ষে। যেমন তারা বলেছেন,

 

“সূর্য ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে নিভে যাচ্ছে। তারকাদের অনেকেই এখন পোড়া কয়লা মাত্র। বিশ্বের সর্বত্রই তাপের মাত্রা কমে আসছে। পদার্থ বিকীর্ণ হয়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হচ্ছে এবং কর্মশক্তি মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে বিশ্ব এভাবে তাপ-মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অনেক কোটি বছর পরে বিশ্ব যখন এরূপ অবস্থায় পৌঁছবে, তখন প্রকৃতির সমস্ত প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।”

 

(বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন, পৃঃ নং ১২৩-১২৪)

 

“প্রকৃতির সমস্ত দৃশ্য এবং তথ্যাদি দ্বারা এই একমাত্র সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, অনমনীয় ও অপরিবর্তনীয়ভাবে বিশ্ব এক অন্ধকার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে।” (বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন পৃঃ নং ১২৭)

 

বিজ্ঞানীদের মতে প্রকৃতির সমস্ত প্রক্রিয়া যেদিন স্তব্ধ হয়ে যাবে সেদিন বিশ্ব ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

 

كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ ﴿٢٦﴾ وَيَبْقَىٰ وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ

 

“বিশ্বে যা কিছু আছে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তোমরা একমাত্র প্রতিপালকই অবশিষ্ট থাকবেন, যিনি মহীয়ান ও গরীয়ান।”

 

(সুরা আর-রহমান, আয়াত ২৬-২৭)

 

(জ) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উদ্ভিদ, তরুলতা ও গাছ-গাছড়া ইত্যাদিকে মানব ও জন্তু-জানোয়াররের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

وَالْأَرْضَ بَعْدَ ذَٰلِكَ دَحَاهَا ﴿٣٠﴾ أَخْرَجَ مِنْهَا مَاءَهَا وَمَرْعَاهَا ﴿٣١﴾ وَالْجِبَالَ أَرْسَاهَا ﴿٣٢﴾ مَتَاعًا لَّكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ ﴿٣٣﴾

 

“অতঃপর তিনি জমিনকে বিস্তার করে দিয়েছেন। আর তা হতে পানি ও তরুলতাদি নির্গত করেছেন এবং পাহাড়কে তিনিই সু-প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর তা (গাছ-গাছড়া) হল তোমাদের এবং তোমাদের জন্তু-জানোয়ারদের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ।” (সুরা আন নাজিয়াত, আয়াত নং ৩০-৩৩)

 

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

 

فَلْيَنظُرِ الْإِنسَانُ إِلَىٰ طَعَامِهِ ﴿٢٤﴾ أَنَّا صَبَبْنَا الْمَاءَ صَبًّا ﴿٢٥﴾ ثُمَّ شَقَقْنَا الْأَرْضَ شَقًّا ﴿٢٦﴾ فَأَنبَتْنَا فِيهَا حَبًّا ﴿٢٧﴾ وَعِنَبًا وَقَضْبًا ﴿٢٨﴾ وَزَيْتُونًا وَنَخْلًا ﴿٢٩﴾ وَحَدَائِقَ غُلْبًا ﴿٣٠﴾ وَفَاكِهَةً وَأَبًّا ﴿٣١﴾ مَّتَاعًا لَّكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ ﴿٣٢﴾ فَإِذَا جَاءَتِ الصَّاخَّةُ ﴿٣٣﴾ يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ ﴿٣٤﴾ وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ ﴿٣٥﴾ وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ ﴿٣٦﴾ لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ ﴿٣٧﴾ وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ مُّسْفِرَةٌ ﴿٣٨﴾ ضَاحِكَةٌ مُّسْتَبْشِرَةٌ ﴿٣٩﴾ وَوُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ ﴿٤٠﴾ تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ ﴿٤١﴾ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ ﴿٤٢﴾

 

মানুষের উচিৎ তার খাদ্য বস্তুর দিকে লক্ষ্য করা। এক অত্যাশ্চর্য পদ্ধতিতে আমি পানি বর্ষণ করেছি। অতঃপর অভিনব পদ্ধতিতে আমি জমিনকে বিদীর্ণ করে তা হতে নানা ধরনের শস্য, আঙ্গুর, শাক-সব্জি, জাইতুন, খেজুর, ঘন বৃক্ষরাজি পরিপূর্ণ বাগ-বাগিচা ফল-মূল, তৃণ-রাজি উৎপাদন করেছি। আর এসব হল তোমাদের ও তোমাদের গৃহপালিত পশুগুলির জন্য বিশেষ উপকারী।” (সূরা আবাসা, আয়াত ২৪-৩২)

 

বর্তমান বিজ্ঞানীদের উদ্ভিদ সম্পর্কে নানারূপ গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্রকৃতির মধ্যে মানুষের এবং জন্তু-জানোয়ারদের জন্য উদ্ভিদের চেয়ে পরম বন্ধু আর কিছুই নেই। কেননা উদ্ভিদ শুধু আমাদের খাদ্যই জোগায় না, বরং বায়ু হতে বিষাক্ত গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন তৈরী করে দেয়।

 

উদ্ভিদ শিকড়ের সাহায্যে মাটি হতে পানি শুষে পাতায় নিয়ে আসে এবং পাতা বায়ু হতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস শুষে নেয়। গাছের পাতায় রক্ষিত ক্লোরোফিল (যার কারণে পাতা সবুজ দেখায়) ও সূর্য কিরণের দ্বারা পাতার ভিতরেই এক ধরণের রান্নার কাজ চলে। ফলে তৈরী হয় শর্করা যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। আর বের হয়ে আসে অক্সিজেন যা না হলে আমরা সামান্য সময়ও বাঁচতে পারি না।

 

কাজেই উদ্ভিদ আমাদের জন্য মামুলী সম্পদ নয় বরং মহামূল্যবান সম্পদ। কোরআনে অসংখ্য বার আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর উদ্ভিদরূপ নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন।

 

(ঝ) উদ্ভিদ ও যাবতীয় ধাতব পদার্থের যে জীবনী শক্তি আছে, প্রখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুই নাকি তা সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন। অথচ বসু মহাশয়ের উক্ত আবিষ্কারের প্রায় তেরশত বছর পূর্ব পবিত্র কোরআন আমাদেরকে উদ্ভিদ, পাথর যাবতীয় ধাতব পদার্থ ইত্যাদির জীবনী শক্তি ও অনুভূতি শক্তির সন্ধান দিয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে কোরআন হতে কয়েকটি উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে,

 

﴿تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ ۚ وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ ۗ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا﴾

 

“সপ্ত আকাশ, ভূমণ্ডল ও তন্মধ্যস্থ সকল বস্তুই আল্লাহর গুণগান করে। আর এমন কোন বস্তু নেই যা তার গুণকীর্তন করে না, কিন্তু তোমরা তাদের এ গুণকীর্তন (তাসবীহ পাঠ) উপলব্ধি করতে পারো না। আর তিনি হলেন ধৈর্যশীল ও ক্ষমাকারী।” (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত-৪৪)

 

سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

 

“আকাশ ও ভূমণ্ডলস্থ সকলেই আল্লাহর গুণগানে মশগুল। আর তিনি হলেন মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।” (সুরা ছফ, আয়াত-১)

 

নিম্নের আয়াতটি বিশেষভাবে পাথরের জীবনী শক্তির ইঙ্গিত বহন করে,

 

﴿ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّن بَعْدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ۚ وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ﴾

 

“আর কোন কোন পাথর এমনও হয়ে থাকে যা হতে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়। কোন কোনটি ফেটে গিয়ে তা থেকে পানি নির্গত হয়। আবার কোন কোনটি আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়ে ভূতলে পতিত হয়। আর আল্লাহ তোমাদের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে মোটেই অনবহিত নহেন।”

 

(সুরা বাকারা, আয়াত-৭৪)

 

একদা এক অভিযানকালে হযরত মুহাম্মদ (স) যখন সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, কোন কোন সাহাবী হাতের অস্ত্রের আঘাতে পথিপাশর্স্থ গাছের ডাল-পালা কাটছেন। হুজুর (স) তাদেরকে নিষেধ করলেন, আর বললেন, “ খবরদার অযথা তোমরা গাছ-পালার উপরে আঘাত করবে না। কেননা তাদের প্রাণ আছে তোমাদের আঘাতে তারা কষ্ট পায় ও কাঁদে।”

 

অতিসম্প্রতি রুশ বিজ্ঞানী মানুষের সুখে ও দুঃখে নিকটবর্তী ফুলও যে প্রভাবান্বিত হয়, অর্থাৎ মানুষের সুখে ও আনন্দে নিকটবর্তী ফুলও আনন্দিত হয় এবং মানুষের দুঃখে বেদনা বোধ করে, এ তথ্যটি আবিষ্কার করেছেন।

 

মাত্র কিছুদিন পূর্বে আমেরিকার দুজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী পিটার টস্পকীন এবং ক্রিস্টোফার-বার্ত্ত কর্তৃক লিখিত (the crescent life of plan) নামক পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তারা প্রমাণ করেছেন যে, সব রকমের গাছ-গাছড়া এমনকি মূলা, গাজর, পিঁয়াজ ইত্যাদির শুধু অনুভূতি শক্তিই নেই বুদ্ধি এবং ইচ্ছা শক্তিও আছে।

 

এমনকি অন্য উদ্ভিদের সাথে যোগাযোগ করার ভাষাও আছে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদ্বয় তাদের পুস্তকে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ক্লেপব্যকস্টার, মর্সেল ভোগেল, কেন হার্মিমোট ও ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের মতামতও প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন।

 

শস্যের চারা কিভাবে সঙ্গীতে সাড়া দেয়, বীজ ও কুঁড়ি কিভাবে বৈদ্যুতিক আঘাতে জেগে ওঠে, এ সম্পর্কে কাজাকিস্তানের রুশ বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানের ফলাফলও উক্ত পুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

\r\n\r\n

সাত: কোরআনের অভিনব হেফাযত ব্যবস্থা

 

স্মরণাতীত কাল হতে পয়গাম্বরদের উপরে যে সব কিতাব নাযিল হয়েছে তার অধিকাংশই এখন দুষ্প্রা্প্য । যে অল্প কয়েকখানা পাওয়া যায় তাও তার মূল ভাষায় নয়। আর মূল ভাষা হতে যখন কোন গ্রন্থকে অনুবাদ করা হয়, তখন তা অনুবাদ গ্রন্থ, আসল গ্রন্থ নয়। বিশেষ করে মহান আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের অনুবাদ। আর অনুবাদ গ্রন্থের ভাষা গ্রন্থের অনুবাদকের, আল্লাহর নয়।

 

তাছাড়া ঐ সমস্ত গ্রন্থ যে পরিবর্তন মুক্ত নয় তা তাদের বিজ্ঞ অনুসারীদের অনেকেই মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেছেন। কেননা সে যুগে না ছিল কাগজ, আর না ছিল আজকের মত ছাপাখানা। ফলে বৃক্ষপত্র, কাষ্ঠফলক, সমৃণ পাথর-প্লেট অথবা পাতলা চামড়ায় উহা লিখে রাখা হত এবং উহার অতিরিক্ত কপি করা অসম্ভব বিধায় পাদরী পুরোহিতদের কাছে উহার এক আধ কপি তাদের কেন্দ্রীয় উপাসনালয়ে রক্ষিত হত। আর যখনই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোন জাতি তাদের রাজধানী কিংবা নগর আক্রমণ করত, তখন তাদের ধর্মগ্রন্থ ও উপাসনালয়ই হত বিজয়ী জাতির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল। ইসলামের অভ্যুত্থানের পূর্বে এভাবে বহুবার প্রতিদ্বন্দ্বি শক্তি কর্তৃক ইহুদী ও খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অধুনা একখানা পূর্ণাঙ্গ তাওরাত কিংবা ইঞ্জিল তার মূল ভাষায় পাওয়া সাধারণভাবে অসম্ভব।

 

পবিত্র তাওরাত গ্রন্থ যা হযরত মূসার (আ) উপরে অবতীর্ণ হয়েছিল, সেটা কয়েকবারেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে খৃঃ পূঃ ৫৮৬ সনে ব্যাবিলনের অত্যাচারী শাসক বখতে নাছার (নবুকারদোযাহ) জেরুজালেম আক্রমণ করে শহরটিকে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় এবং ইসরাইলী আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে যায়। বখতে নাছার হযরত সুলায়মানের (আ) তৈরী পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ এবং সেখানে রক্ষিত তাওরাত গ্রন্থও ধ্বংস করে দেয়।

 

অতঃপর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে খৃ: পৃ: ৫৩৮ সনে পারস্য সম্রাট মহামতি সাইরাছ ব্যাবিলনের বাদশাহকে পরাজিত করে ইহুদীদের মুক্ত করে দেন এবং ফিলিস্তিনে তাদের পূনর্বাসন, নতুন করে জেরুজালেম নগরী ও বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ পুনঃনির্মাণে সহায়তা করেন। তৎপর ইহুদী আলেমগণ তাওরাতের বিক্ষিপ্ত অংশ যা তাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল এবং যা তাদের মুখস্ত ছিল তা হতে তাওরাত নতুন করে লিপিবদ্ধ করেন। এ সম্পর্কে (the story of bible) নামক গ্রন্থের প্রসিদ্ধ ইউরোপীয়ান লেখকের মত হল নিম্নরূপ:

 

That the original manuscripts were destroyed with Solomon\'s temple and the Ezra made a fresh set from such copies as could be found. (The Story of Bible)

 

“প্ৰকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, তাওরাতের মূল লিপি, হযরত সুলায়মানের পবিত্র মসজিদের সাথেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অত:পর ইজরা বা হযরত ওজায়ের (আ:) যা কিছু সংগ্ৰহ করতে পেরেছিলেন তা দ্বারা নতুন একটি কপি তৈরী করলেন ।\"

 

রোমান ঐতিহাসিক প্রিাণীর মতে জেরোস্তারের উপরে নাযিলকৃত কিতাব জিন্দাবেস্তা মোট বার হাজার গরুর চামড়ায় সোনালী কালিতে লিপিবদ্ধ করে পারসিয়ানদের তদানীন্তীন রাজধানী পার্সেপলিসের বিখ্যাত লাইব্রেরীতে রাখা হয়েছিল। অত:পর গ্ৰীক সম্রাট আলেকজান্ডার যখন উক্ত রাজধানী দখল করে পুড়িয়ে দেয়, তখন লাইব্রেরীটি এবং তাতে রক্ষিত পবিত্র জিন্দাবেস্তা কিতাবখানিও পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। বাইবেল নিউটেস্টামেন্ট (ইঞ্জিল) সম্পর্কে লেখক তার অনুসন্ধানের ফল ব্যক্ত করে বলেন,

 

\"All the New Testment is found, with documents in a manuscript calle the \'Sainaitic Codex\' preserved at Leningrad probably written in Egypt in the 4th century.\" (The Story of Bible P. no. 107)

 

\"সমস্ত নিউটেস্টামেন্টই (ইঞ্জিল) অন্যান্য ডকুমেন্টসহ যে মূল লিপিতে লেনিনগ্রাডে রক্ষিত আছে সেটাকে ‘ছায়ানাইটিক লিপি\' বলা হয় । এটা যথাসম্ভব খৃস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে মিসরে লিখিত হয়।”

 

সুতরাং হযরত ঈসার (আ:) মৃত্যুর চারশত বছর পর যদি তাঁর উপর আছে তা ভাববার বিষয় বটে?

 

আবার কোন কোন ঐশীবাণী (ওয়াহী) পুরুষাক্রুমে ধর্মযাজকগণ তাদের শিষ্যদের তালিম দিতেন। অতঃপর সেটা যখন কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিত, কিংবা ব্যাপকভাবে তাতে বাইরের আখ্যান ইত্যাদি যুক্ত হত, তখনই তাদের কোন জ্ঞানী ব্যক্তি সেটাকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে নিতেন। ফলে উহা হতে যেমন কোন অংশ বাদ পড়ত, তেমনি অনেক বাইরের কথাও তাতে শামিল হয়ে যেত।

 

হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ বৈদিক যুগের অনেক পরে মহাভারতীয় যুগে (কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়) বেদব্যাস মুনি কর্তৃক সঙ্কলিত হয়। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতে বেদ যীশু খৃস্টের জন্মের মাত্র সাত কি আটশত বছর পূর্বের রচনা। অনুরূপভাবে বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটককে তৃতীয় পিটকখানা বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় দুই শত বছর পর মহামতি অশোকের নেতৃত্বে লিপিবদ্ধ করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় পিটকদ্বয়ও বুদ্ধের মৃত্যুর পরে সংকলিত। উপরন্তু কোরআন পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থগুলো যে সব ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল, দুনিয়ার কোথাও আর সে সব ভাষার প্রচলন নেই। জগতের অধিকাংশ পয়গম্বরই ছিলেন বনি ইসরাইল কওমভুক্ত, আর তাদের ভাষা ছিল ইবরানি বা হিব্রু। এ সকল ইবরানী পয়গম্বরদের উপরে নাযিলকৃত সমস্ত কিতাবের ভাষাই ছিল ইবরানি বা হিব্রু। এ সকল ইবরানী পয়গম্বরদের উপরে নাযিলকৃত সমস্ত কিতাবের ভাষাই ছিল হিব্রু। কিন্তু ‍দুনিয়ার কোথাও আজ আর হিব্রু ভাষার তেমন প্রচলন নেই।

 

অনুরূপভাবে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ ও গীতার ভাষা সংস্কৃতেরও যেমন কোন সন্ধান পাওয়া যায় না, তেমনি বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ পিটকের ভাষা পালিতেও এখন আর কেউ কথা বলে না। এসব এখন মৃত ভাষার শামিল।

 

কিন্তু একমাত্র কোরআনের ব্যাপারই এসব থেকে স্বতন্ত্র। যে মূল ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সেই মূল ভাষায়ই তার কোটি কোটি কপি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন লোকের কাছে মওজুদ আছে। কোরআন যে শুধু গ্রন্থাবস্থাই রক্ষিত আছে তাই নয়, বরং কোরআন নাযিলের পর থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে অগণিত লোক তা পুরাপুরি মুখস্থ করে রেখেছেন।

 

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোরআন অল্প অল্প করে তেইশ বছর ধরে অবতীর্ণ হয়েছে। যখনই কোরআনের কোন অংশ হুজুর (স) এর উপরে অবতীর্ণ হত, হুজুর (স) সাথে সাথেই যেমন সেটা কাতিব (ওয়াহী লিপিবদ্ধকারী) দ্বারা লিপিবদ্ধ করিয়ে নিতেন, তেমনি বহু মুসলমান সঙ্গে সঙ্গেই ঐ অংশটুকু মুখস্থ করে ফেলতেন। তেইশ বছর পর যখন কোরআন নাযিল হওয়া সমাপ্ত হলো, তখন একদিকে যেমন কোরআন পুরাপুরি লিপিবদ্ধ হয়ে রক্ষিত হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি অসংখ্য মুসলমান সেটাকে পূর্ণরূপে মুখস্থ করে তার হেফাযতের চমৎকার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। অতঃপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উক্ত হেফাযত ব্যবস্থা যথা নিয়মেই চলে এসছে।

 

কেউ যদি উহা পরীক্ষা করে দেখতে চায়, তাহলে তিনি যেন পূর্ব এশিয়ার কোন এক দেশ হতে একখানা কোরআন সংগ্রহ করেন। অতঃপর উত্তর আফ্রিকার কোন একজন হাফেযের মুখে তা পাঠ করিয়ে শুনে নেন। শব্দ ও অক্ষর তো দূরের কথা একটা জের যবরেরও কোন অমিল পাবে না।

 

তাছাড়াও যে মূল আরবী ভাষায় কোরআন মহানবীর প্রতি নাযিল হয়েছে, আজ চৌদ্দশত বছরের ব্যবধানেও কোরআনের সে ভাষা না পুরান হয়েছে, না পরিত্যক্ত।

 

[আরবী ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করতে গিয়ে প্রখ্যাত আমেরিকান পণ্ডিত জর্জ সার্টন বলেন,

 

“মুসলিম তামুদ্দুন ছিল বিচিত্র প্রকৃতির। মুসলমানেরা ধর্ম ও ভাষারূপ দুটি শক্তিশালী বন্ধন দ্বারা নিজেদেরকে ঐক্যসূত্রে গেথে নিয়েছিল। মুসলমানদের প্রধান কর্তব্যগুলোর ভিতরে একটি হল মূল আরবী ভাষার কোরআন পাঠ করা। এ চমৎকার ধর্মীয় বিধানকে ধন্যবাদ.....। আজকেও যেসব ভাষা পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে, আরবী তাদের অন্যতম। (the life of science by George sarton) লেখক তাঁর পুস্তকের অন্য এক জায়গায় বলেছেন’ “অষ্টম শতকের মধ্য ভাগ হতে একাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত আরবী ভাষা-ভাষীরা এগিয়ে চলছিল মানব জাতির পুরো ভাগে। তাদেরকে ধন্যবাদ, আরবী ভাষা শুধু কোরআনের পবিত্র ভাষা বা আল্লাহর বাণীর বহনরূপেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং তা বিশ্বের সামনে নিজেকে তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক ভাষারূপে।” মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে আরবী রচনাবলী অসীম গুরুত্বের কথা স্বীকার করে লেখক গ্রন্থের অন্য এক জায়গায় লিখেছেন,

 

“ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে যারা অগ্রগামী ছিলেন তারা বুঝতে পারলেন যে, আরবী রচনাবলী শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ তাই নয়, সেগুলো অপরিহার্যও বটে। কারণ তারই মধ্যে সঞ্চিত ছিল জ্ঞানের প্রচুর সম্পদ। এ কথা বললে মোটেই অতিরিক্ত হবে না, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত খৃস্টান পণ্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল আরবী গ্রন্থের ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ।”( the life of science by George sarton)

 

 বরং দুনিয়ার বেশ কয়েক কোটি লোকই উক্ত ভাষায় কথাবার্তা বলে। কোরআনের পাঠক মাত্রই তার এ অভিনব হেফাযত ব্যবস্থায় মুগ্ধ না হয়ে পারবে না।

 

আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ পয়গম্বরের প্রতি নাযিলকৃত তাঁর এ সর্বশেষ কিতাবখানার এ অভিনব হেফাযত ব্যবস্থা যে আল্লাহর নিজেরই পরিকল্পিত সে কথা আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন। এ ঘোষণাটি একবার আমরা দেখতে পাই ‘সুরা কিয়ামাহ’ নামক প্রাথমিক স্তরের একটি মক্কী সুরাতে। আর একবার আমরা দেখতে পাই ‘সুরায়ে হিজর’ নামক অপর একটি মক্কী সুরাতে।

 

মক্কা শরীফের প্রথম যখন জিরারাইল (আ) হুজুরের (স) কাছে উপস্থিত হয়ে ওয়াহী পাঠ করে শুনাতেন, তখন হুজুর (স) জিবরাইলের (আ) সাথে ব্যস্ততার সাথে তা পাঠ করতে থাকতেন, যাতে ওয়াহীর কোন একটা অংশও বাদ না পড়ে। ফলে মহান আল্লাহ নিম্নলিখিত মর্মে হুজুরকে আশ্বস্ত করলেন,

 

﴿لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ﴾

 

﴿إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ﴾

 

﴿فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ﴾

 

﴿ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ﴾

 

“হে রাসূল, দ্রুত কোরআন আয়ত্ব করার জন্যে আপনি আপনার জিহ্বা সঞ্চালন করবেন না। কোরআন পূর্নাঙ্গ করা এবং তা পাঠ করিয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। সুতরাং আমি যখন (জিবরাইলের জবানে) সেটা পাঠ করি, তখন আপনি তা অনুসরণ করুন। অতঃপর তার ব্যাখ্যা দানও আমার জিম্মাদারী।” (সুরা কিয়ামাহ, আয়াত ১৬-১৯)

 

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

 

﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾

 

“নিশ্চয় কোরআন আমিই নাযিল করেছি। আর অবশ্যই তার হেফাযতের দায়িত্ব আমারই।” (সুরা হিজর, আয়াত-৯)

 

সুরা তায়াহায়ও অনুরূপ ধরনের একটি উক্তি দেখা যায়।

 

وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِن قَبْلِ أَن يُقْضَىٰ إِلَيْكَ وَحْيُهُ ۖ وَقُل رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا

 

“কোরআন যখন নাযিল হয়, তখন তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কোরআনের (হেফাযতের) জন্য আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। আর আপনি বলুন, হে আল্লাহ! তুমি আমার ইলম বাড়িয়ে দাও”। (সুরা তায়াহা, আয়াত-১১৪ )

 

কোরআনের এই অত্যাশ্চর্য হেফাযতের ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে মন আপন হতে সাক্ষ্য দিবে যে, এ হেফাযত ব্যবস্থার মূলে তাঁর হাতই ক্রিয়াশীল, ‍যিনি উহা নাযিল করেছেন।

\r\n\r\n

আট: কোরআনের ভাষা ও ভাবে আশ্চর্য সাঞ্জস্য

 

দীর্ঘ তেইশ বছর কালব্যাপী অল্প অল্প নাযিল হওয়ার পরেও কোরআনের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত ভাষা, সাহিত্যিক মান, অর্থ ও ভাবে যে আশ্চর্য ধরনের সামঞ্জস্য উহাও প্রমাণ করে যে, কোরআন মানব রচিত কোন গ্রন্হ নয়। কেননা কোন মানুষের পক্ষে উক্ত বিষয়সমূহের ভিতরে এরূপ ধারাবাহিকতা ও সামঞ্জস্য রক্ষা করা দীর্ঘকালব্যাপী সম্ভব ছিল না।

 

 

\r\n\r\n

কোরআন রসূলের সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেযা

 

মহান আল্লাহ ‍দুনিয়ার মানব জাতির হেদায়াতের উদ্দেশ্যে যে সব নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদেরকে নবূয়ত ও রিসালাতের প্রমাণ স্বরূপ মোযেযাও দান করেছেন। ‘মোজেযা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল অপরাগ ও ক্ষমতাহীন করে দেয়া, মোকাবেলায় কাবু করে ফেলা ইত্যাদি। আর পারিভাষিক অর্থ হল নবী-রাসূলদের নিজস্ব দাবীর সমর্থনে এমন অলৌকিক ও আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়ে দেখানো, যা পয়গাম্বর ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে ঘটানো আদৌ সম্ভব নয়।

 

সাধারণ মোজেযার বাইরেও আল্লাহ তার কোন কোন রসূলকে বিশেষ মোজেযাও দান করেছিলেন। যেমন মূসার (আ) আসা (লাঠি) ও ইয়াদে বায়যা (উজ্জ্বল হাত)। অর্থাৎ হযরত মূসা (আ) যখন তার লাঠিখানা মাটিতে নিক্ষেপ করতেন, তখন তা এক ভয়াবহ প্রকাণ্ড অজগরের রূপ ধারণ করে মাটিতে ছুটাছুটি করত। আবার যখন তিনি সেটি ধারণ করতেন লাঠিতে রূপান্তরিত হত। অনরূভাবে তিনি তার ডান হাত বগলে দাবিয়ে যখন বের করতেন, তখন উক্ত হাত থেকে এক বিশেষ ধরণের আলো-রশ্নি বের হয়ে চারদিক আলোকিত করে ফেলত। ইহাই । ছিল মূসার (আ) মোজেযা ‘আসা ও ইয়াদে বায়যা উপরে বর্ণিত দুটি বিশেষ মোজেযা ছাড়াও হযরত মূসার (আ) দীর্ঘ জীবনে আরও বহু বিচিত্র ও অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। তন্মেধ্যে লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানিকে বিভক্ত করে ইসরাইলদের জন্য রাস্তা তৈরী করে দেয়া, পাথর খণ্ডের মধ্য হতে বনি ইসরাইলে বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা, আসমান হতে মান্না সালওয়া (আসমানী খাদ্য) নাযিল হওয়া প্রভৃতি অন্যতম।

 

হযরত ঈসার (আ) জীবনেও এ ধরণের বহু অলৌকিক ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায়, তবে তার বিশেষ মোজেযা ছিল দূরারোগ্য ব্যাধি আরোগ্য করা মৃতকে জীবিত করে কথা বলিয়ে নেয়া।

 

আল্লাহ তার শেষ পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদের (স) দ্বারাও বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে অবিশ্বাসীদের সামনে তার নবুয়তের সাক্ষ্য পেশ করেছিলেন। তবে তাঁকে যে সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেযাটি দান করা হয়েছিল সেটা আরবী ভাষায় নাযিলকৃত আল-কোরআন।

 

এমনিতেই দুনিয়ার সর্ব প্রধান ভাষাগুলির মধ্যে আরবী ভাষা ছিল এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তদুপরি রসূলের আবির্ভাবকালে কাব্য ও সাহিত্য চর্চার দিক থেকে আরবরা ছিল শীর্ষস্থানীয়। তারা তাদের জাতীয় আনন্দ অনুষ্ঠানাদিতে প্যান্ডেল ও মঞ্চ সাজিয়ে কাব্য-কলা ও সাহিত্য প্রতিভার প্রদর্শনী করত। উন্নত ও মার্জিত ভাষার অধিকারী এহেন একটি জাতির নিকটে আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে একজন নিরেট নিরক্ষর লোকের কাছে এমন উচ্চাংগের কালাম নাযিল করা শুরু করলেন যার ভাষা ও ভাবের সুউচ্চ মান দর্শনে সমস্ত আরব হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। ভাষার দিক থেকে কোরআনের মোকাবিলা করা যেমন আবরদের জন্য অসম্ভব ছিল, তেমনি ভাব ও বিষয়াবলীর দিকে দিয়েও কোরআনের অনরূপ কালাম তৈরী করা তাদের জন্য সম্ভব ছিল না। কোরআন বার বার তার বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ করেছে যে, যদি মুহম্মদের মুখনিঃসৃত কোরআন সম্পর্কে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যে তা আল্লাহর কালাম নয় বরং মুহাম্মাদের তৈরী, তাহলে কোরআনের অনুরূপ ছোট একটি সূরা অন্তত: তোমরা তৈরী করে নিয়ে এসো।

 

কোরআনের এ চ্যালেঞ্জ তার অন্তর্নিহিত সুষমারাজী, দার্শনিক বিষয়মসমূহ ও জটিল বিধানবলী ইত্যাদির ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। যদি তা হত তাহলে হয়ত আরবরা বলতে পারতো আমরা তোর আর দার্শনিক নই, নীতি-শাস্ত্রও আমরা জানি না, আর জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েই বা আমাদের মাথা ঘামাবার সময় কোথায়। কিন্তু শুধু তাতো নয়, কোরআন ভাবের শ্রেষ্ঠত্বের সাথে সাথে তার ভাষার মানের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করে আরবসহ সারা বিশ্বকে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ দান করেছে যে কোরআনের অনুরূপ একটি ছোট্ট সুরা অন্ততঃ তৈরী করে নিয়ে এসো। আরবী ভাষার মহাপণ্ডিত ও দিকপালরা যেভাবে ভাষাগত দিক দিয়ে কোরআনের কোন মোকাবিলা করতে পারেনি। তেমনি আরবসহ রোম-পারস্যের নীতি শাস্ত্র বিশেষজ্ঞরাও ভাবের দিক দিয়ে কোরআনের মত কোন গ্রন্থ অথবা তার অংশ বিশেষের ন্যায়ও কিছু তৈরী করতে পারেনি। ফলে ভাষা ও ভাব উভয় দিক হতেই কোরআন মহানবীর এক অত্যাশ্চর্য মোজেযারূপে কিয়ামত পর্যন্ত বিরাজ করবে।

 

 

\r\n\r\n

কোরআনের গ্রন্থবদ্বকরণ ও শ্রেণীবিন্যাস ব্যবস্থা

 

কোরআন অবতীর্ণের সময় কোরআনের যে অংশই যখন অবতীর্ণ হত, হুজুর (স) ওয়াহী লিপিবদ্ধকারী সাহাবাদের দ্বারা একদিকে যেমন তা লিপিবদ্ধ করিয়ে নিতেন, অন্যদিকে অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম সেটা মুখস্থ করে ফেলতেন। হুজুরের তিরোধান মুহুর্তে পূর্ণাঙ্গ কোরআন যেমন অসংখ্য সাহাবায়ে কেরামের মুখস্থ ছিল, তেমনি বেশ কয়েকজন সাহাবাদের (রা) নিকটে লিপিবদ্ধ আকারেও মওজুদ ছিল। কোরআনের কোন অংশ অবতীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাহাবাদের অনেকেই পাতলা উষ্ট্র চর্মে, মসৃণ পাথর টুকরায়, বৃক্ষপত্রে কিংবা বাকলে লিখে নিতেন। কাতিবে ওয়াহী হযরত জায়েদ ইবনে সাবেতের একটি বর্ণনা হাদীসের কিতাবে দেখা যায়। তিনি বলেছেন,

 

نولف القرآن من الرقاع

 

“আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের কাছে বসে চর্ম টুকরায় কোরআন শরীফ লিখে নিতাম।” (মোসতাদরিক-ইতকান)

 

বোখারীর যে অংশে সাহাবাদের মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের একটি বর্ণনার উল্লেখ আছে যাতে তিনি বলেছেন যে, আমি নবী করীমকে (স) এ কথা বলেতে শুনেছি, “তোমরা কোরআন চার ব্যক্তির কাছ থেকে শিখে নাও। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, সালেম, উবাই বিন কায়াব ও মায়ায ইবনে যাবাল।” (বুখারী)

 

বোখারীর অন্যত্র হযরত আনাসের একটি বর্ণনায় তিনি উল্লেখ করেছেন,

 

“নবী করীমের (স) জামানায় যে চারজন সাহাবী (বিশেষভাবে) কোরআনকে সংগ্রহ করেছিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন আনছার। উবাই-বিন কায়াব, মায়ায-জাবাল, আবু ছায়েদ এবং যায়েদ-ইবনে সাবেত (রা)।” (বুখারী)

 

মোহাদ্দিসীনরা উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এর অর্থ হল যদিও অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম কোরআন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু বিশেষ ভাবে উপরোক্ত চারজন সাহাবী কোরআনের হেফয, তেলাওয়াত, সংরক্ষণ ও সংগ্রহ ইত্যাদির ব্যাপারে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

 

এভাবে তিরোধানের কেবল পরপরই হযরত আবু বককরের খিলাফতের প্রথম ‍দিকে ইয়ামামার যুদ্ধে যখন কয়েক শত হাফেজ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন, তখন হযরত উমর (র) খলিফাতুর-রসূল হযরত আবু বককরের নিকটে এই আরজী নিয়ে হাজির হলেন যে, এখনই কোরআনের সমস্ত অংশগুলিকে ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে একখানা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হোক। নতুবা ব্যাপকভাবে হাফেজে কোরআনের ‍দুনিয়া থেকে উঠে যাওয়ার কারণে হয়তবা কোরআনের কোন অংশ আমরা হারিয়ে ফেলতে পারি। হযরত আবু বকর প্রথমে কিছু ইতস্তত করে পরে হযরত উমরের প্রস্তাবকে অনুমোদন দিলেন এবং কাতিবে ওয়াহী হযরত জায়েদ ইবনে সাবেতকে এ পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত করলেন।

 

ইমাম বোখারী তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ বোখারী শরীফে “কোরআনের গুরুত্ব ও মর্যাদা” অংশে হযরত জায়েদ ইবনে সাবিতের মাধ্যমে নিম্নরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন,

 

“ইয়ামামার যুদ্ধের পর পরই আমাকে হযরত আবু বককর (রা) ডেকে পাঠালেন। আমি উপস্থিত হয়ে হযরত উমরকেও তাঁর পার্শ্বে উপবিষ্ট দেখলাম। অতঃপর হযরত আবু বককর (রা) আমাকে লক্ষ্য করে বললেন,

 

‘দেখ এই উমর (রা) আমার কাছে এসেছে, সে বলে ইয়ামামার যুদ্ধে অসংখ্য হাফেজে কোরআন শাহাদাত বরণ করেছেন। আর আমার আশংকা হচ্ছে; অন্যান্য যুদ্ধেও ‍যদি এইভাবে হাফেজে কোরআন শাহাদাত বরণ করহে থাকেন, তাহলে হয়তো আমরা কোরআনের কোন কোন অংশ হারিয়ে ফেলব। সুতরাং আমার অভিমত আপনি কোরআনকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার হুকুম ‍দিন’ আমি উমরকে জওয়াবে বললাম, যে কার রসূল (স) করেননি তা আমি কি করে করতে পারি? অতঃপর উমর আল্লাহর শপথ করে বললেন যে, অবশ্য কাজটি অত্যন্ত উত্তম ও প্রয়োজনীয়।’ উমরের (রাঃ) এই সব তর্কাতর্কী ও বাদানুবাদের মাধ্যমে আমার অন্তরেও আল্লাহ উক্ত কাজের গুরুত্বের অনুভূতি দান করলেন। আমিও উমরের সাথে একমত হয়েছি।”

 

বর্ণনাকারী হযরত জায়েদ ইবনে সাবিত আরও বলেন যে, অতঃপর হযরত আবু বককর (রা) আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

 

“তুমি যুবক ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কারো কোনরূপ অভিযোগও নেই। উপরন্তু রসূলের সময় তুমি ওয়াহী লিপিবদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত ছিলে। সুতরাং তুমিই পূর্ণাঙ্গ কোরআনকে একখানা গ্রন্থাকারে সাজিয়ে লিপিবদ্ধ কর।” (বোখারী ফাজায়েলুল কোরআন)

 

অতঃপর হযরত জায়েদ (রা) সাহাবায়ে কিরামের কাছে হতে এবং হুজুরের নিজের ঘরে রক্ষিত লিখিত অংশগুলিকে সংগ্রহ করে পরস্পর সাজিয়ে হাফেজ সাহাবাদের তেলাওয়াতের সাথে মিলিয়ে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে ফেললেন।

 

হারেস মোহাসেবী স্বীয় গ্রন্থ “ফাহমুস সনানে” বর্ণনা করেছেন,

 

“কোরআন লিপিবদ্ধ করা কোন অভিনব কাজ ছিল না। স্বয়ং নবী করীমই (স) কোরআন লিপিবদ্ধ করতেন। তবে উহা বিভিন্ন খন্ডাকারে ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক উহার সবগুলোকে একত্র করে গ্রন্তাকারে লিপিবদ্ধ করা হুকুম দিয়েছিলেন। এ কাজটি ছিল এ ধরনের যেমন কোরআন লিপিবদ্ধকারে কতগুলি বিক্ষিপ্ত পৃষ্ঠায় রসূলের (স) ঘরে মওজুদ ছিল। অতঃপর কোন একজন সংগ্রহকারী উহাকে সাজিয়ে সুতা দিয়ে বেঁধে ‍দিলেন যাতে কোন অংশ হারিয়ে যেতে না পারে।”

 

আচ্ছাকাফাতুল ইসলামীয়া। (আল্লামা রাগেব তাব্বাখ)।

 

হযরত জায়েদের সংগ্রহীত ও লিখিত মাছহাফখানা প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের জীবদ্দশায় আমানত হিসেবে তাঁর কাছেই রক্ষিত ছিল এবং প্রয়োজনানুসারে অন্যান্যরা সেটা হতেই কপি করে উমরের নিকট তা সমর্পন করা হয়। হযরত উমরের শাহাদাতের পরে উক্ত মাছহাফ উম্মুল মুমেনীন হযরত হাফসার হেফাযতে দেয়া হয়।

\r\n\r\n

কোরআনের পঠন পদ্ধতির সংস্কার

 

একই ভাষা-ভাষীদের সমগ্র এলাকার ভাষা এক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বোল-চাল ও উচ্চারণ ইত্যাদিতে কিছু ব্যবধান ও ব্যতিক্রম অবশ্যই হয়ে থাকে। যেমন নদীয়া ও কুমিল্লার ভাষায় বেশ পার্থক্য দেখা যায়। যেমন দেখা যায়- খুলনা ও চিটাগাংয়ের ভাষায়। অথচ উভয় জেলার ভাষায় বাংলা।

 

অনুরূপভাবে গোটা আরব দেশের ভাষা আরবী হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন এলাকা ও গোত্রের ভাষা, উহার উচ্চারণ, বাচন-ভঙ্গী ও প্রয়োগে বেশ তারতম্য পরিলক্ষিত হত। হুজুর কোরয়শী বিধায় কোরআন শরীফ ‍যদিও কোরায়শী আরবীতে অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু অন্যান্য এলাকার আরবদেরকেও তাদের আঞ্চলিক আরবীতে উহা পাঠ করার ও লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কেননা ইহাতে কোরআনের মূল অর্থ কিংবা ভাবে কোন পরিবর্তন দেখা দিত না। কিন্তু ইসলাম যখন আরবের সীমানা অতিক্রম করে আযমেও প্রসার লাভ করল, তখন পঠন পদ্ধতি ও উচ্চারণের এ ব্যবধান অনারবদের ভিতরে বিশেষ জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। বিষয়টির দিকে তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমানের (রা) দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ইহার গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুধাবন করলেন। অতঃপর তিনি নিম্নে বর্ণিত উপায়ে উদ্ভুত সমস্যার সমাধান করে ফেললেন।

 

প্রথমত: তিনি কোরায়েশদের ভাষায় লিখিত ও রক্ষিত হযরত হাফসার মাছহাফখানা আনিয়ে উহার অনেকগুলো কপি তৈরী করালেন। অতঃপর উহার এক এক খন্ড মুসলিম সাম্রাজ্যের এক এক এলাকায় প্রেরণ করে উহা হতে সকলকে কপি করতে আদেশ দিলেন। আর অ-কোরায়েশদের ভাষায় লিখিত মাছহাবগুলিকে একেবারে নষ্ট করে দিলেন। ফলে বাচন-ভঙ্গি ও উচ্চারণের ব্যবধানটুকুও আর অবশিষ্ট থাকল না।

 

এ সম্পর্কে ইমাম বুখারী, বুখারী শরীফের ‘ফাজায়েলুল কোরআন’ অংশে হযরত আনাসের মাধ্যমে নিম্নলিখিত মর্মে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, “একদা হযরত হোযায়ফা-বিন আর ইয়ামান হযরত ওসমানের (রা) খেদমতে উপস্থিত হলেন। ইতিপূর্বে তিনি কেবল আরমিনিয়া বিজয়ে সামী মোজাহিদের সঙ্গে এবং আজারবাইজানের যুদ্ধে ইরাকী মোজাহিদদের সাথে অংশগ্রহণ করে এসেছিলেন, সেখানে তিনি সীমা ও ইরাকী মুসলমানদের কোরআন পাঠ পদ্ধতির বিরোধ দেখে সংকিত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি যখন তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের খেদমতে হাজির হলেন, তখন তিনি খলিফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমিরুল মোমেনীন, ইহুদী নাছারাদের ন্যায় আল্লাহর কিতাবে বিরোধ করারা পূর্বে আপনি এ উম্মতের কল্যাণের জন্য একটা কিছু করুন।’ এ কথা শুনে হযরত উসমান (রা) উম্মুল মুমেনীন হাফসাকে অনুরোধ করে পাঠালেন যে, হযরত আবু বকরের (রা) সংগ্রহীত গ্রন্থখানা যেন তাকে পাঠান হয়। তিনি উহা নকল করিয়ে আসল কপি আবার তাকে ফেরত দিবেন। অতঃপর হাফসা (রা) হযরত উসমানকে (রা) উক্ত পবিত্র গ্রন্থখানা দিলেন এবং উসমান (রা), হযরত জায়েদ বিন সাবেত, আব্দুল্লাহ বিন জোবায়ের, সাইয়েদ বিন আছ ও আব্দুর রহমান বিন হারিসকে (রা) তা হতে নকল করার কাজ শুরু করালেন। হযরত উসমান (রা) (হযরত জায়েদ বিন সাবেত ব্যতীত) তিনজন কোরায়শী সাহাবীদের বললেন, যদি তোমাদের সাথে জায়েদ বিন সাবেতের কোন অংশ পঠন পদ্ধতির ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে উহা কোরায়েশদের ভাষায় লিখবে। কেননা কোরআন কোরায়েশদের ভাষায়ই নাযিল হয়েছে।”

 

উল্লেখিত সাহাবাগণ হযরত উসমানের আদেশ মোতাবেক যখন পূর্ণ গ্রন্থখানার কপি তৈরী করে ফেললেন, তখন হযরত উসমান (রা) মূল কিতাবখানা হযরত হাফসার (রা) কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং নকলকৃত মাছহাফের এক একখানা সাম্রাজ্যের এক এক এলাকায় পাঠিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলেন যে, তাঁর প্রেরিত মাছহাফ ব্যতীত অন্যান্য মাছহাফ যেখানে আছে উহা যেন নষ্ট করে ফেলা হয়। (বুখারী-ফাজায়েলুল কোরআন)

 

“হযরত উসমানের নকলকৃত মূল কোরআন শরীফের কপি রুশ, মিসর, সিরিয়াসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আজও রক্ষিত আছে। আমাদের নিকটে বর্তমান যে কোরআন শরীফ মওজুদ রয়েছে উহাও সেই মূল সিদ্দীকী গ্রন্থের অনুরূপ যা হতে হযরত উসমান (রা) নকল করিয়ে সরকারী ব্যবস্থাপনায় রাজ্যের বিভিন্ন অংশে প্রেরণ করেছিলেন।”

 

গ্রন্থ সংগ্রহ ও সংরক্ষনের ব্যাপারে এর চেয়ে অধিক ত্রুটিমুক্ত, উন্নতর ও বিজ্ঞান সম্মত পন্থা আর কিছু কি হতে পারে?

 

কোরআনের যে বর্তমান শ্রেণীবিন্যাস ও তরতিবও কোন পরবর্তী মানুষের দেয়া নয়। বরং হযরত নবী (স) হযরত জিরাইলের (আ) নির্দেশে বর্তমান কোরআনকে সুবিন্যস্ত করেছিলেন। আর এই তরতিব অনুসারেই হুজুর (স) নিজে সাহাবায়ে কেরাম নামাযে উহা পাঠ করতেন। আর হাফেজ সাহাবাগণ অনুরূপ তরতিব মোতাবেকই কোরআন মুখস্থ করতেন।

\r\n\r\n

কোরআন অল্প অল্প করে নাযিল হওয়ার কারণ

 

সমস্ত কোরআন মাজীদখানা একসঙ্গে অবতীর্ণ না হয়ে কেন অল্প অল্প করে দীর্ঘ তেইশ বছরে কালব্যাপী অবতীর্ণ হল। কেন আল্লাহ তওরাত, জবুর,ইঞ্জিল প্রভৃতি আসমানী কিতাবের ন্যায় কোরআন মাজীদকেও এক সংগে অবতীর্ণ করলেন না, এটাও একটি অনুধাবনযোগ্য বিষয় বটে। পবিত্র কোরআনের ব্যাপারে কাফেরদের এও একটি অভিযোগ ছিল যে, কেন কোরআন মুহাম্মদের (স) উপরে একই সঙ্গে অবতীর্ণ হল না?”

 

কাফেরদের এ উক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,

 

﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْلَا نُزِّلَ عَلَيْهِ الْقُرْآنُ جُمْلَةً وَاحِدَةً ۚ كَذَٰلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِ فُؤَادَكَ ۖ وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلًا﴾

 

“আর কাফেরগণ বলে, কোরআন মুহম্মদের (স) উপরে একই সঙ্গে অবতীর্ন হল না কেন? এরূপ (বিরতি সহকারে) অবতীর্ণের মাধ্যমে আমি আপনার অন্তরকে শক্তিশালী করছি। আর আমি উহাকে বিরতি সহকারে অবতীর্ণ করেছি।” (সুরা আল-ফোরকান, আয়াত-৩২)

 

মানাহেহুল ইরফান ফি উলুমিল কোরআন এর লেখক আল্লামা আব্দুল আজিম স্বীয়-গ্রন্থে কোরআন অল্প অল্প করে নাযিল হওয়ার ভিতরে চারটি বিশেষ হিকমতের কথা উল্লেখ করেছেন।

\r\n\r\n

. রসূলের অন্তকে শক্তিশালী করা

 

অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হতে বার বার ওয়াহী বহনকারী সম্মানিত ফিরিশতা হযরত জিবরাইল আমিনের হুজুরের কাছে আগমনে তাঁর অন্তরাত্না আধ্যাত্নিক আনন্দে পরিপূর্ণ থাকত এবং মনের পবিত্র মনিকোঠায় নিয়তই এ ধারণা বদ্ধমুল থাকত যে তাঁর উপরে আসমান থেকে অবারিত ধারে আল্লাহর অনুগ্রহ ও নিয়ামত বর্ষিত হচ্ছে। ফলে হুজুরের অন্তর-আত্না ঈমানের অলৌকিক শক্তিতে ক্রমশই শক্তিশালী হতে থাকে।

 

কোরআন বিরতি সহকারে অল্প অল্প করে নাযিল হওয়ার ফলে হুজুর (স) তা সাথে সাথে মুখস্থ করে ফেলতেন এবং তার অন্তরনিহিত মর্ম উপলব্ধি করে তার হিকমত সম্পর্কে বিশেষভাবে ওয়াকিফহাল হতেন। ফলে হুজুরের পবিত্র অন্তকরণ কোরআনের অভিনব ও অলৌকিক শক্তিবলে নিয়তই শক্তিশালী হতে থাকত।

\r\n\r\n

. মুসলিম উম্মতের ধারাবাহিক তরবীয়ত

 

অর্থাৎ নবীর নেতৃত্বে যে নতুন একটি জাতির অভ্যুদয় ঘটেছিল সেই জাতিকে ধারাবাহিক শিক্ষা ও তরবীয়তের মাধ্যমে ধাপে ধাপে অগ্রসর করিয়ে পূর্ণতার প্রান্ত সীমায় নিয়ে যাওয়া। বিরতিসহ অল্প অল্প কোরআনের অংশ নাযিলের মাধ্যমে উক্ত উদ্দেশ্য বিশেষভাবে সাধিত হয়েছিল। কেননা শরীয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম যদি প্রথম ধাপেই একত্রে অবতীর্ণ হত, তাহলে হয়ত সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী নতুন লোকদের পক্ষে উহা পুরাপুরি মেনে চলার অধিকতর কষ্টসাধ্য হত। যেমন আল্লাহ বলেছেন,

 

﴿وَقُرْآنًا فَرَقْنَاهُ لِتَقْرَأَهُ عَلَى النَّاسِ عَلَىٰ مُكْثٍ وَنَزَّلْنَاهُ تَنزِيلًا﴾

 

“আর আমি কোরআনকে ভাগ ভাগ করে এই জন্য অবতীর্ণ করেছি যাতে করে আপনি ইহা লোকদেরকে বিরতি সহকারে পাঠ করে শুনাতে পারেন।” (সুরা ইসরা, আয়াত-১০৬)

\r\n\r\n

. নতুন নতুন সমস্যা সমূহের ব্যাপারে পথ প্রদর্শন

 

হুজুর (স) ও তাঁর আত্নোৎসর্গী সঙ্গীদের উপরে ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার যে গুরুদায়িত্ব আল্লাহ অর্পণ করেছিলেন, উহার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্নেরও সম্মুখীন হুজুরকে হতে হয়েছিল। উক্ত সমস্যা সমূহের সমাধান ও প্রশ্ন সমূহের জওয়াব দান প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় কোরআনের বিভিন্ন অংশ নাযিল হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।

 

যেমন একদা একজন মুসলিম মহিলা হযরত খাওলা বিনতে সায়ালাবা রসূলের দরবারে হাজির হয়ে তার স্বামী কর্তৃক তাকে জেহার করার ঘটনা বর্ণনা করে কান্নাকাটি ও হাহুতাশ করতে লাগলেন। কেননা তার কয়েকটি ছোট ছোট সন্তান সন্ততি ছিল। যদি এই সন্তানদেরকে তিনি তাঁর স্বামীর হাতে অর্পণ করেন তাহলে তাদের জীবনই বরবাদ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আবার যদি নিজের কাছে রেখে দেন, তাহলেও অন্নকষ্টে তাদের অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল। ফলে মহিলাটি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে হুজুরের সামনে কান্নাকাটি ও হাহুতাশ করতে লাগলেন।

 

ইসলাম পূর্বে জাহেলিয়াত যুগে জেহার দ্বারায় স্ত্রী তালাক হয়ে যেতো।

 

[জেহার বলা হয় আপন স্ত্রীকে মোহররামাত অর্থাৎ মা, কন্যা ইত্যাদিদের সাথে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার নিয়তে তুলনা করা। যেমন কেহ ‍যদি তার স্ত্রীকে একথা বলে তুমি আমার মায়ের ন্যায়, তাহলে উহা জেহার হবে। জাহেলিয়াত যুগে আরবরা যে স্ত্রীর সাথে জেহার করত তাকে তারা চিরদিনের তরে নিজের জন্য হারাম মনে করত। ইসলাম ইহাকে অনুমোদন দেয়নি। তবে এ ধরনের অশালীন ও অসংগত আচরণের জন্য জেহারকারীর উপর কিছু কাফফারা আরোপ হয়েছে।]

 

মুসলিম সমাজে জেহারের সমস্যা এই প্রথম বারই দেখা দিয়েছিল। হুজুর (স) কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ঠিক এই মুহুর্তে উহার সমাধানে নিম্নলিখিত আয়াত অবতীর্ণ হয়,

 

قَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّتِي تُجَادِلُكَ فِي زَوْجِهَا وَتَشْتَكِي إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ يَسْمَعُ تَحَاوُرَكُمَا ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ﴾

 

﴿الَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنكُم مِّن نِّسَائِهِم مَّا هُنَّ أُمَّهَاتِهِمْ ۖ إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلَّا اللَّائِي وَلَدْنَهُمْ ۚ وَإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ مُنكَرًا مِّنَ الْقَوْلِ وَزُورًا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَعَفُوٌّ غَفُو

 

“যে মহিলাটি তার স্বামীর ব্যাপারে তোমার সাথে ঝগড়াঝাটি করছিল এবং আল্লাহর কাছে অভিযোগ পেশ করছিল। আল্লাহ তোমাদের উভয়ের কথাবার্তাই শুনে নিয়েছিলেন। আর আল্লাহ সবকিছুই শুনেন ও দেখেন। তোমাদের মধ্য হতে যারা আপন স্ত্রীর সাথে জেহার করে তাদের সে জেহারকৃত স্ত্রীরা (প্রকৃতপক্ষে) তাদের মা হয়ে যায় না। তাদের মা তো তারাই যারা তাদেরকে প্রস্রব করেছে।” (সুরা মোজাদালা, আয়াত১-২)

 

একদা মক্কার মুশরিকরা ইহুদীদের প্ররোচনায় হুজুরকে অপ্রস্তুত করার মানসে জুলকারনাইন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল অথচ তখনও জুলকারনাইন সম্পর্কে হুজুরের কিছুই জানা ছিলনা। ফলে মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে জুলকারনাইনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ওয়াহীর মারফত অবগত করিয়ে দেন।

 

﴿وَيَسْأَلُونَكَ عَن ذِي الْقَرْنَيْنِ ۖ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُم مِّنْهُ ذِكْرًا﴾

 

“আর এরা আপনার নিকটে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। আপনি বলুন শীঘ্রই তোমাদেরকে তাঁর বর্ণনা পাঠ করে শুনাচ্ছি।” (সুরা কাহাফ, আয়াত-৮৩)

\r\n\r\n

পবিত্র কোরআনের পরে আর কোন আসমানী কিতাব নাযিল হচ্ছে না কেন?

 

মহানবীর আগমনের পূর্বে দুনিয়ায় যেমন অসংখ্য নবী রাসূল এসেছিলেন। তেমনি তাদের উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অসংখ্য কিতাব ও সহীফাও অবতীর্ণ করেছিলেন। কিন্তু মহানবীর তিরোধানের পরে নতুন করে আর কোন আসমানী কিতাব বা সহীফাও অবতীর্ণ হবে না, আর এ অবস্থা কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।

 

প্রশ্ন হতে পারে, কোরআনের পরে কেন আর কোন আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হবে না? এর জওয়াব স্বরূপ একথা বলা চলে যে, মহান আল্লাহ কোরআন অবতীর্ণের মাধ্যমে তাঁর দ্বীনকে মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ কোরআনে উল্লেখ করেছেন,

 

 الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ

 

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামতকেও তোমাদের উপরে সম্পূর্ণ করে দিলাম, আর দ্বীন হিসেবে তোমাদের জন্য আমি ইসলামকেই মনোনীত করলাম।” (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩)

 

সুতরাং দ্বীনের পূর্ণতা প্রাপ্তির পরে নতুন করে আর কোন কিতাব নাযিল করার প্রয়োজন ছিল না।

 

দ্বিতীয়ত: আল্লাহর কিতাবের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, উহার আংশিক কিংবা পূর্ণাঙ্গ বিলুপ্তির কারণেই অতীতে নতুন করে কিতাব নাযিলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর অলৌকিক অনুগ্রহ কোরআন এসব বিপর্যয় হতে একেবারেই নিরাপদ। কোরআনের যেমন কোনরূপ পরিবর্তন, পরিবর্ধন সম্ভব নয়, তেমনি উহার কোন অংশের বিলুপ্তিরও আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই। সুতরাং এমতাবস্থায় আর কোন আসমানী কিতাবের প্রয়োজনীয়তাই নেই।

 

অধুনা যোগাযোগ ব্যবস্থার অস্বাভাবিক উন্নতি, মুদ্রণ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ও সভ্যতার আদান-প্রদানের প্রচুর সুযোগ কোরআন ও কোরআনের বাণীকে দুনিয়ার প্রায় সর্বত্রই পৌঁছিয়ে দিয়েছে। কাজেই দুনিয়ার কোন প্রান্তেই এখন আর কোন আসমানী কিতাব নাযিল করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। সুতরাং হযরত মুহাম্মদের (স) আবির্ভাবের পরে তিনি যেমন সারা বিশ্বের সমগ্র মানব জাতির জন্য কিয়ামত পর্যন্ত একমাত্র নবী, তেমনি কোরআন অবতীর্ণের পরে সমগ্র মানব জাতির জন্য কিয়ামত পর্যন্ত কোরআনই একমাত্র অনুসরণযোগ্য আসমানী কিতাব। অতঃপর আর যেমন কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবেনা, তেমনি আর কোন আসমানী কিতাবও অবতীর্ণ হবে না।

 

 

\r\n\r\n

দুনিয়ার বিভিন্ন খেলাফত যুগের কোরআনের কয়েকখানা পান্ডুলিপি

 

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (স) সময়ই নিয়মিতভাবে কোরআন শরীফ লেখার কাজ শুরু হয় এবং হুজুরের জীবদ্দশায়ই বেশ কয়েকজন সাহাবীর কাছে খন্ডাকারে কোরআন লিখিতভাবে মওজুদ ছিল। হযরত আব বকরের (রা) সময় এই লিখিত বিচ্ছিন্ন টুকরাগুলিকে সাজিয়ে একখানা সুসজ্জিত পূর্ণাঙ্গ কিতাবের রূপ দেয়া হয়। অতঃপর হযরত উসমান (রা) হিজরী ২৫ সনে প্রথম হযরত আবু বকরের (রা) ব্যবস্থাপনায় লিখিত অত্র গ্রন্থখানার বেশ কয়েকখানা কপি তৈরী করিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেন।

 

হযরত উসামান (রা) স্বহস্ত লিখিত একখানা মাছহাব তার নিজের কাছেই ছিল। এ মাসহাব খানিকে “মাসহাফুল ইমাম” বলা হতো। আজীবন উহা হযরত উসমানের কাছে ছিল, অতঃপর হযরত আলী (রা) ও হযরত ইমাম হোসেনের হাতে আসে। পরবর্তী পর্যায়ে ইহা স্পেনে এবং তারও পরে উহা মরক্কোর রাজধানী ফাশ-এ গিয়ে পৌঁছে। এরপরে উহা আবার মদীনায় ফিরিয়ে আনা হয়। অতঃপর প্রথম মহাযুদ্ধকালে মদীনা হতে মাসহাফখানা তুরস্কের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে নীত হয় এবং অদ্যাবধি সেখানেই আছে।

 

হযরত উসমানের (রা) স্বহস্ত লিখিত একখানা পান্ডুলিপি যার শেষে এ কথা লিখা আছে যে, এ খানা লিখেছেন হযরত উসমান বিন আফফান।

 

বর্তমানে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে আছে এই মাসহাফখানা তেলাওয়াত করা অবস্থায়ই বিদ্রোহীরা হযরত উসমানকে (রা) শহীদ করে। পরে এখানা দামেস্কে নীত হয় এবং বনু উমাইয়া রাজন্য বর্গের হাতেই তাদের খেলাফতের শেষ পর্যন্ত থাকে। অতঃপর উহা বসরায় নীত হয়। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানা বসরায় দেখতে পান। ১৯৪১ সনে এখানা রাশিয়ার বলসেভিকদের হস্তগত হয় এবং সে হতে এখানা মস্কোতে আছে।

 

হযরত উসমানের (রা) তৈরী আর একখানা পান্ডুলিপি বর্তমানে ফ্রান্সে, একখানা মিসরের খাদুর্বিয়া কতুবখানা, একখানা আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে এবং অন্য একখানা ফ্রান্সের গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে।

 

হযরত আলীর (রা) তৈরী পাঁচখানা পান্ডুলিপির মধ্যে একখারা মাশহাদে, দুখানা কনষ্টান্টিনোপলে ও একখানা বর্তমানে কায়রোর জামে হোসাইনে রক্ষিত আছে। হযরত আলীর (রা) তৈরী আর একখানা পান্ডুলিপি বর্তমানে দিল্লীর জামেয়া মিল্লাতে রয়েছে।

 

হযরত ইমাম হোসেন সঙ্কলিত একখানা পান্ডুলিপিও বর্তমানে দিল্লীর জামেয়া মিল্লিয়ায় রক্ষিত আছে। হযরত ইমাম জয়নাল আবেদিন কৃত একখানা মাসহাফ জামেয়া মিল্লিয়ায় এবং একখানা দেওবন্দের কুতুবখানায় মওজুদ আছে।

\r\n\r\n

কোরআনে কখন জের, জবর, পেশ সংযুক্ত করা হয়

 

যাদের মাতৃভাষা আরবী তারা কোনরূপ হরকত ছাড়াই আরবী ভাষায় যে কোন বই-কিতাব পড়তে পারে। কাজেই যে পর্যন্ত ইসলাম আরবের বাইরে সম্প্রসারিত হয়নি ততদিন কোরআন হরকত ছাড়াই লেখা হত। কেননা আরবদের জন্য জের, জবর, ও পেশের সাহায্য ব্যতীরেকেই কোরআন পাঠ সম্ভব ছিল। কিন্তু ইসলাম যখন আরবের সীমানা অতিক্রম করে আযমেও সম্প্রসারিত হল, তখন অনারব মুসলিমদের পক্ষে হরকত বিহীন কোরআন পাঠ মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। ফলে উপরোক্ত সমস্যার সমাধানকল্পে ৮৬ হিজরীতে (৭০৫ খৃস্টাব্দে) বনু উমাইয়া যুগে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কোরআনের হরকত অর্থাৎ জের জবর, পেশ সংযুক্ত করার নির্দেশ দেন।

\r\n\r\n

পবিত্র কোরআন সম্পর্কে কতিপয় স্মরণীয় দিন তারিখ

 

১। হিজরী পূর্ব ১৩ সন ১৭ই রমাজান সোমবার হেরা গুহায় সর্বপ্রথম ওয়াহী অবতীর্ণ হওয়া শুরু হয়। (মোতাবেক ৬ই আগস্ট ৬১০ খৃস্টাব্দ)।

 

২। হিজরী ১১ সনের সফর মাসে কোরআন অবতীর্ণ সমাপ্ত হয়।

 

৩। সর্বপ্রথম যে পাঁচটি আয়াত হুজুরের প্রতি অবতীর্ণ হয় উহা ছিল সুরায়ে আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত। যথা-

 

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ﴾

 

﴿خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ﴾

 

﴿اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ﴾

 

﴿الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ﴾

 

﴿عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ﴾

 

৪। সর্বশেষ অবতীর্ণ আয়াত সুরায়ে বাকারার ৩৭ রুকুর শেষ আয়াত।

 

ﻭَﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﻳَﻮْﻣًﺎ ﺗُﺮْﺟَﻌُﻮﻥَ ﻓِﻴﻪِ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺛُﻢَّ

 

ﺗُﻮَﻓَّﻰ ﻛُﻞُّ ﻧَﻔْﺲٍ ﻣَﺎ ﻛَﺴَﺒَﺖْ ﻭَﻫُﻢْ ﻟَﺎ ﻳُﻈْﻠَﻤُﻮﻥَ

 

৫। তেলাওয়াতের সুবিধার জন্য ৮৬ হিজরীতে কোরআনকে পারা ও রুকুতে বিভক্ত করা হয়।

 

৬। হিজরী ৩০ সনে হযরত উসমানের (রা) আদেশে শুধু কোরায়েশী আরবী ব্যতীত অন্যান্য আরবী মাসহাফগুলিকে নষ্ট করে দেয়া হয়।

 

৭। কোরআন পাকের সর্বপ্রথম অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ সুরা সুরায়ে মুদাসসির এবং সর্বশেষ অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ সুরা সুরায়ে নছর। কারও কারও মতে সর্বপ্রথম অবতীর্ণ সুরা-সুরায়ে ফাতেহা।

\r\n\r\n

পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন বিষয়ের কয়েকটি পরিসংখ্যান

 

মোট সুরা - ১১৪

 

মক্কী সুরা - ৯৩

 

মাদানী সুরা – ২১

 

রুকু - ৫৫৪

 

আয়াত সংখ্যা - ৬২৩৬

\r\n\r\n

কোরআন সম্পর্কে কয়েকজন খ্যাতনামা অমুসলিম পণ্ডিতদের উক্তি

 

১। “ কোরআনের সংগ্রহকারীরা কোরআনের কোন অংশ, বাক্য কিংবা শব্দ বাদ দিয়েছে এমন কখনো শোনা যায়নি। আবার কোরআনের এমন কোন বাক্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি যা বাহির হতে কোরআনে প্রবেশ করেছে। যদি এমন হত, তাহলে অবশ্যই হাদীসের কিতাবে উহার উল্লেখ থাকত, যা থেকে সামান্য বিষয়ও বাদ পড়েনি।” (উইলিয়াম ময়িউর)

 

২। নিঃসন্দেহে কোরআন আরবী ভাষার সর্বোত্তম এবং দুনিয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। কোন মানুষের পক্ষেই এ ধরনের একখানা অলৌকিক গ্রন্থ রচনা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। কোরআন মৃতকে জীবিত করার চেয়েও শ্রেষ্ঠ মোজেযা। একজন অশিক্ষিত লোক কি করে এ ধরণের ত্রুটিমুক্ত ও নজিরবিহীন বাক্যাবলীর রচনা করতে পারে তা ভাবতেও আশ্চর্য লাগে।” (জর্জ সেল)

 

৩। “কেবল মাত্র কোরআনই এমন একখানা গ্রন্থ যাতে তেরশত বছরের ব্যবধানেও কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের এমন কোন নির্ভরযোগ্য ধর্মগ্রন্থ নেই যা আদৌ কোন দিক থেকে কোরআনের সমকক্ষ হতে পারে।” (প্রসিদ্ধ খৃস্টান ঐতিহাসিক মি: বাডলে)

 

৪। “প্রাচীন আরবীতে অবতীর্ণ কোরআন শরীফ অত্যন্ত মনোরম ও আকর্ষণীয়। ইহার বাক্য বিন্যাস পদ্ধতি ও প্রকাশভঙ্গী খুবই মনোমুগ্ধকর। কোরআনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্যগুলিতে যে বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী যু্ক্তির অবতারণা করা হয়েছে তা খুবই চমৎকার। কোরআনের ভাবধারা অন্য ভাষায় যথাযথ প্রকাশ করা খুবই মুসকিল।” (দি উইসডম অফ দি কোরআন- জন ফাস)

 

৫। “ কোরআনের বিধানবলী স্বয়ং সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ।” (প্রিচিং অফ ইসলাম- আর্নল্ড টয়েনবি)

 

৬।“দুনিয়ার কোন গ্রন্থই কোরআনের ন্যায় বেশি পাঠ করা হয় না। বিক্রির দিক দিয়ে হয়ত বাইবেল সংখ্যায় বেশী হবে। কিন্তু মুহম্মদের কোটি কোটি অনুসারীরা যেদিন থেকে কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করে সেদিন থেকে দৈনিক পাঁচবার কোরআনের দীর্ঘ দীর্ঘ আয়াতসমূহ পাঠ করা শুরু করে।” (চার্লস ফ্রান্স পুটার)

 

৭। “ সমস্ত আসমানী গ্রন্থসমূহের মধ্যে কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ। মহান আল্লাহ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে মানব জাতির উদ্দেশ্যে এই সর্বোৎকৃষ্ট কিতাবখানান নাযিল করেছেন। মানুষের কল্যাণ সাধনে ইহা প্রাচীন গ্রীক দর্শনের চেয়েও অধিকতর ফলপ্রসূ। কোরআনের প্রতিটি শব্দ হতেই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের ঝংকার ধ্বনিত হয়।” (ড: মোরসেন ফ্রান্স)

 

৮। “পবিত্র কোরআন শুধুমাত্র কতগুলি ধর্মীয় বিধানবলী সমষ্টিই নয়, বরং উহাতে এমন এমন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধানবলীও রয়েছে যা গোটা মানব জাতির জন্য সমান কল্যালকর।” (ড: মসিজিউন)

 

৯। “ আমি কোরআনের শিক্ষাসমূহ উপরে গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে পোঁছেছি যে, কোরআন নাযিলকৃত আসমানী কিতাব এবং উহার শিক্ষাসমূহ মানব স্বভাবের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল।” (মিস্টার গান্ধী- ভারত)

 

১০। “আমি ইসলামকে পছন্দ করি এবং ইসলামের গয়গম্বরকে দুনিয়ার একজন শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বলে স্বীকার করি। আমি কোরআনের সামাজিক, রাজনৈতিক, আত্নিক ও নৈতিক বিধানবলীকে অন্তরের সহিত পছন্দ করি। হযরত উমরের খেলাফতকালে ইসলামের যে রূপ ছিল উহাকেই আমি ইসলামের বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ রূপ বলে মনে করি।” (লালা লাজ পাত রায়, ভারত)

 

১১। “কোরআনের অধ্যয়নে বিবেক হয়রান হয়ে যায় যে, একজন অশিক্ষিত লোকের মুখ হতে এ ধরনের কালাম (ভাষ্য) কি করে বের হল।” (কোন্ট হেনরী)

 

১২। “মুহম্মদের এ দাবী আমি সর্বান্তকরণে স্বীকার করি যে কোরআন মুহাম্মদের (স) একটি সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ মোজেযা।” (মি: বোরথ সমুখ)

 

১৩।“ কোরআন গরীবের বন্ধু ও কল্যাণকামী। ধনীদের বাড়াবাড়িকে কোরআন সর্বক্ষেত্রেই নিন্দা করেছে।” (গর্ড ফ্রে হগনস)

 

১৪।“ তেরশত বছর পরেও কোরআনের শিক্ষাসমূহ এতই জীবন্ত যে আজও একজন ঝাড়ুদার মুসলমান হয়ে ( কোরআনের প্রতি ঈমান এনে) যে কোন খান্দানী মুসলিমদের সাথে সমতার দাবী করতে পারে।” (মি: ভুপেনন্দ্রেনাথ বোস)

 

১৫।“ইসলামকে যারা প্রতিক্রিয়াশীল ধর্ম বলে নিন্দা করে, তারা কোরআনের শিক্ষাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। এই কোরআনের বদৌলতেই আরবদের কায়া সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিল।” (মোসেউর্মিওব ফ্রান্স)

\r\n\r\n

কোরআনের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে মহানবীর (সা) কতিপয় হাদীস

 

تركت فيكم أمرين لن تضلوا ما تمستمسكتُم بهما كتاب الله وسنّة رسوله. (مشكوة - موطا

 

“রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি।এ দুটিকে যে পর্যন্ত তোমরা আকড়ে থাকবে, পথভ্রষ্ট হবে না। উহা হল আল্লাহর কিতাব ও রসুলের সুন্নত।” (মেশকাত-মোয়াত্তা)

 

من قراً القرآن فاستظهرهٔ - فاًحل

 

خلالهٔ و حرم حرامهٔ آذخلهٔ الله به الجنة و شافعهٔ فی عشر من أهل بيته كلهم قد وجبت لة التار. ة

 

“হযরত আলী (রা) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি উত্তমরূপে কোরআন পাঠ করত: উহার হালাল হারাম মেনে চলবে, আল্লাহ তাঁকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। আর তার বংশ হতে তাকে এমন দশজন লোকের সুপারিশ করার অধিকার দিবেন যাদের প্রতি জাহান্নাম ছিল ওয়াজিব।” (আহমদ, তিরমিজি, ইবনে মাযা, দারেমী)

 

و عن ابی سعی در رضایی انتهٔ عنهٔ قال قال رسول الله صلی اللههٔ عليه وسلم يقول الرب تبارك وتعالى. من شغلة القرآن عن ذكرى ومسألتي اعطيتة أفضل ما اعطي السائلين – فضل

 

كلام اللّه على سائر الكلام كفضل الله على خلقه.

 

হযরত আবু সাইয়িদ (রা) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,‘ যে ব্যক্তি কোরআন অধ্যয়নে মগ্ন থাকায় (অতিরিক্ত) জিকর ও দোয়ার সময় পায় না। আমি তাকে দোয়া প্রার্থীদের চেয়েও অধিক দিয়ে থাকি।’ আর যাবতীয় সৃষ্টির উপরে আল্লাহর মর্যাদা যেরূপ, যাবতীয় কালামের উপরে আল্লাহর কালামের মর্যাদা সেরূপ।” (তিরমিজি)

 

 وعن عائشة رضيى الله عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الذي يقراً القرآن وهو ماهير به مع السفرة الكرام البررة والذي يقرأه وهو عليه شاقلة أجران. (بخاري - مسلم

 

“হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। রসূলে করীম (সা) বলেছেন, কোরআনে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি যিনি নিয়মিত কোরআন পাঠ করে থাকেন, তিনি ( কিয়ামতের) নবীদের সঙ্গী হবেন। আর যিনি কষ্ট করে কোরআন পাঠ করেন তিনি দ্বিগুণ প্রতিদান পাবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)

 

 وعن أبى هريرة قال قال رسول الله صلى الة علية وسلم وما اجتمع قوم فى بيتر من بيوتر الله يتلون كتاب الله ويتدارسونة بينهم الأنزلت عليهم السكينة وغشيتهم الرخمة وحفنهم الملائكة وذكرهم فيمن عندهٔ

 

“হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, “নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, যখন কিছু লোক কোন একটি ঘরে আল্লাহর কিতাবের আলোচনার পর্যালোচনায় মগ্ন থাকে, তখন তাদের পরে মহাপ্রশান্তি অবতীর্ণ হতে থাকে এবং আল্লাহর রহমত ও করুণা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আর ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ্‌ স্বয়ং নিকটস্থ ফিরিশতাগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির আমল তাকে পিছন ঠেলবে বংশ মর্যাদা তাকে আগে বাড়াতে পারবে না।” (মুসলিম)

 

“হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, রসূল (স) বলেছেন, যার সিনায় কোরআনের কোন অংশ নাই তার তুলনা হয় বিরান ঘরের সাথে।” (তিরমিযি)

 

“হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা) বলেন, রসূল (স) বলেছেন, অবশ্য অবশ্য আল্লাহ এই কোরআনের সাহায্যে বহ জাতিকে শীর্ষে উঠাবেন, আবার এই কোরআনই (অর্থাৎ কোরআনকে ছেড়ে দেয়ার কারণে) কোন কোন জাতিকে অবনতির নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছবেন।” (মুসলিম)

 

--- সমাপ্ত ---

মহাগ্রন্থ আল – কোরআন কি ও কেন

আবুল কালাম মুহাম্মাদ ইউসুফ

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড